লক্ষ্মীবাজারের মানুষদের তখন বদু মওলানার ছোট ছেলের মৃত কুকুরের কথা মনে পড়ে। তারা মহল্লায় খাজা আহমেদ আলী আর খাজা শফিকের কবরের কাছে ছুটে যায়, অতি সন্তর্পণে কুকুরের প্রোথিত কঙ্কালের সঠিক স্থান নির্ধারণ করে এবং খুব আস্তে ও যত্নের সঙ্গে বদু মওলানার পরিবারের মৃত কুকুরের চাপা দেওয়া দেহাবশেষের ওপর থেকে মাটি সরায়। তারা কুকুরের হাড়গুলো এমনভাবে মাটি থেকে আলাদা করে, যেন মাটি এবং সেই মাটিতে শায়িত খাজা আহমেদ আলী এবং খাজা শফিক টের না পায়, তারা কি করে। কুকুরের হাড়গুলো লক্ষ্মীবাজারের মানুষ একটি চটের ব্যাগে পুরে ভিক্টোরিয়া পার্কে নিয়ে যায়। সেখানে তারা আবদুল গণির দ্বিখণ্ডিত দেহ এবং রক্ত মাখানো মাটি আর ভুলুর কঙ্কাল একত্রিত করে এবং বুড়িগঙ্গা নদীর মাঝখানে নিয়ে গিয়ে পানিতে ফেলে দেয়। তারপর তারা এ দুটো প্রাণীর কথা ভুলে যায়। এর নবছর পর বদু মওলানার মুখে আবদুল গণির কথা শুনে মানুষের চোখে পুনরায় সব ভেসে ওঠে, তারা ব্লিচিং পাউডারের গন্ধ পায়। তারা দেখে, পাঁচ ফুট এক ইঞ্চি লম্বা আর এক শ পাউন্ড ওজনের আবদুল গণি অন্য পাঁচ জন রাজাকারের সঙ্গে মহল্লার রাস্তায় কুচকাওয়াজ করে। মহল্লার লোকেরা, তাদের ভয় সত্ত্বেও, রাস্তায় এই ছয় কাকতাড়ুয়াকে লেটরাইট করতে দেখে যেন আমোদিত হয়েছিল। তাদের মনে হয়েছিল যে, তারা নির্ঘাত কোনো সার্কাস দেখছে; দড়ি দিয়ে বাঁধা প্যান্ট, ক্যানভাসের ঢিলে জুতো আর বেড়ানো ক্যাপ পরা যেন ছয় জন সঙু। তখন, মার্চের পঁচিশ তারিখের পর মহল্লায় যে নির্জনতা নেমেছিল তাতে চার জোড়া ঘুঘু এসে মহল্লায় বাসা বেঁধেছিল। দুপুরবেলা যখন লোকেরা ঘরের ভেতর লুকিয়ে থাকত তখন বাড়ির কার্নিশের ওপর বসে ঘুঘু ডাকত আর লোকেরা শুনতে পেত তাদের রাস্তা দিয়ে ‘লেপ্ট, লেপ্ট’ করতে করতে রাজাকারদের চলে যেতে। সেই সময়, প্রাণ যখন ম্রিয়মাণ ছিল ভয়ে, এদের দেখে মহল্লার নারীদের অর্বাচীনের মতো হসি পেয়েছিল। তাদের মনে হয়েছিল যেন এক সারি ডায়া হেঁটে যায়। কেমুন লাল পিঁপড়ার লাহান লাগে একেকটারে, তারা বলেছিল। মহল্লার লোকেরা বুঝতে পারে না রাজাকাররা তাদের রমণী এবং শিশুদের এই কৌতুকের কথা শুনেছিল কি না, তবে মনে হয় যেন রাজাকাররা মহল্লায় তাদের জীবন কৌতুক দিয়েই শুরু করে। মহল্লায় তাদের প্রথম দেখা যাওয়ার তিন দিন পর তারা প্যারেড করে ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং আব্বাস আলীর দরজায় এসে টোকা দেয় তেষ্টা নিবারণের জন্য, তারপর দরজা খুলতে দেরি হওয়ায় দরজায় লাথি মারে তিনবার। তখন দরজা খুলে ছ ফুট লম্বা আব্বাস আলী এগিয়ে এলে তারা তার নাম জিজ্ঞেস করে। মহল্লার লোকেরা পরে শোনে যে, আব্বাস আলী তার নাম বললে ছজন রাজাকার মুখ ভেঙিয়ে বলেছিল যে, তার নাম আব্বাস আলী নয়, গাবগাছ আলী : তারপর দরজা খোলার বিলম্বের কারণ জিজ্ঞেস করলে সে যখন ভোলায় তখন একজন রাজাকার লাঠি দিয়ে বিশালদেহী আব্বাসের পাঁজরে আঘাত করে এবং বলে, তুই ব্যাটা গাবগাছ আলী, তরে পিটায়া লাশ বানামু। তবে মহল্লার লোকেরা যখন আব্বাস আলীর পাজরে আঘাতের কালো হয়ে যাওয়া দাগ দেখে তারা বুঝতে পারে যে, এর ভেতর কোনো কৌতুক ছিল না। এরপর সঙের মতো দেখতে রাজাকারা প্রাইমারি স্কুলে কসাইখানা বসায় এবং এই কসাইখানার কর্মকাণ্ডের বিশদ হিসাব মহল্লার লোকেরা জানতে পারে ভিক্টোরিয়া পার্কে আবদুল গণির পাছার ভেতর বন্দুকের নল ঢুকিয়ে দেয়ার পর। এর নবছর পর বদু মওলানা তাদের বলে যে, আবদুল গণি কুকুরের মতো জনতার ক্রোধের কারণে নিহত হয়েছিল সে শহীদ হয়েছিল আসলে। মহল্লার লোকদের এ ব্যাপারে যদিও বিভ্রান্তি হয় না, তবু তারা অনুধাবন করতে পারে যে, সময়ের সঙ্গে সত্য বদলে যায়। মহল্লার লোকের মনে হয় যে, প্রকৃতি অথবা ভাগ্য বোধ হয় ছজন রাজাকারের ভেতর কোনো কারণে আবদুল গণিকে বাছাই করে নিয়েছিল। ছজনের ভেতর একমাত্র সে-ই ধরা পড়েছিল যুদ্ধের পর, তার কারণেই এক বর্ষার দিনে সব ভয়ের ভেতরও বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল মহল্লার লোক এবং তারপর মহল্লায় দ্বিতীয় দিনের মতো মিলিটারি এসেছিল। শ্রাবণের শেষ দিকে একদিন রাস্তায় হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলে আবদুল গণি দ্রুত মায়ারাণীদের পরিত্যক্ত বাড়ির ফটকের নিচে আশ্রয় নিয়েছিল। সে ভেবেছিল, বৃষ্টি শিগগিরই থেমে যাবে, কিন্তু অঝোর ধারায় বৃষ্টি দীর্ঘক্ষণ ধরে পড়তে থাকলে সে বিরক্ত এবং কাধে ঝোলানো থ্রি নট থ্রি রাইফেলের ভারে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। সে রাইফেল নামিয়ে রাখে না, তবে দেখে, খোলা ফটকের পাশে একটি তুলসী গাছ বৃষ্টির পানিতে ভিজে টলোমলো করে। আবদুল গণি অনেকটা বিরক্তি এড়ানোর জন্য প্রথমে তুলসীর দুএকটি পাতা ছিঁড়ে চিবোয়, তারপর সে গাছের একটি ডাল ভেঙে নেয়। মহল্লার লোকেরা এই কাহিনী পরে জানতে পারে। তারা জানতে পারে যে, মায়ারাণীদের তুলসী গাছের ডাল ভাঙার পর বৃষ্টির দিনের সেই ঘটনার শুরু হয়েছিল। মায়ারাণীকে মহল্লার লোকেরা এখনো দেখে, বনগ্রামের প্রাইমারি স্কুলে সে এখন শিক্ষকতা করে এবং এখনো অনূঢ়া। মহল্লার লোকেরা বলে যে, মায়ারাণী মোহাম্মদ সেলিমের প্রতীক্ষায় তার জীবন নিয়োজিত করেছে। কিন্তু আবদুল মজিদের মনে হয়েছিল যে, মায়ারাণী মোহাম্মদ সেলিমের প্রতীক্ষায় নাই, তবে সে কেন বিয়ে করে না তা আবদুল মজিদ বুঝতে পারে না। বাহাত্তর সনে যখন অন্যান্য হিন্দুদের সঙ্গে মহল্লায় মায়ারাণীরা ফিরে আসে কিন্তু মোহাম্মদ সেলিম ফেরে না এবং তার তোরঙ্গের ভেতর মায়ারাণীর একটি চিরকুট পাওয়া যায়, তখন আবদুল মজিদের তাদের দেয়ালের ফোকরে রাখা একুশটি চিঠির কথা মনে পড়ে। সে ফোকরের মুখের ইট খসিয়ে ধুলো জমা কাগজগুলো বের করে পুনরায় অতীতের সেই বিপদগ্রস্ততায় ফিরে গিয়েছিল, যখন, সে চিঠিগুলো গ্রহণে মায়ারাণীকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে নাই অথচ সেগুলো মোহাম্মদ সেলিমকে ফিরিয়ে দিতেও পারে নাই। নিখোঁজ মোহাম্মদ সেলিমের চিঠিগুলো পুনরায় দেখে আবদুল মজিদের অপরাধবোধ হয়েছিল এবং একবার ভেবেছিল চিঠিগুলো মোহাম্মদ সেলিমের মার কাছে ফিরিয়ে দেবে, খুলে বলবে মায়ারাণীর চিরকুটের গোপন রহস্যের কথা। কিন্তু তা সে করতে পারে না, তার মনে হয় এই মিথ্যেটি এখন সত্যের চাইতে অধিক বিশ্বাসযোগ্য হয়ে গেছে এবং মোহাম্মদ সেলিমের মৃত্যুর ফলে বিষয়টি ইতিমধ্যেই অর্থহীন হয়ে গেছে; বিষয়টির নতুন করে অবতারণার কোনো মানে হয় না। ফলে মোহাম্মদ সেলিমের একুশটি নিষ্ফল চিঠি আবদুল মজিদদের ঘরের দেয়ালের ফোকরে আরো এক যুগের বেশি বন্দি হয়ে থাকে। তারপর একদিন, যেদিন রায়সা বাজার যাওয়ার পথে খায়ের মওলানার কথা শুনে তার স্পঞ্জের স্যান্ডেলের ফিতে ছিঁড়ে যায় তার ছমাস পর, এক রবিবারের সকালে ইয়াসমিন একটি কন্যাসন্তান প্রসব করলে আবদুল মজিদ তার নাম রাখে মোমেনা এবং সেদিন বিকেলে পড়ন্ত রোদের মতো ম্লানঅনূঢ়া মায়ারাণী যখন আবদুল মজিদের নবজাতক মেয়েকে দেখতে আসে, তার পুনরায় মোহাম্মদ সেলিমের কথা মনে পড়ে। সে কালো এবং বিষণ্ণ মায়ারাণীর মুখের দিকে তাকায় কিন্তু সে এখনো তাকে বুঝতে পারে না। তারপর মায়ারাণী যখন ইয়াসমিনের শয্যাপাশ ত্যাগ করে বাইরের ঘরে আসে, তখন আবদুল মজিদের মনে হয়, আর একবার সে চেষ্টা করে দেখতে পারে। সে মায়ারাণীকে বাইরের ঘরে বসায়। তারপর সে একটি চেয়ারের ওপর দাঁড়িয়ে সেই প্রাচীন ফোকরের ভেতর থেকে মলিন কাগজের টুকরোগুলো বের করে বলে, এগুলি লয়া যান। আবদুল মজিদ বিস্ময়াবিষ্ট হয়, যখন, সে একুশটি চিঠি মায়ারাণীর দিকে এগিয়ে ধরে এবং মায়ারাণী একদণ্ড চুপ করে তাকিয়ে থেকে দুহাতের করতল পেতে চিঠিগুলো নেয়। আঁচলের খুঁটে একথোকা বাসী শেফালি ফুলের মতো মোহাম্মদ সেলিমের একুশটি প্রেমপত্র বেঁধে নিয়ে মায়ারাণী যখন একটিও কথা না বলে নিষ্ক্রান্ত হয়, তখন প্রথমে আবদুল মজিদের মনে হয় যে, এতদিনে সে লাড্ড বিস্কুট খাওয়ার ঋণ থেকে মুক্তি পেল। তারপর, মোহাম্মদ সেলিমের জন্যও তার হৃদয় উদ্বেলিত হয়; তার মনে হয় মোহাম্মদ সেলিমের সবকিছুই অবশেষে সফল হলো, সে যুদ্ধে গিয়ে দেশ মুক্ত করল এবং দীর্ঘ অবহেলা শেষে মায়ারাণী গ্রহণ করল তার প্রেম। কিন্তু মোহাম্মদ সেলিমের প্রেমের পুনর্বাসন সম্পর্কে আবদুল মজিদের এই ধারণা একদিন পরেই সংশয়কবলিত হয়। তার ভেতর একধরনের বিভ্রান্তি দেখা দেয়, যখন পরের দিন অপরাহ্বে মায়ারাণী তাকে ডেকে নিয়ে যায় এবং তাকে উঠোনে বসিয়ে রেখে তার চোখের সামনে কতিপয় কর্মকাণ্ড সম্পাদন করে। আবদুল মজিদকে উঠোনের ধারে বারান্দায় বসিয়ে মায়ারাণী একটি মরচে ধরা দা দিয়ে ফটকের কাছে বেদির ওপর লাগানো বড় তুলসী গাছটি গোড়া থেকে কেটে দূরে নিয়ে ফেলে দিয়ে আসে, তারপর সে বেদির মাটি খুঁড়ে শিকড়সহ গোড়াটাও তুলে ফেলে দেয়। আবদুল মজিদের মনে পড়ে, তুলসী গাছ কাটাকে কেন্দ্র করে একাত্তর সনে শ্রাবণের এক বৃষ্টির দিনে মহল্লায় এক বিদ্রোহ ঘটে যায়। রাজাকার আবদুল গণি বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মায়ারাণীদের ফটকের নিচে আশ্রয় নিয়ে তুলসীর ডাল ভেঙে পাতা চিবুচ্ছিল। তারপর বৃষ্টি ধরে এলে সে যখন তুলসীর ডাল হাতে নিয়ে বদু মওলানার বাড়িতে যায় এবং বারান্দায় বদু মওলানার মুখোমুখি হয়, তার দিকে তাকিয়ে বদু মওলানার জ কুঁচকে যায়, কি খাও! বদু মওলানার এটা প্রশ্ন ছিল না, তিরস্কার ছিল; কারণ, তুলসী পাতা বদু মওলানার অপরিচিতি ছিল না। কিন্তু আবদুল গণি না বুঝে তার প্রশ্নের উত্তরে বলেছিল, তুলসী পাতা খাই। এই কথা শুনে বদু মওলানা ক্ষেপে গিয়েছিল, কিন্তু তার পরেও সে নিজেকে ধরে রেখে বলেছিল, তুলসী পাতা খাও কেন! নির্বোধ আবদুল গণি এর পরও তার কথা বুঝতে পারে নাই, সে পুনরায় মনে করে যে, এটা আর একটি প্রশ্ন এবং বলে যে, তুলসীর পাতা চিবোতে ভালো লাগে। তখন বদু মওলানা নাদান’ বলে হুঙ্কার দিয়ে ওঠে এবং তুলসীর ডালটি কেড়ে নিয়ে উঠোনে ছুড়ে ফেলে দেয়। সে বলে যে, তুলসী গাছ হিন্দুরা পূজা করে, এই গাছ হিন্দু গাছ। তখন বদু মওলানার একটি কথা মনে পড়ে যে, লক্ষ্মীবাজার এলাকা এই গাছ দিয়ে ভরে গেছে, সে জানে মহল্লার প্রতিটি বাড়িতে তুলসী গাছ আছে। তার মনে হয়, গাছ হিসেবে তুলসী অপ্রয়োজনীয় এবং আত্মার জন্য ক্ষতিকর। সে আধ ঘণ্টার ভেতর তার আঙিনায় ছজন রাজাকারকে সমবেত করে তুলসী গাছ সম্পর্কে তার বক্তব্য শোনায় এবং তারপর তাদেরকে অনতিবিলম্বে মহল্লার সব তুলসী গাছ কেটে ফেলতে বলে। এই নির্দেশের ফলে মহল্লায় প্রথম মিলিটারি আসার পর এবার রাজাকাররা প্রতিটি বাড়ির প্রাঙ্গণ, কুয়োতলা এবং গলি দিয়ে হাঁটাহাঁটি করতে শুরু করে। তারা হিন্দু এবং মুসলমানদের প্রতিটি বাড়ি থেকে সব তুলসী গাছ টেনে উপড়ে অথবা গোড়া থেকে ভেঙে এনে রাস্তার ওপর এক জায়গায় ফেলে। এভাবে তুলসী গাছ কাটতে গিয়ে ব্যাপারটি জটিল হয়ে ওঠে যখন সকলের শেষে একজন রাজাকার আবদুল মজিদদের বাসায় ঢুকে পেছনের আঙিনায় কুয়োতলার কাছ থেকে একটি বড় আর দুটো ছোট গাছ উপড়ে নিয়ে আসার সময় দেখে, রক্তের মতো লাল হয়ে জবাফুল ফুটে আছে। এই রাজাকারটির তখন মনে হয় যে, জবাফুল দিয়ে হিন্দুরা পূজা করে এবং তুলসীর মতো জবা ফুল গাছও হিন্দু গাছ এবং অপ্রয়োজনীয়। সে তখন ঝাঁকড়া জবাগাছটি গোড়া থেকে ভাঙার চেষ্টা করে, না পেরে ডাল ভাঙতে থাকে। এই অবস্থায় তাকে আবদুল মজিদের বোন মোমেনা দেখতে পায় এবং সে তার সহ্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। মহল্লার লোকেরা পরে জানতে পারে যে, মোমেনা জবা ফুল গাছ ভাঙায় বাধা দিলে রাজাকারটি তার কথায় কর্ণপাত করতে চায় না, তখন এই মেয়েটি রান্নাঘর থেকে কাটারি নিয়ে এসে অনুপ্রেবেশকারীকে তাড়া করে বের করে দেয়। মহল্লার লোকেরা একটু পরেই সব জানতে পারে, কারণ, একটু পরেই তারা বিষয়টির সঙ্গে জড়িত হয়। তাড়া খাওয়া রাজাকারটি ঘটনার সময় নিরস্ত্র থাকায় ভয় পেলেও অন্যদের সঙ্গে মিলিত হওয়া মাত্র তার সাহস ফিরে আসে এবং আহত পৌরুষ জাগ্রত হয়। সে তার সঙ্গীদের সব ফুল গাছ কেটে ফেলার প্ররোচনা দেয় এবং মহল্লার লোকেরা দেখে, রাজাকাররা আবার তাদের বাড়ির ভেতর প্রবেশ করতে উদ্যত হয়। এতে তারা আপত্তি করে এবং এর ফলে প্রথমে রাজাকারদের সঙ্গে তাদের বচসা হয়, তারপর সবলোক জড়ো হয়ে গেলে এবং রাজাকাররা পুনরায় গৃহে প্রবেশের জন্য জোর করলে ধ্বস্তাধ্বস্তির এক পর্যায়ে একজন বিচ্ছিন্ন রাজাকারকে একজন চপেটাঘাত করে। ঘটনাটি খুবই আকস্মিকভাবে ঘটে যায়, যে রাজাকারটি চড় খায় সে হঠাৎ করে বুঝে উঠতে পারে না কে তাকে চড় মেরেছে, কারণ, সে তখন অন্যদিকে তাকিয়েছিল। অন্যদিকে মহল্লার লোকেরা এই লোকটিকে শনাক্ত করতে অস্বীকার করে, তারা বলে যে, তারা চপেটাঘাত করতে দেখেনি। তবে মহল্লার লোকেরা এক মুহূর্তের ভেতর ঘটনার ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে সচেতন হয়। তারা এক প্রবল ভয়ের অনুভব নিয়ে দ্রুত যার যার বাড়ির ভিতর অপসৃত হয়। রাস্তার ওপর ছজন রাজাকার প্রথমে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর আক্রান্ত রাজাকারটির চৈতন্য যেন প্রথম ফিরে আসে। সে শূন্য রাস্তা আর বাড়িগুলোর বন্ধ ফটকের দিকে তাকিয়ে গর্জন করে ওঠে, মান্দার পোলারা! তারপর তারা সব বন্ধ ফটকের দিকে দৌড়ে যায় এবং দমাদম করে লাথি মারতে থাকে, উন্মত্ততার এই পর্যায়ে চড় খাওয়া রাজাকারটি থ্রি নট থ্রি রাইফেল বাগিয়ে ধরে এলোপাথাড়ি গুলি ছোড়ে; রাইফেলের গুলি লেগে বাড়ির কার্নিশের পলেস্তারা খসে পড়ে, দরজা ফুটো হয়ে যায়। মহল্লার লোকেরা পরে জানতে পারে যে, গুলির শব্দ শুনে বদু মওলানা প্রথমে ভয় পেয়ে যায়, তারপর যখন সে জানতে পারে যে, তার রাজাকাররা ক্ষেপে গেছে, সে এগিয়ে এসে সব দেখে এবং তারা একটু শান্ত হয়ে এলে সব বৃত্তান্ত শোনে। বদু মওলানা যখন শোনে যে, একজন রাজাকারকে চড় মারা হয়েছে, সে খুব বিচলিত হয়ে পড়ে। এই সময় গুলির শব্দ থেমে গেলে মহল্লার দু-একজন, যারা সাহস করে রাস্তায় উঁকি দেয় তারা দেখে, বদু মওলানার পেছনে রাজাকারদের মার্চ করে যেতে। সেই দিন আর কিছুক্ষণ পরে মহল্লায় দ্বিতীয়বারের মতো মিলিটারি আসে এবং মহল্লার লোকেরা এক অবিস্মরণীয় ঘটনা সংঘটিত হতে দেখে। এই বিষয়টি পরে জানা গিয়েছিল যে, বদু মওলানা রাজাকারদের কাছ থেকে সব শুনে বিচলিত হয়ে পড়ে এই কারণে যে, সে পুরো জিনিসটার ভেতর ভেঙে গুড়িয়ে দেয়া সাহসের এক পুনরুত্থানের ইঙ্গিত যেন দেখতে পায়। তার মনে হয়, মহল্লার লোকদের আর একবার মিলিটারি দেখানো প্রয়োজন। তার দেয়া খবর পেয়ে একটু পরে গুমগুম্ শব্দ করে মিলিটারি বোঝাই একটি ট্রাক মহল্লার চাপা রাস্তার ওপর, ফেলে রাখা তুলসী গাছের তূপের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। তখন মহল্লার লোকদের যে অনুভূতি হয়েছিল সেটা এই অবস্থায় সব প্রাণীরই হয়, তা হলো ছুটে পালানো। কিন্তু লক্ষ্মীবাজারে লোকদের অতীতের সেই উপলব্ধির কথাটি মনে পড়ে যে, দেশে পালানোর স্থান নেই এবং এবার তারা পলায়নের প্রবল ইচ্ছে অবদমিত করে যার যার বাড়িতে থেকে যায়। পরে এই বিষয়টি জানা গিয়েছিল যে, মিলিটারির আগমন সংবাদ পেয়ে বদু মওলানা মিলিটারির এই দলটির নেতা, এক মাকরানি লেফটেন্যান্টকে অভ্যর্থনা করে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গিয়ে বসায়। বদু মওলানা তখন তাকে মহল্লায় সংঘটিত অভ্যুত্থানের ঘটনা সম্পর্কে বলে। কালো কুচকুচে অল্প বয়সী লেফটেন্যান্ট প্রশ্ন করে ঘটনার প্রতিটি স্তর উন্মোচিত করে বলে ওঠে, কেয়া আপ আওরাতকা সাথ নেহি সাকতা? বদু মওলানা তার এই কথায় খুবই ব্ৰিত বোধ করে এবং বলে যে, যদিও এই উত্থানের সূত্রপাত করেছিল একজন স্ত্রীলোক, পরিণতিতে মহল্লার সব পুরুষ এতে অংশ নেয় এবং একজন পুরুষই আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী রাজাকারকে চপেটাঘাত করার দুঃসাহস দেখায়। তখন মাকরানি লেফটেন্যান্ট মহল্লায় একটি অপারেশন করার বিষয়ে বদু মওলানার সঙ্গে একমত হলেও সে তার চাপল্য ত্যাগ করতে ব্যর্থ হয় এবং বলে, লেটস সি দি হিরোইন ফাস্ট। বদু মওলানা, হিরোইনটি কে তা বুঝতে সক্ষম হলেও, ইংরেজি এই বাক্যের পুরো অর্থ বুঝতে পারে না; তখন লেফটেন্যান্ট তাকে উর্দুতে তার ইচ্ছের কথা বুঝিয়ে দেয় এবং বদু মওলানা দুজন রাজাকারকে পাঠায় মোমেনাকে নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু রাজাকাররা মোমেনাকে বাসায় পায় না মহল্লার লোকেরা কেউ তাকে বাড়ি ত্যাগ করে যেতে দেখে নাই, কিন্তু তার মা বলে যে, সে কুমিল্লায় তার খালার বাড়ি বেড়াতে গেছে এই একটু আগে। রাজাকাররা আবদুল মজিদের মার এই কথা শুনে রাগে বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে থাকে। তাদের কোনো সন্দেহ-ই থাকে না যে, স্ত্রীলোকটি মিথ্যে বলছে, কিন্তু বাড়ির ভেতরটায় খুঁজে তছনছ করেও তারা মোমনাকে দেখতে পায় না। এই সময় মহল্লার লোকেরা, যারা জানালা অথবা দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দেয়, রাস্তার ওপর সেই অবিস্মরণীয় দৃশ্যটি উন্মোচিত হতে দেখে। তারা দেখে, ট্রাকের ওপর থেকে কয়েকজন মিলিটারি সিপাই রাস্তার ওপর লাফিয়ে নামে, তাদের হাতে চাইনিজ অটোমেটিক রাইফেল। তারা প্রথমে রাস্তায় অল্প অল্প পায়চারি করে, তারপর দুজন গিয়ে ওয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়ায় এবং পেশাব করে। সেই সময় একজন সিপাই একটি তুলসীর ডাল তুলে নিয়ে পাতা ছিঁড়ে রাস্তার ওপর ফেলতে থাকে। এটা মহল্লার লোকেরা বুঝতে পারে যে, সময় কাটানোর জন্য সে এই কাজ শুরু করেছিল। কিন্তু এটা করতে গিয়ে সে তুলসীর প্রভাবের কবলিত হয়। পাতা টেনে হেঁড়ার সময় সে প্রথমে এর ব্যতিক্রমী ঘ্রাণটি পায় এবং সে তখন একটি সবুজাভ বেগুনি রঙের পাতা প্রথমে একটু সামনের দাঁতে কেটে তারপর মুখের ভেতর স্থাপন করে। তখন, ক্যান্টনমেন্টের রুটি আর কাবাব খাওয়ার একঘেয়ে অভিজ্ঞতা এবং যুদ্ধের উত্তেজনায় অবসাদগ্রস্ত তার জিহ্বাটি এক মুহূর্তে ঝাঁঝালো রসের ঝাকুনি খেয়ে জেগে ওঠে। এ সময় রাজাকাররা কুচকাওয়াজ করে ফিরে আসে, তারা তুলসী পাতা ভক্ষণরত সিপাইদের দিকে না তাকিয়ে ভেতরে গিয়ে তাদের ব্যর্থতার খবর দেয়। রাজাকারদের এই ব্যর্থতায় তরুণ লেফটেন্যান্টের অপারেশন পরিচালনা করার ইচ্ছে সবল হয়। বদু মওলানাকে সঙ্গে করে সে যখন বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়ায় তখন সে দেখে, তার সিপাইরা গুল্মের একটি স্থূপকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের কাঁধে রাইফেল হাতে তুলসীর ডাল; প্রত্যেকে পাতা চিবোচ্ছে। সে এবং বদু মওলানা দেখে যে, লোকগুলো তুলসীর সব পাতা প্রায় খেয়ে ফেলেছে, তাদের সামনে পড়ে আছে পাতাহীন গুল্মের কঙ্কালের স্থূপ। এই দৃশ্য দেখে বদু মওলানা স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। এবং লেফটেন্যান্ট বিচলিত হয়। যখন বদু মওলানা তাদেরকে বলে যে, এ তারা কি করছে, তারা উত্তর দেয়, ইয়ে এলাজ হায়। তখন হতাশ বদু মওলানা লেফটেন্যান্টের দিকে ফিরে বলে যে, এই লোকগুলোর আত্মা কলুষিত হয়ে গেছে। তার এই কথা শুনে লেফটেন্যান্টের মনে হয়, সিপাইগুলো যেভাবে ধুলোবালি-মাখা আধমণ পাতা খেয়েছে তাতে খুব শিগগিরই তাদের পেটে বিষক্রিয়া হবে। তার মনে হতে থাকে। এ-ও হয়তো মুক্তিযোদ্ধাদের পেতে রাখা একটি ফাঁদ ছিল। এই অবস্থায় মহল্লায় অপারেশন স্থগিত হয় এবং দ্রুত চিকিৎসার জন্য লেফটেন্যান্ট সিপাইদের নিয়ে মহল্লা ত্যাগ করে। এর পনেরো বছর পর নির্জন এক অপরাহ্নে মায়ারাণী যখন আবদুল মজিদকে সামনে বসিয়ে রেখে ফটকের কাছে বেদির মাটিতে বড় হয়ে ওঠা তাদের তুলসী গাছটি শেকড়সহ খুঁড়ে তুলে ফেলে দেয় সে বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে থাকে। সে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারে না, কারণ, মায়ারাণীর সঙ্গে তার কখনোই বেশি কথা বলার সম্পর্ক ছিল না, তা ছাড়া তার মনে হয় যে, মায়ারাণী এইসব অলৌকিক কর্মকাণ্ডের ব্যস্ততার ভেতর তার সঙ্গে এখন কথা বলবে না। সে দেখে, গাছ কেটে এবং শেকড় উপড়ে ফেলে দেয়ার পর মায়ারাণী একটি কচি তুলসী গাছের চারা, কাঁসার ঘড়ায় করে পানি, গোলাপি কাপড়ে বাঁধা একটি ছোট পুঁটুলি এবং তেলের প্রদীপ এনে উঠোনে রাখে। তারপর মায়ারাণী যখন পায়ের পাতার ওপর বসে পুঁটুলিটি খোলে, আবদুল মজিদ সেই একুশটি পত্র দেখতে পায়। আবদুল মজিদের মনে হয় যেন মায়ারাণী কোনো এক বিস্ময়কর যজ্ঞ সম্পাদন করে চলে; সে দেয়াশলাইয়ের কাঠি ঠুকে প্রদীপের সলতেয় আগুন জ্বালে, তারপর মোহাম্মদ সেলিমের একুশটি বিষণ্ণ চিঠি একে একে পুড়িয়ে ছাই করে সে ছাই বেদির মাটিতে প্রয়োগ করে। এই ঘটনায় আবদুল মজিদের দুঃখবোধ হলেও সে অপেক্ষা করে এবং দেখে যে, বেদির মাটির সঙ্গে কাগজ-পোড়া ছাই মেশানোর পর মায়ারাণী তরুণ তুলসী গাছটি তুলে নিয়ে যত্নের সঙ্গে সেই মাটিতে রোপণ করে। তারপর গোড়ায় একটি কাঠ পুঁতে দিয়ে ঘড়া থেকে জল ঢেলে দেয়। এই পর্যায়ে এসে আবদুল মজিদের হতাশা এবং দুঃখবোধ একধরনের বিভ্রান্তিতে রূপ নেয় এবং তার মনে হয় যে, তার এই বিভ্রান্তির সমাধান কোনো দিনই হবে না; কারণ, মায়ারাণী কোনোদিনই তাকে পরিষ্কার করে বলবে না, সে যা করেছিল তা কেন করেছিল। মায়ারাণী শুধু তার অন্য প্রশ্নটির উত্তর দিয়েছিল, যে প্রশ্নটি তার মনের ভেতরে ছিল কিন্তু সে উচ্চারণ করে নাই, এই বলে যে, তাকে ডেকে এনে এসব দেখানোর উদ্দেশ্য ছিল এই, যাতে সে জানে চিঠিগুলোর অস্তিত্ব লুপ্ত হয়েছে। মায়ারাণীর এই কাণ্ড দেখে ঘরে ফিরে আসার পর আবদুল মজিদের মনে দীর্ঘদিন পূর্বে মৃত এবং বিস্মৃত মোহাম্মদ সেলিমের প্রেমের সাফল্য এবং ব্যর্থতাবিষয়ক তার বিভ্রান্তি জেগে থাকে। এই সময় তার মা একটি কাঁথায় জড়িয়ে তার সদ্যোজাত কন্যাটিকে তার কোলে যখন দেয়, সে দেখে, একটি খয়েরি রঙের নরম কাপড়ের মতো তার মেয়ের ছোট্ট মুখ; তার মনে হয়, তার কন্যাটিও কালো হবে তার মা এবং মোমেনার মত। মোমেনার কথা আবার যখন তার স্মৃতিতে স্পষ্টভাবে এসে পড়ে এবং যখন সদ্যজাত মেয়ে সন্তানটির নামকরণ নিয়ে তার নানি এবং দাদি, মা এবং খালা অচিরেই তৎপরতা শুরু করে তখন আবদুল মজিদ তার কন্যাটিকে দুহাতে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে বলে যে, এই কন্যাটির নাম ‘মোমেনা’ রাখা হোক। তার কথা শুনে সকলে স্তব্ধ হয়ে যায়। তার বৃদ্ধা মা নিমজ্জিত হয় তার নিজের প্রথম কন্যার আগমন এবং তিরোধানের ঘটনার আনন্দ এবং বেদনার স্মৃতি উদ্ঘাটনে, অন্যরা বুঝতে পারে যে, এই নামটি এই পরিবারের লোকদের আবেগ এবং অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত। আবদুল মজিদের মেয়ের নাম ‘মোমেনা রাখা হয়ে যায়। ছোট মোমেনার অস্তিত্বের ভেতর বড় মোমেনার অস্তিত্ব যে ফিরে আসে, এ ব্যাপারে আবদুল মজিদের কোনো সন্দেহ থাকে না যে বড় মোমেনাকে তারা বাঁচাতে ব্যর্থ হয়েছিল। জবা ফুল গাছ নিয়ে মহল্লায় খণ্ড যুদ্ধের পর যখন রাজাকাররা আবদুল মজিদদের বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়েছিল মোমেনার খোঁজে তখন সে কুয়োতলার পেছনে একটি পরিত্যক্ত এবং ভগ্ন কুঠরির মেঝের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে ছিল, তার দেহ ছাই এবং মাটি দিয়ে পরিপূর্ণভাবে ঢেকে দেয়া ছিল, কেবলমাত্র পেঁপে পাতার ডাঁটার তিনটে নল তার নাকের সঙ্গে বাইরের আবহাওয়ার সংযোগ সাধন করেছিল, এবং এই আস্তরণের ওপর একটি মুরগি সাতটি ডিমের ওপর বসে তা দিচ্ছিল। রাজাকাররা এসে সারা বাড়ি খুঁজে মোমেনাকে পায় না, তার মা তাদের বলে যে, সে তার খালার বাড়ি বেড়াতে গেছে। সে দিন মোমেনা মাটি এবং ছাইয়ের নিচে চাপা দেয়া অবস্থায় পড়ে ছিল। পরে সে বলেছিল যে, সে এই সময়টা ঘুমিয়ে ছিল, রাত গভীর হলে আবদুল মজিদ কোদাল দিয়ে কেটে তার ওপর থেকে মাটি সরানোর পর তার ঘুম ভাঙে। এই কবরের ভেতর থেকে বের হয়ে এসে মোমেনা আশ্রয় নেয় তাদের মধ্যের ঘরের চৌকির তলায়। মহল্লার লোকেরা এরপর আর মোমেনাকে দেখে নাই, তারা জেনেছিল, যে সে কুমিল্লা গেছে এবং ডিসেম্বরের দশ তারিখে, ঢাকার ওপর যখন উড়োজাহাজ বোমা ফেলছিল এবং দেশ যেকোনো মুহূর্তে মুক্ত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল, তখন তারা জানতে পারে যে, মোমেনা তাদের বাসাতেই ছিল এবং রাজাকাররা তাকে ধরে নিয়ে গেছে। মহল্লার লোকেরা জানতে পারে যে, মোমেনা চৌকির নিচে লুকিয়ে ছিল এবং রাত ছাড়া বের হতো না; তা সত্ত্বেও, রাজাকাররা খবর পেয়ে যায় এবং দশ তারিখে কারফুর ভেতর এসে আবদুল মজিদদের প্রাঙ্গণে দাঁড়ায়। এবার আবদুল মজিদের মা, তার মেয়ে কুমিল্লায় থাকে বললে তারা হাসে এবং ঘরে ঢুকে চৌকির তল থেকে মোমেনাকে টেনে বের করে। সে সময়, আবদুল মজিদ এসে যখন তার বোনের হাত ধরে, একজন রাজাকার তার পেটের ওপর বন্দুকের নল চেপে ধরে এবং মোমেনা তখন বলে, ডরাইস না, আমারে কিছু করব না। এই কথা বলে একাত্তর সনের ডিসেম্বরের দশ তারিখে দুপুরের পর মোমেনা আবদুল মজিদের হাতের বাঁধন খুলে রাজাকারদের সঙ্গে চলে যায়; সে আর ফেরে নাই। তখন আবদুল মজিদ আর তার মা বদু মওলানার বাড়িতে ছুটে গিয়েছিল, বদু মওলানার পায়ের ওপর তার মা পড়ে ছিল, লোকে যেমন আল্লাহর উদ্দেশে সেজদায় পড়ে থাকে। আবদুল মজিদ দেখেছিল, আধোচৈতন্যের ভেতর অবস্থানকারী তার মায়ের মুখের ফেনায় বদু মওলানার পাম্প শু ভিজে যাচ্ছিল। বাড়ির ছাদের ওপর এবং ফটকের কাছে বালুর বস্তার পেছনে পাহারারত রাজাকার নিয়ে, এই কোণঠাসা অবস্থাতেও বদু মওলানা আবদুল মজিদের মায়ের কথা শুনে কৌতুক করে ওঠে, আপনের মাইয়া না কুমিল্লা থাকে। এবং তারপর সে তার পা ছাড়িয়ে নিয়ে বাড়ির ভেতর চলে যায়। এরপর বদু মওলানাকে তারা দুবছরের আগে আর মহল্লায় দেখে নাই। মোমেনাকে আবদুল মজিদ চার দিন পর খুঁজে পায় রায়েরবাজারের পশ্চিম প্রান্তে, বুড়িগঙ্গা নদীর কিনারায়, বালুচরের মতো দেখতে এক মাঠের ওপর। আবুদল মজিদ এখন বুঝতে পারে না এই চার দিন তার আদৌ সংজ্ঞা ছিল কি না। তার এখন শুধু মনে পড়ে খুঁজে খুঁজে সে যখন মোমেনাকে পায়, সেই সময়টিকে। রায়েরবাজারের জনমানবহীন কুমোরপাড়ার ভেতর দিয়ে সে যখন গিয়ে একটি উঁচু ডাঙার প্রান্তে দাঁড়ায়, সে দেখে, বালুচরের মতো কিছু শুকনো মাঠ এবং কিছু জলাভূমি ধার ঘেঁষে পড়ে আছে, আর দূরে রোদের আলোয় চিকচিক করে বিশীর্ণ নদীর জল। এই বালুচরের মতো একটি মাঠে সে মোমেনাকে পড়ে থাকতে দেখতে পেয়েছিল। এই দূরত্বটুকু সে পার হয়ে এসেছিল অথবা বলা যায়, সে এখন বলে যে, এই দূরত্বটুকু পার করে এনে ঈশ্বর তাকে তার মৃত বোনের পাশটিতে স্থাপন করে দেয়। সে তখন তার বোনকে দেখে। তার একটি স্তন কেটে ফেলা, পেট থেকে উরু পর্যন্ত ক্ষতবিক্ষত, ডান উরু কোমর থেকে হাঁটু পর্যন্ত চিরে তরমুজের মতো হাঁ করে রাখা; সে চিৎ হয়ে শুয়ে ছিল, তার পিছমোড়া করে বাঁধা হাত দুটো দেহের নিচে চাপা পড়ে ছিল, মুখটা ছিল আকাশের দিকে উথিত। সে হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছিল, তার বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠেছিল, আর সে বিকারগ্রস্তের মতো শুধু ‘আল্লাহ’ ‘আল্লাহ’ ধ্বনি উচ্চারণ করেছিল। সে মোমেনার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে আকাশের দিকে খুলে রাখা অর্ধনিমীলিত চোখের ওপর চোখ রেখে আপা আপা বলে কেঁদেছিল। আবদুল মজিদ পরে যখন তার মেয়ের নাম রাখে মোমেনা, সে তা এই কারণে করে না যে, সে মোমেনার নাম ভুলে যাচ্ছে; বরং এই কারণে যে, এই নামটি ভুলে যাওয়ার নয়। আবদুল মজিদের মেয়ের নাম মোমেনা রাখায় মহল্লার লোকদের কি প্রতিক্রিয়া হয়, আদৌ কোনো প্রতিক্রিয়া হয় কি না অথবা তারা আদৌ ব্যাপারটি জানে কি না, তা সে জানতে পারে না। কিন্তু আবদুল মজিদ এ সময় একদিন প্রবল বিস্ময়ের সঙ্গে দেখে যে, একাত্তর সনের স্মৃতি সবচাইতে বেশি মনে রয়ে গেছে বদু মওলানার। বদু মওলানা এই বিষয়টি ভোলে নাই যে, মোমেনাকে রাজাকাররা ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছিল এবং সম্ভবত দেশ মুক্ত হওয়ার পর মহল্লায় ফিরে আলাউদ্দিনের মায়ের তাড়া খাওয়ার পর বুঝতে পারে যে, এই জনগোষ্ঠীও কোনো কিছুই ভুলে যায় নাই। কারণ, যে বদু মওলানা, আবদুল মজিদের সঙ্গে অপ্রয়োজনে কথা বলে না, সে একদিন তাকে রাস্তায় থামিয়ে তার বাচ্চা মেয়ের কুশল জিজ্ঞেস করে এবং তারপর বলে, বইনের নামে নাম রাকছে, বইনেরে ভুলো নাইকা? আবদুল মজিদ যে মোমেনার কথা কোনোদিন ভুলবে না সেটা তো আবদুল মজিদের জানাই আছে। কিন্তু বদু মওলানার কথা শুনে তার যা মনে হয়, তা হলো এই যে, বদু মওলানা জানে আবদুল মজিদরা একাত্তরের নয় মাসের কথা ভোলে নাই। বদু মওলানার কথা শুনে আবদুল মজিদ চিন্তিত হয়ে থাকে। তার মনে পড়ে একদিনের কথা, রায়সা বাজার যাওয়ার পথে স্যান্ডেলের ফিতে ছিঁড়ে গেলে বদু মওলানার ছেলেকে ধন্যবাদ দেওয়া দেখে সে প্রবলভাবে তাড়িতবোধ করেছিল এবং সেদিন আজিজ পাঠান তাকে তার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে কাঁধের ওপর হাত রেখে বলেছিল যে, সময়ে মানুষকে অনেক কিছু ভুলে যেতে হয়, বাস্তবতা অনেক সময় বড় হয়ে ওঠে। আবদুল মজিদ এখন বরং দেখতে পায়, মানুষ কেউই কিছু ভোলে না এবং বদু মওলানারও এই কথাটি জানা আছে। এই অবস্থায় কয়েক দিনের চিন্তাভাবনার শেষে সে সিদ্ধান্ত নেয় মহল্লা ত্যাগ করে যাওয়ার। এ ব্যাপারে অবশ্য সে তার মা, স্ত্রী এবং দুবোনের স্বামীদেরও মতামত নেয়, তবে লক্ষ্মীবাজারের বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে বাড়ায় তার শ্বশুরবাড়ির কাছ গিয়ে নতুন বসত শুরু করার সিদ্ধান্ত অপরিবর্তিত থাকে। কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করে তার মনে হয়, এটাই একমাত্র যৌক্তিক সিদ্ধান্ত। প্রথমত, সে চায় না, তার মেয়েটি তার বোনের মতো বদু মওলানা কিংবা তার ছেলেদের জিঘাংসার শিকার হোক এবং তার মনে হয়, বাস্তবতা এভাবে এগোলে এ রকম যে ঘটবে না তা কেউ বলতে পারে না। তার মনে হয়, বদু মওলানা একাত্তর সনের সেই একই রাজনীতির চর্চা করে এবং সে এখনো জানে আবদুল মজিদ এবং তার পরিবার মোমেনার মৃত্যুর জন্য এখনো তাকে ঘৃণা করে। তার মনে হয়, এই পরিবর্তিত রাজনৈতিক অবস্থায় বদু মওলানা এবং তার দল সুবিধে করতে পারলে তারা আবদুল মজিদকে ছেড়ে দেবে না এই ঘৃণার জন্য। তবে আবদুল মজিদ এটাও বুঝতে পারে যে, বদু মওলানার সে সুযোগ ঘটলে মহল্লার প্রায় সব লোকই আবার তার সেই পুরনো চেহারাটা দেখতে পাবে; কিন্তু এই ভয়ে একটি মহল্লার সব অধিবাসী বাড়িঘর বিক্রি করে পালাতে পারে না। তা সত্ত্বেও, আবদুল মজিদ ঠিক করে যে, মহল্লার সব লোকের কি হবে তা নিয়ে চিন্তা করে তার লাভ হবে না, সে প্রথমে নিজেকে বাঁচাতে চায় এবং কোনো সমষ্টিগত প্রচেষ্টার অবর্তমানে সে তা করতে পারে এখনই মহল্লা ত্যাগ করে। তার এই চিন্তা এবং সিদ্ধান্তের পরিণতিতে ছিয়াশি সনের সাতই জানুয়ারির দৈনিক ইত্তেফাকে আবদুল মজিদদের বাড়ি বিক্রির একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। এবং ধরে নেয়া যায় যে, তাদের বাড়ি বিক্রি হয়ে গিয়ে থাকলে লক্ষ্মীবাজারে তাদের নাম অবলুপ্ত হয়েছে। মহল্লার লোকেরা তাদের এই আচরণে প্রথমে হয়তো বিস্মিত হয়; তবে একসময় তারা হয়তো বুঝতে পারে, কেন আবদুল মজিদ মহল্লা ছেড়ে চলে যায়, অথবা এমনও হতে পারে যে, আবদুল মজিদের এই সংকটের বিষয়টি মহল্লায় এবং দেশে হয়তো কেউ-ই আর বুঝতে পারে নাই।