1 of 3

স্বর্গের চাবি

স্বর্গের চাবি

না, কিছুতেই পাওয়া গেল না। সমস্ত ঘর ওলোট-পালোট করে ফেলা হয়েছে। ঘরের চারদিকে যে বিশৃঙ্খলা এখন দেখা যাচ্ছে, কে বিশ্বাস করবে মাত্র আধঘন্টা আগেও এই গৃহ আবাসযোগ্য ছিল! সামনের চেয়ারগুলো উলটে ফেলা হয়েছে, আলনাটা বাঁদিকের জানলার পাশে চিত, একটা আলমারি হাটখোলা, অধিকাংশ বই নীচে নামানো। আর তিনজন ঘর্মাক্ত পুরুষ ও একজন মহিলার বহু পরিশ্রমের দীর্ঘনিশ্বাসে ঘরে ঝড়।

 গুরুপদ আর বলাই এসেছে বেলা আটটায়। আর আসার পর থেকেই গুরুপদর যা স্বভাব–এই ঘরের সমস্ত জিনিসগুলো একে একে ঘেঁটেছে। প্রথমে ধীরে-সুস্থে এদিক ওদিক তাকিয়ে ঘরের আসবাবপত্র লক্ষ করেছে। তারপর বইপত্র যা কিছু সব নেড়েচেড়ে দেখেছে। এখন বেলা দেড়টা। গুরুপদ আর বলাই কারওরই মানখাওয়া হয়নি, যার বাড়িতে এসেছে সেই বন্ধু অনিল এবং অনিলের। স্ত্রী-ও অভুক্ত এখনও। সাড়ে বারোটাতেই গুরুপদ উঠছিল, যাই, বেলা হয়ে গেছে, আর দেরি করার কোনও মানে হয় না। এবং সেই সময়েই বিপত্তিটা ঘটল। গুরুপদ পকেট থেকে সিগারেট বার করার জন্যে হাত দিয়ে অচেতনভাবেই খোঁজ করেছিল ওর ফ্ল্যাটের চাবিটার এবং তার তিন পকেট ঘেঁটে ঘোষণা করল, আমার চাবি পাওয়া যাচ্ছে না! কোথায় হারালাম বল তো?

চাবি হারানো, সবাই ব্যাপারটাকে বেশ লঘু বলে ধরে নিয়েছিল কিন্তু গুরুপদ যখন জানাল যে চাবি ছাড়া আর বাড়িতে ফেরাই সম্ভব নয়, কেননা তার ফ্ল্যাটের সদরের চাবি ওতেই রয়েছে, ওই রিংয়েই, যে রিংটা সে এইমাত্র এই ঘরে হারিয়েছে, এবং যে চাবি ওই রিংয়ে ছাড়া আর কোথাও নেই। এ কথায় অনিলকে একটু দুশ্চিন্তিত দেখা গেল কেননা গুরুপদকে সে বিলক্ষণ জানে। গুরুপদ যেকোনও মুহূর্তে বলতে পারে, আমার ঘরের চাবি তোমার ঘরে হারিয়েছে, যতদিন বা যতক্ষণ এই চাবি না পাওয়া যাচ্ছে আমি তোমার ঘরে থাকব। সুতরাং অনিলকে ব্যস্ত হতে হল, অনিলের স্ত্রী নীরাকেও রান্না বান্না স্নান ফেলে গাছকোমর শাড়ি বেঁধে স্বামী-সুহৃদের নিরুদ্দিষ্ট চাবিটির সন্ধানে ব্যাপৃত হতে হল।

এবং সমস্ত ঘর তছনছ হল, ওলোট-পালোট হল, কিন্তু চাবিটার সন্ধান হল না। কিন্তু এমনও তো হতে পারে যে আপনি আজ চাবিটি ঘরে না লাগিয়েই বেরিয়ে এসেছেন?নীরা একবার বিনীতভাবে প্রশ্ন করল। গুরুপদ জানাল, তা হতে পারে, নাও হতে পারে। তবে এরকম আগে কোনওদিন হয়নি। তা হলে তুমি তো বাড়ি থেকে বাসে করে এলেবাসে কিংবা রাস্তায় কোথায়ও পড়তে পারে তো? বলাই-এর এই প্রশ্নে গুরুপদ ঠিক কোনও উত্তর দিল না। একটু মৃদু হেসে বন্ধু-পত্নীর দিকে তাকিয়ে করুণকণ্ঠে বলল, দেখুন, আমার চাবি হারানোর আসল দুঃখটা কী জানেন?

অনিল র‍্যাকের ওপর চাবিটাকেই হাতড়াচ্ছিল, সে সেখান থেকে গুরুপদর কথায় বাধা দিল, দ্যাখ গুরুপদ, বেলা দেড়টার সময় আমার বউকে বোকা পেয়ে আষাঢ়ে গল্প ফাঁদবি না। এখন। কোনও গালগল্প সইবে না। তোর ঘরের চাবি হারিয়ে গেছে, খুঁজছি, বেশ। ওই চাবির মধ্যে নিশ্চয়ই কোনও স্মৃতিচিহ্নের ব্যাপার নেই। চাবি চাবিই, হারিয়ে গেলে তালা ভাঙতে হয়। এ ছাড়া তোর। দুঃখের আর কী কারণ হতে পারে? অনিল গুরুপদর ওপর বিশেষ চটে গেছে বোঝা গেল।

কিন্তু গুরুপদ থামল না, পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে দেশলাইয়ের ওপর একটু একটু করে ঠুকতে লাগল, দেখুন নীরা দেবী, চাবিটা হারিয়ে গেছে, যেতে পারে। কিন্তু এটা তো আমার পকেটে থাকার কথা নয়। হারাবেই তো! আমাকে কেন বয়ে নিয়ে বেড়াতে হচ্ছে? গুরুপদর কণ্ঠে স্পষ্ট অভিযোগের সুর শোনা গেল।

 নীরা একটু হেসে সামনের উপুড় করে ফেলা আলমারিটার একধারে বসে জিজ্ঞাসা করল, কেন, এটা আর কারওর ঘরের চাবি নাকি?

গুরুপদ ম্লান হাসল, প্রায় ঠিকই বলেছেন। এ চাবি তো আমার কাছে থাকার কথা নয়, এটা থাকার কথা কারওর আঁচলের গিটে। একটা অস্পষ্ট দীর্ঘনিশ্বাসের শব্দও যেন শোনা গেল।

গুরুপদর এই শোকপ্রকাশে অনিল এবং বলাই হো হো করে অট্টহাসিতে ভেঙে পড়ল, নীরা একটু কম হাসল।

নীরাই আবার প্রশ্ন তুলল, কেন, সেই নীলবসনা সুন্দরীর কী হল?

কথাটার একটা গূঢ় অর্থ আছে। গুরুপদ যে ফ্ল্যাটটায় সম্প্রতি অধিষ্ঠিত হয়েছে, তারই পাশের ফ্ল্যাটে অমলা থাকে। নীরার ধারণা, অমলা সব সময়েই নীল শাড়ি পরে থাকে। অন্তত নীরা যে কবার গুরুপদর ফ্ল্যাটে গিয়েছে অমলাকে নীলবসনাই দেখেছে। নীরার আরও ধারণা এই রকম যে অমলার ব্যাপারে গুরুপদর কিঞ্চিৎ দুর্বলতা রয়েছে। গুরুপদ অবশ্য কোনও সময়েই ব্যাপারটিকে বিশেষ অস্বীকার করেনি।

কিন্তু সম্প্রতি কিছুদিন হল গুরুপদর ভাবগতিক কথাবার্তায় কেমন যেন একটা অভূতপূর্ব হতাশার ভাব দেখা দিয়েছে। হয়তো অমলা-সংক্রান্ত ব্যাপারে কোনও গোলযোগ দেখা দিয়েছে। গুরুপদ নীরার প্রশ্নের জবাবও একটু ঘুরিয়ে দিল।

গুরুপদ বলল, আপনার অযাচিত সহানুভূতি প্রদর্শনের জন্য ধন্যবাদ নীরা দেবী। তবে আপনার অবগতির জন্যে জানাই, নীলবসনা আর নেই।

সে কি মরে গেছে? অনিলের কণ্ঠে কপট উদ্বেগ প্রকাশ পেল।

গুরুপদ প্রায় কোনও বাধাই না দিয়ে বলল, বলাই জানে।

বলাই বলল, নীলবসনা আর নীলবসনা নেই। সে এখন নানা ধরনের রঙে মনোনিবেশ করেছে। এখন দেখা যাচ্ছে অন্য যেকোনও রংই তার সমান পছন্দ। আজ সকালে দেখলাম একটা ফিকে সবুজ রঙের শাড়ি পরনে।

ব্যাপারটা গুরুপদর পক্ষে মর্মান্তিক। ইতিমধ্যে একাধিক দিন গুরুপদ নীল রঙ এবং তার মূল্য, অর্থ, ব্যঞ্জনা, সেই রঙ যাদের পছন্দ তাদের মানসিকতার উৎকর্ষ ইত্যাদি আলোচনায় বিশেষ উৎসাহ দেখিয়েছে। অসাধারণ বিশ্লেষণ-ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে নীল রঙের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে। সেই অমলা যদি ক্যাটক্যাটে হলুদ বা ফিকে সবুজের অনুরাগিণী হয় তাতে গুরুপদর কী? এই ধরনের একটা শুষ্ক অনুযোগ তুলে গুরুপদ আর বলাই অনিলের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল। অনিল ও নীরা অবশ্য দেরি যখন হয়েছেই স্নান খাওয়া করে যেতে বলল। কিন্তু ওরা আর বসল না।

ঝাঁ ঝাঁ দুপুরের গনগনে রোদ। বেলা দেড়টা বেজে গেছে, সেও বেশ কিছুক্ষণ হল। সবে চৈত্রের শুরু। এর মধ্যে রাস্তাঘাট ভয়ংকর তেতে উঠেছে। শহরতলির এদিকটায় গাছপালা বিশেষ নেই। দুজনে ঘামতে ঘামতে বাস-স্টপের দিকে এগুল। বলাই বলল, কিন্তু তুই তো চাবিটা বাসেও ফেলতে পারিস! এই ধর পকেট থেকে পড়ে যেতে পারে!

গুরুপদ জানে ব্যাপারটা অসম্ভব নয়। কিন্তু এখন এই চো-চো পেটে কোন ধাবমান বাসের পশ্চাদনুসরণ করতে হবে সেই হারা-উদ্দেশে–সেই আশঙ্কায় সে আর এদিকটায় মাথা ঘামাতে চায়নি। যা হয় তোক।

কিন্তু এখনও বলাইয়ের প্রস্তাবে আবার তার হুঁশ হল। সত্যিই চাবিটা না পেলে বড় অসুবিধা হবে। নিজের বাড়িতে তালা ভেঙে ঢোকা জিনিসটা খুব পছন্দের নয়। তার ওপরে তালা ভাঙা ব্যাপারটায় গুরুপদর কোনও অভিজ্ঞতা নেই। কী করে তালা ভাঙতে হয় সে ভাবতেই পারে না।

বলাইয়ের পরামর্শ মতো স্থির করে যে একবার বাস-ডিপোটা ঘুরে যেতে হবে। যদি সেখানে জমা পড়ে থাকে। বলাই রইল, গুরুপদ একাই বাসে উঠল। প্রথমে নামল গিয়ে ডিপোতে। নেমে এদিক ওদিক কাকে ঠিক প্রশ্নটা করা দরকার স্থির করতেই গেল কয়েক মিনিট। তারপর ভয়ে ভয়ে একজন নিরীহ গোছের কর্মচারীকে বলল, আচ্ছা মশায়, একটা কথা জিজ্ঞেস করব?

সেই কর্মচারীটি বললেন, কী, বলে ফেলুন!

 গুরুপদ বলল, দেখুন, আজ এই সকালের দিকে…

সেই মুহূর্তে কোথায় একটা হুইসল বেজে উঠল। গুরুপদ যে ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলছিল তিনি একটি লাফে সামনের সদ্যচলন্ত বাসটিতে উঠে পড়লেন, আমার ট্রিপের সময় হয়ে গেছে। ঘণ্টা বাজিয়ে বাসটা চলে গেল।

গুরুপদর নিজের ওপরেই একটু রাগ হল। এত ভণিতা করার কোনও প্রয়োজন নেই, সে তো আর চুরি করতে আসেনি। এবার একটু বেপরোয়া হয়ে টিকিট-ঘরের দিকে অর্থাৎ যে ঘর থেকে কন্ডাক্টররা টিকিট ও ভাঙানি নিয়ে আসছেন সেই ঘরের সামনে গিয়ে বলল, ও মশায়, শুনছেন।

কে, পার্টনার নাকি? ভেতর থেকে একটি কোমল কণ্ঠ শোনা গেল। গুরুপদ একটু আশান্বিত হল। কিন্তু সেই কণ্ঠটি যখন গরাদের চৌকো দিয়ে একটু বেরিয়ে এসে গুরুপদকে দেখল, মুহূর্তে স্বরযন্ত্রটি কেমন রুক্ষ হয়ে গেল, কী চাই?

গুরুপদ বলে, আমার একটা চাবি হারিয়েছে।

তা আমাকে কী করতে হবে? আমাকে কি তালাচাবিওয়ালা পেয়েছেন?

না, ঠিক তা নয়। তবে আপনাদের বাসে হারিয়েছে। গুরুপদ বিনীতভাবে নিবেদন করল।

 কিন্তু ওই আপনাদের শব্দটি লোকটিকে যেন ক্ষিপ্ত করে দিল, হ্যাঁ, আমাদের! সত্তর টাকা মাইনে আর কোম্পানি আমার হয়ে গেল! এ মশায় সরকারি ব্যাপার, কারুর একার কোম্পানি নয়।

কী সব বাজে কথা বলছ। পাশ থেকে একজন ভারিক্কিমতন লোক এসে গুরুপদকে উদ্ধার করে, কী দরকার বলুন তো?

গুরুপদ এতক্ষণে সমস্ত ব্যাপারটা গুছিয়ে বলার সুযোগ পায়। এবং এক নিশ্বাসে বলে ফেলে।

ভারিক্কিমতন লোকটি সব মনোযোগ দিয়ে শোনে। তারপর গুরুপদকে আবার জিজ্ঞাসা করে, আচ্ছা কত নম্বর বাসে হারিয়েছে বলুন তো?

ঠিক বাসেই হারিয়েছে কিনা সে বিষয়ে অবশ্য আমি যথেষ্ট নিশ্চিত নই। তবে বাসের নম্বরটা হল…গুরুপদ যে রুটে এসেছিল সেই রুট-নম্বরটা বলল।

কিন্তু তাতে কোনও কাজ হল না। ভদ্রলোক রুট-নম্বর নয়, যে বাসে গুরুপদ এসেছে সেই বাসের নম্বরটি কী তাই জানতে চাইল। এর উত্তরে ঘাড় চুলকানো ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। গুরুপদ তাই করল, কেননা, কে বাসের নম্বর টুকে রাখে, কীই বা প্রয়োজন?

সে যা হোক, বাসের নম্বর বলতে পারলেও বিশেষ কোনও সুবিধা হত বলে মনে হল না। কেননা গুরুপদ তখনই জানতে পারল যে বাসে যাই হারাক এখানে তা পেলেও ফেরত দেয়া হয় না, তা ফেরত পেতে হলে যেতে হবে ডালহৌসি স্কোয়ারে লস্ট প্রপার্টি অফিসে।

গুরুপদ হাল ছাড়ল না। লস্ট প্রপার্টি অফিসের ঠিকানাটি কোনও রকমে সংগ্রহ করে নিয়ে তখনই রওনা হল সেই অফিসের দিকে।

অফিস পৌঁছাতে ততক্ষণ বেলা তিনটে। এনকোয়ারিতে একজন মহিলা বসে রয়েছেন। গুরুপদ কয়েক মিনিট দাঁড়ানোর পর তিনি ভ্রুক্ষেপ করলেন। একবার গুরুপদর মাথা থেকে পা পর্যন্ত তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী হারিয়েছে?

গুরুপদ বিনীতভাবে জানাল।

থানায় ডায়েরির কপি কই? ভদ্রমহিলা সুরঞ্জিত কয়েকটি নখাগ্র কাউন্টার-পথে নিক্ষেপ করলেন।

গুরুপদ জানাতে বাধ্য হল যে থানায় কোনও ডায়েরি নেই।

তা হলে তো হবে না। আপনার যে জিনিস হারিয়েছে এবং সেই জিনিসই যে আপনার তার প্রমাণ কী? যে এলাকায় হারিয়েছে সেই এলাকার থানায় একটা ডায়েরি করে নকল নিয়ে আসতে হবে আর এই একটা ফর্ম নিন, এটা পূরণ করে দিন।

ভদ্রমহিলা একটি ছাপানো ফর্ম এগিয়ে দিলেন।

গুরুপদ জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা আমি তো বাসে চড়ে গিয়েছি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়। সে প্রায় তিন চারটে থানার এলাকা দিয়ে বাস গেছে। কোন থানায় ডায়েরি করতে হবে?

আপনি একটু বসুন। ভদ্রমহিলা দ্রুত পদক্ষেপে ভিতরের দিকে চলে গেলেন। বসবার কোনও বন্দোবস্ত নেই, বসতে গেলে ভদ্রমহিলার পরিত্যক্ত আসনে গিয়ে বসতে হয়, গুরুপদ তাই দাঁড়িয়েই রইল।

ভদ্রমহিলা ফিরলেন একটু পরে, দেখুন আমি আপনাকে সঠিক বলতে পারছি না, আসলে এটা অনীতাদির কাজ। অনীতাদি আজ কদিন আসছেন না, ওঁর ভাইয়ের বিয়ে কিনা। আমাকেই ওঁর কাজ করতে হচ্ছে। আর কেউই কিছু বলতে পারছে না। আপনি এক কাজ করুন, সব থানাতেই একটা করে ডায়েরি করুন না।

যেন ব্যাপারটা খুবই সহজ এই রকম মুখভাব রেখে গুরুপদ জানতে চাইল, তারপরে চাবি কি নাগাদ পাওয়া যাবে?

চোদ্দোদিন পরে খোঁজ নেবেন। অবশ্য ততদিনে অনীতাদি ফিরে আসবেন। অনীতাদি এখানেই বসবেন, দেখলেই চিনতে পারবেন। এই আমার চেয়ে আরেকটু কালোমতন…ভদ্রমহিলা আরও কী সব বলতে যাচ্ছিলেন, গুরুপদ কোনও কিছুতে কান না দিয়ে একটি দ্রুত নমস্কারে কক্ষত্যাগ করে পথে অবতরণ করল। ভদ্রমহিলা বিশেষ নিরাশই হলেন বলে মনে হল, তাঁর যেন আরও কী কী বলার ছিল।

পথে নেমেই সামনে একটা ঝালমুড়িওয়ালা। যেন গুরুপদর জন্যেই দাঁড়িয়েছিল। ঝাল বেশি করকে, পেঁয়াজ বেশি করকে আর মুড়ি বেশি করকে–চার আনা কো। গুরুপদ আদেশ দিয়ে একটা গাছের নীচে মাথাটা সূর্যের আক্রমণ বাঁচিয়ে দাঁড়ায়। এটা কলেরা ঋতু। দোকানের ওমলেট পর্যন্ত গুরুপদ খায় না কিন্তু কোনও কোনও সময় মহামারীও তুচ্ছ মনে হয়। গুরুপদর এখন সেই সময়। চার আনার ঝালমুড়ি হাতে করে লালদিঘির ভেতরে গিয়ে বসল গুরুপদ। দাম দেয়ার সময় নোট বের করতে গিয়ে সেই ভদ্রমহিলার দেয়া হারানো-প্রাপ্তির দরখাস্ত ফর্মটা কখন পকেটে রেখে ছিল, সেটা হাতে এসেছিল, তাই হাতে করে গুরুপদ পা ছড়িয়ে বসল। একবার ফর্মটার ওপরে চোখ বুলিয়েই বুঝল, পৃথিবীর আর দশটা ফর্ম পূরণ করার মতোই এ ফর্ম-ও পূরণ করা তার পক্ষে অসম্ভব।

হারানো জিনিস ফিরিয়া পাইবার আবেদনপত্র।

(দ্রব্য প্রত্যর্পণ সংক্রান্ত ১৯৫৮ সালের XVIIনং আইনের গ ধারা মতে আবেদন করিতে হইবে। আবেদনকারী নাবালক বা উন্মাদ হইলে অভিভাবক (গার্জিয়ান) বা আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে ভারপ্রাপ্ত প্রাধিকারিক কর্তৃক এই আবেদনের যৌক্তিকতা গ্রাহ্য হইবে)।

১। নাম

পূর্বনাম–আপনার পূর্বে কী নাম ছিল? যাঁহারা নিজেদের পূর্বনাম পরিত্যাগ করিয়াছেন, তাঁহাদের প্রতি প্রযোজ্য।

২। পিতার নাম পিতার পূর্বনাম–যাঁহাদের পিতা পূর্বনাম পরিত্যাগ করিয়াছেন তাহাদের প্রতি প্রযোজ্য। পিতা মৃত কি জীবিত? কেন?

৩। ঠিকানা– পূর্ব বাসস্থান বর্তমান বাসস্থান

আপনি কি গত সাত বৎসরের মধ্যে বাসস্থান পরিবর্তন করিয়াছেন, যদি করিয়া থাকেন সমস্ত ক্ষেত্রে বিশদ ঠিকানা দিতে হইবে।

৪। ভারতীয় উন্মাদ আইন অনুসারে আপনাকে কি কখনও উন্মাদ বলিয়া ঘোষণা করা হইয়াছিল? যদি হইয়া থাকে, কেন? ঘোষণাপত্রের তারিখ ও নম্বর।

৫। আপনি কি কখনও কোনও আদালতের বিচারে কারারুদ্ধ হইয়াছিলেন? যদি হইয়া থাকেন, কী অপরাধে, কত দিনের জন্য, কোন জেলে ছিলেন?

৬। (ক) যে জিনিস হারাইয়াছে বলিয়া আপনি ভারতীয় হৃত-অপহৃত দ্রব্য প্রত্যর্পণ সংক্রান্ত আইনের ১৭ (ক) ধারামতে এই আবেদন করিতেছেন সেই জিনিসটির বিশেষ বিবরণ :

 (এইরূপ ভাবে বর্ণনা করিতে হইবে যে যাহাতে জিনিসটি দেখামাত্র বোঝা যায় এবং কোনও প্রশ্ন না ওঠে।)

(খ) যে জিনিসটি হারাইয়াছে তাহা আপনি ইতিপূর্বে আরও হারাইয়াছেন কি?

(গ) যদি (খ) প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ হয়, তবে নিম্নলিখিত ঘরগুলি পূরণ করুনঃ

(অ) কতবার হারাইয়াছেন?

(আ) প্রত্যেক বারই ফেরত পাইয়াছেন কি?

(ই) ইতিপূর্বে যতবার হারাইয়াছেন ততবারই ফেরত পাইয়াছেন কি?

(ঈ) পাইয়া থাকিলে কোথায় পাইয়াছেন?

(উ) কীরূপে পাইয়াছেন?

(ঊ) কখন পাইয়াছেন?

৭। যে জিনিস হারাইয়াছেন তাহার মূল্য কত?

পূর্ব মূল্য কত ছিল? বর্তমান মূল্য আনুমানিক কত?

(যদি দশ টাকার অধিক মূল্যের দ্রব্য হয় তবে ২২ ধারামতে দুই টাকার স্ট্যাম্পসমেত দরখাস্ত করিতে হইবে। প্রকৃত উদ্বাস্তু দরখাস্তকারীদের ক্ষেত্রে রিফিউজি সার্টিফিকেট দৃষ্টে এই স্ট্যাম্প ফি মাফ হইতে পারে। রিফিউজি সার্টিফিকেটের প্রত্যয়ীকৃত নকল দাখিল করিতে হইবে।)

৮…

আট, নয়, দশ এই রকম টানা বাইশ ঘর পূরণ করতে হবে। সাত নম্বর ঘর পর্যন্ত পৌঁছেই গুরুপদর মাথা রিমঝিম করতে লাগল। সে স্পষ্ট বুঝতে পারল পৃথিবীর আর সমস্ত ফর্মের মতোই এ ফর্ম পূরণ করা অসম্ভব। এই ফর্ম যে পূরণ করতে পারে সে হারানো জিনিস ফিরে পায়, নির্ধনের ধন হয়, বেকারের চাকরি হয়, উদ্বাস্তুর পুনর্বাসন হয়। কিন্তু অসম্ভব, আর দু-এক ঘর পড়লেই গুরুপদ অজ্ঞান হয়ে যেত সে স্পষ্ট বুঝতে পারে।

সুতরাং আর কোনও গত্যন্তর নেই। গুরুপদ একটা ফেরত বাস ধরে বাড়ির দিকে রওনা হয়। কিন্তু বাড়িতে ফিরেই বা কী হবে? যে বাড়ির দরজা বন্ধ আর সেই দরজার চাবি নেই, সে বাড়িতে ফেরাও যা আর পথে পথে পার্কে ময়দানে ঘুরে বেড়ানোও তাই। গুরুপদও তাই করল। রাত্রি প্রায় দশটা পর্যন্ত পথে পথে ঘুরল। একবার ভাবল রাত্রে একটা পার্কে শুয়েই কাটাবে। কিন্তু বাড়িতে তো একসময়, আজ হোক কাল হোক ফিরতেই হবে। একটা তালাচাবিওয়ালা ধরতে পারলে বেশ হত। কিন্তু এত রাত্রে কোথায় পাওয়া যাবে? সেটা সময়মতো খুঁজলে হত। এখন যারা রাত্রে তালা খোলে, যেকোনও দরজার তালা খুলতে পারে, তারা কেউই প্রকাশ্যে খোলে না। আর ব্যর্থ অনুসন্ধানে ব্যস্ত হয়ে গুরুপদ বাড়ির দিকেই পা চালাল।

গুরুপদর শেষ একটা ক্ষীণ আশা ছিল যে হয়তো গিয়ে দেখবে দরজা বন্ধ করেই সে আদৌ বেরোয়নি। খোলা দরজায় তালা ঝুলছে দেখতে পাবে। কিন্তু দরজা নিতান্তই বন্ধ আর তার তালা ঝুলছে, বেশ ভাল ভাবেই ঝুলছে।

অমলাদের ফ্ল্যাটটার দিকে তাকায় গুরুপদ। আলো জ্বলছে না। এত সকাল সকাল অমলার ঘরের আলো নেভে না কোনও দিন। হয়তো দিদি জামাইবাবুর সঙ্গে সিনেমাই দেখতে গেছে রাত্রের শোতে। তাহলে পাশের বাড়িটা থেকেই হাতুড়িটা চাইতে হয়। হাতুড়িটা চেয়ে আনল। কিন্তু পুরনো। আমলের লোহার তালা অত সহজে ভাঙা সম্ভব নয়। লোহার তালাটাকে ঈশ্বরের মতন, বা প্রায় খোদাতালার মতোই সর্বশক্তিমান মনে হল গুরুপদর। দুমদাম, ঠুকঠাক ক্রমাগত শব্দ হতে লাগল, আশপাশের ফ্ল্যাটবাড়ির লোকেরা জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ফেলল, একটা বাচ্চা ছেলের কান্না শোনা গেল। হাঁফাতে হাঁফাতে ঘামে স্নান করতে আরম্ভ করল গুরুপদ। হাতটা ক্রমাগত হাতুড়ি সমেত ওঠানামা করতে করতে ভারী হয়ে আসছে ক্রমশ। শেষ পর্যন্ত ওর মনে হল, হাত আর হাতুড়ির তফাতটা বোধ হয় আর একসময় থাকবেই না। তখন শুধু হাত দিয়েই ঠুকে ঠুকে তালা। খোলা যাবে। হাত আর হাতুড়ির মারাত্মক বিয়োগফলে ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা প্রায় থেঁতলে গেল। অন্ধকারে রক্ত দেখা যায় না, গেলে থেমে যেত গুরুপদ, তালে তালে তালার ওপর হাতুড়ি ঠুকত না আর। গুরুপদ জীবনে এই প্রথম চোরদের জন্যে মমতাবোধ করল এবং একাত্মতাও। চোরেরা কাউকে না জানিয়ে তালা ভাঙে কিন্তু গুরুপদ পাড়াসুদ্ধ লোক জানিয়ে দরজাটাই ভেঙে ফেলল শেষ পর্যন্ত। তালাটা তেমনি ঝুলছে, ডান দিকের দরজার পাল্লা হুড়মুড় করে ঘরের মধ্যে গিয়ে পড়েছে। ঘরের ভেতরে বড় আয়নাটা, টেবিল-ল্যাম্প সব চুরমার। তবু ভাল, দরজা ভাঙলে। ওপরের বালব ভাঙে না। সন্তর্পণে আলোটা জ্বালে। আলোটা জ্বালতেই রক্ত দেখল এবং রক্ত দেখেই সটান বিছানায় মাথা ঘুরে শুয়ে পড়ল। খানিক পরেই অমলার গলা শুনল গুরুপদ। কোত্থেকে ফিরল যেন। বুড়ো আঙুলটার জন্যে তুলো আর ন্যাকড়ার প্রয়োজন, অমলার গলা শুনেই যেন অনুভব করে সে। কোনও রকমে বুড়ো আঙুলটা চেপে অমলাদের ফ্ল্যাটের দিকে এগুল গুরুপদ। অমলার ঘরে আলো জ্বলছে। সেদিকে তাকিয়ে থেতলানো আঙুলের ব্যথাটা ও যেন ভুলে। গেল। আবার অমলা নীল শাড়ি পরেছে। খাটের ওপর হাটু মুড়ে বসে বাতাসে গাল পেতে চুল খুলছে। পেছন থেকে পায়ের পাতা, কোমর, বাঁকানো গ্রীবা এই সব দেখতে দেখতে কখন দরজার কড়া নেড়ে, অমলার ঘরের মধ্যে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে সে নিজেই টেরই পেল না।

–ও কী, ও কী হয়েছে আপনার আঙুলে? ওর হাতের দিকে তাকিয়ে বিছানা থেকে ছিটকে দাঁড়িয়ে পড়ে অমলা।

-হাতুড়ি! আর কিছু বেরুল না গুরুপদর গলা দিয়ে। অতি তীব্র একটি দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে চোখও বন্ধ করে ফেলল। নীল শাড়ির খানিকটা ছিঁড়ে ফেলেছে অমলা, তুলো, ডেটল ২০৪

আনিয়েছে চাকরটাকে দিয়ে। কোমল, নরম একটা স্পর্শে গুরুপদ চোখ খুলে দেখল হালকা এক টুকরো নীল আকাশকেই যেন ডান হাতে পেয়ে গেছে সে।

–চলুন আপনার ঘরে চলুন। ইস, একেবারে রক্তারক্তি কাণ্ড করে ফেলেছেন!

 গুরুপদর ঘরে এসে অমলা অবাক।

–এ কী কাণ্ড, দরজা ভাঙা, ঘরময়

–মানে ওই চাবিটা পাচ্ছিলাম না কিনা, তাই…কাতর কণ্ঠে আরও কী বলতে যাচ্ছিল, অমলার মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেল। নীল শাড়ির মধ্যে হঠাৎ অমলার মুখটা কেমন লাল হয়ে উঠল, মেঝের দিকে চোখ নামিয়ে গুরুপদকে প্রায় ঘুম পাড়িয়ে দেয়া গলায় বলল অমলা।

–আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। সত্যি ভীষণ অন্যায়…মানে আজ সকালে বেরুনোর সময় আপনি দরজায় তালা দিতে ভুলে গিয়েছিলেন, চাবিটা

গুরুপদ স্পষ্ট দেখতে পেল, ধীরে ধীরে কাধ থেকে নীল শাড়ির ভেঁড়া আঁচলটা টেনে তার চাবিটা খুলে দিচ্ছে অমলা।

গুরুপদর প্রবল ইচ্ছে হল চিৎকার করে বাধা দেয় অমলাকে, কিন্তু অমলাই শেষ পর্যন্ত আর খুলল না।

–থাক আমার কাছেই থাক, আপনি তো আর এক হাতে চাবি দিতে পারবেন না।

ঘুমোতে ঘুমোতে গুরুপদ সেদিন একটা হাজারদুয়ারি বাড়ির স্বপ্ন দেখেছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *