১৫
শীতটা প্রচণ্ড পড়েছে। ‘শিউলি বাড়ি’৫২র স্যুটিং—এর দরুন যেতে হয়েছিল এই ঠান্ডাতেও, রাঁচির কাছে একটা শহরে। সারাদিন স্যুটিং—এর পর রাত্রিতে ফিরে এসেছি যে যার আস্তানায়। পাহাড়ি ঠান্ডা। সোয়েটার, গরম কোট পরে অবসর সময় কাটাবার জন্যে রেডিওটা খুলে দিলাম। রেডিও—ঘোষক ঠিক সেইসময় ঘোষণা করছেন— ‘বিখ্যাত অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তী পরলোকগমন করেছেন।’ নিজের কানকে যেন বিশ্বাস হল না। কিন্তু সেই নির্মম সত্য, আমায় বিশ্বাস করতে হল। পরের দিন খবরের কাগজ পৌঁছতেই দেখলাম সেই একই ব্যাপার—তুলসীদা আর নেই। মনে পড়ল অতীত দিনের কথা।
‘কামনা’ ছবির নায়কের পার্ট করবার জন্য আমি মনোনীত হয়েছিলাম। ইতিপূর্বে ছবিতে অনেককে দেখেছি, কিন্তু আলাপ হয়নি কারোর সঙ্গে। হঠাৎ দেখি তুলসীদা তাঁর সুপরিচিত টাকটিকে নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছেন।
প্রশ্ন করলেন—’তোমারই নাম উত্তমকুমার, এই ছবির নায়ক?’
সলজ্জভাবে নমস্কার করে বললাম—’আজ্ঞে হ্যাঁ।’
আমার মুখের দিকে চেয়ে তিনি বললেন—’দেখে তো মনে হচ্ছে বয়স বেশি হয়নি। লেখাপড়া, অফিস, এসব ছেড়ে এ লাইনে কেন? বলি, ফুর্তি করবার ইচ্ছা আছে নাকি?’
প্রবীণ অভিনেতার মুখে এ কী কথা! সলজ্জভাবে বলি —’আজ্ঞে না, অভিনয়কে ভালোবাসি আমি।’
—’অভিনয়কে ভালোবাসো? তা হলে স্টেজে যাওনি কেন?’
কী জবাব দেব?
বলি—’আমাকে নেবেই বা কেন?’
সরাসরি বলতে পারলাম না আমাকে এই ফিল্ম লাইনে ঢুকতে যা বেগ পেতে হচ্ছে তা তো দেখছি। তাতে এ লাইনে আসার শখ বুঝি মিটে যায়!
মুখে কিন্তু বলতে পারলাম না সেকথা। মনের কথা আঁচ করে নিয়ে তুলসীদা বললেন—’অভিনয় যদি ভালো লাগে তাহলে অভিনয়কে সাধনা করে নিয়ো হে উত্তম। তবেই জীবনে প্রতিষ্ঠা পাবে।’
শুরু করলেন তাঁর জীবনের কাহিনি বলতে। তিনি বললেন— ‘মাত্র ন’বছর বয়সে তিনি অভিনয় করতে পারবেন বলে কেমন করে ভিড়ে গিয়েছিলেন একটা সার্কাসের দলে। আউট্রাম ঘাটে তিনি আর তাঁর বন্ধু একদিন দেখলেন একটা দল বর্মা মুলুকে যাবে জাহাজে করে। সঙ্গে তাদের প্রচুর জিনিসপত্র। বর্মা কোথায়, কলকাতা থেকে কতদূর, কিছুই জানা নেই। তবু জানেন দলে ভিড়তে পারলে দর্শকদের অভিবাদন করবার সুযোগ তিনি পাবেন।
এই আশাতেই তিনি একদিন দেখা করলেন ম্যানেজারের সঙ্গে। মনোনীত হলেন সার্কাসে খেলা দেখাবার জন্যে। জাহাজে উঠে পড়লেন। ঘাট থেকে জাহাজ ছেড়ে দিল।
ঝোঁকের মাথায় কাজটি করবার সময় তার গুরুত্ব বোঝেননি। বুঝলেন, যখন কলকাতার মাটি ধীরে ধীরে চোখের সামনে থেকে সরে যেতে লাগল। তাও মিলিয়ে গেল দিকচক্রবালে। ক্রমশ জাহাজ এসে পড়ল সমুদ্রের মাঝখানে।
এ যেন রবীন্দ্রনাথের ‘দেবতার গ্রাস’৫৩ এর রাখালের অবস্থা।—
‘জল, জল, জল,
দেখে দেখে চিত্ত তার হয়েছে বিকল।’
কিন্তু ফিরে যাবার উপায় নেই, সার্কাসের ম্যানেজারের ভয় রয়েছে।
এলেন বর্মা মুলুকে। তাঁবুতে খেলাও দেখালেন। খেলা দেখাতে গিয়ে বুঝলেন তিনি যা মনে মনে চেয়েছিলেন এ, তা নয়। কী করেন অনেক কষ্টে এলেন কলকাতায়। স্টার থিয়েটারে যোগ দিয়ে পূর্ণ হল তাঁর মনের বাসনা।
তারপর বললেন—’জানলে, কত কষ্ট করেছি থিয়েটার করবার জন্যে। তবুও তো একটা বড়ো পার্ট পেলাম না আজ পর্যন্ত। বলি, তোমরা তো একেবারেই হিরো হয়ে এসেছো হে! যেদিন প্রথম একটু বড়ো পার্ট পেলুম,—তাও নতুন বইতে নয়, একজন আসেনি তার জায়গায়, এক রাত্তিরের জন্যে—সেদিন আমার ড্রেসারের কাছে গেলুম মোজা চাইতে। ড্রেসার বলল— ভাগ, একদিনের জন্য পার্ট করবে, তার জন্যে আবার মোজা পায়ে দেবে। সবেদা দিয়ে এঁকে নে।’
আমি বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলাম— ‘তাই করলেন?’
তুলসীদা বললেন— ‘উপায় কি, চান্স মিস করব ভাই? আর যদি না চান্স পাই! সবেদা আর আলতা দিয়ে বর্ডার এঁকে নেমে গেলাম স্টেজে। তারপর সাতদিন লাগলো পায়ের আলতার দাগ তুলতে।
যখনই আলতা ধুয়েছি, তখনই মনে মনে আনন্দ হয়েছে যে একটা বড়ো পার্ট করবার সুযোগ পেয়েছি।’
ওনার কথা শুনে বুঝলাম, কতখানি ভালোবোসেন উনি অভিনয়কে।
তারপর বললেন—’শুনবে আর একটা গল্প? সেবারে পার্ট পেয়েছিলাম হাকিমের। কথা ছিল নায়িকার নাড়ি টিপে বলব— আর চিন্তার কারণ নেই, রক্ষা পেয়ে যাবেন।’
মনে মনে কত আশা। ভাবছি ভালোভাবে পার্টটা করতে পারলে চাই কি একদিন হিরোর চান্সও হয়ে যাবে।
কিন্তু কপাল আমার মন্দ। স্টেজে গিয়ে দারুণ ভয় পেয়ে গেলুম। কারণ নায়ক বা নায়িকা যাদের সঙ্গে পর্দায় অভিনয় করতে হবে, তাঁরা দুজনাই সে যুগের শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বা অভিনেত্রী। হাত পা কাঁপতে লাগলো, মাথাটা কেমন যেন ঘুরে উঠলো। তবুও মনটাকে জোর করে রেখেছি— এই অভিনয়ের উপর আমার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।
আমার কথা বলার সময় এলো। কথাগুলো উলটে বলে ফেললাম—”রক্ষার কারণ নেই, চিন্তা পেয়ে যাবেন।” কথাটা বলে ফেলে নিজেও ভালো বুঝতে পারিনি যে ভুল বলেছি।
প্রশংসা পাবার আশায় নায়িকার মুখের দিকে চেয়ে আছি, সেখানে অসুস্থতার লক্ষণ নেই, চোখে ফুটে উঠেছে আগুন। নায়কের মুখও বিরক্তিপূর্ণ।
বুঝলাম কোথায় একটা গোলমাল করে ফেলেছি।
তাড়াতাড়ি স্টেজ থেকে ভেতরে আসতেই প্রম্পটার আমাকে এই মারে তো ঐ মারে।
সীন পড়তে নায়কও খোঁজ করলেন আমাকে। ভয়ে পালিয়ে গেলাম সেদিনকার মতো গ্রীনরুম থেকে। তারপর সাতদিন একেবারে থিয়েটারমুখোই হইনি।’
প্রথম আলাপেই তিনি জয় করে নিলেন আমার হৃদয়। আমাদের বন্ধুত্ব শুরু হল এইভাবে। যদিও মুখে ওকে ‘দাদা’ বলতাম, স্নেহ পেতাম পুত্রের। আমাদের সম্বন্ধ হতে লাগল নিবিড়তর।
আজ তুলসীদার কথা লিখতে বসে কত কথা মনে পড়ছে। মনে পড়ছে আমার প্রথম গাড়ি কেনার কথা। গাড়িটা ছিল হিন্দুস্থান—১৪।
‘চাঁপাডাঙ্গার বৌ’ স্যুটিং হচ্ছে। গাড়িটা চড়ে গেলাম স্টুডিওতে।
আমার গাড়ি দেখে তুলসীদার সে কী আনন্দ! বারবার মুছছেন গাড়িটাকে। সকলকে ডেকে বলছেন— ‘উত্তম আজ গাড়ি কিনেছে।’
তখনও গাড়ি চালাতে শিখিনি।
আমাকে বললেন—’একবার আমাকে ঘুরিয়ে আনবি?’
ড্রাইভারকে বললাম তুলসীদাকে ঘুরিয়ে আনতে। একপাক টালিগঞ্জ অঞ্চল ঘোরা হল ।
গাড়ি আবার স্টুডিওতে ফিরে এলো। তুলসীদার মন তখনও তৃপ্ত হয়নি।
আমাকে বললেন— ‘চ আরেকবার ঘুরে আসি লেকের ধার থেকে।’
সেদিন তুলসীদার মুখে যে কী আনন্দর চিহ্ন আমি দেখেছিলাম অতি আত্মীয় ছাড়া তেমনটি আর দেখা যায় না। সে মুখ আমার স্মৃতিপটে চিরদিন আঁকা থাকবে।
আর একবার বুড়ো (তরুণকুমার) নিয়ে গিয়েছিল গৌতমকে৫৪, স্টুডিওতে।
গৌতমের পরিচয় তুলসীদা যেই পেলেন, সঙ্গে সঙ্গে তাকে কোলে নিয়ে তাঁর কী আনন্দ!
মেক—আপ করছিলেন তুলসীদা। বন্ধ হল তাঁর মুখের রং মাখা। ছোটো ছেলের মতো তিনি গৌতমকে নিয়ে নাচতে লাগলেন।
আমি বলি— ‘তুলসীদা, পরিচালক যে এখুনি ডাকবেন, মেকআপটা শেষ করে নিন।’
উনি বললেন—’তুই থাম। অনেক অভিনয় করেছি জীবনে, বাঁচলে অনেক অভিনয় করবও ভবিষ্যতে। কিন্তু গৌতম এমন ছোট্টটি থাকবে না, সে বড়ো হয়ে যাবে। তখন হয়তো আমাকে এমন অবাক চোখে আর দেখবে না।’
মুহূর্তের মাঝে দেখি বয়সের ব্যবধান ছুটে গেছে। তুলসীদাকে দেখে, কে বলবে তিনি তখন পঞ্চাশের ওপরে বৃদ্ধ। তখন মনে হচ্ছে তিনি যেন গৌতমেরই সমবয়সি।
আর একবার তুলসীদা আর আমি গাড়িতে যাচ্ছি আশুতোষ মুখার্জি রোডের ওপর দিয়ে।
বেলা তখন কতইবা! চারটে বাজে। ঠিক এমনি সময় একটা মেয়ে—স্কুলের ‘বাস’ আমাদের পাশ দিয়ে চলে গেল। নায়ক হিসেবে তখন আমার কিছু নাম হয়েছে। তাই ছাত্রীরা আমার দিকে বিস্ফারিত চোখে চেয়েছিল।
ব্যাপারটাকে আমি তত গুরুত্ব দিইনি। কারণ তখন আমি গাড়ি চালাতেই ব্যস্ত।
তুলসীদা হঠাৎ আমাকে বললেন—’দেখো, উত্তম, ওরা বিস্ফরিত দৃষ্টিতে তোমার দিকে চাইল। তোমার উচিত ছিল হাত নেড়ে ওদের অভিনন্দন জানানো।’
আমি বলি —’কেন তুলসীদা?’
তুলসীদা বললেন— ‘যদি তোমাকে কেউ নায়ক করে থাকে, জানবে সে হচ্ছে ওই ছোটো ছোটো আমাদের বোনেরা। পরিচালক নন, প্রযোজকও নন। ওরা খোঁজে বলেই তোমার এত দাম। নইলে আমাদের আর দাম কী!’
ভেবে দেখলাম কথাটা নিদারুণ সত্য। যতদিন দর্শকের কাছ থেকে সংবর্ধনা পাইনি ততদিন তো আমাকে কেউ খোঁজেনি! আমাকে নায়ক করেছেন, প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন আমার দর্শকরা। আমার যা—কিছু সব তাঁদেরই। সুতরাং সতর্ক হয়ে তাঁদের অভিবাদন জানানো উচিত আমার।
তুলসীদার কথা লিখতে বসলে লেখার শেষ হয়না কোনোদিন। তাই জোর করেই নিজেকে সংবরণ করছি। তুলসীদার একটা কথা ছিল —’সূর্যতোরণ’৫৫ —এ উত্তম আমাকে চাকর রেখেছে। ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’৫৬—এ আমি উত্তমকে চাকর রেখেছি।
ইদানীং আমার সঙ্গে দেখা হলেই তিনি ‘সূর্যতোরণ’—এর সংলাপ বলতেন। আগামী ছবি ‘বিপাশা’য় আবার দেখবেন তাঁর ‘পানওয়ালা’র অদ্ভুত পার্ট।
তুলসীদা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। খবরটা পেয়ে আমি বুড়োকে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম তাঁকে দেখতে। বলেছিলাম, ‘বলবি, সুবিধে পেলেই আমি তাঁকে দেখতে যাবো।’
আমি যাব শুনে তাঁর সে কী আনন্দ! বলে পাঠালেন, ‘উত্তমকে বোলো, তাকে আসতে হবে না। আমি ডাক্তারের অনুমতি পেলেই নিজে যাব তার কাছে।’
যাব যাব করে আমারও যাওয়া হল না। গেলাম ‘শিউলিবাড়ি’র স্যুটিং করতে। সেখানেই শুনলাম এই নিদারুন ঘটনা।
স্মৃতির ঝুলি খুলে ভাবছিলাম আমার হারিয়ে যাওয়া দিনের কথা। তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ মনে হল তুলসীদা সামনে এসে মুখে সেই সুপরিচিত হাসি ফুটিয়ে আমাকে বলে যাচ্ছেন বহুবার শোনা ‘সূর্যতোরণ’—এর সংলাপ।
ঘুম ভেঙে গেল। চেয়ে দেখলাম ঘরে কোথাও কেউ নেই। মনে হল তিনি তো আজ সব ধরাছোঁয়ার বাইরে।
প্রণাম জানালাম মনে মনে। বললাম, তুলসীদা আশীর্বাদ করুন, যেন আপনার মতো প্রকৃত অভিনেতা হতে পারি।
১৬
তুলসীদার মৃত্যুর পর থেকেই বুঝতে পেরেছি মৃত্যু কত সত্য। বাবার মৃত্যুতে শোকে অভিভূত হয়েছিলাম। তাই জীবনকে বোঝবার বা দেখবার সুযোগ তখন পাইনি। দিদির মৃত্যুতে শিশুসুলভ চপলতায় মনে করেছিলাম, দিদি আবার ফিরে আসবে। কিন্তু, আজ বুঝতে পারছি, ও পথে যে যায়, সে আর ফেরে না। জীবনের যবনিকা পড়লে আর ওঠে না। সেখানে শুরু হয় নতুন নাটক।
আমাদের বাড়িতে একদিন উপনিষদ পড়তে পড়তে একজন বলেছিলেন, ‘নান্যঃ পন্থা মৃতুরেতি,’ মৃত্যু ছাড়া অন্য পথ নেই। ভেবেছিলাম, তবে এই যে বাড়ি, এই গাড়ি, জীবনের যে রঙিন স্বপ্ন, এর সবটাই মিথ্যে? যদি মিথ্যেই হয় তবে কোটি কোটি মানুষ কেন ছুটছে এর পেছনে! হাসি পেয়েছিল কথাটা ভেবে। কবিগুরুর লেখা ‘পথের শেষ কোথায়,’ যেদিন পড়েছিলাম সেদিন তার আসল মানে বুঝতে পারিনি। আজ ভাবছি সত্যিই তো, ‘কী আছে শেষে।’ এত প্রীতি, এত ভালোবাসা, মুহূর্তের মধ্যে জীবনের সবকিছু শেষ হয়ে যায়! তাই বোধহয় গীতায় ভগবান বলেছেন, ‘সর্বধর্মান পরিত্যাজ্য মামেক্য শরণং ব্রজ’— সবকিছু ত্যাগ করে, তুমি শুধু আমাকেই ভজনা করো।
আজ বুঝছি, ব্যাপ্ত মনকে যদি তুলে কোনোকিছু অসীমের ওপর দেওয়া যায়, তাহলে বোধহয় জীবনের দুঃখ এত তীব্র হয়ে ওঠে না। উন্মাদ করেও দেয় না। মনে পড়ে যায় শ্রীশ্রীসারদা মায়ের কথা, ‘তাঁতে মন দিলে খাঁড়ার ঘা—ও প্রবল হয়ে আঘাত করে না। প্রবল আঘাতও নরুনের আঘাতের মতন তুচ্ছ হয়ে যায়।’ কিন্তু, কে তা পারার ক্ষমতা রাখে…।
একটা প্রবাদবাক্য আছে ভগবান যখন দেন তখন ছাদ ফুটো করেই দেন।
মানুষ নিজের চেষ্টায় কী করতে পারে? এ প্রত্যক্ষ সত্য আমি নিজের জীবন দিয়েও সেদিন অনুভব করেছিলাম। আমাদের মনের ইচ্ছেগুলোকে যদি তীব্রভাবে আমাদের মনে আমরা জাগিয়ে রাখতে পারি, এবং তাকে ধরে বাকি জীবনটা চেষ্টা করতে থাকি, তাহলে হয়তো একদিন-না-একদিন তা সফল হবেই।
রবার্ট ব্রুসের দৃষ্টান্ত টানতে চাই না। Try, Try, Try again বলে আপনাদের মনও ভারী করতে চাই না। তবে আমার জীবনে সেদিন যে, এ জিনিসের ব্যতিক্রম হয়নি, তাই আপনাদের বলছি।
তীব্র ইচ্ছা ছিল ফিল্মের ‘হিরো’ হবার। সেকথা আগেই বলেছি।
সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও আপনাদের জানিয়েছি, টাকার অভাবও ছিল আমার প্রচুর, সংসারের চাহিদা সামান্য চাকরি করে মিটতও না। তাই, এদিকে আর একটা রোজগারের পথ পাব বলেই আশা করেছিলাম।
শখের যাত্রাদলে আর থিয়েটারে অভিনয় করে, নাম-যশের আশাও কম ছিল না। কিন্তু আগেকার সব ক’টা ছবি আমার জন্যে নিয়ে এসেছিল হতাশা। তাই নিজের আত্মবিশ্বাস তখনও গড়ে ওঠেনি।
নিজের ওপর বিশ্বাস ছিল না বলেই বোধহয় সেদিন ‘এম. পি.’র আমন্ত্রণে যেতে মোটেই ইচ্ছা ছিল না।
যাই হোক, এসে যখন পড়েছি, তখন এঁরা যা বলেন তা আমার শোনা উচিত।
বিমলবাবুর৫৭ পেছনে পেছনে গিয়ে ঢুকলাম একটা ঘরে। ঘরে বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা ছিল,—‘বিভূতি লাহা’৫৮।
বুঝলাম এ ঘরটা তখনকার বিখ্যাত পরিচালকগোষ্ঠীর অন্যতম বিভূতি লাহার ঘর।
ঘরের মধ্যে তখন ‘সহযাত্রী’ ছবির রিহার্সাল হচ্ছে। রিহার্সাল দেওয়াচ্ছিলেন বিখ্যাত অভিনেতা সন্তোষ সিংহ মহাশয়।
বিমলবাবু আমাকে ঘরের মধ্যে নিয়ে গিয়ে সন্তোষবাবুকে উদ্দেশ্য করে বললেন—‘দেখুন তো, এ ছেলেকে দিয়ে কিছু হয় কি না? ওপরের চেহারাটা তো মন্দ নয়। এখন মাকাল ফল না হলেই বাঁচি!’
সন্তোষবাবু আমাকে পরীক্ষা করতে শুরু করলেন। এদিকে আমারও বুকের ভেতর কে যেন হাতুড়ি পিটতে গুরু করল।
সন্তোষবাবু আমাকে বললেন—‘আপনার নাম কী?’
আমি বলি—‘আজ্ঞে, উত্তমকুমার।’
বয়সে কম বলেই বোধহয় তিনি বললেন—‘হুঁ, চেহারাটা তো উত্তমের মতনই মনে হচ্ছে, এখন গলার আওয়াজ আর অভিনয়টা উত্তম হলেই তো বাঁচি!’
এতক্ষণ বুকের ভেতর বোধহয় স্যাকরার হাতুড়ি পড়ছিল, সন্তোষবাবুর কথা শুনে সেটা হঠাৎ কামারের হয়ে গেল। ভয়ে আমার গায়ে ঘাম দিল। সব রাগ পড়লো গিয়ে বুড়োটার ওপর। কেন আমাকে জোর করে এখানে পাঠাল? আমি তো অভিনয় ছেড়েই দেব ভেবেছিলাম। পাড়াতে শখের দলে যা যাত্রা থিয়েটার করছি তাই করতাম। ফিল্ম করে কী হবে? খানিকটা পরেই তো এঁরা তাড়িয়ে দেবেন। সে অপমানিত আর হতে হত না।
যাক, এসে যখন পড়েছি, তখন তো আর ফেরা যায় না। একটা ভদ্রতা, একটা চক্ষুলজ্জা তো আছে। দেখাই যাক না, শেষ পর্যন্ত কী হয়!
সন্তোষবাবু আমাকে বললেন—‘কী ভাবছ হে ছোকরা? একটু অভিনয় করে দেখাও!’
আমি বলি—‘কী অভিনয় করব?’
সামনে রাখা খাতায় লেখা ‘সহযাত্রী’র পাণ্ডুলিপিটা আমার হাতে তিনি তুলে দিলেন। একটা ‘সীন’ বার করে দিয়ে বললেন—‘এইটা পড়ো।’
‘সীন’টা ছিল কান্নার।
মনকে শক্ত করে নিয়ে আমি পড়ে ফেললাম। বলা বাহুল্য, ভাব দিয়েই পড়বার চেষ্টা করেছিলাম। পড়া শেষ করে চাইলাম সন্তোষদার মুখের দিকে।
বড়ো অভিনেতা তিনি। মুখ দেখে তাঁর মনের ভাব বোঝা ভারী শক্ত।
তাই আমিও ঠিক বুঝতে পারলাম না আমার অভিনয়টা কেমন হয়েছে।
তাড়াতাড়ি তিনি পাতা উলটে পাণ্ডুলিপির আর একটা জায়গা আমাকে পড়তে বললেন।
একই দৃশ্যের ধারা মনে করে পড়তে গিয়ে দেখি কোথায় কান্না, এ যে সম্পূর্ণ বিপরীত— হাসির দৃশ্য!
খানিকটা দাঁড়িয়ে দম নিয়ে নিলুম। তারপর, গলাটা নামিয়ে বেশ ইয়ার্কির ছলেই হাসির দৃশ্যটা পড়তে লাগলাম।
পড়া হয়ে গেলে সন্তোষদা এবারে বললেন—‘বাঃ মন্দ পড়োনি তো হে! আচ্ছা তুমি এইখানটা এইবার একটু পড়ো!
আগেকার অভিজ্ঞতাতেই বুঝতে পেরেছি সন্তোষদা আমাকে বিভিন্ন ভাবের দৃশ্য পড়তে দিচ্ছেন।
উদ্দেশ্য—কোন ভাবটা আমার ভেতর ভালো ফোটে, তাই দেখা। তাই চেঁচিয়ে পড়বার আগে মনে মনে একবার সেটাকে পড়ে নিয়ে দেখে নিলাম, সেটা কী দৃশ্য। আরে! এটা যে একেবারে নায়িকার সঙ্গে নায়কের প্রেম। যাকে বলে—love scene!
প্রবীণ অভিনেতার সামনে কেমন যেন লজ্জা লজ্জা করল। যা হোক, কুছ পরোয়া নেহি,—নাচতে নেমে ঘোমটা টানলে তো চলে না!
আবেগের সঙ্গে পড়ে ফেললাম দৃশ্যটা। বিমলবাবু সন্তোষদাকে জিজ্ঞেস করলেন—‘উত্তমকে দিয়ে চলবে তো?’
সন্তোষদা বললেন—হ্যাঁ ঘষলে মাজলে চলে যাবে।
সেইদিনই বিমলবাবু আমার হাতে দিলেন কোম্পানির একটা চুক্তিপত্র। যার অর্থ এম. পি.র নিজস্ব অভিনেতা হিসাবে আমি তিন বছরের জন্য নিযুক্ত হলাম।
এর প্রথম বছরে আমাকে দেওয়া হবে মাসে ৪০০ টাকা করে, দ্বিতীয় বছর দেওয়া হবে ৬০০ টাকা করে, আর তৃতীয় বছরে আমি পাব মাসিক ৭০০ টাকা করে।
এত টাকা! নিজের চোখকেও যেন ভালো করে বিশ্বাস করতে পারলাম না।
চুক্তিপত্রে সেইদিনই সই করে দিলাম আমি। এইখানে বলে রাখা ভালো ‘নিউ থিয়েটার্স’৫৯ একসময় বহু অভিনেতা, অভিনেত্রীকে এইভাবে মাইনে করে রেখে দিতেন।
তারপর শ্রদ্ধেয় মুরলীধর চট্টোপাধ্যায়৬০ মহাশয় তাঁর এম. পি. প্রতিষ্ঠানে এই রীতির প্রবর্তন করেন।
‘সহযাত্রী’ ছবি উঠবে, নায়ক মনোনীত হয়েছেন অসিতদা। কিন্তু আর একটা ছবির কাজের জন্যে, তিনি এ কাজ করতে পারলেন না।
সুতরাং শিকে ছিঁড়ল আমার। আমিই মনোনীত হলাম নায়কের পার্ট করবার জন্যে। আমার বিপরীতে অভিনয় করবেন তখনকার দিনের প্রখ্যাতা অভিনেত্রী ভারতী দেবী।৬১
ভারতী দেবী প্রথম চিত্রজগতে অভিনয় করেন নিউ থিয়েটার্সের ‘ডাক্তার’৬২ ছবিতে। তাঁর সে ছবি যখন মুক্তি পায় তখন আমি স্কুলের ছেলে। তবে সে অভিনয় আমার মনে রেখাপাত করেছিল। তার কথা আজও আমি ভুলতে পারিনি।
ওই নিউ থিয়েটার্সেরই ‘প্রতিশ্রুতি’৬৩ ছবিতে অসিতদা প্রথম অভিনয় করেন, এবং তাঁর বিপরীতে তখন ছিলেন ভারতী দেবী।
রোম্যান্টিক নায়ক আর নায়িকা হিসেবে তাঁরা তখন নামও করেছিলেন প্রচুর।
সেই ভারতী দেবী অভিনয় করছেন আমারই বিপরীতে।
যাইহোক, রিহার্সাল হল। স্টুডিওর সেটে গেলাম স্যুটিং করতে। স্যুটিং-এর ফাঁকে ভারতী দেবীকে বললাম, ‘দেখুন, অভিনয়ে ভুল-ক্রটি হলে একটু সংশোধন করে নেবেন। তবেআমি আপ্রাণ সুঅভিনয় করবার চেষ্টা করব।’
অভিনয় হল। ছবিও তৈরি হয়ে নানা প্রেক্ষাগৃহে দেখানো হল। কিন্তু এবারেও সেই আমার ভাগ্য এক। ছবি চলল না।
অভিনেতার জীবনে ছবি না-চলা যে কতখানি দুঃখের তা লিখে বোঝানো যায় না।
ভাবলাম কাজ নেই আর অভিনয় করে। ফিরে যাই আমি আমার সেই পোর্ট কমিশনার্স অফিসে।
অগ্রদূতে৬৪র বিভূতিবাবুকে একদিন জিজ্ঞাসা করলাম—‘কী করা যায় বলুন তো? চাকরিতে ফের ফিরে যাব?’
বিভূতিবাবু একটু বিস্মিত হয়ে গিয়ে বললেন—‘চাকরি এখনও রেখেছ?’
আমি আমতা আমতা করে বলি—‘আজ্ঞে, কী হবে তা তো ঠিক বুঝতে পারছি না, তাই বন্ধুবান্ধবের সাহায্যে কোনোরকমে চাকরিটা টিঁকিয়ে রেখেছি।’
বিভূতিবাবু শুনে বললেন—‘মনে হচ্ছে, চেহারার জোরে তুমি টিঁকে যেতে পারো। তবে আর একটু চেষ্টা করা দরকার। কারণ চাকরি ছাড়লে, এ বাজারে আর একটা চাকরি জোগাড় করা বড়ো শক্ত। তার ওপর তোমার পোর্ট কমিশনারের চাকরি! চাকরিটাও কিছু খারাপ নয়।’
আমি বলি—‘কিন্তু চাকরি রাখতে গেলে’—
বিভূতিবাবু বলেন—‘সেটা অবশ্য তুমি বোঝো, কী করে রাখবে?’
মনটা তখন আমার সত্যিই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কারণ চেহারার ওপর যেটুকুও আস্থা ছিল, সেটুকুও আমার তখন চলে গেছে, তখনকার দিনের একখানা বিখ্যাত সাপ্তাহিক পত্রিকায় একটা কার্টুন ছবি দেখে। ছবিটার নামকরণ করা হয়েছিল ‘বাংলার নায়ক’।
আমাকে সাজানো হয়েছে একটা ছ’মাসের ছেলে। অপরদিকে একটি মেয়ের কোলের ওপর একটি শিশুকে শোয়ানো হয়েছে। শিশুটি মেয়েটির গলা লক্ষ্য করে দুটি হাত তুলেছে ওপর দিকে। নিচে লেখা আছে—‘আমি তোমায় ভালোবাসি’।
হায়, এইকি আমার ভাগ্য! আমার চেয়েও বয়সে বড়ো যদি কোনো নায়িকার সঙ্গে আমাকে অভিনয় করতে হয়, সে দোষ কি আমার? সে দোষ যাঁরা পার্ট ঠিক করেছেন তাঁদের। কিন্তু মাঝখান থেকে বেশ খানিকটা বিদ্রূপ আর গালাগালি এসে পড়ল আমার ওপর।
আজকে অবশ্য সেকথা মনে পড়লে হাসিই পায়। সেদিন অবশ্য হাসির বদলে চোখে দেখা দিয়েছিল জল, পরাজয়ের চিহ্ন হিসেবে।
১৭
গত মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে আমাকে চলে যেতে হয়েছিল কলকাতার বাইরে। যদিও এটা নিছক দেশভ্রমণ নয়, কাজের তাগিদেই যেতে হয়েছিল সুদূর রাজপুতানার উদয়পুরের পাহাড়ে পাহাড়ে। ঘোড়ায় চড়ে তরোয়াল হাতে ছবি তোলবার সময় কেবলি মনে হচ্ছিলো, এই সেই দেশ, যেখানে জন্মেছিলেন বাপ্পা, প্রতাপ, রাজসিংহ। যে দেশের লোকেরা তরোয়াল আর ঘোড়া সম্বল করে বেরিয়ে পড়ত দেশদেশান্তরে। সেই দেশেই আমি এসেছি, তরোয়াল খেলার আর ঘোড়ায় চড়ার অভিনয় করতে। কতদূর সার্থক হয়েছি, তার বিচার করবেন আপনারা। ইচ্ছে ছিল মাউণ্ট আবু অবধি যাব, কিন্তু তার আগেই ফিরে আসতে হল কলকাতায়।
আজ এক বছরের ওপর ধরে আমার ক্ষুদ্র জীবনের কাহিনি আপনাদের বলতে শুরু করেছি। একসঙ্গে লিখে দিতে পারলেই ভালো হতো কিন্তু তার সময় কোথায়? তাছাড়া, আমি এতবড়ো লেখক নই যাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে আপনাদের ধরে রাখতে পারি। তবুও লিখছি এ কাহিনি, যাতে ছবিতে রাজপুত্রের ভূমিকায় আমায় দেখে কেউ না আমায় মনে করেন, আমি সত্যিকারের রাজপুত্র। ঘোড়া আর তরোয়াল নিয়ে আমি নেমে পড়েছি আমার জীবনযুদ্ধে। তাঁদের কাছে আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ তাঁরা যেন মনে রাখেন এটা ঘোড়া আর তরোয়ালের যুগ নয়, এ যুগটা এরোপ্লেন আর হাইড্রোজেন বোমার যুগ।
যাক সেসব কথা। কথায় কথায় যুদ্ধের কথা যখন উঠে পড়ল তখন আমার জীবনের একটা যুদ্ধের কাহিনি বলবার লোভ আর সংবরণ করতে পারছি না।
সালটা বোধহয় ১৯৪৭ হবে। গৌরীর সঙ্গে বেশ প্রেম জমে উঠেছে, আবার বিচ্ছেদও হয়েছে। বিচ্ছেদ মানে, ঘটনাটা জানাজানি হওয়ার পর বাড়িতে সে আটকা পড়েছে।
আমার জীবনের কাহিনি লিখতে গিয়ে সেকথা আপনাদের আগেই নিবেদন করেছি।
আমার মনমেজাজও বিশেষ ভালো নয়। একটুতেই তিরিক্ষে হয়ে উঠি। এমনি সময় আমাদের পাড়ার কাছে ঘটল একটা ঘটনা।
গোটাকতক ট্যাক্সি ড্রাইভার আমাদের ওই গলির মোড়টায় রাতে সাড়ে আটটা ন’টা থেকে তখন ভিড় জমাত। তখনও বেবী ট্যাক্সি৬৫র প্রচলন হয়নি। কলকাতার অধিকাংশ ট্যাক্সি ড্রাইভার ছিল অবাঙালি।
যুদ্ধ কিছুদিন আগে থেমেছে। রেশ তখনও কমেনি।
তারপর কলকাতার বুকে কিছুদিন আগেই ঘটে গেছে সেই সর্বনাশা ৪৬ সালের ১৬ অগস্টের৬৬ ঘটনা। এখানে সেখানে লোক জমায়েত হলেই, লোকে ভাবে, বুঝি তারই পুনরাবৃত্তি ঘটছে। ব্যাপার কী কেউ অনুসন্ধান করে না। সকলেই মারামারি থেকে দূরে থাকতে চায়। খানিকটা এরই সুযোগ নিয়ে ওদের আড্ডাটা জমলও ভালো। রাতের অন্ধকারে যা হয় তা হতেও দেরি হল না। চড়চাপড় মেরে এর কাছ থেকে পয়সা কেড়ে নেওয়া, ওকে অপমান করা, এ তো প্রায়ই ঘটত। শুধু এই নয়, মেয়েরা ভয়ে ও রাস্তা দিয়ে চলাই বন্ধ করল। কারণ দু’একজন রাত্রে ফেরবার সময় বেশ অপমানিত হয়েছিলেন।
খবরটা আমাদের কানে এল। গোলমাল আর পুলিস হাঙ্গামার ভয়ে, কেউ গায়ে মাখল না। থানাতে জানিয়েও কোনো লাভ নেই। কারণ তাঁরা তখন অন্য ব্যাপারে ব্যস্ত। এদিকে ওই দলকে সাহস করে চটাতেও কেউ চাইছে না। কারণ কলকাতায় যদি আরও গণ্ডগোল বাধে তখন ভরসা তো ওদেরই বাহুবল!
কিন্তু আমার যেন ব্যাপারটা অসহ্য মনে হল। একদিন আমি রাত্তির বেলায় আরও দু তিন জন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে একরকম ইচ্ছে করেই রাত্তির করে বাড়ি ফিরলাম। মাকে আমার উদ্দেশ্যের কথা আগে বলিনি। কী জানি, জানতে পারলে হয়তো বাড়ি থেকে বেরোতেই দেবেন না কিংবা বকুনি দিয়ে হয়তো নিজের কাছে বসিয়ে রাখবেন। রাত্তিরবেলায় যখন ফিরছিলাম, ওই দলের একজন একটু মত্ত অবস্থাতেই আমার কাছে এসে বলল—‘অ্যাই, কিধার যাতা?’
গলার স্বরটাকে নকল করে আমি বললাম—‘যিধার খুশ।’
লোকটা অপমানিত বোধ করল। সুরটা একটু চড়িয়ে আমাকে বলল— ‘পাঁচঠো রূপেয়া দে যাও!’
আমি এই সুযোগেরই অপেক্ষা করছিলাম। সজোরে এক ঘা বসিয়ে দিয়ে বললাম—‘লিজিয়ে!’
লোকটা এরজন্য প্রস্তুত ছিল না। আচমকা আঘাতে, পড়ে গেল রাস্তার ওপর। তার দলের দশ-বারো জন সঙ্গীকে পড়ে যেতে দেখে, আমাদের চার পাঁচ জনের ওপর বাঘের মতো লাফিয়ে পড়ল। কিন্তু ওই পর্যন্তই।
বিশেষ দ্রব্যের প্রভাবে আমাদের সামনে তারা বেশিক্ষণ আর দাঁড়াতে পারল না। হোক না কেন তারা আমাদের চেয়েও লম্বাচওড়া আর বিশেষ শক্তিশালী।
মিনিট দশেকের মধ্যেই ওদের রণে ভঙ্গ দিয়ে পালাতে হল। ততক্ষণে কিন্তু আমাদের সকলকারই গায়ে, মুখে, মাথায় ওরা খানিকটা করে চিহ্ন এঁকে দিয়ে গেছে। পায়ে পা লাগিয়ে আমিই প্রথম ঝগড়া বাধাতে গিয়েছিলাম বলে, আমি পড়েছিলাম ওদের মাঝখানে। আমার বন্ধুর দল না থাকলে ওরা আমাকে হয়তো মেরেই ফেলত সেদিন। কিন্তু বন্ধুরা থাকার দরুন আমার মাথাটাই সেদিন ফেটেছিল। জামাকাপড়ের অবস্থাও সেইরকম। বেশ ছিঁড়ে গেছে। দরদর করে রক্ত কপাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। পুলিসের ভয়ে তাড়াতাড়ি ঢুকতে হল বাড়িতে।
ভেবেছিলাম কলে মুখ-হাত ধুয়ে জামাকাপড়টা বদলে নেব। তারপরে মাথায় একটা ব্যান্ডেজ করলেই হবে। আমার জামাকাপড়ের ওই অবস্থা আর রক্ত দেখেই, বুড়ো খবরটা মাকে গিয়ে দিল। ব্যস, আর যায় কোথায়! কলঘরের মধ্যেই ছুটে এলেন তিনি। জোর করে রক্ত ধুয়ে দিয়ে নিজের শাড়ির আঁচলা ছিঁড়ে ফেলে কপালে ব্যান্ডেজ করে দিলেন। তারপর, সে রাত্রে কাছে বসিয়ে খাইয়ে, নিজের কাছে নিয়ে শুলেন তিনি। আমার কোনো ওজর-আপত্তি তাঁর কাছে সেদিন টিঁকল না। সারারাত কেবল মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছেন।
আমি যত তাঁকে বোঝাবার চেষ্টা করি—‘মা, আমার কিছুই হয়নি, তুমি ঘুমোও।’—উত্তর শুনি কেবল একটা কথা—‘তুই আগে ঘুমো, তারপরে আমি ঘুমোবো।’
আমি বলি—‘কেন তুমি এত ভাবছ, আমি ভালো আছি, আমার কিছু হয়নি।’
উত্তরে কেবল তিনি বললেন—‘তোর কী হয়েছে না হয়েছে তা কী আমায় বলে দিতে হবে?’
অত বয়সেও তিনি আমার সঙ্গে ব্যবহার করতে লাগলেন যেন আমি একটা দু’বছরের ছেলে। নিজের আঘাতের গুরুত্বটুকুও বোঝবার ক্ষমতা যেন আমার নেই।
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। ভেবেছিলাম দেখব, মা ঘুমিয়ে পড়েছেন। তার বদলে দেখলাম, তন্দ্রার কোলে ঢলে পড়েও তিনি জোর করে জেগে থেকে আমার শুশ্রূষা করবার চেষ্টা করছেন।
আমি মাকে বলি—‘মা, তুমি শুয়ে পড়ো, আমি ভালোই আছি।’
আমাকে উত্তরে তিনি কেবল বললেন—‘হুঁ, তুমি যে কেমন আছো তা আমার আর জানতে বাকি নেই! এখন জ্বর না এলে বাঁচি!’—কথাগুলো বলতে বলতে তাঁর দু চোখ ভরে এল জল।
আমি বলি—‘লাগল আমার, ব্যথা পেলে তুমি? আমার কী হয়েছে, আমি কি কচিখোকা যে কিচ্ছু বুঝতে পারি না?’
মা একটু রাগতভাবে বললেন—‘না তুমি খুব বুড়ো হয়েছ! এখন ঘুমিয়ে আমাকে উদ্ধার করো।’
সেইদিনই প্রথম বুঝতে পারলাম, আমি এতটুকু ব্যথা পেলে তা কতখানি হয়ে মা’র বুকে গিয়ে লাগে। কতখানি স্নেহ আর মমতা দিয়ে তিনি আমাদের ঘিরে রেখেছেন! আর বিনিময়ে আমি মাকে কী দিতে পারলাম!
সেরে উঠলাম দিন তিনেকের মধ্যে। ওই ঘটনাতে আর একটা ব্যাপার দেখতে পেয়েছিলাম। জানি না কেমন করে কথাটা পৌঁছেছিল গৌরীর কানে। সেও কেঁদে কেঁদে হয়েছিল সারা। ও-তো ভেবেইছিল গুন্ডারা বুঝি আমায় মেরেই ফেলেছে।
১৯৪৮ সালের প্রথম দিকে গৌরী শুরু করল অনশন। কারণ ওর বাড়ি থেকে তখন ওর জন্য পাত্র স্থির করা হয়েছে। বিয়েরও আর বেশি দেরি নেই, একরকম উপায়হীন হয়েই প্রতিবাদস্বরূপ সে খাওয়া বন্ধ করল।
অগত্যা ওর বাবা মাকে রাজি হতে হল ওরই কথায়। ছাড়া পেল গৌরী, এল আমাদের বাড়ি। আমার হাত ধরে বলল—‘চলো আমার বাবার কাছে, গিয়ে বলো সব কথা তাঁকে। উনি নিশ্চয়ই রাজি হবেন। আমাদের বিয়ে দেবেন।’
দুরুদুরু বুকে গৌরীর সঙ্গে এগিয়ে গেলাম ওদের বাড়িতে। বাড়ির সামনে গিয়ে কেমন যেন ভয়ে গলা শুকিয়ে আসতে লাগলো। পরে শুনেছি প্রেমের ধর্মই নাকি সন্দেহ করা।
আমার হঠাৎ মনে হল, যদি গৌরী আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে, যদি ওর বাবাকে দিয়ে দরোয়ান ডেকে মারের ব্যবস্থা করে থাকে, তাহলে?
সব সাহস কোথায় আমার চলে গেল। যেই গৌরী গেল তার বাবাকে ডাকতে, অমনি আমিও সেখান থেকে পত্রপাঠ গেলাম পালিয়ে।
আমায় খুঁজে না পেয়ে গৌরী আবার এল আমার কাছে। বললো—‘পালিয়ে এলে যে? বলতে হবে না?’
আমি বলি—‘না মানে, একা গিয়ে বলব ওঁর সামনে, তাই এসেছিলাম বুড়োকে ডাকতে। ওকেও সঙ্গে নিয়ে যাই না।’
আমার একার সাহসে যে কুলোচ্ছেনা তা বোধহয় বুঝেছিল গৌরী। তাই বোধহয় রাজি হল আমার কথায়।
আমি বুড়োকে সঙ্গে নিয়ে আবার গেলাম ওদের বাড়িতে। বিশেষ কিছু বলতে হল না। গৌরীর বাবা নিজের থেকে বললেন—‘ও আমার আদরের মেয়ে, ওকে অযত্ন কোনোদিন করবে না তো?’
আমি বলি—‘দেখুন, আমার সাধ্যমতো’—
কথাটা একরকম মুখ থেকে কেড়ে নিয়েই বললেন তিনি—‘করো তো পোর্ট কমিশনারে চাকরি, ফিলিমে নামবারও চেষ্টা করছ শুনেছি। যাহোক, তোমরা সুখী হও। তবে এইটুকু কথা দাও, জীবনের কোনো অবস্থাতেই আমার গৌরীর অনাদর করবে না। এইটুকুই তোমার কাছে আমার অনুরোধ। আমি যাব তোমার বাবার কাছে, তিনি মত দেবেন তো এ বিয়েতে?
আমি বলি—‘মাকে আমি বলে রাখব। আশাকরি উনিও মত দেবেন।’
কথাটা বোধহয় ইতিপূর্বে মা কানাঘুষোয় শুনেছিলেন। তাছাড়া গৌরীকে মা’র বরাবরই পছন্দ হয়েছিল।
মাকে কথাটা বিশেষ করে বলতে হল না। অনুমতি চাইবার ভূমিকা করতে না করতেই তিনি আমায় বললেন—‘খোকা, বিয়ের ব্যাপার, ভালো করে ভেবে বল, তুই সুখী হবি তো?’
আমি বলি—‘হ্যাঁ মা, যদি তুমি আশীর্বাদ করো।’
মা বললেন—‘আশীর্বাদ! তোর সুখই আমার সব সময় লক্ষ্য! তোর বাবাকে আমি রাজি করাবোই।’
এদিকে গৌরীর বাবাও এলেন আমাদের বাড়িতে। কথাবার্তাও হল পাকাপাকি। ১ জুন সকালবেলায় আমাদের বাড়িতে বেজে উঠল শুভ সানাই। অবসান হতে চলল দীর্ঘ প্রতীক্ষার।
১৮
সানাই তো বাজল। ভৈরবীর সুরে তানের সঙ্গে সানাই সুরের জাল বুনে চলল। ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনেও তা শুনে দোলা লাগল।
যাকে পাবার জন্যে এতদিন করেছি প্রতীক্ষা, তাকেই আজ পেতে চলেছি। কিন্তু মন তো বিশ্বাস করে না!
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আত্মীয় কুটুম এসে বাড়ি ভরিয়ে তুললেন। আমি এদিক ওদিক ঘুরছি। সকলকার লক্ষই আমার ওপর। আমি বর, অর্থাৎ hero of the day.
আজ স্বীকার করছি, জীবনে অনেকবার হিরো সেজেছি, মঞ্চে, পর্দায় কিছুতেই বাদ যায়নি, কিন্তু এমন হিরো আমি কখনও সাজিনি।
প্রেক্ষাগৃহে নায়ক সেজে দর্শকের সামনে বারবার হাততালি পেয়েছি। পর্দার ওপরে আমার ছবি দেখে, অনেকে আমার উদ্দেশে হাততালি দিয়েছেন। অসংখ্য চিঠি আর অভিনন্দনও পেয়েছি আপনাদের কাছ থেকে। কিন্তু সেদিনকার নায়ক হবার অনুভূতি আর ফিরে আসেনি আমার জীবনে।
যিনিই আসেন আমাদের বাড়িতে, তিনিই খুঁজতে থাকেন আমাকে। সকলকার মুখেই সেই একই কথা—‘কোথায় গেল অরুণ?’
প্রথমটা ভয় ভয় করলেও, তা কাটতেও দেরি হল না। গাত্রহরিদ্রা আর নান্দীমুখের পালা চুকতেই বেলা গড়িয়ে দুপুর হল। দারুণ খিদে পেয়েছিল। মা’র কাছে গিয়ে বললাম—‘কিছু খেতে দাও মা?’
মা কিছু বলবার আগেই আমার এক বৌদি বলে উঠলেন—‘ওমা, খাবে কি গো ঠাকুরপো! সন্ধের পর বৌয়ের চাঁদমুখ দেখলেই পেট ভরে যাবে! এখন থেকে খেলে পরে অম্বল হতে পারে।’
রসিকতা করবার সুযোগ আমিও ছাড়ি না, বলি—‘তোমার মুখখানা দেখে দাদার কি পেট ভরে গিয়েছিল? না অম্বল হয়েছিল?’
বৌদি বলেন—‘আমার মুখখানা তো আর চাঁদের মতন নয়! আর গৌরীর মতন আমি তো আর না খেয়ে তপস্যা করিনি শিবকে পাবার জন্যে, যে আমার মুখ দেখে তোমার দাদার পেট ভরবে।’
কথা বাড়ালেই বাড়ে, অথচ আসল কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না দেখে মাকে বলি—‘মা, আজ কি কিছু খেতে দেবে না?’
মা বলেন—‘খোকা, আজ যে খেতে নেই বাবা! আর কয়েক ঘণ্টা পরে বিয়ে হয়ে গেলে একেবারে খাবি।’
সন্ধেবেলায় জাঁতি হাতে বেনারসি জোড় পরে মাথায় টোপর দিয়ে চললাম গৌরীদের বাড়ির উদ্দেশে।
সোজা রাস্তায় গেলে ওঁদের বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে বেশি দূর নয়। সোজা পথে কেউ যেতে রাজি হল না। ভবানীপুরের এ রাস্তা সে রাস্তা ঘুরে রাত সাড়ে সাতটা-আটটা নাগাদ আমরা পৌঁছোলাম ওদের বাড়িতে। জোড়া শাঁখ, সানাই আর উলুধ্বনিতে ওঁরা আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন।
একটু আড়ষ্ট হয়েই আসরের মাঝখানে বসলাম। কিছুক্ষণ বসবার পর, বাবা, জেঠামশায়ের অনুমতি নিয়ে ওঁরা আমায় নিয়ে গেলেন ভেতরে। দেখলাম সেখানে গৌরীকেও আনা হয়েছে। লাল বেনারসি পরে, কপালে চন্দন দিয়ে ওকে যেন আরও সুন্দর দেখাচ্ছে। হাঁ করে চেয়েছিলাম সেদিকে। তখন ভেবেছিলাম আজ থেকে গৌরীর দিকে চাইতে আর কোনো বাধা নেই।
কিন্তু আমি ভুলে গিয়েছিলাম, সেটা বিবাহ আসর। পরমুহূর্তেই এমন একটা ঘটনা ঘটল যাতে বড়ো মর্মান্তিকভাবে আমাকে মনে করিয়ে দিল বাস্তবের কথা।
গৌরীর ঠাকুমা সকলকার সামনেই আমার ডান কানটা মলে দিয়ে বললেন—‘ওহে ছোকরা, ওদিকে অত কী দেখছ? এদিকে, আমাদের দিকে একটু চাও। গৌরী তো ও মুখ দেখবেই। আমরা একটু দেখে নিই, এই ফাঁকে!’
আমি বলি—‘ফিল্মে এই মুখ তো দেখেছেনই। তাছাড়া আমার মুখ কি আপনাদের ভালো লাগবে?’
তিনি বলেন—‘ফিল্মে দেখেছি বলেই তো চাক্ষুষ দেখবার ইচ্ছে এই মুখখানা। নাতনি আমার হিরে চেনে। খুঁজে খুঁজে বারও করেছে দেখো! কী মিষ্টি দাদার মুখখানা আমার! শুধু গৌরী কেন, বুড়ো বয়সে আমারই ভুলতে ইচ্ছে করছে। মনে হচ্ছে দিদি খাবার আগে আমিই সবটুকু চুষে খাই। কেমন গো দাদা, রাজি?’
কথা শেষ করে ফোকলা মুখে বুড়ির সে কী হাসি!
একে একে বিয়ের সব পর্ব মিটে গেল। ফুলশয্যার রাত্রে গৌরী আর আমার দেখা হল এক নিভৃত ঘরে। সে আর এক অনুভূতি! লিখে বোঝাবার নয়। বোধ হয় চোখে দেখলেও বোঝা যায় না। এ অনুভূতি বুঝতে গেলে চাই মন।
গৌরী প্রথমটা আমার সঙ্গে কথা বলেনি। হাত ধরে তাকে কাছে বসিয়ে আমি প্রশ্ন করি—‘আমরা তোমাদের মতো বড়োলোক নই। তোমার কষ্ট হবে না এ বাড়িতে?’
আমার বুকের ওপর মুখখানা রেখে গৌরী বলে—‘তোমার বলছ কাকে? আমি কি তুমি ছাড়া? বড়োলোক বলে আমাকে কেন দূরে ঠেলে দিচ্ছ?’
বেশ খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম গৌরীর কথায়। সত্যিই তো, ও তো আর পর নয়! ও যে আমাদেরই একজন।
নিজের বোকামিতে কথাটা বলে ফেলেছিলাম। তাই তাড়াতাড়ি কথাটা ঘুরিয়ে নিয়ে বলি—‘আচ্ছা গৌরী, এখন তো ফিল্মে চান্স পাচ্ছি, দু একটা ছবিতে কাজও করছি। এমন দিন যদি আসে যে অফিসের কাজ ছেড়ে দিয়ে খালি ফিল্মের কাজ আমায় করতে হয়? তাহলে তুমি রাগ করবে না?’
—‘আমি রাগ করব? কেন?’
—‘অন্য মেয়েদের সঙ্গে আমাকে অনবরত অভিনয় করতে হবে বলে।’
গৌরী আমার কাছে সরে এসে বললো—‘আমায় বলো তুমি আমায় কোনোদিন ভুলে যাবে না!’
—‘না, জীবন থাকতে তোমায় ভুলতে পারব না।’
গৌরী বলে—‘তাহলে জেনে রাখো, কারোর সাধ্য নেই তোমাকে আমার বুক থেকে ছিনিয়ে নেয়। কারণ আমি যে তোমায় ভালোবাসায় বেঁধে ফেলেছি! সে বাঁধন কাটিয়ে তুমি যাও, অতখানি শক্তি তোমার নেই। তুমি এগিয়ে যাও তোমার ইচ্ছেমতো। করো তোমার যা খুশি। তাতে আমি ভয় পাই না।’
শেষের কথাগুলো বলতে বলতে ওর চোখের চাহনি কেমন যেন তীব্র হয়ে গেল। সে দীপ্ত চোখের সামনে আমিও চাইতে পারলাম না, চোখ ঘুরিয়ে নিলাম। জবাব আর দিতে পারলাম না। দু হাত দিয়ে ওকে টেনে নিলাম নিজের বুকে।
ফিল্ম থেকে কিছু টাকা পেয়ে, (অবশ্য তখনও আমি ‘ফ্লপ-মাস্টার জেনারেল’, অর্থাৎ আমি নামলেই ছবি চলে না।) কিনলাম একটা হিন্দুস্তান গাড়ি। প্রথম প্রথম নিজেই সেটা চালাতাম। নতুন গাড়িখানা নিয়ে গিয়েছিলাম একদিন গৌরীদের বাড়ি। নাতজামাই গাড়ি কিনেছে শুনে, ভেবেছিলাম গৌরীর দাদু সুখী হবেন। নাতনিকে গাড়ি চড়িয়ে নিয়ে বেড়াই বলে, আমাকে একটা বাহবা দেবেন। সেই বাহবা পাবার আশায় বলে ফেললাম—‘দাদু, একটা গাড়ি কিনেছি। চলুন আপনাকে খানিকটা ঘুরিয়ে আনি।’
বৃদ্ধ অমনি ঝংকার মেরে বললেন—‘হেঃ, গাড়ি কিনে টাকাটা নষ্ট করলে তো! বলি সেটাকে জমিয়ে জমি কেনো না। ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।’
আমার উৎসাহ কোথায় উবে গেল। বলি—‘তা দাদু, মানে আমার একটু দরকার কিনা গাড়ির! তাই এটা কিনলাম।’
বৃদ্ধ মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে বললেন—‘কিনেছ বেশ করেছ, বাজে খরচ আর না করে, এইবার জমানোর দিকে মন দাও। ভবিষ্যতে ছেলেমেয়ে হলে তখন সামলাবে কী করে?’
বৃদ্ধের উপদেশের মূল্য সেদিন বুঝতে পারিনি, আজ বুঝতে পেরেছি মর্মে মর্মে।
১৯
১৯৫০ সালে আমার একমাত্র সন্তান গৌতম জন্মালো সেপ্টেম্বর মাসে। অদ্ভুত এই সেপ্টেম্বর মাস! এই মাসেই জন্মেছি আমি, এই মাসে জন্মেছে গৌরী, আর আমাদের একমাত্র সন্তান সেও জন্ম নিয়েছে এই সেপ্টেম্বর মাসেই।
ফিল্ম করি বটে, ছবি চলে না বলে আনন্দ পাই না। সমাজে স্বীকৃতি কই? তা ছাড়া, অভিনেতা হিসেবে যে যশ আমি আকাঙ্ক্ষা করেছিলাম তা কিছুইতো পেলাম না!
তাহলে, এ লাইন ছাড়ব? অফিস পালিয়ে স্যুটিংই বা করব ক’দিন? ওদিকে গোরাচাঁদবাবু ছিলেন, তাই চলে যাচ্ছে। কিন্তু এভাবে দু নৌকোয় বেশিদিন পা দিয়ে থাকলে তো আমার চলবে না।
যা হোক, জীবনের একটা লক্ষ্য ঠিক করে নিতে হবে। হয় ফিল্ম, না হয় অফিস। অফিসে উন্নতি কতদূর হবে তাতো জানাই আছে। আমার মতো বিদ্যের ছেলে আর কতদূরই বা এগোতে পারবে। অফিসে উন্নতি করতে গেলে চাই ব্যাকিং, চাই বিদ্যে। কিন্তু ও দুটোই আমার নেই। এই না থাকার দরুন চাকরিতে উন্নতির আশাও আমার মন থেকে চলে গেছে। তাহলে?
ফিল্মে তো তিন-চারখানা ছবি করলাম, সবকটাতেই সেই একই ভাব। উন্নতি কোথায়? দর্শকরা যদি আমাকে মেনে না নেন, প্রডিউসাররাই বা নেবেন কেন?
এমনি সময় আমার জীবনে ঘটল একটা ঘটনা। এম. পি.তে তখন নতুন ছবি খোলা হবে। নাম ‘বসু পরিবার’৬৭। কাহিনিটা শোনা যায় মুরলীবাবুর (এম. পি.র স্বত্বাধিকারী) নিজের। শৈলেন রায়৬৮ মশায় পরে সাজিয়ে গুছিয়ে তাকে লিপিবদ্ধ করেন। এই বইটির জন্য তখনকার দিনে এম. পি., নির্মল দে৬৯ নামে এক পরিচালককে ঠিক করেছিলেন।
সুন্দর সৌম্য মূর্তি তাঁর। দেখলেই শ্রদ্ধা হয়। থাকতেন তিনি আমাদেরই এই ভবানীপুরে ‘ইন্দুভূষণের’ দোকানের ওপর এক মেসে। ‘বসু পরিবার’ বইটা পড়ে অবধি নিজেকে নায়ক সুধীন বলে কল্পনা করতে আমার ভালো লাগত।
একদিন এম.পি.র অফিসে গিয়ে আভাসে বিমলবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম— ‘নতুন ছবির নায়ক কে হবে?’
বিমলবাবু বললেন—‘বোধহয় নির্মলবাবু অভি ভটচায৭০, মহাশয়কে ঠিক করেছেন। তাঁকে না পাওয়া গেলে অসিতবাবু মানে অসিতদা।’
চুপ করে থাকি, বলতে পারি না কোনো কথা। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে বিমলবাবু বললেন—‘কিছু কি বলবি আমাকে?’
বলবার ইচ্ছে তো অনেক কিছুই। কিন্তু বলব কোন মুখে? কোম্পানি আমাকে নায়ক সাজিয়ে একটা ছবিতেও পয়সা পায়নি। সে ক্ষেত্রে আমি কী করে বলি আমাকে আপনারা নায়ক মনোনীত করুন।
তবুও আমতা আমতা করে বলি—‘বিমলদা, আমাকে আর একটা চান্স দিতে পারেন?’
—‘চান্স, উত্তম! তোকে তো দিতে ইচ্ছে করে ভাই’—বিমলদা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বলেন—‘কিন্তু—‘
আমি একটু উৎসাহিত হয়েই প্রশ্ন করি—‘কিন্তু কী বিমলদা?’
—‘তোর নাম নায়কের তালিকায় দেখলে ধর্মতলা তো টাকা দিতে চায় না।’
ধর্মতলা মানে ডিস্ট্রিবিউটিং কোম্পানিগুলি। এই ডিস্ট্রিবিউটিং কোম্পানির কাজ হল, ছবির কাজ কিছুদূর এগোলে ফিল্ম কোম্পানিগুলিকে টাকা দেওয়া। পরে ছবি শেষ হলে, একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এই ছবিগুলো থাকে তাঁদেরই তত্ত্বাবধানে। ফলে, তাঁরা যা টাকা দিয়েছেন তা তখন উঠে যায়। ছবি ভালো হলে আসল তো ওঠেই, তার সঙ্গে প্রচুর লাভও হয়। এইভাবেই চলে ফিল্মের ব্যবসা।
আমার নাম যদি নায়কের ক্ষেত্রে থাকে, তাতে যদি কোম্পানি টাকা না পায়, এবং সেই কারণেই তাঁরা যদি আমাকে ছবিতে চান্স না দেন, তাতে আমার দুঃখের কিছু থাকতে পারে না, অভিযোগ করবারও কিছু নেই।
কিন্তু তবু দুঃখ হল। বিমলদার কথা শুনে সমস্ত বুকের ভেতরটা যেন মুচড়ে উঠল। ভাবলাম মিথ্যে আমার এতদিন স্বপ্ন দেখা। মিথ্যে আমার জীবনের অলীক কল্পনা। তৃষ্ণার্ত মানুষ যেমন ছুটে বেড়ায় মরীচিকার পেছনে, শেষকালে নিজের জীবন দিয়ে আকণ্ঠ তৃষ্ণা নিয়ে রৌদ্রকিরণে বালির ওপর মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে যেমন তার নিজের ভুল বুঝতে পারে, আমিও ঠিক যেন এতদিন পরে নিজের ভুল বুঝতে পারলাম।
মনে হল কার পেছনে ছুটেছি এতদিন? ও মায়াবিনী রাক্ষুসী। ফিরে যাই আমার পোর্ট অফিসের চাকরিতে। ছেড়ে দিই এ সমস্ত স্বপ্নবিলাস।
আমার মুখে বোধহয় হতাশার চিহ্ন খানিকটা ফুটে উঠেছিল, তাই বিমলদা আমাকে আশ্বাস দিয়ে বললেন—‘আচ্ছা, দেখি একবার নির্মলবাবুকে বলে। যদি তিনি—‘
অভিমানক্ষুব্ধ স্বরে আমি বলি—‘না না বিমলদা, ওঁকে বলে শুধু শুধু—‘
বিমলদা বললেন—‘শুধু শুধু নয় রে। দেখি কী করা যায়।’
কেটে গেল আরও দু’চার দিন। গোরাবাবুকে জানিয়েছি, আমি শীঘ্রই ফের নিয়মিত অফিস করব। এ লাইন জন্মের মতো ছেড়ে দেব।
শুনে গোরাবাবু আমাকে বললেন—‘তুই উন্নতি করলে আমি সত্যিই সুখী হতাম। আর এ লাইন যদি সত্যিই ছেড়ে দিবি মনে করিস, তবে মন দিয়ে অফিস কর।’
সে রাত্রি আমার জীবনে একটা দুর্যোগের রাত্রি। মুখ দেখেই বোধহয় গৌরী আঁচ করেছিল ব্যাপারটা। আমাকে প্রশ্ন করলো—‘কী হয়েছে গো?’
আমি বলি—‘কিছু নয়।’
গৌরী বলে—‘লুকোবে কাকে, মুখ তোমার কালো হয়ে গেছে। তবুও তুমি আমাকে বলছ, কিছু নয়!’
আমি ব্যর্থ হাসবার চেষ্টা করি, বলি—‘গৌরী, ফিল্ম লাইন ছেড়ে দেব ভাবছি। আমি আবার পোর্ট অফিসের চাকরিতে নিয়মিতভাবে যাব।’
—‘চাকরিতে ফিরে যাবে? তুমি বলছ কী? আমি তো ভাবছিলুম তুমি চাকরিটা এবার ছেড়ে দেবে। যা করছ সেই কাজটাই মন দিয়ে করবে। ওতেই তোমার উন্নতি হবে।’
—‘উন্নতি, না অবনতি হবে! দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে চেষ্টা করলুম এই লাইনে, কিন্তু বলো তো কী পেলাম! এখনও—‘
কথাটা আর আমি শেষ করতে পারি না। মনের জমাট দুঃখ গলে চোখের জল হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
ঢাকবার চেষ্টা করতে অন্য দিকে মুখ ফেরালাম, কিন্তু লুকোতে পারলাম না।
গৌরী বুঝতে পারল। শাড়ির আঁচল দিয়ে আমার চোখ মুছিয়ে দিয়ে বললো—‘তুমি অত ভাবছো কেন? যা চাইছ, তা নিশ্চয়ই পাবে। মাথার ওপরে ভগবান বলে একজন আছেন।’
ইচ্ছে হল চেঁচিয়ে প্রতিবাদ করে বলি—ভগবান নেই। তাহলে এতদিনে নিশ্চয় তিনি আমার প্রার্থনা শুনতেন। গৌরী ব্যথা পাবে বলে বললাম না।
সে রাত্রে ভালো করে ঘুম আসতে চাইল না। কেমন যেন একটা অস্বস্তি, কেমন যেন একটা অশান্তি।
মনে মনে ভাবলাম ভগবান বলে যদি কেউ থাকেন, (থাকেন কেন বলছি নিশ্চয়ই আছেন, নইলে এত লোক কি মিথ্যের পেছনে ছুটছে?) প্রাণভরে একবার তাঁকে ডাকি।
অশান্তি আর হতাশায় মানুষ যেমন করে ভগবানকে ডাকতে পারে, হয়তো সুখের দিনে তেমন করে ডাকতে পারে না। বোধহয় ডাকতে চায়ও না। সে রাত্রে কখন যে তাঁর নাম করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তা আর মনে নেই। পরের দিন যখন ঘুম ভাঙল বেশ বেলা হয়ে গেছে। শরীর মন তখনও অবসন্ন।
মুখ হাত ধুয়ে গেলাম মা’র কাছে। মুখের চেহারা দেখেই তিনি বললেন—‘কী হয়েছে রে খোকা? শরীরটা খারাপ নেই তো?’
—‘না, মা, শরীর আমার ভালোই আছে। তবে—‘
—‘তবে কী রে?’
আমি বলি—‘নাঃ, কিছু না।’
মা বলেন—‘তুই আমার কাছে কিছু লুকোচ্ছিস?’
আমি বলি—‘না, মা, লুকোইনি। বলছি—‘
বলে তাঁকে সমস্ত ঘটনা বললাম। তারপরে বলি—‘এর পরে কি আর কারোর কিছু ভালো লাগে!’
আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে তিনি বললেন—‘খোকা, ভগবানের খেলা বোঝা ভারী শক্ত। মানুষ মিথ্যে অহংকারে ভাবে সে সবটাই বুঝতে পারছে।’ তাঁর খেলা বোঝা যে কী শক্ত সে কথা বুঝেছিলাম খানিক পরেই।
সেইদিন খাওয়াদাওয়া সেরে গেলাম পোর্ট অফিসে। সেখান থেকে গেলাম এম. পি.তে।
বিমলদা আমায় দেখেই বললেন—‘এই যে উত্তম, আরে তোকেই খুঁজছিলাম এতক্ষণ! অভি ভটচাযকে কলকাতায় আসবার জন্যে টি. এম. ও. করেছিলাম বম্বেতে। টাকা ফেরত এসেছে। সে এখন অন্য ছবির কাজে ব্যস্ত। এ ছবি করা সম্ভব হবে না। এখন তোকে নিয়ে একবার আমায় যেতে হবে নির্মলবাবুর কাছে। দেখা যাক কী হয়। ওদিকে অসিতবাবুকেও খবর দিয়েছি। নির্মলবাবু কাকে পছন্দ করেন, দেখি।’
আমি বিস্মিত হয়ে বড়ো বড়ো চোখ করে বলি—‘আমি?’
বিমলবাবু বলেন—‘হ্যাঁ তুই। অভিনয় কি তুই খারাপ করিস!’