০৪. আলিবর্দি খান ও বর্গীর হাঙ্গামা

আলিবর্দি খান ও বর্গীর হাঙ্গামা

তাঁর মৃত্যুর পূর্বে মুরশিদকুলি খান তাঁর দৌহিত্র সরফরাজ খানকে বাঙলার নবাব মনোনীত করে যান। কিন্তু সরফরাজ খানের পিতা শুজাউদ্দিন নিজেই পুত্রের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাড়ান। আমলার চক্রান্ত করে পিতা শুজাউদ্দিনকেই বাঙলার নবাব করে। তবে তিনি নবাব হবার পর পুত্র সরফরাজ খানকে দেওয়ান পদে অভিষিক্ত করেন। নবাবের গদিতে উপবিষ্ট হয়েই শুজাউদ্দিন মুরশিদকুলি খান কর্তৃক কারারুদ্ধ বাঙলার জমিদারদের মুক্তি দেন। নিজ বন্ধু-বান্ধব অনেককে তিনি রাজকাৰ্যে নিযুক্ত করেন। দেশশাসন বিষয়ে তিনি নিকট আত্মীয় হাজি আহম্মদ ও আলিবর্দি খান ও রায়রায়ন আলমৰ্চাদ ও জগৎশেঠ ফতেচাদ প্ৰমুখদের উপদেশ অনুসরণ করেন। সম্রাটের সঙ্গে তিনি অটল আনুগত্যসম্পন্ন সম্পর্ক রাখেন। দিল্লীতে নিয়মিতভাবে রাজস্ব প্রেরণ ছাড়া, বহু অর্থ ও উপঢৌকন সম্রাটকে (মহম্মদ শাহকে) পাঠাতেন। তিনি নিজ সৈন্যবল বৃদ্ধি করেছিলেন এবং পুনরায় বিহার অধিকার করে সেখানে তাঁর প্ৰতিভূ হিসাবে আলিবর্দি খানকে নিযুক্ত করেন।

১৭৩৯ খ্রীস্টাব্দে শুজাউদ্দিনের মৃত্যুর পর তার পুত্র সরফরাজ খান বাঙলার নবাব হন। তিনি বিলাসী, আরামপ্রিয় ও অপদাৰ্থ ব্যক্তি ছিলেন। যদিও বাহ্যতঃ তিনি দিল্লীর সম্রাটের আনুগত্য স্বীকার করতেন, তা হলেও ১৭৩৯ খ্রীষ্টাব্দে যখন নাদির শাহ ভারত আক্রমণ করে দিল্লীতে প্ৰবেশ করে, সম্রাট তখন তার কাছ থেকে বিগত তিন বছরের রাজস্ব চেয়ে পাঠান। তখন সরফরাজ খান যে মাত্র রাজস্ব পাঠিয়ে দিলেন না তা নয়, নাদির শাহের নামে মুদ্রা নির্মাণ করবারও আদেশ দিলেন। পিতার ন্যায় তিনিও দেশশাসন বিষয়ে হাজি আহম্মদ, রায়রায়ন আলমৰ্চাদ ও জগৎশেঠের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করতেন। কিন্তু পরে তাদের সঙ্গে বিবাদে প্ৰবৃত্ত হন। তখন তারা এক চক্রান্ত করে, তাকে গদিচ্যুত করে বাঙলার মসনদে আলিবর্দি খানকে বসাবার জন্য গোপনে সম্রাট মহম্মদ শাহের কাছ থেকে এক মনোনয়ন পত্র সংগ্রহ করে। ফলে ১৭৪০ খ্রীস্টাব্দে আলিবর্দি খান গিরিয়ার যুদ্ধে সরফরাজ খানকে পরাজিত করে বাঙলার মসনদে অধিষ্ঠিত হন।

দুই

আলিবর্দি খানের প্রকৃত নাম মীর্জা মহম্মদ আলি। তার পূর্বপুরুষরা ছিলেন আরবদেশীয় লোক। পিতামহ ঔরঙ্গজেবের মনসবদার ছিলেন। পিতা ঔরঙ্গজেবের পুত্র আজম শাহের রন্ধনশালার তত্ত্বাবধান করতেন। মা ছিলেন তুর্কদেশীয় রমণী। ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর দিল্লীর সিংহাসন নিয়ে তাঁর পুত্রদের যে যুদ্ধ হয়, আজম শাহ তাতে নিহত হন। আলিবর্দি খান তখন দিল্লী থেকে বাঙলায় আসেন চাকুরীর সন্ধানে। কিন্তু মুরশিদকুলি খান তাকে পছন্দ না করায়, ওড়িশার নায়েব নাজিম শুজাউদ্দিনের (মুরশিদকুলি খানের জামাতা) কাছে যাবে। রাজকার্ধে তার প্রখর বুদ্ধি দেখে শুজাউদ্দিন তাকে একটি জেলার ফৌজদারের পদে নিযুক্ত করেন। মুরশিদকুলি খানের মৃত্যুর পর, আলিবর্দি খান কৌশলে, পুত্র সরফরাজ খানের পরিবর্তে পিতা শুজাউদ্দিনকে বাঙলার সিংহাসনে বসান। এই উপকারের জন্য শুজাউদ্দিন তাঁকে রাজমহলের ফৌজদার নিযুক্ত করেন। পরে ১৭৩৩ খ্ৰীস্টাব্দে বিহার যখন বাঙলার সঙ্গে যুক্ত হয়, তখন আলিবর্দি খান বিহারের নায়েব নিজামের পদে উন্নীত হন। তার পরের ঘটনা পূর্ব অনুচ্ছেদে বিবৃত হয়েছে।

মসনদে বসেই আলিবর্দি খান আর কালক্ষেপণ না করে, প্রাক্তন নবাবের কোষাগার দখল করে নেন এবং প্ৰাপ্ত ধন থেকে এক কোটি টাকা নগদ ও ৭০ লক্ষ টাকার বহুমূল্য রত্নাদি, থালাবাসন ও রেশম বস্ত্ৰাদি দিল্লীতে সম্রাট মহম্মদ শাহকে উপঢৌকনস্বরূপ পাঠিয়ে দেন। মহম্মদ শাহ সঙ্গে সঙ্গেই বিহার, বাঙলা ও ওড়িশা, এই তিন প্রদেশের শাসক হিসাবে তাকে স্বীকৃতি দেন। কিন্তু কোন কারণবশতঃ কিছুদিন পরে মহম্মদ শাহ আলিবর্দি খান কর্তৃক প্রেরিত উপঢৌকনে অসন্তুষ্ট হয়ে, প্ৰাক্তন নবাবের সমস্ত ধনরত্ব ও দু’বৎসরের বকেয়ী রাজস্ব মুরাদ খান নামক একজন কর্মচারী মারফৎ চেয়ে পাঠান। কিন্তু আলিবর্দি খান রাজমহলে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাকে একটা মোটা অঙ্কের উৎকোচ দেওয়ায়, মুরাদ খান মাত্র কয়েক লক্ষ টাকা ও ৭০ লক্ষ টাকার ধনরত্নাদি ও কিছুসংখ্যক হস্তী ও অশ্ব গ্ৰহণ করে বকেয়া রাজস্ব সম্বন্ধে কোন মীমাংসা না করে দিল্লীতে ফিরে যায়। পরে আলিবর্দি খান দিল্লীতে রাজস্ব প্রেরণ রহিত করেন ও বাঙলায় স্বাধীন শাসক হিসাবে আচরণ করেন।

আলিবর্দি খান শ্রীহট্ট, ত্রিপুরা ও চট্টগ্রাম অধিকার করেন ও ঢাকার সঙ্গে তা সংযুক্ত করে, ঢাকার শাসনভার তার জ্যেষ্ঠ জামাত নুয়াজিশ মহম্মদের ওপর অৰ্পণ করেন। কনিষ্ঠ জামাতা জিনুদিনের ওপর তিনি বিহারের শাসনভার অৰ্পণ করেন। আর ওড়িশার শাসন থেকে তিনি শুজাউদিনের জামাতা রুস্তম জঙ্গকে অপসারণ করে তার শাসনভার নিজ মধ্যম জামাতা সৈয়দ আহম্মদের ওপর অর্পণ করতে চান। কিন্তু রুস্তম জঙ্গ বিরোধিতা করায়, আলিবর্দি খানের সৈন্যবাহিনী রুস্তম জঙ্গের বিরুদ্ধে যাত্রা করে দীর্ঘদিন লড়াইয়ের পর তাকে পরাজিত করে। পরাজিত হয়ে রুস্তম জঙ্গ মসুলিপটনমের ফৌজদার আনওয়ার উদিনের কাছে পালিয়ে যায় ও আশ্রয়লাভ করে। এর পর আলিবর্দি খান নিজ মধ্যম জামাতা সৈয়দ আহম্মদকে ওড়িশার শাসনভার দেন। কিন্তু তার অত্যাচারে পীড়িত হয়ে ওড়িশার জনগণ রুন্তিমকে ওড়িশায় প্ৰত্যাবর্তন করতে আমন্ত্রণ জানায়। জীবনের অবশিষ্টাংশ তিনি অবসরে কাটাবেন সিদ্ধান্ত করায়, ওড়িশার জনগণ তখন তার এক প্ৰাক্তন কর্মচারী বৌকির খানকে ওড়িশার শাসনভার গ্ৰহণ করতে অনুরোধ জানায়। এক গোপন কৌশলে তিনি সৈয়দ আহম্মদকে বন্দী করেন এবং ওড়িশার শাসনভার গ্ৰহণ করেন। কিন্তু শীঘ্রই আলিবর্দি খানের নেতৃত্বে এক বাহিনী এসে তার প্রতিরোধ করায়, তিনি ওড়িশা থেকে পালিয়ে যান।

তিন

তাঁর ওড়িশা অভিযান থেকে ফেরবার পথে মেদিনীপুরে এসে আলিবর্দি খান শুনলেন যে বেরারের মারাঠা দলপতি রঘুজী ভেঁসলে চল্লিশ হাজার অশ্বারোহী সমেত ভাস্কর পণ্ডিত নামে এক ব্যক্তিকে বাঙলায় পাঠিয়েছেন চৌথ আদায় করবার জন্য। আলিবর্দি খানের ইচ্ছা ছিল যে তিনি রাজধানী মুরশিদাবাদে ফিরে মারাঠাদের প্রতিরোধ করবেন। কিন্তু সে সুযোগ তিনি পেলেন না, কেননা মারাঠারা ইত্যবসরেই ওড়িশার ভিতর দিয়ে বাঙলায় প্রবেশ করেছিল। বিভিন্ন স্থানের যুদ্ধে বাঙলার সৈন্যবাহিনী অসীম বীরত্বের সঙ্গে মারাঠাদের প্রতিহত করেছিল, কিন্তু যুদ্ধের সম্মুখীন হওয়া মারাঠাদের উদ্দেশ্য ছিল না। তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল তরবারীর জোরে গ্রামসকল লুণ্ঠন করা। চতুর্দিকেই এতে এক সন্ত্রাস পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। বাঙলার লোক একে ‘বৰ্গীর হাঙ্গামা’ আখ্যা দেয়। ১৭৪২ খ্রীষ্টাব্দে এই হাঙ্গামা শুরু হয়, এবং প্ৰায় ন’বছর ধরে এই হাঙ্গামা চলে। সমসাময়িক তিনখানা বইয়ে আমরা বৰ্গীর হাঙ্গামার এক ভীতিপ্ৰদ চিত্ৰ পাই। এই তিনখানা বইয়ের মধ্যে একখানা হচ্ছে গুপ্তপঞ্জীর প্ৰসিদ্ধ কবি বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার রচিত ‘চিত্রচম্পূ’ নামক কাব্যগ্রন্থ। তিনি প্ৰথমে নদীয়াধিপতি কৃষ্ণচন্দ্রের সভাপণ্ডিত ছিলেন। কিন্তু কোন কারণে কৃষ্ণচন্দ্ৰ তার ওপর রুষ্ট হলে তিনি বর্ধমানরাজ চিত্ৰসেনের আশ্রয়ে যান এবং তাঁর আদেশেই গদ্যেপদ্যে ‘চিত্রচম্পূ গ্রন্থ রচনা করেন। গ্ৰন্থখানির রচনাকাল ১৭৪৪৷ সুতরাং বইখানা বৰ্গীর হাঙ্গামার সমসাময়িক। লণ্ডনের ইণ্ডিয়া অফিসের পুস্তকাগারে (এখন এই পুস্তকাগারের নাম পরিবর্তিত হয়েছে) এই গ্রন্থের একখানা পুথি আছে। এই গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে-’বৰ্গীদিগের অতর্কিত আগমনের সংবাদে বাঙলার লোক বড়ই বিপন্ন ও ব্যাকুল হয়ে পড়ে। শকটে, শিবিকায়, উষ্ট্রে, অশ্বে, নৌকায় ও পদব্ৰজে সকলে পালাতে আরম্ভ করে। পলায়মান ব্ৰাহ্মণগণের স্কন্ধোপরি ‘লম্বালক’ শিশু, গলদেশে দোদুল্যমান আরাধ্য শালগ্ৰামশিলা, মনের মধ্যে প্ৰাণাপেক্ষ প্রিয়তরা ‘দুৰ্বহ মহাভার’ সঞ্চিত শাস্ত্ৰগ্ৰন্থরাশির বিনাশের আশঙ্কা, গৰ্ভভারালস পলায়মান রমণীগণের নিদাঘ সুৰ্যের অসহনীয় তাপক্লেশ, যথাসময় পানাহারলাভে বঞ্চিত ক্ষুধাতৃষ্ণায় ব্যাকুল শিশুগণের করুণ চীৎকারে ব্যথিত জননীগণের আর্তনাদ ও অসহ বেদনায় সমস্ত পৃখিবী ব্যাপ্ত।’ আর একখানা গ্ৰন্থ হচ্ছে ‘মহারাষ্ট্র পুরাণ’। এখানা রচনা করেছিলেন কবি গঙ্গারাম দাস, ১৭৫০ খ্রীস্টােব্দ নাগাদ। ‘মহারাষ্ট্র পুরাণ’-এ বর্ণিত হয়েছে—‘কাকু হাত কাটে কারু নাক কান। একই চোটে কারু বধে পরাণ ॥ ভাল ভাল স্ত্রীলোক জত লইয়া জ এ। অঙ্গুষ্টে দড়ি বাধি দেয়। তার গলা-এ ॥ একজনে ছাড়ে তারে আর জানা ধরে। রামণের ভরে ত্ৰাহি শব্দ করে।’ বর্গীর হাঙ্গামাকে লক্ষ্য করে ভারতচন্দ্ৰও (১৭১২-১৭৬০) তীর ‘অন্নদামঙ্গল’-এ (১৭৫২-৫৩) লিখেছেন- লুঠি বাংলার লোক করিল কাঙ্গাল। গঙ্গাপার হইল বাধি নৌকার জাঙ্গাল। কাটিল বিস্তর লোক গ্রাম গ্রাম পুড়ি। লুঠিয়া লইল ধন ঝিউরী বহুড়ী৷’

সাধারণ লোকের মনে বঙ্গীর হাঙ্গামা এমন এক উৎকট ভীতি জাগিয়েছিল যে তা পরবর্তীকালে বাঙলার মেয়েদের মুখে ছেলেদের ঘুম পাড়ানো গানে প্রতিধ্বনিত হত।

বর্গীরা ভাগীরথী অতিক্রম করে মুরশিদাহ্বাদ শহর লুটপাট করে। জগৎশেঠের বাড়ী থেকে অনেক টাকা সংগ্রহ করে। ইংরেজদের কয়েকটা নৌকাও বৰ্গীরা লুটপাট করে। কলকাতার লোক ভয়ে সম্রান্ত হয়ে ওঠে। কাঠের রক্ষাবেষ্টনী থাকা সত্বেও ভীতিগ্ৰস্ত হয়ে ইংরেজরা শহর সুরক্ষিত করবার জন্য দেশীয় বণিকদের সহায়তায় গঙ্গার দিক ছাড়া শহরের চারদিক ঘিরে ‘মারাঠা ডিচ’ খুঁড়তে আরম্ভ করে।

আলিবর্দি খান যখন ওড়িশা অভিযান থেকে ফিরছিলেন তখন বধৰ্মান শহরে রাণীন্দীঘির কাছে বৰ্গীরা তাঁর শিবির অবরোধ করে। নবাব অতি কষ্টে সেখান থেকে পালিয়ে আসেন। আলিবর্দি খান যখন মুরশিদাবাদে আসেন, বৰ্গীরা তখন কাটোয়ায় পালিয়ে যায়। পূজার সময় বৰ্গীর কাটোয়ার কাছে দাঁইহাটায় দুর্গাপূজা করে। কিন্তু ওই পূজা অসমাপ্ত থাকে, কেননা নবমীর দিন আলিবর্দি খান অতর্কিতে আক্রমণ করে তাদের তাড়িয়ে দেন। তারপর বালেশ্বরের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মারাঠারা চিলক হ্রদের দক্ষিণে পালিয়ে যায়।

পরের বছর (১৭৪৩) রঘুজী ভোঁসলে নিজে বাঙলা দেশ আক্রমণ করেন। দিল্পীর বাদশাহ মহম্মদ শাহের অনুরোধে পেশওয়া বালাজী বাজীরাও বাঙলাদেশ থেকে বৰ্গীদের তাড়িয়ে দিতে সম্মত হন। আলিবর্দি খান স্বীকার করেন যে তিনি মারাঠারাজা শাহুকে বাঙলাদেশের চৌথ এবং পেশওয়াকে যুদ্ধের খরচ বাবদ ২২ লক্ষ টাকা দিবেন। পেশওয়ার সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে রঘুজী ভোঁসলে পালিয়ে গেলেন বটে, কিন্তু তাতে কোন স্থায়ী ফল হল না। বগীরা প্ৰতি বছরই বাঙলা দেশে এসে উৎপাত করতে লাগল। ১৭৪৪ খ্রীস্টাব্দে আলিবর্দি খান ভাস্কর পণ্ডিত ও তার সেনাপতিদের সন্ধির অছিলায় মুরশিদাবাদের কাছে মানকর নামক স্থানে নিজ শিবিরে আমন্ত্রণ করে হত্যা করেন। এই ঘটনার পর বগীরা বছর খানেক হাঙ্গামা বন্ধ রাখে। কিন্তু তারপর হাঙ্গামা আবার শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত আলিবর্দি খান বর্গীদের সঙ্গে আর পেরে ওঠেন নি, এবং সন্ধি করতে বাধ্য হন। ১৭৫১ খ্রীস্টাব্দের সন্ধি অনুযায়ী আলিবর্দি খান ওড়িশা বৰ্গীদের হাতে তুলে দেন। মারাঠারা প্ৰতিশ্রুতি দেয় যে তারা ওড়িশা থেকে সুবর্ণরেখা নদী অতিক্রম করে বাঙলাদেশে আর ঢুকবে না। জলেশ্বরের কাছে সুবর্ণরেখার পূর্বতীর পর্যন্ত আলিবর্দি খানের রাজ্যের সীমানা নির্ধারিত হয়। আলিবর্দি খান প্ৰতি বৎসর বাঙলাদেশের চৌথ হিসাবে ১২ লক্ষ টাকা দেবার প্রতিশ্রুতিও দেন।

বৰ্গীর হাঙ্গামা নিয়ে বাঙলাদেশে অনেক কিংবদন্তীর সৃষ্টি হয়েছিল। বীরভূমের বৈষ্ণবগণের মধ্যে এক কিংবদন্তী আছে যে এক যোগিনীসিদ্ধ ব্ৰাহ্মণ আনন্দচন্দ্ৰ গোস্বামী (যাকে বৈষ্ণবগণ চৈতন্য মহাপ্রভুর অবতার ভাবেন) অলৌকিক শক্তিবলে বর্গীর হাঙ্গামা দমন করেছিলেন। আনাসহিদ নামে একজন পীর সাহেবও-বৰ্গীদের বিরুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে মারা যান। বীরভূমের রামপুরহাটের নিকট নলহাটিতে এক পাহাড়ের ওপর তার স্মৃতি-সমাধি বর্তমান।

মুরশিদকুলি খানের ন্যায় আলিবর্দি খান যোগ্য শাসক হলেও, দেশ ক্রমশ অবক্ষয়ের পথেই এগিয়ে গিয়েছিল। বর্গীর হাঙ্গামার ফলে দেশের এক বিশাল অঞ্চল বিধবন্ত হয়েছিল। বহুস্থানে কৃষিভূমি ও লোকালয় শ্মশানে পরিণত হয়েছিল। বিবেচক শাসক হলেও আলিবর্দি খান বর্গীদের বাধা দেবার প্রয়োজনে দুৰ্ভিক্ষক্লিষ্ট প্রজাদের করভারে জর্জরিত করতে বাধ্য হয়েছিলেন।

১৭৫৬ খ্ৰীস্টাব্দে আলিবর্দি খান হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি তাঁর কনিষ্ঠ জামাত (আলিবর্দি খানের কনিষ্ঠ কন্যা আমিন বেগমের সঙ্গে তাঁর ভ্রাতুষ্পপুত্র জিনুউদ্দিনের বিবাহ হয়েছিল) জিনুউদ্দিনের পুত্র মিরজা মহম্মদ (ওরফে সিরাজদ্দৌলা)-কে নবাব পদে মনোনীত করে যান।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *