সাথিয়া

সাথিয়া

ট্রেড মিলে তার ২০ মিনিট ছোটার কোটাটা প্রায় শেষ করে এনেছিল পিউ। কিন্তু যেই নিশ্বাসের হলকার মধ্যে দিয়ে তীব্র ‘চাওয়াকে’, ‘ওয়ান্ট’কে একটু একটু করে বের করে দেওয়ার মতো আদনান সামির গলায় ‘এই উড়ি উড়ি উড়ি, এই খোয়াবোঁ কি পুরি, এই রং রং গিরি, এই সারি রাত উড়ি’ গানটা তার কান বেয়ে ঢুকে ছড়িয়ে পড়ল তার শরীরের আনাচকানাচে, সে থামতে ভুলে গেল এবং ‘নাগিড়া নাগিড়া নাগিড়া নাগাড়ে নাগাড়ে নাগিড়া’-র দ্বারা তাড়িত হয়ে নতুন উদ্যমে আবার, আবার, ট্রেড মিলের উপর দিয়ে ছুটতে শুরু করল। এবং তার কপাল থেকে, কানের পিঠ থেকে, চিবুক থেকে টপাটপ ঘাম ঝরে পড়তে লাগল রবারের চলন্ত ম্যাটটার উপর। এই গানটা পিউয়ের বিশেষ প্রিয়! সে ‘সাথিয়া’ সিনেমাটা দ্যাখেনি। ফলে নিজের একটা স্বপ্নের সঙ্গে ইচ্ছেমতো এই গানটাকে সে ব্যবহার করতে পারে। গানটা শুনলেই তার মনে হয় যে, একদিন এই গানটার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসবে তার প্রেমিক, তার ভালবাসা! কখনও কখনও মনে হয়, এই গানটা তার চুলের মধ্যে মুখ ডুবিয়েই কেউ গাইছে বোধহয়, এত জীবন্ত!

আয়নার মধ্যে নিজেকে পাগলের মতো ছুটতে দেখে পিউ ফিক করে হেসে ফেলল। অতঃপর চোখ সরাতে গিয়ে চোখাচোখি হয়ে গেল মানব মেহরোত্রার সঙ্গে। ভীষণ রাগ হল পিউয়ের! ছেলেটার কি খেয়েদেয়ে কাজ নেই? এই ভোরে উঠে এত কষ্ট করে জিমে এসেছে মেয়ে দেখতে? কেন, দিল্লিতে কি মেয়ের অভাব পড়েছিল যে, কলকাতা ছুটে আসতে হল? রিডিকিউলাস! দৌড়তে দৌড়তে ভাবল পিউ। ভাবতে গিয়ে সে অন্যমনস্ক হয়ে গেল এবং গানটার অদ্ভুত শেষটাকে এনজয় করতে পারল না। যে নেশা-নেশা রেশটা গানটা শেষ হওয়ার পরও থাকে, সেটাও উবে গেল। এফ এমে আর-একটা গান শুরু হল। ‘ধুস’ বলে নেমে এল পিউ। সে দরদরিয়ে ঘামছিল। তোয়ালে দিয়ে ঘাম মুছে বোতল থেকে দু’ ঢোক জল খেয়ে সে মানবকে পাশ কাটিয়ে এগোল সাইক্লিং করতে। ঊর্ধ্বশ্বাসে চাকা ঘোরাতে ঘোরাতে পিউ আড়চোখে দেখে নিল মানবকে একবার। ডন দিচ্ছে।

মাস দুয়েক হল তাদের জিমে জয়েন করেছে ছেলেটা। প্রথম দু’-একদিন পিউ যখন বেরোবে বেরোবে তখন এন্ট্রি নিত মানব। তারপরই সময়টা চেঞ্জ করে একেবারে পাক্কা টাইমে টাইম! তার সঙ্গে ঢুকবে, তার সঙ্গে বেরোবে। দু’-একদিন কথাও বলেছিল যেচে। নাম, ধাম, কী করা হয়, পুলে কবে জল ছাড়বে, সিট-আপটা আস্তে আস্তে সময় নিয়ে করলেই বেশি এফেক্টিভ হবে— পিউ একদম পাত্তা দেয়নি। একটা-দুটো কথার ছুতো ধরে শেষে প্রেম নিবেদন। ‘কী বোরিং’—নিজেকে বলল পিউ। ছেলেবেলায় সে ভীষণ ন্যাম্বি-প্যাম্বি ছিল। মোটাসোটা, চাইনিজ কাট হেয়ারস্টাইল। স্কুলে টিফিন বক্স খুলে পেত ছানা, ডিম সেদ্ধ আর আঙুর। কিংবা আপেল, রোজ রোজ। কলেজে উঠেই সেটা রিয়ালাইজ করল! নিজেই নিজেকে ভ্যাঙাত তখন মুটকি বলে। জেনে বুঝে আঠাশ সাইজের কাপরি কিনে আনত নিজেকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য। দেন শি কেম টু দ্য জিম, নাউ শি ইজ ফিট অ্যান্ড ট্রিম! যেন বসন্ত এল জীবনে। সব মেদ খসে পড়ল। নিজেই নিজেকে চিনতে পারল না পিউ। অবিশ্বাস্য! যেন একটা নতুন জন্ম! তার পাঁচ-সাত হাইটে কি কম ফ্যাট জমিয়েছিল সে? নামাতে কী কষ্ট! কী কষ্ট! যত কষ্ট, ততই আনন্দ!

কিন্তু তারপর? ওরকম ফিগার, অতখানি গ্রেস দেখে যা শুরু হল চারপাশে! যে দেখে, প্রেমে পড়ে যায়। বিয়েবাড়িতে যাও, পার্টিতে যাও। একটা সুন্দর মেয়ে নিজের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ সেটা সহ্য করতে পারে! ছেলেরা, ছেলেদের বাবা-মা-দিদিরা— শূন্য স্থানে বাতাস ছুটে আসার মতো সব ছুটে আসে। অবশ্য উলটো ঘটনাও ঘটে! যেমন হল তাদের ‘সরোবর’ বিল্ডিংয়ের প্রমিতদার সঙ্গে! দারুণ চাকরিটা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চারজন বান্ধবীর মা অল্টারনেট দিনে লাঞ্চ-ডিনার খাওয়াতে শুরু করে দিলেন। বাড়িয়ে বলা নয় বাবা, এটাই ফ্যাক্ট!

এবং এই হিসেবটাই চালাচ্ছে সবাইকে। কিন্তু পিউয়ের কিছুতেই সেটা মেনে নিতে ইচ্ছে হয় না। সে ভাবে যে, একটা ঘূর্ণিঝড় কোথাও থেকে ছুটে আসবে একদিন! পাগলের মতো ভালবেসে তাকে তছনছ করে দেবে। বোঝাবে তাকে ভালবাসা কী? ভালবাসা কেমন? সেই ভালবাসাকে বুঝতে যদি পিউয়ের এই বাস্তব জীবনটার সর্বনাশও হয়ে যায়, হোক— তবু সে গভীরভাবে আস্বাদ নেবে তেমন প্রেমের! খুব ঘেমেছে মানব, তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে তাকে দেখছে। যেন দেখতে দেখতে অনেক কিছু ভেবে নিচ্ছে। নাহ, শুধুমুধু বিরক্ত হয়ে নিজের পিস অফ মাইন্ড নষ্ট করার মানে হয় না— দেখছে দেখুক। পিউ মুখ ঘুরিয়ে নিল।

ফেরার পথে কী মনে হতে লিফ্‌টে না উঠে সিঁড়ি দিয়ে লাফাতে লাফাতে উঠছিল পিউ! মিষ্টুদিদের ফ্ল্যাটের দরজা খোলা দেখে যারপরনাই বিস্মিত হল। কী আশ্চর্য! মিষ্টুদিরা এসেছে বুঝি? ভীষণ আনন্দে নেচে উঠল তার মনটা।

সে ঢুকে পড়ল ভিতরে। কিন্তু কাউকেই দেখতে পেল না। তবে অনেক আনপ্যাক্‌ড লাগেজ দেখল পড়ে আছে! পিউ গলা চড়িয়ে ডাকল, ‘মিষ্টুদি!’

তাকে অবাক করে দিয়ে বেরিয়ে এল এক অচেনা যুবক। বছর ত্রিশ হবে বয়স। কালো জিনসের উপর একটা কালো টি-শার্ট পরা লম্বা, ছিপছিপে, গায়ের রং কালো। যেন একটা বেগুনি অর্কিড! পিউয়ের খুব আকর্ষক লাগল চেহারা। সে দু’পলক বেশি তাকাল। ছেলেটা বলল—‘ক্যান আই হেল্প ইউ?’

‘ও ইয়েস!’ পিউ স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করল— ‘আমি, আই মিন আই থট, মে বি মিষ্টুদি ইজ ব্যাক ফ্রম আমেরিকা!’

‘মিষ্টু মানে টিনার কথা বলছেন?’ বাংলায় বলে উঠল ছেলেটা।

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, টিনাদি, কাকলিমাসি! ইউ নো দেম?’

‘অবশ্যই, টিনা আমার বন্ধু, খুব ভাল বন্ধু!’

‘ওরা আসেনি বুঝি?’

‘না, ওরা আসেনি। মাসখানেকের জন্য কলকাতায় আমার একটা কাজ ছিল। এখানে আমার কোনও আস্তানা নেই বলে টিনা আমাকে ওর ফ্ল্যাট ব্যবহার করার প্রস্তাব দিল। এনি ওয়ে, আমি অঙ্গন। শিকাগোতে থাকি, একটা পাবলিসিটি কর্পোরেশনের জুনিয়র আর্ট ডিরেক্টর!’

‘আমি পিউ! এই ফ্ল্যাটবাড়ির আটতলার বাসিন্দা। যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে সোসাল সায়েন্স পড়ি। মিষ্টুদি আমার চেয়ে দশ বছরের বড় হলেও আমরা ভীষণ বন্ধু ছিলাম! আমি ওকে খুব মিস করি, কেমন আছে ও?’

‘ভাল আছে খুব, তোমার কাকলিমাসিও ভাল আছেন। তোমাকে তুমি বললাম। বোসো না!’ কোথাও কিছু নেই, অথচ পিউ যেন আদনান সামির গলা পেল, ‘নাগিড়া নাগিড়া নাগিড়া…’, স্পষ্ট! মিষ্টুদির বন্ধুকে তার ভাল লাগছিল খুব। এরকম অদ্ভুত ফিলিং এর আগে কখনও হয়নি। সে বসে পড়ল একটা সোফায়। অঙ্গন বসল তার সামনের সোফায়। ঈষৎ ঝুঁকে, কনুই দুটো হাঁটুতে রেখে, পা ফাঁক করে। পিউ বড় করে শ্বাস নিল। মনে মনে ভাবল ‘অঙ্গন কী সুন্দর, তাই না?’

দ্বিতীয় দিন যখন পিউয়ের সঙ্গে দেখা হল অঙ্গনের, তখন অঙ্গন তাকে বলল, ‘পিউ, আমাকে একটু গাইড করতে পারো? ধরো, আমার কী উচিত, রান্না করে খাওয়া উচিত নাকি বাইরেই খেয়ে চালিয়ে নেব?’ ‘বাইরে খাওয়াই বেটার! আপনি নিশ্চয়ই এখানে কিছু করতে এসেছেন। সে ক্ষেত্রে অনর্থক সময় নষ্ট করবেন কেন?’

‘ঠিক বলেছ, ইনফ্যাক্ট রোজ সকালে-বিকেলে খাবার পৌঁছে দেবে এরকম একজনের সঙ্গে কথাও বলেছি আমি। তবে সত্যি-সত্যি খুব বেশি কাজ আমার নেই। যা আছে, তা দু’-চারদিনেই শেষ হয়ে যেতে পারে!’

‘তবে যে একমাস থাকবেন বলেছিলেন?’

‘যদি দু’-চারদিনে না হয়, মানে চান্সেস আর দেয়ার!’

‘কী কাজ? মনে হয়, সামথিং ইন্টারেস্টিং?’

‘ইন্টারেস্টিং? হ্যাঁ, একরকম!’ অঙ্গন থামল, যেন কী কাজ সেটা বলবে কি বলবে না, ভাবল সামান্য, ‘আসলে, আমি এসেছি আমার রাঙামাইমাকে খুঁজে বের করে আমেরিকায় নিয়ে যাব বলে। উদ্দেশ্য সেটাই, জানি না কী হবে!’ অঙ্গন কাঁধ ঝাঁকাল।

‘কেন, আপনার রাঙামাইমা কি হারিয়ে গেছেন?’

‘প্রায় সেরকমই!’ মাথা নাড়ল অঙ্গন।

‘কী করে হারালেন?’ আজ অঙ্গন একটা বিস্কুট রঙের ট্রাউজারের উপর সাদা শার্ট পরেছে।

পিউ চোখ সরাতে পারছে না, এত ভাল লাগছে। অঙ্গনের মুখটা একটু উদাস হয়ে গেল।

হঠাৎ বলে উঠল অঙ্গন, ‘তুমি ওই কবিতাটা জানো?’ বালক আজও বকুল কুড়ায়, তুমি কপালে কী পরেছ কখন যেন পরে, সবার বয়স হয়, আমার বালক বয়স বাড়ে না কেন…’। অঙ্গন নিজের ডান হাতটা বাঁ বুকে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করল।

‘আপনি কি ওঁকে ভালবাসেন অঙ্গন?’ ফট করে জিজ্ঞেস করে ফেলল পিউ।

‘আমি ওঁকে খুব শ্রদ্ধা করি, আর হ্যাঁ, ভীষণ ভালবাসি পিউ।’

অঙ্গনের প্রতিক্রিয়া দেখে পিউয়ের বুকটা মুচড়ে উঠল কেন? কিন্তু উঠল, এটা সত্যি!

‘রাঙামাইমাই আমার প্রথম এবং শেষ প্রেম!’ আবার বলল অঙ্গন।

‘আপনি বিয়ে করেননি?’ জিজ্ঞেস করল পিউ।

‘না করিনি। আমেরিকায় প্রচণ্ড লড়াই করে পায়ের নীচে মাটি পাওয়ার পর প্রথম যাঁর কথা মনে পড়ল, তিনি রাঙামাইমা’

‘রাঙামাইমা আপনার মাইমাই?’

‘মাইমাই তো! অবশ্য যখন আমার এগারো-বারো, তখন রাঙামাইমার কুড়ি হবে। নিজের মাইমা নয়, কিন্তু একই বাড়িতে বসবাস, শরিকি বাড়িতে যেমন হয়। বাবা-মা’কে হারিয়ে আমি এসে উঠলাম মামাবাড়িতে। আমাকে কেউ চাইত না, না মামারা, না মাইমারা, টোটালি আনওয়ান্টেড! নিজের ভাল খাবারটা রাঙা আমাকে খাইয়ে দিত। আমার খুব জ্বর আর রাঙা আমার মাথার কাছে বসে হাপুস নয়নে কাঁদছে। কেননা, আমাকে কেউ ডাক্তার দেখাচ্ছে না, এটা আমার খুব মনে পড়ে। রাঙাই আমাকে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিল। স্বপ্ন দেখতে দেখতে আমি পৌঁছে গেলাম শিকাগোয়। একদিন অফিসের লিফ্‌টে ৪০ তলায় উঠতে উঠতে আমার মনে হল, আই লাভ হার টু মাচ, সো আই মাস্ট ডু সামথিং ফর হার!’ ‘তারপর?’

‘দেশের সঙ্গে প্রায় সাত-আট বছর কোনও যোগাযোগ ছিল না। আমি খোঁজ নিতে শুরু করলাম। তখনই ফিরে আসা সম্ভব ছিল না আমার পক্ষে।’

‘পুরনো জায়গায় ছিলেন না উনি, আপনার মামাবাড়িতে?’

‘না, রাঙামামা মারা যাওয়ার পর রাঙামাইমা কলকাতায় কোনও আত্মীয়বাড়ি শেল্টার পায়। শেল্টার মানে আসলে দাসীবৃত্তি! আমি সেখানে অনেক চিঠি লিখলাম, একটারও উত্তর আসেনি!’

‘আপনি কি সেই বাড়িতে রাঙামাইমাকে খুঁজতে যাবেন অঙ্গন?’

‘যাব তো!’

‘যদি না পান ওখানে?’

অঙ্গন চোখ তুলে তার মুখের দিকে তাকাল, ‘খুঁজব পিউ, আপ্রাণ খুঁজব! এখানে না পেলে গ্রামে যাব। কাগজে বিজ্ঞাপন দিতে পারি। কত কিছুই তো করা যায়। খোঁজার জন্য পুরো জীবনটাই তো পড়ে রয়েছে।’

‘আশা করি, খুব শিগগিরই ওঁকে খুঁজে পাবেন আপনি!’

‘থ্যাঙ্কস! তোমার সঙ্গে হঠাৎ আলাপ হয়ে খুব ভাল হল কিন্তু। কলকাতা আমি মোটেও চিনি না। পরিচিত কেউ নেই এখানে। কোনও প্রয়োজন হলে তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি?’

‘হোয়াই নট?’ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেছিল পিউ। তখন কোনও কারণ না থাকা সত্ত্বেও সে ভীষণ অস্থিরতা অনুভব করেছিল ভিতরে!

কোনও কারণ ছাড়াই পিউ বিষন্ন হয়ে রইল দুটো দিন। ভোরে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে লেকের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার মনে হল, সে যেন স্পষ্ট দেখতে পেল অঙ্গন আর রাঙামাইমাকে! হেঁটে যাচ্ছে হাত ধরে, ত্রিশ বছরের পুরুষালি অঙ্গনের পাশে চল্লিশ ছুঁই ছুঁই এক বিধবা জীবনের সব দীনতা থেকে ভালবাসার জোরে মুক্তি পেয়ে হাঁটছে! কত দূর থেকে এসেছে অঙ্গন প্রেম ফেরত নিতে! কী অদ্ভুত এই প্রেম, যা মানুষকে এতখানি চালিত করতে পারে? পিউ বুঝতে পারছে না যে, সে নিজে অঙ্গনের প্রেমে পড়েছে, নাকি অঙ্গনের ভিতরের ওই প্রেমিক সত্তাটার প্রেমে পড়েছে। কিন্তু সেটা অস্পষ্ট থাকলেও তবু তার হতাশ লাগছে। কেননা, সে দেখতে পাচ্ছে, অঙ্গনের কালো টি-শার্টের পিছনের দিকে বড় করে ‘রাঙা’ লেখা! চোখেমুখে জল দিয়ে পিউ রওনা হল জিমে। দু’দিন আসেনি। জাস্ট বিকজ অফ অঙ্গন। অঙ্গনকে দেখার পর থেকে উবে গেছে তার স্পিরিট! পিউ আস্তে আস্তে ট্রেড মিলের উপর দৌড়তে লাগল। কিন্তু মাস্‌লগুলোর কেমন হালছাড়া ভাব। ‘এভাবে হয় না, থাক গে, বাড়ি চলে যাই’, ভাবল সে। তখনই নীল-সাদা পোশাকে জিমে ঢুকল মানব। কী যে হল পিউয়ের, সে চোখের পাতা ফেলতে ভুলে গিয়ে তাকিয়ে রইল মানবের দিকে। এভাবে কাউকে দেখা ঠিক নয়। মনে রইল অঙ্গনের প্রতি তার নিজের দৃষ্টিপাত।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে পিউ বেরিয়ে এল জিম থেকে। বাড়ির পথ ধরল। সে এখন বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে, এভাবেও হয়। এভাবেও প্রেমে পড়ে মানুষ। সামান্য আলাপে, দু’মুহূর্তের দেখাশোনায়!

পিউয়ের মনটা মানবের প্রতি নরম হয়ে গেল। সত্যি মানব তো তাকে কখনও বিরক্ত করেনি। শুধু দেখেছে। যদি পিউকে দেখতে ওর ভাল লাগে তা হলে সে কী করতে পারে! কাল যেমন তার কী প্রচণ্ড ইচ্ছে হয়েছিল অঙ্গনকে একঝলক দেখবার!

তখন ইচ্ছেটাকে দমন করেছিল পিউ। আজ আর পারল না! টুকটুক করে উঠে এল পাঁচতলায়। আর ছলোমলো চোখে তাকিয়ে রইল বন্ধ দরজাটার দিকে। বহু বছর ধরে যেভাবে দেখে আসছে ঠিক সেভাবেই তালা ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাদা দরজাটা! এত সকালে অঙ্গন খেতে বেরিয়েছে এটা অসম্ভব, দু’দিনে শিকাগো ফিরে গেছে, সেটাও সম্ভব নয়। অঙ্গন রাঙামাইমাকে খুঁজতে গেছে। অঙ্গন রাঙামাইমাকে ভালবাসে।

দিন সাত-আট কেটে গেছে। অঙ্গন ফেরেনি। প্রতিদিন ভোরে উঠে আটতলা থেকে পাঁচতলায় নেমে বন্ধ দরজাটার সামনে দাঁড়ায় দু’-চার মুহূর্ত। তারপর বেরিয়ে আসে সরোবর থেকে। ভাবে আজ জিমে যাবে, যাবেই! কিন্তু যায় না শেষ পর্যন্ত। লেকের সামনে একটা ফাঁকা বেঞ্চ দেখে বসে থাকে। নিজেকে বোঝায়, নিশ্চয়ই গ্রামে গিয়ে রাঙাকে খুঁজে পেয়েছে অঙ্গন। অনাথ, অসহায় অঙ্গন নয়, আমেরিকা ফেরত অঙ্গন। এই অঙ্গনের নিশ্চয়ই খুব কদর আছে সবার কাছে। মে বি হি ইজ এনজয়িং ওল্ড কম্প্যানিজ।

রাঙামাইমাকে সঙ্গে করে ফিরে এলে অঙ্গন কি তাকে সেকথা জানাবে ডেকে? কেন জানাবে? পিউ কে? ঘটনাচক্রে আলাপ হওয়া পিউয়ের কি আলাদা কোনও গুরুত্ব থাকতে পারে? তুমি কি পাগল পিউ? এত তোমার এক্সপেক্টেশন? বোকার মতো কোরো না! পিউ অবুঝের মত কেঁদে ফেলে আর নিজেকে বলে ‘বিহেভ ইওরসেল্ফ পিউ!’

তখন শুকনো মুখে হাঁটি হাঁটি পা করে সে সরোবরে ফিরে আসে। কিন্তু তার মন মানে না। সে অঙ্গনের ফেরার অপেক্ষা করে থাকে, একা ফেরার! তখন নিজেকে খুব সস্তা মনে হয় তার। আচ্ছা, অঙ্গন একা ফিরলেই বা পিউয়ের কী? ‘খুঁজে না পেলেই তো খোঁজা শেষ হয়ে যায় না’, বলেছে। অঙ্গন।

দুপুরে খাওয়ার টেবিলে পিউ বুঝল মা তাকে লক্ষ করছে। অস্বস্তি কাটাতে সে কথা বলল, ‘রোজ একঘেয়ে রান্না মমতাকে একটু নতুন কিছু করতে বলো না কেন মা?’

‘কেন, রসুন ধনেপাতা দিয়ে চিকেন তো তোর ভাল লাগে বলেই জানতাম!’ ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন মা।

‘সেটা হয়েছে নাকি আজ? কোথায়?’

‘ওমা, সামনে পড়ে আছে দেখতে পাচ্ছ না!’ পিউ দু’দিকে মাথা ঝাকাল, সরি, দেখতে পাইনি গো!’ সত্যিই সে নজর করেনি!

‘আশ্চর্য ব্যাপার তো? এত অন্যমনস্ক? কী হয়েছে তোর ক’দিন ধরে? একেবারে নেতিয়ে রয়েছিস? পরপর তিন-চারদিন ইউনিভার্সিটি গেলি না। দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে যে রাতদিন কী করছিস ঈশ্বরই জানেন।’ মায়ের অভিযোগের সামনে মাথা নিচু করে পিউ ভাত নাড়াচাড়া করতে লাগল।

‘প্রেমেট্রেমে পড়ে থাকলে বল আমাদের!’

কথাটা বলে মা চমকে দিলেন পিউকে, ‘ব্যাপারটা আমাদেরও একটু বুঝতে দাও, একা একা কষ্ট পাওয়ার মানে কী?’

‘আমি প্রেমে পড়লেই তো আর হল না মা!’

বলে মাকে হতভম্ব অবস্থায় বসিয়ে রেখে পিউ হাসতে হাসতে উঠে পড়ল।

তারপর সারা দুপুর একটা ছেলেমানুষি খেলায় মেতে নিজেকে কষ্ট দিল সে। অনবরত ‘নাগিড়া নাগিড়া…’ বাজিয়ে অঙ্গনের প্রতি তার অনুভবের জায়গাটাকে খুঁচিয়ে জাগিয়ে তুলতে লাগল আর তখন ‘বালক আজও বকুল কুড়োয়…’ অমোঘ শব্দের মতো উচ্চারণ করে সেই জেগে ওঠা অনুভবকে আঘাত দিয়ে দিয়ে তছনছ করে দিতে লাগল পিউ!

দরজায় ধাক্কা দেওয়ার শব্দে ঘুম ভেঙে পিউ উঠে বসল। চারদিকে অন্ধকার নেমে গেছে, কে জানে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল। তাড়াতাড়ি উঠে দরজা খুলে দ্যাখে মা!

‘বাব্বাঃ! কী ঘুমে ধরল তোকে?’ বললেন মা।

‘কী হয়েছে?’

‘তোর ফোন।’

‘কে?’ ল্যান্ডলাইনে তো বন্ধুরা কেউ ফোন করে না, মোবাইলে করে।

‘মানবই বলল নামটা। ধরে আছে।’

মানব? এক ঝটকায় ঘোর কেটে গেল পিউয়ের। তাড়াতাড়ি এসে ফোন ধরল।

‘হ্যালো?’

‘হাই পিউ, দিস ইজ মানব হিয়ার!’

একটা সংযত গলার স্বর ভেসে এল ও-প্রান্ত থেকে।

‘মানব? জিম?’ পিউ ক্লিয়ার হতে চাইল।

‘হ্যাঁ!’

‘কী ব্যাপার?’ পিউ দেখল, মা নিজের ঘরে চলে যাচ্ছেন।

‘সেদিন তুমি রাগ করে চলে গেলে, তারপর আর এলে না। আমি জানি তুমি আমাকে পছন্দ করো না, কিন্তু তার জন্য তুমি জিমে আসা ছেড়ে দেবে কেন?’ মানব ইংরেজি এবং হিন্দি মিশিয়ে কথা বলছে।

‘তুমি ফোন নম্বর কোথায় পেলে?’

‘জিমের রেজিস্টার থেকে!’

‘ওঃ! কিন্তু তুমি আমাকে ভুল বুঝেছ। আমি রাগ করিনি। আমার ব্যক্তিগত অসুবিধের কারণে আমি ক’দিন জিমে যেতে পারিনি!’

‘সরি!’ একটু চুপ করে থেকে বলল মানব, ‘আমার বুঝতে ভুল হয়েছে, প্লিজ কিছু মনে কোরো না।’

‘না, না, ঠিক আছে! আমি দু’-একদিন বাদেই জিমে যাব, তখন দেখা হবে।’

‘আমি কালই দিল্লি ফিরে যাচ্ছি পিউ, তাই…’

‘কালই?

‘হুঁ!’

‘আবার কবে আসবে?’

‘আর হয়তো সেভাবে আসব না!’

‘কেন মানব?’

‘আমি তো নানির প্রপার্টি বিক্রি করতে এখানে এসেছিলাম পিউ। দু’মাসের জন্য। তাও যাওয়া-আসা করতাম। সেসব মিটে গেছে। এখন তো ফিরে গিয়ে মায়ের জিনিস মাকে বুঝিয়ে দিতে হবে। মা আমার জন্য অপেক্ষা করছেন।’

পিউ দেওয়ালে পিঠ চেপে দাঁড়াল। কোনও কথা বলল না।

‘যাওয়ার আগে কি তোমার সঙ্গে একবার দেখা হতে পারে?’ আবার বলল মানব।

‘কেন মানব?’

‘কারণ, আমি তোমাকে ভালবাসি পিউ! আই মিন, এটা আর কিভাবে বলা যায় আমি জানি না!’

কথাটা মানবের মুখ থেকে ছিটকে এসে পিউয়ের বুকে ধাক্কা মারল। ‘আমি তোমার সামনে দাঁড়িয়ে শুনতে চাই যে, ইফ উই ক্যান কন্টিনিউ!’ ‘আমি জানি তুমি সত্যি কথা বলছ মানব। এভাবে হয়, হতে পারে ভালবাসা। আচমকা!’

‘আচমকা কেন হবে? আমি দু’মাস ধরে দেখছি তোমাকে। একটু একটু করে ভালবেসেছি। অনেক পরে সেটা বুঝেছি।’

‘তাই বুঝি? তোমার কী মনে হয় মানব, এটা সত্যিকারের ভালবাসা?’ ‘আমার তাই মনে হয়। এবং আমি সেটা তোমার কাছে প্রমাণ করতে চাই। কাল প্লিজ জিমে এসো। আমাদের মধ্যে অন্তত কিছু কথা হওয়া দরকার।’

‘জিমে কি কোনও কথা হতে পারে?’

‘কিন্তু আমার হাতে তো বেশি সময় নেই, আমি কাল সন্ধেবেলায় চলে যাচ্ছি,’ মানব অধৈর্য স্বরে বলে উঠল।

‘তুমি সকাল ছ’টায় ক্লাবের গেটে দাঁড়াও, আমরা লেকের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলব,’ বলল পিউ।

ভোরে উঠে জিমের পোশাকের বদলে একটা আকাশি-রঙা লং স্কার্ট আর সাদা টপ পরে নিল পিউ। তারপর লিফ্‌ট ধরে নেমে সরোবর থেকে বেরিয়ে এল।

ওরা লেকের ধারে একটা বেঞ্চে বসল জল ঘেঁষে। পিউ মানবের চোখের দিকে তাকাল। মানব পিউয়ের চোখের দিকে। মানবই বেশি কথা বলছিল। দিল্লির কথা, পড়াশোনা, বেড়ে ওঠা, ব্যবসা, এমনকী মেয়েদের সম্বন্ধে যতটুকু অভিজ্ঞতা, সেটুকুও। পিউও বলছিল কথা। মানবের প্রশ্নের উত্তরে ছোট ছোট বাক্যে নিজেকে যথাসম্ভব মেলে ধরছিল সে। মানবকে ভীষণ খুশি দেখাচ্ছিল সকালের আলোয়। মনে হচ্ছিল, যা চেয়েছিল, পেয়েই গেছে মানব। পিউ মানবের উচ্ছ্বাস দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছিল!

এভাবে কথা বলতে বলতে ন’টা বেজে গেল। আর সময় নেই। অনেক কাজ বাকি, মানবকে যেতে হবে। দু’জনে উঠে হাঁটতে শুরু করল তাই। লেকের মুখটায় এসে মানব আলতো করে পিউয়ের হাত স্পর্শ করল। ‘এক মাসের মধ্যেই আসব আমি। এসে তোমার বাবা-মা’র সঙ্গে দেখা করব। আর রোজ তো ফোনে দু’-তিনবার কথা হবেই। মোবাইলটা সব সময় ক্যারি করবে। রাতেও অন করে রাখবে, ঠিক হ্যায়?’

‘রোজ দু’-তিনবার ফোন করবে?’

‘একদম!’

‘কিন্তু শোনো…’ বলল পিউ, তারপর যেন একটু দ্বিধায় পড়ে গেল। মানব বলল, ‘বলো কী বলবে?’

‘না শোনো’, পিউ খুব কাছে এগিয়ে গেল মানবের, ‘যদি ধরো, কোনও কারণে ফোন করে তুমি আমাকে না পাও, ধরো, খোঁজ নিয়ে দেখো যে, আমি হারিয়ে গেছি, কোথায় কেউ জানে না, নো ট্রেস, তা হলে তখন তুমি কী করবে মানব? কিছু কি করবে?’ মানব একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘এরকম যদি কখনও হয়, আমি জানি হবে না, কিন্তু যদি কখনও হয়, আমি তখন তোমাকে খুঁজব পিউ! ভীষণ ভীষণ খুঁজব!’

‘কিন্তু অনেক খুঁজেও যদি না পাও?’

ঠিক অঙ্গনের মতো সাবলীল গলায় মানবও বলে উঠল—‘ধ্যাত, না-পাওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই, আমি তো পিউ তোমাকে সারাজীবন ধরে খুঁজব’, বলে পিউয়ের গালটা আলতো করে টিপে দিয়ে হাসল মানব।

উনিশ কুড়ি, ৪ মে ২০০৫

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *