সবাই খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। ছেলেটি বাকি অনুষ্ঠান কিছুক্ষণ শোনার পর হল থেকে বেরিয়ে যায়। অনন্যা এতটাই লজ্জিত এবং মুগ্ধ হয়ে পড়েছিল যে সে নিজের জায়গা ছেড়ে ছুটে যায়। হলের বাইরে গিয়ে দেবরূপকে ধরে। সে সিগারেট খাচ্ছিল।
“প্লিজ় কিছু মনে করবেন না।”
দেবরূপ তাচ্ছিল্যের চোখে তাকিয়ে বলে, “কী মনে করব না বলুন তো?”
অনন্যা নিচু গলায় বলল, “আমি ভিতরে ছিলাম। সামনে বসেছিলাম… আপনার কবিতা ভুলে যাওয়া দেখে…”
দেবরূপ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, “হাসি লুকিয়েছেন তো? স্বাভাবিক। অ্যাভারেজ লোকজন এমনই করে। আমাদের হেডমাস্টারমশাই অ্যাভারেজ ছিলেন না। সেটা প্রমাণ করার জন্যই আমি মাঝপথে কবিতাটি ভুলেছি। নাথিং মোর।”
অনন্যা অস্ফুটে বলল, “সরি।”
দেবরূপ খানিকটা রুক্ষ ভাবে বলল, “নো নিড। আমি এসব পাত্তা দিই না।”
অনন্যা যেমন অবাক হল, তেমন হল হালকা অপমানিতও। এতদিনের অভ্যেস বলছে, ছেলেরা তাকে দেখলে বেশি করে ভাব করতে চায়। কাছে সরে আসে। এই ছেলে তো একেবারে অন্যরকম। শুধু অন্যরকম নয়, তাকে হেলাফেলাও করছে! অনন্যা সেদিন স্মরণসভার সঙ্গে খাপ খাইয়ে শাড়ি পরেছিল। সেই শাড়ি উজ্জ্বল নয়। সাদার উপর কালো দিয়ে কাজ। এতে তাকে আরও সুন্দর লাগছিল। দেবরূপ সেদিকে ঘুরেও তাকাল না।
অনন্যা বলল, “সে আপনার বিষয়, আমার বলাটা উচিত মনে হল, তাই উঠে এসে আপনাকে বললাম।”
দেবরূপ একইরকম ভাবে পাত্তা না দিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘোরাল। ফসফস করে ধোঁয়া ছাড়তে লাগল। ভাবটা হল, ‘অনেক হয়েছে। আপনি আসুন। এবার হাসি পেল অনন্যার। লোকটা আচ্ছা ছেলেমানুষ তো!
“আমি আপনার মোবাইল নম্বরটা পেতে পারি?”
দেবরূপ মুখ ঘুরিয়ে, ভুরু কুঁচকে বলল, “কেন?”
অনন্যা মুখ টিপে হেসে বলল, “না, তেমন কোনও কারণ নয়। আসলে, আপনি… আপনি তো এখন খুব রেগে আছেন। আপনার রাগ কমলে আমি ফোন করে না হয় একবার দুঃখপ্রকাশ করতাম।”
দেবরূপ সিগারেটের টুকরো মাটিতে ফেলে এবার ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল, “ম্যাডাম, আপনি অনেকক্ষণ থেকে বিরক্ত করছেন। এমন কিছু ঘটেনি যে আপনাকে এতবার ক্ষমা চাইতে হবে। সাধারণ মানুষরা যেমন বোকার মতো আচরণ করে, আপনি তেমনটাই করছেন। এই নিয়ে আমি মাথা ঘামাচ্ছি না। আপনি এবার যেতে পারেন। আমিও চললাম।”
অনন্যার খুব মজা লাগল। এমন পুরুষমানুষ সে খুব একটা দেখেছে বলে মনে পড়ছে না। একজন সুন্দরীকে শুধু অপমান করছে না, নিজেকে অসাধারণ বলে গর্ব করছে।
“আমি কি আমার নামটা বলতে পারি?”
দেবরূপ চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে বলল, “কোনও প্রয়োজন নেই।”
অনন্যা শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “আচ্ছা চললাম। তবে আপনার সঙ্গে আমার শিগগিরই কথা হবে।”
অনসূয়ার কাছে খোঁজ নিয়ে দেবরূপের পরিচয়, ফোন নম্বর পেতে বেশি সময় লাগেনি অনন্যার। ছেলেটা অনসূয়ার দাদার বন্ধু। একরকম জেদ করে লেগেছিল সে। সঙ্গে খানিকটা প্রতিশোধ নেওয়ার ছেলেমানুষি বাসনা। পুরুষমানুষ তাচ্ছিল্য করলে কেমন হতে পারে তার হালকা আঁচ পেয়েছিল সেই প্রথম। ঘটনার তিনদিনের মাথায় ফোন করেছিল অনন্যা। রাত তখন দশটাই হবে। নাকি একটু বেশিই ছিল?
“কেমন আছেন?”
ওপাশ থেকে কড়া গলায় দেবরূপ বলেছিল, “আপনি কে বলছেন?”
অনন্যা বলেছিল, “নাম বললে চিনবেন কী করে? সেদিন নাম শুনতেই চাইলেন না। শুধুই ঝগড়া করলেন।”
দেবরূপ এবার খানিকটা থতমত খেয়ে বলল, “ঝগড়া! আপনি কে বলছেন বলুন তো! নাম বলুন।”
অনন্যা হেসে বলল, “গুড। এতক্ষণে আপনি আমার নাম জানতে চাইলেন। আমি অনন্যা। অনন্যা বোস। মাস্টারমশাইয়ের স্মরণসভায় আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। আপনি ‘সোনার তরী’ কবিতা বলেছিলেন। পরে আমাকে যথেষ্ট অপমান করেন।”
দেবরূপ একটু চুপ করে থেকে বলল, “দুঃখিত। সেদিন মাস্টারমশাইয়ের জন্য খানিকটা ডিস্টার্বড হয়ে ছিলাম। মানুষটা সত্যি অন্যরকম ছিলেন।”
অনন্যা বলল, “আমি নিজের আচরণের জন্য দুঃখপ্রকাশ করছি। সেদিন ওভাবে রিঅ্যাক্ট করা ঠিক হয়নি। সত্যিই আমরা সাধারণ। যাক, সব মিটে গেল। আপনারও মাথা ঠান্ডা হয়েছে। এবার ফোন ছাড়লাম।” দেবরূপ চাপা গলায় বলল, “না, এবার ছাড়বেন না।”
ব্যস। তারপরেই দেখা করা, হালকা গল্পগুজব থেকে ঘনিষ্ঠতা। আগে ফোনে কথা বলে সময় ঠিক করে নিত। যেমন কালই ঠিক ছিল, আজ দেখা হবে। দেবরূপই ফোন করে সময় চেয়েছিল।
“অফিসের পর তোমাকে তুলে নেব।”
“কোথায় যাব?” শান্তভাবে জানতে চেয়েছিল অনন্যা।
দেবরূপ ঠাট্টাচ্ছলে বলেছিল, “বাপ রে, গলা কী গম্ভীর! যেন এবার থেকে কোথায় যাচ্ছি না জেনে আমার সঙ্গে বেরোবেই না। আরে বাবা, চিন্তা নেই। গেস্ট হাউজ় যাব না।”
অনন্যা বলল, “আমি সেকথা বলতে চাইনি।”
দেবরূপ হেসেই বলল, “আচ্ছা বলতে চাওনি। হয়েছে তো? আর ঝগড়া নয়। স্রেফ গাড়ি চড়ে ঘুরব। ঘণ্টা দেড়-দু’-একের ড্রাইভও হতে পারে। তারপর হাইওয়ের ধারের কোনও ধাবায় বসে খাওয়াদাওয়া করব।”
অনন্যা বলল, “ফিরতে অনেকটা রাত হয়ে যাবে।”
“হলে হবে। তুমি তো আমার সঙ্গে থাকবে। এমন করে বলছ যেন আগে কখনও তুমি আমার সঙ্গে লং ড্রাইভে যাওনি এবং দেরি করে ফেরোনি। অফিস থেকে একটু আগে বেরিয়ো।”
অনন্যা অবাক হয়ে বলল, “আর তোমার অফিস? নাকি কাল বলবে, সরি যাওয়া হল না, মিটিং পড়ে গিয়েছে?” একটু থামল অনন্যা। বলল, “হয়তো তুমি জানো কাল মিটিং পড়বেই। বেরোনো হবে না, তাই আজ এত সহজে প্ল্যান করছ?”
দেবরূপ বলল, “উফ, ইট্স টু মাচ অনন্যা। তুমি মাথা থেকে সেদিনের ঝগড়াটা বের করতে পারছ না। প্লিজ়, এসব বাদ দাও। কাল কথা বললে তোমার মাথা ঠান্ডা হবে।”
বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে ছেড়ে ন্যাশনাল হাইওয়েতে ওঠার পর দেবরূপ মুখ ফিরিয়ে হেসে বলল, “এবার বলো, তোমার অভিযোগ শুনি। তবে এমন কিছু বোলো না যাতে হাত কেঁপে যায়। হাইওয়েতে হাত কাঁপলে মুশকিল।”
অনন্যা একটু চুপ করে থেকে সহজ ভাবে বলল, “দেবরূপ, আমার মনে হচ্ছে,আমি প্রেগন্যান্ট।”
দেবরূপের সত্যি হাত কেঁপে গেল। সে গতি কমিয়ে গাড়ি রাস্তার পাশে নিয়ে গেল। অনন্যা ঠোঁটের কোণে হেসে বলল, “ঘাবড়ে গেলে?”
দেবরূপ বলল, “না না, তুমি ঠিক কী বলছ আমি বুঝতে পারছিনা অনন্যা।”
অনন্যা নিচু গলায় বলল, “সেদিনই তোমাকে বলেছিলাম, আমি প্রোটেকশন নিইনি। ভয় করছে।”
দেবরূপ চিন্তিত গলায় বলল, “তা বলে এত তাড়াতাড়ি?”
“তাড়াতাড়ি বা দেরির বিষয় নয় এটা। মেয়েদের শরীরের মেকানিজ়মটা অন্যরকম। পিরিয়ডের কত আগে-পরে ঘটনা ঘটেছে তার উপর সবটা নির্ভর করে। এমনটাও হতে পারে গতবারে কোনও ভুল হয়েছিল। হয়তো সেই সময় প্রোটেকশন ডিড নট ওয়র্ক প্রপারলি।”
দেবরূপ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আর ইউ শিয়োর?”
অনন্যা দেবরূপের উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠার মাত্রাটা বুঝতে চাইছিল। কতটা ঘাবড়ে গেল ছেলেটা? মনে হচ্ছে, বেশ অনেকটাই। এরকম একটা দুশ্চিন্তার সময়ও তার হাসি পলে। মুচকি হেসে বলল, “অত টেনশন করতে হবে না।”
দেবরূপ বিরক্ত ভাবে বলল, “উফ্ অনন্যা। এসব হাসি-ঠাট্টার বিষয় নয়। ঘটনা ঠিক কিনা বলো।” অনন্যা জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। শহর ছেড়ে ধানখেত শুরু হয়েছে। সূর্য ডুবে যাওয়া লালচে আলো সেই সবুজ ধানের উপর পড়ছে। একটা সুন্দর আর রহস্যময় রং তৈরি হয়েছে।
“কী হল, বললে না তো? তুমি নিশ্চিত অনন্যা?”
অনন্যার মন খারাপ হয়ে গেল। দেবরূপ কী শুনতে চাইছে? নিশ্চিত নয়? তার উদ্বেগ সেকথাই বলছে।
“না, আমি শিয়োর নই। এই টেস্ট বাড়িতে করা হয়েছে। ডক্টরের কাছে গেলে শিয়োর হওয়া যাবে। ল্যাব থেকে টেস্ট করাতে হবে। তুমি এত ভেবো না। তা ছাড়া… তা ছাড়া সত্যি যদি কিছু হয়েও থাকে, সেটা নষ্ট করে ফেলতে…”
দেবরূপ যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। বলল, “সেটাই ঠিক হবে অনন্যা। এই সব খুচরো ঝামলো চুকিয়ে ফলোই ভাল। বিচক্ষণতার কাজ হবে।”
অনন্যা মৃদু হেসে বলল, “আমি জানি বিচক্ষণতার কাজ হবে।”
দেবরূপ টেবিলের উপর ঝুঁকে পড়ে বলল, “তুমি রাগ করছ? দেখো অনন্যা, যদি কালও আমরা বিয়ে করি, আমরা নিশ্চয়ই এত তাড়াহুড়ো করে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ফেঁসে যাব না। ক’বছর হাত-পা ছড়িয়ে এনজয় করব। কাজ করব, ঘুরব, প্রেম করব। তা-ই না?”
অনন্যা শান্ত গলায় বলল, “হ্যাঁ, তা-ই। রাগ করব কেন? বিয়ের আগে ভাবী স্বামীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়া যায়, কিন্তু পেটে বাচ্চা নিয়ে ঘোরা যায় না।”
দেবরূপ বলল, “এই তো তোমার রাগের কথা অনন্যা। আচ্ছা, আমি তোমার রাগ দূর করছি। অফিসে আমার সেটল্ড হতে আর দুটো মাস। মে বি আরও কম। আমার প্রোমোশন হচ্ছেই। স্যালারি এবং পার্কসের প্যাকেজও হেভি। আমাদের জীবন অনেক স্মুদ হয়ে যাবে। তবে একটা জিনিসও আমি ঠিক করে নিয়েছি অনন্যা। খুব বেশি হলে দুই থেকে আড়াই মাস আমি অপেক্ষা করব। তার মধ্যে যদি কিছু হয় তো ভাল, নইলে আমি কোম্পানি চেঞ্জ করব এবং বিয়ে করব। সো গেট রেডি। এবার বলো, আমি কবে তোমার বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলব,” একটু থামল দেবরূপ। হেসে বলল, “কি, এবার খুশি তো?”
অনন্যা টেবিলের উপর থেকে ব্যাগটা টেনে নিয়ে বলল, “হ্যাঁ, খুশি। চলো এবার উঠি। ফিরতে দেরি হয়ে যাবে।”
ফেরার পথে গাড়ি চালাতে-চালাতে দেবরূপ অনর্গল কথা বলে গিয়েছে। বেশিরভাগই তার অফিস, তার কাজকর্মের কথা। প্রোমোশনের দিকে এগোচ্ছে বলে কলিগরা কীভাবে হিংসার চোখে তাকাচ্ছে, সেকথাও বলল। অনন্যা মূলত ‘হুঁ’, ‘হাঁ’ করে গেল। বাড়ির কাছাকাছি এসে একটা হাত স্টিয়ারিং থেকে নামিয়ে অনন্যার থাইয়ের উপর রাখল দেবরূপ। বলল, “তুমি কোন ক্লিনিকে যাবে? আমি কিন্তু তোমার সঙ্গে থাকব।”
দেবরূপের স্পর্শে শরীরটা ছ্যাঁত করে উঠল অনন্যার। হাতটা সরিয়ে দিতে ইচ্ছে করলেও নিজেকে সামলে নিল সে। বলল, “চিন্তা কোরো না। ও অনেক আছে। ক্লিনিকে না গিয়ে শুধু মেডিসিনেও এখন অ্যাবরশন করা যায়। আগে ডক্টরের কাছে যাই৷”
“ডক্টরের কাছে কবে যাবে? আমি সঙ্গে যাব।”
অনন্যা শুকনো হেসে বলল, “গিয়ে কী বলবে? ডক্টর, আমি এই সন্তানের পিতা, কিন্তু পরিস্থিতি এমন যে তাকে আমি বাবা ডাকার সুযোগ দিতে পারছি না। আপনি একে ডেস্ট্রয় করে ফেলুন?”
দেবরূপ বলল, “এই তো তুমি সব দোষ আমার ঘাড়ে ঠলেছ। এমন ভাবে বলছ এই ঘটনার জন্য শুধু আমিই দায়ী। তোমার কোনও রোল নেই। আর এই যুগে এটা কোনও ইসু হল? বিয়ের পরেও আর্লি বাচ্চা-কাচ্চা কেউ নেয় না। জীবনের সবকিছুর একটা প্ল্যানিং থাকে। তুমি আমাদের ঠাকুরমা-দিদিমাদের মতো বিহেভ করছ অনন্যা।”
অনন্যা কিছু একটা বলতে গিয়ে নিজেকে সামলাল। বলল, “রাগ করছ কেন? ঠাট্টা করছিলাম।”
দেবরূপ অনন্যার বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড় করাল। বাইরে অন্ধকার। গাড়ির ভিতরও তাই। দেবরূপ হাত বাড়িয়ে অনন্যার ডান হাতটা ধরে বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ। আমার পাশে যে তুমি সবসময় আছ, সেটা আমি জানি। তুমি ঝামলো চুকিয়ে ফেলো। তারপরই আমি তোমাদের বাড়িতে আসার জন্য একটা ডেট করে নিচ্ছি। গুড নাইট। রাতে ফোন করছি ডার্লিং।”
অনন্যা গাড়ি থেকে নেমে ধীর পায়ে গলি দিয়ে হাঁটতে লাগল। তার হাসি পাচ্ছে। আজ কেরিয়ারের কথা বলে লেকচার দিলেও এই দেবরূপই এক সময় তাকে চাকরি বদলাতে দেয়নি। কাজটা ভাল ছিল। বেতন বেশি তো বটেই, এক বছরের মধ্যেই মুম্বইতে ট্রান্সফার করে দেবে বলেছিল। দেবরূপ ‘রে রে’ করে উঠেছিল।
“খেপেছ নাকি? সরকারি চাকরি ছেড়ে কেউ যায়?”
অনন্যা বলেছিল, “সরকারি বলছ কেন? আধা সরকারি বলো।”
দেবরূপ বলল, “ওই একই হল। কাজকর্ম তো সবই সরকার থেকে পাও। ইচ্ছে করলে বাইরের কাজও করতে পার। এই অফিস থেকে কেউ বেরিয়ে যায়!”
অনন্যা বলে, “এখানে তো উন্নতির কোনও ব্যাপার নেই। সেভাবে নিজের স্কিলও দেখাতে পারি না। বেতনও আহামরি কিছু নয়। এত লেখাপড়া শিখে শুধুই প্রজেক্ট নিয়ে ঘাঁটব?”
দেবরূপ বলল, “কী এসে যায়? নিশ্চিন্তে মাইনে পাচ্ছ।”
“ওরা কিন্তু অফার দিচ্ছে। একবার বাইরে যেতে পারলে স্কোপ আরও খুলবে।”
দেবরূপ বলল, “পাগল! তোমার বাইরে যাওয়ার কোনও প্রশ্নই উঠছে না।”
অনন্যা হেসে বলেছিল, “আর যদি তোমাকে যেতে হয়? তখন?”
“সে তখনকার কথা তখন দেখা যাবে। আমি বাইরে কোথাও গেলে এতটাই টাকা-পয়সা করব যে তোমাকে কাজকর্মের কথা ভাবতে হবে না। এখন চেপে বসে থাকো তো দেখি।”
অনন্যা সেদিন বুঝেছিল, কিন্তু এত কঠিন ভাবে নয়। কেরিয়ার বলতে দেবরূপ বোঝে শুধু নিজেরটুকুই। বাড়ির গেট খুলতে গেলেই পাশ থেকে কেউ বলে উঠল, “দেবরূপদা তোমাকে গাড়িতে করে দিয়ে গেল, না?”
হঠাৎ হালকা কথায় চমকে মুখ ফেরাল অনন্যা। দোপাটি পাশে দাঁড়িয়ে হাসছে। কে বলবে এই মেয়ে দু’দিন আগে কী কুৎসিত ব্যবহার করেছে! বাড়িতে অনন্যা তাকে এড়িয়ে চলছিল। যেটুকু কথা না বললে নয়। দোপাটিও আজকাল নিজের ঘর থেকে বিশেষ বের হয় না। উপরেই থাকে। খাওয়ার সময় রান্নাঘর থেকে নিজের খাবার নিয়ে উপরে চলে যায়। এখন এমনভাবে কথা বলছে যেন কখনও কিছুই হয়নি। মেয়েটার কি লজ্জা- শরম বলে কিছু নেই? নেই যে বোঝাই যাচ্ছে।
“তুই কোথা থেকে?”
দোপাটি আবার হেসে বলল, “ওমা আমি তো তোমার পিছু-পিছু হাঁটছিলাম। তুমি কী আস্তে-আস্তে হাঁটছিলে! বাপ রে! মনে হচ্ছিল পা টিপে-টিপে।”
অনন্যা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল। গেট খুলে ভিতরে পা দিয়ে বলল, “ডাকলি না কেন?”
দোপাটি গলায় মজার ভাব এনে বলল, “সে কী গো! ডাকব কী! দেখলাম গলির মোড়ে একটা গাড়ি থেকে নামলে। তাই তো জিজ্ঞেস করলাম, দেবরূপদার গাড়ি? ছোট্ট কিন্তু কী সুন্দর গাড়ি গো! আমাকে একদিন চড়াতে হবে।”
এক টুকরো বাগান পেরিয়ে অনন্যা সদর দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। ডোরবেল টিপল। মেয়েটি সত্যি অদ্ভুত অভিনয়ও করতে পারে। এইটুকু বয়সে কত ক্ষমতা! কে জানে হয়তো অপরাধের জন্য অভিনয়ের ব্যাপারটা নিজে থেকেই ভিতরে এসে যায়।
“কোথায় গিয়েছিলি?”
দোপাটি বিনুনি দুলিয়ে বলল, “টিউশন। তোমরা তো আমাকে পড়াবে না, তাই বাইরেই পড়া বুঝতে যেতে হয়।”
ঘরে ঢুকতে-ঢুকতে অনন্যা হালকা ব্যঙ্গের ঢংয়ে বলল, “ভালই করিস। আমরা লেখাপড়ার কী জানি? যা জানি তাতে তোর চলবে না। তুই হলি ভাল মেয়ে।”
দোপাটি হেসে বলল, “ঠিক বলেছ অনন্যাদি। আমি ভাল মেয়ে। আমি সব কাজ ভাল করি। যাই উপরে যাই,” কথা শেষ করে সিঁড়ি দিয়ে লাফাতে-লাফাতে উপরে ওঠে দোপাটি। মাঝখানে থমকে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরল। একগাল হেসে বলল, “অনন্যাদি, আমার গাড়ি চড়ার কথাটা দেবরূপদাকে বলতে ভুলো না যেন।”
অনন্যা থমকে দাঁড়াল। তার কেমন যেন মনে হতে লাগল, দোপাটি খুব দ্রুত বড় কোনও সর্বনাশ ঘটানোর দিকে যাচ্ছে। মেয়েটা যেন আজ বেশি খুশি। সর্বনাশটা কী? সে কি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেবে? এই মেয়ের কাজের ধারা সেকথা বলে না। সে কোনও জটিল অপরাধ করবে। যে অপরাধ করে সে তৃপ্তি পাবে। অনন্যার এখন দোপাটিকে মনে হচ্ছে, নিয়তির মতো। যে নিয়তি বাইরে থাকে না, বসে থাকে মানুষের ভিতরেই। গুটিসুটি মেরে অপেক্ষা করে। কখন ভাল কিছুকে নষ্ট করা যায়, অপবিত্র করা যায়। সাদা পাতায় কালি ঢেলে দেওয়ার মতো। দোপাটি হাতে কালি নিয়ে বসে আছে।
রাত দুটোর কিছু বেশি হবে। জল তেষ্টায় অঞ্জলির ঘুম ভেঙে যায়। তিনি খাট থেকে নামেন। রোজ রাতেই ঘরে এক বোতল জল রাখেন অঞ্জলি। কিন্তু আজ আলো জ্বেলে দেখেন, জল রাখতে ভুলে গিয়েছেন। বিশ্বনাথ বসু ঘুমে আচ্ছন্ন। হালকা নাকও ডাকছে। বালিশের পাশে, খাওয়ার সময় ছেলের ভুল করে ফেলে যাওয়া বই। বইটি চটি আকারের। বিষয়টি বড় অদ্ভুত। তন্ত্রসাধনা। ফিজ়িক্সের মাস্টার তন্ত্রসাধনার বই কেন পড়বে? নাকি যে পড়ে সে সবই পড়ে? এইসব ভাবতে-ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছেন বিশ্বনাথবাবু।
অঞ্জলি নিঃশব্দ পায়ে ঘরের দরজা খুলে বাইরে এলেন। ডানদিকে রান্নাঘরে জল আছে। ঘরটা অন্ধকার আবার অন্ধকারও নয়। কোথাও থেকে একটা আলো আসছে। অঞ্জলি আলো না জ্বেলেই রান্নাঘরে যান, জল খান। বেরিয়ে আসার পরই মৃদু একটা আওয়াজ কানে আসে। কারও গলা না? মালব্য? না, এ তো মেয়ের গলা। অনন্যা কি ফোনে কারও সঙ্গে কথা বলছে? এত রাতে!হতে পারে। আজকাল রাতের আগে ছেলেমেয়েরা কথা বলার সুযোগ পায় না। নিশ্চয়ই দেবরূপ। নিশ্চিন্তে এক পা এগিয়েই থমকে যান অঞ্জলি। দোতলায় কোনও কিশোরী যেন ফিসফিস করছে! দোপাটি! শরীর কেঁপে ওঠে অঞ্জলির। এত রাতে দোপাটি দোতলায় কী করছে? সে কি অনন্যার কাছে কিছু চাইতে এসেছে? হঠাৎ শরীর খারাপ হয়েছে নাকি? নিজেকে কোনওরকমে সামলে সিঁড়ি দিয়ে পা টিপে-টিপে উঠতে থাকেন অঞ্জলি। প্রথম ল্যান্ডিং থেকেই উপরের ঘরদুটো চোখে পড়ে। বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে। তিনি সিঁড়ির পাশটা ধরে ফেলেন। অনন্যার ঘর বন্ধ। মালব্যর ঘরের দরজায় সামান্য ফাঁক। সেখান থেকে আলো এবং দোপাটির গলা ভেসে আসছে। ভাসা-ভাসা কথা। মালব্যও কিছু বলছে। মাথা টলমল করে উঠল অঞ্জলির।
দোপাটি চাপা গলায় খিলখিল করে হাসল। মালব্য কিছু একটা বলল।
দোপাটি বলল, “আপনি যদি আমাকে পড়ান তাহলে আবার একদিন…”
আবার চাপা হাসি। দোপাটি ফিসফিস করে বলল, “আমাকে আপনার কেমন লাগল? ছাত্রী হিসেবে ভাল না…?”
মালব্য আবার কিছু বলল। আবার হাসল দোপাটি।
কিছু একটা আওয়াজ হল। টেবিলে বই খাতা পড়ার মতো। সব চুপ। মালব্য নিচু গলায় কিছু বলল। অল্প কিছু পর দরজা ফাঁক হল। অঞ্জলি নিজেকে দেওয়ালের সঙ্গে চেপে ধরলেন। মিশে যেতে চেষ্টা করলেন। তাঁকে যেন দেখা না যায়। দোপাটি ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। তার গায়ে দরজা থেকে চিরে আসা আলো পড়েছে। অঞ্জলির মাথার ভিতরটা ঝনঝন করে উঠল। দোপাটির গায়ে কিছু নেই! ম্যাক্সি ধরনের কিছু একটা গুটিয়ে কোমরের কাছে ধরা। দরজাটা টেনে দিয়ে খুব নিশ্চিন্তে সে তিনতলায় ওঠার অন্ধকার সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল নগ্ন অবস্থাতেই। মেয়েটি গুন-গুন করে গান গাইছে নাকি? হতে পারে। অঞ্জলি দম বন্ধ করে আছেন। নিশ্বাসের আওয়াজ যেন শোনা না যায়। তারপরেও দোপাটির কিছু একটা যেন সন্দেহ হল। থমকে দাঁড়াল সে। দ্রুত হাতের গোটানো জামাটাকে লম্বা করে ঝুলিয়ে দিল হাটু পর্যন্ত। বুকটাও ঢেকেছে। ঝুঁকে পড়ে নীচের দিকে তাকাল। তারপর মুচকি হেসে উপরে উঠে গেল নিঃশব্দে। গাঢ় অন্ধকারেও অঞ্জলি সেই হাসি দেখতে পেলেন।
কীভাবে টলতে-টলতে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামলেন অঞ্জলি জানেন না। তিনি স্বামীকে ঘুম থেকে তুলে হাউহাউ করে কেঁদে উঠলেন।
এক মাস পরে
কর্ণফুলি সেন প্রায় মিনিট তিনকে চুপ করে থাকার পরে কথা বললেন।
“ঘটনার আজ কতদিন হল?”
অনন্যা নিস্পৃহ গলায় বলল, “মনে নেই।”
কর্ণফুলি বললেন, “আমার মনে আছে। ঠিক একমাস।”
অনন্যা আরও নিস্পৃহ ভাবে বলল, “হয়তো তাই।”
কর্ণফুলি সেন একটু উত্তেজিত হয়ে বললেন, “পুলিশ কতটা ক্যালাস দেখেছ অনন্যা! একমাস হয়ে গেল একটা মার্ডার কেসের কোনও হদিশ করতে পারল না। এদের হাতে কোন ভরসায় আমরা আছি বলো তো? ছি ছি! আচ্ছা অনন্যা, ওরা কাউকে কি সন্দেহ করছে?”
অনন্যার এসব কথা ভাল লাগছে না, তারপরেও সে শুনছে। কর্ণফুলি সেনের কাছে সে কৃতজ্ঞ। তাকে কিছু একটা হালকা অপমান করে কথা বন্ধ করে দিতে পারে। দিচ্ছে না। এই বয়সেই কতরকম মানুষ দেখা হয়ে গেল। যাকে ভাল বলে মনে হয়েছিল, সে কত সহজে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আবার যাকে দেখলে এক সময় নাক সিটকেছে, তার বিশ্বাসী আচরণ দেখলে অবাক হতে হয়।
কর্ণফুলি সেন বললেন, “কী হল, তোমরা কাউকে সন্দেহ করোনি? পুলিশকে কারও নাম বলোনি?”
অনন্যা বড় করে নিশ্বাস ছেড়ে বলল, “না, আমরা কারও নাম বলিনি। আমাদের কাউকে সন্দেহ করার নেই।”
কর্ণফুলি সেন বিরক্ত গলায় বললেন, “তাতে কী? এই কাজ তো তোমাদের নয়, পুলিশের কাজ। মার্ডারার ধরবে তারা। আমরা নই। ওরা কী বলছে? আরে বাপু, আমরাই যদি নাম বলে দিতে পারি তা হলে তোরা কী করতে আছিস? ওদের কাকে সন্দেহ?”
অনন্যা বলল, “জানি না। ঘটনার পর ক’দিন বাড়িতে পুলিশ এসেছিল। এখন আর আসে না।”
কর্ণফুলি সেন বললেন, “এটা তো খুব খারাপ। ওদের উচিত তোমাদের সঙ্গে রোজ যোগাযোগ রাখা।”
অনন্যা বলল, “হয়তো উচিত। ঠিক জানি না। ম্যাডাম, এবার তা হলে আপনি আমাকে ফাইলটা বুঝিয়ে দিন, আমি কাজে যাই?”
কর্ণফুলি সেন তাকে কাজ বুঝিয়ে দিতে ঘরে ডেকেছেন। তারপর স্বভাব মতো অন্য কথা বলছেন। অবশ্য ঘটনা যা তাতে কর্ণফুলি সেনকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, যে কেউ কৌতূহলী হবে। তা-ই হয়েছে। পাড়াপ্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, অফিসের কলিগ, কেউ বাদ যায়নি। খবরের কাগজেও বড় করে খবর বেরিয়েছে, ফলে জানাজানির কিছু বাকি ছিল না। দু’দিন ফোন বন্ধ করে দিয়েছিল অনন্যা। অফিসও যাচ্ছিল না। বাড়িতে অনবরত লোক আসতে শুরু করল। বাবা-মাকে সামলাবে, না বাইরের লোক? একসময় মনে হত বাড়ি থেকে পালিয়ে ক’টাদিন অন্য কোথাও চলে যাই। পুলিশ বলে গেল, বাড়ি ছাড়বেন না। ইনভেস্টিগেশনের জন্য যে-কোনও সময় দরকার লাগতে পারে। তারও পর বাবা জানিয়ে দিল, বাড়ি ছেড়ে এক পা-ও নড়বে না। সীমন্তিকা একদিন বাড়ি গিয়ে বোঝালেন।
“জীবনটাকে তো স্বাভাবিক রাখতে হবে অনন্যা। এ বাড়ির যা অবস্থা তাতে তুই ভেঙে পড়লে সবটাই ভেঙে পড়বে। যা হয়েছে তা তো মেনে নিতে হবে। অফিস যাওয়া শুরু কর।”
অনন্যা ভেঙে পড়া গলায় বলল, “অফিস গেলে তো সবাই সেই একই প্রশ্ন করবে। সবার কৌতুহল। বাবা-মায়ের তো প্রশ্নই ওঠে না, আমিও পথে বেরোতে পারি না। যাদের চিনি না, তারাও তাকিয়ে থাকে। আমি ক্লান্ত সীমন্তিকাদি।”
সীমন্তিকা অনন্যার মাথায় হাত রাখলেন। বললেন, “আমি তোকে সান্ত্বনা দিতে আসিনি। এসেছি স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে।”
“এরপরে আর স্বাভাবিক হওয়া যায় সীমন্তিকাদি?”
সীমন্তিকা মলিন হেসে বললেন, “যায় না। হওয়ার ভান করতে হয়। বেঁচে থাকতে হবে তো। আমরা সবাই তো নানারকম ভান করেই বেঁচে থাকি। তুই অফিস চল। যদি কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে করবে। যতটা পারবি উত্তর দিবি, যা ইচ্ছে করবে না, বলবি না। কিছুদিন পরে দেখবি, কেউ আর কিছু বলছে না। মানুষের কৌতূহলের সময়সীমা খুব বেশি নয়।”
অনন্যা ঘটনার দশদিনের মাথায় এই অফিসে এসেছে। প্রথম-প্রথম সান্ত্বনার জন্য অনেকে ছুটে এসেছে। সবচেয়ে সুবিধে হল, বাড়িতে ফালতু লোকের আসা-যাওয়া কমেছে। তার কারণ পাড়ায় খবর ছড়িয়েছে বাড়ির আশেপাশে প্লেন ড্রেসে পুলিশ ঘুরছে। কেউ এলে তার উপর নজরদারি শুরু হচ্ছে। অনন্যা প্রথমে ভেবেছিল মা-বাবাকে বাড়িতে ফেলে রেখে কীভাবে অফিসে যাবে? মা-ই বলল, “কাজে বেরো অনু। তোর বাবাকেও কাজে বেরোতে হবে। এভাবে ঘর অন্ধকার করে বসে থাকলে তো মানুষটা পাগল হয়ে যাবে।”
অনন্যা মাথা নামিয়ে বলল, “পাগল হওয়ার কি আমাদের কিছু বাকি আছে মা?”
মা বলেছিল, “না, নেই। তারপরেও বেঁচে তো থাকতে হয়। পাগল মানুষকেও তো বাঁচতে হয়। তুই অফিস যাওয়া শুরু কর। ঘরে বসে আর কত কান্নাকাটি করবি?”
অফিসে বোধহয় কর্ণফুলি সেনই একমাত্র মানুষ যিনি ঘটনাটা ভুলতে চাইছেন না। একমাস হয়ে গেল সেটাও হিসেব রেখেছেন।
কর্ণফুলি টেবিলের ওপার থেকে একটু ঝুঁকে পড়ে গলা নামিয়ে বললেন, “অনন্যা, তোমাদের বাড়িতে যে মেয়েটা আশ্রিত থাকে, সে গিয়েছে? কাগজে লিখেছিল না?”
অনন্যা অবাক হয়ে বলল, “সে কোথায় যাবে? আর কাগজে তো ভুল লিখেছিল, সে আশ্রিত নয়। আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়া। এখানে থেকে লেখাপড়া করে।”
কর্ণফুলি চশমা ঠিক করতে-করতে বললেন, “ও! তাই? আমি শুনেছিলাম, ওকে তোমরা বাড়ি চলে যেতে বলেছ।”
অনন্যা সতর্ক হল। বলল, “এরকম অদ্ভুত কথা আপনি কোথা থেকে শুনলেন! তাকে আমরা চলে যেতে বলব কেন?”
অনন্যার গলায় স্পষ্টত বিরক্তি ছিল। সে আর নিজেকে সামলাতে পারল কর্ণফুলি সেন এই বিরক্তি বুঝতে পেরেছেন। ইতস্তত করে বললেন, “আমি শুনেছি। ভুল শুনেছি।”
অনন্যা উঠে পড়ল। কঠিন গলায় বলল, “ম্যাডাম, আমাদের এটাই সমস্যা অন্যের পার্সোনাল বিষয়ে আমরা এত বেশি শুনতে চাই যে বেশিটাই ভুল শুনতে হয়। তার চেয়ে কম শোনাই ভাল। তাই না? আমি কাজে চললাম।”
নিজের টেবিলে এসে কাগজপত্র খুলল অনন্যা। সে মনকে শক্ত রাখে, কিছুতেই দাদার কথা মনে করবে না। তারপরেও পারে না। মাঝে-মাঝেই মুখটা ভেসে ওঠে।
ঠিক একমাস আগে মর্গে গিয়ে অনন্যা যখন বডি আইডেনটিফাই করেছিল তখন মালব্যর মুখটা ছিল একেবারে স্বাভাবিক। কে বলবে, মানুষটা চারঘণ্টা আগে খুন হয়েছে? বিশ্বাসই হচ্ছিল না। অনন্যার সঙ্গে তখন দেবরূপ ছিল। মর্গের লোকেরা তাকে বলেছে, পিছন থেকে কেউ গুলি করলে মুখে বিকৃতি তো দূরের কথা, ভয়ের ছাপও থাকে না। মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে।
এমন কিছু রাত ছিল না সেটা। বারোটার একটু আগে-পরে। বর্ধমানের কোনও কলেজে সেমিনার শুনতে গিয়েছিল। দুপুরে কলেজ থেকেই রওনা দিয়েছিল। না বলে যায়নি। বিশ্বনাথবাবু জানতেন। আগের দিনই মালব্য তাঁকে বলেছিল। সকালবলো চা খেতে নীচে এসেছিলেন বিশ্বনাথবাবু।
“বাবা, তোমার শরীর-টরির খারাপ নাকি?”
বিশ্বনাথবাবু গম্ভীর মুখে বলেছিলেন, “কেন? হঠাৎ এরকম মনে হচ্ছে কেন?”
মালব্য হেসে বলেছিল, “ক’দিন হল দেখছি কথা-টথা কম বলছ। রাতেও আর একসঙ্গে খাও না, আগে খেয়ে নাও। তাই ভাবলাম।”
বিশ্বনাথবাবু অন্যমনস্ক ভাবে বললেন, “না, ঠিক আছি।”
মালব্য বলল, “ঠিক থাকলেই ভাল।”
বিশ্বনাথবাবু একটু চুপ করে থেকে বললেন, “তোমার সঙ্গে একটু কথা ছিল মালব্য।”
মালব্য বলল, “এখন বলবে? বলো। কলেজে বেরোতে দেরি আছে।”
বিশ্বনাথবাবু বললেন, “না, আজ না। কাল বলব।”
মালব্য সহজভাবে বলল, “কাল তো হবে না বাবা। কাল যে আমি বর্ধমান যাব। সেখানে সেমিনার আছে। আমি বলব না, শুনব। খুব ইন্টারেস্টিং বিষয়ে সেমিনার। ফিরতে রাত হবে। তুমি বরং পরে কোনওদিন বোলো৷”
বিশ্বনাথ ভুরু কুঁচকে মুখ তুললেন। একটু চুপ করে থেকে বললেন, “কত রাত হবে?”
“কত রাত হবে জানি না, তবে সেমিনার তো বিকেলের পর। ফেরার ট্রেন কখন পাই কে জানে।”
ফেরার ট্রেন ঠিক সময়েই পেয়েছিল মালব্য। পথে লেট হল ঘণ্টাখানকে। মেন লাইনে কী হয়েছিল, গাড়ি ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। হাওড়া স্টেশন থেকে বাসে করে এসে নামতে আর একটু রাত হয়ে গেল। শেষের দিকে বাস লোক তুলতে-তুলতে ঢিমে তালে চলে। বড় রাস্তা থেকে বাড়ির পথটুকু হেঁটেই ফিরছিল মালব্য। মিনিট নয়-দশকেের পথ। একটু জোরে হাঁটলে আট মিনিটে হয়ে যায়। সঙ্গে গাড়ি, বাইক, স্কুটার থাকলে অন্য কথা, নইলে অনেকেই এই পথটুকু রিকশা নিয়ে নেয়। এখন তো ফোন করলে রিকশা এসে হর্ন বাজায়। তবে মালব্য চিরকালই হাঁটে। বাজারের পর মিনিট তিন-চার একটা পুরনো বন্ধ কারখানার সামনে দিয়ে আসতে হয়। কারখানা বড় নয়, ছোটখাটো। চল্লিশ বছর আগে রাবার গুডসের কাজ হত। যাদবপুরের দিকে একসময় এরকম বহু ছোটখাটো কলকারখানা ছিল। এখন প্রায় সবই ধ্বংসস্তূপ। এটাও তাই। ভাঙাচোরা, লম্বা পাঁচিল। জায়গাটা অন্ধকারও। বাইরে থেকে হঠাৎ এলে গা ছমছম করবে। পাড়ার লোক অভ্যস্ত। মালব্যও নিশ্চিন্ত মনে হাঁটছিল। পিছন থেকে একটা মোটরবাইক নিঃশব্দেই আসে। দু’জন ছিল। নিশ্চয়ই পিছনের জনই গুলি চালায়। গুলি লাগে মালব্যর ঘাড় থেকে দেড় বিঘতের মতো নীচে। রিভলভারের গুলি। গুলি পরীক্ষা করে পুলিশ জানিয়েছে, রিভলভারটি খুব সম্ভবত ছিল ‘সেভেন এম এম’ মডেলের। যে দূরত্ব থেকে গুলি ছোড়া হয়েছে, তাতে মালব্যর শরীর এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যাওয়ার কথা। কোনও কারণে, গুলি বুকের পাঁজর পুরোটা ভাঙতে পারেনি।
মোটরবাইকের কথা জানা গিয়েছে খোকনের চায়ের দোকান থেকে। খোকনের দোকান বড় রাস্তা থেকে আসার পথে, কারখানার পথে। সে তখন দোকান গোছাচ্ছিল। বন্ধ করবে। লোকজন, রিকশা, সাইকলে টুকটাক চলছিল। ক’টা গাড়িও গেল। তবে মোটরবাইক একটাই যেতে দেখেছে। চেরা পটকার আওয়াজ শোনার পর সেই মোটরবাইক তার দোকানের সামনে দিয়ে ফিরেও যায়। কোনও তাড়াহুড়ো ছিল না। খোকন কিছু বুঝতে পারেনি। সে দোকান বন্ধ করে। বুঝতে পারে টহলদার পুলিশ জিপ। তা-ও আধঘণ্টা পরে। তারা পথের পাশে একজনকে উপুড় হয়ে পড়ে থাকতে দেখে জিপ থামায়। টর্চ ফেলে দেখে, রক্তে ভেসে গিয়েছে শরীর।
মালব্যর পরিচয় পেতে পুলিশের সমস্যা হয়নি। তার সঙ্গে যে ব্যাগটা ছিল সেটা ঘাঁটতেই ফোন, ডায়েরি পাওয়া গিয়েছে। হাসপাতাল থেকে তারা বাড়ির ল্যান্ড ফোনেই ফোন করে।
বিশ্বনাথবাবু জেগে টিভি দেখছিলেন। ঠিক দেখছিলেন না, খানিকটা অস্থির ভাবে চ্যানলে সার্ফ করছিলেন। সেই রাতের পর থেকেই মানুষটা অস্থির।
অঞ্জলি সেই রাতে স্বামীকে ঘুম থেকে তুলে কাঁদতে শুরু করেন। বিশ্বনাথবাবু কিছু বুঝতে পারেননি। হতবাক হয়ে যান। অঞ্জলি শুধু চাপা গলায় টানা বলে যাচ্ছিলেন, “ওই মেয়েটাকে আমি খুন করব। আজই খুন করব।”
বেশ খানিকটা পর কান্না থামিয়ে অঞ্জলি সব ঘটনা বলেন। জল তেষ্টা পাওয়া থেকে নগ্ন দোপাটির ছেলের ঘর থেকে বেরিয়ে আসা, তারপর অন্ধকার সিঁড়িতে ঝুঁকে পড়ে মুচকি হাসা পর্যন্ত।
“কত বড় শয়তান! আমার ছেলের ঘরে কাপড় খুলে ঢোকে! উফ্! আমি ভাবতেও পারছি না। ওই মেয়েকে এখনই আমি চুলের মুঠি ধরে বাড়ি থেকে বের করে দেব।”
বিশ্বনাথবাবু একটা সময় পর্যন্ত পাথরের মূর্তির মতো চুপ করে থাকেন। নির্বাক, অনড়। তারপর বলেন, “চুপ করো অঞ্জলি। চুপ করো।”
অঞ্জলি গর্জে ওঠেন, “কেন চুপ করব? আরও কত চুপ করব? এরপরেও তুমি চুপ করতে বলবে?”
বিশ্বনাথবাবু গলা নামিয়ে খানিকটা যেন ঘোরের মধ্যে থেকে বলেন, “হ্যাঁ, বলব। এই ঘটনা জানাজানি হলে মালব্যর লজ্জা, গোটা বাড়ির লজ্জা। আজ বাদে কাল মেয়েটার বিয়ে হবে।”
অঞ্জলি বললেন, “কেন আমাদের লজ্জা? একটা বেহায়া মেয়ের নোংরামির জন্য আমাদের মাথা হেঁট হবে কীসের জন্য!”
বিশ্বনাথবাবু গভীর চিন্তার মধ্যে থেকে বললেন, “কার নোংরামি অঞ্জলি? প্রমাণ করা যাবে না। কোনওদিন হয়তো আইনগত লড়াই হলে প্রমাণ হতে পারে, কিন্তু তার আগে পর্যন্ত সমাজ কিছু মানবে না। মালব্যর দিকেই আঙুল তুলবে। সত্যি কি মালব্য নিজেও… আমার বিশ্বাস হচ্ছে না?” কথা শেষ করে দু’হাত দিয়ে মুখ ঢাকলেন বিশ্বনাথবাবু। মাথা নাড়তে নাড়তে-নাড়তে বলতে লাগলেন, “আমার বিশ্বাস হচ্ছে না… কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না। মালব্যর মতো একজন ভাল ছেলে… কী করে… কী করে… আই ডোন্ট বিলিভ… আই ডোন্ট বিলিভ… ছি ছি!”
অঞ্জলি আবার কেঁদে উঠেছিলেন। ফোঁপাতে-ফোঁপাতে বললেন, “ওই মেয়ে বিষকন্যা। ভাল দেখলেই তার উপর বিষ ছড়ায়। তার মুখে কালি দেয়, তাকে নষ্ট করে। এইটুকু মেয়ে এত খারাপ! ওই মেয়েকে বাড়িতে ঢুকিয়ে কত বড় সর্বনাশ তুমি আমাদের করেছ, বুঝতে পারছ এখন?”
বিশ্বনাথবাবু অনেক আগেই খাট থেকে নেমে চেয়ারে বসেছেন। এবার পায়চারি করতে-করতে বললেন, “আমার কোনও উপায় ছিল না। দোপাটিকে এখানে রাখতে আমি বাধ্য।”
অঞ্জলি মুখ তুলে বললেন, “মানে!”
“এখন ওই প্রসঙ্গ বাদ দাও। শুধু জেনে রাখো, আমি ওই মেয়েকে বাধ্য হয়ে এবাড়িতে এনে রেখেছি। কেন রেখেছি, সে কথা পরে হবে। আগে এই ভয়ংকর ঘটনা সামলাতে দাও।”
অঞ্জলি বললেন, “তুমি ছেলের সঙ্গে কথা বলো। আমি ওই বিষ-মেয়েকে বুঝে নিচ্ছি।”
বিশ্বনাথবাবু স্ত্রীর কাছে এসে বললেন, “খবরদার না। এখন কাউকে কোনও কথা নয়। এমনকী অনুকেও নয়। ক’টাদিন যেতে দাও।”
“এই ঘটনা তো আরও ঘটবে।”
বিশ্বনাথবাবু শূন্য দৃষ্টিতে সামনের সাদা দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললেন, “না, আর ঘটবে না। আমি মালব্যর কাছে শুধু জিজ্ঞেস করব…”
অঞ্জলি দিশেহারা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “কী? কী জিজ্ঞেস করবে?”
বিশ্বনাথবাবু চোয়াল শক্ত করে চুপ করে রইলেন। সেদিন ঘরে ভাল করে দেখার মতো কেউ ছিল না। যদি থাকত দেখতে পেত, মানুষটার চোখে একই সঙ্গে ক্রোধ এবং বিশ্বাসভঙ্গের ঘৃণা।
হাসপাতাল থেকে আসা ফোন প্রথম ধরেছিলেন বিশ্বনাথ বসুই। ওপাশের কথা শুনে চিৎকার করে ওঠেন।
“অনু, অঞ্জলি… কে আছ? কে আছ… একবার এদিকে এসো, এসো একবার… এরা কী বলছে… এসব কী বলছে এরা?”
ছুটে আসে অনন্যা। বাবার হাত থেকে ফোনের রিসিভারটা নেয়। ওপাশ থেকে শীতল কণ্ঠস্বরে একজন হাসপাতালের নাম করে বলে, “এটা বিশ্বনাথ বসুর ফোন নম্বর তো?”
অনন্যা কাঁপা গলায় বলে, “বলুন।”
ওপাশের কণ্ঠস্বর প্রাণহীন ভাবে বলে, “খানিকক্ষণ আগে মালব্য বসু নামে একজনকে আমাদের এখানে আনা হয়েছে। ব্রট ডেড। মনে হচ্ছে, ইট্স আ কেস অফ মার্ডার। ওর ব্যাগ থেকে ফোন নম্বর পাওয়া গিয়েছে। আপনাদের কাউকে এখনই একবার হাসপাতালে আসতে হবে।”
অনন্যার গলা কেঁপে উঠল। কী বলছে! দাদা খুন হয়েছে! অসম্ভব ! নিশ্চয়ই কিছু ভুল হচ্ছে। হাসপাতাল কোনও ভুল করছে। ‘হ্যালো! হ্যালো!’ বলে চিৎকার করে উঠল অনন্যা। লাভ হল না। ওপাশ থেকে ফোন কেটে দেওয়া হয়েছে। থরথর করে কাঁপতে-কাঁপতে চেয়ারে বসে পড়েছিল অনন্যা।
অঞ্জলি রান্নাঘর থেকে ছুটে এসে বললেন, “কী হয়েছে?”
রক্তশূন্য মুখে অনন্যা বলল, “মা, কোথাও একটা ভুল হয়েছে। চিন্তা কোরো না, এখনই সব ঠিক হয়ে যাবে।”
অঞ্জলি চিৎকার করে বললেন, “কী ভুল হয়েছে? বল কী ভুল হয়েছে? আমাকে বল। আগে বল আমাকে।”
এই সময় আবার ফোন বেজে ওঠে৷ অনন্যা ঝাঁপিয়ে পড়ে ধরে। এবার হত্যাকাণ্ডের খবর জানাতে পুলিশ ফোন করেছে।
অনন্যা দেবরূপকে ফোন করেছিল। সে এতটাই কান্নাকাটি করছিল যে পুরো কথা বলতে পারেনি। দেবরূপ শুনতে চায়ওনি। সে যতটা দ্রুত সম্ভব গাড়ি নিয়ে চলে আসে। অনন্যাকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটে যায়। মৃতদেহ ততক্ষণে মর্গে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কেস লেখার সময় পুলিশ প্রথমদিনই অনন্যাকে বলে দিল, এটা সহজ একটা ‘সুপারি কিলিং’। লোক ভাড়া করে খুন করা হয়েছে। কলকাতা এবং তার চারপাশে এই কাজ করার জন্য লোক ভাড়া পাওয়া কোনও বিষয় নয়। ভাড়াটে লোক দিয়ে এই ধরনের চোরাগোপ্তা খুনখারাপি হয়েই চলে। খবরের কাগজে একদিন-দু’দিন খবর বেরোয়, ব্যস, তারপর সব চুপচাপ।
অনন্যা পুলিশকে বলেছিল, “দাদাকে কে মারবে? কেন মারবে?”
পুলিশ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “সেটা জানার জন্য ইনভেস্টিগেশন দরকার। দেখা যাক।”
নন্দ এসে টেবিলের সামনে দাঁড়াল। নরম গলায় জিজ্ঞেস করল, “চা দিই?”
অনন্যা মুখ তুলে বলল, “না, আর চা খাব না।”
এই আর এক ঘটনা ঘটেছে। অনন্যার জন্য অফিসের সবার গলা নরম হয়ে গিয়েছে। সবটাই মিথ্যে সান্ত্বনা বা কৌতূহল নয়, অনেকে সত্যি সমব্যথীও। তাতে কোনও ভান নেই। সীমন্তিকাদি তো আছেনই, অন্য কলিগরাও কাজকর্মে খুব সাহায্য করছে। কর্ণফুলি সেন পর্যন্ত বলে দিয়েছেন, অনন্যাকে একদম আটকে রাখা চলবে না। দেরি করে ফিরলে ওর বাড়িতে চিন্তা করবে। কেউ আটকে রাখতে চায়ও না। হাতে বেশি কাজ থাকলে নিয়েও যাচ্ছে। অবশ্য এর মধ্যে দু’-একটা বিশ্রী ঘটনাও ঘটেছে। অন্য সেকশনে বাইরের কেউ এলে, এখানে উঁকি মেরে যাচ্ছে। যাদের কাছে আসে তারাই বলে দেয়। সঞ্জয় একদিন একজনকে ধরে এই মারে তো সেই মারে। টেবিল থেকে লাফ দিয়ে উঠেছিল। দরজার সামনে গিয়ে হাত চেপে ধরে সঞ্জয়। লোকটা ছিল গোবেচারা দেখতে। থতমত খেয়ে গেল। সঞ্জয় চোখ পাকিয়ে বলল, “উঁকি মারছেন কেন? এই ঘরে কোনও কাজ আছে?”
গোবেচারা চেহারার লোক তো জোর ঘাবড়াল! বলল, “না না, তা নয়।”
“তা হলে কী? চুরিচামারির ধান্দা?”
সেই লোক আরও ঘাবড়ে গিয়ে বলে, “এমনই দেখতে এসেছি।”
বরুণ ঝাঁপিয়ে পড়ে বলে, “দেখতে এসেছেন! অফিসের কম্পিউটার ডিভিশন কি দেখবার জিনিস? চলুন সিকিউরিটি অফিসারের কাছে।”
“বিশ্বাস করুন, ওসব কিছু নয়। আমি পাশের সেকশনে কাজে এসেছিলাম, ওখান থেকেই বলল, উনি এঘরে বসেন।”
সঞ্জয় অবাক হয়ে বলল, “কে এখানে বসে?”
লোকটা কাঁচুমাচু হয়ে বলল, “ওই, যে লোকটা খুন হয়েছে, তার বোন। আমার কোনও দোষ নেই। আর কোনওদিন আসব না।”
সঞ্জয়রা ঠিক করেছিল, বিষয়টা নিয়ে গোলমাল করবে। কর্ণফুলি সেনকে বলবে, “উপরমহলে কথা বলে এই অসভ্যতা বন্ধ করুন। যারা অনন্যাকে দেখতে লোক পাঠাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধেও অ্যাকশন নিতে বলুন।”
অনন্যাই হইচই করতে বারণ করল। সীমন্তিকাও বললেন, “ঠিকই। এতে আরও কৌতূহল বাড়বে। সময়ের সঙ্গে এগুলো বন্ধ হয়ে যাবে।”
অনন্যাও বুঝে গিয়েছে, এইটুকু তাকে সহ্য করতে হবে। এই ভয়াবহ শোকের পর বাবা-মাকেও কত কিছু মেনে নিতে হচ্ছে। প্রথম-প্রথম বাড়ি থেকে বেরোলে সবাই ঘুরে-ঘুরে দেখত। হয় ট্যাক্সি ডেকে, নয় রিকশায় পরদা ফেলে বেরোতে হত। সেই পরিস্থিতি অনেকটাই বদলেছে। বেশিরভাগ সময়েই মানুষের স্মৃতি নড়বড়ে। সে অনবরত ভুলতে চায়। পুরনো ঘটনা মুছে মস্তিষ্কে নতুন ঘটনা ঢোকাতে চায়। এভাবেই পাড়ার মানুষের কৌতূহল কমে গিয়েছে। গোড়াতে অনেকে মিলে লোকাল থানায় গিয়ে ডেপুটেশন দিয়েছিল। গলিতে পাকাপাকিভাবে পুলিশ পাহারা বসাতে হবে। যেখানে খুনের ঘটনাটা ঘটেছে, একসপ্তাহ সেখানে পুলিশ ছিল। তারপর যে কে সেই। ক’টা আলো লাগানোর ব্যবস্থা হয়েছে।
ছুটির সময় হয়ে গিয়েছে, অনন্যা কাগজপত্র গুছিয়ে ফলেল। প্রথম ক’টাদিন ফোনে ক্যাব ডেকে নিয়ে বাড়ি ফিরছিল। এখন আর ওসব করে না৷ মেট্রো ধরে অথবা বাসে ফিরে যায়। স্বাভাবিক হতে হবে। বাবা বাইরে থেকে খানিকটা সামলে নিলেও, মা একেবারেই স্বাভাবিক হতে পারছে না। প্রথমদিকে একটু শক্ত থাকলেও, তাদের জোর করে অফিসে পাঠালেও, এখন ফের শোক আর ট্রমার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। বেরোতে পারছে না কিছুতেই। পুত্রশোক থেকে কোনওদিনই বেরোতে পারবে না, কিন্তু ভয়-আতঙ্ক থেকে না বেরোলে সমস্যা হয়ে যাবে। ওষুধ খেয়ে ঘুম হয় না। রাতে ঘুম ভেঙে যায়। চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। প্রথমে মেয়েকে অফিস যেতে বললেও এখন উলটো হয়েছে তার। চায় না মেয়ে বাড়ি থেকে বেরাকে। বিশ্বনাথবাবুই জোর করেন।
“অনু অবশ্যই অফিস যাবে। আমিও যাব।”
অঞ্জলি সন্ত্রস্ত গলায় বলেন, “এবার যদি মেয়েটার কিছু হয়?”
অনন্যা বলে, “কী হবে? আমাকে মারবে? মারলে মারবে। তা হলে তো গোটা জীবনটাই ঘরে বসে থাকতে হবে মা। তুমি স্বাভাবিক হও।”
অনন্যা অফিস থেকে বাইরে এসে দাঁড়াল। চারপাশের দোকানগুলোয় একটা-দুটো করে আলো জ্বলে উঠছে। গাড়ি ছুটছে, মানুষ ছুটছে। কারও কোনও দিকে তাকানোর ফুরসত নেই। কলকাতা শহর একই রকম আছে। তার কাছে জীবন-মরণ খুবই সামান্য ব্যাপার। নির্বিকারভাবে ছুটে চলাই তার কাজ। অনন্যার ক্লান্ত লাগছে। সে হাত বাড়িয়ে একটা অটোকে দাঁড় করায়।
“দাদা, এমন হল কেন?”
“জানি না অনু৷”
“তোর সঙ্গে তো কারও বিবাদ নেই, তোর শত্রুও নেই কোনও। তুই থেকেছিস নিজের মতো।”
“একটা সময় পর্যন্ত তাই জানতাম। আজ বুঝতে পারছি, ভুল জানতাম। নিশ্চয়ই আমার কোনও শত্রু আছে। নইলে আমাকে মারবে কেন?”
“তুই তো এত লেখাপড়া করেছিস, তোর এত বুদ্ধি, এত জ্ঞান। তলে- তলে কে তোর এত বড় শত্রু হয়ে উঠল বুঝতে পারলি না?”
“সব কি বোঝা যায় অনু? ভালবাসা যেমন বোঝা যায় না, ঘৃণাও বোঝা যায় না। কোন একটা বইতে যেন পড়েছিলাম, তীব্র ভালবাসা থেকে ঘৃণার জন্ম হয়। হয়তো সেরকম কেউ আমাকে মেরে ফলেল।”
“এসব তোর বই পড়া কঠিন কথা।”
“আসলে সবই কঠিন অনু। জন্ম-মৃত্যু, ভাল-মন্দ সবই কঠিন কথা। কেউ বুঝতে পারে, কেউ বুঝতে পারে না। আমিও বারবার বুঝতে চেষ্টা করেছি। কখনও বই পড়ে, কখনও জীবন থেকে। পারিনি। এক জীবনে এত কঠিন সব জিনিস বোঝা যায় না।”
“দাদা, তোর জন্য খুব মন খারাপ করে। মা-বাবাকে নিয়ে ভয় করে। মায়ের দিকে তাকানো যায় না। এরকম ক’দিন চললে মাকে সাইকায়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যেতে হবে।”
“আর বাবা? বাবা কেমন আছে রে?”
“বাবা বাইরে শক্ত, কিন্তু ভিতরটা যে একটা ওলটপালট হয়ে গিয়েছে সেটা বুঝতে পারি। এই দুনিয়ায় বাবা তোকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসত দাদা। ছেলেকে নিয়ে তার গর্বের শেষ ছিল না।”
“দুর, তোরা যে কী বলিস অনু, গর্ব করার মতো আমার কী ছিল? সর্বক্ষণ বই মুখে থাকাটাই কি ভাল? একেবারেই নয়। কখনও বড় পরীক্ষায় খুব ভাল রেজ়াল্ট করতে পারিনি। তাই নিয়ে আমার হীনম্মন্যতার শেষ ছিল না। কলেজে গিয়ে সিঁটিয়ে থাকতাম। কাউকে বলতে পারতাম না।”
“এসব তোর ভালমানুষির কথা দাদা। বাবা বাইরে থেকে আপ্রাণ স্টেডি থাকবার চেষ্টা করছে। এটা তাকে দেখানো। আসলে বাবা সারাক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে আছে। নিশ্চয়ই তোর কথা ভাবে। আমি আড়াল থেকে দেখেছি, মানুষটা অস্থির-অস্থির করে। ছটফট করে। দু’দণ্ড কোথাও স্থির হয়ে বসতে পারে না। সবসময় ভিতরে অশান্তি। আপনমনে বিড়বিড় করতেও দেখি।”
“বাবার দিকে খেয়াল রাখিস অনু। মানুষের বাইরেটা কঠিন হয়, ভিতর হয় নরম। এই মানুষটা নরম-কঠিনে মেশানো। একটার সঙ্গে ক্রমাগত আর একটার লড়াই চলছে। তুই ভাল থাকিস।”
অনন্যা তার দাদার ঘরে বসে আছে। মৃত দাদার সঙ্গে মনে-মনে কথা বলছে। যেদিন খুব মন খারাপ করে অনন্যা এই ঘরে এসে বসে। সন্ধের পর অফিস থেকে ফিরে হাত-মুখ ধুয়ে, জামা-কাপড় বদলে চলে আসে। ঘরের আলো জ্বালায়। টেবিলে রাখা দাদার ফোটোতে মালা দেয়। তারপর খাটে বা চেয়ারে চুপ করে বসে খানিকটা সময় কাটায়। মালব্যর সঙ্গে অনন্যার যে একেবারে পিঠোপিঠি সম্পর্ক ছিল এমন নয়। বরং খানিকটা দূরত্বই থেকেছে চিরকাল। ভাই-বোন দু’জনেই লেখাপড়ায় মনোযোগী ছিল। খুব ছোটবলোর পর আর কখনওই ভাই-বোনে খুব একটা হুল্লোড় হয়নি। বড় হওয়ার পর মালব্য সারাক্ষণ মুখের সামনে বই ধরে থাকা শুরু করল। এমন একটা মানুষের সঙ্গে বাকিদের দূরত্ব তৈরি হওয়াটাই স্বাভাবিক। সে যতই কাছের সম্পর্ক হোক না কেন। আরও বড় হওয়ার পর থেকে তো মালব্য একেবারে নিজের মধ্যে ঢুকে যেতে লাগল। সকলের সঙ্গে বসলেও কথা বলত খুব কম। সংসারের ছাপোষা কথায় তার মন ছিল না। দাদার সঙ্গে বসে মনের প্রাণের কথা বলেছে বলেও অনন্যার খুব একটা মনে পড়ে না। বন্ধুরা তো হাসি-ঠাট্টা করত। সুজাশ্রী খুব বলত।
“ইস, জীবনে খুব শখ ছিল রে বন্ধুর দাদার সঙ্গে প্রেম করব। তোর দাদাকে একসময় টার্গেট করেছিলাম, কিন্তু এখন যেমন গোমড়ামুখো দেখছি তাতে ক্যানসেল করে দিলাম।”
অনন্যা হেসে বলত, “গোমড়ামুখো কোথায়? বইমুখো বল।”
সুজাশ্রী বলত, “ওই একই হল। গোমড়া আর বইয়ের মধ্যে পার্থক্য কী? তোর দাদা তো হাসির গল্প বগলে নিয়ে ঘোরে না।”
অনন্যা বলত, “তা ঠিক। দাদার যত কঠিন-কঠিন বই। ফিজ়িক্স, কেমিস্ট্রি, ফিলজ়ফি।”
সুজাশ্রী ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে বলত, “তা হলে একবার ভেবে দেখ, চুমু খেতে কোয়ান্টাম মেকানিক্স বা মলিকিউলার বন্ড বোঝাবে। বাপ রে! মনে হবে চুমু তো না, উচ্ছে সিদ্ধ গিলছি। না থাক বাপু, আর বন্ধুর দাদার সঙ্গে প্রেমে কাজ নেই।”
সুজাশ্রী যে সবটা বানিয়ে বলেছে এমন নয়। বোনের সুন্দর-সুন্দর বান্ধবীদের দিকেও মালব্য কখনও ভাল করে নজর করেনি। বাড়িতে এলে অনন্যা আগ বাড়িয়ে না হোক, মুখোমুখি হয়ে গেলে আলাপ করিয়ে দিত।
“দাদা, এ হল অর্যমা, আমার কলেজে পড়ে। ও অনেকটা তোমার মতো। খুব পড়তে পারে।”
মালব্য প্রায় মুখের দিকে না তাকিয়ে নিস্পৃহ গলায় বলত, “ও… ভাল কথা। যাও ঘরে গিয়ে বসো।”
অর্যমা বলেছিল, “কিছু মনে করিস না অনন্যা, বেশি গুড বয়দের অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। দেখিস, তোর দাদাকেও পড়তে হবে।”
মালব্যর এই ঘরে পুলিশ মোট দু’দিন এসেছে। বিছানা-বালিশ, কাপড়- জামা, কাগজপত্র সব ঘাঁটাঘাঁটি করেছে। আলমারি, ড্রয়ার যেমন খুলেছে, বইয়ের ভিতর উলটোতেও বাকি রাখেনি। যদি কোনও ক্লু পাওয়া যায়। শেষদিন বলে গিয়েছে, “না, কিছু পাওয়া গেল না। আপনারা এবার নিজেদের মতো ঘরটা ব্যবহার করতে পারেন। আমরা আর আসব না।”