1 of 3

পটললালের বিপদ

পটললালের বিপদ

পটললাল হলেন নৃত্যপটিয়সী প্রাক্তন ক্যাবারে সুন্দরী মিস জুলেখার স্বামী।

পটললাল সম্পর্কে যাঁরা একেবারেই ওয়াকিবহাল নন, অর্থাৎ আমার দুর্ভাগ্যবশত ইতিপূর্বে পটললালকে নিয়ে লেখা আমার কোনও কাহিনি যাঁরা কখনও পড়েননি, তাদের অবগতির জন্য ওই পূর্বকথা।

.

ইংরেজিতে একটি কথা আছে, নো বিজিনেস লাইক শো-বিজিনেস (No business like show business)। পটললাল হলেন এই শো-বিজিনেসের লোক, যাত্রা-থিয়েটার-সিনেমার বিভিন্ন অলিন্দে তার দীর্ঘদিনের মসৃণ যাতায়াত।

যদিও পটললাল এ লাইনের পুরনো লোক, তার স্ত্রী মিস জুলেখার সুবাদেই আজকাল তিনি করে কম্মে খাচ্ছেন। তাকে অনেকে মিস্টার পটললাল কিংবা পটলবাবু না বলে মি. জুলেখা বলে। থাকে।

মিস জুলেখা, যাঁর অভিনয়পূর্ব-জীবনে নাম ছিল শ্রীমতী লেখা ভট্টাচার্য, যাত্রা-থিয়েটার ব্যাপারে বিশেষ আবেদনময়ী নাচিয়ে। কোনও কোনও নাটক বা পালা শুধুমাত্র মিস জুলেখার মোহময়ী নৃত্যের আকর্ষণেই অনেক দর্শক দেখতে আসতেন। সম্প্রতি বিশেষ স্পেশ্যাল শো ছাড়া জুলেখা। নাচেন না।

মিস জুলেখা একটু স্থূলাঙ্গিনী হয়ে গিয়েছেন। তাঁর নাচের আর তেমন কদর নেই। তা ছাড়া কিছুক্ষণ নাচলেই তিনি হাঁফিয়ে পড়েন। কিছুদিন হল শ্রীযুক্ত পটললালকেই সংসার চালাতে হচ্ছে। মিস জুলেখার পরিচয়টা কাজে লাগছে।

পটললাল পারেন না এমন কোনও কাজ নেই। সেই সঙ্গে তাঁর অল্পস্বল্প চুরিবিদ্যা আয়ত্তে আছে, কিঞ্চিৎ হাতটানও রয়েছে। সম্প্রতি তিনি টলিউডে একটি সিনেমার সহকারী পরিচালক।

এই সহকারী পরিচালক হওয়ার জন্যে কী যোগ্যতা প্রয়োজন, বেতনাদি কী রকম এবং কী কাজ একজন সহপরিচালকের সেটা কেউ জানে না, পটললালও জানেন না।

মাঝেমধ্যে দুয়েকশো টাকা প্রযোজকের তরফ থেকে তিনি পান, কিন্তু আয়টা ভাল নয়, নিয়মিতও নয়। তদুপরি কাজের প্রকৃতিটাও নির্দিষ্ট নয়। সহকারী পরিচালক হিসেবে তাকে চিত্রপরিচালনা ছাড়া আর সবই করতে হয়।

আজকাল স্টুডিয়োতে, বিয়েবাড়ি কিংবা ধর্মস্থানের মতো খুব জুতোচোরের উপদ্রব হয়েছে। যেসব দিন নায়িকার শুটিং থাকে, পটললালকে নায়িকার জুতো পাহারা দিতে হয়। উঠতি নায়কের ট্যাক্সি ডেকে দিতে হয়। কোনও ট্যাক্সিই আসতে চায় না, কারণ ট্যাক্সিওলারা জানে মিটার ওঠবার আগেই নায়কেরা টালিগঞ্জের মোড়ে নেমে যান তারপর পাতাল রেল কিংবা মিনিবাসে চড়ে চলে যান।

আরও অনেকরকম হাঙ্গামা আছে। প্রযোজকের শাশুড়ি ঠাকুরানি ডেন্টিস্টের কাছে দাঁত তুলতে যাবেন, পরিচালকের বান্ধবী পার্ক স্ট্রিটে চুল ববকাট করতে যাবেন,–পটললাল ছাড়া কে সঙ্গে যাবে?

.

মূল গল্পের মধ্যে প্রবেশের আগে অন্য একটি চরিত্রের কথা উল্লেখ করতে হয়।

 এই ব্যক্তিটি হলেন ডা. সহদেব শুক।

 ভদ্রলোক কবি এবং হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক। সেই সঙ্গে শখের গোয়েন্দা। এই গল্পে তাঁর প্রবেশ গোয়েন্দা হিসেবেই।

প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, ডা. সহদেব শুক মশায়ের আসল নাম হল নকুল শুকুল। তিনি কেন নকুল শুকুল থেকে সহদেব শুক হলেন সেটা যাঁরা জানেন না তাদের অনুরোধ করি পটললালের পুরনো গল্পগুলি পড়ে দেখতে, এই ছোট গল্পে সেসব বিষয়ে পুরালোচনার সুযোগ বা অবকাশ নেই।

শুধু একটা কথা বলার আছে, যদিও একদা নিতান্ত পেশাগত কারণেই তার সঙ্গে পটললালের পরিচয় হয়েছিল, ডা. শুক এই ছন্নছাড়া, কাণ্ডজ্ঞানহীন লোকটিকে বহুবার রক্ষা করেছেন। ডা. সহদেব শুক পটললালের একমাত্র সহায়।

গল্পকথা

নিউ আলিপুরের এই অঞ্চলটা আজ দুপুরেই ঘুরে গেছেন পটললাল। এখন শেষরাত।

জীবনমুখী প্রোডাকশনসের ব্যানারে নতুন ছবি শরীর এক জ্বালা। শুটিং শুরু হয়ে গেছে।

সপ্তাহ দুয়েক আগে পটললালের গৃহিণী জুলেখা জানতে চেয়েছিলেন, ওগো, তোমাদের নতুন পালাটার নাম কী?

পটললাল সরলভাবে বলেছিলেন, দুর্দান্ত নাম হয়েছে, শরীর এক জ্বালা।

 জুলেখা স্থূলাঙ্গিনী হলেও তার হাত-পা খুব ভাল চলে, মুহূর্তের মধ্যে বাঁ হাতে পটললালের গালে একটা চপেটাঘাত করে কর্কশ কণ্ঠে বললেন, ফাজলামি করার জায়গা পাওনি।

আসলে জুলেখা ভেবেছেন, তিনি মোটা হয়ে তার শরীর যে মাটির জালার মতো হয়ে গেছে, তার স্বামী তাই নিয়ে তাঁকে পরিহাস করছেন।

সেদিন পটললালের মহা হয়রানি হয়েছিল এ কথা বোঝাতে যে এ জ্বালা সে জালা নয়, দুজনেরই ক-অক্ষর গোমাংস, তা না হলে এ জ্বালায় যে একটা ব-ফলা আছে সেটা বোঝাতে এবং বুঝতে পারলে ঝগড়া খুব একটা গড়াত না।

সে যা হোক এই শরীর এক জ্বালা চলচ্চিত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যে আছে যে গল্পের নায়িকা পরমাণু বিজ্ঞানের বিখ্যাত গবেষিকা এবং কলকাতা হাইকোর্টের নামজাদা ব্যারিস্টারের স্ত্রী একদিন শেষরাতে ছবির নায়ক বাড়ির ড্রাইভারের সঙ্গে গৃহত্যাগ করবে। তখন ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বাজবে,

যেতে দাও গেল যারা,
তুমি যেয়ো না,
তুমি যেয়ো না..

পটললালকে পরিচালক পাঠিয়েছেন এই দৃশ্যের লোকেশন যাচাই করতে।

আজ দিনের বেলায় পাড়াটা ঘুরে দেখে গেছেন পটললাল। চিত্রনাট্যে যেমন বলা আছে তেমনই সব বড়লোকের বাড়ি। অবশ্য শুটিংয়ের সময় স্টুডিয়োর মধ্যে নানারকম জোড়াতালি দিয়ে, কারসাজি করে, বাড়ির ভেতরটা তৈরি করা যাবে। তবে রাস্তায় শেষরাতে একদিন আউটডোর শুটিং করতে হবে।

সাজানো সংসার ফেলে সতীসাধ্বী পরমাণু গবেষিকার পালিয়ে যাওয়ার সময়ের দ্বিধা, সেই সঙ্গে এম. এ. পাশ (ট্রিপল এম. এ. গোল্ড মেডালিস্ট), কোনও কাজ না পেয়ে যে ড্রাইভার হয়েছে এমন নায়কের সবল বাহুবন্ধনে নিমজ্জিতা নায়িকার দ্বিধামুক্তি–এরই পটভূমিকা শেষরাতের উদাস নির্জন অভিজাত পল্লি, আন্দোলিত দেবদারুতরু, পিয়াল শাখার ফাঁকে আধফালি চাঁদ।

এই সবের উপযুক্ত পরিবেশের অনুসন্ধানে আজ শেষরাতে পটললাল এখানে এসেছেন। সন্ধ্যাবেলায় পরিচালকের বাড়ির বাইরের ঘরে সোফার ওপরে শুয়েছিলেন, রাত তিনটের সময় পরিচালকের গাড়ি এসে তাকে পুরনো আলিপুর আর নিউ আলিপুরের মধ্যবর্তী এই অভিজাত এলাকায় নামিয়ে দিয়ে গেছে।

তাকে নামিয়ে দিয়েই গাড়ি ফিরে গেছে। কারণ পরিচালকের বাবা বাবুঘাটে গঙ্গাস্নানে যাবেন।

এর মানে হল পটললালকে এখন নিজের খরচায় বাড়ি ফিরতে হবে। তার বাড়ি তিলজলা পেরিয়ে। ট্যাক্সিভাড়া তার কাছে নেই, বাস-ট্রামেই যেতে হবে। তবে তার জন্য সকাল হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। অবশ্য এই সময়ে ট্যাক্সিও পাওয়া যেত না।

উদোর পিণ্ডি

এসব পাড়ার রাস্তায় হেঁটেও আরাম। ফুটপাত তেমন ভাঙাচোরা নয়, তিলজলার গলির মতো নোংরা, কাদাভরা নয়।

যদিও সময়টা বর্ষার মাঝামাঝি, এখন আকাশে কোনও মেঘ নেই, শেষরাতের তারা ঝলমল, চন্দ্রনীল আকাশ। ঝিরঝির করে বাতাস বইছে।

নিজের এলাকার পথঘাটের দুর্গতির কথা ভুলে অভিজাত পল্লির শূন্য রাস্তায় পটললাল। পদচারণা করতে লাগলেন।

রাত ভোর হয়ে এসেছে। আশেপাশের দুয়েকটা বাড়িতে ঘরে আলো জ্বলে উঠল। লোকেরা ঘুম থেকে ওঠা আরম্ভ করেছে। এ অঞ্চলের ধনবান গৃহকর্তারা অনেকেই একটু পরে মর্নিং ওয়াকে বেরোবেন। তারই প্রস্তুতি চলছে। নানা লোকের নানারকম তদ্বির থাকে এই সব বৃহৎ ব্যক্তিদের কাছে, তাই এঁরা অন্ধকার থাকতে থাকতেই হাঁটতে বেরিয়ে যান, রোদ উঠবার আগেই বাড়ি ফিরে। আসেন, যাতে ভ্রমণের সময় কেউ বিরক্ত না করে।

.

এমন সময় ঘটাং করে একটা শব্দ হল। সামনের বাড়ির সদরের লোহার গেটটা একজন নেপালি দারোয়ান খুলে দিল।

সব নেপালি দারোয়ানই ছোটবেলায় কাঞ্চা, বড় হলে সে বাহাদুর। এই দারোয়ানের বয়েস বেশি হয়নি। এখনও সে বাহাদুর হয়নি, কাঞ্চাই আছে। কাঞ্চা একটু ঘুমকাতুরে। সে সদর দরজাটা খুলে দিয়ে পাশেই আউট হাউসের ঘরের বারান্দায় চারপায়ার ওপর গিয়ে শুয়ে পড়ল।

সুন্দর এই দোতলাবাড়ি শিল্পবিদ উদয় চৌধুরীর, যিনি কলকাতার শিল্পজগতে ইউ সি নামে বিখ্যাত। তিনি প্রত্যহ সকালে এই সময়ে হাঁটতে বেরোন। তাকে যাতে ঘুম থেকে ডেকে তুলতে না হয় সাহেবকে, সেইজন্যে সে একটু আগেই ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলে রাখে।

কাঞ্চা অবশ্য জানে না যে আজ ইউ সি বেড়াতে বেরোবেন না। কাল গভীর রাত পর্যন্ত ক্লাবে হই-হুঁল্লোড় হয়েছে। তারপরে আটটার সময়ে এয়ারপোর্টে পৌঁছতে হবে দিল্লি যাওয়ার জন্যে। আজ ইউ সি একেবারে সেই সাতটায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে সরাসরি এয়ারপোর্ট চলে যাবেন। আজ হাঁটা নেই।

এদিকে পটললাল সামনে গেট খোলা পেয়ে এবং কোনও বাধা না পেয়ে ভেতরে ঢুকে পড়েছেন। বাড়িতে ঢোকার সময় গেটের পাশে নেমপ্লেটে দেখে নিয়েছেন লেখা আছে, ইংরেজিতে ও বাংলায়।

U. C. Chaudhuri
উদয়চাঁদ চৌধুরী

আউটহাউসের বারান্দায় কাঞ্চা অকাতরে ঘুমোচ্ছে। পটললাল সন্তর্পণে বাড়ির ভেতরের দিকে এগিয়ে গেলেন।

কলকাতা শহরের তুলনায় এমনকী নিউ আলিপুরের তুলনায়ও বাড়িটা বড়। সামনে একফালি ফুলের বাগান। বাড়ির পিছনদিকে একটা লন। সেখান দিয়ে ভিতরবাড়ির ছোট সিঁড়ি। সেই সিঁড়ির নীচেই একটা ঘরের দরজা খোলা, আলো জ্বলছে।

 আলোটা একটু আগে বাইরের গেট খোলার সময় কাঞ্চাই ঘরের দরজা খুলে জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে।

সিঁড়ির নীচে এই ছোট ঘরটা হল ইউ সি-র ড্রেসিং রুম। শেষরাতে বাড়ির কাউকে বিরক্ত না করে রাত-পোশাক এখানে ছেড়ে হাফ প্যান্ট, স্পোর্টস গেঞ্জি এবং পাওয়ার শু পায়ে দিয়ে প্রত্যহ ইউ সি হাঁটতে বেরিয়ে যান। আবার হেঁটে ফিরে এসে এখানেই জামাপ্যান্ট ছেড়ে ওপরে উঠে যান।

আজ অবশ্য সেসব ঘটছে না। কিন্তু কোথাও কোনও বাধা না পেয়ে পটললাল সিঁড়ির নীচে এই ঘরে প্রবেশ করেছেন।

প্রথমে পটললাল ভেবেছিলেন বাড়িটা একটু ঘুরেফিরে দেখে নেবেন, সিনেমার সেট তৈরির সময় সুবিধে হবে। কিন্তু পটললালের নীতিবোধ খুব প্রখর নয়, আর তা ছাড়া যারা পটললালের কোনও গল্প আগে পড়েছেন তারা জানেন, পটললালের একটু হাতটানের অভ্যেস আছে।

আজ একতলার খালিঘরে ঢুকে মূল্যবান শর্ট, শার্ট এবং জুতো দেখে পটললাল লোভ সম্বরণ করতে পারলেন না। অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ইউ সি-র প্রাতঃভ্রমণের পোশাক তিনি পরে নিলেন। এই হতদরিদ্র টাউট এবং সফল শিল্পপতির শরীরের গড়নে খুব ফারাক নেই। পোশাক-আশাক ভালই ফিট করেছে।

ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের পুরনো জামাকাপড় ছেঁড়া হাওয়াই চটি লনে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পটললাল সদর গেট দিয়ে দ্রুত নিষ্ক্রান্ত হলেন।

 ঘুমঘোরে কাঞ্চা ভাবল সাহেব বুঝি বেরিয়ে গেলেন, সে উঠে গিয়ে সদর দরজায় আবার তালা দিয়ে দিল।

পটললাল মনের আনন্দে তার নবযৌবনের হিন্দি সিনেমার গানের কলি হাম তুম এক কামরামে অস্ফুট স্বরে গাইতে গাইতে মোড়ের দিকে এগোতে লাগলেন। এরকম একজোড়া শর্ট-শার্ট, পাওয়ার জুতো তার বহুকালের স্বপ্ন।

পটললাল মোড়ের কাছে পৌঁছে দেখলেন, একটি মারুতি ভ্যান খারাপ হয়ে গেছে, চারজন লোক বনেট তুলে গাড়িটা সারানোর চেষ্টা করছে।

পটললাল গাড়ির কাছে পৌঁছতেই একটা কাণ্ড ঘটল। যারা গাড়ি সারাচ্ছিল তাদের মধ্যে তিনজন হঠাৎ লাফ দিয়ে এসে পটললালকে জাপটিয়ে ধরল।

পটললাল ঘটনার আকস্মিকতায় খুবই হকচকিয়ে গিয়েছিলেন। চেঁচাতে যাচ্ছিলেন। বিপদে পড়লে চেঁচানোয় এবং সম্ভব হলে, দৌড়ে পালানোয় পটললালের অসীম দক্ষতা।

কিন্তু আজ কোনওটাই কাজে লাগল না। দুজন তাঁকে জাপটে ধরেছে আর তৃতীয় জন তার মুখে এমনভাবে হাতচাপা দিয়েছে যে চেঁচানো অসম্ভব। আর নির্জন রাতের শূন্য রাস্তায় চেঁচিয়েই বা কী লাভ হত।

ইতিমধ্যে চতুর্থ ব্যক্তি গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে গিয়ে বসেছে। অন্য তিনজন পাঁজাকোলা করে পটললালকে মারুতি ভ্যানের সিটের পিছনের জায়গাটায় নিয়ে তুলেছে।

ধস্তাধস্তি করার চেষ্টা নিষ্ফল জেনে পটললাল চুপচাপ থাকলেন। তিনি কীসে কী হল কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। হঠাৎ একজন তার নাকের কাছে হাসপাতালগন্ধী কী একটা আরকসিক্ত তুলো চেপে ধরতে পটললাল জ্ঞান হারালেন।

জ্ঞানোদয়

পটললালের জ্ঞান হল আঠারো ঘণ্টা পরে সেদিন রাত দশটায়।

একটা প্রায়ান্ধকার ঘরে একপাশে খুব টিমটিম করে একটা কেরোসিনের কুপি জ্বলছে, অন্যপাশে একটা ভাঙাচোরা অর্ধ-অসমতল খাটের একপাশে সমতল দিকটায় তিনি ভেঁড়া গদির ওপরে বালিশবিহীন শুয়ে আছেন।

পটললাল প্রথমে ভেবেছিলেন এটা কোনও সিনেমার সেট। কিন্তু কিছু চিন্তা করার বা বুঝে ওঠার আগে তিনি আবার চেতনাহীন হয়ে গেলেন।

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল। খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। এরই মধ্যে তার মনে পড়ছে কারা যেন দু গেলাস দুধ খাইয়েছিল কাল রাতে ঘুমের মধ্যে।

 এখনও ঝিমুনির ভাব আছে। তবু কোনও রকমে বিছানা থেকে নেমে উঠে দাঁড়ালেন পটললাল। দেয়াল ধরে ধরে এগিয়ে ঘরের বন্ধ দরজার দিকে এগোনোর চেষ্টা করলেন। দরজার ধারে পৌঁছানোর আগেই লাল লুঙ্গিপরা একজন ষণ্ডা মতন খালিগায়ে লোক বাইরে থেকে দরজা খুলে তাঁর সামনে এসে দাঁড়াল। লোকটি তাকে দেখে একটা নিমের দাঁতন আর গামছা তার হাতে দিয়ে, তাঁকে সঙ্গে করে উঠোনে নামল। উঠোনের একপাশে একটা বাথরুমের মতো ঘেরাও দিয়ে রাখা জায়গা। ইঙ্গিত বুঝতে পেরে পটললাল সেখানে ঢুকে গেলেন।

 স্নান ইত্যাদি সেরে আবার নজরদারের সঙ্গে তার ঘরে ফিরলেন। কয়েকটা ঠান্ডা পুরি আর হালুয়া, সেই সঙ্গে দেহাতি লাল জিলিপি বড় বড় আকারের একটা শালপাতার ঠোঙায় নজরদার এগিয়ে দিতে পটললাল গোগ্রাসে গিলতে লাগলেন।

ইতিমধ্যে পটললাল পুরো ব্যাপারটা মনে মনে ভেবে দেখেছেন। যেকোনও কারণেই হোক এখানে তাকে ধরে আনা হয়েছে। জায়গাটা সম্ভবত কোনও বন্ধ কয়লাখনির পরিত্যক্ত কুলিব্যারাক।

আসানসোল-ধানবাদ অঞ্চলের এরকম নানা জায়গায় যাত্রাপার্টির সঙ্গে মিস জুলেখার তলপিবাহক হিসেবে তাকে বহু ঘুরতে হয়েছে।

সে যা হোক পটললাল ভাবতে লাগলেন, হঠাৎ তাকে এভাবে ধরে এনে এতদূরে আটকে রাখার মানে কী?

অবশ্য বেশিক্ষণ ভাবতে হল না, একটু পরেই ক্রিম রংয়ের সাফারি সুট পরা সেলুলার ফোন হাতে এক ব্যক্তি এলেন, তাঁকে বললেন, গুড মর্নিং মি. চৌধুরী।

পটললাল বললেন, আমি চৌধুরী নই। আমার নাম পটললাল পাল।

 সাফারি সুট বাঁকা হাসি হেসে বললেন, নিজের নাম অস্বীকার করে কোনও লাভ নেই মি. চৌধুরী। অনেক খোঁজখবর করেই আপনাকে ধরে আনা হয়েছে। এখন বেগড়বাই করবেন না, বিপদ হবে।

চকিতে পটললালের মনে পড়ল, যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে তিনি এদের হাতে বন্দি হয়েছেন সে বাড়ির গেটে লেখা ছিল, উদয় চৌধুরী। তার বুঝতে অসুবিধে হল না, উদয় চৌধুরী ভ্রমেই তাকে এখানে ধরে আনা হয়েছে।

এই সময়ে সাফারি সুট তার হাতের ফোনটা পটললালকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, আপনি বাসায় বলে দিন ভাল আছি। আর আজ বিকেলের মধ্যে নগদ পঁচিশ লক্ষ টাকা জোগাড় করে একটা সুটকেসের মধ্যে ভরে রাখতে বলে দিন। কোথা থেকে কীভাবে টাকাটা নেব সেটা পরে জানাচ্ছি।

এরপর ধমকের সুরে সেই সাফারি সুট তাঁর দেহাতি বাংলায় বললেন, কোনও চালাকি করতে যাবেন না। বাসায় বলে দিন পুলিশে যেন খবর না পায়, তাহলে এখানে আপনাকে জ্যান্ত পুঁতে রেখে দেব। কোনওদিন কেউ খোঁজ পাবে না। চারদিকে পাহারা রাখা আছে, পালাতেও পারবেন না।

সেলুলার ফোনটা হাতে নিতে নিতে পটললাল একবার ভাবলেন এদের বলি, আমি উদয় চৌধুরী নই। আমি পটললাল পাল। আমার স্ত্রীর পঁচিশ লাখ টাকা নেই, পঁচিশ টাকাও আছে কিনা সন্দেহ আর আমার নিজেরও পঁচিশ টাকা নেই। তা ছাড়া সবচেয়ে বড় কথা, আমার বাড়ির ফোন বিল দেওয়া হয়নি বলে গত মাসে কেটে দিয়েছে।

এরকম দুরূহ অবস্থায় পটললাল কখনও পড়েননি। একেবারে জীবনমৃত্যুর মুখোমুখি। কিন্তু পেটের দায়ে তাকে সারাজীবন বিস্তর ঝুট-ঝামেলার সম্মুখীন হতে হয়েছে এবং সেসব কেটে বেরিয়ে এসেছেন।

এবারেও বেরোতে হবে, তবে আমি উদয় চৌধুরী নই এ কথা এদের এখন বোঝানো যাবে না। পটললাল চিন্তা করতে লাগলেন, একটু খোঁজখবর করলেই এরা সেটা ধরতে পারবে। ততক্ষণ পর্যন্ত কোনওভাবে আত্মরক্ষা করতে হবে।

ফোন হাতে ধরে পটললাল নিশ্ৰুপ বসে আছেন দেখে সাফারি সুট এবার খেঁকিয়ে উঠল, কী হল, জলদি করুন।

পটললাল ধমক খেয়ে একটু থতমত হয়ে গেলেন, তারপর বললেন, দেখুন বাড়িতে ফোন করে লাভ নেই। আমার বাড়ি থেকে পঁচিশ লাখ টাকা জোগাড় করতে পারবে না।

সাফরি সুট ভুরু কুঁচকিয়ে বললেন, তা হলে?

পটললাল বললেন, যদি অনুমতি করেন, আমি একটু আলাদাভাবে চেষ্টা করি।

সাফারি সুট একটু চিন্তা করলেন, তারপর বললেন, চেষ্টা করতে পারেন। এদিক ওদিক করতে যাবেন না। গোলমাল হলে বড়সাহেব আপনার-আমার দুজনারই হাইট ছয় ইঞ্চি ছোট করে দেবেন।

পটললাল অবাক হয়ে বললেন, ছয় ইঞ্চি ব্যাপারটা কী?

গলা কেটে ফেললে হাইট ছয় ইঞ্চি ছোট হয়ে যায়, জানেন না? সাফারি সুট অবাক হয়ে যায় পটললালের অজ্ঞতায়।

ডাক্তার শুক

আজ সকালে চেম্বারে রোগীর ভিড় একটু কম। ডাক্তার সহদেব শুক রোগী দেখার ফাঁকে ফাঁকে কবিতা লিখছিলেন, একটু হালকা ধরনের কবিতা।

কনের পিসি বরের মাসি
সারা বছর সর্দি কাসি
বরের মাসি কনের পিসি
ওষুধ খায় শিশি-শিশি ॥

 এমন সময় ফোনটা এল, ডাক্তারবাবু আমি পটললাল বলছি।

সহদেব ডাক্তার বললেন, আরে পটলবাবু কোথা থেকে বলছেন?

পটলবাবু বললেন, সেটাই জানি না।

সহদেব বললেন, কী ব্যাপার বলুন?

পটললাল বললেন, আমায় বন্দি করে রাখা হয়েছে, পঁচিশ লাখ টাকা মুক্তিপণ না দিলে এরা ছাড়বে না। তারপর একবার সাফারি সুটের দিকে তাকিয়ে বললেন, এরা অবশ্য এখনও পর্যন্ত আমার ওপর কোনও অত্যাচার করেনি।

ডাক্তার সহদেব অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে পটললালের কাছে পুরো বৃত্তান্ত শুনলেন। হঠাৎ পটললাল বললেন, এখন ছেড়ে দিচ্ছি। ফোনটা কেটে গেল। দুটো জিনিস ডা. শুককে স্ট্রাইক করেছে।

প্রথমটি তার নিজের ব্যাপার। গোপনে তিনি একটা নতুন ওষুধ চালু করেছেন। হোমিওপ্যাথিক ক্লোরোফর্ম জাতীয় তরল ওষুধ। রুমালে ঢেলে একবার শুকলে ঘুম ঘুম ভাব আসবে, ঘুমের ট্যাবলেট খেলে কিংবা অল্প মদ খেলে যেমন হয়।

কবিস্বভাব এবং স্বভাবকবি সহদেব ওষুধটার নাম দিয়েছেন, সম্মুখে শান্তি পারাবার।

 ওষুধের শিশির গায়ে লাল কালিতে ছাপার হরফে লেখা থাকে।

দুবার চারবার নয় মাত্র একবার।
তা না হলে একেবারে শান্তি পারাবার ॥

দ্বিতীয় যে ঘটনা সহদেববাবুকে ভাবাচ্ছে সেটা হল আজকের সকালবেলায় খবরের কাগজের দুটি সংবাদ।

প্রথম সংবাদটি: প্রথম পৃষ্ঠায় গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়েছে

অজ্ঞাতপরিচয় প্রাতঃভ্রমণকারী অপহৃত।
সংবাদপত্রের ভাষায়
গতকাল ভোররাতে চিত্রতারকা রমলাদেবী যখন তার দেহরক্ষকের সঙ্গে প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছিলেন, তিনি দূর থেকে দেখেন যে মর্নিং ওয়াকের পোশাক পরিহিত এক ব্যক্তিকে জোর করে একটি মারুতি ভ্যানে তুলে নিচ্ছে। অপহৃত ব্যক্তিকে অত দূর থেকে তার কেমন চেনা চেনা মনে হয়, কিন্তু ঠিক চিনতে পারেননি।..

সংবাদটি অবশ্য আরও বড় করে ফেনিয়ে-ফাঁপিয়ে লেখা। কিন্তু সংবাদের সারমর্মটি সহদেববাবুকে বেশ ভাবিত করল।

এ ছাড়াও ষষ্ঠ পৃষ্ঠায় একেবারে নীচের দিকে একটি ক্ষুদ্র সংবাদ আছে।
আলিপুরে ছিঁচকে চোরের উৎপাত।

কে বা কাহারা বিখ্যাত শিল্পপতি উদয় চৌধুরীর বাসভবনে কাল রাতে প্রবেশ করে তার মূল্যবান স্পোর্ট শর্ট, ব্যাবিটো শার্ট এবং পাওয়ার জুতোজোড়া নিয়ে পালিয়েছে। চৌধুরী সাহেব এখন দিল্লিতে, তার বাড়িতে অন্য কারণে যোগাযোগ করা হলে তাঁর স্ত্রী এই খবরটি জানান।

.

পটললালের অপহরণের সঙ্গে এই ঘটনাগুলো জড়িয়ে দুয়ে দুয়ে চার মেলাতে লাগলেন তীক্ষ্ণধী সহদেব ডাক্তার।

দুয়ে দুয়ে সব সময়ে যে চার হয় না, বহু সময়েই দুই হয়, শিবরাম চক্রবর্তীর এই উপপাদ্যটিও জানা আছে সহদেববাবুর।

এর মধ্যে আরেকটা ব্যাপার দাঁড়িয়েছে ঠিক পরশুদিন, তার এক পুরনো রোগী ঝরিয়ার আতঙ্ক গর্জনপ্রসাদ রাতে ঘুম হচ্ছে না বলে তার কাছ থেকে এক শিশি সম্মুখে শান্তি পারাবার নিয়ে গেছে। গর্জনপ্রসাদ হেঁচকির রোগী, সদাসর্বদা তার হেঁচকি ওঠে, রাতে হেঁচকির জন্যে ঘুম হয় না।

তিনটে ব্যাপার পটলবাবুর কাছ থেকে জানতে হবে, এইরকম ভাবছেন সহদেব ডাক্তার। এমন সময় আবার ফোন এল পটললালের।

সাফারি সুটের বড়সাহেব এসেছে। বড়সাহেবের পরনে খাদির আলিগড়ি পাজামা, হাঁটুঝুল পাঞ্জাবি, সুগন্ধী পান চিবোচ্ছেন আর হেঁচকি তুলছেন।

পটললালকে দেখে বড়সাহেবের একটু খটকা লাগল। এই ছিঁচকে চেহারার লোকটা বিখ্যাত শিল্পপতি উদয় চৌধুরী! এর হালচাল দেখে তো একে বিশাল শিল্পপতি বলে মনে হয় না।

রুপোর কৌটো থেকে আরেকটা পান বের করে মুখে পুরে বড়সাহেব হাতজোড় করে পটললালকে নমস্কার করলেন। তারপর বললেন, সুপ্রভাত চৌধুরীজি, আপকো বহোত তকলিফ হল। আর একটা কাম বাকি, এবার ফোন করে বলে দিন একটা রেশন ব্যাগের মধ্যে টাকাটা ভরে আজ সন্ধ্যা ছটার সময় রেডি রাখতে। কোথায় কাকে কীভাবে দিতে হবে সেটা পরে বলছি।

বাধ্য বালকের মতো পটললাল আবার ডাক্তার সহদেব শুককে ফোন করলেন, সঙ্গে সঙ্গেই সহদেববাবুকে পাওয়া গেল।

পটললাল তাকে বললেন, পুরো পঁচিশ লাখ টাকা আজ সন্ধ্যা ছয়টার সময় দিতে হবে।

সহদেব ডাক্তার বললেন, সে দেখা যাবে। তার আগে আপনি আমার তিনটি প্রশ্নের জবাব দিন। যদি তিনটি প্রশ্নের জবাবই হ্যাঁ হয়, তবে বেশি কথা না বলে শুধু একবার হ্যাঁ বলবেন।

পটল বললেন, প্রশ্ন তিনটে বলুন।

সহদেব ডাক্তার বললেন, এক নম্বর প্রশ্ন হল, এরা কি আপনাকে শেষরাতে আলিপুরের রাস্তা থেকে ধরেছে? প্রশ্ন নম্বর দুই হল, তখন কি আপনার পরনে শর্ট-শার্ট ইত্যাদি ভ্রমণকারীর পোশাক। ছিল এবং সে পোশাক কি আপনি আশেপাশের কোনও বাড়ি থেকে সংগ্রহ করেছিলেন? আমার তৃতীয় ও শেষ প্রশ্ন, আপনাকে গাড়িতে তুলে আপনার নাকে কি ঘিয়ের সঙ্গে ফিনাইল আর রসুনের। রস মেশালে যেরকম গন্ধ হতে পারে সেই রকম গন্ধ শুকিয়েছিল?

পটললাল বিস্মিত হয়ে বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ।

সহদেব ডাক্তার বললেন, তিনবার হা না বলে একবার বললেই হত। সে যা হোক, আপনার সামনে কি কোনও লিডার চেহারার লোক জাপান খাচ্ছে আর হেঁচকি তুলছে? যদি তাই হয়, তাকে ফোনটা দিয়ে বলুন কড়েয়ার ডাক্তার শুক কথা বলবেন।

স্তম্ভিত পটললাল বড়সাহেবের হাতে ফোনটা তুলে দিয়ে বললেন, কড়েয়ার ডাক্তার সহদেব শুক কথা বলবেন।

বড়সাহেব সঙ্গে সঙ্গে টেলিফোনটা নিয়ে রাম রাম ডাক্তারজি বলে বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা বললেন।

.

পটললাল বহাল তবিয়তে ফিরে এসেছেন। বড়সাহেব লোক খারাপ নন। অকারণ হেনস্থা বাবদ তিনি পটললালকে পাঁচশো টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়েছেন। সেই টাকা দিয়ে হাওড়া স্টেশনে ট্রেন থেকে নামার পর, ব্রিজের পাশ থেকে তিনশো টাকা দিয়ে দেড় কেজি ইলিশ মাছ নিয়ে বাড়ি এসেছেন, মিস জুলেখা এতই খুশি হয়েছেন, পটললাল দুদিন কোথায় ছিলেন তাও জানতে চাইলেন না।

পটললালকে যদি আপনারা কেউ চাক্ষুষ দেখতে চান, যেকোনও দিন সকালবেলা তিলজলা চলে যাবেন। তপসিয়ামুখী কর্দমাক্ত গলিপথে যে ব্যক্তিকে দামি শর্ট-শার্ট পরে পাওয়ার শু পায়ে মাতব্বরি চালে হাঁটতে দেখবেন, তিনিই পটললাল পাল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *