তফাত যাও! (THE SHUNNED HOUSE)
[আপাতদৃষ্টিতে ভূতের বাড়ির গল্প হলেও লাভক্র্যাফট সুচারুভাবে এর সঙ্গে ভ্যাম্পায়ারের জনশ্রুতি ও প্রভিডেন্সের সত্যিকারের ঘটনা ও স্থান মিশিয়ে দিয়েছেন। দ্য ডানউইচ হরর বা দ্য কল অব কথুলুর মতো এই গল্পেও লাভক্র্যাফট বিজ্ঞানের সঙ্গে অলৌকিক ঘটনার মুখোমুখি সংঘাত ঘটিয়েছেন। প্রথমে ছাপতে অসমর্থ হলেও লাভক্র্যাফটের মৃত্যুর পরে লেখাটি উইয়ার্ড টেলস পত্রিকায় প্রকাশ পায়।]
০১.
১৮৪০-এর দশকের প্রভিডেন্স৷ এডগার অ্যালান পো তখন প্রতিভাবান কবি শ্রীমতী ওয়াল্টার হুইটম্যানের প্রেমে পড়েছেন। বেনিফিট স্ট্রিটের ম্যানসন হাউস থেকে হুইটম্যানের বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত করতেন পো। তাঁর সেই প্রেমনিবেদন সফল হয়নি, এ কথা সবাই জানেন। পো-র সেই যাত্রাপথের ডানদিকে পড়ত একটা পুরোনো বাড়ি। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার কী জানেন? টিলার গা ঘেঁষে দাঁড়ানো ওই অবহেলিত, জীর্ণ দোতলা বাড়িটার ভেতরে এমন ভয়ানক জিনিস ছিল, এবং আছে, যা পো-র লেখাকেও হার মানাবে। অথচ পো এমন কিছু আন্দাজ করতে পারেননি। সেন্ট জেমস চার্চের লাগোয়া বিস্তীর্ণ সমাধিক্ষেত্র নিয়ে পো অনেক কিছু লিখেছেন। কিন্তু ওই বাড়িটা নিয়ে তিনি কিছু লেখেননি।
অবশ্য পো-কে দোষ দেওয়া যায় না। নিউ ইংল্যান্ডের আদি বাসিন্দারা যখন ওখানে নিজেদের বাড়িঘর বানিয়েছিলেন, তখন ওই সমাধিক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে যেতে হত। পরে রাস্তাটা সোজা আর চওড়া করতে গিয়ে বিস্তর ভাঙাভাঙি হয়। তাই পো রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় একটা ফুট দশেক উঁচু ধূসর দেওয়াল ছাড়া কিছুই দেখেননি। বাড়িটার পেছনে, দক্ষিণদিকে অনেকটা ভোলা আর উঁচু জায়গা ছিল, যেটা রাস্তা থেকে দেখা যেত না। শ্যাওলা-ধরা পাথরে ঘেরা ওই জায়গাটায় কী আছে? ভাঙা সিঁড়ি, মরা ঘাস, বিবর্ণ ইটের দেওয়াল, আগাছা আর আধমরা গাছে ভরা বাগান, আর এসবের মাঝে সময়ের মার খেয়ে কালশিটে পড়ে যাওয়া সদর দরজা। এরপরেও বাড়িটাকে কে মনে রাখবে বলুন?
আমি বাড়িটার কথা প্রথম শুনি ছোটবেলায়। ওটাকে লোকে অপয়া বাড়ি বলত। ওখানে যারাই থাকে, তাদেরই নাকি আয়ু ফুরিয়ে যায় বড় তাড়াতাড়ি। অথচ আশপাশের বাড়িতে তেমন কোনও সমস্যা ছিল না। সচরাচর এমন বাড়িকে ভূতুড়ে বলে দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে সেটাও করা যায়নি, কারণ জানলায় ধোঁয়াটে মুখ, হঠাৎ করে ভেসে-আসা ঠান্ডা হাওয়া, আলোর আচমকা জ্বলা-নেবা… এমন কিছু হত না ওই বাড়িটায়। তাই এলাকার সবার বক্তব্য ছিল, বাড়িটার জল-হাওয়ায় রোগব্যাধির জীবাণু বড় বেশি। তবে হ্যাঁ, লোকে মুখে মুখে কিছু কথা বলত। ওই বাড়িতে যারা কাজকর্ম করত, তারা নিজেদের মধ্যে গুজগুজ-ফুসফুস করে অনেক কিছুই বলত। সেগুলো লোকে পাত্তা দিত না। পরে যখন প্রভিডেন্স জমজমাট এলাকা হয়ে গেল, তখন লোকের ভিড়ে চাপা পড়ে গেল সব কথা।
ছোটবেলায় আর পাঁচটা ছেলের মতো আমিও ওই বাড়িটায় বিস্তর দস্যিগিরি করেছি। ওটা তত দিনে পরিত্যক্ত হয়ে গেছে। মাকড়সার জাল আর অন্ধকার, ভাঙা আসবাব আর সবুজ-হয়ে-যাওয়া দেওয়াল… এগুলোর মাঝে কোনও প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ দশ মিনিটও কাটাতে চাইবেন না। তবে আমাদের কাছে ওগুলো ছিল দারুণ সব অ্যাডভেঞ্চারের জায়গা। বাড়িটার একমাত্র জায়গা, যেটা আমরা এড়িয়ে চলতাম, সেটা হল মাটির নীচের সেলার। ওখানে এক ধরনের ছত্রাক হত। ছাদ, দেওয়াল, এমনকী মেঝে থেকেও উঠে আসত ছত্রাকগুলো। সেগুলোর বিশ্রী গড়ন দেখে আমাদের গা-শিরশির করত। একটা সময়ে ছত্রাকগুলো ভেঙে গিয়ে সবৃজেটে-নীল আলোর গুঁড়ো ছড়িয়ে পড়ত। লোকে ভাবত, জলার মতো ওই বাড়ির নীচ থেকেও উঠে আসছে আলেয়া।
.
০২.
ওই বাড়িটায় আসল গোলমাল কী, সেটা স্রেফ দু-জন মানুষ জানতেন। একজন আমার কাকা ডক্টর এলিহু হুইপল। অন্যজন আমি। আমেরিকার সবচেয়ে বনেদি পরিবারগুলোর মধ্যে একটির সন্তান ছিলেন এলিহু। প্রত্নতত্ত্ব আর নৃতত্ত্ব– এই দুই শাখাতেই তাঁর মতো পণ্ডিত বিরল। বাড়িটার পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর বলেই ওখানে এত লোক মারা গেছে, এমনটাই ছিল তাঁর ঘোষিত মত। ভদ্রলোকের যা ব্যক্তিত্ব, তাতে এই নিয়ে তাঁকে খোঁচাখুঁচি করা চাট্টিখানি ব্যাপার ছিল না। কিন্তু আদরের ভাইপোর নাছোড় দাবি এড়ানোও কি সহজ? নিরুপায় হয়ে কাকা আমার কাছে একদিন তাঁর খাতাপত্র রেখে দিয়ে নাও! পড়ো! বলতে বাধ্য হন। ওই বাড়িটা নিয়ে শ-খানেক বছর ধরে চলে-আসা কানাকানি আর তাঁর নিজের নোট-করা কিছু পর্যবেক্ষণ তখনই আমার সামনে আসে।
সযত্নে সংকলিত ওই রেকর্ড অনুযায়ী বাড়িটা বানানো হয়েছিল ১৭৬৩ সালে। ওখানে বসত-করা প্রথম পরিবারের সদস্য ছিলেন উইলিয়াম হ্যারিস, তাঁর স্ত্রী রোবি ডেক্সটার, তাঁদের ছেলেমেয়েরা, অর্থাৎ এলকানা, অ্যাবিগেইল, উইলিয়াম জুনিয়র আর রুথ। হ্যারিস সেই আমলের বেশ নামকরা ব্যবসায়ী এবং নাবিক ছিলেন। হ্যারিস চেয়েছিলেন, তাঁর পঞ্চম সন্তানের জন্ম হওয়ার আগেই যেন নতুন বাড়িটা তৈরি হয়ে যায়। বাড়ি হল, ১৭৬৩-র ডিসেম্বরে তাতে হ্যারিস আর রোবির পঞ্চম সন্তানের জন্মও হল। কিন্তু বাচ্চাটি মৃত হয়েই জন্মায়।
পরের বছর এপ্রিলে হঠাৎ-হওয়া অসুখে অ্যাবিগেইল আর রুথ মারা যায়। স্থানীয় ডাক্তার ওটাকে সংক্রমণ বলেছিলেন। কিন্তু বর্ণনা থেকে ওটাকে স্রেফ শরীরের ক্ষয় ছাড়া কিছু বলা যায় না। সংক্রমণের জন্য কী দায়ী তা বোঝার আগেই জুন মাসে ওই পরিবারের এক ভৃত্য হ্যাঁনা ব্রাউন মারা যায়। অন্য ভৃত্য এলি লিডিয়াসন দুর্বলতা এবং আরও নানা কারণ দেখিয়ে কাজ ছেড়ে চলে যেতে চাইছিল। হ্যাঁনার জায়গায় মেহিতাবেল পিয়ার্স নামের যে নতুন মেয়েটি আসে, তার প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ায় সে ব্যাপারটা পিছিয়ে দেয়। ওই দেরিটাই কালান্ত হয়ে যায়। পরের বছরেই মারা যায় এলি৷ সেই বছরে উইলিয়াম হ্যারিসও মারা যান। বিষণ্ণ বাড়িটায় থেকে যান বিধবা রোবি আর তাঁর দুই ছেলে।
দু-বছর পর এলকানার মৃত্যু হয়। স্বামীর মৃত্যুর ধাক্কায় ইতিমধ্যেই কাহিল রোবি এটা বরদাস্ত করতে পারেননি। ১৭৬৮-র কোনও একসময় তাঁর মাথা খারাপ হয়ে যায়। সেই সময় এর চিকিৎসা বলে কিছু ছিল না। তাঁকে বাড়ির ওপরতলায় আটকে রাখা হয়। রোবির দিদি মার্সি ডেক্সটার এই পরিবারের দায়িত্ব নিতে আসেন। বোনের আর রুগ্ণ বোনপো উইলিয়ামের যথাসাধ্য দেখভাল করতেন মার্সি।
১৭৬৮-তেই প্রথমে মেহিতাবেল মারা যায়। তারপর অন্য কর্মচারীটিও অসংলগ্ন কিছু গালগল্প শুনিয়ে, শেষে বাড়িটার গন্ধ পছন্দ হচ্ছে না বলে একদিন হাওয়া হয়ে যায়। একের পর এক মৃত্যু আর এইসব গালগল্পের অবধারিত ফল হয় একটাই। মার্সি এলাকা থেকে এমন কাউকে জোগাড় করতে পারেননি যে, ওই বাড়িটায় কাজ করতে রাজি হবে। বিস্তর চেষ্টা করে তিনি নুসনেক এলাকার বাসিন্দা অ্যান হোয়াইট নামের এক গম্ভীর, মলিনবদন মহিলাকে এই বাড়িতে কাজ করাতে রাজি করান। বস্টনের বাসিন্দা জেনাস লো বলে এক মোটামুটি করিতকর্মা পুরুষও ওই বাড়িতে এরপর কাজে ঢোকে।
এই বাড়ি নিয়ে গল্পগুলো জমাট আকার পায় অ্যান হোয়াইটের মাধ্যমে। মাস তিনেকের মধ্যে অ্যানকে বরখাস্ত করে নিউপোর্টের মারিয়া রবিন্সকে নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু তদ্দিনে বাড়িটা নিয়ে বাজারে যা চাউর হওয়ার ছিল, হয়ে গেছে।
এইসবের মধ্যে রোবি হ্যারিসের উন্মাদনা ক্রমেই অন্য চেহারা নিচ্ছিল। ঠিক কী বলে চিৎকার করতেন রোবি, সেই বিষয়ে কাগজপত্র নীরব। তবে ফরাসি ভাষায় কিছুমাত্র দখল না-থাকা সত্ত্বেও ওই ভাষায় তিনি যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতেন– এটা লেখা আছে। অপলক চোখে তাঁর দিকে কে যেন তাকিয়ে আছে, কে যেন তাঁকে খেতে আসছে– এইসব বলে আর্তনাদ করতেন রোবি। বাড়ির পরিস্থিতি এতই ঘোরালো হল যে, সাময়িকভাবে উইলিয়ামকে তার খুড়তুতো দাদা পেলেগের কাছে সরিয়ে দেওয়া হয়। উইলিয়ামের অবস্থার যথেষ্ট উন্নতি হয়েছিল তার ফলে। ১৭৭২ সালে জেনাস মারা যায়। রোবি নাকি পাগলের মতো হেসেছিলেন সেই মৃত্যুসংবাদ পেয়ে। পরের বছর তাঁরও মেয়াদ ফুরোয়।
১৭৭৫ সালে শুরু হয় গ্রেট ব্রিটেনের সঙ্গে তার কলোনির ঝামেলা। সেটা ক্রমে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে পরিণত হয়। উইলিয়াম হ্যারিসের শরীর যতই ক্ষয়টে থোক না কেন, মাত্র ষোলো বছর বয়সে সে জেনারেল গ্রিনের বাহিনীতে যোগ দেয়। তারপর উইলিয়ামের স্বাস্থ্য এবং সম্মান, দুয়েরই প্রভূত উন্নতি হয়। ১৭৮০ সালে রোড আইল্যান্ড এলাকার ভারপ্রাপ্ত ক্যাপটেন থাকার সময় এলিজেবেথটাউনের বাসিন্দা ফেবে হেটফিল্ডের সঙ্গে উইলিয়ামের বিয়ে হয়। পরের বছর যুদ্ধ থামলে, সেনাবাহিনী থেকে সসম্মানে অবসর নিয়ে উইলিয়াম সস্ত্রীক তাঁর পৈতৃক বাড়িতে ফিরে আসেন। বাড়িটা মজবুত অবস্থায় ছিল। এলাকাটাও বেশ পশ হয়ে উঠেছিল তদ্দিনে, যার ফলে রাস্তাটার নাম ব্যাক স্ট্রিটের বদলে বেনিফিট স্ট্রিট হয়ে গিয়েছিল।
দুর্ভাগ্যের বিষয়, উইলিয়ামের প্রত্যাবর্তন সুখের বা আনন্দের হয়নি। তত দিনে মার্সি এবং মারিয়ার শরীর-স্বাস্থ্য জবাব দিয়ে দিয়েছে। ১৭৮২-র শরৎকালে ফেবে একটি মৃত কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। ১৭৮৩-র মে মাসে মারিয়াও পাড়ি জমায় দুনিয়া ছেড়ে। এরপর উইলিয়াম হ্যারিসের মনে আর কোনও সংশয় ছিল না। এই বাড়ি যে বিপজ্জনক– এটা বুঝে উইলিয়াম প্রথমে গোল্ডেন বল সরাইয়ে, তারপর বড় ব্রিজের ওপারে ওয়েস্টমিনস্টার স্ট্রিটের ওপর নতুন বাড়ি বানিয়ে সেখানেই চলে যান। ১৭৮৫ সালে তাঁদের ছেলে ডাটির জন্ম হয়। ১৭৯৭ সালের মড়কে উইলিয়াম আর তাঁর স্ত্রীর মৃত্যু হয়। পেলেগ যেভাবে একসময় রুগণ উইলিয়ামের দেখাশোনা করেছিলেন, সেভাবেই তাঁর ছেলে র্যাথবোন হ্যারিস এবার ডাটির দায়িত্ব নেন।
র্যাথবোন একটু কড়া ধাঁচের বাস্তববাদী লোক ছিলেন। ডাটির ভরণপোষণে যাতে সমস্যা না হয়, সেটা নিশ্চিত করার জন্য তিনি বেনিফিট স্ট্রিটের বাড়িটা ভাড়া দেন। ভাড়াটেদের মৃত্যু, বাড়িটা ছেড়ে চলে যাওয়া, কানাকানি এসবে র্যাথবোনের কোনও মাথাব্যথা ছিল না। তবে ১৮০৪ সালে প্রায় একসঙ্গে চারজন ভাড়াটের মৃত্যুর পর শহরের কাউন্সিল র্যাথবোনকে গন্ধক, আলকাতরা, কর্পূর দিয়ে বাড়িটা শোধন করতে আদেশ দেয়। ডাটি নিজে বাড়িটা নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাতেন বলে মনে হয় না। ১৮১২-য় ব্রিটেনের সঙ্গে হওয়া যুদ্ধে ডাটি ক্যাপটেন ক্যাহুনের নেতৃত্বে লড়েছিলেন। অক্ষত দেহেই ডাটি যুদ্ধ থেকে ফেরেন, ১৮১৪-য় বিয়ে করেন, এবং ১৮১৫-য় এক দারুণ দুর্যোগের রাতে ওয়েলকাম নামে এক পুত্রসন্তানের গর্বিত পিতা হন। ওয়েলকাম দীর্ঘায়ু হননি৷ ১৮৬২ সালে ফ্রেডরিক্সবার্গের যুদ্ধে তিনি মারা যান।
ওয়েলকাম বা তাঁর ছেলে আর্চার ওই বাড়িটা নিয়ে কিছু লিখে যাননি। বাড়িটা ভাড়া দেওয়া এমনিতেই দুঃসাধ্য ছিল। ১৮৬১ সালে আবার পরপর কয়েকটা মৃত্যু ঘটে ওখানে। গৃহযুদ্ধের ডামাডোলে সেসব ধামাচাপা পড়ে গিয়েছিল। তবে লোকে আর ওটা ভাড়া নিত না।
.
০৩.
হ্যারিস পরিবারের এই ইতিহাস আমাকে ঠিক কতটা ঝাঁকিয়ে দিয়েছিল, বোঝাতে পারব না। এতগুলো মৃত্যু, অসুস্থতা এবং সে-ও শুধু ওই পরিবারে নয়, অন্য ভাড়াটেদের পরিবারেও… এর থেকে একটাই জিনিস পরিষ্কার হয়। ওই পরিবারে নয়, বরং ওই বাড়িটায় গণ্ডগোল আছে। সেটাও এমন কিছু, যাকে মামুলি ড্যাম্প বা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ বলে চালিয়ে দেওয়া যায় না।
কোন সে মৃত্যুদূত, যে ওই বাড়িতে শিকার করে চলেছে একের পর এক মানুষকে?
অনেক কিছু রেকর্ড করেছিলেন ডক্টর এলিহু। অনেক গুজব, অভিযোগ, অপবাদ… মুশকিল হল, সেই ডকুমেন্টেড জিনিসগুলোর ভাঁজে ভাঁজে মিশে গিয়েছিল এলাকার মানুষের দীর্ঘলালিত কুসংস্কার। ফলে কোন কথাটাকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত, আর কোনটাকে নয়, সেটা বুঝতেই আমি হিমশিম খেয়ে যাই। একটা উদাহরণ দিই। অন্তত তিনজন মানুষ একেবারে জবানবন্দি দিয়ে বলেছেন, ওই বাড়ির সেলারে যে বিচিত্র ছত্রাক হয়, তার চেহারা, গন্ধ, আলো… এগুলো তাদের প্রভাবিত করেছে। ছোটবেলার স্মৃতি থেকে আমি বুঝতে পারছিলাম, এটা হতেই পারে। কিন্তু একই নিশ্বাসে সেই লোকেরা ডাইনি আর অপদেবতা নিয়ে যত রাজ্যের ভুলভাল কথাও বলেছিল শ্রোতাদের সামনে।
অ্যান হোয়াইটের কথাই ধরুন। সেলারের ছত্রাকের বর্ণনা দেওয়ার পাশাপাশি ও বলেছিল, ওই বাড়ির নীচে কোনও রক্তচোষার বাস! একেবারে হাল আমলেও এক্সেটারের লোকজন এই ভ্যাম্পায়ার-ট্যাম্পায়ার নিয়ে মাথা ঘামিয়েছে। কাজেই তখন এই কথার মহিমা কেমন ছিল ভাবুন! ওই বাড়িটা যে জমিতে বানানো, সেটা কোনও একসময়ে কবরখানা ছিল। তাই লোকে জুলজুলে চোখে কান খাড়া করে ওই বাড়ির সেলারে অ্যানের কী ধরনের ভয়াল-ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হয়েছে তা শুনত। অ্যানের ওই ক্রমাগত সেলার খোঁড়ো, নয়তো মরো! কথায় ক্লান্ত হয়ে ওকে বাড়ি থেকে দূরই করে দেওয়া হয়েছিল একসময়।
আমি কিন্তু কথাগুলো পুরোপুরি উড়িয়ে দিতে পারিনি। তার কারণগুলো একে একে লিখি।
এক চাকরের জবানিতে আমি কিছু কথা পড়েছিলাম। অ্যানের সঙ্গে তার কখনও কথা হয়নি। অ্যান হোয়াইট ওই বাড়িতে কাজ পাওয়ার আগেই সে ওখানকার কাজ ছেড়ে দিয়েছিল। প্রিজার্ভড স্মিথ নামের সেই চাকর বলেছিল, রাতে কেউ তার নিশ্বাস কেড়ে নেয়!
১৮০৪ সালে ডক্টর চ্যাড হপকিন্স জ্বরের ঘোরে মৃত্যুর জন্য যে চারটি মানুষের ডেথ সার্টিফিকেট ইশ্য করেছিলেন, তাতেও একেবারে স্পষ্টভাবে লেখা ছিল একটা তথ্য। চারজনের শরীরেই রক্ত প্রায় ছিলই না!
রোবি হ্যারিস এমন কারও কথা বলতেন, যে নাকি ধারালো দাঁত বের করে তাঁকে খেতে আসত!
আরও ইন্টারেস্টিং ব্যাপার পাওয়া গেল কাগজ থেকে কেটে রাখা খবরে। ১২ এপ্রিল ১৮১৫-র প্রভিডেন্স গেজেট আর কান্ট্রি জার্নাল-এ একটা মৃত্যুর বর্ণনা পাই। ২৭ অক্টোবর ১৮৪৫-এর ডেইলি ট্র্যানস্ক্রিপ্ট অ্যান্ড ক্রনি-এ ছিল অন্য একটা বিবরণ। ত্রিশ বছরেরও বেশি ব্যবধানে হওয়া এই দুটো ঘটনার মধ্যে এমন একটা মিল ছিল, যাকে মামুলি সমাপতন বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
১৮১৫ সালে ওই বাড়িতে স্ট্যাফোর্ড নামের এক বয়স্ক মহিলা মারা যান। ১৮৪৫ সালে মারা যান এলিয়াজার ডার্ফি নামের এক স্কুল শিক্ষক। মারা যাওয়ার আগে এঁরা দু-জনেই শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে তারপর সামনে থাকা ডাক্তারের ঝুঁটি কামড়াতে গিয়েছিলেন! এটাকে জ্বরের ঘোর বলে মানা যায় না। আর-একটা কথাও কাগজে পেলাম। ১৮৬১ সালে যে মৃত্যুগুলোর পর ওই বাড়ি ভাড়া হওয়াই বন্ধ হয়ে যায়, তাতেও প্রতিটি ক্ষেত্রে মৃত্যুপথযাত্রী মানুষটি সামনে থাকা মানুষের কবজি বা গলা কামড়ে প্রায় ফুটো করে দিয়েছিল!
মোটামুটি ওই সময়েই আমার কাকা তাঁর ডাক্তারি শুরু করেছিলেন ওই এলাকায়। আমার প্রশ্নের উত্তরে থেমে থেমে কাকা কয়েকটা কথা বলেছিলেন।
শুধু মৃত্যুর মিছিল চলার জন্য নয়। জানলা দিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে-পড়া সূর্যের আলোয় ধুলোর নাচ দেখতে দেখতে কাকা বলেছিলেন, আমার কাছে বাড়িটা কৌতূহলের বিষয় হয়ে উঠেছিল অন্য একটা কারণে। ওই অপুষ্ট, রুগ্ণ মানুষগুলো এমনিতে মাতৃভাষাই ভালোভাবে লিখতে-পড়তে জানত না। অথচ তারাই অসুস্থ হলে ফরাসি ভাষায় প্রলাপ বকত, চিৎকার করত, হাহাকার করত! ব্যাপারটা কতটা অস্বাভাবিক ভাবতে পারছ?
পারছি। আমি বলেছিলাম, আচ্ছা, এটা কি শুধু ওই চারজনের মধ্যেই হয়েছিল?
উঁহু। মাথা ঝাঁকিয়ে বলেছিলেন এলিহু, প্রায় একশো বছর আগে উন্মাদিনী রোবি হ্যারিসের মধ্যে এই জিনিস প্রথম দেখা আর শোনা গিয়েছিল। এই কথাটা জানতে পারার পরেই বাড়িটার ইতিহাস নিয়ে আমার চর্চা শুরু হয়। ডক্টর চেস আর ডক্টর হুইটমার্শের বাড়িতে যাতায়াত করে তাঁদের কেসবুকগুলো উদ্ধার করি। সেগুলো থেকে একটা ব্যাপারে একেবারে নিঃসংশয় হয়ে যাই। ওই বাড়ির ছোঁয়ায় মানুষগুলোর শুধু শরীরে নয়, মনেও কিছু একটা পরিবর্তন এসেছিল। কিন্তু কীভাবে?
কারণটা জানতে পেরেছিলেন? আমি প্রশ্ন করেছিলাম। প্রতিষ্ঠিত মহলে এসব নিয়ে আলোচনা করা অসম্ভব ছিল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাকা বলেছিলেন, তাই আমি এই প্রসঙ্গটা ভুলেই গিয়েছিলাম। এবার তুমিই যখন সেগুলো খুঁড়ে বের করলে, তখন বাকি তদন্তটা তোমাকে চালাতে হবে। কী? পারবে তো?
এমনিতে আমি যেমনই হই-না কেন, বোধহয় কাকার বিশ্বাসের মর্যাদা দিতেই আমি এই রেকর্ডগুলো নিয়ে দারুণ সিরিয়াস হয়ে পড়ি।
হ্যারিস পরিবারের শেষ সদস্য ক্যারিংটনের সঙ্গে আমি বহুবার কথা বলেছিলাম। সন তারিখের খুঁটিনাটি মেলানো, মৃত্যুর যে মর্বিড খতিয়ান ডাক্তারদের নোটবুক থেকে পাওয়া গিয়েছিল, তাকে চার্চ আর অন্য প্রতিষ্ঠানের দস্তাবেজ দিয়ে যাচাই করে নেওয়া– এসবই করেছিলাম আমি। হ্যারিস পরিবারের লোকেরা ওই ফরাসি ভাষা নিয়ে কিছু বলতে পারেনি। শুধু এটুকু বোঝা গিয়েছিল যে, মারিয়া নামের ওই পরিচারিকা কিছু জানতেন বা আন্দাজ করেছিলেন। ১৭৬৮-তে কাজে লাগার পর থেকে ১৭৮৩-তে ওই বাড়ি থেকে
হ্যারিস পরিবার পাততাড়ি গোটানো অবধি সময়টা ওখানে ছিলেন মারিয়া। রোবির শেষ সময়ের হাহাকার নিয়ে তিনিই একদা অন্যদের কিছু বলেছিলেন। কিন্তু কালের গর্ভে তলিয়ে গেছে সেই কথাগুলো।
এই এলাকায় একটা শাসনব্যবস্থার পত্তন হওয়ার গোড়ার দিকের রেকর্ড দেখতে গিয়ে আমি অবশেষে কিছু জানতে পারলাম। নারাগানসেট ইন্ডিয়ানদের কাছ থেকে এই এলাকাটা দখল করেছিল প্রথমদিকের বাসিন্দারা। জন থ্রকমৰ্টন নামের কেউ ওই প্লটটা প্রথম পেয়েছিল। পরে ওই জায়গাটায় রাস্তা বানানো আর নতুন করে জমিজিরেত ভাগাভাগির চক্করে বিস্তর বদল হয়। হ্যাঁ, ওখানে এককালে প্ৰকমৰ্টনদের কবরখানাও ছিল। কিন্তু ব্যাক স্ট্রিট ওরফে বেনিফিট স্ট্রিট বানানোর সময় কবরগুলো নিয়মমাফিক সরিয়ে পটাকেট ওয়েস্ট রোডে সরিয়ে আনা হয়।
ওই জরাজীর্ণ ধূলিমলিন কাগজের স্তূপ থেকে কিছু পাওয়া যাবে না, এমনই ভেবেছিলাম। কপালজোরে একটা কাগজ তখনই দেখলাম। সেটা থেকে জানা গেল, জনৈক এতিয়েন রুলে আর তাঁর স্ত্রী-কে এই জমি লিজ দেওয়া হয়েছিল।
এতক্ষণে আমি একটা ফ্রেঞ্চ কানেকশন খুঁজে পেলাম! নতুন উৎসাহে বলীয়ান হয়ে কাগজে আরও খোঁড়াখুঁড়ি করলাম। জানা গেল, রুলেদের একটা ছোট্ট একতলা কটেজের পেছনেই ছিল তাদের পারিবারিক কবর। ১৭৪৭ থেকে ১৭৫৮-র মধ্যে ব্যাক স্ট্রিটকে সোজা করার জন্য কটেজটা ভাঙা হয়েছিল। কিন্তু ওই কবরগুলো সরানোর কোনও প্রমাণ আমি পেলাম না। পুরোনো ম্যাপ দেখে দেখে আমার চোখে পার্মানেন্ট হলদে ভাব হয়ে গেল। অবশেষে আমি যা খুঁজছিলাম, তা পেলাম।
উইলিয়াম হ্যারিস তাঁর বাড়িটা সেই কবরখানার ওপরেই বানিয়েছিলেন!
অতঃপর রোড আইল্যান্ড হিস্টরিক্যাল সোসাইটি আর শেপলির লাইব্রেরি অভিযান চালালাম। বিস্তর খোঁজাখুঁজির পর জানা গেল, ১৬৯৬ সালে ইস্ট গ্রিনউইচ থেকে এসেছিল রুলে পরিবার। সেখানে ওই পরিবারটিকে স্থানীয় লোকে দু-চোখে দেখতে পারত না। প্রভিডেন্সে অভিবাসী হওয়া ফরাসি পরিবারগুলোর সঙ্গে ইংরেজ বাসিন্দাদের সাংঘাতিক ঝামেলা হয়েছিল, এটা ঐতিহাসিক সত্য। কিন্তু তার মধ্যেও এই বিশেষ পরিবারটির ওপর লোকজন বিশেষভাবে খেপে ছিল। কেন? সে প্রশ্নের সহজ উত্তর আমি কোথাও পাইনি। তবে মনে হয়, এতিয়েন রুলে চাষবাস বা অন্য কাজকর্মের বদলে কী সব নিষিদ্ধ বইপত্র পড়ায়, আর বিচিত্রদর্শন নকশা-টকশা আঁকায় পারদর্শী ছিলেন। স্থানীয় লোকেদের চাপেই রুলে পরিবারকে এই একচিলতে জায়গায় থাকতে বাধ্য করা হয়। প্রশাসন তাদের ওপর সদয় হয়ে টাউন স্ট্রিটের জেটিতে এতিয়েনের জন্য একটা কাজ জুটিয়ে দেয়। তারও প্রায় চল্লিশ বছর পর শহরে একটা বিশাল দাঙ্গা হয়। তারপর থেকে রুলে পরিবারের আর কোনও খবর পাওয়া যায়নি।
বসত করার পর প্রায় শ-খানেক বছর ধরে রুলে পরিবারের উল্লেখ নানা কথায় বা লেখায় পাওয়া যায়। তেমন কিছু ছিল না সেই কথায়। তবে সমুদ্রের ধারে একটা ঝিম-ধরা শহরে আলোচ্য বিষয় হওয়ার জন্য তো তেমন কিছু লাগেও না। এতিয়েনের ছেলে পল ছিল বদমেজাজি এবং অভদ্র। তার আচরণের পরেই শহরের ওদিকে দাঙ্গাটা হয়। কিন্তু কী এমন করেছিল পল? নাহ্ এ প্রশ্নের উত্তর কোথাও পাইনি আমি। তবে হ্যাঁ, প্রভিডেন্সের বাসিন্দারা আশপাশের লোকেদের মতো অত কুসংস্কারাচ্ছন্ন না হলেও কিছু জিনিস তাঁরা অপছন্দ করতেন। পল নাকি ভুল সময়ে, ভুল দিকে মুখ করে, ভুল জিনিস বলে উপাসনা করতেন। এই নিয়ে তাঁদের অসন্তোষের আঁচ এত দিন পরেও আমার গায়ে এসে লাগল। সেই সঙ্গে আরও একটা জিনিস জানা গেল।
ষোড়শ শতাব্দীর কডের বাসিন্দা হিউগোনট পরিবারগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল এই রুলেরা। এই তথ্যটা আমাকে অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছিল। একটু অপ্রচলিত পুথিপত্র নিয়ে নাড়াচাড়া করি বলে আমি একটা জিনিস জানতাম।
কডের বাসিন্দা জাক রুলেকে ১৫৯৮ সালে দানব উপাসনার দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। পরে সেটা রদ করে তাকে সারাজীবনের জন্য একটা ঘুপচি ঘরে কয়েদ করে রাখা হয়। কিন্তু সে যা করেছিল, সেটা তাতে লঘু হয়ে যায়নি।
কী করেছিল জাক? জঙ্গলের মধ্যে দুটি নেকড়ের আক্রমণে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া একটি ছেলের শরীরের পাশে জাককে পাওয়া গিয়েছিল রক্ত-মাখা অবস্থায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা সেখান থেকে একটি নেকড়েকেই পালাতে দেখেছিলেন। ফলে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, অন্য নেকড়েটি আর কেউ নয়, জাক স্বয়ং। আমি এমন কোনও দলিল পাইনি, যা থেকে মনে হয় যে, এই উপাখ্যান প্রভিডেন্সেও এসে পৌঁছেছিল। কিন্তু যেভাবে দাঙ্গায় পরিবারটিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়, তাতে মনে হয়, কেউ হয়তো কিছু জেনেছিল।
বুঝতেই পারছেন, এই ব্যাপারটা সমাপতন হতেই পারত। কিন্তু আমার তখন যেখানে দেখিবে ছাই দশা। অতঃপর ওই বাড়িতে আমার আনাগোনা বাড়ল। শেষে ক্যারিংটন হ্যারিসের অনুমতি নিয়ে আমি সরাসরি বেনিফিট স্ট্রিট থেকে ওই বাড়ির সেলারে ঢোকার অনুমতি পেলাম। কারণটা ছিল অত্যন্ত সরল। পরিত্যক্ত একতলা, অন্ধকার সিঁড়ি, ছাতা ধরা দেওয়াল– এসবের মধ্য দিয়ে ওই সেলারে ঢোকার কথা ভেবেই স্নায়ুতে চাপ পড়ছিল। অস্বীকার করব না, দীর্ঘ দিনের অব্যবহারে প্রায় জ্যাম হয়ে যাওয়া দরজায় জং ধরা চাবিটা লাগানোর সময় বুক ধুকপুক করছিল। জানলাগুলো তো বটেই, আমি দরজাটাও খোলা রাখতাম। সেখান দিয়ে আসা দিনের আলোয় ঘরটার প্রতি ইঞ্চি খুঁটিয়ে দেখেও আমি ওখানে স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ, ঠান্ডা মেঝে আর অন্ধকার ছাড়া কিছু পাইনি। রাস্তা দিয়ে যাওয়া পথচারীরা আমাকে দেখে কী ভাবতেন, কে জানে।
অবশেষে ঠিক করলাম, দিনে নয়, বরং রাতে ওখানে যাব। সে দিন মাঝরাতে আমি যখন ফ্ল্যাশলাইট হাতে ওখানে ঢুকলাম, তখন বাইরে তুমুল ঝড়বৃষ্টি চলছে। ফ্ল্যাশলাইটের জোরালো আলোয় উঁচুনিচু মেঝের মধ্যে আমি অবশেষে একটা অস্বাভাবিক জিনিস দেখলাম।
কী দেখলাম আমি?
নোনা-ধরা মাটি, চুন, এমন নানা জিনিসের মধ্যে অনেকটা ঘাড় গুঁজে বসে থাকার মতো করে স্থির হয়ে আছে একটা সাদাটে চেহারা! নিবে-থাকা ফায়ারপ্লেসের গায়ে একটা বড়, প্রায় মানুষ-প্রমাণ ছত্রাকের দাগ-লাগা দেওয়ালের ঠিক পাশেই ওটা রয়েছে। ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় জিনিসটা দেখে মনে হচ্ছিল, যেন বেশ কিছুটা বাষ্প বা কুয়াশা সাদাটে হলুদ রং নিয়ে ঝিলমিল করছে। ছোটবেলায় এমনই কিছু দেখেছিলাম আমি সেলারের অন্ধকারে। সেই স্মৃতি এবং একটা অশুভ আর বিপজ্জনক কিছুর অস্তিত্ব আমাকে মুহূর্তে সজাগ করে তুলল। বুঝতে পারছিলাম, জিনিসটা আমাকে দেখছে… ক্ষুধার্ত চোখে, হিংস্রভাবে! অবস্থাটা বেশিক্ষণ চললে কী করতাম, জানি না। তবে কিছুক্ষণ পর, ঠিক ধোঁয়ার মতো করেই ফায়ারপ্লেসের চিমনির মধ্য দিয়ে জিনিসটা উঠে গেল। পেছনে রয়ে গেল কিছুটা দুর্গন্ধ, আর আমার শরীর-মন জুড়ে একটা কাঁপুনি।
ওখান থেকে ফিরে এসে ঘটনাটা কাকাকে বললাম। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন কাকা। তারপর খুব শান্ত গলায় বলে উঠলেন, ওটাকে শেষ করতে হবে। আর এই কাজটা আমাদেরই করতে হবে। ব্যাস।
.
০৪.
২৫ জুন, ১৯১৯, এই তারিখটা আমি কখনও ভুলতে পারব না। সে দিন আমি আর কাকা ওই বাড়িতে অভিযান চালালাম। ক্যারিংটন হ্যারিসকে আমাদের অভিযান সম্বন্ধে জানানো হয়েছিল। কেন এবং কী উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা সেই রাতে ওখানে যাচ্ছি, সে বিষয়ে ওঁকে আমরা কিছু বলিনি। তবে আমাদের সঙ্গে থাকা জিনিসপত্র থেকে ভদ্রলোক কিছু আন্দাজ করেছিলেন। কাকা ওঁকে বুঝিয়েছিলেন, যা-ই হোক না কেন, সেটা আর কাউকে না-বলাই ভালো হবে। বেচারির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল, তবে উনি রাজি হয়েছিলেন।
পরিকল্পনা ছিল, আমাদের দুজনের মধ্যে প্রথমে একজন, পরে আরেকজন পাহারা তথা পর্যবেক্ষণে নিযুক্ত থাকবে, অন্যজন ঘুমোবে। পরে দু-জনেই জেগে থাকবে। সেইমতো দুটো ক্যাম্প চেয়ার আর একটা ভাঁজ-করা খাট নিয়েছিলাম আমরা। সঙ্গে ছিল বেশ কিছু ভারী, দামি যন্ত্রপাতি। শেষোক্ত জিনিসগুলো ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয় আর ক্রানস্টন স্ট্রিটের আর্মারি থেকে ধার নিতে হয়েছিল। এমনিতে ওসব জিনিস চাইলে পাওয়া যায় না, তবে ডক্টর এলিহু হুইপল কিছু চাইলে তাতে না বলা…!
সেই রাতেও ঝড় উঠেছিল। মনে হচ্ছিল, আমাদের মধ্যেও যেন ঝড়ই হচ্ছে। যেসব জিনিসকে কুসংস্কার বা অন্ধবিশ্বাসের বস্তু ছাড়া আর কিছু ভাবিনি কখনও, তাদের মুখোমুখি হওয়ার জন্য মনকে কি তৈরি করা যায় আদৌ? আমি আর কাকা দু-জনেই এই ক-দিনের ঘাঁটাঘাঁটি থেকে বুঝতে পেরেছিলাম, কিছু একটা আছে ওই বাড়ির সেলারে। আমি তাকে দেখেওছি! তবু, মন এই মুহূর্তগুলোয় উটপাখির মতো বালুতে মুখ গুঁজে বলতে চায়, ঝড় ওঠেনি, কোথাও কিছু নেই, সব ঝুট হ্যায়! কিন্তু এলিহু হুইপলের পাল্লায় পড়লে উটপাখিরাও বোধহয় স্বভাব বদলাত।
রুলে পরিবারের সঙ্গে যে অশুভশক্তির উপাসনা, এবং সেইরকম কিছু বিশ্বাসের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল– এটা আমরা বুঝতে পেরেছিলাম। তাহলে কি সেই পরিবারের শেষ পুরুষ পল রুলে কোনওভাবে, যে যা চাইছিল তা-ই পেয়েছিল? মানুষের মতো চেহারা, ছত্রাকের মতোই একটা পরজীবী স্বভাবের বশে বাসিন্দাদের প্রাণরস শুষে টিকে থাকা, এবং মানুষের মতোই ঘৃণা আর হিংস্রতা দিয়ে আমাকে সেই সন্ধ্যায় দেখা– এগুলোর প্রতিটিই আমাদের বলছিল, পল রুলের একটা অন্ধকার অস্তিত্ব রয়েছে এই বাড়ির সেলারে। কিন্তু ওই অস্তিত্বের বাইরে তার সম্বন্ধে আমরা কিছু জানতাম না। তাই তার মোকাবিলা করার জন্য আমাকে কাকার বিজ্ঞানচেতনা আর ধারণার ওপরেই ভরসা করতে হয়েছিল।
দুটো অস্ত্র নিয়ে তৈরি হয়েছিলাম আমরা।
শক্তিশালী স্টোরেজ ব্যাটারি দিয়ে চালিত কয়েকটা ক্রুকস টিউব, স্ক্রিন আর রিফ্লেক্টর দিয়ে বানানো একটা জটিল জাল ছিল প্রথম হাতিয়ার। যদি জিনিসটা একটা উপস্থিতি ছাড়া কিছু না হয়, তাহলে বাতাসে একটা দৃষ্টির অগোচর, কিন্তু প্রাণঘাতী বিকিরণ ছড়িয়ে তাকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন কাকা।
দ্বিতীয় হাতিয়ারটা আমাদের কারও মনঃপূত হয়নি। তবে ওটা সঙ্গে না রেখে উপায়ও ছিল না। যদি জিনিসটা বায়বীয় না হয়ে নিরেট আকার নেয়, তাহলে সেটাকে ধ্বংস করার জন্য আমাদের একেবারে আদিম একটি শক্তির প্রয়োজন ছিল। আগুন! তাই মিলিটারির কাছ থেকে ধার-নেওয়া দ্বিতীয় হাতিয়ারটা ছিল ফ্লেম-থ্রোয়ার।
এগুলো আমরা যথাসাধ্য বুঝে-শুনে ফিট করলাম। ফায়ারপ্লেসের সামনে ওই জায়গায় ছত্রাকের দাগটা তখন খুবই ফিকে হয়ে এসেছিল। আমি একবার ভাবলামও, ভুল দেখিনি তো? তারপরেই পুরোনো কথাগুলো মনে পড়ে গেল। নতুন উদ্যমে কোমর বেঁধে, ওই জায়গাটা ঘিরে, এবং আরও যেসব এলাকা আমাদের দুজনের কাছেই গোলমেলে ঠেকছিল, সেগুলোর দিকে নিশানা করে আমরা গুছিয়ে বসলাম। রাত তখন দশটা।
বৃষ্টির দাপটে বাইরে রাস্তার আলোগুলো টিমটিম করছিল। সেই আলোয় আর ঘরের ভেতরে ছত্রাক থেকে ছড়িয়ে-পড়া আভায় ঘরটা আরও কুৎসিত দেখাচ্ছিল। দেওয়ালে চুনের লেশমাত্র নেই, বরং ভেজা পাথরগুলোই আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। পায়ের তলায় শক্ত কাঠ নয়, বরং স্যাঁতসেঁতে, ছাতা-পড়া মাটির অস্তিত্ব প্রতিমুহূর্তে বুঝিয়ে দিচ্ছিল, আমরা একটা বাজে জায়গায় এসে পড়েছি। তার সঙ্গে যোগ করুন পরিত্যক্ত ভাঙাচোরা আসবাব, মাথার ওপর বিম আর কড়িবরগার জাল, জায়গায় জায়গায় হাঁ করে থাকা ঘোরানো সিঁড়ি! এর মধ্যে বসিয়ে নিন আমাদের সঙ্গে আনা জটিল যন্ত্রপাতি, আর চেয়ারে বসে থাকা আমাদের।
ছবিটা কি খুব মনোরম ঠেকছে?
আমরা রাস্তার দিকের দরজাটা খোলাই রেখেছিলাম। বাইরে থেকে আলো আসার জন্যই শুধু নয়, বিপদে পড়লে পালানোর জন্যও। প্ল্যান হিসেবে যেটা আমাদের মাথায় ছিল, সেটা খুবই সরল। আমরা ওখানে থাকব। ওই বাড়িতে এখন যেহেতু মানুষের পা পড়েই না বলতে গেলে, রাতভর আমাদের উপস্থিতি ওই অশুভ জিনিসটিকে উত্তেজিত বা প্রলুব্ধ করবে। তখন সে আমাদের কাছে এলে অস্ত্রশস্ত্র প্রয়োগ করা যাবে। আমরা নিজেদের মধ্যে নানা এতোল-বেতোল কথা বলে অনেকটা সময় কাটালাম। তারপর দেখলাম, কাকার চোখ বুজে আসছে। ওঁকে কটে শুইয়ে দিলাম। কেন যেন মনে হল, এবারই যা হওয়ার হবে।
একজন ঘুমন্ত মানুষের পাশে বসে কখনও রাত জেগেছেন? বড় একা লাগে ওই সময়টায়। দুনিয়ার যত রাজ্যের ভয় তখন এসে দানা বাঁধে মনের নরম জায়গাগুলোয়। কাকার গভীর শ্বাসের শব্দের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল বাইরে বৃষ্টি আর হাওয়া মিলে তৈরি হওয়া হাহাকার। জানলা দিয়ে আসা আবছা আলোয় দাগে ভরা দেওয়ালের গা বেয়ে চুঁইয়ে পড়ছিল জলের দানা। পরিবেশটা এতই শ্বাসরোধী হয়ে উঠল যে, আমি দরজা খুলে দিলাম। বাইরে থেকে আসা ভেজা বাতাসটাই বুক ভরে নিলাম। মাথাটা সাফ হয়ে আসছিল ওই হাওয়ায়। তখনই কাকার শ্বাসের শব্দটা আমাকে সচেতন করল।
গত আধ ঘণ্টায় কাকা বেশ কয়েকবার এপাশ-ওপাশ করেছিলেন ঘুমের মধ্যেই। আমি অবাক হইনি। বয়স হলে মানুষের ঘুম পাতলা হয়। কিন্তু এবার তাঁর নিশ্বাসের আওয়াজটা আমার অন্যরকম লাগল। ওঁর ঘুম ভেঙে যেতে পারে জেনেও আমি ফ্ল্যাশলাইটটা ফেললাম খাটের ওপর। দেখলাম, কাকা ওপাশ ফিরে শুয়ে আছেন। আমি এবার ওপাশে গিয়ে সোজা কাকার মুখে আলো ফেললাম। যা দেখলাম, সেটা আমাকে দারুণ ভয় পাইয়ে দিল।
এলিহু হুইপলের ঘুমের সঙ্গে আমি পরিচিত ছিলাম। সেই অবস্থায় তাঁর মুখে একটা গভীর প্রশান্তির ভাব থাকে। কিন্তু সেই মুহূর্তে আমি কাকার মুখে একটা অস্থিরতা দেখলাম। যেন… যেন কাকা আর নিজের মধ্যে নেই। বরং তাঁর শরীরের মধ্যে যেন বাসা বেঁধেছে অন্য অনেকে। তাদের ধাক্কাধাক্কি আর অস্তিত্বের লড়াই ফুটে উঠছে কাকার নিশ্বাস-প্রশ্বাসে, মুখে, আর খুলে-যাওয়া চোখে!
কাকা বিড়বিড় করতে শুরু করলেন। আমি প্রথমে কথাগুলো বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই ওই জড়ানো শব্দ আর নিচু গলার মধ্য দিয়ে একটা জিনিস বুঝতে পেরে আমার মেরুদণ্ড দিয়ে কনকনে ঠান্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল।
এলিহু হুইপল ফরাসি ভাষায় বিড়বিড় করছেন!
আমার জ্ঞানগম্যি কাকার তুলনায় কিছুই না। কিন্তু মানুষটার সাহচর্য পেয়েছিলাম বলে আরও একটা জিনিস বুঝতে পারলাম। প্যারির বিখ্যাত জার্নাল রেভ দে দু মদ-এর জন্য বিশ্বের ভয়ংকরতম কয়েকটা কিংবদন্তি অনুবাদ করেছিলেন কাকা। এই মুহূর্তে, এই অভিশপ্ত বাড়িতে ঘুমে, বা অজ্ঞান অবস্থায় তিনি সেগুলো থেকেই ছেড়ে ছেড়ে কয়েকটা কথা বলছেন।
হঠাৎ কাকার সারা মুখ জুড়ে ঘামের বিন্দু দেখা দিল। মনে হল, যেন একটা অমানুষিক লড়াই চলছিল ওঁর ভেতরে, যাতে সাময়িকভাবে কেউ পিছু হটেছে। কাকা ফরাসির বদলে ইংরেজিতে ফিরে এলেন, আর আর্তনাদ করে উঠলেন, দম আটকে যাচ্ছে। আমার দম আটকে যাচ্ছে! বলে। চোখ খুলে আমাকে দেখেই কাকা উঠে বসলেন। আমি ওঁর হাত ধরে ওঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলাম। একটু শান্ত হয়েই কাকা মুখ খুললেন।
আমি স্বপ্ন দেখছিলাম। বললেন কাকা, একটা ভয়ানক স্বপ্ন! কিন্তু সেটা শুরু হয়েছিল খুব স্বাভাবিকভাবেই। রোজকার কাজ বা কথাগুলো যেভাবে টুকরো টুকরো হয়ে ঘুমের মধ্যে ঘাই মারে, সেভাবেই… আর তারপর…!
তারপর? কাকার দিকে জলের ফ্লাস্ক এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম।
তারপর চেনাজানা জিনিসগুলো অন্যরকম হয়ে যেতে লাগল! জানি, স্বপ্নে এরকম হয়। কিন্তু এবার মনে হচ্ছিল, যেন জিনিসগুলোর জ্যামিতি বদলে যাচ্ছে। সময় আর স্থান দুটোই যেন গলে গলে পড়ছে। একটা ছবির ওপর চেপে বসছে আর-একটা ছবি। সেটা অন্য জায়গার, না অন্য সময়ের… কিছু বুঝতে পারছি না। তার কিছুক্ষণ পর ব্যাপারটা আরও ভয়ানক হয়ে উঠল।
আপনি কাউকে দেখতে পেয়েছিলেন?
একবার মনে হল, যেন আমি একটা অগভীর গর্তের মধ্যে পড়ে আছি, আর বাইরে থেকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে মাথায় তেকোনা টুপি-পরা বেশ কিছু রাগি, হিংস্র লোক! কাকার গলার কাছটা যেভাবে ওঠানামা করছিল, তাতে বেশ বুঝতে পারছিলাম যে, কথাগুলো মনে করতে মানুষটির ইচ্ছে করছে না, পরক্ষণেই মনে হল, যেন একটা
খুব পুরোনো বাড়ির মধ্যে আছি আমি, যার বাসিন্দারা ক্রমাগত বদলে যাচ্ছে! কিন্তু তার মধ্যেও একটা জিনিস বুঝতে পেরেছিলাম।
কী?
আমি যাদের দেখেছিলাম, তাদের মধ্যে অনেকেই এই হ্যারিস পরিবারের মানুষ। আমি ওদের কয়েকজনকে চিনতাম, ছবিও দেখেছি। তাই ওদের মুখের আর চেহারার বিশেষত্ব চিনতে অসুবিধে হয়নি আমার। কিন্তু অন্য একটা ব্যাপার আমাকে ভীষণ কষ্ট দিচ্ছিল।
হ্যাঁ। আমি উদবিগ্ন হয়ে বললাম, আপনার মুখ দেখে মনে হচ্ছিল, আপনি কষ্ট পাচ্ছেন। আপনার কি শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল?
শুধু শ্বাস নিতে নয়। কাকার মুখে একটা ম্লান হাসি ফুটল, একাশি বছর বয়সি এই শরীরের সব কটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তখন লড়াই করছিল। কার বিরুদ্ধে? জানি না। তবে কেউ, বা কিছু একটা আমার শরীর দখল করতে চেষ্টা করছিল ভীষণভাবে।
আমি জানি, আপনারা কী ভাবছেন। এই বর্ণনা শুনে আমার চোখ থেকে ঘুম-টুম উড়ে যাওয়ার কথা, তাই না? কিন্তু বাস্তবে উলটোটাই হচ্ছিল। ঘুমে আমার চোখ জুড়ে আসছিল। বাধ্য হয়ে আমি লম্বা হলাম, আর কাকা আমার পাশে বসলেন একেবারে সোজা আর সজাগ হয়ে। ঘুমে আমি একেবারে তলিয়ে গেলাম। স্বপ্ন দেখাও শুরু হল প্রায় তক্ষুনি। কিন্তু স্বপ্নগুলো আদৌ সুখদায়ক ছিল না। অস্বস্তিতে, ভয়ে আমি চ্যাঁচাতে চাইছিলাম, অথচ পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল, যেন আমি হাত-পা-মুখ-বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছি। আমার চারপাশে যেন এমন অজস্র মানুষের ভিড়, যারা আমাকে মারতে চাইছে। এমনকী কাকার মুখটাও যেন বিকৃত হয়ে আমাকে গিলতে আসছিল স্বপ্নে। শেষ অবধি একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার আমার শরীর-মন থেকে ঘুমের কম্বলটা ছুঁড়ে ফেলে দিল।
.
০৫.
কাকা যে চেয়ারে বসেছিলেন, শোয়ার সময় আমার মুখ ছিল তার উলটোদিকে। ফলে ঘুম ভেঙে আমি প্রথমে রাস্তার দিকের দরজা, উত্তরের জানলা, মেঝে, দেওয়াল, এমনকী সিলিং– এগুলো সবই দেখতে পেলাম। জিনিসগুলো আমার চোখে এতই স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ল, যেটা ওই অবস্থাতেও অস্বাভাবিক ঠেকল। ব্যাপারটা ভাবুন। রাস্তা থেকে আসা মলিন আলো, আর ঘরের মধ্যে ওই বিশ্রী ছত্রাক থেকে বেরিয়ে-আসা আবছা দ্যুতি– এই দিয়ে তো বই পড়াও অসম্ভব ছিল। অথচ ওই মুহূর্তে আমার আর খাটের রীতিমতো ছায়া পড়ছিল সামনের দেওয়ালে! আলোটার মধ্যে একটা জোরালো, হলুদ ভাব ছিল। সেটার উৎস নিয়ে ভাবতে গিয়েই আমার খেয়াল হল, আরও দুটো অস্বাভাবিক জিনিস ঘটেছে ও ঘটছে।
প্রথমত, যে চিৎকারটা আমার ঘুম ভাঙিয়েছে, সেটা কাল্পনিক ছিল না। আমার কান তখনও সেই আওয়াজে একেবারে থরথর করে কাঁপছিল!
দ্বিতীয়ত, একটা বিকট গন্ধে আমার দম আটকে আসছিল।
এক লাফে খাট ছেড়ে উঠে আমি ওই যন্ত্রপাতিগুলোর দিকে এগোলাম। পেছন ফেরার সময় একটা আশঙ্কা ছিল। ভাবছিলাম, না জানি কী দেখতে হবে এবার। কিন্তু যা দেখলাম…!
মাটি থেকে বাষ্পের মতো করে উঠে আসছিল একটা হলদেটে আলো। সেই আলোয় তীব্রতা ছিল, কিন্তু উষ্ণতা ছিল না। মৃত্যুর শীতলতায় ভরে-রাখা আলোটা একটা দানবিক ছত্রাকের মতো চেহারা নিয়েছিল। মনে হচ্ছিল যেন আমি ওই আলোর মধ্যে কিছু একটা আধা-মানুষ, আধা-পিশাচ চেহারার আবছায়া অস্তিত্ব দেখতে পাচ্ছি। তার সারা শরীর জুড়ে রয়েছে ব্যঙ্গ আর খিদে! তার মধ্যে দিয়ে পেছনের চিমনি আর সিলিং দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু জিনিসটাকে হাওয়ার মতো কিছু ভাবতে পারছিলাম না। বরং ওটার ডিম্বাকার মাথাটা যেভাবে ভেঙে ভেঙে চিমনির মধ্যে ঢুকে যাচ্ছিল, তা দেখে কোনও প্রকাণ্ড অজগরের কথাই মনে হয়।
আলোর কি গন্ধ হয়? হয় না। ওই গন্ধটার ফলেই আমি বুঝতে পারলাম, যেটা দেখছি, সেটা একটা দৈত্যাকৃতি ধোঁয়া বা কুয়াশার পুঞ্জ। মাটি থেকে উঠে এসে জিনিসটা পাক খাচ্ছে। আর তার ঘূর্ণনের কেন্দ্রে রয়েছে একজন মানুষ।
এলিহু হুইপল!
কাকার মুখে তাঁর শান্ত, সৌম্য ভাবের লেশমাত্র ছিল না তখন। বরং তাঁর গোটা শরীর ঢেকে যাচ্ছিল একটা কালচে ভাবে। আর তাঁর মুখে ফুটেছিল একটা ক্রুর হাসি, যা কিছু ভালো সেসবকে উড়িয়ে দেওয়ার ব্যঙ্গ, আর… খিদে। ওইভাবেই কাকা… না, কাকার শরীরটাকে গ্রাস-করে-ফেলা ওই কুয়াশা আমার দিকে এগিয়ে এল।
আমি পাগল বা অনড় হয়ে যাইনি। হয়তো এই বাড়িটার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার পর থেকে নিজেকে মনে মনে এইরকম একটা মুহূর্তের জন্য তৈরি করছিলাম। মোদ্দা কথা হল, ওই ধোঁয়া বা জিনিসটা আমার দিকে এগোনোমাত্র আমি একটা জিনিস বুঝে ফেললাম। এই আলো বা ধোঁয়া আমাদের চেনাজানা দুনিয়ার কিছু নয়। তাই ফ্লেম-থ্রোয়ার দিয়ে এর কিসসু করা যাবে না। বরং তার মধ্যে বন্দি আমার কাকাই পুড়ে খাক হবেন ওতে। তাই আমার কাছে থাকা অন্য অস্ত্রটি প্রয়োগ করতেই হচ্ছে।
প্রায় লাফিয়ে আমি যন্ত্রটার কাছে গেলাম। ক্রুকস টিউবগুলো নীলচে আলো আর একরাশ ফুলকি ছড়িয়ে ঝলসে উঠল। কিছুক্ষণের জন্য মনে হল, হলুদ আলোর দীপ্তি কমে আসছে। কিন্তু বুঝতে পারলাম ওটা স্রেফ চোখের ভুল। আদতে ওই যন্ত্রটা, আর তার থেকে হাওয়ায় ছড়িয়ে-পড়া কম্পন জিনিসটার ওপর কিছুমাত্র প্রভাব ফেলতে পারছে না।
এরই মধ্যে আমি এমন একটা দৃশ্য দেখলাম, যার জন্য আমি তৈরি ছিলাম না। দেখলাম, কাকা মাটিতে পড়ে গেছেন। কিন্তু কাকার শরীরটা জমাট না থেকে যেন গলে গলে যাচ্ছে। মুহূর্তের জন্য সেটা জমাট বাঁধছে, আবার পরক্ষণেই শরীরটা ভেঙে থলথলে জেলি হয়ে যাচ্ছে! আমি ওই অদ্ভুত পিণ্ডের মধ্যে বহু নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধের আনাগোনা দেখলাম। মনে হল, কাকার শরীরটা যেন একটা প্রকাণ্ড শবাগারের মতো হয়ে গেছে, যেখানে মৃতেরা দলে দলে ঢুকছে, হয়তো তারপর অন্য কোথাও যাবে বলে! এক সেকেন্ডের জন্য হয়তো আমার কাকার শরীরটাও আমি তার মধ্যে মোচড়াতে দেখলাম। মনে হল, তিনি যেন ওই অবস্থাতেও আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লেন। তারপর ডক্টর এলিহু হুইপল হারিয়ে গেলেন ওই আলো আর গন্ধের মধ্যে।
এই দৃশ্যটা সহ্য করা আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল। আমিও কি কাকার উদ্দেশে বিদায় জানিয়েছিলাম? কী জানি! এটুকু মনে আছে যে, দরজা খুলে আমি কোনওক্রমে টলতে টলতে বেরিয়ে এসেছিলাম বাইরে, রাস্তায়, বৃষ্টির মধ্যে। তারপর কী করেছিলাম, কোথায় গিয়েছিলাম– এগুলো সব ঝাপসা। যদূর মনে পড়ে, আমি লক্ষ্যহীনভাবে হেঁটেছিলাম। কলেজ হিলের দক্ষিণ দিয়ে, এথেনিয়ামের পাশে, হপকিনস স্ট্রিট ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমি অবশেষে ব্রিজ পেরিয়ে পৌঁছেছিলাম শহরের প্রাণকেন্দ্রে। ভোরের ভেজা আলোয় দাঁড়িয়ে ছিল বড় বড় বাড়ি। ওদের দেখে মনে হল, অতীতের অন্ধকার থেকে উঠে-আসা ওই হলদেটে কুয়াশাই শেষ কথা নয়। বরং সমকালেরও একটা জোরালো উপস্থিতি আছে আমার চারপাশে।
ওই ধাক্কাটা দরকার ছিল। আমি ফিরে গেলাম বেনিফিট স্ট্রিটের ওই ঠিকানায়। দরজাটা তখনও খোলা ছিল। ভেতরে ঢুকে মেঝেতে অজস্র ছোট ছোট ফুটো ছাড়া আর কিছু দেখতে পেলাম না। হতবুদ্ধির মতো আমি ঘরের সব কিছু দেখলাম। যন্ত্রপাতিগুলো, ফাঁকা খাটটা, উলটে-পড়া চেয়ার দুটো, কাকার মাথার টুপিটা– এগুলো সবই আমার চোখে ধরা পড়ল। কিন্তু কাকা বা ওই ভয়ংকর হলদেটে কুয়াশার কোনও চিহ্ন আমি খুঁজে পেলাম না। একবার মনে হল, সবটাই আমার স্বপ্ন ছিল না তো? কিন্তু কাকার টুপিটাই আমাকে মনে করিয়ে দিল, গত রাতের অভিজ্ঞতাটা স্বপ্ন ছিল না।
কী ছিল ওই জিনিসটা?
পুরোনো রেকর্ড থেকে পড়া একটা কথা মনে পড়ল। এক্সেটারের বাসিন্দা কিছু বুড়োবুড়ির বয়ান রেকর্ড করেছিলেন কাকা। তাদের বক্তব্য ছিল, কিছু খুব পুরোনো চার্চের লাগোয়া কবরখানার ওপর এক ধরনের কুয়াশা বা ধোঁয়া জমে মাঝেমধ্যে। তারা প্রাকৃতিক হয় না। বরং মানুষকে শুষে, নিংড়ে নেওয়ার জন্যই তাদের জন্ম হয়। সেই কথাগুলোর সঙ্গে আমি মেলালাম ফায়ারপ্লেসের পাশে তৈরি-হওয়া সেই অদ্ভুত চেহারার ছত্রাকটাকে।
মনে হল, পালটা মার দেওয়ার একটা উপায় আমি খুঁজে পেয়েছি।
বাড়ি গেলাম। স্নান সারলাম। ফোনে কয়েকটা জিনিসের অর্ডার দিয়ে বললাম, পরদিন সকালে যেন সেগুলো বেনিফিট স্ট্রিটের ওই দরজার সামনে পৌঁছে দেওয়া হয়। তারপর বিশ্রাম আর বই-পড়াতেই দিনটা কাটল। আমি জানতাম, খুব বড় কাজ করতে হবে পরদিন ওই জিনিসগুলো দিয়ে।
কী জিনিস?
শাবল আর বেলচা। মিলিটারি গ্যাস-মাস্ক। ছ-টা বড় কন্টেনারে ভরতি সালফিউরিক অ্যাসিড!
পরদিন সকাল এগারোটায় আমি খুঁড়তে শুরু করলাম। ভাগ্য ভালো বলতে হবে, কারণ ঘরের ভেতরটা যেমনই হোক না কেন, বাইরেটা রোদে ঝলমল করছিল। আমি একাই যা করার করছিলাম। হ্যারিসকে আমি কিছু বলিনি। ভয় ছিল, যদি ও আমাকে খোঁড়াখুঁড়ি না করতে দেয়! অনেক পরে আমি ওকে ব্যাপারটা খুলে বলেছিলাম, কারণ না বলে উপায় ছিল না।
আমার লক্ষ্য ছিল ফায়ারপ্লেসের পাশের অংশটা। ওখানকার কালচে, দুর্গন্ধযুক্ত মাটিটা খুঁড়তে খুঁড়তে একটা অদ্ভুত জিনিস দেখলাম। যেখানেই আমার শাবলের ঘায়ে সাদা ছত্রাকগুলো ভেঙে যাচ্ছিল, সেখানেই বেরিয়ে আসছিল একটা দুর্গন্ধযুক্ত হলদে পুঁজের মতো তরল! আরও খুঁড়লে কী বেরোতে পারে ভেবে আমার হাত কাঁপছিল। মনে হচ্ছিল, কিছু জিনিস মাটির গভীরে, অন্ধকারে থেকে যাওয়াই হয়তো ভালো। তবু আমি থামিনি।
গর্তটা গম্ভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে চলছিল দুর্গন্ধ। বেশ কিছুটা নীচে পৌঁছোনোর পর হঠাৎ খেয়াল হল, এতটা নীচ থেকেই যে জিনিস এমন মারাত্মক খেল দেখাতে পারে, একেবারে সামনে থেকে সেটা কতটা বিপজ্জনক আর বড় হবে! মুহূর্তের জন্য দারুণ ভয় আমাকে অসাড় করে দিল। কিন্তু সাহস আর একটা মরিয়া ভাব আমাকে মাথা ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করল। আমি লাফিয়ে গর্তটা থেকে উঠে এলাম। চারদিকে ছড়িয়ে-থাকা মাটির স্তূপটা গর্তের দু-পাশে এমনভাবে সরিয়ে রাখলাম, যাতে দরকার পড়লেই তা-ই দিয়ে গর্তের মুখটা বুজিয়ে দেওয়া যায়। অ্যাসিডের কন্টেনারগুলো হাতের নাগালে সাজিয়ে রাখলাম। ক্রমবর্ধমান গন্ধের সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য গ্যাস-মাস্ক পরলাম। তারপর আবার খুঁড়তে শুরু করলাম।
তখন আমি প্রায় ছ-ফুট নীচে নেমে এসেছি। গর্তের কিনারা আমার গলার কাছাকাছি রয়েছে। হঠাৎ আমার শাবল মাটির বদলে একটা নরম কিছুতে আঘাত করল! ভয়ে আমার প্রায় দম আটকে গেল। মনে হল, এত দিন ধরে এতগুলো মানুষকে গ্রাস করেছে। যে জিনিস, এখনই যদি সে আমাকেও…! তবু আমি পালাইনি। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর বুঝলাম, সাহস ফিরে আসছে। ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় নীচটা দেখতে দেখতে আমি শাবল চালাচ্ছিলাম। অবশেষে তাকে পেলাম।
যা দেখলাম, সেটার অন্তত ওই অংশটুকু মাছের মতো আঁশওয়ালা চেহারার। আবার কাচের মতো একটা তেলতেলে ভাবও আছে তাতে। মনে হচ্ছিল, যেন জেলির মতো একটা কিছু ভাঁজ হয়ে রয়েছে ওখানে। সেই ভাঁজ বরাবর জমে গেছে তার শরীর থেকে বেরোনো রস। অনেকটা জায়গা ফাঁকা করে মনে হচ্ছিল, একটা সিলিন্ডারের মতো চেহারার জিনিসটা। প্রায় দু-মিটার ব্যাসের ওই বস্তুর অত কাছে দাঁড়িয়ে আমার স্নায়ু প্রায় ছিঁড়ে পড়ছিল ভয়ে। তবে আমি পাগলামো করিনি। বরং ঠান্ডা মাথায় গর্তটা থেকে উঠে এসেছিলাম। তারপর অ্যাসিডের পাত্রগুলো একে একে খালি করতে শুরু করেছিলাম গর্তের মধ্যে।
গর্ত থেকে উঠে-আসা হলদেটে-সবুজ রঙের আর বীভৎসতম গন্ধের সেই কুয়াশাকে আমি কোনও দিন ভুলতে পারব না। অ্যাসিডের প্রবাহের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল সেই গন্ধের দাপট। লোকে এখনও হলদে দিন-এর কথা বলে, যে দিন নাকি প্রভিডেন্স নদীতে কারখানার আবর্জনা পড়ে গন্ধ আর ধোঁয়ায় এলাকা ভরিয়ে রেখেছিল বহু দূর অবধি। তারা কারখানার বেশ কিছু যন্ত্র বিগড়ে যাওয়ার ফলে তৈরি-হওয়া বিকট গর্জনের কথাও বলে।
সত্যিটা শুধু আমি জানি।
ছ-নম্বর কন্টেনারটা খালি করার পর আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। ওই পূতিগন্ধ আর অ্যাসিডের ঝাঁজ মাস্ক পেরিয়ে আমার নাগাল পেয়ে গিয়েছিল প্রায়। তবে জ্ঞান ফিরে আসার পর বুঝেছিলাম, নতুন করে আর কিছু উঠে আসছে না গর্ত থেকে। তারপর আমি মাটি ফেলে গর্তটা ভরাট করা শুরু করি। প্রায় সন্ধে নাগাদ আমার লড়াই শেষ হয়। হ্যাঁ, মাটিতে তখনও ভিজে ভাব ছিল। দেওয়ালে তখনও নোনা আর ছাতার দাগ ছিল। কিন্তু বেশ বুঝতে পারছিলাম, যে জিনিসটা ওই জায়গাটা বিষিয়ে রেখেছিল, তা আর নেই। যে নরক থেকে ওটা এসেছিল, হয়তো সেখানেই তাকে ফেরাতে পেরেছি আমি।
মেঝেটা সমান করার সময় আমি অবশেষে কাঁদতে পারলাম। আমার কাকার জন্য, এই বাড়ির বাসিন্দা হয়ে যত মানুষ ওই অশুভ জিনিসটির শিকার হয়েছিল, তাদের জন্য, হয়তো নিজের জন্যও… কারণ আর কখনও আমি পৃথিবীকে সহজ চোখে দেখতে পারব বলে মনে হয় না।
পরের বসন্তে আর ছত্রাক বা সাদা ঘাস নয়, বরং স্বাভাবিক ঘাস মাথা তুলল বাড়ির পেছনের জমিটায়। বাগানের বন্ধ্যা গাছগুলোয় ফুল ফুটল, পাখিরা বাসা বাঁধল, ফলও হল। ক্যারিংটন হ্যারিস বাড়িটা ভাড়াও দিতে পারলেন।
ডক্টর এলিহু হুইপল সারাজীবন কুসংস্কারের কথা উঠলেই নাক কুঁচকে বলতেন, সব ঝুট হ্যায়! বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে সে দিন মনে হল, তাঁর কথার সূত্র ধরে আমি অন্তত ওই অশুভ জিনিসটাকে এই বাড়ি থেকে দূর করতে পেরেছি। বলতে পেরেছি, তফাত যাও!
[প্রথম প্রকাশ: গল্পটি উইয়ার্ড টেলস ম্যাগাজিনের অক্টোবর ১৯৩৭ সালের সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। ভাষান্তর : ঋজু গাঙ্গুলী]