হিপনোস (HYPNOS)
[লাভক্র্যাফটের সিংহভাগ লেখার মতোই এই গল্পেও রয়েছে অচেনা বিশ্বের অজানা ভয়ের কথা। ন্যাশনাল অ্যামেচার পত্রিকাতে প্রকাশিত এই গল্প তিনি উৎসর্গ করেছিলেন বন্ধু স্যামুয়েল লাভম্যানকে। লাভক্র্যাফটের দেখা দুটি স্বপ্নে লাভম্যান ছিলেন। যা থেকে তিনি দুটি গল্প (দ্য স্টেটমেন্ট অব র্যানডলফ কার্টার এবং নায়ারলাথোটেপ) লেখেন। পরে হিপনোস-এর মতো স্বপ্নতাড়িত গল্প লিখে তাই সেটি এই বন্ধুকেই উৎসর্গ করেন লেখক।]
এস এল-এর প্রতি
ঘুম সম্পর্কে বলা যায়, তাকে ঘিরেই আমাদের প্রতিরাতের দুঃসাহসিক অভিযান। আমরা বলতেই পারি, মানুষ রোজ বিছানায় যায়, এটা তার স্পর্ধা! আসলে পুরোটাই তার ধারণাতীত, বিপদ সম্পর্কে অবহেলারই ফল এটা।
— বোদলেয়র
করুণাময় ঈশ্বর কি সত্যিই আছেন? যদি থাকেন, তাহলে তাঁর কাছে আমার একান্ত প্রার্থনা, তিনি ওই কয়েক ঘণ্টার জন্য আমাকে রক্ষা করুন। যখন কোনও মনের জোর বা মানুষের তৈরি কোনও ড্রাগ আপনাকে ঘুমের অতলে তলিয়ে যাওয়া থেকে বাঁচাতে পারে না, সেই সময়টা তাঁর করুণা আমার চাইই। মৃত্যু, আহা, তাকে এখন পরম মমতাময় বলে মনে হয়। আসলে যারা একবার রাত্রির গোপন কুঠুরিতে ঝাঁপ দিয়ে সেই অজানা সত্যির সন্ধান পেয়েছে, তারা জীবনে আর কখনও শান্তি পাবে না। আজকাল খালি মনে হয়, যেখানে প্রবেশের অনুমতি কারও নেই, কেন সেখানে বোকার মতো ঢুকতে গেলাম? ওই চিরন্তন রহস্যের সন্ধান কোনও মানুষের পক্ষে কখনও পাওয়া সম্ভব নয়। মনে পড়ে আমার বন্ধুর কথা। জানি না সে কে ছিল, কোনও নির্বোধ নাকি ঈশ্বরের দূত– যে-ই হোক, সে-ই ছিল আমাদের সফরের নেতা। আমাকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে গিয়ে সে মুখোমুখি হয়েছিল সেই ভয়ংকরতম দুঃস্বপ্নের, যা হয়তো আমারও হতে পারত।
মনে পড়ে তার সঙ্গে দেখা হওয়ার সেই প্রথম দিনটার কথা। একটা স্টেশনে তাকে আমি প্রথম দেখি। অজ্ঞান হয়ে সে পড়ে ছিল প্ল্যাটফর্মে। তার অচেতন শরীরটাকে ঘিরে ভিড় জমিয়েছিল কৌতূহলী জনতা। আচ্ছন্ন শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছিল খিঁচুনিতে। সেই সময়ই আমি তাকে প্রথম দেখি। চল্লিশের আশপাশে বয়স। মুখময় অজস্র রেখার কাটাকুটি। অসুস্থতার ছাপ স্পষ্ট। তবুও ডিম্বাকার মুখটা বড় সুন্দর। ঢেউখেলানো চুল আর দাড়ির মধ্যে রুপোলি রেখা। ভুরুটা ধবধবে সাদা, যেন শ্বেতপাথরে তৈরি। সব মিলিয়ে লম্বাচওড়া শরীরটা দেখলে মনে হয়, বুঝি কোনও শাপভ্রষ্ট দেবতা।
আমার ভেতরের যে শিল্পী, সেই ভাস্কর তার সমস্ত পাগলামি নিংড়ে বলে উঠল, আরে! এ যে পৃথিবীর কোনও আদিম দেবতার পাথুরে শরীর! কোনও প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ থেকে যাকে উদ্ধার করে কেউ তার শরীরে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেছে। যাতে দমচাপা এই নশ্বর জীবনের স্পন্দন সে অনুভব করতে পারে।
সে যখন তার উজ্জ্বল, ধ্যানমগ্ন, গভীর চোখ মেলে চেয়ে দেখল, সেই মুহূর্তেই আমি বুঝে গিয়েছিলাম, এই মানুষটি হতে চলেছে আমার বন্ধু। আমার মতো নির্বান্ধব এক মানুষের একমাত্র বন্ধু। তার দৃষ্টিতে ছিল আমাদের চেতনাময় বাস্তব জীবনের বহু দূরে অবস্থিত কোনও এক অচেনা ভয়াল দুনিয়ার সংকেত৷ যে জগৎকে আমি এতকাল কেবল কল্পনাই করতে চেয়েছি। বলা বাহুল্য, তাতেও ব্যর্থ হয়েছি।
আশপাশের ভিড় সরিয়ে তাকে আমি বললাম, চাইলে সে আমার বাড়ি যেতে পারে। দুর্বোধ্য রহস্যে ঘেরা অজানা জগতের সন্ধান পেতে তার মতো শিক্ষক আমার প্রয়োজন। সে কী বুঝল জানি না। তবে মাথা নেড়ে নীরবে আমার আহ্বানে সম্মতি দিল।
সেই সময়ে কোনও কথা না বললেও পরে আমি আবিষ্কার করেছিলাম, তার কণ্ঠস্বর আসলে এক সুর। চেতনার গভীর থেকে উঠে আসা এক আশ্চর্য সুর। আমি তার একটা প্রস্তরমূর্তি তৈরি করতে শুরু করে দিলাম। ছেনি-বাটালি দিয়ে কাজ করতে করতে আমরা কথা বলতাম। দিন হোক বা রাত আমাদের কথা চলত অনর্গল।
তার সঙ্গে কথা বলা অবশ্য কঠিনই ছিল, কেননা পার্থিব এই দুনিয়ার কোনও কিছুর সঙ্গেই তার কোনও সংস্রব ছিল না। তবু আমরা কথা বলতাম। আমাদের কথোপকথনের বিষয় ছিল এক অজানা, অসীম ব্রহ্মাণ্ড। চিরচেনা বস্তুজগৎ, সময় ও স্পেসের হিসেব সেখানে চলে না। সেই জগতের অবস্থান আমাদের সমস্ত অস্তিত্ব ও চেতনার অনেক গভীরে। কেবল ঘুমের ভেতরে স্বপ্নের অবয়বে সেই অচেনা ও ভয়ংকর জগতের আঁচ মেলা সম্ভব। সেই স্বপ্ন অবশ্যই আমাদের রোজকার দেখা স্বপ্ন নয়। স্বপ্নের ভেতরের সেই স্বপ্ন সাধারণ হরিপদ কেরানির জীবনে কখনও আসে না। কেবল কল্পনায় ঝুঁদ মানুষেরা সারাজীবনে হয়তো এক কি দু-বার সেই স্বপ্ন দেখতে পায়।
মানুষ তার জ্ঞানবুদ্ধি দিয়ে যে ব্রহ্মাণ্ডকে চিনেছে তা আসলে জন্ম নিয়েছে সেই অসীম জগতের ইশারায়। যেন এক আকস্মিকের খেলা। অনুসন্ধিৎসু মানুষরা কখনও হয়তো তার সামান্য আঁচ পায়। অবশ্য তারপরই সেটাকে অগ্রাহ্যও করে। জ্ঞানী মানুষেরা অবশ্য স্বপ্নকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাঁদের সেইসব প্রয়াসের আড়ালে সজোরে অট্টহাসি হেসে উঠেছেন ঈশ্বর।
এক আয়ত চোখের মানুষ একবার বলেছিলেন, সময় আর স্পেস আপেক্ষিক। শুনে সবাই ব্যঙ্গের হাসি হেসেছিল। সেই আয়ত চোখের মানুষটি অবশ্য কেবল আঁচটুকুই পেয়েছিলেন। আমি সবসময়ই চেয়েছি সেই সীমিত আন্দাজকে অতিক্রম করতে। বলাই বাহুল্য, পারিনি। আমার বন্ধু জানাল, সে-ও চেষ্টা করেছে। এবং খানিকটা সাফল্যও নাকি পেয়েছে। এবার আমরা দুজনেই চেষ্টা করা শুরু করলাম। হোরি কেন্টের পুরোনো ম্যানর হাউসের স্টুডিয়োর চেম্বারে উদ্ভট সব ড্রাগ সেবন করতে শুরু করলাম আমরা। যে ড্রাগসেবনে মগজে ভেসে আসে ভয়ানক ও নিষিদ্ধ স্বপ্নের সারি।
সেই দিনগুলোয় যে তীব্র যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে আমাদের যেতে হয়েছিল, তাকে ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। ওই কয়েক ঘণ্টার সফরে যা যা দেখেছি আর অনুভব করেছি, সেই ভয়ংকর ও অপার্থিব অভিজ্ঞতাকে প্রকাশ করার মতো চিহ্ন ও সংকেত পৃথিবীর কোনও ভাষার ভাণ্ডারেই খুঁজে পাওয়া যাবে না। ব্যাপারটা একটু খুলে বলা যাক। আমাদের সেই আশ্চর্য সফর জুড়ে ছিল অজানা এক উত্তেজনার দাপাদাপি। ঠিক কী কী দেখে আমরা ওরকম উত্তেজিত হয়েছিলাম, তা বলা সম্ভব নয়। কারণ তাকে নিজের স্নায়ু দিয়ে অনুভব করার সাধ্য কোনও সাধারণ মানুষের নেই। বস্তুজগৎ ও সময়ের অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয় সব উপাদান মিলেমিশে ছিল সেই উত্তেজনার ভেতরে। উপাদানগুলি যেন একসঙ্গে গাঁথা। তাদের কোনও পৃথক অস্তিত্ব নেই।
আমরা যেন ভেসে যাচ্ছিলাম। কিংবা বলা যায়, উড়ে চলেছিলাম। আমাদের মনের একটা অংশের সঙ্গে চিরচেনা বাস্তব দুনিয়ার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। মনের সেই টুকরো যেন প্রতিমুহূর্তে ধাওয়া করে চলছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন, প্রবল ভয়াল কোনও নারকীয় জগৎকে। যেতে যেতে মাঝেমধ্যে আশ্চর্য থকথকে পদার্থের তৈরি সব প্রাচীরকে ভেদ করে এগোতে হচ্ছিল। যেন জমাট-বাঁধা বাষ্প দিয়ে তৈরি। কিংবা বলা ভালো, মেঘের শরীরের উপাদান দিয়ে সেই প্রাচীরগুলি তৈরি।
শরীরহীন, অন্ধকার সেই যাত্রাপথে আমরা কখনও একসঙ্গে ছিলাম। কখনও-বা একদম একলা। যখন একসঙ্গে এগোচ্ছিলাম, টের পাচ্ছিলাম, আমার বন্ধু আমার থেকে অনেক এগিয়ে রয়েছে। আমি কেবল তার উপস্থিতির আন্দাজ পাচ্ছিলাম। এক অপার্থিব সোনালি ছমছমে আলোয় তার ধবধবে ভুরু, জ্বলজ্বলে চোখ, অন্ধকার চুল-দাড়ির আভাস ঝলমল করে উঠে আমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছিল তার উপস্থিতি।
আমাদের কাছে সময়ের কোনও হিসেব ছিল না। সময় যেন আমাদের কাছে হয়ে উঠল এক অলীক মায়া। পুরো ব্যাপারটাই যে অস্বাভাবিক, সেটা দিব্যি বুঝতে পারছিলাম। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপারটা হল, আমাদের বয়স গেল থমকে!
আমরা কথা বলতাম ফিশফিশ করে। গোপনীয় আর উচ্চাকাঙ্ক্ষায় ভরা সব কথা। কোনও দেবতা বা শয়তানেরও কল্পনার অতীত, এমন সব পরিকল্পনা আমাদের আলোচনায় ভেসে বেড়াত। তবে জোরে স্পষ্ট গলায় সেসব বলতে পারতাম না। কথা বলতে গেলেই যেন কেঁপে উঠতাম। আমার বন্ধু একবার একটা কাগজে লিখে বসল তার ইচ্ছের কথা, যা মুখে বলার সাহস তার ছিল না। আমি সঙ্গে সঙ্গে সেই কাগজটা আগুনে পুড়িয়ে ফেললাম। তারপর ভয়ে ভয়ে উঁকি দিলাম জানলার বাইরে। শিউরে উঠে তাকিয়ে রইলাম তারা-ঝলমলে রাত্রির আকাশের দিকে। ওর লেখাটা ভালো করে দেখিনি। তবে যেটুকু দেখেছিলাম, তাতে আন্দাজ করতে পারি… কেবল আন্দাজ… আমার বন্ধু পাতায় ফুটিয়ে তুলছিল একটা নকশা। যে নকশা আমাদের চোখে দেখা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নিয়ন্ত্রক। সেই নকশাই নিয়ন্ত্রণ করে সমস্ত গ্রহনক্ষত্রের গতিবিধি। এবং জীবজগতের সমস্ত প্রাণের অন্তিম গন্তব্যও তারই নির্দেশ অনুযায়ী স্থির হয়।
আমি সত্যি বলছি, বন্ধুর ওইসব চিন্তাভাবনার সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক ছিল না। আমি ভাবতে চেষ্টা করছিলাম, ও যা বলতে বা লিখতে চায়, তা নিশ্চয়ই আজগুবি। কেননা সেই অজানা জগতের অজানা লড়াইয়ের সাক্ষী হওয়ার মতো শক্তি আমার ছিল না।
এরপর এল সেই রাত। অজানা জগতের গভীর হাওয়ার ঢেউ আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে চলেছিল অনন্ত শূন্যের ভেতরে। আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের চেতনা থেকে ক্রমে দূরে, আরও দূরে আমরা হারিয়ে যাচ্ছিলাম। আমাদের মনের মধ্যে ভিড় করে আসছিল পাগলপারা আশ্চর্য সব অনুভূতি। অনন্তকে বুঝি অনুভব করতে পারছিলাম আমরা। অবিশ্বাস্য আনন্দে কাঁপছিলাম। সেইসব অনুভূতির খানিকটা আমার স্মৃতি থেকে মুছে গিয়েছে। যেটুকু মনে আছে, তাকেও ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
ক্রমে সেই থকথকে প্রাচীরগুলির সংখ্যা বাড়ছিল। তারা আমাদের শরীরে যেন কামড় বসাচ্ছিল। যেতে যেতে একসময় আমি বুঝতে পারলাম, আমরা আজ এমন এক জগতে চলে এসেছি, যেখানে এর আগে কখনও আসিনি। এক পবিত্র ইথারের সমুদ্রের মধ্যে যেন আমরা ঝাঁপ দিয়েছি। আমার বন্ধু অন্য দিনের মতোই আমার থেকে অনেকটা এগিয়ে রয়েছে। তার মুখ আজ উজ্জ্বল ও অতি তরুণ। মনে হল, তার সেই ভেসে চলার মধ্যে কেমন একটা অশুভ ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে। আচমকাই তার সেই মুখ অস্পষ্ট হয়ে গেল। দেখতে দেখতে সে যেন মিলিয়ে গেল! আর তখনই চলতে চলতে আমি ধাক্কা খেলাম এমন এক প্রাচীরে, যাকে ভেদ করার ক্ষমতা আমার ছিল না। ঘন, আঠালো, দুর্ভেদ্য সেই প্রাচীরকে আমাদের চেনা জগতের কোনও কিছুর সঙ্গে তুলনা করা যায় না।
বুঝতে পারলাম, আমি এই প্রাচীরের সামনে আটকে গেলেও আমার বন্ধু সেই প্রাচীরকে অনায়াসেই পেরিয়ে গিয়েছে। প্রাচীরটা পেরিয়ে যাওয়ার জন্য আবার চেষ্টা করতেই আমার স্বপ্ন ভেঙে গেল। চোখ মেলে দেখলাম, আমি শুয়ে আছি টাওয়ার স্টুডিয়োর ভেতরে। ঘরের অন্যদিকে শুয়ে আছে আমার এতক্ষণের স্বপ্ন-সহযাত্রী। তখনও সে অচেতন। তার স্বপ্নালু মুখটা ম্লান। অথচ কী সুন্দর! জানলা দিয়ে আসা চাঁদের সোনালি আলোয় ধুয়ে যাচ্ছে তার প্রত্ন-শরীর।
ক্ষণিকের নীরবতার পরে আচমকাই নড়ে উঠল তার শরীরটা। আর তারপরেই সে চিৎকার করে উঠল। ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না, কতটা তীক্ষ্ণ ছিল সেই চিৎকার! ঠিক যেমন বোঝাতে পারব না, কোন সুদূর নরকের ছায়া সেই সময় তার আতঙ্কিত চোখের তারায় ফুটে উঠেছিল! মাত্র এক মুহূর্তের ওই চিৎকার ও অমানুষিক দৃষ্টি সহ্য করতে না পেরে আমি জ্ঞান হারালাম। আমার বন্ধু চেতনা ফিরে পেয়ে আমাকে ধাক্কা দিয়ে না-জাগানো পর্যন্ত অজ্ঞানই রইলাম।
স্বপ্নের ভেতরে আমাদের আশ্চর্য অভিযানের সেই শেষ। আমার বন্ধু পেরিয়ে গিয়েছিল সেই প্রাচীর, যা আমি টপকাতে পারিনি। সেখানে গিয়ে সে কী দেখেছে, তা বলার সাহস ওর ছিল না। কেবল ভীত, সন্ত্রস্ত ও হতবাক আমার বন্ধু আমাকে সতর্ক করে বলেছিল, চির-অচেনা অন্ধকারের রাজত্বে অভিযানের কথা আমাদের আর কক্ষনো ভাবা উচিত নয়।
সে আমাকে পরামর্শ দিল, এবার থেকে যতটা সম্ভব কম করে ঘুমোতে হবে আমাদের। তার জন্য ড্রাগের আশ্রয় নিতে হলে তা-ই সই। কিন্তু ঘুমের রাস্তায় যাতায়াত কমাতেই হবে। সে যে ভুল বলেনি তা আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিলাম। ঘুমিয়ে পড়লেই এক অবর্ণনীয় দুঃস্বপ্ন গ্রাস করে নিচ্ছিল আমাকে। প্রতিটা ছোট ও অনিবার্য ঘুমের ভেতরেই আমার বয়স বেড়ে যাচ্ছিল দ্রুত! কিন্তু আমার বন্ধুর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আরও অদ্ভুত হয়ে উঠল। সে চোখের সামনে বুড়িয়ে যাচ্ছিল! রাতারাতি তার মুখে বলিরেখা গজিয়ে উঠল, চুল হয়ে উঠল সাদা।
আমাদের জীবনটা বদলে গেল। আমার সেই বন্ধু, যার আসল নাম বা পরিচয় সে কখনও মুখ ফুটে বলেনি, সে ক্রমে বিচ্ছিরি রকমের খিটখিটে হয়ে উঠল। আসলে সে একা থাকতে ভয় পাচ্ছিল। বিশেষত, রাত হলে সে একা থাকতেই চাইত না। বেশ কয়েকজন মানুষের সান্নিধ্যও তাকে প্রশান্তি দিতে পারছিল না। অচেনা মানুষদের সঙ্গেও আমরা মেলামেশা করছিলাম। অকালে বুড়োটে মেরে-যাওয়া আমাদের চেহারা অন্যদের মনে বিশ্রী কৌতূহলের জন্ম দিত। আমার সেটা একেবারেই ভালো লাগত না। কিন্তু আমার বন্ধুর তাতে অসুবিধা ছিল না। অন্তত একা থাকার চেয়ে লোকের ভিড়ে থাকাটাই তার কাছে শ্ৰেয় ছিল, যতই তারা আমাদের কৌতূহলের চোখে দেখুক না কেন।
ঘরের বাইরে কক্ষনো একা একা বেরোতে চাইত না সে। বিশেষ করে রাতে, তারা ঝলমলে আকাশের নীচে একলা যেতে তার তীব্র আপত্তি ছিল। ঠেলেঠুলে বের করলে দেখতাম, ভয়ে ভয়ে আকাশের দিকে তাকাচ্ছে। তার চোখে এমন ভয়ের জলছাপ লেগে থাকত, যেন আকাশের শরীরে কোনও ভয়ংকর জেগে রয়েছে। সে আকাশের একই দিকে তাকাত, এমন নয়। বিভিন্ন সময় আকাশের বিভিন্ন কোণে আটকে থাকত তার ভয়ার্ত দৃষ্টি। বসন্তকালে সে তাকাত উত্তর-পূর্ব আকাশের দিকে। গ্রীষ্মে দেখত ঠিক মাথার ওপরে থাকা আকাশের দিকে। শরৎকালে তার দৃষ্টি ঘুরে যেত উত্তর-পশ্চিমে। শীতকালে সেটা চলে যেত পুব আকাশে, তবে ভোরের দিকে। শীতের মাঝামাঝি সময়ে তার চোখে ভয়ের মাত্রা কমে আসত।
বছর দুয়েক কাটার পরে আস্তে আস্তে ব্যাপারটা আমার কাছে স্পষ্ট হল। আমি বুঝতে পারছিলাম, আকাশের দিকে তাকানোর সময়ে আসলে সে নির্দিষ্ট কোনও নক্ষত্রপুঞ্জের দিকে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছে। সেই নক্ষত্রপুঞ্জ যেমন যেমন সরছে, আকাশে তার দৃষ্টিও সেইভাবেই বদলে বদলে যাচ্ছে। তার দৃষ্টি অনুযায়ী আকাশের দিকে দেখতে দেখতে আমার ধারণা হল, করোনা বোরিয়ালিসের দিকেই তাকায় আমার বন্ধু।
আমরা এখন লন্ডনের একটা স্টুডিয়োতে থাকি। দুজনের কেউই সেই দিনগুলোর কথা ভুলেও উচ্চারণ করি না। অজানা জগতের ভয়াল রহস্যের খোঁজে বেরিয়ে পড়ার সময়টা এখন কেমন অলীক বলে মনে হয়। যত দিন যাচ্ছে, আমরা আরও বুড়ো আর দুর্বল হয়ে যাচ্ছি। নিয়মিত ড্রাগসেবন আর স্নায়বিক দৌর্বল্যেরই ফল এই অকালবার্ধক্য। লম্বা ঘুমের থেকে অবশ্য ছুটি মিলেছে। কিন্তু দু-এক ঘণ্টার ঘুমও আমাদের কাছে আতঙ্কের কালো ছায়া নিয়ে আসে।
জানুয়ারি মাস। বৃষ্টি আর কুয়াশাচ্ছন্ন চারপাশ। পকেট একেবারে ফাঁকা। ড্রাগ কেনার পয়সা জোগাড় করা মুশকিল। যেসব মূর্তি বানিয়েছিলাম, সবই বিক্রি হয়ে গেছে। নতুন করে মূর্তি বানাব, মালমশলা কেনার সাধ্যও নেই। সত্যি বলতে কী, উৎসাহও নেই। ভয়ংকর খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম আমরা।
এরপরই এল সেই রাত৷ স্পষ্ট মনে আছে সেই রাতটার কথা। লক্ষ করলাম, আমার বন্ধু ঘুমোচ্ছে। একেবারে অঘোরে। জাগাতে গিয়েও পারলাম না। জনশূন্য, অন্ধকারময় স্টুডিয়ো। বাইরে বৃষ্টিপতনের ছন্দময় ধ্বনি। বড় ঘড়ির টিক টিক শব্দটা প্রচণ্ড হয়ে উঠেছে এই নিস্তব্ধতার ভেতরে। এমনকী, ড্রেসিং টেবিলের ওপরে রাখা আমাদের শৌখিন ঘড়ির মৃদু টিক টিকও শোনা যাচ্ছে। বাড়ির অন্যত্র কেউ ক্যাঁচ শব্দে দরজা খুলল। দূরে বৃষ্টি ও কুয়াশা-মাখা শহরের শব্দ। আর সব কিছুকে ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছে আমার ঘুমন্ত বন্ধুর গভীর শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ। সেই নিশ্বাসের ভেতরে মিশে রয়েছে যেন কোনও অশুভ দুনিয়ার ছায়া। ছন্দময় শ্বাসক্রিয়ার গভীরে অমানুষিক আতঙ্ক ও যন্ত্রণা লুকিয়ে আছে। বুঝতে পারছিলাম, ঘুমের গভীরে স্বপ্নের পথে সে পৌঁছে গিয়েছে সেই নিষিদ্ধ, অকল্পনীয়, অসহনীয় ব্রহ্মাণ্ডের ভেতরে।
জেগে থাকাটা আমার কাছে অসহ্য হয়ে উঠতে লাগল। বিপর্যস্ত মনের মধ্যে নানারকম ছবি ভেসে উঠতে লাগল। শুনতে পেলাম, কোথায় যেন কোনও ঘড়িতে ঘণ্টা বাজার শব্দ হচ্ছে। এ ঘড়ি আমাদের ঘড়ি নয়। কেননা, ওরকম শব্দ-করা কোনও ঘড়ি আমাদের নেই। আমার বিষণ্ণ কল্পনায় স্পষ্ট অনুভব করলাম, ওই ঘণ্টার শব্দ আসলে কোনও দীর্ঘ সফর শুরুর সংকেত। ঘড়ি– সময়– স্পেসঅসীম– বহু দূরে তলিয়ে যেতে যেতে কল্পনার স্রোত আবার আমাকে ঘরের মধ্যে নিয়ে এল। আমি অনুভব করলাম, এই ছাদ, কুয়াশা, বৃষ্টি, আবহাওয়ামণ্ডলের অন্তরালে আকাশের উত্তর-পূর্বে জেগে উঠেছে করোনা বোরিয়ালিস! হ্যাঁ, সেই করোনা বোরিয়ালিস। আমার বন্ধুর চেতনায় যে প্রবল ভয়ংকর অজানা জগতের দূত। তার অর্ধবৃত্তাকার শরীর জুড়ে ফুটে রয়েছে উজ্জ্বল তারারা।
ঠিক সেই সময় আমি একটা নতুন শব্দ শুনতে পেলাম। একনাগাড়ে চলতে থাকা একটা সুর। স্পষ্ট হয়ে উঠেছে অনেক দূরের কোনও জগৎ থেকে ভেসে-আসা একঘেয়ে গুঞ্জন নাকি গজরানি– আকাশের উত্তর-পূর্ব কোণ থেকে ভেসে আসছে কার আহ্বান!
এরপর আমি এমন চিৎকার করে উঠেছিলাম যে, পুলিশ ও বাড়িওয়ালা এসে ঘরের দরজা ভাঙতে বাধ্য হয়। কিন্তু সেই দূরের একঘেয়ে গুঞ্জনের এত ক্ষমতা ছিল না যে, আমাকে একেবারে দখল করে ফেলে আমার বুকের মধ্যে চিরকালীন ভয়ের জলছাপ হয়ে উঠবে। আমার চিৎকারের কারণ ছিল অন্য কানে ভেসে আসা কোনও গুঞ্জন নয়, চোখে দেখা এক দৃশ্য। আমি দেখেছিলাম আকাশের অন্ধকারাচ্ছন্ন উত্তর-পূর্ব কোণ থেকে অন্ধকার, বন্ধ দরজার আড়ালে থাকা ঘরের মধ্যে এসে পৌঁছেছে ভয়ংকর এক লাল ও সোনালি-মেশানো আলোকরশ্মি। এমন এক রশ্মি, যা ঘরের অন্ধকারকে ভেদ করছে না। সে কেবল বিচ্ছুরিত হচ্ছে ঘরের কোণের নিদ্রিত মানুষটির মুখমণ্ডল থেকে। আমার বন্ধুর মুখটা এখন অবিকল পুরোনো সময়ের মতো দেখাচ্ছে, যখন আমরা সময় আর স্পেসের শিকল ভেঙে কোন সুদূরে ভেসে গিয়েছিলাম এক গোপন, নিষিদ্ধ দুঃস্বপ্নের গুহায়। তখনও স্বপ্নের গভীরে তার তারুণ্যে ভরা মুখে আমি এমনই আলো ফুটে থাকতে দেখেছিলাম।
আমি দেখলাম, আমার বন্ধুর কালো, ঘন, আয়ত চোখে ফুটে উঠেছে আতঙ্ক। তার পাতলা, ছায়াচ্ছন্ন ঠোঁট ধীরে ধীরে ফাঁক হচ্ছে। মনে হল, সে ভয়ে চিৎকার করে উঠতে চাইছে। কিন্তু আতঙ্ক এমনভাবে তাকে গ্রাস করেছে, তার গলায় কোনও স্বর ফুটে উঠছে না। অন্ধকারে অদৃশ্য হয়েছে তার দেহ, কেবল জেগে আছে মাথাটুকু। কেঁপে কেঁপে উঠছে। সেই আতঙ্কিত মুখে জেগে রয়েছে তীব্র, মগজ অবশ করে দেওয়া ভয়ের জলছাপ।
কোথাও কোনও শব্দ নেই। কেবল সেই অমানুষিক গজরানি ক্রমেই বেড়ে উঠছে। বন্ধুর আতঙ্কিত দৃষ্টি অনুসরণ করে আমিও তাকালাম অভিশপ্ত সেই সোনালি-লাল আলোর উৎসের দিকে। আর দেখলাম… ওহ্! এক লহমার জন্য আমি যা দেখেছিলাম আর শুনেছিলাম, তার অভিঘাতেই আমার কণ্ঠস্বর চিরে বেরিয়ে এসেছিল তীব্র আর্তনাদ। সেই চিৎকার এমনই তীব্র ছিল, ছুটে এসেছিল পুলিশ ও বাড়িওয়ালা।
আমি কখনও কাউকেই বলতে পারিনি আমি কী দেখেছিলাম। চেষ্টা করেও পারিনি। সেই স্বপ্নতাড়িত মানুষটিও পারেনি। আমি নিশ্চিত, আমি যা দেখেছিলাম, ও তার থেকেও অনেক, অনেক বেশি কিছু দেখেছিল। ও আর কখনওই কথা বলবে না। কিন্তু আমি চিরকাল পাহারা দিয়ে যাব ওকে, অনন্ত জ্ঞান ও দর্শনের পিপাসু, চির-অতৃপ্ত ঘুমের দেবতা হিপনোসকে।
ঠিক কী ঘটেছিল সেই রাত্রে, তা আমার কাছে অজানাই রয়ে গেছে। মনের ভেতরে জেগে-ওঠা ভয়ানক সব দৃশ্যের অভিঘাতে আমি এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলাম। বাকিরাও কেউ কিছুই বলতে পারেনি। ওদের আচরণে স্পষ্ট, ওরা পুরো ব্যাপারটাই আমার পাগলামি বলে ধরে নিয়েছে। ওরা আমাকে বলেছে, আমার কোনও দিনই কোনও বন্ধু ছিল না। শিল্প-দর্শনে ঝুঁদ হয়ে থাকার পাগলামিতেই নাকি আমার জীবনের এমন করুণ পরিণতি!
সেই রাতে বাড়িওয়ালা, পুলিশ– সবাই আমাকে অনেকক্ষণ ধরে শান্ত করার চেষ্টা করেছিল। ডাক্তার এসে আমাকে ওষুধ দিল, যাতে আমি শান্ত হতে পারি। আমার বন্ধুকে নিয়ে ওদের কোনও মাথাব্যথা ছিল না। ওরা স্টুডিয়োর এক কোণ থেকে উদ্ধার করেছিল একটা মূর্তি, যার জন্য প্রচুর প্রশংসা জুটেছিল আমার কপালে। পরবর্তী সময়ে খ্যাতিও পেয়েছি প্রভূত। একসময় যে খ্যাতির আশাকে হেলায় সরিয়ে দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বুঁদ হয়ে থেকেছি এক ধূসর দাড়িময়, বলিরেখায় ঢাকা মুখের সামনে। ভালোবাসা ও প্রার্থনায় মগ্ন থেকেছি তার সামনে।
আমি আমার বানানো সব মূর্তি বিক্রি করে দিয়েছি এ কথা ওরা বিশ্বাস করতে রাজি ছিল না। অবিশ্বাসে মাথা নেড়ে ওরা দেখাচ্ছিল ঘরের কোণের মূর্তিটার দিকে। কী করে ওদের বোঝাই, ওটা আমার বন্ধুর দেহাবশেষ। এক অজানা জগৎ থেকে ভেসে-আসা আলোয় যে বন্ধু চিরকালের মতো অনড়, শীতল, নীরব হয়ে গিয়েছে। সেই বন্ধু, যার সঙ্গে দিনের পর দিন আমি মেতে উঠেছিলাম এক আশ্চর্য পাগলামিতে। যার ঈশ্বরপ্রতিম দেবদুর্লভ শ্বেতপাথরের মুখশ্রীতে লেগে আছে চিরতারুণ্যের জলছাপ। ঠোঁটে লেগে মৃদু বাঁকা হাসি। সুবিন্যস্ত দাড়ি, ঢেউখেলানো চুল।
ওদের দাবি, ওই মুখ আসলে আমারই আদলে তৈরি। আমারই মতো বছর পঁচিশেকের এক তরুণকে আমি তিলে তিলে নির্মাণ করেছি পাথর কুঁদে কুঁদে। কিন্তু ওরা খেয়াল করেনি ওই মুখের চারপাশে যে শ্বেতপাথরের পশ্চাৎপট, তাতে খোদাই-করা একটা নাম। অ্যাটিকা হরফে লেখা যে নামটি প্রাচীন গ্রিসের উপাস্য ঘুমের দেবতার– হিপনোস।
[প্রথম প্রকাশ: গল্পটি ১৯২৩ সালের মে মাসে, দ্য ন্যাশনাল অ্যামেচার ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়।
ভাষান্তর: বিশ্বদীপ দে ]