হত্যাকাণ্ডের আগে ও পরে – ৭

ফোন বন্ধ করে অনন্যা খাট থেকে নামল। মনটা হালকা লাগছে। এটাই ভাল হল। বরং বলা উচিত ঠিক হল। ভালবাসার কারণে ভুল মানুষকে নিয়ে জীবন কাটানো বড় কষ্টকর। দেবরূপের সঙ্গে এই ব্রেক-আপ অবশ্যম্ভাবী হয়েছিল। একেবারে কি কষ্ট হবে না? হবে বই কী। মাঝে-মাঝে মনে পড়বে। হয়তো মন খারাপ হবে, হয়তো কান্নাও পাবে। বিয়ের পরের কান্নার চেয়ে তা অনেক ভাল।

বিছানা থেকে নেমে পড়ল অনন্যা। ঘুমটা নষ্ট হয়ে গেলো। একটা বই- টই পড়লে হত। গত একমাস বইয়ের পাতা খোলেনি। সকালের খবরের কাগজটাও ভাঁজ করা অবস্থায় পড়ে থাকে। একটা সময় ছিল রাতে কিছু না পড়ে ঘুমোতে পারত না। খুব বেশি রাত হয়ে গেলে বাবা বকাবকি করত। তবে দাদা এত বেশি পড়ত যে তার দিকে বেশি নজর দেওয়ার সময় ছিল না বাবার।

অনন্যা বইয়ের তাকের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দাদার ঘরে অনেক বই আছে। বেশিরভাগই লেখাপড়ার বই। অনন্যা মনে-মনে ঠিক করেছে, বইগুলো দাদার কলেজেই দিয়ে দেবে। ছেলেমেয়েরা পড়তে পারবে। বাড়িতে পড়ে থাকা মানে নষ্ট হওয়া। একটাই সমস্যা, বাবা-মা স্মৃতি আঁকড়ে পড়ে থাকতে চাইবে। বোঝাতে হবে। সময় নিতে হবে, তাড়াহুড়োর কিছু নেই। তাক থেকে একটা বই টানতে যাওয়ার সময় দরজায় আওয়াজ হল। কেউ নক করল। চমকাল অনন্যা। এত রাতে কে? বাবা? মায়ের শরীর আরও খারাপ হল?

“কে?”

দরজার ওপাশ থেকে চাপা গলায় উত্তর এল, “আমি দোপাটি। একটু দরজা খুলবে?”

অনন্যা দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলল। গত একমাসে এই প্রথম দোপাটি তার ঘরে এল। মালব্যর ঘটনার পর থেকে সে যেটুকু সময় বাড়ি থাকে নিজের ঘরেই থাকে। প্রথম ক’দিন স্কুলে যায়নি। বাবা বারণ করেছিল। সম্ভবত বাইরে থেকে ওর মা-ও বলে পাঠিয়েছিল। তারপর থেকে সহজ ভাবে স্কুলে যেতে শুরু করে। বাড়ির সামনে রিকশা, বড় রাস্তায় গেলে স্কুল বাস। রান্নার মাসি যেটুকু যা রান্না করে তাই খেয়ে নেয়। তার ভাবভঙ্গিটা অনেকটা পেয়িং গেস্টের মতো। এই বাড়িতেই থাকে, কিন্তু বাড়ির কেউ নয়। যেদিন একটু পুজো হল, সেদিন না ডাকতেই নীচে এসে দূরে চুপ করে বসে ছিল।

অনন্যা দরজা খুলতে ভয় পাওয়া মুখে দোপাটি বলল, “ভিতরে আসব?”

“আয়। কী হয়েছে?”

দোপাটি বলল, “তোমার সঙ্গে কথা আছে অনন্যাদি। দরজাটা বন্ধ করে দাও।”

অনন্যার ক্লান্ত লাগছে। সন্ধে থেকে শুধু সবার কথা শুনতে হচ্ছে। তার কথা শোনার কি কেউ আছে? একটা সময় ভেবেছিল, একজন এসেছে। দেবরূপ৷ সে-ও ক্রমে দূরে সরে গেল। সংসারে কিছু মানুষের বেলায় এমনটাই কি হয়? শেষ পর্যন্ত তাদের সুখ, দুঃখ, কষ্ট শোনার মানুষ থাকে না?

অনন্যা দরজা বন্ধ করে দোপাটিকে চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বলল, “বস। কী হয়েছে?”

দোপাটি একটা গাঢ় নীল রঙের ম্যাক্সি পরেছে। কনুই পর্যন্ত হাতা, ঝুল পায়ের গোড়ালি ছুঁয়েছে। খোলা চুল কাঁধ আর পিঠ জুড়ে ছড়িয়ে আছে। প্রসাধনহীন মুখ নিষ্পাপ। হালকা ভয়ের ছাপ। এখনকার কিশোরীদের মতো চালাকচতুর, চটকদারি ভাব নেই। চোখ-মুখ খানিকটা ভোঁতা। তারপরেও একধরনের সৌন্দর্য টলটল করে। এই জিনিস অনন্যা আগে লক্ষ করেছে, আজ আবার করল। দাদার ঘটনার পর দোপাটির অস্তিত্ব অনেকটা মন থেকে সরে গিয়েছিল। চোখের সামনে আছে এই পর্যন্ত। আজ সন্ধেবেলা বাবা আবার মনে করিয়েছে।

দোপাটি বলল, “আমি আগে দেখে নিয়েছি ঘরে আলো জ্বলছে, তারপর নক করলাম। ভাবলাম ঘুমোওনি।”

অনন্যা খাটের উপর পা ঝুলিয়ে বসে বলল, “ঠিক আছে, এবার বল।”

দোপাটি মাথা নিচু করে আঙুলের নেলপলিশ খুঁটতে লাগল। অনন্যা বিরক্ত গলায় বলল, “তাড়াতাড়ি বল। ঘুমোব। কাল অফিস আছে।”

দোপাটি মুখ তুলে বলল, “আমার ভয় করছে অনন্যাদি৷”

অনন্যা ভুরু কোঁচকাল। এই মেয়েকে সে বিশ্বাস করে না।

“এতদিন পরে নতুন করে কীসের ভয়?”

দোপাটি কাঁপা গলায় বলল, “এতদিন কিছু হয়নি। পরশু রাত থেকে শুরু হয়েছে।”

অনন্যা এই কথায় গুরুত্ব না দিয়ে হালকা ভাবে বলল, “তোর ভয় কবে থেকে শুরু হয়েছে সেই ইতিহাস জেনে কী হবে দোপাটি? ছোট মেয়ে ভয় পেয়েছিস, ব্যস। অবশ্য তুই কতটা ছোট সে ব্যাপারে তোরও নিশ্চয়ই সংশয় আছে।”

শেষ বাক্যে যথেষ্ট শ্লেষ থাকলেও দোপাটি গায়ে মাখল না। মুখ তুলে, স্থির চোখে অনন্যার দিকে তাকিয়ে বলল, “পরশু রাতে বাথরুম করতে উঠেছিলাম, মনে হল কেউ একজন খুব কাছে রয়েছে। এত কাছে যে তার নিশ্বাসের আওয়াজও পেয়েছি। আমি আলো জ্বেলে ঘরের আনাচকানাচ দেখলাম। খাটের তলা, আলমারির পিছন। কেউ নেই। বাথরুম থেকে ফিরে এসে আলো নিভিয়ে শুলাম। তখন বুঝতে পারলাম, যে এসেছে সে ঘরের মধ্যে নেই। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।”

অনন্যার রাগ হল। মেয়েটা ভেবেছে কী! আইনের জোরে এবাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে বলে যা খুশি তাই করবে? আর সেটা মেনে নিতে হবে? মাঝরাতে ভূতের গল্প শোনাবে আর সেটা শুনতে হবে?”

অনন্যা কড়া গলায় বলল, “থাক। এসব গল্প শুনে কাজ নেই। মানুষ মারা গেলে তাকে নিয়ে এরকম বিশ্রী, গাঁজাখুরি সব গল্প ছড়ায়… আমার দাদাকে নিয়ে এধরনের গল্প শুনতে আমার ভাল লাগছে না।”

দোপাটি নিচু গলায় বলল, “উনি নন অনন্যাদি। উনি হলে তোমাকে এত রাতে বলতে আসতাম না। আমি এতে ভয় পাই না। আমার যা অবস্থা তাতে মানুষ বা ভূত কাউকে ভয় পেলেই চলবে না। উনি নন…”

অনন্যা থতমত খেয়ে গেল। মেয়েটার কথা বলার মধ্যে পাকামি যেমন আছে একধরনের আকর্ষক ক্ষমতাও আছে। তাকে এড়িয়ে থাকা কঠিন। অনন্যা অস্ফুটে বলল, “দাদা নয় তো কে?”

দোপাটি বলল, “পরশু রাতে ভেবেছিলাম, ভুল হচ্ছে। কাল স্কুল ছুটি হয়ে যায় দুটোর সময়। আমি বাড়ি ফিরে এলাম। রত্নামাসি তখনও ছিল, বাসন-টাসন গোচ্ছাছিল, আমাকে দরজা খুলে দিল। আমি উপরে গেলাম। হাত-মুখ ধুয়ে, স্কুলের পোশাক বদলে পড়তে বসলাম। দরজা একটু ফাঁক ছিল। মন দিয়ে পড়ছিলাম, হঠাৎ মনে হল, দরজার ফাঁক দিয়ে কেউ আমার উপরে লক্ষ রাখছে। আমি তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজা খুলে দেখলাম। কেউ নেই। কাল সন্ধের পর একবার ছাদে গিয়েছিলাম। মা ফোন করেছিল। পায়চারি করতে-করতে কথা বলছিলাম। একটু পরে মনে হল, ছাদের দরজার আড়াল থেকে আমাকে কেউ দেখছে। আমি ঘাড় ফেরাতেই সরে গেল। সেইটুকু সময়ের মধ্যেই আমি বুঝতে পারলাম তার হাতে বেঁটে মতো কিছু একটা ধরা।”

অনন্যা ভুরু কুঁচকে বলল, “মাকে বলেছিস?”

“না, মাকে এখন এসব বলা মানে ভয় পাইয়ে দেওয়া। মা অত দূর থেকে কী করবে? মা এমনিতেই ওখানে খুব সমস্যায় রয়েছে। যে লোকটাকে দুম করে বিয়ে করে বসেছিল সে নানারকম ভাবে জ্বালাতন শুরু করেছে। নতুন করে আর মাকে চিন্তায় ফেলতেফ চাই না। যাই হোক আমি ছাদ থেকে ঘরে এসে ঠান্ডা হয়ে ভাবলাম, অবশ্যই ভুল করেছি। মন শক্ত করতে হবে।”

অনন্যা এসব কথার কিছুই বিশ্বাস করছিল না। যে মেয়েটাকেই সে বিশ্বাস করে না, তার গল্প বিশ্বাস করার কোনও কারণ আছে কি? একেবারেই নেই। তার উপর আবার ভূতের গল্প। অন্য কেউ হলে, সাহস দিত। এমনকি নিজের ঘরে এনে শোওয়াত হয়তো। এ মেয়ের সঙ্গে সেসব আদিখ্যেতার কোনও প্রশ্ন নেই।

“বাঃ, মন যখন শক্ত করে ফেলেছিস তা হলে আর চিন্তা কী? তাহলে মুখ শুকিয়ে আছিস কেন? শক্ত মনে ভূতের ভয় জয় কর,” ব্যঙ্গের ঢংয়ে বলল অনন্যা।

দোপাটি অনন্যার চোখের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে খানিকটা ঘোরে থাকা গলায় বলল, “ভূত নয় অনন্যাদি, আজ সন্ধেবেলা তাকে আবার দেখেছি। তুমি তখনও অফিস থেকে ফেরোনি। আমি টিউশন সেরে বাড়ি এলাম। খুব খিদে পাচ্ছিল, রাস্তা থেকেই একটা রোল কিনে খেয়েছি। বাড়িতে ঢোকার সময় মুখে লঙ্কা কুচি পড়ল। আমি রান্নাঘরে গিয়ে জল খেলাম। তারপর সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলাম। সিঁড়ির আলোগুলো নেভানো। আমি জ্বালাতে-জ্বালাতে উঠছিলাম। দোতলা পেরোনোর পর হঠাৎ মনে হল, আমার পিছনে কেউ পা টিপে-টিপে উঠছে। আমি যেমন উঠছি, সে-ও তেমন উঠছে। আমি আরও কয়েক ধাপ গেলাম, তারপর মুখ ঘোরাতেই উনি পিছন ফিরে দুড়দাড় করে নেমে গেলেন। স্পষ্ট দেখলাম হাতে একটা লাঠি বা রডের মতো কিছু। উনি সেটা লোকানোর চেষ্টা করলেন।”

অনন্যার চোখ-মুখ শক্ত হয়ে গিয়েছে। হওয়ারই কথা। দোপাটি কার কথা বলছে সে আন্দাজ করতে পারছে। মেয়েটা এখনও তার সর্বনাশের খেলা থামায়নি।

অনন্যা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “তুই কার কথা বলতে চাইছিস?”

দোপাটি মাথা নামিয়ে বলল, “তুমি বুঝতে পারছ অনন্যাদি। তোমার খুব বুদ্ধি।”

মাথায় আগুন জ্বলে উঠল অনন্যার। কত বড় স্পর্ধা! কী করবে সে? উঠে গিয়ে গালে একটা চড় কষাবে? তা-ই উচিত। ঠোঁট কামড়ে অনন্যা নিজেকে সামলাল। মাথা গরম করলে এই রাতে একটা গোলমাল হবে। মেয়েটা নিশ্চয়ই গোলমাল পাকাতে এসেছে।

“তুই কী বলছিস? মা তোকে খুন করার জন্য হাতে রড নিয়ে ঘুরছে?”

দোপাটি আঙুলের নেলপলিশ খুঁটতে-খুঁটতে শান্ত ভাবে বলল, “না, খুন করতে পারবে না। ওর সে সাহস নেই। তবে আমাকে আঘাত করতে পারে।”

অনন্যা লম্বা করে শ্বাস টেনে বলল, “এটা কি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না দোপাটি?”

দোপাটি একইরকম ভাবে মাথা নামিয়ে বলল, “বাড়াবাড়ি কেন বলছ? তোমার মা আগে কি আমাকে কখনও মারেনি? হাত দিয়ে মেরেছে, এবার রড দিয়ে মারবে।”

অনন্যা এবার চাপা গলায় ধমকে উঠল, “চুপ কর। একদম চুপ কর। আর একটা কথা বললে…”

দোপাটি মুখ তুলে অবাক গলায় বলল, “আমাকে কেন বকছ অনন্যাদি! যে রড নিয়ে আমার পিছনে ঘুরছে তাকে বকো। তাকে বারণ করো।”

ধমক শোনার পরও শান্ত ভঙ্গি দেখে অনন্যা বুঝতে পারল, দোপাটি তৈরি হয়ে এসেছে। চট করে মাথা গরম করবে না।

“আমাকে বলতে এসেছিস কেন?”

দোপাটি বলল, “এবাড়িতে এখন আর কাকে বলব? মামা শোনার মতো অবস্থায় নেই। তাঁকে তো দেখি সবসময় ছটফট করছেন। ঘর-বার করেন। বাড়িতে থাকলে একটা মুহূর্ত স্থির হয়ে বসেন না। তুমি একমাত্র শান্ত মাথার মানুষ। আমার বিশ্বাস তুমি তোমার মাকে বুঝিয়ে বলবে।”

অনন্যা বলল, “মা হঠাৎ তোকে মারতে যাবে কেন?”

দোপাটি একটু ভাবল। তারপর গলা নামিয়ে সহজ ভাবে বলতে থাকে, “উনি মনে করেন, মালব্যদার মৃত্যুর ঘটনার পিছনে আমার হাত আছে। একথা উনি তোমাকে যেমন বলেছেন, বাড়িতে যিনি কাজ করতে আসেন, রান্না করতে আসেন, দুধ দেন, তাদেরও বলেছেন। দু’-একজন পাড়া প্রতিবেশী দেখা করতে এলে, তাদের শুনিয়েছেন। বলেছেন, আমি নাকি মায়ের সঙ্গে প্ল্যান করে মালব্যদাকে মেরেছি। তুমি তো জানো অনন্যাদি। তোমাকে তো উনি এই কথাগুলো বলেছেন। যেহেতু পুলিশ বাইরে থেকে ভাড়াটে খুনি আনার কথা বলেছে, আর আমার মা-ও যেহেতু বাইরে থাকে, তাই দু’য়ে-দু’য়ে চার করতে সুবিধে হয়েছে। আমি এসব শুনেও কখনও কিছু বলতে আসিনি! উড়িয়ে দিয়েছি। কিন্তু এবার উনি আমাকে ফিজিক্যালি আঘাত করতে চাইছেন।”

অনন্যা বলল, “তুই এবাড়ি থেকে চলে যাসনি কেন? তোকে তো বলা হয়েছিল? তোর মা-ও রাজি হয়েছিলেন। এসবের মধ্যে তা হলে জড়াতিস না।”

ঠোঁটের কোনায় হালকা হাসি এনে দোপাটি বলল, “আরও বেশি করে জড়াতাম। তোমার মা পুলিশকে বলতেন, খুন করে পালিয়ে গেল।”

অনন্যা বলল, “বাজে কথা বলিস না। খুনের জন্য মোটিভ লাগে। পুলিশ এসব কথা কেন বিশ্বাস করবে?”

দোপাটি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “সেটা ওঁর মাথায় নেই। আমায় খানিকটা ফাঁসাতে পারলেই হল। উনি প্রথম থেকেই চান না, আমি এবাড়িতে থাকি। একটা সময় পর তুমিও চাওনি। মামাও নন। একমাত্র মালব্যদা…”

অনন্যা অস্ফুটে বলল, “দাদা! সে এসব বিষয় কী করে জানবে! তুই আবার বানিয়ে-বানিয়ে বাজে কথা বলছিস।”

দোপাটি অনন্যার চোখের দিকে তাকাল। হাত তুলে আড়মোড়া ভাঙল। ব্রা না থাকায় বুকদুটো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। অনন্যার মনে হল, এই ক’দিনে মেয়েটা যেন শরীরে আরও খানিকটা বড় হয়েছে। দোপাটি একটু হেসে বলল, “তা হলে বানিয়ে বলছি। ওসব কথা এখন ছাড়ো অনন্যাদি। অনেক রাত হয়েছে। ঘুমোতে যাব। কাজের কথাটুকু শেষ করে নিই। আমি এখানে আশ্রয় নিইনি, নিজের অধিকারে আছি। তারপরেও আমি আর থাকতে চাই না। অনন্যাদি, তোমার দাদার খুনি ধরা পড়লেই আমি চলে যাব। আমার মা যাকে ভালবেসে বিয়ে করেছিল, সেই মানুষটার সঙ্গে মা আর বেশিদিন থাকবে না। ভালবাসা ভেঙে গিয়েছে। যাওয়ারই ছিল। মা কলকাতায় ফিরে আসবে। আবার আমরা একসঙ্গে থাকব। তুমি তোমার মাকে বুঝিয়ে বলো অনন্যাদি, উনি যেন আমাকে আর বিরক্ত না করেন।”

অনন্যা এই মেয়ের একটা কথাও বিশ্বাস করে না। সে বলল, “কিছুই বলব না। তুমি যা খুশি বানিয়ে বলে যাবে, আর তাই নিয়ে আমাকে ভাবতে হবে?”

দোপাটি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “সে তোমার ইচ্ছে। তবে আর একবারও যদি আমি দেখি ওই মহিলা আমাকে মারার তাল করছেন, আমি পুলিশের কাছে যাব। আমার বয়স এখনও আঠারো হয়নি, ফলে সব সময়ই অ্যাডভানটেজ আমার। আমি এখনও নাবালিকা,” কথা শেষ করে সামান্য হাসল সে।

অনন্যা বলল, “ভয় দেখাচ্ছিস?”

“না, সাবধান করে দিচ্ছি।”

অনন্যার কপালের দুটো পাশ দপদপ করছে। এই মেয়েটা সাঁড়াশির মতো গলা চেপে ধরছে যেন। অনন্যা বলল, “তুই কি জানিস তোর ভিতরে একটা ক্রিমিনাল মন বাস করে? জানিস তুই?”

দোপাটি দরজার দিকে খানিকটা এগিয়ে থমকে দাঁড়াল। অবহেলা ভরে বলল, “অনন্যাদি, আমি জানি। আমি সেই ক্রিমিনাল মনের সঙ্গে খেলা করতে ভালবাসি। আমি তাকে বাঁচিয়ে রাখি। আমি ভাল বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারি না গো। আমার শরীরের ভিতর জ্বালা করে।”

অনন্যার মুখ দিয়ে চট করে গালাগালি শোনা যায় না। এখন আর পারল না। নিচু গলায় বলে, “স্কাউন্ড্রেল।”

দোপাটি এই গাল গায়ে মাখে না। সে নিজের মতো বলে যেতে থাকে, “আগে এমন ছিলাম না, ধীরে-ধীরে হয়েছি। বাবা মারা যাওয়ার পর। ওই সময়ে নতুন লোকটা বাড়িতে আসা শুরু করল। আমাকে ভালবাসত, মায়ের গান ভালবাসত। অন্য প্রদেশের মানুষ, বাংলা ভাল বুঝত না, কিন্তু সুর বুঝত। আবেগ বুঝত। মানুষটা যে কত ভাল ছিল তোমাকে কী বলব অনন্যাদি! অনেক লেখাপড়াও করেছে, ইঞ্জিনিয়ার। একসময় ছবিও আঁকত। আমি তাকে বিশ্বাস করতাম। ভরসা পেতাম। ভেবেছিলাম, বাবা নেই, এই লোকটা স্নেহ মমতা নিয়ে মাথায় হাত রাখবে। একদিন এই ভাল মানুষটা আমার মাকে কেড়ে নিয়ে চলে গেল। আমার মাকেও খারাপ করে দিল। যে মা আমাকে ছাড়া এক মুহূর্ত চলতে পারত না, সেই মা নতুন লোকটার প্রেমে এমনভাবে পড়ল যে আমাকে এখানে ফেলে রেখে চলে যেতেও রাজি হয়ে গেল। আমাকে বলল, ‘ভাবিস না, ওকে বুঝিয়ে, ওর বাড়িকে বুঝিয়ে আমি তোকে নিয়ে যাব। নইলে তিনজনে আলাদা ফ্ল্যাটে থাকব। এই ক’টা দিন এখানে থাক।’ আমি চেয়েছিলাম, কোনও স্কুল বোর্ডিং-এ ঢুকে যেতে। যেমন তোমরা এখন চাও। মা বলল, ‘বোর্ডিং কেন? এখানে তো তোর থাকার জায়গা আছে। নিজের অধিকারের জায়গা। দূর সম্পর্কের হলেও আত্মীয় আছে। তারা তোর লোকাল গার্জেন হবে।’ ওই বয়সটা খুব কঠিন। বিশ্বাস ভেঙে গেলে, ভরসা ভেঙে গেলে, স্নেহ মিথ্যে মনে হলে, সব লন্ডভন্ড হয়ে যায়। আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আমাকে যেভাবে থাকতে বলবে, আমি সেভাবে থাকব। কোনও আপত্তি করব না। কোনও দুঃখ করব না। যত কষ্ট হোক মুখ বুজে থাকব। মাকে কিচ্ছু জানাব না। এই বয়সে এমন ঘটলে ছেলেমেয়েরা নেশা ভাং করে, নিজে উচ্ছন্নে যায়, নয় তো সুইসাইড করে। আমি ঠিক করেছিলাম, ভাল যা কিছু দেখব ভেঙেচুরে নষ্ট করে দিয়ে এই অবহেলা, অপমানের প্রতিশোধ নেব। তাই মুখ বুজে একটা অচেনা-অজানা বাড়িতে সুটকেস হাতে চলে এলাম।”

থামল দোপাটি। অনন্যা বিহ্বল হয়ে বসে আছে। সে নড়াচড়া করতেও পারছে না। মেয়েটা এসব কী বলছে! এ কি সত্যি? নাকি এ-ও অভিনয়? এত অভিনয় কি সম্ভব!

দোপাটি দরজার একটা পাল্লা খুলল। অনন্যার দিকে তাকিয়ে সুন্দর করে হাসল।

“এরপরে আমি বেশিক্ষণ ভাল সহ্য করতে পারি? তুমি হলে পারতে? যাকে ভাল দেখি, তাকেই দুমড়ে দিতে ইচ্ছে করে। তোমার দাদাকে পারিনি।”

অনন্যা কিছু একটা বলতে চাইল। পারল না।

দোপাটি বিড়বিড় করে বলল, “চেষ্টা করেছিলাম। শক্ত মানুষ বলে শক্ত ভাবে চেষ্টা করেছিলাম। ভেবেছিলাম, প্রথমবার যখন পারিনি খেলাটা জমবে। আবার চেষ্টা করব। সুযোগ পেলাম না। মানুষটাকে খুব বিচ্ছিরিভাবে মরতে হল। খুব দুঃখের। আচ্ছা, আজ চলি, গুড নাইট। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।”

খাট থেকেই ঝাঁপিয়ে পড়ল অনন্যা। দোপাটির কাঁধদুটো চেপে ধরে কাঁপতে-কাঁপতে বলল, “বল দাদার সঙ্গে কী করেছিলি… বল আগে… যতক্ষণ না বলবি তোকে ছাড়ব না… তোকে মেরে ফেলব…” বলতে বলতে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল অনন্যা। এত চাপ সে আর নিজের ভিতরে ধরে রাখতে পারল না।

দোপাটি তাকে জড়িয়ে ধরে। খাটে এনে বসায়। পাশে বসে বলে, “তুমি শান্ত হও, শান্ত হও। সব বলছি। তুমি খুশি হবে। এই দাদার জন্য গর্ব হবে তোমার।”

অনন্যা মুখে হাত চাপা দিয়ে কাঁদতে থাকে। তার শরীর কেঁপে-কেঁপে ওঠে। দোপাটি তার মাথায়, পিঠে হাত বোলায়। গাঢ় স্বরে বলে, “সব শুনে তুমি আমাকে আরও ঘেন্না করবে অনন্যাদি। করলে করবে। এতে আমার নতুন করে কিছু যাবে আসবে না। আমি ঠিক করেছি, মা যেদিন ফিরে আসবে, আমিও তোমার মতো হাউমাউ করে কাঁদব। মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদব। ভাল ভেবেছি না?”

দোপাটি অনন্যার চিবুক ধরে জোর করে তোলার চেষ্টা করে।

“প্লিজ মুখ তোলো অনন্যাদি। অন্তত একবারের জন্য সব রাগ, সব ঘেন্না ভুলে বলো,‘হ্যাঁ, তুই ভাল করবি দোপাটি। তুই ঠিক করবি।’”

মেয়েটিকে সুন্দর এবং শান্ত দেখতে। বয়স অনন্যার মতোই। সামান্য কম বেশি হতে পারে। আকাশি রঙের শাড়ির সঙ্গে ম্যাচ করা রঙের লম্বা হাতা জামা। তবে রং পুরোপুরি ম্যাচ করেছে এমন নয়। কপালে ছোট্ট একটা টিপ ছাড়া মেকআপের কোনও বালাই নেই। মুখটা বিষণ্ণ। বিষণ্ণ বলেই বোধহয় বেশি শান্ত লাগছে।

অনন্যা বলল, “আপনি দাদাকে কতদিন চিনতেন?”

“বেশি দিন নয়। একবছরের একটু বেশি।”

অনন্যা বলল, “আপনাদের কি অনেকবার দেখা হয়েছিল?”

“না। মোট তিনবার। তারপর আমি একদিন ওঁকে টেলিফোন করি। দেখা করতে চাই। উনি বারণ করেন।”

অনন্যার অস্বস্তি হল। প্রশ্নটা বোধহয় বেশি ব্যক্তিগত হয়ে গেল। পরিস্থিতি সহজ করার জন্য অনন্যা সামান্য হাসতে চেষ্টা করল। বলল, “দাদা এরকমই ছিল। নিশ্চয়ই সেই সময় কোনও বই পড়ছিল। বই হাতে নিলে জগৎ সংসার সব ভুলে যেত। সেইছোটোবেলাথেকে আমাদেরই ঘরে ঢুকতে দিত না। ঢুকলে বের করে দিত।”

“এটা সেরকম বারণ নয়। আপনার দাদা পাকাপাকি ভাবে দেখা করতে বারণ করে দিয়েছিলেন।”

অনন্যা একটু থতমত খেয়ে বলল, “ও… আপনি চা-টা খান। ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”

লাঞ্চের ঠিক পরে নন্দ টেবিলের সামনে এসে গলা নামিয়ে জানাল একজন দেখা করতে এসেছে। অফিসে অনন্যার সঙ্গে দেখা করতে আসা লোকের সংখ্যা খুবই কম। দেবরূপ এলে বাইরে থেকে মোবাইলে টেক্সট পাঠায়, ‘রিচ্‌ড’। বছরখানেক আগে কোনও এক নেমন্তন্নবাড়িতে যাওয়ার জন্য বাবা-মা এসে গাড়িতে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। আগে থেকে জানা ছিল। একবার হঠাৎ এসে হাজির হয়েছিল, সুচয়ন। ইউনিভার্সিটিতে একসঙ্গে পড়েছে। যে সামান্য ক’টা ছেলেকে অনন্যা সহ্য করতে পারত, সুচয়ন ছিল তাদের একজন। তা বলে সেই ছেলে এতদিন পরে একেবারে অফিসে এসে হাজির হবে ভাবতেই পারেনি। প্রথমে তো চিনতেই পারেনি। শরীর ভেঙে গিয়েছে। তারপর একমুখ দাড়ি। এক ঝলক দেখে চিনবে কী করে? অবশ্য মনে পড়তে বিশেষ দেরি হয়নি। সুচয়ন এসেছিল কাজের সন্ধানে। যে অফিসে কাজ করত, সেটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তারপর হন্যে হয়ে কাজ খুঁজছে।

অনন্যা বলল, “আমার কাছে চাকরি! তুই কি পাগল হয়েছিস সুচয়ন?”

সুচয়ন বলেছিল, “তা খানিকটা হয়েছি বলতে পারিস। আগে একটা ডেটা বেস তৈরি করেছি। পরিচিত কে কোথায় কাজ করে, ব্যবসা করে। তারপর তাদের কাছে গিয়ে ধরনা দিচ্ছি। পরিচিত ছাড়া কাজ পাওয়া অসম্ভব।”

অনন্যা হেসে বলেছিল, “এসেছিস ভাল করেছিস। চা খেয়ে যা, কিন্তু তোর ওই ডেটা বেস থেকে আমার নাম বাদ রাখ।”

সুচয়ন বলেছিল, “চাপ নিস না। একটা সিভি দিয়ে যাচ্ছি। কেউ যদি কাজকর্ম হারানো অল্প পয়সায় মানুষের খোঁজ করে তখন ফট করে ধরিয়ে দিবি। আজ আর চা খাব না। আরও সাতজনের কাছে যাব।”

এর বেশি কেউ অফিসে উপস্থিত হয় না। তাই নন্দ যখন এসে বলল, ‘একজন এসেছে’, একটু অবাকই হল অনন্যা। সামান্য বিরক্তও। এখন আর নতুন করে কারও সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগে না। তা ছাড়া সেলসের কেউ হতে পারে। কারও রেফারেন্সে জিনিস বা ইনশিয়োরেন্সের পলিসি বিক্রি করতে এসেছে হয়তো। নীচে ভিজ়িটরস লাউঞ্জে যেতে শান্ত দেখতে মেয়েটি এগিয়ে এসে হাতজোড় করে প্রণাম করল।

“নমস্কার, আমার নাম বিধুরা। বিধুরা মৈত্র। আপনি আমাকে চেনেন না।”

অনন্যা খানিকটা ব্যস্ততার ভঙ্গিতে বলল, “বলুন কী বিষয়।”

বিধুরা একটু গলা নামিয়ে বলল, “আমি মালব্যবাবুর পরিচিত ছিলাম।”

অনন্যা এবার একটু থমকাল। দাদার পরিচিত যখন, ব্যবহার অন্যরকম করতে হবে। কৌতূহলও হল। দাদার পরিচিত সুন্দরী! দাদার পরিচিত মেয়ে মানে তো শুধু ছাত্রী। এ মেয়ে ছাত্রী নয়। ছাত্রী হলে ‘মালব্যবাবু’ সম্বোধন করত না। ‘স্যার’ ডাকত।

অনন্যা এবার নরম গলায় বলল, “বলুন।”

বিধুরা একটু চুপ করে থেকে ছাড়া-ছাড়া ভাবে বলল, “আমি ঘটনাটা কিছুদিন পরে শুনেছি। এত শকিং যে আমি কীভাবে রিঅ্যাক্ট করব বুঝতে পারছিলাম না… উনি এমন একজন দেবতার মতো মানুষ ছিলেন… তাঁর যে এমন একটা… আমার বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হয়েছে… ইন ফ্যাক্ট এখনও হয়নি। আমার মনে হয়েছিল, আপনাদের সঙ্গে একবার দেখা করি। একটু পাশে গিয়ে দাঁড়াই… কিন্তু আমার কাছে কোনও ঠিকানা ছিল না। শুধু ওঁর কলেজটা চিনি। অনেক কষ্ট করে আপনার অফিসের হদিশ পেয়েছি। খুব দুঃখিত, ব্যস্ত সময়ে আপনাকে…”

মেয়েটির কথা এবং কথা বলার ভঙ্গি ভাল লাগল অনন্যার। দাদার প্রতি একধরনের মুগ্ধতা রয়েছে। সে বলল, “বিধুরা, আপনি কি আমার সঙ্গে এক কাপ চা খাবেন? তাহলে ক্যান্টিনে বসে একটু কথা বলতে পারি।”

বিধুরা কুণ্ঠিত ভঙ্গিতে বলল, “আপনার কাজে ব্যাঘাত ঘটবে।”

অনন্যা একটু হেসে বলল, “আপনার সঙ্গে এক কাপ চা খাওয়ার সময়টুকু আমার আছে।”

অফিসের ক্যান্টিন এই সময়টা একেবারে ফাঁকা থাকে। দুটো চা নিয়ে কোণের একটা টেবিলে বসেছে অনন্যারা। বিধুরা বলল, “আমি একটা স্কুলে পড়াই। অঙ্কের শিক্ষিকা।”

অনন্যা বলল, “বাঃ। খুব ভাল।”

বিধুরা বলল, ‘“বাঃ’ বলার মতো কিছু নেই৷ খুব ইচ্ছে ছিল কলেজে পড়াব। সেই মতো নিজেকে প্রস্তুতও করেছিলাম। সুযোগ হল না।”

অনন্যা বলল, “সময় তো আছে, চেষ্টা করুন।”

বিধুরা বলল, “আপনার দাদা কিন্তু আমাকে উলটো বলেছিলেন।”

অনন্যা কৌতূহল নিয়ে বলল, “তাই নাকি! কীরকম উলটো?”

বিধুরা চা বিশেষ খাচ্ছে না। কাপ নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। অনন্যা এবার খেয়াল করল, দাদার প্রসঙ্গ এলে মেয়েটার টানা-টানা উজ্জ্বল চোখদুটোতে যেন ছায়া পড়ছে।

“মালব্যবাবু আমাকে বলেছিলেন, আপনি স্কুলেই থাকুন। আমাদের দেশে ছোট ছেলেমেয়েদের গণিতভীতি প্রবল। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাবজেক্টটি সম্পর্কে এই ভীতি খুবই দুর্ভাগ্যজনক। এই ভীতি কাটানোর জন্য আমাদের যা করা উচিত তা আমরা করি না। একমাত্র স্কুলেই এই কাজ সম্ভব। সেখানেই ছোট ছেলেমেয়েদের মন থেকে ভয় দূর করে অঙ্কের প্রতি ভালবাসা তৈরি করা যায়। আপনাদের হাতে খুব বড় দায়িত্ব। এই দায়িত্ব কখনও ত্যাগ করবেন না।”

অনন্যার ভাল লাগছে। রোজই এক-এক ভাবে মালব্য বসু তার সামনে উন্মোচিত হচ্ছে। নিজে ছোট বোন হয়ে, এত বছর কাছে থেকেও মানুষটাকে পুরো চিনতে পারেনি। অতিরিক্ত ভালমানুষদের বেলায় এরকমটাই হয়। কাছে থাকলেও তাদের সবটা স্পর্শ করা যায় না। কিছুটা অচেনা থেকেই যায়। কাল দোপাটি যে ঘটনা বলেছে সেটা শুনে অনন্যা চমকে উঠলেও শেষ পর্যন্ত মনে হয়েছিল, দাদাকে এমনটাই মানায়। অথচ বাইরে থেকে কেউ ঘটনাটা জানলে পুরো উলটো ভাববে। ভাববে, একটা নোংরা মানুষ। এক নিষ্পাপ কিশোরীকে…

অনন্যা কান্না থামিয়ে মুখ তুললে দোপাটি একটানা বলে যেতে থাকে।

“একদিন মালব্যদা আমাকে বলল, ‘এই মেয়ে, তুমি আমার সঙ্গে দেখা করো তো।’ আমি উৎসাহ নিয়ে বললাম, ‘এখন যাব?’

“মালব্যদা বলল, ‘না, এখন নয়। এখন আমি পরীক্ষার খাতা চেক করছি। তুমি সন্ধের পর আসতে পারবে?’

“আমি বললাম, ‘খুব পারব।’ আমার আগ্রহ বাড়ছিল। যে মানুষটা বাড়ির কারও সঙ্গেই তেমন কথা বলে না, এতদিনে আমার সঙ্গে দশটা কথাও বলেছে কিনা সন্দেহ, সে আমাকে ডাকে কেন? আমার ভিতরের ক্রিমিনাল মন আমাকে জিজ্ঞেস করল, “হ্যাঁ রে দোপাটি, এই প্রফেসরকে আজ গোলমালে ফেললে কেমন হয়?

“আমি বললাম, ‘খুব ভাল হয়। এই ভাল ছেলের দিকে আমার অনেকদিন নজর আছে। এত ভাল দেখে আমার গা চিড়বিড় করে। কিন্তু কিছু করার সুযোগ পাই না। সাহসও হয় না। খুব গম্ভীর। আজ যদি চান্স মেলে মানুষটাকে খানিকটা ঘেঁটে দিতে পারলে খুশি হব। মামির মারধরের প্রতিশোধ নেওয়া হবে। যদি সেরকম বুঝি, চিৎকার চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় তুলব। প্রফেসরের মা এসে দেখবে, তার গুণধর ছেলে আমাকে কী করেছে।’ ভাল প্ল্যান, না? আমার ক্রিমিনাল মন বলল, ‘খুব ভাল প্ল্যান। একেবারে ডবল ভাল। গুড বয়কে চটকে দেওয়া যাবে, আবার এবাড়ির গিন্নিমার উপর জমিয়ে বলা হবে।’ কেচ্ছা কেলেঙ্কারির মতো জিনিস হয় না। সত্যি মিথ্যে যা-ই হোক ভদ্রলোকের মুখ শুকিয়ে আমসি হয়ে যায়। গুড বয় এক নিমেষে ব্যাড বয় হয়ে যাবে। কেলেঙ্কারিতে আশ্রিতা কিশোরী জড়িত হলে ভেরি ব্যাড বয়।

“অনন্যাদি, তুমি নিশ্চয়ই এই পর্যন্ত শুনে আমার উপর খেপে যাচ্ছ? যত খুশি রাগ করো। যত আমার উপর রাগ বাড়বে, তত… যাক। সেদিন নিজের ঘরে গিয়ে আমি তৈরি হলাম। আলমারি ঘেঁটে ড্রেস বের করলাম। আঁটোসাটো জামা। হাঁটুর কাছেই শেষ। বছরখানেক আগে পরতাম, এখন আর পরা যায় না। শরীর ফেটে বেরিয়ে আসে। বয়স কম হলেও পুরুষমানুষকে কীভাবে গোলমালে ফেলতে হয় তার কিছুটা আমার জানা আছে। সেই চেষ্টাই করছিলাম। যা-ই হোক, সন্ধের পর সেজেগুজে মালব্যদার ঘরে গেলাম। মালব্যদা টেবিলে বসে মাথা নামিয়ে কিছু লিখছিল। আমি দরজা নক করে ঘরে ঢুকতে মুখ তুলল। আমি ইচ্ছে করেই আরও খানিকটা ঢুকে গেলাম। যাতে আমায় ভাল করে দেখতে পায়। মালব্যদা বলল, ‘ও, তুমি এসে গিয়েছ? কিন্তু এখন তো একটা নোট্‌স তৈরি করছি। এটা শেষ করতেই হবে। এক কাজ করো দোপাটি, তুমি কি বেশি রাতের দিকে আসতে পারবে?’

“বেশি রাতের কথা শুনে আমি বেশি খুশি হলাম। বড় করে ঘাড় কাত করলাম। মালব্যদা বলল, ‘তা হলে তাই এসো। রাত যত বেশি হয় তত ভাল। সবচেয়ে ভাল হয়, বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর এলে।’

“আমার বুকের ভিতর ধড়াস করে ওঠে। আমি ইঙ্গিত স্পষ্ট বুঝতে পারলাম। বুঝতে পারলাম, গুড বয় আমাকে এই অবস্থায় দেখেই পা পিছলেছে। বেশি রাতে তার অবস্থা তো ভয়ংকর করে দেব। ভালমানুষের মতো মুখ করে বললাম, ‘মালব্যদা, আমি যদি তখন আমার সায়েন্সের বইটা নিয়ে আসি আপনি কি আমাকে একটু বুঝিয়ে দেবেন?’

“অনন্যাদি, তোমার দাদা খুশি হয়ে বললেন, “অবশ্যই এনো। বোঝাতে পারব কিনা জানি না, তবে বই দেখতে আমার সব সময় ভাল লাগে।’

“রাত একটা নাগাদ পা টিপে টিপে নেমে আসি৷ নাইটির উপর একটা গাউন মতো পরেছিলাম। অনন্যাদি, আমার ভয় ছিল তোমাকে। ঘরটা পাশেই কিনা। দেখলাম তোমার দরজা শক্ত করে বন্ধ। ফাঁকফোকরে আলো নেই। তার মানে তুমি ঘুমোচ্ছ। নিশ্চিন্ত হলাম। মালব্যদা তখনও টেবিলে বসে বই উলটোচ্ছে। আমাকে টেবিলের পাশে রাখা মোড়ায় বসতে বলে। বই উলটে দেখে। দু’-একটা প্রশ্ন করে। তারপর সরাসরি জিজ্ঞেস করে, ‘দোপাটি, তুমি নাকি ভালমানুষ পছন্দ করো না। তাদের খারাপ করতে চাও? এটা কি সত্যি?’

“আমি এই প্রশ্নের জন্য তৈরি ছিলাম না। একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাই। প্রফেসরকে এই নালিশ কে করল? বাইরের কেউ? স্কুলের টিচার? নাকি তার মা? যেই করুক, আমি বুঝলাম, লুকিয়ে লাভ নেই। বললাম, ‘হ্যাঁ, তা-ই। যাদের সবাই ভাল বলে তাদের আমি বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারি না।’

“মালব্যদা হেসে বলল, ‘কেন? তারা তোমার ক্ষতি করে?’

“আমি বললাম, ‘না, সবসময় তা করে না।’

“মালব্যদা হাসিমুখে বলল, ‘তবে কি তুমি তাদের হিংসা করো?’

“আমি বললাম, ‘খানিকটা। আপনি আমাকে জেরা করছেন কেন?’

“মালব্যদা আবার হেসে বললেন, ‘ঘটনাটা শোনার পর থেকে তোমাকে আমার খুব ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে দোপাটি। আমি দু’-একটা সাইকোলজির বই ঘেঁটে নিলাম। বয়ঃসন্ধিক্ষণের মনস্তত্ত্ব। ছেলেমেয়েদের অ্যাডোলেসেন্স পিরিয়ডের সমস্যা নিয়ে অনেক বড়-বড় মনোবিদ কাজ করেছেন। তুমি যে বয়সটার মধ্যে দিয়ে চলেছ আর কী… তোমার বয়স কত? ষোলো? নাকি সতেরো? যাই হোক, আরও বছরখানেক তুমি বয়ঃসন্ধির মধ্য দিয়েই চলবে। খুব জটিল সময়। বিখ্যাত মনোবিদ জ়্যঁ পিয়াজ়ে এই সময়টাকে কী বলেছেন জানো? বলেছেন, এটা হচ্ছে সেই বয়স যখন বস্তুজগত থেকে মানুষ বিমূর্ত জগতে প্রবেশ করে। এতদিন পর্যন্ত একটা ছেলে বা মেয়ে জানত দুইয়ের সঙ্গে দুই যোগ করলে শুধু চার হয়। এই বয়সে পৌঁছে সে শিখল, শুধু চার নয়, দুই আর দুই যোগ করলে পাঁচও হয়। এই অতিরিক্ত ‘এক’-কে নিয়ে যত যন্ত্রণা। কখনও এই এক মানুষকে সৃষ্টিশীল করে, কখনও বানায় ধ্বংসাত্মক।’

“আমি বললাম, আমি কি তবে ধ্বংসাত্মক?’

“মালব্যদা নরম গলায় বললেন, ‘সেটা তো মনোবিদরা বলতে পারবেন দোপাটি।’

“ওঁর কথায় আমার খুব মজা লাগল। খুব বিনয়ের সঙ্গে বললাম, ‘আমি কি একজন মনোবিদের কাছে যাব?’

“মালব্যদা এ প্রশ্নের উত্তর দেননি। একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘তুমি কীভাবে ভালমানুষকে খারাপ করো দোপাটি?’

“এবার আমি একটু ঘাবড়ে গেলাম। আমি যতই চালাকি করি, উনি তো অনেক বেশি বুদ্ধিমান। কিন্তু আমার ভিতরের ক্রিমিনাল মন ছেড়ে কথা বলার পাত্রী নয়। সে আমাকে সাহস জোগাল। আমি বললাম, ‘নানারকম ভাবে পারি মালব্যদা। মানুষ আসলে খারাপ হওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকে। একটু সুযোগ পেলেই হল।’

“আমার কথা শুনে পণ্ডিত মানুষ কুপাকোৎ। চোখ বড় করে বললেন, ‘বাঃ, এই বয়সে তুমি তো খুব চমৎকার কথা বলতে পারো। ভাবনাচিন্তার মধ্যে ফেলে দাও।’

“আমি দেখলাম আর সময় নষ্ট করে লাভ নেই। এই সুযোগ আর কবে পাব জানি না। বললাম, ‘আমি শুধু কথা বলতে পারি না, কাজেও পারি’, বলে খুব সহজ ভাবে নাইটির উপর পরা গাউনটা খুলে ফেললাম। বললাম, ‘আপনার ঘরটা কিন্তু খুব গরম। সারাক্ষণ লেখাপড়া করেন বলে ঠান্ডা গরমে মন নেই।’ মালব্যদা আমার আধখানা খোলা শরীরের দিকে না তাকিয়ে খুব মন দিয়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। খুব রেগে যাচ্ছ তো অনন্যাদি? প্লিজ় আর একটু অপেক্ষা করো। এই নাইটি আমার গরমকালের। মায়ের সঙ্গে গিয়ে পছন্দ করে কিনেছিলাম। যতই আমার এবাড়িতে থাকার অধিকার থাকুক, তোমরা তো আমাকে ছাদের ঘরে তুলে দিয়েছ। গরমের সময় খুব গরম হয়। মনে হয় খালি গায়ে থাকি। এই নাইটি খালি গায়ে থাকার মতোই।

“এরপর মালব্যদা চোখ সরিয়ে বলল, ‘তুমি কি আমাকেও নষ্ট করতে পারবে?’

“আমি বললাম, ‘ছি ছি। আপনাকে নষ্ট করতে যাব কেন?’ কথা শেষ করে আমি মোড়া থেকে উঠে পড়ি, তোমার দাদার কাছে এগিয়ে যাই। টেবিলে রাখা আমার পড়ার বইটা এগিয়ে দিই। নিচু গলায় বলি, ‘আমাকে একটু পড়া বুঝিয়ে দেবেন?’

মালব্যদা মনে হল মজা পেয়েছেন। একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘এত রাতে পড়া না হয় না-ই বা বুঝলে।’ আমি আবার চাপা আওয়াজ করে হাসলাম। অনন্যাদি, এই হাসিতে ভালমানুষকে নষ্ট করার ডাক থাকে। বললাম, ‘আমার সৌভাগ্য। আপনি যদি আবার আমাকে পড়ান তা হলে আবার একদিন… আমাকে আপনার কেমন লাগল? ছাত্রী হিসেবে ভাল না…?’

“উনি বললেন, ‘অবশ্যই ভাল। ভাল ছাত্রছাত্রী হওয়ার মূল কথা শুধু পরীক্ষায় বেশি নম্বর পাওয়া নয়, নিজের মতো ভাবতে পারাটাও। তুমি নিজের মতো ভাবতেও পার। তবে তোমার ভাবনাগুলো এলোমেলো। অন্যদেরও তুমি এলোমেলো করে দিতে চাও। কিন্তু সব মানুষ যে এলোমেলো হয় না দোপাটি।’

“আমার এবার সন্দেহ হল। বুঝতে পারলাম, কঠিন জায়গায় এসে পড়েছি। মানুষটার চোখে কোনও লোভ নেই। বিস্ময় আছে। যেন বইয়ের পাতা থেকে, গবেষণার খাতা থেকে উঠে আসা কোনও চরিত্র আমি। অনন্যাদি, বুঝতে পারলাম তোমার দাদার জন্য আমাকে আরও কঠিন হতে হবে। ফিসফিস করে বললাম, ‘ভালদের মধ্যে অনেক মিথ্যে থাকে। একটা টোকা দিলেই সেই মিথ্যে ঝরে পড়ে।’

“মালব্যদা এ কথায় পাত্তা না দিয়ে বললেন, ‘দোপাটি, তোমার খুব বুদ্ধি। বয়সের তুলনায় বেশি। কিন্তু কোনও কারণে বুদ্ধির একটা অংশ জট পাকিয়ে গিয়েছে। তার পিছনে নানা কারণ থাকতে পারে। রাগ, অভিমান, অবহেলা। বয়সটা খুব জটিল যে। আসলে তোমার চিকিৎসা দরকার। আমি তোমার বুদ্ধিতে খুশি হয়েছি। এবার তোমাকে চিকিৎসাতেও সাহায্য করব। তোমার মায়ের সঙ্গে কথা বলব। তুমি রাজি তো?’

“অনন্যাদি, আমি থমকে গেলাম। ভেবেছিলাম এক আচরণ দেখব, পেলাম সম্পূর্ণ উলটো! অচেনা একটা মানুষ আমাকে এত স্নেহ করে ফেলল! আমি কী বলব, কী করব বুঝতে পারছি না। ঘর নিস্তব্ধ। জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছি চুপ করে। আর তখনই বাইরে হালকা পায়ের আওয়াজ পেলাম। সিঁড়ি দিয়ে কেউ উঠছে। হাতের চুড়ির অল্প আওয়াজ হল। যেমন হয়। আমার ক্রিমিনাল মন যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ভিতরে। বলল, ‘মালব্যদার মা আসছে, তুমি আর দেরি কোরো না। আরও এগিয়ে যাও। যদি না পার অন্তত ভান করো।’ অনন্যাদি, আমি ঘোরের মধ্যে ঢুকে পড়লাম যেন। ফিসফিসিয়ে তোমার দাদাকে বললাম, ‘অবশ্যই আপনাকে সাহায্য করব। কিন্তু আপনি কি আমাকে একটু সাহায্য করবেন? আমার এই নাইটিটা একটু খুলে দেবেন প্লিজ?’ বলতে-বলতে আমি আর দেরি করিনি। নিজেই জামাটা খুলে ফেলি। নগ্ন হয়ে দাঁড়াই তোমার দাদার মুখোমুখি। মালব্যদা উঠে দাঁড়ান। একটু এগিয়ে সপাটে একটা চড় মারেন। এই দেখো, গালে এখনও বুঝি হালকা দাগ আছে। মানুষ এই সময় অগ্নিমূর্তি হয়ে থাকে। তোমার দাদা শান্ত গলায় বললেন, ‘সরি দোপাটি। কিছু মনে কোরো না। এই মুহূর্তে এটা তোমার জন্য প্রয়োজন ছিল। আমার জন্যেও। চিন্তা কোরো না, সব ঠিক হয়ে যাবে। এবার তুমি যাও।’ তোমার দাদার প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তিতে আমার মন ভরে যায়। এত ভাল মানুষও আছে! অসম্ভব, এত ভাল আমার পক্ষে সহ্য করা অসম্ভব। তাই শেষ চালটা খেলি। কিছু না পরে, জামা হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসি ঘর থেকে। আমি নিশ্চিত ছিলাম, তোমার মা বাইরে কোথাও আছেন। অন্ধকারে ঘাপটি দিয়ে। উনি দেখুন, ওই রাতে ছেলের ঘর থেকে আমি বেরোচ্ছি… আমার মজা লাগে। আমি গুনগুন করে গানও গাই। সিঁড়ির মুখে এসে থমকে দাঁড়াই, নীচের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসিও। গালে চড়ের জ্বালা নিয়ে এমন নিখুঁত অভিনয় কেউ পারত?

“মজার কথা কী জানো অনন্যাদি, আমি নিশ্চিত তোমার ভালমানুষ মাকেও আমি নষ্ট করে দিতে পেরেছি। উনি তখন নিজের ছেলেকেও বিশ্বাস করতে পারেননি। আর তাই আমাকে মারার জন্য পিছন-পিছন ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এটাও তো একরকম নষ্ট হওয়া, তাই না?”

এত পর্যন্ত বলে অনন্যাকে স্তব্ধ করে উঠে পড়েছিল দোপাটি। শুকনো হেসে মৃদু গলায় বলেছিল, “নষ্ট হয়ে গিয়েছি আমি নিজেও। তোমার দাদা নষ্ট করে দিয়ে গেলেন, ডাক্তার লাগল না। অল্প স্নেহতেই হয়ে গেল। মানুষ খারাপ করার যে ভাল গুণ নিয়ে ছিলাম এতদিন, সেটা হারিয়ে ফেলেছি। ক্রিমিনাল মনটাকে পাওয়ার জন্য অনেক হাতড়াই, পাই না। চলি, গুড নাইট। তুমি কিন্তু তোমার মাকে বলে দিয়ো।” দোপাটি চলে যাওয়ার পর অনন্যা চুপ করে বসে থাকে দীর্ঘক্ষণ।

বিধুরা ব্যাগ থেকে একটা বই বের করে। বলে, “মালব্যবাবুর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল একটা সেমিনারে। ফরাসি গণিতজ্ঞ ব্লেইস পাস্কালের উপর বলতে এসেছিলেন ওদেশেরই এক অধ্যাপক। খুবই জটিল আলোচনা। আমি প্রায় কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আপনার দাদা ওখানে দু’-একটা প্রশ্নও করলেন। পরে চা খাওয়ার সময় আলাপ হল। উনি খুব সহজ করে আমাকে ‘পাস্কাল ট্রায়াঙ্গ্যাল’-এর মূল কথাটা বোঝালেন। আমি ওঁর টেলিফোন নম্বর চাইলাম,” একটু থামল বিধুরা। মনে হয় কিছু ভাবল। রুমাল দিয়ে মুখ মুছে বলল, “আমার সঙ্গে পরেও দেখা হয়েছে। উনি আমাকে একটা বই পড়তে দিয়েছিলেন। ‘আ মর্ডান ইনট্রোডাকশন টু এনশিয়েন্ট ইন্ডিয়ান ম্যাথমেটিক্স’। এই সেই বই। আমি বইটা ফেরত দিতে এসেছি।”

বিধুরা বইটা এগিয়ে দিল। অনন্যা বইটা নিয়ে বলল, “সে কী! এই বই আপনি ফেরত দিচ্ছেন কেন! এই বই তো দাদা আপনাকে দিয়েছিল।”

বিধুরা মেয়েটা মাথা নামিয়ে গাঢ় স্বরে বলল, “সেটা জানার জন্য আমি ওঁর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলাম। উনি অ্যালাউ করেননি। তখন ভেবেছিলাম, বইটা চিরকাল নিজের কাছে রেখে দেব। এই ভয়ংকর ঘটনার পর মনে হল, এটা আপনাদের কাছে থাকা দরকার।”

অনন্যার খারাপ লাগছে। এই সুন্দর মেয়েটি নিশ্চয়ই সামান্য পরিচয়েই দাদাকে ভালবেসে ফেলেছিল। সে বলল, “যা-ই হোক, বইটা আপনি রেখে দিন। একটা স্মৃতি থাকবে। আর এই বই আপনাদের সাবজেক্টের। কাজে লাগবে।”

বিধুরা এই কথার কোনও জবাব না দিয়ে বলল, “এবার আমি উঠি? এই অবস্থায় কিছু বলা যায় না, তবু বলি, আপনারা সাবধানে থাকবেন।”

অনন্যা বলল, “বাড়িতে একদিন আসবেন।”

বিধুরা মৃদু হাসল। অনন্যা অফিসের গেট পর্যন্ত বিধুরাকে এগিয়ে দিল। নিজের টেবিলে ফিরে এসে মনে হল, যাঃ, মেয়েটার ফোন নম্বরটা তো নেওয়া হল না। স্কুলের নাম-ঠিকানাও তো জানা হয়নি। অন্যমনস্ক ভাবে বইয়ের পাতা উলটোতে লাগল অনন্যা। একেবারে শেষ পাতায় গিয়ে থমকে গেল। বইয়ের শেষে সুন্দর হাতের লেখায় লেখা রয়েছে, জীবনের সব অঙ্ক মেলে না। চাইলেও মেলে না।’ অনন্যার হাতের লেখা চিনতে অসুবিধে হল না। দাদার হাতের লেখা ছোটোবেলা চথেকেই সুন্দর। মেয়েটা কত সুন্দর ভাবেই না তার ভালবাসার গোপন কথাটুকু জানিয়ে দিয়ে গেল। অন্য কেউ হলে এত খোঁজখবর করে বইটা ফেরত দিতে আসত না। বিধুরা যেন নিঃশব্দে এসে জানিয়ে দিয়ে গেল, ‘আমি মালব্য বসুকে ভালবেসেছিলাম।’ ভালবাসার এটাই নিয়ম। সে জানাতে চায়।

মন খারাপ হয়ে গেল অনন্যার। ভাইব্রেশনে রাখা মোবাইল ফোনটা টেবিলে নড়ে উঠতে বিরক্ত ভাবে হাত বাড়াল।

দেবরূপ!

‘ধরব না, ধরব না’ করেও কানে ফোন তুলল অনন্যা। এই ছেলে সত্যি অদ্ভুত। এত কিছুর পরও ছেড়ে যেতে চায় না!

“অনন্যা, দারুণ খবর আছে।”

গলা শুনে কে বলবে, এই ছেলে দু’দিন আগেই এমন বিশ্রী আচরণ করেছে। অনন্যা নিরাসক্তভাবে বলল, “প্রোমোশনের জন্য কনগ্রাচুলেশন্‌স।”

দেবরূপ গলা নামিয়ে বলল, “না, প্রোমোশন নয়। তোমার দাদার ব্যাপারে খবর। আমার সেই পুলিশ কাজিন ফোন করেছিল।”

অনন্যা বিরক্ত গলায় বলল, “আমি তো তোমাকে বলেছি, এব্যাপারে আমার কোনও ইন্টারেস্ট নেই।”

দেবরূপ এই কথায় পাত্তা না দিয়ে বলল, “মালব্যদার ভাড়াটে খুনিদের একজনকে পুলিশ আসানসোলের বর্ডার না কোথা থেকে যেন ধরেছে। আর চিন্তা নেই অনন্যা, এবার মূল কালপ্রিট ধরা পড়বে। উফ বাঁচব। আবার তোমার সঙ্গে নিশ্চিন্তে দেখা করতে পারব। পুলিশ আর পিছনে পড়ে থাকবে না।”

দেবরূপের ফোন রেখে দেওয়ার পরপরই বাড়ি থেকে দোপাটি ফোন করল।

“থানা থেকে ফোন এসেছিল। মালব্যদার খুনি নাকি ধরা পড়েছে। মামা খুব কান্নাকাটি করছেন। খুব অস্থিরও দেখাচ্ছে। উনি বারবার বলছেন, তোমাকে খবর দিতে।”

অনন্যা থমথমে গলায় বলল, “তুই কোথা থেকে জানলি? স্কুলে যাসনি?”

দোপাটি বলল, “আমার খুব গলা ব্যথা। মনে হয় জ্বর আসছে। গার্গল করব বলে নীচে গরম জল আনতে গিয়েছিলাম। তখন জানলাম। অনন্যাদি, একটু পরে মা আসবে। আমি মায়ের সঙ্গে চলে যাব।”

অনন্যা অবাক হয়ে বলল, “কোথায় যাবি?”

দোপাটি বলল, “জানি না। তুমি যদি এর মধ্যে এসে পৌছও, দেখা হবে। নইলে পরে।”

অনন্যা বলল, “আমার মা কোথায়?”

“মনে হয় ওষুধ খেয়ে ঘুমোচ্ছে।”

একটু চুপ করে থেকে অনন্যা বলল, “আমি যাচ্ছি।”

অনন্যা বাবার হাত ধরে বসে আছে। ঘরের দরজা-জানলা বন্ধ। আলো- আঁধারিতে ঘরটাকে লাগছে মায়াবী।

নৈঃশব্দ্য ভেঙে অনন্যা বলল, “এমন কেন করলে বাবা? এত বড় একটা ভুল কেন করলে?”

বিশ্বনাথ বসু রক্তবর্ণ চোখ নিয়ে ভাঙা গলায় বলতে থাকেন, “ঘেন্নায়। প্রবল ঘেন্নায়। যাকে তীব্র ভালবাসতে হয়, তাকে ঘৃণা করতে হয় আরও তীব্র। অনু, ভালবাসার যেমন নিয়ন্ত্রণ থাকে না, ঘৃণারও তাই। মালব্য এই নোংরা কাজ করতে পারে আমি ভাবতে পারিনি। দোপাটি সম্পর্কে তাকে তো আমিই সব বলেছিলাম। তারপরেও সে এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা করল! তাকে গভীর রাতে ঘরে ডেকে এই কাজ! এই জিনিস চরম বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া আর কী? তোর মায়ের কাছ থেকে শুনেও আমি বিশ্বাস করিনি। দু’দিন নিজের সঙ্গে অনেক লড়াই করি। তারপর আমি মালব্যর কাছে যাই। তাকে আমি প্রশ্ন করেছিলাম, ‘দোপাটি মেয়েটি সেদিন রাতে তোর ঘরে এসেছিল?’ তোর দাদা বলেছিল, ‘হ্যাঁ, আমিই তাকে ডেকেছিলাম।’ আমি বলি, ‘আর একটা প্রশ্ন করব’। সে সহজ ভাবে বলল, ‘করো।’ আমি বলি, ‘এই প্রশ্ন পিতা হিসাবে পুত্রকে করা যায় না। তারপরেও আমি করতে বাধ্য হচ্ছি। মেয়েটি কি তোর ঘর থেকে জামা কাপড় না পরা অবস্থায় বেরিয়ে যায়?’ তোর দাদা বলে, ‘যতদূর মনে হচ্ছে তাই। বাবা, দোপাটি খুব বুদ্ধিমতী। আমি ওকে সময় দেব বলে কথা দিয়েছি।’ আমার শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে। তোর দাদার কাছ থেকে আমি চলে আসি,” বিশ্বনাথবাবু চুপ করলেন।

অনন্যা কিছু বলতে গিয়ে চুপ করে গেল! কী বলবে? তার সবটা শূন্য লাগছে। থানা থেকে আবার ফোন করেছিল। দোপাটি তার মায়ের সঙ্গে বেরিয়ে গেল। যাবার সময় অনন্যাকে বলে গেল, “বলেছিলাম, খুনি ধরা পড়লে চলে যাব। খুনি ধরা পড়েছে। আমাকে কখনও মাফ করতে পারবে কিনা জানি না অনন্যাদি, তারপরেও বলছি, যদি পার ক্ষমা কোরো।”

বিশ্বনাথবাবু মেয়ের হাত ছেড়ে বললেন, “প্রথমে ভেবেছিলাম, আমি নিজের হাতে মালব্যকে খুন করব। নষ্ট হয়ে যাওয়ার শাস্তি পাবে সে। শুধু তাই নয়, দোপাটি যখন আঙুল তুলে সব বলবে, ছেলেটার কী হবে? গলায় দড়ি দিতে হবে। যদি না পারে? তাই মেরে ফেলাই ভাল। পরে বুঝতে পারলাম, একাজ নিজে পারব না। তখন পাগলের মতো তাকে খুঁজতে লাগলাম। যে লোক খুন করতে পারে,” আবার চুপ করে দম নিলেন বিশ্বনাথবাবু।

অনন্যা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “চুপ করো। দোহাই তোমার, চুপ করো বাবা।”

বিশ্বনাথবাবু মেয়ের বারণে কান দিলেন না। বললেন, “কলকাতা শহরে খুনি ভাড়া করা যে এত সহজ আমি জানতাম না। যেদিন তোর দাদা বর্ধমানে সেমিনার শুনতে গেল, আমি তাদের খবর দিলাম।”

কথা শেষ করে মাথা নামিয়ে মুখে হাত চাপা দিলেন বিশ্বনাথবাবু। এক সময়ে অনন্যা শান্তভাবে বলল, “বাবা, আমি যদি এখন সত্যি ঘটনাটা বলি তোমার খুব আফসোস হবে। তুমি আরও ভেঙে পড়বে। তাই সে ঘটনা এখন বলব না। পরে অনেক সুযোগ পাব, তখন বলা যাবে। এখন মন শক্ত করার সময়। চলো, আমরা মাকে ডাকি তোমাকে থানায় যেতে হবে বাবা।”

বাইরে বিকলে গড়িয়ে সন্ধে নেমেছে। পুলিশের গাড়ি বাড়ির গেটের সামনে এসে দাঁড়াল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *