শবঘর

শবঘর (IN THE VAULT)

 [এই গল্পের সূত্র লাভক্র্যাফটকে দেন ট্রাই আউট পত্রিকার সম্পাদক চার্লস ডব্লিউ স্মিথ। ১৯২৫ সালে উইয়ার্ড টেলস পত্রিকা গল্পটি বাতিল করে দেয় গল্পে প্রচণ্ড হিংস্রতা থাকা অভিযোগে। ট্রাই আউট গল্পটি প্রকাশ করলেও ঘোস্ট স্টোরিজ নামের এক পাল্প পত্রিকায় গল্পটি পরে জমা দেন লাভক্র্যাফট। সেখানেও গল্পটি অমনোনীত হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৩২ সালে গল্পটি ছাপে উইয়ার্ড টেলস।]

এরকম অবাস্তব আর কিছু কখনও শুনিনি। সাধারণ একজন মানুষের মনস্তত্ত্বে এরকম অদ্ভুত কিছু একটা বাসা বেঁধেছে তা ভাবাও যায় না। আমেরিকান গ্রাম্য পরিবেশ, একটা ষণ্ডামার্কা কবরখানার কর্মচারী আর অনবধানবশত ঘটে-যাওয়া একটা দুর্ঘটনা। যে-কোনও সাধারণ গল্প-বলিয়ে এর থেকে একটা স্থূল রকমের হাস্যরসের গল্প টেনে বার করতে পারত। কিন্তু জর্জ বার্ক যে কীভাবে… লোকটা নিজের জীবন দিয়ে যে পঙ্কিল অন্ধকারকে উপলব্ধি করেছে, তার কাছে আমাদের জীবনের কদর্যতম মুহূর্তগুলিকেও অত্যন্ত ফ্যাকাশে লাগে। আজ জর্জ বার্কের মৃত্যু আমাকে জনসমক্ষে নিয়ে আসার সম্মতি দিয়েছে এই গল্পটা। এই দুনিয়ার এক চরমতম ভয়ংকর মনস্তাত্ত্বিক গল্প।

১৮৮১ সাল নাগাদ বার্ক যে কেন হঠাৎ নিজের আদি ব্যাবসা আর বাসস্থান পরিবর্তন করল তা কেউই জানত না। ব্যাপারটা নিয়ে সে কখনওই কারও সঙ্গে কথা বলেনি। জানতেন শুধু তার পুরোনো ফিজিশিয়ান ডক্টর ডেভিস। বেশ কিছু বছর আগেই ডক্টর ভদ্রলোক খবরটা সঙ্গে করে কবরে গেছেন। ডক্টর ডেভিসের মৃত্যুর পরে বার্কের কাউকে দরকার ছিল কথাগুলো বলার। তার বিয়েও হয়নি, দুই কূলে কোনও আত্মীয়স্বজনের চিহ্নও ছিল না। এমত অবস্থায় নিজের ডাক্তার ছাড়া আর কাকেই বা সে কথাগুলো জানাবে?

সাধারণ মানুষ জানত, ওই দুর্ভাগ্যবশত ঘটে-যাওয়া ঘটনাটাই বার্ককে মানসিকভাবে বিগড়ে দিয়েছিল। যতই শক্তপোক্ত মানুষ হোক, প্রায় নয় ঘণ্টার জন্যে পেক ভ্যালি সিমেট্রির শবঘরে বন্দি থাকা আর শেষ পর্যন্ত ওইরকম সর্বনাশা পদ্ধতিতে রাস্তা বানিয়ে বেরিয়ে আসা! নাহ্ গল্পটা যে-কোনও সাধারণ মানুষের আঁতকে ওঠার জন্যেই যথেষ্ট। কিন্তু ওই সত্য গল্পের পেছনে ছিল আরও কিছু ভয়ংকর সত্য, যা মানুষটা মদের ঘোরে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমার কানের কাছে ফিশফিশ করে বলে গেছে।

১৮৮১-র আগে জর্জ বার্ক পেক ভ্যালি গ্রামের কবরখানার কর্মচারী ছিল। বার্ককে যে শুধুই অপেশাদার বলা যায় তা-ই নয়, সে নিজের কাজেও যথেষ্ট অমনোযোগী ছিল। শবাগারের মধ্যে যে কাজ সে করেছিল তা আজকের দিনে অকল্পনীয়, অন্তত শহরের বুকে। পেক ভ্যালির লোকজনও যদি ওটা শুনত, তাহলে তারা ভয়ে শিউরেই উঠত, যে তাদের শবাধার শিল্পীর নীতিবোধ কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঠিক বন্ধ কফিন বক্সের ভেতরের কাপড়ের মতোই দৃষ্টির অগোচর ছিল। মৃতদেহের প্রতি লোকটার ভদ্রতাবোধ কখনও কখনও সঠিক তুল্যমূল্য বিচার করে চলত না। খুব ঠিকঠাকভাবে বলতে গেলে গন্ডারের চামড়াওয়ালা বার্ক ছিল আদতে স্থূলরুচিসম্পন্ন আর অপেশাদার, তবুও আমি বার্ককে খুব শয়তান মানুষ হিসাবে ভাবতে পারিনি। সে খানিকটা মোটা মাথার মানুষ ছিল– অনুভূতিশূন্য, অসাবধান এবং মাতাল। তার অ্যাক্সিডেন্টটাই এটা প্রমাণ করে দেয়। ওই অ্যাক্সিডেন্টটা সে অতি সহজেই এড়াতে পারত। আসলে তার মধ্যে সাধারণ মানুষের রুচি, নীতিবোধ, এমনকী কল্পনাশক্তির বিন্দুমাত্রও ছিল না।

পারদর্শী গল্প-বলিয়ে হলে এসব উলটোপালটা না বলে, বার্কের গল্পটা আমি বেশ জমিয়েই শুরু করতে পারতুম। গল্পটা শুরু হয়েছিল ১৮৮০ সালের সেই শীতল ডিসেম্বর মাস থেকে। সেইবার এতই ঠান্ডা পড়েছিল যে, পেক ভ্যালি গ্রামের মাটিও জমাট বেঁধে গিয়েছিল শক্ত বরফের মতোই। কবরখানার খোদাইকর্মীরা বুঝতে পারছিল, তারা বসন্ত না-আসা পর্যন্ত আর কবর দেওয়ার জন্যে মাটি কাটতে পারবে না। ভাগ্যক্রমে গ্রামটা ছিল ছোট। মৃত্যুহারও আনুপাতিকভাবে কমই ছিল। বার্কের দায়িত্বে থাকা প্রাণহীন পদার্থগুলিকে একটা ক্ষণস্থায়ী স্বর্গলাভের ব্যবস্থার জন্য, পাহাড়ের গায়ে একটা গুহাকে শবঘর বিবেচনা করে, তার মধ্যে তাদেরকে রাখার ব্যবস্থা করা হল।

শবঘরের একমাত্র কর্মী বার্ক এই নিদারুণ ঠান্ডা আবহাওয়ায় দ্বিগুণ জবুথবু হয়ে গিয়েছিল। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল যে, অলসতায় সে নিজেই নিজেকে টেক্কা দেবে। শবঘরের মধ্যে হাঁটতে গেলেই সে কফিনগুলোয় অনবরত ঠোকা খাচ্ছিল। কোনওরকম সাবধানতা ছাড়াই শবঘরের দরজার পাল্লা দুটোকে দুমদাম করে বন্ধ করছিল।

অবশেষে বরফ-গলানো বসন্ত এল। অনেক পরিশ্রমে নয়খানা কবর খোঁড়া হল কবরখানায়, বহুপ্রতীক্ষিত নয়জন স্বর্গলোভীর কবর, যারা শবঘরের মধ্যে অপেক্ষা করছিল, তাদের যাত্রা শুরুর জন্যে। এক দুর্যোগপূর্ণ এপ্রিলের সকালে বার্ক জড়তা কাটিয়ে উঠে কাজ শুরু করল বটে, কিন্তু ঘোড়াটার ত্যাঁদড়ামির চোটে মোটে একটামাত্র কফিনই কবর দিতে পারল। নব্বই বছরের বুড়ো দারিয়াস পেকের কফিনটা।

বার্ক অবশ্য ভেবেছিল, পরের দিনই ম্যাথু ফেনারকে কবর দিয়ে দেবে। কিন্তু আলসেমি আর ভাগ্য দুইয়ে মিলে বার্ক তিন দিনের আগে কাজে হাতই দিতে পারল না। ১৫ তারিখ গুড ফ্রাইডের দিন সে ঘোড়ার গাড়িটা নিয়ে খুটখুট করে পাহাড়ে উঠল, শবঘরের উদ্দেশে। মাথু ফেনারের কফিনটাকে কবর দিয়ে দেওয়াই যাক। গুড ফ্রাইডের দিন কাজ করা উচিত নয়। কুসংস্কারে আচ্ছন্ন না হয়ে সে ফেলে-রাখা কাজটা চুকিয়ে দিতে গেল। অবশ্যই সেই দিনের সন্ধের ঘটনাই জর্জ বার্কের জীবনটাকে পরিবর্তন করে দিয়েছিল।

১৫ এপ্রিল, শুক্রবার বিকেলে সে সামান্য মদও খেয়েছিল। পরে সে এটা স্বীকার করেছিল। যদিও এখনকার মতো সব ভুলে যাওয়ার মতো পাঁড়মাতাল সে তখন হত না, সে কথাও বলেছিল। সে দিন তার উদোমাদাভাবে গাড়ি চালানোটাই ঘোড়াটাকে যথেষ্ট বিরক্ত করে তুলছিল। বেশ কয়েকবার চিঁহি ডাক ছেড়ে, খুর ঠুকে, কেশর নাচিয়ে বিরক্তির চরম সীমায় গিয়ে ঘোড়াটা কোনওমতে গাড়িটাকে টেনে টেনে পাহাড়ের কাছে নিয়ে এসেছিল। অবশ্য আগের দিনের মতো সেই দিন বৃষ্টি হচ্ছিল না, বিকেলটা বেশ পরিষ্কারই ছিল। কিন্তু পাহাড়ের কাছে আসতেই একঝলক ঝোড়ো হাওয়া টিলাটাকে ঘিরে দাপিয়ে উঠল।

বার্ক বেশ খুশি হল যে, ঝড়বৃষ্টি আসার আগেই সে শবঘরের ছাদের তলায় ঢুকে যেতে পারবে। অন্য কেউ হলে হয়তো ওই ড্যাম্প-ধরা, দুর্গন্ধযুক্ত চেম্বারের মধ্যে আশ্রয়ের লোভে ঢোকার কথা স্বপ্নেও ভাবত না। অন্তত যেখানে আটখানা কফিন এদিক-ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। কিন্তু সেই সময় বার্ক এতটাই সংবেদনহীন ছিল যে, ওইসব পারিপার্শ্বিক অবস্থায় তার কিছু যেত-আসত না। সে শুধু চিন্তিত ছিল সঠিক কফিনটাকে সঠিক কবরে ঢোকানো নিয়ে। আগের বার ঘটিয়ে-ফেলা কাণ্ডটা সে একদমই ভোলেনি। কী কেলেঙ্কারি! সেইবার যখন হানাহ্ বিক্সবির আত্মীয়রা চেয়েছিল তাঁর দেহটাকে অন্য এক শহরে নিয়ে যেতে, যেহেতু তারাও এই জায়গা ছেড়ে চলে যাচ্ছে। কিন্তু কবর খুঁড়ে হানাহ্ বিক্সবির হেডস্টোনের তলায় পাওয়া গিয়েছিল জাজ ক্যাম্পয়েলের কফিন বক্স। খুব গোলমাল আর সমালোচনার ঝড় উঠেছিল সেইবার তাকে ঘিরে। আর যা-ই হোক-না কেন, ওইরকম ভুল যেন আর না হয়। বার্ক দরজাটা খুলে শবঘরের মধ্যে ঢুকল।

আলোটা টিমটিম করে জ্বলছিল। তাতে অবশ্য বার্কের দেখতে কোনও অসুবিধা হচ্ছিল না। সে আসাফ সইয়ারের কফিনটা টানেনি। যদিও সেটা প্রায় একই রকমের দেখতে ছিল। তার স্পষ্ট মনে আছে, ওই কফিনটা সে ম্যাথু ফেনারের জন্যেই বানিয়েছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সরিয়ে রেখেছিল ওই বিশ্রী ঠুনকো কাঠের তৈরি কফিনটাকে। এই ব্যাপারটার পেছনে অবশ্যই তার প্রায় হারিয়ে-যাওয়া অনুভূতিটুকু কাজ করেছিল। পাঁচ বছর আগে যে ব্যাঙ্কে সে সমস্ত টাকা গচ্ছিত রাখত, ওটার গণেশ ওলটানোর সময় ওই বৃদ্ধ তাকে কতটা সাহায্য করেছিল। বৃদ্ধ ম্যাথু ফেনারের কফিনটা যতটা যত্ন সহকারে বানানো সম্ভব, সে বানিয়েছিল। আর পরক্ষণেই সমস্ত অনুভূতি শিকেয় তুলে, হিসেবি মানুষের মতোই সরিয়ে-রাখা ওঁচা কফিনটাতে মৃত আসাফ সইয়ারকে ঢুকিয়ে দিয়েছিল বার্ক।

ম্যালিগন্যান্ট জ্বরে মৃত সইয়ার মোটেও ভালো মানুষ ছিল না। ব্যক্তিগত প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রে লোকটার অনমনীয় স্মৃতিশক্তি এবং অমানুষিক প্রতিহিংসাপরায়ণতা, তাকে ঘিরে প্রচুর গল্প তৈরি করেছিল। অবশ্যই তার প্রতি বার্কের কোনওরকম ভাবালুতা ছিল না। এমনকী একটা ফেলে-রাখা, মাপ নিয়ে তৈরি না-করা কফিনে সইয়ারের মৃতদেহকে ঢুকিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রেও বার্কের কোনওরকম অনুশোচনা ছিল না।

যেইমাত্র সে ম্যাটের কফিনটা চিহ্নিত করেছে, অমনি জোর হাওয়ায় শবঘরের দরজাটা ধড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল। ভেতরটা আগের থেকেও বেশি অন্ধকার হয়ে গেল। কয়েক মুহূর্ত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বার্ক হাতড়ে হাতড়ে দরজার দিকে এগোতে লাগল। দরজার ওপরে শিক-লাগানো হাওয়া চলাচলের অংশটা দিয়ে ক্ষীণ আলোর রেখা আসছিল।

সেই শবতুল্য পাংশু গোধূলির আলোতে বার্ক দরজার জং-ধরা হুড়কোটা ধরে ঘড়ঘড় শব্দ করে টানাটানি করতে লাগল। ধাক্কা দিতে লাগল লোহার পাল্লায়। সে অবাক হয়ে ভাবতে থাকল, এই বিশাল দরজাটার এমন কী হল, যে ব্যাটা এত অবাধ্য হয়ে উঠেছে?

কিছুক্ষণের মধ্যেই গোধূলির ম্লান আলোতে সে অনুভব করতে শুরু করল সত্যটা। এইবার বার্ক গলা ছেড়ে চিৎকার করতে শুরু করল। অবশ্য ওই জনহীন প্রান্তরে গুড ফ্রাইডের বিকেলবেলা মানুষের আসার সম্ভাবনা এতই কম; বার্কের মনে হচ্ছিল, সে যেন এই আশায় চিৎকার করছে যে, বাইরে থেকে তার ঘোড়াটা যেন সহানুভূতিহীন হেষাধ্বনি করা ছাড়া আরও কিছু করতে পারে। অবশ্যই শবঘরের প্রতি দীর্ঘ অবহেলায় দরজার হুড়কোটা ভেঙে গিয়েছিল। এই উদাসীন কর্মচারীটি নিজেই নিজের ভুলে শিকার হয়ে আটকে পড়ল শবঘরের মধ্যে।

ঘটনাটি ঘটেছে বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ। বার্ক তার বাস্তববাদী স্বভাবের জন্য বেশিক্ষণ চিৎকার করল না। সে অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে শবঘরের মধ্যে যেখানে কফিন বানানোর যন্ত্রপাতি রাখা ছিল, সেগুলো খুঁজতে শুরু করল। এই ভয়ংকর অবস্থাটার আতঙ্ক এখনও তাকে ছুঁতে পারেনি। কিন্তু গুড ফ্রাইডের দিনে জনমানুষহীন এই প্রান্তরে শবঘরের মধ্যে আটকা পড়ার সত্যটা তাকে ক্রমশই রাগিয়ে তুলছিল। একে তো তার সেই দিনের কাজেরও বারোটা বেজে গেল। এখন হয়তো তাকে সারারাত অথবা কালকের দিনটাও এইখানে বন্দি থাকতে হবে! যতক্ষণ না ভাগ্য সদয় হয়ে কাউকে নিয়ে আসে এই রাস্তায়।

যন্ত্রপাতিগুলো খুঁজে পেতেই বার্ক কাজে লেগে গেল। একটা ছেনি আর হাতুড়ি নিয়ে সে আবার কফিনগুলোর মধ্যে দিয়ে দরজার দিকে ফিরে এল। ইতিমধ্যে বদ্ধ ঘরের বাতাস ক্রমে দুর্গন্ধে ভ্যাপসা হতে শুরু করেছে। কিন্তু মরচে ধরে ক্ষয়ে-যাওয়া ভারী হুড়কোটার সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে, অন্যান্য ব্যাপার নিয়ে সে মাথাই ঘামাল না। অবশ্যই কাজটা আরও ভালোভাবে করা যেত, যদি একটা লণ্ঠন বা মোমবাতি থাকত। কিন্তু অন্ধকারের মধ্যে প্রায় অন্ধভাবেই সে কোনওরকমে হুড়কোটাকে ঢিলে করার চেষ্টা করতে লাগল।

যতক্ষণে বার্ক বুঝতে পারল, এই অন্ধকার অবস্থায় এই সামান্য যন্ত্রপাতি দিয়ে এই হুড়কোটাকে কোনওভাবেই নড়ানো সম্ভব নয়, ততক্ষণে অন্ধকার জমিয়ে নেমে এসেছে।

এবার বার্ক মুক্তির অন্য সম্ভাবনাগুলোর কথা ভাবতে লাগল।

এই শবঘর একটা পাহাড়ের প্রান্তদেশ খনন করে তৈরি করা হয়েছিল। বায়ুচলাচলের চিমনিটা পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে বেশ কয়েক ফুট খাড়া উঠে গিয়ে তবে বাইরে বেরিয়েছে। ওই চিমনি বেয়ে ওঠা কোনওমতেই সম্ভব নয়। দরজার ওপরে, অনেকটা উঁচুতে ইটে গাঁথা সরু সরু জানলা, যেটা বার্কের পক্ষে ভেঙে বড় করা সম্ভব।

জানালাটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বার্ক মাথা চুলকে টাক করে ফেলল। কীভাবে অত উঁচুতে পৌঁছোনা যায়? শবঘরের মধ্যে কোনওরকম মইয়ের মতো কিছু ছিল না। কফিনগুলো যত্ন করে ঘরের দু-পাশে এবং পেছনদিকে মেঝের ওপরে রাখা ছিল, যেখান থেকে ওগুলোকে টেনে বার করতে বার্কের বেশ অসুবিধা হত।

এবার জানালাটা ছেড়ে বার্ক ঘরের কফিনগুলোর প্রতি মনোযোগ দিল। একমাত্র এগুলোকে দিয়েই সিঁড়ি বানানো সম্ভব। বার্ক হিসাব কষে দেখল, তিনটে কফিন উপর্যুপরি সাজালেই সে পৌঁছোতে পারবে জানালার কাছে। কিন্তু সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে তাকে ওই জানালাটা কাটতে হবে। কাজটা ভালোভাবে করার জন্যে উপর্যুপরি চারটে কফিন সাজালে ব্যাপারটা সিঁড়ি হিসাবে আরও সন্তোষজনক হয়। বাক্সগুলো উচ্চতায় প্রায় সমান। এদেরকে ইটের মতো পাকারে সাজানো সম্ভব। এবার বার্ক খুব গভীরভাবে হিসাব করতে শুরু করল, কীভাবে আটটা মাত্র কফিন দিয়ে চারটে দৃঢ় স্তর তৈরি করা সম্ভব। ছক কষার সময় তার মনের মধ্যে একটু ভয়-ভয় করছিল, অবশ্য সেটা কফিন বক্সে ব্যবহৃত কাঠের দৃঢ়তা নিয়ে। স্বর্গের সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় পায়ের তলার বক্সগুলো খালি কি ভরতি, সেটা তার কল্পনাতেও আসেনি।

অবশেষে হিসাব ছকা হয়ে গেল। তিনটে বাক্সকে দেওয়ালের সমান্তরালে ভিত্তি হিসাবে সাজাবে, তার ওপরে দুটো স্তরে দুটো-দুটো করে বাক্স রাখবে, একদম শেষে সবার ওপরে একটি বাক্সকে প্ল্যাটফর্ম হিসাবে রাখবে। ওপরে ওঠার এই বন্দোবস্তটাই সব থেকে কম ঝামেলার। এতেই দিব্যি সঠিক উচ্চতা ওঠা যাবে। যদিও বার্ক ভাবছিল, এই সুপার স্ট্রাকচারটার তলায় যদি তিনটের বদলে দুটো বাক্স রাখা যায় তাহলে তার হাতে আরও একটা বাক্স বাড়তি থাকে। আসলে পালাবার জন্যে যদি আরও বেশি উচ্চতার দরকার হয়, তাহলে সে সেটাকে ব্যবহার করতে পারবে।

যা-ই হোক, এবার আমাদের বন্দি প্রায় মিলিয়ে আসা গোধূলি আলোতেই পরিশ্রম করে চলল। নিঃসাড় মৃতদের অবশিষ্টাংশের বাসস্থানগুলোকে সরানোর সময় সে ঘন ঘন কুশ এঁকে নিচ্ছিল বুকের মধ্যে। নাড়াচাড়া করার সময় কিছু কফিন খুলে যেতে শুরু করল। যাতে ওপরে ওঠার সময় পায়ের তলার বাক্সটা ভেঙে না যায়, তাই সে ঠিক করল, বেঁটেখাটো ম্যাথু ফেনারের শক্তপোক্ত আধারটিকে সে একদম ওপরেই রাখবে। এই আলো-আঁধারির মধ্যে সে কফিনগুলো স্পর্শ করে করে সঠিক কফিনটা বোঝার চেষ্টা করছিল। তৃতীয় স্তরে সে যখন বোকার মতোই নির্বাচিত একটা কফিনকে রাখছিল, তখন হঠাৎ অসতর্কভাবেই কফিনটা উলটে পড়ে যায়। কোনওমতে কফিনগুলোকে একের পর এক সাজিয়ে একসময় বার্ক ঠিক তার টাওয়ার অব ব্যাবেল তৈরি করে নিল।

অবশেষে টাওয়ার তৈরি শেষ হল। ব্যথা-হয়ে-যাওয়া হাত দুটোকে বিশ্রাম দেওয়ার জন্যে বার্ক এবার থামল। সিঁড়ির প্রথম ধাপে এসে বসল। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বার্ক আবার তার যন্ত্রপাতি দুটো হাতে নিয়ে ধাপগুলো চড়ে দরজার ওপরের ছোট জানালার সামনে এসে দাঁড়াল। ছোট জানালাটার চারপাশ ইটে গাঁথা। জানালাটা ছেনি দিয়ে ভেঙে ওই ফোকর গলে বের হওয়াটা খুব একটা সহজ হবে না বলেই মনে হচ্ছিল। দমাদম হাতুড়ির বাড়ি শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাইরে ঘোড়াটা উচ্চকিত স্বরে ডাকতে শুরু করল। হেষাধ্বনি উৎসাহপ্রদানকারী নাকি ব্যঙ্গাত্মক, বার্ক ঠাওর করতে পারল না। অবশ্য দুটোই উপযুক্ত ছিল তৎকালীন অবস্থায়। ওই আপাত সহজ ইটের গাঁথনিটার অবিশ্বাস্য দৃঢ়তা  জীবিত মানুষটার আশার ওপরে হাতুড়ির ঘায়ের মতোই দমাদম আঘাত হানছিল।

সন্ধ্যা নেমে এল। বার্ক তখনও লড়ে যাচ্ছে জানালার সঙ্গে। আকাশে সদ্য গজানো মেঘের দল চাঁদটাকে ঢেকে দেওয়ার পরে অন্ধের মতোই বার্ক কাজ করে যাচ্ছিল। সাফল্যের গতি অবশ্য খুবই ধীর ছিল। অবশেষে জানালাটার ওপরে আর নীচের খানিক অংশকে ইটমুক্ত করতে পেরে যারপরনাই আনন্দিত হল বার্ক। সে মোটামুটিভাবে নিশ্চিত ছিল, যে মধ্যরাত্রির আগেই ছাড়া পেয়ে যাবে। অবশ্য এই চিন্তাটা সে সুস্থভাবেই করছিল। এই অতিপ্রাকৃত পরিবেশের আতঙ্ক তখনও তার হৃদয়কে গ্রাস করতে পারেনি। ওই বিশ্রী ভূতুড়ে স্থান, অলৌকিক সময়, এমনকী তার পায়ের নীচে থাকা পরপারে বন্ধুদের ঘরবাড়ি কোনওটাই তাকে ছুঁতে পারছিল না। সে প্রায় দার্শনিক উদাসীনতায় পাথুরে ইটগুলোকে ভেঙে ফেলছিল। গালাগালি দিচ্ছিল, যখন ইটের টুকরো ছিটকে এসে মুখে লাগছিল। আবার হেসে উঠছিল, যখন বাইরের উত্তেজিত ঘোড়াটাকে গিয়ে আঘাত করছিল ইটের টুকরোগুলো। ঘোড়াটা বাঁধা ছিল সাইপ্রাস গাছের তলায়। আস্তে আস্তে গর্তটা বড় হচ্ছে দেখে সে পায়ে চাপ দিয়ে নিজের শরীরটা ওর ভেতর দিয়ে গলানোর একটা প্রচেষ্টা করল। আর তক্ষুনি পায়ের তলার কফিনগুলো কড়কড় করে নড়ে উঠল। কিন্তু তার শরীরটা গর্ত অবধি পৌঁছোল না। সে বুঝতে পারল আরেকটা কফিনের উচ্চতা প্রয়োজন ওই গর্ত দিয়ে শরীর বার করতে গেলে।

তখন প্রায় মধ্যরাত্রি হবে, যখন বার্ক সিদ্ধান্ত নিল যে, সে এবার জানালা দিয়ে বেরোতে পারবে। অনেকবার বিশ্রাম নেওয়া সত্ত্বেও সে একেবারে ক্লান্ত হয়ে ঘেমে-নেয়ে উঠেছে। বাইরের খোলা প্রকৃতিতে বেরোনোর আগে সে একবার কফিনগুলো বেয়ে নীচে নেমে এল। একদম তলার কফিনের ওপরে বসে সে শেষ ঝাপটা দেওয়ার শক্তি অর্জন করছিল। বাইরে ক্ষুধার্ত ঘোড়ার ঘন ঘন হ্রেষাধ্বনিটা পরিবেশের গা-ছমছমে ভাবটা ক্রমে বাড়িয়ে তুলছিল। এতক্ষণে সে একবার অস্পষ্টভাবে প্রার্থনা করল, এই আওয়াজটা যেন থেমে যায়। তার আসন্ন মুক্তিতে খুব অদ্ভুতভাবেই সে একদমই গর্ব বোধ করছিল না। বরং, এই যৌবনের প্রান্তদেশে পৌঁছোনো অলস গেঁতো দেহটা এতখানি পরিশ্রমসাপেক্ষ কাজ করে ফেলেছে দেখে তার কেমন যেন একটু ভয়ই লাগছিল।

বার্ক আবার চড়তে শুরু করল। ক্লান্ত দেহের ওজনটা তার নিজের কাছেই খুব বেশি বলে মনে হচ্ছিল। এতক্ষণে একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের চাপে কফিনগুলো প্রায় ভেঙে পড়েছে। বিশেষ করে যখন সে একদম ওপরের কফিনটার ওপরে উঠল, সে স্পষ্ট শুনতে পেল, পায়ের তলার কফিনটা চড়চড় করে শব্দ তুলে ভাঙছে। সে অনেক ভেবেচিন্তেই সবার ওপরে সবচেয়ে শক্ত কফিনটা তুলেছিল। কিন্তু দেখে মনে হচ্ছিল, তার এতক্ষণ ধরে করা সমস্ত পরিকল্পনাই জলে যেতে বসেছে।

সহসা একদম ওপরের কফিনের পচা ঢাকনা ভেঙে তার সমস্ত শরীরটা দু-ফুট নীচে নেমে এল। বার্কের মতো মানুষও কল্পনা করতে পারল না, এখন তার পায়ের তলায় কী আছে, সেই সত্যটা। বিশ্রী পচা গন্ধ এক লহমায় বাইরের বাতাসকে দখল করে নিল। ওই গন্ধে নাকি কাঠ ভাঙার ভয়ংকর শব্দটাতেই ঘোড়াটা মারাত্মক লাফিয়ে উঠে দড়ি ছিঁড়ে ছুটে পালাল। এমন উন্মাদের মতো চিৎকার করছিল জন্তুটা, যাকে হ্রেষাধ্বনির বদলে আর্তনাদ বলাটাই ভালো। যেন খুরে খুরে পিষে ফেলতে চাইছিল বাইরের রাত্রিটাকে। এমনকী পেছনে বাঁধা ঠ্যালাগাড়িটাও ঝনঝন করে উঠল ওই দিগ্‌বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়োনোয়।

পায়ের তলার কফিনটা ভেঙে যাওয়ার ফলে এখন বার্ক গর্তটার ধার ধরে ঝুলছে। ওই ভয়ানক পরিস্থিতির মধ্যেই বার্ক মনের জোরে নিজের শক্তি একত্রিত করতে লাগল। কোনওরকমে গর্তের ধারটা দু-হাতে ধরে নিজেকে টেনে ওপরে তুলতে চাইল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অনুভব করল, গোড়ালি দুটো ধরে কে যেন তাকে তলার দিকে টানছে। সেই রাত্রিতেই সেই প্রথমবার তার বুকের ভেতরটা হিম হয়ে এল। সে ওঠার জন্য যত চেষ্টা করতে লাগল, তত তার পায়ের টান ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। কিছুতেই সেই অমানুষিক হাত দুটো থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারছিল না বার্ক। মারাত্মক ক্ষত তৈরি হওয়ার অসম্ভব যন্ত্রণা যেন দু-পায়ের গোছ থেকে বিদ্যুতের মতো উঠে এল। যতই সে নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করছিল যে, ওটা বাক্সের ভাঙা কাঠের টুকরো বা খুলে-আসা পেরেক, ততই তার মনের মধ্যে তৈরি-হওয়া সমস্ত যুক্তিবাদ আদতে মিশে যাচ্ছিল এক তীব্র ভয়ের ঘূর্ণিতে। এতক্ষণে সে চিৎকার করে উঠল। প্রায় পাগলের মতোই লাথি মারতে শুরু করল সে। ক্রমশ তার চেতনা ডুবে যাচ্ছিল অন্ধকারে।

অজ্ঞান হওয়ার আগেই বেঁচে থাকার সহজাত প্রবৃত্তিতে তার দেহ এক ঝাঁকুনিতে উঠে এল গর্তটার কাছে। পরক্ষণেই প্রায় অচেতনের মতোই গর্তের মধ্যে গলিয়ে দিল নিজের দেহ। সামান্য হামাগুড়ি দিতেই গর্তের অন্য পাশ দিয়ে ধপ করে বার্ক উলটে পড়ল ভেজা মাটির ওপরে। সে বুঝতে পারছিল যে, সে হাঁটতে পারছিল না। উদীয়মান চাঁদটা একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী ছিল সেই ভয়ংকর ঘটনার। সে কোনওমতে রক্তাক্ত পা টানতে টানতে এগিয়ে যেতে লাগল কবরস্থানের কাছের বাড়িটার দিকে। কোনওমতে কালো মাটি আঁকড়ে ধরে প্রায় অচৈতন্যের মতোই এগিয়ে যাচ্ছিল। ক্রমশ তার গতি কমে আসছে। শরীর আর সঙ্গ দিচ্ছে না। ঠিক যেমন রাত্রে অমানুষদের তাড়া খেলে ভয়ে দেহ অবশ হয়ে আসে। আসলে তার পেছনে কেউই দৌড়ে আসছিল না। একাকী হামাগুড়ি দিতে দিতে ভয়ে অর্ধমৃত অবস্থায় সে কোনওমতে পৌঁছোল বাড়িটায়। আর্মিংটন, বাড়ির মালিক তার দুর্বল আঁচড়ানির শব্দেই দরজা খুলে দিয়েছিল।

আর্মিংটন বার্ককে ধরাধরি করে বসার ঘরের অতিরিক্ত বিছানাটায় শুইয়ে দিল। তৎক্ষণাৎ তার ছোটছেলে এডউইনকে পাঠাল ডক্টর ডেভিসকে ডেকে আনার জন্য। আর্ত মানুষটি অবশ্য স্বজ্ঞানে ছিল, কিন্তু তার মুখ থেকে কোনওরকম শব্দ বেরোচ্ছিল না। সে শুধু অস্পষ্টভাবে বিড়বিড় করছিল, উফ। গোড়ালিটা… ছাড় আমাকে। হতচ্ছাড়া! পচে মর তুই নরকে।

অনতিবিলম্বেই ডাক্তার ওষুধের বাক্স নিয়ে এলেন। দু-চার কথাতে জেনে নিলেন, কী ঘটেছে। রোগীর ভিজে-যাওয়া জামাকাপড়, জুতো-মোজা ডাক্তার নিজের হাতেই খুলে নিলেন। দুই পায়ের গোড়ালির সামান্য ওপরে বীভৎস ক্ষতস্থান। পায়ের অ্যাকিলিস টেন্ডনটা (রগ) প্রায় ছিঁড়ে যাওয়ার মতো অবস্থায় পরিণত হয়েছে। আঘাতের বহর দেখে বৃদ্ধ ডাক্তারও হতভম্ব হয়ে গেলেন। তাঁকে সামান্য ভীতও দেখতে লাগছিল। ডাক্তারি শাস্ত্র ছেড়ে তাঁর প্রশ্নগুলো বিশ্রীভাবে অন্যদিকে বাঁক নিচ্ছিল। এমনকী তাঁর হাত পর্যন্ত কাঁপছিল, যখন তিনি পায়ের ক্ষতবিক্ষত অংশটা পরিষ্কার করছিলেন। তারপরে তিনি অত্যন্ত দ্রুত ক্ষতস্থান দুটি ব্যান্ডেজ করে ফেললেন। তাঁর ব্যবহার দেখে মনে হচ্ছিল, ক্ষতস্থানগুলো ঢেকে ফেলাই বৃদ্ধ ডাক্তারের একমাত্র উদ্দেশ্য।

ডক্টর ডেভিস সাধারণভাবে কৌতূহলশূন্য মানুষ। কিন্তু ডাক্তারের অদ্ভুত রকমের জেরা ক্রমেই ভয়ংকর হয়ে উঠছিল। প্রায় অর্ধচেতন রুগিটিকে তিনি বিশ্রামের সুযোগ না দিয়ে ক্রমাগত প্রশ্ন করেই যাচ্ছিলেন। ওই অস্বাভাবিক ঘটনার প্রত্যেক মুহূর্তের বর্ণনা না শুনে তিনি যেন শান্তি পাচ্ছিলেন না। তিনি অদ্ভুতরকম উদবিগ্ন হয়েছিলেন একটা ব্যাপারে যে, বার্ক কি আদৌ নিশ্চিত সম্পূর্ণ নিশ্চিত একদম ওপরের কফিনটার ব্যাপারে? কীভাবে ওটাকে বাছাই করেছিল? ওই অন্ধকারের মধ্যে কীভাবে নিশ্চিত হল যে, ওটা ফেনারেরই কফিন ছিল? বার্ক কীভাবে ওই হতচ্ছাড়া আসাফ সইয়ারের কফিনটাকে আলাদা করতে পারল ম্যাথু ফেনারেরটার থেকে? দুটো কফিনই যদি একই রকমের আকৃতির হয়, অন্ধকারের মধ্যে হাত বুলিয়ে কি কাঠের কোয়ালিটি বোঝা সম্ভব? এত সহজে কি ফেনারের শক্তপোক্ত কফিনের ডালাটা ভেঙে যেতে পারে?

গ্রামের পুরোনো ডাক্তার হওয়ার সুবাদে ডক্টর ডেভিস ফেনার এবং সইয়ার দু-জনেরই অন্তিমশয্যায় উপস্থিত ছিলেন। তিনি দু-জনেরই শেষকৃত্য দেখেছেন। তিনি তো সইয়ারের শেষকৃত্যের সময় রীতিমতো অবাকই হয়েছিলেন। ওই লম্বাচওড়া চাষিটাকে এত ছোটখাটো একটা কফিন বাক্সে, যা আদতে বেঁটে রোগা ফেনারের মতো করে বানানো, কীভাবে সোজা করে শোয়ানো সম্ভব হল।

ঘটনার প্রায় দু-ঘণ্টার পরে ডক্টর ডেভিস চলে গেলেন। যাওয়ার আগে তিনি বার্ককে পইপই করে বুঝিয়ে গেলেন যে, সমস্ত ক্ষতই তৈরি হয়েছে কফিনের ভাঙা কাঠ আর পেরেক থেকে। এ ছাড়া তিনি বললেন, আর কী-ই বা প্রমাণ অথবা বিশ্বাসের আছে? সব থেকে ভালো হয়, এই সম্বন্ধে তুমি আর কোনও কথা না বলো এবং অন্য কোনও ডাক্তারকে এই ঘা-গুলো না দেখাও। তিনি শাসিয়েছিলেন বার্ককে।

বার্ক অবশ্য তাঁর সেই উপদেশ বাকি জীবন ধরে মনে রেখেছিল। যত দিন পর্যন্ত না আমাকে তার গল্প বলেছিল। আর আমি যখন সেই পুরোনো এবং সাদা-হয়ে-যাওয়া দাগগুলো দেখছিলাম, তখন আমিও মানতে বাধ্য হয়েছিলাম যে, ওই বৃদ্ধ ডাক্তার একদম বিচক্ষণের মতোই নির্দেশ দিয়েছিলেন। বার্ক অবশ্য বাকি জীবনের জন্যে খোঁড়া হয়ে গিয়েছিল। পায়ের পেশিতন্তুগুলো মারাত্মক আহত হওয়ার জন্যে। কিন্তু আমি মনে করি, আদতে তার আত্মা পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল ওই বিভীষিকাময় আঘাতে।

একসময় বার্কের চিন্তাভাবনা যথেষ্ট শান্ত এবং যুক্তিপূর্ণ ছিল। কিন্তু এই ঘটনার পরে তার স্বাভাবিক চিন্তাভাবনাও সারাজীবনের জন্য ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল। এটা দেখতেও খারাপ লাগত যে, মানুষটা শুধুমাত্র শুক্রবার, কবরখানা, কফিন- এই শব্দগুলো শোনামাত্রই আতঙ্কিত হয়ে উঠত। তার ভয়ার্ত ঘোড়াটি বাড়ি ফিরতে পেরেছিল, কিন্তু তার ভয়ার্ত বুদ্ধিমত্তা আর কোনও দিনই বাড়ি ফিরে আসতে পারেনি।

বার্ক ব্যাবসা পরিবর্তন করে ফেলল। আর সে কফিন বক্স বানাত না। তবুও কিছু একটা তাকে আজীবন তাড়া করে বেড়িয়েছে। এটা হয়তো-বা শুধুই ভয়, হয়তো-বা ভয়ের সঙ্গে মেশানো কোনও এক বিকৃত অতীত কৃতকর্মের জন্য উৎকট অনুশোচনা। তার মদ খাওয়া, অবশ্যই, সে অনুভূতিটাকে তাড়ানোর জন্যেই খেত, কিন্তু তার পরিবর্তে অনুভূতিটা আরও উগ্রতর হয়ে তার মনের মধ্যে গেড়ে বসত।

সেই রাত্রে বার্ককে আর্মটঙ্গের বাড়িতে রেখে ডক্টর ডেভিস একটা লণ্ঠন নিয়ে সেই পুরোনো শবঘরে গিয়েছিলেন। মাটিতে পড়ে থেকে বিক্ষিপ্ত ইটের টুকরোগুলো তখনও চাঁদের আলোয় ঝকঝক করছিল। চন্দ্রকিরণে স্নাত বড় দরজার হুড়কোটা সামান্য নেমে এসেছে। ওটাকে বাইরে থেকে একটু ঠেললেই খুলে যাবে। এত দিন ব্যবচ্ছেদ ঘরে থেকে থেকে বিভিন্ন বিষয়ে যে ডাক্তারের মনটা পোক্ত হয়ে উঠছে তা বোঝাই যাচ্ছিল। তিনি লণ্ঠনটা উঁচু করে ধরে শবঘরের মধ্যে ঢুকলেন। ঘরের ভেতরের অবস্থা দেখে ডাক্তারের মাথা ঘুরে গেল। তিনি আর্তনাদ করে উঠলেন। পরক্ষণেই তাঁর ভয়ানক আঁতকে-ওঠাটা একটু আগের চিৎকারটাকেও পেছনে ফেলে দিল। তিনি একদৌড়ে ফিরে এলেন আর্মটঙ্গের বাড়িতে। ডাক্তারির সমস্ত নিয়ম ভেঙে তিনি চিৎকার করে রোগীকে ডেকে তুলেই ক্ষান্ত হলেন না, অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে রোগীকে ধরে ঝাঁকাতেও লাগলেন। অবশ্য তিনি ফিশফিশ করেই কথা বলছিলেন, কিন্তু উত্তেজনায় সেই শব্দগুলো শিসের মতো গিয়ে কানে বিঁধছিল।

ওটা আসাফের কফিন। বার্ক। আমি ঠিকই ভেবেছিলাম। ওর দাঁতগুলো আমি দেখেছি। ওপরের চোয়ালের সামনের পাটির একটা দাঁত ভাঙা। শুধু তা-ই না। তোমার এই ক্ষতই প্রমাণ করে দিচ্ছে যে আমি ভুল নই। তার দেহটা মোটামুটি নষ্টই হয়ে গেছে, কিন্তু তার মুখে যে আক্রোশ দেখে এলাম তা আগে কখনও দেখিনি। তুমি তো জানোই, কীরকম পাষণ্ড প্রতিহিংসাপরায়ণ ছিল আসাফ সইয়ার। সেই জমির সীমানা নির্দেশের গোলমালে ত্রিশ বছর পরে এসেও সে বুড়ো রেমন্ডকে প্রায় শেষ করে ফেলছিল। এক বছর আগে আঁচড়ে দেওয়ার প্রতিশোধ তোলার জন্যে সে গত অগাস্টে বাচ্চা কুকুরটাকে মাড়িয়ে মেরে ফেলছিল। শয়তানের অবতার ছিল সে… বার্ক। আমি মনে করি, তার চোখের বদলে চোখ প্রতিশোধের ব্যাপারে সে হয়তো যমকেও ছাড়িয়ে যাবে। কী ভয়ংকর ওই রাগ! ভগবান! আমার ওপরে যেন তা কোনও দিন না এসে পড়ে। বার্ক, তুমি কেন এটা করলে? জানি, সে এক নম্বরের বজ্জাত ছিল। আমি তোমাকে কোনও দোষ দিচ্ছি না ওকে একটা পরিত্যক্ত কফিনে ঢুকিয়েছ বলে। কিন্তু তুমি একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করে ফেলেছ। কৃপণতা করা ঠিক আছে, কিন্তু তুমি তো জানতে, ফেনার কতটা বেঁটেখাটো ছিল। হে ভগবান, কেন দেখতে গেলাম? দৃশ্যটা ভুলব কী করে এখন আমি! তুমি একটু বেশি জোরেই লাথি মেরেছিলে। আসাফের কফিনটা পড়ে ছিল মাটির ওপরে। মাথাটা ভেঙে টুকরো হয়ে গেছে, পচা ঘিলুও বেরিয়ে এসেছে। এসব আমি আগেও দেখেছি, কিন্তু এখানে আরও কিছু ছিল। খুলিটা দেখে আমার বমি পেয়ে গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তুমি যা করেছ… চোখের বদলে চোখ। মা মেরির দিব্যি! বার্ক, কিন্তু তুমি তোমার প্রাপ্যই পেয়েছ। কী করে করতে পারলে ওটা? ওই ছোট কফিনটার মধ্যে ওই লম্বা দেহটাকে খুঁজেছ তুমি আসাফের পা দুটো গোড়ালি থেকে কেটে!?

[প্রথম প্রকাশ: ১৯২৫ সালের নভেম্বর মাসে টাই-আউট নামে একটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয় গল্পটি। ভাষান্তর : অঙ্কিতা]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *