2 of 3

০৫৬. ইসরা বা রাত্রীকালীন সফর

একদিন রাত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসায় অর্থাৎ বাইতুল মাকদিসে নিয়ে যাওয়া হয়। [৩৩.সুহাইলী বলেন : ঘটনাটা মদীনায় হিজরাতের এক বছর পূর্বে সংঘটিত হয়েছিল বলে কেউ কেউ উল্লেক করেছেন।] এই সময় কুরাইশ গোত্রের মধ্যে এবং অন্যান্য গোত্রের লোকজনের মধ্যে ইসলাম বেশ প্রসার লাভ করেছে। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ বলতেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট বোরাক আনা হয়। এটি একটি চতুষ্পদ জন্তু। পুর্বতন নবীদেরকেও এই জন্তুর পিঠে সওয়ার করানো হতো। এটি এত দ্রুতগামী যে, সে দৃষ্টির শেষ সীমায় পা ফেলতো। তিনি সেই জানোয়ারে সওয়ার হলেন। তাঁর সঙ্গী (জিবরীল) তাঁকে সাথে নিয়ে রওনা হলেন। আকাশ ও পৃথিবীর অসংখ্য নিদর্শন দেখতে দেখতে তিনি এগিয়ে যেতে লাগলেন। এভাবে চলতে চলতে বাইতুল মাকদিস গিয়ে থামলেন। সেখানে নবীদের এক বিরাট সমাবেশ দেখতে পেলেন। তার মধ্যে ইবরাহীম (আ). মূসা (আ) ও ঈসাকেও (আ) দেখলেন। তাঁদের সবাইকে নিয়ে এক জামায়াতে নামায পড়লেন। তারপর তাঁর কাছে তিনটা পাত্র আনা হলো। একটিতে পানি, একটিতে মদ এবং একটিতে দুধ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “ঐ তিনটি পাত্র আমার সামনে রাখার পর শুনতে পেলাম কে যেন বলছেঃ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি পানি ভরা পাত্র গ্রহণ করেন তা হলে তিনি বিপথগামমী হবেন এবং তাঁর উম্মতও ডুববে। আর যদি মদের পাত্র গ্রহণ করেন তা হলে তিনি বিপথগামী হবেন এবং তাঁর উম্মতও বিপথগামী হবে। আর যদি তিনি দুধের পাত্র গ্রহণ করেন তা হলে তিনিও হিদায়াত লাভ করবেন এবং তাঁর উম্মাতও হিদায়ত লাভ করবে।” এ কথা শুনে আমি দুধের পাত্রটা নিলাম এবং তা থেকে দুধ পান করলাম। তখন জিবরীল (আ) আমাকে বললেন : “হে মুহাম্মাদ! আপনিও সুপথগামী হয়েছেন আর আপনার উম্মাতও।”

হাসান (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “আমি হাজরে আসওয়াদের কাছে ঘুমিয়ে ছিলাম। সহসা জিবরীল এলেন। তিনি আমাকে চিমটি কাটলেন। আমি উঠে বসলাম কিন্তু কোন কিছু না দেখে আবার শুয়ে পড়লাম। তিনি আবার এসে আমাকে চিমটি কাটলেন। আমি আবার উঠে বসলাম এবং কিছু না দেখে আবার শুয়ে পড়লাম। তিনি তৃতীয়বার এলেন এবং পুনরায় চিমটি কাটলেন। এবারে আমি উঠে বসতেই তিনি আমার বাহু ধরে টান দিলেন। সেখানে আমি একটা সাদা বর্ণের জন্তু দেখতে পেলাম। তা ছিল খচ্চর ও গাধার মাঝামাঝি আকৃতির। তার দুই উরুতে দুটি পাখা। পাখার সাহায্যে সে পা সঞ্চালন করে। আর হাত দুটিকে সে দৃষ্টির শেষ সীমায় দিয়ে রাখে। তিনি আমাকে ঐ জন্তুটির ওপর সওয়ার করালেন। অতঃপর আমাকে নিয়ে রওনা দিলেন। দুজনের কেউ কাউকে হারিয়ে না ফেলি, এতটা পাশাপাশি আমরা চলতে লাগলাম।” হাসান (রা) তার বর্ণনায় বলেন, অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চলতে লাগলেন।আর তাঁর সাথে জিবরীলও চলতে লাগলেন। বাইতুল মাকদিস গিয়ে তাঁরা যাত্রাবিরতি করলেন। সেখানে দেখলেন নবীদের একটি দল সমবেত হয়েছেন এবং তাঁদের মধ্যে ইবরাহীম, মূসা ও ঈসা আলাইহিমুস্ সালামও উপস্থিত আছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইমাম হয়ে তাঁদের নিয়ে নমায পড়লেন। অতঃপর তাঁর কাছে দুটো পাত্র হাজির করা হলো। একটাতে মদ, অপরটায় দুধ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুধ ভর্তি পাত্রচা নিলেন, তা থেকে কিছুটা দুধ পান করলেন এবং মদভর্তি পাত্রটা বর্জন করলেন। তা দেখে জিবরীল বরলেন, “হে মুহাম্মাদ! আপনি নিজেও ইসলামের পথে চালিত হয়েছেন আর আপনার উম্মাতও ইসলামের পথে চালিত হয়েছে। মদ আপনাদের ওপর হারাম হয়েছে।” এরপর তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে মক্কায় ফিরে গেলেন। পরদিন সকালে তিনি কুরাইশদের কাছে গেলেন এবং রাত্রের ঘটনা ব্যক্ত করলেন। অধিকাংশ লোক তা শুনে বললো, “আল্লাহর শপথ, এ এক আজব ও অবিশ্বাস্য ব্যাপার। মক্কা থেকে সিরিয়া কত কাফিলা যায়। তাদের যেতে একমাস এবং আসতে এক মাস সময় লাগে। আর এত লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে মুহাম্মাদ কিনা একরাতেই সেখানে গেল আবার মক্কায় ফিরেও এলো!”

হাসান (রা) বলেন, “এই ঘটনা শুনে বহু সংখ্যক মুসলমান ইসলাম ত্যাগ করলো। লোকেরা আবু বাক্রের (রা) কাছে গিয়ে তাঁকে বললো, “হে আবু বাক্র, তোমার বন্ধুকে কি তুমি বিশ্বাস কর? সে বলছে, সে নাকি গতরাতে বাইতুল মাকদাস গিয়েছিলো, সেখানে সে নামায পড়েছে, অতঃপর মক্কায় ফিরে এসেছে!”

আবু বাকর বললেন, “তোমরা কি তাকে অবিশ্বাস কর?” সবাই বললো, “হ্যাঁ, ঐতো মসজিদে বসে লোকজন এই কথাই বলছে।” আবু বাক্র (রা) বললেন, “আল্লাহর শপথ, তিনি যদি একথা বলে থাকেন তা হলে সত্য কথাই বলেছেন। এতে তোমরা আশ্চর্য হওয়ার কি দেখলে? তিনি তো আমাকে বলে থাকেন যে, তাঁর কাছে আল্লাহর কাছ থেকে ওহী আসে। আকাশ থেকে পৃথিবী পর্যন্ত ওহী আসে মাত্র এক মুহূর্তের মধ্যে। তাঁর সে কথাও আমি বিশ্বাস করে থাকি। তোমরা যে ঘটনা নিয়ে চোখ কপালে তুলছো তার চেয়েও এটা বিস্ময়কর।” অতঃপর তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গিয়ে হাজির হলেন। তিনি তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, “হে আল্লাহর নবী, আপনি কি জনগণকে বলেছেন যে, আপনি গত রাতে বাইতুল মাকদাস ভ্রমণ করেছেন?” তিনি বললেন, “হ্যাঁ।” আবু বাকর (রা) বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, বাইতুল মাকদাসের আকৃতি কেমন আমাকে বলুন। কেননা বাইতুল মাকদাস আমি গিয়েছি।” রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, “এই সময় আমার সামনে বাইতুল মাকদাস তুলে ধরা হলো এবং আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।” তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু বাকরকে (রা) তার আকৃতির বর্ণনা দিতে লাগলেন। আর তা শুনে আবু বাক্র (রা) বলতে লাগলেন, “আপনি ঠিক বলেছেন। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনি নিঃসন্দেহে আল্লাহর রাসূল।” বর্ণনা দেয়া শেষ হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু ব্ক্রাকে বললেন, “হে আবু বাক্র, তুমি সিদ্দীক।” সেদিনই তিনি আবু বকরকে (রা) সিদ্দীক তথা ‘পরম সত্যনিষ্ঠ’ উপাধিতে ভূষিত করেন।

সাঈদ ইবনুল মুসাইয়াভ (রহ) বলেন, “ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীদের কাছে হযরত ইবরাহীম, মূসা ও ঈসা আলাইহিমুস সালামের দৈহিক গঠনের বর্ণনা দিয়েছিলেন। তিনি ঐ রাতে তাঁদেরকে দেখেছিলেন। তিনি বলেছেন, “দৈহিক গঠনের দিক দিয়ে হযরত ইবরাহীম (আ) তোমাদের সঙ্গীর (অর্থাৎ স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ) সাথেই সর্বাধিক সাদৃশপূর্ণ। আর মূসা আলাইহিস সালাম বাদামী রঙের দীর্ঘাকায় একহারা গড়নের ও উন্নত নাসা সুপুরুষ ছিলেন। মনে হয় যেন শানুয়া গোত্রের কোন লোক। ঈসা (আ) মাঝারী গড়নের, লাল বর্ণের, নরম ও সোজা চুল এবং মুখে বহুসংখ্যক তিলবিশিষ্ট। দেখে মনে হয়, তাঁর চুল থেকে পানির বিন্দু গড়িয়ে পড়ছে। সবে মাত্র হাম্মাম থেকে গোসল করে বের হয়েছেন। তোমাদের মধ্যে উরওয়াহ ইবনে মাসউদ সাকাফীর সাথে তাঁর দৈহিক সাদৃশ্য সর্বাধিক।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *