কথামুখ (আঠারো শতকের বাঙলা ও বাঙালী)
উনবিংশ শতাব্দীর বাঙলা ও বাঙালী সম্বন্ধে অগণিত বই ও প্ৰবন্ধ লেখা হয়েছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে তার পূর্বগামী শতাব্দী, আঠারো শতক সম্বন্ধে আমরা এক শূন্যময় পরিস্থিতি লক্ষ্য করি। ইতিহাসের আসরে উনবিংশ শতাব্দীকে বিশেষ মৰ্যাদা দেবার পিছনে অবশ্য একটা যুক্তি আছে। উনবিংশ শতাব্দী ছিল একটা ঘটনাবহুল শতাব্দী, যে সকল ঘটনার ফল-সমষ্টিতে স্বই হয়েছিল বাঙলায় নবজাগরণ । তার মানে উনবিংশ শতাব্দী ছিল একটা রূপান্তরের যুগ । সেদিক থেকে আঠারো শতকও কম ঘটনাবহুল ছিল না। তা ছাড়া, আঠারো শতক অবক্ষয়ের যুগ হলেও নবজাগরণোত্ন প্ৰস্তুতিপৰ্ব আঠারো শতকের শেষের দিকেই ঘটেছিল । বস্তুতঃ বাঙলার ইতিহাসে আঠারো শতক চিহ্নিত হয়ে আছে এক সন্ধিক্ষণের যুগ হিসাবে। রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে এই শতাব্দীতে আমরা এক বিরাট পরিবর্তন লক্ষ্য করি। রাষ্ট্ৰীয় ক্ষেত্রে এই শতাব্দীর গোড়াতেই ঘটেছিল দিল্লীতে অবস্থিত কেন্দ্রীয় মুঘলশক্তির অবনতি । এই অবনতির অন্তরালেই বাঙলায় নবাবী আমলের সুচনা হয়েছিল, যার পদস্থলনে ইতিহাস কলঙ্কিত হয়েছিল পলাশীর যুদ্ধে। এই পলাশীর যুদ্ধই বাঙলায় বপন করেছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বীজ। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ সম্পূর্ণভাবে বিপর্যন্ত করেছিল বাঙলার জনজীবনকে। বৰ্গীর হাঙ্গামার দুঃস্বপ্ন ছাড়া, পলাশীর যুদ্ধের সময় পৰ্যন্ত বাঙলার জনজীবন মুখরিত ছিল সুখ, শাস্তি ও স্বাচ্ছন্দ্যের প্রাচুর্যে। এর বহিঃপ্রকাশে বাঙলার প্রাচীন সাংস্কৃতিক ধারা অব্যাহত ছিল। প্ৰধান প্ৰধান ভূম্যাধিকারীদের পৃষ্ঠপোষকতায় কবিজন রচনা করে যাচ্ছিলেন নানাবিধ মঙ্গলকাব্যসমূহ। আবার তাদেরই পৃষ্ঠপোষকতায় বাঙলায় নির্মিত হয়েছিল অসংখ্য দেবদেউল । দুর্ভিক্ষ মাঝে মাঝে আবির্ভূত হত বটে (এখনও আবির্ভূত হয়), কিন্তু সুফলার বছরে বাঙালী অতীতের ক্লেশ ভুলে যেত। আবার দৈনন্দিন জীবন আনন্দময় হয়ে উঠত। আনন্দের স্রোতে অবগাহন করে বাঙালী বার মাসে তের পার্বণ করত। সারা বৎসর নিজেকে মাতিয়ে রাখত। এই আনন্দময় জীবন পযুদন্ত হয়, যখন ১৭৬৫। খ্রীস্টাব্দে দুর্বল রাজশক্তির অনুগ্রহে ইংরেজ দেওয়ানী লাভ করে। দেওয়ানী পাবার পর ইংরেজ জনজীবনের সঙ্গতির ওপর প্রথম হস্তক্ষেপ করে। এর আগে বাঙলার ঘরে ঘরে সুতা কাটা হত, এবং সেই সুতার সাহায্যে বাঙালী তাঁতীরা বস্ত্ৰ বয়ন করে তা বিদেশীদের বেচে প্ৰভূত অর্থ উপার্জন করত। দেওয়ানী পাবার মাত্র চার বছর পরে ১৭৬৯ খ্রীস্টাব্দের ১৭ই মার্চ তারিখে কোম্পানির বিলাতে অবস্থিত ডিরেকটাররা এখানকার কর্মচারীদের লিখে পাঠাল–“বাঙলার রেশম বয়নশিল্পকে নিরুৎসাহ করে মাত্র রেশম তৈরির ব্যবসায়কে উৎসাহিত করা হউক ৷” শীঘ্রই অনুরূপ নীতি কার্পাসজাত বস্ত্র ও অন্যান্য শিল্প সম্বন্ধেও প্রয়োগ করা হল । ইংরেজ এখান থেকে কাঁচা মাল কিনে বিলাতে পাঠাতে লাগল, আর সেই কাঁচামাল থেকে প্ৰস্তুত দ্রব্য বাঙলায় এনে বেচিতে লাগিল । বাঙলা ক্রমশ গরীব হয়ে পড়ল। বাঙলার শিল্পসমূহ জাহান্নামে গেল। বাঙালী কৃষিনির্ভর হয়ে পড়ল। ১৭৮২ খ্রীস্টাব্দ থেকে সাহেবরা নীলচাষের প্রবর্তন করল । নীলচাষ দরিদ্র কৃষকের ওপর অত্যাচারের একটা যন্ত্র হয়ে দাঁড়াল। তন্তুবায়দের ভাত মারা যাবার ফলে, তন্তবায়দের বিদ্রোহ ছাড়া, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষপাদ আরও চিহ্নিত হয়ে আছে, সন্ন্যাসী বিদ্রোহ ও চুয়াড় বিদ্রোহ দ্বারা। সন্ন্যাসী বিদ্রোহ ঘটেছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর সবচেয়ে শোকাবহ ঘটনা ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’-এর পদচিহ্নে। আর চুয়াড় বিদ্রোহ ঘটেছিল বাঙলার আদিবাসীদের জীবিকার সূত্র ইংরেজগণ কর্তৃক রুদ্ধ হওয়ার ফলে। শুধুমাত্র বাঙলার অর্থনৈতিক জীবনই ষে এভাবে পর্যুদন্ত হয়েছিল, তা নয়। যুগ যুগ ধরে অনুসৃত বাঙলার ধর্মীয় জীবনের ওপরও ইংরেজ হাত দিয়েছিল। ১৭৭৫ খ্রীস্টাব্দে ইংরেজরা বাঙলায় অনুষ্ঠিত করেছিল প্ৰথম ব্ৰহ্মহত্যা । নিছক চক্রান্ত করে ১৭৭৫ খ্রীস্টাব্দের ৫ আগস্ট তারিখে তারা ফাঁসীকাঠে ঝুলিয়ে দিয়েছিল নিষ্ঠাবান ব্ৰাহ্মণসন্তান মহারাজা নন্দকুমারকে। এ সব দুৰ্যোগ ও দুৰ্গতির পরিপ্রেক্ষিতেই ঘটেছিল বাংলা হরফের সৃজন, যা উনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণের সাথক রূপায়ণে সহায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছিল ।
।। দুই ।।
আজ পর্যন্ত আঠারো শতক সম্বন্ধে যা কিছু বই লেখা হয়েছে, তা কলকাতা শহরকে কেন্দ্র করে কতকগুলো ভূঁইফোঁড় বড়লোক ও ইংরেজের বাণিজ্য ও আধিপত্য বিস্তারের ইতিহাস। আঠারো শতকের বাঙলার গ্রামীণ সমাজজীবন সম্বন্ধে কিছুই লেখা হয়নি। সমগ্র বাঙলা দেশকে নিয়েই গঠিত ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের পুর্বদিকের প্রত্যন্ত সুবা । তারাই এর নাম দিয়েছিল ‘সুবে বাঙলা” । মুঘলরা বাঙলা সুবা তৈরি করেছিল, পাঠান শক্তির পতনের পর সম্রাট আকবরের আমলে মানসিংহ যখন বাঙলা জয় করে। মানসিংহের সমসাময়িক মুঘল রাজস্ব সচিব তোদরমল্লের ‘আসল-ই-জমা-তুমার’ থেকে আমরা জানতে পারি যে সম্রাট আকবরের সময় সমগ্র বাঙলা দেশ ৬৮৯ মহাল-বিশিষ্ট ১৯টি সরকারে বিভক্ত ছিল । তখন বাঙলা থেকে রাজস্ব আদায় হত ৩,২৬,২৫০ টাকা । কিন্তু কালক্রমে হিজলি, মেদিনীপুর, জলেশ্বর, কুচবিহারের কিছু অংশ, পশ্চিম আসাম ও ত্রিপুরা বাঙলার সহিত সংযুক্ত হওয়ার ফলে, সম্রাট ঔরঙ্গজেবের সময় বাঙলা ১৩৫০ মহাল বা পরগণা বিশিষ্ট ৩৪টি সরকারে বিভক্ত হয় এবং রাজস্বের পরিমাণ দাঁড়ায় ১,৩১,১৫,৯০৭ টাকা । এই রাষ্ট্ৰীয় বিন্যাসই অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ায় বলবৎ ছিল। কিন্তু মুরশিদকুলি খান যখন নবাবী আমলের উদ্বোধন করল, তখন এর পরিবর্তন ঘটল । ১৭২২ খ্ৰীস্টাব্দে প্ৰণীত ‘জমা-ই- কামিল-তুমার’ অনুযায়ী বাঙলা দেশকে ১৩টি চাকলায় বিভক্ত করা হল। তখন মহাল বা পরগণার সংখ্যা ছিল ১৬৬০ ও রাজস্বের পরিমাণ ছিল ১,৪২,৮৮,১৮৬ টাকা । ১৭৬৫ খ্রীস্টাব্দে ইংবেজরা যখন দেওয়ানী লাভ করে তখন রাজস্বের স্ফীত হয়ে দাঁড়িয়েছিল ২,৫৬,২৪,২৩৩ টাকায়।
।। তিন ।।
আঠারো শতকের গোড়ার দিকে বাঙলার ভূ-প্রকৃতি মোটামুটিভাবে এখনকার মতই ছিল, তবে অন্তবর্তীকালে জনবিন্যাসের অনেক পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। বাঙলার বিচিত্র ভূ-প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য এই যে পশ্চিমে বিন্ধ্যপর্বতের পাদমূল থেকে এক তরঙ্গায়িত মালভূমি পূর্বদিকে এগিয়ে এসেছে ভাগীরথী-জাত পলিমাটির দেশের দিকে। পশ্চিমের এই অংশ বনজঙ্গল পরিবৃত রুক্ষ ও কর্কশ শাশ্বত নির্জনতায় মণ্ডিত ৷ শৈল অন্তরীপরূপে এই মালভূমি অভিক্ষিপ্ত হয়েছে মেদিনীপুরের জঙ্গলমহল পর্যন্ত। এই অঞ্চলের শাশ্বত নির্জনতার মধ্যেই অভ্যুত্থান ঘটেছিল তন্ত্রধর্মের। অতি প্ৰাচীনকাল হতে এই অঞ্চলে বাস করে এসেছে অস্ট্রিক ভাষাভাষী আদিবাসীরা যথা সাঁওতাল, লোধা, হো প্ৰভৃতি ।
পূর্বদিকে এই ভূখণ্ডই মিশে গিয়েছে কোমল পলিমাটির দেশের দিকে। শস্যশ্যামলা এই পলিমাটির দেশই বাঙলার ঋদ্ধির আকর। এখানেই উৎপন্ন হত ধান্য, তুলা, রেশম, ইক্ষু, সরিষা প্ৰভৃতি তৈলবীজ। অষ্টাদশ শতাব্দীতে এসব কৃষিপণ্য বাঙলাদেশে প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হত। এ সব পণ্যই বাঙলার কৃষকের সমৃদ্ধির কারণ ছিল। পরে বাঙালীর এই কৃষি-বনিয়াদের আমূল পরিবর্তন ঘটেছিল, যার পরিণামে আজ আমাদের ইক্ষু ও সরিষার জন্য বিহার ও উত্তরপ্রদেশের মুখাপেক্ষী হতে হয়েছে। তুলার চাষের পরিবর্তে এখন পাটের চাষ হয়, যার ন্যায্য মূল্য বাঙালী কৃষক পায় না ; কিন্তু যার মুনাফার সিংহভাগ অবাঙালীর উদর স্ফীত করে ।
কৃষি ব্যতীত অষ্টাদশ শতাব্দীতে গ্রাম বাঙলার সমৃদ্ধির উৎস ছিল, নানারূপ শিল্প। অর্থনীতির দিক দিয়ে গ্রামগুলি ছিল স্বয়ম্ভর । গ্রামের লোকের দৈনন্দিন ব্যবহারের সামগ্ৰীসমূহ ও পালপার্বণে প্রয়োজনীয় দ্রব্যসমূহ গ্রামের শিল্পীরাই তৈরি করত। অর্থনীতির সঙ্গে সমাজের সম্পর্ক একেবারে অঙ্গাঙ্গিভাবে গাঁটছড়া বাঁধা ছিল। সমাজ গঠিত হত ভিন্ন ভিন্ন জাতিসমূহকে নিয়ে। প্ৰতি জাতির একটা করে কৌলিক বৃত্তি ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ পৰ্যন্ত এই সকল কৌলিক বৃত্তি অনুসৃত হত। তারপর উনবিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকেই বাঙালী তার কৌলিক বৃত্তিসমূহ হারিয়ে ফেলে।
অষ্টাদশ শতাব্দীর কৌলিক বৃত্তিধারী জাতিসমূহের বিবরণ আমরা সমসাময়িক বাংলা সাহিত্য থেকে পাই । মোটামুটি যে সকল জাতি বাঙলাদেশে বিদ্যমান ছিল, তা সমসাময়িককালে অনুলিখিত এক মঙ্গলকাব্যে যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, তা এখানে উদ্ধৃত করছি–“সদগোপ কৈবর্ত আর গোয়ালা তাম্বুলি। উগ্ৰক্ষেত্ৰী কুম্ভকার একাদশ তিলি।। যোগী ও আশ্বিন তাঁতি মালী মালাকার। নাপিত রাজক দুলে আর শঙ্খধর ।। হাড়ি মুচি ডোম কলু চণ্ডাল প্ৰভৃতি। মাজি ও বাগদী মেটে নাহি ভেদজাতি ।। স্বর্ণকার সুবর্ণবণিক কৰ্মকার । সূত্ৰধর গন্ধবেনে ধীবর পোদ্দার ।। ক্ষত্ৰিয় বারুই বৈদ্য পোদ পাকমারা । পড়িল তাম্রের বালা কায়স্থ কেওরা ॥” এছাড়া, সকলের শীর্ষে ছিল ব্ৰাহ্মণ। এথেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর পরিচয় পাওয়া যায়। তবে ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চল সমূহে ভিন্ন ভিন্ন জাতির প্ৰাধান্য ছিল। পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি প্রধান জেলায় কোন কোন জাতির কোন কোন জেলায় কিরূপ প্রাধান্য ছিল, তা পরপৃষ্ঠার ছকে দেখানো হচ্ছে–
স্থান | মেদিনীপুর | হুগলি | বর্ধমান | বাঁকুড়া | বীরভূম | ২৪ পরগণা | নদীয়া |
প্রথম | ১ | ১ | ৫ | ৯ | ২ | ১২ | ১ |
দ্বিতীয় | ২ | ৫ | ২ | ৩ | ৫ | ১ | ৬ |
তৃতীয় | ৩ | ৩ | ৩ | ৭ | ৩ | ৩ | ৩ |
চতুর্থ | ৪ | ৬ | ৬ | ৬ | ৮ | ৫ | ১১ |
পঞ্চম | ৫ | ২ | ৭ | ১১ | ৯ | ৬ | ১০ |
জাতি–১-বৈবর্ত; ২-সদ্গোপ; ৩–ব্রাহ্মণ; ৪–তাঁতী; ৫-বাগদি; ৬-গোয়ালা; ৭-তিলি; ৮-ডোম; ৯-বাউরি; ১০-চণ্ডাল; ১১-চামার; ১২-পোদ।
লক্ষণীয় যে পশ্চিমবাঙলার এই সমস্ত জেলাসমূহে সংখ্যাধিক্যের দিক দিয়ে কায়স্থদের প্রথম পাঁচের মধ্যে কোন জেলায় প্ৰাধান্য ছিল না । সমগ্ৰ পশ্চিমবাঙলার মোট জনসংখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের স্থান ছিল ছয় । প্ৰথম পাঁচ ছিল যথাক্রমে কৈবর্ত, বাগদি, ব্ৰাহ্মণ, সাদগোপ ও গোয়ালা। আজ কিন্তু পরিস্থিতি অন্য রকম। তার কারণ, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষপাদে মহারাজ নবকৃষ্ণ দেব বাহাদুর ‘জাত কাছারী’ স্থাপন করে জাতি নির্বিশেষে অনেক জাতির লোককেই ‘কায়স্থ’ স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। পরে অনেক জাতের লোকই সামাজিক মৰ্যাদা লাভের জন্য নিজেদের ‘কায়স্থ’ বলে পরিচয় দিতে আরম্ভ করে ; এটা নাগরিক জীবনের পরিণাম মাত্র। কেননা, নগরবাসীরা আগন্তুকের কুলশীল সম্বন্ধে কেউই কিছু জানত না। সুতরাং আগন্তকের জাত যাচাই করবার কোন উপায় ছিল না । গ্রামের লোকেরা সকলেই সকলকে চিনত। সেজন্য সেখানে জাত ভাঁড়াবার কোন উপায় ছিল না । গ্রামের লোকেরা হয় নিজের গ্রামে, আর তা নয় তো নিকটের গ্রামেই বিবাহ করত। এই বৈবাহিকসূত্রে এক গ্রামের লোক নিকটস্থ অপর গ্রামের লোকেরও জাত জানত ।
অষ্টাদশ শতাব্দীর গ্রামবাঙলায় এই সকল হিন্দুজাতি ছাড়া, ছিল আদিবাসীরা। মেদিনীপুরের আদিবাসীদের মধ্যে প্রধান আদিবাসী ছিল সাঁওতাল, লোধা ও হো। বাঁকুড়ার আদিবাসীদের মধ্যে ছিল কোরা, ভূমিজ, মাহালি, মেচ, মুণ্ডা, সাঁওতাল ও ওঁরাও। সকলের চেয়ে বেশি আদিবাসী ছিল বীরভূমে, প্ৰায় সবই সাঁওতাল। রাজশাহীর আদিবাসীদের সংখ্যা তুলনামূলকবাহবে ছিল কম। এখানকার প্রধান আদিবাসী ছিল মুণ্ডা, সাঁওতাল, ওঁরাও প্রভৃতি। সাঁওতালদের ৭৩.৭৩ শতাংশ বাস করত মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, বর্ধমাম, বাঁকুড়া, বীরভূম ও হুগলি জেলায়। বাকী অংশ বাস করত পশ্চিম দিনাজপুর, মালদহ ও জলপাইগুড়ি জেলায়। মুণ্ডারা অধিক সংখ্যায় (৬০.১৮ শতাংশ) বাস করত জলপাইগুড়ি ও চব্বিশ পরগণা জেলায়। বাকী ৩৯.৮২ শতাংশ বাস করত বাকী জেলাসমূহে। ওঁরাওদের ৮৯.০৪ শতাংশ বাস করত জলপাইগুড়ি, দাৰ্জিলিং, পশ্চিম দিনাজপুর ও চব্বিশ পরগণায়। সমষ্টিগতভাবে পশ্চিমবাঙলার আদিবাসীদের মধ্যে ৯০-১৫ শতাংশ ছিল সাঁওতাল, ওঁরাও, মুণ্ডা, ভূমিজ, কোরা ও লোধা। তবে সাঁওতালরাই ছিল বাঙলার আদিম অধিবাসী । কিংবদন্তী অনুযায়ী তাদের জন্মস্থান ছিল মেদিনীপুরের সাঁওত পরগণায় ।
এ ছাড়া ছিল ধর্মান্তরিত মুসলমান সমাজ। তাদের কথা আমরা এখানে বলছি না ।
।। চার ।।
আগেই বলেছি যে আঠারো শতকের গোড়ায় বাঙলাদেশের বিরাট আকার ছিল। এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। ওড়িশা, আসাম, ও কুচবিহারের অংশবিশেষ ও ত্রিপুরা। এটা বিভক্ত ছিল ১৬৬০ মহাল বা পরগণায়। সব মহল অবশ্য সমান আকারের ছিল না। কোন কোনটা খুব বড়, যার বাৎসরিক রাজস্বের পরিমাণ ছিল ৭০ লক্ষ টাকা। আবার কোন কোনটা খুবই ছোট, এত ছোট যে রাজদরবারে দেয় বার্ষিক রাজস্বের পরিমাণ ছিল মাত্ৰ পঁচিশ টাকা। এই সকল ছোট-বড় মহালগুলি যাদের অধীনে ছিল, তারা নানা অভিধা বহন করত, যথা জমিদার, ইজারাদার, ঘাটওয়াল, তালুকদার, পতনিদার, মহলদার, জোতদার, গাতিদার ইত্যাদি। বড় বড় মহালগুলি জমিদারদেরই অধীনস্থ ছিল। এ সকল জমিদারীর মধ্যে যেগুলো সবচেয়ে বড়, সে সব জমিদারদের প্রায় সামন্তরাজার মত আধিপত্য ছিল। দিল্লীর বাদশাহ তাদের রাজা, মহারাজা, খান, সুলতান প্রভৃতি উপাধিতে ভূষিত করতেন। তারাই ছিল সাহিত্য, শিল্পকলা, সংস্কৃতি ও স্থাপত্যের পৃষ্ঠপোষক। তাদের সম্বন্ধে শিবনাথ শাস্ত্রী যা বলেছেন, তা এখানে উন্মুক্ত করা যেতে পারে। “দেশীয় রাজগণ এক সময় দেশের মহোপকার সাধন করিয়াছেন। যখন সমগ্ৰ দেশ যবন রাজাদিগের করকবলিত হইয়া মুহ্যমান হইতেছিল, তখন তাহারা স্বীয় মস্তকে ঝড়বৃষ্টি সহিয়া দেশ মধ্যে জ্ঞানী ও গুণীজনকে রক্ষা করিয়াছেন ; এবং শিল্প সাহিত্য কলাদির উৎসাহ দান করিয়াছেন। যবনাধিকার কালে দেশীয় রাজগণ অনেক পরিমাণে সর্বময় কর্তা ছিলেন। তাঁহাদের দেয় নির্ধারিত রাজস্ব দিলেই তাহারা স্বীয় অধিকার মধ্যে যথেচ্ছ বাস করিতে পারিতেন। সুতরাং তাহারা পাত্ৰ, মিত্র, সভাসদে পরিবেষ্টিত হইয়া সুখেই বাস করিতেন। জ্ঞানী ব্যক্তিগণ অনেক সময়ে ইহাদের আশ্রয়ে বাস করিয়া নিরাপদে স্বীয় স্বীয় প্ৰতিভাকে বিকাশ করিবার অবসর পাইতেন।”
এরূপ জমিদারদের অন্যতম ছিল জঙ্গলমহল ও গোপীভূমের সদগোপ রাজার, বাঁকুড়ার মল্লরাজগণ, বর্ধমানের ক্ষত্ৰিয় রাজবংশ, চন্দ্ৰকোেনার ব্ৰাহ্মণ রাজারা, নদীয়ার ব্ৰাহ্মণ রাজবংশ, নাটোরের ব্ৰাহ্মণ রাজবংশ ও আরও অনেকে।
জঙ্গলমহলের রাজাদের মধ্যে প্ৰসিদ্ধ ছিলেন নারায়ণগড়, নাড়াজোল ও কর্ণগড়ের রাজারা। এর মধ্যে নারায়ণগড়ের আয়তন ছিল ৮১,২৫৪ একর বা ২২৬,৯৬ বর্গমাইল, আর নাড়াজোলের ছিল ৮,৯৯৭ একর বা ১৪.০৪ বর্গমাইল । সুতরাং নারায়ণগড়ই বড় রাজ্য ছিল। কিংবদন্তী অনুযায়ী এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা গন্ধৰ্বপাল। তিনি বর্ধমানের গড় আমরাবতীর নিকটবর্তী দিগনগর গ্রাম থেকে এসে নারায়ণগড় রাজ্য প্ৰতিষ্ঠা করেন। ১৮৫২ খ্ৰীস্টাব্দের ৭ জানুয়ারী তারিখে মেদিনীপুরের কালেকটর মিস্টার এচ. বি. বেইলী লিখিত এক মেমোরাণ্ডাম থেকে আমরা জানতে পারি যে নারায়ণগড়ের রাজারাই ছিলেন জঙ্গলমহলের প্ৰধানতম জমিদার। তাদের কুলজীতে ৩০ পুরুষের নাম আছে। তাঁরা খুরদার রাজার কাছ থেকে ‘শ্ৰীচন্দন’ ও দিল্পীর বাদশাহের কাছ থেকে ‘মাড়ি সুলতান’ উপাধি পেয়েছিলেন। বেইলী সাহেব এই দুই উপাধি পাবার কারণও উল্লেখ করে গেছেন। যে চন্দনকাষ্ঠ দিয়ে পুরীর জগন্নাথদেবের বিগ্রহ তৈরী হত, তা নারায়ণগড়ের রাজারা সরবরাহ করতেন বলেই খুরদার রাজা তাদের ‘শ্ৰীচন্দন’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। ‘মাড়ি সুলতান’ মানে ‘পথের মালিক’। শাহজাদা খুররম (উত্তরকালের সম্রাট শাহজাহান) যখন পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হন, তখন সম্রাট সৈন্যদ্বারা পরাজিত হয়ে মেদিনীপুরের ভিতর দিয়ে পলায়ন করতে গিয়ে দেখেন যে ঘোর জঙ্গলের ভিতর দিয়ে পলায়ন করা অসম্ভব । তখন নারায়ণগড়ের রাজা শ্যামবল্লভ এক রাত্রির মধ্যে তাঁর গমনের জন্য পথ তৈরি করে দেন। এই উপকারের কথা স্মরণ করে পরবর্তীকালে সম্রাট শাহজাহান রক্তচন্দনে পাঁচ আঙুলের ছাপবিশিষ্ট এক সনদ দ্বারা তাঁকে ‘মাড়ি সুলতান’ বা ‘পথের মালিক’ উপাধি দেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে বৰ্গীর হাঙ্গামার সময় ও ১৮০৩ খ্রীস্টাব্দে মারাঠাদের বিরুদ্ধে নারায়ণগড়ের রাজারা ইংরেজদের সাহায্য করেছিলেন । বেইলী সাহেব নারায়ণগড়ের তৎকালীন ২৫ বৎসর বয়স্ক রাজার জনহিতকর কাজের জন্য খুব প্ৰশংসা করে গেছেন।
কিংবদন্তী অনুযায়ী কর্ণগড়ের রাজারা খ্ৰীষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে বর্ধমানের নীলপুর থেকে মেদিনীপুরে আসেন। প্ৰথম যিনি আসেন তিনি হচ্ছেন রাজা লক্ষণসিংহ ( ১৫৬৮-১৬৬১ খ্রীস্টাব্দ ) । অষ্টাদশ শতাব্দীতে যারা কর্ণগড়ের রাজা ছিলেন তাঁরা হচ্ছেন রাজা রামসিংহ ( ১৬৯৩-১৭১১ ), রাজা যশোমন্ত সিংহ ( ১৭২২-১৭৪৮ ), রাজা অজিত সিংহ ( ১৭৪৯-১৭৫৬ ), ও রাণী শিরোমণি ( ১৭৫৬-১৮১২ )। রাজা রামসিংহের আমলেই মধ্যযুগের অন্যতম প্ৰধান কবি রামেশ্বর ভট্টাচাৰ্য, তাঁর জন্মস্থান যদুপুর থেকে শোভাসিংহের ভাই হিমতসিংহ কর্তৃক বিতারিত হয়ে, কর্ণগড়ে এসে বাস করেন । রাজা যশোমন্ত সিংহের আমলে কর্ণগড়ের দেয় রাজস্বের পরিমাণ ছিল ৪০,১২৬ টাকা ১২ আনা ও তাঁর সৈন্যসংখ্যা ছিল ১৫,০০০ । তৎকালীন জঙ্গলমহলের প্রায় সমস্ত রাজা তাঁর অধীনতা স্বীকার করত। রাণী শিরোমণির আমলে প্ৰথম চুয়াড় বিদ্রোহ ঘটে এবং যদিও যশোমন্ত সিংহের মাতুল নাড়াজোলের রাজা ত্ৰিলোচন খানের দ্বারা চুয়াড়রা পরাহত হয়, তা হলেও দ্বিতীয় চুয়াড় বিদ্রোহের সময় ইংরেজ সরকার রাণী শিরোমণিকে ওই বিদ্রোহের নেতা ভেবে ১৭৯৯ খ্রীস্টাব্দের ৬ এপ্রিল তাঁকে তাঁর অমাত্য চুনীলাল খান ও নীরু বকসীসহ বন্দী করে কলকাতায় নিয়ে আসে। কর্ণগড় ইংরেজ সৈন্যদল কর্তৃক লুষ্ঠিত হয়ে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। মুক্ত হবার পর রাণী শিরোমণি আর কর্ণগড়ে বাস করেন নি। জীবনের শেষ দিন পৰ্যন্ত মেদিনীপুরের আবাসগড়ে বাস করে এই নিৰ্ভীক রমণী ১৮১২ খ্রীস্টাব্দের ১৭ সেপটেম্বর তারিখে মারা যান। তারপর কর্ণগড় নাড়াজোল রাজবংশের অধীনে চলে যায়।
নাড়াজোল রাজবংশের আদিপুরুষ হচ্ছেন উদয়নারায়ণ ঘোষ। উদয়নারায়ণের প্রপৌত্রের ছেলে কাৰ্তিকরাম মুঘল সম্রাটের কাছ থেকে ‘রায়’ উপাধি পান। তার পর তিন পুরুষ ধরে ওই বংশ ওই উপাধি ব্যবহার করেন। তারপর ওই বংশের অভিরাম রায় সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ‘খান’ উপাধিতে ভূষিত হন। অভিরামের মধ্যমপুত্ৰ শোভারাম খানের পুত্ৰ মতিরাম রাণী শিরোমণির তত্ত্ববধায়ক হন। মতিরামের মৃত্যুর পর তাঁর পিতৃব্যপুত্ৰ সীতারাম খান রাজ্যের রক্ষক হন । ১৮০০ খ্রীস্টাব্দে সম্পাদিত এক দানপত্র দ্বারা রাণী শিরোমণি সমস্ত রাজ্য সীতারামের জ্যেষ্ঠপুত্র আনন্দলালকে দান করেন। আনন্দলাল নিঃসন্তান অবস্থায় ১৮১০ খ্রীস্টাব্দে মারা যান। তিনি তাঁর ছোট ভাই মোহনলালকে কৰ্ণগড় রাজ্য ও মধ্যম ভাই নন্দলালকে নাড়াজোল রাজ্য দিয়ে যান ।
মেদিনীপুরের অন্তৰ্গত মুকসুদপুরের ভুঁইয়ারাও অতি প্ৰসিদ্ধ সদ্গোপ জমিদার ছিলেন। এছাড়া, মেদিনীপুরে অন্য জাতির জমিদারীও অনেক ছিল। তন্মধ্যে চেতুয়া-বরদার রাজারা, তমলুকের রাজারা, ঝাড়গ্রামের রাজারা, জামবনির রাজার, ঝাটিবণির রাজার ও ঘাটশিলার রাজারা উল্লেখের দাবী রাখে। এঁদের অনেকের সঙ্গেই বাঁকুড়ার মল্লরাজাদের মিত্ৰতা ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীতে তমলুকের রাজা ছিলেন কৈবর্ত জাতিভুক্ত আনন্দনারায়ণ রায়। ময়ুরধ্বজ তাম্রধ্বজ, হংসধধ্ব ও গরুড়ধ্বজ নামে চারজন রাজার পর আনন্দনারায়ণের উর্ধ্বতন ৫৬তম পূর্বপুরুষ বিদ্যাধর রায় এই রাজবংশ প্ৰতিষ্ঠা করেন। এই বংশের রাজারা বহু দেবদেউল নিৰ্মাণ করেন, তন্মধ্যে বর্গভীমের মন্দির সুপ্ৰসিদ্ধ।
চৈতন্য মহাপ্ৰভুর সময় ঝাড়খণ্ড বা ঝাড়গ্রাম ‘বন্যজাতি’ অধ্যুষিত ও ওড়িশাময়ূরভঞ্জের বনপথের সংলগ্ন ছিল। খ্ৰীস্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে ঝাড়গ্রামে যে রাজবংশ রাজত্ব করতেন, তাদের আদিপুরুষ ষোড়শ শতাব্দীতে ফতেপুর সিকরি অঞ্চল থেকে পুরীর জগন্নাথ ক্ষেত্রে তীর্থ করতে আসেন এবং আভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে ঝাড়গ্রামে একটি রাজ্য প্ৰতিষ্ঠা করেন। বাঁকুড়ার মল্লরাজগণের সঙ্গে ঝাড়গ্রামের রাজাদেরও বিশেষ মিত্ৰতা ছিল ।
বর্ধমানের রাজবংশ সম্বন্ধেও অনুরূপ কিংবদন্তী শোনা যায়। ওই বংশের প্ৰতিষ্ঠাতা সংগ্ৰামসিংহ পঞ্জাব থেকে শ্ৰীক্ষেত্রে তীর্থ করতে আসেন। ফেরবার পথে তিনি বর্ধমানের বৈকুণ্ঠপুর গ্রামে একখানা দোকান করেন। তারপর দোকানদারী থেকে জমিদারী ও জমিদারী থেকে রাজ্য স্থাপন। যাদের জমি গ্ৰাস করে তিনি রাজ্য স্থাপন করেন, তারা হচ্ছে গোপীভূমের সাদগোপ রাজারা। ১৯১০ খ্রীস্টাব্দে J.C.C Peterson, I. C. S. ‘বেঙ্গল ডিস্ট্রিকটস্ গেজেটিয়ারস্’-এর বর্ধমান খণ্ডে সদগোপ রাজাদের পরিখাবেষ্টিত নগরীসমূহ, প্রাসাদ, দুর্গ, মূর্তি ও মন্দিরাদির ধ্বংসাবশেষ দেখে বিস্মিত হয়ে লিখেছিলেন যে, “একদা দামোদর-অজয় বেষ্টিত ভূখণ্ডের এক বিস্তৃত অঞ্চলে সদগোপ রাজাদের আধিপত্য ছিল।” সাম্প্রতিককালে বিনয় ঘোষ তার ‘পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি’ গ্রন্থে বলেছেন–‘গোপভূমের সদ্গোপ রাজবংশের ইতিহাস রাঢ়ের এক গৌরবময় যুগের ইতিহাস। আজও সেই অতীতের স্মৃতি-চিহ্ন ভালকি, আমরাগড়, কাঁকশা, রাজগড়, গৌরাঙ্গপুর প্ৰভৃতি অঞ্চলে রয়েছে। বাঙলার সংস্কৃতির ইতিহাসে সদগোপদের দানের গুরুত্ব আজও নির্ণয় করা হয়নি।’
অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে গোপীভূমে যে সদ্গোপ রাজা রাজত্ব করছিলেন। তার নাম শতক্ৰতু। ১৭১৮ খ্ৰীস্টাব্দে শতক্ৰতু মারা গেলে তাঁর পুত্ৰ মহেন্দ্র রাজা হন। মহেন্দ্ৰ নিজ পিতৃরাজ্য বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত করেন। নবদ্বীপাধিপতি রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের জীবনচরিতে রাজা মহেন্দ্রর কথা বিস্তারিতভাবে লেখা আছে । যখন জগৎশেঠের বাড়িতে নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে সভা আহূত হয়, তখন রাজা মহেন্দ্র একজন প্ৰধান উদ্যোগী ছিলেন। নবাবের বিপক্ষে বিরোধী হওয়ার জন্য তাঁর রাজ্য বর্ধমানের রাজা কর্তৃক আক্রান্ত হয় এবং তিনি শেষ পর্যন্ত পরাজিত হন।
অষ্টাদশ শতাব্দীর বাঙলায় আরও রাজা মহারাজা ছিলেন । তাদের মধ্যে অনেকেই ব্ৰাহ্মণ ছিলেন। যেমন চন্দ্রকোনার রাজারা, নাটোরের রাজবংশ, নদীয়ার রাজবংশ ইত্যাদি ।
অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে নাটোরের জমিদার ছিলেন রাজা রামকান্ত রায় । ১৭২৬ খ্রীস্টাব্দে রামকান্তের মৃত্যুর পর তার ৩২ বৎসর বয়স্কা বিধবা রাণী ভবানী নাটোরের বিশাল জমিদারীর উত্তরাধিকারিণী হন। ওই বিশাল জমিদারী কৃতিত্বের সঙ্গে পরিচালনার স্বাক্ষর তিনি ইতিহাসের পাতায় রেখে গেছেন। তাঁর জমিদারীর বাৎসরিক আয় ছিল দেড় কোটি টাকা। নবাব সরকারে সত্তর লক্ষ টাকা রাজস্ব দিয়ে বাকী টাকা তিনি হিন্দুধর্ম ও ব্রাহ্মণ প্ৰতিপালন, দীনদুঃখীর দুর্দশামোচন ও জনহিতকর কাৰ্যে ব্যয় করতেন। বারাণসীতে তিনি ভবানীশ্বর শিব স্থাপন করেছিলেন ও কাশীর বিখ্যাত দুৰ্গাবাড়ী, দুৰ্গাকুণ্ড ও কুরুক্ষেত্ৰতলা জলাশয় প্রভৃতি তার কীর্তি। বড়নগরে তিনি ১০০টি শিবমন্দির স্থাপন করেছিলেন। যদিও সিরাজউদ্দৌলাকে গদিচ্যুত করার ষড়যন্ত্রে তিনি ইংরেজ পক্ষকেই সাহায্য করেছিলেন, তা সত্বেও তাঁর জমিদারীর কিয়দংশ ইংরেজরা কেড়ে নিয়েছিল। তার বাহেরবন্দ জমিদারী ওয়ারেন হেষ্টিংস বল পূর্বক কেড়ে নিয়ে কান্তবাবুকে দিয়েছিলেন। পাঁচশালা বন্দোবস্তের সুযোগ নিয়ে গঙ্গাগোবিন্দ সিংহও তাঁর রংপুরের কয়েকটা পরগণা হস্তগত করেছিলেন।
রাণী ভবানীর সমসাময়িক কালে নদীয়ার কৃষ্ণনগরে জমিদারী পরিচালনা করতেন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় । কৃষ্ণচন্দ্রের জমিদারীর আয়তনও বিশাল ছিল। ভারতচন্দ্ৰ তার ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে কৃষ্ণচন্দ্রের রাজ্যের সীমানা সম্বন্ধে বলেছেন–“রাজ্যের উত্তরসীমা মুরশিদাবাদ। পশ্চিমের সীমা গঙ্গাভাগীরথী খাদ। দক্ষিণের সীমা গঙ্গাসাগরের খাদ । পূর্ব সীমা ধুলাপুর বড় গঙ্গা পার।” সিরাজউদ্দৌলাকে গদিচ্যুত করার ষড়যন্ত্রে তিনিও ইংরেজদের সাহায্য করেন। এর প্ৰতিদানে তিনি ক্লাইভের কাছ থেকে পাঁচটি কামান উপহার পান। কিন্তু পরে খাজনা আদায়ের গাফিলতির জন্য মীরকাশিম তাঁকে মুঙ্গের দুর্গে বন্দী করে রাখে। ইংরেজের সহায়তায় তিনি মুক্তি পান।
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন আঠারো শতকের নিষ্ঠাবান হিন্দু সমাজের কেন্দ্ৰমণি। ১৭৫৩ খ্রীস্টাব্দের মাঘ মাসে তিনি অগ্নিহোত্র ও বাজপেয় যজ্ঞ সম্পাদন করেন। এই যজ্ঞ সম্পাদনের জন্য তাঁর ২০ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়েছিল। বাঙলা, তৈলঙ্গ, দ্রাবিড়, মহারাষ্ট্র, মিথিলা, উৎকল ও বারাণসীর বিখ্যাত পণ্ডিতরা এই যজ্ঞে আহুত হয়েছিলেন। এছাড়া, তার সভা অলঙ্কৃত করত বহু গুণিজন যথা গোপাল ভাঁড়, ভারতচন্দ্র, রামপ্ৰসাদ সেন, জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন, হরিরাম তর্কসিদ্ধান্ত, কৃষ্ণানন্দ বাচস্পতি, বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার প্রমুখ। নাটোর থেকে একদল মৃৎশিল্পী এনে, তিনি কৃষ্ণনগরের বিখ্যাত মৃৎশিল্পের প্রবর্তন করেন। বাঙলা দেশে জগদ্ধাত্রী পূজারও তিনি প্রবর্তক।
বাঁকুড়ার মল্লরাজগণের রাজধানী ছিল বিষ্ণুপুরে। বিষ্ণুপুর জঙ্গলমহলেরই অন্তর্ভুক্ত ছিল। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে বিষ্ণুপুরের মল্লরাজগণ তাদের গৌরবের তুঙ্গে উঠেছিল। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীতে মল্লরাজগণ যথেষ্ট দুর্বল হয়ে পড়ে। গোপাল সিংহের রাজত্বকালে বগীদের আক্রমণে রাজ্যটি বিধ্বংস হয় ও তার পতন ঘটে। কিন্তু এক সময় তারা এক বিশাল ভূখণ্ডের অধিপতি ছিল। এই ভূখণ্ড উত্তরে সাঁওতাল পরগণা থেকে দক্ষিণে মেদিনীপুর পর্যন্ত এবং পূর্বদিকে বর্ধমান পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পশ্চিমে পঞ্চকোট, মানভূম ও ছোটনাগপুরের কিয়দংশ তাদের জমিদারীভুক্ত ছিল। মল্লরাজগণের আমলে বিষ্ণুপুর রেশম চাষ ও সংস্কৃত চর্চার একটা বড় কেন্দ্ৰ ছিল। মল্লরাজগণ প্ৰথমে শৈব ছিলেন, কিন্তু পরে শ্ৰীনিবাস আচাৰ্য কর্তৃক বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। বিষ্ণুপুরের প্রসিদ্ধ মন্দিরগুলি রাজা বীর হাম্বির (১৫৯১-১৬১৬), রঘুনাথ সিংহ (১৬১৬-৫৬), দ্বিতীয় বীরসিংহ (১৬৫৬-১৬৭৭), দুর্জন সিংহ (১৬৭৮-১৬৯৪) প্ৰমুখের আমলে নির্মিত হয়। এদের পর অষ্টাদশ শতাব্দীতে মল্লরাজগণ যখন দুর্বল হয়ে পড়ে, তাদের রাজ্য বর্ধমানের অন্তর্ভুক্ত হয়।
অষ্টাদশ শতাব্দীর একজন দুর্ধর্ষ জমিদার ছিলেন রাজা সীতারাম রায়, বঙ্কিম যাকে তাঁর উপন্যাসে অমর করে গেছেন। যশোহরের ভুষনা গ্রামে তাঁর জন্ম। পিতা উদয়নারায়ণ ছিলেন স্থানীয় ভূম্যাধিকারী। মহম্মদ আলি নামে একজন ফকিরের কাছ থেকে তিনি আরবী, ফারসী ও সামরিক বিদ্যা শিক্ষা করেন। পরে তিনি পিতার জমিদারীর সৈন্য সংখ্যা বাড়িয়ে নিজেই ‘রাজা’ উপাধি গ্ৰহণ করেন। মুরশিদকুলি খান তাঁকে দমন করবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পরে তিনি ঐশ্বৰ্যমত্ত হলে, তার রাজ্যে বিশৃঙ্খলার উদ্ভব হয়। সেই সুযোগে নবাবের সৈন্য তাঁর আবাসস্থল মহম্মদপুর আক্রমণ করে তাঁকে পরাজিত ও বন্দী করে। কথিত আছে তাকে শূলে দেওয়া হয়েছিল।
।। পাঁচ ।।
অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম তিনপাদে সামস্ত রাজগণের আমলে আমরা নিষ্ঠাবান সমাজ ও সাহিত্যের ধারাবাহিকতাই লক্ষ্য করি। বাংলা সাহিত্য তখনও তার পূৰ্ববর্তী খাতেই প্ৰবাহিত হচ্ছিল। এই সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন বাঙলার সামান্তরাজগণ ও জমিদারবৃন্দ। তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় মঙ্গলকাব্য ও পৌরাণিক কাব্যসমূহের ধারা স্তিমিত হয়নি। কর্ণগড়ের রাজা যশোমন্ত সিংহের পৃষ্ঠপোষকতায় রামেশ্বর ভট্টাচাৰ্য রচনা করেছিলেন তাঁর ‘শিবায়ন’, বর্ধমানের রাজা কীৰ্তিচন্দ্রের পৃষ্ঠপোষকতায় ঘনরাম চক্রবর্তী রচনা করেছিলেন তাঁর ‘ধর্মমঙ্গল’, ও নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পৃষ্ঠপোষকতায় ভারতচন্দ্র রচনা করেছিলেন তাঁর ‘অন্নদামঙ্গল’ ও ‘বিদ্যাসুন্দর’। শতাব্দীর দ্বিতীয় পাদে গঙ্গাধর দাস রচনা করেছিলেন তার ‘জগৎমঙ্গলা’ কাব্য। এই গঙ্গাধরেরই অগ্রজ ছিলেন ‘মহাভারত’ রচয়িতা কাশীরাম-দাস। শতাব্দী শেষ হবার পূর্বেই রচিত হয়েছিল আরও তিনখানা ধর্মমঙ্গল কাব্য–১৭৮১ খ্রীস্টাব্দে মানিক গাঙ্গুলির, ১৭৯০ খ্রীস্টাব্দে রামকান্তের ও ১৭৯৬ খ্ৰীস্টাব্দে গোবিন্দরামের । অনুবাদ সাহিত্যে শতাব্দীর প্রারম্ভেই শঙ্কর কবিচন্দ্র রচনা করলেন তার ‘রামায়ণ’ ও ‘মহাভারত, ও শতাব্দীর শেষের দিকে ( ১৭৯০ খ্রীস্টাব্দে ) রামপ্ৰসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় রচনা করলেন তাঁর ‘রামায়ণ’। এছাড়া রচিত হয়েছিল শচীনন্দন কর্তৃক তার ‘উজ্জ্বলনীলমণি’, রামপ্ৰসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক ‘দুর্গাপঞ্চর্যাত্ৰি’, জয়নারায়ণ সেন কর্তৃক তার ‘হরিলীলা’, জগৎ নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক ‘আত্মবোধ’, ও জয়নারায়ণ ঘোষাল কর্তৃক পদ্মপুরাণের ‘কাশীখণ্ড’। শতাব্দীর শেষের দিকে অনুবাদ সাহিত্যের ক্ষেত্রে উল্লেখনীয় সংযোজন হচ্ছে গোলাকনাথ দাস কর্তৃক ইংরেজি নাটক Disguise-এর বাংলা অনুবাদ, যা হেরোসিম লেবেডফ কর্তৃক ১৭৯৫ খ্রীস্টাব্দে মঞ্চস্থ হয়েছিল তাঁর ডোমতলার বেঙ্গল থিয়েটারে ।
বাঙলার অষ্টাদশ শতাব্দীর সামাজিক ইতিহাস চিহ্নিত হয়ে আছে দুই বীভৎস ঘটনার দ্বারা । একটা হচ্ছে বগীর হাঙ্গামা ( ১৭৪২-৫১ ) ও আর একটা হচ্ছে ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ ( ১৭৬৯-৭০ ) ৷ প্ৰথমটার ভীতিপ্ৰদ চিত্র আমরা তিনখানা বই থেকে পাই, কিন্তু ছিয়াত্তরের মন্বন্তর আরও ভয়ঙ্কর ঘটনা হলেও সমসাময়িক কোন গ্রন্থে এর ভীতিপ্ৰদ চিত্রটা অঙ্কিত হয়নি। বাংলা সাহিত্যের এই শূন্যতা বিশেষভাবে দ্রষ্টব্য।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকটা ঝঙ্কৃত হয়েছিল রামপ্রসাদ, নিধুবাবু ও রামরাম বসুর গানে। নিধুবাবুর টপ্পা এক সময় বাঙালীর কানে সুধাবর্ষণ করত, এবং রামপ্রসাদের গান আজও বাঙালীর অন্তরকে মুগ্ধ করে। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে অষ্টাদশ শতাব্দীর বিশেষ অবদান বিষ্ণুপুর ঘরাণার উদ্ভব। এটা ধ্রুপদেরই একটা বিশেষ ঘরাণা। এই ঘরাণার বিশিষ্ট কলাবিদদের মধ্যে ছিলেন গদাধর চক্রবর্তী, কৃষ্ণমোহন গোস্বামী, নিতাই নাজীর ও বৃন্দাবন নাজীর। অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে রামশঙ্কর ভট্টাচাৰ্য কর্তৃক এই ঘরাণার সাংগীতিক খ্যাতি বিশেষভাবে বর্ধিত হয়। এখানে আরও উল্লেখযোগ্য যে অষ্টাদশ শতাব্দীতে প্ৰচলিত মধ্যযুগের সাহিত্যধারার পাশে আর একটা নূতন ( মৌখিক ) সাহিত্যধারার সৃষ্টি হয়েছিল। এটা হচ্ছে কবির গান। কবির গান এ সময় বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে সামন্তরাজগণ ও জমিদারগণের আমলে বাঙলায় নির্মিত হয়েছিল বাঙলার নিজস্ব স্থাপত্য রীতিতে ( চালা, রত্ন, শিখর, দালান ইত্যাদি ) বহু মন্দির। এই সকল মন্দিরের বৈশিষ্ট্য ছিল মন্দিরগুলির গায়ে পোড়ামাটির অলঙ্করণ। পোড়ামাটি অলঙ্করণের বিষয়বস্তু ছিল রামায়ণ, মহাভারত ও পৌরাণিক কাহিনী, কৃষ্ণলীলা বিষয়ক বৃত্তান্ত, সমকালীন সমাজচিত্র, বন্যপশুর অনায়াস বিচরণভঙ্গী ও সাবলীল গতিবেগ, এবং ফুল, লতাপাতা ও জ্যামিতিক নকশা প্ৰভৃতি। রামায়ণের কাহিনীর মধ্যে চিত্রিত হয়েছে হরধনুভঙ্গ, রামসীতার বনগমন, সুর্পনখার নাসিকাচ্ছেদন, মারীচবধ, রাবণ-জটায়ুর যুদ্ধ, জটায়ুবধ, অশোকবনে সীতা প্রভৃতি এবং মহাভারতের কাহিনীর মধ্যে অর্জুনের লক্ষ্যভেদ, শকুনীর পাশাখেলা, দ্ৰৌপদীর বস্ত্রহরণ, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধদৃশ্য, ভীষ্মের শরশয্যা, প্রভৃতি। পৌরাণিক বিষয়বস্তুর মধ্যে রূপায়িত হয়েছে বিষ্ণুর দশাবতার, দশদিকপাল, দশমহাবিদ্যা, ও অন্যান্য মাতৃকাদেবীসমূহ এবং অন্যান্য জনপ্রিয় পৌরাণিক উপাখ্যান যথা–শিববিবাহ, দক্ষযজ্ঞ, মহিষাসুরমর্দিনী ইত্যাদি। সামাজিক দৃশ্যসমূহের মধ্যে আছে বারাঙ্গনা বিলাস ও নানাবিধ আমোদ-প্ৰমোদ, বেদে-বেদেনীর কসরৎ, নানারূপ ঘরোয়া দৃশ্য ও বাঙালী রমণীর বিদেশীর নিকট প্রেম নিবেদন। এ ছাড়া, কয়েকটি মন্দিরে আছে যৌন-ক্রীড়ারত মিথুন মুর্তি।
বল-বাহুল্য যে মন্দিরগাত্রের এই সব অলঙ্করণ আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরে অষ্টাদশ শতাব্দীর বাঙালীর ধর্মীয় সচেতনতা ও জীবনচৰ্যার সজীব চিত্র।
।। ছয় ।।
১৭০৭ খ্ৰীস্টাব্দে মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকারিগণের পঙ্গুতা ও সেই অবসরে বাঙলার নবাবদের স্বাধীন শাসক হিসাবে আচরণ, ও এই বিশৃঙ্খলতার সুযোগে ইংরেজদের চক্রান্ত ও পরে আধিপত্য স্থাপন-এই নিয়েই বাঙলার অষ্টাদশ শতাব্দীর রাষ্ট্ৰীয় ইতিহাস। প্ৰথম যিনি নবাবী আমলের উদ্বোধন করেন, তিনি হচ্ছেন মুরশিদকুলি খান । ঔরঙ্গজেব জীবিত থাকাকালীন মুরশিদকুলি খান বাঙলায় যথেষ্ট শক্তিমান হয়ে উঠেছিল। কথিত আছে মুরশিদকুলি খান দাক্ষিণাত্যের এক ব্ৰাহ্মণ পরিবারের সন্তান। শৈশবকালে দস্যুরা তাকে হরণ করে নিয়ে গিয়ে পারস্যদেশীয় এক বণিকের কাছে বেচে দেয়। পারস্যদেশীয় এই বণিক তাকে মুসলমান ধর্মে দীক্ষিত করে নানারূপ বৈষয়িক বিষয়ে তাকে শিক্ষা দেন। ঔরঙ্গজেব যখন তার পিতা শাহজাহানের আমলে দীক্ষিণাত্যের সুবাদার ছিলেন, মুরশিদকুলি খান তখন তাঁর অধীনে দাক্ষিণাত্যের রাজস্ববিভাগে কর্ম গ্ৰহণ করে। ঔরঙ্গজেব যখন দিল্লীর সম্রাট হন, তখন তিনি মুরশিদকুলি খানকে কর্মপটু দেখে তাকে ঢাকায় সুবে বাঙলার দেওয়ান করে পাঠান। কিন্তু সুবাদার আজিম-উস-শানের সঙ্গে তার বনিবনা না হওয়ায় মুরশিদকুলি খান ১৭০১ খ্রীস্টাব্দে ঢাকা থেকে মুকসুদাবাদে তার দপ্তর উঠিয়ে নিয়ে আসেন। ১৭১৩ খ্রীস্টাব্দে সম্রাট ফারুকশিয়ারের আমলে মুরশিদকুলি খান বাঙলা, বিহার ও ওড়িশার সুবাদার নিযুক্ত হন। তখন থেকে তিনি মুকসুদাবাদের নাম বদল করে নিজ নাম অনুসারে মুরশিদাবাদ রাখেন। সে সময় থেকেই মুরশিদাবাদ বাঙলার রাজধানী হয়, এবং বাঙলার সুবাদাররা দিল্লীর সম্রাটের সঙ্গে নামমাত্র সম্পর্ক রেখে স্বাধীন নবাব হিসাবে শাসন করতে থাকেন। ১৭২৭ খ্রীস্টাব্দে তার মৃত্যুর পর তার জামাতা সুজাউদ্দিন খান বাঙলা, বিহার ও ওড়িশার সুবাদার হন। সুজার মৃত্যুর পর তার পুত্র সরফরাজ খান বাঙলার নবাব হয়। কিন্তু এক বছরের মধ্যে বিহারের শাসনকর্তা আলিবর্দী খান সরফরাজের কর্মচারীদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে তঁকে গিরিয়ার যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত করে মুরশিদাবাদের মসনদ দখল করে নেন। আলিবর্দীর মৃত্যুর পর তার দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলা নবাব হন। ইংরেজদের তিনি বিরোধী থাকায়, ইংরেজরা তার সেনাপতি মীরজাফরের সঙ্গে চক্রান্ত করে তাকে পলাশীর যুদ্ধে হারিয়ে দেয়। তাঁকে নিহত করে মীরজাফরকে মুরশিদাবাদের মসনদে বসানো হয়। পরে মীরকাশিম এবং তারও পরে পুনরায় মীরজাফর নবাব হয়। মীরজাফরের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্ৰ নজামউদ্দৌলার সময় ১৭৬৫ খ্ৰীস্টাব্দে ক্লাইভ সম্রাট শাহ আলমের কাছ থেকে বাঙলা, বিহার ও ওড়িশার দেওয়ানী লাভ করেন। তখন থেকে ইংরেজরাই প্ৰকৃতপক্ষে বাঙলা, বিহার ও ওড়িশার হর্তাকর্তা বিধাতা হয়ে দাড়ায়।
ইংরেজরা প্ৰথম বাঙলায় আসে ১৬৫১ খ্ৰীস্টাব্দে। তারা সম্রাট শাহজাহানের কাছ থেকে একটা ফরমান পায় । কিন্তু ১৬৫৮ খ্রীস্টাব্দে সম্রাট ঔরঙ্গজেব সম্রাট হবার পর হুগলির ফৌজদার সম্রাট শাহজাহান কর্তৃক প্রদত্ত ফারমান বাতিল করে দেয়। এর ফলে ইংরেজদের বাণিজ্য ব্যাহত হয়। নবাবের সঙ্গে তাদের ঝগড়া চলতে থাকে। শীঘ্রই তা সংঘর্ষ ও যুদ্ধে পরিণত হয়। ইংরেজরা নবাবের ফৌজকে পরাজিত করে হুগলি তছনছ করে দেয়। ১৬৮৬ খ্রীস্টাব্দে ইংরেজরা হুগলিতে থাকা আর যুক্তিযুক্ত নয় মনে করে, জোব চার্নকের নেতৃত্বে হুগলি পরিত্যাগ করে সুতানটিতে এসে ঘাঁটি স্থাপন করে। তারপর ১৬৯৮ খ্রীস্টাব্দের জুলাই মাসে ইংরেজরা মাত্র ১৬ হাজার টাকায় কলকাতা, সুতানটি ও গোবিন্দপুর এই তিন গ্রামের জমিদারী স্বত্ব কিনে নেয়। এখানেই তার তাদের প্রথম দুর্গ ফোর্ট উইলিয়াম নির্মাণ করে। এইভাবে ভাবীকালের রাজধানী কলকাতা শহর প্রতিষ্ঠিত হয়।
কলকাতায় শক্তিকেন্দ্ৰ স্থাপনের পর ইংরেজরা ব্যস্ত হয়। ভারতে শাসন বিস্তারে । সমসাময়িক রাজনৈতিক চক্রান্ত ইংরেজদের সহায় হয়। বাঙলার নবাব সিরাজকে তারা অপসারণ করে। তার পরিণতিতে ১৭৬৫ খ্রীস্টাব্দে তারা, দেওয়ানী লাভ করে ভারতের প্রকৃত শাসক হয়ে দাড়ায়। সদর দেওয়ানী ও নিজামত আদালত মুরশিদাবাদ থেকে কলকাতায় স্থানান্তরিত করা হয়। ১৭৭৩ খ্রীস্টাব্দের রেগুলেটিং অ্যাকটি অনুযায়ী কলকাতায় সুপ্রিম কোর্ট স্থাপিত হয়। ওই সালেই ওয়ারেন হেষ্টিংস গভর্নর-জেনারেল নিযুক্ত হন। আবার চক্রান্ত চলে। সুপ্রিম কোটের বলি হন এক ব্রাহ্মণ সন্তান—মহারাজ নন্দকুমার। এই ব্ৰহ্মহত্যা করে ইংরেজ তার প্রবল প্ৰতাপান্বিত শাসনশক্তির পরিচয় দেয়। এর কোন সক্রিয় প্ৰতিবাদ দেশের মধ্যে হল না । অনুগ্রহ দান করে ইংরেজ নাগরিক সমাজকে পঙ্গু করে রেখেছিল। সামন্তরাজগণ ও জমিদারদের ইংরেজ ভীতিগ্ৰস্ত করে তুলল। রণী ভবানীর জমিদারীর এক অংশ কেড়ে নিয়ে কান্তবাবুকে দিল । আর এক অংশ গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ দখল করে নিল । তারপর জমিদারদের সম্পূর্ণ নির্জীবি করে দিল ১৭৯৩ খ্রীস্টাব্দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দ্বারা। তার উদ্ভবের কথা নীচের অনুচ্ছেদে বলছি।
।। সাত ।।
১৭৬৫ খ্ৰীস্টাব্দে দেওয়ানী পাবার পরের সাত বৎসর ইংরেজ পূর্বতন ভূমিরাজস্ব প্ৰশাসন বলবৎ রাখে। মহম্মদ রেজা খানকে নায়েব-দেওয়ানরূপে ভূমিরাজস্ব পরিচালন ভার দেওয়া হয়। এর ফলে দ্বৈতশাসনের উদ্ভব হয়। দ্বৈতশাসনের ফলে অরাজকতা ও স্বৈরতন্ত্রের আবির্ভাব ঘটে । কৃষি-ব্যবস্থা বিশেষভাবে বিপৰ্যন্ত হয়। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পর কৃষকদের মধ্যে অর্ধেক মারা যাওয়ার ফলে, আবাদী জমির অর্ধাংশ অনাবাদী হয়ে পড়ে। দেয় রাজস্বের অর্ধাংশও আদায় হয় না। ১৭৭২ খ্রীস্টাব্দে ওয়ারেন হেস্টিংস জমিদারী মহালগুলিকে নিলামে চড়িয়ে দিয়ে ইজারাদারদের সঙ্গে পাঁচশালা বন্দোবন্ত করে । কিন্তু পাঁচশালা বন্দোবন্ত ব্যর্থ হয়। পরিস্থিতি গুরুতর দেখে ১৭৭৬ খ্রীস্টাব্দে ইংরেজ দ্বৈতশাসনের অবসান ঘটায় ও নিজেরাই দেওয়ানরূপে রাজস্ব আদায়ের ভার নেয়। ১৭৮৯-৯০ খ্রীস্টাব্দে বাঙলা, বিহার ও ওড়িশার জমিদারদের সঙ্গে দশশালা বন্দোবস্ত করা হয় । ১৭৯৩ খ্রীস্টাব্দে লর্ড কর্নওয়ালিশের আমলে এটাই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু রাজস্ব আদায় সম্বন্ধে কোম্পানির প্ৰত্যাশা সিদ্ধিলাভ করে না। ‘সূর্যাস্ত আইন’ অনুযায়ী অনাদায়ী মহালগুলিকে নিলামে চড়ানো হয় । কলকাতার নব্য-ধনিকেরা নিলাম থেকে সে সব মহাল কিনে নিয়ে নিজেরা জমিদার হয়ে বসে। কৃষিকলাবিদ, উদ্যোগী, ও সাহিত্যসংস্কৃতি অনুরাগী জমিদারদের পরিবর্তে সৃষ্ট হয় এক প্রবাসী, আধা-সামন্ততান্ত্রিক ও রায়তদের ওপর অত্যাচারী জমিদার শ্রেণী। দেশের সামাজিক বিন্যাস এতে বিপৰ্যস্ত হয়। বাঙলার সামন্তরাজগণ ও জমিদারবৃন্দের প্রতাপ, প্ৰতিপত্তি ও গৌরবের এখানেই ছেদ ঘটে। সাহিত্য, সংস্কৃতি, স্থাপত্য, ভাস্কৰ্য তার এ বলিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষকতা হারায় ।
।। আট ।।
ইংরেজ দেশের শাসনভার নেবার পর থেকেই, রাজস্ব আদায়ের ব্যাপার নিয়ে বাঙলার বহু জায়গায় কৃষক ও আদিবাসীদের মধ্যে অসন্তোষ প্ৰকাশ পায়। এর ফলে ঘটে সংঘর্ষ ও বিদ্ৰোহ । ১৭৬০ থেকে ১৮০০ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে মোট আটটা বিদ্রোহ ঘটে, যথা ১৭৬০ খ্ৰীস্টাব্দের প্রথম চুয়াড় বিদ্রোহ, ১৭৬৭ খ্রীস্টাব্দের সন্দীপের বিদ্রোহ, ১৭৬৯-৭০ খ্রীস্টাব্দের সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, ১৭৭০ খ্রীস্টাব্দের ত্ৰিপুরার বিদ্রোহ, ১৭৭৩ খ্রীস্টাব্দের ঘরুই বিদ্রোহ, ১৭৭৬ খ্ৰীস্টাব্দের চাকমা বিদ্রোহ ও ১৭৯৮-৯৯ খ্রীস্টাব্দের দ্বিতীয় চুয়াড় বিদ্রোহ। মেদিনীপুরের জঙ্গলমহল ও তার সংলগ্ন পশ্চিম ও উত্তরের অরণ্যভূমি অঞ্চলের আদিবাসীদের চুয়াড় বলা হত। তারা কৃষিকৰ্ম করত না এবং পশুপক্ষী শিকার ও বনজঙ্গলে উৎপন্ন দ্রব্যাদি বিক্রয় করে জীবিকা-নির্বাহ করত। স্থানীয় জমিদাররা তাদের পাইকবরকন্দাজের কাজে নিযুক্ত করত এবং বেতনের পরিবর্তে নিষ্কর ভূমির উপস্বত্ব ভোগ করতে দিত। এরূপ নিষ্কর জমিকে ‘পাইকান’ বলা হত। ১৭৬০ খ্রীস্টাব্দে মেদিনীপুর জেলায় ইংরেজ শাসন প্রবর্তিত হলে, ইংরেজরা নিয়মিত রাজস্ব আদায়ের উদ্দেশ্যে জমিদার ও তৎসঙ্গে চুয়াড়দের দমন করবার চেষ্টা করে। এর ফলেই বিদ্রোহ হয় এবং একেই চুয়াড় বিদ্রোহ বলা হয়। চুয়াড় বিদ্রোহের নায়ক ছিল গোবর্ধন দিকপতি। জঙ্গলের চুয়াড়গণ গোবর্ধনের নেতৃত্বে কর্ণগড় রাজ্য আক্রমণ করে ( ১৭৬০ ) । কর্ণগড়ের রাণী শিরোমণি ভীত হয়ে নাড়াজোলের রাজা ত্ৰিলোচন খানের আশ্ৰয় নেন। ত্ৰিলোচনী খান চুয়াড়দের পরাস্ত করেন। কিন্তু ১৭৯৮ খ্ৰীস্টাব্দে আবার দ্বিতীয় চুয়াড় বিদ্রোহ হয়। দিকপতির নেতৃত্বে প্ৰায় ৪০০ বিদ্রোহীর বাহিনী চন্দ্ৰকোেনা পরগনা ও মেদিনীপুর জেলার বৃহত্তম গ্ৰাম আনন্দপুর আক্রমণ ও লুণ্ঠন করে। ইংরেজরা চুয়াড়দের দমন করে, কিন্তু রাণী শিরোমণিকে এই বিদ্রোহের নেত্রী ভেবে, তাঁকে কলকাতায় এনে বন্দী করে রাখে। পরে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে তন্তুবায়দের ওপর ইংরেজ বণিকদের উৎপীড়নের বিরুদ্ধে তন্তুবায়রা বিদ্রোহ করে । ইতিহাসে একে তন্তুবায় আন্দোলন বলা হয়। শান্তিপুরে এই আন্দোলনের প্রধান নায়ক ছিল বিজয়রাম ও ঢাকায় দুনিরাম পাল । এদের পর এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয় লোচন দালাল, কৃষ্ণচন্দ্ৰ বড়াল, রামরাম দাস, বোষ্টম দাস প্রমুখ। ইংরেজ বণিকদের শর্ত মেনে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর না করায় ইংরেজরা বোষ্টম দাসকে তাদের কুঠিতে আটক করে তার ওপর অত্যাচার করে। সেই অত্যাচারের ফলে বোষ্টম দাস মারা যায়।
১৭৬০ খ্রীস্টাব্দে ত্রিপুরা জেলার রোশনাবাদ পরগণায় কৃষকরা সমশের গাজী নামক এক ব্যক্তির নেতৃত্বে বিদ্রোহ ঘোষণা করে । সমশের কৃষকদের সঙ্ঘবদ্ধ করে ত্রিপুরার প্রাচীন রাজধানী উদয়পুর দখল করে ও সেখানে স্বাধীন রাজ্য প্ৰতিষ্ঠা করে কৃষকদের মধ্যে জমিবণ্টন ও কর মকুব, জলাশয় খনন প্ৰভৃতি জনহিতকর কাজ করে। নবাব মীরকাশিম ইংরেজ সৈন্যেরা সহায়তায় সমশের বাহিনীকে পরাজিত করে। সমশেরকে বন্দী করে মুরশিদাবাদে নিয়ে আসা হয়। পরে নবাবের হুকুমে তাকে তোপের মুখে ফেলে হত্যা করা হয়।
এই সময়ে মেদিনীপুরের ঘরুই উপজাতিরা বিদ্রোহ করে। দুবার বিদ্রোহ হয়। প্ৰথমবার জমিদার শত্ৰুঘ্ন চৌধুরীর পুত্র নরহর চৌধুরী রাত্ৰিতে নিরস্ত ঘরুইদের এক সমাবেশের ওপর আক্রমণ চালিয়ে ৭০০ ঘরুইকে হত্যা করে । দ্বিতীয়বার বিদ্রোহ হয় ১৭৭৩ খ্ৰীস্টাব্দে। এবারও ঠিক আগের মতই রাত্রিকালে আক্রমণ চালিয়ে বহু ঘরুইকে হত্যা করা হয়।
চাকমা উপজাতির মধ্যেও একাধিকবার বিদ্রোহ হয়। প্ৰথম চাকমা বিদ্রোহের (১৭৭৬-৭৭) নায়ক ছিল রামু খাঁ । সে চাকমা জাতিকে একত্রিত করে প্ৰথম কার্পাস কর দেওয়া বন্ধ করে ও তার সঙ্গে ইংরেজদের বড় বড় ঘাঁটিসমূহ ধ্বংস করে দেয় । ইংরেজ বাহিনী এসে এই বিদ্রোহ দমন করে। এই বিদ্রোহে চাকমা দলপতি শের দৌলত অসাধাবণ বীরত্ব দেখিয়েছিল। পিতার পর শের দৌলতের ছেলে জানবক্স খাঁ দ্বিতীয় চাকমা বিদ্রোহের নেতৃত্ব করে। তার সময় ( ১৭৮৩-৮৫ খ্রীস্টাব্দে ) কোন ইজারাদারই চাকমা অঞ্চলে প্ৰবেশ করতে পারেনি। বহুদিন সে স্বাধীনভাবে শাসন করেছিল ।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধের সবচেয়ে বড় বিদ্রোহ হচ্ছে সন্ন্যাসী বিদ্রোহ । এই বিদ্রোহেই আমরা প্ৰথম এক মহিলাকে নেতৃত্ব করতে দেখি । সেই মহিলা হচ্ছে দেবী চৌধুরানী। বিদ্রোহের অন্যতম নেতা হচ্ছে ভবানী পাঠক। ইংরেজরা তাদের গ্রেপ্তার করবার জন্য সৈন্যসামন্ত পাঠিয়ে দেয়। ভবানী পাঠক ইংরেজদের দেশের শাসক বলে মানতে অস্বীকার করে। দেবী চৌধুরানীর সহায়তায় সে ইংরেজদের ওপর হামলা চালায়। তার ফলে ময়মনসিংহ ও বগুড়া জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে শাসন ব্যবস্থা আচল হয়ে পড়ে। লেফটানেণ্ট ব্রেনোর নেতৃত্বে পরিচালিত ইংরেজ বাহিনী তাকে এক ভীষণ জলযুদ্ধে পরাজিত করে, ও ভবানী পাঠক নিহত হয়। সন্ন্যাসী বিদ্রোহের অপর এক নেতা ছিল কৃপানাথ। কৃপানাথ এক বিরাট বাহিনী নিয়ে রংপুরের বিশাল বৈকুণ্ঠপুর জঙ্গল অধিকার করে। তার ২২ জন সহকারী সেনাপতি ছিল। রংপুরের কালেকটর ম্যাকডোয়াল পরিচালিত বিরাট সৈন্যবাহিনী দ্বারা জঙ্গল ঘেরাও হলে ইংরেজবাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের খণ্ডযুদ্ধ হয়। বিদ্রোহীগণ বিপদ বুঝে নেপাল ও ভুটানের দিকে পালিয়ে যায়। উত্তরবঙ্গে এই বিদ্রোহের অন্যতম নেতা ছিল ফকির সম্প্রদায়ের মজনু শাহ। মজনুর কার্যকলাপে উত্তরবঙ্গ, ময়মনসিংহ ও ঢাকা জেলায় ইংরেজরা নাস্তানাবুদ হয়। সশস্ত্র বাহিনীর সাহায্যে তাকে দমন করা সম্ভবপর হয় না। ভবানী পাঠকের সন্ন্যাসীর দলের সঙ্গে মজনুর ফকির দলের একবার সংঘর্ষ হয়, কিন্তু পরে তারা পুনরায় সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে নিজেদের কার্যকলাপ চালায়। তাদের কার্যকলাপের অন্তর্ভুক্ত ছিল। জমিদারদের কাছ থেকে কর আদায় করা, ইংরেজ সরকারের কোষাগার লুণ্ঠন করা ইত্যাদি । তবে সাধারণ জনসাধারণের ওপর তারা অত্যাচার বা বলপ্ৰয়োগ করত না । ১৭৮৬ খ্ৰীস্টাব্দের ২৯ ডিসেম্বর তারিখে মজনু পাঁচশত সৈন্যসহ বগুড়া জেলা থেকে পূর্বদিকে যাত্রা করার পথে কালেশ্বর নামক জায়গায় ইংরেজ, বাহিনী কর্তৃক মারাত্মকভাবে আহত হয়। মজনুর দল বিহারের সীমান্তে পালিয়ে যায়। মাখনপুর নামক স্থানে মজনুর মৃত্যু হয়।
ফকির সম্প্রদায়ের অপর এক প্রধান নেতা ছিল সোভান আলি । সোভান আলি বাঙলা, বিহার ও নেপালের সীমান্ত অঞ্চলে ইংরেজ সরকার ও জমিদারদের অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। দিনাজপুর, মালদহ ও পূর্ণিয়া জেলায় ইংরেজী বাণিজ্যকুঠি ও মহাজনদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালাবার সময় তার সহকারী জহুরী শাহ ও মতিউল্লা ইংরেজদের হাতে ধরা পড়ে কারারুদ্ধ হয়। সোভান পরে আমুদী শাহ নামে এক ফকির নায়কের দলে যোগ দেয়। এ দলও ইংরেজদের হাতে পরাজিত হয়। এর পরেও সোভানা ৩০০ অনুচর নিয়ে ১৭৯৭-৯৯ খ্রীস্টাব্দঃ পর্যন্ত উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ছোট ছোট আক্ৰমণ চালায়। লর্ড ওয়েলেসলী তাকে গ্রেপ্তারের জন্য চার হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে।
।। নয় ।।
আগেই বলেছি যে বাঙলার অষ্টাদশ শতাব্দীর সামাজিক ইতিহাস চিহ্নিত হয়ে আছে দুই বীভৎস ঘটনার দ্বারা । একটা হচ্ছে বর্গীর হাঙ্গামা ও আরেকটা হচ্ছে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। ১৭৪২ খ্রীস্টাব্দে আলিবর্দী খানের শাসনকালে নাগপুরের রঘুজী ভেঁসলের দেওয়ান ভাস্কররাম কোলাহাতকারের (ওরফে ভাস্কর পণ্ডিত ) নেতৃত্বে একদল মারাঠা অশ্বারোহী সৈন্য বাঙলাদেশে এসে উৎপাত শুরু, করে । এটাই বৰ্গীর হাঙ্গামা নামে পরিচিত । এই হাঙ্গামা স্থায়ী ছিল ১৭৪২ থেকে ১৭৫১ পৰ্যন্ত । প্ৰথম বছর যখন তারা আসে, আলীবর্দী খান তখন বাঙলায় ছিলেন না, ওড়িশায় গিয়েছিলেন। কিন্তু ফেরবার পথে যখন তিনি বর্ধমান শহরে রাণী দীঘির কাছে আসেন, মারাঠা অশ্বারোহীরা তাঁর শিবির অবরোধ করে। নবাব অতি কষ্টে সেখান থেকে কাটোয়ায় পালিয়ে যান । মারাঠারা সংখ্যায় পঁচিশ হাজার ছিল। তারা ভাগীরথী অতিক্রম করে। মুরশিদাবাদে এসে লুটপাট করে। জগৎশেঠের বাড়ি থেকে তারা অনেক ধনদৌলত সংগ্ৰহ করে। ইতিমধ্যে আলিবর্দী খান মুরশিদাবাদে এলে বর্গীরা কাটোয়ায় পালিয়ে যায়। পূজার সময় বর্গীরা কাটোয়ার কাছে দাঁইহাটায় দুর্গাপূজা করে। নবমীর দিন আলিবর্দী অতর্কিতে তাদের আক্রমণ করে তাড়িয়ে দেয়। তারপর বালেশ্বর যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মারাঠারা চিলাকা হ্রদের দক্ষিণে পালিয়ে যায়। কিন্তু বৰ্গীদের হাঙ্গামা এক বছরের ব্যাপার নয়। নয় বছর ধরে এটা বাৎসরিক অভিযানে দাড়ায় । এই নয় বছরের উৎপাতের ফলে ভাগীরথীর পশ্চিম তীরস্থ অঞ্চলসমূহ বিশেষ করে বর্ধমান ও মেদিনীপুর জেলা আতঙ্কে অভিভূত হয়ে পড়ে। লুটপাট ও গণহত্যা ছাড়া, তারা ব্যাপকভাবে নারীধর্ষণ করত। ভারতচন্দ্ৰ তাঁর ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে লিখেছেন– ‘লুঠি-বাঙলার -লোক করিল কাঙাল। গঙ্গাপার হইল বাঁধি নৌকার জাঙ্গাল।। কাটিল বিস্তর লোক গ্রাম গ্রাম পুড়ি । লুঠিয়া লইল ধন বিহুড়ী বহুড়ী ।।” অনুরূপ বর্ণনা মহারাষ্ট্রপুরাণ ও চিত্রচম্পূতেও আছে।
বৰ্গীর হাঙ্গামা ঘটেছিল পলাশীর যুদ্ধ ও ইংরেজদের দেওয়ানী পাবার আগে । ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ঘটে দেওয়ানী পাবার চার-পাঁচ বছর পরে। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময়ই ইংরেজ শাসনের শোষক রূপটা ফুটে ওঠে। এরকম ভয়াবহ ও মর্মান্তিক দুর্ভিক্ষ বাঙলা দেশের ইতিহাসে আর কখনও ঘটেনি। ১৭৬৮ খ্রীস্টাব্দে অনাবৃষ্টির জন্য চালের ফলন কম হয় । তার ফলে ১৭৬৯ খ্রীস্টাব্দের গোড়া থেকেই চালের মূল্য বৃদ্ধি পেতে থাকে। দুর্ভিক্ষের আশঙ্কায় ইংরেজ সরকার সৈন্যবাহিনীর জন্য ৬০ হাজার মণ চাল বাজার থেকে কিনে নেয়। সঙ্গে সঙ্গে কোম্পানির কর্মচারীরাও ফটিকাজনিত মুনাফা লোভের আশায় বাজার থেকে চাল সংগ্রহ করতে থাকে। এর ফলেই ১৭৭০ খ্রীস্টাব্দে এক ভয়াবহ দুর্তিক্ষের আবির্ভাব হয়, যার বৰ্ণনা হাণ্টারের ‘অ্যানালস্ অভ্ রুরাল বেঙ্গল’ ও বঙ্কিমের ‘আনন্দমঠ’-এ পাওয়া যায়। মন্বন্তরের পরের দু’বছর বাঙলা আবার শস্য-শ্যামলা হয়ে উঠেছিল। লোক পেট ভরে খেতে পেল বটে, কিন্তু লোকের আর্থিক দুৰ্গতি চরমে গিয়ে পৌঁছাল । অত্যধিক শস্যফলনের ফলে কৃষিপণ্যের দাম এমন নিম্নস্তরে গিয়ে পৌঁছােল যে হাণ্টার বলেছেন যে হাটে শস্য নিয়ে গিয়ে বেচে গাড়ী ভাড়া তোলাই দায় হল। এদিকে ইংরেজ তার শোষণ নীতি পূর্ণোদ্যমে চালাতে লাগল, এবং তার জন্য নির্যাতনও বাড়তে লাগল। শুধু তাই নয় খাজনার পরিমাণও বাড়িয়ে দিল। কিন্তু বাড়ালে কি হবে ? আধা রাজস্ব আদায় হল না। কৃষকের দুৰ্গতির পূরিসীমা রইল না। জমিদাররা খাজনা দিতে না পারায়, তাদের জমিদারীসমূহ নিলামে উঠল।
।। দশ ।।
এবার গ্রামীন জীবনচৰ্যা সম্বন্ধে কিছু বলব। বিভিন্ন জাতির এক একটা কৌলিক বৃত্তি ছিল। কৌলিক বৃত্তিধারী এই সকল জাতিরাই ছিল সমাজের ‘টেকনোলজিস্টস্’ বা মেরুদণ্ড। তবে ধনগরিমায় সমাজের শীর্ষে ছিল বণিক সম্প্রদায়। সাধারণ লোক ধন-দৌলতের মধ্যে অবগাহন না করলেও সুখস্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে বাস করত। সকল জাতির লোকেরাই চাষবাস করত। সুফলার বছরে কারুরই অন্নকষ্ট হত না । পুকুর থেকে পেত প্রয়োজনীয় মাছ, গোয়াল থেকে দুধ ও নিজ বাগিচা থেকে শাক-সবজী। সকলেই সূতা কাটত ও তা দিয়ে কাপড় বুনিয়ে নিত। সাধারণ লোকের ছিল ধুতি ও চাদর বা গামছা । মেয়েরা পরত শাড়ী । তাদের কোন রকম অন্তর্বাস বা উত্তরবাস ছিল না | শাড়ীখানাই ওপরের অঙ্গে জড়িয়ে ঘোমটা দিত। অন্তর্বাস ছিল না বলে শাড়ীর মধ্যভাগে পাছার কাছে আর একটা পাড় থাকত। এরূপ শাড়ীকে পাছাপাড় শাড়ী বলা হত ।
তবে বিত্তশালী সমাজের পোশাক-আশাক অন্য রকমের হত। তারা প্রায়ই রেশমের কাপড়, পায়ে ভেলভেটের ওপর রূপার কাজ করা জুতা, কানে কুণ্ডল, দেহের ওপর অংশে আঙরাখা, মাথায় পাগড়ি ও কোমরের নীচে কোমরবন্ধ পরত। পুরুষরা দেহ চন্দনচর্চিত করত, আর মেয়েরা স্নানের সময় হলুদ ও চূর্ণ চুৰ্ণ দিয়ে দেহমার্জিত করত। মাথার কেশপাশ আমলকীর জলে ধৌত করত। অভ্রের চিরুনি দিয়ে মাথা আঁচরাত ও নানারকম খোঁপা বাঁধত ।
সধবা মেয়েরা সকলেই হাতে নোয়া ও শাঁখা পরত। তাছাড়া থাকত হাতে কঙ্কণ, পায়ে মল, কোমরে গোট, গলায় হার, কানে মাকড়ি, নাকে নোলক ও নথ।
মেয়ে পুরুষ নির্বিশেষে দিনের বেলা সকলেই কাজকর্মে ব্যস্ত থাকত। রাত্ৰিবেলা মঙ্গলকাব্য বা পৌরাণিক উপাখ্যান অবলম্বনে রচিত পাঁচালী গান শুনত। এ ছাড়া ছিল নানারকম বারব্রত ও পালপার্বণ। দোল দুর্গোৎসবের সময় মহাঘাটা হত। দুটা লৌকিক পাৰ্বণও ছিল। একটা অরন্ধন ও আর একটা পৌষপার্বণ। এছাড়া ছিল অনেক সামাজিক অনুষ্ঠান যথা বিবাহ, শ্ৰাদ্ধ, মেয়েদের সাধ, রজঃদর্শন, অন্নপ্রাশন, উপনয়ন, নামকরণ, বিদ্যারম্ভ, আটকৌড়ে, চারকৌড়ে ইত্যাদি। বিবাহে কন্যাপণ দেওয়াই রীতি ছিল, তবে কুলীন ব্ৰাহ্মণরা বরপণ পেতেন। কৌলীন্য প্ৰথা দ্বারা সমাজ ভীষণভাবে কলুষিত ছিল। কুলরক্ষার জন্য কুলীন পাত্রের সঙ্গে মেয়ের বিবাহ দিয়ে নিজের কুলরক্ষা করতে হত । প্ৰায়ই কুলীন ব্ৰাহ্মণগণ অগণিত বিবাহ করত ও স্ত্রীকে তার পিত্ৰালয়েই রেখে দিত। ভারতচন্দ্ৰ তার ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাব্যে লিখেছেন–“আর রামা বলে আমি কুলীনের মেয়ে। যৌবন বহিয়া গেল বর চেয়ে চেয়ে ।। যদি বা হইল বিয়া কতদিন বই। বয়স বুঝিলে তার বড় দিদি হই ।। বিয়াকালে পণ্ডিতে পণ্ডিতে বাদ লাগে। পুনর্বিয়া হবে কিনা বিয়া হবে আগে ।। বিবাহ করেছে সেটা কিছু ঘাটিষাটি। জাতির যেমন হৌক কুলে বড় আঁটি ।। দু’চারি বৎসরে যদি আসে একবার। শয়ন করিয়া বলে কি দিবি ব্যাভার ।। সুতা বেচা কড়ি যদি দিতে পারি তায়। তবে মিষ্ট মুখ নহে রুষ্ট হয়ে যায় ॥” এছাড়া আঠারো শতকের সমাজে ছিল বাল্যবিবাহ, শিশুহত্যা, সতীদাহ, দেবদাসী প্রথা ও দাসদাসীর কেনাবেচা ।
।। এগার ।।
এই গ্রামীণ সমাজের কাছে তাদের ধনাগরিমার ডাঁট দেখাবার জন্যই অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে কলকাতায় গঠিত হয়েছিল এক নাগরিক সমাজ। এই সমাজের সমাজপতিরা বাঙলার প্রাচীন বনিয়াদী পরিবারের লোক ছিলেন না । এঁৱা সামান্য অবস্থা থেকে দেওয়ানী, বেনিয়ানী, খোসামুদী, দালালী, নারী সংঘটন ও নানারকম চক্রান্তে যোগ দিয়ে, ইংরেজদের অনুগ্রহ লাভ করে কলকাতার অভিজাত পরিবারসমূহের প্রতিষ্ঠাতা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। এই অভিজাত পরিবারের লোকদের ‘বাবু’ বলা হত। রাত্রে বাড়ীতে থাকা তারা অভিজাত্যের হানিকর মনে করতেন। বারবনিতার গৃহেই তারা রাত্রিটা কাটাতেন। শহরে বারবনিতার প্রসারে তারাই ছিলেন সহায়ক। পরবর্তী শতাব্দীর নবজাগরণ এঁদের দ্বারা সংঘঠিত হয়নি। নবজাগরণ সংঘটিত হয়েছিল এক শিক্ষিত সমাজের প্রয়াসে। এই শিক্ষিত সমাজের অভ্যুত্থান ঘটে মুদ্রণের প্ৰবৰ্তন ও তার পরিণতিতে স্কুল, কলেজ ইত্যাদি স্থাপনের ফলে। মুদ্রণের প্রবর্তন হয় অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে ওয়ারেন হেষ্টিংস-এর আমলে। মাত্র মুদ্রণ নয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর অনেক বৈশিষ্ট্যের আবির্ভাব ঘটেছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে। বানিজ্যের প্রসার, ডাকের প্রবর্তন, ব্যাঙ্ক ও ইনসিওরেন্স্ কোম্পানীর প্রতিষ্ঠা, সংবাদপত্র প্রকাশ, জ্ঞানানুশীলনের জন্যে এসিয়াটিক সোসাইটি স্থাপন, নাট্যাভিনয়, ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন ইত্যাদি অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকেই ঘটেছিল। এক কথায়, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকটাই ছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণের প্রস্তুতিপর্ব।