কে? (THE THING ON THE DOORSTEP)
[লাভক্র্যাফটের একটি প্রিয় বিষয় ছিল গল্পের চরিত্রের মন অন্য কোনও চরিত্রের সঙ্গে বদলে দেওয়া। বিয়ন্ড দ্য ওয়াল অব স্লিপ ও দ্য কেস অব চার্লস ডেক্সটার ওয়ার্ড-এর মতোই এই গল্পেও লেখক সেরকমই একটি ঘটনার ছবি এঁকেছেন। মূল চরিত্র এডওয়ার্ড ডার্বিকে লাভক্র্যাফট যেন তাঁর প্রিয় লেখক পো-এর আদলেই গড়ে তুলেছেন। চার্লস ডেক্সটার ওয়ার্ডের মতো এই গল্পেও মন পালটানোর পিছনে আছে কথুলুর সমগোত্রীয় নিষিদ্ধ দেবতার আরাধনা।]
০১.
বিশ্বাস করুন, আমি খুনি নই!!
যদিও আমার প্রিয়তম বন্ধুর করোটির ভেতর ছ-ছ-টা গরম সিসের গুলি পুরে দিতে সেই মুহূর্তে আমার হাত কাঁপেনি, তবুও আমি পাঠককে অনুরোধ করব, আমার বয়ানটা যেন দয়া করে পড়েন। আমার ওপর অভিযোগের আঙুল ওঠার আগেই আমি নিজের জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করে যেতে চাই।
জানি, লোকে আমাকে পাগল ভাবছে। তবে সুধী পাঠক আমার পুরো ঘটনা পড়ার পর, সবরকম সম্ভাবনা নিক্তিতে বিচার করলে বুঝতে পারবেন, যে ভয়ংকরের মুখোমুখি আমি হয়েছিলাম, তার থেকে বেরিয়ে আসার জন্য এর চেয়ে শ্রেয় আর কিছু ছিল না।
হ্যাঁ– সেই আতঙ্ক নিজে এসেছিল আমার দুয়ারে আমার সঙ্গে দেখা করতে।
আমি নিজেই এখনও কেমন একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছি– এখনও অনুধাবন করতে পারছি না, আমি এটা করলাম কীভাবে। যা জানতে পেরেছিলাম, তাতে হয়তো আমার বিচারবুদ্ধি লোপ পেয়েছিল। আমি তো আর জন্ম থেকে পাগল নই! লোকে এডওয়ার্ড আর অ্যাসেনাথ১৭৬ ডার্বির ব্যাপারে যে অদ্ভুত কথাগুলো বলছে, আমি বেশ বুঝতে পারছি, এই তুধোমুখো পুলিশগুলো অবধি সেটা উড়িয়ে দিতে পারছে না। এরা চেষ্টা করছে কয়েকটা মনগড়া, যুক্তিপূর্ণ গল্প খাড়া করে কেসটা ফাইল করার, কিন্তু তারাও মন থেকে জানে সত্যিটা কী অবিশ্বাস্য রকমের ভয়ানক।
আমি জানি, এডওয়ার্ডকে আমি হত্যা করিনি তাকে শাস্তি দিয়েছি। সেই সঙ্গে এই পৃথিবীকে উদ্ধার করেছি এক ভয়ানক অশুভশক্তির কবল থেকে। এটা আমি নিজের কর্তব্য বলে মনে করেছি। হে পাঠক, আপনারাও হয়তো এ ধরনের কিছু আপনার চারপাশে উপলব্ধি করতে পারবেন। আপনার জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে নরকের অন্ধকার ছায়া তার করাল বাহু বিস্তৃত করতে চাইছে আমাদের এই সাধের দুনিয়ার দিকে। বুঝতে না পারলে কিছু করার নেই– কিন্তু টের পেলে, যে-কোনও মূল্যে তাকে রোধ করতে হয়।
নইলে অনেক অনেক দেরি হয়ে যেতে পারে।
এডওয়ার্ড পিকম্যান ডার্বিকে আমি ছোটবেলা থেকেই চিনি। আমার থেকে বয়সে আট বছরের ছোট হলেও, এডওয়ার্ডের মানসিক বাড়বৃদ্ধি ছিল বিস্ময়কর। হয়তো সে জন্যই এই বয়সের তফাত আমাদের বন্ধুত্বের মাঝে কোনওরকম বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। তার দুর্দান্ত মেধার স্ফুরণ ওই বয়স থেকেই ফুটে বেরুচ্ছিল তার লেখালেখির মধ্যে। গদ্য, কাব্য এবং গম্ভীর প্রবন্ধ রচনায় তার ব্যুৎপত্তি শিক্ষকদেরও চমকিত করেছিল। তার নিভৃতে পড়াশোনা করার ক্ষমতা এবং নিজের মধ্যে গুটিয়ে-থাকা স্বভাবটাই হয়তো তার এই প্রতিভার বিচ্ছুরণের কারণ। পরিবারের একমাত্র ছেলে সে, স্বাভাবিকভাবেই বাপ মায়ের নয়নের মণি। আদরের চোটে বেচারার শারীরিক বাড়বৃদ্ধি বড়ই ধীরস্থিরভাবে হয়েছিল তার মেধার মতো তার শরীর মোটেই চটপটে ছিল না। তা ছাড়া, সে যেখানেই যেত, পরিবারের নির্দেশে তার পেছনে কড়া নজর রাখত তাদের চাকর। সবার সঙ্গে খেলাধুলা করার অধিকারও ছিল না বেচারির। এই একাকিত্বই অবশ্য তাকে নিভৃতে চিন্তা করার অবকাশ দিয়েছিল আর সেই চিন্তার মধ্যে দিয়েই সে পেত মুক্তির স্বাদ।
তার শেখার ক্ষমতা ছিল বিস্ময়কর। যে সময়ের কথা বলছি, তখন কিছু বিদঘুটে শিল্পের ওপর হঠাৎ করেই আমার আগ্রহ জন্মেছিল। এডওয়ার্ডের সঙ্গে ব্যাপারগুলো নিয়ে আলোচনা করতাম। রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও, তার সঙ্গে কেমন যেন একটা আত্মার সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল খুব সহজেই। আমরা যে শহরে বাস করতাম, তার মতো অভিশপ্ত, পিশাচতাড়িত, দুঃস্বপ্নের শহর হয়তো-বা আর দুটি ছিল না। রহস্যময় কিংবদন্তির ছায়ায় ঘেরা এই আর্কহ্যামের ভেঙে পড়া ছাদ আর মোটা মোটা থামের ঘরবাড়িগুলি যেন ইতিহাসকে থামিয়ে রেখেছে থামিয়ে রেখেছে এক প্রাচীন সময়কে। এই অদ্ভুত শহরের বাসিন্দা হওয়ার সুবাদেও হয়তো আমার বন্ধুত্বটা এতটা গাঢ় হতে পেরেছিল।
স্কুলের পড়াশোনা শেষে আমি স্থাপত্যের ওপর বিশেষভাবে আকর্ষণ অনুভব করি এবং তা নিয়ে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়ি যে, এডওয়ার্ডের সঙ্গে মেলামেশার সময় হয়ে উঠত না বিশেষ। তাতে অবশ্য আমাদের পুরোনো বন্ধুত্বে কোনও ছেদ পড়েনি। ইতিমধ্যেই যুবক ডার্বির কাব্যপ্রতিভা দুরন্ত ছন্দে গতিমান হয়ে উঠেছিল। আঠারো বছর বয়সে তার লেখা দুঃস্বপ্নের কবিতাগুচ্ছ রীতিমতো আলোড়ন তুলেছিল পাঠকসমাজে। আপনারা জাস্টিন জিওফ্রেকে চেনেন? খ্যাপা এক কবি, যিনি মানব ও প্রস্তরখণ্ড লিখে বিখ্যাত হয়েছিলেন তাঁর খুব কাছের লোক হয়ে উঠেছিল এই এডওয়ার্ড। তবে কথিত আছে, সেই জিওফ্রে নাকি হাঙ্গেরির কোনও এক অভিশপ্ত গ্রাম থেকে ফিরে আসার পর ১৯২৬ সালে এক পাগলাগারদে ভরতি হন। আর সেখানেই উন্মত্তের মতো চিৎকার করতে করতে একদিন তাঁর দুঃখজনক অকালপ্রয়াণ ঘটে।
দায়িত্ব নিয়ে কোনও কাজ করার ব্যাপারে ডার্বির কোনও সাড়া পাওয়া যেত না। পড়াশোনা ছাড়া অন্যান্য কাজে তার আত্মবিশ্বাস ছিল বড়ই কম। তার বাপ-মা-র অতিরক্ষণশীল আদরের অত্যাচার থেকে বেচারা তখনও মুক্তি পায়নি। তাই অচিরেই বোঝা গিয়েছিল, চাকরি বা ব্যাবসার মতো কায়িক শ্রম তার দ্বারা কোনওমতেই হওয়ার নয়। তবে তাদের সম্পত্তির পরিমাণ এতটাই বেশি ছিল যে, এই সামান্য অক্ষমতাটুকুর জন্য তাকে মোটেই বেগ পেতে হয়নি৷ নীল চোখ, ফরসা সুন্দর মুখের অধিকারী ছেলেটির চেহারাতে একটা আদুরে থলথলে ভাব ছিল, যেটা ওর নিরীহ ব্যক্তিত্বের সঙ্গে চমৎকার খাপ খেয়ে গিয়েছিল। সুন্দর উচ্চতার, সোনালি চুলের ডার্বি খুব স্বাভাবিকভাবেই জনসমাজে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়াতে পারত, যদি না তার অন্তর্মুখীনতা আর গভীর পুস্তকপ্রেম তাকে বাইরের জগৎ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে রাখত।
ডার্বির বাবা-মা তাকে প্রতি গ্রীষ্মে একবার করে ইউরোপ ঘুরতে নিয়ে যেতেন। ডার্বি তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে খুব দ্রুত ইউরোপের সংস্কৃতি এবং সামাজিক রীতিনীতি আয়ত্ত করে নিয়েছিল। সে সময় তার সঙ্গে আমার প্রচুর আজ্ঞা হত। আমি তখন সবে সবে হার্ভার্ড থেকে পাশ করে বস্টনে এক নামি আর্কিটেক্টের অফিসে কাজ করে হাত পাকিয়েছি। বিয়ে করে সংসার পেতে আমি আর্কহ্যামে ফিরে এসেছি প্র্যাকটিস করতে৷ বাবার শরীরটা ভালো না-থাকায় উনি ফ্লোরিডা চলে গিয়েছিলেন তাই আমি সপরিবার সলটনস্টল স্ট্রিটে একটা বাড়িতে উঠলাম। এডওয়ার্ড এই সময়টা প্রায় প্রতিদিন দেখা করতে আসত। আমার বাড়িতে এসে এডওয়ার্ড একটা স্পেশাল কোডে ডোর বেল বাজাত বা দরজাটা নক করত। প্রতিদিন খাওয়াদাওয়ার পর আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম, কখন ও এসে দরজায় পরপর জোরে জোরে তিনটে আর তারপর থেমে থেমে দুটো নক করবে। মাঝে মাঝে আমি ওর বাড়িতে গিয়েও ওর ক্রমবর্ধমান দুর্লভ বইয়ে সমৃদ্ধ লাইব্রেরি দেখতাম আর ঈর্ষান্বিত হতাম।
ডার্বি মিসকাটনিক বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া আর কোথাও পড়েনি। আসলে ওর বাবা-মা ওকে বাড়ি থেকে বেশি দূরে একা একা যেতেই দেয়নি। যা-ই হোক, মিসকাটনিকে ইংরেজি এবং ফরাসি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করলেও ওর মার্কস প্রায় সবেতেই ভীষণ ভালো ছিল। কেবল গণিত আর বিজ্ঞানে ও তেমন সুবিধে করতে পারেনি। কিন্তু ওর সবচেয়ে আগ্রহের বিষয় ছিল প্রাচীন গুপ্তবিদ্যা। সেসব বিদ্যা আয়ত্ত করা কেবল দুরূহ নয়, তার অধীত জ্ঞানও বড় ভয়ানক। সেসব নিয়ে পড়ার জন্য সে বার বার ছুটে যেত মিসকাটনিক লাইব্রেরিতে।
লাইব্রেরিতে বসে ডার্বি গোগ্রাসে গিলত অদ্ভুত সব নিষিদ্ধ বইয়ের জ্ঞান যেসব বইয়ের নাম মনে আনলেও আতঙ্কে শিহরিত হতে হয়, সে পরম পরিতোষে সেগুলো নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটিয়ে দিত। কী ছিল না সেসব বইয়ের মধ্যে হাড়-হিম-করা বুক অব ইবন যেমন ছিল, তেমনই ছিল ভন জুন্থের অভিশপ্ত গুহ্যবিদ্যা এবং উন্মাদ আরব জাদুকর আবদুল আলহাজেডের লেখা নেক্রোনমিকন। এই শেষোক্ত বইটি সম্পর্কে যত কম বলা যায়, ততই ভালো লোকমুখে শোনা যায়, স্বয়ং শয়তান জাগানোর এবং তাকে বশীভূত করার গুপ্তমন্ত্র নাকি লেখা আছে ওই বইতে। এডওয়ার্ড যদিও এসব কাউকে কোনও দিন বলেনি, তবু আমি জানতে পেরেছিলাম। বই-পাগল এই ছেলেটা আমার মনে এতটাই ভালোবাসার উদ্রেক করেছিল, যে আমি ওর নামে আমার ছেলের নামও রেখেছিলাম এডওয়ার্ড ডার্বি আপটন।
পঁচিশ পেরোতে-না-পেরোতেই এডওয়ার্ড রীতিমতো বিজ্ঞ হয়ে উঠেছিল বিভিন্ন বিষয়ে, বিশেষ করে গুপ্তবিদ্যাতে। কিন্তু তার অন্তর্মুখীনতা এবং বাইরের জগৎ সম্পর্কে চরম উদাসীনতা তার জ্ঞানকে কেবল বইয়ের পাতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছিল। লোকজনের সঙ্গে ডার্বি যে ইচ্ছে করে মিশত না তা ঠিক নয়, বহু দিনের অনভ্যাস, বাবা-মা-র অতিরিক্ত আঁচল-চাপা-দেওয়া স্বভাব– এসবের জন্য অপরিচিত কোনও জনসমাবেশে গেলেই সে বেচারা কেমন কুণ্ঠিত হয়ে খোলসের মধ্যে ঢুকে যেত।
এডওয়ার্ডের যখন চৌত্রিশ বছর বয়স, তখন তার মা মারা গেলেন। তার পর পরই সে বেচারাও কী এক বিশ্রী রোগে বিছানা নিল। বেশ কয়েকদিন যমে-মানুষে হওয়ার পর, তার বাবা তাকে টেনে নিয়ে গেলেন ইউরোপে– ভালো চিকিৎসা করানোর জন্য। ডার্বির কপাল ভালো বলতে হবে, সে সুস্থ হয়ে ফিরে এল। কিন্তু এই রোগে ভোগার পর থেকেই
ছেলেটা কেমন যেন হয়ে গেল। ওকে দেখে স্বাভাবিক রোগে ভোগা মনমরা মানুষ লাগত না। খুব আশ্চর্যরকমভাবে উল্লসিত ছিল সে, যেন তার এক বন্ধনমুক্তি ঘটেছে। যে ছেলেটা আগে মুখচোরা হয়ে বই মুখে করে পড়ে থাকতেই ভালোবাসত সে রাতারাতি হয়ে পড়ল চরম মিশুকে। কেবল তা-ই নয়, সে মিসকাটনিকের নতুন ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে যেচে মিশতে লাগল, তাদের দলে ভিড়ে করতে লাগল গোপন সব ক্রিয়াকলাপ।
শুনেছিলাম, কোনও একদিন সে এবং একদল ছেলেমেয়ে মিলে চর্চা করেছিল এমন একটা কিছুর, মিসকাটনিকের ইতিহাসে যা কোনও দিন শোনা যায়নি।
এক ভয়াল-ভয়ংকর গুপ্তবিদ্যা সাধনার কথা কানাঘুষোতে জেনে স্তম্ভিত হয়েছিলাম আমি।
.
০২.
এডওয়ার্ডের যখন আটত্রিশ বছর বয়স, সে সময়েই অ্যাসেনাথ ওয়াইটের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়। অ্যাসেনাথ তখন তেইশ বছরের যুবতি, মিসকাটনিকে মধ্যযুগীয় অধ্যাত্মবাদ নিয়ে পড়াশোনা করতে এসেছিল সে। আমার এক বন্ধুর মেয়ের থেকে তার ব্যাপারে আমি কিছুটা হলেও শুনেছিলাম। অ্যাসেনাথও যে খুব একটা মিশুকে প্রকৃতির ছিল, তা নয়– তবে তার সঙ্গে বাকি ছাত্রছাত্রীদের দূরত্ব বজায় রাখার কারণ ছিল অন্য।
ছোটখাটো চেহারার সুন্দরী অ্যাসেনাথের চোখগুলো ছিল বেশ ভীতিপ্রদ। কোটর থেকে বেরিয়ে-আসা চোখে যেন সবসময় খেলা করে যেত কী এক অবজ্ঞা, অবহেলা। অন্য ছাত্রছাত্রীদের তুলনায় সে যে অনেক বেশি বিদুষী আর ক্ষমতাসম্পন্না, সেই অভিব্যক্তি যেন ফুটে বেরুত তার চোখ দিয়ে। সে ছিল ইন্সমাউথের কুখ্যাত ওয়াইটদের৮২ বংশধর। এমনিতেই অভিশপ্ত, পরিত্যক্ত ইন্সমাউথের নামেই লোকে আতঙ্কিত হত, তারপর অ্যাসেনাথের চলাফেরাতে এমন একটা তমসাচ্ছন্ন ব্যক্তিত্ব ছিল, যে ওকে খুব স্বাভাবিকভাবেই লোকে এড়িয়ে চলতে পছন্দ করত।
এপ্রাহিম ওয়াইট এই বংশের সবচেয়ে কুখ্যাত নাম। শুধু নামের দিক দিয়ে নয়– কাজের দিক দিয়েও এপ্রাহিম এক মূর্তিমান আতঙ্ক ছিল। তার স্ত্রীর মুখ কেউ কোনও দিন দেখেনি, কারণ ভদ্রমহিলা সারাদিন মুখে একহাত ঘোমটা টেনে নিজেকে আড়াল করে রাখতেন। ইন্সমাউথ শহরে ওয়াশিংটন স্ট্রিটের ধারে যে আধভাঙা পোড়ো দুর্গের মতো বাড়িতে এপ্রাহিম ওয়াইট বাস করত, তার চিলেকোঠার জানলাটা কোনও দিন কেউ খোলা দেখেনি– আজন্ম সেটায় একটা তক্তা মারা থাকত। যারা ওই অভিশপ্ত শহরে পা রেখেছে, তাদের থেকে শুনেছি, রাতের অন্ধকারে ওই চিলেকোঠা থেকে ভেসে আসত অপার্থিব সব শব্দ। এপ্রাহিম তার যুবক বয়সে নাকি জিনিয়াস ধরনের তান্ত্রিক ছিল। জনশ্রুতি আছে, সে নাকি তার নিজের ইচ্ছেমতো সমুদ্রে তুফান আনতে পারত, সৃষ্টি করতে পারত মহাদুর্যোগ। আমি আমার জীবদ্দশায় তাকে এক-দু-বারই দেখেছিলাম। তখন আমি মিসকাটনিকে কী একটা কাজে গিয়েছিলাম, আর এপ্রাহিম এসেছিল লাইব্রেরিতে নিষিদ্ধ সব অকাল্টের বই নিয়ে আলোচনা করতে। নেকড়ের মতো ধূর্ত মুখে ধূসর দাড়ির জঙ্গলে ঢাকা এপ্রাহিমকে দেখে আমি চমকে পালিয়ে এসেছিলাম।
তবে এপ্রাহিমের অস্বাভাবিক মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই, ওর মেয়ে অ্যাসেনাথ মিসকাটনিকে পড়তে আসে। বাপ আর মেয়ের মধ্যে কেবল যে মুখের মিল ছিল তা নয়– মেয়ে যে বাপের একনিষ্ঠ ছাত্রীও ছিল, সেটা বুঝতে ভুল করেনি মিসকাটনিকের ক্লাসমেটরা। অ্যাসেনাথের নানাবিধ অদ্ভুত ক্ষমতা ওর ক্লাসের বন্ধুদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করেছিল। এমনকী তার রাস্তা এড়িয়ে চলত পশুপাখিরাও। আমার বন্ধুর যে মেয়েটি অ্যাসেনাথের সঙ্গে পড়াশোনা করত, তার মুখ থেকেই আমি বেশির ভাগ খবর জোগাড় করতাম। অনেক কথার মধ্যে অ্যাসেনাথের একটা বিশেষ ব্যাপার আমাকে আকৃষ্ট করেছিল, এবং তা হল, মেয়েটি নাকি চূড়ান্তরকম ভালো সম্মোহন জানত। নিজের চেতনাকে অন্যের শরীরে স্থাপন করে অন্যের চেতনাকে নিজের মধ্যে নিয়ে আসতে পারত। এর ফলে সম্মোহিত মানুষটি সভয়ে দেখতে পেত, ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে সে তার নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আর সেই শরীরধারীর দুটো চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে, আর সে চোখ যেন জ্বলছে এক অনন্ত জিঘাংসায়। শরীরবিহীন চেতনার ওপর অ্যাসেনাথের জ্ঞান ছিল অবাক করার মতো।
অ্যাসেনাথ তার বন্ধুমহলে ক্ষোভ প্রকাশ করত যে, একজন পুরুষ হলে সে এই তন্ত্রে সিদ্ধিলাভ করতে পারত আরও ভালোভাবে। একটা পুরুষ মস্তিষ্কের ক্ষমতা তার আয়ত্তে এলে, অ্যাসেনাথ হয়তো অলৌকিক ক্রিয়াকলাপে তার বাবাকেও ছাড়িয়ে যেত বহু দিন আগেই।
এডওয়ার্ডের সঙ্গে অ্যাসেনাথের আলাপ হয় একদল বুদ্ধিজীবীর সমাবেশে এবং আমার স্পষ্ট মনে আছে, পরের দিন একমাত্র অ্যাসেনাথের বিষয়ই ছিল তার কথাবার্তার একমাত্র সারমর্ম। অ্যাসেনাথের জ্ঞান, বাগ্মিতা এবং এডওয়ার্ডের পছন্দের বিষয়ে তার আগ্রহ, তাকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করেছিল মেয়েটির প্রতি। তবে অ্যাসেনাথের ব্যাপারে আগে যা শুনেছিলাম, তাতে আমার এডওয়ার্ডের ওপর করুণাই হল। এত দিন পর ছোকরা কিনা এরকম এক জাদুগরনির পাল্লায় পড়ল!! আমি অবশ্য ওকে কিছু বলিনি– জানতাম, এসব ক্ষণিকের ভালো-লাগা দু-দিনেই হয়তো কেটে যাবে। তা ছাড়া এডওয়ার্ড নিজেও বলল, অ্যাসেনাথের ব্যাপারে সে তার বাবাকে কিছুই জানাবে না।
কিন্তু ব্যাপারটা সেরকম হল না মোটেই। পরের সারা সপ্তাহ জুড়ে যখনই ডার্বি আমার সঙ্গে আড্ডা দিতে এল, অ্যাসেনাথ, অ্যাসেনাথ করে আমার কান পচিয়ে ছাড়ল। আমি আগেই বলেছি যে, এডওয়ার্ডকে দেখতে রাজপুত্রের মতো সুন্দর ছিল। তাকে দেখে কেউ আন্দাজ করতে পারত না যে, তার বয়স চল্লিশের দিকে বিপজ্জনকভাবে ঝুঁকে পড়েছে। উলটোদিকে অ্যাসেনাথকে তার বয়সের তুলনায় বেশ বয়স্কই লাগত। যা-ই হোক, এক শরতের সকালে এডওয়ার্ড আমাকে নেমন্তন্ন করে নিয়ে গেল তার প্রেমিকার সঙ্গে আলাপ করাবে বলে। গিয়ে দেখলাম, ব্যাপার মন্দ না, প্রেমের রং দু-জনের মনেই ভালোভাবে লেগেছে। চোরা চোখের চাউনিতে অ্যাসেনাথ দেখলাম বেশ পটু– যখনই সুযোগ মিলেছে, সে এডওয়ার্ডের প্রতি বিলোল কটাক্ষ হানতে কুণ্ঠা বোধ করেনি।
এর ক-দিন পর মি. ডার্বি, মানে এডওয়ার্ডের বাবা একদিন আমার বাড়িতে হঠাৎ এসে হাজির। ওঁকে রীতিমতো সমীহ করতাম আমি, যথেষ্ট খাতির করেই বসালাম। এ কথা-সে কথার পর বুঝলাম, ভদ্রলোকে বেশ মুষড়ে পড়েছেন। উনি ছেলের বান্ধবীর কথা শুনতে পেয়ে ছেলেকে চাপ দিয়ে সব গুপ্তকথা জেনে নিয়েছেন। কিন্তু ছেলে এর মধ্যে নাকি অনেক দূর এগিয়ে গেছে। সে শুধু অ্যাসেনাথকে বিয়ের প্ল্যানই করেনি, অন্য বাসার খোঁজও করছে, যেখানে সে বিয়ের পর উঠে যেতে পারে। মি. ডার্বি আমাকে অনেক অনুনয় করলেন, আমি যেন একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কাজ করি এবং কোনওভাবেই মতিচ্ছন্ন এডওয়ার্ডের বিয়ে ওই ডাইনিটার সঙ্গে হতে না দিই।
বলাই বাহুল্য, এই প্রস্তাবে আমি মোটেই রাজি হলাম না। এডওয়ার্ডের মধ্যে অনেকদিন পর একজন দায়িত্ববান মানুষ হওয়ার ক্ষমতা এবং ইচ্ছে জাগ্রত দেখে আমার ভালোই লাগছিল। আর ব্যাপারটা তো শুধু এডওয়ার্ডের দিক দিয়ে নয়, মেয়েটিরও এই সম্পর্কে যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে। এডওয়ার্ডের এই পরিবর্তনটুকুকে আমি মনে মনে স্বাগত জানালাম। বাপের ছত্রছায়া থেকে বেরিয়ে এসে নিজে কিছু করার শক্তি যে ছেলেটা জোগাড় করতে পেরেছে– এটা দেখেই আমার গর্ব হচ্ছিল, তাই সম্পর্ক ভেঙে দিয়ে ছেলেটার জীবন বরবাদ করার আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে হল না।
মাসখানেক পরে একটা ঘরোয়া সমাবেশে ওদের বিয়েটা হয়ে গেল। বলাই বাহুল্য, আমি এবং আমার পরিবার বিয়েতে আমন্ত্রিত ছিলাম, এবং মিসকাটনিকের প্রচুর ছাত্রছাত্রীও বিয়েতে উপস্থিত হয়ে আনন্দ করেছিল। অ্যাসেনাথ আর ডার্বি মিলে হাই স্ট্রিটের মোড়ে ওল্ড ক্রাউনিংফিল্ড নামে একটা বড়সড়ো বাড়ি কিনে রেখেছিল। আপাতত স্থির হল যে, নবদম্পতি সপ্তাহখানেকের জন্য ইন্সমাউথে কাটিয়ে আর্কহ্যামে তাদের নতুন বসতবাড়িতে ফিরে আসবে। ইন্সমাউথের বাপের বাড়ি থেকে কিছু আসবাব, বই আর তিনখানা চাকরকেও আনার ছিল অ্যাসেনাথের।
মিসকাটনিকের কাছে থাকার অনুরোধ এডওয়ার্ডের বাবা ফেলতে পারেননি। ছেলে এমনিতেও সারাক্ষণ বই মুখে করে থাকে। আর তা ছাড়া, ওদিকটাতে প্রচুর বিজ্ঞ মানুষের বাস– ওদের সান্নিধ্যে এডওয়ার্ড পরিবার নিয়ে সুখেই থাকবে, সে আশাই করেছিলেন মি. ডার্বি।
মধুচন্দ্রিমা থেকে ফেরার পর এডওয়ার্ড যখন আমাকে প্রথম তার নতুন বাড়িতে ডাকল, তখন লক্ষ করলাম, ছোকরা বেশ কিছুটা বদলে গিয়েছে। ক্লিন শেজ্ঞ এডওয়ার্ডকে বেশ ভদ্রজনোচিত লাগছে ঠিকই, কিন্তু এই ক-দিনেই যেন বেশ বড় হয়ে গেছে সে। মুখে একটা স্পষ্ট চিন্তাক্লিষ্ট ভাব। আমার ব্যাপারটা কেমন জানি ভালো লাগল না। এডওয়ার্ড ক দিনেই যেন বুড়ো হয়ে গেছে। আমি অবশ্যই চেয়েছিলাম, যাতে সে নিজের পায়ে দাঁড়ায়, নিজের ছেলেমানুষ বদনাম ঘুচিয়ে পৌরুষকে জাগিয়ে তোলে গড়ে তোলে একটা স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব। তবুও কেন জানি না, ডার্বির এই পরিবর্তনটা মন থেকে মেনে নিতে পারছিলাম না। তার ওপর এডওয়ার্ড ইন্সমাউথ থেকে একাই এসেছে, অ্যাসেনাথ আসেনি। তার নাকি কিছু কাজ পড়ে গেছে ওখানে। তবে গুচ্ছ বই দিয়ে এডওয়ার্ডকে সে এখানে পাঠিয়েছে। বইগুলোর নাম উচ্চারণ করলেও দেখলাম, সে বেশ শিউরে উঠছে, নিজের অজান্তেই।
এডওয়ার্ড এমনিতেই গুপ্তবিদ্যা নিয়ে রীতিমতো চর্চা করত, তার ওপর এখন অ্যাসেনাথ সহায়। গিন্নির সাহচর্যে আর তার জ্ঞানের প্রাচুর্যে সে বেশ তাড়াতাড়িই ব্যাপারগুলো শিখে নিতে লাগল। কিন্তু মাঝেমধ্যে অ্যাসেনাথের ক্রিয়াকলাপ বা তার গুপ্তবিদ্যার উপাচার ও উপাসনাপদ্ধতি এতটাই বীভৎস আর আতঙ্কজনক হয়ে উঠত যে, এডওয়ার্ড নাকি রীতিমতো অস্বস্তি বোধ করত।
বাড়ির তিন চাকরের দু-জন ছিল এক অতিবৃদ্ধ দম্পতি। তারা সেই এপ্রাহিমের সময় থেকেই রয়েছে। মাঝে মাঝেই তারা এডওয়ার্ডকে এপ্রাহিম এবং তার ঘোমটা পরিহিতা স্ত্রীর রহস্যজনক মৃত্যুর ব্যাপারে বিড়বিড় করে শোনাত। আর ছিল একটি মেয়ে কালো কষ্টিপাথরের মতো রং তার। শরীরে তার নানা অসংগতি ছিল, কিন্তু সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার তার গা গিয়ে সারাক্ষণ ভেসে আসত তীব্র আঁশটে গন্ধ।
.
০৩.
পরের দু-বছর ডার্বি পুরো ডুমুরের ফুল হয়ে গেল। মাসে দু-বার বা নিদেনপক্ষে একবারও তার দেখা পাওয়া ভার হয়ে দাঁড়াল। মাঝে মাঝে ফোন-টোন করলে জবাব দিত বটে, কিন্তু বুঝতাম কথাবার্তা চালিয়ে যাওয়াতে তার বিশেষ আগ্রহ নেই। যেসব গুপ্তবিদ্যাচর্চার ব্যাপারে বা অকাল্টের ব্যাপারে আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা চালিয়ে যেতাম, সেসব নিয়ে আজকাল সে আর টু-শব্দটি করে না। অ্যাসেনাথের ব্যাপারে তো কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছিল সে।
অ্যাসেনাথ দিন দিন কেমন যে বুড়িয়ে যাচ্ছিল। ডার্বি আর অ্যাসেনাথকে পাশাপাশি দেখলে বিশ্বাসই করা যেত না, যে মেয়েটি ওর থেকে বয়সে এত ছোট। বরং অ্যাসেনাথকেই ডার্বির চেয়ে বড় মনে হত। তা ছাড়া আমার গিন্নি আর ছেলে মিলে এটা লক্ষ করেছিল যে, অ্যাসেনাথের মুখের গাম্ভীর্য যেন অনাবশ্যকরকমভাবে বেড়ে গিয়েছে। ধীরে ধীরে আমরা ওদের ফোন করাই বন্ধ করে দিলাম। হয়তো ওরা একাই থাকতে চাইছিল, তাই আমরা ওদের আর বিরক্ত করিনি।
বছরখানেক পর থেকেই এডওয়ার্ডের ব্যাপারে নানা কানাঘুষো শোনা যেতে লাগল। সব থেকে অদ্ভুত ব্যাপারটা হল, এডওয়ার্ড আগে নিজে কোনও দিন ড্রাইভ করেনি। গাড়ি চালাতে সে রীতিমতো ভয় পেত। শোনা গেল, সে এখন নাকি পুরো পাকা ড্রাইভারের মতো গাড়ি চালাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, ট্রাফিক সিগনাল বাঁচিয়ে অ্যাসেনাথের গাড়িখানা সে হু হু করে ছুটিয়ে দেয় পুরোনো ক্রাউনিংশিল্ড ড্রাইভওয়ে দিয়ে। অবশ্য সে বেশির ভাগ সময়ে ওই রাস্তাটাই বেছে নেয়, যেটা আর্কহ্যাম থেকে ইন্সমাউথের দিকে চলে গেছে।
ডার্বিকে ড্রাইভিং সিটে যারা দেখেছে, তারা সবাই একটা আশ্চর্য দাবি জানিয়েছিল– ড্রাইভারের সিটে এডওয়ার্ডকে নাকি অনেকটা অ্যাসেনাথের মতো দেখতে লাগছিল। সেই মুখ, সেই চোখ। আমি ব্যাপারটা শুনলেও উড়িয়ে দিয়েছিলাম পুরোপুরি। পরে শুনেছিলাম যে, ডার্বি-দম্পতি কলেজ ছেড়ে দিয়েছে কারণ তারা নাকি এমন কিছু বিষয় নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেছিল, যা জানতে পেরে পিলে চমকে গিয়েছিল প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর।
বিয়ের বছর তিনেকের মাথায় এডওয়ার্ড আমার কাছে ঘ্যানঘ্যান করতে শুরু করল এই বলে যে, তার অ্যাসেনাথের সঙ্গে রীতিমতো সমস্যা হচ্ছে। সারাক্ষণ কিছু একটা ভয় এবং বিরক্তি তাকে গ্রাস করে রাখে। আমাকে সে কয়েকবার বলেছিল বটে যে, অ্যাসেনাথের ব্যাপারস্যাপার তার মোটেই সুবিধের মনে হচ্ছে না। ওর কিছু আচরণ তো একেবারেই সৃষ্টিছাড়া। আমি সাক্ষাতে কয়েকবার ওকে প্রশ্ন করার চেষ্টা করে দেখেছি, তবে বিশেষ উত্তর পাইনি।
এর কয়েকদিন পর এডওয়ার্ডের বাবা মারা গেলেন। এডওয়ার্ডের মধ্যে সে জন্য কিছুমাত্র অনুতাপ দেখা গেল না। হতে পারে, বিয়ের পর থেকে তার সঙ্গে মি. ডার্বির একরকম সম্পর্ক ছিল না বললেই চলে, কিন্তু তা সত্ত্বেও মি. ডার্বির মৃত্যুর পর এডওয়ার্ডের গাড়ি চালিয়ে হুল্লোড় যে আরও বেড়ে যাবে, সেটা অনেকেই আশা করেননি। নিজের পরিবারের প্রতি এমন ঔদাসীন্য লোকজন মোটেই ভালোভাবে নেয়নি।
এডওয়ার্ডের ফোন আসাটা এরপর কয়েকদিন একটু বেড়ে গেল। ফোনে সে এমন এমন কথা বলতে লাগল, যা বিশ্বাস করা রীতিমতো কঠিন। মেইন-এর ঘন জঙ্গলে কিছু পুরোনো ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। তারই কিছু ভগ্ন কাঠামোর নীচে রয়েছে গভীর সুড়ঙ্গ। হাজার সিঁড়ি পেরিয়ে সেই গভীরতায় পৌঁছোনো যায় কেউই এই গুপ্ত সুড়ঙ্গের সন্ধান জানে না। কিন্তু এডওয়ার্ড জানতে পেরেছে। সে এ-ও জানতে পেরেছে যে, সেখানে এমন কিছু আছে, যা ঠিক প্রকাশ করা যায় না অন্য দেশ-কাল থেকে, অন্য মাত্রা থেকে আগত কিছু ভয়ংকরের ব্যাপারে জানতে পেরেছে সে।
মাঝে মাঝে এডওয়ার্ড আমার কাছে এসে ফিশফিশ করে বলত, এপ্রাইমের ব্যাপারে জানো ড্যান? আমার স্থির বিশ্বাস, সে বেঁচে আছে। কোথাও একটা আছে, কিন্তু বেঁচে রয়েছে। তার আত্মা এই আমার আশপাশেই কোথাও রয়েছে, শুধু দেহ ধারণ করতে পারছে না। বলেই সে শিউরে উঠে চারপাশে তাকাত। আমি ওর অবস্থা দেখে অবাক হয়ে যেতাম।
কথা বলার মাঝেই এডওয়ার্ড হঠাৎ কেমন যেন চুপ করে যেত, যেন জোর করে কেউ তার মুখ চেপে ধরেছে। আমি অ্যাসেনাথের ব্যাপারে যা কিছু শুনেছিলাম, তাতে আমার কেমন জানি মনে হত, অ্যাসেনাথ হয়তো দূর থেকেই ডার্বিকে নিয়ন্ত্রণ করে– সে কী বলবে, কীভাবে চলবে– সব।
এরপর থেকে ডার্বির পক্ষে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসা মুশকিল হয়ে পড়ল। সময় সুযোগ বুঝে সে আসত বটে, কিন্তু তেমন কথা হত না। আমি ঠিকই বুঝতাম যে, যখন অ্যাসেনাথ আমার থেকে কোনও ক্ষতির আশঙ্কা করত না, তখনই ডার্বিকে আসতে দিত।
কিন্তু আসল ব্যাপারটা টের পেলাম কয়েকদিন পরেই।
.
০৪.
এডওয়ার্ডের বিয়ের ঠিক তিন বছর পর, অগাস্টের এক সকালে আমার নামে একটা টেলিগ্রাম এল। দেখে আশ্চর্য হলাম– ওটা মেইন থেকে এসেছে। এডওয়ার্ডের থেকে গত দু-মাস সাক্ষাৎ বা ফোন কিছুই পাইনি। শুনেছিলাম যে, সে নাকি ব্যাবসার কাজে বাইরে গেছে– অ্যাসেনাথকে সঙ্গে নিয়ে। যদিও অতিরিক্ত কৌতূহলী লোকজন, যারা উঁকিঝুঁকি মেরে পরের হাঁড়ির খবর সংগ্রহে বিশেষজ্ঞ, তারা জানিয়েছিল যে, ডার্বিদের বাড়ির ওপরতলায়, পর্দার আড়ালে কেউ নাকি রয়েছে। কিন্তু সে যে কে, তা স্পষ্ট বোঝা যায়নি। চাকরবাকররাই নাকি বাজার-দোকান করছে।
টেলিগ্রামটা পড়ে চমকে গেলাম। চেজুনকুক-এর পুলিশ থানা থেকে খবর পাঠিয়েছেন খোদ হেড ইন্সপেক্টর। মেইন-এর জঙ্গল থেকে ছেঁড়া জামাকাপড়-পরা এক মূর্তিমান উন্মাদকে নাকি প্রলাপ-বকা অবস্থায় উদ্দেশ্যহীনভাবে চলতে-ফিরতে দেখা যায়। সে নাকি আমার নাম করে তাকে উদ্ধারের আরজি জানাচ্ছিল, তাই ইন্সপেক্টর বাধ্য হয়েই আমায় তার করে ব্যাপারটা জানায়।
চেজুনকুক গ্রামটি মেইন-এর সবচেয়ে দুর্গম জঙ্গল অধ্যুষিত জায়গা। সারাদিন গাড়ি চালিয়ে, প্রকৃতির সৌন্দর্য আস্বাদ করতে করতে শেষ পর্যন্ত সেখানে পৌঁছোনো গেল। গিয়ে দেখি, ডার্বিকে একটা খামারের ঘরে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। আমাকে দেখেই সে তড়বড় করে একগাদা কথা বলে গেল, যার বিন্দুবিসর্গও বুঝতে পারলাম না।
ড্যান– তুমি ভাবতে পারবে না–উফফ! ওটা সোগথের জায়গা! পাক্কা ছ-হাজার সিঁড়ি নীচে অন্ধকার, নিবিড় নিকষ অন্ধকার!! সেখানে থাকে–উহ্! কী বীভৎস! আমি, আমি কোনও দিন আমাকে এখানে আনতে দিইনি, কিন্তু ও-ও আমাকে সেই এনেই ছাড়ল। উফফ, কী হারামি মেয়েছেলে! বিশ্বাস করবে না, সেই পাথরের মূর্তিটা জীবন্ত হয়ে উঠল। এগিয়ে আসতে লাগল আমার দিকে। কারা যেন সব অদ্ভুত ভাষায় মন্ত্রোচ্চারণ করছিল। কী একটা নাম বারবার বলছিল, কামগ, কামগ। ওটা নাকি এপ্রাহিমের গুপ্তনাম। কয়েক মিনিট আগে আমি আমার বাড়ির লাইব্রেরিতে বসে ছিলাম, আর পরমুহূর্তেই কিনা এক পাতালের অন্ধকারে প্রবেশ করলাম। আমি জানি, ওই মেয়েছেলেটা আমার নশ্বর দেহটাকে নিজেই ওখানে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। কী ভয়ানক জায়গা, সে তুমি কল্পনাতেও আনতে পারবে না ড্যান– ওহ্! মনে হল যেন নরকের সমস্ত দ্বার আমার সামনে উন্মুক্ত হয়ে গেছে। অলৌকিক এবং অসম্ভব সব মিলেমিশে এক হয়ে গেছে ওই অন্ধকার গর্তের গভীরে। চোখের সামনে একটা সোগথকে নিজের অবয়ব বদলাতে দেখলাম। আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না কোনওমতে… দেখে নিয়ে, আর যদি আমার সঙ্গে এরকম বদমাইশি করে তাহলে আমি নিজে হাতে ওই শয়তান মাগিকে খুন করব। কিন্তু ড্যান আমি এখনও বুঝছি না যে, ওটা কী ছিল? অ্যাসেনাথ নাকি এপ্রাহিম নাকি নাকি… উফ, আমার সব গুলিয়ে যাচ্ছে ড্যান।
কোনওরকমে এডওয়ার্ডকে শান্ত করলাম। অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে তাকে ঘুম পাড়ানো গেল। পরের দিন সকালে একপ্রস্থ ভদ্র জামাকাপড় পরিয়ে ওকে নিয়ে ফিরে চললাম আর্কহ্যামে। কাল সারাদিন প্রলাপ বকে এডওয়ার্ডের মনের ভার কিছুটা লাঘব হয়েছে তাই সে আপাতত চুপচাপ বসে রইল আমার পাশে। গ্রামের গাছপালা, জঙ্গলের আলিঙ্গন পেরিয়ে যখন শহরের মধ্যে আমাদের গাড়ি ঢুকে পড়ল, এডওয়ার্ডের মুখখানা হঠাৎ কুঁচকে যেতে দেখলাম। যেন শহরের সান্নিধ্য ও আর সহ্য করতে পারছে না।
আমি অনুমান করলাম, স্ত্রী অ্যাসেনাথের সম্মোহনের প্রভাব ওর ওপর বেশ ভালোরকমই পড়েছে। সেটা কাটিয়ে উঠতে ও প্রাণান্তকর পরিশ্রম করলেও, ওই মহিলা যে বেশ উচ্চপর্যায়ের জাদুকর তা স্বীকার করতেই হয়। এডওয়ার্ড আমাকে বলেছিল, সে আর বাড়ি ফিরতে ইচ্ছুক নয়। আমিও মনে মনে সেটাই চাইছিলাম। ওকে আমাদের বাড়িতে ক-দিন নিয়ে রাখব। তার মধ্যে আশা করি, আমি ওদের ডিভোর্সের কাগজপত্র সব তৈরি করে নেব।
পোর্টল্যান্ড পেরিয়ে আসার পর এডওয়ার্ডের বিড়বিড়ানি বেড়ে গেল। গড়গড় করে অনেক কিছু বলে যাচ্ছিল সে। আমি ড্রাইভ করতে করতে চুপচাপ শুনতে লাগলাম আর বিস্মিত হলাম অ্যাসেনাথের ব্যাপারে কিছু কথা জেনে। মেয়েটি নাকি এডওয়ার্ডের ওপর এই আত্মাবিনিময়ের সম্মোহনপদ্ধতি অনেকদিন ধরেই চালাচ্ছে। মাঝেমধ্যেই সে এডওয়ার্ডের দেহধারী হয়ে চলে যায় কোন দূর দূর জায়গায়। অ্যাসেনাথ যখন এডওয়ার্ডের শরীরের মাধ্যমে বাইরে যায়, তখন সে নাকি এডওয়ার্ডের চেতনা বা আত্মাকে অসহায়ভাবে তার নিজের শরীরে বন্দি করে রেখে যায় নিজের বাড়িতে। তবে অ্যাসেনাথ নাকি বেশিক্ষণ তার দেহ ধারণ করে থাকতে পারে না। সম্ভবত সে কারণে অধিকাংশ সময়েই এডওয়ার্ড সংবিৎ ফিরে পাওয়ার পর নিজেকে আবিষ্কার করে বাড়ি থেকে বহু দূরে, ভয়াল, ভয়ংকর সব দুর্গম প্রদেশে কোন এক অজানা স্থানে, একাকী। সেসব জায়গা থেকে কয়েকবার নাকি সে বহু কষ্টে ফেরত এসেছে। কিন্তু এবারেরটা যেন সব কিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু আশঙ্কার কথা হল, অ্যাসেনাথের সম্মোহন এবং শরীর বদলানোর ক্ষমতা ক্রমশই বেড়ে চলেছে। আগে যতটা সময় সে এডওয়ার্ডের দেহের ওপর কবজা করতে পারত, এখন আরও বেশিক্ষণ পারে। অ্যাসেনাথ নাকি প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে একজন পুরুষ হওয়ার অন্তত এমন একজন পুরুষের শরীর ধারণ করার, যার মস্তিষ্ক ক্ষুরধার, কিন্তু আত্মবিশ্বাস তলানিতে। একদিন সে পুরোপুরি এডওয়ার্ডের শরীর নিয়ে কেটে পড়বে, আর এডওয়ার্ডকে রেখে যাবে অমানুষিক এক নারীদেহের মধ্যে বন্দি করে।
এডওয়ার্ড জানতে পেরেছে এক ভয়াবহ সত্য এপ্রাহিমের সুপ্ত বাসনা। এপ্রাহিম বরাবর চেয়ে এসেছে, যাতে সে অমর হয়, নশ্বর দেহকে ছাড়িয়ে সে তার চেতনাকে স্থানান্তরিত করতে পারে একের পর এক দেহে। অ্যাসেনাথ সফল হবেই- ইতিমধ্যেই একটা সফল পরীক্ষার ফলাফল সে নিজের চোখে দেখেছে…
এডওয়ার্ড ডার্বিকে আমি এবার পূর্ণদৃষ্টিতে দেখলাম। তার চেহারা বেশ খোলতাই হয়েছে এ ক-দিনে। পেশিবহুল মেদহীন শরীরটা পুরোনো থলথলে ডার্বির থেকে যথেষ্ট আলাদা। দেখলে বোঝাই যায়, ডার্বি এখন আর ঘরের কোনায় একাকী বসে চিন্তার ঊর্ণনাভ জাল বুনে সময় কাটায় না। সে কায়িক শ্রম করে বলা ভালো, করতে বাধ্য হয়। স্ত্রী নামক মালকিনের হুকুমে এবং সম্মোহনের বশে এডওয়ার্ড ছুটে বেড়ায় দিগ্বিদিকে, নিরন্তর, ক্লান্তিহীনভাবে। তবে শরীরের উন্নতি হলেও, তার মনের অবস্থা মোটেই সুবিধের নয়। স্ত্রী র সম্মোহন, এপ্রাহিমের কালাজাদু, অদ্ভুত সব রহস্য, সব মিলিয়ে তার মনে রীতিমতো জট পড়ে গিয়েছে।
এডওয়ার্ডের অসংলগ্ন কথাবার্তার মধ্যে জানতে পারছিলাম নিষিদ্ধ অকাল্ট চর্চার এক একজন গুপ্ত দেবদেবীর নাম। প্রাচীন লোককথা ও পুরাণের কাহিনি বিড়বিড় করে যাচ্ছিল এডওয়ার্ড হয়তো নিজেকে প্রস্তুত করছিল চূড়ান্ত কথাটা বলবার জন্য। সাহস জোগাচ্ছিল নিজেকেই।
ড্যান– তোমার মনে আছে এপ্রাহিমের সেই মুখটা? চোখে বন্য দৃষ্টি, মুখে এলোমেলো কাঁচা দাড়ি। একবার, একবার সে আমার দিকে তাকিয়েছিল–উফ, সেই দৃষ্টি ভোলবার নয়। অ্যাসেনাথ, এখন অ্যাসেনাথ আমার দিকে ওভাবে তাকায়। ঠিক সেই বন্য দৃষ্টি। আমি জানি, আমি জানতে পেরেছি। নেক্রোনমিকনের একটা পাতায় এই ভয়াবহ সংকেত লিপিবদ্ধ রয়েছে। তোমাকে পাতার নম্বরটা বলে দিলে তুমি নিজেই দেখে নিতে পারবে ড্যান। আর তখনই বুঝবে, কী অশুভ জিনিস আমাকে গ্রাস করেছে। দেহ থেকে দেহান্তর –অর্থাৎ, মৃত্যুহীন চেতনা। শরীরের মরণ হলেও যে তাতে কীভাবে নিজের চেতনাকে জিইয়ে রাখা যায়, সেই সূত্র ও জানত।
ড্যান, তুমি অ্যাসেনাথের হাতের লেখা দেখেছ? আমি জানি, আমি ওকে তাড়াহুড়োতে লিখতে দেখেছি। কীরকম অদ্ভুত একটা টান উলটোদিকে আঁচড় দিয়ে দিয়ে লেখা। প্রথমে আমি বুঝতে পারিনি কিন্তু পরে যখন আমি এপ্রাহিমের পাণ্ডুলিপি দেখি, পুরো ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে যায় আমার কাছে। সেই এক ছাঁচে লেখা, এক আঁচড়ের টান।
…অ্যাসেনাথ–আমার সন্দেহ হয়, সত্যিই এই নামে কারও অস্তিত্ব রয়েছে কি না?? আমার মনে অনেক প্রশ্ন আছে, ড্যান। যেমন ধরো, এপ্রাহিমের পাকস্থলীতে বিষ পাওয়া গিয়েছিল কেন? ইন্সমাউথে ওয়াইটদের ওই বাড়ির চিলেকোঠায় বিশেষভাবে তৈরি প্যাডেড রুমে তালা মারা ছিল কেন? কাকে সেখানে বন্দি করে রাখা হয়েছিল? কেন এপ্রাহিম বারবার নিজেকে অভিসম্পাত দিত তার একটা ছেলে নেই বলে? ওই নরকের জীবটা অভিশপ্ত বাড়িতে বসে কী এমন ভয়ানক ক্রিয়াকলাপ করেছিল, যার ফলে হয়তো সে অ্যাসেনাথের শরীর সারাজীবনের জন্য দখল করে নিতে পেরেছে? আমি জানি, সে প্রাণপণ চেষ্টায় আছে আমার শরীরটা দখল নেওয়ার কারণ তার একমাত্র বাসনা ছিল উন্নতমস্তিষ্ক কিন্তু দুর্বলহৃদয় এক পুরুষের। বলতে পারো, কী কারণে অ্যাসেনাথ নামের ওই জীবটা হুবহু এপ্রাহিমের ভঙ্গিতে লেখে? কী কারণে..।
আচমকা এডওয়ার্ড চুপ করে গেল। যেন কেউ সুইচ টিপে কলের গান বন্ধ করে দিল– এমনিভাবে। আমাদের বাড়িতেও কয়েকদিন আগে এডওয়ার্ড যখন আসত, গল্প করত– তখনও মাঝে মাঝে এরকম আচমকা চুপ হয়ে গেছে সে। আমি ভাবতাম এ ওর আত্মবিশ্বাসের অভাব। মাঝেমধ্যে মনে হত যে, অ্যাসেনাথ হয়তো দূর থেকে সম্মোহন করে ওকে চুপ করিয়ে রাখছে। কিন্তু এবারে যা দেখলাম, তাতে বিস্ময়ে, ভয় বারুদ্ধ হয়ে গেল।
আমার পাশে বসে-থাকা এডওয়ার্ডের মুখটা হঠাৎ কুঁচকে বিকৃত হয়ে গেল। তার সারা শরীরে একটা প্রবল খিচুনি হতে লাগল, যেন শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, হাড়, পেশি সব নিজের জায়গা বদল করে আলাদাভাবে সজ্জিত হচ্ছে। আতঙ্কে আমার শরীর থেকে কুলকুল করে ঘাম ঝরতে লাগল। দেখতে পেলাম, আমি যাকে এডওয়ার্ড বলে চিনি বা চিনতাম, তার জায়গা নিয়েছে এক নতুন কেউ। এইমাত্র যেন কোনও ভিনগ্রহীর আক্রমণে আমার বন্ধুর শরীরটা বেদখল হয়ে কোনও অশুভ মহাজাগতিক শক্তির কুক্ষিগত হয়ে পড়ল। চেহারায়, মুখের আদলে আমূল পরিবর্তন এসে সম্পূর্ণ নতুন কেউ, আমার ঠিক পাশে এডওয়ার্ডের জায়গায় বসে রয়েছে। এই নতুন মূর্তির আকৃতি ও প্রকৃতি অদ্ভুত ভয়ংকর। ব্যাপারটা প্রত্যক্ষ করে আমার সারা অঙ্গ কাঁপতে লাগল– সেই সঙ্গে কাঁপতে লাগল আমার হাতে ধরে-থাকা গাড়ির স্টিয়ারিং। দুর্ঘটনা ঘটেই যেত, যদি না সেই নতুন অতিথি শক্ত হাতে আমার গাড়ির স্টিয়ারিং হুইলটা চেপে ধরত।
আমরা জায়গা বদলাবদলি করে নিলাম। ভালোই করলাম, কারণ এই অবস্থায় গাড়ি চালানো আত্মহত্যার শামিল। সন্ধের অন্ধকার ততক্ষণে বেশ ঘনিয়ে এসেছে। পোর্টল্যান্ড পেরিয়ে আমরা অনেকটা দূর চলে এসেছি। রাস্তার আলো কমে যাওয়ায়, আগন্তুকের মুখটা ভালো করে দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল না আমার। কিন্তু তার চোখ দিয়ে যে জ্বলজ্বলে জ্যোতি বেরিয়ে আসছিল, সেটা ভুল হবার নয়। বুঝলাম এটা এডওয়ার্ডের সেই অদ্ভুত শক্তিশালী সত্তা, যার সঙ্গে আমার চেনাজানা এডওয়ার্ডের বিন্দুমাত্র মিল নেই। এডওয়ার্ড, যে গাড়ি চালাতেই জানে না, সে শক্ত হাতে আমার থেকে গাড়ির স্টিয়ারিং কেড়ে নেবে– এটা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারি না। যা-ই হোক, পাশে বসা মূর্তিটা চুপচাপ ড্রাইভ করে যেতে লাগল, আর আমিও মনে মনে ভগবানকে ডাকতে লাগলাম।
শহরের নিকটবর্তী হতে-না-হতেই অন্ধকার ছিঁড়ে আলো এসে ধুয়ে দিয়ে গেল গাড়ির ভেতরটা। আর সেই আলোতে দেখতে পেলাম মূর্তিমানকে। চরম আতঙ্কে দেখলাম, ডার্বির ব্যাপারে লোকজনের কানাঘুষো কিছু মিথ্যে নয়। সত্যিই একে অনেকটা এপ্রাহিমের মতোই দেখতে। ব্যাপারটা যে কী ভয়ানক, সেটা বোঝাতে পারব না। এরকম চমকের জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। হয়তো ডার্বির মুখ থেকে এতক্ষণ ধরে অর্থহীন প্রলাপ শোনার ফলেও আমার এই অবস্থা হতে পারে, কিন্তু আমি দিব্যি গেলে বলতে পারি, আমার পাশে বসে যে গাড়িটা চালাচ্ছে, সে এডওয়ার্ড পিকম্যান ডার্বি নয়, এবং কস্মিনকালেও ছিলও না। এ যেন পাতালের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে-আসা কোনও মূর্তিমান প্রেতাত্মা!
শহর ছাড়িয়ে আবার অন্ধকার রাস্তায় না-পড়া পর্যন্ত মূর্তিটা কোনও কথা বলল না। তারপর যখন সে কথা বলা শুরু করল, তখন সেই গলা শুনেও আমার পিলে চমকে গেল। সম্পূর্ণ আলাদা কণ্ঠস্বর গভীর, দৃঢ় অথচ প্রত্যয়ী। একটা অদ্ভুত ব্যক্তিত্বপূর্ণ আভিজাত্য আছে সেই কণ্ঠস্বরে, যা কমবয়সি এডওয়ার্ডের কথাবার্তায় কখনও ধরা পড়েনি। উচ্চারণভঙ্গিমা, বলার ধরন পুরোপুরি আলাদা হলেও, কেমন যেন অস্বস্তি হতে লাগল আমার। কিছু যেন মিলছে না, কিন্তু সেটা যে কী, তা তখন মাথায় এল না।
কণ্ঠস্বর বলে চলল, কিছুক্ষণ আগের আমার নাৰ্ভ ব্রেকডাউনটা তুমি নিশ্চয়ই ভুলে যাবে আপটন। তুমি তো জানো আমার স্নায়ু দুর্বল– আর এ ব্যাপারটা প্রায়ই হয়ে থাকে, তাই অস্বাভাবিক কিছু না। তবে আমাকে বাড়ি পৌঁছোতে সাহায্য করার জন্য আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ।
আর-একটা কথা, আমি আমার স্ত্রী অথবা অন্য ব্যাপারে যা কিছু উলটোপালটা বলেছি, ভুলে যাও। জানোই তো আমার পড়াশোনার বিষয়টা একটু অন্যরকম। এসব নিয়ে সারাক্ষণ নাড়াঘাঁটা করলে মস্তিষ্ক উত্তেজিত হয়ে ওঠে। তাই আপাতত আমি ক-দিন বিশ্রাম নিতে মনস্থ করেছি। হয়তো মাসখানেক আমাকে তুমি দেখতে পাবে না। তাই বলে আবার অ্যাসেনাথকে দোষারোপ করতে যেয়ো না।
আপটন, আমার এবারের যাত্রার জায়গাটা একটু অদ্ভুত ঠিকই, তবে খুব অস্বাভাবিক কিছু না। উত্তরের বনে বেশ কিছু পুরোনো রেড ইন্ডিয়ান সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ লুকিয়ে রয়েছে আগাছার আড়ালে। এসবের মধ্যেই তো জমে থাকে ছায়াঘেরা কিংবদন্তি, নানারকম লোককথা। অ্যাসেনাথ আর আমি এটার অনেকদিন ধরেই খোঁজ করছিলাম। কিন্তু জিনিসটা নিয়ে পড়ে থাকতে থাকতে আমি এতটাই মগ্ন হয়ে গিয়েছিলাম, যে চারপাশের পৃথিবীর অস্তিত্ব প্রায় ভুলতে বসেছিলাম। যা-ই হোক, আমার গাড়িটাকে ওখান থেকে আনার জন্য আবার কাউকে পাঠাতে হবে মুশকিল আর কী।
আমার সহযাত্রীর বক্তব্যের মাঝে আমি আদৌ কিছু বলতে পেরেছিলাম কি না, এখন মনে পড়ছে না। তবে হ্যাঁ, চাক্ষুষ করা ঘটনার সম্পূর্ণ উলটো ব্যাখ্যা শুনে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম ভালোমতন। ওই চেহারা আর ভিন্ন কণ্ঠস্বরের আওয়াজে আমি আতঙ্কে এতটাই সিঁটিয়ে ছিলাম যে, বারবার মনে হচ্ছিল, এটাই হয়তো আমার শেষযাত্রা! ভয়ে দিশেহারা হয়ে চিন্তাভাবনার স্বাভাবিক গতি হারিয়ে ফেলেছিলাম আমি। ডার্বি গাড়িটা ঝড়ের বেগে পোর্টসমাউথ পার করে নিয়ে চলল– আর আমি ভাগ্যের হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে এলিয়ে বসে রইলাম ওর পাশের সিটে।
গাড়িটা যখন আকামের প্রবেশমুখে চলে এল, আমি সভয়ে দেখলাম, সামনে রয়েছে সেই অভিশপ্ত মোড়– যার বাঁয়ে ঘুরলে একটা অন্ধকার রাস্তা সোজা চলে গেছে রহস্যময় ইন্সমাউথের দিকে। আমার বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল আমার সহযাত্রী যদি গাড়িটা ওই রাস্তায় নিয়ে তোলে, তাহলে নিশ্চিতভাবেই আমি কাল আর দিনের আলো দেখতে পাব না। ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল বলতে হবে, ইন্সমাউথের রাস্তা না ধরে, ডার্বি তীব্রবেগে গাড়িটা শহরের মধ্যে দিয়েই ছুটিয়ে নিয়ে চলল আমাদের গন্তব্যের দিকে। মধ্যযামের সামান্য আগে ওল্ড ক্রাউনিংশিল্ডের সামনে গাড়ি যখন থামল, তখনও ঘরে আলো জ্বলছে। ডার্বি প্রচুর কৃতজ্ঞতা এবং ধন্যবাদে আমাকে ভরিয়ে দিয়ে দ্রুতপায়ে বাড়ির মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমিও স্টিয়ারিং চেপে গুটিগুটি ঘরে ফিরে এলাম। সত্যি, একটা দিন কাটল বটে! এই প্রথম ডার্বির আগাম অনুপস্থিতির খবরে আমার কোনও দুঃখ বা উদ্বেগ হল না, উলটে যেন বেশ খানিকটা নিশ্চিন্ত বোধ করলাম।
.
০৫.
পরের দু-মাস এডওয়ার্ডের ব্যাপারে কেবল কানাঘুষো শুনেই কেটে গেল। লোকে নাকি ওকে বেশির ভাগ সময়েই এদিক-ওদিক ছুটে বেড়াতে দেখেছে। চির-অলস এডওয়ার্ডের শরীরে এখন উদ্দীপনার অবধি নেই। অ্যাসেনাথ নাকি মোটামুটি পর্দানশিন হয়ে পড়েছে– খুব একটা বেরোতে দেখাই যায় না। এর মধ্যে এডওয়ার্ড একদিনই আমার বাড়ি এসেছিল, কয়েকটা বই ফেরত দিতে। অ্যাসেনাথের গাড়িটা দেখে বুঝলাম, সেটিকে মেইন-এর জঙ্গল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। তবে আমার বাড়িতে এলেও, সে বেশিক্ষণ ছিল না। খুব লৌকিকতা করে দু-চারটে মধুর বচন শুনিয়ে দ্রুত বিদায় নিল। যাবার সময় কায়দা করে বিদায়সম্ভাষণটুকুও জানাতে ভুলল না। এসবই ঠিক ছিল, কিন্তু একটা খটকা কিছুতেই গেল না।
প্রতিবার আমার বাড়ির দরজায় এসে সে যেভাবে তিন-দুই কোডে ডোর বেল বাজাত, সেটা এবার বাজল না।
কেমন যেন একটা নিঃসীম আতঙ্কে আমার মন পূর্ণ হয়ে গেল। মনে মনে ভাবলাম, যাক, তাড়াতাড়ি বিদেয় হয়ে বাঁচাই গেছে।
সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি, ডার্বি সপ্তাহ দুয়েকের জন্য কোথায় একটা গেল। শুনলাম, আর্কহ্যামের বসবাসরত এক প্রাক্তন তান্ত্রিকের১৮৬ সঙ্গে নাকি তার বেশ গাঢ় সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তার ইতিহাস মোটেই সাধারণ নয়। শয়তানের বাড়ি একটি। ইংল্যান্ড থেকে বিতাড়িত হয়ে সেই তান্ত্রিক এখন আমেরিকার নিউ ইয়র্ক শহরে বাস করে। যা-ই হোক, সে দিনের মেইন থেকে ফেরার সময়কার ঘটনাটা তখনও আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছিল। বারবার ভেবেও জিনিসটার ব্যাখ্যা খুঁজে না পেয়ে রীতিমতো অস্বস্তি হতে শুরু হল– আর তার সঙ্গে ছিল এক চোরা আতঙ্ক।
এর মধ্যে একটা আশ্চর্য খবর শুনলাম, ওল্ড ক্রাউনিংশিল্ডের ডার্বিদের বাড়িতে নাকি রাতের বেলা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ শোনা যায়। মেয়েদের গলার কান্না লোকজন বলল নাকি অ্যাসেনাথের গলা। কান্নার শব্দটা নাকি হঠাৎ হঠাৎ শোনা যায়– আবার নাকি আচমকা থেমেও যায়। যেন কেউ ক্রন্দনরতার মুখ চেপে তার কান্নাটা জোর করে থামিয়ে দেয়। অনেকে নাকি পুলিশে খবর দেওয়ার তোড়জোড়ও করছিল, কিন্তু তার আগেই অ্যাসেনাথ হঠাৎ একদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে এমনভাবে বাজার-দোকান করতে শুরু করল যেন কিছুই হয়নি। লোকজনের সঙ্গেও কথাবার্তা বলতে লাগল স্বাভাবিকভাবে। শোনা গেল, বস্টন থেকে তার বাড়িতে নাকি কোনও এক আত্মীয় এসেছে, তার ফিটের ব্যামো আছে। মাঝেমধ্যেই সেই মহিলার খিচুনি হয় আর তাই কান্নাকাটির শব্দ শোনা যেত।
অ্যাসেনাথের কথার ওপর কথা চলে না। সেই আত্মীয়কে অবশ্য কেউ চোখে দেখল না –তবে কে নাকি বলল, ক্রাউনিংশিল্ডের বাড়ি থেকে ভেসে-আসা বামাকন্ঠী কান্নার আওয়াজের পাশাপাশি মাঝে মাঝে নাকি পুরুষের গলার কান্নাও শোনা যেত।
রহস্য আরও ঘনীভূত হয়ে উঠল।
.
অক্টোবরের মাঝামাঝি নাগাদ একদিন আমার বাড়ির দরজায় ঘণ্টী শোনা গেল সেই পরিচিত তিন-দুই আওয়াজ। আমি লাফিয়ে উঠে দরজা খুলে দিলাম। চৌকাঠের ওপাশ থেকে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে সেই পুরোনো এডওয়ার্ড সেই অভিশপ্ত রাত্রির পর যাকে আমি আর দেখতে পাইনি। এডওয়ার্ডের মুখে খেলা করছে যুগপৎ ভয় ও সাফল্যের আনন্দ৷ ওকে তাড়াতাড়ি ঘরে ডেকে এনে বসালাম।
একটু হুইস্কি মিলবে ড্যান? ঘরে ঢুকে প্রথমেই বলল এডওয়ার্ড। আমি বিনা বাক্যব্যয়ে তার গ্লাস পূর্ণ করে দিলাম আর ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে লাগলাম সেই মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য, যখন সে নিজের থেকে কথা শুরু করবে।
অ্যাসেনাথ বিদেয় হয়েছে ড্যান। কাল রাত্রে চাকরবাকরগুলো বেরিয়ে যাওয়ার পর হেব্বি ঝগড়া হয়েছে আমাদের মধ্যে। আমি ওকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছি যেন আমাকে আর এইভাবে উত্ত্যক্ত না করে। ওর সঙ্গে থাকা আর সম্ভব নয়। আমারও কিছু ক্ষমতা আছে, ড্যান- তোমাকে এত কথা যদিও আগে বলিনি আমি। ওই ক্ষমতা আমি অনেক চর্চায় আয়ত্ত করেছিলাম। সেই দিয়ে ওর জাদুকে কেটে আমি ওকে আত্মসমর্পণ করাতে বাধ্য করলাম। আমার প্রতিরোধে রাগে ওর মুখ-চোখ লাল হয়ে গেল। কী বিড়বিড় করতে করতে নিজেই সব গুছিয়ে নিল। তারপর তড়বড় করে বেরিয়ে গেল সেই ভরসন্ধেবেলাতেই ট্রেন ধরে বস্টন থেকে নিউ ইয়র্কের দিকে রওনা দেবে বলে। লোকে অবশ্য ঠারেঠোরে অনেক কিছু রটাবে, কিন্তু আমি নাচার। তোমাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, বলে দেবে, একটা রিসার্চের কাজে অ্যাসেনাথ বাইরে গেছে।
আমার বিশ্বাস, নিউ ইয়র্কে গিয়ে কোনও এক গোপন তান্ত্রিক দলের সঙ্গে যোগ দেবে সে। তারপর আরও পশ্চিমের দিকে চলে যাবে। হয়তো সেখান থেকেই ডিভোর্স দেবে আমায়। যাক গে, আপদ বিদেয়! উফ, ড্যান– জানো না কী দুঃস্বপ্নের মতো কেটেছে আমার এ ক-দিন। আমার দেহ চুরি করে, আমাকেই নিজের দেহে বন্দি বানিয়ে রাখত ওই মাগিটা। আমিও তক্কে তক্কে ছিলাম– সঠিক সময়ের অপেক্ষায়। ওকে বুঝতেই দিইনি আমার মনে কী চলছে– কতটা ঘৃণা জমে রয়েছে সেখানে। ও আমাকে খুব অসহায় ভেবে নিয়েছিল কিন্তু আমারও দু-চারটে বিদ্যা যে জানা আছে, সেটা বুঝতে পারেনি ডাইনিটা।
সতর্ক দৃষ্টিতে চারদিকে দেখে নিয়ে ডার্বি আবার শুরু করল, ওর পেয়ারের চাকরগুলো সকালে কাজে এসে ডাইনিটাকে না দেখে আমাকে রীতিমতো জেরা করতে শুরু করে দিয়েছিল। টাকা মিটিয়ে দিয়ে ব্যাটাদের বিদেয় করলাম। অ্যাসেনাথের বাপের বাড়ির উন্মাদের দল– সব কটাকে তাড়িয়েছি। হতচ্ছাড়াগুলো কেমন হাসতে হাসতে চলে গেল। –যেন খুব একটা কৌতুকের ব্যাপার!!! আমি দ্রুত বাবার পুরোনো চাকরবাকরদের ডেকে নিয়ে একত্র করলাম। এবার ওই হানাবাড়ি ছেড়ে নিজের পৈতৃক বাড়িতেই ফিরে যাব।
তুমি আমাকে হয়তো উন্মাদ ভাবছ, ড্যান। তবে বিশ্বাস করো, আমি যা বলছি, তার বর্ণে বর্ণে সত্যি। আর্কহ্যামের প্রাচীন ইতিহাস যদি তুমি পড়তে, এখানে ঘটে-যাওয়া রহস্যময় ঘটনা সম্পর্কে যদি তোমার ধারণা থাকত, তাহলে হয়তো তোমার বিশ্বাসে জোর আসত৷ যা-ই হোক, সে দিন রাতের ঘটনা হয়তো তুমি বিস্মৃত হওনি৷ অ্যাসেনাথের ভয়ানক কার্যকলাপের ব্যাপারে বলার সময়েই ওর আত্মা এসে আমার চেতনাকে দখল করে নেয়, আর আমি নিজেকে আবিষ্কার করি আমার বাড়ির লাইব্রেরিতে। ওই জাদুকরির দেহের মধ্যে বন্দি অবস্থায়। আমাকে পাহারা দিচ্ছিল অ্যাসেনাথের ওইসব চাকরবাকরের দল, যাতে আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোনও কাণ্ড না ঘটাতে পারি।
ওটা কি মানুষের শরীর, ড্যান? উফ– কী ক্লেদাক্ত ঘিনঘিনে সেই শরীর। আর ড্যান, সে রাতে তুমি নিশ্চয়ই ওই ডাইনিটার সঙ্গে পাশাপাশি গাড়িতে চড়ে এসেছ। নিশ্চই পার্থক্যটা বুঝতে পেরেছ…
নিজের অজান্তেই কেমন যেন কেঁপে উঠলাম সেই রাতের কথাটা মনে করে। ব্যাপারটা মনের ভুল ভেবেই এত দিন নিজেকে প্রবোধ দিয়ে এসেছি আমি কিন্তু এ কী বলছে ডার্বি! আমার বিস্ময় আর আতঙ্কের বুঝি তখনও কিছু বাকি ছিল। এডওয়ার্ড বলে চলল স্থলিত স্বরে, নিজেকে বাঁচাতেই হত, ড্যান। আমি শুনে ফেলেছিলাম যে, আমার শরীরটা পাকাপাকিভাবে দখল করে নেওয়ার ফন্দি কষেছে অ্যাসেনাথ। হালউইনের পরের দিনই, চেসুনকুক১৮৭ থেকে খানিক দূরে তান্ত্রিকদের এক গোপন সমাবেশ ডাকা হয়েছিল। আর সেই সমাবেশেই.. আমার শরীর চিরজীবনের জন্য হয়ে যেত অ্যাসেনাথের, আর তার শরীরে জোর করে প্রবেশ করানো হত আমাকে। তারপর কিছু একটা করে, অ্যাসেনাথরূপী এডওয়ার্ডকে হয়তো বিষ খাইয়েই যমের বাড়ি পাঠিয়ে দিত ওই ডাইনিটা –বা সেই শয়তানটা।
চরম বিতৃষ্ণায় এডওয়ার্ডের মুখটা কুঁচকে ছোট হয়ে গেল। জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে আমার সামনে অনেকটা ঝুঁকে এসে প্রায় ফিশফিশিয়ে বলল, তুমি জানো না, ড্যান, আমি জানি। আমি জানি, অ্যাসেনাথের শরীর পাকাপাকিভাবে দখল নিয়েছে ওই শয়তান এপ্রাহিম। এপ্রাহিম বেঁচে থাকতে চেয়েছিল আজন্মকাল ওর বাসনা ছিল অমর হবার। তাই যখন ও বুঝল যে তার নশ্বর দেহের মরণ নিকটেই, তখন সে খুঁজে নিল এমন এক শরীর, যা আমারই মতো, অর্থাৎ তুখোড় মস্তিষ্কসম্পন্ন অথচ ইচ্ছাশক্তি দুর্বল। অ্যাসেনাথের শরীরে বাসা বেঁধে সে অ্যাসেনাথের আত্মাকে স্থানান্তরিত করল তার প্রাচীন জরাগ্রস্ত দেহে৷ বিষ খাইয়ে মারল তাকে অবশ্য তার আগে বন্দি বানিয়ে তাকে রেখে দিয়েছিল ইন্সমাউথের বাড়ির চিলেকোঠার ছাদের ঘরে। তাই সেখান থেকে দিনের পর দিন ভেসে আসত অসহায় এপ্রাহিমরূপী অ্যাসেনাথের বিলাপ ককিয়ে ককিয়ে।
ডার্বির গলা ধরে এল, ড্যান আমি দেখেছি এপ্রাহিমকে। অ্যাসেনাথের ওই বড় বড় তীব্র চোখের দৃষ্টিতে দেখেছি, ওর হাতের লেখার মধ্যে দেখেছি। ওকে এমন সব কথাবার্তা আমি বলতে শুনেছি, যা কেবল বিটকেল বুড়োরাই বলতে পারে। আমি বলছি, ড্যান অ্যাসেনাথের আর অস্তিত্ব নেই। আছে ওই শয়তান, নরকের কীটটা।
এতটা একটানা বলার পর এডওয়ার্ড কিছুটা শান্ত হল। গলার স্বর আবার আগের অবস্থায় ফিরে এল তার। বুঝলাম, ছেলেটার ওপর বিশ্রীরকম ধকল গেছে। যদিও তাকে একবার মনোবিদের কাছে নিয়ে যাওয়ার চিন্তা আমার মনে উঁকি দিয়েছিল, কিন্তু আমি সেরকম কিছু করতে উদ্যোগী হলাম না। আমার স্থির বিশ্বাস ছিল, ক-দিন নিঃসঙ্গ, নিরবচ্ছিন্ন বিশ্রাম নিলেই ডার্বির এই অবস্থার উন্নতি ঘটবে। তবে এই ধাক্কায় হয়তো তার এইসব কালাজাদুচর্চা একটু হলেও কমতে পারে।
আমি তোমাকে পরে আরও কথা বলব, তবে আমার এখন একটু বিশ্রাম চাই, শ্রান্ত গলায় বলল ডার্বি, ড্যান, এগুলো অতি পুরাতন কিন্তু বীভৎস ধরনের গুপ্তবিদ্যা। এর সাধকও গুটিকয়েক– তারাও বিশ্বের কোনও কোনায় হয়তো ছড়িয়ে রয়েছে। এ পৃথিবী রহস্যময়ী, তার সব রহস্য কেউ জানে না, কারও জানতে পারার কথাও নয়। আর এসব গূঢ় রহস্যের কিয়দংশও পৃথিবীর ভারসাম্য নষ্ট করে দিতে পারে। আমি নিজে এই ভয়ানক বিদ্যাকে খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছি। আমি যদি মিসকাটনিকের লাইব্রেরিয়ান হতাম, তাহলে আমি আজই ওই অভিশপ্ত নেক্রোনমিকন আর বাকি ওই ধরনের যত বই আছে, সব পুড়িয়ে ধ্বংস করে ফেলতাম।
আমি বুঝলাম, এডওয়ার্ডের আজ আর বাড়ি ফেরা হবে না।
এডওয়ার্ড বিড়বিড় করতে লাগল, খুব শিগগিরি ওই বাড়ি ছেড়ে আমি আমার নিজের বাড়িতে গিয়ে উঠব। এই হতচ্ছাড়া চাকরগুলোকে তাড়িয়ে পুরোনো লোকজনকে আনব। ড্যান, তুমি আমাকে সাহায্য করবে না? বলো? যদি কেউ অ্যাসেনাথের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে, তাকে তুমি সামলে নেবে তো? জানোই তো, এত লোকজন আমাদের ব্যাপারে জানে আমাদের বিচ্ছেদটা বেশি জানাজানি হলে সমাজে মুখ দেখাতে পারব না।
সে রাতটা আমার বাড়ির গেস্টরুমে কাটিয়ে, পরের দিন সকালে ডার্বিকে বেশ চাঙ্গা লাগল। ব্রেকফাস্টের টেবিলে দু-জনে আলোচনা করলাম, কীভাবে পুরোনো ডার্বি ম্যানসনকে সারিয়ে তুলে তাতে দ্রুত থাকার ব্যবস্থা করা যায়। বুঝলাম, ডার্বি আর তিলমাত্র সময় নষ্ট করতে রাজি নয়।
পরের দিন থেকে ডার্বির ব্যস্ততা তুঙ্গে উঠে গেল। তবে মাঝে মাঝেই সে আমাদের বাড়িতে এসে আড্ডা দিয়ে যেত আমার সঙ্গে, সেই পুরোনো এডওয়ার্ডের মতোই। আমরা ওইসব গুহ্যবিদ্যার মন্ত্র নিয়ে আলোচনাই করতাম না– বিভিন্ন দরকারি কাজের ব্যাপারে কথা হত। ঠিক হল, সব মিটে গেলে সামনের গরমের ছুটিতে কয়েক দিনের জন্য বেড়িয়ে আসা যাবে আমার ডার্বি জুনিয়রকে সঙ্গে নিয়ে।
অ্যাসেনাথের ব্যাপারে আমরা আর উচ্চবাচ্য করিনি। কিন্তু হলে কী হবে, গুজব দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। সেটাও নয় সহ্য হত, কিন্তু ডার্বির একটা ব্যাপার আমার পছন্দ হল না। ক-দিন আগে মিসকাটনিকের এক সমাবর্তনে গিয়েছিলাম। সেখানে আর্কহ্যামের ব্যাঙ্ক ম্যানেজার একটু বেশিই পান করে আমার সামনে একটি অদ্ভুত তথ্য উগরে দেন।
মোজেস, অ্যাবিগেল সার্জেন্ট আর ইউনিস ব্যাবসনের নামে নাকি প্রতি মাসেই একটা মোটা অঙ্কের চেক ডার্বি পাঠিয়ে থাকে ইন্সমাউথের ঠিকানায়। ওল্ড ক্রাউনিংফিল্ডের অভিশপ্ত বাড়ির বিতাড়িত চাকরাকরদের প্রতি ডার্বির কীসের টান, সেটা বুঝতে পারলাম না। ডার্বি আমাকে ব্যাপারটা জানায়ওনি। আরও একটা খটকা রয়ে গেল। ওল্ড ক্রাউনিংশিল্ডের অনেক রহস্যের সঙ্গে যুক্ত হল আরও একটি রহস্য।
আমি চাইছিলাম, গরমের ছুটিটা দ্রুত আসুক, যাতে এডওয়ার্ডকে এই শহরের বিষাক্ত পরিবেশ থেকে কয়েক দিনের জন্য বের করে নিতে পারি। কিন্তু যতটা সহজে সে আরোগ্য পাবে ভেবেছিলাম, ব্যাপারটা ততটা সহজ হচ্ছিল না। এডওয়ার্ডের পৈতৃক ম্যানসনের মেরামতি ডিসেম্বরের মধ্যে হয়ে গেলেও, সে ঠিক সুস্থির হতে পারল না। কোনও এক অজ্ঞাত কারণে, ওল্ড ক্রাউনিংফিডল্ডের বাড়িটাকে গুঁড়িয়ে দেবার দিনক্ষণ পেছোতে লাগল সে। যেন কী একটা অস্থিরতা গ্রাস করেছে এডওয়ার্ডকে। তার ছটফটানি দিন দিন বেড়ে যেতে লাগল। যদিও সে ওই বাড়িটায় থাকত না বা ওখানে আর থাকার তার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না, তবুও বাড়িটা যেন কী এক অমোঘ আকর্ষণে এডওয়ার্ডকে রোজ টানতে থাকল।
এডওয়ার্ডের বাপের আমলের যে খানসামা, তার সঙ্গে দেখা করে খবর জানতে চাইলাম। সে জানাল, এডওয়ার্ডের অবস্থার বিশেষ উন্নতি নেই। একা একা লাইব্রেরিতে সারাক্ষণ ছটফট করে বেড়ায় সে। আমি ভাবলাম, অ্যাসেনাথ হয়তো তাকে ভুলভাল চিঠিপত্র লিখছে, যার ফলে সে মানসিকভাবে উত্তেজিত হয়ে পড়ছে।
কিন্তু খানসামা জানাল, এরকম কোনও চিঠি এডওয়ার্ডের নামে আসেনি– অন্তত এ বাড়িতে ফিরে আসার পর থেকে তো নয়ই।
.
০৬.
ক্রিসমাসের সময়ের একদিনের কথা। এডওয়ার্ড তখন আমার বাড়িতে প্রায় প্রতিদিনই আসে। সে দিনও সন্ধেটা আমার ঘরে বসে আগামী গরমের ছুটির ব্যাপারেই আলোচনা হচ্ছিল। আচমকা এডওয়ার্ড লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। তার মুখ ভয়ে সাদা হয়ে গেছে বিষম আতঙ্কে চোখ বিস্ফারিত। যেন সে জেগে জেগেই ভয়ানক কোনও দুঃস্বপ্ন দেখছে।
আমার মগজ… ড্যান– কেউ যেন টানছে, পেছন থেকে টানছে। তাকে আঁচড়াচ্ছে, খাবলাচ্ছে। ওই ডাইনিটা, ওই ওই শয়তান এপ্রাহিমের কাজ এটা। কামগ– কামগ!! মহান সোগথ, সোগথের গহ্বর- ইয়াআ– সাব নিগুরাথ! সহস্র তারুণ্যের নিয়ন্ত্রক অজ!! আগুন আগুন। লেলিহান আগুনের শিখা– দেহহীন, মৃত্যুহীন। এই তো, এখানেই, এই ধরিত্রীতেই… ডার্বি চিৎকার করে উঠল।
আবার শুরু হল!! ডার্বিকে হাত ধরে বসালাম। জোর করে গিলিয়ে দিলাম খানিক হুইস্কি। চরম ঔদাসীন্যে খানিকক্ষণ শূন্যদৃষ্টিতে চেয়ে রইল সে। তারপর আবার বিড়বিড় করতে লাগল নিজের মনে।
আবার আবার সে চেষ্টা করেই যাচ্ছে, করেই যাচ্ছে। আমার বোঝা উচিত ছিল আগেই– এ জিনিস বন্ধ হওয়ার নয়। কিছু দিয়েই নয়– না দূরত্ব, না জাদু, না মৃত্যু, কেউই আমার এই অভিশপ্ত ভবিতব্যকে আটকাতে পারবে না। এরা আসে, শুধুমাত্র রাতেই আসে হানা দেয় নিঃশব্দে। আমি, আমি পালাতে পারব না, ড্যান। উফফ কী ভয়ানক, কী বীভৎস। ড্যান, আমি বোঝাতে পারব না…
চেয়ার থেকে উঠতে গিয়ে হোঁচট খেল ডার্বি, আর কেমন যেন অসাড় হয়ে গেল। পতনোন্মুখ ডার্বিকে জাপটে ধরে আমার ঘরে শুইয়ে দিলাম। প্রথমে ভাবলাম, ডাক্তার ডাকব, কিন্তু পরে বুঝলাম, ডাক্তার এলেই ডার্বির মানসিক ভারসাম্য নিয়ে প্রশ্ন উঠে যেতে পারে। দেখাই যাক-না– নিজে থেকে ঠিক হয় কি না। এতশত ভেবে আমিও শুতে গেলাম।
সকাল উঠে দেখি, ডার্বি খুব ভোরেই বেরিয়ে গেছে নিঃশব্দে। ওর খানসামাকে ফোন করে জানতে পারলাম, নিজের বাড়িতে পৌঁছে একতলার লাইব্রেরিতে অস্থিরভাবে পায়চারি করে চলেছে ডার্বি।
এরপর থেকে ডার্বির মানসিক অবস্থা খুব ঠুনকো হয়ে পড়ল। আমি প্রায় প্রতিদিনই ওর বাড়ি যেতাম, আর ওর সঙ্গে নানা বিষয়ে আড্ডা মেরে ওকে প্রফুল্ল রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করতাম। মাঝে মাঝে আমার কথার উত্তর দিলেও, মাঝে মাঝেই ডার্বি শূন্যদৃষ্টিতে একমনে কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে থাকত। কোনওভাবে অ্যাসেনাথের প্রসঙ্গ, ডার্বির বিবাহিত জীবন বা আনুষঙ্গিক কিছুর খোঁজ উঠে পড়লে, এডওয়ার্ডকে আর রোখা যেত না। উন্মাদের মতো চিৎকার করে হাত-পা ছুঁড়তে শুরু করে দিত সে।
ডার্বির ডাক্তার, ব্যাঙ্ক ম্যানেজার আর উকিল– তিনজনের সঙ্গেই আমি ওর অবস্থা নিয়ে গভীর পর্যালোচনা করলাম। ডাক্তারবাবু তাঁর দুই সহকর্মীকে নিয়ে ডার্বিকে দেখতেও এলেন। কিন্তু বিশেষ বিশেষ প্রসঙ্গ উত্থাপনে ডার্বির শারীরিক খিচুনি এবং মানসিক পরিবর্তন এত তীব্র হতে লাগল, যে আমার পক্ষে তা সহ্য করা মুশকিল হয়ে উঠল। শেষমেশ যা আশঙ্কা করেছিলাম, সেটাই ঘটল। অ্যাম্বুলেন্সে করে ডার্বিকে আর্কহ্যামের পাগলাগারদে নিয়ে গেলেন ডাক্তার।
সপ্তাহে দু-দিন আমি ওকে দেখতে যেতাম। যেহেতু ওর অভিভাবক বলতে কেউ ছিল না, আমিই ওর অভিভাবক নিযুক্ত হয়েছিলাম। গরাদের ওপার থেকে ডার্বির রক্ত-জল-করা বন্য চিৎকার, নিশ্বাসের শব্দের মতো ফিশফিশানি আর প্রলাপ শুনতে শুনতে চোখে জল এসে যেত আমার। একটা অসংলগ্ন বাক্য সে পুনরাবৃত্তি করে যেত, আমায় করতে হত… করতে হতই এটা আমায়। ওরা নিয়ে যাবে, আমায় ধরে নিয়ে যাবে- ওইখানে, ওই অন্ধকার নরকে। ও মা গো ড্যান, বাঁচাও আমাকে, বাঁচাও।
ডার্বির সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা কতটা, এই পর্যায়ে সেটা আন্দাজ করা অসম্ভব ছিল। কেবল আমিই আশায় বুক বেঁধে ছিলাম। ডার্বি ম্যানসনে আমি ওর পুরোনো চাকরবাকরদের আবার বহাল করলাম। ওল্ড ক্রাউনিংফিল্ডের বাড়িটার কী গতি করব, সেটা আমি ভেবে পেলাম না। নানা প্রাচীন ও গুহ্যবিদ্যার আকরগ্রন্থ ও জিনিসপত্র সংবলিত বাড়িটির ভাগ্য ডার্বির হাতেই ছেড়ে দেওয়া মনস্থ করে আমি একজন সাফাইকারীকে সপ্তাহে দু-দিন গিয়ে বাড়িটির বড় ঘরগুলি ঝাড়পোঁছ করতে আর ফার্নেসে আগুন জ্বেলে রাখতে নির্দেশ দিলাম।
জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটল, যা যুগপৎ আশাপ্রদ এবং ভয়ংকর। পাগলাগারদ থেকে আমার কাছে আচমকা ফোন এল এই মর্মে যে, ডার্বির চেতনা এবং যুক্তিবোধ ফিরে এসেছে। বেশির ভাগ স্মৃতি নষ্ট হয়ে গেলেও, মানসিক সুস্থতাটুকু যে ফিরিয়ে আনা গেছে, সে ব্যাপারে ডাক্তাররা নিশ্চিত। যদিও তাকে এখন কয়েকদিন নজরদারিতে রাখা হবে, তবে ডার্বির অবস্থা বেশ আশাজনক। পুরোনো মতিচ্ছন্নতায় ফেরত যাবার সম্ভাবনা কম। হয়তো হপ্তাখানেক বাদেই তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে।
আনন্দে উদবেল হয়ে আমি প্রায় ছুটে গেলাম হাসপাতালে। কিন্তু যখন নার্স আমাকে এডওয়ার্ডের কাছে নিয়ে গেল, বিস্ময়ে, আতঙ্কে আমি বারুদ্ধ হয়ে গেলাম। বিছানার ওপর বসে আমার দিকে যে রুগি হাত বাড়িয়ে দিল, তার এনার্জি এবং ব্যক্তিত্ব দেখে চমকে গেলাম। এডওয়ার্ডের পক্ষে এত চনমনে থাকা তো অসম্ভব। যে এডওয়ার্ডকে আমি চাক্ষুষ করেছি এই সেদিন পর্যন্ত, তার শারীরিক এবং মানসিক অবস্থার সঙ্গে এই মানুষটার তুলনাই চলে না। কেউ এত চটপট ঠিক হতে পারে নাকি? তা-ও ওরকম পর্যায়ের এক মানসিক আঘাত অতিক্রম করে?
আমি বুঝলাম, গণ্ডগোল রয়েছে, বিস্তর গণ্ডগোল। যখন রুগি আমার সঙ্গে কথা বলল, আমার দিকে তাকাল– আমি চকিতে বুঝে গেলাম এ সেই অ্যাসেনাথ বা এপ্রাহিম। একই চাহনি, দৃঢ়বদ্ধ ঠোঁট, মার্জিত কিন্তু বিদ্রুপাত্মক কথা বলার ভঙ্গি– আমাকে মুহূর্তে সেই রাতের গাড়ির স্মৃতি মনে করিয়ে দিল। আমি বুঝলাম, এ সেই যে সে রাত্রে আমাকে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে এসেছিল, আমার বাড়িতে এসে ভুলে ভরা সংকেতে ডোর বেল বাজিয়েছিল। কিছুক্ষণ পূর্বের আমার হর্ষোৎফুল্ল মন কী এক নিরবচ্ছিন্ন আতঙ্কে আর বিষাদে পূর্ণ হয়ে গেল।
ওকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে বাধা দেওয়ার আর কোনও কারণ বা যুক্তি দিতে পারলাম না। কিন্তু আমার বারংবার মনে হতে লাগল যে, ব্যাপারটা ঠিক হচ্ছে না। এ যদি এডওয়ার্ড না নয়, তাহলে সে এখন কোথায়? এই মূর্তিমান আতঙ্ককে এখান থেকে নিয়ে যাওয়া কি ঠিক হচ্ছে? একে কি দুনিয়ার বুকে চলে-ফিরে বেড়াতে দেওয়াটা উচিত হবে?
হাজার প্রশ্নের ভিড়ে আমার মাথাটা সারাদিন ব্যস্ত রইল। এডওয়ার্ডের দেহের মধ্যে ঠিক কে রয়েছে? কী রয়েছে? ওই বড় বড় চোখের তারায় যে জ্যোতি দেখেছি, সেটা কার? কে ওই দেহের মধ্যে দিয়ে আমাদের দুনিয়াকে প্রত্যক্ষ করছে, অনুভব করছে? রহস্যের খাসমহলে যেন আমি সম্পূর্ণ নিমজ্জিত হয়ে গেলাম। বাকি কাজকর্ম শিকেয় উঠল। পরের দিন সকালে হাসপাতাল থেকে ফোন এল, যে এডওয়ার্ড একই রকম রয়েছে, অবনতির কোনও লক্ষণ নেই। পরের দিন সকালেই ওকে ছেড়ে দেওয়া হবে।
কিন্তু সে দিনই রাত্রের দিকে আমার চরম স্নায়ুবৈকল্য হবার উপক্রম হল।
সেই ঘটনাই আমি এবার আপনাদের বলব।
.
০৭.
সেই রাতের কথা মনে করলে এখনও নিঃসীম আতঙ্কে শিউরে উঠি–ভয়ের এই আদিম অনুভূতি কীভাবে যে আমার মনকে সম্পূর্ণ গ্রাস করে ফেলেছে, তা আমার ধারণার বাইরে। কিছুতেই সে অবস্থা থেকে আমি আজও বেরিয়ে আসতে পারিনি।
মাঝরাতের একটা টেলিফোন কল দিয়ে ঘটনার সূত্রপাত। বাড়িতে আমি একাই জেগে ছিলাম। ফোনের আওয়াজ শুনে লাইব্রেরিতে গিয়ে ফোনটা ধরলাম। নিঃশব্দ। কয়েকবার হ্যালো হ্যালো করে রিসিভারটা সবে ক্রাডেলে রাখতে যাচ্ছি, আচমকা একটা শ্বাসের শব্দ শোনা গেল। যেন কেউ ভীষণ কষ্ট করে কিছু বলার চেষ্টা করছে, কিন্তু স্বর ফুটছে না। রিসিভারটা কানে লাগিয়ে গভীর মনোযোগে বোঝার চেষ্টা করতে লাগলাম সেই দূরাগত শব্দের অর্থ। জলে ডোবা কোনও ব্যক্তি যেমন কথা বলতে গেলে গ্লাব, গ্লাব শব্দ করে, ঠিক সেরকম কিছু একটা যেন শুনতে পেলাম। মনে হল কেউ যেন শব্দ বা বাক্য ভেঙে নির্দিষ্ট ছন্দে কিছু একটা বলতে চাইছে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কে, কে? কে বলছেন?
উত্তর এল, গ্লাব গ্লাব গ্লাব।
আওয়াজটা যান্ত্রিক। হতে পারে, ও প্রান্তে যে রয়েছে, তার মাইক্রোফোনটা খারাপ আছে। তাই কথা পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে না। আমি গলাটা খানিক চড়িয়েই বললাম, শুনুন, আপনার কথা কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। আপনি বরঞ্চ ফোনটা রেখে দিন। বলার সঙ্গে সঙ্গেই কেউ কলটা কেটে দিল।
পরে খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছিল, কলটা এসেছিল ওল্ড ক্রাউনিংফিল্ডের থেকে। সে বাড়ির পরিচারিকার রাত্রে থাকার কথাই নয়। পুলিশ যখন বাড়িটা তল্লাশি নিতে গিয়েছিল, তখন ভূগর্ভস্থ ঘরে গিয়ে দেখতে পায়, সব কিছু কীভাবে ওলটপালট হয়ে আছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চতুর্দিকে। আলমারি তছনছ করা, টেলিফোনের ওপর অদ্ভুত সব হাতের ছাপ। সব কিছুতেই কেমন যেন একটা বিকট পূতিগন্ধ ছড়িয়ে রয়েছে। পুলিশ অবশ্য নিজের মতো একটা থিয়োরি খাড়া করে ফেলে বাড়ির চাকরবাকরগুলোকে ধরার জন্য হুলিয়া জারি করে তৎক্ষণাৎ।
ধরা পড়ার পর চাকরগুলো স্বীকার করেছিল, পূর্বেকার কোনও কৃতকর্মের পৈশাচিক প্রতিশোধ নিতে এসব করা হয়েছে। কে বা কারা করেছে, সে বিষয়ে তারা অবগত নয়। তবে সেই প্রতিশোধের আগুনে আমিও জ্বলেছি, কারণ এডওয়ার্ডের বন্ধু, পরামর্শদাতা বলতে কেবল আমিই ছিলাম।
ওই মূর্খ পুলিশের দল কী জানে? ওরা জানতেও পারবে না, কী হয়েছিল এডওয়ার্ডের সঙ্গে। কিছু আদিম রহস্য সৃষ্টির উষালগ্ন থেকে পৃথিবীর বুকে তাদের অধিকার কায়েম করে এসেছে। সেই রহস্যের অন্তে যে ভয়ানক সত্য লুকিয়ে রয়েছে, তাকে অনুধাবনের ক্ষমতা ছিল কেবল মুষ্টিমেয় কিছু লোকের। তারা এই রহস্যের চাবিকাঠিকে লুকিয়ে রেখেছিল মানুষের অধীত জ্ঞানের সীমানা থেকে অনেক দূরে। কিন্তু কেউ কেউ তার সন্ধান পায় খুঁড়ে তুলে আনে সেই গুপ্তজ্ঞান মুক্তি দিতে চায় সেই মূর্তিমান আতঙ্কদের। বিপন্ন হয়ে পড়ে পৃথিবী, বিপন্ন হয়ে পড়ে তার মনুষ্যজগৎ। এপ্রাহিম, অ্যাসেনাথ এরা ওই পিশাচের এক-একটা রূপ। এডওয়ার্ডকে তারা নরকে টেনে নিয়ে গেছে এবার, এবার আমার পালা।
আমি কীভাবে নিজেকে বাঁচাতে পারতাম? ওই বিপুল পৈশাচিক শক্তি মানবদেহের সীমানা অতিক্রম করেছে বহু আগেই। পরের দিন দুপুরবেলা, নিজের শরীর আর মনকে সুস্থির করে, মানসিক হাসপাতালে নিজের পিস্তলটা নিয়ে গিয়েছিলাম। এডওয়ার্ডের খুলি তাক করে আমার পিস্তলটা খালি করে দিয়েও আমি নিশ্চিন্ত হতে পারিনি যে, এই অভিশাপ পৃথিবীর বুক থেকে চিরনিশ্চিহ্ন হল কি না– আমি চাইছিলাম ওর দেহটা দাহ করতে, সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করতে ওর প্রতিটা অংশ। কিন্তু হা হতোস্মি!! দেহটাকে নাকি এখনই কবর না দিয়ে সুরতহালের জন্য কাটাছেঁড়া করা হবে। আমি বারবার বলছি, ওকে পোড়াও, আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দাও। না হলে কারও মুক্তি নেই।
ওই জীবন্ত দেহটাকে যখন আমি গুলি করি, আমি নিশ্চিত ছিলাম সে এডওয়ার্ড নয়। তবে আমি জানি, ওরা আমার জন্য ফিরে আসবে আসবেই। তবে আমার ইচ্ছাশক্তি এত দুর্বল নয়, আমি প্রাণপণে বাধা দেব। আমার পুরুষকার ওই আতঙ্কের সামনে মাথা নত করবে না। কোনও অবস্থাতেই না। একটা প্রাণ, তার জন্য তিন তিনটে দেহ বিসর্জন দিতে হল। এপ্রাহিম, অ্যাসেনাথ এবং এডওয়ার্ড। এবার কে?? আমি নয়– না না, আমার শরীর আমি ওই দানবকে দেব না, আমি জুঝব– সর্বশক্তি দিয়ে।
কী যে বলছি, নিজেও জানি না। আবোল-তাবোল কথা ছেড়ে আমি বরঞ্চ আসল ঘটনাতে ফিরি। সেই ভয়াল, সৃষ্টিছাড়া, ক্লেদাক্ত, পূতিগন্ধময় নরকের জীবটার কথা আর বলতে চাই না। পুলিশ কিছুতেই আমার কথা বিশ্বাস করতে চায়নি। রাত দুটো নাগাদ ওই বস্তুটাকে তিন তিনজন পথচারী দেখতে পায়– হাই স্ট্রিটের ওপর চলাফেরা করতে। তার পদচিহ্নও পুলিশ খুঁজে পেয়েছে।
রাত দুটোর কিছু পরে, আমার বাড়ির দরজায় ঘণ্টীটা বেজে ওঠে। বোঝাই যাচ্ছিল আগন্তুক যথেষ্ট উত্তেজিত। সে মরিয়া চেষ্টা করে যাচ্ছিল এডওয়ার্ডের তিন-দুই সংকেত নকল করার।
গভীর ঘুমের থেকে আচমকা জেগে উঠে আমার মাথাটা ঘুলিয়ে গিয়েছিল। ডার্বি এসেছে? আমার বাড়িতে? জানি, ওর বহু স্মৃতি হারিয়ে গেছে, তাই হয়তো কোডটা মনে করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে সে৷ হয়তো নতুন এডওয়ার্ড তার পুরাতন চেতনার স্মৃতি খুঁড়ে বের করার চেষ্টা করছে সংকেতটাকে। কিন্তু তৎক্ষণাৎ সতর্ক হলাম, এত রাতে কী ব্যাপার? ওকে কি আগেভাগেই হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিল? নাকি ও পালিয়ে এসেছে। সেখান থেকে? হাউসকোটটা জড়িয়ে আমি নীচে নেমে এলাম। নামতে নামতে চিন্তা করলাম, আমি হয়তো সব কিছুই একটু বেশি বেশিই ভাবছি। হয়তো এডওয়ার্ড সুস্থ হয়ে গেছে– পূর্বের জীবনে ফিরতে চেয়ে সে নিজে কিছুটা উত্তেজিত, উদ্গ্রীব। যা-ই হোক-না কেন, এডওয়ার্ড আমার বৈমাত্রেয় ভাই, ওকে আমি সাহায্য করবই।
ওক কাঠের ভারী দরজাটা খুলতেই একটা বিকট বিশ্রী গন্ধ এবং হাওয়ার একটা তীব্র ঝটকা আমাকে পেড়ে ফেলল। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি ছিটকে পড়ে গড়িয়ে গেলাম খানিকটা। কিছুক্ষণ সেই পূতিগন্ধময় ভারী বাতাসে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে লাগল আমার। কয়েকবার বমি করার জন্য ওয়াক তুললাম। তারপর একটু সুস্থির হয়ে তাকিয়ে দেখি, দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা কালচে ছোটখাটো কুঁজো অবয়ব। আমি চমকে উঠলাম– এটা আবার কে? আমি তো একে এডওয়ার্ড ভেবেছিলাম।
ম্লান আলোয় ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, অবয়বটার শরীরে লেপটে রয়েছে এডওয়ার্ডেরই ওভারকোট। কিন্তু আগন্তুক এতটাই বেঁটে যে, কোটের নীচের অংশটা পুরোপুরি মাটি স্পর্শ করছে। হাতা গোটানো হলেও, সেখান থেকে ডার্বির হাতও দেখা যাচ্ছে না। আগন্তুকের মাথাটা কেমন যেন ঘাড়ের ওপর জবুথবু হয়ে বসানো। সারা মুখে এডওয়ার্ডের স্কার্ফটা জড়িয়ে রাখা, তার ফলে মুখটাও দৃশ্যমান নয়। এটা কী? বিপুল কৌতূহলে দ্বিধাগ্রস্তভাবে মূর্তিটার দিকে এক পা এগোতেই, সেটা একটা শব্দ করে উঠল, গ্লাব গ্লাব। শব্দটা করেই সে আমার দিকে একটা দলাপাকানো কাগজ ছুঁড়ে দিল। কাগজটা তুলে দেখি, সেটা ঘন হাতের লেখায় ভরতি একটা চিঠি। দরজার বাইরে দাঁড়িয়েই আমি চিঠিটা পড়ার চেষ্টা করতে লাগলাম।
নিশ্চিতভাবেই এটা এডওয়ার্ডের হাতের লেখা। কিন্তু সে এত বড় একটা চিঠি লেখার কষ্ট করতেই বা গেল কেন, যখন একটা ফোন করলেই আমাদের মধ্যে কথা হতে পারত? আর লেখাটাই বা এত অপরিষ্কার, কাঁপা কাঁপা কেন? বাইরের হালকা আলোতে চিঠিটা ভালোভাবে পড়া গেল না তাই ঘরের মধ্যে ঢুকে আলোটা জ্বেলে দিলাম। বাইরের ওই মূর্তিটাও থপথপ করতে করতে আমার সদর দরজা পেরোল, কিন্তু আমার পড়ার ঘরের চৌকাঠ পেরোল না। বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকল। ভাগ্য ভালো, এত কিছুর মধ্যেও আমার স্ত্রী-র ঘুম ভাঙেনি, না হলে এই বস্তুটিকে দেখে তিনি যে কী করতেন তা ভাবতেও ভয় করছে।
চিঠিটা পড়তে পড়তে আমার হাঁটু কাঁপতে লাগল। বেশিক্ষণ নিজেকে সামলে রাখতে পারিনি আমি জ্ঞান হারিয়েছিলাম সামান্য পরেই। জ্ঞান ফিরতে দেখি, সেই অভিশপ্ত চিঠিটাও হাতেই ধরা রয়েছে। চিঠির বয়ান এরকম–
ড্যান, হাসপাতালে যাও আর ওটাকে খতম করো, নির্মূল করো ওটাকে। ওই জিনিসটা আর এডওয়ার্ড ডার্বি নয়। ওর মধ্যে এখন কে বসে আছে জানো? অ্যাসেনাথ। সাড়ে তিন মাস আগেই যে মৃত!! আমি তোমাকে মিথ্যে বলেছিলাম, ড্যান। অ্যাসেনাথ বাড়ি ছেড়ে যায়নি, আমি ওকে হত্যা করেছিলাম। আজ না-হয় কাল আমি সেটা করতামই। আচমকাই আমি এই সিদ্ধান্তটা নিই। সে রাতে আমরা একা ছিলাম, আর আমার আত্মা আমার নিজের দেহেই ছিল। ওর অন্যমনস্কতার সুযোগে হাতের কাছে রাখা মোমবাতিদানটা দিয়ে ওর মাথা আমি খুঁড়িয়ে দিই। না হলে, হ্যালোইনের পরদিনই গুপ্তবিদ্যার মাধ্যমে আমার দেহকে কবজা করে নিত ও।
সেলারের মধ্যে পুরোনো বাক্সগুলো যেখানে ডাঁই করা আছে, তার নীচে ওকে মাটিচাপা দিই। আর সমস্ত তথ্যপ্রমাণ লোপাট করি। পরের দিন সকালে চাকরগুলো কিছু সন্দেহ নিশ্চয়ই করেছিল, কিন্তু ওদের নিজেদেরই এত কুকর্ম রয়েছে যে, ওরা যেচে পুলিশের কাছে যেতে সাহস করেনি। আমি ওদের তাড়িয়ে দিয়েছিলাম, টাকা দিয়ে মুখ বন্ধও রাখতাম, কিন্তু জানতাম না– এই বিশেষ কাল্ট-এর লোকজন পরে কী করতে পারে। প্রথমে আমি ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করা বন্ধ করে দিয়েছিলাম, কিন্তু পরে বুঝলাম, আমার মগজটাকে, আমার আত্মাকে যেন বাইরে থেকে থেকে কেউ টানছে, উপড়ে নিতে চাইছে আমার চেতনাকে। আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল, এপ্রাহিম বা অ্যাসেনাথের মতো আত্মারা তাদের দেহ থেকে ততক্ষণ পুরোপুরি মুক্ত হয় না, যতক্ষণ তাদের দেহটার কিছুমাত্র অবশিষ্ট থাকে। অ্যাসেনাথ তাই আমাকে ছেড়ে যায়নি, আমাকে টেনে রাখত, চেষ্টা করত, কীভাবে আমার মধ্যে ঢুকে পড়বে, দখল করবে আমার শরীরটা। আর বদলে আমার আত্মাকে ঢুকিয়ে রেখে যাবে সেলারের তলায় বাক্সের নীচে পোঁতা ওই দেহাবশেষের মধ্যে।
আমি জানতাম, কী হতে চলেছে। আমি তাই মরিয়া হয়ে অভিনয় করলাম হাসপাতালে যাওয়ার জন্য। কিন্তু এত করেও কিছু হল না। একদিন নিজেকে আবিষ্কার করলাম নিকষকালো অন্ধকারের মধ্যে দমবন্ধ অবস্থায়। অ্যাসেনাথের পূতিগন্ধময় শবদেহের মধ্যে, সেলারের তলায়।
আমি বুঝতে পারলাম যে, আমার শরীরে অ্যাসেনাথ পাকাপাকিভাবে ঢুকে পড়েছে। সে হাসপাতালেই রয়েছে, কিন্তু তাতে কিছু এসে যায় না। হ্যালোইনের পরে যে গুপ্ত অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল, তাতে তার শারীরিক উপস্থিতির আর দরকার নেই। সে যে ফিরে এসেছে, এটুকু বার্তাই সেই ভয়ানক তন্ত্রানুষ্ঠান সম্পন্ন করার পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু সেই ভয়ানক উপাসনার ফলশ্রুতি হিসাবে এই পৃথিবীর যে কী হবে, তা কল্পনাতেও আনা যায় না। আমি আর থাকতে পারলাম না। কোনওমতে সেলারের সেই বন্দিদশা থেকে হাঁচোড়পাঁচোড় করে বেরিয়ে এলাম।
আমি এখন আর কথা বলার অবস্থায় নেই। তাই টেলিফোন করে লাভ নেই, বন্ধু। তবে দেখলাম, আমি এখনও মোটামুটি লিখতে পারি। কোনওমতে জোড়াতালি দিয়ে তোমাকে আমার শেষ চিঠিটা লিখে পাঠাচ্ছি। ধরে নাও এটাই আমার অন্তিম ইচ্ছে এবং নির্দেশ। ওই শয়তানটাকে মেরে ফেলল। যদি এই পৃথিবীতে শান্তি চাও, তাকে বাঁচাতে চাও, তাহলে ওই মৃতদেহটাকে জ্বালিয়ে দেবে। কোনও অস্তিত্ব যেন না থাকে ওটার। আর যদি থাকে, তাহলে তুমি কল্পনাও করতে পারবে না যে, ওটা ফিরে এসে কী করতে পারে।
গুপ্তবিদ্যা, অকাল্ট, কালাজাদু থেকে দূরে থাকো ড্যান। বিদায়। তোমার মতো বন্ধু পেয়ে আমি ধন্য। পারলে পুলিশকে বুঝিয়ে বোলো। তোমাকে এসবের মধ্যে টেনে আনার জন্য আমায় ক্ষমা করে দিয়ো ড্যান। আমার চিরশান্তির সময় ঘনিয়ে আসছে। এই নড়বড়ে কাঠামো আর আমাকে ধরে রাখতে পারবে না।
ওটাকে নিশ্চিহ্ন করো ড্যান। চিরতরে।
তোমারই –এড।
চিঠিটার শেষাংশ পড়েছিলাম জ্ঞান ফেরার পর। প্রথম কিছুটা পড়ার পরই সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ি আমি। যখন জেগে উঠি, তখন দরজার কাছে পড়ে-থাকা জিনিসটা দেখে আর গন্ধ শুঁকে আবার অজ্ঞান হওয়ার উপক্রম হয়। অবশ্য ততক্ষণে এই চিঠির বার্তাবাহকের দেহে আর প্রাণ ছিল না।
আমার খানসামাটি বেশ শক্তপোক্ত বলতে হবে। সকালে উঠে আমার ঘরের চৌকাঠে জিনিসটা দেখেই সে তৎক্ষণাৎ পুলিশকে ফোন করে। পুলিশ আসার আগেই আমি ওপরের ঘরে বিছানায় স্থানান্তরিত হয়েছিলাম।
এডওয়ার্ডের নোংরা কোট আর প্যান্টের মধ্যে থেকে যা বেরোল, সে বীভৎসতা হাড় হিম করে দেওয়ার মতো। চটচটে হয়ে-যাওয়া গলিত মাংসপিণ্ডের মধ্যে কয়েকটা হাড়ের টুকরোও ছিল ছিল ভাঙা খুলির টুকরোও। দাঁতের গঠন দেখে পরে জানা গিয়েছিল– খুলিটা অ্যাসেনাথের।
[প্রথম প্রকাশ: ১৯৩৭ সালের জানুয়ারি মাসে উইয়ার্ড টেলস পত্রিকায় লেখাটি প্রকাশ পায়। ভাষান্তর : সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়]