কৃষ্ণগহ্বর তত কালো নয়
সম্প্রচার : ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬
আমার আগের বক্তৃতায় আপনাদের উৎকণ্ঠার এক কিনারায় ফেলে রেখেছিলাম আমি। অর্থাৎ নক্ষত্রদের সংকোচনে তৈরি হওয়া অবিশ্বাস্য রকম ঘন বস্তু বা কৃষ্ণগহ্বরের প্রকৃতি-সম্পর্কিত একটা প্যারাডক্সে ঝুলিয়ে রেখেছিলাম। একটা তত্ত্বমতে, অসীমসংখ্যক বিভিন্ন ধরনের নক্ষত্রদের থেকে একই রকম গুণসম্পন্ন কৃষ্ণগহ্বর গঠিত হতে পারে। আরেকটা তত্ত্ব অনুযায়ী, সম্ভাব্য এই ধরনগুলো সসীম হতে পারে। এটি হলো তথ্যসংক্রান্ত সমস্যা, অর্থাৎ মহাবিশ্বের প্রতিটি কণা এবং প্রতিটি বলেরই হ্যাঁ-না সূচক প্রশ্নের একটা ঊহ্য উত্তর থাকে।
বিজ্ঞানী জন হুইলার বলেছিলেন, ‘কৃষ্ণগহ্বরের কোনো লোম থাকে না’। সে কারণে বাইরে থেকে কারও পক্ষেই বলা সম্ভব নয়, কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে তার ভর, ঘূর্ণন অবস্থা এবং বৈদ্যুতিক চার্জ ছাড়া আর কী আছে। এর অর্থ একটি কৃষ্ণগহ্বরে বিপুলসংখ্যক তথ্য থাকতে পারে, সেগুলো বাইরের বিশ্ব থেকে লুকানো থাকে। কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে লুকিয়ে রাখা এই তথ্যের পরিমাণ যদি তার আকারের ওপর নির্ভর করে, তাহলে সাধারণ নীতি থেকে আশা করা যায়, ওই কৃষ্ণগহ্বরটির একটি তাপমাত্রাও আছে। সে ক্ষেত্রে সেটি একটি উত্তপ্ত ধাতব খণ্ডের মতো দ্যুতিও ছড়াবে। কিন্তু এটা ঘটা অসম্ভব। কারণ, সবারই জানা ছিল, কৃষ্ণগহ্বর থেকে কোনো কিছুই বাইরে বেরিয়ে আসতে পারবে না। তখন এমনটাই ভাবা হতো।
এই প্যারাডক্সটা নাছোড়বান্দার মতো ঝুলে ছিল ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত। সে সময় আমি কোয়ান্টাম বলবিদ্যা অনুযায়ী একটি কৃষ্ণগহ্বরের আশপাশের এলাকার বস্তুদের আচরণ কেমন হবে, তা নিয়ে অনুসন্ধান চালাচ্ছিলাম।
ডেভিড শুকম্যান : কোয়ান্টাম বলবিদ্যা হলো চরমভাবে ক্ষুদ্র কণাদের বিজ্ঞান। এটি ক্ষুদ্রতম কণাদের আচরণ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে। কোনো গ্রহ বা অন্য বড় কোনো বস্তুর চলাফেরার জন্য ব্যবহার করা কোনো সূত্র অনুসারে এসব কণা ব্যাখ্যা করা যায় না। অর্থাৎ আইজ্যাক নিউটনের প্রথম কাঠামোবদ্ধ করা সূত্রগুলো এখানে অকার্যকর। ক্ষুদ্র কণাদের বিজ্ঞান ব্যবহার করে বৃহৎ পরিসরের কোনো বস্তুদের গবেষণার ক্ষেত্রে স্টিফেন হকিংয়ের এই অর্জন অনেকটা পথিকৃতের মতো।
স্টিফেন হকিং: আমি বিপুল বিস্ময়ে দেখতে পেলাম, স্থিতিশীল অবস্থায় কৃষ্ণগহ্বর কণা নিঃসরণ করে বলে মনে হয়। ওই সময়ে অন্য সবার মতোই আমিও এই নীতিবাক্য মেনে নিয়েছিলাম যে কৃষ্ণগহ্বর কোনো কিছু নিঃসরণ করতে পারে না। তাই এই বিব্রতকর প্রভাব সম্পর্কে ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করতে গিয়ে অনেক শ্রম দিয়েছিলাম। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে যত ভাবলাম, ততই চলে যেতে অস্বীকার করতে লাগল সেটি। তাই শেষ পর্যন্ত সেটিই মেনে নিলাম শেষ পর্যন্ত আমাকে বিশ্বাস করাতে বাধ্য করে যে সত্যিকার ভৌত প্রক্রিয়াটি ছিল বহির্গামী কণাগুলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য নির্ভুলভাবে তাপীয় আমার গণনা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল, একটি কৃষ্ণগহ্বর কণা ও বিকিরণ তৈরি ও নিঃসরণ করে। যেন সেটি কোনো সাধারণ উত্তপ্ত বস্তু। তারও এমন একটি তাপমাত্রা থাকে, যা তার পৃষ্ঠতলের মহাকর্ষের সমানুপাতিক এবং তার ভরের ব্যস্তানুপাতিক।
ডেভিড শুকম্যান : এই গণনা প্রথমবার প্রমাণ করেছিল, একটি কৃষ্ণগহ্বরকে অন্ধগলিযুক্ত কোনো একমুখী পথ হওয়ার প্রয়োজন নেই। এই তত্ত্বে যে নিঃসরণের প্রস্তাব করা হলো, সেটি যে একসময় হকিং রেডিয়েশন নামে পরিচিত হয়ে উঠবে, তাতে আর অবাক হওয়ার কী আছে।
স্টিফেন হকিং : এই সময় থেকে, কৃষ্ণগহ্বর যে তাপীয় বিকিরণ নিঃসরণ করে তার সপক্ষে গাণিতিক প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল। আর সেগুলো অন্যান্য অনেকে বিভিন্ন পদ্ধতিতে নিশ্চিত করেছিল। এই নিঃসরণকে বোঝার একটি উপায় এ রকম: কোয়ান্টাম বলবিদ্যা ইঙ্গিত করে যে পুরো স্থানই কাল্পনিক কণা আর প্রতিকণার জোড়া দিয়ে পরিপূর্ণ। সেগুলো অনবরত জোড়ায় জোড়ায় মূর্ত হচ্ছে, আলাদা হচ্ছে। তারপর তারা আবারও একত্রে কাছাকাছি এসে পরস্পরকে ধ্বংস করে ফেলছে।
ডেভিড শুকম্যান : একটি শূন্যস্থান কখনোই পুরোপুরি শূন্য থাকে না—এই আইডিয়ার ওপর এই ধারণা নির্ভরশীল। সংক্ষেপে বলা যায়, কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অনিশ্চয়তার নীতি অনুযায়ী, সেখানে সব সময়ই কণাদের অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনা থাকে। আর সেখানে সব সময়ই জোড়ায় জোড়ায় কণা থাকবে, যারা বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে পরস্পরের বিপরীত। কণাগুলো হাজির হবে এবং ক্রমান্বয়ে হারিয়েও যেতে থাকবে।
স্টিফেন হকিং: এই কণাদের বলে ভার্চুয়াল পার্টিকেল বা কাল্পনিক কণা। কারণ, এরা বাস্তব কণাদের মতো নয়। পার্টিকেল অ্যাকসিলারেটর বা কণাত্বরক যন্ত্র দিয়ে তাদের সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা যায় না। তবু তাদের পরোক্ষ প্রভাব পরিমাপ করা যায় এবং তাদের অস্তিত্ব একটি ছোট কৌশলের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়েছে।
এই কৌশলকে বলা হয় ল্যাম্ব শিফট। উত্তেজিত হাইড্রোজেন মাধ্যমে পরমাণুর আলো-বর্ণালি শক্তি নিঃসরণ পর্যায়ে সেগুলো সৃষ্টি হয়। এখন একটি কৃষ্ণগহ্বরের উপস্থিতিতে কাল্পনিক কণা জোড়ার একটি সদস্য যদি গর্ত বা গহ্বরের মধ্যে পড়ে যায়, তাহলে অন্য সদস্যটি আর ধ্বংস হবে না। টিকে যাবে। টিকে থাকা এই কণা বা প্রতিকণাটি হয়তো তার সঙ্গজোড়ের পরে কৃষ্ণগহ্বরে পড়েও যেতে পারে। অথবা কণাটি অসীমের দিকেও বেরিয়ে যেতে পারে। তখন একে দেখে মনে হবে সেটি যেন কৃষ্ণগহ্বরটি থেকে বিকিরণ হিসেবে নিঃসৃত হলো।
ডেভিড শুকম্যান : এখানে মূল বিষয়টি হলো, ওই সব কণার সৃষ্টি ও হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি সাধারণত অলক্ষ্যেই ঘটে। তবে এই প্রক্রিয়াগুলো যদি কৃষ্ণগহ্বরের কিনারায় ঘটে, তাহলে কণাজোড়ার একটি হয়তো কৃষ্ণগহ্বর টেনে ভেতরে নিয়ে যেতে পারে। আর, অন্য কণাটি হয়তো কৃষ্ণগহ্বর থেকে বেরিয়ে যেতে পারে। যে কণাটি বাইরে বেরিয়ে এল, তাকে দেখে মনে হবে, সেটা যেন কৃষ্ণগহ্বর থেকে নিঃসৃত হলো।
স্টিফেন হকিং: সূর্যের মতো ভরের সমান একটি কৃষ্ণগহ্বর এতই ধীরগতিতে কণা নিঃসরণ করতে পারে যে এই প্রক্রিয়া শনাক্ত করা অসম্ভব। তবে কোথাও হয়তো একটা ছোট মিনি কৃষ্ণগহ্বর থাকতেও পারে। ধরা যাক, সেটা কোনো পর্বতের সমান। পৰ্বত- সমান একটি কৃষ্ণগহ্বর প্রায় ১০ মিলিয়ন মেগাওয়াট হারে এক্স-রে এবং গামা রশ্মি বিকিরণ করবে। এটা পুরো বিশ্বের বিদ্যুৎ চাহিদার জোগান দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। অবশ্য কোনো মিনি কৃষ্ণগহ্বরকে বশ মানানোর প্রক্রিয়াটা মোটেও সহজ কাজ নয়। একে কোনো পাওয়ার স্টেশনেও রাখা যাবে না। কারণ, তা মেঝের ভেতর দিয়ে পড়ে যাবে এবং একসময় পৃথিবীর কেন্দ্রে গিয়ে থামবে। আমাদের কাছে যদি এমন কোনো কৃষ্ণগহ্বর থাকত, তাহলে তাকে বশে রাখার একমাত্র উপায় হবে, তাকে পৃথিবীর চারপাশের কক্ষপথে রাখা।
অনেকেই এ রকম ভরের মিনি কৃষ্ণগহ্বরের খোঁজ করছেন, কিন্তু এ পর্যন্ত একটাও পাওয়া যায়নি। বিষয়টি দুঃখজনক। কারণ, এ রকম কিছু পাওয়া গেলে আমি নোবেল পুরস্কার পেতাম! অবশ্য আরেকটি সম্ভাবনা হলো, স্থান-কালের অতিরিক্ত মাত্রাগুলোতে আমরা হয়তো মাইক্রো কৃষ্ণগহ্বর তৈরি করতে পারব।
ডেভিড শুকম্যান : এই অতিরিক্ত মাত্রাগুলো দিয়ে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পরিচিত তিন মাত্রা এবং চতুর্থ মাত্রা সময়ের বাইরের কিছুকে বোঝানো হয়েছে। চুম্বকীয় বলসহ অন্যান্য বলের চেয়ে মহাকর্ষ বল এত দুর্বল কেন—সেটি ব্যাখ্যা করতে এই অতিরিক্ত মাত্রাবিষয়ক ধারণার সূচনা। মহাকর্ষ হয়তো সমান্তরাল মাত্রাগুলোতেও কাজ করে বলে ধারণা করা হয়।
স্টিফেন হকিং : কিছু তত্ত্ব অনুযায়ী, আমরা যে মহাবিশ্ব প্রত্যক্ষ করি, তা কোনো ১০ বা ১১ মাত্রিক স্থানের মধ্যে শুধু চারমাত্রিক পৃষ্ঠতল। এটা কেমন হতে পারে, সে সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া যায় ইন্টারস্টেলারমুভিতে। এসব অতিরিক্ত মাত্রা আমরা দেখতে পাই না। কারণ, এর ভেতর দিয়ে আলো বিস্তৃত হতে পারে না। তবে আমাদের মহাবিশ্বের শুধু চারটি মাত্রার মধ্য দিয়ে আলো চলাফেরা করতে পারে। তবে এই অতিরিক্ত মাত্রাগুলোতে মহাকর্ষ প্রভাবিত হয় এবং আমাদের মহাবিশ্বের তুলনায় সেখানে এই বলটি অনেক বেশি শক্তিশালী হবে। একে হয়তো সুইজারল্যান্ডের সার্নের এলএইচসি বা লার্জ হ্যাড্রন কলাইডারে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব। এলএইচসিতে ২৭ কিলোমিটার লম্বা একটি বৃত্তাকার টানেল রয়েছে। এখানে কণাদের দুটি বিম এই সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে পরস্পরের বিপরীত দিকে গিয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এ ধরনের কিছু সংঘর্ষে মাইক্রো কৃষ্ণগহ্বর তৈরি হতে পারে। এটি এমন বিন্যাসে কণা নিঃসরণ করবে যে তা চেনা খুব সহজ। কাজেই, আমি হয়তো নোবেল পুরস্কার পেয়েও যেতে পারি!
ডেভিড শুকম্যান : পদার্থবিদ্যার কোনো তত্ত্ব কালপরিক্রমায় প্রমাণিত হলেই কেবল পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। সে জন্য তত্ত্বের সপক্ষে শক্ত কোনো প্রমাণ হাজির করতে হয়। যেমন বিজ্ঞানী পিটার হিগস ১৯৬০-এর দশকে একটি কণার অস্তিত্বের কথা বলেছিলেন, যেটি অন্যান্য কণাকে ভর প্রদান করে। প্রায় ৫০ বছর পর, লার্জ হ্যাড্রন কলাইডারের দুটি আলাদা ডিটেক্টরে একটা কণার অস্তিত্ব ধরা পড়ে, যাকে বলা হয় হিগস-বোসন কণা। চমৎকার একটি তত্ত্ব আর শক্ত একটি প্রমাণ হাজির করার ক্ষেত্রে এটি ছিল বিজ্ঞান আর প্রকৌশলের এক বিশাল সাফল্য। ফলাফল হিসেবে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পান পিটার হিগস এবং বেলজিয়ামের বিজ্ঞানী ফ্রাসোয়া এংলার্ট। এদিকে হকিং রেডিয়েশনের কোনো ভৌত প্ৰমাণ এখনো পাওয়া যায়নি। কয়েকজন বিজ্ঞানীর মতে, এই বিকিরণ শনাক্ত করা খুব কঠিন। কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে এখন আরও বিস্তারিত গবেষণা চলছে। কোনো একদিন হয়তো এ বিকিরণ সম্পর্কেও নিঃসন্দেহ হওয়া যাবে।
স্টিফেন হকিং : কৃষ্ণগহ্বর থেকে কণারা বেরিয়ে আসার কারণে কৃষ্ণগহ্বরের ভর কমে যাবে এবং সেটি সংকুচিত হয়ে যাবে। এতে বেড়ে যাবে কণাদের নিঃসরণের হার। ক্রমান্বয়ে কৃষ্ণগহ্বরটি তার ভর হারাতে থাকবে। একসময় তা হারিয়ে যাবে। কিন্তু তাহলে কৃষ্ণগহ্বরের সব কণা এবং তাতে পড়ে যাওয়া সেই হতভাগা নভোচারীর ভাগ্যে কী ঘটবে? কৃষ্ণগহ্বর হারিয়ে বা মিলিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা তো আবারও হাজির হতে পারবে না। আপাতভাবে মনে হয়, কৃষ্ণগহ্বরের ভর, ঘূর্ণন ও বৈদ্যুতিক চার্জের সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে কী কী পড়েছিল, সে-সংক্রান্ত সব তথ্যও চিরতরে হারিয়ে যাবে। কিন্তু তথ্য যদি হারিয়ে যায়, তাহলে এতে একটা গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা দেখা দেয়। সেটা বিজ্ঞান সম্পর্কে আমাদের উপলব্ধির মর্মে আঘাত করে।
দুই শ বছরের বেশি সময় ধরে আমরা বৈজ্ঞানিক নিমিত্তবাদে বিশ্বাস করতাম। বৈজ্ঞানিক নিমিত্তবাদ বলে যে বিজ্ঞানের সূত্রগুলো মহাবিশ্বের বিবর্তন নির্ধারণ করতে পারবে। এই নীতিটি সূত্রবদ্ধ করেছিলেন পিয়েরে সাইমন ল্যাপ্লাস। তিনি বলেন, ‘আমরা যদি মহাবিশ্বের যেকোনো একটা সময়ের অবস্থা জানতে পারি, তাহলে বিজ্ঞানের সূত্রগুলো দিয়ে মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ ও অতীতের অবস্থাও নির্ধারণ করতে পারা যাবে।’ কথিত আছে, ল্যাপ্লাসকে একবার নেপোলিয়ান জিজ্ঞেস করেছিলেন, এর মধ্যে ঈশ্বরের অবস্থান কোথায়? জবাবে ল্যাপ্লাস বলেছিলেন, ‘স্যার, আমার তো এই হাইপোথিসিসের কোনো প্রয়োজন নেই।’ আমার মনে হয় না যে ল্যাপ্লাস ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছিলেন। আসলে তিনি শুধু বিজ্ঞানের সূত্রগুলো ভাঙার ব্যাপারে কোনো হস্তক্ষেপ করতে চাননি অধিকাংশ বিজ্ঞানীর অবস্থান এ রকমই হয়। একটা বৈজ্ঞানিক সূত্র আসলে কোনো বৈজ্ঞানিক সূত্র হতে পারে না, যদি তা সবকিছু পরিচালনার জন্য কেবল কোনো অলৌকিক কারও সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে এবং তাতে কোনো হস্তক্ষেপ না করার সিদ্ধান্ত নেয়।
ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আগাম অনুমান করতে ল্যাপ্লাসের নিমিত্তবাদে যেকোনো মুহূর্তে সব বস্তুকণার অবস্থান ও গতিবেগ জানার প্রয়োজন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তার নীতিও হিসাবের মধ্যে ধরা দরকার কোয়ান্টাম বলবিদ্যার মর্মমূলে থাকা এই নীতি ১৯২৩ সালে সূত্রবদ্ধ করেন ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ।
এই নীতি অনুযায়ী, কোনো কণার অবস্থান যত বেশি নিখুঁতভাবে জানা যাবে, ততই তার গতি আমরা কম নিখুঁতভাবে মাপতে পারব। একইভাবে কোনো গতির অবস্থান যত বেশি নিখুঁতভাবে মাপা হবে, ততই তার অবস্থান আমরা কম নিখুঁতভাবে মাপতে পারব। অন্য কথায়, কোনো কণার অবস্থান ও গতিবেগ দুটোই একই সঙ্গে নিখুঁতভাবে জানা যাবে না। তাহলে আমরা কীভাবে নির্ভুলভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারব? উত্তরটি হলো, অবস্থান ও গতিবেগকে আলাদাভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করা না গেলেও, আমরা কোয়ান্টাম অবস্থার ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি। এটি এমন একটা কিছু যেখান থেকে অবস্থান ও গতিবেগ দুটোই নির্দিষ্ট মাত্রার নির্ভুলতায় নির্ণয় করা যাবে। আমরা এখনো আশা করব, মহাবিশ্ব নিমিত্তবাদী হোক। এটা এই অর্থে যে আমরা যদি মহাবিশ্বের কোনো এক সময়ের কোয়ান্টাম অবস্থা জানতে পারি, তাহলে বিজ্ঞানের সূত্রগুলোর মাধ্যমে আমরা অন্য যেকোনো সময়ের কোয়ান্টাম অবস্থা জানতে পারা উচিত।
ডেভিড শুকম্যান : একটি ঘটনা দিগন্তের কী ঘটবে—তার ব্যাখ্যার জন্য বিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু দার্শনিক বিষয়বস্তুর অনেক গভীরে অনুসন্ধান সূচনা হলো। এ বিষয়গুলো নিউটনের ঘড়ির মতো মহাবিশ্ব থেকে শুরু করে ল্যাপ্লাসের সূত্রগুলো এবং সেখান থেকে হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার নীতি পর্যন্ত বিস্তৃত। আবার কৃষ্ণগহ্বরের রহস্য এ বিষয়গুলোকে চ্যালেঞ্জ জানায়। অনিবার্যভাবে, একদিকে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুসারে, একটি কৃষ্ণগহ্বরে তথ্য প্রবেশ করে, তা ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু অন্যদিকে কোয়ান্টাম তত্ত্ব বলে এটি ভেঙে পড়তে পারে না।
স্টিফেন হকিং : কৃষ্ণগহ্বরে তথ্য যদি হারিয়ে যায়, তাহলে আমরা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আগাম অনুমান করতে পারব না। কারণ, কৃষ্ণগহ্বর যেকোনো ধরনের কণা নিঃসরণ করতে পারবে। এটি চালু থাকা টেলিভিশন সেট কিংবা চামড়ায় বাঁধাই করা শেক্সপিয়ারের রচনাসমগ্রও নিঃসরণ করতে পারবে। অবশ্য বাইরের এই নিঃসরণের সম্ভাবনা খুব অল্প। মনে হতে পারে, কৃষ্ণগহ্বর থেকে কী বেরিয়ে আসতে পারে, আমরা যদি তার পূর্বাভাস দিতে না পারি, তাহলে তার কোনো গুরুত্ব নেই। আমাদের কাছে কোনো কৃষ্ণগহ্বর নেই। কিন্তু এটি আসলে নীতির প্রশ্ন।
নিমিত্তবাদ বা মহাবিশ্বের ভবিষ্যদ্বাণী করার সম্ভাবনা যদি কৃষ্ণগহ্বরের সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে পড়ে, তাহলে এটি অন্যান্য অবস্থাকেও ভেঙে ফেলতে পারবে। আরও বাজে ব্যাপার হলো, নিমিত্তবাদ ভেঙে পড়লে, আমাদের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে আমরা নিঃসন্দেহ হতে পারব না। তাতে ইতিহাসের বইগুলো এবং আমাদের স্মৃতি শুধু মায়া বা অলীক হয়ে যেতে পারে। আমরা কারা, তা অতীতই আমাদের জানায়। কাজেই এটি ছাড়া আমরা আমাদের পরিচয় হারিয়ে ফেলব।
তাই কৃষ্ণগহ্বরে সত্যি সত্যিই তথ্য হারিয়ে যায়, নাকি তা শুধু তাত্ত্বিকভাবেই হারিয়ে যায়, তা নির্ধারণ করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, এখানে তথ্য হারিয়ে যাওয়া উচিত নয়। কিন্তু এখানে তথ্য কীভাবে সংরক্ষিত হতে পারে, সে ব্যাপারে কেউই কিছু বলতে পারেনি। এ ব্যাপারে বছরের পর বছর তর্কবিতর্ক চলছে। অবশেষে, আমি এমন কিছু পেয়েছিলাম, যেটি আমার কাছে উত্তর বলেই মনে হয়েছিল। রিচার্ড ফাইনম্যানের ধারণার ওপর এটি নির্ভর করে। সে ধারণায় বলা হয়, একটি একক ইতিহাসের বদলে অনেকগুলো ভিন্ন ভিন্ন ইতিহাস থাকা সম্ভব। অর্থাৎ প্রতিটির জন্য তার নিজস্ব সম্ভাবনা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে সেখানে দুই ধরনের ইতিহাস থাকে। এর একটি হলো, সেখানে একটি কৃষ্ণগহ্বর থাকে, যার ভেতর কণা দিয়ে পরিপূর্ণ থাকতে পারে। অন্যটি হলো, সেখানে কোনো কৃষ্ণগহ্বরই নেই।
এখানে বিষয়টি হলো, বাইরে থেকে সেখানে কোনো কৃষ্ণগহ্বর আছে কি নেই, সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়। কাজেই সব সময়ই একটি সম্ভাবনা থাকে যে কোথাও কোনো কৃষ্ণগহ্বর নেই। এই সম্ভাবনা তথ্য সংরক্ষণের জন্য যথেষ্ট। তবে এসব তথ্য কোনো দরকারি রূপে ফিরে আসবে না। এটা অনেকটা এনসাইক্লোপিডিয়া পুড়িয়ে ফেলার মতো। ধোঁয়া আর ছাইগুলো রেখে দেওয়া হলে কোনো তথ্যই হারাবে না, কিন্তু তা পাঠোদ্ধার করা খুব কঠিন বিজ্ঞানী কিপ থর্ন আর আমি আরেক পদার্থবিদ জন প্রেসকিলের সঙ্গে একবার একটা বাজি ধরেছিলাম। বাজির বিষয় ছিল, কৃষ্ণগহ্বরে তথ্য হারিয়ে যাবে। যখন আবিষ্কার করলাম, তথ্য কীভাবে সংরক্ষিত হতে পারে, তখন আমি বাজিতে হার মেনে নিই। তখন জন প্রেসকিলকে আমি একটি এনসাইক্লোপিডিয়া দিয়েছিলাম। তার বদলে তাকে আসলে বইটির ছাই দেওয়ার উচিত ছিল।
ডেভিড শুকম্যান : তত্ত্বে এবং মহাবিশ্ব সম্পর্কে বিশুদ্ধ নিমিত্তবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে, আপনি একটি এনসাইক্লোপিডিয়া পুড়িয়ে ফেলতে পারেন। তারপর সেটি পুনর্নির্মাণ করতে পারবেন। তা করা সম্ভব হবে যদি আপনি কালি ও কাগজের প্রতিটি অণু যেসব পরমাণু দিয়ে গঠিত হয়েছে, তাদের প্রতিটির চরিত্র ও অবস্থান জানেন এবং সব সময় তাদের গতিবিধি নজরে রাখতে পারেন।
স্টিফেন হকিং : বর্তমানে কেমব্রিজে আমার সহকর্মী ম্যালকম পেরি এবং হার্ভার্ড থেকে আসা অ্যান্ড্রু স্ট্রমিনজারের সঙ্গে সুপারট্রান্সলেশন নামের গাণিতিক ধারণার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা নতুন একটি তত্ত্ব নিয়ে কাজ করছি আমি। আমাদের গবেষণার উদ্দেশ্য হলো কৃষ্ণগহ্বর থেকে তথ্য ফিরে আসার কলাকৌশল ব্যাখ্যা করা। আমাদের তত্ত্ব অনুসারে, তথ্যগুলো কৃষ্ণগহ্বরের ঘটনা দিগন্তে এনকোডেড হয়। সেজন্য কিন্তু এটার [ঘটনা দিগন্ত] দিকে খেয়াল রাখতে হবে!
ডেভিড শুকম্যান : এই রিথ লেকচার রেকর্ড হওয়ার সময় অধ্যাপক হকিং এবং তার সহকর্মীরা একটি গবেষণাপত্ৰ প্ৰকাশ করেছেন। সেখানে গাণিতিকভাবে দেখানো হয়েছে, ঘটনা দিগন্তে তথ্য সংরক্ষিত হতে পারে। তথ্য দ্বিমাত্রিক হলোগ্রামের মধ্যে সুপারট্রান্সলেশন নামের একটি প্রক্রিয়ায় রূপান্তরিত হতে পারে—এর ওপর এই তত্ত্বটি নির্ভরশীল। গবেষণাপত্রটির শিরোনাম ‘সফট হেয়ার অব ব্ল্যাকহোল’, যা এই বিষয়ে গূঢ় ভাষায় উচ্চতর আভাস পাওয়া যায়। এর সারাংশ এই বক্তৃতার শেষে যোগ করা হয়েছে। আর এটি ব্যাখ্যার চেষ্টা করার সময় বিজ্ঞানীরা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবেন।
স্টিফেন হকিং : কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে পড়ে গিয়ে অন্য কোনো মহাবিশ্বের বাইরে বেরিয়ে আসা সম্ভব কি না, সে ব্যাপারে এটি কী বলে? কৃষ্ণগহ্বরের সঙ্গে বিকল্প ইতিহাস থাকা না-থাকা ইঙ্গিত করে যে এটি সম্ভবও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে গর্তটি বড় হতে হবে। আর এটি যদি ঘূর্ণনশীল হয়, তাহলে তার আরেকটি মহাবিশ্ব পর্যন্ত একটি পথও থাকতে পারে। কিন্তু আপনি তাহলে আমাদের মহাবিশ্বে আর ফেরত আসতে পারবেন না। কাজেই মহাকাশ ভ্রমণে আমার আগ্রহ থাকলেও আমি কৃষ্ণগহ্বরে যাওয়ার চেষ্টা করব না।
ডেভিড শুকম্যান : কৃষ্ণগহ্বর যদি ঘূর্ণমান হয়, তাহলে তার কেন্দ্রে অসীম ঘন বিন্দুর অর্থে কোনো পরম বিন্দু না-ও থাকতে পারে। তার বদলে সেখানে আংটির মতো কোনো পরম বিন্দুও থাকতে পারে। আর এতে শুধু কৃষ্ণগহ্বরে পড়ে যাওয়াই শুধু নয়, সেই সঙ্গে এর ভেতর দিয়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার সম্ভাবনাবিষয়ক সন্দেহও তৈরি হয়। অর্থাৎ আমরা হয়তো এই মহাবিশ্ব ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে পারি। স্টিফেন হকিং এই লোভ দেখিয়ে শেষ করেছেন যে অন্য পাশে কিছু একটা থাকতেও পারে।
স্টিফেন হকিং : তাহলে এখানে আমার বক্তব্য হলো, কৃষ্ণগহ্বরকে আসলে যেভাবে দেখানো হয়, সেটি আসলে সে রকম নয়। এটি আসলে কোনো চিরন্তন বন্দিশালা নয়, অথচ একসময় একে এভাবেই ভাবা হতো। কৃষ্ণগহ্বর থেকেও বস্তু বেরিয়ে আসতে পারে। সেটা এই মহাবিশ্বেও হতে পারে কিংবা অন্য কোনো মহাবিশ্বেও হতে পারে। কাজেই যদি মনে মনে ভাবেন যে আপনি কোনো কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে আছেন, তাহলে হাল ছেড়ে দেবেন না, এখান থেকে বেরিয়ে আসার পথ আছে!
তথ্যনির্দেশ
ভার্চুয়াল বা কল্পিত কণা : কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় এমন একটি কণা, যাদের সরাসরি শনাক্ত করা যায় না। তবে পরিমাপগত প্রভাব দেখে তাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়।
কণাত্বরণযন্ত্র : যে যন্ত্রের সাহায্যে বিদ্যুৎ-চুম্বক ব্যবহার করে চার্জিত কণাগুলোকে অনেক বেশি শক্তি দান করে গতিশীল করতে পারে।
বৈদ্যুতিক আধান বা চার্জ : কণার একটি ধর্ম, যার কারণে কণাটি একই ধর্মবিশিষ্ট (অথবা বিপরীত ধর্মবিশিষ্ট) অন্য কণাকে বিকর্ষণ (অথবা আকর্ষণ) করে।
বর্ণালি (Spectrum) : উপাদানের কম্পাঙ্ক, যা একটি তরঙ্গের সৃষ্টি করে। সূর্যের দৃশ্যমান অংশের বর্ণালি মাঝেমধ্যে রংধনু হিসেবে দেখা যায়।
হিগস-বোসন : হিগস-বোসন কণাটি একসময় গড পার্টিকেল বা ঈশ্বর কণা নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিত হয়ে উঠেছিল। ১৯৬৪ সালে পদার্থবিদ পিটার হিগস এক কাল্পনিক কণার কথা বলেছিলেন, যা বস্তুর ভর সৃষ্টি করে। এ কণাটির নাম কালক্রমে হয়ে যায় হিগস-বোসন কণা। হিগস হচ্ছে বিজ্ঞানী হিগসের নামের অংশ। আর বোসন হচ্ছে বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নামের অংশ। আসলে এ কণাটির বৈশিষ্ট্য ও স্বরূপ সম্পর্কে প্রথম ধারণা দিয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু। তা ছাড়া এটি আইনস্টাইন-বসু পরিসংখ্যান মেনে চলে বলে বসুর নাম এতে জড়িয়ে যায়।
মহাবিশ্বের কণাদের চরিত্র ব্যাখ্যায় গড়ে তোলা হয়েছে স্ট্যান্ডার্ড মডেল। এর মাধ্যমেই বোঝা সম্ভব মহাবিশ্বের জন্মরহস্য। আর এ তত্ত্বের প্রাণভোমরা হচ্ছে ওই ঈশ্বর কণা। তাই কাল্পনিক এ কণাটি ধরতে বিজ্ঞানীরা ২০০৮ সালে সুইজারল্যান্ডের মাটির নিচে প্রায় ৩০ কিলোমিটার পরিধির সুড়ঙ্গ খুঁড়ে তাতে বসান লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার বা এলএইচসি। সেখানে আলোর গতিতে ধাবমান দুটি বিপরীতমুখী প্রোটনের মধ্যে সংঘর্ষে তৈরি করা হয় ছোট আকারের বিগ ব্যাং। এ সংঘর্ষে সৃষ্টি হয় বিপুল পরিমাণ শক্তি আর অসংখ্য অতিপারমাণবিক কণা। সেখান থেকেই বিজ্ঞানীরা খোঁজ পান বহু কাঙ্ক্ষিত হিগস-বোসন কণা। ২০১২ সালের ৪ জুলাই ইউরোপিয়ান অরগানাইজেশন ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ (সার্ন) এ কণা শনাক্ত করার ঘোষণা দেয়।
মহাকর্ষ বল : নিউটনের সূত্রমতে, মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তু পরস্পরকে আকর্ষণ করছে। যে বলে বস্তুগুলো পরস্পরকে আকর্ষণ করছে, তাকেই বলা হয় মহাকর্ষ বল। সূত্রমতে, এই আকর্ষণ বলের পরিমাণ বস্তু দুটির ভরের গুণফল এবং তাদের মধ্যবর্তী দূরত্বের ব্যস্তানুপাতিক।
বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল : বৈদ্যুতিক চার্জের কারণে কণাদের মধ্যে যে বলের সৃষ্টি হয়। চারটি মৌলিক বলের মধ্যে এটি দ্বিতীয় শক্তিশালী বল।
গামা রশ্মি : খুবই ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় রশ্মি। তেজস্ক্রিয় পদার্থের ক্ষয় বা মৌলিক কণাদের সংঘর্ষে এ রশ্মি সৃষ্টি হয়।
রিচার্ড ফাইনম্যান : রিচার্ড ফাইনম্যানের জন্ম নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে, ১৯১৮ সালে। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৪২ সালে জন হুইলারের তত্ত্বাবধানে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করেছিলেন। এর কিছুদিন পরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটান প্রজেক্টে জড়িয়ে পড়েন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই তিনি কোয়ান্টাম মেকানিকস সম্পর্কে চিন্তাভাবনার নতুন শক্তিশালী একটি উপায় খুঁজে পেয়েছিলেন। এ কারণেই ১৯৬৫ সালে তাঁকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। মৌলিক চিরায়ত অনুমান অনুযায়ী, প্রতিটি কণার একটি নির্দিষ্ট ইতিহাস থাকে। তিনি একে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বললেন, কণারা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলাচল করতে স্থান-কালের সম্ভাব্য প্রতিটি পথ ব্যবহার করে। প্রতিটি বক্র পথের সঙ্গে ফাইনম্যান দুটি সংখ্যাকে যুক্ত করেছিলেন। এদের একটি হলো তরঙ্গের আকার বা বিস্তার এবং অন্যটি হলো এর দশা, অর্থাৎ এটি চূড়ায় নাকি নিম্নবিন্দুতে। একটি কণার A বিন্দু থেকে B বিন্দু পর্যন্ত যাওয়ার সম্ভাব্য সব পথের যোগফল দিয়ে কণাটির A থেকে B-তে যাওয়ার মোট সম্ভাবনা পাওয়া যায়।
তারপরও দৈনন্দিন জীবনে আমাদের কাছে মনে হয় যে বস্তুগুলো তাদের জন্ম এবং চূড়ান্ত গন্তব্য পর্যন্ত শুধু একটি একক পথই অনুসরণ করছে। এ বিষয়টিও ফাইনম্যানের বহুবিধ ইতিহাস (বা ইতিহাসের যোগফল) ধারণার সঙ্গে মেলে। কারণ, বড় বস্তুর ক্ষেত্রে তার প্রতিটি পথের সঙ্গে সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেওয়ার নিয়মটি সুনিশ্চিত করে যে সব পথকে একত্র করা হলে একটি বাদে সব পথই পরস্পরকে বাতিল করে দেয়। অসীমসংখ্যক পথের মধ্যে শুধু একটি পথই বড় বস্তুর ক্ষেত্রে গতির ক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয়। আর এই বক্রপথটি নিউটনের চিরায়ত গতির সূত্রগুলো থেকে নিখুঁতভাবে পাওয়া যায়।