স্পর্শ
নভেম্বর মাসের শেষ। এ বছর এখনও খুব একটা শীত পড়েনি। তবে তাপমাত্রা এমনও নয় যে, হল্টার নেক টপ পরে এত রাতের ডান্স পার্টিতে যাবে, অথচ তার উন্মুক্ত পিঠ বা কাঁধ একটুও ঠান্ডার ছ্যাঁকা খাবে না! তার উপর পার্টি হচ্ছে টলি ক্লাবের মূল ক্লাবহাউজের পিছনের খোলা মাঠে। মাথার উপর হিম পড়া আকাশ। যূনী রুপোলি রংয়ের টপটা পরে আহ্লাদি-আহ্লাদি মুখ করে আয়নার দিকে তাকাল। অন্তত রাত দুটো অবধি চলবে বাকার্ডি-ব্লাস্ট ইভ। দুই হাজারের বেশি মানুষ আজ নামবে ডান্স ফ্লোরে। মুম্বই থেকে আসছে ডি জে আকাশ আর সাক্ষী। তুমুল নাচাবে ওরা সবাইকে, নাচিয়ে নাচিয়ে পাগল করে দেবে!
‘ঠান্ডাটা কোনও ব্যাপারই নয়। আজ নেচেই ঠান্ডা তাড়াব,’ বলে উঠল যূনী । হাতে বেশি সময় নেই। অনির্বাণ, রাহুল আর ঋষিকে তুলে নিয়েছে। এবার নেহা আর পদ্মাকে নেবে পদ্মার বাড়ি থেকে। শেষে সদলবলে তাকে পিক আপ করবে। অনির্বাণ এইমাত্র ফোন করে বলল, ‘নেহাকে তুলছি, তুই রেডি তো?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, রেডি’, বলে দিল সে, অথচ এখনও অন্তত মিনিটকুড়ি লাগবে তার সম্পূর্ণ তৈরি হতে। যূনী দ্রুত হাতে ব্লাশারের ব্রাশ ছোঁয়াল গালে। একটু পিঙ্ক, তার উপর গ্লিটার। ঠোঁটেও তাই, শুধু পিঙ্ক গ্লস। কানে জন্মদিনে পাওয়া হিরের দুলটাই পরল। বাবা দিয়েছিল। ভীষণ সুন্দর দেখতে! ও হ্যাঁ, ব্যাগ! সে আবার ওয়ার্ডরোব খুলে মাথা চুলকোতে লাগল, শেষে কালো প্যান্টের সঙ্গে ম্যাচ করে কালো চুমকি বসানো বটুয়াটা তুলে নিল। পায়ে রুপোলি পেনসিল হিল গলিয়ে ঢালাও পারফিউম ছড়াল গায়ে। তারপর গলা চড়িয়ে ডাকল নমিতাদিকে।
নমিতাদি জন্ম থেকে তাকে দেখাশোনা করার দায়িত্বে আছে। সে আসতে যূনী বলল, ‘বলো, কেমন দেখাচ্ছে?’
‘শীত করবে, দেখো!’ বলল নমিতাদি৷
‘ধুস! কলকাতায় আবার শীত! শোনো, ঘরটা একটু গুছিয়ে দিয়ো আর গোছাবার সময় একটু খুঁজে দেখো তো, একজোড়া সবুজ দুল কোথায় যে খুলে রাখলাম!’
‘আবার হারিয়েছ?’
‘উফ! জ্ঞান দিয়ো না। পারলে খুঁজো, না হলে আমিই খুঁজে নেব।’ ‘হ্যাঁ, তুমি যে কত খুঁজে নেবে, তা আমার জানা আছে,’ মুখটা হাঁড়ির মতো করে বলল নমিতাদি। নীচে গাড়ির হর্ন, তারপরই দীনদয়ালের সেই পেটেন্ট গেট খোলার আওয়াজ। ক্যাঁ-অ্যাঁ-চ! যাক বাবা, সে রেডি! যূনী তরতরিয়ে নামতে লাগল তিনতলা থেকে। দোতলার বসার ঘরে সবগুলো আলো জ্বলছে। তার মানে লোকজন আসতে শুরু করে দিয়েছে। যূনী ব্রেক কষল, উঁকি দিল বাবার ঘরে, ‘হাই ড্যাড! অ্যাজ ইউজুয়াল? নাকি নতুন কিছু?’
‘অ্যাজ ইউজুয়াল! মা’র মৃত্যুদিন পালন করার মধ্যে খুব বেশি ভ্যারাইটি না-থাকলেও চলে রে,’ বলল বাবা।
‘আমি জানি বাবা,’ বলল সে।
আসলে আজ বাবার মা’র মানে যূনীর ঠাকুরমার মৃত্যুদিন। প্রতি বছরই এই দিনটা যত্নসহকারে পালন করা হয়। বাবার বন্ধুরা আসে, যূনীর কাকারা, পিসিরাও আসে। অবশ্য এই কাকা-পিসিরা বাবার জ্যাঠতুতো-খুড়তুতো-মামাতো-মাসতুতো ভাইবোন। বাবা নিজে একমাত্র সন্তান। বাবার মা তার ঠাকুরমা ঠিকই, কিন্তু প্রচলিত ‘ঠাকুরমা’ কনসেপ্টটার সঙ্গে যূনীর ঠাকুরমার কোনও মিল নেই। তার কারণ, বাবার জন্ম দিয়েই যে কুড়ি বছরের মেয়েটা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিল, তার আর বয়স বাড়েনি। বাড়তে পারেনি। ভাবতে অবাক লাগে, আর বছর দুয়েক পরে তার নিজেরও কুড়ি বছর বয়স হয়ে যাবে। বাবার মা’র নাম প্রমিতা। প্রমিতার যে ছবিটা যূনী আজন্ম দেখে আসছে, সেটায় প্রমিতার কুড়িরও কম বয়স। প্রমিতা ওই বয়সেই আটকে আছে চিরদিনের মতো। কিন্তু এরকম একটা মারাত্মক স্মার্ট আর সুন্দরী যুবতীকে ‘ঠাকুরমা-ঠাকুরমা’ করে কখনও ডাকা যায়? না ডাকা উচিত? তবে নিজের মাকে যে কখনও দেখতে পায়নি বাবা, আদর পায়নি, কোল পায়নি, এই দুঃখ বাবার এই পঞ্চাশ বছর বয়সেও যায়নি। মাকে হারানোর জন্য বাবা আজও আফসোস করে।
তার মায়ের মতো যূনীও বাবার সঙ্গে চিরকাল এই দুঃখটাকে ভাগ করে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এবারই এই দিনটার কথা সে ভুলে গেল। বন্ধুদের কথা দিয়ে দিল যে সকলে মিলে বাকার্ডি ব্লাস্টে যাবে। মনে পড়ার পর সে ক্যানসেল করতে চেয়েছিল যাওয়াটা, বাবা বাধা দিল। বলল, ‘যূনী এটা আমার জীবন, ওটা তোমার জীবন। প্লিজ ডোন্ট ফিল ব্যাড! যাও, এনজয় করো! তোমার যা বয়স, তাতে তোমাকে এটাই মানায়। তুমি আনন্দ করছ দেখলেই আমরা বেশি আনন্দ পাব।’
সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ। নিশ্চয়ই অনির্বাণ অধৈর্য হয়ে উঠে আসছে।
যূনী বাবাকে জড়িয়ে গালে গাল ঘষল, ‘আমি তা হলে যাই বাবা?’
‘হ্যাঁ, আয়!’ বলে বাবাও নমিতাদির মতো বলল, ‘তোর কিন্তু শীত করবে যূনী, গাড়িতে একটা জ্যাকেট-ট্যাকেট রাখলে ভাল হত!’
সে না-সূচক হাত নাড়ল। এতক্ষণে মূর্তিমান এসে দাঁড়িয়েছেন পাশে।
কালো লেদার জ্যাকেটে দারুণ দেখাচ্ছে ওকে।
‘হাই আঙ্কল!’ বলল অনির্বাণ।
‘হাই অনির্বাণ! ছোট্ট মেয়েটাকে একটু দেখো।’
‘ছোট না আরও কিছু, আঙ্কল, বলল অনির্বাণ।
‘আমার বাবার কাছে আমি সবসময়েই ছোট।’
বাবা এটা করবেই! ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে তার বন্ধুদের এই অনুরোধ করবে। যখনই বেরোয় যূনী, বন্ধুদের সঙ্গে হইহই করতে তখনই।
‘মাকে বোলো, আমি বেরোলাম।’
যূনীর মা তখন স্নান সেরে তৈরি হচ্ছে আজকের শ্রদ্ধাবাসরের জন্য।
তাকে দেখেই রাহুলরা হইহই করে উঠল। সকলে এত চেঁচাচ্ছে যে, কী বলছে বোঝাই যাচ্ছে না! অনির্বাণের পাশে নেহা। যূনী পিছনে উঠে বসতেই অনির্বাণ গাড়ি ছোটাল টলি ক্লাবের দিকে। টলির নিজস্ব কয়েক হাজার সদস্য, তার সঙ্গে আমন্ত্রিত অতিথিরা। সব মিলিয়ে আটটা নাগাদ যূনীরা যখন পৌঁছল, তখনই যথেষ্ট ভিড়। গোল মতো ডান্স ফ্লোরের পাশের জায়গাটা প্রায় দখল হয়েই গিয়েছে। অনির্বাণ ঢুকেই পানীয়ের কাউন্টারের দিকে ঢুঁ মারতে গেল। যূনীর বাবা যেমন এই ক্লাবের সদস্য, অনির্বাণের বাবাও তেমনই এই ক্লাবের সদস্য। ফলে রাহুলরা আজ যূনীদের অতিথি। তবে খাদ্য-পানীয়ের জন্য যে-যার পকেট থেকে টাকা বের করে কুপন কাটবে, এমনটাই ঠিক করা আছে। অতীতেও এরকম করা হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মঞ্চে হাজির হল ডি জে আকাশ। ‘ধুম মচা দে’ গানটা বাজতেই সকলে উত্তাল হয়ে ছুটল ফ্লোরের দখল নিতে। যূনীরাও ঢুকে পড়ল হুড়মুড় করে। সে নাচতে লাগল নেহার সঙ্গে। দারুণ নাচে নেহা, কত্থক শেখে কিনা শাশ্বতীদির কাছে। ঘুরে-ফিরে সকলের সঙ্গেই নাচছে যূনী। নাচতে নাচতে দম নেওয়ার ফুরসত পাচ্ছে না। এখন সে নাচছে অনির্বাণের সঙ্গে। সাইকোডেলিক আলোয় ভেসে যাচ্ছে তারা দু’জন। যূনীদের কারওরই পাবলিক নাইট ক্লাবে যেতে ভাল লাগে না। ওখানকার ভিড়টা পাঁচমিশালি। বেশিরভাগই আসে অল্প পোশাক পরা মেয়েদের দেখতে আর মদ খেতে। ক্লাবের ব্যাপারটা ঠিক সেরকম নয়। এটা হল পরিবার নিয়ে আনন্দ করার জায়গা। আনন্দ, ফুর্তি নয়! এই যেমন এখন এক কোণে রণবীর আঙ্কল আর তাঁর ছেলে যশ একসঙ্গে নাচছে!
কিছু একটা বলছে অনির্বাণ। কী বলছে বোঝা যাচ্ছে না।
‘কী বললি?’ নাচতে নাচতেই জিজ্ঞেস করল যূনী।
অনির্বাণ বলল, কিন্তু যূনী শুনতে পেল না। সে তখন অনির্বাণের কাঁধে দু’ হাত রেখে নিজের কানটা চেপে ধরল অনির্বাণের মুখে, ‘আবার বল।’
‘যূনী, লেট আস মেক লাভ টু ইচ আদার’, বলল অনির্বাণ, ‘তোকে আজ দারুণ হট দেখাচ্ছে, আউট অফ কন্ট্রোল হয়ে যাচ্ছি!’
যূনী গাল টিপে দিল অনির্বাণের, ‘রিয়্যালি?’
‘সত্যি বলছি।’
‘তোর কোনও এক্সপেরিয়েন্স আছে?’
‘একটা আছে। তোর? সত্যি বলবি!’
‘না, নেই।’
‘চল তোকে শেখাই, হাউ টু মেক লাভ।’
‘কখন? কীভাবে?’
‘ওরা নাচুক, আমরা গাড়িতে চলে যাই!’
‘গাড়িতে? ধ্যাৎ!’ হেসে উঠল যূনী।
‘কেন গাড়িটা খারাপ কী?’
যূনী একটু ভাবল, তারপর বলল, ‘আজ নয়, অন্য দিন!’
‘কেন?’
‘আজ তো নাচতে এসেছি, তা-ও একা নয়, এতজন মিলে এসেছি। আজ অন্য কিছু কেন করব? আজ খালি নাচব!’
নাচতে নাচতে দু’জনে ফ্লোরের মাঝখানে চলে এসেছে। যূনী খুবই উৎসাহী হয়ে কথা বলছে অনির্বাণের সঙ্গে। অনির্বাণ তার শরীরকে ভালবাসতে চেয়েছে। তারও এ-ব্যাপারে আগ্রহ আছে। নিজের শরীরকে, পুরুষের শরীরকে সে আবিষ্কার করতে চায়।
ফেরার সময় তাকে নামাতে এসে রাহুল্-নেহারা গাড়িতেই বসে রইল। একা অনির্বাণ এল তাকে সিঁড়ি অবধি এগিয়ে দিতে এবং ল্যান্ডিংয়ে দাঁড়িয়ে তাকে চেপে ধরে চুমু খেল। যূনী তৈরিই ছিল। চলে যেতে যেতে অনির্বাণ বলল, ‘উই উইল অ্যারেঞ্জ সামথিং দিস উইক, যূনী। কিছু একটা ভেবে তোকে জানাচ্ছি। ভুলিস না! পিছিয়ে যাস না।’
দোতলা অন্ধকার। বাবা-মা ঘুমোচ্ছে। সে লাফাতে লাফাতে তিনতলায় উঠল। অনির্বাণ তার দশ বছরেরও পুরনো বন্ধু। সেই স্কুল থেকে দু’জনে দু’জনকে চেনে।
‖২‖
সকালবেলা ব্রেকফাস্ট টেবিলে যূনী দেখল, মা গম্ভীর। সে জিজ্ঞেস করল কী হয়েছে? মা বলল, কিছু না। তার মনে হল মা রেগে গিয়েছে খুব। কিন্তু রাগটা যুক্তিসঙ্গত হচ্ছে কি না তা যেন নিজেই বুঝতে পারছে না। সকালে তার অনেক কাজ ছিল। সে মাস কমিউনিকেশনের ছাত্রী। কলেজ থেকে ফিরতে ফিরতে যূনীর প্রায় চারটে বেজে গেল। দুপুরের খাওয়ার সময় তখন পার হয়ে গিয়েছে। তবু নমিতাদির অনুরোধে সবজি, ডাল, মাছ সবকিছুর উপর চারটে পাঁচটা করে ভাত ছড়িয়ে-ছড়িয়ে খেতে লাগল সে। খাওয়ার পর ফ্রিজ থেকে একটা চকোলেট বের করে খেতে খেতে ফিরল নিজের ঘরে। কম্পিউটার চালু করে চেয়ার টেনে বসবে, ঘরে ঢুকল মা। মুখ দেখে মনে হল না সকালের মতো এখন আর রেগে আছে মা।
‘স্নান করলি না?’ মা জিজ্ঞেস করল।
‘সন্ধেবেলা বেরোব। তার আগে স্নান করে নেব।’
‘কোথায় বেরোবি?’
‘ফোরামে যাব, একটা সিনেমা দেখব।’
‘কে কে?’
‘সবাই! নেহা, অনির্বাণ, সকলে মিলে!’
‘অনির্বাণের সঙ্গে তোর বোধহয় একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, তাই না যূনী?’
যা ধরেছিল, ঠিক তাই। মা কাল কিছু দেখে থাকবে!
‘হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন করলে মা?’ অস্বস্তি নিয়েই মা’র দিকে তাকাল যূনী।
‘কাল আমি তোমাদের একটা বিশেষ অবস্থায় দেখেছি। ইউ ওয়ার কিসিং ইচ আদার।’
শুকনো গলা মায়ের। তার নার্ভাস লাগল। মা আবার বলল, ‘সেইজন্যই আমি জানতে চাইছি, তুমি কি ওকে ভালবাস?’
‘অনির্বাণকে? না তো।’
‘আর অনির্বাণ? ও তোমাকে ভালবাসে?’ মা যেন হতভম্ব।
‘না ওর তরফে কখনও কোনও হিন্ট তো পাইনি! ভালবাসার কথা তোলেনি তো!’
‘তা হলে তোমরা শারীরিক সম্পর্কের দিকে কীভাবে এগোচ্ছ?’ মা বসে পড়ল সোফায়।
‘ভাল না বাসলে কি শারীরিক সম্পর্ক হতে পারে না?’
‘হতে পারে? হতে পারে বলে তুই মনে করিস যূনী?’
‘আমি তোমার সঙ্গে কতটা খোলাখুলি কথা বলতে পারি মা?’
‘তুমি বলো যূনী, সব কথা মন খুলে বলো আমাকে। আমি জানতে চাই তোমার বিশ্বাসটা কী? তোমার দৃষ্টিভঙ্গিটা কী?’
‘আমি কি ভুল করছি? শুধু জীবনটাকে চেনার বা জানার জন্য একটা ছেলের কাছাকাছি যেতে পারি না আমি? সেটা ভুল?’
‘যদি তুমি ভাল না বেসেও কারও সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক পর্যন্ত যেতে পারো, তা হলে সেটাকে ভুল বললে কিছুই বলা হবে না প্রায়। কেন না, কোথায় ভুল তা তোমাকে বোঝানো অসম্ভব। শুধু যদি তুমি কখনও কারও প্রেমে পড়ো, তখনই বুঝবে, বিনা প্রেমে শারীরিক সম্পর্ক কতখানি ভুল ও অসম্ভব।’
‘তুমি কী চাও মা? আমার শরীর পবিত্র থাকুক? তুমি কি চাও আমার শরীর আমি সযত্নে একটা উঁচু তাকে তুলে রাখব যাতে কবে অজানা, অচেনা একটা ছেলে আমাকে বিয়ে করে ধন্য করে? এটা কি খুব খারাপ একটা ধারণা নয়? কারও জন্য নিজের শরীর রক্ষা করে রাখার মধ্যেই কি বেশি শরীর-শরীর গন্ধ লুকিয়ে থাকে না?’
‘আমি শুধু চাই, তোমার জীবনে প্রেম আসুক, যূনী। তুমি ভালবাস কাউকে, তুমি ভালবাসার দরজা দিয়ে শরীরের পূর্ণত্ব আবিষ্কার করো! বিয়েও তো অনেকটা তারই প্রতিচ্ছবি।’
‘শরীর শরীর, মন মন! আমি জানি না এই দুটোকে মিশিয়ে ফেলার আদৌ কোনও প্রয়োজন আছে কিনা’, বলে উঠল যূনী।
এর কিছুদিন পরে, যখন মা’র কথাগুলো ভুলতেই বসেছে, তখন কলেজে একদিন যূনীর সঙ্গে আলাপ হল উদিতার দাদা অভ্যুদয়ের। আলাপটা হল, আর স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তারা এগিয়ে গেল পরস্পরের দিকে। যেন এমনটা ঘটতই বলে মনে হল যূনীর, যেন এটাই ছিল তাদের অবধারিত নিয়তি। এই দেখা হওয়া, পরিচিত হওয়া, বন্ধু হওয়া আর তারপর একটা ভোরে আচমকা আবিষ্কার করা যে সারারাত যূনী মোটেই ঘুমোয়নি, কেবলই অভ্যুদয়ের কথা ভেবেছে সারারাত ধরে। তখন সমস্ত সূক্ষ্মতম প্রেমের কারুকার্য ফুটে উঠল তার মনে৷ সে বুঝল, সে প্রেমে পড়েছে, ভালবেসেছে কাউকে। অথবা ‘কাউকে’ নয়, নির্দিষ্ট একজনকেই, বিশেষ একজনকেই, অভ্যুদয়কে। আর যূনীর আঠারো বছরের জীবনে সেই প্রথম হাতধরার প্রশ্নে, চুম্বনের প্রশ্নে, আলিঙ্গনের প্রশ্নে কল্পনায় যুক্ত হয়ে যাচ্ছে
একটা মুখ। সেটা অভ্যুদয়েরই!
॥ ৩॥
স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে রাইট টার্ন নিতে নিতে অনির্বাণ বলল, ‘অভ্যুদয় কবে ফিরবে ভুবনেশ্বর থেকে?’
‘পরশু! আমি ওকে যা মিস করব না! অভ্যুদয়ের সঙ্গে আমার আলাপ হওয়ার পর এই প্রথম টলিতে একটা গেট-টুগেদার হচ্ছে আর ঠিক এখনই ও শহরে নেই। খুব মনখারাপ লাগছে আমার।’
পদ্মা বলল, ‘ব্যস। হয়ে গেল! শুরু করে দিলি! আমি ভেবেছিলাম, তুই একটু অন্যরকম হবি! কেন রে, বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে না থাকলে কি আনন্দ হয় না? আগে তো আমরা কত ঘুরেছি, হইহই করেছি। সেসব দিনগুলোয় কি তুই এনজয় করতিস না?’
‘তা কেন? আনন্দ করব বলেই তো আসা। কিন্তু ওর সঙ্গে নাচতে পারলে কত ভাল হত বল!’
‘ছাড় ছাড়, সব জানি। আমরা এখন তোর কেউ না!’ মুখ বেঁকিয়ে বলল পদ্মা।
তখন হঠাৎ অদ্ভুত চোখে তাকাল অনির্বাণ যূনীর দিকে, ‘অভ্যুদয় আমাদের যূনীকে কেড়ে নিয়েছে পদ্মা!’
প্রচণ্ড ভিড় টলি ক্লাবে। অনির্বাণকে গাড়ি রাখতে অনেক বেশি কসরত করতে হল। ওদিকে যূনীরা শুনতে পেল, ‘কাঁটা লগা!’ আর আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে হল্লা উঠল অমনই। যূনীরা পড়িমরি করে ছুটল ফ্লোরের দিকে, নাচবে বলে।
নাচতে নাচতে একসময় অনির্বাণ তার কানের কাছে মুখ এনে বলল, ‘আমি কিন্তু আজ তোর সঙ্গে ভীষণ মিসবিহেভ করব। আজ আমি একদম পাগল হয়ে যাচ্ছি।’
সে হাসল জোরে, ‘বদমাইশি করলে এক থাপ্পড় খাবি। যা না, একটু কাবাব-টাবাব কী পাওয়া যাচ্ছে নিয়ে আয় না! আমার খিদে পেয়েছে।’ ‘ওসব পরে হবে, তুই সরে আয় আমার কাছে।’ অনির্বাণ হাত ধরল তার। ঠিক তখনই যেন ঝাঁকুনি লাগল যূনীর শরীরে। অনির্বাণের স্পর্শ তার ভাল লাগল না, অসহ্য লাগল! চকিতে মনে পড়ল তার, সেদিন বলা মায়ের কিছু কথা! হ্যাঁ, অভ্যুদয়ের স্পর্শের চেয়ে অনির্বাণের স্পর্শ কত আলাদা! অভ্যুদয় ছুঁলে সে মুহূর্তে কাতর হয়ে পড়ে, কারণ সেই স্পর্শ যূনী নিজের প্রেম দিয়ে রচনা করেছে। অনির্বাণ সেখানে কিছুই না!
যূনী রেগে গেল, ‘প্লিজ হাত ছাড়, অনির্বাণ!’
‘তোর সঙ্গে আমার কী কথা ছিল ভুলে গিয়েছিস, যূনী?’
‘গো টু হেল অ্যান্ড ডোন্ট টাচ মি,’ বলে এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ডান্স ফ্লোর ছেড়ে হনহন করে ঘাসে নেমে এল যূনী। আর তারই শেষতম বাক্যের প্রতিধ্বনির মতো তখন বেজে উঠল সেই গানটা, যাতে একটা মেয়ে বারবার বলে ওঠে, ‘ডোন্ট টাচ মি, ডোন্ট টাচ মি, ডোন্ট টাচ মি!’
যূনী এগোতে লাগল পানীয়ের কাউন্টারের দিকে। গলাটা একদম শুকিয়ে গিয়েছে, মাথাটা ঝাঁ-ঝাঁ করছে।
ঢকঢক করে জল খেল সে। তারপর একটা মকটেল নিয়ে ঘাড় ঘোরাতে দেখল, অনির্বাণ।
সে তর্জনী তুলল, ‘ডোন্ট ডেয়ার টাচ মি, অনির্বাণ!’ পিছিয়ে গেল যূনী দু’পা।
‘ওরকম ঝটকা দিলি কেন? আই ফেল্ট ইনসালটেড,’ চেঁচাল অনির্বাণ।
কিছুক্ষণ কোনও কথাই বলতে পারল না যূনী। ‘আমি তোকে মলেস্ট করছিলাম না অন্তত। আমি ভেবেছিলাম, তোর ভাল লাগছে,’ আবার বলল ছেলেটা।
যুনী তাকাল অনির্বাণের দিকে। তার দু’চোখে জল, ‘সত্যিই তোর কোনও দোষ নেই রে! শোন অনির্বাণ, একটা সময় আমি কাউকে ভালবাসতাম না। অনেকটা মুক্ত পাখির মতো ছিলাম। কিন্তু এখন আমি অভ্যুদয়কে ভীষণ ভালবাসি। এখন আমি পুরোপুরি ওর হয়ে গিয়েছি। কেউ জোর করেনি আমাকে, আমি নিজেই এটা করেছি। আর তাই এখন আমি নিজেকে প্রোটেক্ট করতে চাই ওর জন্য— আমার শরীর, মন, সবকিছুই ওর হয়ে গিয়েছে,’ যূনী হাত রাখল পুরনো বন্ধুর হাতে, ‘এটা একটা চয়েস বলতে পারিস! আর কারও স্পর্শ আমার আর ভাল লাগবে না। আমি শিয়োর, তুই কাউকে সত্যি সত্যি ভালবাসলে তোরও এটা হবে। তখন আমি বললেও তুই আমার কাছে ঘেঁষবি না!’
অনির্বাণ শান্ত হয়ে গিয়েছে, যেন সব বুঝে গিয়েছে, যা যূনী বলতে চায়। ‘তুই খুব ভাল মেয়ে যূনী, সত্যিই খুব ভাল মেয়ে। কিন্তু হতে পারে আমি তোকে বোঝাতে পারিনি যে, এতগুলো বছর ধরে আমিও তোকেই ভালবেসেছি।’
উনিশ কুড়ি, শরৎ ২০০৫