দোপাটি সেদিন একটা গলার কাছে চুমকি বসানো লাল রংয়ের স্লিভলেস টপ আর কালো লম্বা ঝুলের স্কার্ট পরেছিল। মেয়েটা সাজগোজ ভালবাসে। বাড়িতে থাকলেও টিপটপ হয়ে থাকে। তবে এবাড়ির দেওয়া জামাকাপড় বিশেষ পরে না। পর্ণা যখন আসে মেয়েকে নিয়ে দোকান বাজারে যায়। তা-ও চার-পাঁচমাসের আগে সে আসে না। মেয়ের হাতে কিছু টাকাও দিয়ে যায়। দোপাটি খরচ করে। ব্রা, প্যান্টি নিজেই কেনে। প্রথমদিকে একবার অনন্যা স্যানিটারি ন্যাপকিনের কথা বলতে গিয়েছিল।
“লাগলে আমার কাছ থেকে চেয়ে নিস।”
“দরকার নেই অনন্যাদি, ওসব আমি ব্যবস্থা করে নেব। তুমি বরং আমাকে একপাতা টিপ দিও। তোমার টিপ খুব সুন্দর। একেবারে ছোট-ছোট।”
পর্ণা এবাড়িতে আসতে চায় না। মোট দু’বার এসেছিল। প্রথমবার একবলো ছিল। দুপুরে খেয়েওছিল। বাকি সময়টা মেয়ের ঘরেই কাটিয়েছে। অঞ্জলি ঘেঁষতে গিয়ে তেমন পাত্তা পাননি। অল্প দু’-একটা কথা বলে চুপ করে গিয়েছে পর্ণা। আগের থেকে পর্ণা অনেক বদলে গিয়েছে। চুপচাপ হয়ে গিয়েছে। হয়তো দ্বিতীয়বার বিয়ের কারণে। তার উপর মেয়েকে ফেলে চলে যেতে হয়েছে বলে অপরাধবোধ কাজ করে। বিশেষ কথা বলতে লজ্জাও পায়। অঞ্জলি তারপরেও উৎসাহ দেখিয়েছিলেন। তা-ও কাজে দেয়নি। বরং এড়িয়ে যাওয়ার ভঙ্গি ছিল।
“মেয়ের কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো পর্ণা?”
“অসুবিধে হবে কেন? তোমাদের কাছে আছে, বাইরের কারও কাছে তো নেই।”
অঞ্জলি বলেছিলেন, “তারপরেও তো ছোটখাটো অসুবিধে থাকতে পারে। তোমাকে কিছু বলেছে? বললে নিঃসংকোচে জানাতে পার। আমাদের হয়তো বলতে লজ্জা পায়।”
পর্ণা একটু চুপ করে থেকে বলেছে, “আমার মেয়ে অনকে বড় অসুবিধার মধ্যে রয়েছে। ছোটখাটো সুবিধে-অসুবিধে নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় তার নেই। তোমরা চিন্তা কোরো না।”
এরপরে আর কথা বাড়ানো যায় না। তবে অঞ্জলি মনে-মনে বিরক্ত হয়েছিলেন।
পরেরবার যখন এল, একতলায় বসে চা খেয়ে মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল পর্ণা। তারপর থেকে যতবার এসেছে, মেয়েকে বাইরে থেকে ফোন করে ডেকে নিয়েছে। মেয়ে সারাদিন মায়ের সঙ্গে কাটিয়ে বাড়ি ফিরেছে। অঞ্জলি এই সিস্টেমে আপত্তি করেছিলেন। তবে আপত্তি অন্য কোথাও করতে পারেননি, করেছিলেন সেই অনন্যার কাছেই।
“এ কী ছিরি! এটা হস্টেল নাকি? এলাম আর মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে গেলাম! আমাদের বলা-কওয়া নেই, পারমিশন নেওয়া নেই, এবাড়িতে যেন মাসে-মাসে পয়সা দিয়ে আছে। যখন খুশি বেরিয়ে যাব, যখন খুশি আসব।”
অনন্যা রেগে গিয়ে মাকে বলেছিল, “সব বিষয়ে মাথা ঘামিয়ো না। মেয়ে তার মায়ের সঙ্গে যাবে তার জন্য তোমার কাছে পারমিশন নেওয়ার কী আছে?”
অঞ্জলি রাগে গজগজ করতে বলেছিলেন, “যেমন মা, তার তেমন শিক্ষা। মেয়েকে রেখে পালিয়েছিস, এবাড়িতে মাথা নামিয়ে ঢোক।”
অনন্যা বলেছিল, “মা, তুমি মাথা থেকে দোপাটি আর তার মাকে বাদ দাও।”
দোপাটির সেদিনের চুমকি লাগানো লাল পোশাকও নিশ্চয়ই তার মায়ের কিনে দেওয়া। মায়ের বিষয় নিয়ে কথা বললে, মেয়েটা ‘হুঁ’, ‘হাঁ’ বলে এড়িয়ে যায়। স্পষ্ট বুঝিয়ে দেয়, এই প্রসঙ্গে আর না এগোলেই ভাল। মালব্য তাকে ঘর থেকে বের করে দিতে পারে শুনে অনন্যা সেদিন খুব অবাক হয়েছিল। এ কেমন রসিকতা!
দোপাটি চোখ ভাসিয়ে খানিকটা যেন অভিনয় করে বলল, “উনি তো আমাকে চেনেনই না। খাবার নিয়ে গেলে হয়তো বলবেন, ‘এই মেয়ে, তুমি কে? আমার ঘরে কেন এসেছ? তুমি কি আমাদের বাড়ির নতুন কাজের মেয়ে?’”
অনন্যা রেগে গিয়ে বলেছিল, “ছিঃ, এসব কী কথা দোপাটি! তুমি নিশ্চয়ই জানো দাদা একজন পারফেক্ট জেন্টলম্যান। ওর মতো ভদ্রলাক খুব কম পাওয়া যায়।”
দোপাটি ঠোঁটের কোণে মুচকি হেসে বলেছিল, “বেশি ভদ্রলোক বলেই তো মুশকিল। পরশুদিন আমি যখন টিউশন করে ফিরছিলাম, তখন দেখি মালব্যদা একই বাসে৷ একেবারে মুখোমুখি বসে। উনি আমার দিকে তাকিয়েও মুখ ফিরিয়ে নিলেন। যেন চিনতেই পারলেন না। ভাবলাম, খেয়াল করেননি, নামার সময় ডাকবেন। বাড়ির স্টপেজ আসতে আমি উঠে গিয়ে গেটের সামনে দাঁড়ালাম। উনিও এসে আর সকলের সঙ্গে আমার পিছনে দাঁড়ালেন। ও মা! বাস থামতেই বললেন, ‘না নামলে সরে দাঁড়ান তো দেখি, নামব।’ আমি যেন অচেনা কোনও মেয়ে! তার উপর আবার আপনি-আজ্ঞে করছে! তুমি ওঁকে জিজ্ঞেস করো, আমি মিথ্যে বলছি কিনা।”
গল্প শুনে অনন্যা খুব হাসতে লাগল।
দোপাটি চোখ সরু করে রাগ-রাগ গলায় বলল, “হাসছ কেন? আমাকে তোমার দাদা চিনতে পারেনি বলে হাসছ?”
অনন্যা হাসতে-হাসতেই বলল, “হাসব না তো কী? চব্বিশ ঘণ্টা যে পুঁচকে মেয়েটাকে বাড়িতে দেখছে, তাকে যদি চিনতে না পেরে ‘আপনি’ সম্বোধন করে তা হলে হাসব না?’
দোপাটি একটু চুপ করে থেকে নিচু গলায় বলল, “অনন্যাদি, মোটা বলে আমাকে বড় লাগে, না?”
অনন্যা দোপাটির গায়ে হাত দিয়ে বলল, “দুর, তুই মোটা কোথায়? কাল থেকে একটু ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করবি।”
দোপাটি দোতলার সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যেতে-যেতে গম্ভীর ভাবে বলেছিল, “তাই করব। ফ্রি হ্যান্ড করে রোগা হব। তখন প্রফেসর সাহেব আমাকে ঠিক বাসে চিনতে পারবেন। দাঁড়াও, খাবারটা দিয়ে আসি আর নিজের নাম-টামগুলো ভাল করে বলে আসি। এতদিনে নিশ্চয়ই তা-ও ভুলে মেরে দিয়েছেন।”
অনন্যার মনে হয়েছিল, দাদার আচরণে মেয়েটা দুঃখ পেয়েছে। চেহারায় বড়সড় হলেও আসলে তো বয়স কমই। ছোট মেয়ে দুঃখ পাওয়াটাই স্বাভাবিক। সে তো আর তেমন ভাবে মানুষটাকে চেনে না। নিশ্চয়ই সেদিন বাসে দাদা কোনও বই-টই নিয়ে ভাবছিল। পরে মালব্যকে বলেছিল অনন্যা।
“এইটা তোমার ঠিক নয় দাদা। বাড়িতে সর্বক্ষণ যাকে দেখছ, তাকে রাস্তায় চিনতে না পারাটা যথেষ্ট অপমানজনক। আমারই তো ভয় করছে, এরপর একদিন হয়তো আমাকেও চিনতে পারবে না।”
মালব্যও লজ্জা পেয়েছিল। বলেছিল, “ছি ছি! কী যে বলিস। আসলে কী জানিস অনু, মাথায় এত সব জিনিস ঘোরে… তা ছাড়া সত্যি কথা বলতে কী, দোপাটি মেয়েটিকে তো আমি তেমন ভাল করে দেখিনি… মানে সেরকম তো দরকার হয়নি… এখন যদি মুখটা মনে করতে বলিস, চট করে পারব না…”
অনন্যা বলেছিল, “দোহাই তোমার, এসব আর ফলাও করে বলতে হবে না। বাড়ির মানুষগুলোকে অন্তত ভাল করে চিনে রেখো।”
অনন্যা জানে, এই বিষয়ে দাদাকে খুব বেশি বলেও লাভ নেই। মুখে সবার কথা বললেও, মেয়েদের ‘চিনে রাখার’ ব্যাপারে মানুষটা চিরকালই কাঁচা। নিজের মা এবং বোন ছাড়া কোনও মেয়ের মুখের দিকেই এই লোকের ভাল করে তাকানো হয়নি। বয়সে খুব বড় না হলেও সিরিয়াস ধরনের বলে, এই প্রসঙ্গে কখনওই খোলামেলা আলোচনা হয়নি। তারপরেও অনন্যা জিজ্ঞেস করেছে। মা-ই জিজ্ঞেস করতে বলেছিল।
“একবার খুঁচিয়ে দেখিস না, পছন্দের কেউ আছে-টাছে কিনা।”
অনন্যা বলেছিল, “মনে হয় না। মেয়েদের মুখের দিকেই তাকায় না যে মানুষ, সে করবে প্রেম! তা হলেই হয়েছে। তবু একবার জানতে চেষ্টা করব।”
মালব্যকে গিয়ে বলেছিল, “দাদা, একটা কথা সরাসরি বলে ফেলো দেখি।”
মালব্য মুখের সামনে বই ধরেই বলেছিল, “পরে বললে হয় না অনু? একটা জরুরি জিনিস পড়ছিলাম।”
অনন্যা হাত দিয়ে বই সরিয়ে দিয়ে বলল, “না, এখনই বলো।”
মালব্য হতাশ গলায় বলেছিল, “কী হয়েছে?”
অনন্যা কোনওরকম ভনিতা ছাড়াই দুম করে বলল, “তুমি কি কাউকে বিয়ে করবে বলে ঠিক করে রেখেছ?”
খানিকটা থতমত খেয়ে মালব্য হেসে ফেলল। বলল, “দুর পাগলি মেয়ে। এই তোর জরুরি কথা? যা পালা।”
অনন্যা বলল, “আমার কথার উত্তর পলোম না কিন্তু।”
মালব্য হাত বাড়িয়ে অনন্যার মাথায় হালকা চাঁটি মেরে, হেসে বলল, “তোর কথা? নাকি তোর মাতৃদেবীর কথা?”
“যারই হোক। তুমি জবাব দাও।”
মালব্য মাথা ঝুঁকিয়ে চোখ বড়-বড় করে বলল, “জবাব পেলে কী করবি? আমার মাথাটা নিয়ে বলিকাঠে ঢুকিয়ে দিবি? তারপর এক কোপে ঝপাং? সে চান্স হচ্ছে না মাই বিলাভেড সিস্টার,” কথা শেষ করে জোরে হেসে উঠল মালব্য। তারপর চোখ পাকিয়ে বলল, “এবার পালা অনু, নইলে কিন্তু কোয়ান্টাম মেকানিক্স বোঝাতে শুরু করব।”
এরপর আর এই প্রসঙ্গে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই, বুঝেছিল অনন্যা। দাদার ঘর থেকে চলে এসেছিল। কিন্তু আজ বাবার ঘর থেকে চলে গেলে হবে না। তাকে বোঝাতে হবে।
“বাবা, দোপাটি এবাড়ির সঙ্গে খাপ খাচ্ছে না। তুমি এটাকে ইগো হিসাবে নিয়ো না। মা যে এত রাগারাগি করে, বকাঝকা করে, মাথা গরম হয়ে যায় বলেই করে। দোপাটি এমন সব কাজ করছে… মাথা ঠান্ডা রাখা কঠিন… কাজগুলো শুধু ছেলেমানুষি বয়সের দুষ্টুমি নয়, তার চেয়েও বেশি। তুমি তো কিছু-কিছু জানো।”
বিশ্বনাথবাবু চুপ করে রইলেন। মেয়ে এত জোর দিয়ে বলায় তিনি এতক্ষণে সম্ভবত খানিকটা বিশ্বাস করছেন। গলা নামিয়ে বললেন, “তোরা বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কিছু করতে পারছিস না?”
অনন্যা সামান্য হেসে বলল, “কে বোঝাবে? মা, না আমি? মা কেন বোঝাবে বলো তো? কী দায় পড়েছে পরের মেয়েকে মানুষ করার? আমিই বা তাকে শাসন করার দায়িত্ব নেব কেন? আর ওই মেয়ে তো ছোট নয়। এই মেয়ের তো অ্যাডোলেসেন্স শেষ হতে চলেছে। তার মানে যথেষ্ট বড়। আর সেটা বিপদের।”
বিশ্বনাথবাবু বললেন, “বিপদ! কীসের বিপদ?”
অনন্যা চুপ করল। ভাবল একটু। কতটা বলা ঠিক হবে? খানিকটা বলতেই হবে। অন্তত ইঙ্গিত দিতে হবে। নইলে মানুষটা বুঝতে চাইছে না।
“বাবা, দোপাটির বেশি বুদ্ধি৷ সেই বুদ্ধি সে মাঝে-মাঝে এমন খারাপ দিকে ব্যবহার করছে সেটা ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। এতদিন পর্যন্ত যা শুনেছ সেগুলোর কথা না হয় ছেড়ে দিচ্ছি, কিন্তু সে এমন একটা কাজ করেছে যেটা খুব খারাপ মেয়ে ছাড়া করবে না। এতে ভয়ংকর কোনও ঘটনা ঘটলে সেই বদনাম আমাদের বাড়ির উপরে এসে পড়বে।”
বিশ্বনাথবাবু চুপ করে থেকে বললেন, “কোনও ছেলের সঙ্গে মেলামেশা করছে?”
অনন্যা থমথমে গলায় বলল, “সেটা হলে নরমাল হত। এটা নোংরা।”
বিশ্বনাথবাবু বললেন, “আমি ডেকে কথা বলব।”
অনন্যা উঠে পড়ল। মানুষটা বুঝতে চাইছে না। কী আর করা যাবে? ধৈর্যেরও তো সীমা আছে। অনন্যা নিশ্বাস ফেলে বলল, “বলে দেখতে পার। কিন্তু আমি শেষবারের মতো তোমাকে বলে যাচ্ছি। এই সমস্যার সমাধান একটাই। দোপাটিকে বাড়ি থেকে সরিয়ে দেওয়া। যাক, রাত হল। শুয়ে পড়ো।”
অনন্যা নিজের ঘরে এসে পোশাক ছেড়ে নাইটি পড়ল। আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল বিরক্তি নিয়ে। দোপাটি-সমস্যার সমাধান হল না। সমস্যা গভীর হবে। কালই মায়ের কাছ থেকে ঘটনা শুনে শিউরে উঠেছিল।
অঞ্জলি তার মেয়েকে এসে জানায়, দোপাটি আজকাল মাঝে-মাঝেই ঘরে শুধু ব্রা আর প্যান্টি পরে থাকছে। প্রথমদিন ছাদে ওঠার সময় দরজার ফাঁক দিয়ে হঠাৎই চোখে পড়ে যায়। দোপাটিকে প্রায় নগ্ন দেখে অঞ্জলি থমকে দাঁড়ান। ভুরু কুঁচকে যায় তার। এ কী! মেয়েটি এভাবে ঘরে হাঁটাচলাও করছে! তবে সেদিন দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়েছিলেন অঞ্জলি। মনে হয়েছিল, হয়তো ভুল বুঝেছেন। দোপাটি জামা-কাপড় বদলাচ্ছে। দরজা ভাল করে বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছে। দু’দিন পরে আবার এক ঘটনা। দরজার ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ে ফের। অঞ্জলি একটু এগিয়েই যান। নিচু হয়ে দেখেন। চমকে ওঠেন। দরজা বন্ধ না করেই মেয়েটা খাটের উপর শুয়ে রয়েছে। বই-টই কিছু একটা পড়ছে। গায়ে শুধু ব্রা আর প্যান্টি! পাশ থেকে দেখলে মনে হবে, কিছুই নেই। শোওয়ার ভঙ্গি স্বাভাবিক। যেন এভাবে থাকতেই তার পছন্দ। অঞ্জলি অবাক হয়েছিলেন, বিরক্তও হলেন। এ কী অসভ্যতা! এত বড় মেয়ে রোজ এই ভুলটা করে কী করে? তারপরেও দরজায় নক করতে গিয়ে থমকে যান। ডেকে কী বলবেন? জামাকাপড় পরে থাকো? এটাও কি বলা যায়? ঠিক আছে, আর একদিন দেখলে মাথা ঠান্ডা করে বলতে হবে। অন্তত দরজাটা যেন ভিতর থেকে আটকে রাখে।
এক সপ্তাহ কিছু হয়নি। অঞ্জলি ছাদে ওঠা-নামা করেছেন, দোপাটি এর মধ্যে দিনতিনকে ওই সময়ে ঘরেও ছিল। স্কুলে মাধ্যমিক পরীক্ষার সিট পড়েছে। যেদিন পরীক্ষা নেই, সেদিনই শুধু মেয়েদের ক্লাস হয়, বাকি দিন ছুটি। দোপাটিও সেই মতো বাড়ি থাকে। রোজই তার তিনতলার ঘরের দরজা অন্যদিনের মতোই আধখোলা বা একটু ফাঁক থাকে। আপত্তিকর কিছু চোখে পড়েনি অঞ্জলির। পড়ল কাল। কাল বেলায় ভিজে কাপড় মেলে ছাদ থেকে নামার সময় ঘরে আওয়াজ পেলেন। চাপা হাসির আওয়াজ। খুবই চাপা। প্রায় ফিসফিসানির মতো। অঞ্জলি অবাক হন। দোপাটি ঘরে একা-একা হাসে! গল্পের বই পড়ছে? মোবাইলে কথা বলছে কারও সঙ্গে? গতবার পর্ণা এসে মেয়েকে একটা মোবাইল ফোন দিয়ে গিয়েছে। খুব দামি কিছু নয়। কিন্তু অঞ্জলির এতে আপত্তি ছিল। স্কুলে পড়া মেয়ের হাতে মোবাইল ফোন দেওয়ার মানে কী? লেখাপড়া তো লাটে উঠবে। তিনি দোপাটিকে কথাটা বলেওছিলেন।
“তোমার মা এটা কী করল বলো তো? দুম করে তোমার হাতে একটা মোবাইল ফোন ধরিয়ে দিয়ে গেল। আমাকে একবারও বলল না! ক’দিন পর তোমার ফাইনাল পরীক্ষা। মোবাইল নিয়ে মেতে থাকলে চলবে?”
দোপাটি স্থির চোখে মুহূর্তখানকে অঞ্জলির দিকে তাকিয়ে থেকে ফিক করে হেসে ফেলে। বলে, “চিন্তা কোরো না। এবারও ক্লাসে ফার্স্ট হব। এই ফোনে মায়ের সঙ্গে কথা বলব।”
অঞ্জলি আরও বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, “কেন, আমাদের বাড়ির ল্যান্ডফোনটা আছে, সেটায় কথা বলা যায় না? এতদিন তো তোমার মা ওই ফোনেই কথা বলেছে। বলেনি?”
দোপাটি একটু চুপ করে শান্ত ভঙ্গিতে বলে, “হ্যাঁ, বলেছে। আমিও বলেছি। কিন্তু মাতা-কন্যার সব কথা কি সবার সামনে বসে হয় মামি? এই ধরো না, তুমি আর অনন্যাদি যখন কথা বলো, সব সময় কি সবার সামনে বসে বলো?”
চড়াৎ করে মাথায় আগুন ধরে গিয়েছিল অঞ্জলির। ইচ্ছে করছিল, এক চড়ে পাকা মেয়েটার গাল লাল করে দিয়ে বলেন, ‘তোমার অনন্যাদির মা তো প্রেম করে পালায়নি যে তাকে লুকিয়ে মেয়ের সঙ্গে ফিসফিস করতে হবে।’ অঞ্জলি নিজেকে সামলান। একথা বলা যায় না। তিনি কাটা-কাটা উচ্চারণে বললেন, “আড়ালে কন্যা মাতাকে কী বলবে জানতে পারি? মামি খুব মারধর করে? একবলো খেতে দেয়? বাসন মাজায় আর কাপড় কাচায়?”
দোপাটি ফিক করে হেসে মুখে হাত চাপা দিয়ে বলল, “এগুলো যে সত্যি নয়, তুমি ভাল করেই জানো মামি। তোমার হালকা চড়-চাপড়, ঝুঁটি ধরে টানাও খুব কিছু মারধরের মধ্যে পড়ে না। তবে সত্যি হলেও মাকে এসব বলতাম না। আমাকে এখানে রেখে মা নিশ্চিন্ত হয়ে আছে।”
কথা শেষ করে মোবাইল দেখতে-দেখতে দোপাটি সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গিয়েছিল।
মেয়েটা কি সেই মোবাইলেই কথা বলছে আর হাসছে? সেদিন দোপাটির ঘরের দিকে কয়েক পা এগিয়ে গিয়েছিলেন অঞ্জলি। দরজার ফাঁকে চোখ রাখেন। ঘরে যে-পাশে জানলা সেদিকটায় দাঁড়িয়ে আছে দোপাটি। আজও সে প্রায় নগ্ন। কালো রঙের ব্রা আর মেরুন রঙের প্যান্টি ছাড়া গায়ে কিছু নেই। জানলাটা আধখোলা। দোপাটি একটা পাল্লার আড়ালে নিজেকে খানিকটা ঢেকে রেখেছে, খানিকটা রেখেছে উন্মুক্ত। জানলার ঠিক ওপাশে ফ্ল্যাটবাড়ি। বাড়ির কোনও না-কোনও ফ্ল্যাট থেকে নিশ্চয়ই এই ঘর দেখা যায়। পুরোটা না হলেও খানিকটা তো বটেই। অঞ্জলি স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তার সারা শরীর দিয়ে ভয়ের ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। শয়তান মেয়েটা কি কাউকে নিজের উদোম শরীর দেখাচ্ছে!
মুহূর্তখানকে সময় নিয়েছিলেন অঞ্জলি। তারপর দু’হাতে দরজা খুলে ঢুকে পড়েন ঘরে। প্রায় ছুটে গিয়ে জানলার পাল্লা বন্ধ করেন, এলোপাথাড়ি মারতে থাকেন দোপাটিকে। চড়, কিল, চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকানো কিছুই বাদ দেন না।
এই প্রথম দোপাটি একটুও বাধা না দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে মার খায়। অঞ্জলি একসময় হাত চালানো থামান। হাঁপাতে থাকেন। হুঙ্কার দিয়ে বলেন, “বল, কী করছিলি? কাকে শরীর দেখাচ্ছিলি বল?”
দোপাটি শান্ত ভাবে বলে, “একটা কথাও বলব না। তুমি এবার যাও মামি। না হলে বিপদে পড়বে।”
‘বিপদে পড়বে’ কথাটা শুনে অঞ্জলি থমকে যান। মেয়েটার এত স্পর্ধা! খানিকটা হতবাক হয়েই তিনি ঘর ছাড়েন। সন্ধেবেলা অফিস থেকে ফিরলে মেয়েকে জানান।
অনন্যার এবার ঘুম পাচ্ছে। ঘুমের ঘোরে তার মনে হল, এবাড়ির মানুষকে নিয়েই গন্ডগোল হচ্ছে। এতক্ষণ মনে হয়েছিল, গোলমালের কারণ শুধু দোপাটি। ঘটনা তা নয়। গোলমালের কারণ সে নিজেও। এমন একটা ছেলের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে যার চেহারা ধীরে-ধীরে বদলে যাচ্ছে। অথবা এমনটাই ছিল, আগে চিনতে পারেনি। গোলমাল দাদাকে নিয়েও। সংসারে থেকেও সংসার সম্পর্কে উদাসীন। যত দিন যাচ্ছে, উদাসীনতা বাড়ছে। বাড়িতে থাকে, এমন মানুষকেও চিনতে পারছে না। নাকি চায় না? এখন মনে হচ্ছে, দাদার এই উদাসীনতা দায়িত্ব থেকে পালানোর পথ। মায়ের গোলমাল অন্য জায়গায়। দোপাটির উপর মহিলার এত ক্রোধের কারণ, সে বিশ্বনাথ বসুর স্নেহ পায়, মদত পায়। দাদার উপর মায়ের এই কারণেই বিরক্তি। এটা কি মানসিক জটিলতা? হিংসে? হতে পারে। যতই বিশ্বনাথ বসু তাঁর উপর দাপট দেখান না কেন, স্বামীর মনের দখল তিনি পুরোটা চান। সব থেকে গোলেমলে হয়ে গিয়েছেন বাবা। দোপাটিকে নিয়ে তাঁর এত দুর্বলতা কীসের? কেন তাকে এই বাড়িতেই রাখতে চান? এটা কি জেদ নাকি অন্য কিছু?
পাশ ফিরতে-ফিরতে অনন্যা ঠিক করল, কাল সকালেই সে দোপাটির সঙ্গে কথা বলবে। দাদার মতো মুখ লুকিয়ে থাকলে বাড়িতে বড় সমস্যা হয়ে যাবে। এই সমস্যা তাকে ঠেকাতে হবে।
অনন্যাকে এত সকালে ঘরে ঢুকতে দেখে দোপাটি চমকাল না। হেসে বলল, “গুড মর্নিং।”
দোপাটিকে যথারীতি সুন্দর লাগছে। লম্বা স্কার্টের সঙ্গে ফুলস্লিভ শার্ট পরেছে। চুল টেনে বেঁধে নিয়েছে। অনন্যারই দেওয়া ছোট্ট একটা টিপ লাগিয়েছে কপালে। ঘুম ভাঙা মুখটা কী সরল!
“ছাদে মর্নিং ওয়াক করতে এসেছ নাকি?”
অনন্যা একটু ইতস্তত করে বলল, “না। তোর সঙ্গে গল্প করতে এসেছি। পড়ছিস?”
দোপাটি এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল, “তুমি এলে কেন? আমাকে নীচে ডাকলে পারতে।”
দোপাটি খাটে বাবু হয়ে বসে পড়ছিল। অনন্যা বসল পড়ার টেবিলের সামনে রাখা চেয়ার টেনে।
“নীচে ভাল করে কথা বলা যায় না। রাজ্যের লোকে। তোর উপরটা বেশ নিরিবিলি,” একটু চুপ করে থেকে খানিকটা ছেলেমানুষির ঢংয়ে অনন্যা বলল, “অ্যাই দোপাটি, চল, ছাদে পায়চারি করতে-করতে একটু গল্প করি।”
দোপাটি এক মুহূর্ত ভাবল না। লাফ দিয়ে উঠল। খাট থেকে নেমে বলল, “তাই চলো। এতদিন এবাড়িতে আছি, তোমার সঙ্গে কোনওদিন ছাদে হাঁটিনি। তোমার সঙ্গে কেন? এ বাড়ির কারও সঙ্গেই হাঁটিনি। যদি এখান থেকে কোনওদিন চলে যেতে হয়, আফশোস থেকে যাবে।”
কথাটা বলে ‘খিল খিল’ আওয়াজ করে দোপাটি হাসল। হাসলে মেয়েটাকে আরও সুন্দর, আরও নরম-সরম দেখায়। অনন্যা আগে দেখেছে, আজও দেখল। অনন্যা পরিস্থিতি সহজ করার জন্য বলল, “বেশি পাকামি করিস না। ছাদে একসঙ্গে না হেঁটে যেন তোর বিরাট লোকসান হয়ে গিয়েছে।”
ছাদে সকালের প্রথম রোদ এসে পড়েছে। নরম কমলা রংয়ের রোদ। কোথা থেকে অল্প-অল্প ঠান্ডা বাতাস আসছে। অনন্যা নীল-সাদায় মেশানো সালোয়ার-কামিজ পরেছে। তবে সে চুল আঁচড়ায়নি। সাতসকালে সাজগোজের প্রশ্নই ওঠে না। ছাদে উঠে তার মনে হল, কতদিন এভাবে আসা হয় না। যখন উপরে ওঠে, কিছু না-কিছু থাকে। হয় কাপড় শুকোতে দেওয়া, নয় ট্যাঙ্কে ঠিকমতো জল ভরল কি না খোঁজ নেওয়া, নয় বৃষ্টির জল জমে থাকলে নালা খুঁচিয়ে দেওয়া। একটা সময় টবে গাছ ছিল। সে পাট অনেকদিন চুকেছে। দেখাশোনার অভাবে গাছ মরে গিয়েছে। বাড়িতে ছেলেপিলে থাকলে ঘুড়ি ওড়াতে, বাজি পোড়াতে ছাদ ব্যবহার হয়। এবাড়ির ছেলে তো কোনওদিনই সেসবের মধ্যে থাকেনি। বরং স্কুলবয়সে বন্ধুরা এলে ছাদে উঠত অনন্যাই। শীতের দুপুরে কমলালেবু, কুলের আচার খাওয়া হত। বড় হওয়ার পর সেসব বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এখন তো বন্ধুরা বাড়িতে আসেই না। ক’দিন আগে আমেরিকা থেকে অর্যমা কলকাতায় এসেছিল। দিন বারো-তেরোর ছোট টুর। তার মধ্যে একদিন ঢুঁ মেরে গেল। আসার সময় সুজাশ্রীকে জোর করে ধরে এনেছিল। স্কুল-কলেজের বন্ধু সব। অর্যমা লেখাপড়ায় আহামরি ছিল না। কিন্তু লেখাপড়া নিয়ে পড়ে থাকার ইচ্ছে ছিল। পরিশ্রমও করত খুব। কলেজে পড়ার সময় থেকে বাইরে চলে যাওয়ার দিকে মন। শেষ পর্যন্ত করেই ছাড়ল। বিদেশ যাবে বলে সাবজেক্ট পর্যন্ত বদল করেছে। জিআরই দিয়ে স্কলারশিপ জোগাড় করল। পাঁচবছর হল বাইরে রয়েছে। রিসার্চ করছে, সঙ্গে পার্ট টাইম চাকরি। মাঝে-মাঝে বুড়ো বাপ-মায়ের কাছে দেশে আসে। তখন পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে চায়। প্রথমবার রেস্তোরাঁয় ডেকে খাইয়েছিল। সাত-আটজন এসেছিল। হইচই হয়েছিল খুব। ধীরে-ধীরে সেই উৎসাহ ফুরিয়েছে। এখন অর্যমা ডাকাডাকি করলেও কেউ আসতে চায় না। অফিস, চাকরির ইন্টারভিউ, ছেলের টিউশন, শ্বশুরমশাইয়ের শরীর খারাপ বলে এড়িয়ে যায়। আড়ালে বলে, “বিদেশ থেকে বাপু তুমি ছুটি নিয়ে এসে পিরিত দেখাচ্ছ, আমার তো এখন ছুটি নেই। আমার ছুটির সময় আসবে তুমি?”
অনন্যা এসব ভাবে না। বন্ধুর সঙ্গে দেখা হবে, গল্প হবে, এর মধ্যে হিসেবনিকেশ কী? তবে তার নিজের সময়ও কমে গিয়েছে। এবার অর্যমার জন্য অফিস থেকে সিএল নিয়েছিল। বাড়িতেই ডেকে নিয়েছিল। শুক্তো, ডাল, তিনরকম মাছের ঝোল-ঝাল আর চাটনি দিয়ে বাঙালি লাঞ্চ। সুজাশ্রী মেনু শুনে মুখ বেঁকিয়েছিল, “ইস রোজই তো এসব ছাইভস্ম খাচ্ছি। আমি তো আমেরিকায় থাকি না, আমার উপর অত্যাচার কেন?”
অনন্যা বলেছিল, “বন্ধুর জন্য স্যাক্রিফাইস কর।”
সুজাশ্রী পুরো মাত্রায় হাউজ়ওয়াইফ। কুড়িতেই বিয়ে থা করে ছেলেমেয়ের মা হয়ে গিয়েছে। ফলে বুড়িয়েও গিয়েছে। তিন বন্ধুর আড্ডা বসেছিল ঘরেই। অর্যমা বলেছিল, “মনে আছে এই বাড়ির ছাদে বসে কেমন আড্ডা দিতাম?”
অনন্যা হেসে বলল, “মনে নেই আবার! সুজার বয়ফ্রেন্ডের প্রেমপত্র পড়া হয়েছিল। ইংরেজিতে লেখা চিঠি।”
‘ছাই ভস্ম খাবার’ বলে নাক সিঁটকোলেও মোটাসোটা সুজাশ্রী খেয়েছিল সবথেকে বেশি। আইঢাই পেট নিয়ে শুয়ে পড়েছিল অনন্যার খাটে। বয়ফ্রেন্ডের চিঠি নিয়ে আপত্তি করে উঠল।
“মোটেই ইংরেজিতে লিখত না। গুল মারবি না শালা।”
অর্যমা হেসে বলল, “অবশ্যই ইংরেজিতে লিখত। বানান আর গ্রামারে দেদার ভুল।”
অনন্যা বলল, “তোর এখন রাগ করার কী আছে? সেই ছেলে তো কোথায় ভ্যানিশ হয়ে গেছে। তুই এখন ইংরেজি জানা বর নিয়ে দিব্যি ঘর সংসার করছিস৷”
অর্যমা চোখ নাচিয়ে বলে, “নাকি এখনও তলে-তলে ইটিং-পিটিং চলে?”
সুজাশ্রী এবার উঠে পড়ে তেড়ে গেল প্রায়। হাসতে-হাসতে বলল, “আমি কি তোমাদের মতো? একজন আমেরিকায় বসে নতুন-নতুন ছেলের সঙ্গে লিভ টুগেদার করছে, যখন পারছে চকাস-চকাস করে চুমু খাচ্ছে, আর একজন এখানে ডিভাইন লভের নামে ডিভানে শুয়ে জড়ামড়ি করছে।”
অনন্যা সুজাশ্রীর উপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল, “অ্যাই, তোকে কে বলেছে আমি ডিভানে শুয়ে জড়ামড়ি করি?”
অর্যমা বলল, “না উনি ডিভানে শোন না, দেবরূপের ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে আদর খান।”
অনন্যা ঝুঁকে পড়ে অর্যমার গলা টিপে ধরল। অর্যমা ‘কোঁ কোঁ’ আওয়াজ করে বলতে লাগল, “যেখানেই জড়ামড়ি করো মাই ডিয়ার, সাবধানে কোরো। কাজ হয়ে গেলে পুরুষমানুষ বড্ড ভুলে যায়। সে এখানেও ভোলে, আমেরিকাতেও ভোলে। যত ঝক্কি আমাদের।”
তিনজনে খুব হাসাহাসি হল। বিকলে হলে অর্যমা বলল, “চল, ছাদে গিয়ে একটু বসি।”
উঠতে গিয়েও সুজাশ্রী থমকে গেল। বলল, “না, ছাদে নয়।”
অর্যমা বলল, “কেন! চল না। আবার কবে আসব ঠিক আছে? এই বাড়িতে হয়তো আসাই হবে না আর। অনন্যার তো বিয়ে হয়ে যাবে। পার্টি তখন দেবরূপের ফ্ল্যাটে হবে।”
অনন্যাও উৎসাহ নিয়ে নিয়ে বলল, “চল, সেই আগের মতো ট্যাঙ্কের সিঁড়িতে বসে আড্ডা দেব। চা খাব।”
সুজাশ্রী একটু চুপ করে থাকল। তারপর শুকনো হেসে বলল, “থাক না, এখানেই তো বেশ বসেছি। ছাদে উঠলে হয়তো সেই বানান ভুলের চিঠির কথা মনে পড়ে যাবে। মন খারাপ হয়ে যাবে। কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে?”
অনন্যা, অর্যমা মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। অনন্যা তাড়াতাড়ি বলল, “থাক। আমি ঘরেই চা নিয়ে আসছি।”
সেই ছাদে আজ দোপাটিকে নিয়ে উঠে অনন্যার কেমন যেন লাগছে।
“চল, ওই দিকটায় যাই। এদিকটায় এলে ফ্ল্যাটবাড়িটা দেখা যায়।”
দোপাটি সহজভাবে বলল, “তাই ভাল।”
দু’জন মিনিটকয়কে চুপ করে পাশাপাশি হাঁটল। অনন্যা বলল, “তোর পরীক্ষা কবে দোপাটি?”
দোপাটি মুখ টিপে হাসল। বলল, “কালই তো বললাম, ভুলে গেলে? পরীক্ষার দেরি আছে। আমি তো পরীক্ষার জন্য পড়ি না। সারা বছরই নিয়ম করে পড়ি।”
অনন্যার একটু অস্বস্তি হল। সত্যি, কাল না পরশু মেয়েটাকে পরীক্ষার কথা জিজ্ঞেস করেছিল। আসলে আজ কথাটা কীভাবে শুরু করবে বুঝতে পারছিল না। নিজেকে সামলে নিয়ে সহজ ভাবে বলল, “এটা ভাল করিস। সারা বছর পড়লে পরীক্ষার সময় চাপ থাকে না। আমিও তাই করতাম।”
দোপাটি হাসি-হাসি মুখে বলল, “শুনেছি, তুমি নাকি লেখাপড়ায় খুব ভাল ছিলে।”
অনন্যা হেসে বলল, “কচু ছিলাম। লেখাপড়ায় ভাল হল আমার দাদা। পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়ে কি আর লেখাপড়া বোঝা যায়?
দোপাটি চোখ সরু করে বলল, “তা হলে কী করে বোঝা যায়? সারাদিন বই মুখে দিয়ে বসে থাকলে?”
মেয়েটা কী ইঙ্গিত করছে অনন্যা বুঝতে পারল। দাদার ওকে চিনতে না পারার অপমান এখনও মেটেনি। এই বয়সটা এরকমই। চট করে মান- অভিমান যায় না। তার উপর এই মেয়ে সেনসিটিভ। মাথায় হাজারটা বদবুদ্ধি। যা-ই হোক, এখন গল্পগুজব করে মেয়েটার কনফিডেন্সে আসতে হবে। তারপর আসল কথা পাড়তে হবে। এই কৌশলটা সে মাথা খাটিয়ে ঠিক করেছে। কোনও কিছুতে কৌশল করা অনন্যার পছন্দ নয়। কিন্ত এক্ষেত্রে আর কোনও উপায় নেই। বিশ্বনাথ বসু যদি তার কথা মেনে নিত তা হলে সমস্যা ছিল না। সে তো হল না।
অনন্যা বলল, “তা কেন? দাদা কত বড় মাস্টার বল তো? কলেজে পড়ান।”
দোপাটি অনন্যার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “মাস্টার হলেই ভাল হয় বুঝি? একেবারেই নয়। খারাপও হয়। আমাদের ক্লাসের সৃজাকে বাড়িতে একজন বুড়ো মতো মাস্টার পড়াত। ওর মা ভীষণ স্ট্রিক্ট। সৃজার উপর সবসময় নজর রাখত। স্কুল থেকে নিয়ে আসে, দিয়ে আসে। অল্পবয়সি কোনও মাস্টার যাতে সৃজার সঙ্গে প্রেমে না পড়ে তার জন্য বুড়ো মাস্টার রেখেছিল। কিন্তু…”
দোপাটি মুখে হাত দিয়ে হাসল। অনন্যাও হেসে বলল, “ঠিক আছে আর কিন্তু বলতে হবে না। বুঝতে পেরেছি।”
দোপাটি চোখ জ্বলজ্বল করে বলল, “আরে শোনো না কাণ্ড। একদিন সৃজার মা কোথায় যেন বেরিয়েছিল। বুড়ো মাস্টার সেই সুযোগে সৃজাকে কাছে ডেকে…”।
অনন্যা বলল, “আঃ, বলছি না আর বলতে হবে না। সবাই ভাল হয় না। তার মানে এই নয় সবাই খারাপ। বহু ভাল টিচার আছেন। ছাত্রীদের নিজের মেয়ে, বোনের মতো করে লেখাপড়া শেখান। আমাদের কলেজেরই তো এস বি নামে একজন ইকনমিক্সের স্যার ছিলেন। তিনি অন্তত তিনটে গরিব মেয়ের বই-খাতার ব্যবস্থা করে দিতেন। আরও ছিলেন।”
দোপাটি ভাল মানুষের কথা শুনল বলে মনে হয় না। সে হাঁটতে-হাঁটতে চোখ স্থির করে বলল, “সৃজার বদলে যদি আমি থাকতাম, আমি ওই লোকটার পিণ্ডি চটকে দিতাম। সৃজাটা তো রোগা-প্যাংলা টাইপের মেয়ে। তার উপর ভিতু।”
অনন্যা তাড়াতাড়ি বলল, “ঠিক আছে, অনেক গুন্ডামি হয়েছে। এবার একটা কাজের পরামর্শ দেব। মন দিয়ে শোন। তোর হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার আর দেরি নেই। সামনের বছরটা যদি কোনও ভাল স্কুলে পড়িস সেটা তোর জন্য ঠিক হবে। পাড়ার স্কুলে পড়ার চেয়ে বড় স্কুলে পড়ে পরীক্ষা দিলে কেরিয়ারের পক্ষে ভাল। দেখ দোপাটি, বড় পরীক্ষা তোকে ভাল স্কুল থেকেই দিতে হবে। ঠিক কিনা?”
দোপাটি এইরকম ভাবে হাঁটতে-হাঁটতে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “কোন বড় স্কুল?”
অনন্যা খুশি হল। মেয়েটা তা হলে টোপটা গিলেছে। আরও সতর্কভাবে বলতে হবে।
“সে খুঁজে পেতে আর কতক্ষণ? দেশে ভাল স্কুল কলেজের কি অভাব আছে? সবচেয়ে সুবিধের কথা হল, মেয়ে হিসেবে তুই যতই পাজি হ, স্টুডেন্ট হিসেবে তো তুই ভাল। তাই ভর্তিতে অসুবিধে হবে না। সবচেয়ে ভাল কী জানিস দোপাটি?”
অনন্যা থমকে দাঁড়াল। দোপাটিও দাঁড়িয়ে পড়ে চোখ বড় করে বলল, “কী জানি! ভাল স্কুলে গেলে ওরা পড়া ক্যাপসুলে ভরে গিলিয়ে দেবে?”
অনন্যা ভুরু কুঁচকে বলল, “ফাজলামি করিস না। মার খাবি। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, কোনও রেসিডেনশিয়াল স্কুলে ভর্তি হয়ে যেতে পারলে দারুণ হবে। সেখানকার হস্টেলে থেকে নিজের মতো পড়তে পারবি। হাতের কাছে ল্যাবরেটরি, লাইব্রেরি সব পাবি। যখন ইচ্ছে টিচারের কাছে গিয়ে পড়া বুঝে নিতে পারবি। ভাল-ভাল রেসিডেনশিয়াল স্কুলে চব্বিশ ঘন্টা টিচার থাকে শুনেছি।”
দোপাটির মুখের উপর রোদ এসে পড়েছে। ওই রোদের আলোতেই বোঝা গেল, মেয়েটার চোখ চকচক করছে। ফিসফিস করে বলল, “আর? আর কী সুবিধে হবে?”
অনন্যা দোপাটির কাঁধে হাত রেখে বলল, “আর? আর পাবি ইনডোর- আউটডোর গেমস, অডিটোরিয়াম। আর একগাদা সমবয়সি বন্ধু। খেলাধুলো, থিয়েটার, সিনেমা এসব অ্যাকটিভিটির মধ্যে থাকলে দুষ্টুমি করার সময় পাবি না।”
দোপাটি হেসে বলল, “মামির মারও খেতে হবে না। তাই না?”
অনন্যা হাত বাড়িয়ে মাথার চুল ঘেঁটে দিয়ে বলল, “দুর পাগলি। আমি কি তা বলেছি? এত বড় হয়েছিস এখন চড়, কানমলাও উচিত না। তুই তো মাকে রাগিয়ে দিস। মায়ের কী দোষ? তোর ভাল যাতে হয় সেটাই বললাম।”
দোপাটি একটু চুপ করে থেকে বলল, “এসব স্কুলে ভর্তি হতে তো অনেক খরচ।”
অনন্যা বলল, “তা ঠিক। তবে সে নিশ্চয়ই ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আমার বাবা আছে, তোর মা আছে, আমিও তো কিছু উপার্জন করি। তাই না? চিন্তা করছিস কেন?”
দোপাটি সামান্য হাসল। বলল, “না, চিন্তা করছি না।”
অনন্যার আরও উৎসাহ হল। বলল, “তা হলে এক কাজ কর, তুই তোর মামাকে বল, আজই বল।”
“কী বলব?”
অনন্যা বলল, “যাহ্ বাবা! কী বলব কী? এতক্ষণ ধরে কী বোঝালাম? বলবি, আমি ভাল স্কুলে পড়ব। হস্টেলে থাকব।”
দোপাটি আবার একটু হাসল। বলল, “আচ্ছা, এবার চলো, রোদ উঠেছে।”
অনন্যা দোপাটিকে নিয়ে সিঁড়ির দিকে হাঁটলে লাগল৷ মেয়েটা কি সত্যি মেনে নিল? মেনে নিলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। বাবাকে যখন দোপাটি নিজে থেকেই বলবে, আমি হস্টলেে থেকে পড়ব, তখন তো বাবা আর রাগ করতে পারবে না। অবশ্যই টাকাটা একটা বিষয়। সেটা সবাই মিলে বসে ঠিক করতে হবে। বাবা বলেছিল, দোপাটির আশ্রয় নেই। টাকা নেই কখনও বলেনি। অনন্যা শুনেছে, ওর মা মেয়ের খরচ বাবদ টাকা পাঠাতে চেয়েছিল। বাবাই নেয়নি। বাইরে কোথাও পড়ার প্রশ্ন উঠলে হয়তো টাকা নেওয়া যাবে। দোপাটির নিজের বাবাও তো নিশ্চয়ই কিছু রেখে গিয়েছেন। অন্তত ইনশিয়োরেন্স তো নিশ্চয়ই এক-আধটা ছিল। সে যা-ই হোক, দোপাটি রাজি হলে ওসব দেখা যাবে।
ছাদের চৌকাঠ টপকে নিজের ঘরে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল দোপাটি। নিজেকে যেন নিমেষের মধ্যে বদলে নিল। মুখ থেকে হাসি-হাসি ভাব উধাও। অনন্যার দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বলল, “এ-বাড়ি থেকে তাড়াতে চাইছ? জানতে পারি, আমি কী করেছি?”
অনন্যা থমকে দাঁড়ায়। মেয়েটা মত বদলাচ্ছে? এতক্ষণ তা হলে অভিনয় করল!
“এভাবে বলছিস কেন? তোকে তাড়াতে চাইব কেন?”
দোপাটি ঠোঁটের ফাঁকে ক্রূর হেসে বলল, “অনন্যাদি, এ-বাড়ির মানুষগুলোর মতো না হলেও, আমার বুদ্ধি একেবারে কিছু নয়, এটা মনে করা কি ঠিক হচ্ছে? আমাকে বোঝানোর পরামর্শ তোমাকে কে দিল? তুমি নিজেই ঠিক করলে? নাকি তোমার বুদ্ধিমান মা দিয়েছে?”
অনন্যা নিজেকে সামলাতে পারল না। চিৎকার করে উঠল, “শাট আপ অসভ্য মেয়ে। একটাও কথা বলবি না। এখন বুঝতে পারছি মা কেন নিজেকে সামলাতে পারে না। তোর মতো মেয়েকে মারাই উচিত।”
সকালের আলোয় দোপাটিকে যেন আরও নরম-সরম লাগছে। সে ঘরের ভিতর এক পা ঢুকে দরজার পাল্লা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। চিবিয়ে-চিবিয়ে বলল, “অনকেদিন মার সহ্য হয়ে গেল অনন্যাদি। এবার তোমার মাকে বলে দিও, আর সহ্য করব না। তা-ও নিজের মামি হলে একটা কথা ছিল। সম্পর্ক অনেক দূরের। কোন সাহসে উনি আমার গায়ে হাত দেন?”
অনন্যা স্তম্ভিত। এইটুকু মেয়ের এই সব কথা বলার সাহস হয় কী করে! সে চাপা গলায় বলল, “সম্পর্ক যখন নেই, এই বাড়িতে আছিস কেন? চলে গেলেই পারিস।”
দোপাটি গলা নামিয়ে ঠান্ডা ভাবে বলে, “কেন আছি, তোমার বাবাকে জিজ্ঞেস করো।”
অনন্যার বুকের ভিতরটা ধক করে উঠল। মেয়েটা এই সব বলার স্পর্ধা পাচ্ছে কোথা থেকে! নিজেকে অনেক কষ্ট করে সামলাল।
“তুমি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছ দোপাটি। এইটুকু মেয়ের মুখে এইসব কথা মানায় না।”
দোপাটি হিসহিস করে বলল, “তা হলে কী মানায় অনন্যাদি? তোমার মায়ের মতো বয়স হয়ে যাওয়ার পরও অন্যের মেয়ের ঘরে উঁকি মারা? সে কী ভাবে আছে, সেটা লুকিয়ে-লুকিয়ে দেখা?”
রাগে-অপমানে অনন্যার চোখ-মুখ লাল হয়ে যায়। সে রাগে কাঁপতে থাকে।
“চুপ কর। চুপ কর দোপাটি।”
দোপাটি একটু চুপ করে থাকে। তারপর বলে, “আমি ঘরে জামা-কাপড় খুলে থাকব না, জামা-কাপড় পরে থাকব, কার কী? তুমি ঘরে কীভাবে থাকো, তোমার মা উঁকি মেরে দেখতে যায়?”
“মা এমনই রাগেনি, তুই জামা-কাপড় না পরে জানলার সামনে দাঁড়িয়ে অসভ্যতা করছিলি।”
দোপাটি এক পা পিছিয়ে গিয়ে বলে, “আমি দেখছিলাম ফ্ল্যাটবাড়ি থেকে আমাকে কেউ দেখে কিনা। বেশ করছিলাম। আমি অসভ্য। কার কী? দেখা যাবে এ বাড়ির অন্য মানুষগুলো কেমন সভ্য। সব দেখা যাবে অনন্যাদি। আমি কথা দিচ্ছি, তোমাদের দেখিয়ে ছাড়ব। তখন তোমরা কাকে ধরে মারো দেখব। এখন যাও, আমাকে পড়তে দাও। ছোট স্কুল থেকেই আমি ভাল রেজ়াল্ট করব। আমাকে নিয়ে তোমাদের ভাবতে হবে না।”
ঘরে এসে খাটের উপর থম মেরে বসে রইল অনন্যা। সত্যি তার এবার ভয় করছে। দোপাটির মধ্যে এতদিন কুবুদ্ধির ব্যাপার দেখেছে। এখন মনে হচ্ছে, তার চেয়েও বেশি। সে উদ্ধত। সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। সঙ্গে রয়েছে হুমকি। এই মেয়ে ভয়ংকর কোনও ঘটনা ঘটাবে। কবে ঘটাবে?
বেশিদিন সময় লাগল না। তিনদিন পরেই ঘটনা ঘটল এবং সেই ঘটনা যে-কোনও আশঙ্কার চেয়েও ভয়াবহ।
আকাশ আজ একটু মেঘলা। পুরো মেঘলা নয়, অল্প-অল্প নীল আকাশ দেখা যাচ্ছে। বিকেলবেলার নীল আকাশ। কলকাতা থেকে একটু বেরিয়ে হাইওয়ের ধারে একটা ধাবায় বসে কফি খাচ্ছে অনন্যা আর দেবরূপ। একসময় ধাবা মানেই ছিল খাটিয়া পেতে বসার ব্যবস্থা। মোটা-মোটা রুটি আর তরকা। সঙ্গে আস্ত পেঁয়াজ, লঙ্কা। সেই সঙ্গে বড়-বড় কাচের গ্লাসে চা। আজকাল ধাবার চেহারা বদলে গিয়েছে। শহুরে রেস্তোরাঁর মতো চেয়ার, টেবিল, কফি, পকোড়া হয়েছে। অনন্যাকে নিয়ে সেরকমই একটা টেবিলে বসেছে দেবরূপ। টেবিলটা ঘরের বাইরে বের করা। মাথার উপর বড় রঙিন ছাতা। সামনে এক টুকরো বাগানও আছে। তার খানিক দূরে মসৃণ হাইওয়ে। হুশ-হাশ করে গাড়ি ছুটে যাচ্ছে। একটু চিন্তাভাবনা করা মানুষের এখানে বসলে অন্যরকম লাগবে। মনে হবে, বুঝি একটু দূর থেকে জীবনটাকে দেখা যাচ্ছে। যে জীবন ছুটছে। সে কোথা থেকে আসছে? যাচ্ছেই বা কোথায়? তা-ও জানা নেই। শুধু ছুটছে। সম্ভবত এই ক্লান্তিহীন দৌড় দেখার জন্যই ধাবাওয়ালা বাইরে বসার ব্যবস্থা রেখেছে।
দেবরূপ গাড়ি চালিয়ে অনন্যাকে নিয়ে এসেছে। অনন্যা আজ শাড়ি পরেছে। সবুজ রংয়ের শাড়ি। চুলে একটা আলতো খোঁপা। সেই খোঁপা কাঁধের উপর ভেঙে পড়েছে। তাকে বিষণ্ণ দেখাচ্ছে।
দেবরূপ গলা নামিয়ে বলল, “তোমার দায়িত্ব আমার অনন্যা। তুমি আমাকে বিশ্বাস করো।”
অনন্যা মলিন হেসে বলল, “কী দায়িত্ব নেবে?”
দেবরূপ ডান হাতটা বাড়িয়ে অনন্যার হাতের উপর রাখে। খানিকটা আবেগঘন গলায় বলে, “তোমাকে বিয়ে করব।”
অনন্যা হাত সরিয়ে নিয়ে বলে, “থাক ওসব প্রসঙ্গ। আবার তিক্ত কথা হবে।”
“কেন তিক্ত কথা হবে? আমি তো কখনও না বলিনি। ঝগড়ার সময় কে কী বলেছি তাই নিয়ে পড়ে থাকলে চলে? আমি যেমন বলেছি, তুমিও তো বলেছ।”
অনন্যা মুখ ফিরিয়ে বলল, “আচ্ছা, বলেছি।”
দেবরূপ বলল, “এই দেখো, আবার রাগ করে। আরে বাবা, আমি একটু সময় চেয়েছি। আরে, কেউ যদি কেরিয়ারটা ঠিকমতো তৈরি করতে চায়, সেটা কি তার অপরাধ? এই যুগে তো সেটাই ঠিক।”
দেবরূপ অফিস থেকে এসেছে বলে ফরমাল পোশাকে আছে। নীল-সাদা স্ট্রাইপ শার্টে তাকে সুন্দর দেখাচ্ছে। চোখে-মুখে অফিস করে আসার ক্লান্তি নেই। বরং মনে হচ্ছে, ফিরে গিয়ে আবার অফিসে ঢুকে পড়তে পারে। ছেলেটা আসলে কাজ ভালবাসে। অফিস থেকে বেরিয়ে দেবরূপ অনন্যাকে তুলে নিয়েছে। বেরোনোর সময় সীমন্তিকা নিচু গলায় বললেন, “দেবরূপ?” অনন্যা মুখে কিছু না বলে ঘাড় কাত করল।
“তোকে পেল লাগছে কেন? কেমন অসুস্থ মনে হচ্ছে। শরীর আবার খারাপ হল নাকি?”
অনন্যা হাসার চেষ্টা করে বলল, “ইট্স ওকে।”
সীমন্তিকা বললেন, “দেন ফাইন। টেক কেয়ার মাই সিস্টার।”
অনন্যা বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ।”
আগে বেরোনোর জন্য কর্ণফুলি সেনকে আজ আর বলতে হয়নি। মহিলা আজ অফিসেই আসেননি। দু’দিন ছুটি নিয়েছেন। তবে কর্ণফুলি সেন সম্পর্কে অনন্যা এখন অনেকটাই দুর্বল। মহিলা গোটা ঘটনাটা যেন ভুলে গিয়েছেন। তারপরেও অনেকবার মুখোমুখি হয়েছে অনন্যা। প্রত্যকেবারই মনে হয়েছে, এবার নিশ্চয়ই পুরনো কথা কিছু তুলবেন। উচ্চবাচ্যই করেননি। কোনওরকম কৌতূহল নেই। মহিলা কি নিজেকে বদলে ফেলেছেন?
গাড়িতে বসেই দেবরূপকে ঘটনাটা বলেছে অনন্যা। আজ সকালবলো নিজেই ‘কিট’ এনে প্রেগন্যান্সি টেস্ট করেছে। সেই পরীক্ষা বলেছে, ‘হ্যাঁ, তুমি মা হতে চলেছ।’ শহরে এই জিনিসটার খুব চল আছে। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার আগে অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়ে নেওয়া। এই পরীক্ষা যে চূড়ান্ত এমন নয়। তবুও… প্রাথমিক কৌতূহলটা মেটে। অনন্যা নিজের পাড়া থেকে খানিকটা দূরের ওষুধের দোকানে গিয়ে এই ‘কিট’ কিনেছে। পাড়ার সব দোকানই তো চেনা। ছোটবলো থেকে চেনে। সেই সব দোকান থেকে অবিবাহিত মেয়ে প্রেগন্যান্সি কিট কিনলে মুশকিল। পরীক্ষার ফলাফল দেখে প্রথম চোটে হতবাক হয়ে গিয়েছিল অনন্যা। পেটে বাচ্চা! সে বেশ কয়েকবার কিটের ভিতরে লেখা চিরকুটে নিয়মাবলি পড়ে দেখল। ভুল হচ্ছে না তো কোথাও? না, ভুল হচ্ছে না। তারপর কেন জানি বুক ফেটে কান্না এল অনন্যার। যা সে কখনও করে না, তা-ই করল। অনেকটা সময় ধরে নিজের ঘরের দরজা আটকে কাঁদল। কাঁদতে-কাঁদতে নিজেই অবাক হল। কী অদ্ভুত! সন্তান জন্মের বার্তা নারীকে আনন্দ দেয়। জীবনের পরম পাওয়া। অথচ সেই বার্তায় আজ সে কাঁদছে। এমন তো নয়, তাকে কেউ ধর্ষণ করেছে, সেই কারণে এই অযাচিত সন্তান। এমন তো নয়, তার আর দেবরূপের মিলন হয়েছে অনিচ্ছায়, দায়সারা ভাবে। দু’জনেই রাজি ছিল। রতিক্রিয়ায় দু’জনের অংশগ্রহণই ছিল সক্রিয়। তাতে ভালবাসাও ছিল। দেবরূপের কামনা উগ্র হলেও তার দিক থেকে তো ফাঁকি থাকেনি। তারপরেও কেন চোখে জল আসছে?
চোখের জলেই অনন্যা নিজেকে শান্ত করে। মনে-মনে খানিকটা বকেও নিজেকে। কী ছেলেমানুষি করছে? কান্নাকাটির কী হয়েছে! বিপদ তো হয়নি কিছুই। এই ঘটনা সামলানোর বহু উপায় আছে। তা হলে? দেবরূপের বদলে যাওয়া, শুধু ‘আমি, আমি’ বলে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়া, মনের দিক থেকে ধীরে-ধীরে দূরত্ব বেড়ে যাওয়া কি আজ আবার নতুন করে আঘাত দিল? অনন্যা বাথরুমে গিয়ে শাওয়ার খুলে নগ্ন হয়ে দাঁড়ায়। ধুয়ে নিতে চেষ্টা করে যাবতীয় কান্না ও অপমান। তার শরীর বেয়ে জল নামে। তারা ফিসফিস করে বলতে থাকে, ‘ভাল থেকো, ভাল থেকো, ভাল থেকো…’
দেবরূপের সঙ্গে প্রেমের শুরুটাও অদ্ভুত। অনন্যা তখন সব ক্ষেত্রেই বুদ্ধিতে ঝকঝকে, কিন্তু পুরুষ জাতটি সম্পর্কে প্রাচীন আমলের একটা ধারণা ছিল। বিভিন্ন অভিজ্ঞতা এবং বান্ধবীদের মুখে গল্প শুনে-শুনে তার বিশ্বাস হয়েছিল কলেজের গম্ভীর মাস্টারমশাই এবং বাবা, দাদার মতো কয়কেজন ব্যতিক্রম ছাড়া, বেশিরভাগ পুরুষই মোটের উপর গোলমেলে। তাদের একটাই কাজ, মেয়ে দেখলে গায়ে পড়ার জন্য ছুকছুক করা। গায়ে যদি পুরোপুরি না পড়া যায় তা হলে যে কোনও ছলছুতোতে গায়ে হাত দিতে হবে। এই ব্যাপারে ভদ্রজন বা অভদ্রজনে কোনও ফারাক নেই। সামাজিক অবস্থান বিচারে এক-একজনের ‘ছুকছুকানি’ এক-একরকম। নানা ধরনের মোড়ক দিয়ে বাঁধা থাকে। অনন্যার সৌন্দর্যে একই সঙ্গে স্নিগ্ধ এবং আদিম ভাব থাকায়, তার প্রতি পুরুষমানুষের মনোযোগ বেশি। এটা একটা সময় পর্যন্ত নিশ্চয়ই অনন্যাকে ক্লান্ত এবং বিরক্ত করেছিল। এই মনোযোগ ব্যাপারটাকে কখনওই সে না পেরেছে উপভোগ করতে, না পেরেছে অহংকারের বিষয় করে তুলতে। স্কুল কলেজের কত বান্ধবীই তো পুরুষের নজর নিয়ে গর্ব করত। অর্যমা বলত, “আমার বুক তেমন বলেই তো ছেলেরা দেখে। কেউ যদি না দেখত আমি তো দুঃখই পেতাম। ভাবতাম, হায় রে! এই বুক লইয়া তবে আমি কী করিব?” এই কথা বলত আর হাসতে-হাসতে গড়িয়ে পড়ত।
তীর্ণা ছিল আর এককাঠি বেশি। বলত, “পুরুষ মানুষের একটু-আধটু ছোঁয়া আমার বাপু ভালই লাগে। আমার শরীর তো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে না। চরিত্র নষ্ট হয়, শরীর হয় না,” তারপর নাটুকে কায়দায় হাত ছড়িয়ে বলত, “গল্প-উপন্যাসে পড়িসনি, নারীশরীর পুরুষ ছাড়া যে ডুকরে মরে।”
সুজাশ্রী বলত, “যে যা-ই বলুক আমার সাজগোজ কিন্তু ছেলেদের জন্যই। আমার মনে হয় সব মেয়েদেরই তাই। পার্টিতে, অনুষ্ঠানে গেলে তোরা যখন বলিস, ড্রেসটা কী সুন্দর! জুয়েলারিতে তোকে দারুণ মানিয়েছে, তোকে খুব মিষ্টি লাগছে, শুনতে ভাল লাগে, কিন্তু কোনও পুরুষ ড্যাবডেবিয়ে না তাকালে মনে হয়, সব বৃথা।”
বান্ধবীরা যা-ই বলুক, অনন্যা তার পুরনো বিশ্বাস ধরেই বসে ছিল। এমনকী কলেজ-ইউনিভার্সিটির বেশিরভাগ ছেলেকেও পছন্দ ছিল না তার। হাতে গোনা কয়কেজন ছাড়া কাউকে সে বিশেষ পাত্তা দিত না। মনে হত, কতগুলো ছেলে নানা কৌশলে মেয়েদের কাছে অবিরত ঘেঁষবার চেষ্টা করছে।
পরে অবশ্য অনন্যার ধারণা ভাঙে। কর্মজীবনে এবং তার বাইরে এমন বহু পুরুষ মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়েছে তারা একেবারে অন্যরকম। তখন পুরনো কথা মনে পড়লে লজ্জা হত। মনে হত এতদিন একশো বছর আগের মন আঁকড়ে বসে ছিল। ভুল ভাঙার আগেই অবশ্য তার সঙ্গে দেবরূপের দেখা। সেটা ছিল এক শোকের পরিবেশ। অফিস কলিগ অনসূয়ার বাবা মারা গিয়েছেন। ভদ্রলোকের বয়সও হয়েছিল অনেক। ছিলেন স্কুলের প্রধানশিক্ষক। কর্মজীবন শেষ হওয়ার পর নানা ধরনের সামাজিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়েছিলেন। অসহায়, দরিদ্র ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য কাজ করেছেন বিস্তর। অনসূয়া আর তার দাদা প্রথাগত শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে না গিয়ে একটা স্মরণসভার আয়োজন করে। সেই স্মরণসভায় অফিসের কয়কেজনের সঙ্গে অনন্যাও গিয়েছিল। সাদা ফুলে ঢাকা একফালি মঞ্চে উঠে কেউ কিছু বলছিল, কেউ গান করছিল। একসময় সুদর্শন একটি যুবক জিন্স এবং টি-শার্ট পরে মঞ্চে উঠে আসে, এবং অনভ্যস্ত গলায় আবৃত্তি শুরু করে,
“গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা / কূলে একা বসে আছি নাহি ভরসা…”
শ্রোতারা উশখুশ করে উঠল। অনসূয়ার বাবার স্মরণসভায় এই কবিতা কেন? অনন্যাও একটু অবাক হল। অন্য কোনও কবিতা কি ছিল না? এই তো খানিক আগে একজন বই দেখে পড়ে গেল রবীন্দ্রনাথেরই ‘দুঃসময়’ কবিতা। ‘যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে…,’ বলছিলও খুব দরদ দিয়ে। শুনে কষ্ট হচ্ছিল। সেই জায়গায় সোনার তরী! তা-ও ছোট কোনও ছেলে-মেয়ে বললে মানে ছিল। ছোটরা কী বলছে তা নিয়ে অত মাথা ঘামানোর কিছু নেই। কিন্তু এ তো রীতিমতো একজন যুবক। আর বলাটাও মোটে ভাল নয়। সেই ছেলে এরপর আরও একটা কীর্তি করল। ‘ওগো তুমি কোথা যাও কোন বিদেশে’ লাইনের পর মাথা চুলকে বিড়বিড় করতে লাগল! ভুলে গিয়েছে নাকি? হ্যাঁ, ভুলেই গিয়েছে। পরিবেশ সম্পূর্ণ অন্যরকম, তা সত্ত্বেও স্টেজে উঠে কবিতা ভুলে যাওয়াটা সবসময়ই একটা হাসির ঘটনা। কেউ নড়েচড়ে বসল, কেউ পাশের জনের সঙ্গে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। কেউ আবার সত্যি-সত্যি মুখে হাত চাপা দিয়ে হাসি গোপন করল। তার মধ্যে সামনে বসে থাকা অনন্যাও ছিল। যতই হোক স্মরণসভা বলে কথা। সেখানে হাসা যায় না। কিন্তু ছেলেটি স্মিত হেসে এবার যা বলল তাতে সবাই স্তব্ধ।
“নমস্কার। আমার নাম দেবরূপ। না, আমি কবিতাটি ভুলিনি। ভান করলাম ভুলে যাওয়ার। আমি আপনাদের রিঅ্যাকশন দেখতে চাইছিলাম। স্টেজে কবিতা ভুলে গেলে সবাই হাসে। আজ শোকের পরিবেশ, তারপরেও আপনাদের কারও-কারও মুখে হাসি চলে এসেছে। আজ আমরা যে-মানুষটার জন্য এখানে এসেছি তিনি একসময় ছিলেন আমার স্কুলের প্রধান শিক্ষক। পরে অবশ্য আমি স্কুল বদল করি। যা-ই হোক, একবার সেই স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে আমি এই ‘সোনার তরী’ কবিতাটি বলতে উঠি এবং ভুলে যাই। ঠিক আজ যেমন ভুলে গিয়েছি। দর্শকরা হেসে উঠল। আমিও কেঁদে ফেললাম। হেডমাস্টারমশাই স্টেজে উঠে এসে মাইক হাতে নিয়ে বললেন, ‘আপনারা যাঁরা হাসলেন তাঁদের লজ্জা পাওয়া উচিত। সবার সামনে দাঁড়িয়ে কিছু বলতে আসাটাই গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখা বা ভুলে যাওয়াটা নয়। ও তো পরীক্ষা দিতে আসেনি।’ ঘটনা এখানেই শেষ নয়। পরে হেডমাস্টারমশাই আমাকে একটা বই উপহার দিয়েছিলেন। সেই বইয়ের নাম ‘সোনার তরী’। মাস্টারমশাইয়ের স্মরণসভায় ছুটে এসেছি। আমি মোটেও আবৃত্তি করতে পারি না, তারপরেও একরকম জোর করেই সেদিনের কবিতার খানিকটা বলেই তাঁর সেই ভালবাসাকে শ্রদ্ধা জানালাম।”