হৃদয় যতদূর

হৃদয় যতদূর

কোনো কিছুই সত্য নয়, কোনো কিছুই মিথ্যা নয় তাই সত্য ও মিথ্যার সঙ্গে স্বাভাবিকতার সংসর্গটাকেই সে জীবনের জীবিত গ্রন্থ বলে বেছে নিয়েছে এবং একা একা থাকা তাই তার তুমুল দর্শনে কুলিয়ে গেছে। মীয়ের বারান্দায় বসে ঘন মেঘের মতো একা একা থাকতে তাই তার কোনো ক্রমেই অস্বাভাবিক মনে হয়নি। কিন্তু নিজেকে নিশ্চিতের নম্রতায় বাঁধা সে আর এক অভিভূত পথ। বরং যেখানে জাগতিক সম্বন্ধ, সময়ের সঙ্গে শত্রুতা ও বন্ধুত্বের ব্যবহার বিরাজমান; সেখানে সম্মিলিত হয়েছে যারা; তাদের প্রতি তাই আজ তার শ্রদ্ধা বেড়ে গেছে। কিন্তু শ্রদ্ধার সঙ্গে হৃদয়ের যতদূর যোগসূত্র থাকা উচিত ততটুকু কেন যে হয়নি এটাই তার বিস্ময়াভুক্তি এখন। ভেবেছিল কোনো বন্ধন যখোন নেই কোথায়ও চলে যাবে। এবং এ নিয়ে তার কল্পনার সীমাটা একটু বাড়ন্তই ছিল। জীবনের যখোন যৌবন তখোন সে বৃদ্ধত্বকে ভালোবেসে কষ্ট পায়নি। নক্ষত্রের মধ্যে নীরবতাকে বরং মনে হচ্ছে পৃথিবীর সমস্ত স্থাপনের চেয়ে, পরিণত মানুষের পরিশ্রমের চেয়ে, কৃতিত্বের চেয়ে বিশাল। সকাল বেলা একটি শিশিরের সঙ্গে সূর্যের যে ক্ষীণ সম্পর্ক সেই সম্পর্কের মধ্যে যে সূক্ষ্ম ব্যাঞ্জনা তাকেই তার মনে হয়েছে সত্য। আর সংসারের স্থূলতা, স্বামী স্ত্রী বিরচিত কাপ-পিরিচের, উনুনের, শয্যার, সন্তাপের এবং একই সঙ্গে সন্দেহের যে একটি জগত আছে আমাদের সময়ের আশেপাশে তাকে সে মনে মনে ঘৃণা কোরলেও প্রকাশ করেনি। এমনকি সিনেমার সেলুলয়েডের মধ্যে হাঁটাচলা নায়কের মতো এই নিয়ে নায়িকাকে গল্পও শোনায়নি। বলা চলে, সে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র হয়েও একেবারে সাধারণ সাধারণ হয়েও একেবারে স্বতন্ত্র। কোনোক্রমে পিতৃত্বের রক্ত বংশের বিবদমান সম্পত্তি হিসেবে তার স্বাস্থ্যকে সে সম্পূর্ণ কোরে রাখতে পারতো হয়তো। কিন্তু রাত্রিজাগা তার নিদ্রার অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ যত না ঘুম তার চেয়ে ঘুমের পাশে বসে জেগে থাকাই তার স্বভাব। মোটামুটি বলা চলে, সে বলীয়ানও নয় যেমন বলীয়ান ছিল তার শৈশবের সে এবং বৃদ্ধও নয় যেমন বৃদ্ধ হলে লোকে বলতো বয়স হয়েছে। বিদ্যার্জনের আলোকিত যে পথ তাকে সে হেঁটে নিশ্চিন্তে পেরিয়েছে কামরা আর করিডোর। এখন আর কোনো স্থান অবশিষ্ট নেই স্বদেশে। সবুজ ধান গাছের মতো কেবল সামনে পড়ে আছে পরিণতি। যে কোনো সময়ে ইচ্ছে কোরলে সে একটি চাকুরি জুড়িয়ে নিতে পারে কিন্তু চাকরের শোভন দরখাস্ত তার হাতে এলেও নিজ হস্তে লেখা হয় না। অগত্য শিমুল ফুলের সঙ্গে স্বপ্নের একটা সন্ধি নয়তো স্বপ্নের সঙ্গে স্মৃতির একটা বিয়ে দেয়া চুক্তির খসড়াপত্র লেখালেখি কোরে ভাবলো “আমি ইমান, নিশ্চয়ই রাজনীতির নিহত কৌশলগুলি অবলম্বন কোরে আমার ভিতরের ইমানের স্বভাবের মধ্যে পরিবর্তমান আলো জ্বালতে পারি।”

“আমার শৈশবের সন্ধ্যাগুলি ছিল সারসরে সঙ্গে সদ্ব্যবহার। আমার যৌবনের সন্ধ্যাগুলিকে আমি সমস্যার সঙ্গে সদ্ব্যবহার কোরবো। আমি-এককালে নির্জন ঘরদোর, ইস্কুল বাড়ী, নিরিবিলি–গাছপালা ঘিরে বসে থাকতাম।

এখন পল্টনের পরিধির মতো পরিচয় বিস্তৃত মানুষের মধ্যে মহৎ যাবতীয় উপাদান খুঁজে বক্তৃতা করায় আমার অসুবিধে হবে না। এবং আমি ডায়রীর দিন যাপনের অংশে যে সব স্মৃতি চিত্র সংগ্রহ কোরেছি, মিলিটারী পুলিশের পরিণতি এবং মহিলাদের সাময়িক সরগরমী স্মৃতি নিয়ে, তাতে মনে হয় একটি গল্প লেখা যাবে।”

কিন্তু ইমান কোনোদিন কান্নাকে ছুঁয়ে দেখেনি। সে যদিও অশ্রু শব্দটাকে ভালোবাসে এবং কারো কবিতায় বার বার অশ্রুর কথা উল্লেখিত হলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে রৌদ্রের মধ্যে যেমন পাখি পাখা পাল্টায় ওরকম শব্দগুলো পাল্টিয়ে-পাল্টিয়ে পড়লেও নিশ্চিত মনে হয়েছে তার অশ্রুর মধ্যে একটি অন্ধকারের চুমু না পড়লে অশ্রু কান্না হয়ে ওঠে না। অশ্রু ও কান্নার মধ্যে তফাৎ অনেক। এবং ভালোবাসলেই কেবল অশ্রুও হওয়া যায়। শিশুরা কাঁদে কিন্তু ভালোবাসা অশ্রুও হয়। শিশু ও ভালোবাসার মধ্যে যা সম্পর্ক তা ঐ কান্না ও অশ্রুর। একই অর্থবাচক। কিন্তু পৃথক। আগুনে ও চিতায় যেমন। কিন্তু যখোন সময়ের ঘরে একটি সূচ পড়ে নক্ষত্র জ্বলে ওঠে, আলো পতঙ্গের মধ্যে পরিচ্ছন্ন ইমানের আকাশে ভিড় করে তখোন সে স্মৃতি মুখাপেক্ষী হয়। একবার যখোন যাবতীয় সংশ্রব থেকে সে নিজেকে স্বেচ্ছায় বহিষ্কার কোরেছিল। সময়ের সঙ্গে আর পেরে উঠছিল নির্বাসনে। তখোন এক বন্ধুর সাথে পার্বত্যাঞ্চল ভ্রমণের সৌভাগ্য হয়েছিল তার এবং সমুদ্র দর্শনেরও। কিন্তু পর্বত আর সমুদ্রের মধ্যে কি জলের ও স্থলের সাময়িকী প্রকাশিত হতে দেখে প্রেমিক ও প্রেমিকারা, কবি এবং সাহিত্যিক সেসব দেখে আর ভেবে উঠতে পারলো না। বরং উঁচু নীচু খাড়ি, লাল ধুলো রাঙ্গা পথ একাকী অস্ত-সূর্যে দুইজনের বেশী লোকের একটিও পথ না থাকা অঞ্চল, তার মনে হয়েছিল বিরস। কেবল, কালো গোড়ালীতে ভরপুর মাংসের এক যুবতী পুষ্করিণীর পাড়ে হাঁসের মতো বসে, পাখা থেকে যখোন শব্দ আসছিল ওজু করার এবং যুবতীটি আশ্চর্য একটি বয়সের গ্রহণযোগ্য বলেই সে ঐটুকুই সৌন্দর্য পাহাড় পল্লব থেকে চয়ন কোরেছিল। যুবতীটির হাতে ছিল এক গাছি অস্ত-সূর্যের কিরণ। চোখের উপর দিয়ে শেষ বিকেলের বাতাস, মালা বুনে যাচ্ছিল সবুজ শিহরণের। শাড়ী কোমর অবধি জলের ভঙ্গির মধ্যে যেমন ঘাসগুচ্ছ মাঝে মাঝে বিল অঞ্চলে বেড়ে ওঠে তেমন উঠে তারপর আবার দুই ভাগে স্রোতের বিপরীতে ভাগ হয়ে বুক পর্যন্ত একটি বঙ্কিম ঢেউ চালিয়ে গ্রীবায় একটি জলের মরু উপকূল ঘিরে বয়ে যাচ্ছিল। শাড়ীটির পিছনে পটক্ষেপ বলতে কয়েকিট শালিক বসে থাকা ঘাসের ঢিপি। অর্থাৎ সে যেখানে বসেছিল তার পিছনেই বনভূমির এর প্রান্ত এসে ঢেস দিয়ে দাঁড়িয়েছে গার্হস্থ্য ঘরের নিকানো আঙ্গিনার ডোয়ার মতো। ইমান বার বার তাকিয়েছিল। কিন্তু তাকিয়ে থাকতেও তার স্বভাব দুর্বল হচ্ছিল। আর দুর্বলতাটাকে সে মনে করে নৈরাশ্যের জনক। এবং একবার কোনো এক বিরচিত ব্যথার মধ্যে সে বুঝেছিল নৈরাশ্য কি ভয়াবহ। তাই যেখানেই সে ঐ শব্দটিকে, অনুভূতিটাকে খুঁজে পায় সেখানে সে আর একদণ্ড স্থাপিত হতে পারে না। অগত্যা বলেছিল বন্ধুটাকে–“পাহাড়ের মধ্যে পাথর ছাড়া তো আমি কিছু দেখতে পাইনে, পিকনিকে মেয়ে মানুষের হাতের রান্না বরং খাওয়া যায়, কিন্তু পাহাড়ে এসে পৃথিবী দেখা–ন্যাক্কারজনক!”

সমুদ্রের কাছে শখ আছে। ভালো। কিন্তু শখের মধ্যে সমুদ্রের বিপদ আছে, এরকম কথা কয়জন কবি লিখেছেন?

কিন্তু বন্ধুটি নিরুত্তর। তার নিরুত্তর সাহচার্যে বরং ইমান খুশী হয়েছিল। সে শাসনের মধ্যে কোনো অনুশাসনের আভাস সইতে পারে না। এবং বাক্যের মধ্যে প্রতিবাক্য। একা একা কথা বলার সুখ। একা একা হাটার সুখ। একা একা প্রেমের মধ্যে হাবুডুবু খাওয়া সবচেয়ে সত্য এবং সবচেয়ে নিরাপদ বরং যেখানেই দুই পক্ষ বিরাজমান সেখানে পরিণতি হয়তো আসে, কিন্তু প্রবাহ কোনো গোলমালের ধার ধারে না বলেই বয়ে চলেতো বয়েই চলে। এবং ইমানের এই সহজাত স্বভাবের জন্যেই তার প্রিয় হয়েছে সমান্তরাল রেলরেখা।

বিশাল রাত্রির মধ্যে হঠাৎ লণ্ঠন ঘুরিয়ে যেমন চৌকিদার কথা বলে, ঈষৎ আশ্চর্যে প্রোথিত ভয় ও ভীতিতে এরকম রাত্রির মধ্যে ইমাম তাই বার বার বিশাল অন্ধকারের বাণিজ্য কোরেছে। সংসারে সীমানায় পৌঁছায়নি। সংসারের সম্বন্ধেও তার কোনো সাহচর্য নেই। কেবল থাকা এবং থাকতে হয় বলেই সে সংসারকে সহিত’ কোরেছে। যার জন্য বিরোধী উপাদান তার কাছে এসে বীজাণু গমন করেনি, কুঁকড়ে শুকিয়ে গিয়েছে। সামান্য সে সচকিত হয়নি। সচকিতের মতো সামান্যকে দেখে আঁতকে ওঠেনি। বন্ধুটি যখোন কথা বলছিল না তখোন সে নিজের নাকের ডগায়-মাটির মতো ম্লান সূর্যাস্তকে তাড়িয়ে দিয়ে সেই প্রথম বারের মতো পিতার সদ্ব্যবহারের মতো উচ্চারণ কোরেছিল–“তাহলে কি ঔদাসীন্যের মধ্যে উচ্চতরাল থাকলেই ঘিচিয়ে আসে মানুষ।”

এইবার বন্ধুটি মুখ খুলেছিল–“কেমন?”

বলছিলাম কেমন সহজেই সব সমাধান হয়। অথচ সমাধান কোরতে গেলে কত সমস্যার জন্মদাতা হতে হয়।

“হেয়ালী করছো?”

“না।”

ইমান নিজেকে লম্বমান অস্ত-সূর্যের মধ্যে নিক্ষেপ কোরে প্রথম ‘প্রেম’ কথাটি উচ্চারণ কোরলে; আর তার বন্ধু, বিবাদমান ক’টি কথার কপালে আঙ্গুলের টোকা লাগলে সূর্য অস্ত গেল।

সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পাহাড় এবং সমুদ্রের সঙ্গে সহজীবী হওয়া সে কি আশ্চর্যের ব্যাপার ইমান সেদিনই বুঝেছিল। কক্সবাজার থেকে পটিয়া। পটিয়া থেকে ফের আবার চট্টগ্রামে ফিরে এসেছিল তারা। ইমানের পকেটে একটি ফটোগ্রাফ ছিল। বন্ধুটি তা দেখতে চাইলে শৈশব এসে আলো জ্বালায়। তখন সমুদ্রের বালিয়াড়ীর কথা মনে পড়েছিল তার। ছাতার মধ্যে চুপে বসে থাকা রৌদ্রের মধ্যে যেমন গ্রীষ্মের ঘাম ওড়ে তেমন বাষ্পীভূত তার বুক–শৈশব থেকে সম্পর্ক ঘুচে যাওয়ার পর যৌবনের যেখানে শুরু সেখান থেকে ভিন্নতর অস্তিত্বে বসবাস করা কিন্তু কাউকে সে বলতে পারে না, তোমরা যা ভাবো তা সবই মিথ্যে। কোথাও কেননা সত্য নেই। অথবা সত্য ও মিথ্যা দুটি যমজ, পাশাপাশি পৃথিবীর উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, কিন্তু তাদের কোন ভূমিকা জীবনে বড় একটা বর্তায়না। আমরা কেবল ক্ষণিকের সন্তান। যেখানেই যাই একটি প্রবাহ বই তো কিছু নই। কোনো কিছুতেই ক্লান্ত করানো যাবে না, কোনো কিছুকে করুণায়ও টেনে আসা যাবে না। আমরা কোনদিকে তাই মুখ ফিরাবো না বলেই মুখ ফিরিয়ে নেই। হঠাৎ ইমান বলেছিল শৈশব যেখানে খোলা সেখানে যৌবনের শুরু, আর যৌবনের অন্তিমে বার্ধক্য। কিন্তু কি আশ্চর্য মিল থেকে যায়। স্মৃতিতে গ্রথিত হয়ে, স্বপ্নের পুঞ্জে পরিবর্তিত হয়ে শৈশব যৌবন আর বার্ধক্য ঘুরে ফিরে একই। কেবল চেনা জানার পরিধি এবং ব্যাস বাড়িয়ে দেওয়া। যাক চেনা জানাই বা কি, সবই তো প্রথম উচ্চারণ। মানুষ তার কতগুলি মৌলিক শিহরণ ভেদ কোরে হয়তো স্বপ্নলোক পেতে পারে; কিন্তু সীমার সঙ্গে সময়ের যে যোগসূত্র তাকে কি কোরে অবহেলা কোরে ভাঙ্গবে সংসার?

আজকাল তাই কোনো কিছুই মনে হয় না তার। বন্ধুরা যে যার যাবতীয় অংশে পৃথক পৃথক পৃষ্ঠার মতো পাল্টে গেছে। নিষ্ক্রমনযোগ্য নির্জনতা কোথাও নেই। সীমার বাইরে বহুদূর গেলে নাকি সবুজের সঙ্গে সন্ধি করা যায়। বাসে বসে একবার সে নয়ারহাট গিয়েছিল। পথে সাভারের একটি মিষ্টি দোকানে যাত্রার দলের খঞ্জনী আর জিনিসপত্র বাধাছাদা অবস্থার মধ্যে সে জীবনের ঐ যাত্রার নেশার মতো মনে করেছিল তাকে। আর যাত্রী যে কোনো জায়গায় যাত্রী হওয়া যে কেমন আলোর মতো হাল্কা অথচ অবিনশ্বরতার বিপরীত নশ্বরতা’ তা সে কিছু দূর যেতেই বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু তবু ভালো লেগেছিল। ডায়ারী ফার্মের উঁচু সবুজ ঝোঁপঝাড়ওয়ালা মসৃন মেটান্ড রাস্তার সমান্তরাল গ্রীবাভঙ্গী। দু’পাশে কাঁঠাল গাছের সারি। ঝোঁপঝাড়ে দুলে ওঠা ফড়িং কি ফিঙ্গে। পেঁপে বাগান। মুলো ক্ষেতের মধ্যে জল ঢালছে কেউ। সজীর গায়ে জল নিংড়িয়ে সহজ কোরে দিচ্ছে তার বৃদ্ধি। টমাটোর মতো লাল গালের রৌদ্র ভেঙ্গে একটি কৃষাণী চলেছে মেষ বালিকার মতো। মেরী বোধহয়–এ রকম ভঙ্গীতে মাঠে যেতেন। ঠিক ঐ যুবতী কৃষাণীর মতো। অমন ঐ একই ভঙ্গীতে। মেরীর সময়ে পৃথিবীর কোথাও পার্থিব পরাস্ত হয়নি। কিন্তু আমাদের সবাই পার্থিবে অপার্থিবতা খুঁজতে গিয়ে পরাস্ত। একটা রেডিও বাজছিল বাসের ভিতর। বেহালা বিবাদ করছিল বেদনার সাথে সেই রেডিওর মধ্যে। একটি প্রেমিকা ছিল সে সাত মাইল দূরে যাবে। সেতু পার হবে। ইমান মেয়েটাকে প্রেমিকা বলেই কল্পনা কোরেছিল। কারণ মেয়েটার কপালে যদিও সিঁদুর ছিল কিন্তু মুখটা ছিল বিষণ্ণ। হাতে ছিল শাখা, কিন্তু স্বপ্নের মতো গড়িয়ে পড়ছিল তার আঙ্গুল। আঁচলের চাবিগুলি চাতকের মতো বেজে বেজে উঠছিল সেই আঙ্গুলের স্বপ্নের ঘর্ষণে। তার গ্রীবায় তিনটি কালো তিল ছিল পাশাপাশি। ঠোঁটের নীচে দূরতম নিসর্গের নক্ষত্রের মতো গোল আর একটি তিল। তার খোঁপায় কোনো ফুল ছিল না। গলায় কোনো মালা। কেবল হাওয়া দিয়ে ভরা মালা গাঁথা হচ্ছিল তার গলায় গ্রীবায় শরীরের সব জায়গায়। ইমান ভাবছিল বাসের কোথাও কোনো ঠাই নেই। একটি নারী চলেছেন একটি বাসে। আর বাসটি কোথাও থামবে না। আর সাত মাইল সাতটি পৃথিবীর সমান। আর ঐ নারী যাকে ইমান চেনে না–সিঁদুর কপালে, কান্নার বিষণ্ণতা কাকণে, কিন্তু কাকণে কান্না বলেই সে আলোর মধ্যে অশ্রু খুঁজবার চেষ্টা করছিল। ইমানের কত স্মৃতির মধ্যে হেঁটে আসতে হয়েছে। সে কত প্রকৃতি দেখেছে। মন্দির। জল দেখেছে। নদী দেখেছে। নারীর সঙ্গে সাহচর্য তার কম হয়নি। বন্ধুদের স্ত্রীর সব আলোকিত কোটায় তার যাতায়াত। কিন্তু কোনো কালেও বুঝি ভালোবাসার মতো ভীরু অথচ সংক্ষেপ কোনো সিদ্ধান্তে সে যায়নি। আজ সে যেতে গিয়েও বুঝি তাই যেতে পারবে না। কারণ কান্না বাজছিল তার কারণে। আর কপালে সিঁদুর। সংসারের গার্হস্থলীগত বউ কতদূর থেকে এসেছে। সংসারের সময়ের সব সদ্ব্যবহার থেকে চয়ন কোরে কে একে নিয়েছে। সংসারের ভূবনে সবাই আলাদা। অথচ এই একাকী একটি বাসে তাকে মনে হচ্ছিল তার আপন স্বভাব। তাই ইমান ভাবলো সেই বুঝি প্রেমের প্রেমিকা। সাত মাইল দূরে কোথাও যাবে। কিন্তু যাত্রার দলের সেই মালপত্তর, সখা সখিদের মনে পড়ে গেল তার। যাত্রীর সঙ্গে ক্ষণিক একটি যোগাযোগ। অথচ যাত্রার দল নেই এখানে। ভালোবাসার কপালে সে তাই কপাল নীচু কোরে ভালাবাসার চোখে চুমু খেলো। কিন্তু সংসারের সীমান্তে এসে কড়া পাহারার সব সশস্ত্র সমস্যাকে দেখে আবার ইমান ফিরে এলো তার নিজস্ব স্বভাবে।

অর্থাৎ কোথাও সে যেতে পারলো না। সহজ স্বভাবের কোনো স্থান তার জন্য খালি পড়ে নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *