হকিংয়ের সাক্ষাৎকার
‘কখনো নোবেল পুরস্কার পাব না।’ —স্টিফেন হকিং
প্রশ্ন : হ্যালো, প্রফেসর হকিং
স্টিফেন হকিং : হ্যালো, কেমন আছেন? আমার আমেরিকান টান ক্ষমা করবেন। [হাসি]
প্রশ্ন : মহাবিশ্ব আপনার কৌতূহল আকর্ষণ করার আগে আপনার প্রথম জীবন সম্পর্কে কিছু বলবেন?
হকিং : গ্যালিলিওর মৃত্যুর ৩০০ বছর পর ১৯৪২ সালের ৮ জানুয়ারি আমার জন্ম। আমার মা-বাবার বাড়ি লন্ডনে হলেও আমার জন্ম অক্সফোর্ডে। কারণ, যুদ্ধের সময় অক্সফোর্ড ছিল সুবিধাজনক একটা জায়গা।
প্রশ্ন : মহাবিশ্ব-সম্পর্কিত তত্ত্বের কারণে গ্যালিলিওকে ধর্মদ্রোহের দায়ে ক্যাথলিক চার্চ কারাবন্দী করেছিল। আপনার সঙ্গে তার কোথাও মিল আছে?
হকিং : হ্যাঁ। অবশ্য, আমার ধারণা, আরও দুই লাখ শিশুও ওই তারিখে জন্ম নিয়েছিল। [হাসি] ওদের কেউ পরে জ্যোতির্বিদ্যায় আগ্রহী হয়েছিল কি না, জানি না।
প্রশ্ন : এক অর্থে আপনার ছোটবেলাটা সাদামাটাই ছিল। আপনার স্কুলজীবনে কৈশোরিক মেধার কোনো বিব্রতকর প্রকাশ ঘটেনি—
হকিং : হ্যাঁ। পাবলিক স্কুলে পড়েছি আমি—আমেরিকানরা যাকে পাবলিক স্কুল বলে আরকি–সেন্ট অ্যালবানস। আমার বাবা আমাকে নামকরা বেসরকারি বিদ্যালয় ওয়েস্টমিনস্টার স্কুলে পড়াতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেন্ট অ্যালবানসে ওয়েস্টমিনস্টারের চেয়ে ভালো শিক্ষাই পেয়েছিলাম।
প্রশ্ন : আপনি গড়পড়তা ছাত্র ছিলেন?
হকিং : [হাসি] ১২ বছর বয়সে আমার এক বন্ধু আমার সঙ্গে এক ব্যাগ লজেন্সের বাজি ধরেছিল যে আমি জীবনে কিছু হতে পারব না। ওই বাজির ফয়সালা হয়েছে কি না, যদি হয়েও থাকে, সেটা কোন দিকে স্থির হয়েছে, আমি জানি না।
প্রশ্ন: সেন্ট অ্যালবানসের পর পদার্থবিদ্যা নিয়ে উচ্চতর পড়াশোনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।
হকিং: বাবা চিকিৎসক ছিলেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল, আমি যেন অক্সফোর্ডে চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করি। কিন্তু আমি গণিত ও পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়তে চেয়েছি। কিন্তু বাবা ভেবেছিলেন, গণিত নিয়ে পড়াশোনা করলে মাস্টারি ছাড়া অন্য চাকরির নিশ্চয়তা নেই। আমাকে রসায়ন, পদার্থবিদ্যা আর কিছু পরিমাণ গণিত নিয়ে পড়ার সুযোগ দেন তিনি। ১৯৫৯ সালে পদার্থবিদ্যা পড়তে ইউনিভার্সিটি কলেজে যাই। পদার্থবিদ্যাই মহাবিশ্বের বিধিবিধান নিয়ন্ত্রণ করে বলে এ বিষয়টিই আমাকে আগ্রহী করে তুলেছিল।
প্রশ্ন : তাহলে প্রথম থেকেই কী হতে চান, সে ব্যাপারে মনস্থির করে ফেলেছিলেন?
হকিং : হ্যাঁ। ১২ বছর বয়সেই বিজ্ঞানী হতে চেয়েছিলাম। কসমোলজি বা সৃষ্টিতত্ত্বই আমার কাছে সবচেয়ে মৌলিক বিজ্ঞান বলে মনে হয়েছে।
প্রশ্ন: ধরে নিচ্ছি, আপনি অক্সফোর্ডে থাকতেও মাঝারি মাপের ছাত্রই ছিলেন।
হকিং: আমার সময়ের অক্সফোর্ডের বেশির ভাগ ছাত্রই সেনাবাহিনীর ছিল। বয়সেও বড় ছিল। অক্সফোর্ডে অনায়াসেই আপনি মেধাবী হবেন কিংবা নিজের সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়ে ফোর্থ ক্লাস ডিগ্রি পাবেন বলে ধরে নেওয়া হতো। ভালো ডিগ্রি পাওয়ার জন্য কঠোর পরিশ্রমকে ভাবা হতো বোকা মানুষের চরিত্র।
প্রশ্ন: অক্সফোর্ডে আপনার শেষ বছরে আপনার এএলএস বা অ্যামিওট্রফিক লেটারাল সিরোসিস বা লু গেরিগস ডিজিজ শনাক্ত করা হয়। অল্প সময়েই এ রোগের পরিণতি মারাত্মক হয়ে ওঠার কথা। নিশ্চয়ই এ ব্যাপারটা আপনাকে পাল্টে দিয়েছিল?
হকিং: হ্যাঁ। আগেভাগে মৃত্যুর আশঙ্কার মুখোমুখি হলে বেঁচে থাকার মূল্য বোঝা যায়। তখন অনেক কিছু করতে ইচ্ছা হয়।
প্রশ্ন: বহুল পঠিত এক সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছিলেন, মারা যাচ্ছেন এটা জানার পর আপনি স্রেফ হাল ছেড়ে দিয়ে বেশ কয়েক বছর নেশার ঘোরে হারিয়ে গিয়েছিলেন—
হকিং : সাক্ষাৎকারের এ গল্পটা ভালো, তবে সত্য নয়।
প্রশ্ন : আসলে কী ঘটেছিল?
হকিং : অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই আমার মৃত্যু ঘটানোর মতো একটা দুরারোগ্য রোগে ভোগার উপলব্ধি কিছুটা ধাক্কার মতো ছিল। আমার বেলায় কেন এমন হবে? কেন আমাকেই এভাবে ছেঁটে ফেলা হবে? কিন্তু হাসপাতালে থাকতেই আমার পাশের বেডে একটা ছেলেকে লিউকেমিয়ায় ভুগে মারা যেতে দেখি। ওটা সুখকর দৃশ্য ছিল না। আমার চেয়ে খারাপ অবস্থার লোকজন ছিল। যখনই নিজের জন্য খারাপ লাগার মতো ঝোঁক এসেছে, ওই ছেলেটার কথা মনে করেছি। প্রশ্ন: তাহলে রটনামতো ওই দীর্ঘ নেশার ঘোরে ছিলেন না আপনি?
হকিং : ভাগনার শুনতে শুরু করেছিলাম, কিন্তু প্রচুর মদ্যপানের খবর অতিরঞ্জন ছিল। মুশকিল হলো, কোথাও একটা কিছু লেখার পর অন্যরা সেটাকে নকল করে। কারণ, আকর্ষণীয় খবর ছিল এটা। অসংখ্যবার ছাপার অক্ষরে হাজির হওয়ায় এটা সত্যি না হয়ে পারে না!
প্রশ্ন: আপনার কোমল প্রতিক্রিয়া বিস্ময়করই ছিল। এ রকম পরিস্থিতিতে বেশির ভাগ লোকই হয়তো হাল ছেড়ে দিত কিংবা অমন নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ত—
হকিং: কিছু সময়ের জন্য আমার স্বপ্নগুলো বিঘ্নিত হয়েছিল। রোগ শনাক্ত হওয়ার আগপর্যন্ত জীবন সম্পর্কে একঘেয়েমিতে ভুগছিলাম। করার মতো কিছু ছিল বলে মনে হয়নি। কিন্তু হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার অল্প পরেই স্বপ্ন দেখলাম আমাকে ফাঁসি দেওয়া হচ্ছে। সহসা উপলব্ধি করলাম, যদি রেহাই মেলে, করার মতো বহু কিছুই আছে। বেশ কয়েকবার দেখা আরেকটা স্বপ্নে অন্যদের জীবন বাঁচাতে জীবন উৎসর্গ করতে দেখি। হাজার হোক, মরতেই যেহেতু হবে, ভালো কিছু করে যাওয়াই উচিত।
প্রশ্ন : ভয়ংকর রোগটা আপনাকে ক্ষুব্ধ করেনি?
হকিং : হ্যাঁ, করেছে। আমি স্বাভাবিক চাহিদা আর আবেগসম্পন্ন একজন সাধারণ মানুষ।
প্রশ্ন : রোগ শনাক্ত হওয়ার পরেই আপনি বিয়ে করেছেন, সংসার শুরু করেছেন –
হকিং: হ্যাঁ। মোটামুটি রোগ শনাক্ত হওয়ার সময়ই জেন ওয়াইল্ডের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। ওর সঙ্গেই আমার বাগ্দান হয়। ওই বাগ্দান আমার জীবন পাল্টে দিয়েছে। বেঁচে থাকার মতো একটা অবলম্বন দিয়েছে। কিন্তু বিয়ে করতে হলে আগে একটা কাজ জোটানোর ব্যাপারও ছিল।
প্রশ্ন : অক্সফোর্ডে আপনার কাজ পাওয়া সহজ হয়নি?
হকিং : হ্যাঁ। শেষতক কিস কলেজে, কেমব্রিজে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার রিসার্চ ফেলোশিপের আবেদন করি। আমাকে অবাক করে দিয়ে ওখানে ফেলোশিপটা মিলে যায়। এর কয়েক মাস পরেই বিয়ে করে ফেলি আমরা।
প্রশ্ন : আপনার অসুখ জীবনধারাকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে?
হকিং: আমাদের বিয়ের পর, জেন তখনো লন্ডনের ওয়েস্টফিল্ড কলেজের আন্ডারগ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থী। ফলে সাপ্তাহিক কাজের দিনগুলোয় ওকে লন্ডনে চলে যেতে হতো। তার মানে, একাকী সামাল দিতে পারার মতো মাঝামাঝি কোথাও একটা থাকার জায়গা খুঁজে বের করা দরকার হয়ে পড়েছিল আমাদের। কারণ, তত দিনে হেঁটে খুব বেশি দূর যেতে পারছিলাম না আমি। কলেজের কাছে সাহায্য চেয়েছিলাম, কিন্তু বাসস্থান দিয়ে ফেলোদের সাহায্য করা কলেজের নিয়মে ছিল না।
প্রশ্ন : কিন্তু আপনি সামলে নিয়েছিলেন—
হকিং : হ্যাঁ। বেশ কয়েক বছর পর কলেজের মালিকানাধীন এ বাড়িটার নিচতলা আমাদের দেওয়া হয়। বড় বড় কামরা আর চওড়া দরজা থাকায় আমার বেশ সুবিধাই হয়েছে। কাছাকাছি হওয়ায় ইলেকট্রিক হুইলচেয়ারে ইউনিভার্সিটি ডিপার্টমেন্ট বা কলেজে যেতে পারতাম। বাগানঘেরা হওয়ায় আমাদের সন্তানদের জন্যও দারুণ জায়গাটা।
প্রশ্ন : তিনটি সন্তানকে বড় করে তোলা নিদারুণ কষ্টের?
হকিং : হ্যাঁ। ১৯৭৪ পর্যন্ত নিজেই বিছানা থেকে ওঠানামা করতে পারতাম। বাইরের সাহায্য ছাড়াই জেন আমাকে সাহায্য করার পাশাপাশি আমাদের দুই সন্তানকে বড় করে তুলতে পেরেছে। কিন্তু অবস্থা ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছিল, আমার রিসার্চ স্টুডেন্টদের একজনকে আমাদের সাহায্য করতে কাছে এনে রেখেছিলাম।
প্রশ্ন : এখন ২৪ ঘণ্টা নার্সিং সেবা লাগছে আপনার?
হকিং : হ্যাঁ। ১৯৮৫ সালে নিউমোনিয়া বাঁধিয়ে বসেছিলাম। ট্র্যাকাটোমি করতে হয়েছিল। এরপর থেকে ২৪ ঘণ্টা সেবার দরকার হয়ে পড়ে।
প্রশ্ন : ওই অপারেশনই কি আপনার কথা বলার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করেছে?
হকিং: হ্যাঁ। অপারেশনের আগে আমার কথা জড়ানো ছিল। আমাকে চেনে এমন অল্প কিছু লোকই আমার কথা বুঝতে পারত। কিন্তু অন্তত যোগাযোগ করতে পারতাম আমি। সেক্রেটারিকে ডিকটেশন দিয়ে বৈজ্ঞানিক চিঠিপত্র লিখেছি। দোভাষী মারফত লেকচারও দিয়েছি। ওরা আমার কথাগুলো আরও স্পষ্ট করে পুনরাবৃত্তি করত।
কিন্তু অপারেশনের পর কার্ডে লেখা হরফের দিকে কেউ ইশারা করলে ভুরু নাচিয়ে বানান করে যোগাযোগ করতে পারতাম। বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ লেখা তো দূরের কথা, এভাবে কথাবার্তা চালিয়ে যাওয়া কঠিন ছিল।
প্রশ্ন : এখন আপনার কাছে কম্পিউটার রয়েছে?
হকিং: ক্যালিফোর্নিয়ার সফটওয়্যার বিশেষজ্ঞ ওয়াল্ট ওল্টসজ আমার দুর্গতির খবর পেয়ে ‘ইকোয়েলাইজার’ নামে তাঁর লেখা একটা কম্পিউটার প্রোগাম পাঠান। এটা হাতের সুইচ টিপে পর্দায় বিভিন্ন মেনু থেকে শব্দ নির্বাচনের সুযোগ করে দিয়েছিল। যে কথা বলতে চাই, সেটা স্থির করার পর স্পিচ সিন্থেসাইজারে পাঠিয়ে দিতে পারি।
প্রশ্ন : গবেষণার জন্য তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা বেছে নিয়েছিলেন কেন? হকিং: আমার রোগের কারণে। আমার এএলএস থাকার কথা জানা ছিল বলেই নিজের কাজের ক্ষেত্র বেছে নিই। অন্য কোনো শাস্ত্রের তুলনায় সৃষ্টিতত্ত্বের বেলায় লেকচারের দরকার পড়ে না। আমার বাক্-প্রতিবন্ধিতা মারাত্মক বাধা নয়, এমন অল্প কয়েকটি বিষয়ের অন্যতম হওয়ায় সুবিধাজনক পছন্দ ছিল এটি। ১৯৬২ সালে গবেষণা শুরুর মুহূর্তে ভাগ্যও সহায় ছিল। সাধারণ আপেক্ষিকতা এবং সৃষ্টিতত্ত্ব অবিকশিত ক্ষেত্র ছিল। প্রতিযোগিতাও ছিল সামান্য। ফলে আমার অসুখ মারাত্মক বাধা হয়ে দাঁড়াত না। অনেক উত্তেজনাকর আবিষ্কার বাকি রয়ে গিয়েছিল, সেগুলো আবিষ্কারের মতো খুব বেশি লোক ছিল না। আজকাল অনেক বেশি প্রতিযোগিতা। [হাসি]
প্রশ্ন : গোড়ার দিকে সমস্যা মোকাবিলা করেছেন?
হকিং : গাণিতিক পটভূমি না থাকায় গবেষণা নিয়ে খুব একটা এগোতে পারছিলাম না, তবে ধীরে ধীরে কী করছি বুঝতে শুরু করি।
প্রশ্ন: আপনার আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম গ্রন্থে স্রেফ একটা মৌলিক সমীকরণ ব্যবহার করেছেন। সেটা আপনার কাজের ভিত্তি নির্মাণ করেছে। আমাদের একটু ব্যাখ্যা করে বলবেন?
হকিং : শক্তি ও ভর যে আসলে একই জিনিস, সেটাই তুলে ধরে E=mc2 সমীকরণটি। E হচ্ছে শক্তি, m ভর। এই সমীকরণে আলোর গতিবেগ c দুই পাশের উপাদানকে সমতা দেওয়ার জন্য। অবশ্য আপনি এমন উপাদান ব্যবহার করতে পারেন, যেখানে c এক-এর সমান। বস্তুকে শক্তিতে এবং বিপরীতক্রমে পাল্টানোর সম্ভাব্যতা তুলে ধরায় এ সমীকরণ গুরুত্বপূর্ণ। আসলে মহাবিশ্বের গোড়ার দিকে সব বস্তুই শক্তি থেকে তৈরি হয়েছিল বলে মনে হয়।
প্রশ্ন: বস্তুতে রূপান্তরিত শক্তি কিংবা মহাবিশ্বকে নির্মাণকারী নিরেট বস্তু –
হকিং: হ্যাঁ। মহাবিশ্বের মহাকর্ষীয় বল শক্তি থেকে ধার করা হয়েছিল, বিগ ব্যাংয়ে ছড়িয়ে পড়ার আগে সবকিছুকে অসীম ঘনত্বে জমাট করে রেখেছিল। মহাবিশ্বের মোট শক্তি শূন্য। এভাবে গোটা মহাবিশ্ব আসলে কিছু না। কে বলে জগতে বিনা পয়সায় খানাপিনা বলে কিছু নেই? [হাসি]
প্রশ্ন : মহাবিশ্বের মোট শক্তি শূন্য হয় কীভাবে?
হকিং : বস্তু সৃষ্টির জন্য শক্তি গ্রহণ করে এটা। কিন্তু মহাবিশ্বের বস্তুগুলো মহাবিশ্বের অন্য সব বস্তুকে আকর্ষণ করছে। এ আকর্ষণ বস্তুকে যে ঋণাত্মক শক্তি জোগাচ্ছে, সেটা বস্তু সৃষ্টিতে প্রয়োজনীয় শক্তির সমান। এভাবে মহাবিশ্বের মোট শক্তি শূন্য।
প্রশ্ন: তাহলে বস্তু সৃষ্টি হয়ে গেলে শক্তি বস্তুতে থেকে যাচ্ছে, গোটা মহাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। তাহলে বিগ ব্যাং ঘটার জন্য যে শক্তির দরকার ছিল, সেটা কোত্থেকে এল?
হকিং : বিগ ব্যাং ঘটার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি এসেছে এর সৃষ্টি মহাবিশ্ব থেকেই।
প্রশ্ন : সমীকরণে সময়ও গুরুত্বপূর্ণ। কেন?
হকিং: আইনস্টাইনের আগে সময়কে স্থান থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ভাবা হতো। লোকে পরম সময়ের অস্তিত্বে বিশ্বাস করত। মানে প্রতিটি ঘটনাকে সময়ের বিচারে অনন্য মূল্য দেওয়া যাবে। কিন্তু পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেখিয়ে দিল যে ব্যাপারটা মোটেও তা নয়। পাশাপাশি আইনস্টাইন দেখিয়ে দিলেন, সময় স্থান থেকে বিচ্ছিন্ন নয়; বরং স্থান-কাল নামে পরিচিত কিছুতে সম্পর্কিত বলা গেলে পরীক্ষা- নিরীক্ষাকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব।
প্রশ্ন: আইনস্টাইনের মতে, তার মানে পর্যবেক্ষণ করা কোনো ঘটনার সময় দর্শকের অবস্থানের ওপর নির্ভরশীল। ফলে তা দৈর্ঘ্য আর উচ্চতার মতো আরও একটা এককে পরিণত হয়—
হকিং : হ্যাঁ। পরে আইনস্টাইন স্থান-কাল সমান না হয়ে বক্র হলেই মহাকর্ষের ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব বলে দেখাতে সক্ষম হলেন। কোনো কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে সিঙ্গুলারিটি বা পরম বিন্দুর অস্তিত্ব থাকবে, যেখানে স্থান ও কাল ফুরিয়ে যায়। এ সিঙ্গুলারিটি বস্তুর অসীমভাবে ঘন একটা বিন্দু, অনেকটা বিগ ব্যাংয়ের সময়কার সিঙ্গুলারিটি এবং স্থান-কাল ও গোটা মহাবিশ্বের সূচনার মতো।
প্রশ্ন : একে কৃষ্ণগহ্বর বলার কারণ কী?
হকিং : সিঙ্গুলারিটির মহাকর্ষীয় শক্তি এত প্রবল হয়ে দাঁড়াবে যে খোদ আলোই এটার আশপাশের এলাকা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না। বরং মহাকর্ষ ক্ষেত্রের টানে ফিরে যাবে। যে অঞ্চল থেকে পালিয়ে আসা সম্ভব নয়, সেটাই কৃষ্ণগহ্বর। এর সীমানাকে বলা হচ্ছে ইভেন্ট হরাইজন বা ঘটনা দিগন্ত।
প্রশ্ন: কৃষ্ণগহ্বর পর্যবেক্ষণ অসাধ্য হলে আপনি কীভাবে খুঁজে পেলেন?
হকিং : ১৯৭০ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত আমি মূলত কৃষ্ণগহ্বর নিয়েই কাজ করেছি। ১৯৭৪ সালে সম্ভবত আমার সবচেয়ে বিস্ময়কর আবিষ্কারটি করি। কৃষ্ণগহ্বর সম্পূর্ণ কালো নয়! সূক্ষ্ম মাত্রার আচরণ হিসেবে ধরলে কণা ও বিকিরণ কৃষ্ণগহ্বর থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। কৃষ্ণগহ্বর এমনভাবে বিকিরণ ছড়ায় যেন তপ্ত কোনো বস্তু।
প্রশ্ন: আপনার তত্ত্ব ঠিক হলে কৃষ্ণগহ্বর শেষমেশ এমনভাবে বিস্ফোরিত হবে, যেটা মহাবিশ্বের সূচনারই অনুরূপ?
হকিং : কোয়ান্টাম মেকানিকসের অনিশ্চয়তার নীতির কারণে কণা ও শক্তি ধীরে ধীরে কৃষ্ণগহ্বর থেকে বেরিয়ে আসবে। ফলে তা ছোট থেকে আরও ছোট হবে এবং আরও দ্রুত শক্তি বেরিয়ে আসবে। শেষ পর্যন্ত কৃষ্ণগহ্বর এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণে অদৃশ্য হয়ে যাবে।
প্রশ্ন: কোয়ান্টাম মেকানিকস কি ক্ষুদ্র মাত্রায় কোনো ব্যবস্থার আচরণ নিয়ে গবেষণা?
হকিং : হ্যাঁ। অণু বা মৌলিক কণা। যা-ই হোক, কৃষ্ণগহ্বর স্রেফ হুট করে হাজির হয়ে বিস্ফোরিত হতে পারে না। কারণ, শক্তির জোগান দেওয়ার জন্য একটা কিছু থাকতেই হবে।
প্রশ্ন: কোনো নক্ষত্রের কারণে সংকুচিত বস্তু সেটার ভেতরেই লুটিয়ে পড়ছে?
হকিং : হ্যাঁ। ভর বা শক্তি সব সময়ই অপরিবর্তিত থেকে যায়। তার মানে বস্তু বা শক্তিহীন স্থান শূন্য থাকবে। আগে থেকেই শূন্য কোনো স্থানে কৃষ্ণগহ্বর দেখা দিতে পারে না। নিজের মহাকর্ষের কারণে নিজের ভেতর লুটিয়ে পড়া কোনো নক্ষত্রের মতো অবশ্যই বস্তু বা শক্তি থেকেই এর সৃষ্টি হতে হবে।
প্রশ্ন : অনুমান বাদ দিয়ে কৃষ্ণগহ্বর আসলে কেমন, তার প্রমাণ দিতে পারেন?
হকিং: কৃষ্ণগহ্বরে ঝাঁপিয়ে পড়ে ভেতরে কী হচ্ছে জানার জন্য আমাদের একজন স্বেচ্ছাসেবী দরকার। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের জানাতে কোনো সংকেত পাঠাতে পারবে না সে।
প্রশ্ন : কেন?
হকিং: তার কারণ লাইট কোন বা আলোক শঙ্কু নামের একটা জিনিস। কোনো ইভেন্টের লাইট কোন A আলোর গতিতে চলমান সংকেতের মাধ্যমে ইভেন্ট থেকে পৌঁছানো সম্ভব কতগুলো ইভেন্টের একটা সিরিজ। এখন আপেক্ষিকতা তত্ত্ব অনুযায়ী আলোর চেয়ে দ্রুতগতিতে কিছুই চলতে পারে না। এভাবে A-এর লাইট কোনের বাইরের কোনো ইভেন্ট B A-র ইভেন্টের কারণে প্রভাবিত হতে পারে না। এবং আলোর চেয়ে কম গতিতে চলার কারণে সংকেত বেরিয়ে আসতে পারে না।
প্রশ্ন : কাল্পনিক সময় কী জিনিস?
হকিং: কাল্পনিক সময় হলো সাধারণ, বাস্তব সময়ের সঙ্গে সমকোণে অবস্থান করা সময়ের আরেকটি পথ। বিপুলসংখ্যক কাল্পনিক সময় ওয়ার্মহোল শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে সর্বত্র মিলে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আমরা প্রত্যক্ষভাবে সেগুলোকে লক্ষ করি না, তবে আমাদের প্রত্যক্ষভাবে লক্ষ করা সবকিছুকেই তারা প্রভাবিত করে। গবেষণার একটা উত্তেজনাকর এলাকা এটা।
গত ১৫ বছরে আমরা বুঝতে পেরেছি যে সময়কে স্থানের সঙ্গে মেলানোর জন্য কোয়ান্টাম তত্ত্বকে কাজে লাগানো যেতে পারে। তার মানে হবে আমরা সময়ের এই একমাত্রিক সরলরেখার মতো আচরণ থেকে দূরে সরে আসতে পারব।
প্রশ্ন: এবং আপনি সময়ের ভেতর দিয়ে ভ্রমণরত বস্তু সম্পর্কে ধারণা করার জন্য কাল্পনিক সময় এবং ওয়ার্মহোল ব্যবহার করছেন, তাই নয় কি?
হকিং : [হাসি] বিভিন্ন বস্তু পাতলা টিউব বা ওয়ার্মহোল হয়ে কাল্পনিক সময়ের ভেতর দিয়ে অন্য এক মহাবিশ্বে কিংবা আমাদের মহাবিশ্বের অন্য অংশে বেরিয়ে যাবে। সাধারণ সময়ে কেউ কৃষ্ণগহ্বরের ভেতর দিয়ে গিয়ে শ্বেতগহ্বর থেকে বেরিয়ে আসতে পারে।
প্রশ্ন : শ্বেতগহ্বর?
হকিং : হ্যাঁ। পদার্থবিদ্যার বিধিবিধান প্রতিসম। কৃষ্ণগহ্বর বলে কিছু থেকে থাকলে যেখানে বস্তু ঢুকতে পারে কিন্তু বেরিয়ে আসতে পারে না, এমন জিনিসও থাকতে বাধ্য যেখান থেকে বস্তু বেরিয়ে আসবে, ঢুকতে পারবে না। একে শ্বেতগহ্বর বা হোয়াইট হোল বলা যেতে পারে।
প্রশ্ন : সাধারণ সময়ে। কিন্তু আপনি বলেছেন সেটা অসম্ভব— হকিং : শ্বেতগহ্বর হচ্ছে কৃষ্ণগহ্বরের সময়-বিপরীত। শ্বেতগহ্বর ভিন্ন মহাবিশ্বে বা আমাদের মহাবিশ্বের ভিন্ন অংশে থাকতে পারে। মহাকাশ ভ্রমণের কাজে আমরা এ পদ্ধতি কাজে লাগাতে পারি। তা না হলে দূরত্ব এত বিরাট যে পাশের ছায়াপথে যেতে-আসতেই কয়েক মিলিয়ন বছর লেগে যাবে। কিন্তু কৃষ্ণগহ্বরের ভেতর দিয়ে শ্বেতগহ্বর হয়ে বেরোতে পারলে নাশতা সারার সময়ের মধ্যেই ফিরে আসতে পারবেন।
প্রশ্ন : এবং তত্ত্বগতভাবে হলেও এটা সম্ভব হলে তবে কি সময়ের অতীতে যেতে পারবেন আপনি?
হকিং : হ্যাঁ। মুশকিল হলো, আপনি রওনা দেওয়ার আগেই প্রত্যাবর্তনে বাধা দেওয়ার মতো কিছু থাকবে না।
প্রশ্ন: কিংবা ফিরে এসে নিজেকে মৃত আবিষ্কার করে বসতে পারেন। কিংবা আপনার বিশ্বকেই মৃত আবিষ্কার করতে পারেন—
হকিং : সৌভাগ্যক্রমে আমাদের টিকে থাকার বেলায় যে স্থান-কালে আমরা অতীতে যেতে পারি, সেটা অস্থিতিশীল মনে হয়। কোনো মহাকাশযান চলার সময় সবচেয়ে কম ঝামেলাটা কৃষ্ণগহ্বর ও শ্বেতগহ্বরের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় সেটাকে চিড়েচ্যাপ্টা করে দিতে পারে। মহাকাশযানের ইতিহাসের অবসান ঘটতে পারে। ছিন্নভিন্ন হয়ে অস্তিত্বহীন হয়ে যেতে পারে।
প্রশ্ন : কিন্তু ধরুন, বাস্তবে ফিরে আসতে গেলে কাল্পনিক সময়ে ওয়ার্মহোল কি ভিন্ন ধরনের?
হকিং: কাল্পনিক সময়ের ওয়ার্মহোলের সিঙ্গুলারিটি বা পরম বিন্দু নেই। যেকোনো পরিস্থিতিতেই ঘটতে পারে। বিভিন্ন কণার আপাত-সংযোগ এমনভাবে পাল্টে দিতে পারে এখনো যার সঠিকভাবে হিসাব বাকি রয়ে গেছে। কিন্তু একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক খুবই তাৎপর্যপূর্ণভাবে প্রভাবিত হয় বলে মনে হয়। এটাই স্থান ও সময়কে প্রসারণ বা সংকোচনের একধরনের সহজাত প্রবণতা জোগানো তথাকথিত মহাজাগতিক ধ্রুবক।
প্রশ্ন : তাহলে এসব কণা যায় কোথায়?
হকিং : বেবি ইউনিভার্সে বা শিশু মহাবিশ্বে। আমার সাম্প্রতিক কিছু কাজের ভিত্তিতে এসব কণা তাদের নিজস্ব শিশু মহাবিশ্বে চলে যাবে। এই শিশু মহাবিশ্ব আবার আমাদের স্থান ও সময়ের অঞ্চলে যোগ দিতে পারে। যদি দেয়, আমাদের চোখে সেটাকে তৈরি হয়েই মিলিয়ে যাওয়া আরেকটা কৃষ্ণগহ্বর বলেই মনে হবে। কৃষ্ণগহ্বরে পড়া কণাগুলো অন্য কৃষ্ণগহ্বর থেকে বিকিরিত কণার মতো মনে হবে এবং বিপরীতক্রমে।
প্রশ্ন : কাল্পনিক সময় ও বাস্তব সময়ের সম্পর্ক কী?
হকিং: কাল্পনিক সংখ্যা ব্যবহারের ভেতর দিয়ে কেউ নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের কণাসমূহের সব ইতিহাসের—যেমন বিশেষ সময়ে নির্দিষ্ট অবস্থান হয়ে যাওয়ার সময়—সম্ভাবনা একত্র করেন। এরপর সেই ফলকে স্থানের দিকের ওপর ভিত্তি করে ভিন্ন বাস্তব স্থান-কালে আঁচ করতে হয়। কোয়ান্টাম থিওরির ক্ষেত্রে খুব বেশি পরিচিত পদ্ধতি নয় এটা, তবে অন্য পদ্ধতির মতো একই ফল জুগিয়ে থাকে।
প্রশ্ন: এ ধরনের দৈবচয়িতা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রয়োগ কঠিন, এমনকি ঝামেলাপূর্ণ করে তোলে না?
হকিং: হ্যাঁ। ‘ঈশ্বর মহাবিশ্ব নিয়ে পাশা খেলেন না’, এ বিখ্যাত মন্তব্যের মাধ্যমে আইনস্টাইন এর জোর বিরোধিতা করেছেন। কিন্তু সব প্রমাণ বলছে, ঈশ্বর সত্যিই একজন নাছোড় জুয়াড়ি। [হাসি] প্রতিটি পর্যবেক্ষণের ফলাফল স্থির করতে ঘুঁটি ছুড়ে মারেন তিনি
ফাইনম্যানের তত্ত্বের ভেতর দিয়ে এ অনিশ্চয়তা সবচেয়ে সুন্দরভাবে সংজ্ঞায়িত হয়েছে। এখানে বলা হচ্ছে, কণার একক, সুসংজ্ঞায়িত পথ বা ইতিহাস নেই। বরং একে সম্ভাব্য সব ক্ষেত্রেই স্থান-কালের ভেতর দিয়ে চলমান হিসেবে দেখতে হবে। প্রতিটি পথ বা ইতিহাসের আকারের ওপর নির্ভরশীল হবে এর মোট সম্ভাবনা। এ ধারণা কার্যকর হতে হলে আমরা যে বাস্তব সময়ে বাস করি, তার চেয়ে বরং কাল্পনিক সময়ে ঘটে যাওয়া ইতিহাসকে বিবেচনা করতে হয়। কোয়ান্টাম মহাকর্ষের বেলায় ফাইনম্যানের ইতিহাসের যোগফলের ধারণায় মহাবিশ্বের বিভিন্ন সম্ভাব্য ইতিহাসের সমষ্টি, অর্থাৎ বিভিন্ন ইউক্লিডীয় বক্র স্থান-কাল অন্তর্ভুক্ত করবে।
সুতরাং, আপনার প্রশ্নের উত্তর হলো, প্রতিটি পথের সঙ্গে সম্পর্কিত জটিল সংখ্যার যোগ সুসংজ্ঞায়িত কোনো যোগফল দেয় না। কিন্তু কোনো ঘটনার আমরা যেমন মনে করে থাকি, সেভাবে সময়ের পরিচিতি কেবল সাধারণ কোনো সংখ্যা না হয়ে বরং একটি জটিল সংখ্যা কল্পনা করলেই সুসংজ্ঞায়িত উত্তর মিলতে পারে।
প্রশ্ন: মোটেই সহজ ধারণা নয়। কাল্পনিক সময় এবং ওয়ার্মহোলের উপলব্ধির কাছে কী ব্যবহার রয়েছে?
হকিং: বেশ, আমরা আদৌ কোনো কৃষ্ণগহ্বর থেকে বেরিয়ে আসতে পারব কি না, সে কথা বলছিলাম। কাল্পনিক সময় কৃষ্ণগহ্বরে লুটিয়ে পড়া কোনো বস্তুর বেরিয়ে আসার উপায় জোগাতে পারে। বাস্তব সময়ে একটি বস্তুর সাধারণ ইতিহাস শেষ হয়ে যাবে। কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে চুরমার হয়ে অস্তিত্বহীন হয়ে যাবে। কিন্তু কেউ যদি কাল্পনিক সময়ে বস্তুর ইতিহাস বিবেচনা করে, মহাবিশ্বের সীমাহীনতার প্রস্তাব সত্যি হয়ে থাকলে সেই ইতিহাস শেষ হয়ে যেতে পারে না।
প্রশ্ন : আপনি কি—সংক্ষেপে—সীমাহীনতার ধারণা ব্যাখ্যা দিতে পারেন?
হকিং : ১৯৮৩ সালে জিম হার্টলে এবং আমি মাত্রার দিক থেকে স্থান ও কাল সসীম কিন্তু কোনো চৌহদ্দি বা প্রান্ত না থাকার প্রস্তাব রেখেছিলাম। আরও দুটি মাত্রাসহ ভূপৃষ্ঠের মতোই হবে এগুলো। ভূপৃষ্ঠ আয়তনের দিক থেকে সীমাবদ্ধ। কিন্তু এর কোনো সীমা নেই। আমি বলতে চাই, যতবার ঘুরে বেড়িয়েছি, কখনো পড়ে যাইনি। [হাসি]
প্রশ্ন: আবার সীমানাহীন অবস্থার প্রসঙ্গে ফেরা যাক : আপনার প্রস্তাব প্রমাণিত হলে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, তাই না?
হকিং : মহাবিশ্ব সীমানাহীন অবস্থায় থাকলে বিজ্ঞানের পক্ষে স্পষ্টতই দারুণ হবে। কিন্তু সেটা কীভাবে বলবেন আপনি? উত্তর হলো, সীমানাহীনতার প্রস্তাব মহাবিশ্বের কেমন আচরণ করা উচিত, তার সুনির্দিষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী করছে।
প্রস্তাব সঠিক হয়ে থাকলে সিঙ্গুলারিটি বা পরম বিন্দু বলে কিছু থাকবে না এবং বিজ্ঞানের বিধিবিধান মহাবিশ্বের সূচনাকাল থেকে সর্বত্র প্রযোজ্য হবে। বিজ্ঞানের বিধান অনুযায়ী, মহাবিশ্বের সূচনা নির্ধারণ করা হবে। মহাবিশ্বের সূচনা জানার লক্ষ্যে আমি সফল হতে পারতাম। তার পরও কারণ জানতে পারতাম না।
প্রশ্ন : কিন্তু আপনি বলেছেন না সীমানাহীন অবস্থায় সিঙ্গুলারিটির অস্তিত্ব থাকবে না। আপনার কাজে সব সময়ই কি সিঙ্গুলারিটির প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেননি?
হকিং: সিঙ্গুলারিটিজ-সংক্রান্ত মতামতের পরিবর্তন লক্ষ করা কৌতূহলোদ্দীপক। আমি গ্র্যাজুয়েট ছাত্র থাকতে বলতে গেলে কেউ একে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি। এখন সিঙ্গুলারিটি থিওরেমের পরিণতিতে সবাই বিশ্বাস করছে যে মহাবিশ্ব সিঙ্গুলারিটি নিয়েই সূচিত হয়েছিল।
অবশ্য এরই মধ্যে আমি মত পাল্টে ফেলেছি। আমি এখনো বিশ্বাস করি, মহাবিশ্বের একটা শুরু ছিল, কিন্তু সেটা সিঙ্গুলারিটি নয়।
প্রশ্ন : কীভাবে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন?
হকিং : আপেক্ষিকতার সাধারণ সূত্রকে বলা হচ্ছে ক্ল্যাসিক্যাল থিওরি বা ধ্রুপদি তত্ত্ব। অর্থাৎ এটা কণার যে নির্দিষ্ট অবস্থান ও গতি নেই, বরং কোয়ান্টাম মেকানিকসের অনিশ্চয়তার নীতিমালার কারণে ক্ষুদ্র অঞ্চলে লেপ্টে থাকে, সেই বাস্তবতাকে বিবেচনা করে না। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে এতে কিছু এসে যায় না। কারণ, কোনো কণার অবস্থানের অনিশ্চয়তার সঙ্গে তুলনা করলে স্থান-কালের বাঁকের ব্যাসার্ধ অনেক বড়।
অবশ্য সিঙ্গুলারিটি থিওরেম স্থান-কাল মহাবিশ্বের বর্তমান সম্প্রসারণ পর্যায়ের শুরুতে বাঁকের ছোট ব্যাসার্ধের ক্ষেত্রে অনেক বেশি বিকৃত হওয়ার ইঙ্গিত দেয়। এ পরিস্থিতিতে অনিশ্চয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে। এভাবে সাধারণ আপেক্ষিকতা সিঙ্গুলারিটির ভবিষ্যদ্বাণী করার ভেতর দিয়ে নিজেরই পতন ডেকে আনছে। মহাবিশ্বের সূচনা নিয়ে আলোচনার জন্য আমাদের এমন একটা তত্ত্ব দরকার, যেটা সাধারণ আপেক্ষিকতাকে কোয়ান্টাম মেকানিকসের সঙ্গে সমন্বয় করবে।
প্রশ্ন : অধরা সমন্বিত তত্ত্ব কিংবা টিওই [থিওরি অব এভরিথিং]?
হকিং: আমরা এখনো কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি তত্ত্বের সঠিক রূপ জানতে পারিনি। আপাতত সুপারস্ট্রিং তত্ত্বই আমাদের সামনে সেরা প্রার্থী। কিন্তু এখনো বেশ কিছু অমীমাংসিত সমস্যা রয়ে গেছে। অবশ্য আমরা যেকোনো বৈধ তত্ত্বে উপস্থিত থাকবে এমন নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য প্রত্যাশা করি। একটি হলো বস্তু এবং শক্তির কারণে বক্র বা বিকৃত স্থান-কালের মাধ্যমে মহাকর্ষের প্রভাব তুলে ধরা যেতে পারার আইনস্টাইনের ধারণা। এ বক্র স্থানে সব বস্তুই সরলরেখায় সবচেয়ে কাছের বস্তুর কাছে যেতে চায়। অবশ্য স্থান বাঁকানো বলে যেন কোনো মহাকর্ষ ক্ষেত্রের কারণে সেগুলোর পথ বাঁকা মনে হয়।
প্রশ্ন: আপনি ফাইনম্যানের সামওভার থিওরিও অন্তর্ভুক্ত করেছেন—
হকিং : হ্যাঁ, আমরা রিচার্ড ফাইনম্যানের কোয়ান্টাম তত্ত্বকে পরম তত্ত্বে উপস্থিত ইতিহাসের যোগফল আকারে তুলে ধরতে পারব বলে আশা করি। মনে রাখবেন, এটা স্থান-কালে কোনো কণার সব ধরনের সম্ভাব্য পথ বা ইতিহাস থাকার ধারণা। এ ধরনের স্থানের সম্ভাবনা তত্ত্ব দিয়ে নয়, বরং এক ধরনের খামখেয়ালির সঙ্গে নির্ধারণ করতে হবে।
প্রশ্ন: ‘একধরনের খামখেয়ালির সঙ্গে’–আবার দৈবচয়িতা?
হকিং: এর মানে হচ্ছে বিজ্ঞান স্থান-কালের ক্ষেত্রে এ ধরনের একক ইতিহাসের সম্ভাবনা আঁচ করতে পারে না বলে মহাবিশ্বের কেমন আচরণ করা উচিত, তা-ও অনুমান করতে পারে না। অবশ্য এমনও হাতে পারে যে মহাবিশ্ব কেবল সামওভার ননসিঙ্গুলার ইউক্লিডীয় বাঁকা স্থানে সংজ্ঞায়িত অবস্থায় রয়েছে। এ ক্ষেত্রে তত্ত্ব মহাবিশ্বকে সম্পূর্ণভাবে সংজ্ঞায়িত করবে, এর সূচনা নির্ধারণের জন্য কাউকে মহাবিশ্বের বাইরের কোনো শক্তির শরণ নিতে হবে না।
এক দিক থেকে একটি ননসিঙ্গুলার ইতিহাসের যোগফলে মহাবিশ্বের অবস্থা নির্ধারিত হওয়ার প্রস্তাব অনেকটা ল্যাম্পপোস্টের নিচে মাতালের চাবি খোঁজার মতো। সেটা তার খোয়ানোর জায়গা না-ও হতে পারে, কিন্তু একমাত্র ওখানেই খুঁজে পাওয়ার মতো যথেষ্ট আলো রয়েছে।
একইভাবে মহাবিশ্ব হয়তো ননসিঙ্গুলার ইতিহাসের যোগফলে সংজ্ঞায়িত অবস্থায় নেই, কিন্তু একমাত্র এই অবস্থাতেই বিজ্ঞান মহাবিশ্বের কেমন হওয়া উচিত, তার আভাস দিতে পারে।
প্রশ্ন : কথাটা বলতে খারাপ লাগছে, কিন্তু সীমানাহীন প্রস্তাব ভুল হয়ে থাকলে?
হকিং: [হাসি] পর্যবেক্ষণ অনুমানের সঙ্গে না মিললে, আমরা জানতে পারব যে সম্ভাব্য ইতিহাসের কাতারে অবশ্যই সিঙ্গুলারিটি রয়েছে। অবশ্য কেবল এটুকুই জানতে পারব আমরা। এভাবে আমরা মহাবিশ্বের কেমন আচরণ করা উচিত, তার আভাস দিতে পারব না।
কেউ হয়তো ভাবতে পারেন, কেবল বিগ ব্যাংয়ের মুহূর্তে ঘটে থাকলে এ অনুমান অযোগ্যতায় কিছু যাবে আসবে না। হাজার হোক, রাজনীতির ক্ষেত্রে একটা সপ্তাহ বেশ দীর্ঘ হয়ে থাকলে, ১০ মিলিয়ন বছর অনন্তের কাছাকাছিই বটে। কিন্তু বিগ ব্যাংয়ের অতি জোরালো মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রে অনুমানযোগ্যতা ভেঙে পড়লে, যেকোনো নক্ষত্রের ধ্বংসের সময়ও তা ঘটতে পারে। কেবল আমাদের ছায়াপথেই সপ্তাহে বেশ কয়েকবার ঘটতে পারে এমন। এভাবে, এমনকি আবহাওয়ার পূর্বাভাসের বিচারেও আমাদের অনুমানের ক্ষমতা হবে খুব দুর্বল।
প্রশ্ন : এবং…
হকিং : তাহলে সীমানাহীনতার প্রস্তাব মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে কী অনুমান করছে? প্রথম যে কথাটি বলতে হয়, সেটা হলো মহাবিশ্বের সব সম্ভাব্য ইতিহাস মাত্রার দিক থেকে সসীম হওয়ায় সময়ের পরিমাপ হিসেবে কেউ যেকোনো একক ব্যবহার করুক না কেন, তার হাতে একটা বৃহত্তম ও একটা ক্ষুদ্রতম সংখ্যা থাকবে। সুতরাং মহাবিশ্বের একটা আদি ও অন্ত থাকবে। অবশ্য শুরুটা সিঙ্গুলার বা একক হবে না, বরং পৃথিবীর উত্তর মেরুর মতো হবে সেটা। কেউ যদি ভূপৃষ্ঠের অক্ষাংশের ডিগ্রিগুলোকে সময়ের অ্যানালগ হিসেবে ধরে নেয়, তাহলে বলা যাবে ভূপৃষ্ঠের শুরু হয়েছে উত্তর মেরুতে। কিন্তু উত্তর মেরু পৃথিবীর বুকে নেহাতই সাধারণ একটি বিন্দু। এর বিশেষত্ব বলে কিছু নেই। আবার পৃথিবীর অন্যান্য জায়গার মতো একই নিয়মকানুন উত্তর মেরুতেও খাটে। একইভাবে মহাবিশ্বের সূচনা হিসেবে তকমা দিতে আমরা যে ঘটনাকে বেছে নেব, সেটাও স্থান-কালের বিচারে অন্য যেকোনো কিছুর মতো সাধারণ একটা বিন্দুই হবে। বিজ্ঞানের বিধিবিধান অন্যান্য জায়গার মতো এই সূচনাতেও খাটবে!
প্রশ্ন: আপনার কাজ থেকে আমরা যতটা বুঝতে পারছি—যত বেশি বা কম—এটা আবার আমাদের চোখে পড়ে যে আপনার ধারণাগুলো সাধারণ, পর্যবেক্ষণযোগ্য জীবন থেকে বহুদূরের অস্পষ্ট গাণিতিক ধারণার ওপর নির্ভরশীল—
হকিং : কাল্পনিক সময়কে হয়তো বিজ্ঞান কল্পগল্পের মতো মনে হতে পারে, কিন্তু এটা সুসংজ্ঞায়িত গাণিতিক ধারণা।
প্রশ্ন : হ্যাঁ, গণিতবিদ এবং পদার্থবিদদের কাছে, কিন্তু আমাদের বেশির ভাগের বেলায় এটা অনায়াসবোধের অতীত—
হকিং : হ্যাঁ।
প্রশ্ন : তাহলে সাধারণ মানুষ এসব ধারণা বোঝার চেষ্টা করতে গিয়ে কী উপকার পাবে? বেশির ভাগই বলবে সামাল দেওয়ার মতো আরও জরুরি সমস্যা আছে আমাদের-
হকিং : এ কারণেই আমরা কী করছি তার ব্যাখ্যা জোগাতে কিছু সময় দিচ্ছি। আমার মনে হয় সৃষ্টিবিজ্ঞানের সাম্প্রতিক অগ্রগতির সাধারণ ধারণাসংক্রান্ত জ্ঞান জনসাধারণের পক্ষে উপকারী।
এটা ঠিক যে সৃষ্টিবিজ্ঞান বোঝার ফলে কারও পেট ভরবে না। এমনকি তা কাপড়চোপড় আরও পরিষ্কার করবে না। কিন্তু নারী বা পুরুষ কেবল খেয়ে-পরে বাঁচে না। আমরা সবাই নিজেদের যে মহাবিশ্বে আবিষ্কার করেছি, তার সঙ্গে বোঝাপড়ায় আসার এবং আমরা এখানে কেমন করে এসেছি জানার প্রয়োজনীয়তাটুকু বুঝতে পারি।
প্রশ্ন : সে কারণেই আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম লিখেছেন?
হকিং: বইটি লেখার বেশ কয়েকটি কারণ আছে। একটি হচ্ছে আমার মেয়ের স্কুলে ফি মেটানো। অবশ্য তাতে সফল হতে পারিনি কারণ, বইটা বেরোতে বেরোতে হাইস্কুলের শেষ ক্লাসে পৌঁছে গিয়েছিল সে। কিন্তু ওর কলেজের খরচা মেটানোর দরকার ছিল বটে।
প্রশ্ন : কারণটা অসাধারণ। আরও কোনো কারণ?
হকিং : মূল কারণ ছিল বেশ কিছু জনপ্রিয় নিবন্ধ লিখেছিলাম এবং কয়েকটি জনপ্রিয় লেকচারও দিয়েছিলাম। সেগুলোর সব কটিই গৃহীত হয়। কাজ করতে গিয়ে মজা পেয়েছি, কিন্তু আরও বড় কিছু চাইছিলাম আমি। আমার মনে হয়েছিল, গত ২৫ বছরে মহাবিশ্বের উপলব্ধির ক্ষেত্রে আমরা বিপুল অগ্রগতি অর্জন করেছি। সাধারণ মানুষের সঙ্গে সেসব ভাগাভাগি করে নিতে চেয়েছি। আমার মনে হয়, বিজ্ঞানে সাধারণ মানুষের কিছুটা আগ্রহী হয়ে ওঠা এবং মোটামুটি উপলব্ধি থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ।
বিজ্ঞান আমাদের জীবন বিপুলভাবে পাল্টে দিয়েছে। ভবিষ্যতে আরও বেশি করে পাল্টে দেবে। সমাজ কোন দিকে যাবে, সেটা যদি আমাদের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে স্থির করতে হয়, সে ক্ষেত্রে জনগণের বিজ্ঞানের কিছুটা উপলব্ধি থাকা দরকার।
প্রশ্ন : তাহলে রাজনীতি-জাতীয় কিছু একটা করছেন আপনি—মহান সাম্য স্থিরকারী হিসেবে জ্ঞান, ভাষা জানা অল্প কিছুর ভেতর সীমিত নয়—
হকিং : মহাবিশ্ব কীভাবে কাজ করে, কীভাবে এর শুরু হয়েছিল, সেই জ্ঞান ও উপলব্ধি মুষ্টিমেয় বিশেষজ্ঞের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু আমরা সবাই মানুষ জাতির অবস্থার ভাগীদার বলে আমরা কোত্থেকে এসেছি সবাই জানতে চাই। আমার বইটি বিশেষজ্ঞদের আবিষ্কার করা জ্ঞান সাধারণ মানুষের সঙ্গে ভাগাভাগি করার প্রয়াস। সাধারণভাবে বিশেষজ্ঞরা কেবল অন্য বিশেষজ্ঞের সঙ্গেই যোগাযোগ করেন; আমার মনে হয় সাধারণ মানুষের সঙ্গেও তাঁদের যোগাযোগ করা উচিত।
প্রশ্ন : আপনি বলেছেন যে মহাবিশ্বের সূচনা হয়তো জানতে পারবেন, কিন্তু কারণ জানতে পারবেন না। আপনিও আইনস্টাইনের মতো পরম স্রষ্টার ধারণাকে নাকচ করছেন না—
হকিং : আমার মনে হয় আমার বইটিতে যত্নশীল ছিলাম। ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে কি না এবং তার বৈশিষ্ট্য কেমন হওয়া উচিত, সে প্ৰশ্ন উন্মুক্ত রেখে দিয়েছি। কেউ কখনো ঈশ্বরের অস্তিত্বহীনতা প্ৰমাণ করতে পারবে না। আমি যেটা দেখিয়েছি সেটা হলো, মহাবিশ্বের সূচনা কীভাবে হয়েছে, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ঈশ্বরের শরণাপন্ন হওয়ার দরকার নেই। কারণ, সেটা বিজ্ঞানের নিয়মকানুনেই স্থির হয়েছে। তবে কেউ বলতে পারেন, বিজ্ঞানের নিয়মকানুন মহাবিশ্বের আচরণের ঈশ্বর নির্ধারিত বিধান
প্রশ্ন : আপনার মেয়ের কলেজের ফি মেটানো বাদে ওই বইটি কি আপনার জীবনের আর কোনো পরিবর্তন এনেছিল?
হকিং : : খুব একটা পরিবর্তন ঘটায়নি। এমনকি ওই বইয়ের আগেই উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ, মূলত আমেরিকান [হাসি] পথে-ঘাটে আমার দিকে এগিয়ে আসত। তবে বইটি এ ধরনের সাক্ষাৎ আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। এ ছাড়া বিভিন্ন সাক্ষাৎকার ও পাবলিক লেকচারের মতো ব্যাপারগুলো আমার গবেষণার সীমিত সময় দখল করে নিয়েছে অবশ্য এখন এসব কমিয়ে দিয়ে গবেষণায় ফিরে যাচ্ছি।
প্রশ্ন : আমরা ধরে নিচ্ছি সব বিজ্ঞানীই তাঁর প্রয়াসের বিনিময়ে স্বীকৃতি আশা করেন। আপনি বেশ কিছু পুরস্কার পেয়েছেন, কিন্তু এখনো নোবেল পুরস্কার পাননি। কোনো একদিন নোবেল পুরস্কার পাবেন বলে মনে করেন?
হকিং : আমার বেশির ভাগ কাজই সাধারণভাবে গৃহীত হয়েছে। সম্প্রতি বহু স্বীকৃতি পেয়েছি। কিন্তু জানি না কখনো নোবেল পুরস্কার পাব কি না। কারণ, কেবল পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া তাত্ত্বিক কাজের জন্যই এটা দেওয়া হয়। আমি যেসব বিষয় নিয়ে কাজ করেছি, সেগুলো পর্যবেক্ষণ করা অত্যন্ত কঠিন। [হাসি]
* সাক্ষাৎকারটি ১৯৯০ সালের এপ্রিলে প্লেবয় ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়।
হকিংয়ের মৃত্যুর পর এর বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয় সিল্করুট-এ মার্চ ২৩, ২০১৮ সালের সংখ্যায়। অনুবাদ করেছেন শওকত হোসেন।
পরিভাষা
অতিপারমাণবিক Subatomic
অতিস্ফীতি Inflationary
অবিচ্ছিন্ন Continuous
অবিচ্ছেদ্য Inseparable
অনিশ্চয়তার নীতি Uncertainty principle
ইলেকট্রন Electron
এক্স-রে X-rays
এনট্রপি Entropy
ওয়ার্মহোল Wormhole
কণা Particle
কণাত্বরক যন্ত্র Particle accelerator
কক্ষপথ Orbit
কম্পাঙ্ক Frequency
কিনারা Edge
কোয়ার্ক Quark
কোয়ান্টাম অবস্থা Quantum state
কোয়ান্টাম প্রভাব Quantum effect
কোয়ান্টাম বলবিদ্যা Quantum mechanics
কোয়ান্টাম তত্ত্বের অনিশ্চয়তা Uncertainty of quantum theory
কোয়ান্টাম মহাকর্ষ Quantum gravity
কোয়াসার Quasars
কৌণিক ভরবেগ Angular momentum
কৌশল Mechanism
কৃষ্ণগহ্বর Black hole গাণিতিক Mathematical
গামা রশ্মি Gamma rays
ঘটনা দিগন্ত Event horizon
ঘনত্ব Density
চাপ Pressure
চার্জ Charge
চুপসে Collapse
চিরায়ত তত্ত্ব Classical theory
তরঙ্গ Wave
তরঙ্গদৈর্ঘ্য Wavelength
তথ্য Information
তাপমাত্রা Temperature
তাপগতিবিদ্যা Thermodynamics
দ্বৈততা Duality
নিউট্রন Neutron
নিউট্রন তারা Neutron star
নিউক্লিয়াস Nucleus
নিউক্লিয়ার ফিউশন Nuclear fusion
নিউক্লিয়ার জ্বালানি Nuclear fuel
নিমিত্তবাদ Determinism
নিঃসরণ Emit
পরমাণু Atom
পরমাণু কেন্দ্র Nuclei
পরম বিন্দু বা অনন্যতা Singularity
পরম সময় Absolute time
পরম শূন্য Absolute zero
পজিট্রন Positron
পারমাণবিক ফিউশন Nuclear fusion
প্রতিসাম্যতা Symmetric
প্রতিবস্তু Antimatter
প্রতিকণা Antiparticle
প্রতিবিশ্ব Antiworlds
প্রতিমানুষ Antipeople
পৃষ্ঠতল Aurface
প্রোটন Proton
ফোটন Photon
বক্রতা Curvature
বর্ণালি Spectrum
বল Force
বিকিরণ Radiation
ব্যাসার্ধ Radius
ব্যাপ্তি Extent
বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল Electromagnetic
বৈদ্যুতিক চার্জ বা আধান Electric charge
বৈজ্ঞানিক নিমিত্তবাদ Scientific determinism
বৃশ্চিক-মহিষাসুর Scorpius-Centaurus
ভর Mass
ভার্চুয়াল বা কাল্পনিক কণা Virtual Particle
মহাবিশ্ব Universe
মহাবিস্ফোরণ Big bang মহাকর্ষ Gravity