সন্ধ্যাবেলা রাত্রিবেলা
এক সময় বেলা পড়ে আসে। দু’দিন ধরে রেডিওতে ঝড়ের খবর! সবাই মেঘগুলি খুটে খুটে দেখে। আকাশে মেঘ, খাজ করা চুলের মতো, কোথাও একটা দুটো চিকন রেখা। সবার চোখ মেঘের পাশে সাদা রোদ খোঁজে। কিন্তু এক সময় বেলা পড়ে আসে। বাইরে দু’জন, দশজন লোক বাড়তে থাকে। গুমোট গরম, লোক বাড়তে থাকে। ঘাসের উপর পায়ের ছাপ পড়ে। ঘন ঘন কথা। স্যান্ডেল জমে ওঠে সাদা কাগজের উপরে বড় বড় অক্ষরের মতো লাইব্রেরীর মাঠে। রাজীব কথা বলে না। এক সময় মেঘকে ভেল্কী দেখিয়ে সমস্ত আকাশ ছিমছাম হয়ে পড়ে। দ্রুত ঝিরিঝিরি বাতাস বইতে থাকে। নিশ্চিত বিবাদ অথবা আপদের আক্রমণ ছাড়া পাওয়া গেল বলে। দলে দলে লোকের আলাপ দ্রুত হয়। কিন্তু রাজীব কথা বলে না।
শুধু তাকে প্রতিধ্বনি করে গাছের তক্ষক। লম্বা দোতলা দালানের চিলে কোঠায় শুধু তাকে প্রতিধ্বনি করে একটা বেহায়া বাদুড়।
ধীরে ধীরে আলো জ্বলে ওঠে। আর ধীরে ধীরে সে উঠে পড়ে। কোথায় যাওয়া দরকার। কিন্তু ভালো লাগে না। আবার বসে। আবার তক্ষক ডাকে।
নিজের নিশ্চিত নিঃশ্বাসকে শাসন করে এ যেন হঠাৎ কোরে আত্মবিজয়ের মতো। বেলা যখোন সমস্ত পড়ে গেল তখন সে উঠে পড়লো।
কিন্তু কথা ছিল আসবে। একসঙ্গে একটি শান্তির মীমাংসায় পৌঁছানোর কথা ছিল। কিন্তু মনিকাকে সারা লাইব্রেরীর কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। এক এক সময় প্রতীক্ষার এমন কড়া শাসনে কোনো কিছু মনে হলেও সেটা মানিয়ে নেওয়া গেছে। কিন্তু মনিকাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। প্রতীক্ষার এক একটি সময়–এক একটি শান্তির মতো তাকে ভীত কোরে তুলেছিল, তবু যে পর্যন্ত ঝড় না আসে, যে পর্যন্ত দিন না ছিঁড়ে যায় যতটুকু এসেছে ততটুকু সময় সে মনিকার জন্য আজ ব্যয় করেছিল। প্রতিদিনের মতো একটি ধ্রুব বিশ্বাসকে বনেদী আমলের ঘোড়ার মতো দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। কিন্তু এক সময় বেলা পড়ে এলো ঝড় হলো না। এক সময় সমস্ত আকাশ ফরসা হলো। লাইব্রেরী মাঠে অনেকবার অনেক লোক কথা বললো। প্রেম শব্দটা উচ্চারিত হলো। রাজার মতো কেউ মেয়ে মানুষের কথা বললো। কিন্তু মনিকার আজ যেনো কোনো সময়ই হলো না। তার ব্যয় করা সময়কে পুষিয়ে দেয়ার মতো।
তাই রাজীবের হাতের ঘড়ির দিকে তাকাতে হলো। একবার কোথাও যেতে যেতে এই ঘড়ির দিকে চোখ রেখে সময় জেনে নিয়েছিল যেই মেয়ে। আজ তার সময়ের দিকে মনযোগ নেই, আশ্চর্য। তার ঠোঁট বিড় বিড় করলো। অথবা সময়কে ঠিকই মনে রেখেছে মনিকা। কিন্তু সময়ের ঘড়ি পাল্টে গেছে তার।
এই সময় আকাশে এরোপ্লেন উড়ে গেল আর তার ভাবনাগুলি বাধাপ্রাপ্ত হলো।
আবার ঘড়ি দিকে তাকালো, যে সময়ে তার ফেরার কথা, তা পেরিয়ে এখন খাওয়ার সময়। অগত্য রিকশায় উঠে পড়লো রাজীব। হাতে হঠাৎ একটি সিগ্রেটের সোনালী কেসের প্রয়োজন অনুভূত হলো তার।
: ন্যুমার্কেটে অনেকদিন যাইনি, কেনা হয় না!
: আমি তোমাকে কিনে দেবো।
একবার এ্যান্টিকসের দোকানে যে মেয়েটাকে দেখে ভালো লেগেছিল, সে রকম অদ্ভুত গলায় মনিকা এবার সিগ্রেটের সোনালী কেস কিনে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। আর এক রবিবারে সিনেমা দেখার দিন দেয়াশলাইয়ের আলো জ্বালতে গিয়ে সারাটা কাঠি সে ধরে রেখেছিল আঙ্গুলে আর এক সময় আগুন আঙ্গুলে এসে ছুঁতে মনিকার সে একটা অদ্ভুত ভীতি দেখে রাজীব হেসে বলেছিল : বুঝলে মনিকা, আমি কোনো কিছু একেবারে না পুড়িয়ে সুখ পাই না।
: তুমি ওরকম চোখে তাকিয়ো না।
রাজীব বুঝি তখন তার চোখে আগুনের ইঙ্গিত দিয়েছিল।
কিন্তু সে অনেকদিনের কথা। কয়েকদিনের নয়। রিকশা ধীরে ধীরে গাছ অতিক্রম করে। রাস্তার মোড়ে সেই বেশ্যাটাকে দেখা যায়। হাইকোর্টের রাস্তার মোড়ে। স্বীকার করতে লজ্জা কেউ করে না। এক রাতে মনিকার কাছ থেকে ফিরে এসে সে এই বেশ্যার পিছু নিয়েছিল। জিজ্ঞেস করেছিল, তোমার ঘর নেই? বুকের স্তনে কাটা কাপড়ের প্যাঁচ লাগানো। জামাটা ককেটিশ ভঙ্গীতে কাঁপছে। কালো মাংসের উপর চাঁদের জ্যোত্সা। মোটের উপর ভোগচিহ্ন ফুটে আছে বেশ্যাটার পুরু ঠোঁটে। কিছুদিন আগে গগার ছবি দেখেছিল। কালো পুরু মেয়ে মানুষের নিতত্বের বাঁক পুরু ফুটে উঠেছে। পায়ের গোড়ালী ভাসা জামরুলের মতো ভরা। কোনো কোনো মেয়েমানুষের শরীর আশ্চর্য রকমের ভালো। আশ্চর্য রকমের উত্তেজনার যোগান দেয় কোনো কোনো মেয়েমানুষের গায়ের রং। ছবির পাতা উল্টে তার জামা আর পাজামার ভিতর হাওয়া ঢুকে বাথরুমে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেটা হয়তো ভুলে যাওয়ার মতো। এতদিন বীর্যের কোনো বিদ্রোহ তাকে বিশৃংখল করেনি। কারণ প্রেমবোধ একটি যৌবনকে অনেক দিক দিয়ে রক্ষা করে। একটি প্রেমিক ভোগবাদী হতে পারে না। প্রেমিকের বীর্য থাকে সহিষ্ণু ভালো স্থির নদীর জলের মতো। শরীরের পাড় ভাঙতে তার অতো বাঁচোয়া নেই। গরজ থাকে না শরীরের। কিন্তু অনুশীলন থাকে অনুভুতির। তাই মন তাকে চালায়। শরীর নয়। প্রেমিকের ভালোর মধ্যে এই, যে লম্পট হয় না। তাই মনিকার কাছ থেকে ফিরে এসে সেই রাত্রে এক রকম পুরু সহজলভ্য, কাটারক্তের লাল বিদ্রোহের মতো মেয়েটাকে হাতে পেয়েও, সে কোনো কিছু করেনি। ইচ্ছে করলে সে তাকে রিকশায় উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে সারা রাত যেমন ভঙ্গীতে হোক, সব রকমের সবকিছু চালাতে পারতো কিন্তু তা হয়নি। হয়নি বোধ হয় দুটি কারণে।
এক, মনিকা বলেছিল, যৌবন মাঝে মাঝে আমাদের ভয়ানক প্রতারণা করে। পুরুষ প্রতারকও বটে। অন্ততঃ আমার মনে হয় তুমি সে দলের নও।
দুই, মনিকার মুখের ভিতর যে গন্ধ, তা এই রাস্তার মেয়েটা তাকে দিতে পারবে। চুমু খেতে গিয়ে দুর্গন্ধ উঠে আসবে। মেয়েটর দাঁত ময়লা। মনিকার আঁচ করলো বরং দাঁতের মধ্যে যে এলাচের সৌরভ আছে, এর দাঁতের মধ্যে তা নেই বরং মরা ইঁদুরের দুর্গন্ধ! তাছাড়া আরো কারণ আছে! শরীর গরম হয় দুটো কারণে। মানুষ হতাশায় ভুগলে বেশ্যাগামী হয় সে শুনেছে এবং এক রকম অভিজ্ঞতাও তার আছে। তার প্রমাণও সে পেয়েছে। আর মানুষ অভ্যাসের পাল্লায় পড়েও এসব কাণ্ড করে। কিন্তু সে রাত্রে এর কোনোটাই তার মধ্যে বিদ্যমান ছিল না। সারা সন্ধ্যা ছিল ভালো কথায়, ভালো চুমুতে ভরা। স্বাস্থ্য ছিল উত্তম। কাপড় চোপড়ে কোনো ময়লা ছিল না। মনিকা তাকে সেদিন সন্ধ্যায় আঙ্গুল থেকে আংটি খুলে দিয়েছিল।
ব্যাগ থেকে পাতলা মিহি রুমাল বের কোরে নিজের মুখের ঘ্রাণমাখা ঘাম মুছে বলেছিল, তুমিও মোছ।
মানি ব্যাগ থেকে দুটো দশ টাকার নোট বের কোরে বলেছিল, আজ স্কলারশীপের টাকা পেলাম। এ দিয়ে তুমি তোমার কবিতার বই কিনো। মার্কেটে ভালো চায়ের দোকানে চা খেয়েছিল। কায়েদে আযমের ছবি আয়নায় বাঁধানো। ছিমছাম সুন্দর কাটছাঁট চেহারায় কায়েদে আযম। শরীর যতটুকু হলে নয় ততটুকু শরীর। চোখ মুখ মানুষের চেহারার মতো। যেনো এ রকমই হওয়া উচিত ছিল কায়েদে আযমের। এর চেয়ে বেশী খাটো হলে, বেশী মোটা কিংবা এর চেয়ে অন্য কায়দার পোশাক পরলে ঠিক তাকে মানাতো না। রাজীব অনেকক্ষণ তাকিয়েছিল কায়েদে আযমের দিকে।
মনিকা তার চোখে হঠাৎ অঙ্গুলী টুইয়ে দিয়ে বলেছিল, তোমাকে কিন্তু কায়েদে আযমের মতো লাগে।
কেমন?
ও রকম শরীর। ও রকম চিকন। মোটা লম্বা। চুল উল্টো করে আঁচড়ানো। কেবল পার্থক্যের মধ্যে তুমি পাজামা পাঞ্জাবী পর।
আর আমি কোনো দেশ স্বাধীন করিনি।
কিন্তু দেশ জয় করছে তো।
হঠাৎ মনিকা মুখ নীচু কোরে থাকাতে সে বলেছিল, কি রকম? দেশ দেশ করছে, জানো আমি ঘরের একটি বিছানাও জয় কোরতে পারলাম না এতদিনে। আর তুমি কি না..! বাক্য শেষ না হওয়ার আগেই মনিকা কথাটাকে নিজের মুখে জড়িয়ে বলেছিল, কেন? আমি যদি বলি আমি একটা দেশ।
ওঃ! হো হো করে হেসে উঠেছিল রাজীব। ও রকম কত কিছু বলা যায়।
তারপর এক রিকশায় মনিকাদের বাসা পর্যন্ত গিয়েছিল রাজীব। আকাশে কোনো চাঁদ না থাকলেও যেনো পূর্ণিমা থাকতো সে রাতে, এমন পাশাপাশি সেদিন তারা রিকশায়। গাছগুলি এক একটি ফুল ফুটিয়েছে। নতুন কোরে বিজ্ঞান ভবন প্রস্তুত হচ্ছে মেডিক্যালের মোড়ে। বহু ইলেকট্রিক আলো। সুইস বোরিং এর শব্দ। মনিকা হঠাৎ বুকের কাপড় আলগোছে রুমালের মতো রাজীবের নাকের কাছে এনে বলে উঠেছিল, শুঁকে দ্যাখো, সারাদিন কোথাও বেরোইনি। বিকেলে বাবা অদ্ভুত একটা সেন্ট কিনে এনে দিয়েছিল আমাকে। তাই মেখে বেরিয়েছি। কেমন বকুল আর বেলফুলের জড়োয়ার গন্ধের মতো না?
রাজীব নাকে বার বার নিঃশ্বাস টানছিল। অনেক সুখে ভরা ছিল সেই রাত্রি। সবদিকে আলো। আকাশে অর্ধেকমাত্র চাঁদ আর গাছের সারি। সুইস বোরিং এর শব্দ। বহুতলা দালানেরমতো একটি দালান হঠাৎ যেনো রাজীবের সামনে খেলে গেল, তার মুখ এখন মনিকার মুখের ভিতর।
তারপর তাকে নামিয়ে দিয়ে ফিরে আসার সময় রাস্তার বেশ্যা মেয়েটার সাথে দেখা।
ভালো জিনিস না খেলেও তার কাছাকাছি থাকার পর যেমন খারাপ জিনিসের প্রতি খিদে থাকলেও আর পরে থাকে না সে রাত্রে তেমন অবস্থা হয়েছিল তার। একটা শারীরিক প্রতিক্রিয়া প্রবাহিত হয়েছিল বটে। মনিকাকে নামিয়ে দেওয়ার পর। কিন্তু মনিকার সান্নিধ্য থেকে ফিরে এসে আর কোনো মেয়ে মানুষের নিঃশ্বাসও যেনো তার ভালো লাগছিল না। আর তাছাড়া রাজীব সেই চিত্তের অধিকারী, একটা বিলাসী রিক্ততার জন্য যারা সমস্ত সম্পদ বিসর্জন দিতে রাজী। প্রিয়জনের জন্য সন্যাস নেওয়া যে তাদের একটা ধর্ম। এই ধরনের অসুস্থ মানসের অধিকারীও বটে। কিন্তু রাজীবকে তাও বলা যায় না। প্রেমের জন্য একটি সামাজিক চলতি প্রবাহকে সে বিসর্জন দিতে পারে, কিন্তু নিজের ভিতর সে যা গড়ে নিয়েছে, তার নিজের ইচ্ছের ভিতর যে সহজাত সন্ধান সেটাকে সে কোনোদিন বিসর্জন দেয়নি।
মনিকার চরিত্রের কোনো চলমান সাদৃশ্য নেই অবশ্য রাজীবের সাথে। কিন্তু মেয়ে হিসেবে, সে কোনো কিছুতে খারাপ নয়। উষ্ণ স্বাস্থ্যে ভরপুর। পড়াশুনায় ভালো। বুদ্ধি ও মেধা শতকরা দশজনের পর্যায়ে। মানুষের হৃদয়বৃত্তির সে বিশ্বাসী। আর তাই শিল্প সাহিত্যে তার ঝোঁক কম নয়। কবিতার প্রতি পক্ষপাত রয়েছে। বৈবাহিক মানুষের প্রতি প্রসন্ন একটি ধারণা না থাকলেও প্রতিক্রিয়াশীল কোনো মতবাদ নেই। জীবনের ভুলত্রুটিকে সে অস্বীকার করে না। একটি কথা তার সবচেয়ে রাজীবকে আকৃষ্ট করে মেনে নেয়া মেনে নিলেই হলো। অনেক কিছুর মধ্যে দিয়ে তবে বেঁচে থাকতে হয়। মানুষের জীবনের মধ্যে কোনোকিছু সম্পূর্ণ ভালো নয়, কোনো কিছু সম্পূর্ণ খারাপ নয়। আর মনিকা বলতো, আত্মীয়ের সূত্রে শুধু রক্তের সম্পর্কই কাছে আসে না। একই স্বভাবের স্বভাবী মানুষ একমাত্র শ্রেষ্ঠ আত্মীয়। আত্মার কথার সাথে যার সায় নেই সে কি কোরে আত্মীয় হয়।
যার জন্যে সে অনেকের বাড়ী যেতো না। ঘন সম্পর্কের কারো সাথে তার মিল ছিল না। নির্জনতায় বিশ্বাসী। কিন্তু নির্জনতার শিকার নয়। মতামতের মিল থাকায় রাজীবকে তার ভালো লেগেছিল। রাজীব তাকে ভালো লাগার আগে ভালোবেসে ফেলেছিল এবং সেটা যদি ভালোবাসা হয় তবে বলতে হবে রাজীব ভুল করেনি। কিন্তু যা ভুলের ছিল সেটা সে ভেবে দেখেনি মানুষ মনের চুক্তির দাস না হয়ে মাঝে মাঝে মানুষের এবং পরিবেশের দাস হয়।