তাদের বিষণ্ণ লাগে কারণ, তাদের মনে হয় যে, একমাত্র মুরগির ভয় থাকে বলাৎকারের শিকার হওয়ার আর ছিল গুহাচারী আদিম মানবীর। কিন্তু পাকিস্তানি মিলিটারি এক ঘণ্টায় পঞ্চাশ হাজার বছর ধরে মানুষের বুনে তোলা সভ্যতার চাদর ছিঁড়ে ফেলে এবং লক্ষ্মীবাজারের লোকেরা তাদের মহল্লায় মানুষের গুহাচারিতা এক মর্মান্তিক অক্ষমতায় পুনরায় অবলোকন করে; তারা মা এবং ছেলে, পিতা এবং যুবতীকন্যা একসঙ্গে বলাকারের অর্থ অনুধাবন করে। এই সময় কিশোর আবদুল মজিদ তার যুবতী বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেছিল। তখন মিলিটারি চলে গেছে এবং তারা উন্মত্ত ঝড়ের পর ক্লান্ত বৃক্ষশাখার মতো স্থিত হয়েছে, সেই সময় আবদুল মজিদ মোমেনার মুখের দিকে কেন যেন তাকিয়ে দেখে। বলা যায় যে, সে হয়তো তার বোনের চেহারায় কিছু খুঁজছিল না, নিশ্চিত করে কিছু ভাবছিলও না, শুধুমাত্র মিলিটারি চলে গেছে এই ভাবনা ছাড়া; তা সত্ত্বেও, সে তার মোমেনা আপার চেহারায় মলিন বিষণ্ণতা দেখেছিল এবং মোমেনা বুঝতে পেরেছিল যে আবদুল মজিদ তার বিষণ্ণতা দেখছে। কিংবা, সত্য এ-ও হতে পারে যে, আবদুল মজিদ হয়তো মোমেনার বিষণ্ণতাও দেখছিল না, হয়তো শুধু চোখ রেখেছিল, দৃষ্টি নিয়োজিত করে নাই; তবু মোমেনা তাকে ধমক দিয়েছিল, কি দেখছ তুই বারে বারে! তখন আবদুল মজিদের এই কৃষ্ণ দিনের ভেতর অন্য এক কৃষ্ণতর দিনের কথা মনে পড়েছিল যখন মোমেনা একইভাবে বলেছিল, কি দেখছ তুই! একাত্তর সনের এপ্রিল মাসের দুই তারিখে জুম্মার দিন জিঞ্জিরায় তারা যখন মিলিটারির তাড়া খেয়ে একটি অপরিচিত বাড়ির দোতলায় আশ্রয় নিয়ে অসংখ্য মানুষের সঙ্গে বসেছিল তখন তার চোখ পড়ে তার প্রৌঢ়া মায়ের ওপর, মোমেনার আঙ্কিত ঘর্মাক্ত মুখ এবং ক্রন্দনরত ছোট দুটো বালিকা বোনের ওপর। আবদুল মজিদ তার মা, ছোট দুই বোন এবং তার মোমেনা আপার দিকে তাকিয়ে কিছুই দেখে নাই। আসলে তার মনে হয়, সেই নয় মাস তার বোনের দিকে তাকিয়ে দেখা তার হয়ে ওঠে নাই এবং সে বস্তুত তাকে যখন প্রথম দেখে তখন তার গলায় খয়েরি জবার মতো ক্ষত ছিল, মুখটা কাত হয়ে ছিল এবং চোখ অনন্তের দিকে মেলা ছিল। কিশোর আবদুল মজিদ বুকের ওপর দুহাত চেপে ধরে তার পাশে হাঁটু গেড়ে বসেছিল এবং চোখ রেখেছিল চোখের ওপর। কিন্তু তখন সে বলে নাই, কি দেখচ তুই; যেমন জিঞ্জিরার সেই ঘরের ভেতর বলেছিল। জিঞ্জিরার সেই ঘরের ভেতর মোমেনার ভৎসনায় আবদুল মজিদের কিছুই মনে হয় নাই অথবা সে তখন তার কথাটি ঠিকমতো শোনে নাই। মাঠ, রাস্তা এবং হিন্দুদের পোড়ো বাড়ির ওপর দিয়ে তার মা এবং তিন বোনসহ ছুটে আসার পর তারা যখন এই বাড়িতে আশ্রয় পায় এবং দোতলায় একটি ঘরের মেঝের ওপর তাদেরই মতো ছুটে আসা মানুষের ভিড়ের ভেতর বসে তখন আবদুল মজিদের মনে হয়েছিল যে, তার অস্তিত্ব থেকে চেতনা বিযুক্ত এবং দেহের ওপর মনের ক্রিয়া স্থগিত হয়ে গেছে। সেই বিহ্বল মুহূর্তগুলোয় সে দেখে যে, তার হাতগুলো আর কাজ করে না, কাঁধ থেকে অপ্রয়োজনীয় বোঝার মতো ঝুলে থাকে এবং সে বুঝতে পারে যে তার পাজামা ঊরুর কাছে ভিজে যাচ্ছে আর এই প্রক্রিয়া সে কোনোভাবেই রোধ করতে সক্ষম হয় না। এখন আবদুল মজিদের মানে হয়, সে সময় সে চেতনা এবং চেতনাহীনতার মধ্যের এক বিপজ্জনক তৃতীয় স্তরে অসহায়ের মতো নিজের নিয়ন্ত্রণ থেকে নিজেরই প্রত্যঙ্গের স্বাধীন হয়ে যাওয়া প্রত্যক্ষ করেছিল। সে তখন তার অসহায়তা নিয়ে তার মা এবং মোমেনার মুখের দিকে তাকিয়েছিল এবং তখন মোমনা তাকে বলেছিল, কি দেখ তুই! তারপর আবদুল মজিদের দেহ-তরল যখন তার সকল ভয় এবং বিপন্নতাকে অবজ্ঞা করে গড়িয়ে বের হয়ে আসতে থাকে তখন নিমজ্জিত বালকের কাছে বোনের ঐশ্বর্য প্রকাশিত হয়। মোমেনা তার লজ্জা ঢেকে দেয়, সে তার শাড়ির আঁচলে মেঝেতে নেমে আসা আবদুল মজিদের মূত্ররস মুছে নেয়। তারপর আবদুল মজিদের মনে হয় যেন তার দেহ এবং মনের ভেতর ছিন্ন হয়ে যাওয়া সঙ্গতি ফিরে আসে এবং বিহ্বলতার স্তর অতিক্রম করে সে হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফেঁাপাতে থাকে। তখন, প্রৌঢ়া এবং ভীত জন্তুর মতো চুপ করে বসে থাকা তার মা বুঝতে পারে, তার ছেলেটি কত ছোট এবং সে তার মাথা টেনে নিয়ে নিজের বুকের ওপর স্থাপন করে, চুমো খায়; বলে, বাপ, বাপ আমার! কিন্তু কিশোর আবদুল মজিদের অপৌরুষ এই একদিন ছাড়া আর প্রকাশিত হওয়ার সুযোগ পায় না। বস্তুত মার্চের ছাব্বিশ তারিখের সকালে যখন সূর্যের আলো ফোটে এবং দরজা খুলে তারা যুদ্ধের প্রথম দিনটির ভেতর দাঁড়ায় তখন তার মা আর বোনদের দিকে তাকিয়ে আবদুল মজিদের ভেতর অবচেতনভাবে সেই বোধটির জন্ম হয়, প্রতিটি পুরুষের ভেতর যে বোধ একসময় জন্মে, যে, এই লোকগুলোর দায়িত্ব তার। আবদুল মজিদ সেদিন মহল্লার রাস্তায় নেমে দেখেছিল যে প্রতিটি মানুষ আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে গেছে আর অনুভব করেছিল চারদিকে জমাট হয়ে আসা স্তব্ধতা। সে তখন মহল্লা থেকে বের হয়ে লুকিয়ে ভিক্টোরিয়া পার্ক পর্যন্ত যায়! নয়াবাজারের দিক থেকে সে ধোয়া উড়তে দেখে, তার নাকে পোড়া কয়লার গন্ধ আসে। ঘরে ফিরে সে তার মা এবং বড় বোনের দিকে তাকায়, মহল্লার মানুষের ভেতর যে স্তব্ধতা সে দেখেছিল সেই চাপা দেয়া নির্বাক ভয় সে দেখতে পায় তার মা আর বোনদের ভেতর। সে নিজের ভেতরও এক বোবা আতঙ্ক পরিষ্কার দেখতে পায়, তবু পঁচিশ তারিখের শেষ রাতে গুলি আর হৈ চৈয়ের শব্দে ঘুম ভেঙে উঠে তার যখন দিশেহারা হয়ে হয়ে পড়ে, দেখে আগুনের লেলিহান শিখায় দেশ পুড়ছে, তখন আবদুল মজিদকে বলতে হয়, ডরায়ো না। পরদিন উপদ্রুত মানসিক অবস্থার ভেতর তারা দেখে যে, কারফুর ভেতরও মহল্লার লোকেরা পালাতে থাকে। হিন্দুরা সবার আগে এবং অলক্ষ্যে বাড়িঘর ছেড়ে চলে যায়, তাদের পেছন পেছন পালাতে থাকে মুসলমানরা। বিকেল নাগাদ মহল্লার নিস্তব্ধ রাস্তায় ঝিঝির ডাক শোনা যেতে থাকে। মহল্লা খালি হয়ে আসায় তার মা আরো বিচলিত হয়ে পড়ে, আবদুল মজিদেরও মনে হয় যে এভাবে একা মহল্লায় থাকা যায় না। তবু তারা মহল্লায় থেকে যায় যেহেতু তারা বাড়ি ছেড়ে কোথায় যাবে তা ঠিক করতে পারে না এবং তাদের পাশের বাড়ির রহিম ব্যাপারি বলে যে, সেও কোথাও যাবে না। কিন্তু তার পরদিন সে পরিবার নিয়ে দরজায় তালা ঝুলিয়ে চলে গেলে আবদুল মজিদের মা ভেঙে পড়ে। এই অবস্থায় আবদুল মজিদ তার পরিবার জিঞ্জিরায় নিয়ে যায় এবং মাত্র একটি রাতের ব্যবধানে, যেন এক দুঃস্বপ্নের পর, মা এবং বোনদের হাত ধরে পুনরায় মহল্লায় ফিরে আসে, দরজার তালা খুলে ঘরে ঢুকে আশ্চর্য রকমের নিরাপদ বোধ করে এবং তারা বলে যে, তারা আর বাড়ি ছেড়ে যাবে না। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তারা এটা দেখতে পেয়েছিল যে, বাড়ির ভেতরটাও আর নিরাপদ ছিল না এবং পরিণতিতে একদিন কিশোর আবদুল মজিদকে খুঁজে বের করে বয়ে নিয়ে আসতে হয় মোমেনার লাশ। যেদিন রহিম ব্যাপারি মহল্লা ত্যাগ করে এবং আবদুল মজিদের মা অস্থির হয়ে পড়ে সেদিন তখন আবদুল মজিদের যে অনুভূতি হয়, সেটা ছিল দিচিহ্নহীন সাগরে কোনো নাবিকের বন্দরের বাতিঘর খোঁজার মতো একটি ব্যাপার। প্রথমে তার মনে হয়, কুমিল্লার গ্রামে তার খালার বাড়ি তারা যেতে পারে কিন্তু একই সঙ্গে এটাও সে বুঝতে পারে যে, অতদূর তারা যেতে পারবে না। তারপর তার আনোয়ারের নাম মনে আসে এবং সে ঠিক করে যে, সে তার মা-বোনদের নদী পার করে আনোয়ারদের বাড়িতে নিয়ে যাবে। এপ্রিলের এক তারিখে দুপুরের পর তারা দ্রুত গুছিয়ে নিয়ে রাস্তায় বের হয়। রাস্তার নির্জনতায় তাদের মনে হয় যেন তারা কোনো এক তেপান্তরে এসে পড়েছে এবং হয়তোবা এখন দিনের বদলে রাত। মহল্লা থেকে ভিক্টোরিয়া পার্ক পর্যন্ত পথটুকু তারা রাস্তার ধার ঘেঁষে নিশ্ৰুপ ছায়ার মতো এগিয়ে গিয়ে রিকশায় চড়ে। এই সময়টুকুতে সেদিন কারফু ছিল না, তাদের রিকশা আরমানিটোলা মাঠের পাশ দিয়ে জেলখানার সামনে এসে উঠেছিল। জেলখানার সামনে এসে চারদিকে বালুর বস্তার বাঙ্কারের ভেতর তাক করে রাখা মেশিনগানের নল আর খাকি পোশাকপরা মিলিটারি দেখে তাদের নির্জনতার বোধ আরো বেড়ে যায়, আবদুল মজিদ দম বন্ধ করে রাখে কিন্তু তার মা নিজের আতঙ্ক আর ধরে রাখতে পারে না, সে শব্দ করে কলেমা পড়তে থাকে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসুল্লাহ। এভাবে রিকশা তাদেরকে নিয়ে চক সার্কুলার রোড ঘুরে চম্পাতলীর সংকীর্ণ গলির ভেতর দিয়ে গিয়ে সোয়ারীঘাটে বুড়িগঙ্গার তীরে নামিয়ে দেয়। কেরায়া নৌকোয় নদী পার হয়ে তারা যখন জিঞ্জিরার মাটিতে পা রাখে, তারা ফেলে যাওয়া অন্য পারের দিকে তাকায়, তাদের মনে হয় যে, জিঞ্জিরা এক স্বাধীন দেশ, তাদের আর ভয় নাই। তারা দেখে অসংখ্য মানুষ নদী পার হয়ে এপারে উপচে পড়ে এবং এই জনতা এপারের মাটিতে পা রেখে কেমন নিশ্চিন্ত এবং সজীব হয়ে ওঠে। তারা সে সময় বুঝতে পারে না যে, পলায়নের জন্য দেশে বস্তুত তখন কোনো জায়গা ছিল না; আর জিঞ্জিরা তো ছিল একেবারে নাগালের ভেতর। আবদুল মজিদ এবং তার পরিবার কলেজিয়েট স্কুলে তার সহপাঠী আনোয়ারদের চড়াইল গ্রামের বাড়িতে একটি রাত যে নিশ্চিন্ততার আত্মপ্রবঞ্চনার আড়ালে তৃপ্তির সঙ্গে ঘুমায়, সেটা পরদিন খুব ভোরে নদীর ওপার থেকে তোপ দেগে পাকিস্তানি মিলিটারি চুরমার করে দেয়। সেদিন দুপুর নাগাদ যখন জিঞ্জিরার অপারেশন শেষ হয় তখন আবদুল মজিদ, তার মা এবং বোনের এই বোধ জন্মে যে, পালানোর জায়গা নেই। পাকিস্তানি মিলিটারির আক্রমণের মুখে আনোয়ারদের বাড়ি ছেড়ে পালাতে গিয়ে তারা যখন দেখেছিল যে মিলিটারি বৃত্ত রচনা করে আছে তখন তারা মাঠের ভেতর সেই দোতলা বাড়িটিতে আশ্রয় নেয়, যেখানে আবদুল মজিদের দেহযন্ত্র ক্ষণিকের জন্য ভেঙে পড়ে। তারপর সেদিন বিকেলে তারা আবার লক্ষ্মীবাজারে তাদের বাড়িতে ফিরে আসে এবং তারা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করে যে, দুদিনের ভেতর মহল্লার অন্য সকলে প্রত্যাবর্তন করে, কেবলমাত্র হিন্দুদের বাড়িগুলো পরবর্তী ন মাস জনমানবহীন থেকে যায়। মহল্লার লোকেরা পরে জেনেছিল যে পঁচিশ তারিখের পর প্রতিটি প্রাণী বাড়ি ত্যাগ করেছিল, কেবলমাত্র দুজন ছাড়া। এদের একজন ছিলেন খাজা আহমেদ আলী, শনিবার সন্ধ্যায় লক্ষ্মীবাজারে একমাত্র তিনি বাতি জ্বালিয়েছিলেন। মহল্লার লোকেরা জেনেছিল যে, এ সময় আর-একজন লোক বাড়ি ছাড়ে নাই, সে বদু মওলানা। এ সময় তার বাড়ি ছাড়ার প্রয়োজন ছিল না, যদিও মহল্লার লোকেরা মার্চ মাসের শেষ পর্যন্ত তাকে একবারও দেখে নাই। পরে তারা জেনেছিল যে, সে নিজের বাড়িতেই লুকিয়ে ছিল, কারণ পঁচিশে মার্চের গোলাগুলি আর ঢাকার আকাশের আগুনের শিখা দেখে সে বুঝতে পারে যে, ‘জয় বাংলা শেষ হয়ে গেছে এবং সংকট শেষে তার সুসময় আসার এই অন্তর্বতি সময়টিতে সে হঠাৎ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনায় মরে যেতে চায় নাই। মহল্লার লোকেরা পরে জানতে পারে যে, বদু মওলানা এই কটি দিন তার রান্নাঘরের পাশে অন্ধকার ভাড়ার ঘরে নিজেকে লুকিয়ে রাখে। এখান থেকে বের হয়ে বদু মওলানাকে কবে প্রথম রাস্তায় নেমে আসতে দেখা গিয়েছিল তা মহল্লার লোকেরা মনে করতে পারে না, তবে তারা বলে যে, তারা যেদিন তাকে আলখাল্লা পরে রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসতে দেখে, তাদের ভয় হয়েছিল এবং এই ভয়ের কারণে তাদের একধরনের ঘৃণা হয়েছিল। তাদের মনে হয়েছিল যে, এই লোকটিকে তারা আগে কখনো যেন দেখে নাই এবং এই লোকও দেখে নাই তাদেরকে, সে জানে না যে, লক্ষ্মীবাজারের বাড়িঘর পঁচিশ তারিখের রাতের পর নয়া বাজারের আগুনের ভৌতিক লাল আভায় ডুবে ছিল এবং গুলির শব্দে মহল্লার লোকেরা দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল আতঙ্কে। তাদের মনে হয়েছিল যে, মহল্লার লোকেরা যখন ছিল বিপর্যস্ত তখন বদু মওলানা ছিল একমাত্র লোক, যে এসব কিছুর ভেতর সুস্থির ছিল। ভাড়ার ঘর থেকে বের হয়ে আসার পর রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় সে তার প্রতিবেশীদের আতঙ্কিত মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, আসসালামু আলাইকুম। তবু, এ সময় বদু মওলানাকে নিয়ে তাদের যে অনুভূতি হয় তাতে অস্পষ্টতা থাকলেও, মহল্লায় প্রথম যেদিন মিলিটারি আসে এবং বদু মওলানা আবিষ্কৃত হয়, সে দিন তারা পরিষ্কার বুঝতে পারে যে, বদু মওলানাকে দেখে তারা আগেই চিনেছিল। এর পর থেকে ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত মহল্লার লোকেরা যেন এক মড়কের ভেতর দিয়ে পার হয়ে আসে। একাত্তর সনে মহল্লার সংকীর্ণ গলিতে মোট দুবার মিলিটারি আসে। মহল্লার লোকেরা বলে যে, মহল্লায় প্রথমবার মিলিটারি আসার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বদু মওলানাকে খুঁজে বের করা; বদু মওলানা প্রথমেই হাজির হুজুর’ বলে উঠে দাঁড়িয়েছিল এবং তারপর মহল্লার লোকেরা তাকে চিনেছিল মহল্লার দণ্ডমুণ্ডের মালিকরূপে। প্রথম দিন সাতজন লোক এবং বদু মওলানার ছোট ছেলের পোষা কুকুর ভুলুকে গুলি করে মারার পর মিলিটারি চলে গিয়েছিল। সেই মিলিটারিদের নেতা, ক্যাপ্টেন ইমরান জিপে ওঠার আগে ভেবেছিল যে, তার পেশাব করা প্রয়োজন এবং সে তখন একটি ল্যাম্পপোস্টের নিচে, দেয়ালের কিনারায় পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে প্যান্টের সামনের বোতাম খুলে আয়েশ করে পেশাব করতে থাকে। এ সময় মিলিটারি সিপাইরা তাদের ট্রাকে গিয়ে ওঠে, ক্যাপ্টেনের জিপের ড্রাইভার ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে বসে থাকে; তখন, মধ্যাহ্নের রোদের ভেতর শুধু বদু মওলানা হাত দুটো নাভির নিচে বেঁধে বিনীত এবং কোমল এক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ক্যাপ্টেনের পেশাব করা দেখে। মহল্লার লোকেরা যখন সাতটি লাশ নিয়ে নিপ বসে ছিল এবং বদু মওলানার ছোট ছেলে, ভুলু নিহত হওয়ায় কাঁদছিল, তখন বদু মওলানা পেছন থেকে, দীর্ঘদেহী যুবক পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের দুপায়ের মাঝখানে তরলবিদ্যুৎ রেখার মতো একটি সাদা ধারা মাটিতে ক্রমাগতভাবে বিদ্ধ হতে দেখে। বদু মওলানার সমস্ত শ্রবণেন্দ্রিয় জুড়ে এই জল-পতনের শব্দ ছড়িয়ে থাকে এবং ক্যাপ্টেন এত আয়েশ করে এই ক্রিয়াটি সম্পাদন করে যে, মনে হচ্ছিল যেন অনন্তকাল ধরে সে এই কাজটি করে যাবে এবং বদু মওলানার চেতনা জুড়ে ক্যাপ্টেনের পেশাব করার ভোতা শব্দ একটি হালকা সঙ্গীতধ্বনির মতো তার জীবনকাল পর্যন্ত ভেসে বেড়াবে। সে সময় মহল্লায় যারা বদু মওলানাকে দেখেছিল তারা বলেছিল যে, তাদের মনে হয়েছিল, বদু মওলানা যেন একটি স্বপ্নের ভেতর দাঁড়িয়ে ছিল। ক্যাপ্টেনের পেশাব করা শেষ হলে সে বোতাম লাগিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল, তখন বদু মওলানার চোখে পড়েছিল, ক্যাপ্টেনের পেশাববিদ্ধ ক্ষতবিক্ষত জমিতে জমে আছে ফেনার রঙিন বুদ্বুদ। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর ক্যাপ্টেন, এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা বদু মওলানাকে পুনরায় শনাক্ত করে তার পিঠ চাপড়ে দিয়েছিল জিপে ওঠার আগে। বদু মওলানা তখন হেসেছিল, সে হাসি কেমন ছিল মহল্লার লোকেরা এখন তা কাউকে বলতে পারে না, তারা শুধু নিজেরা বুঝতে পারে, যারা সেদিন ক্যাপ্টেনের হাতের ছোঁয়ায় বদু মওলানার মুখে সেই হাসি উদ্ভাসিত হতে দেখেছিল। মুখের সেই হাসি নিয়ে বদু মওলানা লম্বা আলখাল্লা পরে কাঁধে স্কার্ফ ঝুলিয়ে মহল্লার রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে ছিল। মহল্লার লোকেরা পরে লক্ষ করেছিল যে, বদু মওলানা তার সেই ধূসর রঙের কামিজ আর গায় দিচ্ছিল না। তারা বলে যে, তারা মনে করেছিল, বোম লাগানোর সময় ক্যাপ্টেনের হাতে প্রস্রাব লেগে যায় এবং সে তার ভেজা হাত নিজের পকেটে রুমাল না থাকায় বদু মওলানার পিঠের কাপড়ে মোছে। কিন্তু তারা পরে জেনেছিল যে, তাকে ক্যাপ্টেন ছুঁয়েছিল এই ব্যাপারটির প্রতি সম্মান দেখানো এবং স্মৃতি ধরে রাখার জন্যই সে তার জোব্বাটি সংরক্ষণ করেছিল। বদু মওলানা ডিসেম্বর মাসে পালিয়ে যাওয়ার পর, যেদিন লোকেরা তার বাড়ির সব মালামাল এনে আজিজ পাঠানের বাসায় জড়ো করে সেদিন আজিজ পাঠানের স্ত্রী সব দেখে বলেছিল যে, শুধু একটি আলখাল্লা আর একটি কাঁধের স্কার্ফ ছাড়া সব তাদের। মহল্লার লোকেরা তখন বহুদিন পর বদু মওলানার সেই ধূসর রঙের আলখাল্লাটি দেখতে পায়, তাদের তখন মনে পড়ে যে, পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন বদু মওলানার এই কাপড়ে পেশাব মুছেছিল আর তাতে সে, সেই অপার্থিব হাসিতে উদ্ভাসিত হয়েছিল। মহল্লার লোকেরা তখন একটি লাঠির মাথায় করে বদু মওলানার আলখাল্লা এবং ওড়না মহল্লার রাস্তার মাথায় নিয়ে গিয়ে আগুন দিয়ে ভস্মীভূত করে। সেটা ছিল একাত্তর সনের ডিসেম্বর মাসের একত্রিশ তারিখ। কিন্তু দুবছর পর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হলে বদু মওলানা যখন লক্ষীবাজারে ফিরে আসে মহল্লার লোকেরা তার গায়ে পুনরায় পপলিনের ধূসর সেই আলখাল্লা দেখতে পায়, বদু মওলানার মুখের সেই হাসিটি তখন শুধু থাকে না। এবার বদু মওলানা যেন পুনরায় শূন্য থেকে শুরু করে, মহল্লার লোকেরা তাকে পুনরায় মাটির দিকে তাকিয়ে হেঁটে যেতে দেখে। ফিরে আসার পর প্রথম দিন সে মহল্লার সকলের সঙ্গে বিনীতভাবে কুশল বিনিময় করে, সে একাত্তর সনে মহল্লায় নিহত আট ব্যক্তির পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে যায়। মহল্লার লোকেরা পরে তাদের এই বিশ্বাসের কথা বলেছিল যে, এই দুঃসাহসিক কাজের দ্বারা সে আসলে সাতটি ক্ষতচিহ্ন পরীক্ষা করতে চেয়েছিল মাত্র। তখন সেই মঙ্গলবারের অপরাহ্নে আবদুল মজিদ তাদের প্রাঙ্গণের ফটকের কাছে কামিনী গাছতলায় বদু মওলানাকে বিনীতভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। কেমন আছ তোমরা? এই প্রশ্নের ভেতরকার পরিহাস এমন নিদারুণ ছিল যে, নিজের বাড়ির প্রাঙ্গণের ভেতর তা শুনে এবং বদু মওলানাকে দেখে আবদুল মজিদ বাক-রহিত হয়ে থাকে। তখন তার মা এগিয়ে এসে বদু মওলানাকে দেখে। কেমন আছেন আপনেরা? এই কুশল জিজ্ঞাসা যেন আবদুল মজিদের মায়ের সহ্যের বাইরে চলে যায়। ক্ৰদ্ধ, ক্ষিপ্ত এবং শোকার্ত এই নারী দ্রুত বারান্দা থেকে প্রাঙ্গণে নেমে এসে চিৎকার করে উঠেছিল, তাকে অভিসম্পাত দিয়েছিল এবং হাহাকার করে বলেছিল, থুক দেই, থুক দেই, থুক দেই মুখে। একইভাবে এই নারী একদিন তার কন্যার ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ দেখে হাহাকার করেছিল। তখন বদু মওলানাকে খুঁজে পাওয়া যায় নাই, সে তখন পালিয়েছিল। একাত্তর সনের ডিসেম্বরের সেই বিষণ্ণতম বিকেলে আবদুল মজিদ যখন তার বোনের মৃতদেহ কুড়িয়ে আনে, সে সেটা একটি শাড়ি দিয়ে জড়িয়ে এনেছিল। মমামেনার দেহ আবদুল মজিদ বস্ত্রহীন দেখেছিল, আর দেখে তার মা, মেয়ের ছিন্নভিন্ন দেহ দেখে আবদুল মজিদের মায়ের কান্না জমে গিয়েছিল। মেয়েকে সে সেদিন শেষ গোসল করাতে দেয় নাই এবং কাফন ছাড়া, পরনের শাড়িতে জড়িয়ে তাকে দাফন করতে মহল্লার লোকদের বাধ্য করেছিল। স্বলিত চেতনার প্রান্ত থেকে বিভ্রমের প্রলাপের মতো মহল্লার সকলকে সে এই কথা বলেছিল যে, সে তার মেয়ের লাশ এ রকম রক্ত-মাখা এবং কাফনহীন অবস্থায় হাসরের মাঠে আল্লাহর আরশের সামনে নিয়ে গিয়ে হাজির করবে। বারান্দায় চৌকির ওপর শোয়ানো মৃত মোমেনার কাত হয়ে থাকা মুখে সে আদর করেছিল, রক্ত ও ধুলো জমা ঠোঁটে চুমো খেয়েছিল, আধ-বোজা চোখের দিকে তাকিয়ে হাহাকার করেছিল, মা রে, মা রে, মা রে। তখন মহল্লার সব লোক কামিনী গাছতলায় দাঁড়িয়ে চোখ আনত করে রেখেছিল, মহল্লার সব রমণী এবং শিশু ডুকরে কেঁদে উঠেছিল, তাবৎ বৃক্ষ শোকার্ত হয়েছিল। মহল্লার লোকেরা আবার এক মঙ্গলবারের হিমেল অপরাহ্নে আবদুল মজিদের মায়ের হাহাকার শুনতে পায়, থুক দেই, থুক দেই, থুক দেই মুখে। লক্ষ্মীবাজারের লোকেরা জানতে পারে আবদুল মজিদের মা কেন আবার হাহাকার করে; মহল্লায় আর এক বদু মওলানা প্রকাশিত হয়। মৃত খাজা আহমেদ আলী এবং খাজা শফিকের বিধবা স্ত্রীরা, আলাউদ্দিনের মা, পুত্রহারা আবু করিম এবং আরো তিনজন পুরুষ ও রমণী সেই শীতের মঙ্গলবারে তাদের বাড়ির প্রাঙ্গণের ভেতর বদু মওলানাকে দণ্ডায়মান দেখে স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। মহল্লার লোকেরা জানতে পারে যে, বদু মওলানাকে দেখে খাজা আহমেদ আলীর বিধবা স্ত্রী এবং খাজা শফিকের মা দ্রুত নেমে এসে বদু মওলানাকে প্রাঙ্গণের গভীরে প্রবিষ্ট হওয়া থেকে আটকায়। তখন মহল্লায় যারা ছিল, তারা শুনতে পেয়েছিল একটি নারী কণ্ঠে উচ্চারিত হুঁশিয়ার ধ্বনি, খবরদার, খবরদার! তখন জয়নব বেগমকে যারা দেখেছিল তারা পরে বলে যে, উত্তোলিত হাতে তসবির মালা ঝোলানো জয়নব বেগমকে দেখে মনে হয়েছিল যেন সে তার প্রাঙ্গণে আযাযিলের পুনঃপ্রবেশ রোধ করতে চাচ্ছিল এবং তার চোখের আগুন দেখে বদু মওলানা একটিও কথা না বলে সেই উঠোন ছেড়ে একটি অপছায়ার মতো দ্রুত অপসৃত হয়েছিল। মহল্লার লোকেরা আলাউদ্দিনের মা এবং আবু করিমের স্ত্রীর কথাও শুনেছিল। তারা জানতে পারে যে, বদু মওলানাকে জানালা দিয়ে আঙিনায় দাঁড়ানো দেখে আবু করিমের স্ত্রী রান্নাঘরের ছড়ানো-ছিটানো তৈজসপত্রের ওপর মূৰ্ছিত হয়ে পড়ে। মূৰ্ছা যাওয়া এই স্ত্রীলোকটিকে নিয়ে বাড়িতে হাঁকডাক পড়ে গেলে বদু মওলানা সে স্থান ত্যাগ করে আসে। আর তারা জানতে পারে যে, বদু মওলানা মৃত আলাউদ্দিনদের বাসায় বাইরের প্রাঙ্গণে কাউকে না পেয়ে গলি দিয়ে ভেতরের উঠোনে পৌঁছেই বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আলাউদ্দিনের মা, কুয়োতলা থেকে থালাবাসন ধুয়ে ঘরে আসার মুখে বদু মওলানা সামনে পড়ে গেলে, হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। মহল্লার লোকেরা জানতে পারে যে, আলাউদ্দিনের মা হাতের বাসনকোসন বদু মওলানার মুখের ওপর ছুড়ে মারে। পরে পাশের বাড়ির একজন লোক, যে ব্যাপারটি দেখেছিল, বলে যে, সে তাদের ছাদে দাঁড়িয়ে থাকার সময় আলাউদ্দিনদের বাড়ির গলির ভেতর থেকে তাড়া খাওয়া শৃগালের মতো একটি লোককে ছুটে বেরিয়ে উঠোনের ফটক পার হয়ে পলায়ন করতে দেখে। সে বলে যে, লোকটি ছিল বদু মওলানা এবং বদু মওলানার পেছন পেছন সে খড়ির চুলোর ফুকনি হাতে মৃত আলাউদ্দিনের রণচণ্ডীবেশী মাকে ছুটে আসতে দেখে। সে আরো বলে যে, ছুটে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ফটকের চৌকাটে লেগে বদু মওলানা আছড়ে পড়ে আর তখন পশ্চাদ্ধাবনকারিণী তার লোহার ফুকনি ছুড়ে মারে। সেদিন অপরাহ্নে যারা মহল্লায় ছিল না তারা পরে গভীর রাত পর্যন্ত জেগে বিশদ শুনেছিল তাদের কাছ থেকে, যারা ঘটনাগুলো চাক্ষুষ করেছিল অথবা অন্য কারো কাছ থেকে শুনেছিল। সে রাতে লক্ষ্মীবাজারের লোকদের ঘুম আসে নাই বলে পরদিন সকালে তারা একে অন্যকে বলেছিল। তারা বলেছিল যে, সে দিন রাতে তাদের স্ত্রীরা স্খলিত শয্যায় শোকার্ত রমণীর মতো পড়ে ছিল এবং তারা অস্থিরতার এক প্রবল প্রবাহে উডডীন হয়েছিল। সেই সকালে মহল্লার লোকেরা বদু মওলানাকে হেঁটে আসতে দেখেছিল, শুনেছিল ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলতে। কিন্তু মহল্লার লোকেরা প্রত্যুত্তর দেয় নাই, তাদের মনে হয়েছিল যে, তাদের রাতজাগা শরীর এই কাজ করতে চায় না; তাদের মুখ এবং জিহ্বার বদু মওলানাকে প্রত্যাভিবাদন করার আগ্রহ নাই। তারা দেখেছিল যে, বদু মওলানার নাকের কাছে ফুলে আছে এবং সে খুঁড়িয়ে হাঁটে। তারা তাকে দেখে প্রথম ভেবেছিল যে, সে হয়তো ফজরের নামাজ শেষে মসজিদ থেকে ফিরছিল, কিন্তু পরে তারা জানতে পারে যে, সে সেই ভোরে ফিরছিল আজিজ পাঠানের বাসা থেকে। তারা জেনেছিল যে, আগের দিন সন্ধ্যায় আলাউদ্দিনের মায়ের তাড়া খেয়ে সে ছুটে গিয়েছিল আজিজ পাঠানের বাসায়। কিন্তু তখন পাঠান বাসায় না থাকায় খুব ভোরে সে আবার যায়। লুঙ্গি এবং স্যান্ডো গেঞ্জির ওপর চাদর জড়িয়ে আজিজ পাঠান যখন দাঁত ব্রাশ করতে করতে বাইরের ঘরে আসে তখন বদু মওলানা অপরাধীর মতো দাঁড়িয়েছিল; তার পরস্পরকে আঁকড়ে থাকা হাত দুটো ছিল সামনের দিকে তলপেটের নিচে ঝোলানো, আর দৃষ্টি ছিল পাঠানের ঘরের চামড়া ওঠা, চল্টানো পাকা মেঝের ওপর। মহল্লার লোকেরা পরে শুনেছিল যে, বদু মওলানা একটি কথাও আজিজ পাঠানোর সামনে উচ্চারণ করে নাই, সে শুধু দাঁড়িয়েছিল নিশ্রুপ এবং বাঁকা হয়ে। আজিজ পাঠান ব্রাশ দিয়ে দাঁত ঘষছিল আর বারে বারে জানালা দিয়ে রক্ত আর লালা মাখানো পেস্টের থোকা থোকা আবিল ফেনা ফেলছিল। সে মুখের ভেতর জড়ো হয়ে আসা লালা আর ফেনা মেঝেয় পড়ে যাওয়া রোধ করতে করতে ভাঙা ভাঙাভাবে বদু মওলানাকে এবার ভালো হয়ে যেতে বলেছিল, সে বলেছিল যে, তার নেতা যেহেতু বদু মওলানাদের মাফ করেছে, তার নিজের কোনো প্রতিহিংসা নাই। মহল্লার লোকেরা জেনেছিল যে, তার এ কথায় বদু মওলানার চোখ দিয়ে পানি ঝরে পড়েছিল মেঝের ওপর এবং সেদিকে তাকিয়ে ব্ৰিত আজিজ পাঠান বলেছিল, কাইন্দেন না, কাইন্দেন না। মহল্লার লোকেরা আরো একটি কথা জানতে পেরেছিল, তা হলো, যে মঙ্গলবার রাতে তাদের নিদ্রাহীন কাটে সে রাতে মহল্লায় শুধু আজিজ পাঠান ঘুমিয়েছিল। মঙ্গলবার অপরাহ্নে বাসায় না থাকায় মহল্লার সাত জন নারী পুরুষের হাহাকার সে শুনতে পায় নাই। অনেক রাতে ক্লান্ত দেহে বাড়ি ফিরে সে ঘুমিয়ে থাকে। সকালে বদু মওলানাকে দেখে সে বিচলিত হয়, তার নীরব বিষণ্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারে না। তার মনে পড়ে, বিজয়ের পর মহল্লায় ফিরে সে জেনেছিল মহল্লায় সাত জনের নিহত হওয়ার কথা, দেখেছিল বিধবা এবং সন্তানহারা নরনারীর ম্লান মুখ, খাজা আহমেদ আলীর বাড়ির উঠোনের জোড়া কবর এবং মহল্লার রাস্তার মাথায় জনতার বদু মওলানার কুর্তা পোড়ানোর উৎসব। সে সময় আজিজ পাঠানের, নিজের লুণ্ঠিত বাড়িটির চেহারাও মনে পড়েছিল। কিন্তু ব্রাশের ঘায়ে মাড়ি ক্ষতবিক্ষত করে, বদু মওলানার দিকে তাকিয়ে তার মনে হয় যে, একাত্তরের মার্চের পঁচিশ তারিখের আগেও বদু মওলানা এ রকমই ছিল, বিষণ্ণ ও নতমুখ এবং মহল্লার লোকেরা জেনেছিল যে, যে মঙ্গলবার বিকেলে মোমেনার মার হাহাকার শোনা গিয়েছিল, থুক দেই মুখে তার পরদিন সকালে আজিজ পাঠান ক্রন্দনরত বদু মওলানাকে বলেছিল কাইন্দেন না মওলানা, কাইন্দেন না। কিন্তু তারপর বদু মওলানা যখন সকলের সম্মুখ দিয়ে স্লামালেকুম’ বলে হেঁটে গিয়েছিল তখন মহল্লার লোকেরা নির্বিকার থাকে, কারণ তখন তাদের অদ্ৰিাপীড়িত চেতনায় মোমেনার মার আগের দিনের চিত্বর জেগে ছিল, তবে তখন মহল্লার লোকের এই আচরণে বদু মওলানা আর বিচলিত হয় না। আজিজ পাঠানের বাড়িতে বদু মওলানার অশ্রুপাতের কাহিনী মহল্লায় প্রচারিত হয়ে পড়লে মহল্লার লোকেরা সে বিষয়ে তার নিজের বক্তব্য শুনতে পায়। মহল্লার লোকেরা জানতে পারে যে, বদু মওলানা এই কথা বলে যে, একমাত্র মানী লোক-ই মানীর সম্মান রাখতে জানে। বালক-বালিকাদের স্কুলের গল্পের বই থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে সে বলে যে, বীর রাজা পুরুর মতো সে বিজয়ী আলেকজান্ডারের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং সে দেখেছিল যে, আলেকজান্ডাররা সব সময় পুরুদের সঙ্গে একই ব্যবহারই করে; কারণ, একমাত্র বীরই চিনতে পারে বীরের লক্ষণ সকল। বদু মওলানার এইসব কথা মহল্লার লোকেরা বুঝতে পারে না। তাদের অনেকে পুরু রাজা কিংবা আলেকজান্ডারকে চিনতে পারে না, বুঝতে পারে না বদু মওলানার বীরত্ব কোথায়। তারা বদু মওলানার এইসব কথাবার্তা ভুলে যায়। কিন্তু আবদুল মজিদ দীর্ঘদিন পর আলেকজান্ডার আর পুরু রাজার ব্যবহারের তাৎপর্য পুনরায় উপলব্ধি করে এবং নিজেকে এক সংকটাপন্ন অবস্থায় দেখতে পায়। হরতালের পর যেদিন সব পক্ষই মহল্লার লোকদের ভাইসব’ বলে সম্বোধন করে ধন্যবাদ দেয় এবং যেদিন বাজারে যাওয়ার পথে আবদুল মজিদের স্যান্ডেলের ফিতে ফট করে ছিঁড়ে যায় তার পরদিন সে আজিজ পাঠানকে এক মুহূর্তের জন্য রাস্তায় পায়; তখন দুএকটি কথার ভেতর সে তাকে এ-ও বলে যে, বদু মওলানারা এখন তাদেরকে ভাইসব’ বলে ডাকে এবং হরতাল করার জন্য ধন্যবাদ দেয়। এই কথা শুনে তখন আজিজ পাঠান যেন তার মর্মস্থল দেখতে পায় এবং সে বিষণ্ণভাবে হেসে আবদুল মজিদের কাঁধের ওপর প্রাচীন বৃক্ষ শাখার মতো তার শিরা-ওঠা হাত রাখে। সে তাকে বাসায় নিয়ে যায় বহুদিন পর এবং তার সঙ্গে এত কথা বলে যে, আবদুল মজিদ তার প্রায় কিছুই বুঝতে পারে না, শুধুমাত্র একটি কথা ছাড়া, তা হচ্ছে এই যে, রাজনীতিতে চিরদিনের বন্ধু অথবা চিরদিনের শত্রু বলে কিছু তো নেই, কাজেই অতীত ভুলে যাওয়া ছাড়া আর কিইবা করার থাকে মানুষের। কিন্তু, ক্রমাগতভাবে অতীত ভুলে যাওয়া লক্ষ্মীবাজারের লোকেরা দেখে যে, তাদের অতীত যেন অনবরত ঘাসের অঙ্কুরের মতো মাটি ভেদ করে উঠে আসে। তারা এখন এই সত্যটি ভুলে থাকে যে, মসজিদে জমায়েত হওয়ার এই অধিকারও চিরন্তন নয়; কারণ একাত্তরের ছাব্বিশে মার্চ সকালে যখন তারা দেখেছিল নয়াবাজারের লাল আগুন আকাশ থেকে একটি পর্দার মতো ঝুলে আছে এবং তারা আতঙ্কিত জল্পর মতো ভেবেছিল পালাতে হবে, সেই শুক্রবারে মসজিদে কোনো মুয়াজ্জিনের কণ্ঠ ধ্বনিত হয় নাই, সেদিন কারফুর ভেতর জুমার নামাজ কেউ পড়ে নাই। অবস্থা তো তখন এমন হয়েছিল যে, প্রতিনিয়তই তাদের মুখে আল্লাহর নাম ধ্বনিত হয়েছিল এবং তারা ‘আল্লাহ’ ‘আল্লাহ’ করতে করতে মহল্লা ছেড়ে পালিয়েছিল। তারপর আবার তাড়া খাওয়া ইদুরের মতো সকলেই ফিরে এসেছিল মহল্লায়। তারা কে কোথায় পালাতে চেয়েছিল তা নিয়ে তাদের আলোচনা হয় নাই, তারা শুধু এই সত্যটি জেনেছিল যে, পালানোর কোনো পথ এবং স্থান ছিল না দেশে। সেই সময় তারা বদু মওলানাকে দেখেছিল হেঁটে আসতে; সে তাদেরকে বলেছিল যে, তাদের কোনো ভয় নাই, আল্লাহ মুসলমানদের রক্ষা করবেন, এবং তারপর মহল্লায় সে কাক ওড়াতে শুরু করেছিল। তারপর মহল্লায় যেদিন প্রথম পাকিস্তানি মিলিটারি আসে, বদু মওলানা সালাম দিয়ে দাঁড়ায় এবং তারা সাত জন লোককে গুলি করে মারে। পাকিস্তানি মিলিটারির ক্যাপ্টেন আয়েশ করে প্রস্রাব করে তার সৈন্যদের নিয়ে চলে যাওয়ার পর তখন সেখানে দণ্ডায়মান বদু মওলানা তার সেই স্মিত হাসিটিকে বিকশিত হতে দেয় এবং সে মহল্লার বাড়িঘরের দিকে ঘুরে তাকায়। মহল্লার লোকেরা তখন যারা তাকে দেখেছিল তাদের মনে হয় যেন কোনো ব্যাখ্যাতীত বায়ুচারিতার কারণে বদু মওলানার দেহ সম্প্রসারমাণ হয়ে ওঠে এবং মহল্লার কৃষ্ণতম দিনটিতে কাকতাড়ুয়ার মতো আকাশের দিকে মুখ করে ঝুলে থাকে। কিন্তু যখন সে শোনে যে, মহল্লার লোকেরা বলে, খাজা আহমেদ আলীর দেয়া আজান তারা শুনতে পেয়েছিল এবং তিনি তার আজান সমাপ্ত করেছিলেন, সে চিৎকার করে ওঠে এবং অন্ধকার রাতে কারফুর ভেতর তার হাঁকডাক শোনা যায়। বদু মওলানা মহল্লার লোকদের বলে যে, তারা নিশ্চয়ই জানে খাজা আহমেদ আলী একজন মুনাফেক ছিল। কিন্তু মহল্লার লোকেরা এ রকম কিছু স্মরণ করতে ব্যর্থ হলে বদু মওলানা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। সকালে খাজা আহমেদ আলী আর তার ছেলেকে বাড়ির উঠোনে দাফন করার সময় মহল্লার লোকেরা যখন বলে যে, খাজা আহমেদ আলী আজান সমাপ্ত করেছিলেন এবং তিনি আজানের শেষে চারবার উচ্চারণ করেছিলেন ‘আল্লাহই শ্রেষ্ঠ’ তখন বদু মওলানা তাদেরকে মূর্তিপূজক কাফের বলে গাল দেয় এবং বলে যে, খাজা আহমেদ আলী কোনো ফেরেশতা ছিল না, সে নিশ্চিতরূপেই আজান দেয়া সমাপ্ত করে নাই। কারণ তাকে যখন ছাদের ওপর গুলি করে মারা হয় তখন সে সিঁড়ির ওপর ছিল এবং সে গুলির শব্দের সঙ্গে সঙ্গে আজান বন্ধ হয়ে যেতে শুনেছিল। কিন্তু মহল্লার লোকেরা তার কথা গ্রহণ করে না, তারা বলে যে, তাদের মনে হয়েছিল একমাত্র কিন্নরকণ্ঠ বেলালের দেয়া আজানই এমন মধুর হতে পারে। তাদের এ কথা শুনে বদু মওলানা চলে যায় এবং সে যখন পুনরায় ফিরে আসে তখন লোকেরা কবরে মাটি চাপা দেয়া শেষ করে দাঁড়িয়েছে। তারা দেখে, বদু মওলানার চাকরেরা হৈ হৈ করতে করতে ভুলুর মৃতদেহ বয়ে আনে। তাদের মনে পড়ে, তারা সেদিন বদু মওলানার চোখে সাপের চেয়েও ভয়াবহ এক দৃষ্টি দেখেছিল এবং তারা তার দিকে তাকিয়ে নীরব নিশ্চল হয়ে ছিল। বদু মওলানার লোকেরা ধপাধপ করে মাটি খুঁড়ে খাজা আহমেদ আলীর বাড়ির উঠোনে, তার আর তার ছেলের কবরের পাশে কুকুরের মৃতদেহটি কবর দেয় এবং তারপর মহল্লার আতঙ্কিত লোকদের দিকে তাকিয়ে সে বলে, এই কবরে কোনো পীর নাই, কুত্তা আছে। তখন বদু মওলানার মুখের দিকে তাকিয়ে মহল্লার লোকদের মনে হয়েছিল যে, বদু মওলানাকে কিছু বলার জন্য তাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু কালক্রমে তারা দেখতে পায় যে, বদু মওলানাকে তাদের কিছুই আর কোনোদিন বলা হয় না; বরং বদু মওলানা পুনরায় তাদেরকে বলতে শুরু করে। মহল্লার লোকেরা খাজা আহমেদ আলীকে দাফন করার দিন এটা বুঝতে পেয়েছিল যে, তার প্রতি তাদের সম্মানবোধের ওপর বদু মওলানা ঘৃণিত এক কুকুরের লাশ চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু উনিশ শ আশি সনে মহল্লার লোকেরা জেনেছিল যে, এই কুকুরের মৃতদেহ বদু মওলানার কাছে প্রিয় ছিল সাতটি মানুষের লাশের চাইতে। ভিক্টোরিয়া পার্কের সভায় দাড়িয়ে সেদিন বদু মওলানা বলে যে, তার পুত্রের মৃত্যুর কথা বাদ দিলে একাত্তর সনে দুটো দুঃখজনক মৃত্যু সে দেখেছিল; বস্তুত সে একটি মৃত্যু দেখেছিল, সেটা ছিল তার প্রিয় পুত্রের কুকুর ভুলুর মৃত্যু। ভুলুর মৃত্যুতে সে মনে বেদনা অনুভব করেছিল। অপর মৃত্যুটি সে সংঘটিত হতে দেখে নাই; সে পরে শুনেছিল। সেটা ছিল রাজাকার আবদুল গণির মৃত্যু। বদু মওলানা অঙ্গুলিনির্দেশ করে শ্রোতাদের সেই বেঞ্চটি দেখিয়ে দেয় এবং বলে যে, যারা তখন ওই বেঞ্চের ওপর বসেছিল তারা জানে না, ওই বেঞ্চের ওপর আবদুল গণি শহীদ হয়েছিল, বদু মওলানার কথা শুনে লক্ষ্মীবাজার এবং কলতাবাজারের, পটুয়াটুিলি এবং আরমানিটোলার লোকদের, যারা তার কথা শুনছিল, মনে হয়েছিল যে, সে হয়তো অন্য কোনো আবদুল গণির কথা বলছে। তাদের মনে হওয়া সত্ত্বেও, তারা বুঝতে পেরেছিল যে, এটা সেই অবিদুল গণিই, যে ভিটাকোলার স্ট্র চুষতে চুষতে একুশ জন নিখোঁজ ব্যক্তিকে মৃত বলে শনাক্ত করেছিল এবং এই সব মহল্লার লোকেরা শোকার্ত মিছিল করে গিয়ে খ্রিষ্টানদের কবরস্থানের পাশ থেকে খুঁড়ে তুলেছিল ছাপ্পান্নটি মাথার খুলি। কলাপাতার ওপর সাজিয়ে রাখা খুলিগুলোর দিকে তাকিয়ে ক্রুদ্ধ জনতার তখন আবদুল গণির কথা মনে পড়েছিল। তাদের শোকার্ত ক্রোধ জ্বলে উঠেছিল এবং তারা তখন খ্রিষ্টানদের কবরস্থান ছেড়ে ভিক্টোরিয়া পার্কের দিকে চতুর্দিক দিয়ে ধাবিত হয়েছিল। তারা যখন ভিক্টোরিয়া পার্কে পৌছয়, তারা দেখে যে, আবদুল গণির ছিন্ন মাথা ধুলোয় পড়ে আছে। আবদুল গণিকে কে হত্যা করেছিল লোকেরা তা জানতে পারে না, তবে তারা বুঝতে পারে যে, আবদুল গণি যাদেরকে নিহত বলে শনাক্ত করেছিল, সেই একুশ জনের যেকোনো আত্মীয় হত্যা করে থাকতে পারে; নয়াবাজারের ভস্মীভূত জনপদের যে-কেউ অথবা লক্ষ্মীবাজার, কলতাবাজার, পাটুয়াটুলি, ইংলিশ রোড, নারিন্দায় ন মাস যাবৎ মৃত্যুর মুখোমুখি বসবাসকারী যে কেউ হত্যা করে থাকতে পারে। জনতার মনে আবদুল গণির নিহত হওয়া নিয়ে কোনো বিস্ময় হয় না। তারা দড়ি খুলে আবদুল গণির ধড় বেঞ্চের ওপর থেকে একটি চাটাইয়ের ওপর নামিয়ে রাখে, রক্ত লেগে থাকা ভিটাকোলার বোতল এবং ছিন্ন মস্তক একখানে করে, মাটিতে জমা গাঢ় লাল রক্তের প্রতিটি বিন্দু ঘাস এবং মাটিসহ খুঁড়ে তোলে। তারপর জনতা একটিন ব্লিচিং পাউডার নিয়ে আসে, আবদুল গণির রক্ত লেগে যাওয়া বেঞ্চ এবং মাটিতে পাউডার ছড়িয়ে সবকিছু পরিশুদ্ধ করে।