পুলিশ ওই দু’দিন বাড়ির সবার সঙ্গে কথাও বলেছে। দোপাটিকেও বাদ দেয়নি। সবার কাছে একটাই প্রশ্ন। কাউকে সন্দেহ হয়? কেউই কোনও নাম বলতে পারেনি। মালব্যর কলেজের প্রিন্সিপাল অম্বরীশবাবু এসেছিলেন। অধ্যাপকরাও প্রায় সবাই বাড়িতে ঘুরে গিয়েছেন। তাঁরাই জানিয়েছেন, পুলিশ কলেজেও গিয়েছিল। খোঁজ নিয়েছে, কারও সঙ্গে মালব্যর কখনও ঝগড়া হয়েছে কিনা, কোনও গোপন রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিল কিনা, শেষের ক’দিন আচরণে কোনওরকম অসঙ্গতি দেখা যাচ্ছিল কিনা। কিছুই পাওয়া যায়নি। সবাই বলেছে, ঝগড়া করবে কী! এই ছেলে তো একা থাকতেই ভালবাসত। সবার থেকে সরে থাকত। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কখনও কোনও গোলমাল? বকাবকি? পরীক্ষার সময় টুকতে গেলে কাউকে ধরেছিল নাকি? তা-ও পাওয়া যায়নি। বরং উলটো। ছেলেমেয়েরা যারা পড়াশোনা করতে চায় তারা ‘এম.বি’ মানে মালব্য বোসকে যথেষ্ট পছন্দ করত। উনি রাগারাগির মাস্টারমশাই ছিলেন না। অনন্যা হাত ঘুরিয়ে সময় দেখল। আটটার সামান্য বেশি। এই ঘরে শুধু অনন্যাই আসে। অঞ্জলি বা বিশ্বনাথ উপরে উঠতে চান না। অনন্যার যেদিন বেশি মন খারাপ লাগে সেদিন এসে খানিকটা সময় বসে যায়। আজ দাদার সঙ্গে মনে-মনে কথা বলে মন আরও খারাপ হয়ে গেল। অনন্যা দরজা বন্ধ করে বসে। আজও তাই ছিল। দরজা খুলে অঞ্জলি ঢুকলেন।
অনন্যা বলল, “এসো মা।”
অঞ্জলি ঘটনার পর থেকে চুলটাও ঠিক মতো আঁচড়ান না। হাতের কাছে যে শাড়িটা পান সেটাই পরেন। শরীরের জন্য যেটুকু না খেলে নয়, সেটুকু খান। কান্নাকাটি এবং রাতে ঠিক মতো ঘুম না হওয়ার কারণে চোখ-মুখ ফোলা। সব মিলিয়ে তাঁকে খুবই বিধ্বস্ত লাগে। এটাই স্বাভাবিক। একজন নারীর কাছে তার সন্তানের মৃত্যু হল জীবনের চরমতম দুঃখের ঘটনা। যাকে এই দুঃখের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় একমাত্র সে-ই জানে তারপরেও বেঁচে থাকা কী ভয়ংকর! সারাক্ষণ মনে হয়, এর চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভাল ছিল। তবু বেঁচে থাকতে হয়। খেতে হয়, ঘুমোতে হয়। সংসারের এবং বাইরের কাজে মন দিতে হয় ফের। প্রকৃতি মানুষকে যেমন নরম ভাবে তৈরি করে, তেমন নিষ্ঠুর ভাবেও করে। একটা সময়ের পর সে-ই এই ভয়াবহ শোককে শুধু নিজের ভিতর বহন করার ক্ষমতা দেয়। তখন আর বাইরে থেকে বেশি বোঝা যায় না। অন্যরা ভাবে মেয়েটা শোক সামলে উঠেছে।
অঞ্জলির বলোয় ঘটনা উলটো ঘটেছে। কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছেন না। কথাবার্তাও খানিকটা অসংলগ্ন হয়ে পড়েছে। আজ মেয়ে অফিস থেকে ফেরার পর হাসি-হাসি ভাব নিয়ে বললেন, “অনু, লুচি ভেজে দেব? জলখাবারে গরম লুচি খাবি?”
অনন্যা অবাক হল। সন্ধেবলোর টিফিনে গরম লুচি সে কোনওদিন খেয়েছে বলে মনে পড়ে না। মায়ের এই আকস্মিক উৎসাহের কারণ কী! বলার ভঙ্গিটাও দৃষ্টিকটু। যেন বাড়িতে কোনও খুশির ঘটনা ঘটেছে। গরম লুচি খেয়ে সেলিব্রেট করতে হবে। অনন্যা কিছু একটা বলতে গিয়ে থমকে যায়। থাক, নিশ্চয়ই মায়ের সমস্যা হচ্ছে।
“না, এখন কিছু খাব না। শুধু চা। তুমি ছাড়ো, আমি করে দিচ্ছি।”
অঞ্জলি বললেন, “ঠিক আছে,” বলে আবার ফিরে গেলেন থমথমে, বিষাদভরা মুখে। মুহূর্তের জন্য কোনও গোলমাল হয়েছিল। একটু পরেই সমস্যাটা ধরতে পারল অনন্যা। মনে পড়ে গেল, দাদা লুচি পছন্দ করত। যদিও খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে বিশেষ কোনও উৎসাহ ছিল না মানুষটার। যা দেওয়া হত খেয়ে নিত। আলাদা করে চাহিদা ছিল না কোনও। তারপরেও গরম লুচি ভাল লাগত। খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও মা তাকে মরে যাওয়া ছেলে ভেবে ভুল করেছিল। তাই লুচির কথা বলেছে। একধরনের হ্যালুসিনেশন। অনন্যা চিন্তিত হল। না, মাকে এবার একজন সাইকায়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হয়েছে। তার আগে পর্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে। বাবাকে জানানো ঠিক হবে না। এই অবস্থায় এই সব শুনলে আরও ভেঙে পড়বে। যা করার তাকেই করতে হবে। অনন্যা মনে-মনে হাসল। দুঃখের হাসি। কোনও-কোনও সময় পরিস্থিতি এমন আসে যখন নিজের শোক করার ফুরসত থাকে না। অন্যকে সামলাতে হয়।
অঞ্জলি মালব্যর ঘরে ঢুকে চারপাশে তাকালেন। যেন কাউকে খুঁজছেন। অনন্যা উঠে মায়ের হাত ধরে খাটের উপর বসাল। অনন্যা নিয়মিত এই ঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখে। বিছানার চাদর পালটায়। অঞ্জলি খাটে বসে চাদরে হাত বোলালেন। নিয়নের আলোয় তাঁর চোখ চকচক করে উঠল।
“মা, কিছু বলবে?”
অঞ্জলি চাপা গলায় বললেন, “হ্যাঁ, বলব। তুই আগে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে আয়।”
অনন্যা বলে, “কিছু হবে না। এঘরে কে আসবে এখন? বাবা নীচে, দোপাটি উপরে।”
অঞ্জলি বললেন, “তুই দরজা বন্ধ করে দিয়ে আয়।”
অনন্যা কথা না বাড়িয়ে দরজা আটকে ফিরে এল।
“তুই এই ঘরে মাঝে-মাঝে আসিস, না?”
অনন্যা মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, আসি৷”
অঞ্জলি বললেন, “কেন আসিস? মানুষটা তো বেঁচে নেই।”
মায়ের চোখগুলো শুধু জলে চকচকে নয়, কেমন ঘোলাটেও লাগছে। অনন্যা সতর্ক হল। পরিস্থিতি সহজ করার জন্য জোর করে হাসল। বলল, “তুমি তো জানো মা, আমি এঘরে খুব একটা আসতাম না। এসে কী করব? দাদা তো আর পা ছড়িয়ে আমার সঙ্গে গল্প করতে বসত না। বরং দুটো কথার পর-পরই বলত, ‘এবার আয়। আমি একটু কাজ সেরে নিই।’ এখন বেশি-বেশি করে এসে কমপেনসেট করছি।”
অঞ্জলি মেয়ের রসিকতা পুরোটা ভাল করে বুঝতে পারলেন না। তিনি খানিকটা শূন্য দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
অনন্যা বলল, “এবার বলো, কী বলবে?”
অঞ্জলি গলা আরও নামিয়ে বললেন, “তোর দাদাকে কে খুন করেছে জেনেছিস?”
অনন্যা অবাক হয়ে বলল, “এসব কী বলছ মা! আমি কী করে জানব? সে তো পুলিশ জানবে। আর পুলিশ জানলে আমরা সকলেই জানতে পারব।”
অঞ্জলি মেয়ের দিকে সামান্য ঝুঁকে পড়ে বললেন, “পুলিশ কিছু জানে না, জানতেও পারবে না। আজ তো একমাস হয়ে গেল, ধরতে পেরেছে?”
অনন্যা কিছু একটা রাগের কথা বলতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিল। ঠান্ডা গলায় বলল, “না পারলে না পারবে। এটা নিয়ে আমাদের ভাবার কী আছে? দাদাকে যারা মেরেছে তাদের নাম জানলে কি দাদা ফিরে আসবে? না, আসবে না। সুতরাং ওসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ো না।”
অঞ্জলি মেয়ের কথায় গুরুত্ব দিলেন না। ঘাড় ঘুরিয়ে বন্ধ দরজার দিকে তাকালেন। তারপর ফিসফিস করে বললেন, “কাছে আয়। তোকে বলে দিচ্ছি তোর দাদাকে কে মেরেছে।”
অনন্যা বুঝতে পারল, এ সবই অসংলগ্ন কথা। বিরক্ত লাগছে, তারপরও শান্ত ভাব দেখিয়ে বলল, “আমি যথেষ্ট কাছে আছি।”
চোখ দুটো বড় করে অঞ্জলি হিসহিসিয়ে বলল, “তোর দাদাকে ওই মেয়েটা মেরেছে।”
মুহূর্তখানকে থমকে অনন্যা বলল, “কোন মেয়েটা?”
অঞ্জলি ডান হাতের তর্জনী তুলে ছাদের দিকে দেখালেন। দাঁতে দাঁত ঘষে বললেন, “কোন মেয়েটা বুঝতে পারছিস না? যে মেয়েটাকে তোর বাবা এখানে রাখতে বাধ্য হয়েছে।”
অনন্যা অবাক হয়ে বলল, “বাধ্য হয়েছে! কেন বাধ্য হবে কেন?”
অঞ্জলি দাঁতে দাঁত ঘষে বললেন, “আমাকে জিজ্ঞেস করছিস? বিশ্বনাথ বসুকে জিজ্ঞেস কর। কার সঙ্গে তার ফষ্টিনষ্টি ছিল। এই মেয়ে তোর বাবার সত্যিকারের ভাগনি কিনা তা নিয়ে আমার সন্দেহ হচ্ছে।”
অনন্যা বলল, “উফ মা, তুমি কিন্তু খুব বেশি ভাবছ। এসব গল্প-উপন্যাসে আর সিনেমায় হয়। দোপাটি মোটরবাইকে চেপে দাদার উপর গুলি চালিয়ে পালিয়ে যাবে? এটা কি একটা বিশ্বাসযোগ্য কথা হল মা?”
অঞ্জলি মেয়ের দিকে রোষভরা চোখে তাকিয়ে বললেন, “ওই মেয়ে নিজে গুলি চালাবে কেন? ভাড়া করা গুন্ডা দিয়ে করিয়েছে।”
অনন্যা এবার বিরক্তি না দেখিয়ে পারল না।
“উফ! মেয়েটা খুব খারাপ আমি জানি। ও যে ভয়ংকর কোনও সর্বনাশ করতে পারে, সেই ভয় আমিও পেয়েছিলাম। কিন্তু গুন্ডা ভাড়া করে খুন করাটা ভাবতে পারছি না। এসব ভেবে তুমি চাপ নিয়ো না মা। তুমি নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়ছ।”
অঞ্জলি বললেন, “পর্ণাও এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। বলা যায় না, হয়তো ওর নতুন স্বামীও…”
“তারা সবাই মিলে দাদাকে মারবে কেন! দাদা ওদের কী ক্ষতি করেছে!”
অঞ্জলি ঝাঁঝিয়ে ওঠেন, “ওরা আমাদের ক্ষতি করতে চায়। আমার মনে হয় তোর দাদা ওদের গোপন কিছু জেনে গিয়েছিল।”
অনন্যা এবার উঠে দাঁড়াল। মায়ের হাত ধরে ছেলেভোলানো গলায় বলল, “ঠিক আছে, বুঝেছি। ওঠো এবার, নীচে যাও। ঘুমের ওষুধ খেয়েছ? আচ্ছা, চলো আমি দিচ্ছি।”
অঞ্জলি উঠে দাঁড়ালেন, কিন্তু প্রসঙ্গ পালটালেন না। বরং আরও গলা তুললেন।
“আমি পুলিশকে বলব। সব বলে দেব। ওই মেয়ে কী-কী করেছে সব বলব। পুলিশ যদি তখন ওকে না ধরে, আমি নিজের হাতে খুন করব।”
অনন্যা এবার মাকে একরকম জড়িয়ে ধরে বলে, “ঠিক আছে, ঠিক আছে। উত্তেজিত হতে হবে না। চিৎকার কোরো না, সবাই শুনতে পাবে।”
অঞ্জলি আরও উত্তেজিত হয়ে পড়েন। চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসে। আলুথালু চুলে তাকে দেখাচ্ছে উন্মাদিনীর মতো। চিৎকার করে বলতে থাকেন, “পাক শুনতে। আমি সবাইকে বলে দেব। সবাই জানবে, ওই মেয়ে আমার ছেলেকে খুন করেছে… খুনি মেয়েটা কী করেছে জানিস? জানিস কী করেছিল? তোর বাবা জানে। তাকে সব বলেছিলাম। সে কাউকে বলতে বারণ করেছিল… এমনকী তোকেও নয়। তাই এতদিন বলিনি… চুপ করে থেকেছি। আজ আর চুপ করব না… খুনের ঘটনার ক’দিন আগে এক রাতে দেখি, শয়তান মেয়েটা তোর দাদার ঘর থেকে ন্যাংটো হয়ে বেরোচ্ছে… হাসছে খিলখিলিয়ে?”
অনন্যা প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে মায়ের মুখ চেপে ধরে।
“ছি ছি! চুপ করো মা, দোহাই তোমার, চুপ করো?”
অঞ্জলি মুখ দিয়ে ‘গোঁ গোঁ’ আওয়াজ করেন, জোর করে মেয়ের হাত সরিয়ে দেন।
“কেন? চুপ করব কেন? আমার ছেলের খুনির নাম আমি বলব না? পুলিশকে সব বলব… তারা জানবে এইটুকু মেয়ে কীভাবে আমার হিরের টুকরো ছেলেটার সর্বনাশ করেছে…”
অনন্যা ফের মায়ের মুখ চেপে ধরে। কাঁদো-কাঁদো গলায় বলে, “মা, তুমি নিজেই জানো না, তুমি দাদার নামে কী বলছ! তুমি নীচে চলো।”
একরকম জোর করেই মাকে একতলার ঘরে নামিয়ে নিয়ে যায় অনন্যা। দুটো ঘুমের ওষুধ খাইয়ে শুইয়ে দেয়। তারপর ঘরের দরজা আটকে আলো নিভিয়ে বসে থাকে পাশে। অঞ্জলি দীর্ঘক্ষণ ফোঁপানোর পর একসময় ঘুমিয়ে পড়েন। অনন্যা সিদ্ধান্ত নেয়, কালই ডাক্তারের কাছে যাবে।
রাতে বাবার পাশে খেতে বসল অনন্যা। এই ক’দিন যে যেরকমভাবে পেরেছে খেয়ে নিয়েছে। অনন্যার খেতে ইচ্ছে করতনা,মা-বাবাকে খাওয়াতে হবে, তাই নিজেও বাধ্য হয়ে খেত। শুধু দোপাটি নিজের মতো উপর থেকে নেমে রান্নার মাসির করে যাওয়া রুটি-তরকারি নিয়ে উপরে চলে যেত। সকালে নিজের প্লেট-টেট ধুয়ে রেখে যেত। মেয়েটা কথা বলা একদম বন্ধ করেছে। কেমন যেন থম মেরে গিয়েছে। তার মা এসেছিল। বিশ্বনাথবাবু তাকে বলেছিলেন, “অন্য কোথাও নিয়ে যাও। ক’টাদিন সেখানে থাকুক। তারপর না হয় কোনও বোর্ডিংয়ে ভর্তি করে দেওয়া যাবে।” পর্ণা রাজি হয়েছিল। আগরপাড়ায় একজনের বাড়িতে ক’দিনের জন্য মেয়েকে রেখে দেবে ঠিক করেছিল। নিজেও থাকবে। যদি সেখানে থাকা না যায় তাহলে বাড়ি ভাড়া করে থাকবে। স্বামী কিছুতেই নিজের বাড়িতে দোপাটিকে নিয়ে যেতে রাজি নয়। পর্ণার বিয়ের আগে এটাই শর্ত ছিল। যতদিন পর্ণার বুড়ো শ্বশুর-শাশুড়ি বেঁচে থাকবেন, দোপাটির ওবাড়িতে প্রবেশ নিষিদ্ধ। কিন্তু বাড়ি ভাড়া করে কত দিন কলকাতায় পড়ে থাকা যাবে পর্ণা জানে না। জানতে হল না। দোপাটি এবাড়ি ছাড়তে রাজি হয়নি। রাজি হয়নি অদ্ভুত কারণে। অন্তত তার মাকে সেরকমই বলে গিয়েছে। মহিলাকে সেদিন খুব চিন্তিত লাগছিল।
বিশ্বনাথবাবু প্লেটের ভাত নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলেন। মুখে দেওয়ার প্রস্তুতিই নিচ্ছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত মুখে তুলছিলেন না। বোঝা যাচ্ছে, মানুষটার ভিতরে ছটফটানি চলছে। অনন্যা বলল, “বাবা, মায়ের শরীরটা বেশ খারাপ।”
বিশ্বনাথবাবু অন্যমনস্কভাবে ‘হুঁ’ বললেন।
এই উত্তর অনন্যার ভাল লাগল না। মায়ের শরীর বেশ খারাপ শোনার পর শুধু এই প্রতিক্রিয়া! দাদার এই মৃত্যুতে বাবা যত বড়ই আঘাত পাক, বাড়ির অন্যদের কথাও তো একটু চিন্তা করতে হবে। মালব্য বসু তারও তো দাদা। তারও তো মাঝে-মাঝে ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। সে তো কাঁদছে না। তা হলে তো গোটা বাড়িটাই ভেঙে পড়বে। বাবার মধ্যে শুধু শোকের অস্থিরতা নয়, একধরনের উদভ্রান্তির ভাব তৈরি হয়েছে। যতদিন যাচ্ছে এই ভাব বাড়ছে। কী করবে, কী করবে না বুঝতে পারছে না। চুপ করে এক জায়গায় বেশিক্ষণ বসে থাকতেও পারে না। দু’দিন অফিসে গিয়ে আবার অফিস যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। সন্ধের দিকে শুধু একবার করে বেরোয়। দাদাকে যেখানে গুলি করা হয়েছে, সেই জায়গাটা দেখে আসে। এ খবরটা অনন্যা জানত না। রান্নার মাসি বলেছে।
অনন্যা বলল, “ভাত হাতে নিয়ে বসে আছ কেন বাবা? খেয়ে নাও।”
বিশ্বনাথবাবু নিচু গলায় বলেন, “খাচ্ছি।”
“কাল মাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাব।”
“ও…”
অনন্যা একটু চুপ করে খলে, তারপর অভিমানের গলায় বলল, “তোমরা সবাই যদি এরকম করো, আমি একা কতটা করব? দাদার ঘটনায় আমিও তো আঘাত পেয়েছি বাবা। সেই আঘাত তোমাদের থেকে কম হতে পারে, কিন্তু খানিকটা তো বটেই। আমি তো তোমাদের সামলাতেই ব্যস্ত হয়ে আছি, নিজের জন্য সময় পাই না। তারপরও যদি তোমরা এরকম করো… মা পাগলামি করছে, তুমি খাচ্ছ না। এমন ভাবে দিশেহারা হয়ে আছ যে জরুরি কথাও কানে তুলছ না। রোজকার জীবনযাপনটুকুও যে যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠেছে সে তো বুঝতে পারছি বাবা, কিন্তু বেঁচে তো থাকতে হবে।”
মেয়ের অভিমান বিশ্বনাথবাবু বুঝতে পারলেন। খানিকটা চুপ করে থাকার পর বিষাদমাখা গলায় বললেন, “আসলে কী জানিস অনু, একমাস হয়ে গেল, আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না। ছেলেটাকে নিয়ে আমার খুব গর্ব ছিল। আমি জানতাম সে কখনও কোনও অপরাধ করতে পারে না। কী করছি, কী করব নিজেই ঠিক করতে পারি না। অনু, তুই না থাকলে এতক্ষণে বুড়ো-বুড়িতে গলায় দড়ি দিতাম। এই যন্ত্রণার চেয়ে সেটাই ভাল হত।”
অনন্যার খারাপ লাগল। বাবাকে বেশি বলা হয়ে গিয়েছে। সে বাঁ হাতটা বাড়িয়ে বিশ্বনাথবাবুর হাত ধরল। বলল, “সরি, আমি ওভাবে বলতে চাইনি। কিন্তু এসব তুমি কী বলছ! দাদার কী অপরাধ! অপরাধ তো তাদের, যারা তাকে মার্ডার করেছে।”
বিশ্বনাথবাবু সামান্য হাসলেন। একজন বিপর্যস্ত মানুষের হাসি।
“সেদিন অফিসের সিঁড়ি দিয়ে উঠছিলাম। ক’জন আমার সামনে ছিল। তাদের মধ্যে দু’জন একেবারে আমার পাশের টেবিলে বসে। তারা মালব্যর ঘটনা নিয়ে কথা বলছিল।”
অনন্যা বলল, “এ আবার নতুন কী বাবা? সে তো সবসময়ই শুনছি। এখন খানিকটা কমেছে। এর জন্য তুমি ভেঙে পড়ছ!”
বিশ্বনাথবাবু মেয়ের কথায় পাত্তা দিলেন না। পাতা না ফেলা চোখে তাকিয়ে বললেন, “আমি শুনতে পেলাম পাশে বসা সহকর্মী বলছে, ‘বিশ্বনাথবাবুর ছেলেটার নিশ্চয়ই কোনও গড়বড় ছিল। যতই কলেজের মাস্টার হোক, অপরাধ জগতের সঙ্গে জড়িয়ে না পড়লে এমন হতে পারে না। ভাল ছেলেদের এরকম কত কীর্তি শুনি। নিউজ়পেপারে তো রোজ বেরোয়। পুলিশ ঠিক সব টেনে বের করবে।’ ”
অনন্যা বলল, “বাবা, তুমি এদের কথা বিশ্বাস করলে? তুমি তোমার ছেলেকে চেনো না?”
বিশ্বনাথবাবু চুপ করে খানিকক্ষণ খেলেন। তারপর বললেন “তোর মা চেঁচাচ্ছিল কেন?”
“মায়ের শরীর খুব খারাপ হয়েছে। আবোল-তাবোল কথা বলে ফেলছে। সমস্যা হল, এই সব কথা বাইরের কেউ শুনলে নতুন করে সমস্যা হবে।”
বিশ্বনাথবাবু মুখ তুলে বললেন, “কী কথা?”
অনন্যা বলল, “থাক, আর শুনে লাভ নেই।”
বিশ্বনাথবাবুর কপালে ভাঁজ পড়ল। তিনি বললেন, “আমাকেও আগে বলেছে। তখনই সন্দেহ হয়েছিল। সে নাকি একদিন রাতে দেখেছে…”
অনন্যা তাড়াতাড়ি বলল, “বলতে হবে না। বিশ্রী কথা শুনতে ভাল লাগছে না। একজন শোকে-দুঃখে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা মানুষ কী বলল তার কোনও দাম নেই। আমি অসুস্থতার তীব্রতা বোঝাতে কথাটা তুললাম। আমার মনে হয়, সেরকম হলে মাকে কোনও ক্লিনিকে ক’দিনের জন্য রাখতে হতে পারে। ভায়োলেন্ট হয়ে ওঠার একটা টেনডেন্সি দেখলাম।”
অনন্যা চুপ করে খাওয়া শেষ করল। বিশ্বনাথবাবু বললেন, “আমায় কী করতে হবে?”
“কিছু করতে হবে না। যা করার আমি করব। তোমাকে শুধু জানিয়ে রাখলাম।”
বিশ্বনাথবাবু প্লেট সরিয়ে উঠে পড়লেন। বললেন, “ইস, তোকে কত দায়িত্ব নিতে হচ্ছে! তোর মা ঘুমিয়েছে?”
অনন্যা বলল, “হ্যাঁ, ঘুমিয়েছে। এ কী, এতটা ভাত ফেলে দিলে! আর একটু খাও।”
বিশ্বনাথবাবু কাতর গলায় বললেন, “ভাল লাগছে না।”
অনন্যা প্লেট নামাতে-নামাতে বলল, “ঠিক আছে, খেতে হবে না। আমি তোমাকে গরম দুধ করে দিচ্ছি। মাকেও তুলে খাওয়াব।”
বিশ্বনাথবাবু একটু থমকে থেকে বললেন, “মেয়েটা খেয়েছে?”
অনন্যা বলল, “দোপাটি আজকাল আটটার মধ্যে খাবার নিয়ে উপরে উঠে যায়। বাবা, তুমি একটাই দায়িত্ব নাও।”
বিশ্বনাথবাবু ডাইনিং টেবিলের পাশের দেওয়ালে বসানো বেসিনে হাত ধুতে-ধুতে বললেন, “কী?”
“মেয়েটাকে এবাড়ি থেকে সরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করো।”
হাত ধুতে অনেকটা সময় নিলেন বিশ্বনাথ বসু। এমনভাবে সাবান ঘষলেন, যেন ভাতের কণা নয়, ভয়ংকর কিছু হাতে লেগেছে, যা সহজে উঠতে চাইছে না। অনন্যা ততক্ষণে রান্নাঘরে গ্যাস জ্বালিয়ে দুধ গরম করল। দুটো গ্লাসে ঢালল। ফাঁকে-ফাঁকে আড়চোখে বাবার দীর্ঘসময় ধরে হাত ধোওয়া নজর করল। মানুষটাকে দেখে মনে হচ্ছে, এই মুহূর্তে কী করছে, ভুলে গিয়েছে। মনটা অন্য কোথাও। হাতে জল দেওয়াটা যন্ত্রের মতো করে চলছে।
“বাবা, হয়েছে? এবার হাত মুছে ফেলো। নাও, দুধটা খেয়ে নাও।”
বিশ্বনাথবাবু চেয়ারে বসে ভাঙা গলায় বললেন, “কী যেন বললি অনু?”
অনন্যা টেবিলের উলটোদিকে দাঁড়িয়ে গলা নামিয়ে বলল, “এবার দোপাটিকে এখান থেকে নিয়ে যেতে বলো।”
বিশ্বনাথবাবু দুধের গ্লাস মুখে দিলেন না। ডান হাত দিয়ে গ্লাসটা ঘোরাতে-ঘোরাতে খানিকটা অন্যমনস্ক, খানিকটা যেন আপনমনে বলে চললেন,
“অনু, তুই আর তোর মা আমাকে ভুল বুঝেছিস। দোপাটিকে এবাড়িতে রাখতে আমি বাধ্য। একটা সময় সম্পত্তি নিয়ে পর্ণার বাবার সঙ্গে আমার বাবার অনেক মামলা-মোকদ্দমা হয়েছিল। তার জন্য দায়ী ছিল আমার বাবা। সম্পত্তি দখলের নেশা ছিল তার। এই বাড়ি নিয়েও মামলা হল। বাড়ির অধিকার কে পাবে? তখন আমি খুব ছোট। পর্ণা জন্মায়ওনি। পরে সব শুনেছি। মামলাটায় আমার বাবা, কাকার কাছে খুব খারাপ ভাবে হারল। জমি-টমি নিয়ে এমন জটিলতা ছিল, কাকার উকিল মামলাটা সাজিয়েছিলেন এমন ভাবে, যে বাড়ির আধখানা ভাগও জুটল না। আদালতে প্রমাণ হল, জমিটাই আমার ঠাকুরদার মালিকানায় নেই। সুতরাং ভাগাভাগির প্রশ্ন ওঠে না। আমাকে আর মাকে নিয়ে বাবার পথে বসার অবস্থা। সেই সময় বাবার হাতে টাকা-পয়সাও খুব কম ছিল। মামলায় জলের মতো টাকা খরচ করেছে। বাবা কাকার কাছে গিয়ে সারেন্ডার করল। কিছুদিন যদি তাকে এই বাড়িতে থাকতে দেওয়া হয়। কাকা রাজি হলেন। শুধু রাজি হলেন না, শিশু অবস্থায় আমাকে দেখে এতটাই ইমোশনাল হয়ে পড়লেন যে বাবাকে বাড়ির স্বত্ব লিখেও দিলেন।”
অনন্যা অস্ফুটে বলল, “ও মাই গড! এসব আমাদের আগে বলোনি কেন?”
বিশ্বনাথ বসু নিজের মনেই যেন সামান্য হাসলেন। ফ্যাকাশে হাসি। বললেন, “সব খারাপ যেমন বলা যায় না, সব ভালও তেমন বলা হয়ে ওঠে না। শেষ পর্যন্ত কোনওটাই চাপা থাকে না,” একটু থেমে দম নিলেন। ফের বলতে শুরু করলেন বিশ্বনাথ বসু, “তবে সেদিন বাবাকে কোর্ট পেপারে লিখে দিতে হল, কাকার দিকের কোনও উত্তরাধিকার যদি ভবিষ্যতে মাথা গোঁজার ঠাঁই নিয়ে বিপদে পড়ে, তাকে এই বাড়িতে থাকতে দিতে হবে। কোনওরকম অসম্মান করা যাবে না। এমন আচরণ তার সঙ্গে করা যাবে না যাতে সে আঘাত পায়। অপমানিত বোধ করে। বাড়িতে তার থাকার জন্য যেন প্রভিশন থাকে। যেন কোনও অসুবিধে না হয়। আমার বাবার তখন অবস্থা এমন যে এর চেয়ে অনেক কঠিন শর্ত এলেও মেনে নিতে বাধ্য হত।”
অনন্যার ভুরু কুঁচকে গেল। মনে পড়ে গেল, একদিন বকাবকির সময় দোপাটি বলেছিল, এই বাড়িতে কোন অধিকারে সে থাকে তার উত্তর জানে বিশ্বনাথ বসু। শুধু মুখে বলা নয়, দাপটের সঙ্গে সে এখানে রয়ে গিয়েছে। একই সঙ্গে অনন্যার ভাল লাগছে। সে নিচু গলায় বলল, “এ তো চমৎকার যুক্তি! আশ্রয়ের বদলে আশ্রয়। আমি তোমার ওই দূর সম্পর্কের কাকার জন্য গর্ব বোধ করছি বাবা।”
বিশ্বনাথবাবু মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোর ঠাকুরদা কিন্তু এসব প্রচার চাননি। তিনি এই শর্তের কথা গোপন রাখতে চেয়েছিলেন। যতই হোক, দয়ায় পাওয়া আশ্রয় তো। তারপরেও আমি জেনেছিলাম। আমি বড় হওয়ার পর ওই কাকা আমাকে সব বলে গিয়েছিলেন। পর্ণাও তার মায়ের কাছ থেকে জেনেছিল। তবে পরিস্থিতি আসেনি। কেউ কোনওদিন এসে এখানে আশ্রয় চায়নি। এই প্রথম পর্ণা তার মেয়ের জন্য করল। আমি না বলব কী করে অনু? আমি কি ঠিক করিনি?”
অনন্যার মনটা আরও দুর্বল হল। বাবার ওই দূর সম্পর্কের কাকা তো একজন পুরুষই ছিলন। বাবাও তাই। অথচ একসময় পুরুষ জাতটা নিয়ে তার কত রাগ, ঘৃণা, তাচ্ছিল্যই না ছিল! বয়স বাড়ার সঙ্গে জীবনের অনেক ধারণা বদলে যায়। অনন্যা অস্ফুটে বলল, “খুব ঠিক করেছ বাবা, বেশ করেছ।”
বিশ্বনাথবাবু মেয়ের সমর্থন গা করলেন না। তিনি হাতের গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে, গ্লাস সরিয়ে রাখলেন।
“আইনি দাবিদাওয়া নিয়ে আমি চিন্তা করিনি, কিন্তু এত বড় অকৃতজ্ঞ আমি কী করে হব?”
অনন্যা বলল, “এসব তো আমাদের আগে বললেই পারতে।”
বিশ্বনাথবাবু বললেন, “দূর সম্পর্কের এক কাকার দয়ায় পাওয়া বাড়িতে থাকি— একথা বলে মরা বাপকে লজ্জা দিতে চাইনি অনু। তবে একজনকে বলেছিলাম। দোপাটিকে এবাড়িতে আনার আগে তাকে জিজ্ঞেসও করেছিলাম।”
অনন্যা বলল, “কাকে? কাকে বলেছিলে?”
বিশ্বনাথবাবু এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে নিচু গলায় বললেন, “তোর দাদাকে। মালব্যকে সব বলেছিলাম। একজন প্রায় অনাত্মীয়কে বাড়িতে এনে তুলব কিনা, সে বিষয়ে তার পরামর্শ চেয়েছিলাম। সে আমাকে সমর্থন করেছিল। এমনকী দোপাটির নামে একটার পর-একটা কমপ্লেন যখন শুনি, তখনও আমি মালব্যর সঙ্গে কথা বলেছি। তাকে সব জানাতাম। সে আমাকে তার মতামত জানাত, বলত কী করা উচিত।”
এবার অনন্যা এতটাই অবাক হল যে তার সন্দেহ হল, বাবা কি সত্যি বলছে? নাকি মায়ের মতো তারও শোকে মাথার সমস্যা দেখা দিচ্ছে? দোপাটিকে নিয়ে বাবার সঙ্গে দাদার নিয়মিত কথা হত! আশ্চর্য! দাদা সংসারের এই সব তুচ্ছ এবং কদর্য কথায় কান দিত? নিজে পরামর্শ দিত? বিশ্বাস করা কঠিন। কিন্তু বাবা যেমন সহজ ভাবে বলছে তাতে অবিশ্বাস করবে কী করে? এত অভিনয় করার ক্ষমতা বাবার আছে? বানিয়ে-বানিয়ে এত কথা বলতে পারে সে? কই আগে তো কখনও দেখেনি! অনন্যা দ্রুত নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করে। বাবার সঙ্গে দাদার সম্পর্ক চিরকাল অন্যরকম ছিল। পিতা-পুত্রের স্নেহ আর শ্রদ্ধার সহজ সমীকরণ নয়, তার থেকে আলাদা। সে সম্পর্ক মায়া-মমতার সুতোয় জড়ানো-পেঁচানো ছিল। সুতোগুলো কখনও স্পষ্ট হত, কখনও আবছা। অন্যরা দেখতে পেত না। মা একটু-একটু পেত, সম্ভবত সেই কারণে দাদার উপর মায়ের অভিমানও ছিল। সম্পর্ক যেরকমই হোক, বাবা ছেলেকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করত। সেই কারণেই হয়তো বলেছে।
যে কারণেই হোক, ঘটনা সত্যি। সেই ‘সত্যি’ অনন্যার জানার কথা নয়। দোপাটির বিষয়ে ছেলের সঙ্গে যে পরামর্শ করেন এটা বিশ্বনাথবাবু স্ত্রীকেও বুঝতে দেননি। তাঁর কাছে অভিযোগ শোনার পর ছেলের কাছে যেতেন।
“এসো বাবা। বসো, এই খাটের উপরই বসো৷ দাঁড়াও, বই-খাতাগুলো সরিয়ে দিই।”
বিশ্বনাথবাবু একটু চুপ করে থেকে বললেন, “বিচ্ছিরি একটা সমস্যায় পড়ে তোর কাছে এসেছি। তোর তো অনেক বুদ্ধি, অনেক লেখাপড়া করিস, দেখি কোনও সলিউশন বের করতে পারিস কি না।”
মালব্য খানিকটা চিন্তিত হয়ে বলল, “কী হয়েছে বাবা?”
বিশ্বনাথবাবু বললেন, “তুই জানিস না, দোপাটি মেয়েটাকে নিয়ে অনেক কমপ্লেন। সাধারণ কমপ্লেন নয়, বিশ্রী সব কমপ্লেন। কম-বেশি রোজই আমার কানে আসে। তোর মা বকাবকি করে, মারধরও করেছে। এই সব ঘটনার অর্ধকেও যদি সত্যি হয় তা হলে মারাত্মক। মেয়েটার মধ্যে একধরনের ক্রিমিনাল ইনস্টিংক্ট রয়েছে।”
মালব্য আগ্রহ নিয়ে বলল, “ক্রিমিনাল ইনস্টিংক্ট? সেটা কীরকম? চুরি- টুরি করে?”
বিশ্বনাথবাবু বললেন, “তা হলে তো সহজ হত। এই মেয়ের অপরাধ একেবারে অন্যরকম। সে মানুষকে নষ্ট করতে ভালবাসে। সে নিজে চুরি করে না, সৎ মানুষকে চোর বানাতে চায়।”
মালব্য চোখ-মুখ উজ্জ্বল করে বলল, “ওইটুকু মেয়ে একজনকে খারাপ হতে ইনফ্লুয়েন্স করে ফেলেছে! খুব ইন্টারেস্টিং তো। আমি এরকম শুনিনি। পাওয়ারফুল মেয়ে বলতে হবে।”
বিশ্বনাথবাবু বললেন, “ইন্টারেস্টিং তুই বলছিস, কারণ তুই দূর থেকে দেখছিস। কিন্তু যাদের প্রতিদিন ফেস করতে হচ্ছে, তাদের কাছে তো অসহ্য। কী করি বলতে পারিস? তোর মা ওকে তাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলছে। একটা খারাপ মেয়েকে সে বাড়িতে রাখতে চায় না।”
মালব্য খানিকটা সময় চুপ করে রইল। তারপর বলল, “ভাল-খারাপ বিষয়টাই তো খুব রিলেটিভ। তোমার কাছেই শুনেছি, ঠাকুরদা মিথ্যে উইল- টুইল বানিয়ে তোমার দূর সম্পর্কের কাকার কাছে এই বাড়িটা হাতিয়ে নিতে গিয়েছিলেন। সেটাও কি ভাল ছিল? আমরা কি সেই অপরাধের দায় কাঁধে বাড়ি ছেড়ে আজ চলে যাব?”
বিশ্বনাথবাবু বললেন, “তা হলে কী করব? আমি দোপাটিকে ডেকে বলতে পারি। জিজ্ঞেস করতে পারি। কিন্তু তাতে যদি সে অপমানিত হয়, আঘাত পায়…”
মালব্য বলল, “তুমি এখনই কিছু করতে যেয়ো না। বিশ্বাসভঙ্গ করা তোমাকে মানায় না। সেই কাকা যদি তোমাকে দেখে সেদিন আবেগতাড়িত না হতেন, তা হলে তোমাদের পথে বসতে হত। তার মর্যাদা তোমাকে রাখতে হবে। তা ছাড়া… তা ছাড়া… মেয়েটা ইন্টারেস্টিং… খুবই অন্যরকম। দাঁড়াও বাবা, আমি ক্রিমিনাল সাইকোলজির বই-টই ঘেঁটে একটু দেখি।”
অনন্যা গাঢ় গলায় বলল, “তুমি কি দাদার সঙ্গে সংসারের অন্য বিষয় নিয়েও কথা বলতে?”
“তোর দাদা আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতো ছিল বলে আমি বিশ্বাস করতাম না। কঠিন বিষয় ছাড়া তার সঙ্গে কথা বললে সে খুশি হত না। আমি তাকে কখনও বিরক্ত করিনি,” এই পর্যন্ত বলে চুপ করলেন বিশ্বনাথবাবু। মুখে দু’হাত চাপা দিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে বসে রইলেন। তাকে দেখাচ্ছিল বিধ্বস্ত, পরাজিত। শরীরটা কেঁপে-কেঁপে উঠছে। অনন্যা পাশে এসে দাঁড়াল। বাবার পিঠে হাত বোলাতে লাগল।
বিশ্বনাথবাবু ফোঁপাতে-ফোঁপাতে বললেন, “ও যে আমার সঙ্গে এত বড় বেইমানি করবে আমি ভাবতে পারিনি।”
অনন্যা কান্না সামলে বলল, “শান্ত হও বাবা, শান্ত হও।”
মোবাইল বাজছে। অনন্যা বালিশের পাশ হাতড়ে ফোনটা টেনে নিল। চোখের সামনে ফোনটা তুলল। দেবরূপ।
“ঘুমিয়ে পড়েছিলে?”
অনন্যা বলল, “না, শুয়ে আছি।”
দেবরূপ বলল, “তা হলে কাল সকালে বলি? জরুরি কথা ছিল।”
অনন্যা উঠে বসল। ঘর অন্ধকার। জানলায় পরদা দেওয়া থাকলেও বাইরের আলো এসে ঘরটাকে আবছা আলোকিত করে রেখেছে। মালব্যর ঘটনার পর থেকে বহুদিন জানলা-দরজা আটকে রাখতে হয়েছে। পিছনের ফ্ল্যাটবাড়ির জানলায়-জানলায় লোক দাঁড়িয়ে যেত। ছাদে কাপড়-জামা শুকোতে যেত কাজের মাসি। এখন কৌতূহল অনেকটাই কমেছে।
অনন্যা বলল, “অসুবিধে নেই, এখনই বলতে পার।”
ওপাশে একটু চুপ করে থেকে দেবরূপ বলল, “পুলিশ তোমাদের কিছু জানিয়েছে অনন্যা?”
পুলিশ কিছু বলেছে কিনা, খুনি ধরা পড়ল কিনা, কেন খুন হল— এইসব প্রশ্নে জেরবার হয়ে অনন্যা তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট বন্ধ রেখেছে। হোয়াটসঅ্যাপে পুরনো বন্ধুদের একটা গ্রুপ ছিল। সেটাও খোলে না। কিন্তু দেবরূপের এই প্রশ্নে আজ একটু থমকাল। নিছকই কৌতূহল নাকি অন্য কিছু? গত একমাস দেবরূপ যতটা করেছে অতটা ওর কাছ থেকে আশা করেনি অনন্যা। বেশ কিছুটা সময় তার পাশে থেকেছে। সরাসরি থাকলেও ফোনে যোগাযোগ রেখেছে। প্রথমদিন তো হাসপাতালে ছুটে গিয়েছিল। দু’দিন বাড়িতেও এসেছে। বাবা-মায়ের কাছে বসে থেকেছে চুপ করে। আত্মীয় পরিজনকে পছন্দ না করলেও মা দেবরূপকে পেয়ে যেন খানিকটা ভরসা পেয়েছিল। সবচেয়ে বড় কথা, প্রথম দিকে দেবরূপ একদিন অফিস ছুটিও নিয়েছিল। সেই সময় মাথায় কিছু ছিল না, কিন্তু পরে কথাটা মনে পড়তে খুব অবাক হয়েছে অনন্যা। ছেলেটা কি তা হলে বদলে গেল! কেরিয়ার ছাড়া একটা কথাও যে ভাবতে পারত না, সে অফিস পর্যন্ত কামাই করে ফেলল! সমুদ্রের বড় জলোচ্ছাস যেমন ছোটখাটো ঢেউকে তুচ্ছ করে দেয়, দাদার নির্মম মৃত্যু, দেবরূপের কাছ থেকে পাওয়া দুঃখ, অপমানকে ভাসিয়ে দিয়ে গিয়েছে। ওসব কথা আর মাথায় নেই অনন্যার। তারপর নিজের উপর রাগও হয়েছে। মনে হয়েছে, দেবরূপকে নিজের দিক থেকেই এতদিন বোধহয় বিচার করেছে। নীতিকথার বই বলেছে, মানুষ চেনা যায় দুঃসময়ে। দেবরূপ তো দুঃসময়ে তার কাছেই থেকেছে। মালব্যর মৃত্যুর ঘটনার আঠারো দিনের মাথায় অনন্যা অনুভব করল সে তলপেটে সমস্যা বোধ করছে। সেদিন রাতেই টেলিফোনে দেবরূপকে বলল, “আর দেরি করব না। এবার ক্লিনিকে গিয়ে কাজটা সেরে ফেলব।”
দেবরূপ হালকা উত্তেজিত গলায় বলল, “এখনই কী দরকার? এই অবস্থায় ঝক্কি নিতে পারবে না।”
অনন্যা ক্লান্ত হেসে বলেছিল, “মাতৃজঠরের ভ্রূণ বাইরের অবস্থা বোঝে দেব। বাইরের দুঃখ-কষ্ট তার গায়ে লাগে না। সে নিজের মতো বড় হতে থাকে, হচ্ছেও। এখনও পর্যন্ত কোনও ঝক্কি নেই, এরপর দেরি করলে সমস্যা হতে পারে। আমারও তো বয়স হচ্ছে।”
দেবরূপ যেন খানিকটা বাড়িয়েই আদরের ঢংয়ে বলল, “ক’টাদিন অপেক্ষা করলে হয় না অনন্যা? বাড়ির পরিস্থিতিটা না হয় একটু সামলে নিতে।”
এই ‘বাড়ানো আদরের’ ভঙ্গি খট করে কানে বাজল অনন্যার। আবার নিজেকেই চাপা ধমক দিয়ে বলল, “শোক একদিন কমে যাবে। কিন্তু এই বিষয়টা কমবে না। তোমাকে চিন্তা করতে হবে না দেব। সীমন্তিকাদির পরিচিত ডক্টর দেখেছেন। তিনিই ব্যবস্থা করে দেবেন। কিছুক্ষণের মামলা। আজকাল ব্যবস্থা খুব সেফ হয়ে গিয়েছে।”
দেবরূপ কাঁচুমাচু গলায় বলেছিল, “তুমি যেটা ভাল বুঝবে।”
দেবরূপ যেতে চেয়েছিল, অনন্যাই বারণ করে। সেদিন তার সঙ্গে সীমন্তিকাদি ছিলেন। উনি এই কাজ অন্তত দু’বার করেছেন। সত্যিই কোনও ঝামেলা হয়নি। তবে অ্যাবরশনের পর দেবরূপকে অনেকটা চনমনে লাগল। একদিন বলেই ফেলল।
“মুখে যতই বারণ করি, বিষয়টা নিয়ে আমি যথেষ্ট চিন্তিত ছিলাম অনন্যা। তোমার দাদার ঘটনাটায় সব এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। এই সময় তোমাকে কী বলব? এখন টেনশন ফ্রি।”
অনন্যা চুপ করেছিল। তবে কি অ্যাবরশনের কাজটা যাতে শেষ পর্যন্ত হয় তার জন্যই দেবরূপ এতদিন পাশে ছিল? নিজেকে মনে-মনে ‘ছিঃ’ বলে ধমক দিয়েছিল অনন্যা। ‘সিনিক’ হয়ে যাচ্ছে। ভাবনা চিন্তায় অসুস্থ। কোনও ঘটনাকেই সহজ ভাবে নিতে পারছে না। তারপরেও যোগাযোগ করে যাচ্ছে দেবরূপ। তবে মাত্রাটা কমেছে। কিন্তু তারপরেও একদিন বাড়ি এসেছে। দু’দিন অফিসের সামনে দেখাও করেছে। তবু দেবরূপের ব্যাপারে মন থেকে ‘খটকা’ সরাতে পারে না অনন্যা। আজও ফোনে দেবরূপের প্রশ্ন শুনে ভুরু কুঁচকে গেলো।
“না, পুলিশ কিছু বলেনি। কী বলবে? একদিন থানা থেকে ফোন করে আমার আর বাবার অফিসের ঠিকানা চেয়েছে শুধু।” ফোনের ওপাশ থেকে দেবরূপ উত্তেজিত গলায় বলল, “এই তো! আমার কাছে এই খবরটাই এসেছে।”
অনন্যা বলল, “কী খবর?”
দেবরূপ চাপা গলায় বলল, “অনন্যা, আমার এক কাজ়িন পুলিশে কাজ করে। চোর-ডাকাত ধরাধরির কাজ নয়, সাইবার ক্রাইম ডিপার্টমেন্টে আছে। কম্পিউটর নাড়াঘাঁটা করে। সেখান থেকে অপরাধী খুঁজে বের করে। তাকে পরশুদিন এক পারিবারিক অনুষ্ঠানে পেয়েছিলাম। মালব্যদার ঘটনাটা বললাম। ইনভেস্টিগেশন কিছু এগিয়েছে কিনা যদি জানা যায়।”
অনন্যা খাটের উপর হাঁটু দুটো তুলে জড়ো করে বসে আছে। মালব্যর ঘটনার পর ক’দিন দোতলায় একা শুতে পারেনি। থাকতেও পারত না। শুধু মনে হত, পাশের ঘরে দাদা আছে। হাঁটাচলা করছে। বইখাতা নাড়াচাড়া করছে। নীচে চলে গিয়েছিল অনন্যা। মায়ের কাছে শুয়েছে। বাবা শুয়েছে বাইরের সোফায়। মা-বাবার কাছে রাতে থাকাটা তখন জরুরি ছিল। আত্মীয়স্বজন দু’-একজন থাকতে চেয়েছিল। বাবা অনুমতি দেয়নি। অনন্যাও চায়নি। বাইরের কেউ থাকা মানেই সান্ত্বনা আর কৌতূহল। তার চেয়ে নিজেদের মতো থাকাই ভাল।
দোপাটিকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, সে রাতে নীচে আসবে কিনা। দোপাটি জানিয়েছিল, সে নিজের ঘরেই থাকবে। সারারাত সিঁড়িতে আলোটা জ্বলবে। অপঘাতে মৃত্যুর ‘কাজ’ হয়েছে তিনদিনের মাথায়। যেটুকু না করলেই নয়। পরের দিনই দোতলায় ফিরে এসেছে অনন্যা। তারপর থেকে নিজের ঘরেই আছে। অভ্যস্ত হতে হবে।
অনন্যা বড় করে শ্বাস ফেলে বলল, “দেব, পুলিশের ইনভেস্টিগেশনে আমাদের কোনও উৎসাহ নেই।”
মুখে একথা বললেও অনন্যা মনে-মনে ঠিক করে রেখেছে, সত্যি যদি খুনি ধরা পড়ে তা হলে তাকে একবার জিজ্ঞেস করবে, দাদার মতো ভাল ছেলেকে সে কেন হত্যা করল? খুব দরকার ছিল? কী দরকার ছিল? অর্থ? সম্পত্তি? প্রতিশোধ? দাদা তো এমন কোনও অন্যায় কাজ করতে পারে না যার জন্য তাকে এত বড় প্রতিশোধের শাস্তি পেতে হল। স্কুলে যখন পড়ত, কোনওদিন বাড়িতে নালিশ আসেনি। বাবা গর্ব করে বলত, “দেখ অনু, তোর নামেও দিদিমণিরা দুষ্টুমির কথা বলে, দাদার নামে কখনও বলে না।” অফিসের কলিগরা মিথ্যে আলোচনা করে বাবার মন ভেঙে দিয়েছে। অর্যমা খবর পেয়ে আমেরিকা থেকে ফোন করেছিল।
“মন শক্ত রাখ অনন্যা। কে কী বলছে কানেও ঢোকাবি না। বাবা-মায়ের দিকে নজর রাখিস।”
কারও কথা কানে ঢোকায়নি। তেমন মেয়ে অনন্যা নয়। তারপরেও মাঝে-মাঝে মন খারাপ হয়ে যায়।
দেবরূপ ফোনের ওপাশ থেকে উত্তেজিত ভাবে বলল, “এটা কারও উৎসাহ-অনুৎসাহের বিষয় না। তদন্ত হবেই। আমি কাজ়িনের কাছে সেটাই জানতে চেয়েছিলাম। সে একটু আগে ফোন করে জানাল, সে কিছু খবর পেয়েছে।”
অনন্যা নিস্পৃহ গলায় বলল, “খবরগুলো কি আমাকে না শোনালেই নয়?”
দেবরূপ জোরের সঙ্গে বলল, “না, নয়। কারণ এই খবরের সঙ্গে আমি জড়িত।”
অনন্যা এবার নড়েচড়ে বসল। বলল, “তুমি!দাদার খুনের ব্যাপারে তুমি কোথা থেকে এলে?”
দেবরূপ কাঁপা গলায় বলল, “আমি জানি না, পুলিশ জানে। তবে শুধু আমি নই, পুলিশ তোমাদের বাড়ির সঙ্গে জড়িত সবার ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে শুরু করেছে।”
অনন্যা বলল, “সো হোয়াট? পুলিশ তার মতো ইনভেস্টিগেশন করলে আমাদের কী?”
দেবরূপ আরও উত্তেজিত হয়ে বলল, “তোমাদের কী আমি জানি না, কিন্তু অবশ্যই আমার অনেক কিছু এসে যায়। এই যে বললে থানা থেকে তোমাদের অফিসের ঠিকানা নেওয়া হয়েছে, এবার যদি আমারটা নেয়? নেবে কেন বলছি, এতক্ষণে নিশ্চয়ই নিয়েছেও। আমার পুলিশে চাকরি করা আত্মীয় বলেছে, সবার উপর নজর রাখা শুরু হয়েছে।”
অনন্যার কাছে দেবরূপের উত্তেজনা এবং নার্ভাস হওয়ার কারণ এবার ধীরে-ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে। তারপরেও শান্ত ভাবে বলল, “তোমার অফিসের ঠিকানা নিলে সমস্যা কী?”
দেবরূপ ফোনের ওপাশে যেন লাফিয়ে উঠল।
“কী বলছ অনন্যা! সমস্যা কী তুমি বুঝতে পারছ না! তুমি কি ইচ্ছে করে বোকা সাজছ? একজন এমপ্লয়ি, যে খুব বড় একটা প্রোমোশনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, যার প্রোফাইল ক্লিন লাইক এনিথিং, প্রোমোশনের জন্য যার এভরিথিং ফাইনাল, পুলিশ যদি তার সম্পর্কে অফিসে এসে খোঁজ করে তা হলে সমস্যা হবে না? আর কেসটা তো কোনও সহজ কেস নয়। এটা একটা মার্ডার কেস।”
অনন্যা চোখ বুজল। সে তা হলে ঠিকই ভাবছিল৷ দেবরূপ নিজের কারণে ভয় পেয়েছে। ইচ্ছে করল মোবাইলটা বন্ধ করে দেয়। তারপরে মনে হল, একটা জবাব দেওয়া দরকার। অনন্যা বলল, “আমি তো পুলিশকে বলতে পারি না, দেবরূপ রায় এই খুনের মামলার সঙ্গে কোনওভাবে জড়িত নন, অনুগ্রহ করে তার অফিসে আপনারা যাবেন না। তারপরেও যদি মনে করো বলা দরকার, আমি কালই থানায় ফোন করে বলতে পারি। করব?”
অপমান গায়ে মাখল না দেবরূপ। মান-অপমান বোঝার মতো অবস্থায় সে নেই। নিজের জন্য সে এতটাই নার্ভাস হয়ে পড়েছে যে সূক্ষ্ম কিছু মাথায় ঢুকছে না।
“কাজ়িন আমাকে জানিয়েছে, পুলিশ নিশ্চিত যে ভাড়াটে খুনি দিয়ে তোমার দাদাকে খুন করা হয়েছে। তারা এসেছিল বাইরে থেকে। কোথা থেকে এসেছিল সে সম্পর্কে খোঁজখবর চলছে। টাকা-পয়সা নিয়ে কলকাতায় এসে যারা এই ধরনের কাজ করে তাদের নাম-টাম পুলিশ জানে। কিন্তু তাদের যে ভাড়া নিয়েছিল তার খোঁজে পুলিশ এখন হন্যে হয়ে উঠেছে। সন্দেহজনক সবার পিছনে, এমনকী তোমাদের বাড়ির সকলের পিছনেও লোক লাগিয়েছে। শুধু বাড়ির মেম্বার নয়, এই পরিবারের সঙ্গে যাদের ঘনিষ্ঠতা, তাদের পিছনেও লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে। যদি কোনও ক্লু পাওয়া যায়। তার মানে ওরা আমাকেও ফলো করছে। তাই তো?”
এই কঠিন সময়েও আনন্দ হচ্ছে অনন্যার। তা হলে গত একমাস ধরে যে ‘খটকা’ তার মনে বেজেছে, সেটা ভুল নয়। দুঃসময়ে দেবরূপের ‘পাশে থাকা’-টা খাঁটি ছিল না। অ্যাবরশন আদৌ হবে কিনা তাই নিয়ে চিন্তিত ছিল সে। সে কারণেই বারবার ছুটে আসা। এখন মনে হচ্ছে, আর ক’টাদিন অপেক্ষা করে নিজেই বলে ফলেত, ‘অনন্যা, এই সময়ে বলতে খারাপ লাগছে, কিন্তু ওটা সেরে ফেলাই উচিত হবে।’ অনন্যা কানে ফোন ধরেই যেন হাসল। যারা কেরিয়ার নিয়ে বাড়াবাড়ি ধরনের ব্যস্ত থাকে তারা নার্ভাস হয়। কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না। প্রেমিকাকেও নয়।
“দেব, আমি কি ফলো করার বিষয়টা নিয়েও থানায় বলব? বলব, তোমাকে যেন…”
ওপাশ থেকে উত্তেজিত গলায় দেবরূপ বলল, “দোহাই তোমায় অনন্যা, আর উপকার করতে হবে না। এতদিনে কত কী হয়ে গিয়েছে কে জানে। নিশ্চয়ই পিছনে লোক ঘুরছে। ইস, বেফালতু একটা মার্ডার কেসে জড়িয়ে পড়লাম।”
অনন্যা আর পারল না। কঠিন গলায় বলল, “এটা কি একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না?”
দেবরূপ ব্যঙ্গের গলায় বলল, “বেশির আর কী রয়েছে? প্রেম করতে গিয়ে পিছনে পুলিশ নিয়ে ঘুরতে হচ্ছে।”
“তুমি ভেবেচিন্তে কথা বলছ?”
দেবরূপ বলল, “বাদ দাও এসব। শোনো অনন্যা, আই টেক আ ডিসিশন। যতদিন না তোমার দাদার কেসটা মিটছে আই শ্যাল কিপ ডিসট্যান্স। তোমাদের থেকে একটু দূরে থাকব। কথা, দেখাসাক্ষাৎ কম করব। সরি, এ ছাড়া আমার কোনও ওয়ে আউট নেই। তুমি অন্যভাবে বিষয়টা নিয়ো না অনন্যা। ভুল বুঝো না।”
অনন্যা ফোন মুখে রেখেই হাই তুলল। এই হাই যতটা না ঘুম পাওয়ার কারণে তার চেয়ে অনেক বেশি তাচ্ছিল্যের। অনন্যা বলল, “আমি তোমাকে কখনওই ভুল বুঝিনি দেবরূপ। এবারও বুঝব না। চিন্তা কোরো না। শুধু একটা কথা বলি, তুমি মিথ্যে অত টেনশন করছিলে। তোমার সন্তানকে পেটে ধারণ করার ইচ্ছে আমারও অনেকদিনই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আমি নিজেই ক্লিনিকে যেতাম। যাক, ভাল থেকো। গুড নাইট।”