সংযোজন : মহাবিস্ফোরণ, কৃষ্ণগহ্বর ও মহাবিশ্বের বিবর্তন

সংযোজন : মহাবিস্ফোরণ, কৃষ্ণগহ্বর ও মহাবিশ্বের বিবর্তন

ফ্রিডম্যানের মহাবিশ্বের প্রথম মডেলে চতুর্থ মাত্রা হচ্ছে সময়। এখানে স্থানের মতো সময়ের ব্যাপ্তিও সসীম। একটি সরলরেখার মতো এরও আছে দুটি শেষ বিন্দু বা সীমানা। তাই সময়েরও একটি শেষ বিন্দু আছে, এমনকি একটি শুরুও আছে। আসলে এই মহাবিশ্বের বস্তুর পরিমাণের যে অংশটুকু আমরা পর্যবেক্ষণ করি, আইনস্টাইনের সমীকরণের সব সমাধানে সেটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য বহন করে। সেটি হচ্ছে অতীতের কোনো এক সময়ে (প্রায় ১৩.৭ বিলিয়ন বছর আগে) প্রতিবেশী গ্যালাক্সিগুলোর মাঝখানের দূরত্ব অবশ্যই শূন্য ছিল। অন্য কথায়, পুরো মহাবিশ্ব বিরাজ করছিল একটি একক বিন্দুতে ও শূন্য আয়তনে গাদাগাদি অবস্থায়। অনেকটা শূন্য ব্যাসার্ধের কোনো এক গোলকের মতো অবস্থা ছিল তার। সে সময় এই মহাবিশ্বের ঘনত্ব আর স্থান-কালের বক্রতা ছিল অসীম। এই সময়টিকে আমরা বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণ নামে ডাকি।

জ্যোতির্বিদ্যা-সম্পর্কিত আমাদের সব তত্ত্ব যে অনুমানের ভিত্তিতে সূত্রবদ্ধ করা হয়েছে সেটি হলো, স্থান-কাল মসৃণ এবং প্রায় সমতল। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, আমাদের সব তত্ত্ব মহাবিস্ফোরণে এসে ভেঙে পড়ে বা অকার্যকর হয়ে যায়। কারণ, অসীম বক্রতাবিশিষ্ট একটি স্থান- কালকে প্রায় সমতল বলাও খুব কঠিন! আবার যদি মহাবিস্ফোরণের আগে কোনো ঘটনা ঘটেও থাকে, সেটি মহাবিস্ফোরণের পরের ঘটনা নির্ণয়ে আমরা ব্যবহার করতে পারব না। কারণ, এ বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণীর সম্ভাবনাও মহাবিস্ফোরণে এসে অকার্যকর হয়ে যাবে।

একইভাবে, এ রকম ক্ষেত্রে আমরা যদি মহাবিস্ফোরণের পরে কী হয়েছিল শুধু সে সম্পর্কে জানি, তাহলেও তার আগে কী ঘটেছিল—তার কোনো কিছু নির্ধারণ করতে পারব না। আবার আমরা যতটুকু জানি, মহাবিস্ফোরণের আগের ঘটনার কোনো পরিণতি থাকতে পারে না। তাই সে ঘটনাগুলো এই মহাবিশ্বের কোনো বৈজ্ঞানিক মডেলের অংশও হওয়া উচিত নয়। কাজেই বৈজ্ঞানিক মডেল থেকে সেগুলো বাদ দেওয়া উচিত। আমাদের বলা উচিত, মহাবিস্ফোরণ থেকেই সময়ের শুরু হয়েছে। সে ক্ষেত্রে মহাবিস্ফোরণের জন্য প্রয়োজনীয় শর্তগুলো কে পূরণ করেছিল—এ ধরনের কোনো প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দায়ভার বিজ্ঞানের আর থাকে না।

আবার মহাবিশ্বের আয়তন শূন্য হলে আরেকটি অসীমতার উদ্ভব ঘটে। সেটি হচ্ছে তাপমাত্রা। মহাবিস্ফোরণের সময় মহাবিশ্ব অসীম তাপমাত্রায় উত্তপ্ত ছিল বলে ধারণা করা হয়। তারপর মহাবিশ্ব যতই প্রসারিত হতে লাগল, ততই কমতে লাগল বিকিরণের তাপমাত্রা। সরল অর্থে তাপমাত্রা হচ্ছে কণার গড় শক্তি বা গতির পরিমাপ। তাই মহাবিশ্বের এই শীতল হওয়ার কারণে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়েছিল কণার ওপর। খুব উচ্চ তাপমাত্রায় কণাগুলো এত দ্রুত ছুটতে পারে যে তারা পারমাণবিক বা বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বলের কারণে পরস্পরের মধ্যে সৃষ্ট আকর্ষণ টানকেও উপেক্ষা করে দূরে সরে যেতে পেরেছিল। তবে শীতল হওয়ার ফলে কণাগুলো পরস্পরকে আকর্ষণ করে গুচ্ছাকারে থাকতে শুরু করেছিল বলে আশা করা যায়। এমনকি এই মহাবিশ্বে কী ধরনের কণার অস্তিত্ব থাকবে, তা-ও নির্ধারিত হয় তাপমাত্রার ওপর ভিত্তি করে। আবার বিষয়টি নির্ভর করে মহাবিশ্বের বয়সের ওপরও।

বস্তু যে কণা থেকে গঠিত, সেটি অ্যারিস্টোটল বিশ্বাস করতেন না। তাঁর বিশ্বাস ছিল, বস্তু অবিচ্ছিন্ন। এর মানে হলো তাঁর মতে, এক টুকরো বস্তুকে অবিরামভাবে ক্ষুদ্র থেকে আরও ক্ষুদ্রতর অংশে ভাগ করা সম্ভব। বস্তুর এমন কোনো ক্ষুদ্র অংশ থাকতে পারে না, যাকে আরও ক্ষুদ্রতর অংশে বিভক্ত করা সম্ভব নয়। অবশ্য সে যুগে ডেমোক্রিটাসের মতো কয়েকজন গ্রিক পণ্ডিত বললেন, বস্তু সহজাতভাবে দানাদার এবং সবকিছুই বিপুল পরিমাণ ভিন্ন ভিন্ন অ্যাটম বা পরমাণু দিয়ে গঠিত। (গ্রিক শব্দ atom-এর অর্থ অবিভাজ্য)। এখন আমরা জানি যে এটিই সত্য—অন্তত আমাদের পরিবেশের ক্ষেত্রে এবং মহাবিশ্বের বর্তমান অবস্থার ক্ষেত্রে। কিন্তু আমাদের মহাবিশ্বের পরমাণুগুলো সব সময় ছিল না, তারা অবিভাজ্যও নয়। এগুলো আসলে এই মহাবিশ্বের বিভিন্ন ধরনের কণাগুলোর খুব ক্ষুদ্র অংশেরই প্রতিনিধিত্ব করে।

পরমাণু খুবই ক্ষুদ্র কণা ইলেকট্রন, প্রোটন আর নিউট্রন দিয়ে গঠিত। প্রোটন আর নিউট্রনও খুবই ক্ষুদ্র কণা দিয়ে গঠিত, যার নাম কোয়ার্ক। আরেকটি কথা বলে রাখা ভালো, এসব সাব-অ্যাটমিক বা অতিপারমাণবিক কণা ছাড়াও এগুলোর প্রতিটির জন্য একটি অ্যান্টিপার্টিকেল বা প্রতিকণার অস্তিত্ব আছে। প্রতিকণার ভরও তাদের সঙ্গী কণার মতো। তবে প্রতিকণার চার্জ ও অন্যান্য ধর্ম তার সঙ্গী কণার বিপরীত। যেমন ইলেকট্রনের প্রতিকণার নাম পজিট্রন। এই পজিট্রনের চার্জ ধনাত্মক, যা ইলেকট্রনের চার্জের ঠিক বিপরীত। প্রতিকণা দিয়ে গঠিত পুরোপুরি প্রতিবিশ্ব এবং প্রতিমানুষ থাকার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যাহোক, একটি প্রতিকণা ও কণা মিলিত হলে, তারা পরস্পরকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। তাই আপনার সঙ্গে আপনার প্রতিমানুষটির কখনো দেখা হলে, তার সঙ্গে হাত মেলানো উচিত হবে না। কারণ, তাহলে বিপুল আলোক ঝলকানির সঙ্গে সঙ্গে দুজনেই চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন!

আলোকশক্তি আরেক ধরনের কণা হিসেবে আসে। এই কণাটি ভরহীন, যার নাম ফোটন। সূর্যের পারমাণবিক চুল্লি পৃথিবীর জন্য সবচেয়ে বড় ফোটনের উৎস। সূর্য আবার অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের কণার বিশাল এক উৎসও বটে। আগেই যেমন নিউট্রিনোর (এবং প্রতিনিউট্রিনোর) কথা বলেছি। তবে এই কণাটি এতই হালকা যে সেগুলো বস্তুর সঙ্গে খুব কমই বিক্রিয়া করে। তাই তারা আমাদের ওপর কোনো প্রভাব না ফেলেই প্রতি সেকেন্ডে কয়েক কোটি পরিমাণ হারে আমাদের ভেদ করে চলে যেতে পারে। সব মিলিয়ে কয়েক ডজন মৌলিক কণা আবিষ্কার করেছেন পদার্থবিদেরা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মহাবিশ্ব যত জটিলতার দিকে বিবর্তিত হতে লাগল, ততই এসব বিশৃঙ্খল কণাগুলোর গঠনও বিকশিত হতে লাগল। পৃথিবীর মতো অন্যান্য গ্রহ সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে এই বিবর্তনের কারণে। পাশাপাশি সম্ভব করে তুলেছে আমাদের অস্তিত্বও।

মহাবিস্ফোরণের ১ সেকেন্ড পর এই মহাবিশ্ব বেশ খানিকটা প্রসারিত হয়েছিল। মহাবিশ্বের তাপমাত্রা প্রায় ১০ বিলিয়ন ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় কমে আসার জন্য এ প্রসারণ ছিল যথেষ্ট অবশ্য সূর্যের কেন্দ্রের চেয়ে কয়েক হাজার গুণ বেশি ছিল এই তাপমাত্রা। হাইড্রোজেন বোমা বিস্ফোরণে এই তাপমাত্রার কাছাকাছি পৌঁছানো যায়। যাহোক, এ সময়টাতে মহাবিশ্বে ছিল বেশির ভাগই প্রোটন, ইলেকট্রন আর নিউট্রিনো। এ ছাড়া কিছু প্রোটন আর নিউট্রনের সঙ্গে ছিল তাদের প্রতিকণারাও। এসব কণার মধ্যে এতই শক্তি ছিল যে সেগুলো যখন পরস্পরের মধ্যে ধাক্কা খেতে শুরু করল, তখন তা থেকে তৈরি হতে লাগল আরও ভিন্ন ভিন্ন কণা বা প্ৰতিকণা যেমন ফোটনগুলোর ধাক্কাধাক্কির ফলে সম্ভবত তৈরি হয়েছিল ইলেকট্রন ও তার একটি প্রতিকণা পজিট্রন। নতুন তৈরি হওয়া এসব কণা তার সঙ্গী প্রতিকণার সঙ্গে সংঘর্ষে নিশ্চিহ্ন হতে লাগল। যেকোনো সময় একটি ইলেকট্রিক আরেকটি পজিট্রনের সঙ্গে মিলে দুজনই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। কিন্তু এর বিপরীত প্রক্রিয়া মোটেও সহজ নয়। ফোটনের মতো দুটি ভরহীন কণা থেকে একটি কণা ও প্রতিকণা জোড়া (যেমন একটি ইলেকট্রন আর একটি পজিট্রন) তৈরি হতে ওই ভরহীন কণাগুলোর অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট সর্বনিম্ন শক্তি থাকতে হবে। এর কারণ হচ্ছে একটি ইলেকট্রন আর একটি পজিট্রনের ভর আছে। তাই সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া কণাগুলোর শক্তি থেকেই রূপান্তরিত হয়ে এই নতুন ভর আসতে হবে। সে সময় মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছিল এবং তার তাপমাত্রাও কমে আসছিল ক্রমেই। তাই এসব সংঘর্ষে ইলেকট্রন আর পজিট্রন জোড়া তৈরি করার মতো শক্তি ছিল যথেষ্ট। তবে একসময় এই কণা আর প্রতিকণা তৈরির হার তারা একত্রে মিলে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার হারের চেয়ে বেশি হয়েছিল। সে কারণে ক্রমান্বয়ে বেশির ভাগ ইলেকট্রন ও পজিট্রন একত্র হয়ে পরস্পর ধ্বংস হয়ে আরও বেশি ফোটন তৈরি করল। আর তুলনামূলকভাবে সামান্য কিছু ইলেকট্রন রয়ে যাচ্ছিল। অন্যদিকে নিউট্রিনো আর প্রতিনিউট্রিনো নিজেদের মধ্যে এবং অন্য কণাদের সঙ্গে খুব দুর্বলভাবে ক্রিয়াশীল ছিল। তাই এই কণাগুলো অতটা দ্রুত নিজেদের ধ্বংস করতে পারেনি। এখনো এই কণাগুলো চারদিকে টিকে থাকার কথা। আমরা যদি তাদের পর্যবেক্ষণ করতে পারতাম, তাহলে সেটি সেই প্রাথমিক পর্যায়ের প্রচণ্ড উত্তপ্ত মহাবিশ্বের অবস্থা পরীক্ষার একটি ভালো সুযোগ হতে পারত। দুর্ভাগ্যজনকভাবে কয়েক কোটি বছর পর এখন তাদের শক্তির পরিমাণ অনেক গুণ কমে গেছে। তাই তাদের এখন আমরা সরাসরি দেখতে পারি না (অবশ্য তাদের পরোক্ষভাবে এখনো শনাক্ত করা যেতে পারে)।

মহাবিশ্বের প্রাথমিক পর্যায়ে ইলেকট্রন আর পজিট্রন জোড়ার মধ্যে সংঘর্ষে ফোটন তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে একটা ভারসাম্য এসেছিল। এমনকি তাদের বিপরীত প্রক্রিয়ার মধ্যেও। মহাবিশ্বের তাপমাত্রা কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে এই ভারসাম্য ফোটন তৈরির পক্ষে পরিবর্তিত হয়েছিল। ক্রমান্বয়ে বেশির ভাগ ইলেকট্রন আর পজিট্রন নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। তবে এর ফলে টিকে ছিল খুব সামান্য ইলেকট্রন।

মহাবিস্ফোরণের প্রায় ১০০ সেকেন্ড পর মহাবিশ্বের তাপমাত্রা মাত্র ১০০ কোটিতে (১ বিলিয়ন) নেমে এসেছিল। সবচেয়ে উত্তপ্ত নক্ষত্রের ভেতরের তাপমাত্রাও এটিই। এই তাপমাত্রায় শক্তিশালী বল নামের একটি বলের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই শক্তিশালী বল হচ্ছে ক্ষুদ্র পরিসরে একধরনের আকর্ষণ বল। এ বলটি প্রোটন আর নিউট্রনকে একত্রে বেঁধে ফেলে পরমাণু কেন্দ্র গঠন করতে পারে। বেশ উচ্চ তাপমাত্রায় প্রোটন আর নিউট্রনের গতিশক্তি অনেক বেশি থাকে। তাই তাদের নিজেদের সংঘর্ষ থেকেও বেরিয়ে এসে মুক্ত আর স্বাধীনভাবে চলাচল করতে পারে সেগুলো। কিন্তু ১০০ কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় শক্তিশালী বলের আকর্ষণ উপেক্ষা করার মতো যথেষ্ট শক্তি তাদের থাকে না। তাই সেগুলো একত্র হয়ে ডিউটেরিয়াম (ভারী হাইড্রোজেন) পরমাণুর একটি কেন্দ্র গঠন করতে শুরু করে। ডিউটেরিয়ামের কেন্দ্রে থাকে একটি প্রোটন আর একটি নিউট্রন। এই ডিউটেরিয়াম কেন্দ্র পরে আরও প্রোটন আর নিউট্রনের সঙ্গে একত্র হয়ে হিলিয়ামের কেন্দ্র তৈরি করে। এখানে থাকে দুটি প্রোটন আর দুটি নিউট্রন। এ ছাড়া এভাবে সামান্য পরিমাণ ভারী মৌল লিথিয়াম আর বেরিলিয়ামও তৈরি হতে থাকে। হিসাব করলে দেখা যায়, উত্তপ্ত মহাবিস্ফোরণ মডেলে চার ভাগের এক ভাগ প্রোটন আর নিউট্রন হিলিয়াম কেন্দ্রে পরিণত হয়। আর বাকিগুলো পরিণত হয় সামান্য পরিমাণ ভারী হাইড্রোজেন ও অন্যান্য মৌলে। এরপর বাকি নিউট্রন ক্ষয় হয়ে প্রোটনে পরিণত হয়, যা আসলে সাধারণ হাইড্রোজেন পরমাণুর কেন্দ্র।

উত্তপ্ত মহাবিশ্বের প্রাথমিক পর্যায়ের এই চিত্র সম্পর্কে প্রথম ধারণা দিয়েছিলেন বিজ্ঞানী জর্জ গ্যামো। ১৯৪৮ সালে র‍্যাফল আলফার নামে তার এক ছাত্রের সঙ্গে বিখ্যাত এক গবেষণাপত্রে এ সম্পর্কে বলেন তিনি। গ্যামোর রসবোধ বেশ ভালো ছিল। তাই ওই গবেষণাপত্রে পরমাণুবিজ্ঞানী হ্যান্স বেথের নাম যুক্ত করতে রাজি করান গ্যামো। এতে গবেষণাপত্রটির লেখক তালিকা দাঁড়াল আলফার, বেথে, গ্যামো। ঠিক যেন গ্রিক বর্ণমালার প্রথম তিনটি অক্ষর : আলফা, বেটা, গামা। এই মহাবিশ্বের প্রাথমিক অবস্থা প্রকাশক কোনো গবেষণাপত্রের জন্য এ নামের তালিকা দারুণভাবে মানানসই হয়েছিল! ওই গবেষণাপত্রে তাঁরা বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি ভবিষ্যদ্বাণী করেন। সেটি হচ্ছে মহাবিশ্বের অতি উত্তপ্ত ও একেবারে প্রাথমিক অবস্থা থেকে নির্গত বিকিরণ (ফোটন কণার আকারে) এখনো চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা উচিত। তবে এই মাইক্রোওয়েভ রেডিয়েশন বা বিকিরণের তাপমাত্রা কমে পরম শূন্য তাপমাত্রার চেয়ে কিছুটা বেশি থাকবে। (-২৭৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসকে বলা হয় পরম শূন্য তাপমাত্রা। এটিই সম্ভাব্য সবচেয়ে কম তাপমাত্রা। এ তাপমাত্রায় বস্তুতে কোনো তাপশক্তি থাকে না।)

এই মাইক্রোওয়েভ রেডিয়েশন ১৯৬৫ সালে শনাক্ত করেন বিজ্ঞানী পেনজিয়াস আর উইলসন। আলফার, বেথে আর গ্যামো যখন তাঁদের গবেষণাপত্র লিখেছিলেন, সে সময় প্রোটন ও নিউট্রনের পারমাণবিক বিক্রিয়া সম্পর্কে খুব বেশি জানা ছিল না। তাই প্রাথমিক মহাবিশ্বের বিভিন্ন উপাদানের অনুপাত সম্পর্কে তাঁদের ভবিষ্যদ্বাণী পুরোপুরি সঠিক হয়নি। পরবর্তী সময়ে এ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান বাড়ার পর তাঁদের গণনা পুনরাবৃত্তি করা হলো। তাতে আমাদের পর্যবেক্ষণের সঙ্গে তাঁদের ভবিষ্যদ্বাণী মিলে গেল খাপে খাপে। আবার মহাবিশ্বের মোট ভরের প্রায় চার ভাগের এক ভাগ কেন হিলিয়াম রূপে বর্তমান—সেটি অন্য কোনোভাবে ব্যাখ্যা করা খুব কঠিন হতো।

তবে এই চিত্রের কিছু সমস্যা আছে। উত্তপ্ত মহাবিস্ফোরণ মডেলে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় তাপ প্রবাহিত হওয়ার মতো আদিম মহাবিশ্বে যথেষ্ট সময় ছিল না। অর্থাৎ মহাবিশ্বের একেবারে শুরুর অবস্থায় সব জায়গায় একই তাপমাত্রা বিরাজ করছিল। আমরা যেদিকেই তাকাই না কেন, মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড বা পটভূমি বিকিরণের তাপমাত্রা একই—এই তথ্য অনুসারে অন্তত ওপরের কথাটি সত্য। আবার প্রাথমিক অবস্থায় প্রসারণের হারও হয়েছিল অবশ্যই ক্রান্তীয় বা সংকটপূর্ণ হারের কাছাকাছি, যাতে মহাবিশ্ব নিজের চুপসে যাওয়া এড়াতে পারে। মহাবিশ্ব কেন ঠিক এভাবে শুরু হয়েছিল—সেটি ব্যাখ্যা করা খুব কঠিন। অবশ্য এটি সৃষ্টিকর্তার কাজ বলে ধরে নিলে আলাদা কথা। যদি ধরে নেওয়া হয়, আমাদের মতো জীবন্ত প্ৰাণী তিনি এভাবে সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন বলেই এমনটি হয়েছিল।

মহাবিশ্বের অনেকগুলো প্রাথমিক গাঠনিক অবস্থা থেকে ক্রমান্বয়ে বিকশিত হয়ে বর্তমানের মহাবিশ্বের মতো একটি অবস্থায় এসে পৌঁছাবে—এমন একটি মডেল খুঁজছিলেন বিজ্ঞানী অ্যালান গুথ। ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির বিজ্ঞানী তিনি। গুথ প্রস্তাব করেন, মহাবিশ্বের সূচনাপর্বে সম্ভবত এমন একটি সময় পার করেছিল, যখন এটি অতি দ্রুতবেগে প্রসারিত হচ্ছিল। এই প্রসারণকে বলা হয় ইনফ্লেশন বা অতিস্ফীতি। এর অর্থ মহাবিশ্ব একটি সময় ক্রমবর্ধমান হারে প্রসারিত হয়েছিল। গুথের মতে, সেকেন্ডের ক্ষুদ্রতর একটি ভগ্নাংশ সময়ে মহাবিশ্বের ব্যাসার্ধ মিলিয়ন মিলিয়ন মিলিয়ন মিলিয়ন মিলিয়ন (১-এর পর ৩০টি শূন্য) গুণ বেড়ে গিয়েছিল। এই প্রসারণের মধ্য দিয়েই মহাবিশ্বের সব ধরনের বিশৃঙ্খলা কমে এসেছিল। ঠিক যেমনটি একটি বেলুনকে ক্রমাগত ফোলানো হলে তার ভাঁজ দূর হয়ে যায়, মহাবিশ্বের ক্ষেত্রেও ঘটেছিল তেমনটিই। এভাবে অনেকগুলো প্রাথমিক গাঠনিক অবস্থা থেকে মহাবিশ্ব ক্রমান্বয়ে বিকশিত হয়ে কীভাবে বর্তমানের মতো শৃঙ্খলাবদ্ধ আর সমরূপ মহাবিশ্ব বিকশিত হতে পেরেছিল—তা ব্যাখ্যা করতে পারে অতিস্ফীতি। তাই আমরা বেশ যুক্তিযুক্তভাবে নিশ্চিত হতে পারি যে আমাদের কাছে অন্তত মহাবিস্ফোরণের ১ সেকেন্ডের বিলিয়ন ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ভাগের এক ভাগ সময়কাল পর্যন্ত মহাবিশ্বের সঠিক চিত্রটি আছে।

প্রাথমিক অবস্থার এসব বিশৃঙ্খলার পর, মহাবিস্ফোরণের মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর বন্ধ হয়ে যায় হিলিয়াম ও লিথিয়ামের মতো অন্যান্য মৌলিক পদার্থের উৎপাদন। এ ঘটনার পর পরবর্তী কয়েক লাখ বছর বা তারও পরের সময়কাল পর্যন্ত মহাবিশ্ব ক্রমাগত প্রসারিত হতে থাকে। এ সময়কালে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটেনি। অবশেষে তাপমাত্রা কয়েক হাজার ডিগ্রি নিচে নেমে আসে। আবার পরমাণুর কেন্দ্রে বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বলকে অগ্রাহ্য করার মতো যথেষ্ট গতিশক্তির অভাব দেখা দেয়। ফলে সেগুলো (কণাগুলো) একত্র হয়ে পরমাণু গঠন করতে শুরু করেছিল। একই সঙ্গে ক্রমান্বয়ে প্রসারিত ও শীতল হচ্ছিল পুরো মহাবিশ্ব। তবে গড়পড়তা অন্যান্য জায়গার চেয়ে কিছুটা ঘন ছিল কিছু কিছু জায়গা। বাড়তি মহাকর্ষীয় আকর্ষণে এই জায়গাগুলোতে প্রসারণ কিছুটা ধীরগতির হয়েছিল।

এই বাড়তি আকর্ষণের পরিণামে কিছু এলাকায় প্রসারণ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা। তাই সেগুলো চুপসে যেতে শুরু করেছিল বলে মনে করা হয়। এই চুপসে যাওয়ার সময় বস্তুর মহাকর্ষীয় টানে ওই এলাকার বাইরের কিছু এলাকা তাদের কেন্দ্র করে সামান্য ঘূর্ণন শুরু করেছিল। চুপসে যাওয়া এলাকা যতই ক্ষুদ্রতর হচ্ছিল, ততই বেড়ে যাচ্ছিল তাদের এই ঘূর্ণনগতিও। বরফের ওপর দ্রুতবেগে পাক খাওয়ার সময় স্কেটাররা যেমন তাঁদের হাত গুটিয়ে নেন—এটাও অনেকটা সে রকম। অবশেষে ওই এলাকাটি একসময় যথেষ্ট ছোট হয়ে গেল। তখন এটি এত বেশি দ্রুত পাক খেতে লাগল যে এর ফলে মহাকর্ষীয় টানের মধ্যেও ভারসাম্যও চলে এল। ঠিক এভাবে জন্ম হলো চাকতির মতো ঘূর্ণমান গ্যালাক্সিদের। অন্য এলাকায় যেখানে এ রকম কোন ঘূর্ণন সংঘটিত হয়নি, সেখানে সৃষ্টি হলো ডিম্বাকৃতির বস্তুদের। এদের বলা হয় ডিম্বাকৃতির গ্যালাক্সি। এসব গ্যালাক্সির জন্মের কারণে ওই এলাকা চুপসে যাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ, গ্যালাক্সির বিভিন্ন অংশ তার কেন্দ্রের চারপাশে স্থিতিশীলভাবে ঘুরতে থাকবে, কিন্তু সাধারণভাবে গ্যালাক্সিটির কোনো ঘূর্ণন থাকবে না।

সময় যতই গড়াতে লাগল, ওই গ্যালাক্সিগুলোতে ততই ছোট ছোট মেঘের মতো ভেঙে যেতে থাকল হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম গ্যাস। পরে এ মেঘগুলো নিজেদের মহাকর্ষীয় টানে নিজের মধ্যেই চুপসে যেতে শুরু করে। এই সংকোচনের সময় তাদের পরমাণুগুলো পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষের মুখে পড়ে। তাতে বেড়ে গেল ওই গ্যাসের তাপমাত্রা। তাপ বাড়তে বাড়তে একসময় এতই গরম হয়ে ওঠে যে তা পারমাণবিক ফিউশন বিক্রিয়ার জন্য যথেষ্ট হয়ে ওঠে। ফলে হাইড্রোজেন রূপান্তরিত হয়ে আরও হিলিয়ামে পরিণত হতে থাকে। এই বিক্রিয়ার ফলে উৎপন্ন তাপের কারণে (অনেকটা নিয়ন্ত্রিত হাইড্রোজেন বোমা বিস্ফোরণের মতো) একটি নক্ষত্র আলো ছড়াতে শুরু করে। মহাকর্ষীয় টানের ভারসাম্য না আসা পর্যন্ত এবং এতে গ্যাসের সংকোচনও বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগপর্যন্ত এই অতিরিক্ত তাপ একই সঙ্গে গ্যাসের চাপও বাড়িয়ে দেয়। এভাবে এসব মেঘ একত্র হয়ে আমাদের সূর্যের মতো নক্ষত্র গঠিত হয়ে থাকতে পারে। সেখানে হাইড্রোজেন পুড়ে রূপান্তরিত হবে হিলিয়ামে মৌলে। ফলে সেখানকার নিঃসৃত শক্তি বিকিরিত হবে তাপ আর আলো হিসেবে। এটি অনেকটা বেলুনের মতো—যেখানে বেলুনের ভেতরের বাতাস আর রাবারের টানের মধ্যে একটা ভারসাম্য থাকে। বেলুনের ভেতরের বাতাসের চাপ বেলুনটিকে প্রসারিত করতে চায়। কিন্তু রাবারের টান বেলুনটিকে ছোট করার চেষ্টা করে।

উত্তপ্ত গ্যাসের মেঘগুলো একবার একত্র হয়ে নক্ষত্রে রূপান্তরের পর, ওই নক্ষত্র দীর্ঘদিন স্থিতিশীল থাকতে পারে। সেখানে পারমাণবিক বিক্রিয়া থেকে প্রাপ্ত উত্তাপ মহাকর্ষীয় আকর্ষণের সঙ্গে ভারসাম্য আনে। ফলে একসময় নিজের হাইড্রোজেন ও অন্যান্য পারমাণবিক জ্বালানি ফুরিয়ে ফেলে নক্ষত্রটি। যত বেশি জ্বালানি নিয়ে কোনো একটি নক্ষত্রের জীবনকাল শুরু হয়, তত দ্রুত তার জ্বালানি ফুরিয়ে যায়। বিষয়টি আপাতদৃষ্টে স্ববিরোধী মনে হলেও এটিই সত্য। এর কারণ হচ্ছে, নক্ষত্রের আকার যত বড় হয়, মহাকর্ষীয় আকর্ষণকে ভারসাম্যে আনতে তাকে তত বেশি উত্তাপ তৈরির প্রয়োজন পড়ে। আর নক্ষত্রটি যত বেশি উত্তপ্ত হয়, তার পারমাণবিক ফিউশন বিক্রিয়াও তত দ্রুত হয়। তাতে নক্ষত্রটি অতি দ্রুত সবটুকু জ্বালানি ব্যবহার করে একসময় নিঃশেষ হয়ে যায়। আমাদের সূর্যের যে পরিমাণ জ্বালানি আছে, তা দিয়ে সম্ভবত আরও ৫০০ কোটি (৫ বিলিয়ন) বছর টিকে থাকতে পারবে। তবে এর চেয়ে বড় আকৃতির নক্ষত্র মোটামুটি ১০০ মিলিয়ন বছরেই তার সবটুকু জ্বালানি ফুরিয়ে ফেলবে, যা এই মহাবিশ্বের বয়সের চেয়ে অনেক অল্প।

কোনো নক্ষত্রের জ্বালানি শেষ হয়ে গেলে, সেটি শীতল হতে থাকে। তখন তার পুরোটা নিয়ন্ত্রণ চলে যায় মহাকর্ষ টানের হাতে। তাই এ সময় ক্রমেই সংকুচিত হতে শুরু করে নক্ষত্রটি। এই সংকোচনের ফলে ভেতরের পরমাণুগুলো পরস্পরকে চারদিক থেকে প্রচণ্ড বেগে ঠেসে ধরে। ফলে আবারও উত্তপ্ত হতে শুরু করে নক্ষত্রটি। ওই নক্ষত্রটি যথেষ্ট উত্তপ্ত হলে সেখানকার হিলিয়াম ভারী মৌলে (যেমন কার্বন বা অক্সিজেন) রূপান্তরিত হতে থাকে। তবে এতে খুব বেশি পরিমাণ শক্তি বেরিয়ে আসতে পারে না। তাই সেখানে একটি সংকট দেখা যায়। কিন্তু এর পরে ঠিক কী ঘটে, তা এখনো আমাদের কাছে পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। তবে সব দেখে মনে হয়, নক্ষত্রটির কেন্দ্রীয় অঞ্চল কৃষ্ণগহ্বরের মতো খুবই ঘন অবস্থায় ভেঙে পড়তে পারে।

ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর (কৃষ্ণবিবর) পরিভাষাটির উৎপত্তি হয়েছে অতিসম্প্রতি। একটি ধারণা সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করতে গিয়ে ১৯৬৯ সালে এটি চালু করেন মার্কিন বিজ্ঞানী জন হুইলার। তবে এ ধারণার বয়স অন্তত ২০০ বছর। তখন আলো সম্পর্কে দুটি তত্ত্ব চালু ছিল। এর একটি ছিল নিউটন-সমর্থিত। প্রথম তত্ত্ব অনুসারে, আলো হচ্ছে কণাগুচ্ছের সমষ্টি। অন্য তত্ত্বমতে, আলো তরঙ্গ দিয়ে গঠিত। এখন আমরা জানি, এই দুটি তত্ত্বই আসলে সঠিক। কোয়ান্টাম মেকানিকসের তরঙ্গ/কণা দ্বৈততা অনুসারে, আলো একই সঙ্গে একটি তরঙ্গ এবং একটি কণা। এই তরঙ্গ ও কণার প্রকারভেদের ধারণা মানুষের সৃষ্টি।

আলো তরঙ্গ দিয়ে গঠিত—এই তত্ত্ব অনুসারে, আলো মহাকর্ষের প্রভাবে কীভাবে আচরণ করবে, সেটি স্পষ্ট নয়। কিন্তু যদি ধরে নিই আলো কণা দিয়ে গঠিত, তাহলে আশা করা যায়, কামানের গোলা, রকেট ও গ্রহদের মতো আলোও মহাকর্ষ দিয়ে প্রভাবিত হবে। সুনির্দিষ্ট করে বললে, ভূপৃষ্ঠ বা একটি নক্ষত্র থেকে একটি কামানের গোলা ওপরের দিকে ছোড়া হলে, রকেটের মতো আলোও একসময় থেমে যাবে। তারপর ক্রমেই নিচের দিকে নেমে আসতে থাকবে সেটা। তবে কামানের গোলা ওপরে ছোড়ার গতি একটি নির্দিষ্ট মানের চেয়ে বেশি না হলেই এমনটি ঘটবে। এ রকম সর্বনিম্ন গতিকে বলা হয় মুক্তি বেগ বা এসকেপ ভেলোসিটি। কোনো নক্ষত্রের মুক্তি বেগ নির্ভর করে তার মহাকর্ষ টান কতটা শক্তিশালী তার ওপর। নক্ষত্র যত বড় হবে, তার মুক্তি বেগও হবে তত বেশি। একসময় মানুষ মনে করত, আলো অসীম বেগে ছুটতে পারে। তাই আলোর এই গতিকে মহাকর্ষ কিছুতেই কমিয়ে আনতে পারবে না বলে ধারণা করা হতো। কিন্তু বিজ্ঞানী রোমার আবিষ্কার করেন, আলোর বেগেরও একটা সীমা আছে। অর্থাৎ আলোর ওপর মহাকর্ষের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব থাকতেও পারে। বিশাল আকৃতির কোনো নক্ষত্রের মুক্তি বেগের চেয়ে আলোর বেগ কম হলে নক্ষত্র থেকে নির্গত সব আলোই তার ওপর আছড়ে পড়বে। স্রেফ এই অনুমানের ভিত্তিতে ১৭৮৩ সালে লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটির ফিলোসফিক্যাল ট্রানজেকশনে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন কেমব্রিজের অধ্যাপক জন মিচেল। সেখানে তিনি ইঙ্গিত করেন, একটি নক্ষত্রের আকার যদি যথেষ্ট বড় আর সেটি ঘন সন্নিবিষ্ট হয়, তাহলে তার এ ধরনের একটি শক্তিশালী মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র থাকতেও পারে। সেখান থেকে কোনো আলোই বেরিয়ে আসতে পারবে না। নক্ষত্রটির পৃষ্ঠ থেকে কোনো আলো নির্গত হওয়ার পর, ওই আলো খুব বেশি দূর যাওয়ার আগেই নক্ষত্রের মহাকর্ষীয় আকর্ষণ তাকে টেনে নিচের দিকে নিয়ে যাবে। এ ধরনের বস্তুকে এখন আমরা কৃষ্ণগহ্বর নামে জানি। কারণ, সেগুলো আসলে এ রকমই : স্থানের মধ্যে এটি কালো শূন্যতা। [জন মিশেল মহাকাশের এ ধরনের বস্তুর নাম দেন ডার্ক স্টার বা কৃষ্ণনক্ষত্র।—অনুবাদক

এর কয়েক বছর পর, স্বাধীনভাবে ঠিক একই রকম ধারণা দেন মারকুইস ডি ল্যাপ্লাস নামের এক ফরাসি বিজ্ঞানীও। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ল্যাপ্লাস তাঁর দ্য সিস্টেম অব দ্য ওয়ার্ল্ডবইটির প্রথম আর দ্বিতীয় সংস্করণে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করলেও পরের সংস্করণগুলো থেকে তা বাদ দেন। সম্ভবত তাঁর কাছে ধারণাটি পাগলাটে মনে হয়েছিল। উনিশ শতকে আলোর কণাবাদী তত্ত্ব কারও সমর্থন পায়নি। কারণ, সবার কাছে মনে হলো, সবকিছুই তরঙ্গবাদী তত্ত্ব দিয়েই ব্যাখ্যা করা সম্ভব। আসলে নিউটনের মহাকর্ষের তত্ত্বে কামানের গোলার ব্যাখ্যা যেভাবে মানানসই বলে মনে হয়েছিল, আলোর ক্ষেত্রে বিষয়টি তেমন মনে হয়নি। কারণ, আলোর একটি নির্ধারিত বা ধ্রুবগতি আছে। পৃথিবী থেকে ওপরের দিকে একটি কামানের গোলা ছোড়া হলে পৃথিবীর অভিকর্ষ টানের প্রভাবে তার গতি আস্তে আস্তে কমে আসে। তারপর একসময় কামান গোলার গতি স্থির হয়ে যায় এবং নিচের দিকে নেমে আসে। কিন্তু একটি ফোটন (আলোর কণা) নিশ্চিতভাবে একটি ধ্রুবগতিতে ওপরের দিকে চলতেই থাকে। মহাকর্ষ আলোর ওপর কীভাবে প্রভাব ফেলে, তা ১৯১৫ সালে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব প্রস্তাবের আগপর্যন্ত বোঝা যায়নি। সাধারণ আপেক্ষিকতা অনুযায়ী, একটি বিশাল আকৃতির নক্ষত্রে আলোর ক্ষেত্রে কী ঘটবে—এ সমস্যার প্রথম সমাধান দেন ১৯৩৯ সালে রবার্ট ওপেনহাইমার নামের এক তরুণ মার্কিন বিজ্ঞানী।

ওপেনহাইমারের গবেষণা থেকে আমরা এখন এ-সম্পর্কিত যে চিত্র পাই, সেটি অনেকটা এ রকম। এই নক্ষত্রের মহাকর্ষীয় ক্ষেত্ৰ স্থান-কালে চলমান আলোকরশ্মির গতিপথ পরিবর্তন করে দেয়। মানে নক্ষত্রটির অস্তিত্ব না থাকলে আলোর গতিপথটি যেমন হওয়ার কথা ছিল, তা থেকে অন্য রকম হয়। সূর্যগ্রহণের সময় দূরের কোনো নক্ষত্র থেকে আসা আলো পর্যবেক্ষণ করলে যেমন বেঁকে যেতে দেখা যায়, এই প্রভাবটিও অনেকটা সে রকম। স্থান আর কালের মধ্যে দিয়ে আলো যাওয়ার সময় সেটির গতিপথ কোনো নক্ষত্রের পৃষ্ঠের দিকে সামান্য বেঁকে যায়। নক্ষত্র যখন সংকুচিত হতে শুরু করে, তখন তার ঘনত্বও বেড়ে যায়। তাই নক্ষত্রটির পৃষ্ঠের মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রও অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। (এ ক্ষেত্রে মহাকর্ষ ক্ষেত্রটিকে নক্ষত্রটির কেন্দ্রের একটি বিন্দু থেকে প্রবহমান বলে ভাবা যেতে পারে। নক্ষত্রটি সংকুচিত হতে থাকলে পৃষ্ঠের বিন্দুগুলোও কেন্দ্রের দিকে সরে যেতে থাকে। তাই বিন্দুগুলো একটি শক্তিশালী ক্ষেত্রের টান অনুভব করে।) ক্ষেত্রটি যত শক্তিশালী হয়, পৃষ্ঠতলের কাছে আলোর গতিপথও তত ভেতরের দিকে বেঁকে যেতে থাকে। অবশেষে নক্ষত্রটি যখন একটি নির্দিষ্ট ক্রান্তীয় বা সংকটপূর্ণ ব্যাসার্ধে সংকুচিত হয়, তখন পৃষ্ঠতলের মহাকর্ষ ক্ষেত্র খুবই শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এর ফলে আলোর গতিপথ কেন্দ্রের বিন্দুর দিকে বেঁকে যায় এবং সেখান থেকে আর বেরিয়ে আসতে পারে না।

আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুসারে, কোনো কিছুই আলোর চেয়ে দ্রুতগতিতে ছুটতে পারে না। তাই আলোই যখন ওই ক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না, তখন অন্য কোনো কিছুর বেরিয়ে আসার আর প্রশ্নই আসে না। তাই সবকিছুই মহাকর্ষ ক্ষেত্রের টানে পিছু হটতে থাকে। এই চুপসে যাওয়া নক্ষত্র তার চারদিকে স্থান-কালের একটি অঞ্চল গঠন করে। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে দূরের কোনো পর্যবেক্ষকের কাছে কোনো কিছুই পৌঁছাতে পারে না। এই অঞ্চলটিই হচ্ছে কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাকহোল। একটি কৃষ্ণগহ্বরের বাইরের সীমানাকে বলে ইভেন্ট হরাইজন বা ঘটনা দিগন্ত। হাবল টেলিস্কোপ আর অন্যান্য টেলিস্কোপকে ধন্যবাদ দিতে হয়। কারণ, এই টেলিস্কোপগুলো এখন দৃশ্যমান আলোর চেয়ে এক্স-রশ্মি আর গামা রশ্মির দিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। আমরা জানি, কৃষ্ণগহ্বর সাধারণ ব্যাপার। অর্থাৎ মানুষ প্রথম দিকে যেমনটি ভাবত, তার চেয়েও অনেক বেশি সাধারণ ব্যাপার। একটি কৃত্রিম উপগ্রহ আকাশের ছোট্ট একটি এলাকায় পনেরো শ কৃষ্ণগহ্বর খুঁজে পেয়েছে। এমনকি আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রের দিকেও আমরা একটি কৃষ্ণগহ্বর খুঁজে পেয়েছি। এর ভর আমাদের সূর্যের চেয়ে ১০ লাখ গুণের বেশি। এই বিপুল আয়তনের কৃষ্ণগহ্বরটিকে কেন্দ্র করে একটি নক্ষত্র ঘুরপাক খাচ্ছে। ওই নক্ষত্রটির ঘুরপাক খাওয়ার গতি আলোর গতির মাত্র ২ শতাংশ। তবে একটি পরমাণুর নিউক্লিয়াসে একটি ইলেকট্রন গড়ে যে গতিতে ঘোরে, তারও চেয়ে এই নক্ষত্রটির গতি বেশি!

একটি বিশাল আকৃতির নক্ষত্র চুপসে গিয়ে একটি কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হলে, সেখানে আমরা কী দেখতে পাব? সেটি বুঝতে চাইলে আপেক্ষিক তত্ত্বে বর্ণিত : পরম সময় বলে কিছু নেই—এ কথাটি আমাদের মনে রাখতে হবে। অন্য কথায়, প্রত্যেক পর্যবেক্ষকের সময়ের একটি নিজস্ব পরিমাপ আছে। একটি নক্ষত্রপৃষ্ঠে অবস্থিত কারও জন্য সময়ের গতি আর নক্ষত্র থেকে দূরে থাকা আরেকজনের সময়ের গতি ভিন্ন ভিন্ন হবে। কারণ, নক্ষত্রটির পৃষ্ঠতলে মহাকর্ষ টান অনেক বেশি শক্তিশালী।

ধরা যাক, একটি নক্ষত্রের পৃষ্ঠে রয়েছেন এক দুঃসাহসী নভোচারী নক্ষত্রটি ক্রমেই চুপসে যাচ্ছে। নক্ষত্রটির ভেতরের দিকে চুপসে যাচ্ছে, এমন পৃষ্ঠের ওপর অবস্থান করছেন তিনি। ধরা যাক, তাঁর ঘড়িতে ১১টা বাজে। ঠিক সে সময় ক্রান্তীয় ব্যাসার্ধের নিচে চুপসে যাচ্ছে নক্ষত্রটি। এই ব্যাসার্ধে মহাকর্ষ টান এতই শক্তিশালী হয় যে কোনো কিছুই সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। এখন ধরা যাক, এই নভোচারীকে আগে থেকেই বলা হয়েছিল, তার ওপরে থাকা একটি নভোযানে প্রতি সেকেন্ড একটি করে সংকেত পাঠাতে হবে। অবশ্যই তাঁর নিজের ঘড়ির সময় অনুযায়ী। নভোযানটি ওই নক্ষত্রটিকে কেন্দ্ৰ করে একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে থেকে ঘুরছে। এখন ১০:৫৯:৫৮টায় (১১টা বাজার ২ সেকেন্ড আগে) নভোচারী সংকেত পাঠানো শুরু করল। তাহলে নভোযানে থাকা তার সঙ্গীরা কী রেকর্ড করবে?

নভোযানসংক্রান্ত আগের চিন্তন পরীক্ষা থেকে আমরা জেনেছি, মহাকর্ষ সময়ের গতি কমিয়ে দেয়। আর মহাকর্ষ টান যত শক্তিশালী হয়, তার প্রভাবও হয় তত বেশি। নভোযানে থাকা নভোচারীদের তুলনায় নক্ষত্রের পৃষ্ঠে অবস্থান করা নভোচারী একটি শক্তিশালী মহাকর্ষ ক্ষেত্রের মধ্যে আছেন। তাই নক্ষত্রের পৃষ্ঠে নভোচারীর ঘড়ির ১ সেকেন্ড তার সঙ্গীদের ঘড়িতে ১ সেকেন্ডের বেশি বলে মনে হবে। তিনি ক্রমেই ভেতরের দিকে চুপসে যেতে থাকা একটি নক্ষত্রের পৃষ্ঠে অবস্থান করছেন। তাই ক্রমেই শক্তিশালী থেকে আরও শক্তিশালী মহাকর্ষ টান অনুভব করতে থাকবেন তিনি। সে কারণে তাঁর পাঠানো সংকেতগুলো নভোযানে পৌছানোর মধ্যবর্তী সময়কালের ব্যাপ্তিও ক্রমে বাড়তে থাকবে। সময়ের এই প্রসারণ ১০:৫৯:৫৯টার আগে খুবই অল্প হবে। তাই নক্ষত্র অবস্থান করা নভোচারীর ঘড়ির ১০:৫৯:৫৮টা থেকে ১০:৫৯:৫৯টার মধ্যবর্তী সময়ে পাঠানো সংকেতগুলো পেতে নক্ষত্রটিকে কেন্দ্র করে ঘুরপাক খাওয়া নভোচারীদের ১ সেকেন্ডের সামান্য কিছু বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু ১১:০০টায় পাঠানো সংকেত পেতে নভোচারীদের অপেক্ষা করতে হতে পারে অনন্তকাল।

নভোযান থেকে দেখলে, নক্ষত্রের পৃষ্ঠতলে ১০ :৫৯:৫৯টা থেকে ১১:০০টার (নভোচারীর ঘড়ির সময় অনুযায়ী) মধ্যবর্তী সময়ে যা কিছু ঘটবে, তা অসীম সময়কাল পর্যন্ত বিস্তৃত হবে বলে মনে হবে। ১১টা যতই ঘনিয়ে আসতে থাকবে, নক্ষত্রটি থেকে নভোযানে আলো পৌঁছানোর পূর্বাপর সময় বাড়তে থাকবে ততই। ঠিক যেমনটি নক্ষত্রটিতে থাকা নভোচারীর পাঠানো সংকেতের ক্ষেত্রে ঘটেছিল। আলোর ফ্রিকোয়েন্সি বা কম্পাঙ্ক পরিমাপ করা হয় সাধারণত প্রতি সেকেন্ডে তার ঢেউয়ের শীর্ষ ও খাদের পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে।

এখানে নক্ষত্র থেকে নভোযানে আসা আলোর কম্পাঙ্ক ক্রমে কমতে থাকবে। তাতে নক্ষত্র থেকে আসা আলো ক্রমে হতে থাকবে লাল থেকে লালতর (অস্পষ্ট থেকে আরও অস্পষ্ট)। সবশেষে নক্ষত্রটি এত বেশি ঝাপসা হয়ে যাবে যে তাকে আর নভোযান থেকে দেখা যাবে না। ওই স্থানে তখন অবশিষ্ট থাকবে শুধু একটি কৃষ্ণগহ্বর। কৃষ্ণগহ্বরটিও নভোযানের ওপর একই মহাকর্ষ বল প্রয়োগ করতে থাকবে। ফলে কৃষ্ণগহ্বরকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকবে নভোযানটি।

ওপরের এই দৃশ্যকল্পটি পুরোটা সত্যি নয়। কারণ, বেশ কিছু সমস্যা আছে এখানে। নক্ষত্র থেকে যত দূরে থাকা যায়, মহাকর্ষ বলও তত কমতে থাকে। তাই নক্ষত্রে অবস্থান করা আমাদের সেই দুঃসাহসী নভোচারীর মাথার চেয়ে তার পায়ের ওপর সব সময় মহাকর্ষ বলের পরিমাণ বেশি হবে। নক্ষত্রটি ক্রান্তীয় ব্যাসার্ধে (যেখানে ঘটনা দিগন্ত গঠিত হয়) পৌঁছানোর আগেই বলের এই পার্থক্য তাকে স্প্যাগেটির (সেমাইয়ের মতো একপ্রকার ইতালীয় খাবার) মতো টেনে লম্বা বানিয়ে ফেলবে। অথবা তাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে! আমরা বিশ্বাস করি, এই মহাবিশ্বে গ্যালাক্সির কেন্দ্রীয় অঞ্চলের মতো অনেক বড় আকারের বস্তু আছে। সেগুলোও মহাকর্ষীয় টানে চুপসে যাওয়ার মতো ঘটনার মধ্য দিয়ে গিয়ে কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হতে পারে, যা হতে পারে আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রে থাকা বিশাল আকৃতির কৃষ্ণগহ্বরের মতো। এ রকম কোনো কিছুতে কৃষ্ণগহ্বর গঠনের আগে একজন নভোচারী হয়তো ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হবেন না। আসলে ক্রান্তীয় ব্যাসার্ধে পৌঁছানোর আগপর্যন্ত তেমন বিশেষ কিছু টেরই পাবেন না তিনি। আবার যেখানে পৌঁছালে আর কখনো ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই, সেখানে গিয়েও তিনি কিছু বুঝতে পারবেন না। এই জায়গা থেকে কোনো সংকেত পাঠালে তা বাইরে যেতে ক্রমে আগের চেয়ে বেশি সময় লাগবে। তারপর একসময় আর বাইরে যেতে পারবে না ওই সংকেত। এর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর (নভোচারীর ঘড়ির হিসাবে), ওই অঞ্চল যেহেতু চুপসে যেতে শুরু করার কারণে নভোচারীর মাথা আর পায়ের ওপর মহাকর্ষ টানের পার্থক্য খুবই বেশি হবে। তাই আবারও ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে নভোচারী।

দূরত্বের কারণে মহাকর্ষ কমতে থাকে। তাই আমাদের পায়ের চেয়ে মাথার ওপর পৃথিবীর আকর্ষণ বল তুলনামূলকভাবে অনেক কম। কারণ, আমাদের মাথার চেয়ে আমাদের পা পৃথিবীর কেন্দ্রের অন্তত এক বা দুই মিটার বেশি কাছে। এই পার্থক্য এতই অল্প যে তা বোঝা যায় না। কিন্তু কোনো কৃষ্ণগহ্বরের পৃষ্ঠের কাছাকাছি থাকা একজন নভোচারী এই টানের পার্থক্যের কারণে আক্ষরিক অর্থেই ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।

মাঝেমধ্যে অনেক বড় আকৃতির কোনো নক্ষত্র চুপসে বা ভেঙে পড়লে নক্ষত্রটির বাইরের এলাকা হয়তো বিপুল বিস্ফোরণে ফেটে ও পড়তে পারে। একে বলা হয় অতিনব তারা বা সুপারনোভা। একটি সুপারনোভা বিস্ফোরণ এত বিশাল হয় যে তা থেকে নির্গত আলো তার নিজের গ্যালাক্সির সব কটি নক্ষত্রের আলোর সমষ্টির চেয়েও অনেক বেশি হয়। এ ধরনের একটি সুপারনোভার অবশিষ্টাংশ দেখা যায় ক্র্যাব নেবুলায়। ১০৫৪ সালে এ-সংক্রান্ত একটি ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায় চীনের নথিপত্রে। ওই নক্ষত্রটি বিস্ফোরিত হয়েছিল আমাদের কাছ থেকে পাঁচ হাজার আলোকবর্ষ দূরে। তারপরও খালি চোখে বেশ কয়েক মাস ধরে দেখা গিয়েছিল সেটা। বিস্ফোরিত নক্ষত্রটি এতই উজ্জ্বল আলো ছড়াচ্ছিল যে দিনের বেলাতেও দেখা যাচ্ছিল তাকে। এমনকি রাতের বেলা ওই আলোতে পড়াও যাচ্ছিল।

৫০০ আলোকবর্ষ দূরের একটি সুপারনোভার (আগেরটি থেকে এর দূরত্ব ১০ ভাগের ১ ভাগ) উজ্জ্বলতা শতগুণ বেশি হতে পারে। পাশাপাশি এটি আক্ষরিক অর্থেই রাতকে দিন বানিয়ে দিতে পারে। এ ধরনের বিস্ফোরণের প্রচণ্ডতা বোঝার জন্য, শুধু একবার ভাবা যেতে পারে যে ওই সুপারনোভা ১০০ কোটি গুণ বেশি দূরে অবস্থিত হওয়া সত্ত্বেও তার আলো আমাদের সূর্যের আলোকে ম্লান করে দিচ্ছে। (স্মরণ রাখা দরকার, সূর্য আমাদের কাছ থেকে মাত্র ৮ আলোক মিনিট দূরে অবস্থিত)। একটি সুপারনোভা যদি আমাদের যথেষ্ট কাছে থাকে, তাহলে তা থেকে নিঃসৃত বিকিরণে পৃথিবীকে অক্ষত রাখলেও পৃথিবীর সব জীব মারা যাবে। আসলে সম্প্রতি প্রস্তাব করা হয়েছে, প্রায় ২০ লাখ বছর আগে প্লেসটোসিন এবং প্লিয়োসিন যুগের সামুদ্রিক কিছু জীবের মৃত্যুর কারণ মহাজাগতিক রশ্মি বিকিরণ। এই বিকিরণ এসেছিল আমাদের প্রতিবেশী একটি নক্ষত্রপুঞ্জের একটি সুপারনোভা থেকে। এই নক্ষত্রপুঞ্জটি বৃশ্চিক-মহিষাসুর নামের নক্ষত্রমণ্ডলের সমন্বয়ে গঠিত। কিছু বিজ্ঞানীর বিশ্বাস, উন্নত জীব শুধু সেসব গ্যালাক্সি এলাকাতেই বিকশিত হওয়া সম্ভব, যেখানে নক্ষত্রের সংখ্যা খুব বেশি নয়। অর্থাৎ এটিই জীবনের জন্য উপযোগী অঞ্চল। কারণ, যেখানে নক্ষত্রের পরিমাণ বেশি, সেখানে সুপারনোভা বিস্ফোরণের ঘটনাও নিত্যনৈমিত্তিক। ফলে সেখানে জীবনের যেকোনো ধরনের বিকাশও শুরুতেই বন্ধ হয়ে যেতে পারে। প্রতিদিন গড়ে কয়েক হাজার সুপারনোভা এই মহাবিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় বিস্ফোরিত হচ্ছে। কোনো নির্দিষ্ট গ্যালাক্সিতে সুপারনোভা বিস্ফোরণ প্রায় ১০০ বছরে একবার ঘটতে পারে। তবে এটি গড়পড়তা হিসাব। দুর্ভাগ্যক্রমে, অন্তত জ্যোতির্বিদদের কাছে, আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে সর্বশেষ সুপারনোভা বিস্ফোরণ হয়েছে ১৬০৪ সালে। কিন্তু তখনো টেলিস্কোপ উদ্ভাবিত হয়নি।

আমাদের গ্যালাক্সিতে পরবর্তী সুপারনোভা বিস্ফোরণের তালিকায় আছে রো ক্যাসিওপি নামের একটি নক্ষত্র। সৌভাগ্যক্রমে নক্ষত্রটা আমাদের কাছ থেকে ১০ হাজার আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। এটা বেশ নিরাপদ আর স্বস্তিদায়ক দূরত্ব। এটি ইয়োলো হাইপারজায়ান্ট বা হলুদ অতিদানব নামের একধরনের নক্ষত্র শ্রেণির। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে এ ধরনের সাতটি হলুদ অতিদানব সম্পর্কে জানা গেছে। জ্যোতির্বিদদের একটি আন্তর্জাতিক দল ১৯৯৩ সাল থেকে এ নক্ষত্র নিয়ে গবেষণা চালিয়ে আসছে। এর পরবর্তী কয়েক বছরে তাঁরা দেখতে পান, নক্ষত্রটির তাপমাত্রা পর্যায়ক্রমিকভাবে কয়েক শ ডিগ্রি কমে এসেছে। পরে ২০০০ সালের গ্রীষ্মে ওই নক্ষত্রটির তাপমাত্রা হঠাৎ নেমে আসে ৭০০০ ডিগ্রি থেকে ৪০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। এ সময়ে নক্ষত্রটির বায়ুমণ্ডলে টাইটেনিয়াম অক্সাইডের উপস্থিতি শনাক্ত করেন গবেষকেরা। তাঁদের বিশ্বাস, বিশাল এক শক ওয়েভের কারণেই নক্ষত্রটির বাইরের স্তর থেকে এই টাইটেনিয়াম অক্সাইডের অংশটি ছিটকে পড়েছে।

একটি সুপারনোভার ভেতরে নক্ষত্রটির জীবনের শেষ দিকে তৈরি হয় কিছু ভারী মৌল। এ মৌলগুলো নক্ষত্র থেকে গ্যালাক্সিতে ছিটকে পড়ে। এগুলোই পরবর্তী সময়ে নতুন প্রজন্মের নক্ষত্রের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আমাদের সূর্যেও এ ধরনের প্রায় ২ শতাংশ ভারী মৌল আছে। সূর্য আসলে দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মের নক্ষত্র। প্রায় ৫ বিলিয়ন বছর আগে আদিম সুপারনোভাগুলো থেকে আসা বিভিন্ন বর্জ্য থেকে তৈরি ঘূর্ণমান গ্যাসের মেঘ থেকে তৈরি হয়েছিল সূর্য। এই মেঘের বেশির ভাগ গ্যাসই সূর্য গঠিত হতে কাজে লেগেছিল কিংবা বিস্ফোরিত হয়েছিল। কিন্তু সামান্য পরিমাণ ভারী মৌল একত্র হয়ে বস্তুর আকার ধারণ করেছিল। এই বস্তুগুলো আসলে পৃথিবীর মতো কিছু গ্রহ, যা এখন সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। আমাদের অলংকারে সোনা আর পারমাণবিক চুল্লিতে ইউরেনিয়াম উভয়েই আসলে সুপারনোভার অবশিষ্টাংশ। আমাদের সৌরজগৎ জন্মের আগে বিস্ফোরিত হয়েছিল এসব সুপারনোভা!

পৃথিবী যখন কেবল ঘন হয়েছিল, তখন সেটি খুবই উত্তপ্ত ছিল। এ সময় কোনো বায়ুমণ্ডলও ছিল না পৃথিবীর। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এটি শীতল হতে থাকে এবং পাথর থেকে নির্গত হওয়া গ্যাস থেকে একটি বায়ুমণ্ডলও গঠিত হয়। আমরা এখন যে বায়ুমণ্ডলে বেঁচে আছি, পৃথিবীর আদিম সেই বায়ুমণ্ডল সে রকম ছিল না। সেখানে কোনো অক্সিজেন ছিল না। তবে অন্য অনেক গ্যাস ছিল, যা আমাদের জন্য বিষাক্ত। এ রকম একটি গ্যাস হচ্ছে হাইড্রোজেন সালফাইড (গ্যাসটি থেকে পচা ডিমের মতো গন্ধ পাওয়া যায়)।

অবশ্য এ ধরনের পরিবেশে আদিম অন্য ধরনের কিছু জীব বিকশিত হতে পারে। মহাসাগরে জীবনের সূচনা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। সম্ভবত পরমাণুর বিন্যাসের পরিবর্তনের মাধ্যমে (একে বলা হয় ম্যাক্রোমলিকুল বা স্থল অণু) বিশাল কাঠামো গঠনের ফলে এমনটি ঘটেছিল। ম্যাক্রোমলিকুল মহাসাগরের অন্যান্য পরমাণুকে একই ধরনের কাঠামোতে সাজাতে সক্ষম। আবার তারা নিজেদের পুনরুৎপাদন ও বংশবৃদ্ধিও করতে পারত বলে ধারণা করা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বংশবৃদ্ধিতে ত্রুটি দেখা দিত। এ ধরনের বেশির ভাগ ত্রুটি ছিল এমন যে নতুন ম্যাক্রোমলিকুল আর নিজের বংশবৃদ্ধি করতে পারত না। ফলে তারা ধ্বংস হয়ে যেত। আবার কিছু ত্রুটি এমনও ছিল যে নতুন ম্যাক্রোমলিকুল অনেক ভালোভাবে নিজেদের বংশবৃদ্ধি করতে পারত। এই নতুন বংশধরেরা সুবিধা পেত এবং তারাই হয়তো একসময় আসল ম্যাক্রোমলিকুলকে হটিয়ে দিয়েছিল। এভাবেই সূচনা হয়েছিল বিবর্তন প্রক্রিয়ার। এ থেকে ক্রমে সৃষ্টি হয়েছিল আরও জটিল থেকে জটিলতর স্বপ্রজননে সক্ষম জীব। প্ৰথম আদিম জীব বিভিন্ন জিনিস খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করেছিল। এর মধ্যে আছে হাইড্রোজেন সালফাইড। এই আদিম জীব অক্সিজেন ত্যাগ করত। এভাবে ক্রমান্বয়ে বায়ুমণ্ডলের গঠন পরিবর্তন হতে হতে বর্তমানের মতো অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। এ বায়ুমণ্ডলের কারণে মাছ, সরীসৃপ, স্তন্যপায়ী এবং শেষ পর্যন্ত মানবজাতির মতো তুলনামূলক উন্নততর জীবের বিকাশ সম্ভব হয়েছিল।

বিশ শতক মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে মহাবিশ্বের রূপান্তর দেখেছে। আমরা বুঝতে পেরেছি, বিশাল এই মহাবিশ্বে আমাদের নিজেদের গ্রহ কতটা তাৎপর্যহীন। আমরা আবিষ্কার করেছি, সময় আর স্থান বক্র এবং একই সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য। আমরা আরও আবিষ্কার করেছি, এই মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে এবং মহাবিশ্বের সময়ের একটা শুরুও ছিল।

শুরুর সময় মহাবিশ্ব অতি উত্তপ্ত ছিল। প্রসারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মহাবিশ্ব শীতল হতে শুরু করে। মহাবিশ্ব সম্পর্কে এই চিত্রটি আমরা পেয়েছি আইনস্টাইনের মহাকর্ষ তত্ত্ব বা সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে। পর্যবেক্ষণগত সব কটি প্রমাণ এই তত্ত্বের সঙ্গে মানানসই। তাই এই তত্ত্বের জন্য আমরা এখন অনেক বড় বিজয় অর্জন করতে পেরেছি। গণিত এখনো অসীম সংখ্যা আয়ত্তে আনতে পারেনি। মহাবিস্ফোরণে মাধ্যমে মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছে এই ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে, এমন একটি সময় ছিল যখন মহাবিশ্বের ঘনত্ব এবং স্থান-কালের বক্রতা ছিল অসীম। সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুসারে, মহাবিশ্বের এমন একটি বিন্দু ছিল, যেখানে এই তত্ত্ব নিজেই অকার্যকর হয়ে যায়। এ ধরনের বিন্দু এমনই এক উদাহরণ, যাকে গণিতবিদেরা বলেন সিঙ্গুলারিটি বা পরম বিন্দু। যখন কোনো তত্ত্ব অসীম ঘনত্ব এবং বক্রতার মতো পরম বিন্দুর ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে, তার অর্থ তত্ত্বটি কোনো না কোনোভাবে অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে। সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব আসলে একটি অসম্পূর্ণ তত্ত্ব। কারণ, এই তত্ত্ব আমাদের বলতে পারে না যে মহাবিশ্ব কীভাবে সূচনা হয়েছিল।

সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব সম্পর্কে আরও বলা যায়, প্রকৃতির জন্য বিশ শতকের আরেকটি মহান আংশিক তত্ত্ব জন্ম নিয়েছিল। যার নাম কোয়ান্টাম মেকানিকস। এই তত্ত্ব অতি ক্ষুদ্র পরিসরে সংঘটিত ঘটনা নিয়ে কাজ করে। মহাবিস্ফোরণ সম্পর্কে আমাদের চিত্র বলে যে মহাবিশ্বের একেবারে শুরুর দিকে অবশ্যই একটি কাল ছিল। তখন মহাবিশ্ব ছিল অতি ক্ষুদ্র। মহাবিশ্বের বড় পরিসরের কাঠামোতে গবেষণাতেও কোয়ান্টাম মেকানিকসের ক্ষুদ্র পরিসরের প্রভাব অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। এই মহাবিশ্বের একেবারে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমরা বুঝতে পারব, সে ব্যাপারে আমরা বেশ আশাবাদী। সে জন্য এই দুটি আংশিক তত্ত্বকে একত্র করে একটি একক মহাকর্ষের কোয়ান্টাম তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে। সে তত্ত্বটি সব জায়গায় বিজ্ঞানের সাধারণ নিয়ম ধারণ করতে পারবে। পাশাপাশি এতে সময়ের সূচনার বিষয়টি থাকবে। সেখানে সিঙ্গুলারিটি বা পরম বিন্দুর কোনো প্রয়োজন হবে না।

*

স্টিফেন হকিংয়ের আ ব্রিফার হিস্ট্রি অব টাইম বই থেকে নেওয়া।

তথ্যনির্দেশ

স্থিতিশীল মহাবিশ্ব তত্ত্ব : বিশ্ব সৃষ্টিতত্ত্বে মহাবিশ্বের বিবর্তনে মহাবিস্ফোরণ মডেলের একটি বিকল্প তত্ত্ব এটি। বিশ শতকের মাঝামাঝিতে এই তত্ত্বটি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ১৯৪৮ সালের দিকে বিজ্ঞানী হারমান বন্ডি, থমাস গোল্ড এবং ফ্রেড হয়েল এই তত্ত্বের সপক্ষে কিছু প্রভাবশালী গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন। তবে কিছু পর্যবেক্ষণগত প্ৰমাণ মহাবিস্ফোরণ মডেলের সঙ্গে মিলে গেছে। সে কারণে বর্তমানে স্থিতিশীল মহাবিশ্ব তত্ত্বটি অধিকাংশ বিশ্ব সৃষ্টিতত্ত্ববিদ, জ্যোতিঃপদার্থবিদ ও জ্যোতির্বিদেরা নাকচ করে দিয়েছেন।

ফ্রেড হয়েল : ইংরেজ জ্যোতির্বিদ ও গণিতবিদ স্যার ফ্রেড হয়েল (১৯১৫-২০০১ সাল) স্টেডি স্টেট থিওরি বা স্থিতিশীল মহাবিশ্বতত্ত্বের জন্য পরিচিত। মহাবিশ্বের উৎপত্তির জন্য মহাবিস্ফোরণ তত্ত্বের বিরোধী ছিলেন তিনি। এমনকি মহাবিস্ফোরণ তত্ত্বকে ব্যঙ্গ করতে গিয়েই বিগ ব্যাং শব্দটি উচ্চারণ করেছিলেন তিনি। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, তার দেওয়া নামটিই এখন তত্ত্বটির জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে।

অ্যারিস্টোটল : প্রাচীন গ্রিসের অন্যতম চিন্তাবিদ ছিলেন অ্যারিস্টোটল। দর্শন, প্রকৃতিবিদ্যা, যুক্তিশাস্ত্র, জীববিদ্যা, মনোবিদ্যা, নীতিশাস্ত্র, রাষ্ট্রনীতি ও কাব্যরীতি—সব ক্ষেত্রেই রয়েছে তাঁর অবদান রয়েছে। প্লেটোর শিষ্য অ্যারিস্টোটল ছিলেন দিগ্‌বিজয়ী বীর আলেকজান্ডারের শিক্ষক। খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩৫ সালে তিনি এথেন্সে প্লেটোর একাডেমির আদলে গড়ে তুলেছিলেন লাইসিয়াম। পলিটিকস তাঁর বিখ্যাত রচনা। জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অ্যারিস্টোটলের ব্যাপক অবদান সত্ত্বেও বিজ্ঞানে তিনি অনেক ভুল ধারণারও জন্মদাতা। তাঁর কারণে এসব ভুল ধারণা দীর্ঘদিন আঁকড়ে ধরে ছিল ইউরোপ।

ইলেকট্রন : ঋণাত্মক চার্জযুক্ত একটি কণা, যা একটি পরমাণুর কেন্দ্র বা নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘোরে। পরমাণুর নিউক্লিয়াস ধনাত্মক চার্জযুক্ত। সহজাতভাবে ঋণাত্মক চার্জযুক্ত ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসের ধনাত্মক চার্জের প্রতি আকর্ষিত হয়। তাই পরমাণুর কেন্দ্রীয় নিউক্লিয়াসের চারপাশে ইলেকট্রনগুলো ঘুরপাক খায়। ১৮৯৭ সালে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জে জে থমসন ইলেকট্রন আবিষ্কার করেন।

নিউক্লিয়াস : পরমাণুর কেন্দ্রীয় অংশ। এখানে শুধু ধনাত্মক চার্জযুক্ত প্রোটন এবং চার্জ নিরপেক্ষ নিউট্রন থাকে। এই দুটি কণা শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বল দ্বারা পরস্পর একত্র থাকে।

প্রোটন : নিউট্রনের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ একটি কণা, তবে এই কণাটি ধনাত্মক চার্জযুক্ত। বেশির ভাগ পরমাণুর কেন্দ্রে এই কণাটি প্রায় অর্ধেকসংখ্যক থাকে, বাকি অর্ধেক নিউট্রন। প্রোটনের ভর ইলেকট্রনের ভরের প্রায় ১৮৩৬.১২ গুণ। ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ পদার্থবিদ আর্নেস্ট রাদারফোর্ড প্রোটন আবিষ্কার করেন। প্রোটনকে বলা হয় অতিপারমাণবিক কণা বা সাব-অ্যাটমিক পার্টিকেল। ধনাত্মক চার্জযুক্ত এ কণা পরমাণুর নিউক্লিয়াসে নিউট্রনের সঙ্গে যুক্ত থাকে। একসময় একে মৌলিক কণা হিসেবে ভাবা হতো। তবে পরবর্তী গবেষণায় দেখা গেছে, এ কণাগুলো কোয়ার্ক নামের আরও ক্ষুদ্র কণা দিয়ে গঠিত। একটি প্রোটন তিনটি কোয়ার্ক দিয়ে তৈরি। এর মধ্যে দুটি আপ কোয়ার্ক ও একটি ডাউন কোয়ার্ক। একটি পরমাণুর নিউক্লিয়াসে এক বা একাধিক প্রোটন থাকতে পারে। প্রতিটি মৌলের একটি নির্দিষ্টসংখ্যক প্রোটন থাকে। তাই নিউক্লিয়াসে প্রোটনের সংখ্যা ওই মৌলটির বৈশিষ্ট্যসূচক বলে বিবেচনা করা হয়। প্রোটনের এই সংখ্যাকে বলা হয় পারমাণবিক সংখ্যা। সবচেয়ে সরল মৌল হাইড্রোজেনে প্রোটনের সংখ্যা মাত্র একটি। অন্যদিকে সবচেয়ে ভারী প্রাকৃতিক মৌল ইউরেনিয়ামের প্রোটনসংখ্যা ৯২। নিউক্লিয়াসে যত বেশি প্রোটন থাকবে, ওই পরমাণুর ইলেকট্রনও তত বেশি হবে।

নিউক্লিয়াসে প্রোটনগুলো শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বলের মাধ্যমে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত থাকে। এই বল বৈদ্যুতিক বিকর্ষণের চেয়েও শক্তিশালী। সে কারণেই ধনাত্মক চার্জযুক্ত প্রোটন পরস্পরকে বিকর্ষণ না করে একত্রে যুক্ত থাকতে পারে।

কোয়ার্ক : বস্তুর ক্ষুদ্রতম মৌলিক কণা। একটি চার্জিত মৌলিক কণা, যা শক্তিশালী বল দ্বারা প্রভাবিত হয়। একসময় পরমাণুর প্রোটন এবং নিউট্রনকে অবিভাজ্য ভাবা হতো। কিন্তু ১৯৬৪ সালে বিজ্ঞানী মারে গেল- মান এবং জর্জ ওয়েন আলাদাভাবে কোয়ার্ক মডেলের প্রস্তাব করেন। এই মডেল অনুযায়ী, কোয়ার্ক পদার্থের একধরনের মৌলিক কণা। তবে এই মৌলিক কণার নাম কী হবে, তা নিয়ে দ্বিধা ছিলেন গেল-মান। কোনো নামই তাঁর পছন্দ হচ্ছিল না। হঠাৎ ইউলিসিস খ্যাত লেখক জেমস জয়েসের ফিনেগানস ওয়েক বইটিতে একটি ছড়ার লাইনে তাঁর চোখ আটকে গেল। ছড়াটির একটি লাইন ছিল : থ্রি কোয়ার্কস ফর মাস্টার্স মার্ক!। ব্যস, এখান থেকেই পরমাণু মৌল কণার নাম কোয়ার্ক (Quark) শব্দটি বেছে নিলেন গেল-মান। পরে তাঁর এই দ্য কোয়ার্ক অ্যান্ড দ্য জাগুয়ার বইটিতে কণাটি নাম এবং অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে আরও বিস্তারিত লেখেন গেল-মান। এদিকে বিজ্ঞানী ওয়েন এই কণাটির নাম প্রস্তাব করেছিলেন এইস (Ace) বা তাসের টেক্কা। কিন্তু তাদের কোয়ার্ক মডেল অন্য বিজ্ঞানীদের কাছে ব্যাপকভাবে গৃহীত হওয়ার পর কোয়ার্ক নামটিই জনপ্রিয় হয়ে যায়।

ছয় ধরনের কোয়ার্ক কণার অস্তিত্বের প্রমাণ পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এদের নাম : আপ কোয়ার্ক, ডাউন কোয়ার্ক, চার্ম কোয়ার্ক, স্ট্রেঞ্জ কোয়ার্ক, টপ কোয়ার্ক এবং বটম কোয়ার্ক। প্রোটন ও নিউট্রনের প্রতিটিই তিনটি কোয়ার্ক কণা দিয়ে গঠিত। এদের মধ্যে দুটি আপ কোয়ার্ক ও একটি ডাউন কোয়ার্ক মিলে তৈরি হয় প্রোটন আর দুটি ডাউন ও একটি আপ কোয়ার্ক মিলে তৈরি হয় নিউট্রন।

ফোটন : আলো কণা নাকি তরঙ্গ, সে বিতর্ক অনেক দিনের। আলোর কণা ধারণার পক্ষে ছিলেন স্বয়ং আইজ্যাক নিউটন। অন্যদিকে আলোর তরঙ্গ ধারণার পক্ষে আছেন রেনে দেকার্ত, রবার্ট হুক, ক্রিস্টিয়ান হাইজেনস, জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েলসহ অনেকে। ১৯৬৫ সালে ম্যাক্সওয়েল আলোকে বিদ্যুৎ- চুম্বকীয় তরঙ্গ হিসেবে অনুমান করেন। ২৩ বছর পর তা প্রমাণ করেন জার্মান বিজ্ঞানী হেনরিক হার্জ। এদিকে ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন ফটো ইলেকট্রিক ইফেক্ট ব্যাখ্যা করতে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টা ধারণা কাজে লাগিয়েছিলেন। এতে তিনি আলোকে কোয়ান্টাম হিসেবে বিবেচনা করেন। তাঁর ব্যাখ্যা অনুযায়ী, বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ শুধু বিচ্ছিন্ন তরঙ্গ প্যাকেটের মতো নিঃসৃত হয়। এই তরঙ্গের প্যাকেটকে তিনি বলেছিলেন আলোর কোয়ান্টা। তাঁর ব্যাখ্যায়, আলো অবিচ্ছিন্নভাবে নয়, বরং কোয়ান্টা বা গুচ্ছ বা প্যাকেট আকারে নিঃসৃত বা শোষিত হয়। শুধু তা-ই নয়, আলো গুচ্ছ আকারেই অস্তিত্বশীল।

শুরুতে আইনস্টাইনের প্রস্তাবিত আলো বা বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় শক্তির কোয়ান্টা অন্য পদার্থবিদদের কাছে পরিচিত ছিল কণিকা নামে। তবে আলোকে একই সঙ্গে তরঙ্গ ও কণা হিসেবে মেনে নিতে অনেকেই রাজি ছিল না। অনেকের ধারণা, আলোর কণাকে ফোটন নামকরণও করেছেন স্বয়ং আইনস্টাইন। কিন্তু আসলে ১৯২৬ সালে আলোক পদার্থবিদ ফ্রিথিওফ উলফার্স এবং রসায়নবিদ গিলবার্ট লুইস এই কণার নাম দিলেন ফোটন। তবে তাঁদের প্রস্তাবিত তত্ত্ব ভুল প্রমাণিত হওয়ায় নামটিও তেমন কারও নজর কাড়তে পারেনি। এদিকে বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বিকিরণের কণাধর্মী প্ৰমাণ হিসেবে কম্পটন ইফেক্ট আবিষ্কার করে ১৯২৭ সালে নোবেল পেয়েছিলেন মার্কিন বিজ্ঞানী আর্থার কম্পটন। ১৯২৮ সালে তিনি আলোর কণা বোঝাতে ফোটন শব্দটি ব্যবহার করেন। তারপর থেকে আলোর কোয়ান্টা হিসেবে ফোটন শব্দটি জনপ্রিয় হতে শুরু করে। শব্দটি ধার করা হয়েছিল গ্রিক ভাষা থেকে। গ্রিক শব্দ phās বা phot-এর অর্থ আলো। এ শব্দের সঙ্গে on প্ৰত্যয় যোগ করে কণাটির নাম রাখা হলো ফোটন (Photon)। ইলেকট্রন, প্রোটন, মিউয়নসহ অন্যান্য কণার শেষে ইংরেজি on প্রত্যয় যুক্ত থাকে। আলোকে কণা বিবেচনা করে এর শেষেও একই প্রত্যয় যোগ করা হয়েছিল।

পরম শূন্য : সম্ভাব্য সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। এই তাপমাত্রায় বস্তুর মধ্যে কোনো তাপশক্তি থাকে না। প্রায় -২৭৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা কেলভিন স্কেলে শূন্য।

বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল : বৈদ্যুতিক চার্জের কারণে কণাদের মধ্যে যে বলের সৃষ্টি হয়। চারটি মৌলিক বলের মধ্যে এটি দ্বিতীয় শক্তিশালী বল। এই বলের কারণেই পরমাণুর ধনাত্মক চার্জযুক্ত নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঋণাত্মক চার্জযুক্ত ইলেকট্রনগুলো ঘুরপাক খায়। একই সঙ্গে এই বলের কারণেই পরমাণুগুলো পরস্পর যুক্ত হয়ে অণু বড় কোনো কাঠামো গঠন করতে পারে।

পরম সময় : একটি সর্বজনীন ঘড়ি থাকতে পারে, এ রকম ধারণা। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব প্রমাণ করেছে যে এ রকম কোনো কিছু থাকতে পারে না।

কোয়ান্টাম মহাকর্ষ : মহাকর্ষের জন্য একটি কোয়ান্টাম তত্ত্বের নামই কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি বা কোয়ান্টাম মহাকর্ষ। একমাত্র মহাকর্ষ বাদে প্রকৃতির সব মৌলিক বলের কোয়ান্টাম তত্ত্ব গঠন করা সম্ভব হয়েছে। প্রস্তাবিত এই তত্ত্বের মাধ্যমেই সাধারণ আপেক্ষিকতা এবং কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্ব একত্র করে একটি পূর্ণাঙ্গ তত্ত্ব পাওয়া সম্ভব হবে বলে ধারণা বিজ্ঞানীদের 1

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *