হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি মোর – ৫

নাঃ, দিন আমার কাটবে না। মেয়েটাই আমাকে পাগল করবে। কেবলই তার চিন্তা। অফিসে যাই, কাজ করতে করতে কেবল মনে পড়ে সেই মুখখানা। অফিস থেকে বাড়ি ফিরে দরজার কাছে বসে থাকি, যদি সে অন্নপূর্ণার সঙ্গে দেখা করতে আসে তাহলে আর কিছু না হোক একবার দেখতে তো পাব!

আঃ, কী অধীর প্রতীক্ষা! কিন্তু যার জন্যে এত, তার মনের ভাবটা কী, তা তো জানতে পারা গেল না! কী বা ভাবে সে আমার সম্বন্ধে! কোনো করুণা, কোনো স্নেহ, কোনো আকাঙ্ক্ষা তার আছে কি আমার জন্যে?

সাজপোশাক দেখে মনে হয় বড়োলোকের মেয়ে। আমাকে তার ভালো লাগবে কেন? আমাদের অবস্থা তো এই! তার ওপর করি তো সামান্য মাইনের চাকরি! এসব জেনেশুনেও— নাঃ,—আর ভাবতে পারলাম না।

তাড়াতাড়ি খাওয়াদাওয়াটা সেরে নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম, যদি সে আসে।

ঝোঁকের মাথায় ভুলেই গিয়েছিলাম, আজ তার আসবার কোনো সম্ভাবনা নেই।

কারণ, অন্নপূর্ণা গেছে গানের স্কুলে গান শিখতে।

বসে থাকাই হল সার—‘সে ফিরে এল না’। বুকের ভেতরটা কেমন যেন খাঁ খাঁ করে উঠল। কিন্তু আমি নিরুপায়। হঠাৎ মনে হল, আমারই মতো অন্য কোনো বড়োলোকের ছেলে, নতুন একটা ‘অস্টিন’ বা ‘মরিস’ বা ওই ধরনের কোনো গাড়িতে তাকে বসিয়ে সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছে না তো?

আবার সেই হতাশা। কখনওবা সেই কল্পিত ছেলেটির উদ্দেশ্যে নিজের অজান্তে, আমার বক্সিং-করা হাতদুটো মুখের কাছে তুলে ধরেছি ঘুসি বাগিয়ে, তা নিজেই বুঝতে পারিনি।

তখন আমার মনের অবস্থা একেবারে অবর্ণনীয়। আমার অজ্ঞাতে আমার সীতাকে কি রাবণ হরণ করে নিল? তা কিছুতেই হবে না! হতে আমি দেব না।

মনে মনে কতরকম প্যাঁচ কষছি তাকে জব্দ করব বলে। হঠাৎ ও, কী ও? নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করা গেল না। সে-ই নয়? হ্যাঁ, হ্যাঁ, সে-ই তো! অন্নপূর্ণার সঙ্গে আমাদের বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে। তাহলে মেয়েটা গানের স্কুলে গান শেখে? হুররে! কোনো রাবণ তাকে হরে নিয়ে যায়নি! আমার চান্স তাহলে এখনও আছে!

কিন্তু না! গম্ভীর হতে হবে। কোনোরকম ছ্যাবলামি করে ফেললে যদি পাগলা বলে পালিয়ে যায়! সব দিক দেখেশুনে, তবে এগোতে হয়।

কিন্তু এগোবো কোথায়! ও যে বড়োলোকের মেয়ে! সঙ্গে রয়েছে বিরাট দারোয়ান!

নিজের অজ্ঞাতসারেই সেদিকে এতক্ষণ চেয়েছিলাম। কিন্তু যেই তার সঙ্গে চোখাচোখি হল, অমনি চোখ ফিরিয়ে নিলাম।

কী জানি আমার কল্পনা কতদূর সত্য হবে তা কে বলতে পারে?

ওরা ততক্ষণে এসে -পড়েছে বাড়ির কাছে। অন্নপূর্ণা ঢুকে পড়ল বাড়ির মধ্যে। সেই মেয়েটাও ফিরে গেল বাড়ির দরজা থেকে। যাবার সময় কয়েকবার পেছন ফিরে চাইল। হঠাৎ আমার মনে হল, আমার চোখে চোখ পড়ায় সে কেমন যেন ফিক করে হেসে ফেলল। আমারও বুকের ভেতরের রক্তটা কেমন যেন ছলাৎ করে উঠল।

তবে?

আজ লজ্জার মাথা খেয়ে অন্নপূর্ণাকে জিজ্ঞেস করলুম—‘মেয়েটা কে রে তোকে পৌঁছে দিতে এসেছিল?’

অন্নপূর্ণা বলে—‘কে বলো তো?’

আমি আরও বিস্মিত হয়ে গিয়ে বলি—‘ওই যে এক্ষুনি এসেছিল!’

অন্নপূর্ণা বলল—‘ও তো গৌরী!’

—‘গৌরীটা ক্যা?’

—‘ওর নাম গৌরীরানী গাঙ্গুলি২২। ল্যান্সডাউন রোডের২৩ বিখ্যাত বড়োলোক চণ্ডীচরণ গাঙ্গুলির মেয়ে।’

—‘তোর সঙ্গে ভাব হল কী করে?’

—‘গানের স্কুলে।’

একে বড়োলোকের মেয়ে। তার ওপর—

মনের ভাবটা গোপন করে অন্নপূর্ণাকে জিজ্ঞেস করি—‘ও-ও গান শেখে?’

—‘হ্যাঁ। শুধু শেখে নয়, বেশ ভালোই গায়। কিন্তু গৌরীর সম্বন্ধে এত প্রশ্ন করছ কেন?’

কেন করছি—মনে মনেই বলি—মুখে বলি—‘এমনি,—বসেছিলুম,— দেখলুম —তাই—‘

অন্নপূর্ণা গৌরীর চেয়ে বয়সে কিছু বড়ো। আমার অভিসন্ধিটা বোধহয় সে বুঝতে পারলে। তাই তার মুখে কেমন চাপা হাসি ফুটে উঠল।

আমি বুঝলাম, গতিক ভালো নয়। দূতীকে ক্ষ্যাপালে ফল হয়তো ভবিষ্যতে খারাপ হবে। তার চেয়ে যেমন চলছে চলুক। পরে সময় বুঝে যা হয় একটা কিছু করা যাবে।

করা তো যাবে! কিন্তু করবটা কী! বহুদিন ধরে ভেবেচিন্তে তেমন কোনো একটা প্ল্যান মাথায় আনতে পারলাম না। মেয়েটার মনোভাব না বোঝা অবধি এগোনোও তো কিছুতে যায় না! যদি অপমান করে!

বোধহয় মানুষমাত্রই বিরহযন্ত্রণা উপস্থিত হলে কবিতা লেখে। কবিতা পড়তেও ভালো লাগে। তাই প্রথমেই আমি বার করে ফেললাম বৈষ্ণব কবি বিদ্যাপতির একখানা গান। আপনাদের কাছে তা অত্যন্ত পরিচিত। সেই—

‘সখি হামারও দুঃখকো

নাহি ওর রে

ই ভরা বাদর, মাহ ভাদর

শূন্য মন্দির মোর’

কবিতা যখন লিখতেই পারি না তখন এই পথ বেছে নিলাম। দেখা যাক আমার শব্দভেদী বাণ কোথায় কেমন করে গিয়ে ঠেকে!

এতো কথা বলছি—ইদানীং সে যেন ঘন ঘন আমাদের বাড়িতে আসতে শুরু করেছে।

বেশ আছি, কিন্তু তাকে দেখলেই বুকের মধ্যে কেমন যেন হু-হু করে উঠতো। তাই আমার শব্দভেদী বাণ ছোড়ার এত প্রয়োজন হল।

বাড়িতে পাহাড়ীদার গাওয়া ওই গানটার পুরোনো রেকর্ড ছিল। বাজিয়ে বাজিয়ে সুরটা তুললাম।

তারপরে একদিন সন্ধের সময় গৌরী আমাদের বাড়িতে আসতেই হারমোনিয়াম নিয়ে বসলাম গানটা গাইতে।

এর আগে কতবার সিনেমায় দেখেছি, নায়িকা হয়তো কোনও একটা বিরাট প্রাসাদের ভেতর বসে নায়কের জন্যে বিরহযন্ত্রণা অনুভব করছে। অপরদিকে বহু দূরে বসে, ঠিক সেই সময়ে নায়ক রেডিওতে গান ধরল। নায়িকা অমনি রেডিও সেটটা চালিয়ে দিল, আর নায়কের কণ্ঠস্বর শুনে একটা হদিশ ঠিক করে নিয়ে আনন্দে চোখ মুছতে মুছতে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

বোধহয় এই রোম্যান্টিক ঘটনাটা আমার মাথায় ভর করে বসেছিল। ভুলে গিয়েছিলাম আমি তখনও ছবির নায়ক হইনি, নায়ক হবার একটা দুর্বার আকাঙ্ক্ষা আমায় পেয়ে বসেছে।

আমার নায়িকা আমাকে মনে মনে ভাবে কিনা তাও জানা নেই। রেডিও সেটের কথা আর নাইবা তুললাম।

ইংরেজিতে একটা কথা আছে, যার অর্থ ‘ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়’। তাই আমারও একটা উপায় হল। আমার নায়িকা এল আমাদের বাড়িতে, পাশের ঘরে বসে গল্প-গুজবও শুরু করল। আর ঠিক সেইসময় আমি পাশের ঘরে বসে গান ধরলাম।—গানের পর উদগ্রীব হয়ে লক্ষ্য করলাম কোনো পরিবর্তন দেখতে পাই কিনা, কিন্ত হা হতোস্মি! মন্দভাগ্যম! কোনো পরিবর্তনই দেখতে পেলাম না। সিনেমার নায়িকার মতো ছুটে যাওয়া তো দূরে থাক, খানিক পরে হাসতে হাসতে সে বেরিয়ে গেল। আমাকেও কেমন জানি একটা বিশ্রী হতাশা পেয়ে বসল।

ভাবলাম কূলে এসে কি তরী ডুবল। আদৌ বোধহয় মেয়েটা আমায় ভালোবাসে না, তার বদলে সে বোধহয়—না আমি কি বোকারে বাবা! নিজের ওপর নিজেরই রাগ হতে লাগল। কেন মরতে—

বুঝিতো সব, কিন্তু মন বাধা মানে কই।

হঠাৎ সেই সময় অন্নপূর্ণা এসে আমাকে বললো—‘হঠাৎ তুমি যে বড়ো গান গাইছিলে?’

আমি একটু তাচ্ছিল্যের সুরে বলি—‘এমনি! রেওয়াজ করতে হবে না!’

অন্নপূর্ণা একটু যেন চাপা হাসিতে ফেটে পড়ে বলে—‘তা তো হবেই। তবে রোজ তুমি সকালের দিকে গান গাও, আজকে বিকেলের দিকে—‘

মনে মনে ভাবি, আরে বাবাঃ, ধরে ফেললে নাকি? আমার আসল উদ্দেশ্যটা যদি বুঝতে পেরে থাকে তা হলে?

তাই বেশ একটু গম্ভীর হবার চেষ্টা করে বলি—‘শিল্পীর ব্যাপারই আলাদা! তাদের কখন কী খেয়াল ওঠে কে বলতে পারে বল? এইতো তুই, এতো দিন ধরে গান শেখবার চেষ্টা করছিস, শিল্পী নয় বলেই কেবল সন্ধের সময় সা-রে-গা-মা সাধাই সার হচ্ছে। কিন্তু যদি প্রকৃত শিল্পী হতিস, তাহলে, গানের ভাব যখন উঠত তখন কি আর চাপতে পারতিস? হারমোনিয়াম নিয়ে তোকে বসতেই হত।’

কথাগুলো অবশ্য বেশ গম্ভীরভাবেই বলেছিলাম। কিন্তু ফলটা ফলল উলটো।

অন্নপূর্ণা হাসিতে ফেটে পড়ে বলল—‘আমার বন্ধু গৌরী বলছিল—‘ বলে, সে চুপ করল।

আমি সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করি—‘কী বলছিল রে?’

—‘সে বলছিল—”তোর দাদাটা একটু পাগলাটে হলেও গান গায় মন্দ নয়। বেশ গলাটা। কেমন গাইছে দেখ।” তুমি তো ওকে শোনাবার জন্যে গান গাইছিলে, তা আমি বুঝতে পেরেছি।—‘

হুররে! তাহলে আমার বাণ লক্ষ্যভেদ করেছে? মুখে গাম্ভীর্য এনে বলি—‘বড়ো জেঠা হয়ে গেছিস তো!’

সময় সময় মানুষের জীবনে এমন সব ঘটনা ঘটে, যা উত্তরকালে ভাবলেও বিস্ময়ের উদয় হয়। অথচ, তাকে ভোলাও যায় না। কারণ, ভুলতে গেলে ভুলতে হয় জীবনের কয়েকটি চরম মুহূর্ত। এই চরম মুহূর্ত বলতে আমি এই মানে করতে চাইছি যে, মনের সঙ্গে সঙ্গে বাইরেরও পরিবর্তন হয়।

কথাটা পরিষ্কার করেই বলি—

আপনারা অনেক সময় লক্ষ্য করেছেন কিনা জানি না, কিন্তু আমি লক্ষ্য করেছি, যে কাজ আপনার করতে ইচ্ছে নেই, করতে ভালোও লাগে না, সেই কাজই আপনাকে করতে হচ্ছে, ইচ্ছের বিরুদ্ধে। সর্বমন-প্রাণ দিয়ে আপনি যা চাইছেন তা পাচ্ছেন না, আর যা পাচ্ছেন তা চাইছেন না। অথচ তা থেকে বেরিয়ে আসবার যেন কোনো উপায় নেই। ঠিক যেন ছোট্ট একটা পালতোলা নৌকো বন্দী হয়েছে একটা পুকুরের মধ্যে। পালে বাতাস লাগছে না, তর তর করে ছুটে চলবার শক্তিও সে হারিয়ে ফেলেছে। তাকে চালাতে হচ্ছে গুণ টেনে।

হঠাৎ পুকুরের একধারের সঙ্গে যুক্ত হল নদীর খরস্রোত। পালেও লাগল হাওয়া, নৌকোও ছুটে চলল অজানার সন্ধানে। সে জানলও না অন্তরীক্ষ থেকে কে তার যাত্রা পরিচালনা করছে, তাকে যেতে হবে কোথায়! এইটুকু সে জানে তাকে চলতে হবে। ঠিক তেমনি ঘটনা ঘটেছিল আমার জীবনে।

একদিকে ফিল্মে নামবার দুর্দমনীয় আকাঙ্ক্ষা আর অপর দিকে গৌরীকে পাবার তেমনি আকাঙ্ক্ষা।

এই দুই আকাঙ্ক্ষার শত্রুই সেদিন আমাকে পাগল করে তুলেছিল। আমার অবস্থাও হয়েছিল ওই পালতোলা নৌকোর মতো। কানে শুনতে পাচ্ছি নদীর কুলুকুলু শব্দ। সেই শব্দ আমার কানের মধ্যে দিয়ে রক্তে মিশে আমাকে তুলছে মাতাল করে। আমি শুনতে পাচ্ছি কার যেন আহ্বান! কিন্তু যাব কেমন করে? সব পথই যে রুদ্ধ।

গৌরীকে পাবার আকাঙ্ক্ষা আমার পক্ষে দুরাশা। কারণ, সে বড়োলোকের মেয়ে। অপর দিকে রুপালি আলোর খেলা। সেখানেও প্রবেশ আমার নিষিদ্ধ।

স্টুডিওর দরজায় দরজায় ঘুরেছি। পরিচালক প্রযোজকদের সঙ্গে দেখা হওয়া তো দূরের কথা, স্টুডিওর গেটই পার হতে পারিনি।

ছবিতে নামবার আশা আমার কেবল স্বপ্নই থেকে যায়, বাস্তবে রূপ নেয় না। অথচ অফিসও করতে ভালো লাগে না।

অফিস কামাই করে যে ছবিতে নামবার চেষ্টা করব, তারও উপায় নেই। তাতে আয় বন্ধ হবার ভয় আছে। অথচ!

তাই ছুটির পর একে-তাকে বলি; মাঝে মাঝে যে টালিগঞ্জে না যাই, তাও নয়; কিন্তু ওই যাওয়া-আসাই সার হয়।

একটা নিদারুণ হতাশা ও ব্যর্থতা ক্রমশ আমাকে পেয়ে বসতে লাগল! কিছুই ভালো লাগে না, তাই অনেক সময় অফিসের পর একা গিয়ে বসে থাকতাম গড়ের মাঠে অথবা গঙ্গার ধারে। চেয়ে থাকতাম ওই জাহাজগুলোর দিকে। আর মনে মনে ভাবতাম, কী হল আমার?

কর্মমুখর কলকাতার লোক ফিরে যেত তাদের নিজের বাড়িতে। আমি ভাবতাম সকলেই কেমন আনন্দে রয়েছে, আমি কেবল সহ্য করছি এই নিদারুণ, দুঃসহ মনোযন্ত্রণা। রাস্তার বাতিগুলো জ্বালিয়ে দিয়ে যেত কর্পোরেশনের কর্মীরা। তীব্র হেডলাইট ফেলে গাড়িগুলো ছুটে যেত। আমার কথা, আমার খবর কেউ রাখত না। যাকনা চলে, কোনো ক্ষতি নেই। জীবনে প্রতিষ্ঠাই যদি না পেলাম, তাহলে বেঁচে থেকে কী লাভ? একা বসে বসে এইসব কথাই চিন্তা করতাম।

তখন বোধহয় শীতকাল। গঙ্গাসাগর বা ওই ধরনের কোনো একটা মেলা উপলক্ষ্যে লোক আসছে দলে দলে!

হঠাৎ আমার কাছে কে যেন বলল—‘বাবুজি, কুছ হুয়া?’

চমকে উঠলাম। মুখ ফিরিয়ে দেখলাম, এক গেরুয়া-বসনধারী সন্ন্যাসী! অত ঠান্ডায়ও গায়ে কিছু নেই। ছাই মাখা। মাথা কামানো। মুখে দাড়ি-গোঁফের চিহ্ন নেই। দীর্ঘ চেহারা। কিন্তু চোখের চাহনি অদ্ভুত। আমার চোখের ওপর চোখ পড়ায় যেন মনে হল, আমার সমস্ত মনটাকে সে দেখতে পাচ্ছে। মুখ ঈষৎ রক্তাভ। তার চোখে পড়ায় কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করলাম! বিরক্তও যে হলাম না তাও নয়। কারণ, তখন একটা বিশ্বাসই ছিল, এই গেরুয়ার অন্তরালে যারা থাকে, তারা সকলেই ঠগ আর চোর ছাড়া কিছু নয়। সংসারে কিছু করবার চেষ্টা বা ইচ্ছা তাদের নেই; কেবল পরের ঘাড়ে বসে খাওয়াই তাদের লক্ষ্য।

আমিও বললাম—‘কিছু হবে না বাবা, সরে পড়ো।’

—‘হবে না? হবে না মানে কী?’

আবার চমকে উঠলাম, সন্ন্যাসীর এ পরিষ্কার বাংলা শুনে। তবে কি লোকটা বাঙালি? তখন কম বয়স। চপলতা হিসেবে উপদেশ দেওয়ার ইচ্ছাটাও প্রবল। কারণ এ উপদেশ দিতে গেলে খরচ হয় না। যদি তা হত, তাহলে আপনারা আমার মতনই লক্ষ্য করতেন, সংসারে অনেক উপদেশই বন্ধ হয়ে গেছে।

আর একটা আশ্চর্য জিনিস এই যে, যে ব্যাপার আমার জানা নেই, কোনো অভিজ্ঞতাই নেই যার সম্বন্ধে, সেই বিষয়ে আমরা আগে উপদেশ দিই। আর যে উপদেশের পাত্র, আমরা সব সময়ে লক্ষ্য রাখি সে আমার চেয়ে দুর্বল কিনা। তাই দেখি, বড়ো ছোটোকে উপদেশ দেয়, সবল দেয় দুর্বলকে। প্রতিপক্ষ যদি সবল হয়, তাহলে উপদেশ দেবার ইচ্ছা আমাদের চলে যায়, আর চোখের ওপর তাকে ভুল করতে দেখলেও বলি—‘বাঃ, ঠিক বলেছেন আপনি!’

এক্ষেত্রে সন্ন্যাসী আমার কাছে প্রার্থী। আর আমি ইচ্ছে করলে দুটো বা চারটে পয়সা দিয়ে দাতার আসনে বসতে পারি।

সুতরাং আমার অবস্থা ওর চেয়ে সবল। তাই একটু গলা ঝেড়ে বললাম—‘বেশ চেহারাটা তো দেখছি তোমার, খেটে খেতে পারো না?’

আমার কথা শুনে সন্ন্যাসী হেসে উঠলেন। তারপরে বললেন—‘খেটে খাব না বলেই মা বাপের কাছ থেকে পালিয়েছি। তবে খাটব কেন?’

না, এর কথা সাধারণ সন্ন্যাসীর মতন তো নয়! কেমন যেন লাগল! তাই বললাম—‘কী বলছেন আপনি, কিছু তো বুঝতে পারলাম না!’

সন্ন্যাসী বললেন—‘আরে এটুকু সোজা কথা বুঝলে না? কয়েকদিন ঘুরেই তুমি হতাশ হয়ে পড়লে? মা বাবা, বাড়ি, ঘরদোর ছেড়ে এই ঠান্ডাতেই বা বসে আছ কেন? তুমি বলবে—আমি ভাবছি, কী করে আমার উদ্দেশ্য সফল হয় সেই কথা। আর আমরা কী করছি জানো? সব কিছু ছেড়েছি, কেবল তাঁকে পাবার জন্যে। কারণ তিনি যে অসীম। তাঁকে লাভ করতে পারলে চরম আনন্দের অধিকারী হওয়া যায়।’

বিস্ময় তখন আমার চরমে পৌঁছে গেছে। আমি ভাবছি এ লোকটা যে দেখছি আমার মনের কথা বলে দিচ্ছে, তবে কি এ লোকটা thought reader ? তাই পরীক্ষার জন্য তাকে বলি, ‘আচ্ছা, আমি কী ভাবছি বলুন তো?’

সন্ন্যাসী আমার কাছে বসে পড়ে বললেন—‘আরে দূর পাগলা, সন্ন্যাসীকে কি পরীক্ষা করতে হয় ওভাবে? এসব কথা বলা কি তাঁর পক্ষে শক্ত কাজ? এসব তো খুব সামান্য জিনিস। সে তো এখুনি বলে দেওয়া যায়। তুমি ভাবছ সেই মেয়েটির কথা। আর ভাবছ, কী করে ফিল্মে অভিনয় করা যায়।’

আমি তখন বেশ অভিভূত হয়ে পড়েছি। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে তাঁকে বলি—‘আমি কী করে—‘

আর বলতে হয় না। হেসে ফেলে তিনি বলেন—‘একদিন যে বড়ো অভিনেতা হবে, সেই ভাবছে কী করে ফিল্মে চান্স পাওয়া যায়!’

আমি বড়ো অভিনেতা হব! নাঃ, এ লোকটা নিশ্চয়ই thought reader।

আমার মনের কথা বুঝতে পেরে, আমাকে খুশি করে বেশ কিছু টাকা ও বার করে নিতে চায়। তাই এইসমস্ত কথা বলছে।

আমি বলি—‘সব বাজে কথা! অভিনয় আমি মোটেই করতে চাই না। আর আমি—‘

—‘আর তুমি—কী বলো?’

—‘কাউকে ভালোওবাসি না। কী তুমি যা-তা বলছ!’

আবার প্রশান্ত হাসিতে ফেটে পড়লেন সেই সন্ন্যাসী।

এইবারে সোজা দাঁড়িয়ে বললেন—‘অভিনয় করতে চাও আর না চাও, ফিল্মে তোমাকে নামতেই হবে। আর যে মেয়েটিকে এতক্ষণ বসে চিন্তা করছিলে, সেই তোমার স্ত্রী হবে। বাড়ি, গাড়ি, যা চাও সব পাবে। আজকে তুমি ভাবতেও পারবে না আগামীদিনের কথা। বললেও তুমি বুঝতে পারবে না।’

তিনি চলে যাচ্ছিলেন—

খপ করে তাঁকে ধরে ফেলে বলি—‘একটা কথা শুনে যান। এসব কথা আপনি বললেন কী করে?’

তিনি বললেন—‘আরে, এতো সন্ন্যাসীর কাছে কিছুই নয়। সব মনই বাঁধা রয়েছে সেই বিরাট একটি মনে। আমি সেই বিরাটেরই ধ্যান করি দিনরাত। তাঁকে লাভ করাই আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। তাই আমার পক্ষে এটুকু বলা কিছু শক্ত নয়। তোমার মুখখানা দেখে বড়ো ভালো লেগেছিল। তাই ভাবলাম, তোমার এত কীসের দুঃখ, একা বসে আছ! তাই তোমাকে আশার কথা শুনিয়ে গেলাম। তবে একটা কথা বলি, তুমি উপবীতধারী ব্রাহ্মণের সন্তান। যাই করো না কেন, দুবেলা গায়ত্রী জপতে ভুলো না। জেনো, এই জগতের সবকিছুর ওপরে একজন আছেন, যার ইচ্ছায় এই পৃথিবী চলছে। বিজ্ঞানের সামান্য ভড়কিতে বা পার্থিব নাম, যশ আর টাকায় তাকে কখনও ভুলো না। সংসারে যদি আঘাত আসে, জানবে পেছনেই আছে তোমার সফলতা। দিন আর রাত্রি যেমন পর পর আসা-যাওয়া করে, ঠিক তেমনি আশা আর নিরাশা মানুষের জীবনেও আসে ঘুরে ঘুরে। নিরাশায় ভেঙে না পড়ে এগিয়ে চলো।’

পকেটে হাত দিয়ে দেখি একটা পাঁচ টাকার নোট রয়েছে। তাড়াতাড়ি সেটাকে বার করে তাঁর পায়ের কাছে রাখতেই—কিন্তু কোথায় তিনি? আমার ধারেকাছেও কেউ নেই। তাড়াতাড়ি উঠে তাঁকে খুঁজতে আরম্ভ করলাম। তাঁকে কোথাও দেখতে পেলাম না। সোজা রাস্তা ধরে দুদিকে সন্তর্পণে চাইতে চাইতে, একেবারে ইডেন গার্ডেন অবধি এগিয়ে এলাম। কিন্তু সেই সন্ন্যাসীকে কোথাও দেখতে পেলাম না।

খুঁজতে খুঁজতে এক সন্ন্যাসীর দলের মধ্যে গিয়ে পড়লাম। গিয়ে দেখলাম, তারা শীতের হাত থেকে বাঁচবার জন্যে কাঠ জড়ো করে আগুন লাগিয়েছে। বুঝলাম, এই ধরনের রকম দেখেই মানুষ ভুল বোঝে আসল সন্ন্যাসীকে।

কিন্তু আমি যে ঠকলাম! হাতের কাছে তাঁকে পেয়েও হারালাম। একী নিদারুণ দুঃখ!

ইচ্ছা করলে হয়তো আরও অনেক কথা জানতে পারতাম। ছিঃ ছিঃ, এ কী দুর্মতি আমার ঘাড়ে চাপল! কিন্তু, তখন তো যা হবার তা হয়ে গেছে।

বিশাল কলকাতার মাঝখানে তাঁকে খুঁজে বার করা আমার সাধ্য নয়। বাড়িতে এসে কেবলই ভাবতে লাগলাম সেই সন্ন্যাসীরই কথা।

পরের দিন সকালবেলায় বসলাম গায়ত্রী জপ করতে। হঠাৎ মা কী একটা কাজে ঘরের মধ্যে ঢুকেছিলেন, আমাকে গায়ত্রী জপ করতে দেখে বললেন—‘এতদিনে সুমতি হল!’

একবার ভাবলাম, মাকে বলি কালকের রাত্রের সব কথা। কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে হল এতবড়ো মহাপুরুষকে হাতের কাছে পেয়েও আমার নির্বুদ্ধিতার জন্যে উপদেশ দিতে গিয়েছিলাম, জানতে পারলে মা হয়তো দুঃখই পাবেন। তাই মাকে খুশি করবার জন্যে বলি—‘কেন মা, তুমিই তো বলেছ গায়ত্রী জপ করতে রোজ!’

মা খুশি হয়ে বলেন—‘সে কথা যে তুই মনে রেখেছিস তাই ভালো’—বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

এরই কয়েকদিন পর হঠাৎ গণেশদা ওরফে গণেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা হল।

আমাকে দেখেই তিনি বললেন—‘অরুণ, ফিল্মে নামবার কথা অনেকদিন বলেছিলি। একটা চান্স এসেছে, নামবি ফিল্মে?’

ফিল্ম! নিজের কানকে নিজেরই বিশ্বাস হলো না। গণেশদা এ কী বলছেন! আমি নামব ফিল্মে! জিজ্ঞেস করি, ‘কী ছবি, কী পার্ট?

—‘আরে তোকে এখন হিরোর চান্স কে দেবে বল? আমাদের একটা হিন্দি ছবি ‘মায়াডোর’-এ বর সাজতে হবে। তেমন বিশেষ কিছু পার্ট নয়। রাজি তো?’

গণেশদার মুখ থেকেই জানতে পারলাম, ‘মায়াডোর’ ছবিতে আমার কাজ স্রেফ বর সেজে বসে থাকা।

ওদিকে পান্না সাজবেন কনে। আমার স্যুটিং একদিনেই শেষ।

তখনই মাথার মধ্যে খেলে গেল সন্ন্যাসীর কথা। আমি না বড়ো অভিনেতা হব?

কিন্তু এতে তো অভিনয়ের নামগন্ধও নেই। স্রেফ রং মেখে সঙ সাজা।

আচ্ছা কুছ পরোয়া নেহি। সুযোগ যখন একটা পেয়েছি, স্টুডিওর গেট পার হওয়ার, তা আর ছাড়ছি না। কে জানে, এর থেকেই পরে একটা বড়ো চান্স পাব কি না।

গণেশদাকে জিজ্ঞেস করলুম—‘আমায় কবে যেতে হবে, কী করতে হবে?’

হেসে তিনি বলেন—‘আরে, সে একটা দিন আমি তোকে বলে দেব। তারপরে সেই বুঝে তুই অফিসের ছুটি নিয়ে নিবি। তারপর স্যুটিং করে পরের দিন অফিসে গেলেই চলবে।’

আমি ছবিতে নামব! একদিন হোক, দু’দিন হোক, আমি স্যুটিং করব! যেন বিশ্বাস হচ্ছে না।

তাই গণেশদার দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করি—‘কথাটা সত্যি বলছ তো?’

—‘সত্যি না তো কী, তোর সঙ্গে আমি ইয়ার্কি করছি?’

যাক তবুও ভালো। কথা শেষ করে অফিসে চলে গেলাম।

কিন্তু এতবড়ো খবরটা আমি চেপে রাখব কী করে? সারা বাস বাদুড়ঝোলা হয়ে গিয়েও খুঁজতে লাগলাম যদি কোনো চেনা লোক চোখে পড়ে, অন্তত তাকে বলেও খানিকটা নিশ্চিন্ত হওয়া যেতে পারে।

একটু দেরি হওয়ার জন্য, আমার সঙ্গে বেশিরভাগই যাঁরা অফিসে যান, তাঁরা প্রায় সকলেই অফিস চলে গেছেন। তাই বিশেষ চেনা মুখের সঙ্গে দেখা হল না। সুখবরটা তাই কাউকে দেওয়াও হল না।

অফিসে পৌছেই, আজও স্পষ্ট মনে আছে, সেদিন যার সঙ্গে দেখা হয়েছিল তাকেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আমার ফিল্মে নামার খবরটা জানিয়ে দিয়েছিলুম।

এখানে বলে রাখা ভালো, আমাদের পাড়ার লুনার ক্লাবে যখনই কোনো থিয়েটার হত আমি তাতে বিশেষ অংশগ্রহণ করতাম। এখানে অভিনয় করার সময় আমার কাকার কাছ থেকে উৎসাহ পেয়েছিলাম প্রচুর। এইভাবেই আমি তাঁদের সঙ্গে অভিনয় করেছিলাম—কর্ণার্জুনে—শ্রীকৃষ্ণ, সাজাহানে—দিলদার, দুই পুরুষে—সুশোভন।

তারাশংকরবাবুর ‘দুই পুরুষ’ নাটকটি নাট্যভারতীতে (বর্তমান গ্রেস সিনেমায়) অভিনীত হয়েছিল। তাতে ‘নুটুবিহারী’র ভূমিকায় প্রথমে ছবিদা অপূর্ব অভিনয় করেছিলেন। পরে ওই ভূমিকায় স্বর্গীয় বিশ্বনাথ ভাদুড়ি২৪ অভিনয় করেন। তাঁর সুন্দর অপূর্ব বাচনভঙ্গির দ্বারা তিনি দর্শকের মন জয় করতে পেরেছিলেন। অবশ্য নাট্যভারতী ভেঙে যাবার পর ছবিদা কিছুদিন মিনার্ভায় ‘নুটুবিহারী’র ভূমিকায় অভিনয় করেন। কিন্তু ‘সুশোভন’-এর ভূমিকায় বরাবরই দক্ষতার সঙ্গে অভিনয় করতেন সুলালদা বা জহর গাঙ্গুলি। শেষের দিকে তিনি যখন স্টেজে এসে বলতেন—‘আমাকে দশটা টাকা দিতে পারো নুটুদা—আজও আমার মুখ দিয়ে রক্ত উঠেছে’—তখন দর্শকের চোখ আর শুকনো থাকত না।

সেই ভূমিকায় আমি যখন অভিনয় করতে নামি তখন আমার মনে মনে বেশ ভয় করেছিল। হোক না একদিনের জন্য, পারব কি আমি দর্শকের মনে ছাপ রাখতে?

কিন্তু আমার ভাগ্য প্রসন্ন ছিল, তাই অভিনয় দেখে সেদিন অনেকেই আমার সুখ্যাতি করেছিলেন।

ঠিক তেমনি ছিল ‘দিলদার’-এর চরিত্র। বাংলার প্রায় সব শ্রেষ্ঠ শিল্পী একবার করে দিলদারের চরিত্রে অভিনয় করে তাঁদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন। তা থেকে সুলালদা, ছবিদাও বাদ যাননি।

পাড়াতে যখন এই ভূমিকায় অভিনয় করবার জন্য আমাকে মনোনীত করা হয়েছিল, তখন মুখে সাহস দেখালেও, ভেতরে সাহস পাইনি সেদিন। সত্যি কথা বলতে কী বেশ ভয় করেছিল।

তার কিছু আগে কালিকায় (বর্তমান কালিকা সিনেমায়) নরেশদা২৫ও একবার এই দিলদারের ভূমিকায় অভিনয় করলেন। তাঁর—‘একটা সমুদ্র শুকিয়ে গেছে’, ‘পর্বত ভেঙে পড়েছে’ কিংবা ‘জাগো অন্ধ জাগো’ এইসমস্ত উক্তি আমার মনে তখনও স্পষ্ট ভেসে আছে।

ছবিদা সুন্দর চেহারায় যখন বিরক্ত ভঙ্গিতে বলতেন—‘বিদ্যার এখনও সে তেজ আছে, যা তোমার রৌপ্যের মাথায় লাথি মারতে পারে’ —তখন দর্শকের মনে অপূর্ব এক ভাবের সঞ্চার হত।

সব শেষে বলি সুলালদার কথা। তাঁর অপূর্ব কণ্ঠস্বরে তিনি দর্শকদের মাতিয়ে তুলতেন। বিশেষ করে ‘দারা’র মৃত্যুদৃশ্যে, কোনও দর্শকের চোখ তাঁর অভিনয় দেখে শুকনো থাকত না।

সেই ভূমিকায় নামলাম আমি। তখন আমার বয়স কতই বা! অভিনয়েরই বা কতখানি জানি! ভেবেছিলাম দর্শকরা হাততালি দিয়ে আমাকে উপহাস করবেন। কিন্তু না, তা হল না। অভিনয় বেশ জমল। দর্শকেরা ভালোও বললেন আমাকে।

এসব তো গেল পাড়ার অভিনয়ের কথা। অফিসে আমি অভিনয় করেছিলাম অবশ্য একবারই, তা হল শরদিন্দুবাবুর হাসির নাটক ‘ডিটেকটিভ’-এ একেবারে অনন্তর ভূমিকায়।

অফিসে ‘চান্স’ পাওয়া কি মুখের কথা? আমার মতো ‘হিরো’ সাজবার জন্যে দলে দলে লোক প্রস্তুত হয়ে আছে। তার ওপর যিনি ইনস্টিটিউটের সেক্রেটারি, মনতোষবাবু, তিনি ছিলেন আমার বিপক্ষে। তাঁর আদৌ ইচ্ছা ছিল না আমি ওই ভূমিকায় অভিনয় করি। মুখে সাহস দেখালেও ভেতরে বেশ ভয় করছিল। শেষ দৃশ্যে ‘ফেয়ার’ জুতো খোলার সময় ‘আঃ, আমি কী ডিটেকটিভ রে বাবা’—এই কথা শুনে দর্শকদের ভালোও লাগল। যবনিকা পড়বার পর সেই মনতোষবাবুই আমাকে উপহার দিলেন একটি স্বর্ণপদক। এর থেকে আমরা পরিচয় পাই তাঁর মহৎ হৃদয়ের। অবশ্য এই অভিনয় করার ব্যাপারে আরও দুজন আমায় অলক্ষ্য থেকে সাহায্য করেছিলেন। তাঁদের একজনের নাম সুধামাধব চট্টোপাধ্যায়, অপরের নাম প্রকাশ ঘোষ।

বড়কর্তারা অভিনয়ের পর কে অরুণকুমার তা দেখবার জন্যে আমায় ডেকেছিলেন। বুঝতেই পারছেন, এই সব কারণের জন্যেই বোধহয় আমার মনে একটা বিশ্বাস জন্মে গিয়েছিল, ভালোরকম চান্স পেলে আমিও আমার এলেমটা একবার দেখিয়ে দিতে পারি। কিন্তু বুঝতেই তো পারছেন, তেমন চান্স এখনও পর্যন্ত আমি পাইনি।

হতাশায় মন বেশ ভেঙে গেছে। এমন সময় ফিল্মে নামবার সুযোগ আমার এল। তাই একথা আর কি চেপে রাখতে পারি! তাই অফিসে পৌঁছনোর ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে সারা অফিসের লোক জেনে গেলেন, আমি এবার ফিল্মে নামছি।

কেউ আমাকে বললেন—‘ব্রেভো’, কেউবা বললেন—‘সাবাস’, আবার কেউ বা নাক কুঁচকে বললেন—‘জানতুম ছেলেটা ভালো অভিনয় করে।’ আর বৃদ্ধগোছের কেউ কেউ বললেন—‘ছেলেটা এতদিনে একেবারে গোল্লায় গেল। যা থিয়েটার যাত্রার দিকে ঝোঁক, যাবে না তো কি?’

সর্বনাশ! এরকম মন্তব্যের জন্য তো প্রস্তুত ছিলুম না। আনন্দের চোটে এদিকটা তো ভাবিনি। বাবা-মার মত নেওয়া দরকার। তার ওপর, কেমন মনে মনে লজ্জা করল,—ওই গৌরীকে একবার জিজ্ঞেস করলে কেমন হয়।

নাঃ, আর ভাবতে পারছি না। কথা তো বলিনি কোনোদিন। এই ফাঁকে কোনোরকমে যদি কথা বলাটা আরম্ভ করা যায়, তাহলে কেমন হয়!

কিন্তু অন্নপূর্ণাটা আছে যে? বাড়ির সকলকে বলে দেবে না তো? যাক, যাই হোক, একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। ওই তিনজনের মত আমাকে নিতেই হবে।

আনন্দটা কেমন যেন আদ্ধেক হয়ে গেল। বিকেলে অফিস থেকে বাড়ি এলুম।

মা খাবার দিতে এলেন আমার ঘরে। এইখানে বলে রাখা ভালো, আমার মা, চিরদিন আমাদের তিন ভাইকে, নিজে হাতে করে সবসময় খেতে দিয়েছেন। আজও আমাদের কারোর বাড়ি ফিরতে যদি দেরি হয় নিজে অভুক্ত থেকে মা তার জন্য অপেক্ষা করেন।

এর ব্যতিক্রম দেখিনি কখনও। স্টুডিওর কাজে যখন সকালে আমাকে বেরিয়ে যেতে হয়, যেদিন আর বাড়ি ফিরবার সময় পাই না, শুনেছি মারও ভালো করে সেদিন খাওয়া হয়না।

যাক, যা বলছিলাম। মা ঘরে ঢুকতেই, মাকে দুহাত দিয়ে ছোটেআ ছেলের মতো জড়িয়ে ধরলাম। তারপরে কথা বললাম—‘মা, একটা কথা বলবো?’

মা জানতেন এরপরেই আমি হয়তো কিছু চেয়ে বসবো।

সস্নেহে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন—‘কিছু চাই বুঝি? ওঁকে বলতে হবে?’

আমি বললাম—‘না মা, তেমন কিছু চাই না। চাই তোমার অনুমতি।’

মা একটু বিস্মিত হয়ে গিয়ে বলেন—‘অনুমতি? কিসের?’

—‘আমি—ফিল্মে নামবো।’

মার সাদা মুখটা কেমন যেন কালো হয়ে গেল।

তারপরে আমায় বললেন—‘তুমি বড়ো হয়েছ খোকা। ভালমন্দ বোঝবার বয়সও তোমার হয়েছে। ফিল্মে নামতে চাও নামো। কিন্তু আমাকে কথা দাও জীবনে এমন কিছু করবে না, যাতে আমার লজ্জায় মুখ পুড়ে যাবে।’

মার পা ছুঁয়ে তখনই বললাম—‘না মা, তোমাকে আমি কথা দিচ্ছি, তোমার খোকা জীবনে এমন কাজ করবে না, যাতে তুমি তার পরিচয় দিতে লজ্জা পাবে।’

আমাকে দুহাত দিয়ে বুকে জড়িয়ে নিয়ে মা বললেন—‘জানি বাবা, সে বিশ্বাস তোমার ওপর আমার আছে। ছেলেবয়েস থেকে তুমি যাত্রা করেছ, থিয়েটার করেছ, লোকে তোমার কত সুখ্যাতি করেছে, তোমার সুখ্যাতি শুনতে আমার যে কত ভালো লাগে তা কি তুমি জানো না। ফিল্মে নামছো নামো। আমি জানি, ওতেও তুমি নাম করবে, কিন্তু ওর মতও তো একবার নেওয়া দরকার।’

আমি বলি—‘বাবাকে, তুমি একবার বলো না মা।’

মা বললেন—‘না, এ কথা তোমাকে নিজে গিয়েই বলতে হবে।’

পরের দিন ভয়ে ভয়ে গেলাম বাবার ঘরে। তারপর আস্তে আস্তে বললাম আমার বক্তব্য।

বাবা সব শুনে, একটু গম্ভীর হয়ে বললেন—‘তোমাদের কারোকে কোনো ব্যাপারে আমি বাধা দিতে চাইনা। যা ভালো বুঝবে তাই করবে। সবসময় মনে রেখো আর্ট জিনিসটা কিছু খারাপ নয়। তবে তা করতে গেলে চাই সাধনা। তা কি তুমি করতে পারবে?’

আমি আস্তে আস্তে বলি—‘আপনি যদি আশীর্বাদ করেন তাহলে নিশ্চয়ই পারবো।’

—Very good. চেষ্টা করে দেখ তোমার ভাগ্যে কী আছে।

বাবার কাছ থেকে অনুমতি তো পাওয়া গেল। কিন্তু যার সঙ্গে কোনোদিন কথা বলিনি তার কাছ থেকে অনুমতি নিই কেমন করে! দূর হোকগে ছাই। অনুমতি নেবারই বা কি দরকার। সে আমার কে? পরমুহূর্তে মনে হলো সন্ন্যাসীর কথা—‘যার কথা তুমি ভাবছো সে-ই তোমার স্ত্রী হবে।’

করবো তো একটা ‘বরে’র পার্ট। তার জন্য এত কিসের?

পরমুহূর্তেই মনে হলো এই সুযোগে কথা বলা আরম্ভ করা যেতে পারে। কিন্তু আজতো অন্নপূর্ণার গানের স্কুল নেই। গৌরী তো আসবে না আমাদের বাড়ি। আবার কাল যদি গণেশদা একটা দিন বলে দেয় তাহলে?

সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে তো অফিস চলে গেলাম। সেদিন অফিস থেকে ছুটি নিয়ে সাড়ে তিনটের মধ্যে বেরিয়ে পড়লাম। জানতাম গৌরী রমেশ মিত্তির গার্লস স্কুলে পড়ে। সেইসময় রাস্তায় কোনোরকমভাবে যদি—

এলাম স্কুলের সামনে। সবে ছুটি হয়েছে তখন। হরেকরকমের শাড়ি দুলিয়ে মেয়েরা বাড়ি ফিরছে। কিন্তু গৌরী কোথায়? হঠাৎ দেখি গৌরী স্কুল থেকে বেরিয়ে এদিক ওদিক কী দেখে নিয়ে চলতে শুরু করলো।

সঙ্গে যথানিয়মে দারোয়ানও আছে। আমার সবটুকু আশা, আনন্দ, উৎসাহ যেন কোথায় উবে গেল।

হন হন করে দুচারবার গৌরীর সামনে যাতায়াত করলাম, কিন্তু একটাও কথা বলতে সাহস হল না। বুকের ভেতরটা কেমন যেন ঢিপ ঢিপ করতে লাগলো। এখন কী বলে কথা আরম্ভ করা যায়?

হঠাৎ গৌরীর চোখে চোখ পড়ায় দেখি সে কেমন ফিক করে হেসে ফেললো। তারপর, মেয়েদের কাছ থেকে একটু দূরে সরে গিয়ে, পেছন থেকে আমাকে হাত নেড়ে ডাকলো।

আমি কাছে যেতেই আমাকে বললো—‘আজ অফিস যাওয়া হয়নি? কী হচ্ছে এখানে?’

সারাটা দিন কত কথা ভেবে রেখেছিলুম বলবো বলে। এখন যেন সব গুলিয়ে গেল। কেবল আমতা আমতা করে বলি—‘না, তাড়াতাড়ি অফিস থেকে এলুম, তাই ভাবলুম—‘

একটু হেসে গৌরী বললো—‘আমাকে দেখে যাই, না?’

আমি বলি—‘না গৌরী। তোমাকে একটা মানে—আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করবার ছিল।’

গৌরী হেসে ফেলে বললো—‘থাক বীরপুরুষ, রাস্তায় আর কথা বলতে হবে না। বাড়ি ফিরে যাও, খানিকটা পরে আমি আসছি তোমাদের বাড়িতে।’

গৌরী আমাকে ‘তুমি’ বললো? অথচ আমি ক্যাবলার মত তাকে ‘আপনি’ ‘আপনি’ করছিলুম?—প্রথম কথা গৌরী চলে যেতেই আমার মনে হলো। এ ‘তুমি’র অর্থ? মানে—মানে—ও কি আমাকে ভালোবাসে?

রাস্তায় চলতে চলতেও সেই বিকেলবেলায়ও মনে হলো যেন আমি আর চলতে পারছি না, সমস্ত শরীর যেন মাটি ছেড়ে উড়ে যেতে চাইছে। ভালো যেন দেখতে পাচ্ছি না।

আঃ, সে কী অপূর্ব অনুভূতি! গৌরী আমায় ভা—লো—বা—সে।

গৌরী তো বলে গেল সে আসছে। কিন্তু সে ‘আসার’ অর্থ কী? কী করে কথা বলবে? কেমন করে আরম্ভ করবো কথা? কেমন করে আমার ফিল্মে নামার কথাটা পাড়বো? আবার ফিল্মে নামার কথা শুনে যদি ‘না’ বলে? তাহলে কেমন করে তাকে বোঝাবো যে ঐ রুপালি আলোর খেলা আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে তারই মতো!

একটু প্রকৃতিস্থ হতেই প্রশ্নগুলো যেন হুড়মুড় করে আমার মাথার মধ্যে উঠে পড়লো। শুধু কি উঠে পড়া? আমার সমস্ত স্নায়ুতে রক্তে, তারা ছুটোছুটি শুরু করলো। আর তাদের সেই ছুটোছুটিতে আমিও যেন কেমন হয়ে পড়লাম। সমস্ত ধাক্কা কাটিয়ে যখন প্রকৃতিস্থ হলাম, তখন দেখি রমেশ মিত্র রোড থেকে সোজা কেমন করে চলে এসেছি আমাদের গিরিশ মুখার্জী রোডের বাড়ির সামনে। অকারণে বাড়ির সামনে ঘোরাঘুরি করা যায়না, তাই ঢুকে পড়লাম বাড়িতে।

মা’র কাছ থেকে খাওয়াদাওয়া সেরে নিলাম। ঘড়ির কাঁটার দিকে অধীর প্রতীক্ষায় কেবলই চাইছিলাম। কারণ গৌরী আসবে বলেছে।

আজ বলতে বাধা নেই, সেদিন কেবলই মনে হয়েছিল ঘড়িগুলো যেন আমার সঙ্গে শত্রুতা করে একসঙ্গে স্লো হতে আরম্ভ করেছে।

খাওয়াদাওয়া চুকিয়ে আবার সেই অধীর প্রতীক্ষা। তবে আজ আর হারমোনিয়াম নিয়ে নয়। গান শুনিয়ে শব্দভেদী বাণও ছুঁড়তে হবেনা। আজ পরিষ্কার যা হয় একটা হয়ে যাবে। আজ ঠিক বুঝতে পারবো ও আমায় ভালোবাসে, না মাছিমারা কেরানী বলে ঘৃণা করে!

একবার মনে হলো, গৌরী বোধহয় সত্যি আমায় ভালোবাসে না। পরক্ষণে মনে হলো তাহলে ‘তুমি’ বলার অর্থ? আর আমাকে কেনই বা ও বললে—এখুনি আসবে বাড়িতে? খেলা করছে নাতো আমায় নিয়ে? দূর বাপু! আর চিন্তা করতে পারি না, কেমন যেন হতাশা এসে গেল।

তাছাড়া সন্ন্যাসীঠাকুর তো আমাকে বলেইছেন, গৌরীর সঙ্গে আমার—মানে—ইয়ে, বিয়ে হবে। তবে আর কি ভাবনা? তাঁর সব কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাচ্ছে। তবে, গৌরীকে না পাওয়া অবধি সম্পূর্ণ বিশ্বাস করি কি করে?

যাক, আর ভাববো না। আশু মিলনের জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করা ভালো।

সূর্য তখন অস্ত গেছে। বাড়িতে বাড়িতে সন্ধ্যার শাঁখও বেজে উঠেছে। প্রতি বাড়িতে ছেলেমেয়েরা তখন বই নিয়ে বসবার উপক্রম করছে।

গৌরী এসেছে আমাদের বাড়িতে প্রায় আধঘণ্টার ওপর। কিন্তু এতক্ষণ তার সঙ্গে কথা বলবার সুযোগ পাইনি। অন্নপূর্ণা আছে। আমি ঘুরঘুর করছি। এমনি সময় অন্নপূর্ণা এসে আমাকে বললো—‘দাদা, তোমার কোনো কাজ আছে?’

আমি বললাম—‘কেন রে?’

—‘গৌরীর দারোয়ানটা এখনও আসেনি, তাই সে যেতে পারছে না, ওকে যদি একটু এগিয়ে দাও।’ গম্ভীর হয়ে গিয়ে বলি—‘এত ঝঞ্ঝাটও তোরা পাকাতে পারিস! আমি এখন কাজ ছেড়ে যাই কি করে বল তো?’ আমার এ চালটা অন্নপূর্ণা বুঝেছিল কিনা জানি না, তাই সে কেবল উত্তরে বললো—‘বেশ, তোমার সময় যদি না হয়, তাহলে আমি অন্য কাউকে বলি।’ সর্বনাশ, অন্নপূর্ণাটা বলে কী! মানে, এইটুকুর জন্যে আমি যে এতক্ষণ অধীর প্রতীক্ষা করছি। গৌরীকে একা পাবো। ভালো হোক, মন্দ হোক, দু চারটে কথা তার সঙ্গে বলবো, ইডিয়েটটা বলে কিনা ‘অন্য কাউকে বলবো’। মান সম্মান আর রাখলে না দেখছি! তাই তাড়াতাড়ি গলার আওয়াজ মিষ্টি করে বলি—‘না, এমন কী কাজ, বলছিস যখন—চল।’

ঠিক এমনি সময় ঘরের মধ্যে ঢোকে গৌরী। আমার দিকে চেয়ে বলে—‘দেখুন, বড়ো মুশকিলে পড়েছি। এদিকে রাত্তির হয়ে যাচ্ছে। দারোয়ানটা কী জানি কেন, এলোনা এখনও। আপনি যদি একটু পৌছে দেন। নইলে দাদু, ঠাকুমা, বাবা, মা সকলে ভাববেন যে।’

—‘আমি, মানে ইয়ে, আপনাকে পৌছে দেব?’

বুঝতে পারলাম গৌরী এতক্ষণ দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আমাদের কথাবার্তা শুনছিল। ভাগ্য সুপ্রসন্ন বলতেই হবে। ঠিক সেই সময় অন্নপূর্ণাকে কে যেন ডাকলো।

—‘যাই’ বলে সাড়া দিয়ে, ‘আমি এখুনি আসছি’ বলে সে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। ঘরের মধ্যে তখন রইলাম, আমি আর গৌরী। তাড়াতাড়ি চাপা স্বরে গৌরী আমায় প্রশ্ন করে—‘আমাকে কী যেন বলতে গিয়েছিলে স্কুলে?’

বুকের রক্তটা আমার ছলাৎ করে উঠলো তার সেই ‘তুমি’ ডাক শুনে।

নিজেকে সংযত করে নিয়ে বলি—‘আমি, মানে, একটা বড়ো বিপদে পড়েছি।’

বিস্মিত হয়ে গিয়ে গৌরী বললো—‘বিপদ, কী বিপদ?’

নাঃ, আর চেপে রাখা যায় না। বলেই ফেললাম—‘গৌরী, আমি সিনেমায় নামছি। এ ব্যাপারে তোমার মতটা কী তাই জিজ্ঞাসা করছি।’

—‘আমার মত? তাতে কী দরকার?’

চোখ তুলে দেখি গৌরী আমার দিকে চেয়ে আছে তীব্রভাবে।

নাঃ, এই সুবর্ণ সুযোগ, যা হবার হোক। বলেই ফেললাম তাকে—‘কারণ, আমি তো—তোমায় ভালোবাসি।’

গৌরী আমাকে প্রশ্ন করে—‘তাহলে একটা কথা বলো! সিনেমায় নেমে আমায় ভুলে যাবে না কোনোদিন?’

—‘তোমায়? তোমায় ভুলবো আমি?’

আবেগে উচ্ছৃসিত হয়ে কী যেন বলতে গিয়েছিলাম সেদিন।

মুখে আঙুল দিয়ে সে আমায় কথা বলতে বারণ করে। ঘরের দরজা দেখিয়ে দিয়ে ইশারা করে বলে—‘কে যেন আসছে।’

পরমুহূর্তেই অন্নপূর্ণা ঘরের মধ্যে ঢোকে। কী বলতে হবে, না বুঝতে পেরে ভ্যাবাগঙ্গারামের মত চেয়ে থাকি তার দিকে, অপলকদৃষ্টিতে।

তাড়াতাড়ি কথার মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে গৌরী বলে—‘আর দেরি করিসনে অন্নপূর্ণা, তোর দাদাকে বলনা ভাই, আমাকে তাড়াতাড়ি পৌঁছে দিতে।’

বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমরা এলাম রাস্তায়। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে আমি জিজ্ঞাসা করি—‘কী ব্যাপার বলো তো? আজ তোমাদের দারোয়ান এলোনা যে?’

গৌরী বলে—‘এটুকুও বুঝতে পারলে না? বাড়িতে যদি তোমার সঙ্গে কথা বলবার সুযোগ না পাই, তাই আমি দারোয়ানকে আসতে বারণ করে দিয়েছি। তাইতো দারোয়ান আজ আসেনি।’

আমি বলি—‘গৌরী, তুমি কী করে বুঝলে আমি তোমায় ভালোবাসি?’

হাসতে হাসতে গৌরী জবাব দিলো—‘মেয়েমানুষের কি পুরুষের ভালোবাসা বুঝতে দেরি হয়? আর তারই মধ্যে সে বুঝে নেয় কোনটা আসল আর কোনটা মেকি।’

‘কিন্তু আমার যে এখনও একটা কথা জানা হয়নি!’ শান্ত অথচ গম্ভীর কণ্ঠে গৌরী প্রশ্ন করে—‘কী বলো?’

—‘তুমি কি আমায়’—

হাসিতে ফেটে পড়ে সে জবাব দেয়—‘তা যদি না বুঝতে পেরে থাকো, তা হলে বুঝেও আর দরকার নেই।’

কথাটা শুনে নিজের কানকে নিজেরই বিশ্বাস হল না।

তবুও সন্দেহ দূর করবার জন্যে তার কাছে গিয়ে প্রশ্ন করি—‘কেরানী বলে তুমি আমায় ঘেন্না করো না?’

আমার হাতটা নিজের হাতের মধ্যে টেনে নিয়ে সে জবাবে বলে—‘মেয়েমানুষ কি তার প্রিয়তমের আর্থিক অবস্থার কথা কোনোদিন চিন্তা করে? সে সবসময় ভাবে তার স্বামীর ঘরই আপনার।’

স্বামী! কথাটা যেন কানের ভেতর ঘুরপাক খেতে লাগলো।

কিছুদিন আগে কীর্তনে একটা চণ্ডীদাসে২৬র লেখা গান শুনেছিলাম—‘কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো আকুল করিল মোর প্রাণ’।

তখন ব্যাপারটা বুঝতে পারিনি, আজ হাতেনাতে তা অনুভব করলাম। উঃ কী মিষ্টি ডাক! কল্পনায় যে সম্বন্ধ কতবার মনে মনে স্থাপন করেছি, রাত্রে ঘুমোতে ঘুমোতে যাকে নিজের বুকের ওপর কতবার স্বপ্নে পেয়েছি, সেই গৌরী আমাকে, আমার সেই চির-আকাঙ্ক্ষিত সম্বন্ধ ধরে সম্বোধন করলো?

বাংলা ভাষায় ‘ধরাকে সরা জ্ঞান’ বলে একটা কথা আছে। সেই ধরাকে সরা চোখে দেখা যে কী জিনিস এতদিন জানতাম না।

আজ বলতে বাধা নেই আমিও যেন চোখে সরা দেখতে আরম্ভ করলাম সেই সন্ধের সময়। বাড়ি, ঘর, দোর, রাস্তা, গাড়ি, ঘোড়া সবকিছু মুছে গেল আমার চোখের সামনে থেকে। আমার কল্পনালোকে কেবল রইলাম আমি আর গৌরী, গৌরী আর আমি।

চমক ভাঙলো গৌরীর ডাক শুনে। প্রকৃতিস্থ হয়ে বলি—‘কী বলছো আমাকে?’

সে বলে—‘এতো ঢিমে তেতালায় চললে বাড়ি পৌঁছতে যে একমাস লেগে যাবে, একটু জোরে চলো।’

আমিও বলি—‘চলো।’

তারপরে জিজ্ঞেস করি—‘গৌরী, তুমি আমায় কবে থেকে ভালোবাসো?’

ফিক করে হেসে ফেলে গৌরী বলে—‘যবে আমি তোমাদের বাড়িতে প্রথম গিয়েছিলাম। তুমি বাইরে দাঁড়িয়েছিলে, আমি তোমায় জিজ্ঞেস করলাম, অন্নপূর্ণা আছে কি না? তুমি আমাকে উত্তরে বললে—দেখুন না, বাড়ির মধ্যে সে আছে কিনা?’

—‘সেই দিন থেকে, কী আশ্চর্য!’

কথায় কথায় গৌরীর বাড়ির কাছে এসে পড়েছিলাম।

গৌরী বললে—‘আজ এই পর্যন্ত।’

আমি জিজ্ঞেস করি—‘আবার কবে দেখা হবে?’

সে বললো—‘খুব শিগগিরি। তোমাদের বাড়িতে আমি আবার যাবো।’

গৌরীকে পৌছে দিয়ে সেদিন ফিরে আসতে আসতে কেবলই মনে হয়েছিল, মিথ্যা নয়, কল্পনা নয়, সত্যি গৌরী আমায় ভালোবাসে। তার প্রমাণ আজ আমি হাতে হাতে পেয়েছি। রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে কেবলই মনে হয়েছে, খানিকটা আগে যা ঘটে গেল, তা কল্পনা না বাস্তব। বোধহয় এমন চিন্তা অনেকেরই মনে হয়। কারণ ঘটনার সমাপ্তির পর সুখ, দুঃখ, বেদনার যে অনুভূতিই মানুষের মনে হোকনা কেন, তার ঝঙ্কার থেকে যায় মানুষের মনের মধ্যে। আর সেই ঝঙ্কারের রেশ ধরে মানুষ কখনও কাঁদে, কখনও হাসে।

হাসি-কান্নাটা কিছুই নয়, সেটা হলো তার বহিঃপ্রকাশ। অন্তরের ঝঙ্কারই হল আসল। তাই রাস্তায় চলতে চলতে গুনগুন করে ধরলাম রবিবাবুর সেই গান—”শেষ গানেরই রেশ নিয়ে যাও চলে, শেষ কথা যাও বলে।”

গণেশদার সঙ্গে স্টুডিওর দরজা পার হলাম। মুখে রঙও মাখলাম। বর সেজে ক্যামেরার সামনে বসলাম।

ফটাস করে ‘ক্ল্যাপস্টিক’ টানা হল। ক্যামেরার হাতল ঘুরতে লাগলো ঘরঘর করে। আমারও বুকের ভেতর করতে লাগলো গুড়গুড়।

স্যুটিংএর পর সেদিন মনে হয়েছিল, বায়োস্কোপে ছবি তোলা কী শক্ত রে বাবা! থিয়েটার করেছি, যাত্রা করেছি—এতো শক্ত বলে মনে হয়নি। কিন্তু আজকে এই একটা ছোট্ট সেটের মধ্যে গোটাকতক আলোর সামনে অভিনয় করতে একেবারে ঘেমেনেয়ে গেলুম।

আমার দ্বারা বোধহয় ‘ফিল্মে’ অভিনয় করা আর হবে না।

কিন্তু মন এ কথা মেনে নিতে পারলো না। সন্ন্যাসীঠাকুর যে বলেছেন—আমি বড়ো অভিনেতা হব! তার চিহ্ন তো দেখতে পাচ্ছি না! আমার কেমন যেন তখন ধারণা জন্মে গেছে, তাঁর কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি হবেই। কারণ গৌরী আমাকে বলেছে—ও আমাকে ভালোবাসে। একটা কথা যদি তার সত্যি হয়, আর একটা হবে না কেন? আর যা ঘটবার তা যখন ঘটবেই, তা নিয়ে আমি আর অত মাথা ঘামাই কেন? অপেক্ষা করেই দেখি, সুযোগ আর সুবিধে কীভাবে আসে আমার জীবনে!

একদিন অফিসের পর সাউদার্ন পার্কে যাই ফুটবল খেলতে। খেলাধুলো করা আমার নিত্যকার অভ্যেস তখন। ভালো খেলতেও পারতাম। আজও স্টুডিও ফেরত গাড়ি করে যেতে যেতে, ময়দানে বা পার্কে যখন দেখি ছেলেরা ফুটবল খেলছে, তখন আমারও ইচ্ছে হয় গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে ‘সট’ মারি ঐ বলে। কিন্তু তা আর হয়না। মনের ইচ্ছে আমাকে মনেই চেপে রাখতে হয়—কারণ আজ আর আমি উনিশ কুড়ি বছরের ছেলে নই।

হাতেনাতে প্রমাণও হয়ে গেল সেদিন। আগামী ছবি ‘সপ্তপদী’২৭র একটা ফুটবল খেলার দৃশ্য তুলতে পরিচালক আমায় নিয়ে গিয়েছিলেন ফুটবল গ্রাউন্ডে।

বাঁধা গরু ছাড়া পেলে যেমন সে ছুটোছুটি করে, আমিও তেমনি বলের সঙ্গে ছুটোছুটি করছিলুম।

পরিচালক অবশ্য অনেকবারই আমায় বারণ করেছিলেন অমনটি করতে, কিন্তু কে শোনে কার কথা। ভুলে গেলাম আমি আমার বয়স, ভুলে গেলাম স্থান, কাল, পাত্র। ভুলে গেলাম আমি উত্তমকুমার, তারাশঙ্করবাবুর লেখা ‘সপ্তপদী’র নায়ক কৃষ্ণেন্দুর চরিত্রে আমি অভিনয় করছি। আমার মনে হল আমি ফিরে গেছি আমার সেই অতীত জীবনে, যখন অফিস, খেলা আর গৌরীর চিন্তাই ছিল আমার একমাত্র লক্ষ্য। সম্বিৎ ফিরলো যখন, অনভ্যাসের ফলে পা মচকালো। মুহূর্তেই পা ফুলে উঠলো। ফিরতে হল বাড়িতে। দুদিন আবার বাড়িতে হলাম বন্ধ। ছেলেবেলাকার দিনগুলোর মতনই মা নিয়ে এলেন চুন আর হলুদ গরম করে। একরকম ধমকে, লাগিয়ে দিলেন প্রলেপ। আমার মনে হল, এখনও মা’র চোখে বোধহয় আমি সেই তেমনি ছোটো ছেলেটিই আছি। এত ভালো লেগেছিল সেই দুটো দিন।

যাক যখনকার কথা বলছিলাম, ফিরে যাই আমার সেই কাহিনিতে।

ছুটোছুটি করে রীতিমতো তখন খেলাধুলো করছি এমনি সময় সেখানে উপস্থিত হলেন ধীরেনবাবু২৮। আমাদের যাত্রা থিয়েটারের ‘ড্রেস’ সাপ্লায়ার ছিলেন তিনি।

আজকাল ফিল্মেও ড্রেস সাপ্লাই দিচ্ছেন। কাছে এসে বললেন—‘অরুণ, শোনো! বায়োস্কোপের ছবিতে নামবে?’

জিজ্ঞেস করলাম—‘কী বই? কী পার্ট?’

উত্তরে ধীরেনবাবু বললেন—‘এস. বি. প্রোডাকসনের—রবীন্দ্রনাথের ”দৃষ্টিদান”। পার্ট বিশেষ কিছু নয়! করবে তুমি অভিনয়?’

মত তো আগের থেকে সকলকার নেওয়াই আছে। তাই মাথা নেড়ে জানালাম—‘হ্যাঁ।’

মাথা তুলে দেখলাম গৌরী দারোয়ানের সঙ্গে পথ দিয়ে কোথায় যাচ্ছে। চোখে চোখ পড়ায় সে ফিক করে হাসল।

তারপর?

রাজি তো হয়ে গেলাম ধীরেনবাবুর কথায়। তখন কি জানতাম এই ‘দৃষ্টিদান’ ছবিকে উপলক্ষ্য করেই আমার জীবনেও আরম্ভ হয়ে যাবে আর একটা অধ্যায়!

আজ সেই কথাই বলবো আমার পাঠকদের কাছে। অবশ্য এই ছবি থেকেই আমি বিখ্যাত হইনি, প্রচুর টাকাও পাইনি। সম্মান? সে আর আমি কি পাবো বলুন? কারণ, আমি তো তখনও নায়কের পার্ট করিনি! করেছিলাম হবু নায়কের পার্ট। হবু নায়ক বলতে আমি এই কথাই মনে করছি, ছবি আরম্ভর পর দুটি ছোটো কিশোর কিশোরী বা ছোটো দুটি শিশুকে আপনারা পর্দার ওপর দেখতে পেলেন। কিছুক্ষণ তারা আপনাদের সামনে এলো, কথা বললো, খানিকটা আপনাদের আনন্দও দিলো। তারপরেই ক্যামেরাম্যানের কায়দায় হঠাৎ পর্দার ওপরে লেখা হয়ে গেল ‘বিশ বছর পরে’। তারপরে বেশীক্ষণ ধরে যাঁরা পর্দার ওপর রইলেন তাঁরাই কেড়ে নিলেন দর্শকের মন। সিনেমা হল থেকে যখন দর্শকরা বেরিয়ে আসেন তখন ছোট শিশুদুটি বা কিশোর-কিশোরীরা দর্শকের মন থেকে একেবারে মুছে গেছে।

অসিতদা২৯ (অসিতবরণ) আর সুনন্দা দেবী৩০ ছিলেন এই ছবির নায়ক-নায়িকা। আমাকে অভিনয় করতে নেওয়া হয়েছিল ঐ অসিতদারই ছোটোবয়সের চরিত্রে। তাই নিজেকে নায়ক না বলে বললাম—হবু নায়ক। আমারই সঙ্গে হবু নায়িকার পার্ট করেছিলেন কেতকী৩১।

ইতিপূর্বে শ্রীরঙ্গমে শিশিরকুমারের পরিচালনায় ‘বিন্দুর ছেলে’ তে অসিতদা বিন্দুর ছেলে অর্থাৎ অমূল্যর পার্ট করতেন। যাহোক, তাঁর জীবনে তবুও দর্শকের হাততালি পাবার একটা চান্স তিনি পেয়েছেন, আমি পাইনি।

পাড়াতে অভিনয় করা এক জিনিস আর দর্শকশূন্য স্টুডিওর সেটে ক্যামেরার সামনে অভিনয় করা আর এক জিনিস। শুধু তাই নয়, আমার পরবর্তী জীবনে, দীর্ঘদিন ধরে, স্টার থিয়েটারের পাদপ্রদীপের সামনে পুর্ণ প্রেক্ষাগৃহে ‘শ্যামলী’৩২ অভিনয় করতে গিয়ে দেখেছি, সে অভিনয় সম্পূর্ণ আলাদা।

এখন বলি, কেন এ কথা আমি বলছি। পাড়ায় বন্ধুবান্ধব মিলে স্টেজ তৈরি করে অভিনয় আমরা করেছি, একথা সত্যি। সে অভিনয় কেমন? তাতে থাকে না দায়িত্ববোধ। দর্শকরা অভিনেতাদের বেশিরভাগ স্থানেই হন বন্ধুস্থানীয়। ভুল-ক্রটি আপনি যাই করুন না কেন, সকলেই তা নেবেন ক্ষমার চোখে আর হাসির মাধ্যমে।

যেমন ধরুন, আপনি হয়তো কোনো বৃদ্ধের পার্ট করছেন।

গোঁফ দাড়ি খুব ভালো করে লাগিয়েছেন; মেক-আপে আপনাকে চেনবার জো নেই। নির্দিষ্ট সময়ের এক ঘণ্টা বা দেড় ঘণ্টা পরে অভিনয় যখন হল তখন আপনি দেখলেন ভীষণ মুশকিল হয়ে গেছে। সাজসজ্জার সময় মুখ বন্ধ করে সেজেছেন। পেন্টার তাড়াতাড়িতে গোঁফের চুলগুলো বড়োই রেখেছেন, কেটে দিতে ভুলে গেছেন। এখন আপনি যেই কথা বলতে যাচ্ছেন, ঠোঁটটা ওপর দিকে উঠে যাচ্ছে, ওপর দিকে উঠতেই, নিঃশ্বাসের সঙ্গে চুলগুলো গিয়ে ঢুকছে আপনার নাকের ভেতর। আর আপনি তখন কথা বলবেন কী, তার আগেই আপনার হয়ে যাচ্ছে প্রচণ্ড হাঁচি।

দু’চারবার এইরকম হবার পর আপনার দর্শকরা আপনাকে দেখে হাসতে আরম্ভ করলেন, কিংবা আপনার অনুকরণে হাঁচতে আরম্ভ করলেন।

পরের দৃশ্যে আপনি যখন গোঁফের চুল কেটে আবার স্থিত হয়ে এলেন, তখন আপনার পূর্ব দৃশ্যের অপরাধ অনেকেই ভুলে গেছেন। পাড়ার কয়েকটা বখাটে ছেলে অবশ্য আপনাকে দেখে হাঁচল। তাদের অবশ্য তখুনি থামিয়ে দেন বয়োজ্যেষ্ঠ লোকেরা। সুতরাং আপনার অভিনয় জমেও গেল।

পরের দিন সকালবেলা যখন রকে রকে বা জানলায় জানলায় আপনার অভিনয়ের সমালোচনা শুরু হল, তখন আপনার অস্বাভাবিক হাঁচির কথা তাঁরা ভুলে গেছেন।

এ তো গেল শখের দলের অভিনয়ের কথা। এখন বলি পেশাদার রঙ্গমঞ্চে অভিনয়ের কথা।

অভিনয় করতে যাবার আগেই আপনার মনে হবে, যাঁরা আপনার অভিনয় দেখতে এসেছেন তাঁদের কাউকেই আপনি চেনেন না। আপনার দোষ-ত্রুটি ধরবার জন্যে তাঁরা ওঁত পেতে বসে আছেন। অথচ তাঁদেরই সামনে অভিনয় করে আপনাকে তাঁদের খুশি করতে হবে। যদি খুশি করতে পারেন তাহলে আপনার সুনামের অবধি থাকবে না। আর আপনার সুনাম হলেই নাট্যপরিচালক, রঙ্গমঞ্চের মালিক, সকলেই খুশি হবেন আপনার ওপর। কারণ তাদের নাটক শুধু চলবেই না, বক্স-অফিসও হিট করবে।

ক্যামেরার সামনে অভিনয় করাটা স্বতন্ত্র। এ প্রম্পটারের কথা শুনে অভিনয় করা নয়। ঠিক যতগুলি কথা আপনাকে বলতে হবে ততগুলি সংলাপ আপনাকে মুখস্থ করতে হবে। পরিচালক যেমনটি দেখিয়ে দিয়েছেন ঠিক তেমনটি আপনাকে করতে হবে। একটু ভুল বা ত্রুটি হলেই অন্যদিক থেকে আওয়াজ আসবে—‘কাট’। তাতে প্রযোজকের মুখ হবে গম্ভীর, কারণ আপনার সামান্য ভুলের জন্য অতখানি নেগেটিভ তাঁর নষ্ট হল।

শুধু এই নয়। ঘণ্টা আড়াই কি তিন, গোছগাছ আর রিহার্সাল দেওয়ার পর আপনি হয়তো ক্যামেরার সামনে অভিনয় করলেন দু’মিনিট। ঠিক যেন টেস্ট পরীক্ষায় allow হয়ে তিনমাস পরে পরীক্ষা দিলেন তিন ঘণ্টায়। কেমন হয়েছে তা জানবার উপায় নেই, যতক্ষণ না ইউনিভার্সিটি ফল বার করছে। এখানেও ঠিক তাই। অভিনয় করে আপনি বসে রইলেন। ছ’মাস কি সাত মাসের পর যখন ছবি মুক্তি পেল, তখন যদি দর্শকরা নিলেন সে ছবি তাহলে বুঝলেন আপনার অভিনয় ভালো হয়েছে। আর যদি ছবি flop করে তাহলে বুঝলেন অভিনয় ভালো হয়নি।

যা হোক, যে কথা বলছিলাম। স্টুডিওতে গেলাম। স্যুটিং হল দু’দিন। দক্ষিণা নিতে গেলাম। শুনলাম আমার ভাগ্যে এবারের দক্ষিণা হচ্ছে সাতাশ টাকা। কমিশন বাদ দিয়ে আমি পকেটে পেলাম মাত্র সাড়ে তের টাকা। আজকে ‘মাত্র’ বলছি কিন্তু সেদিন মনে হয়েছিল যেন অনেকখানি। আরও আনন্দ হয়েছিল, খুব শিগগির এর যা হয় একটা কিছু ফলাফল জানতে পারব।

আবার ফিরে গেলাম আমার সেই পুরোনো জীবনে। অফিস আর বাড়ি, বাড়ি আর অফিস। গৌরী আসে। আজকাল অবশ্য বেশ সয়ে গেছে। আমার ঘরে বসে কথাও বলে। অবশ্য অন্য লোকের অসাক্ষাতে।

‘সয়ে গেছে’ বলছি এই অর্থে,—মা আর অন্নপূর্ণা বা আমার বাড়ির অন্য লোকেরা এ ব্যাপার নিয়ে আর মাথা ঘামান না। কিন্তু আমার কি সত্যি সয়ে গিয়েছিল? আজ স্বীকার করতে বাধা নেই নিভৃতে গৌরীর সঙ্গে যখনই কথা বলবার সুযোগ পেতাম তখন আমার বুকের স্পন্দন যেন বন্ধ হয়ে যেত। তারপরে গৌরী চলে গেলে কিছুক্ষণ আনন্দে সেই চিন্তায় বিভোর হয়ে থাকতাম। পরক্ষণেই মনের মধ্যে আসত কেমন একটা হতাশা। কিছুক্ষণ আগেকার ঘটনা মন যেন বিশ্বাস করতেই চাইত না। মনের মধ্যে কেবলই উঠত একটিমাত্র প্রশ্ন—এ সত্যি ভালোবাসা না অভিনয়?

মাঝে মাঝে হতাশা কাটাবার জন্যে ভাবতাম অভিনয় যদি হবে তাহলে গৌরী কেন আমাদের বাড়ি আসবে। আবার মনে হত, গৌরী বোধহয় আমায় নিয়ে কেবল খেলা করছে। ও জানে সময় হলে ওর বিয়ে হবে কোনো বড়োলোকের ছেলের সঙ্গে। তখন আমার মতো অবস্থার ছেলেকে ভুলতে ওর এতটুকু সময় লাগবে না।

যাক, এইরকম করতে করতে কেটে গেল আরও কয়েকটা মাস। ‘দৃষ্টিদান’ মুক্তি পেল। ছবিটা দেখেও এলাম। মনটাও খুশি হল। কিন্তু হঠাৎ দেখলাম আমাদের বাড়িতে গৌরীর আসা বন্ধ হয়ে গেছে। এ বন্ধ হওয়ার অর্থ কিছু বুঝতে পারলাম না। ওদের বাড়িতে যেতেও সাহস হয় না। কী জানি যদি কেউ কিছু ভাবে! মনটা কেমন যেন খারাপ হয়ে গেল।

অন্নপূর্ণাকে বলি—‘তোর বন্ধু গৌরীর কী হয়েছে রে? একবার খোঁজ নিস তো!’

অন্নপূর্ণা বোধহয় ব্যাপারটা আঁচ করেছিল। বিকেলবেলায় আমি অফিস থেকে আসতেই সে আমাকে বলল—‘শুনেছ কী হয়েছে?’

আমি সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করি, ‘কী রে?’

—‘গৌরী তার ঠাকুমার সঙ্গে গিয়েছিল ”দৃষ্টিদান” দেখতে। ঠাকুমা বায়োস্কোপ দেখতে দেখতে হঠাৎ নাকি গৌরীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন—”হ্যারে গৌরী, তুই কাকে বিয়ে করবি বল তো? এই সমস্ত ছেলেদের মধ্যে কাউকে পছন্দ হয়?” ঠাকুমা হয়তো ভেবেছিলেন—লজ্জায় ভেঙে পড়ে গৌরী বলবে—বাবা কী বলছ ঠাকুমা! ঠাকুমাও নাতনিকে ঠাট্টা করবার একটা সুযোগ পাবেন। কিন্তু গৌরী সে দিক দিয়েও গেল না। হঠাৎ ঠাকুমাকে নাকি তোমার ছবিটা দেখিয়ে দিয়ে গৌরী বলেছে—”ঐ, ঐ, ওকে।” নাতনির উত্তর শুনে ঠাকুমার চোখ তো ছানাবড়া। বাড়িতে ফিরে এসেই সে খবর দিয়েছেন তাঁর ছেলেকে। ফলে গৌরীর স্কুলে যাওয়া, এমনকি বাড়ি থেকে বের হওয়াও বন্ধ।’

স্তম্ভিত হয়ে গেলাম অন্নপূর্ণার কথা শুনে। গৌরী তাহলে সত্যিই আমায় ভালোবাসে! আমার জন্যে সে এতখানি দুঃখবরণ করেছে! তার দুঃখের কথা শুনে আমার কোথায় দুঃখ হওয়া উচিত, তা না হয়ে, আমার মনে প্রাণে খেলে গেল একটা আনন্দের হিল্লোল—গৌরীর ভালোবাসার মধ্যে কোন মেকি নেই জেনে।

অন্নপূর্ণা আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে বলল—‘কী ভাবছ দাদা?’

একটু ঢোঁক গিলে নিয়ে বলি—‘না, এমন কিছু নয়!’

একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস বুক ঠেলে বের হয়ে আসতে চায়। সেটাকে চাপবার প্রাণপণ চেষ্টা করি।

হঠাৎ সচকিত হয়ে অন্নপূর্ণা বলে—‘হ্যাঁ, আসবার সময় তাড়াতাড়িতে গৌরী যেন কী তোমায় লিখে দিয়েছে। পড়ে দেখো।’—বলে সে একটা ভাঁজকরা কাগজ আমার হাতে দিলো।

সেটা নিয়ে গিয়ে নিজের ঘরে বসে দরজা বন্ধ করে বারবার পড়তে থাকি। তাতে লেখা রয়েছে : ‘অন্নপূর্ণার মুখে আমার সব কথা হয়তো শুনেছ। এই আমাদের জীবনের পরীক্ষা শুরু। ভয় পেয়ে পিছিয়ে যেও না বীরপুরুষ। আমি জানি, এ খবর শুনে তোমার কষ্ট হবে। তার সঙ্গে এ-ও জানি, আমার ভালোবাসাই তোমায় টেনে আনবে আমার কাছে একদিন!

ইতি—তোমারই গৌরী’

অদ্ভুত, ছোট্ট অথচ মিষ্টি চিঠি। বারবার পড়েও যেন তৃপ্তি হয় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *