মল্লার আর মল্লিকা শেরাওয়াত

মল্লার আর মল্লিকা শেরাওয়াত

মল্লারের কথা

আমার ঘর থেকে টুলটুলদির ঘরটা অনেকটাই দেখা যায়। কখনও যদি মোটা ভারী পরদাগুলো টেনে দিতে ভুলে গিয়েই পোশাক বদলায় টুলটুলদি কিংবা সিগারেট ধরায় অথবা গৌরীশদাকে চুমু খায় জড়িয়ে ধরে, আমি দিব্যি সেসব দৃশ্য আমার বিছানায় শুয়ে বসে দেখতে পাই! পোশাক বদলানো বা মনোজকাকা, সহেলি কাকিমাকে লুকিয়ে একটু সিগারেট টানা বা আরও ছোট ছোট কিন্তু অদ্ভুত অদ্ভুত ব্যবহার, যা একজন যুবতী নারী নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে ঘটিয়ে থাকে— দেখতে দিব্যি ভালই লাগে আমার। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় যখন গৌরীশদা আদর করে টুলটুলদিকে কিংবা টুলটুলদি নানাবিধ দুষ্টুমি করে গৌরীশদার সঙ্গে, তখন। আমার যেন সেগুলো দেখতে একটু অস্বস্তি-অস্বস্তি হয়। সামান্য জ্বালা-জ্বালা করে বুকের ভিতরটা!

এমনিতে গৌরীশদা আমার হট ফেভারিট। আমার কেন, আমার বয়সি এ পাড়ায় যত ছেলেমেয়ে আছে, তাদের সকলেরই দারুণ পছন্দ গৌরীশদাকে। পড়াশোনায় ব্রিলিয়ান্ট, টল, হান্ডসাম, খেলাধুলোয় চৌকস, সেই সঙ্গে গুড অর্গানাইজার। পিকনিক বলো, স্পোর্টস বলো, ২৩ জানুয়ারি বা সরস্বতী পুজো বলো— রাতুলদা, পকাইদারা সব গৌরীশদার চেনা। আমার, আমাদের বাবা-মা’রা সব গৌরীশদার বশ। এই রাজা বসন্ত রায় রোড, লেক রোড, লেক টেরাস, রাজা নন্দকুমার রোড মিলিয়ে-মিশিয়ে যে ছড়ানো ছিটোনো পাড়াটা, তাতে গৌরীশদার তুলনা মেলা ভার। টুপিতে সর্বশেষ পালক হিসেবে যুক্ত হয়েছে স্কলারশিপের টাকায় যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে যাওয়ার প্রবল হাতছানি প্রত্যাখ্যান করে মুর্শিদাবাদের এক প্রত্যন্ত গ্রামে সরকারি চাকরি নিয়ে চলে যাওয়া এবং এক সমাজসেবী ডাক্তার হিসেবে নিজের পরিচয় প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়া। যদিও এই পর্যন্ত এসে কেউই আর ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না গৌরীশদাকে। আমার মা সেদিনই বাবাকে বলল, ‘গৌরীশকে তো এতদিন খুব ম্যাচিওর্‌ড ভাবতাম। এখন মনে হচ্ছে, একদম ছেলেমানুষ!’ বাবা বলল, ‘মুর্শিদাবাদের ডাক্তারের সঙ্গে সহেলি বউদি নিজের মেয়ের বিয়ে দেবে না! গৌরীশকে আমেরিকা যেতেই হবে!’

রবিবারের সকালের আড্ডায় এই না-বুঝতে পারাটাই যখন একটু খোলসা করে বলে বসল সুপর্ণ, কী খিস্তিই না করল গৌরীশদা ছেলেটাকে! এমনকী বলল, ‘আমাকে, রামঅবতার ভাবিস না। আমিও তোদেরই মতো কেরিয়ারিস্ট। এটা আমার কেরিয়ার!’ এরপরই প্রতি রবিবারের মতো টুলটুলদি হাত নেড়ে সেই বিখ্যাত ভঙ্গিমায় ডাক দিল গৌরীশদাকে আর গৌরীশদা মুহূর্তে হাওয়া। টুলটুলদিকে যে আমি কবে থেকে এত ভালবেসে ফেললাম, জানি না। সম্ভবত কয়েকবছর আগে যখন এই তিনতলার ঘরটায় বদলি করে দেওয়া হল আমায় আর আমি আবিষ্কার করলাম যে টুলটুলদির একান্ত নিজস্ব বলতে যা, তা অনায়াসে আমার দৃষ্টিপথে এসে পড়ছে, তখনই দেখতে দেখতে আর বড় হতে হতে এক ধরনের বুঝে ওঠা একটা মেয়েকে, একেবারে তার অগোচরে, তার বিনা সান্নিধ্যে বুঝে ওঠা, যাকে বুঝে পাওয়াও বলা যেতে পারে, বোধহয় আমাকে প্রেমের দিকে ঠেলে দিল। হয়তো এই প্রেম তৈরি হওয়া ছাড়া হিউম্যান ইনস্টিংক্ট আর অন্য কোনও নিষ্পত্তির কথা জানে না বলেই আমি প্রেমে পড়লাম টুলটুলদির।

রাত দশটার পর খেয়েদেয়ে পড়তে বসা টুলটুলদির হ্যাবিট। যাদবপুর। ফিজিক্স ফাইনাল ইয়ার, এম এসসি। বেশ একটা গেরামভারী ব্যাপার। ঘরে ঢুকল। দরজা বন্ধ করল। চুল আঁচড়াল পদ্মাসনে বসে। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে ফোনে সামান্য বাতচিত। এরপর কোনওদিন বিঠোভেন, মোৎসার্ট, কোনওদিন বেগম আখতার, ভীমসেন জোশী পেঁজা তুলোর মতো বাতাসে ছেড়ে দিয়ে টেবিলল্যাম্প জ্বেলে দুটো-একটা বইয়ের পাতা উলটানো। উলটাতে উলটাতে নিজেও ঘুমে উলটে পড়া। কিন্তু সে ঘুম বড় জোর এক ঘণ্টার। টেবিলে মাথা দিয়েই এপাশ-ওপাশ। দেখবার মতো। ঘুম ভেঙে ধড়মড়িয়ে উঠে সিগারেট ধরানোটাও দেখার মতো। কিন্তু এরপর টুলটুলদিকে আর চেনা যায় না। বা টুলটুলদিও কাউকে দেখে চিনতে পারবে বলে মনে হয় না। রাত দুটো-তিনটে তো কোনও ব্যাপার নয়। প্রায় দিনই ভোর অবধি টেনে দেয় টুলটুলদি। পড়ছে তো পড়ছেই! বসে বসে এসব দেখতে দেখতে একদিন আমি নিজেই ঠিক করলাম, রথ দেখা আর কলা বেচা দুটোই একসঙ্গে সেরে ফেলা যায়, যদি আমি বিছানায় যাওয়ার সময় ক’টা বই বগলে নিয়ে যাই! ব্যস, যেমন ভাবা, তেমন কাজ। হেডবোর্ডের সঙ্গে ছোট্ট একটা ল্যাম্প লাগিয়ে নিয়েছিলাম। সে বছর থেকে আমার রেজাল্ট রাতারাতি ভাল হতে শুরু করল। আমার দিকে পিছন ফিরে বসে পড়ছে টুলটুলদি, আমিও পড়ছি। একা লাগছে না একটুও। যা হয় আমাদের সাধারণত। সবসময় বন্ধুবান্ধব, কিন্তু বইয়ের পাতার ভিতরের খুদে খুদে অক্ষরগুলোর মুখোমুখি কী ভীষণ একা লাগে যেন! অথচ টুলটুলদি যেন আমার সেই কঠিন পরিশ্রমের ভাগ নিয়ে নিচ্ছিল!

ভীষণ গরমে জামাকাপড় খুলে ফেলল টুলটুলদি, আমিও খুলে ফেললাম। শীতে কম্বলমুড়ি দিয়ে পড়তে বসল, আমিও তাই। শুনতে লাগলাম খাঁ সাহেবকে রাত-বিরেতে।

আজকাল আমি যেন আর নিজেকে টুলটুলদির কাছে লুকোতে পারি না।

কেমন ভয়-ভয় করে। কখন কী করে বসব। গোর্কি সদনে ডকু ফিচারের যে ফেস্টিভ্যালটা হচ্ছিল, তাতে একদিন আমাকে পাকড়াও করে নিয়ে গেল টুলটুলদি। বলল, ‘মল্লার, তুই তো চাইকভস্কি এত ভালবাসিস, আজ বিঠোভেন আর চাইকভস্কির ওপর দুটো ছোট ছোট ফিল্ম দেখাবে ফেস্টিভ্যালে। দেখবি চল! ভাল লাগবে।’

গেলাম। চাইকভস্কি ছিল পরে। আগে বিঠোভেন। শুনতে শুনতে মনটা চলে গেল যেন সুরের ভিতর। পাশে টুলটুলদি। অলীক লাগছিল সব। টুলটুলদি এক-একসময় চেপে ধরছিল আমার হাত। (কাঁটা দিচ্ছিল আমার গায়ে।) আর যখন ফিল্মটার শেষে চাইকভস্কির দেহটা পড়ে আছে যে দৃশ্যে, আত্মহত্যা না অসুখে মৃত্যু কেউ জানে না, কলঙ্ক আর সুর যেন তখন মিলেমিশে যাচ্ছে আর আমার মাথার ভিতর যেন বনবন করছে কম্পোজিশনগুলো। ওই যে ফোর্থ সিম্ফনিটা, ইনস্যানিটির উপর একটা মুভমেন্ট, ডিপ্রেশনের উপর একটা মুভমেন্ট, ওই পিসগুলো পাগল করে দিয়েছে আমাকে! গলার নলি বেয়ে বুঝতে পারছি উঠে আসছে একটা কম্পন, ‘টুলটুলদি আমি তোমাকে ভালবাসি’, শব্দগুলো যেন মুখ ফেটে বেরিয়ে যাবে যে-কোনও মুহূর্তে।

বলিনি, সম্বরণ করেছি। সেই থেকে খুব অস্বস্তিতে আছি! ভালও লাগে না কিছু। ‘ভালবাসি’ এরকম একটা অসামান্য সত্যি কথা কোনওদিনও বলাই হবে না টুলটুলদিকে?

শ্রীপর্ণার কথা

আমার ঘর থেকে মল্লারের ঘরটা অনেকটাই দেখা যায়। ঘরটা অধিকাংশ সময় ফাঁকাই পড়ে থাকে। রাত ন’টা-দশটা না-বাজলে বাবু বাড়ি ফেরেন না সচরাচর। আমিও অবশ্য সারাদিন বাড়ি থাকি যে, তা নয়। কলেজ, টিউশন। ব্যস্তই বলা যায়। মা বলে, ‘তোদের জীবনটা যে কী হয়ে গেল। দম নেওয়ার ফুরসত নেই!’ সেই ছেলেবেলা থেকেই মল্লারের তুলনায় আমি খারাপ স্টুডেন্ট। মা আর শ্রীরূপা আন্টির মধ্যে নাকি আমাদের রেজাল্ট নিয়ে বেশ একটা রেষারেষিও ছিল এককালে। তবে স্কুল ফাইনালের পর সব ঠান্ডা। বোঝা গিয়েছে, মল্লার লম্বা দৌড়ের ঘোড়া। আর আমি এই ফিলজফি অনার্স, এম এ স্কুল সার্ভিসের টাট্টু। তারপর বিয়ে-থা ইত্যাদিতে যদি কিছু বেশি নম্বর তোলা যায়। যেমন তুলল আমাদের মোনালিসা। নামটা ছাড়া জন্মকর্ম সবই সি গ্রেডের। কিন্তু বিয়ে হল পয়সাওয়ালা ঘরে। ভারত জুড়ে বিড়ির ব্যবসা। মোনালিসা বলল, ‘বিড়ির ব্যবসা তো কী হয়েছে রে? আমার হবু বর জানিস ফাইভ ফিফটি ফাইভ ছাড়া কিছু খায় না!’

এখন মোনালিসা হন্ডা সিটি চড়ে আসছে। চুলটায় সোনালি রং করেছে। গৌরীশদার উদ্যোগে যে খিচুড়ি উৎসবটা হল সেদিন রাতুলদাদের ছাদে তাতে মোনালিসার প্রসঙ্গে আমি একটু নাক সিঁটকোতে মল্লার খুব মাপল আমায়।

‘বিড়ি বানায় তো কী হয়েছে? খালি নাকে খত দিয়ে অন্যের চাকরি করলেই তোদের খুব ভাল লাগে, না? শোন, বিড়ি বিক্রি করে কারও যদি এত টাকা হয়ে থাকে, তা হলে মুখ টিপে হাসার আগে ভাব যে, বিড়িটা প্রচুর বিক্রি না হলে টাকাটা হত না! বিক্রি হওয়া সম্ভব করতে কিন্তু বুদ্ধির দরকার। ব্যবসার বুদ্ধি৷ বিজনেস ম্যানেজমেন্ট যাকে বলে আর কী! প্রোডাক্টটা বিড়ি না পারফিউম, তাতে কী আসে যায়! আ প্রোডাক্ট ইজ আ প্রোজাক্ট! বানানো হল, মার্কেটে গেল, লাভ তুলে আনল, বুঝলি!’

আমি রেগে গিয়েছিলাম, ‘তুই নিজেকে খুব বিজ্ঞ বলে মনে করিস না মল্লার?’

‘তুই উলটো-পালটা কমেন্ট করা বন্ধ কর শ্রীপর্ণা। বয়েস তো অনেক হল।’

মল্লার কি আমাকে হিংসুটে ভাবল? মোনালিসাকে আমি হিংসে করছি ভাবল? না রে মল্লার, আমি মোনালিসাকে হিংসে করছি না। মোনালিসাকে হিংসে করে আমি কী করব? আমি কি পয়সাওলা বর খুঁজছি বল? আমি, আমি সেই কবে থেকে তোকে ভালবাসি রে মল্লার! সেই এক বছর সরস্বতী পুজোয় তোর সঙ্গে আমার খুব ঝগড়া হল, তুই কথা বন্ধ করে দিলি। তারপর বুঝলাম তোর সঙ্গে কথা না বলে থাকা কী কষ্টের! আমি যেচে গিয়ে ভাব জমালাম তোর সঙ্গে!

আমি খুব সাধারণ একটা মেয়ে রে মল্লার। আমার কোনও স্পেশ্যালিটি নেই! লুক্‌স, অ্যাটিটিউড, কেরিয়ার, ব্যাকগ্রাউন্ড সবই না বলার মতো। জীবন-দর্শনটাও ম্যাড়মেড়ে। এখনও দুঃখের সিনেমা দেখলে কেঁদে ফেলি। প্যান্টস, টাইট গেঞ্জি পরলে আমাকে নেহাত ক্যাবলা দেখায়। কোঁকড়ানো চুলে কোনও হেয়ার স্টাইল মানায় না। বাসের মধ্যে অচেনা লোকজনের সামনে হেসে হেসে মোবাইলে কথা বলতে পর্যন্ত কী লজ্জা লাগে। অথচ দ্যাখ, সাউথ পয়েন্ট স্কুলে তো আমিও পড়েছি। তুইও পড়েছিস।

কখন থেকে আমি একা একা মল্লারের সঙ্গে বকবক করে যাচ্ছি! লক্ষই করিনি, যার জন্য তীর্থের কাকের মতো প্রতিদিন অপেক্ষা করি, সে ইতিমধ্যেই নিজের ঘরে এসে গিয়েছে। এবার একটা সিগারেট ধরাবে। তারপর বইপত্তর খুলবে। সারারাত পড়ে মল্লার। মাঝে মাঝে এমন উলটো মুখো হয়ে বসে মল্লার যে, আমি শুধু ওর পিঠটাই দেখতে পাই। আলো-ছায়ার কারসাজিতে পিঠটা চূড়ান্ত আকর্ষক দেখায় যেন! ইচ্ছে করে, উপর থেকে নীচ অবধি কঠিন মেরুদণ্ডে চুমু খাই, নাক ঘষি! মল্লার পড়ে, আমি ঘুমিয়ে পড়ি। হঠাৎ ঘুম ভাঙলে উঠে তাড়াতাড়ি জানলার আড়ালে দাঁড়াই। দেখি মল্লার চুপ করে কাকে যেন দেখছে। দেখবে আর কাকে! ভাবছে কিছু নিশ্চয়ই। কিন্তু ওরকম মগ্ন মূর্তি দেখলে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। ইচ্ছে করে, রাস্তার ওপার থেকেই চিৎকার করে ডাকি। ডেকে বলি, ‘মল্লার শোন, আমি তোকে ভালবাসি। শোন মল্লার, শুনে রাখ!’

না হয় নাই মূল্য পেল আমার ভালবাসা! না হয় প্রত্যাখ্যাত-ই হলাম। কিন্তু তা বলে ভালবাসি যে, এই কথাটা একবার বলব না পর্যন্ত? এই এত সত্যি কথাটা, অহংশূন্য, ঋজু কথাটা হারিয়ে যাবে এভাবে? পৃথিবীতে কোথাও একটু জায়গা পাবে না?

মল্লারের কথা ভাবলে যে কী কষ্ট হয় আজকাল আমার। ধ্রুবতারার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কাঁদি। কেঁদে যে কী সুখ পাই! বোকা বোকা, তাই না?

মল্লারের কথা

শেষ পর্যন্ত টুলটুলদির মা’র হস্তক্ষেপেই গৌরীশদা গ্রামের ডাক্তারির রোমান্টিকতা ত্যাগ করে স্টেটসে যেতে রাজি হল! রাজি হল মানে, রাজি হতে বাধ্য হল। নইলে আমার বাবার কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলিয়ে দিয়ে টুলটুলদির মা, মানে সহেলি কাকিমা একেবারে বেঁকে বসেছিল গৌরীশদার সঙ্গে টুলটুলদির বিয়ের কথায়। গৌরীশদা অবশ্য কালও রসনায় কফি খেতে এসে চোখ মেরে বলল ‘ঝামেলা না বাড়িয়ে বিয়েটা তো করে নিই। তারপর কোথায় থাকব না-থাকব, সেটা আমার আর টুলটুলের ব্যাপার! সহেলিমাসি কি চিরদিন মেয়েকে কন্ট্রোল করবে?’

দেখতে দেখতে গৌরীশদার যাওয়ার দিনটা এসে গেল। পরশু সকালের ফ্লাইটে সিঙ্গাপুর। সেখান থেকে আমেরিকা। আজ সন্ধেবেলা টুলটুলদির ঘরে আমাদের তাই একটা গেট-টুগেদার মতো ছিল। টুলটুলদির দেখলাম, মন মেজাজ ভাল নেই। দু’-তিনদিন ধরেই তাই অবশ্য। আমি জানি। শুধু তো প্রেমিক নয়, গৌরীশদার মতো বন্ধুর সঙ্গে এতদিনের বিচ্ছেদ! কাল টুলটুলদি সারা রাত সিগারেট খেল। চোখের জল মুছল আর ফোনে কথা বলল। আমার সামনে পরীক্ষা, কী করব, আমিও পড়তে পারলাম না। একটার পর একটা সিগারেট খেলাম। খুব ইচ্ছে হল, টুলটুলদির চোখের জল গড়িয়ে পড়া গালে চুমু খাই একটার পর একটা। বুকে টেনে নিয়ে একটু সান্ত্বনা দিই। এত কাঁদছ তুমি টুলটুলদি, আমি কি তোমাকে একটু আদরও করতে পারি না? তুমি কি সনাতন নারীর মতো, একজনকে ভালবাস বলে, অন্যের পবিত্রতম স্পর্শও তোমাকে অপবিত্র করে দেবে বলে ভাবো?

এতদিন আমার কোনও রাগ ছিল না, অভিমান ছিল না। কাল নিজের ঘর থেকে সমস্ত রাত টুলটুলদিকে কাঁদতে দেখে আমার মধ্যে যেন জন্ম নিল রাগ। গাঢ় অভিমান দপদপ করতে লাগল ভিতরে। জীবনে প্রথমবার মনে হল ‘দূর কী করলাম, কেন এত ভালবেসে ফেললাম মেয়েটাকে! ফালতু ফালতু কষ্ট পাওয়ার কোনও মানে হয়!’

সন্ধেবেলার গেট-টুগেদারে সেই অভিমানই বেরিয়ে এল যেন। আমি নিজেও ভাবিনি, এমন কাণ্ড করব। টুলটুলদির দুঃখিত মনের উপর আরও আঘাত দিয়ে প্রতিশোধ নেব নিজের ব্যর্থতার!

কী কথা থেকে যেন কথাটা উঠল, গৌরীশদা চেপে ধরল শ্রীপর্ণাকে, ‘অ্যাই বল, প্রেম করতে হলে ঠিক কেমন ছেলে পছন্দ তোর? কেমন ছেলে হলে একেবারে দেখামাত্র প্রেমে পড়ে যাবি!’

শ্রীপর্ণা লাফিয়ে উঠল, ‘জাকির হোসেন! জাকির হোসেনকে আমি সেই কোন ছেলেবেলা থেকে ভালবাসি!’

‘যাক, তাও ভাল,’ বলল টুলটুলদি! ‘আমি তো ভেবেছিলাম সলমন খান বলবি!’

শ্রীপর্ণাটা চিরদিনের ধুস। বলল, ‘খারাপ কী, আমার তো দারুণ লাগে!’ নাক কুঁচকে উঠল টুলটুলদির ‘সত্যি, তোর কোনও স্ট্যান্ডার্ড নেই শ্রীপর্ণা!’

আমার যেন মেজাজটা বিগড়ে গেল অমনি। গৌরীশদা যেই বলল, ‘এই যে ছুপা রুস্তম, তোমার পছন্দটা শুনি? নিশ্চয়ই তোর ইউনিভার্সিটির সেই মোটা পাওয়ারের চশমা চোখে পাগলি-ছাগলি ম্যামটাকেই মন দিয়ে বসে আছিস তুই।’

আমার কী হল জানি না, বললাম, ‘না না, ওসব বোগাস মাল নয়। মেয়ে মানে এখন একজনকেই বুঝি, মল্লিকা শেরাওয়াত! ওরকম কাউকে পেলে হয়!’

ভেঙেচুরে গেল টুলটুলদি যেন! বলল, ‘কী বলছিস তুই মল্লার। শেষে এই দাঁড়াল তোর টেস্ট? গৌরীশ তুমি চলে গেলে আমি সত্যি একদম একা হয়ে যাব। এদের সঙ্গে কি কোনও কমিউনিকেশন হয় বলো?’

আমি হাসলাম, বললাম, ‘কী বলছি তা তুমি কী বুঝবে টুলটুলদি!’

শ্রীপর্ণার কথা

মল্লিকা শেরাওয়াতকে কি কেউ প্রেমিকা হিসেবে, বন্ধু হিসেবে, পরিবারের একজন হিসেবে ভাবতে পারে? চাইতে পারে? মল্লার কেন তবে এরকম অদ্ভুত দাবি করল? আমার তো প্রথমে নিজের কানকে বিশ্বাস হয়নি! তারপর বাড়ি আসতে আসতে হঠাৎ মনে হল, আমি কি জানি না কখন এরকম অদ্ভুত কথা বলে মানুষ? কখন বলে?

ও ধ্রুবতারা, আজ রাতে যদি কাঁদি আমি, ভেবো কাঁদছি মল্লারেরও হয়ে, শুধু নিজের জন্য নয়!

উনিশ কুড়ি, ১৯ মার্চ ২০০৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *