উনিশ শ পঁচাশি সনে একদিন লক্ষ্মীবাজারের শ্যামাপ্রসাদ চৌধুরী লেনের যুবক আবদুল মজিদের পায়ের স্যান্ডেল পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতি বিধানে ব্যর্থ হয়ে ফট করে ছিঁড়ে যায়। আসলে বস্তুর প্রাণতত্ত্ব যদি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হতো, তাহলে হয়তো বলা যেত যে, তার ডান পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেলের ফিতে বস্তুর ব্যর্থতার জন্য নয়, বরং প্রাণের অন্তর্গত সেই কারণে ছিন্ন হয়, যে কারণে এর একটু পর আবদুল মজিদের অস্তিত্ব পুনর্বার ভেঙে পড়তে চায়। রায়সা বাজারে যাওয়ার পথে কারকুন বাড়ি লেন থেকে বের হয়ে নবাবপুর সড়কের ওপর উঠলে তার স্যান্ডেলের ফিতে ছিঁড়ে যায় এবং সে থেমে দাঁড়ায়। তখন নবাবপুরের মানুষ আর যানবাহনের শব্দ ও চাঞ্চল্যের ভেতর সে আরো অধিক কিছু অনুভব করে। মানুষ আর গাড়ি যে শব্দ সৃষ্টি করে, যে শব্দ সম্পর্কে মানুষ সব সময় সচেতন হয় না, তার বাইরে, এক ঝাঁ ঝাঁ শব্দের জগতে সে ঢুকে পড়ে। সে দেখে, নবাবপুরের ওপর অপরাহ্নের ম্লান আকাশ উইপোকায় ছেয়ে আছে আর পলায়নপর উইয়ের পেছনে অসংখ্য কাক হুটোপুটি করে। তার মনে হয় যেন কাকের চিৎকার এবং উইপোকার নিঃশব্দ পলায়ন প্রচেষ্টার দ্বারা নবাবপুর রোডের ম্রিয়মাণ বিকেলের ভেতর এক ধরনের নীরব সন্ত্রাসের অনুভব ছড়িয়ে পড়ে। তখন তার ইন্দ্রিয় আর একটি বিষয়ে সচেতন হয়, সে খুব নিকটে লাউড স্পিকারের শব্দ শোনে। নবাবপুর রোডে সে সময় অবস্থানকারী প্রতিটি লোকের মতো সে এই শব্দের উৎস সন্ধান করে এবং তার সামনে, রাস্তার উল্টোদিকে পুলিশ ক্লাবের কাছে মাইক্রোফোন হাতে আবুল খায়েরকে দেখতে পায়। আবদুল মজিদ দেখে, আবুল খায়ের একটি দাঁড় করানো রিকশায় বসে মাইক্রোফোন মুখের কাছে তুলে কথা বলে আর রিকশার হুডের ওপর বসানো চোঙের ভেতর থেকে তার কথা বিস্ফারিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। আবদুল মজিদ তখন, সেই ক’টি মুহূর্ত, কাক এবং উইপোকার ওপর চোখ রেখে আবুল খায়েরের কথা শোনে। আবুল খায়ের কি বলে তা নবাবপুরের ওপর দিয়ে তখন চলমান সকলেই বুঝতে পারে। আবুল খায়ের বলে, আপনেদের ধন্যবাদ। সকলে তার এই কথা তেমন বিচারবিশ্লেষণ ছাড়াই বুঝতে পারে, কারণ যারা তার কথা শুনতে পায় তারা সকলেই জানে কোন প্রসঙ্গে আবুল খায়ের এই কথা বলে। তারা জানে আগের দিন বিভিন্ন দলের আহ্বানে যে হরতাল হয়েছিল, পরদিন, কাকের চিৎকার এবং যান্ত্রিক শব্দের ভেতর আবুল খায়ের তার জন্য সকলকে ধন্যবাদ দেয়। আবদুল মজিদের মনে হয়, তার হৃদয়টি বহুদিন থেকেই বিদীর্ণ হয়েছিল, কিন্তু এই দিন, উইপোকার হত্যাযজ্ঞের বিষণ্ণ বিকেলে আবুল খায়েরের কথা শুনে তার হৃদয়ের তম্ভ তার স্যান্ডেলের ফিতার মতো পুনরায় ছিন্ন হয়। আবদুল মজিদ যখন তার দৃষ্টি আবুল খায়েরের দীর্ঘ এবং তরুণ শুশ্রু আর নীল রঙের জোব্বার ওপর রাখে, তার মনে হয়, আকাশে যত কাক ওড়ে সেগুলো আবুল খায়েরের জোব্বার ভেতর থেকেই যেন বের হয়ে আসে। তার মনে হয়, এ সেই কাক; সে তো জানে কাকের সঙ্গে আবুল খায়েরের পারিবারিক সূত্রে ঘনিষ্ঠতা। তার পিতা বদরুদ্দিন মওলানার সে এক অজ্ঞাত রহস্যময় ভালোবাসা ছিল কাকের জন্য। লক্ষ্মীবাজারের লোকদের মনে পড়ে, একাত্তর সনে বদু মওলানা নরম করে হাসত আর বিকেলে কাক ওড়াত মহল্লার আকাশে। এক থালা মাংস নিয়ে ছাদে উঠে যেত বদু মওলানা আর তার ছেলেরা। মহল্লায় তখনো যারা ছিল, তারা বলেছিল, বদু মওলানা প্রত্যেকদিন যে মাংসের টুকরোগুলো আকাশের দিকে ছুড়ে দিত, সেগুলো ছিল মানুষের মাংস। কারণ, মহল্লার সবচাইতে প্রাচীন মুসলমান পরিবারটির প্রধান, খাজা আহমেদ আলী বলেছিলেন যে, একদিন এক টুকরো ছুড়ে দেয়া মাংস কাকেরা ধরতে ব্যর্থ হলে সেটা এসে পড়েছিল তার বাড়ির ছাদের ওপর। তিনি ছাদের ওপর বিকেলের একচিলতে রোদে বসে অতীত যৌবনের স্মৃতির ভেতর নিমজ্জিত হয়ে ছিলেন, তখন মাংসখণ্ডটি তার পায়ের কাছে এসে পড়ে। তিনি কিছুক্ষণ দেখে অনুধাবন করেন যে টুকরোটির গায়ের একদিকে চামড়া রয়ে গেছে এবং তিনি দেখেন যে এই চামড়া একেবারে মসৃণ। এসব কথা মহল্লার সকলে পরে জেনেছিল। সেই বিকেলে মাংসটুকরোটি হাতে তুলে নিয়ে তিনি দেখেন যে, সেটার গায়ে ছোট্ট মুসুরের ডালের মতো একটি পাথরের ফুল। তিনি হাহাকার করে ওঠেন, দুহাতের অঞ্জলিতে টুকরোটি নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে বড় ছেলে খাজা শফিকের সহায়তায় সেটা দাফন করেন নিজের বাড়ির আঙিনায়। তারপর মাগরিবের নামাজ পড়ার সময় তিনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকেন। একটি অদেখা মেয়ের জন্য লক্ষ্মীবাজারের এক বিষণ্ণ বৃদ্ধের হৃদয় সেদিন ভেঙে পড়ে। এখন তার বাসার আঙিনায় তার নিজের আর তার বড় ছেলের জোড়া কবর। অন্য একটি টুকরো, সেটা ছিল পায়ের বুড়ো আঙুলের, পেয়েছিল এক অচেনা পথিক, রাস্তার ধারে ফুটপাথের ওপর। আবু করিমের বড় ছেলে সেটা দেখেছিল এবং লোকে সব জেনেছিল। আঙুলটির নখ খুব বড় এবং শক্ত ছিল এবং নখের ওপর ঘন এবং মোটা লোম ছিল। নখে লাগানো ছিল টকটকে লাল নখরঞ্জক। রঞ্জকের কথা শুনে সবাই ভেবেছিল যে সেটা একটি মেয়েমানুষের পায়ের আঙুল, তারপর ঘন মোটা কেশের কথা শুনে সবাই ভেবেছিল, সেটা পুরুষের। তারপর সবাই ভেবেছিল সেটা একজন হিজড়ের হবে। আঙুলের এই কাটা টুকরোটির কি হয়েছিল, তা কেউ জানে না। কিন্তু আবু করিমের বড় ছেলেটি রায়সা বাজারের দোকান থেকে ফেরার পথে একদিন নিখোঁজ হয়। অন্য আর একটি টুকরো পড়েছিল জমির ব্যাপারির বাড়ির কুয়োতলায়, বিকেলে ভাতের চাল বোয়ার সময়, হাঁড়ির ভেতর। এটা ছিল একটি কাটা পুরুষাঙ্গ। হাঁড়ির ভেতর এসে পড়তেই জমির ব্যাপারির কিশোরী কন্যাটি চমকে উঠেছিল, কিন্তু হাঁড়ির ভেতর থেকে বের করে এনে সে বস্তুটি চিনতে পারে নাই। সে সেটা তার মায়ের কাছে নিয়ে গেলে ব্যাপারির স্ত্রী অভিজ্ঞতার কারণে জিনিসটা চিনতে পারে। কাটা লিঙ্গটি খাতনা করানো, মুণ্ডিত। ব্যাপারির স্ত্রী সেটা দেখে বিমূঢ় হয়ে পড়ে। তার মেয়ে ‘এটা কি মা’, ‘এটা কি মা’ করতে থাকলেও সে তাকে কিছু বলে না। সে মানুষের কাটা জননেন্দ্রিয়টি একটি ন্যাকড়ায় জড়িয়ে রেখে দেয়। রাতে জমির ব্যাপারি বাসায় ফেরার পর তাকে ন্যাকড়া খুলে জিনিসটি দেখালে সে একই সঙ্গে তার স্ত্রী এবং অন্য সকলের ওপর ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। তখন তার সেই মেয়েটি ফিসফিস করে জিনিসটি কি জানতে চাইলে সে বলে, ল্যাউড়া। এর পরেও মেয়েটি জিনিসটি চিনতে পারে না, তার মনে হয়, তার পিতা ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে গাল দিল। এরপর জমির ব্যাপারি ন্যাকড়ায় জড়ানো অঙ্গটি সে রাতেই বদু মওলানার বাসায় গিয়ে দিয়ে আসে। এ সবই মহল্লার লোক বিস্তারিত জানতে পারে। বদু মওলানার দ্বিতীয় তরুণী স্ত্রী লতিফা বদু মওলানার সামনে বসে উপহারটির মোড়ক খুলে অনাবৃত করেই তা হাত থেকে ফেলে দেয়, এ মা, জোঁক মনে হয়। বদু মওলানা তার পরেও চৌকি থেকে ওঠে নাই। তখন তরুণী লতিফা ভালো করে বাতি জ্বেলে একটি পেন্সিলের চোখা আগা দিয়ে খুঁচিয়ে দেখে জিনিসটি চিনে ফেলে এবং বদু মওলানা তখন জানতে চায় জিনিসটি কি। তার স্ত্রী তার কথার উত্তর না দিয়ে নিরুত্তর থাকলে সে শোয়া থেকে উঠে ঝুঁকে পড়ে ভয়াবহ লিঙ্গটা দেখে। তখন তার স্ত্রী বলে, মুসলমানের। এ কথা শুনে বদু মওলানা নির্বাক হয়ে থাকে। বদু মওলানা কেন নির্বাক হয়েছিল সেটা প্রথমে বোঝা যায় না, তবে বদু মওলানা এই ভেবে নিশ্চয়ই বিচলিত হয় নাই যে দেহাঙ্গটি একজন মুসলমানের। বস্তুত একাত্তর সনে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মহল্লায় প্রথম যে ব্যক্তি নিহত হয়, সে ছিল একজন মুসলমান ও অপ্রাপ্তবয়স্ক। বদু মওলানার এই তথ্যটি মনে রাখার প্রয়োজন ছিল না, কিন্তু মহল্লার লোকদের সেটা মনে থেকে যায়। তাদের এই কথাটি আজীবন মনে থেকে যায় যে একাত্তর সনে মহল্লায় প্রথম নিহত হয়েছিল, আলাউদ্দিন; যে মোটর গ্যারেজে কাজ করত এবং নিহত হওয়ার দিন, তার মায়ের হিসেবে অনুযায়ী, তার বয়স হয়েছিল তেরো বৎসর। আলাউদ্দিন নিহত হওয়ার পর মহল্লার লোকদের সেই কথাটিও মনে পড়েছিল, যা এখনো তাদের মনে আছে যে, হাফপ্যান্টের এক পাশ গুটিয়ে দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে পেশাব করার সময় তার শিশ্নের ওপর নজর পড়ায় বদু মওলানা ক্ষেপে গিয়েছিল একদিন, হারামযাদা, খাড়ায়া খাড়ায়া মোত, খাড়ায়া মোতে কুত্তা। তখন আলাউদ্দিন কয়েক দিন পর নির্মমভাবে নিহত হওয়ার শর্ত পূরণ করেছিল। প্রথমত, সে বদু মওলানার কথা শুনে গালের ভেতর জিভ নেড়ে তাকে ভেঙায়, তারপর বলে, কুত্তা তো মুখ দিয়া খায়বি, আপনে অখনথন হোগা দিয়া খায়েন। বদু মওলানাকে এই অশ্লীল কথা বলায়, তার বাপ শুনতে পেয়ে, তাকে পেয়ারা গাছের সঙ্গে বেঁধে বেদম প্রহার করে, আর আলাউদ্দিন আর করুম না, আর করুম না’ বলে চিৎকার করলে মহল্লার লোকেরা বিশদ জানতে পারে। এর তিন মাস নয় দিন পর, একদিন দুপুরে, মহল্লার লোকজন যখন ‘মিলিটারি আইছে’, ‘মিলিটারি আইছে’ বলে কাকের তাড়া খাওয়া উইপোকার মতো দৌড়াচ্ছিল এবং যেদিন প্রথম বদু মওলানা এবং ক্যাপ্টেন ইমরান পরস্পরকে আবিষ্কার করে, আলাউদ্দিনের প্রাণ-বিযুক্ত দেহ মহল্লায় তাদের বাড়ির সামনের রাস্তায় চিৎ হয়ে আছড়ে পড়ে। তাই বোঝা যায় যে, বদু মওলানা যখন কাটা পুরুষাঙ্গটি দেখে নির্বাক হয়ে থাকে তা এই কারণে নয় যে, তার স্ত্রীর কথায় সে জেনেছে অঙ্গটি একজন মুসলমানের। সে লতিফার কথায় তার এই প্রতিক্রিয়ার মূল বিষয়টি নিজের সঙ্গে দীর্ঘ বোঝাপড়া শেষে ভীরুতার আবরণ খসিয়ে ভোররাতে উদ্ঘাটন করে। সে বুঝতে পারে, লতিফা, অপরিচিত একজন পুরুষের যৌনাঙ্গ অবলোকন শুধু করে নাই, এ ব্যাপারে সে অনেক আগুহ দেখিয়েছে; সে সেটাকে পুরুষের যৌনাঙ্গ হিসেবে শনাক্ত করেছে। তার পরেও সে ছাড়ে নাই, সে শনাক্ত করেছে যে, সেটা মুসলমানের। বিষয়টি জানা হয়ে যাওয়ার পর বদু মওলানার নির্বাক বিষণ্ণতা দূর হয়ে যায়। সে লতিফাকে ডেকে তুলে তিন তালাক দেয়। মহল্লার লোকেরা অনেকে পালিয়ে গেলেও, যারা ছিল, তারা পরে বিস্তারিত সব জানতে পারে। সব ঘটনার সত্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়, কারণ পরদিন বদু মওলানার দ্বিতীয় তরুণী স্ত্রীটি বাসা ত্যাগ করে এবং তার আগে লক্ষ্মীবাজারে রাত জুড়ে একটি নারীকণ্ঠের করুণ এবং একটানা কান্নার শব্দ সকলকে জাগিয়ে রাখে। কেউ তাদের বাসা থেকে এগিয়ে যায় না। বাতি না জ্বেলে, বিছানায় শুয়ে থেকে মহল্লার অবশিষ্ট লোকেরা শনাক্ত করে যে, বদু মওলানার দ্বিতীয় স্ত্রী, সুন্দরী গ্রাম্য তরুণী লতিফা কাদে; তার কোনো কষ্ট হয়েছে। সকলে অন্ধকারে জেগে থাকে, কেবল একবার অসহ্য লাগলে কিশোর আবদুল মজিদ বাতি জ্বালে। পরদিন সকালে আবদুল মজিদের মা, বদু মওলানার বাসায় গেলে সে সেখানে জড়ো হওয়া আরো সব লোককে বলে যে, তার কিছুই হয় নাই। সে ঈশ্বরের প্রশংসা করে এবং সকলকে ধন্যবাদ দেয়। তার বাসায় আগত এই লোকদের ভেতরে সে দুজনের সঙ্গে পৃথক আচরণ করে। প্রথমে সে আবদুল মজিদের বিধবা মাকে বলে যে, এই মহল্লায় এখনো তাদেরই কেবল সাহস রয়ে গেছে। তারপর সে হঠাৎ করে জমির ব্যাপারির শুকনো গালে চপেটাঘাত করে, কিন্তু সে তাকে একটি কথাও বলে না। উপস্থিত জনতা এই সব বিমূঢ় বিস্ময়ে দেখে, যেমন বিমুগ্ধ দর্শক দেখে জাদুকরের ব্যাখ্যাতীত আচরণ, এবং বুঝতে চেষ্টা করে। কিন্তু তারা বুঝতে পারে না, তারা নীরবে অবলোকন করে যায়। তারা দেখে, চড় খাওয়া জমির ব্যাপারি এবং প্রশংসিত আবদুল মজিদের মা দুজনের চেহারাই একই রকম বিষণ্ণ এবং বিপদগ্রস্ত মনে। মার্চের পচিশ তারিখের পূর্বের দিনগুলোর নিদারুণ উৎকণ্ঠা আর হীনম্মন্যতা কাটিয়ে বদু মওলানা দ্রুত যে গাম্ভীর্য এবং আত্মপ্রত্যয় অর্জন করে, সেটা এক মুহূর্তের জন্য ভেঙে পড়ার সুযোগে জমির ব্যাপারি তার ভেতরটা দেখে ফেলার সুযোগ পায়। এবং আর-একটি সকাল আসার আগে বাড়ির দরজায় তালা ঝুলিয়ে স্ত্রী এবং ছেলেমেয়ে নিয়ে সে সাড়ে সাত মাসের জন্য নিখোঁজ হয়। চড় খেয়ে সে বেঁচে যায়, কিন্তু আবদুল মজিদের মা তার পরিবারকে ক্ষয়ক্ষতিহীন রাখতে পারে না। বদু মওলানার প্রশংসায় আতঙ্কিত হয়ে এই বিধবা রমণীটি ঘরে ফিরে ছেলেমেয়েদের সেই কথাটিই বলে, যে কথাটি বদু মওলানা তাকে বলেছিল, কইলো, মহল্লার ভিতরে আপনেগোই অখনও সাহস আছে, কেন কইলো? কেন বলল, সেটা তার চার ছেলেমেয়ের কেউ বলতে পারে না। তারা শুধু শুনে রাখে এবং বিপদগ্রস্ত বোধ করে তাদের মায়ের মতো। তারা তাদের গোটা সংসারে সাহসের কোনো উপাদান খুঁজে পায় না; পরিবারের বয়স্ক পুরুষটি পাঁচ বছর হলো মৃত, একমাত্র ছেলেটির বয়স মাত্র চৌদ্দ বছর, বড় মেয়েটির বয়স কুড়ি এবং এখনো অনুঢ়া। এরকম একটি পরিবার সাহসের অভিযোগে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। কিশোর আবদুল মজিদ সারা দিন কপাল কুঁচকে রাখে, তারপর সন্ধেয় তার মা আর বড় বোনের দিকে তাকিয়ে বলে বাদ দেও, বাদ দেও তো। সে এমনভাবে বলে যে, যেন সে ধরে নেয় তার মা ও বোন তারই মতো একই প্রসঙ্গে চিন্তিত হয়ে আছে, এবং সে দেখে যে তার ধারণাই ঠিক। কারণ তার কথা শুনে তার বোন বলে, হ, এই লয়া ভাবিছ না। কিন্তু আবদুল মজিদের মনে হয়, সেই ভাবনার শেষ নাই। সে তারপর, জীবনের বিভিন্ন সময়ে এই উপলব্ধিটা আবিষ্কার করেছিল যে, কৈশোরের আতঙ্কের সেই দিনে সে যে বিষয়টি বাদ দেয়ার কথা বলেছিল সেটা কোনোভাবেই বাদ হয়ে যায় নাই এবং তাই, পনেরো বছর পর সেই একই আলখাল্লা পরা বদু মওলানার ছেলে, খায়ের মওলানার কথা শুনে রায়সা বাজারে বাজার করতে যাওয়া ত্যাগ করে সে ঘেঁড়া স্যান্ডেল হাতে বাসায় ফিরে তার স্ত্রী ইয়াসমিনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে দেখে ইয়াসমিনের শীর্ণ গ্রীবার গোড়ায় একটি শিরা দপদপ করে, সে সেখানে আঙুল দিয়ে স্পর্শ করে; মোমেনার গলার পাশে এই জায়গায় বেয়োনেট গেঁথে দেয়া হয়েছিল। স্ত্রীর মুখের ওপর চোখ রেখে তার পুনরায় সাহস এবং সাহসহীনতার কথাটি মনে আসে। আবদুল মজিদ জানে, এমনকি কৈশোর উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই সে এই রহস্যটি জেনেছিল যে, তাদের ঘৃণা ছিল। এবং বদু মওলানা হয়তো সেই কথাটি বলেছিল তার মাকে, বদু মওলানার স্ত্রী যেদিন বাড়ি ত্যাগ করে সেদিন সকালে। আবদুল মজিদ বুঝতে পারে যৌবনে পদার্পণ করেও সে কেমন দুর্বল পুরুষ, তার ভয় হয় এবং সে সর্বদা কেমন শঙ্কিত; কিন্তু তার পরেও সে ভুলে যেতে পারে না ঘৃণার কথা এবং ইয়াসমিনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার সময় তার ঘৃণা থেকে ক্রোধ উৎসারিত হয়। হয়তো এই শীতল আগুনের মতো ক্রোধ বদু মওলানা দেখেছিল, হয়তো এখনো দেখে। আবদুল মজিদ বুঝতে পারে, ঘৃণার এই সাহসে তার ভীরু জীবন কেমন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ইয়াসমিনের বাহুর ভেতর নিজেকে সমর্পণ করে সে সুস্থির হতে চায়, এই দ্যাশের মাইনষেরে এ্যালায় বদু মওলানার পোলায় কয়, ভাইছাব। কয়, আপনেগো ধন্যবাদ। জ্বরগ্রস্তের মতো আবদুল মজিদ ইয়াসমিনের গলা জড়িয়ে ধরে ‘আপা, আপা’ বলে ফোঁপায়। এই ভীরুতায় তার লজ্জা করে, কিন্তু সে কিছু করতে পারে না। সে বুঝতে পারে, সাহসী হওয়াটা প্রয়োজন। কিন্তু সাহসী হওয়ার নিয়ম সে খুঁজে পায় না; জীবনে সে ক্রমাগতভাবে সাহসী হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে যায়। প্রথম যেদিন কিশোর আবদুল মজিদ সাহসের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে, সে ঠিক করেছিল যে, সে গুণ্ডা হয়ে যাবে। কলেজিয়েট স্কুলে ক্লাস এইটে পড়ার সময় মোমেনাকে বদু মওলানা রাস্তায় গাল দিলে সেদিন সে ভেবেছিল এর প্রতিকার সে একমাত্র গুণ্ডা হয়েই করতে পারে, তখন এই লক্ষ্মীবাজার এলাকায় মোমেনা ছিল একমাত্র মুসলমানের মেয়ে যে গান গাইত। বাসন্তী গোমেজের সঙ্গে তার ভাব ছিল। আর বাসন্তী গোমেজ তাকে সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুলের চার্চে প্রার্থনা-সঙ্গীতে অংশগ্রহণের জন্য নিয়ে যেত। মোমেনা ওয়ারিতে সিলভারডেল স্কুলের এক অনুষ্ঠানে গান গেয়ে ফেরার সময় বদু মওলানা সামনে পেয়ে তাকে গাল দেয়। সেদিন ঘরে ফিরে মোমেনা এক অস্বাভাবিক যন্ত্রণায় ছটফট করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বিলাপ করেছিল, কয় কি, ডিম পারবার যাও। হারামির পোলা আমারে কয় কি, মাগি, ডিম পারবার যাও। মোমেনা আপাকে দেখে আবদুল মজিদের মনে হয়েছিল, তাকে মুরগির মতো জবাই করে কুয়োতলায় ঝকার নিচে চাপা দেয়া হয়েছে। দরজার বাইরে দাড়িয়ে থেকে আবদুল মজিদ তখন সেই অনুভূতিটির বিষয়ে সচেতন হয়েছিল, যার নাম ঘৃণা এবং আক্রান্ত হয়েছিল সেই আবেগের দ্বারা, যার নাম প্রতিহিংসা। কিশোর আবদুল মজিদ অনুভব করতে পেরেছিল যে, সে মোমেনা আপার অপমানের প্রতিশোধ নিতে চায়, কান্দিচ না আপা, মান্দারপোর খোতা ফাটায়া দিয়া আমুনে। কিন্তু সে নিশ্চিতরূপেই বুঝতে পারে নাই সে কিভাবে তা করবে এবং ওই সময়ই সে সেই বোধটিও আবিষ্কার করে, যার নাম কাপুরুষতা। এই বোধের সামনে দাঁড়িয়ে আবদুল মজিদ ঠিক করে যে, সে করিমের মতো গুণ্ডা হবে এবং বাসন্তী গোমেজের ভাই পঙ্কজ গোমেজের মতো পা ফাঁক করে দাড়িয়ে গিটার বাজাবে। কিন্তু তার কিছুই করা হয় না। সে দিনকয় গুণ্ডা হওয়ার পথ খুঁজে বেড়ায়, করিমের সঙ্গে সিগারেট টানে, মেয়ে-দেখে ঠোঁট টেনে ধরে লম্বা করে শিস দেয়। কিন্তু এসব কিছুতে সে হয়রান হয়ে যায়, তার মা এবং মোমেনার জন্যও সে আর এগোতে পারে না। তার মা তার পকেটে সিগারেট পেয়ে তাকে বকাঝকা করে, তারপর মোমেনা তার চৌকির পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে তার দায়িত্বের কথা বলে, তুই এমুন করচ! তর উপরে মার কত আশা, তুই পইড়াশুইনা কত বড় হবি। আবদুল মজিদ মোমেনার মুখের দিকে তাকিয়ে নির্বাক হয়ে থাকে, তারপর তার মোমেনার যন্ত্রণার কথা মনে পড়ে, কয় কি, ডিম পারবার যাও, মাগি। কিশোর আবদুল মজিদের চোখ সেইদিন অশ্রুতে পূর্ণ হয়ে যায়। নোনা পানির তল থেকে যেন সে শ্যামল পৃথিবীর দিকে তাকায়, সে মোমেনা আপার মুখ দেখে। তার বুকের ভেতর যে বেদনা হয়, সেই বেদনায় সে জীবনে প্রথম ভালোবাসার কথা টের পায়। সে মোমেনার শাড়িতে মুখ গুঁজে দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে রাখে; যে মোমেনাকে, সে তখনো জানে না, সে আবিষ্কার করবে মৃত, গলার বাম দিকে কাঁধের কাছে বেয়োনেট বিধিয়ে দেয়ার এক হা-করা ক্ষত–মুখটা কাত হয়ে আছে। মায়ের চোখ এবং মোমেনা আপার শাড়ির মাড়ের ঘ্রাণ আবদুল মজিদকে গুণ্ডা হয়ে উঠতে দেয় না এবং এর সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায় যখন স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষায় ভালো ফলাফলসহ সে নাইনে ওঠে এবং বাসন্তী গোমেজ তাদের পারিবারিক পাঠাগারের দরজা তার জন্য খুলে দেয়। বাসন্তী গোমেজদের বইয়ের ভেতর সে ধুলো আর ন্যাপথলিনের গন্ধ আবিষ্কার করে এবং একসময় তার মনে হয় যে তার আর রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে বদু মওলানাকে ‘মান্দারপো’ বলে গাল দেয়ার পথ নাই। বদু মওলানা আবদুল মজিদের শত্রু হয়ে যায় যেদিন সে তার বোনকে কুৎসিত কথা বলে এবং তার বোন অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরায়, এবং সে পুরো মহল্লার শত্রু হয়ে যায় একাত্তর সনে নয়াবাজারের লেলিহান আগুনে আকাশ জ্বলে ওঠার পরের দিনগুলোতে। তখন সে হঠাৎ করে কাঁধের ওপর কালো খোপ খোপ চেকের স্কার্ফটি ফেলে এগিয়ে আসে এবং মহল্লার লোক পাঞ্জাবি মিলিটারির পাশে তাকে দেখে বুঝতে পারে না সে বাঙালি কি না এবং লক্ষ্মীবাজারে যারা শেষ পর্যন্ত টিকে থেকে তারা পুরোটা বছর তার কাক ওড়ানো দেখে। তারা দেখে, বদু মওলানার একাত্তরের প্রথম দিককার চেহারার টানাপোড়েন পঁচিশে মার্চের পর কেমন প্রশান্ত হয়ে আসে এবং মহল্লায় যেদিন প্রথম মিলিটারি আসে সে দিন সে কিভাবে আবিষ্কৃত হয়। মহল্লার লোকেরা সেদিন মাত্র এক ঘন্টার প্রলয়ের পর বুঝতে পারে তার বিশেষ মর্যাদার কথা। সেদিন এক ঘণ্টায় মিলিটারি প্রতিটি বাড়িতে প্রবেশ করে, মহল্লায় নিহত হয় সাত জন, তিন জন নারী তাদের শ্লীলতা হারায়। নিহত সাত জনের নাম মহল্লাবাসী একটু পরেই জানতে পারলেও ধর্ষিতা তিন জন নারীর নাম কেউ জানতে পারে না; সে তিনজনকে তারা শনাক্ত করতে পারে না, এমনকি বুঝতে পারে না তারা বালিকা, তরুণী, নাকি বৃদ্ধা। কারণ মহল্লার হতবিহ্বল লোকেরা খবরটা বদু মওলানার বাড়ির যে ভৃত্যের কাছ থেকে জানতে পারে, সেই ভৃত্য তিন জন মেয়ের নাম বলতে পারে না। মহল্লায় সাতটি লাশ এবং একটু পরেই কারফু শুরু হওয়ার দুশ্চিন্তা নিয়ে বসে থাকা মানুষদের সে বলে যে, সে মিলিটারিদের মুখে শুনেছে তিন জন মিলিটারি তিনজন রমণীর সঙ্গে সহবাস করেছে। মহল্লার লোকেরা তার কথা বাঁকা দৃষ্টি মেলে শোনে এবং লাশগুলোর দিকে তাকায়। তারা তাদের পরিবারের বেঁচে থাকা লোকজন গুনে দেখে, পাঁচটি পরিবারে একজন করে কমে যায়, খাজা আহমেদ আলীর পরিবারে কম পড়ে দুজন। মহল্লার লোকজন জানতে পারে যে, মিলিটারি খাজা আহমেদ আলীর বাসায় প্রবেশ করেই তার বড় ছেলে খাজা শফিককে গুলি করে মারে। সে সময় বাড়ির প্রাঙ্গণে পিতা এবং পুত্র দুজনে দণ্ডায়মান ছিলেন। পিতার চোখের সামনে বিনা করণে খাজা শফিকের প্রাণবিযুক্ত দেহের পতন হলে পিতা সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে গিয়ে আজান দিয়েছিলেন। মহল্লাবাসী সকলেই পরে বলে যে, হাঁ, তারা আজানের ধ্বনি শুনেছিল। সেই ঝঞার সময় যখন দিনের আলো ছিল কৃষ্ণবর্ণ তরলের মতো এবং শব্দের জগৎ পাহাড় ভেঙে পড়ার মতো সহস্রখণ্ডিত, সেই সময় তারা শুনেছিল লক্ষ্মীবাজারের পলেস্তারা-খসা বাড়িগুলোর ছাদ ছুঁয়ে আজানের ধ্বনি গড়িয়ে যেতে। এবং তারা যখন জানতে পারে যে খাজা আহমেদ আলী ছিল সেই ঝঞাকালের মুয়াজ্জিন, তারা সকলেই বলে যে, তারা যখন আজান শুনেছিল তারা তার কণ্ঠ চিনতে পেরেছিল। তারা সকলেই বলে যে, এমন মধুর স্বরে আজান দেয়া তারা ইতিপূর্বে কখনো শোনে নাই এবং তারা মনে করেছিল, বেলালের কণ্ঠই কেবল এমন হতে পারে। তারা এ-ও বলে যে, তিনি আজান দেয়া সমাপ্ত করেছিলেন এবং আজানের শেষ স্তবকে দুবারের জায়গায় তিনি চারবার ‘আল্লাহু আকবর’ বলেছিলেন। কিন্তু মহল্লার লোকেরা যখন খাজা আহমেদ আলীর ছাদে গিয়ে তার মৃতদেহ উপুড় হয়ে পড়ে থাকতে দেখে এবং জানতে পারে যে, আজানের মাঝখানে তাকে গুলি করা হয়, তারা তা মেনে নিতে পারে না। তারা বলে যে, তিনি আজানের শেষে চারবার মহল্লার সকলকে বলেছিলেন যে, আল্লাহই শ্রেষ্ঠ। তারা বিভ্রান্ত বোধ করে এবং তাদের এই বিভ্রান্তি আজীবন থেকে যায়। তারা খাজা আহমেদ আলীর লাশ চিৎ করে দেখে তার মুখের শুভ্র দাড়িতে রক্তের বুদ্বুদ লেগে আছে। তখন তারা তার লাশ নামিয়ে এনে উঠোনে খাজা শফিকের লাশের পাশে রাখে। সেদিন মহল্লার রাস্তা আর বাড়ি থেকে তারা মোট সাতটি লাশ সংগ্রহ করে। মৃত ব্যক্তিদের সকলে ছিল পুরুষ এবং এদের ভেতর সবচাইতে কম বয়স্ক বালকটির বয়স ছিল তেরো বৎসর এবং সবচাইতে বৃদ্ধের আশি। এদের ভেতর দুজন ছাড়া অন্য সকলকে তারা মাটির ওপর থেকে কুড়িয়ে আনে, যেন তারা ঝড়ে উৎপাটিত সেইসব বৃক্ষ সরিয়ে আনে, যেগুলো শাখা পল্লব বিস্তার করে আঙিনায় খাড়া ছিল। অন্য দুজনের একজন, খাজা আহমেদ আলীকে পাওয়া যায় অন্তরীক্ষে আর চৌষট্টি নম্বর বাড়ির আলতাফ হোসেনকে কুয়োর পানিতে। আলতাফ হোসেন গুলি খেয়ে পানিতে পড়েছিল, না পানিতে পড়ার পর গুলি খায়–তা মহল্লার লোক প্রথমে বুঝতে পারে না। দড়ি আর হুক নামিয়ে লাশ টেনে তোলার পর গুলির ক্ষত খুঁজতে গিয়ে তারা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। তারা কোনো গুলির ক্ষতের চিহ্ন দেখে না এবং তাদের মনে হয় যে, সে হয়তো পানিতে ডুবে মরেছে। কিন্তু পরে মহল্লার লোকেরা বলে যে, তখন তারা কুয়োর পানির দিকে খেয়াল করে দেখে যে পানি রক্তের মতো লাল হয়ে আছে এবং তখন তারা আবার সর্বত্র অনুসন্ধান করে আলতাফ হোসেনর মাথার চাঁদিতে চুলের ভেতর সরু ক্ষতটা আবিষ্কার করে। কিন্তু তারা গুলির নির্গমন পথ দেখে না; তারা নিশ্চিত হয় যে, যে গুলিতে আলতাফ হোসেন তার প্রাণ হারিয়েছে সেই গুলিটিকে তার দেহ বেরুতে দেয় নাই। এতে মৃত আলতাফ হোসেনের কি লাভ হয়েছিল সে কথা মহল্লার লোকেরা বলে না, তারা শুধু বলে, গুলি ঢুকছে, কিন্তু বাইরয়া পারেনিকা। এবং চাদির মধ্যখানে গুলির ক্ষত দেখে তারা নিশ্চিত হয় যে, কুয়োর পানিতে পড়ে যাওয়ার পর তাকে গুলি করে মারা হয়। মহল্লার লোকেরা সবগুলো মৃতদেহ খাজা আহমেদ আলীর বাড়ির উঠোনে এনে জড়ো করে এবং কারফুর ভেতর কোথাও যেতে না পেরে লাশ নিয়ে বসে থাকে। সাতটি লাশ নিয়ে তাদের বিহ্বলতা হয়, শোকের উচ্ছাস হয় না। সেদিন সাতটি লাশ নিয়ে লক্ষ্মীবাজারের জনতা নির্বাক হয়ে বসে ছিল; লক্ষ্মীবাজারের রাস্তা মৃতের মতো নিঃশব্দ ছিল, রাস্তায় একটি কুকুর ছিল না, আকাশে একটি পেঁচা উড়ে আসে নাই বাতাসে ডানার শব্দ করে। তাদের মনে হয়েছিল, তারা সৃষ্টির আদি থেকে কোনো শব্দ শোনে নাই। কিন্তু তারপর, রাত ক্রমাগত বাড়িতে থাকলে তারা বুঝতে পারে, একটি নারীর কান্নার শব্দ তারা শুনতে পাচ্ছে। অনেকটা বিস্মৃতির তল থেকে যেন তারা মানুষের এই ধ্বনিগত আচরণের বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন হয় এবং দেখে যে, তারা নিজেরা কেউ কাঁদে না। তারা বরং কান পেতে অচেনা রমণীর কান্নার শব্দ শোনে, আস্তে আস্তে তাদের এমন মনে হতে থাকে যে, কান্নার এই শব্দ এমনকি মিলিটারি চলে যাওয়ার আগেই তারা পেয়েছিল। মহল্লার লোকেরা তখন নিশ্চিত হয় যে, আরো একটি লাশ কোথাও রয়ে গেছে, কোনো বাড়িতে, যাদের সঙ্গে যেভাবেই হোক, অন্যান্যদের যোগাযোগ ঘটে নাই। তারা তখন তাদের অসাড় হয়ে আসা ইন্দ্রিয় সজাগ করে শোনে এবং বুঝতে পারে যে, কান্নার শব্দ। মওলানার বাড়ির দিক থেকে ভেসে আসে। বদু মওলানার বাড়িতেই কেউ দীর্ঘক্ষণ ধরে কাঁদছে এই সত্য প্রতিষ্ঠিত হলে মহল্লার মানুষের প্রথমে অবিশ্বাস হয়, তারপর তারা তাদের শোকের ভেতরে উল্লসিত হতে থাকে। কারণ, মহল্লার লোকেরা বদু মওলানাকে সেদিন একটু আগে দেখেছে একা, পৃথক পরিচয়ে। একদল খাকি পোশাক পরা লোকের সঙ্গে ধূসর রঙের পপলিনের জোব্বায় আবৃত বদু মওলানা লক্ষ্মীবাজারের রাস্তায়, ঘরে, আঙিনায়, কুয়োতলায়, বাড়ির ছাদে শিকারোৎসব করেছিল। এখন এই কান্নার শব্দে মহল্লার লোকদের ক্ষোভ এবং উল্লাস একত্রিত হয়ে তাদেরকে এমন এক অবস্থায় নিয়ে যায়, যখন তাদের মনে হয় যে, বদু মওলানার রক্তের রমণীকে কাঁদতে না দেখলে তাদের এই শোকের শেষ হবে না, তাদের এই উল্লাস পূর্ণ হবে না। তখন মহল্লার লোকেরা বদু মওলানার বাসায় যায় এবং গিয়ে তারা ভুল বুঝতে পারে। তারা জানতে পারে যে, প্রথমত যে কাঁদছিল, সে কোনো নারী নয়, সে বদু মওলানার ছোট ছেলে আবুল বাশার। আবুল বাশার কাঁদছিল কারণ, পাকিস্তানি মিলিটারি আবুল বাশারের প্রিয় কুকুর ভুলুকে গুলি করে মারে। মহল্লার লোকেরা বদু মওলানার উঠোনে ইলেকট্রিকের আলোয় লালচে খয়েরি রঙের ভুলুকে ঘিরে বসে থাকা বাড়ির চাকরদের দেখে। তারা জানতে পারে যে, ভুলুকে যে কারণেই হোক মেরে ফেরার পর আবুল বাশার কাঁদতে থাকলে বদু মওলানা তার মুখ চেপে ধরেছিল আর তখন মিলিটারিদের নেতা পাঞ্জাবি ক্যাপ্টেন, বদু মওলানাকে বলেছিল ছেলেকে ছেড়ে দিতে। বলেছিল, উনকো রোনেদো। লক্ষ্মীবাজারের লোকেরা যখন বাড়ির ভেতর লাশ রেখে নিস্তব্ধতার আড়ালে লুকিয়ে ছিল, ঠিক তখন পাকিস্তানি মিলিটারি বদু মওলানাকে এই বিশেষ মর্যদা দেয়। তার ছেলে নিহত প্রিয় কুকুরের জন্য শোক প্রকাশের পায় এবং মিলিটারি মহল্লা ছেড়ে চলে যাওয়ার আগেই সে কান্না শুরু করে। আর মহল্লার লোকেরা নিহতের মোক নিয়ে পুরো রাত অপেক্ষা করে, পুরোটা বছর অপেক্ষা করে; সেই সময় পর্যন্ত, যখন হেমন্তের এক বৃহস্পতিবারে স্টেনগান হাতে, জলপাই রঙের পোশাক আর মুখ ভর্তি লম্বা দাড়ি নিয়ে একদল মুক্তিযোদ্ধা মহল্লায় এসে দাঁড়ায়। তারা বলে, আর ভয় নাই, শালারা খতম। মহল্লার লোকেরা রাস্তায় নেমে এসে জংলি চেহারার লোকগুলোর কাঁধে চাপড় দিতে থাকে। তখন গাঢ় সবুজ রঙের ভেতর লাল সূর্য এবং সোনালি মানচিত্র আঁকা একটি পতাকা নিয়ে আবুল কাশেমের ছেলে জসিম দৌড়ে এসে চিৎকার করে ওঠে, জয় বাংলা, আর তখন মুক্তিযোদ্ধা দেখতে এসে আলাউদ্দিনের মা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে কেঁদে ওঠে, অরা আমার আলাউদ্দিনরে মাইরা ফালাইছে। মুক্তিযোদ্ধা ছেলেগুলো ধুলোয় লুটানো এই নারীকে টেনে তোলে না, কোনো সান্ত্বনা দেয় না, তারা তাকিয়ে দেখে না পর্যন্ত; তারা শুধু এই শোকার্ত নারীকে ঘিরে রাখে। তাদের সকলের পিঠে ঝোলানো আগ্নেয়াস্ত্র এবং কোমরের বেল্টে বাঁধা গুলির বাক্স। তারা নির্বিকারভাবে দাঁড়িয়ে থাকে, রোগা এবং নোরা আঙুল দিয়ে লম্বা চুলের জট ছাড়ায়, সিগারেট ঠোকে। এদের বৃত্তের ভেতর আলাউদ্দিনের মা মাটির ওপর পড়ে থেকে কেঁদে নেয়। মহল্লায় মুক্তিযোদ্ধার আগমনের খবরে অন্যান্যের ভেতর তিনজন নারীর বিশেষ ঔসুক্য হয়, তারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে জনতার সঙ্গে অপরিমিত চুলদাড়ি গজানো এবং নোংরা পোশাক পরা ছেলেগুলোকে দেখে। তারপর, তারা যখন এগিয়ে এসে এই নিরাসক্ত তরুণদের কাছে নিজেদের পুত্রদের পরিচয় প্রকাশ করে এবং তাদের সম্পর্কে জানতে চায়, তখন দাড়িওয়ালা এই জংলি তরুণরা তাদেরকে ঘিরে ধরে এবং পিতা যেমন কন্যাকে বাহুর ভেতর নেয়, সেভাবে তাদের কাঁধের ওপর হাত রেখে বলে যে, তাদের ছেলেরা ফিরবে নিশ্চয়ই। কিন্তু তাদের এই কথা সর্বাংশে সত্য প্রমাণিত হয় না; বাবুল এবং আলমগীর ফিরে আসে কিন্তু মোহাম্মদ সেলিম ফিরে আসে না। তার মায়ের সব প্রতীক্ষা ব্যর্থ হয়ে যায়, তার ছেলেটি মুক্তিযুদ্ধ শেষে আর ফেরে না। সে বুঝতে পারে সে আর ফিরবে না, তবু তার মন পুরনো প্রতীক্ষায় জেগে থাকে।