মহল্লার লোকেরা বলে যে, মোহাম্মদ সেলিমের জন্য তার মা প্রতীক্ষা করে আছে, আর আছে মায়ারাণী মালাকার। কিন্তু আবদুল মজিদ জানে যে, মায়ারাণী মোহাম্মদ সেলিমের জন্য প্রতীক্ষা করে না, সে অবশ্য জানে না মায়ারাণী তবে কার প্রতীক্ষা করে এবং কেন ক্রমাগতভাবে কুমারী থেকে যায়। আবদুল মজিদ নিশ্চিতভাবেই জানে, যুদ্ধের পর মোহাম্মদ সেলিমের প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা যখন শেষ হয়ে যায় তখন তার বাক্স ভেঙে মায়ারাণীর লেখা যে একটিমাত্র চিরকুট পাওয়া যায়, সেটা মায়ারাণী লেখে নাই। একমাত্র আবদুল মজিদ এই দুর্ভাগ্যজনক তথ্যটি জানে যে, মোহাম্মদ সেলিমের একুশটি প্রেমপত্রের উত্তরে এক লাইনের যে পত্রটি তার হস্তগত হয়েছিল সেটা আসলে মায়ারাণীর লেখা ছিল না। আবদুল মজিদ পারিবারিক ঝামেলায় নিমজ্জিত হয়ে না থাকলে শোনে, শনিবার সন্ধেয় মায়ারাণী শনিপুজো করে। তার বিষ কণ্ঠ পাশের বাড়ি থেকে দেয়ালের ওপর দিয়ে এমন এক বাউলসঙ্গীতের মতো ভেসে আসে, যার অর্থ সে বোঝে না। শনিবারের সন্ধেয় মায়ারাণী বিষণ্ণ স্তোত্রের মতো উচ্চারণ করে আসেন শনি বসেন খাটে, পস্সাদ দেব হাতে হাতে। আবদুল মজিদ বুঝতে পারে না মায়ারাণী কেন শনিকে ডাকে, তবে তার মনে হয় এই অনন্ত আহ্বানে তার কোনো আনন্দ নেই, তার কণ্ঠে শুধু বিষণ্ণতা। আবদুল মজিদের মনে পড়ে, মায়ারাণীর মায়ের কণ্ঠে এমন বিষণ্ণতার ঘোর ছিল না। সে সময়, সে যখন হাফপ্যান্ট পরত, তখন, শনিবার সন্ধেয় সে দুবাড়ির মাঝখানের দেয়ালের ওপর চড়ে বসে থাকত। তখন মায়ারাণীর মা আসত মাথায় ঘোমটা টেনে, কপালে থাকত পূর্ণিমার চাঁদের মতো বড় এবং গোল সিঁদুরের টিপ। মায়ারাণীর মা কাঁসার থালার ওপর সরষের তেলের প্রদীপ জ্বালিয়ে ফটকের কাছে তুলসী গাছের কাছে এসে বসত এবং একইভাবে শনিকে ডাকত। তুলসী গাছের গোড়ায় বাঁধানো নিচু বেদির ওপর রাখা প্রদীপ জ্বলত, আদুল মজিদ শুনত মায়ারাণীর মার শনি-আবাহন–আসেন শনি বসেন খাটে, পদদ দেব হাতে হাতে। এভাবে পুজো হয় গেলে, মায়ারাণী হাতে করে একটি বড় বাটি নিয়ে আসত এবং প্রাঙ্গণে অপেক্ষমাণ বালক-বালিকা ও দেয়ালের ওপর বসে থাকা আবদুল মজিদের প্রসারিত করতলের ওপর কলা ও দুধ মাখানো ভিজে চিড়ার একটি করে মণ্ড অর্পণ করত। আবদুল মজিদের এখন কখনো কখনো মনে হয়, হাত পাতলে একইভাবে তার হাতে প্রসাদ তুলে দেবে কালো এবং বোকাটে চেহারার মায়ারাণী। মোহাম্মদ সেলিম কেন এই কালো মেয়েটিকে দেখে বিমোহিত হয়েছিল তা আবদুল মজিদ বুঝতে পারে না, তবে তার মনে হয়, মোহাম্মদ সেলিমের যে রকম প্রাণপ্রাচুর্য ছিল তাতে তার পক্ষে কালো মায়ারাণীর প্রেমে পড়া এবং সেই প্রেম ত্যাগ করে যুদ্ধে যাওয়া সম্ভব ছিল। মায়ারাণী তখন বাংলাবাজার স্কুলে দুবার ফেল করার পর তৃতীয়বার ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল, সেই সময় মোহাম্মদ সেলিম পুষ্পশরে বিদ্ধ হয়ে বেপথু হয়ে পড়ে। মহল্লার লোকেরা কয়েক দিন মোহাম্মদ সেলিমের অস্বাভাবিক ব্যবহার অবলোকন করেছিল, তারা খেয়াল করেছিল মোহাম্মদ সেলিম, মায়ারাণী রাস্তায় বের হলে তার পিছনে ধীরগতিতে এলেবেলেভাবে সাইকেল চালাতে থাকে অথবা রাস্তার মোড়ে চুলে টেরি কেটে দাঁড়িয়ে থাকে হাঁ-করে। তারা এ-ও খেয়াল করেছিল যে, মোহাম্মদ সেলিমের এই উত্তেজনার প্রতি মায়ারাণীর লক্ষ ছিল না, সে বুকের ওপর বই চেপে ধরে রাস্তার দিকে তাকিয়ে হেঁটে যেত। মোহাম্মদ সেলিমের প্রণয় উত্তেজনায় মহল্লার লোকেরা বিরক্ত হয়ে ওঠার আগেই তারা লক্ষ করে যে, তার উত্তেজনা নেমে গেছে। আসলে তখন মোহাম্মদ সেলিম এই সত্যটি আবিষ্কার করে যে, আবদুল মজিদ প্রতি শনিবারে মায়ারাণীর নিজ হাতে তুলে দেয়া দুধ-কলার প্রসাদ খায় এবং সে মায়ারাণীকে প্রেম নিবেদনের পন্থা বদলে ফেলে। তখন তার তৎপরতা লোকচক্ষুর অন্তরাল হয়ে যায়। সে আবদুল মাজিদকে ডেকে নিয়ে গিয়ে তার পিতার কনফেকশনারির দোকানের বয়াম খুলে তার হাত ভরে লাড্ড বিস্কুট দেয় এবং বলে, ল, খা। আবদুল মজিদের এখন মনে হয়, সে নির্বোধের মতো লাড়ু বিস্কুট খেয়েছিল, কারণ তার পরদিনই মোহাম্মদ সেলিম তাকে একটি চিঠি দেয় মায়ারাণীকে পৌঁছে দেয়ার জন্য। আবদুল মজিদ এবারও নির্বোধের মতো সেটা নিয়ে যায় মায়ারাণীর কাছে এবং মায়ারাণী তাদের শেফালি ফুলগাছ তলায় দাড়িয়ে সেটা নিতে অস্বীকার করলে আবদুল মজিদ চিঠিটা এনে তাদের ঘরের ভেতর ইট খসানো একটি ফোকরের ভেতর রেখে দেয়। এভাবে, মোহাম্মদ সেলিমের ইন্টারমিডিয়েট ফাইনাল পরীক্ষার আগে যখন যুদ্ধ লেগে যায় এবং সে মায়ারাণীকে রেখে যুদ্ধে চলে যায়, তখন পর্যন্ত আবদুল মজিদদের বাড়ির দেয়ালের ফোকরে একুশটি চিঠি জমা হয়। আবদুল মজিদের পরবর্তী সময়ে মনে হতো যে, মোহাম্মদ সেলিমের ভালোবাসা পাওয়া উচিত ছিল, মায়ারাণীর উচিত ছিল এটুকু তাকে দেয়া; কারণ সে তো ছিল তাদেরই একজনের মতো, যারা একদিন শরীরে যুদ্ধের ক্লান্তি এবং বারুদের গন্ধ নিয়ে এসে মহল্লায় দাঁড়িয়েছিল আর তখন আলাউদ্দিনের মা এতদিন পর ধুলোয় বিছিয়ে পড়ে কান্নার উৎসব করেছিল। আর যেদিন খাজা আহমেদ আলীর উঠোনে পুরনো মাদুর এবং চাটাইয়ের ওপর আলাউদ্দিনের লাশ অন্য ছটি লাশের সঙ্গে রাখা ছিল সেদিন তার মা চুপ করে বসে ছিল, ভীত মূঢ় জন্তুর মতো। সেদিন মহল্লায় শুধু আবুল বাশার কেঁদেছিল। সেই কান্নার শব্দ একবার শোনার পর মহল্লার লোকদের মনে হয়েছিল যেন সে রাতে আবুল বাশারের কান্না সকাল পর্যন্ত শোনা গিয়েছিল। এই বালকটি যে বদু মওলানার খুব প্রিয় সন্তান ছিল, মহল্লার সকলে তা জানত। এই কারণেই হারাম জীবপোয় ছেলের ইচ্ছেয় সে সম্মত হয়েছিল এবং ফলে এই কুকুরের জন্য শোক করার অনুমতি দেয়ায় তার হৃদয় আপুত হয়, পুত্র, পুত্রের কুকুর এবং সেই পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের জন্য। কিন্তু একাত্তর সনের উত্থান-পতনের কারণে বদু মওলানা কালক্রমে তার এই ছেলেটিকে হারায়; তার আর কোনো বড় ক্ষতি হয় না। এই একটি মৃত্যু ছাড়া সে তার পরিবারকে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া-বিষয়ক তার যে দুর্যোগ হয় সেই অবস্থার ভেতর দিয়ে পার করে নিয়ে আসে এবং আশি সনে সেই একই দলের বড় নেতা হয়। আবদুল মজিদ এখন দেখে আজিজ পাঠানদের সঙ্গে বদু মওলানার দল একসঙ্গে সরকারবিরোধী আন্দোলন করে। আবদুল মজিদ শোনে মহল্লার মানুষকে বদু মওলানা এবং তার ছেলেরা ‘ভাইসব’ বলে সম্বোধন করে সংগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য ডাক দেয়। শুনে আবদুল মজিদের স্যান্ডেলের ফিতে ফট করে ছিঁড়ে যায়; সে দেখে, বদু মওলানার ছেলের আলখাল্লার ভেতর থেকে কাক ওড়ে। সে ঘরে ফিরে এসে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, সে তার মৃত বোনের কথা ভুলে যেতে পারে না; তার ঘাড়ের পাশে বেয়োনেটের ক্ষত ছিল, বুকের নিচ থেকে ছিন্নভিন্ন ছিল এবং দেশ যখন মুক্তি প্রক্রিয়ার শেষ সীমানার নিকটে পৌঁছেছিল তখন সে রায়েরবাজারে একটি মাঠের ওপর আকাশের দিকে স্থির চোখ রেখে পড়ে ছিল। আবদুল মজিদ বদু মওলানার সেই সব দিনের কথা ভুলতে পারে না, কারণ সে মোমেনার কথা ভুলতে পারে না। সে নবাবপুর রোডের ওপর মাইকে বদু মওলানার ছেলের দেয়া ধন্যবাদের মুখোমুখি হয়ে ঘরে ফিরে ইয়াসমিনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে এবং তখন মহল্লার ভেতর আবার মাইকের শব্দ বিকশিত হয়। এই লোকটিও তাদেরকে ভাইসব’ বলে সম্বোধন করে হরতাল সফল করার জন্য ধন্যবাদ প্রদান করে। জয় বাংলা’ বলে সে এই বিবৃতি শেষ করে, তারপর আবার ‘ভাইসব’ বলে শুরু করে। মহল্লার লোকেরা বিভ্রান্ত বোধ করে। তাদের এই কথাটি হয়তো অকারণেই মনে পড়ে যে, যেদিন বদু মওলানা তার কালো চেকের স্কার্ফটা কাধে ফেলে এগিয়ে এসে পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের সম্মুখে দাঁড়ায়, সেদিন মহল্লায় আজিজ পাঠান অনুপস্থিত ছিল। আবার সে বছরের ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে সে যখন মহল্লায় সপরিবারে প্রত্যাবর্তন করে তখন মহল্লায় বদু মওলানা ছিল না। মহল্লার লোকদের মনে পড়ে, মহল্লায় যেদিন প্রথম মিলিটারি আসে, বদু মওলানা তাদেরকে আজিজ পাঠানের বাড়িতে নিয়ে যায়। মিলিটারি আজিজ পাঠানের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। তার বাড়ির গেটে নৌকো দিয়ে তৈরি তোরণে একজন মিলিটারি শালা’ বলে গাল দিয়ে একঝাক গুলি করে, তারপর বাড়ির সঙ্গে সেটা ভস্মীভূত হয়। আজিজ পাঠান কবে মহল্লা ত্যাগ করে তা লোকেরা মনে করতে পারে না, তাদের শুধু মনে পড়ে, মার্চের পঁচিশ তারিখের পর একদিন বদু মওলানা একদল লোক নিয়ে আসে। তারা মহল্লার হিন্দুদের বাসার তালা ভেঙে লুট করে। তারা আজিজ পাঠানের বাসার তালা ভেঙে সব জিনিসপত্র বদু মওলানার বাসায় নিয়ে জড়ো করে। তারা শাবল দিয়ে এই লুষ্ঠিত বাড়িগুলোর পুরনো দরজা আর জানালা চৌকাঠসহ খুলে নেয়। তারপর মিলিটারি যে দিন আজিজ পাঠানের বাড়িতে আগুন দেয় তখন সেটা পুড়তে চায় না; শুধু গুলি খাওয়া, গলুই ভাঙা নৌকোটা দাউদাউ করে জ্বলে। মহল্লার লোকেরা এই বিষয়ে অবগত ছিল যে, বদু মওলানা আজিজ পাঠানের সব অস্থাবর সম্পত্তি নিজের বানিয়ে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ঘটনা এমন আকার নিয়ে ঘটে, যাতে করে মহল্লার লোকদের মনে হয় যেন বদু মওলানা, আজিজ পাঠানের সম্পত্তির জিম্মেদারি গ্রহণ করেছিল মাত্র। একাত্তর সনের শেষ বৃহস্পতিবার, ডিসেম্বরের ত্রিশ তারিখে আজিজ পাঠান ফিরে এলে মহল্লার মানুষ উল্লসিত হয়ে পড়ে। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরিহিত দীর্ঘদেহী আজিজ পাঠান নিজের বাড়িতে প্রবেশের পূর্বে লক্ষ্মীবাজারের রাস্তা দিয়ে বিজয়ী সেনাপতির মতো পা টেনে টেনে হেঁটে যায়। তাকে দেখে পুত্র এবং স্বামীহারা নারীরাও হর্ষধ্বনি করে। আজিজ পাঠান মহল্লার প্রতিটি বাড়ির উঠোনে গিয়ে দাঁড়ায়, প্রতিটি লোকের সঙ্গে আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়, তারপর খাজা আহমেদ আলী এবং তার ছেলের কবর জিয়ারত করে নিজের বাসায় যায়। তার দরজাজানালার চৌকাঠ ওপড়ানো দগ্ধ বাসা কঙ্কালের করোটির মতো দেখায়। সে তার বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে একবার মুখ তুলে বিধ্বস্ত বাড়ির দিকে দেখে, তারপর ঘুরে দাঁড়ায় রাস্তায় তাকে অনুসরণ করে আসা এবং নীরবে অপেক্ষমাণ জনতার দিকে। তার চেহারায় জনতা দুঃখ কিংবা বিষাদ লক্ষ করে না। সে তার হাত তখন জনতার দিকে বাতাসে উড়তে থাকা পতাকার মতো প্রসারিত করে দিলে তারা ঢেউয়ের মতো উদ্বেলিত হয়ে উঠতে চায়। তখন সে স্মিত মুখে বলে, আমাগো অনেক কিছু দেওন লাগচে, তবু আমরা স্বাধীন হইচি। আজিজ পাঠান তার বাসায় প্রবেশ করার পর মহল্লার লোকেরা বদু মওলানার বাড়ির দরজা ভেঙে সব জিনিসপত্র এনে আজিজ পাঠানের উঠোনে স্থূপ করে রাখে। এইসব জিনিসপত্র পরীক্ষা করে আজিজ পাঠানের স্ত্রী বলে যে, এ সবই তাদের, শুধু দুটো বস্ত্রখণ্ড ছাড়া। এ কথা শুনে মহল্লার লোকেরা সন্তুষ্ট হয় এবং কিছুক্ষণ পর যে যার বাড়িতে ফিরে যায়। এই সময় কয়েক দিন পর বদু মওলানার লুণ্ঠিত পরিত্যক্ত বসতবাড়ি এবং আজিজ পাঠানের বাসার সামনে পুনরায় নির্মীয়মাণ এক কাঠের নৌকা দেখে কিশোর আবদুল মজিদের বুকের ভেতরের সেই সংকটের টানাপোড়েন অবচেতনভাবেই নেমে যায়, যার সূচনা হয়েছিল বদু মওলানা মেনাকে গাল দেয়ার পর। সে ঘরে ফিরে তার মাকে খবরটা দিয়ে আশ্বস্ত করে, আজিজ পাঠানের বাসার গেটে এউকগা নতুন নাও বানাইবার লাগছে। কিন্তু বাহাত্তর সনের গোড়ায় মহল্লার লোকেরা এবং আবদুল মজিদ বুঝতে পারে নাই যে, বিষয়টির নিষ্পত্তি তখনো হয় না এবং তারা আরো অনেক কিছু দেখবে। তারা জানে নাই যে, আজিজ পাঠানের বাড়ির ফটকে নির্মিত নৌকোটি জীর্ণ হয়ে ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়ার আগেই, দুবছরের ভেতর বদু মওলানা মহল্লায় ফিরে আসবে এবং লক্ষ্মীবাজারের রাস্তা দিয়ে প্রথমে ছায়ার মতো হেঁটে যাবে তারপর আশি সনে আবদুল মজিদ সহ তারা কেউ কেউ একদিন বদু মওলানাকে দেখবে তার ভারপ্রাপ্ত আমিরকে সংবর্ধনা প্রদান করতে। আবদুল মজিদ কলতাবাজারের মোড়ের পানির ট্যাঙ্কের সামনে দাঁড়িয়ে বদু মওলানার বক্তৃতা শুনবে। এই বক্তৃতা থেকে মহল্লার লোকেরা সেদিন জানতে পারবে, স্বাধীনতার পর পলাতক অবস্থায় কিভাবে বদু মওলানার আদরের ছেলে মারা যায়। এখন মহল্লার লোকদের মনে পড়ে সেদিন বক্তৃতার সময় বদু মওলানা আকাশের দিকে দুহাত উঁচু করে ধরে বলেছিল যে, সেটা ছিল এক পরীক্ষা। আল্লাহ যেমন হযরত ইব্রাহীমকে প্রিয় পুত্র কোরবানি করতে বলে পরীক্ষা করেছিলেন, তেমনি তারও জীবনে পরীক্ষা আসে এবং সে তখন তার প্রিয়তম পুত্রকে হারায়। তিয়াত্তর সনে বদু মওলানা মহল্লায় ফিরে আসার পর মহল্লার লোকেরা জানতে পারে আবুল বাশারের মৃত্যু হয়েছে এবং যদিও এই মৃত্যুর কারণ তারা আশি সনে দেয়া বদু মওলানার বক্তৃতার আগে জানতে পারে না, তারা মনে করে, এটা এক রকমের প্রতিশোধ। পরে বদু মওলানা হজরত ইব্রাহীম এবং তার পরীক্ষার বিষয়ে যেদিন বর্ণনা করে, মহল্লার লোকেরা যারা তখন তার বক্তৃতা শুনছিল, জানতে পারে যে, আবুল বাশার খেপুপাড়ার এক গায়ে লুকিয়ে থাকার সময় পুকুরের পানিতে ডুবে মারা গিয়েছিল। মহল্লার লোকেরা একটি ব্যাপারে একমত ছিল যে, আবুল বাশার, বদু মওলানার যথার্থই প্রিয় ছিল। এ ব্যাপারে মহল্লাবাসীর একটি তত্ত্ব ছিল এই যে, এই বালকটির একধরনের পঙ্গুত্ব ছিল এবং তাই তার পিতার বিশেষ দুর্বলতা ছিল তার প্রতি। আবুল বাশারের পঙ্গুত্বের ব্যাপারে মহল্লার লোকদের এই সন্দেহ পরবর্তী সময়ে সঠিক প্রমাণিত হলেও প্রথমে তারা নিশ্চিত ছিল না। তারা বলেছিল যে, আবুল বাশার বালক অথবা বালিকা কোনোটিই নয়। এই ধারণার সূত্রপাত কিভাবে হয়েছিল তা কেউ বলতে পারে না, তবে কথাটি ছড়িয়ে গেলে তারা সন্দেহ করতে থাকে কিন্তু নিশ্চিত হতে পারে না। বদু মওলানা তার এই ছেলেটিকে জন্মের পর থেকেই ডেমরায় তার শ্বশুর বাড়িতে রেখে দেয় এবং মহল্লায় যখন সে প্রথম আসে তখন সে ছবছরের বালক এবং মহল্লার লোকেরা দেখে যে, তাকে সব সময় কাপড়চোপড় পরিয়ে রাখা হয়। বিষয়টি মহল্লার লোকের জন্য কোনোভাবেই গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিল না, কিন্তু তাহলেও ব্যাপারটি সম্পর্কে তারা নিশ্চিতভাবে জানতে পারে যখন ডিসেম্বরের একুশ তারিখে জিঞ্জিরায় রাজাকার আবদুল গণি ধরা পড়ে। আবদুল গণিকে সেদিনই দুপুরে লক্ষ্মীবাজারে নিয়ে আসে দুজন মুক্তিযোদ্ধা এবং তার নিকট থেকে লোকেরা জানতে পারে এতদিন দেশে এবং মহল্লায় যা কিছু ঘটেছে তা কেমন করে ঘটেছে। প্রথমত, নয় মাসে মহল্লায় নিহত ব্যক্তিদের ছাড়া আটজন নিখোঁজ লোকের তালিকা ছিল মহল্লার লোকদের কাছে। এর ভেতর তিনজন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে গৃহত্যাগ করেছিল বলে পরে জানা গিয়েছিল, অন্য পাঁচজন সম্পর্কে তাদের জানার প্রয়োজন ছিল। দুপুরের একটু আগ দিয়ে আবদুল গণিকে এনে সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুলের ভেতরের প্রাঙ্গণে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। এ অবস্থায় সে কিছু বলতে অস্বীকার করে, তার চেহারা এবং চাহনি দেখে জনতার কোণঠাসা শৃগালের কথা মনে পড়ে। তখন তাকে ভিক্টোরিয়া পার্কের চত্বরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে তাকে একটি পাকা বেঞ্চের ওপর উপুড় করে শুইয়ে দেয়া হয়। তাকে এমনভাবে শোয়ানো হয় যেন তার মাথাটা বেঞ্চের বাইরে থাকে। তারপর তাকে দড়ি দিয়ে বেঞ্চের সঙ্গে পেঁচিয়ে বেঁধে তার মুখের নিচে পেতে দেয়া হয় একটি নিচু টেবিল এবং টেবিলের ওপর বসানো হয় একটি মাইক্রোফোন, রাখা হয় তিনটি দীর্ঘ নামের তালিকা, আর মুখের নাগালের ভেতর স্ট্র-সহ একটি ভিটাকোলার বোতল। তারপর একজন মুক্তিযোদ্ধার এসএলআরের নল তার লুঙ্গি উঁচু করে ভেতরে প্রবেশ করিয়ে দেয়া হয়। তখন মাদক থেকে লোক এসে শহীদ সিপাইদের স্মৃতিস্তম্ভের সিঁড়ি এবং বেদির ওপর এবং নিচে সবুজ ঘাসের চত্বরে জমা হয়। তারা বুঝতে পারে না এসএলআরের নলটি রাজাকার আবদুল গণির পাছার ছিদ্রের ভেতর দিয়ে প্রবেশ করিয়ে দেয়া হয়েছে কি না। তাদের একদলের মনে হয় নলটা প্রবিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু অন্য দল নিশ্চিত হয় যে, নলটি ঢোকানো হয় নাই; কারণ আবদুল গণি যখন নড়ছিল তখন লুঙ্গির তল দিয়ে বেরিয়ে থাকা অস্ত্রটি নড়ছিল না। তারা বলে যে, নলের মুখটি কেবলমাত্র উরুসন্ধিতে ঠেকিয়ে রাখা হয়েছিল। তবে এই সময় তাদের তর্ক থেমে যায়, কারণ মাইকে আবদুল গণির কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। তিনটি তালিকা শেষ করতে আবদুল গণির দুঘণ্টার বেশি লেগে যায়। তালিকার নাম পড়ে সে কতগুলোকে শনাক্ত করে, কতগুলোকে শনাক্ত করতে পারে না। মাইকে যখন তার কণ্ঠস্বর ভেসে আসতে থাকে, তাকে ঘিরে দাঁড়ানো জনতা এক অস্বাভাবিক নীরবতায় প্রস্তরীভূত হয়ে থেকে শোনে সেই দিনগুলোর কথা, যার ভেতর দিয়ে তারা পার হয়ে এসেছিল এক দুঃস্বপ্নের মতো এবং এখন তাদের মনে হচ্ছিল যেন তারা সবকিছুই নতুন শুনছে অথবা তারা কোনো কিছুই আগে জানে নাই। আবদুল গণি যখন একটি নাম শনাক্ত করছিল এবং বর্ণনা করছিল তার অন্তিম পরিণতির কথা, তখন জনতার ভেতর থেকে বিলাপ করে উঠছিল একটি পুরুষ, স্ত্রীলোক অথবা এমন কেউ নিখোঁজ ব্যক্তিটি ছিল যার স্বামী, সন্তান, বন্ধু অথবা প্রতিবেশী। আবদুল গণি যখন কথা বলা শেষ করে তখন ভিক্টোরিয়া পার্কের চত্বরে একুশ জন পূর্ণবয়স্কা নারী মাটি চাপড়ে বিলাপ করে, দশ জন পুরুষ এবং বালক ফোঁপায় আর গোটা জনতা উদ্বেলিত হয়ে পড়ে। আবদুল গণির কাছ থেকে লক্ষ্মীবাজারের লোকেরা জানতে পারে, আবু করিমের বড় ছেলেকে বাড়ি ফেরার সময় কলতাবাজার খাদ্য-গুদামের সামনে থেকে সন্ধের পর ক্যাম্পে ধরে নিয়ে গিয়ে তারা রাতে জবাই করে। তার কাছ থেকে লক্ষ্মীবাজরের লোকেরা মালিটোলার ইসমাইল হাজামের নিহত হওয়ার কথা শোনে। লক্ষ্মীবাজারের নিখোঁজদের তালিকায় ইসমাইল হাজামের নাম না থাকলেও তখন তাদের তার নাম মনে পড়ে। বদু মওলানার বাড়ির বাইরের আঙিনায় জুন মাসের এক মঙ্গলবারে পাথরের শিলের ওপর পানি ছিটিয়ে সে ঘাড় গুঁজে ক্ষুর ধার দিচ্ছিল মহল্লার লোকের নিস্পৃহ ঘোলা দৃষ্টির সামনে। বদু মওলানার বাড়ি সেদিন রঙিন কাগজ দিয়ে সাজানো হয়েছিল, মহল্লার লোকেরা সেটা দেখে ভেবেছিল, বদু মওলানা নিশ্চয়ই আর-একটি বিয়ে করছে। তাদের এ ভুল অবশ্য ভাঙে, কারণ বদু মওলানা তাদেরকে দাওয়াত করে, আর তারা এই দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করতে না পেরে যখন বদু মাওলানার বাড়ি এসে হাজির হয়, আঙিনার আতা গাছের সবুজ ছায়ায় ইসমাইল হাজামকে দেখতে পায়। তারা পায়ের গোড়ালির নিচে এক টুকরো কাঠ দিয়ে বসা ইসমাইল হাজামকে একমনে ক্ষুরে শান দিতে এবং ঝকঝকে ক্ষুরের কিনারায় হাতের বুড়ো আঙুল ছুঁয়ে ধার পরীক্ষা করতে দেখে। তারা কেবলমাত্র তখন জানতে পারে যে, বদু মাওলানার ছেলে বাশারের খাতনা হবে; কারণ বদু মাওলানার চাকর যখন তাদের দাওয়াত করে, সে শুধু বলেছিল, মাওলানা সাবে আপনেরে দুপুরে যাইতে কইছে। এখন কথাটা জানতে পেরে মহল্লার লোকেরা হেসে উঠে এবং বদু মওলানার এই ছেলেটির পুরুষাঙ্গের অনুপস্থিতি সংক্রান্ত গুজব-নির্ভর তাদের সন্দেহ দূরীভূত হয়। তারা আঙিনায় ডেকোরেটরের দোকান থেকে আনা ফোল্ডিং চেয়ারে বসে থাকে, বাড়ির চাকর এবং আগাছ তলার ইসমাইল হাজাম ছাড়া তাদের সামনে আর কেউ আসে না। ইসমাইল হাজাম যেন অনন্তকাল ধরে ক্ষুরে শান দেয়, কিন্তু তার বুড়ো আঙুলকে তৃপ্ত করার মতো ধার যেন ওঠে না; সে বুড়ো আঙুল বুলিয়ে পুনরায় শিলের ওপর এপিঠ-ওপিঠ করে ক্ষুর ঘষে। ইসমাইল হাজামের ক্ষুর ঘষার শব্দে যখন মহল্লার লোকদের চোখে দুপুরের ঘুম এসে যায় তখন তাদের ক্লান্ত চোখের সামনে দিয়ে আবুল বাশারকে বদু মওলানা নিয়ে আসে। একটি আলপনা আঁকা মাদুরের ওপর তাকে বসিয়ে গোলাপ জল মেশানো পানিতে গোসল করিয়ে যখন ভেতরে নিয়ে যায় তখনো ইসমাইল হাজাম তার ক্ষুরে পরতের পর পরত ধার ওঠাতে থাকে। মহল্লার লোকেরা তার এই একঘেয়ে আচরণে বিরক্ত হতে গিয়েও তার প্রশংসা করে এই বলে যে, সে ক্ষুরে যে ধার চড়িয়েছে, এখন ক্ষুর এবং বালকের শিশ্ন কেউ বুঝে ওঠার আগেই বাড়তি চামড়াটুকু খণ্ডিত হয়ে পড়বে। একটু পর ইসমাইল হাজাম শেষবারের মতো আঙুল বুলিয়ে ক্ষুরটা যত্ন করে খাপের ভেতর রেখে সাদা পরিষ্কার ন্যাকড়া ভাজ করে মোটা সলতের মতো বানায়, তারপর সেগুলো আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে একটা কাটা কলাপাতার ওপর রাখে। লোকেরা ইসমাইল হাজামের কাজের কুশলতা দেখে। শিশ্নায় ছেদনের জন্য ক্ষুর এবং ক্ষতে জড়িয়ে দেয়ার জন্য ছাইয়ের পট্টি তৈরি করার পর সে তার সব যন্ত্রপাতি নিয়ে রাবারের জুতোয় ফট ফটু শব্দ করে বাড়ির ভেতরে যায়। এরপর মহল্লার লোকেরা আর কিছু দেখে না। ভেতরের যে ঘরে খাতনার মূল কাজটি সম্পন্ন হয় সেখানে মহল্লার কেউ ছিল না এবং সে সময় জানালাহীন সেই ঘরের দরজা লাগানো ছিল। এই সময় মহল্লার লোকেরা চলে আসতে পারত, কারণ গরম এবং ক্ষুৎপিপাসায় এমনিতেই তারা কাতর হয়ে পড়েছিল এবং তাদের সামনে তখন শূন্য উঠোন ছাড়া আর কিছু ছিল না। কিন্তু কেন তারা তা না করে অপেক্ষা করে তা তারা বলতে পারে না। আসলে বন্ধ ঘরটির ভেতর তাদের দৃষ্টি না গেলেও তারা সকলেই যেন ব্যাপারটি দেখতে পায়। কারণ তাদের সকলেরই শিশ্নাগ্র ছিন্ন হয়েছিল এভাবে একদিন। তারা দেখে যে, আবুল বাশারের পরনের কাপড় খুলে নেয়া হয় আর তাতে তাদের চোখের সামনে উন্মোচিত হয় বালকের ফর্সা নিতম্ব। তখন তাকে একটি পিড়িতে বসিয়ে তার পিতা পিছন থেকে তার পা এবং হাত পেঁচিয়ে চেপে ধরে তার ঊরুসন্ধি উঁচু এবং উন্মোচিত করে তুলে ধরে হাজামের সামনে। তখন তারা আবার বালকের সামনে উবু হয়ে বসা ইসমাইল হাজামকে দেখতে পায় দ্রুত ক্রিয়ারত। তাদের মনে হয় যে, ইসমাইল হাজামের হাত এত দ্রুত কাজ করে যে, বালকটি গোঙানোর সময় পায় না, যেন একটিমাত্র মহূর্তে হাজামের ক্ষুর বালকের শিশ্নাগ্র পেঁয়াজের নরম খোসার মতো ছিন্ন করে এবং সেই একটি মুহূর্তের ভেতরই তারা শুনতে পায় বালকের চিৎকার। পরমুহূর্তে তারা হাজামকে যেন ক্ষুর হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, ক্ষুর বেয়ে ফোটা ফোটা রক্ত পড়ে এবং তাদের মনে হয় যেন, যে তৃষ্ণা ইসমাইল হাজাম তার ক্ষুরের শরীরে জাগিয়ে তুলেছিল তা রক্তের স্বাদ পেয়ে নেমে আসে। এবার সবকিছু দেখা হলে পড়ে মহল্লার লোকেরা হাসে। এই সময় ইসমাইল হাজাম ভেতর থেকে বের হয়ে আসে, সে উপস্থিত কাউকে কিছু বলে না, কারো দিকে তাকায়ও না, কিন্তু তারা বুঝতে পারে যে বদু মওলানার ছোট ছেলের খাতনা হয়ে গেল। এরপর তারা যার যার বাড়িতে ফিরে যায় এবং ফেরার পথে তাদের মনে পড়ে যে বদু মওলানা তাদেরকে ডেকে নিয়ে উঠোনে বসিয়ে রাখা ছাড়া এক গ্লাস শরবত দিয়েও আপ্যায়ন করে নাই। তারপর তারা ব্যাপারটি ভুলে যায় এবং এর ছমাস দশ দিন পর আবদুল গণি মাইকের সামনে উপুড় হয়ে ইসমাইল হাজামের নামোচ্চারণ না করা পর্যন্ত তা আর মনে করার প্রয়োজন এবং সময় তাদের হয় না। আবদুল গণির কথা শুনে তারা বুঝতে পারে যে ইসমাইল হাজামের ক্ষুরে ধার দেয়া দেখানোর জন্যই কেবলমাত্র বদু মওলানা সেদিন তাদেরকে তার বাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে রেখেছিল, কারণ তারা জানতে পারে যে, সেদিন ইসমাইল হাজাম আবুল বাশারের খাতনা করে নাই এবং সেই নাটকের পরবর্তী দিন আসার আগেই সে নিহত হয়। তাকে সে রাতেই তার মালিটোলার বাসা থেকে ডেকে এনে ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে জবাই করা হয়। লক্ষ্মীবাজারের লোকেরা জানতে পারে যে, ছমাস দশ দিন আগে জুনের উত্তপ্ত সেই দুপুরে ইসমাইল হাজামকে আবুল বাশারের শিশ্নাগ্র ছিন্ন করতে হয় নাই। তাকে শুধু ভেতরে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছিল এবং কিছুক্ষণ পর তাকে ঘর থেকে বের করে দেয়া হয় এবং বলা হয় মুখ বন্ধ রাখার জন্য। ইসমাইল হাজাম মুখ খোলে নাই, কারণ মহল্লার লোকদের মনে পড়ে যে ইসমাইল হাজামের চোয়াল পাথরের মতো দেখাচ্ছিল এবং সে উঠোনে বসা কারো দিকে না তাকিয়ে আতা গাছের ছায়ার দিকে গিয়েছিল। তবু এখন সকলে বুঝতে পারে, ইসমাইল ক্ষুব্ধ হয়েছিল। হয়তো ব্যাপারটি এমন ছিল যে, সে অসীম ধৈর্য এবং নিষ্ঠার সঙ্গে তার ক্ষুরে যে ধার চড়িয়েছিল সেটা নিশূপভাবে নামিয়ে নেয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না এবং তার হয়তো মনে হয়েছিল যে, কোনোভাবেই কিছু বলতে না পারলে তার পক্ষে জীবন ধারণ অসম্ভব। এখন মহল্লার লোকেরা ভিক্টোরিয়া পার্কের চত্বরে দাঁড়িয়ে আবদুল গণির কাছ থেকে জানতে পারে যে, আতা গাছের প্রতারক সবুজ ছায়ায় প্রবেশ করে ইসমাইল হাজামের নিজের ওপর প্রতিষ্ঠিত নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে যায়, টিনের হাতবাক্সে জিসিনপত্র গুছিয়ে রাখার সময় সে নিম্নস্বরে বিড়বিড় করেছিল। যেন নিজের সঙ্গে কথা বলছিল, এমনভাবে উচ্চারণ করেছিল একটি বাক্য, যে বাক্যটি আবদুল গণির মুখ থেকে এবার মহল্লার লোকেরা শোনে, হালার হিজড়ার আবার মুছলমানি! এ সময় একটিমাত্র লোক তার শ্রুতিসীমার ভেতর ছিল এবং দুর্ভাগ্যক্রমে সেই লোকটি ছিল আবদুল গণি। সে তখন লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে দাঁড়িয়ে ছিল আর মালিটোলার ইসমাইল তাকে চিনতে পারে নাই। হয়তোবা আতা গাছের সবুজ ছায়ার ক্লোরোফিল তার চেতনা নাশ করেছিল সেই মুহুর্তের জন্য অথবা সে হয়তো আবদুল গণিকে সত্যি চিনত না। আবদুল গনি বলে যে, যখন ইসমাইল হাজাম এই কথা বলে তখন সে তার অর্থ বুঝতে পারে নাই, কারণ ব্যাপারটি কি তার জানা ছিল না। কিন্তু শত্ৰুপরিবৃত এই দেশে একজন সতর্ক রাজাকার হিসেবে এমনকি হাওয়ার গতিপ্রবাহ সম্পর্কেও সে বদু মওলানাকে সব সময় অবহিত রাখত। তাই সে ইসমাইল হাজামের নিজে নিজে বলা কথাটি বদু মওলানাকে সঙ্গত কারণেই অবহিত করেছিল। তার কথা শুনে বদু মওলানা প্রথমে বিচলিত-শীতলতার সঙ্গে তাকে সতর্ক করে, যাতে করে এই নিন্দা এবং কুৎসা তার কাছ থেকে দ্বিতীয় কানে না যায় এবং তারপর বদু মওলানা তার বাড়ির বারান্দায় দাড়িয়ে একটি অপরিসর আয়তক্ষেত্রের মতো আকাশের দিকে বিষণ্ণ চোখ রেখে যা বলে, তার ফলে সেদিন রাতে ইসমাইল হাজাম দেখে, প্রাইমারি স্কুলের আধো অন্ধকার ঘরে ছুরি হাতে অপেক্ষমাণ একজন মানুষ। সে, সেই অন্ধকারের ভেতর জবাইয়ের এই অস্ত্রের ঔজ্জ্বল্য দেখে বুঝতে পারে, গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে এই অস্ত্রের ধাতুতে ধার তোলা হয়েছে এবং এই উন্মুখ অস্ত্র এবং অস্ত্রধারী রক্তপানবিনা তৃপ্ত হবে না। আবদুল গণির কাছ থেকে লোকেরা জানতে পারে যে, আজীবন ছেদন-অস্ত্রের ধাতব প্রবৃত্তির সঙ্গে বসবাস করে ইসমাইল হাজামের আপাত মূর্খতার ভেতর যে ব্যবহারিক প্রজ্ঞা গড়ে উঠেছিল, তার দ্বারা সে অপেক্ষমাণ কসাইয়ের ছুরি দেখে তার ঘৃণা এবং ভালোবাসার, দুঃখ এবং বিরল উল্লাসের এই জীবনের প্রান্ত শনাক্ত করতে পারে। জবাইয়ের সময় জোর করে শোয়ানোর জন্য উপস্থিত তিনজন রাজাকারের বলপ্রয়োগ ছাড়াই সিমেন্টের শীতল মেঝের ওপর সে নিজেকে সমর্পণ করে। উপস্থিত জনতা আবদুল গণির বর্ণনা থেকে বিস্ময়ের সঙ্গে আবিষ্কার করে যে, তার অন্তিম মুহূর্তে ইসমাইল হাজাম একজন অভিযাত্রীর মতো অবিভূত হয়েছিল। যেমন, রৌদ্র এবং তুষারপাতের ভেতর দিয়ে ঊনত্রিশ হাজার আটাশ ফুট বেয়ে ওঠার পর শেষ পদপাত করে তেনজিং নোরগে হয়তো বলেছিল, এই-ই এভারেস্ট; তেমনি, আবদুল গণির কাছ থেকে জানা যায় যে, ছুরির নিচে মাথা রেখে ইসমাইল হাজাম একবার শুধু বলে, এ্যামনে এইটা শ্যাষ হইল। ইসমাইল হাজামসহ আবদুল গণি তিনটে তালিকার একুশ জনকে শনাক্ত করতে পারে এবং জানায় যে তাদের সকলেই মৃত। তার কাছ থেকে শোকাহত এবং ক্রুদ্ধ লোকেরা জানতে পারে যে, এদের প্রত্যেককে জবাই করে দেহ থেকে মস্তক বিচ্ছিন্ন করা হয় এবং মস্তকহীন ধড় রাতের বেলায় রিকশা ভ্যানে করে নিয়ে গিয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলে দেয়া হয় এবং ছিন্ন মুণ্ড নিয়ে গিয়ে খ্রিষ্টানদের কবরস্থানে পুঁতে ফেলা হয়। তখন, তার কথা শুনে, লক্ষ্মীবাজারের লোকেরা, নয়াবাজার এবং সিদ্দিকবাজারের লোকেরা, পটুয়াটুলি এবং নারিন্দার লোকেরা ভিক্টোরিয়া পার্কের চত্বর শূন্য করে খ্রিষ্টানদের কবরস্থানের দিকে যায়। যারা ভিক্টোরিয়া পার্কের এই সমাবেশে আসে নাই অথবা আসতে পারে নাই তারা পৌষের মরা অপরাহ্নে জিলকদ মাসের তিন তারিখে দেখে মহরমের আশুরার দিনের মতো নীরব এবং শোকার্ত এক জনতা নারিন্দা দিয়ে অথবা পদ্মনিধি লেনের ভেতর দিয়ে অথবা রথখোলার মোড় ঘুরে টিপু সুলতান রোড দিয়ে হেঁটে যায়; তারা উত্তর-পূর্বে খ্রিষ্টানদের কবরস্থানের দিকে প্রবাহিত হয়। তারা কবরস্থানের দেয়ালের বাইরে পুরনো রেললাইনের পাশে খনন করে ছাপ্পান্নটি মাথার খুলি পায় এবং এর ভেতর থেকে আবদুল গণির শনাক্ত করা একুশটি বেছে বের করতে পারে না। পানিতে ধুয়ে ঝকঝকে পরিষ্কার করে তার মাথার খুলিগুলো যখন মাটির ওপর বিছানো কলাপাতার ওপর সাতটি সারিতে সাজিয়ে রাখে তখন তাদের মনে হয়, সবুজ রঙের জমিনে এক অপূর্ব জামদানি সৃজন করেছে যেন প্রকৃতি ও মানুষের করোটি মিলে। বিষাদঘন সেই অপরাহ্নে মহল্লার লোকদের কলাপাতার ওপর বিছানো করোটি দেখে এক বুটিতোলা জামদানি শাড়ির কথা মনে হয়েছিল, যে জামদানি অঙ্গে ধারণ করে, এখন তাদের মনে হয়, তাদের মা এবং প্রেমিকারা, কন্যা এবং কন্যাদের কন্যারা জীবনের উৎসবে সঞ্চারিত হয়। সে দিন লক্ষ্মীবাজারের লোকেরা দেখেছিল যে, তাদের পাঁচজন নিখোঁজ লোককে, আবদুল গণি যাদেরকে মৃত বলে শনাক্ত করেছিল, বিচ্ছিন্ন করে বেছে নেয়া যায় না, যেমন মহল্লায় প্রথম যেদিন পাকিস্তানি মিলিটারি আসে সেদিন তারা তিনজন নারীকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে নাই। সেদিন মিলিটারি চলে যাওয়ার পর মহল্লার লোকেরা সাতটি লাশ এবং নিজে নিহত না হওয়ার বিস্ময় নিয়ে যে সময়টায় চূড়ান্ত অবসাদে ডুবে ছিল, সেই সময়ও তারা তাদের নারীদের মুখে লাঞ্ছনার বিষণ্ণতা দেখেছিল। মহল্লার প্রতিটি বালক এবং বালিকার কাছে, পুরুষ এবং রমণীর কাছে যেন এই প্রথম উদ্ঘাটিত হয়েছিল যে, জগৎ-সংসারে একটি ব্যাপার আছে, যাকে বলাকার বলে। তারা আজীবন যে দৃশ্য দেখে কিছু বোঝে নাই–যেখান একটি মোরগ তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় মুরগিকে–মহল্লায় মিলিটারি আসার পর তাদের মনে হয়েছিল যে, প্রাঙ্গণের মুরগির মতো তার মা এবং কিশোরি কন্যাটি, পরিচিত ভালোবাসার স্ত্রী, তাদের চোখের সামনে প্রাণভয়ে এবং অনভিপ্রেত সহবাস এড়ানোর জন্য ছুটে বেড়াচ্ছে। ব্যাপারটি এমন মর্মান্তিকভাবে তাদের জানা থাকে যে, তাদের বিষণ্ণতা ছাড়া আর কোনো বোধ হয় না।