কৃষ্ণগহ্বর কি আসলে লোমশূন্য?

কৃষ্ণগহ্বর কি আসলে লোমশূন্য?

সম্প্রচার ২৬ জানুয়ারি ২০১৬

স্টিফেন হকিং : কথায় বলে, বাস্তব ঘটনা নাকি মাঝেমধ্যে কল্পনাকেও হার মানায়। কথাটি সবচেয়ে সত্য বলে মনে হয় ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বরের বেলায়। বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লেখকদের কল্পলোকে দেখা যেকোনো কিছুর চেয়েও কৃষ্ণগহ্বর অনেক বেশি অদ্ভুতুড়ে। তারপরও এটি যে বৈজ্ঞানিক সত্য, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বৈজ্ঞানিক সমাজ ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছিল, অতি ভারী নক্ষত্রগুলো তাদের মহাকর্ষের প্রভাবে নিজেদের ওপরেই ভেঙে পড়তে বা চুপসে যেতে পারে। এরপর সেখানে পড়ে থাকা অবশিষ্ট বস্তুর আচরণ কেমন হবে, তা-ও একসময় বুঝতে পারেন বিজ্ঞানীরা।

আলবার্ট আইনস্টাইন ১৯৩৯ সালে এক গবেষণাপত্র দাবি করেন, নক্ষত্ররা নিজেদের মহাকর্ষের অধীনে কখনোই চুপসে যেতে পারে না। কারণ, পদার্থ একটি নির্দিষ্ট বিন্দু বা সীমার পর আর সংকুচিত হতে পারে না বলে মনে করতেন তিনি। সেকালে আইনস্টাইনের এই অনুমানের সঙ্গে একমত হন বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী। তবে এ ক্ষেত্রে প্রধানতম ব্যতিক্রম ছিলেন মার্কিন বিজ্ঞানী জন হুইলার। নানা কারণে তিনি কৃষ্ণগহ্বরবিষয়ক কাহিনির নায়ক। ১৯৫০-এর দশক এবং ১৯৬০-এর দশকে তাঁর গবেষণায় তিনি জোর দিয়ে বলেন, অনেক নক্ষত্রই ক্রমান্বয়ে চুপসে যায়। এরপর এ বিষয়ে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার জন্য সম্ভাব্য সব রকম বিব্রতকর সমস্যাগুলো চিহ্নিত করেন তিনি। এ ছাড়া চুপসে যাওয়া নক্ষত্র থেকে তৈরি হওয়া ওই সব বস্তু বা কৃষ্ণগহ্বরের বৈশিষ্ট্যগুলো সম্পর্কেও তিনি আগাম ভবিষ্যদ্বাণী করেন।

ডেভিড শুকম্যান (ডিএস) : ‘ব্ল্যাকহোল’ শব্দগুচ্ছটি বেশ সরল মনে হলেও তা থেকে মহাকাশের এ বস্তুটির প্রকৃতি সম্পর্কে কল্পনা করাও কঠিন। একটা বিশালাকৃতির নর্দমার কথা কল্পনা করুন, যার মধ্যে বিভিন্ন জায়গা থেকে পানি এসে প্রবল ঘূর্ণিপাক তৈরি করে পড়ে যাচ্ছে। কোনো কিছু একবার এই নর্দমার কিনারায় পিছলে গেলে তার আর পেছনে ফেরার কোনো উপায় নেই। কৃষ্ণগহ্বরের বেলায় এ ব্যাপারটিকে বলা হয় ইভেন্ট হরাইজন বা ঘটনা দিগন্ত। কারণ, কৃষ্ণগহ্বর এতই শক্তিশালী যে তা আলোকেও টেনে নিজের ভেতরে নিয়ে যায়। সে কারণে এ ধরনের বস্তু আসলে চোখে দেখতে পাই না আমরা। তবু বিজ্ঞানীরা এর অস্তিত্ব সম্পর্কে জানেন। কারণ, কৃষ্ণগহ্বরের খুব কাছে কোনো নক্ষত্র এলে তাকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে ফেলে কৃষ্ণগহ্বর। আবার স্থানের ভেতর কম্পন বা তরঙ্গ সৃষ্টি করতে পারে কৃষ্ণগহ্বর। প্রায় এক বিলিয়ন বছরের বেশি আগে দুটি কৃষ্ণগহ্বরের মধ্যে সংঘর্ষে এই কম্পনের সৃষ্টি হয়েছিল, যাকে বলা হয় গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ বা মহাকর্ষ তরঙ্গ। সম্প্রতি এই তরঙ্গ শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। আমাদের জন্য এটি অতিগুরুত্বপূর্ণ এক বৈজ্ঞানিক অর্জন।

স্টিফেন হকিং: স্বাভাবিক কোনো নক্ষত্রের জীবনকালের বেশির ভাগ সময়, অর্থাৎ কয়েক বিলিয়ন বছরে, নক্ষত্রটি তাপীয় চাপকে অবলম্বন করে নিজের মহাকর্ষের বিরুদ্ধে টিকে থাকতে পারে। এই তাপীয় চাপের কারণ তার নিউক্লিয়ার বা পারমাণবিক প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় প্রচণ্ড তাপ ও চাপে হাইড্রোজেন রূপান্তরিত হয়ে হিলিয়াম পরমাণুতে পরিণত হয়।

ডেভিড শুকম্যান : নক্ষত্রগুলোকে অনেকটা প্রেশার কুকারের মতো বলে বর্ণনা করেছে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা। নক্ষত্রের ভেতরে নিউক্লিয়ার ফিউশনের বিস্ফোরক বল বাইরের দিকে একটি প্রচণ্ড চাপ তৈরি করে। মহাকর্ষের আকর্ষণে সবকিছুকে ভেতরের দিকে টেনে চুপসে ফেলতে প্রবলভাবে বাধা দেয় এই চাপ

স্টিফেন হকিং: যাহোক, সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে নিজের নিউক্লিয়ার জ্বালানি একসময় ফুরিয়ে ফেলে নক্ষত্রটি। স্বাভাবিকভাবে নক্ষত্রটি তখন সংকুচিত বা চুপসে যেতে থাকবে। অবশ্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিজেকে একটি শ্বেত বামন নক্ষত্র হিসেবে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয় নক্ষত্রটি। তবে সুব্রামানিয়ান চন্দ্রশেখর ১৯৩০ সালে প্রমাণ করে দেখান, একটি শ্বেত বামন নক্ষত্রের সর্বোচ্চ ভর হবে আমাদের সূর্যের চেয়ে প্রায় ১.৪ গুণ বেশি। পুরোপুরি নিউট্রন দিয়ে গঠিত একটি নক্ষত্রের ক্ষেত্রেও ঠিক এই একই সর্বোচ্চ ভর হিসাব করে বের করেছিলেন সোভিয়েত পদার্থবিদ লেভ লান্দাউ।

ডেভিড শুকম্যান : শ্বেত বামন এবং নিউট্রন স্টার এককালে সূর্যের মতো নক্ষত্র হিসেবে টিকে থাকে। কিন্তু নিজেদের জ্বালানি ফুরিয়ে ফেলে সেসব নক্ষত্র একসময় শ্বেত বামন কিংবা নিউট্রন স্টারে পরিণত হয়। পরিণতিতে তাদের স্ফীত করতে বা ফোলানোর জন্য আর কোনো বল অবশিষ্ট থাকে না। কাজেই নিজের অপ্রতিরোধ্য মহাকর্ষীয় টানে তাদের সংকুচিত হওয়া ঠেকানোর কোনো উপায় ও থাকে না তখন। ফলে মহাবিশ্বের অন্যতম ঘনীভূত এক বস্তুতে পরিণত হয় এসব বস্তু। তবে নক্ষত্রদের দলে এদের তুলনামূলক ছোটই বলা যায়। অর্থাৎ পুরোপুরি চুপসে যাওয়ার জন্য তাদের যথেষ্ট মহাকর্ষীয় বলের অভাব থাকে। কাজেই খুব বড় কোনো নক্ষত্র তাদের জীবনকালের শেষ পর্যায়ে পৌঁছালে কী ঘটবে, তা স্টিফেন হকিং এবং অন্য অনেকের কাছে সবচেয়ে কৌতূহলের ব্যাপার।

স্টিফেন হকিং : এরপর কোনো শ্বেত বামন কিংবা নিউট্রন নক্ষত্রের চেয়ে অনেক বেশি ভরের এসব অগণিত নক্ষত্র নিজেদের পারমাণবিক জ্বালানি ফুরিয়ে ফেললে তাদের ভাগ্যে কী ঘটবে? একদা এ সমস্যাটি নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছিলেন বিজ্ঞানী রবার্ট ওপেনহাইমার। পরে পারমাণবিক বোমা বানানোর কারণে বিখ্যাত হন তিনি। জর্জ ভলকফ এবং হার্টল্যান্ড সিন্ডারের সঙ্গে যৌথভাবে ১৯৩৯ সালে বেশ কয়েকটি গবেষণাপত্রে তিনি প্রমাণ করেন, এ ধরনের নক্ষত্রের জন্য আর বাইরের দিকে চাপের কোনো অবলম্বন থাকে না। তাদের গণনায় দেখা গেল, বাইরের চাপ বাদ দিলে একটি সুষম গোলককার সুশৃঙ্খল প্রতিসম নক্ষত্র সংকুচিত হয়ে একক অসীম ঘনত্বের একটি বিন্দুতে পরিণত হবে। এ ধরনের বিন্দুকে বলা হয় সিঙ্গুলারিটি বা পরম বিন্দু।

ডেভিড শুকম্যান : একটি দানবীয় নক্ষত্র কোনো অকল্পনীয় ক্ষুদ্র বিন্দুতে সংকুচিত হলেই তাকে বলা হয় পরম বিন্দু। স্টিফেন হকিংয়ের পুরো কর্মজীবনে গবেষণার মূল বিষয় ছিল এ ধারণাটি ঘিরে। পরম বিন্দু কেবল কোনো নক্ষত্রের সমাপ্তিই নির্দেশ করে না, বরং পুরো মহাবিশ্বের গঠনের সূচনা বিন্দু সম্পর্কেও অনেক বেশি মৌলিক ধারণার নির্দেশক। এ বিষয়ে গাণিতিক গবেষণার কারণে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পান হকিং।

স্টিফেন হকিং : স্থান-কাল মসৃণ ও প্রায় সমতল—এই অনুমানের ওপর ভিত্তি করে স্থানবিষয়ক আমাদের সব তত্ত্ব সূত্রবদ্ধ করা হয়েছে। কাজেই স্থান-কাল পরম বিন্দুতে এসে ভেঙে পড়বে, কারণ সেখানে তাদের বক্রতা অসীম। সত্যি বলতে কি, পরম বিন্দু খোদ সময়ের সমাপ্তিসীমাও নির্দেশ করে। কিন্তু এ বিষয়টিই এককালে ভীষণ আপত্তিকর বলে মনে করেছিলেন স্বয়ং আইনস্টাইন।

ডিএস : আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বমতে, বস্তুরা তাদের চারপাশের স্থান-কাল বিকৃত করে দেয়। একটা ট্রামপোলিনে একটা বাউলিং বলের কথা কল্পনা করুন। ট্রামপোলিনের আকৃতি বদলে দেয় বলটি। এর কারণে ছোট বস্তুগুলো বলটির দিকে সরে যেতে থাকে। মোটাদাগে, মহাকর্ষকেও ঠিক এভাবেই ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু স্থান-কালের বক্রতা অনেক গভীর থেকে গভীরতর হলে এবং ক্রমেই অসীম হয়ে গেলে, সেখানে স্থান ও কালের প্রচলিত নিয়মকানুন আর প্রয়োগ করা যায় না।

স্টিফেন হকিং : এরপর শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এ সময় রবার্ট ওপেনহাইমারসহ বেশির ভাগ বিজ্ঞানী নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানে মনোযোগ দেন। ফলে মহাকর্ষীয় সংকোচনবিষয়ক সব আলোচনা ঢাকা পড়ে অনেকটাই বিস্মৃতির অতলে। অনেক পরে কোয়াসার নামের মহাকাশে বহুদূরের একটি বস্তুর হঠাৎ আবিষ্কারের কারণে এ বিষয়ে বিজ্ঞানীদের আগ্রহ আবারও জেগে উঠতে থাকে।

ডিএস : মহাবিশ্বের সবচেয়ে উজ্জ্বল বস্তুগুলোই কোয়াসার। খুব সম্ভবত সবচেয়ে বেশি দূরত্বে শনাক্ত হওয়া বস্তু এরা। কোয়াসি- স্টেলার রেডিও সোর্সেসকে সংক্ষেপে বলা হয় কোয়াসার (Quasar )। এসব বস্তু কৃষ্ণগহ্বরের চারদিকে চাকতির মতো ঘুরপাক খাচ্ছে বলে ধারণা করা হয়।

স্টিফেন হকিং : প্রথম কোয়াসারটির নাম 3C273। ১৯৬৩ সালে আবিষ্কৃত হয়েছিল এটি। এর পরপরই আবিষ্কৃত হলো আরও কিছু কোয়াসার। আমাদের কাছ থেকে এসব বস্তুর অবস্থান বহুদূরে হওয়া সত্ত্বেও সেগুলো দেখতে বেশ উজ্জ্বল। তাদের শক্তি নিউক্লিয়ার প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় না বলে ধারণা করেন বিজ্ঞানীরা। কারণ, তাদের বাকি ভরের খুব সামান্য অংশই বিশুদ্ধ শক্তি হিসেবে নিঃসৃত হয়। তাই একমাত্র বিকল্প হতে পারে তাদের মহাকর্ষীয় শক্তি, যা কি না মহাকর্ষীয় সংকোচনের কারণে বেরিয়ে আসে। এভাবে একসময় নক্ষত্রের মহাকর্ষীয় সংকোচন পুনরাবিষ্কৃত হয়েছিল।

এরই মধ্যে স্পষ্ট বোঝা গেল যে কোনো সুষম গোলককার নক্ষত্র সংকুচিত হবে অসীম ঘনত্বের একটি বিন্দুতে বা একটা পরম বিন্দুতে। আইনস্টাইনের সমীকরণ পরম বিন্দুতে আর কাজ করে না। এর মানে হলো, অসীম ঘনত্বের এই বিন্দুতে কেউই ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোনো অনুমান করতে পারবে না। এতে বোঝা সম্ভব হলো, কোনো নক্ষত্র সংকুচিত হলে অদ্ভুত সব ব্যাপার ঘটতে পারে। পরম বিন্দুগুলো যদি নগ্ন বা উন্মুক্ত হয়, অর্থাৎ সেগুলো যদি বাইরের দর্শকের কাছ থেকে নিরাপদে ঢাকা না থাকে, তাহলে ভবিষ্যদ্বাণী অচল হওয়ার ব্যাপারটি আমাদের প্রভাবিত করতে পারবে না।

ডিএস : একটি উন্মুক্ত পরম বিন্দু হলো এক তাত্ত্বিক রূপরেখা। এখানে একটি নক্ষত্র চুপসে যায় বা সংকুচিত হয়। কিন্তু তার চারপাশে কোনো ঘটনা দিগন্ত গঠিত হয় না। কাজেই পরম বিন্দুটি বাইরে থেকে দৃশ্যমান হবে এখানে।

স্টিফেন হকিং : ‘ব্ল্যাকহোল’ পরিভাষাটি ১৯৬৭ সালে চালু করেন জন হুইলার। আগের দেওয়া ‘ফ্রোজেন স্টার’ নামটিকে হটিয়ে দেয় এটি। হুইলারের চালু করা শব্দটি চুপসে যাওয়া নক্ষত্রদের অবশিষ্টাংশগুলো তাদের নিজের স্বার্থে স্বাধীনভাবে গঠিত হওয়ার দিকে জোর দেয়। নামটি বেশ দ্রুতই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। কোনো গুপ্ত আর রহস্যময় কিছুর ইঙ্গিত করে এটি। তবে ফরাসি ভাষায় শব্দটিতে বেশ অশ্লীল একটি অর্থ খুঁজে পেয়েছিল ফরাসিরা। তাই অনেক বছর ধরেই trou noir (বা কালো গর্ত) নামটিকে অকথ্য – অশ্লীল বলে অভিযোগ করে আসছিল তারা। তবে তাদের এ আচরণ কিছুটা লে উইকএন্ড (সপ্তাহান্তে) বা অন্যান্য ফ্রেংলিশ (বা ফ্রেঞ্চ+ইংলিশ) শব্দের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মতো। অবশ্য শেষ পর্যন্ত তারাও হাল ছেড়ে দিয়েছিল। কারণ, সবার মন জয় করা কোনো নামের বিরোধিতা কেই-বা করতে পারে?

কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে কী আছে—সে সম্পর্কে তার বাইরে থেকে কিছুই বলা যায় না। আপনার টেলিভিশন সেট, হীরার আংটি কিংবা আপনার সবচেয়ে জঘন্য শত্রুকেও একটা কৃষ্ণগহ্বরে ছুড়ে ফেলে দিতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে কেবল সর্বমোট ভর, ঘূর্ণন অবস্থা এবং বৈদ্যুতিক চার্জটাই মনে রাখতে পারবে কৃষ্ণগহ্বরটি। এই নীতিটিকে ‘কৃষ্ণগহ্বর লোমশূন্য’ (বা আ ব্ল্যাকহোল হ্যাজ নো হেয়ার) হিসেবে প্রকাশ করে পরিচিত হন জন হুইলার। অবশ্য তাতে ফরাসিদের আগের সন্দেহটাই পাকাপোক্ত হয়েছিল কেবল।

কৃষ্ণগহ্বরের একটি সীমানা থাকে, যাকে বলা হয় ইভেন্ট হরাইজন বা ঘটনা দিগন্ত। এখানে মহাকর্ষ এতই শক্তিশালী যে তা আলোকেও পেছন দিকে টেনে নিতে পারে এবং আলোকে বাইরে বেরিয়ে যেতে বাধা দেয়। আমরা জানি, কোনো কিছুই আলোর চেয়ে বেশি বেগে চলতে পারে না। কাজেই অন্য সবকিছুকেও এখানে পেছন দিকে টেনে নিতে পারে কৃষ্ণগহ্বর।

ঘটনা দিগন্তের মধ্যে পড়ে যাওয়াটা অনেকটা নায়াগ্রা জলপ্রপাতের ওপর দিয়ে একটি ক্যানো নৌকা নিয়ে চলার মতো। আপনি যদি জলপ্রপাতের ওপরের দিকে বা উজানে থাকেন, তাহলে যথেষ্ট দ্রুতগতিতে প্যাডেল চালিয়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে পারবেন। কিন্তু একবার কিনারার ওপর চলে গেলে স্রেফ নিচে পড়ে যাবেন আপনি সেখান থেকে ফিরে আসার আর কোনো উপায় নেই। জলপ্রপাতের যতই কাছে যেতে থাকবেন, ততই সেখানকার স্রোতের বেগ বাড়তে থাকবে। স্রোতের বেগ ক্যানোর পেছনের দিকের চেয়ে সামনের দিকে বেশি শক্তিশালী হবে। ক্যানোটি টেনে সরিয়ে আনারও ঝুঁকিও রয়েছে সেখানে। কৃষ্ণগহ্বরের ক্ষেত্রেও ঠিক এমন ঘটনাই ঘটে।

কোনো কৃষ্ণগহ্বরে পড়ে যাওয়ার সময় আপনার পা আগে পড়ে গেলে, মহাকর্ষের টান মাথার চেয়ে বেশি শক্তিশালী হবে পায়ে। কারণ, মাথার চেয়ে পা-টি কৃষ্ণগহ্বরের বেশি কাছে থাকে। ফলাফলটা হবে, আপনি লম্বালম্বিভাবে প্রসারিত হতে থাকবেন। আর সংকুচিত বা পিষ্ট হতে থাকবে দেহের পাশের দিকগুলোতে। কৃষ্ণগহ্বরটির ভর আমাদের সূর্যের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি হলে, আপনি স্রেফ ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন। আক্ষরিক অর্থেই সেমাইয়ে পরিণত হবেন ঘটনা দিগন্তে পৌঁছানোর আগেই। আবার আপনি যদি এর চেয়েও বড় কোনো কৃষ্ণগহ্বরে পড়ে যান, যার ভর হয়তো সূর্যের চেয়ে কয়েক মিলিয়ন গুণ বেশি, তাহলে কোনো সমস্যা ছাড়াই চলে যেতে পারবেন ঘটনা দিগন্তে। কাজেই কোনো কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে অনুসন্ধান চালাতে চাইলে বড়টাকে বেছে নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ। আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি বা আকাশগঙ্গা ছায়াপথের কেন্দ্রে একটি কৃষ্ণগহ্বর আছে। এর ভর আমাদের সূর্যের চেয়ে চার মিলিয়ন গুণ বেশি।

ডিএস : বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন, কার্যত সব কটি ছায়াপথের কেন্দ্রে বিপুলসংখ্যক কৃষ্ণগহ্বর আছে। এটি এক অসাধারণ ভাবনা। সম্প্রতি এই বৈশিষ্ট্যটি কীভাবে নিশ্চিত করা গেছে, সে সম্পর্কে তো আগেই বলা হয়েছে।

স্টিফেন হকিং : একটি কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে পড়ে গেলে নির্দিষ্ট কোনো কিছুই আপনি খেয়াল করতে পারবেন না। তবে বহুদূর থেকে কেউ খেয়াল করলে, আপনাকে ঘটনা দিগন্ত অতিক্রম করতে কখনোই দেখতে পাবেন না তিনি। বরং ওই দর্শকের কাছে আপনার গতি ক্রমেই ধীর হতে থাকবে। পাশাপাশি আপনাকে ঘটনা দিগন্তের বাইরে ভেসে থাকতে দেখা যাবে। এরপর ক্রমেই অস্পষ্ট থেকে অস্পষ্টতর এবং লাল থেকে আরও লাল হতে থাকবে আপনার ছবিটি। বাইরের ওই দর্শকের দৃষ্টি থেকে স্রেফ হারিয়ে যাওয়ার আগপর্যন্ত এ ঘটনাই ঘটতে থাকবে। আপনার সম্পর্কে বাইরের বিশ্ব কেবল এটুকুই জানবে যে চিরতরে হারিয়ে গেছেন আপনি।

ডিএস : কৃষ্ণগহ্বর থেকে কোনো আলোই বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে না। তাই দূর থেকে কোনো দর্শকের পক্ষে আসলে আপনার এই পতনের প্রত্যক্ষ সাক্ষী হওয়ার উপায় নেই। আবার ওই জায়গায় আপনার আর্তচিৎকারও শুনতে পাবে না কেউ। তা ছাড়া কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরেও কেউ আপনার হারিয়ে যাওয়াটা দেখতে পাবে না।

স্টিফেন হকিং : রহস্যময় এ ঘটনা সম্পর্কে আমাদের উপলব্ধির নাটকীয় উন্নয়ন হয়েছিল ১৯৭০ সালে এক গাণিতিক আবিষ্কারের মাধ্যমে। সেটি ছিল ঘটনা দিগন্তের পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফলের (বা কোনো কৃষ্ণগহ্বরের চারদিকের সীমানা অঞ্চল) বিশেষ একটি ধর্ম। ধর্মটি হলো, কৃষ্ণগহ্বরে কোনো অতিরিক্ত বস্তু বা বিকিরণ পতিত হলে এই ক্ষেত্রফল বাড়তে থাকে। এই ধর্মটি বাতলে দেয়, কৃষ্ণগহ্বরের ঘটনা দিগন্তের ক্ষেত্রফল এবং প্রথাগত নিউটোনিয়ান পদার্থবিদ্যার মধ্যে একটি মিল আছে। বিশেষ করে মিলটি দেখা যায় তাপগতিবিদ্যার এনট্রপির সঙ্গে। কোন সিস্টেমের বিশৃঙ্খলার পরিমাপ কিংবা একইভাবে সিস্টেমটির যথাযথ অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞানের অভাবকে এনট্রপি হিসেবে বিবেচনা করা যায়। তাপগতিবিদ্যার বিখ্যাত দ্বিতীয় সূত্র অনুসারে, এনট্রপি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সর্বদাই বাড়ছে। ১৯৭০ সালের এই আবিষ্কারটি ছিল এ বিষয়ে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ এক যোগসূত্র।

ডিএস : এনট্রপি বলতে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যেকোনো কিছুর শৃঙ্খলা থেকে আরও বিশৃঙ্খলার দিকে যাওয়ার প্রবণতাকে বোঝায়। যেমন অনেকগুলো ইট পরিপাটি করে গাদা করে একটি দেয়াল বানানো হলো (নিম্ন এনট্রপি)। এটি শেষ পর্যন্ত অগোছালো ধুলার স্তূপে পরিণত হবে (উচ্চ এনট্রপি)। এই প্রক্রিয়াটিকেই ব্যাখ্যা করে তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রটি।

স্টিফেন হকিং : অবশ্য এনট্রপি আর ঘটনা দিগন্তের ক্ষেত্রফলের মধ্যকার যোগসূত্রটি স্পষ্ট হলেও এই ক্ষেত্রফলকে কীভাবে কৃষ্ণগহ্বরের এনট্রপি হিসেবে শনাক্ত করতে পারা যাবে, তা এখনো আমাদের কাছে নিশ্চিত নয়। কোনো কৃষ্ণগহ্বরের এনট্রপি বলতে আসলে কী বোঝায়? এ ব্যাপারে ১৯৭২ সালে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রস্তাব দেন জ্যাকব বেকেস্টাইন। সে সময় তিনি ছিলেন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থী। পরে জেরুজালেমে হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। যাহোক, এটি এভাবে হতে পারে যে মহাকর্ষীয় সংকোচনের ফলে কোনো কৃষ্ণগহ্বর গঠিত হলে, তা দ্রুত একটি স্থির অবস্থায় স্থিতিশীল হয়। আর এই স্থিতিশীল অবস্থাকে চিহ্নিত করা হয় মাত্র তিনটি পরিমাপকের সাহায্যে। সেগুলো হলো ভর, কৌণিক ভরবেগ (ঘূর্ণনের অবস্থা) এবং বৈদ্যুতিক চার্জ। এই তিনটি ধর্ম ছাড়া ওই কৃষ্ণগহ্বরটির ভেতরে সংকুচিত হওয়া বস্তুগুলো সম্পর্কে আর কোনো তথ্য থাকে না।

তথ্যের ক্ষেত্রে এই উপপাদ্যটির প্রয়োগ আছে। অর্থাৎ তথ্য বলতে এখানে কসমোলজিস্টের দৃষ্টিভঙ্গিতে তথ্যকে বোঝানো হয়েছে। এখানে ধারণাটি হলো, মহাবিশ্বের প্রতিটি কণা এবং প্রতিটি বলের ক্ষেত্রে হ্যাঁ-না প্রশ্নের জন্য একটি ঊহ্য উত্তর আছে।

ডিএস : এই প্রেক্ষাপটে তথ্যের অর্থ হলো, একটি বস্তুর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি কণা ও প্রতিটি বলের বিস্তারিত সবকিছু। কোনো কিছু যত বেশি বিশৃঙ্খল হবে (তার এনট্রপির পরিমাণ উচ্চ), তাকে বর্ণনা বা ব্যাখ্যা করতে তত বেশি তথ্যের প্রয়োজন। পদার্থবিদ ও উপস্থাপক জিম আল-খালিলি যেমন একে এভাবে দেখিয়েছেন, ভালোভাবে বাটা এক প্যাকেট তাসের এনট্রপি, না বাটা এক প্যাকেট তাসের চেয়ে অনেক বেশি। কাজেই বাটা তাসের বর্ণনার জন্য অনেক বেশি ব্যাখ্যা বা তথ্যের প্রয়োজন।

স্টিফেন হকিং : বেকেস্টাইনের উপপাদ্যটি ইঙ্গিত করে, মহাকর্ষীয় সংকোচনে বিপুল পরিমাণ তথ্য হারিয়ে যায়। যেমন যে বস্তুটি চুপসে কৃষ্ণগহ্বর গঠিত হলো, সেটি বস্তু নাকি প্রতিবস্তুতে তৈরি কিংবা বস্তুটির আকার গোলাকার, নাকি অতি অসুষম, কৃষ্ণগহ্বরের চূড়ান্ত অবস্থা সে ব্যাপারে স্বাধীন। অন্য কথায়, প্রদত্ত ভর, কৌণিক ভরবেগ আর বৈদ্যুতিক চার্জযুক্ত কোনো কৃষ্ণগহ্বর যেকোনো বড় ধরনের বিভিন্ন কাঠামোর বস্তু চুপসে গিয়ে গঠিত হতে পারে। বিপুলসংখ্যক বিভিন্ন ধরনের নক্ষত্রের মধ্যে যেকোনোটিই হতে পারে এসব বস্তু। সত্যি সত্যিই কোনো কোয়ান্টাম প্রভাব না থাকলে সম্ভাব্য কাঠামোর সংখ্যা হতো অসীম। তাতে অনির্দিষ্টসংখ্যক বিপুল পরিমাণ কণার মেঘ, অনির্দিষ্টসংখ্যক নিম্ন ভর চুপসে গিয়েই কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হতে পারত। কিন্তু এই কাঠামোর সংখ্যা কি আসলেই অসীম হতে পারে? এখানেই আসলে কোয়ান্টাম প্রভাবের ব্যাপারটি চলে আসে।

কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অনিশ্চয়তার নীতি ইঙ্গিত করে, শুধু যেসব কণার তরঙ্গদৈর্ঘ্য খোদ ওই কৃষ্ণগহ্বরের চেয়ে ছোট, শুধু তারাই কৃষ্ণগহ্বর গঠন করতে পারে। এর মানে সম্ভাব্য তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ব্যাপ্তি সীমিত হবে : এটি আর অসীম হতে পারবে না।

ডিএস : আনসার্টেইনিটি প্রিন্সিপাল বা অনিশ্চয়তার নীতির জন্ম দেন বিখ্যাত জার্মান পদার্থবিদ ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ, ১৯২০-এর দশকে। এই নীতি অনুযায়ী, কখনোই ক্ষুদ্রতম কণাদের নির্ভুল অবস্থান নির্দিষ্ট করা কিংবা অনুমান করা সম্ভব হবে না। কাজেই কোয়ান্টাম পরিসরে প্রকৃতিগতভাবে একটি অস্পষ্টতা আছে। আইজ্যাক নিউটনের বর্ণিত যথাযথ বিন্যাসে সাজানো মহাবিশ্বের সঙ্গে এটি একেবারেই বেমানান।

স্টিফেন হকিং : কাজেই এখানে দেখা যাচ্ছে, প্রদত্ত ভর, কৌণিক ভরবেগ আর বৈদ্যুতিক চার্জের কোনো কৃষ্ণগহ্বর গঠন করতে পারা বিভিন্ন সংখ্যক কাঠামোর সংখ্যা বিপুলসংখ্যক হলেও তারা সসীম। জ্যাকব বেকেস্টাইন প্রস্তাব করেন, এই সসীম সংখ্যা থেকে একটি কৃষ্ণগহ্বরের এনট্রপি পাওয়া যেতে পারে। এর মাধ্যমে যেসব তথ্য কৃষ্ণগহ্বর সৃষ্টি হওয়ার সময় সংকোচনকালে অপূরণীয়ভাবে হারিয়ে গিয়েছিল, সেসব তথ্যের পরিমাণ মাপা যাবে।

আপাতদৃষ্টে বেকেস্টাইনের প্রস্তাবটিতে গুরুতর ত্রুটিটি হলো, কোনো কৃষ্ণগহ্বরের যদি একটি সসীম এনট্রপি থাকে, যা তার ঘটনা দিগন্তের ক্ষেত্রফলের সমানুপাতিক, তাহলে তার তাপমাত্রাও সসীম হওয়া উচিত। এই তাপমাত্রার পরিমাণ হবে তার পৃষ্ঠতলের মহাকর্ষের সমানুপাতিক। এটি ইঙ্গিত করবে, শূন্য ছাড়া অন্য যেকোনো তাপমাত্রায় কোনো কৃষ্ণগহ্বর তাপীয় বিকিরণের সাপেক্ষে সাম্যাবস্থায় থাকতে পারে। কিন্তু চিরায়ত ধারণা অনুযায়ী, এ ধরনের কোনো সাম্যাবস্থা থাকা সম্ভব নয়। কারণ, যেহেতু কৃষ্ণগহ্বরে যেকোনো তাপীয় বিকিরণ পতিত হলে তা খোদ কৃষ্ণগহ্বরই শুষে নেবে। কিন্তু সংজ্ঞা অনুসারে, প্রতিদানে সেখান থেকে কোনো কিছুই আর নিঃসরণ হিসেবে ফিরে পাওয়া যাবে না। কাজেই কোনো কিছুই নিঃসরণ করতে পারে না কৃষ্ণগহ্বর। এমনকি কোনো তাপও নিঃসরণ করতে পারে না।

ডিএস : কৃষ্ণগহ্বরে অহরহই তথ্য হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। তথ্য হারিয়ে গেলে, সেখানে কিছু শক্তি বেরিয়ে আসা উচিত। কিন্তু বিষয়টি এ-সংক্রান্ত তত্ত্বকে প্রকাশ্যে অগ্রাহ্য করে। কারণ তত্ত্ব অনুযায়ী, কৃষ্ণগহ্বর থেকে কোনো কিছুই বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে না।

স্টিফেন হকিং : এটি একটি প্যারাডক্স। আমার দ্বিতীয় বক্তৃতায় এ ব্যাপারে আলোচনা করব। সেখানে এটাও অনুসন্ধান করব যে মহাবিশ্বের ভবিষ্যবাচ্যতা সম্পর্কে সবচেয়ে মৌলিক নীতিকে ও ইতিহাসের নির্দিষ্টতাকে কীভাবে চ্যালেঞ্জ জানায় কৃষ্ণগহ্বর। পাশাপাশি এটাও বলব, কোনো কৃষ্ণগহ্বরে কেউ পড়ে গেল কী ঘটবে।

ডিএস : বৈজ্ঞানিক এক অভিযাত্রায় আমাদের সঙ্গে নিয়েছিলেন স্টিফেন হকিং। এই যাত্রায় আমরা দেখলাম, আইনস্টাইন দাবি করেছিলেন, নক্ষত্ররা সংকুচিত হতে পারে না। সেখান থেকে শুরু করে কৃষ্ণগহ্বরের বাস্তবিক গ্রহণযোগ্যতার ভেতর গিয়ে, এতে থাকা অদ্ভুতুড়ে বৈশিষ্ট্যসংক্রান্ত বিষয়ে তত্ত্বগুলোর বিরোধও দেখেছি আমরা।

তথ্যনির্দেশ

মহাবিস্ফোরণ : মহাবিশ্বের সৃষ্টি সম্পর্কে ব্যাপকভাবে গৃহীত একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব। এই তত্ত্বমতে, প্রায় ১৩.৭ বিলিয়ন বছর আগে এক মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে এই মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছিল। মহাবিশ্ব শুরুর সেই মুহূর্তে অতি উত্তপ্ত ও অসীম ঘনত্বের একটি সিঙ্গুলারিটি বা পরম বিন্দুতে সবকিছু ঘনীভূত ছিল।

১৯২৯ সালে এ মডেলের প্রস্তাব করেছিলেন বেলজিয়ামের পাদরি, গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদ জর্জেস লেমাইতার। অবশ্য লেমাইতার তাঁর তত্ত্বকে সহজভাবে ব্যাখ্যা করতে মহাবিশ্ব সৃষ্টির এই মুহূর্তের নাম দিয়েছিলেন বিগ নয়েজ বা মহাশব্দ। তবে জ্যোতির্বিদ ফ্রেড হোয়েল এ তত্ত্বকে ব্যঙ্গ করে নাম দিয়েছিলেন বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণ। মজার ব্যাপার হচ্ছে, পরবর্তী সময়ে হোয়েলের দেওয়া নামটিই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

পরম বিন্দু বা অনন্যতা : স্থান-কালের একটি বিন্দু, যেখানে স্থান-কালের বক্রতা (অথবা আরও কিছু ভৌত ধর্ম) অসীম হয়।

ভর : কোনো বস্তুর মধ্যে পদার্থের পরিমাণ। এটি বস্তুর জড়ত্বের কারণ, অর্থাৎ এটি ত্বরণে বাধা দেয়।

নিউট্রন : প্রায় প্রোটনের মতো একটি কণা। তবে এর কোনো চার্জ নেই। বেশির ভাগ পরমাণুর কেন্দ্রে প্রায় অর্ধেক এই কণা থাকে। ১৯৩২ সালে জেমস চ্যাডউইক প্রথম নিউট্রনের খোঁজ পেয়েছিলেন। হাইড্রোজেন ছাড়া সব পরমাণুর নিউক্লিয়াসে নিউট্রন থাকে। প্রোটনের মতো নিউট্রন ও শক্তিশালী পরমাণুর নিউক্লিয়ার বলের মাধ্যমে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত থাকে। কণাপদার্থবিদ্যা অনুযায়ী, একটি নিউট্রন তিনটি কোয়ার্ক দিয়ে তৈরি। এদের দুটি ডাউন ও একটি আপ কোয়ার্ক। এই কোয়ার্কগুলো বলবাহী গ্লুয়ন কণার মাধ্যমে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয়।

নিউট্রন তারা : নক্ষত্রের অন্তিম দশায় নিউট্রন নক্ষত্র, শ্বেত বামন এবং কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হতে পারে। সৌরভরের দেড় গুণ, কিন্তু মাত্র ১০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধবিশিষ্ট তারাকে বলা হয় নিউট্রন তারা। নক্ষত্রের ভর ২ থেকে ৫ সৌরভরের মধ্যে হলে জ্বলনের একপর্যায়ে কেন্দ্রীয় স্থানে লোহা অবশিষ্ট থাকে। কোনো প্রতিরোধ না থাকায় মাধ্যাকর্ষণজনিত আকর্ষণ বাড়তে থাকে এবং মাধ্যাকর্ষণের বিরুদ্ধে নক্ষত্রটি আর নিজেকে বহন করতে পারে না। তখন নক্ষত্রটি প্রচণ্ড উজ্জ্বলতা সৃষ্টি করে বিস্ফোরিত হয়। একে বলা হয় সুপারনোভা বিস্ফোরণ বা অতিনব তারা বিস্ফোরণ। এ বিস্ফোরণের পর

নক্ষত্রটির কেন্দ্রের মূল বস্তুর চাপ এতই বেশি হয় যে প্রোটন আর ইলেকট্রন একত্র হয়ে নিউটন গঠন করে। তাই একে নিউট্রন নক্ষত্র বলে। নিউট্রন তারা কৃষ্ণগহ্বরের পূর্ব ধাপ। একটি নক্ষত্রের যদি কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হওয়ার মতো যথেষ্ট ভর না থাকে, তাহলে সেটি শেষ পর্যন্ত নিউট্রন তারায় পরিণত হয়। নিউট্রন তারা অনেক ধরনের হতে পারে। এদের মধ্যে পরিচিত একটি হচ্ছে পালসার। এদের শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্র থাকে। এ ছাড়া এদের ঘূর্ণনের গতিও অনেক বেশি হওয়ায় এরা পর্যায়ক্রমে বেতারতরঙ্গ নিঃসরণ করে। সে কারণেই এদের পালসার বলা হয়।

শ্বেত বামন : যেসব তারার ভর নিউট্রন তারা হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়, তাদের সবাই বিবর্তনের শেষ পর্যায়ে শ্বেত বামনে পরিণত হয়। সে হিসাবে আমাদের ছায়াপথের শতকরা ৯৭ ভাগ তারার শেষ গন্তব্য শ্বেত বামন। এদের ভর সূর্যের সঙ্গে তুলনীয় হলেও আকার তুলনীয় পৃথিবীর সঙ্গে, অর্থাৎ এদের ঘনত্ব অনেক বেশি। উজ্জ্বলতা খুব কম, যা তাদের জমিয়ে রাখা তাপশক্তি থেকে উৎপন্ন হয়।

চন্দ্রশেখর : সুব্রামানিয়ান চন্দ্রশেখর ব্রিটিশ ভারতে জন্মগ্রহণকারী মার্কিন জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী। ১৯১০ সালের ১৯ অক্টোবর তিনি লাহোরে এক তামিল পরিবারে জন্মেছিলেন। চন্দ্রশেখর ছাত্রাবস্থায় বিজ্ঞানী আর্থার এডিংটনের লেখা The Internal Constitution of the Stars বইটি পড়ে জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানে আকৃষ্ট হন। ১৯৩০ সালের দিকে চন্দ্রশেখর গবেষণা করে দেখালেন, কোনো নক্ষত্র সূর্যের চেয়ে সামান্য ভারী হলে (সূর্যভরের তুলনায় ১৪ গুণের বেশি) এবং তার জ্বালানি ফুরিয়ে গেলে যদি সংকুচিত হতে শুরু করে, তবে তা ততক্ষণ পর্যন্ত সংকুচিত হবে, যতক্ষণ না তার ব্যাসার্ধ শূন্য হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ এই ভরের কোনো নক্ষত্র শ্বেত বামনে পরিণত হবে না। প্রতি একক আয়তনে ভরের এই পরিমাণকে বলা হয় চন্দ্রশেখর সীমা। চন্দ্রশেখর সীমা হলো স্থিতিশীল শীতল শ্বেত বামন তারকার সম্ভাব্য সর্বোচ্চ ভর। ভর এর চেয়ে বেশি হলে তারকাটি চুপসে কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হবে। তবে এ আবিষ্কারের পর নিজের শিক্ষক এডিংটনের কাছ থেকেই সবচেয়ে বড় বিরোধিতার মুখে পড়েন তিনি। তাঁর এই গবেষণাকে নাক্ষত্রিক ভাঁড়ামি হিসেবে উল্লেখ করেন এডিংটন। যাহোক, তাঁর এ আবিষ্কারের সুদীর্ঘ ৫০ বছর পর ১৯৮৩ সালে তারার বিবর্তন এবং জীবনচক্র সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক আবিষ্কারের জন্য তাঁকে উইলিয়াম আলফ্রেড ফাউলারের সঙ্গে যৌথভাবে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়।

ঘটনা দিগন্ত : কৃষ্ণগহ্বরের সীমানা। এখান থেকে কোনো বস্তু বা বিকিরণ বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে না। সাধারণ আপেক্ষিকতা অনুসারে, ঘটনা দিগন্ত হচ্ছে কোনো একটি ঘটনার স্থান-কালের সীমানা, যার বাইরে অবস্থিত কোনো পর্যবেক্ষকের ওপর ওই ঘটনার কোনো প্রভাব পড়ে না। সাধারণভাবে একে প্রত্যাবর্তনের শেষ বিন্দু বলা হয়। অর্থাৎ এখানে মহাকর্ষীয় আকর্ষণ এতই বেশি হয় যে কোনো কণার পক্ষেই সেখান থেকে ফিরে আসা সম্ভব হয় না।

তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র : তাপগতিবিদ্যা আসলে গ্যাসের গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞান। বড় পরিসরে গ্যাসের অণুগুলোর পারস্পরিক ক্রিয়া- প্রতিক্রিয়া যে তাপমাত্রা ও চাপের সৃষ্টি হয়—তার ব্যাখ্যা করে এটি। এই বিষয়টি প্রকৃতির একগুচ্ছ সূত্র দিয়ে শুরু হয়, যাদের সঙ্গে তাপমাত্রা, চাপ ও আয়তন জড়িত। তাপগতিবিদ্যার তিনটি সূত্র আছে। এর মধ্যে দ্বিতীয় সূত্রটি বলছে : তাপ কখনো নিজে থেকে শীতল বস্তু থেকে গরম বস্তুতে যেতে পারে না। এ সূত্রটিকে বিভিন্ন বিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। সূত্রটিকে অনেক সময় এভাবেও বলা হয় : একটি বদ্ধ সিস্টেমে এনট্রপি কখনো কমতে পারে না। এনট্রপি ব্যাপারটিকে অনেক সময় সাদামাটাভাবে বিশৃঙ্খলা বা ডিজঅর্ডার হিসেবে দেখানো হয়। এনট্রপি কমার অর্থ হচ্ছে বিশৃঙ্খলা কমা। তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রমতে, একটি তাপগতীয় সিস্টেমের মধ্যে বিশৃঙ্খলার পরিমাণ সব সময়ই বাড়তে থাকে। তাপ থেকে কী পরিমাণ দরকারি কাজ করা যেতে পারে, এই সূত্র ওপর একটি সীমা নির্দেশ করে।

এনট্রপি : এনট্রপি হচ্ছে একটি সিস্টেমের এলোমেলো বা বিশৃঙ্খলার পরিমাপ। যে সিস্টেম যত এলোমেলো, তার এনট্রপি তত বেশি। তাপগতিবিদ্যার সূত্রমতে, মহাবিশ্বের সব বস্তুর মধ্যেই কিছু না কিছু এনট্রপি জড়িত। এতে যখনই কোনো প্রতিক্রিয়া ঘটে তখনই তার এনট্রপি বেড়ে যায়। এনট্রপি বেড়ে যাওয়ার অর্থ হলো, বস্তুর ভেতরের অণু, পরমাণুগুলো আর এলোমেলো বা বিশৃঙ্খল হওয়া। বিজ্ঞানী বোলজম্যানের মতে, এনট্রপি একটি সম্ভাবনা। এনট্রপি এবং সম্ভাব্যতার মধ্যে লগারিদমিক সংযোগ প্ৰথম উত্থাপন করেছিলেন বোলজম্যান। তখনকার প্রতিষ্ঠিত নিয়মের বাইরে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, তাপগতিবিদ্যায় সম্ভাব্যতার ধারণা সংযোজন করা উচিত। এভাবে তাঁর হাত ধরে পারিসাংখ্যিক তাপগতিবিদ্যারও জন্ম হয়েছিল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন প্রকৃতির বিশৃঙ্খলাকে এনট্রপি নামক একটি গাণিতিক রাশির মাধ্যমে পরিমাপ করা সম্ভব।

অনিশ্চয়তার নীতি : বিজ্ঞানী ওয়ার্নার হাইজেনবার্গের সূত্রবদ্ধ করা নীতি। এর নীতি অনুযায়ী, একটি কণার অবস্থান এবং ভরবেগ-দুটোই একই সঙ্গে নির্ভুলভাবে জানা সম্ভব নয়। দুটোর মধ্যে একটি যত নিখুঁতভাবে জানা যাবে, ততই অন্যটিকে নিখুঁতভাবে জানার পরিমাণ কমতে থাকবে।

কোয়ান্টাম মেকানিকস : গণিতের যে শাখায় বলপ্রয়োগে শক্তিকণার গতিবেগ, ধর্ম, আচরণ ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করা হয়, সেটিই কোয়ান্টাম মেকানিকস বা কণা বলবিদ্যা। চিরায়িত বলবিদ্যায় দৃশ্যমান বস্তুর ওপর বলপ্রয়োগে বস্তুর ধর্ম বা আচরণ ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু কোয়ান্টাম বলবিদ্যার ক্ষেত্র অতি ক্ষুদ্র শক্তিকণা (যেমন ইলেকট্রন)। চিরায়ত বলবিদ্যায় যেসব বস্তুর ভর আছে কিন্তু তরঙ্গ প্রকৃতি নেই, তাদের নিয়ে আলোচনা করা হয়। কিন্তু কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় এমন সব বস্তু সম্পর্কে আলোচনা করা হয়, যাদের কণা (বা ভর) প্রকৃতি এবং তরঙ্গ প্রকৃতি উভয়ই আছে। যেমন আলো একই সঙ্গে কণা ও তরঙ্গ।

তরঙ্গদৈর্ঘ্য : একটি পূর্ণ তরঙ্গ যে পরিমাণ দৈর্ঘ্য অধিকার করে, সেই দৈর্ঘ্যকে বলে তরঙ্গদৈর্ঘ্য। একটি অনুপ্রস্থ তরঙ্গের ক্ষেত্রে তার দুটি পাশাপাশি শীর্ষবিন্দু বা দুটি নিম্নবিন্দুর মধ্যবর্তী দূরত্ব দিয়ে তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য মাপা হয়। অন্যদিকে অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গের ক্ষেত্রে সংকোচন ও প্রসারণের সমন্বয়ে তরঙ্গদৈর্ঘ্য গঠিত I

প্রতিকণা : প্রতিটি ধরনের পদার্থ কণার একটি বিপরীত প্রতিকণা থাকে। একটি কণা যখন তার প্রতিকণার সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, তখন দুটিই ধ্বংস হয়ে যায়। অবশিষ্ট থাকে শুধু শক্তি। বিজ্ঞানী পল ডিরাক প্রথম প্রতিকণার ধারণা দেন। পরে পরীক্ষায় তা প্রমাণিত হয়। যেমন ইলেকট্রনের প্রতিকণাকে বলা হয় প্রতি-ইলেকট্রন বা পজিট্রন।

পারমাণবিক ফিউশন : যে প্রক্রিয়ায় দুটি নিউক্লিয়াস সংঘর্ষে লিপ্ত হয় এবং একত্র হয়ে একটি একক, ভারী নিউক্লিয়াস গঠন করে। যেমন দুটো হাইড্রোজেন একত্র হয়ে হিলিয়াম তৈরি হয়। সূর্যসহ নক্ষত্রের কেন্দ্রে অহরহ এই পারমাণবিক ফিউশন প্রক্রিয়ায় হিলিয়াম তৈরি হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় কিছু ভর পরিণত হচ্ছে বিপুল শক্তিতে।

মহাকর্ষ বল : নিউটনের সূত্রমতে, মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তু পরস্পরকে আকর্ষণ করছে। যে বলে বস্তুগুলো পরস্পরকে আকর্ষণ করছে, তাকেই বলা হয় মহাকর্ষ বল। এই সূত্রমতে, এই আকর্ষণ বলের পরিমাণ বস্তু দুটোর ভরের গুণফল এবং তাদের মধ্যবর্তী দূরত্বের ব্যস্তানুপাতিক।

মহাকর্ষীয় তরঙ্গ : আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব থেকে পাওয়া একটি তরঙ্গ, যা আলোর গতিতে চলাচল করে। একটি বিপুল ভরের বস্তু আরেকটি বিপুল ভরের বস্তুর চারপাশে ঘুরলে বস্তু দুটি এই তরঙ্গ বিকিরণ করে। ১৯১৬ সালে এ ধরনের তরঙ্গের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন আইনস্টাইন। এর প্রায় ১০০ বছর পর, ২০১৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের লাইগোর ডিটেক্টরে এই তরঙ্গ প্রথমবার ধরা পড়ে। এই তরঙ্গের উৎস ছিল ১৩০ কোটি বছর আগে সূর্যের চেয়ে ৩৬ গুণ এবং সূর্যের চেয়ে ২৯ গুণ ভারী দুটি কৃষ্ণগহ্বরের মধ্যে সংঘর্ষ। ওই বছরের ২৬ ডিসেম্বর দ্বিতীয়বার শনাক্ত করা হয় মহাকর্ষীয় তরঙ্গ। এরপর ২০১৬ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি এ-সংক্রান্ত ঘোষণা দেওয়া হয়।

হাইজেনবার্গ : জার্মান বিজ্ঞানী ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ (১৯০১-১৯৭৬ খ্রি.) তাঁর সূত্রবদ্ধ করা অনিশ্চয়তার নীতির জন্য বিখ্যাত। এর নীতি অনুযায়ী, একটি কণার অবস্থান এবং ভরবেগ দুটোই একই সঙ্গে নির্ভুলভাবে জানা সম্ভব নয়। দুটোর মধ্যে একটি যত নিখুঁতভাবে জানা যাবে, ততই অন্যটিকে নিখুঁতভাবে জানার পরিমাণ কমতে থাকবে।

স্থান-কাল : একটি চারমাত্রিক স্থান, যার বিন্দুগুলো ঘটনা। নিউটনের মহাবিশ্বে স্থান আর কালকে আলাদা বলে ভাবা হতো। কিন্তু আইনস্টাইন তাঁর আপেক্ষিক তত্ত্বে দেখালেন, এই দুটি আসলে আলাদা কিছু নয়, বরং একক অস্তিত্ব হিসেবে বিরাজমান।

চিরায়ত পদার্থবিদ্যা : বিংশ শতাব্দী শুরুর কিছুদিন আগপর্যন্ত ও প্রাকৃতিক ঘটনাবলি নিউটনের বলবিদ্যা, ম্যাক্সওয়েলের বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় তত্ত্ব, তাপগতিবিদ্যা এবং বোলজম্যানের পরিসংখ্যানিক গতিবিদ্যা দিয়ে বেশ ভালোভাবেই ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল। তবে ইথার এবং বিকিরণসংক্রান্ত কিছু বিষয় তখনো অমীমাংসিত ছিল। উনিশ শতকের একেবারে শেষ দশকে একের পর এক নতুন কিছু আবিষ্কার পদার্থবিজ্ঞানে নতুন বিপ্লবের জন্ম দেয়। যেমন : রন্টজেনের এক্স-রে আবিষ্কার, থমসনের ইলেকট্রনের আবিষ্কার, বেকেরেলের তেজস্ক্রিয়া আবিষ্কার, হার্জের ফটো ইলেকট্রিক ইফেক্ট আবিষ্কার নতুন কিছু প্রশ্নের জন্ম দেয়। এ ছাড়া এ সময়েই কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ পদার্থবিদদের ধাঁধায় ফেলে দেয়। কারণ, পদার্থবিদ্যার প্রচলিত কোনো সূত্র দিয়েই একে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল না। অবশেষে একে ব্যাখ্যার জন্য ১৯০০ সালে বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক কোয়ান্টাম ধারণা ব্যবহার করলেন। তাঁর হাত ধরেই শতাব্দীর একেবারে শুরুতে জন্ম নিয়েছিল নতুন এক বিজ্ঞান, যা কোয়ান্টাম তত্ত্ব নামে পরিচিত। তাই ১৯ শতকের আগপর্যন্ত পদার্থবিদ্যার সব তত্ত্বকে বলা হয় চিরায়ত বা ধ্রুপদি পদার্থবিজ্ঞান।

তরঙ্গদৈর্ঘ্য : একটি তরঙ্গের ক্ষেত্রে তার দুটি পাশাপাশি শীর্ষ বিন্দু বা দুটি নিম্নবিন্দুর মধ্যবর্তী দূরত্ব।

বিকিরণ: তরঙ্গ বা কণার মাধ্যমে স্থান বা অন্য কোনো মাধ্যম দিয়ে পরিবাহিত শক্তি। এর মধ্যে রয়েছে বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বিকিরণ (যেমন তাপ, রেডিও তরঙ্গ, দৃশ্যমান আলো, এক্স-রে, গামা রশ্মি বিকিরণ), কণা বিকিরণ, মহাকর্ষীয় বিকিরণ ইত্যাদি।

নগ্ন বা উন্মুক্ত পরম বিন্দু : স্থান-কালের পরম বিন্দু, যা কোনো কৃষ্ণগহ্বরের ঘটনা দিগন্ত দিয়ে ঘেরা নয়। আর এই পরম বিন্দুটি দূরে থাকা কোনো পর্যবেক্ষকের কাছে দৃশ্যমান।

অসীম (Infinity) : সীমাহীন বা সমাপ্তিহীন কোনো ব্যাপ্তি বা সংখ্যা।

সাধারণ আপেক্ষিকতা: আইনস্টাইনের তত্ত্ব। ১৯১৫ সালে তত্ত্বটি প্রকাশ করেন তিনি। বিজ্ঞানের নিয়মকানুন সব পর্যবেক্ষকের জন্যই একই হবে, তাদের গতিশীলতার ওপর এই নিয়মকানুন নির্ভরশীল নয়—এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে এই তত্ত্বটি গড়ে উঠেছে। চতুর্থমাত্রিক স্থান- কালের বক্রতার ভিত্তিতে এটি মহাকর্ষকে ব্যাখ্যা করে।

কণাপদার্থবিদ্যা : পদার্থবিজ্ঞানের একটি শাখা, যেখানে যেসব কণা বস্তু ও বিকিরণ সৃষ্টি করে তাদের প্রকৃতি নিয়ে গবেষণা করা হয়। সব কণার বর্তমান শ্রেণিবিভাগ স্ট্যান্ডার্ড মডেল বা প্রমিত মডেল দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়।

কৃষ্ণগহ্বর : প্রিন্ট মিডিয়ায় ‘ব্ল্যাকহোল’ শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয়েছিল ১৯৬৪ সালে। সে বছর অ্যান উইন নামের এক সাংবাদিক ১৯৬৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে অনুষ্ঠিত এক সিম্পোজিয়াম নিয়ে একটি রিপোর্ট লিখতে গিয়ে শব্দটি ব্যবহার করেন। তবে শব্দটি প্রথম কে ব্যবহার করেছিলেন, সে বিষয়ে ওই রিপোর্টে কিছু উল্লেখ করেননি তিনি। এদিকে ‘মহাকর্ষীয় প্ৰবল আকর্ষণে নিজের ওপর পুরোপুরি ভেঙে পড়া কোনো নক্ষত্র’ বোঝাতে সংক্ষিপ্ত শব্দ হিসেবে মার্কিন পদার্থবিদ জন হুইলার ১৯৬৭ সালে ‘ব্ল্যাকহোল’ শব্দটি ব্যবহার করেন। এরপরই শব্দটি জনপ্রিয় হতে শুরু করে। তবে ভেঙে পড়া এ ধরনের নক্ষত্রের ধারণাটি প্রথম দিয়েছিলেন মার্কিন বিজ্ঞানী রবার্ট ওপেনহাইমার এবং হার্টল্যান্ড সিন্ডার, ১৯৩৯ সালে।

এদিকে ইংরেজি ব্ল্যাকহোল শব্দটির উৎপত্তির সঙ্গে বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদৌল্লার সঙ্গে সম্পর্ক আছে বলে দাবি করেছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের লেখক পথিক গুহ। কথিত আছে, ১৭৫৬ সালের ২০ জুন বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলা ইংরেজদের হটিয়ে কলকাতা দখল করে নেন। এরপর ব্রিটিশদের নির্মিত ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের ভেতরের ছোট্ট এক কক্ষে ১৪৬ জন ইংরেজকে বন্দী করা হয়েছিল। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের বর্ণনামতে, সেই অমানবিক পরিবেশে প্রচণ্ড গরমে এক রাতে ১২৩ জন ইংরেজের মৃত্যু হয়। ইতিহাসে এ ঘটনা অন্ধকূপ হত্যা নামে পরিচিত। ইংরেজিতে ব্ল্যাকহোল অব ক্যালকাটা। কিন্তু দৈর্ঘ্যে ২৪ ফুট এবং প্রস্থে ১৮ ফুট একটি কামরায় ১৪৬ জন মানুষকে আটক রাখার অবাস্তব ও আজগুবি এই কাহিনির সত্যতা নিয়ে নানান প্রশ্ন ওঠে। বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হেয় করতে সম্ভবত এই কাহিনি রচিত ও প্রচারিত হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়।

যাহোক মহাকাশের নরকতুল্য বস্তু ব্ল্যাকহোল নামকরণের পেছনে কলকাতার এই কাহিনি জড়িত বলে মনে করেন অনেকে। ১৯৬০-এর দশকের শুরুতে ব্ল্যাকহোল শব্দটি বিভিন্ন বক্তৃতায় ব্যবহার করতেন মার্কিন বিজ্ঞানী রবার্ট হেনরি ডিকি। তবে শব্দটি জনপ্রিয় করার পেছনে জন হুইলারের অবদানের কথা স্বীকার করতেই হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *