১
দ্বিজেন্দ্রলালের১ দিলদার এক জায়গায় বলেছেন—”আমি পারিষদ, দার্শনিকের পদে এখনও উন্নীত হইনি। তবে ঘাস খেতে খেতে মুখ তুলে চাওয়ার নাম যদি দর্শন হয় তাহলে আমি দার্শনিক।”
ঠিক তেমনি, আমিও অভিনেতা। অভিনয়ই আমার জীবন। সাহিত্যিক আমি নই।
তবুও আমাকে অনুরোধ করেছেন লেখবার জন্য।
প্রথমটা ভেবেছিলাম লিখব না। শেষকালে কলম ধরতে বাধ্য হলাম এই ভেবে যে আমারও আপনাদের কাছে কিছু বলবার আছে। সেই না-বলা বাণীকেই আজ আমি ভাষায় রূপ দিতে চলেছি।
কারণ ইলেকট্রিকের আলোর সাহায্যে রুপালি পর্দার ওপর আমার ছবি দেখে অনেকেই আমার সম্বন্ধে বিভ্রান্তিকর ধারণা করতে শুরু করেছেন। আর সেই ভ্রান্তি আমাকে নিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী থেকে তুলে আর এক কল্পলোকে—যেখানকার অধিবাসী আমি নই, হবার যোগ্যতাও রাখি না।
যেমন, আমার বাড়ি নাকি বিরাট একটা বাগানের মাঝখানে। রাত্তিরবেলা সেইখানে নাকি আলো জ্বলে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় রংও তার বদলায়। সুইজারল্যান্ড থেকে নাকি আমার জন্যে এসেছে স্পেশাল একধরনের দম দেওয়া পাখি, যাতে দম দিয়ে দিলে সুন্দর গান ভেসে আসে। আর সেই গান শুনতে শুনতে আমি নাকি রাত্তিরে ঘুমোই। Studio থেকে ফেরার সময় একটা ঝোলানো electric hanging bridge-এর সাহায্যে আমার গাড়ি নাকি উঠে যায় বাড়ির তেতলার ছাদে। আমি যেন কোনো রূপকথার রাজপুত্র।
তবে এখন প্রশ্ন হতে পারে এ সব কাহিনি রটল কী করে? আমার যতদূর বিশ্বাস এসব কাহিনি রটেছে—কারণ দীর্ঘদিন দর্শকরা আমাকে পর্দার ওপরে দেখেছেন নায়কের ভূমিকায়। সিনেমার নায়ক অধিকাংশ সময় বড়োঘরের ছেলে কিংবা গরীবের ছেলে হলেও একটা বড়োলোক আত্মীয় বা বড়োলোক নায়িকা তার থাকেই। কিন্তু এ ধরনের গল্প আমার সম্বন্ধে যাঁরা রটান তাঁরা ভুলে যান, পর্দার গায়ে আমাকে যার বেশে দেখছেন তার সঙ্গে বাস্তব ক্ষেত্রে আমার সম্বন্ধ একেবারেই নেই। আমি নায়ক। যেমন বড়োলোক সাজি, তেমনি গরীব চাকরও মাঝে মাঝে সাজতে হয়। সবচেয়ে মজার কথা এই যে, অনেকে ভাবেন গরীবের চরিত্রে অভিনয় করাটাই আমার সত্যিকারের অভিনয়, আর শেষেরটা আমার জীবন।
কিন্তু আপনারা বিশ্বাস করুন রূপকথার রাজপুত্তুর আমি নই। আপনাদেরই মতো সাধারণ রক্তমাংসে গড়া মানুষ। শোকে দুঃখে আমারও জীবন আপনাদেরই মতন গড়ে উঠেছে—আর সেই কথা বলবার জন্যে আপনাদের দরবারে হাজির হয়েছি।
হাজির হয়েছি এই জন্যে যে, আমি ভালোবেসেছি আপনাদের। আপনাদের আনন্দ দিয়ে সেবা করতে চেয়েছিলাম আমার মনপ্রাণ ঢেলে। জানিনা সে কাজে আমি কতদূর সফলতা লাভ করেছি। তবে আমার এই কাজের বিনিময়ে আমি পেয়েছি আপনাদের শুভেচ্ছা আর আশীর্বাদ—যা আমার জীবনের যাত্রাপথে ধ্রুবতারা হয়ে অন্ধকার রাত্রে পথনির্দেশ করবে।
ছেলেবয়সে একদিন স্বামী বিবেকানন্দের কথা পড়তে পড়তে একটা ঘটনা আমাকে স্তম্ভিত করে দিয়ে যায়। তখন তার মানে ভালো করে বুঝতে পারিনি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার অর্থ কিছু উপলব্ধি করতে পারি।
ঘটনাটা এইরকম।
স্বামী বিবেকানন্দ একদিন গিয়েছিলেন এ যুগের অবতার ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে দক্ষিণেশ্বরে দেখতে।
ফিরে আসছেন তিনি সেখান থেকে। সঙ্গে হরি মহারাজ বা তুরীয়ানন্দ।
স্বামীজি প্রশ্ন করলেন—‘কেমন দেখলে ঠাকুরকে?’
উত্তরে তুরীয়ানন্দ অনেক কথাই বললেন। অবশেষে প্রশ্ন করলেন—‘তুমি কেমন দেখলে তাঁকে?’
পথ চলতে চলতে গম্ভীর কণ্ঠে স্বামীজী উত্তরে বললেন–‘L–o–v–e, personified.’
পরে বুঝেছি ঘনীভূত ভালোবাসাই ভগবানের প্রকৃত রূপ এবং তাঁকে পেতে গেলে বা তাঁর কাজ করতে গেলে মানুষের অন্তরেও চাই ভালোবাসা। সুতরাং সেইদিন থেকে এই সহজ পথই বেছে নিলাম নিজের আদর্শরূপে। ভালোবাসলাম নিজের বাবা, মা, আত্মীয়স্বজনকে। ভালোবাসলাম পাড়ার ছেলেদের। ভালোবাসলাম আপনাদের।
কাজের ফাঁকে ফাঁকে অনেক চিন্তা করেছি, আমি কি প্রকৃতই আমার উদ্দেশ্যপথে এগিয়ে যেতে পারছি, না লক্ষ্যহারা হয়ে আমি জীবনের আদর্শ থেকে বহুদূরে সরে যাচ্ছি? তেমন যুক্তিপূর্ণ উত্তর পেতাম না। উত্তর পেলাম সেইদিন যেদিন আমি ভিক্ষাপাত্র হাতে বেরিয়েছিলাম আপনাদের দরজায় দরজায়। সেইদিন আমি বুঝতে পেরেছিলাম কতখানি ভালোবাসা আমি আপনাদের কাছ থেকে পেয়েছি।
কিন্তু আমার এমনি দুর্ভাগ্য যে সেদিন আপনাদের প্রত্যেকের সঙ্গে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আলাপ করার সুযোগ আমার ছিল না।
আপনারা সকলেই জানেন কলকাতার লোকের জীবন ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে থাকে বাঁধা। যদি কোনো কারণে ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে যায় তাহলে সেই কয়েকটা মিনিট পূর্ণ করবার জন্য কী প্রাণান্তকর পরিশ্রমই না মানুষকে করতে হয়!
তেমনি আমার জীবনও বাঁধা রয়েছে ওই ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে।
চিত্রনির্মাতারা আমার অধিকাংশ সময়ই কিনে নিয়েছেন। আমাকেও তাই পাল্লা দিয়ে দ্রুত ছুটতে হয় ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে। ইচ্ছে থাকলেও আপনাদের সঙ্গে বসে আলাপ-আলোচনা করবার সময় আমি পাইনা।
বিশ্বাস করুন, কত রাত বিছানায় শুয়ে আমি ভেবেছি, এ আমার অন্যায়। কিন্তু পরমুহূর্তে এই ভেবে আশ্বস্ত হয়েছি, মুখোমুখি আপনাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে না পারলেও আপনাদের আনন্দ আর সেবার জন্যে আমার অধিকাংশ সময় ব্যয়িত হয়। এইটুকুই আমার একমাত্র তৃপ্তি।
অনেকে আমাকে প্রশ্ন করেছেন, আমার ছেলে বয়সের অরুণকুমার নাম আমি কেন পরিবর্তন করলাম। কী-সে এমন ঘটনা ঘটেছিল, যার জন্যে এই নাম পরিবর্তন!
আপনারা অনেকেই জানেন আমার নাম ছিল অরুণকুমার— অর্থাৎ সূর্যের পুত্র।
সূর্যদেব হচ্ছেন সেই সে দেবতা যাঁর দয়ায়, জগৎ আর তাঁর সৃষ্টি রক্ষা পায়। কিন্তু আমি তো তা নই।
এ যুগের কবিগুরুর নামও তাই।
মধ্যাহ্ন ভাস্করের মতন তিনি সাহিত্যজগতে বিরাজিত। তাঁর মৃত্যুতে আমার যতদূর স্মরণ আছে— Sir Morris Gayer২ বলেছিলেন— ‘গত দু’হাজার বৎসরের মধ্যে এমনি প্রতিভাবান ব্যক্তির জন্ম হয়নি। আর আগামী দু’হাজার বৎসরের মধ্যে এমন কবির জন্ম হবে কিনা সন্দেহ।’
তাই আমি ভেবে দেখলাম তাঁরই সাজে ‘রবীন্দ্র’ নাম নেওয়া। কিন্তু আমি? আমি তো সামান্য মানুষ! ও নাম বা তাঁর পুত্র হবার যোগ্যতা আমার কোথায়? তাই আমার নিজের নাম বদল করে রাখলাম উত্তমকুমার। অর্থাৎ আমি হচ্ছি উত্তম-মানুষের পুত্র।
অবশ্য এ বিষয়ে আপনারাও আমার সঙ্গে একমত হবেন। নিজের পিতাকে সব পুত্রই শ্রেষ্ঠ পুরুষ মনে করে। তা সে নিজে যাই হোক। কারণ বাবা-মা যে কোনও ছেলেমেয়ের সাক্ষাৎ উপাস্য দেবতা। তাই আমি নাম বদল করে হলাম উত্তমকুমার।
২
আত্মজীবনী লিখতে যাওয়া ভারী বিপদ। অনেক কথা ভিড় করে আসে মাথায়। সেগুলোকে বেছে বেছে, একের পর এক, পাঠকের সামনে উপস্থিত করতে হবে। তার মধ্যে কাহিনিকারকে আগে ভেবে নিতে হয়, কোনটা আগে কোনটা পরে। যেন না কখনও মিথ্যের আশ্রয় নিতে হয়। এই বাছাবাছির মধ্যে সবচেয়ে কঠিন নিজের শৈশবের কথা লেখা।
ছেলেবয়েস থেকে কোনও ডায়ারিও লিখে রাখিনি যা থেকে আজ এই কাহিনি লিখতে সাহায্য পাব।
নিজের স্মৃতি ঘেঁটে তাই আমার শৈশবের এক একটা ঘটনা আজ খুঁজে বার করতে হচ্ছে—আপনাদের কাছে নিবেদন করব বলে।
যাক, যা বলছিলাম।
আমি শুনেছি, আমি নাকি আহিরীটোলায় আমার মামার বাড়িতে ৩ সেপ্টেম্বর জন্মেছিলাম। আমার বাবার৩ বাড়ি কিন্তু ভবানীপুর অঞ্চলে গিরিশ মুখার্জি রোডে। বাবার বাড়ি বলছি বলে একথা কেউ মনে করবেন না, সেই বাড়িতে কেবল আমার বাবাই থাকতেন। সেটা ছিল, ও অঞ্চলের চট্টোপাধ্যায় পরিবারের যৌথ সংসার।
মা’র মুখ থেকে গল্প শুনেছি, আমার মা৪ যখন বধূবেশে এ বাড়িতে আসেন, তখন তাঁর অত্যন্ত অল্প বয়স। চট্টোপাধ্যায় পরিবারের তখন উঠতি সময় নয়। ভাঙন শুরু হয়েছে। বন্যার টানে ভেসে যাচ্ছেন অনেকেই। অর্থের অভাব সংসারে দেখা দিয়েছে।
আমার মা’কেও তাই গৃহের কাজে খাটতে হত উদয়াস্ত। লোকজন রাখবার সামর্থ্য আমার বাবার তখন ছিল না। নিশ্বাস ফেলবার সময়ও তাঁর ছিল না। রান্নাবান্না; এককথায় গৃহস্থালীর যাবতীয় কাজ, তিনি নিজে হাতেই করতেন। আর আমার বাবা? সকাল থেকে ঘুরতেন, অর্থের চিন্তায়। কী যে তিনি করতেন তা অবশ্য খবর রাখার বয়স তখন আমার হয়নি। অদ্ভুত ছিলেন এই মানুষটি। সংসারে কারোর ওপর কোনও দাবি রাখতেন না। সকলকে দিতেই তিনি যেন এসেছিলেন। দিয়েই তিনি চলে গেলেন।
আমি তাঁর বড়ো ছেলে হয়েও তাঁর দুঃখের লাঘব এতটুকু করতে পারলাম না।
মেট্রো কোম্পানি কলকাতায় বায়োস্কোপ৫ খোলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি সেখানে যোগদান করেছিলেন ‘চীফ অপারেটর’ হিসাবে। তাই বেশিরভাগ দিনই তিনি বাড়ি আসতেন আমরা যখন ঘুমিয়ে পড়তাম। আমাদের সঙ্গে সম্বন্ধ ছিল তাঁর কম।
কিন্তু একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ করেছি। আমরা কী করছি, তা তাঁর থাকত নখদর্পণে।
সাধারণ বাপ মা’র মতন আমাদের গায়ে তিনি কখনও হাত তোলেননি।
চেঁচামেচি করে বাড়িতে যে বকাবকি করেছেন, এমন কথাও মনে পড়ে না। কিন্তু ওই মানুষটিকে আমরা চিরদিন ভয় পেয়েছি। শুধু ভয় নয়, সত্যিকারের ভালোবেসেছিলাম। সে ভালোবাসা যে কতখানি, তা আজ মর্মে মর্মে অনুভব করছি—তাঁকে হারিয়ে।
তিনমাস আগে আমাদের ছেড়ে যখন তিনি চলে গেলেন, তখন মনে হয়েছিল আমি এ সংসারে যা হারালাম তা বুঝি কোনোদিন পূর্ণ হবে না।
শ্মশানঘাটে চিতার ধোঁয়ার দিকে চেয়ে খালি ভেবেছি—উপযুক্ত পুত্র হয়েও আমি করতে পারলাম না কিছুই আপনার। কেবল দু’হাত পুরে আমি নিয়েই গেলাম। বিনিময়ে দিলাম কী?
আমার উন্নতি, প্রতিষ্ঠা; আজ সংসারে যা কিছু পেয়েছি তা আপনারই দয়ায়।
এই সমস্ত কথা ভাবতে ভাবতে, তাঁর শেষ কাজ করে ফিরে এলাম আমাদের পুরোনো বাড়িতে।
মা’র দিকে চেয়ে দেখি, তাঁর অঙ্গে উঠেছে তখন বিধবার সাজ। কোথায় গেল তাঁর লালপাড় শাড়ি, কোথায় গেল বা তাঁর সিঁথির সিঁদুর!
ঘর থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছিলাম। মা ডাকলেন, ‘খোকা শোন।’
এতক্ষণ ধৈর্য ধরে ছিলাম, কিন্তু এ স্নেহস্পর্শে আমার সব ধৈর্যের বাঁধন যেন টুটে গেল। স্বার্থপরের মতো একবারও সেদিন চিন্তা করতে পারিনি যে এই দুঃখ মায়ের বুকেও কম ব্যথা দেয়নি। তবুও তিনি, আমাদের মুখ চেয়ে নিজেকে প্রাণপণে শক্ত করে রেখেছেন।
মা’র কাছে গিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম। বললাম—‘মা, কী হবে? আমি তো কিছুই ভাবতে পারছিনা।’
অভয়দায়িনীর মতো আমাকে অভয় দিয়ে তিনি বললেন—‘ভয় কী! আমি তো আছি। আর রয়েছে তাঁর আশীর্বাদ।’
আমি বললাম—‘বাবার তো কিছুই আমি করতে পারলাম না। জীবনের শেষদিন অবধি তিনি কাজই করে গেলেন। বিশ্রাম যে কী জিনিস তা তো তিনি জানলেন না। এমন কি এই বাড়ি থেকে আমার নতুন বাড়িতে উঠে যেতে তোমাদের বললাম, তাও তোমরা যেতে রাজি হলে না। তোমাদের সেবা করবার সুযোগ আমাকে দিলে না, কেবল অপরাধীই করে রাখলে।’
আমাকে দু’হাত দিয়ে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে মা বললেন — ‘দুঃখ পাসনে বাবা, জীবনে কখনও তিনি কারুর কাছ থেকে আশা করতেন না। তাই অসুস্থতা সত্ত্বেও শেষ দিন অবধি তিনি কাজ করে গেলেন। তাই বলে মনে ভাবিস না—তিনি তোদের ভালোবাসতেন না। কতখানি যে তোদের ভালোবাসতেন তিনি, তা কেবল জানি আমি। তোদের ভার সমস্ত আমার ওপর দিয়ে তিনি আজ চলে গেলেন।’
কথাগুলো বলতে বলতে তাঁরও দু’চোখ বেয়ে অশ্রুধারা নেমে এলো আমার মাথার ওপর।
শ্রাদ্ধশান্তি চুকে যাবার পর মাকে নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম আমার নতুন বাড়িতে। কিন্তু মা বললেন—তাঁর শ্বশুর আর স্বামীর ভিটে ছেড়ে কোথাও তিনি থাকতে পারবেন না। কারণ তাহলে ভিটেতে প্রদীপ দেবে কে?
তাই আমি ভাবছি আমার নতুন বাড়ি ছেড়ে দিয়ে চলে যাব আমার মায়েরই কাছে। জীবনের বাকি ক’টা দিন তাঁরই সেবায় জীবন উৎসর্গ করব। কারণ বিবেক আমাকে নিয়ত দংশন করছে যে আমার বাবার আমি কিছুই করতে পারিনি।
৩
অনেকে আমাকে আর সম্পাদকমশাইকে চিঠি দিয়েছেন। তাঁরা আমার পূর্বোক্ত কাহিনির মধ্যে রোম্যান্টিক ঘটনা পাননি বলে অভিযোগ জানিয়েছেন।
পর্দার ওপরে আমাকে তাঁরা দেখেছেন নানারকম রোম্যান্টিক চরিত্রে অভিনয় করতে। কিন্তু তেমন রোম্যান্সের সন্ধান আমি পাই কোথায়? তাও আবার এই বিশেষ ধরনের রোম্যান্সগুলো ঘটে একটা নির্দিষ্ট বয়সে। সেই বয়সে কাহিনিকে না টেনে নিয়ে যাওয়া অবধি, আপনাদের কাছে আমার বিনীত নিবেদন, আপনারা একটু ধৈর্য ধরে আমার কথা শুনুন।
যাক যা বলছিলাম।
আমার জেঠামশাই-এর ছিল ‘সুহৃদ সমাজ’ নামে একটি যাত্রা ক্লাব।
ছেলেবয়সে পড়াশুনা আরম্ভ হবার আগে আদরের ভাইপো বলে, রিহার্সালে যাবার অধিকারটুকু আমার বোধহয় মিলত। সেইসমস্ত যাত্রার বিভিন্ন ভঙ্গী, পার্ট, আবৃত্তি আর গান আমাকে মুগ্ধ করত। তখন থেকে ভাবতাম কবে বড়ো হব, কবে আমিও যাত্রা করবার সুযোগ পাব!
যাত্রার রিহার্সাল দেখতে দেখতে কতদিন যে ক্লাবঘরে ঘুমিয়ে পড়েছি তার আর ইয়ত্তা নেই। দিনের বেলায় রিহার্সাল বসত না। বড়ো ফাঁকা ফাঁকা লাগত। কেবলই মনে হত কখন সন্ধে হয়!
আগেই বলেছি আমরা ছিলাম যৌথ পরিবার। তাই আমার বয়সি আমার সঙ্গীসাথিরও বিশেষ অভাব ছিল না। কিন্তু সকলকার চেয়ে আমার বিক্রম বেশি ছিল আমার নিজের দিদির ওপর।
এইখানে বলে রাখি, আমরা ছিলাম চার ভাইবোন। ছিলাম বলছি, তার কারণ, আজ আমাদের একজন আর ইহলোকে নেই। শৈশবেই তাকে চলে যেতে হয়েছে অপর এক পৃথিবীর ডাকে।
খুব সম্ভব ‘বুড়ো’ (তরুণকুমার)৬ তখনও হয়নি।
একদিন সকালবেলায় খেলতে খেলতে দিদি আমাকে বলে—‘হ্যাঁরে তুই রোজ সন্ধের পর ক্লাবঘরে যাস কেন?’
আমি বলি—‘যাই কেন জানিস? যাত্রা শিখব বলে।’
দিদি বলে—‘ইস, তুই যাত্রা করতে পারবি? যা রোগাপটকা চেহারা তোর!’
আমি রেগে উঠলাম। ক্ষেপে উঠে দাঁড়িয়ে যাত্রার ভঙ্গীতে আবৃত্তি করতে লাগলাম।
দিদি হেসেই খুন? দিদি যত হাসে, আমার যাত্রা করবার উৎসাহ ততই বাড়ে। ভেতর ভেতর রাগও যে হচ্ছিলনা তা নয়।
হঠাৎ পার্ট বলা বন্ধ করে বলি—‘হাসছিস কেন রে?’
দিদি বলে—‘হাসব না? তুই কি যাত্রা করছিস, তুই তো কেবল আমার দিকে চেয়ে পার্ট বলে যাচ্ছিস। যাত্রা বুঝি ওইভাবে করে? যাত্রা করতে গেলে তো ঘুরে ঘুরে অ্যাক্টিং করতে হয়।’
সত্যি তো, ক্লাবঘরে যাদের অ্যাক্টিং করতে দেখেছি তারা তো ঘুরে ঘুরেই বলে। উত্তেজনার মাথায় সেটা তো ভুলেই গিয়েছিলাম।
কিন্তু দিদির কাছে তর্কে হারতে ইচ্ছে হ’ল না। তাই বলি—‘ইস—আমি কি সত্যিকারের যাত্রা করছি নাকি! আমার কি গদা আছে না তলোয়ার আছে! গদা আর তলোয়ার জোগাড় করে দে, তা হলে দেখ আমি যাত্রা করতে পারি কি না। এখন তো আমি থিয়েটার করে তোকে দেখাচ্ছিলাম।’
অকাট্য যুক্তি। এর কিছুদিন আগে মা’র সঙ্গে আমার মামারবাড়ি গিয়েছিলাম। সেখান থেকে মায়ের সঙ্গে একদিন থিয়েটারও দেখতে গিয়েছিলাম। কী থিয়েটার দেখেছিলাম, তা আজ আর মনে নেই। মনে রাখবার বয়সও তখন আমার হয়নি। তবে পর্দা ওঠবার পর পাদপ্রদীপের সামনে কয়েকজন লোক এসে চিৎকার করে কী সব বলছিল। তাদের হাত ঘোরানো, চলে যাওয়া, দেখতে দেখতে কখন যে মায়ের বুকে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তা নিজেই বুঝতে পারিনি।
দিদি ছিল আমার চেয়ে মাত্র দু বছরের বড়ো। তারও পরিণাম ওই একই হয়েছিল।
আমরা দুই ভাইবোন যখন ঘুম থেকে উঠলাম, তখন দেখি কোথায় থিয়েটার, কোথায় বা গদি-আঁটা চেয়ার। তার বদলে আমরা শুয়ে আছি মায়ের দুধারে।
তাই আমার ওই যুক্তিতে দিদি চুপ করে গেল। খানিকটা চুপ করে থেকে বলল—‘কই তুই তো গান গাইলিনি!’
বলা বাহুল্য যাত্রা ক্লাবঘরে গানের রিহার্সাল রোজই সন্ধেবেলায় বসত। কয়েকটা গান, প্রত্যহ শুনে শুনে, একরকম মুখস্থর মতনই হয়ে গিয়েছিল, তাই চেঁচিয়ে গান ধরলাম। তাতে না ছিল সুর, না ছিল কিছু। তারস্বরে চিৎকার করে কয়েকটা লাইন মুখস্থ বলা ছাড়া আর কিছু নয়।
দিদি হয়তো এতটা আশা করেনি আমার কাছ থেকে—তাই সে বড়ো বড়ো চোখ করে কেবল আমার দিকে চেয়ে রইল।
ঠিক এমনি সময় পেছন থেকে চটিজুতোর ফটফট আওয়াজ শুনে দিদি আর আমি সচকিত হয়ে পেছনদিকে চাইলাম। দেখি বাবা আসছেন। আমি থেমে গেলাম।
বাবা কাছে এসে সস্নেহে বললেন—‘কীরে খোকা, গান গাইছিলি?’
আমি অপ্রস্তুত হয়ে গিয়ে বলি—‘না, মানে ইয়ে—‘
সস্নেহে আমার পিঠটা চাপড়ে দিয়ে বাবা বললেন—‘সামনেই সরস্বতী পুজো, সেইদিন তোমার হাতেখড়ি হবে। তারপর তোমায় ভর্তি করে দেব স্কুলে।’
দিদি অবশ্য কাছেরই একটা মেয়ে স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। আমি স্কুলে যেতাম না বলে, নিজেকে কেমন দিদির চেয়ে ছোটো ছোটো মনে হত। সেই আমি, আমার হাতেখড়ি হবে, আমি স্কুলে যাব। আনন্দের আর সীমা রইল না।
বাবা কিন্তু কথা বলে আর দাঁড়াননি, চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু হাতেখড়ি জিনিসটা যে কী তা তো বুঝে নেওয়া হয়নি। তাই ছুটে গেলাম মায়ের কাছে। জিজ্ঞেস করলাম—‘হাতেখড়ি কী জিনিস মা?’
মা বললেন—‘সরস্বতী পুজোর দিনই দেখতে পাবে।’
সরস্বতী পুজোর আগে বাবা নিয়ে এলেন আমার জন্যে একখানা ধুতি আর চাদর। অবশ্য দিদির জন্যেও একখানা ছোট্ট শাড়ি এনেছিলেন বাসন্তী রঙের।
মা আমার ধুতি আর চাদরটাকে রঙে চুপিয়ে পরতে দিলেন।
সরস্বতী পুজোর দিন নতুন ধুতি আর চাদর পরে প্রতিমার সামনে উপস্থিত হলাম। সকাল থেকেই মা খেতে বারণ করেছিলেন। বলেছিলেন—খেলে নাকি বিদ্যে হয় না। দারুণ খিদেও তখন পেয়েছিল। বড়ো বড়ো নারকোলে কুল, মাখন, মিছরি, মিষ্টি, সব কিছু সাজানো রয়েছে থালার ওপর। মা, জেঠাইমা আজ সকাল থেকেই পুজোর কাজেই লেগে রয়েছেন।
পুরোহিতমশাই আমার হাত ধরে, মাটিতে খড়ি পেতে লিখতে শেখালেন। কী যে ঘটে গেল ব্যাপারটা তা আমি নিজেও ঠিকমতো বুঝতে পারলাম না। তারপর পুজোর শেষে অঞ্জলি দেওয়া। অঞ্জলিশেষে মা বললেন—‘এবারে প্রসাদ খা খোকা।’
আমাকে, দিদিকে, আলাদা করে তিনি প্রসাদ দিলেন। কিন্তু, কতক্ষণ— আমার সেটাকে শেষ করে ফেলতে।
খাওয়া শেষ করে দেখি দিদির তখনও আদ্দেকও খাওয়া হয়নি।
প্রথমে অনুনয়-বিনয় করলাম দিদিকে, বললাম—‘সকাল থেকে কিছু খাইনি, বড্ড খিদে পেয়েছে, দে ভাই, দে, একটু ভেঙে দে।’
উত্তরে দিদি মুখঝামটা দিয়ে বলল—‘আর আমি বুঝি সকালবেলা একপেট খেয়েছি! অঞ্জলি দেব বলে আমিও যে কিছু খাইনি তা জানিস না!’
সত্যিই দিদিও সকাল থেকে কিছু খায়নি, সেটা আমার অজানা নয়। কিন্তু একটা কিছু বলতে হয়, তাই দিদিকে বলি—‘তোর কি হাতেখড়ি হয়েছে যে তোর খিদে পেয়েছে?’
দিদি বলে—‘নাইবা হ’ল!’
বুঝলাম অনুনয়-বিনয়ে কিছু হবে না। তাই দিদির চুলের মুঠি ধরে পিঠে বসিয়ে দিলাম গুম গুম করে গোটা-কতক কিল। আর তার পাত থেকে সন্দেশটা তুলে নিয়ে পালিয়ে গেলাম সেখান থেকে।
আমার হাতে মার খেয়ে দিদি ভ্যাঁ করে কান্না জুড়ে দিল।
জানতাম ওই রকমই একটা কিছু হবে। তার জন্যে তাই তৈরিই ছিলাম। মা’র কাছে ঘণ্টা দু-তিনের ভেতর না গেলেই হল। তারপর ঘটনাটা মাও ভুলে যাবে, দিদিও ভুলে যাবে। কতক্ষণ সে আর আমার সঙ্গে না কথা বলে থাকতে পারবে?
ক্লাবের ঘরে পুজো হয়েছিল। তাই এদিক সেদিক বেশ খানিকটা ঘুরে ফিরলাম বাড়ি।
আমাকে দেখতে পেয়ে দিদি বলল—‘হ্যাঁরে খোকা, এতক্ষণ ছিলি কোথায়? মা কখন থেকে খুঁজছে তোকে।’
আমি বলি—‘কেন রে দিদি?’
—‘বাঃ, খুঁজবে না? কত বেলা হয়েছে বল তো, খাবি না?’
আমি জিজ্ঞেস করি—‘তুই খেয়েছিস দিদি?’
দিদি একটু যেন আশ্চর্য হয়ে গিয়ে বললো—‘তুই খাসনি, আমি কী করে খাব?’
এই আমার সেই দিদি, যাকে খানিকক্ষণ আগে আমি মেরেছি! যার পাত থেকে আমি তারই মুখের সন্দেশ কেড়ে নিয়েছি? আর বিনিময়ে সেই দিদি আমার, আমারই জন্যে না খেয়ে অপেক্ষা করছে? বড়ো মায়া হল। দিদিকে দু হাতে জড়িয়ে ধরে বলি—‘চল ভাই, খেতে যাই।’
মনে থাকবার নয় তবু মনে আছে, কারণ এরই পরে আমার জীবনে এমন একটা ঘটনা ঘটেছিল যা আমি ভুলতে পারিনি আজও। বোধহয় ভুলতে পারবও না কোনোদিন। আর আমি তা ভুলতেও চাইনা। ভুলতে চাই না এই জন্যে, কারণ সেদিনের কথা ভুললে, বিস্মৃতির অতলতলে মিলিয়ে যাবে আমার জীবনের অনেকখানি। কারণ এরই কিছু পরে, মাত্র সাত বছর বয়সে, আমার দিদি ছেড়ে গেছে ইহলোক। মাত্র কয়েক দিনের জ্বরে সে ভুগেছিল।
সব কথা আজ পরিষ্কার মনেও নেই। তবে এইটুকু পরিষ্কার মনে আছে, দিদিকে নিয়ে মা সারাদিন বসে রইলেন।
বাবা সেদিন কাজে বেরোননি। কেবল ঘর আর বার করছিলেন।
মা’র কোলের ওপর শুয়ে দিদি মাঝে মাঝে যন্ত্রণায় কেবল বলছিল—‘উঃ, আঃ!’
ঘরের মধ্যে ঢুকে বড়ো বড়ো চোখ করে আমি তারই দিকে চেয়েছিলাম।
মা’র মুখখানা কেমন যেন থমথম করছে। সাহস করে একবার ডাকলাম—‘দিদি!’
সেই যন্ত্রণার মাঝখানেও দিদি চোখ মেলে একবার আমার দিকে চাইল। বোধহয় কী যেন বলতেও চাইল, কিন্তু বলতে পারল না। ঠোঁট দুটো তার কেঁপে কেঁপে উঠল।
ঘরের মধ্যে বাবা বসেছিলেন। আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। বললেন—‘দিদির অসুখ করেছে, ওকে ডেকে বিরক্ত কোরো না।’
আমার কেন যেন ভয় ভয় করছিল।
কেঁদে ফেলে বলি—‘বাবা, দিদি কথা বলছে না কেন? কালও তো দিদি আমার সঙ্গে কথা বলেছে।’
বাবা খানিক গম্ভীর হয়ে বললেন—‘অসুখটা আজ দিদির বেড়েছে কি না! তাই—‘
‘তাই’ যে কী তা বুঝিনি তখন। বুঝলাম খানিক বাদে, যখন দেখলাম, মা দিদির ওপর লুটিয়ে পড়ে আর্তনাদ করে উঠলেন।
আমি বিস্মিত হয়ে গিয়ে বলি—‘মা, ওকী করছ, দিদির লাগবে না!’
বাবাকে বলতে গেলাম। কিন্তু বাবারও চোখে দেখি জল। বাবাকেও বলা হল না কথাটা।
বাড়ির সকলে কাঁদল। সকলের কান্না দেখে আমিও কাঁদলাম। এরপর দিদিকে ওরা নিয়ে গেল।
আমার মনে প্রশ্ন উঠল, দিদিকে ওরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? ডাক্তারবাবুর বাড়ি?
কাঁদতে কাঁদতে সে রাত্রে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকালবেলা উঠে প্রতিটি মুহূর্তে ভেবেছি বুঝি দিদি ফিরে আসবে। কিন্তু দিদি তো ফিরল না!
এমন অবস্থা, মুখ ফুটে কাউকে কিছু জিজ্ঞাসাও করতে পারিনা।
মাকে যে জিজ্ঞাসা করব, তারও উপায় নেই কারণ আমি ঘরে ঢুকলেই মা কেবলই ‘খুকি রে’ বলে কাঁদছেন।
অনেকক্ষণ পরে প্রশ্ন করলাম, আমার চেয়ে বয়সে বড়ো আমার এক জেঠতুতো ভাইকে। জিজ্ঞেস করলাম—‘দিদি কোথায়, কবে আসবে?’
গম্ভীর হয়ে গিয়ে আমার সে দাদা বললেন—‘পুতুল আর ফিরে আসবে না।’
—‘ফিরে আসবে না? কেন?’
দাদা বললেন—‘সে মারা গেছে।’
মারা গেলে যে লোকে ফিরে আসে না তা বিশ্বাস হল না। কতবার জিজ্ঞেস করলাম—‘লোকে মরে কোথায় যায়?’
দাদা বললেন—‘ঐ আকাশে!’
তারপর কতদিন নিজের মনেই ওই আকাশের দিকে চেয়ে দিদিকে দেখবার চেষ্টা করেছিলাম।
কতবার ভেবেছি ওই তারার মধ্যে দিদির মুখ বুঝি উঁকি মারছে। অস্পষ্টভাবে দেখতেও যে পাইনি তাও নয়।
মাঝে মাঝে তাকে দেখতেও পেয়েছি। কিন্তু চোখ কচলে ভালোভাবে যেই তাকে অনুভব করতে গেছি সঙ্গে সঙ্গে সে হারিয়ে গেছে ওই আকাশের নীলের মাঝে।
আজও একা থাকলে, রাত্তিরবেলায় আকাশেরদিকে চেয়ে ভাবি—কোথায় সে আমার হারিয়ে যাওয়া বোন! মাঝে মাঝে যেন শুনতে পাই কে যেন আমায় কচি গলায় বলছে—‘তুই এখনও খাসনি, আমি খাব কী করে?’
সংসারে সবই পেলাম, কিন্তু অমন বোনের স্নেহ তো কোথাও পেলাম না!
এই কথাটাই প্রথম প্রথম ভাবতাম। কিন্তু আজ? আজ আমার দিদিকে আমি পেয়েছি বাংলাদেশের প্রতিটি মেয়ের মধ্যে।
আমার অভিনয় দেখে যখনই কোনো ভদ্রমহিলা আমাকে চিঠি লিখেছেন আমার অভিনয়ের সুখ্যাতি করে, তখনই আমি ভেবেছি, আমার দিদি যদি আজ বেঁচে থাকত, তাহলে সে আমার গৌরবে এমনিভাবেই আনন্দ প্রকাশ করত, এমনিভাবেই আমাকে জানাত অভিনন্দন।
তাই আমার মনে হয়, আমার দিদি নেই ওই আকাশে, সে আবার জন্ম নিয়েছে বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে। দেশের প্রতিটি মেয়ের মুখে ফুটে উঠেছে তার প্রতিচ্ছবি।
তাই আজ আর আমার দুঃখেরও কোনও কারণ নেই। ভ্রাতৃদ্বিতীয়ায় যখন মঙ্গলশঙ্খের সঙ্গে প্রতিবেশিনীরা ভায়ের কপালে ফোঁটা দেন তখন আমার মনে হয়, একটি নয় দুটি নয়, অগণিত চন্দনের ফোঁটা এসে পড়ছে আমার কপালে।
অগণিত ভগ্নীর দল আমার মঙ্গল কামনা করছেন ভগবানের চরণে।
যাক সে সব কথা। আমি দার্শনিক নই, উচ্চশিক্ষিতও নই। তবে লেখক হিসেবে আত্মকাহিনি লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে আমার মনের ভাবটুকু আমি বর্ণনা করেছি এইমাত্র।
আবার ফিরে যাই আমি পুরোনো কাহিনিতে।
এ সংসার কারোর জন্যেই আটকে থাকে না। নিজের গতিতে সে এগিয়ে চলে। অদ্ভুত তার যাত্রা। এর শেষ নেই, বিরাম নেই, ক্লান্তি নেই। সে চলেছে। কেবলই এগিয়ে চলেছে। ভাগ্যবিধাতার নির্দেশে কবে যে তার যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা কেবল তিনিই জানেন। মানুষ তার অর্থ কী বুঝবে? তাই সে গতির সঙ্গে তাল রেখে যে না চলতে পারে, সে পড়ে স্মৃতির পর্যায়ে।
আমাদের এই জীবনটাই দেখুন না কেন। স্মৃতি ছাড়া তো আর কিছু নেই! তাই আজকের দিন যা চলে যাচ্ছে, কালকে শত চেষ্টায়ও তাকে ফেরাতে পারা যাবে না। আজকের দিন পড়বে স্মৃতিতে।
তারই মধ্যে কোনোটা থাকবে উজ্জ্বল, কোনোটা থাকবে ম্লান হয়ে। তাই এ জীবনকে যদি আমরা স্মৃতির সমষ্টি বলি তাহলে কি ভুল হয়?
তেমনি আমার দিদির স্মৃতি আমার মনে উজ্জ্বল হয়ে রইল!
মা আবার উঠলেন, আমাদেরই মুখ চেয়ে। সংসার আবার চলতে শুরু হল আগেকারই মতন। বিশেষ কোনো পরিবর্তন দেখা দিল না।
চক্রবেড়িয়া স্কুলে বাবা আমায় ভর্তি করে দিলেন। কিন্তু লেখাপড়া করবে কে? অভিনয়ের নেশা আমার মন থেকে গেল না। অভিনয় যে আমায় করতেই হবে।
মাঝে মাঝে ভাবি—জেঠামশাইকে বলব নাকি? কিন্তু বলবার দরকার আর হল না।
আমার জীবনে অভিনয়ের সুযোগ এসে গেল। স্কুলে প্লে হবে ‘গয়াসুর’। বড়ো ছেলেরাই প্লে করবে। কিন্তু ছোটো গয়াসুর সাজবার ছেলে নেই।
দু চারজন ছেলেকে ওই পার্টের জন্য ট্রায়াল দেওয়া হল, কিন্তু কেউ পারল না। শেষকালে স্যার বিরক্ত হয়ে একদিন ক্লাসে এসে বললেন—‘তোমাদের মধ্যে এমন কি কেউ নেই, যে প্লে করতে পারে?’
কেমন যেন অপমান বোধ হল। সঙ্গে সঙ্গে বেঞ্চি ছেড়ে দাঁড়িয়ে বললাম—‘আমি করব স্যার!’
স্যার আমার দিকে চোখ রেখে বললেন—‘ইউ বয়! তোমার নামটা কী, অরুণ না? পারবে, ভয় পাবে না?’
—‘না স্যার।’
—‘বেশ এসো।’
স্যার আমায় নিয়ে গেলেন রিহার্সাল রুমে। ছোটো গয়াসুরের পার্ট দিলেন আমাকে। আমারও মনটা আনন্দে ভরে গেল একটা অভিনয়ের চান্স পেয়েছি বলে।
পার্ট মুখস্থ করতে দেরি হল না। নিয়মিত রিহার্সালে যাই।
আমাদের বাংলা শিক্ষক আমাদের অভিনয় শেখাতেন, দেখতে দেখতে অভিনয়ের দিন এগিয়ে এল।
স্কুলের প্রাঙ্গণে তক্তা ফেলে স্টেজ বাঁধা হলো। গ্রিনরুমে আমরা সবাই সাজগোজ করতে আরম্ভ করলাম। দুচারজন দর্শকও এসে জমায়েত হলেন।
গ্রিনরুম থেকে পোশাক পরে, মেক-আপ নিয়ে চলে এলাম স্টেজের ওপর।
উইংসের ফাঁক দিয়ে লক্ষ্য করলাম স্কুলের উঠোনটা। সেখানে ভরে গেছে কালো মাথায়। কেমন যেন ভয় ভয় করতে লাগল। হঠাৎ অনুভব করলাম, আমার মুখ যেন শুকিয়ে গেছে, ভীষণভাবে জলতেষ্টা পেয়েছে।
গ্রিনরুমে ফিরে গিয়ে মেক-আপ-ম্যানের সামনেই ঢক ঢক করে জল খেতে লাগলাম। মেক-আপম্যানও ‘হাঁ-হাঁ’ করে চেঁচিয়ে উঠে বলল—‘আরে, মুখের রং উঠে যাবে যে!’
অগত্যা আদ্দেকটা গেলাসের জল শেষ করে আবার গেলাম মেক-আপম্যানের কাছে, মুখের রং ঠিক করতে।
ঠিক এমনি সময় আমাদের হেডমাস্টারমশাই এসে ঢুকলেন আমাদের সাজঘরে। তিনি বললেন—‘রেডি বয়েজ, আর মাত্র দশ মিনিট সময় আছে। ইউ, অরুণ, তুমি এখনও মেক-আপ নিচ্ছ কেন? হয়নি তোমার?’
আমি কাছে সরে গিয়ে বললাম—‘কেমন যেন ভয় করছে স্যার!’
আমার পিঠে একটা চাপড় দিয়ে বললেন—‘ডোন্ট গেট নার্ভাস মাই বয়! ভয় পেও না, ভালো অভিনয় করবে তুমি; আমি দেখেছি তোমার রিহার্সাল। এই ন’বছর বয়সেই সুন্দর অভিনয় করছ তুমি।’
যথারীতি ঘণ্টা পড়ে সীন উঠল। আমিও আবির্ভূত হলাম পাদপ্রদীপের সামনে।
হেডমাস্টার মশায়ের সেই উপদেশ বাণী—‘সামনের দিকে চেও না।’
চাইলাম না সামনের দিকে। নিজের মনেই অভিনয় করে যেতে লাগলাম।
প্রথমটা একটু আড়ষ্ট লেগেছিল। কিন্তু তারপরেই আমি ভুলে গেলাম যে আমি চক্রবেড়িয়া স্কুলের ছাত্র, ভুলে গেলাম আমি অভিনয় করছি।
আমার তখন মনে হতে লাগল, আমি বুঝি কৃষ্ণভক্ত সেই ‘গয়াসুর’।
অভিনয়শেষে সীন পড়ল। হেডমাস্টারমশাই এসে পিঠ চাপড়ে বললেন—‘ওয়ান্ডারফুল! চমংকার অভিনয় করেছ তুমি।’
তখনও আমার অভিনয়ের ঘোর কাটেনি। নিজেকে তখনও ভাবছি ‘গয়াসুর’।
হেডমাস্টারমশায়ের কথায় আমার চমক ভাঙল। তা হলে আমি ‘গয়াসুর’ নই।
যা হোক, সে রাত্রে দুটো মেডেল পেলাম। মাস্টারমশাই করলেন আমাকে প্রশংসা। মুখে রং মেখেই, পেন্ট না ধুয়ে ছুটতে ছুটতে চলে এলাম গিরিশ মুখার্জি রোডে আমাদের বাড়িতে। পোশাক পরে আসবার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু আমার পার্ট শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই ড্রেসাররা সেগুলো খুলে নিয়েছে। তাই হাফপ্যান্ট আর শার্ট পরেই ছুটে এলাম মা’র কাছে।
মাকে বললাম সব কথা। অবশ্য একটু আধটু বাড়িয়েই বলেছিলাম। কারণ আনন্দ তখন আমি আর চেপে রাখতে পারছি না।
তারপরে মুখের রং তুলে, খাওয়াদাওয়া সেরে শুয়ে পড়লাম।
এরপর, স্কুলে অভিনয় হলেই সুযোগ পাই অভিনয় করবার। কিন্তু জেঠামশায়ের ক্লাবে যাত্রা করার সুযোগ তখনও হয়নি।
কিন্তু যাত্রা তো করতেই হবে আমাকে। জুড়িদের বাজনা শুনে শুনে তো একরকম মুখস্থই করে ফেলেছি। কিন্তু তেমন সুযোগ তো পাচ্ছি না।
সেবারে যাত্রা ক্লাবে ধরা হল ‘ব্রজদুলাল’। ছোটো কৃষ্ণ সাজবার লোক নেই।
বেশ কিছুদিন খোঁজাখুঁজি চলল, কিন্তু মনের মতন ছেলে পাওয়া গেল না। আবার সেবারে অভিনয় করছেন তখনকার বিখ্যাত অভিনেতা ফণী রায়৭।
তার কিছুদিন আগে ‘অন্নপূর্ণার মন্দিরে’৮ তিনি এক হাঁপানি রুগীর অভিনয় দেখিয়ে, ছবিতে দর্শকদের মন কেড়ে নিয়েছেন।
তাই আমাদের যাত্রা ক্লাবে, যদি অভিনয় খারাপ হয়, তাহলে আমাদের লজ্জার আর শেষ থাকবে না।
বোধহয় এইজন্যেই জেঠামশাই শেষপর্যন্ত রাজি হলেন আমাকে কৃষ্ণের ভূমিকায় অভিনয় করতে দিতে।
প্রায় মাস দুই রিহার্সালের পর শেষপর্যন্ত আমাদের অভিনয়ের দিন স্থির হল।
কোথায় যে সে রাত্রে অভিনয় হয়েছিল আজ আর তা মনে নেই। তবে এক বিরাট উঠোনে আমাদের সে রাত্রে অভিনয়ের আসর বসেছিল, সেটুকু মনে আছে।
আমি বাঁশি হাতে ‘কৃষ্ণ’ সেজে আসরে এলাম। দেখি চতুর্দিকে লোক। দোতলার বারান্দার ওপরে মেয়েরাও বসে দেখছেন।
শুরুতেই ছিল আমার একটা গান। ওদিকে ঢোল, কনসার্ট বেজে উঠলো, আমিও গান ধরলাম।
হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন বলল—‘ও খোকা, আমার দিকে ফেরো। আমি কি খালি তোমার—‘
আবার সেদিকে ফিরলাম। অভিনয় বেশ জমে উঠেছে। যে রাস্তাটা দিয়ে অভিনেতারা আসরে আসছেন, হঠাৎ সেদিকে চোখ পড়তে দেখি জেঠামশাই স্বয়ং দাঁড়িয়ে আমার দিকে বড়ো বড়ো চোখ করে চেয়ে আছেন।
পার্ট শেষ করে যখন আমি সাজঘরে ফিরে গেলাম তখন তিনি আমার পিঠ চাপড়ে বললেন—‘চমৎকার অভিনয় করেছিস তো!’
জেঠামশাইকে ফণীবাবু সে রাত্রে বলেছিলেন—‘তোমার ভাইপো বড়ো অভিনেতা হবে হে!’
থাক সেসব কথা।
অভিনয় যখন পুরোদমে চলছে তখন হঠাৎ বাড়ি থেকে চাকর এসে জেঠামশাইকে বললো—‘যে ছেলেটি ”কৃষ্ণ” অভিনয় করছে, তাকে গিন্নিমা ডাকছেন।’
গিন্নিমা!
জেঠামশাই আমাকে বললেন—‘ওর সঙ্গে তুমি যাও।’
আমি জিজ্ঞেস করি—‘এইভাবেই জেঠামশাই?’
জেঠামশাই বললেন—‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই ভাবেই।’
অগত্যা গেলাম বাড়ির ভেতর। একজন স্থুলাঙ্গী, সুন্দর চেহারার ভদ্রমহিলা কাছে ডেকে আমার জিজ্ঞেস করলেন—‘তোমার নাম কী খোকা?’
আমি বলি—‘অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায়।’
তিনি বললেন—‘উত্তম অভিনয় করেছ তুমি। এতো রাত হয়েছে, কিছু খেয়েছ কি?’
অভিনয়ের আনন্দেই ভুলে ছিলাম। খিদেতেষ্টার কথা মনেও ছিল না।
তিনি কিছুতেই ছাড়লেন না। জোর করে কাছে বসিয়ে আমাকে নানারকম খাবার খাওয়ালেন।
আমি যত বলি—ওদিকে অভিনয়ের দেরি হয়ে যাচ্ছে, তিনি তত বলেন—‘হোক দেরি। পাঁচ সাত মিনিটে এমন কিছু হবে না, তুমি কিছু খেয়ে নাও, অনেক রাত্তির হয়ে গেছে।’
সে রাত্রের অভিনয়ে বেশ নাম হল আমার। এদিকে অভিনয়ও করি, লেখাপড়াও বেশ সমানভাবেই চলছে। চক্রবেড়িয়া স্কুল ছেড়ে এসে ভর্তি হলাম সাউথ সুবার্বন স্কুলে। সেখান থেকে ‘৪১ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাসও করলাম। এরপর থেকেই আমার জীবনে শুরু হল আর এক নতুন অধ্যায়।
সারা বাংলাদেশের বুকে নেমে এসেছে তখন পঞ্চাশের ভয়াবহ মন্বন্তর।
সকাল থেকে কলকাতার রাস্তায় কান পাতা যায় না—”একটু ফেন দেবে মা, একটু ফেন দেবে!”
বুকের ভেতরটা আমার যেন সে ডাক শুনলে মোচড় দিয়ে উঠত। করতে পারতাম না কিছুই। এরই কিছু আগে, জাপানি বোমার ভয়ে, কলকাতা থেকে পালিয়ে গিয়েছে বহু লোক। ফিরেও এসেছেন তাঁরা সকলে। তবে বেশিরভাগই এসেছেন রোগ সঙ্গে নিয়ে। কেউবা এসেছেন সর্বস্বান্ত হয়ে।
গভর্নমেন্ট কমার্শিয়াল কলেজে ভর্তি হলাম। কিন্তু ওই, নামেই ভর্তি হওয়া। দুর্গাদাস৯, অহীনবাবু,১০ ধীরাজ ভট্টাচার্য১১ মহাশয়ের অভিনয় তখন রীতিমতো বায়োস্কোপে দেখছি। ছবিদা১২ (ছবি বিশ্বাস) তখন যথেষ্ট নাম করেছেন সিনেমায়। তাঁর অভিনয় আমায় তখন মুগ্ধ করত।
নাট্যাচার্যের১৩ অভিনয়ও শ্রীরঙ্গমে১৪ নিয়মিতভাবে দেখছি।
ছবিতে অভিনয় করার আকাঙ্ক্ষা তখন আমার মনে জেগে উঠেছে দুর্দমনীয়ভাবে। কিন্তু সুযোগ পাই না।
দু একজনকে যে বলিনি তা নয়। সকলেই ফচকে ছোঁড়ার কথা শুনে হেসেই উড়িয়ে দেয়। আবার কেউ কেউ বা বলেন, থাক যথেষ্ট হয়েছে, আর ছবিতে অভিনয় করতে হবে না।
ঠিক এমনি সময় আমার জীবনে ঘটল এমন একটা ঘটনা, যার জের আজও টেনে চলেছি।
একদিন আমাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ একটি মেয়ে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলে—‘অন্নপূর্ণা আছে বাড়িতে?’
অন্নপূর্ণা আমার জেঠতুতো বোনের নাম। একটু বিরক্ত হয়ে গিয়েই বলি—‘দেখুন না ভেতরে।’
মেয়েটি ধীরে ধীরে প্রবেশ করল আমাদের বাড়িতে। ক্ষণিক দেখাতেই সে আমার মাথা ঘুরিয়ে দিয়ে গেল। কী একটা আকর্ষণে গেলাম তার পিছু পিছু। মেয়েটি কাদের বাড়ির তা আমাকে জানতেই হবে।
বাড়ির মধ্যে ঢুকে আমার মাকেই সে প্রথম জিজ্ঞেস করল—‘অন্নপূর্ণা কোথায়?’
মা হাতের কাজ ফেলে চাইলেন তার মুখের দিকে। খানিকটা কী যেন দেখে নিলেন তার মুখের ওপর। তারপরে জিজ্ঞেস করলেন—‘তোমার নাম কী মা?’ শান্ত অথচ ধীর কণ্ঠে মেয়েটি বলল তার নাম।
মা বলেন—‘বাঃ, চমৎকার নাম তো তোমার!’
চেঁচিয়ে আমার জেঠতুতো বোনকে ডেকে দিলেন মা।
মেয়েটিকে সেখান থেকে আমার বোন নিয়ে যেতেই আমি এলাম মা’র কাছে।
মা অন্যমনস্ক হয়ে কী যেন ভাবছিলেন। আমি বলি—‘মা, ও মা, কী ভাবছ? কার সঙ্গে কথা বলছিলে এতক্ষণ?’
মা একরকম যেন চমকে উঠে বললেম—‘কে, খোকা? কী বলছিলি? মেয়েটি? আমার পুতুল বেঁচে থাকলে—আচ্ছা, ওর মুখখানা ঠিক আমার পুতুলের মতন নয়? সে বেঁচে থাকলে, এত বড়োই হত।’
৪
একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দেবার পর হঠাৎ মনে হল সামনে দীর্ঘ তিনমাস ছুটি, কী করা যায় এখন?
তাছাড়া কলকাতা তখন বেশ ফাঁকা। আড্ডা মারবার লোকও খুঁজে পাওয়া শক্ত।
আগেই বলেছি সেটা ছিল ১৯৪২ সাল। ইউরোপের যুদ্ধ তখন ঘোরতরভাবে শুরু হয়ে গেছে। যে ক’জন লোক পাড়াতে আছেন, সকালবেলা সংবাদপত্র নিয়ে তাঁদের মধ্যে বেশ খানিকটা বচসা লেগে যেত। বচসার বিষয় চিরপুরাতন—ইংরেজ জিতবে না জার্মানি জিতবে।
আমিও মাঝে মাঝে সেই তর্কে যোগ দিতুম। তারপরে জাপান যুদ্ধে নামার সঙ্গে সঙ্গেই কলকাতার লোক হল ভয়ে সারা।
বর্মায় বোমা পড়ল, আর ভয়ে পালালো কলকাতার লোক। কিন্তু সব যাবে কোথায়? ট্রেনে জায়গা নেই, গ্রামও ভর্তি। শুনেছি যাঁদের গ্রাম বা দেশ ছিল না, তাঁরা সাঁওতাল পরগনায় বা ওই ধরনের কোনো স্বাস্থ্যকর জায়গায় পরিবারের সকলকে পাঠিয়ে দিলেন। আর নিজে কলকাতায় একা থেকে চাকরি বাঁচাতে লাগলেন।
লোকজনও পাওয়া যেত না। সন্ধে হতে না হতেই ঠুঙ্গিপরা আলোগুলো কর্পোরেশনের লোকেরা জ্বেলে দিয়ে যেত। তাতে না হতো আলো, না হত কিছু। রাত্রে পাছে যদি কলকাতা আক্রান্ত হয়, তাই এ. আর পি.১৫ আর সিভিক গার্ডদের১৬ সুবিধের জন্য আলোর সঙ্গে একটা করে দড়ি বাঁধা ছিল। যাতে সময় এলেই সেটাকে টেনে নিচে থেকে নিভিয়ে দেওয়া যায়। ফলে হল কী, কর্পোরেশনের লোক আলো জ্বেলে দিয়ে গেলেই, পাড়ার ছেলেরা যারা বাইরে যেতে পারেনি, তারা দড়ি ধরে টেনে আলোগুলো দিত নিভিয়ে। রাস্তা হয়ে যেত অন্ধকার।
তাছাড়া ব্রিটিশ সরকারের ছিল কড়া শাসন—বাড়ির আলো রাস্তায় এসে পড়বে না। যদি কারো বাড়ির আলো রাস্তায় এতটুকু এসে পড়েছে, অমনি এ আর. পি. আর সিভিক গার্ড এসে প্রথমে গৃহস্থকে সাবধান করতেন আলো দেখা যাচ্ছে বলে। গৃহস্থ যদি তাতে সাবধান হতেন তো ভালো, নইলে হত ফাইন।
যতদিন পরীক্ষা হয়নি, ততদিন কোনোরকম করে সময় কেটেছে। এখন সময় কাটাই কী করে? তাই ঠিক করলাম, এবারে একটু গান শিখব।
ছেলেবয়েস থেকে পড়ায় ফাঁকি দিয়ে যাত্রাদলের কোরাস গানগুলো একদম মুখস্থ করে ফেলেছিলাম। কিন্তু তবুও, কী জানি কেন, কারোর সামনে গাইতে লজ্জা করত। ভাবতাম, আমার গলার আওয়াজ শুনে যদি কেউ হাসে? কোরাসে চলছে, চলুক না!
অনেকসময় মুখ নেড়ে গেছি, গান গাইনি। গলা দিয়ে একটা টুঁ শব্দও বার করিনি। অথচ আসরের কোনো শ্রোতা হয়তো যাত্রাশেষে বাড়ি আসবার সময় আমার পিঠ চাপড়ে বললেন—‘বাঃ, বেড়ে গান গেয়েছ তো ছোকরা!’
তাই সময় পেতেই ভাবলাম ও বিদ্যেটা একটু আয়ত্ত করে নিতে ক্ষতি কি?
তাছাড়া গান শেখার আর একটা উদ্দেশ্য ছিল। ফিল্মে অভিনয় করব এ ছিল আমার মনের তখন একটা স্বপ্ন। রুপালি পর্দার ওপর তখনকার দিনে নায়ক কে. এল. সাইগল১৭, পাহাড়ী সান্যাল১৮, এমন অনেককেই গান গাইতে দেখলাম।
এমন কি জহরদাও১৯ বাদ যাননি। তাই ভাবতাম, ভালো গান না জানলে বুঝি ছবিতে অভিনয় করা সম্ভব হবে না।
কবে গান শিখব, বা কার কাছে গান শিখব, এই প্রশ্নটাই তখন আমার মনে দিবারাত্র ঘুরে বেড়াতে লাগল।
অনেক কষ্টে সংগীতশিল্পী নিদানবন্ধু বন্দ্যোপাধ্যায়২০ মহাশয়ের কাছে গেলাম।
ভেবেছিলাম, গান যদি শিখতেই হয় তো উচ্চাঙ্গসংগীত শেখা ভালো। তাতে গলাটাও তৈরি হবে, আর যখন কেউ আমার গলা পরীক্ষা করবে তখন গিটকিরি আর তান মেরে সকলকে চমকে দেব।
হায় তখন কি জানতাম ফিল্মে গান গাইবার জন্য প্রযোজকরা কোনোদিনই আমাকে সুযোগ দেবেন না! ক্যামেরার সামনে অপরের গাওয়া গানের সঙ্গে আমার ঠোঁট নাড়াই সার হবে! আর ওই জায়গাটায় শ্রোতারা শুনবেন অন্য কোনো সুগায়কের কণ্ঠস্বর!
যাক, তখন তো আর এত কথা বুঝিনি। তাই সংগীতজ্ঞ নিদানবন্ধুর কাছে গিয়ে বললাম—‘দয়া করে আমাকে একটু গান শেখাবেন?’
আমার আপাদমস্তক ভালো করে লক্ষ্য করে নিয়ে তিনি বললেন—‘গান আগে কখনও শিখেছ কি?’
মাথা চুলকে বললাম—‘আজ্ঞে, তেমন কিছু নয়, তবে একটু একটু মানে, ইয়ে হয়েছে—মানে—‘
ভাবলুম যাত্রাদলে কোরাস গানের কথা বলব নাকি? পরক্ষণে মনে হল কোরাস গানের মধ্যে বাহাদুরি তো কিচ্ছু নেই! তাই কথাটা চেপে গিয়ে বললাম—‘আজ্ঞে, একটু আধটু উঁঃ আঁঃ করতে পারি।’
আমার দিকে চোখ রেখে তিনি বললেন—‘করো দিকিনি!’
মাথা চুলকে বললাম—‘আজ্ঞে, আমি তো হারমোনিয়াম বাজাতে জানি না।’
তিনিও ছাড়বার পাত্র নন। সামনে-রাখা একটা হারমোনিয়াম টেনে নিয়ে বলেন—‘গাও, আমি বাজাচ্ছি।’
গান শেখা যতটা সহজ ভেবেছিলাম, তার চেয়ে ঢের শক্ত বুঝি একা কারোর সামনে গান গাওয়া। কোথায় গেল আমার সেই ষাঁড়ের মতো আওয়াজ! তেষ্টায় গলা শুকিয়ে কাঠ! গলার আওয়াজ যেন বারই হতে চায় না। জিভ, তালু যেন একেবারে শুকিয়ে কাঠ! তবুও সাহস করে ধরে ফেললাম যাত্রাদলের একটা গান—‘এসো হে নন্দকিশোর’। অনেক কষ্টে গান থামলে, আমি দেখছি আমার জামা তখন ঘামে ভিজে গেছে। নিদানবাবুর মুখের দিকে চাইতে তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, চেষ্টা করলে হতে পারে। এসো তুমি আগামী শুক্রবার। দেখি কী করা যায় তোমায় নিয়ে।’
ভয়ে ভয়ে গেলাম পরের শুক্রবার। মা সরস্বতীকে প্রণাম করে তিনি বললেন—‘গান তো শিখতে এসেছ, গলা সাধতে পারবে? তোমার গলাটা সামান্য বেসুরো আছে। রীতিমতো অভ্যাস করলে ঠিক হয়ে যেতে পারে। এখন এসো, কীভাবে গলা সাধতে হয় তোমায় শিখিয়ে দিই।’
বেশ খানিকক্ষণ সময় তাঁর কাছে বসে, সা, রে, গা, মা, পা, ধা, নি, র্সা সাধা গেল এবং গলা সাধবার কয়েকটা নিয়মও তিনি শিখিয়ে দিলেন। তারপরে বললেন—‘এসো তুমি আবার পরে, গলা ঠিক হলে গান দেব। এখন নিয়মিত কেবল গলা সেধে যাও।’
শুধু গলা সাধাই নয়, তখন নিয়ম করে শরীরচর্চাও শুরু করে দিয়েছি। কারণ আমি তখনই বুঝেছিলাম, সিনেমায় ঢুকতে গেলে এ ধরনের ‘ল্যাকপ্যাকে’ চেহারা চলবে না। রীতিমতো ডন বৈঠক, এমন কি বক্সিংও শুরু করলাম। তখনকার সময় আমাকে বক্সিং শিখিয়েছিলেন শ্রীভবানী দাস। আজ অবশ্য তাঁর নাম, ‘ববি ডায়াস’। বক্সার হিসাবে নয়, ইংরেজি নাচ জানেন বলে তিনি আজ বিখ্যাত।
আমার আগামী ছবির জন্য তাঁরই কাছ থেকে ‘বলড্যান্স’ শিক্ষা করছি।
কলকাতার মানুষ আবার ফিরে এল, আবার শুরু হল মানুষের সরল জীবনযাত্রা। কলেজে পড়া ইস্তফা দিতে হল, কারণ তখন দেখা দিয়েছে সংসারে অভাব অনটন। একটা যেকোনো চাকরি আমাকে জুটিয়ে নিতেই হবে।
কিছুদিন ঘোরাঘুরি আর ধরাধরি করবার পর চাকরি আমার একটা জুটল—পোর্ট কমিশনার অফিসে ক্যাশ ডিপার্টমেন্টে।
অফিসে যাতায়াত নিত্য করছি। কিন্তু কিছুতেই আমি যা চাইছি তা পাচ্ছি না। কীসের যেন বরাবর একটা অভাব থেকে যাচ্ছে।
তখন স্বর্গীয় শিশির ভাদুড়ি মশাই শ্রীরঙ্গম আবার নতুন করে খুলেছেন। মাঝে মাঝে দেখতেও যাচ্ছি। কিন্তু কিছুতেই আমার মন আরও ভরে না।
এমনিভাবে কেটে গেল আমার জীবনের আরও তিনটি বছর। পাড়ার ক্লাবে মাঝে মাঝে থিয়েটার করি, রীতিমতো ছবিও দেখি। দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় সবেমাত্র মারা গেছেন, বাংলা ছবিতে তাঁর স্থান নিয়েছেন শ্রদ্ধেয় প্রমথেশ বড়ুয়া২১ ও শ্রদ্ধেয় ছবিদা (শ্রীছবি বিশ্বাস)।
তাঁদের অভিনয় মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। আর মনে মনে ভাবতাম—আমি কবে এমন অভিনয় করতে পারব।
দর্শকদের করতালি শুনে মনে হত, আমি কি এমন করতালিধ্বনির অধিকারী কোনোদিন হতে পারব?
যাক এমনি যখন আমার মনের অবস্থা তখন একদিন দেখা হয়ে গেল পুর্বোক্ত সেই মেয়েটির সঙ্গে। তখন তার বয়স কতই বা! চোদ্দো পনেরো হবে! গায়ের ফর্সা রং, ওই মুখ ইত্যাদি যেন আমায় আকর্ষণ করতে লাগল।
আমার জেঠতুতো বোন অন্নপূর্ণার কাছ থেকে সেদিন যেই মেয়েটি চলে গেল, ভাবলাম, লজ্জার মাথা খেয়ে তাকে একবার জিজ্ঞাসা করি ওই মেয়েটির বিষয়। কিন্তু রাজ্যের লজ্জা যেন আমায় পেয়ে বসল।
‘কী রে অন্নপূর্ণা, কী করছিস’—ওই পর্যন্ত বলেই আমার সব কথা যেন ফুরিয়ে গেল।