সাহানা বা শামিম
৯/১১-র সময়ও সাহানা নিয়মিত মাছ কিনেছে। যখন গোধরা কাণ্ড ঘটেছে এ-দেশে তখনও কিনেছে। পরমেশের অনুপস্থিতির সুযোগে সে প্রতি সময়ই কিনব না, কিনব না করেও কিনে ফেলেছে মাছ। কাশ্মীরে রোজই কত লোক মরছে, ইরাককে তছনছ করে দিচ্ছে আমেরিকা। বাংলাদেশে আশ্রয় পাচ্ছে আই এস আই মদতপুষ্ট জঙ্গিরা, এমনকী কলকাতাও আর নিরাপদ নয়। হাওয়ায় কত জায়গায় গুজব, পথে বেরোলে ভয়, ভিড়ে ঠাসা জায়গায় দাঁড়াতে অস্বস্তি, সিনেমাহলে ঢুকে দমবন্ধ লাগা— এ সব সত্যকে এড়িয়েও সাহানা মাছ কিনেছে!
বাজারে ঢুকে সাহানা এদিক-ওদিক তাকায়, তারপর পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় সেখানে, যেখানে মাছ বিক্রি হচ্ছে। মাছ কেনে, ব্যাগে ভরে, বাড়ি আসে। সবটাই ঠোঁট টিপে করে। সতর্কভাবে করে। মাছের টুকরোগুলো ধুতে ধুতেও তার হাত কাঁপতে থাকে।
প্রতি বারই তাই হয়। মাছ কেনা থেকে শুরু করে, বিগ শপার-এ ভরে বাড়িতে আনা তারপর সন্তর্পণে সেগুলোকে ধুয়ে আঁশ সমেত নানা বর্জ্যগুলো নিখুঁত হাতে তুলে নেওয়া ও তার বহুতল থেকে পাশের ভাঙাচোরা ব্রিটিশ আমলের বাংলোটার ডুমুর-জঙ্গলে ছুড়ে ফেলা অবধি তার হাত কাঁপতে থাকে, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, মাথা ঘোরে!
আর যখন মাছ ভাজে সে— কী নিদারুণ আত্মপীড়ন। প্রতি মুহূর্তে তার মনে হয়, পরমেশ তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে, চেঁচাচ্ছে ‘ফ্লেশ, ফ্লেশ’। আঁতকে আঁতকে ওঠে সে। মনে হয়, ভয়ে ভয়ে একটা কাণ্ড ঘটাবে। অসাবধানে পুড়ে মরবে নিজেই। তখন মাছ ভাজার গন্ধের সঙ্গে মিশে যাবে তার পোড়া মাংসের গন্ধ।
কিন্তু মরেও মুক্তি হবে না। ফরেনসিক রিপোর্ট ঠিকই বলে দেবে যে সে মাছ ভাজতে ভাজতে পুড়ে গেছে। তখন মৃতের প্রতি যে নির্লিপ্ত শ্রদ্ধা, প্রেম মানুষের থাকে তাও লুপ্ত হবে পরমেশের মন থেকে। তার ছবি-টবি কোথাও থাকলে বিশ্বাসঘাতক বলে সেসব ছুড়ে ফেলে দেবে পরমেশ। তারপর যত দিন বেঁচে থাকবে ঘৃণা করবে সাহানাকে।
এসব ভাবতে ভাবতে সাহানা মাছ রাঁধে। রাঁধা হয়ে গেলে কেমন যেন বিহ্বল দশা হয় তার। সামলাতে পারে না নিজেকে— ভাত দিয়ে মেখে মেখে ভয়ংকর তৃপ্তি সহকারে খায়। কিন্তু খেয়ে উঠেই হাঁপায় আবার। আসলে ভয় ভীষণ ভারী পাথরের চাঁইয়ের মতো চেপে বসে থাকে তার বুকে। যতক্ষণ না খাওয়া শেষ করে লিকুইড ডিশ ওয়াশার দিয়ে বাসন-কোসন, কড়াই, খুন্তি, টেবিল, আভন মায় সমস্ত কিচেন পর্যন্ত ঝকঝক করে ধুয়ে ফেলছে সে, ততক্ষণ চোখের পলক পর্যন্ত ফ্যালে না। রুম ফ্রেশনার ছড়ায় ঘরে ঘরে, সিঙ্কে ফিনাইল ঢালে। প্রতিটি কাঁটাকুটো নখ দিয়ে দিয়ে খুঁটে তুলে পলিপ্যাকে ভরে আবার পাশের জমিতে ছুড়ে দেয়। আর হাতে সাবান দেয়, মাউথ ফ্রেশনার দিয়ে মুখ ধোয়, চুলে শ্যাম্পু মাখে— স্নান করে! স্নান করে!
তারপর চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বাইরের বাতাসে জোরে জোরে নিশ্বাস নেয় সাহানা। নিয়ে আবার ঘরে গিয়ে বড় বড় করে শ্বাস টানে— গন্ধ আছে এখনও? ফ্লেশি স্মেল? আছে?
গন্ধ কিছুমাত্র থাকে না। তবু আর একবার সে রুম ফ্রেশনার ছড়ায় ঘরে ঘরে, হাতের পাতা উলটে-পালটে শোঁকে। মাঝে মাঝে এত উৎকণ্ঠা সহ্য করতে না পেরে সাহানা রসুন থেঁতো করে তেলে ভেজে ফেলে। সমস্ত গন্ধ তাতে নিশ্চিত রূপেই চাপা পড়ে যায়।
কিন্তু পরিস্থিতি এরকম আদৌ ছিল না, যখন তাদের আলাপ হয়েছিল, কথা দেওয়া-নেওয়া হয়েছিল। প্রেমের সেসব দিনগুলোয় মাছটা তার কাছে তেমন কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মনে হয়নি। এমনকী পরমেশের জীবনের অংশ হতে গিয়ে সে কোনও ত্যাগের পথে হাঁটছে এমনটাও মনে হয়নি তার। সে খুব স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেছিল ব্যাপারটা। যদিও আজ সে বুঝতে পারে যে ব্যাপারটা সে স্বাভাবিকভাবে নিতে চেয়েছিল—
আসলে পারেনি।
পরমেশ তাকে বলেছিল, ‘আমি নিরামিষাশী। বাড়িতে তুমি কিন্তু কোনও আমিষ খাদ্য খেতে পারবে না।’
সে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘বাইরে খেতে পারব?’
পরমেশ দু’মুহূর্ত চুপ করে থেকে কাঁধ ঝাকিয়েছিল, ‘চিকেন খেলে আই ওন্ট মাইন্ড। বাট ইন কেস অফ ফিশ— মাছটা তোমাকে ঘরে বাইরে সর্বত্রই খাওয়া ছাড়তে হবে। মাছের গন্ধ আমি একেবারেই সহ্য করতে পারি না সাহানা। দেন অ্যান্ড দেয়ার বমি হয়ে যায়। এত শরীর খারাপ হয় যে অতীতে আমাকে এ কারণে হসপিটালে পর্যন্ত যেতে হয়েছে। আই হেট ফিশ। মোর ওভার সাহানা, যে মেয়ে মাছ খায় আমি তাকে চুমু খাওয়ার কথা বা তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করার কথা ভাবতেও পারি না। আই কান্ট এন্টার ইন আ বডি হুইচ ইজ সাম ওয়ে অর দি আদার ফিশি!’ বলে বাঁ হাতের মধ্যমা আর তর্জনী দুটো তুলে ধরে নাড়িয়ে ফিশি শব্দটাকে দু’রকম ভাবেই তাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল পরমেশ।— ‘সো ইউ হ্যাভ টু গিভ ইট আপ!’
সাহানা পরমেশকে ভালবেসে ফেলেছিল তত দিনে। শুধু ভালবাসা এক জিনিস, কিন্তু সাহানা মানসিকভাবেও পরমেশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল আসলে তখন। বুঝেছিল পরমেশকে পেতে হলে মাছ তাকে ছাড়তে হবে। সে অনিবার্য সহজতার সঙ্গে নিজের মন থেকে মাছের আকাঙক্ষাই নির্মূল করেছিল। পৃথিবীর বাকি তাবৎ খাদ্যের প্রতি তাকিয়েছিল চোখ তুলে। দু’বছর সে মাছ খায়নি। তারপর আবার তাকে পেয়ে বসল মাছের আস্বাদ।
এবং সে মাছ খেতে শুরু করল লুকিয়ে লুকিয়ে, আর পরমেশকে ভয় পেতে শুরু করল। কেননা, সে পরিষ্কার করে জানত তার মাছ খাওয়ার কথা জানতে পারলে তার আর পরমেশের সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে। অথবা সে-রকম দাঙ্গাই লাগবে কোনও যে-রকম দাঙ্গার কথা আমরা জানি।
যত সাহানা পরমেশকে ভয় পেতে লাগল ততই সে ঘৃণাও করতে লাগল পরমেশকে। ঘৃণা! কিংবা বলা যায় যত সে মাছ এবং মাছ যারা খায় তাদের প্রতি পরমেশের ঘৃণা টের পেল, তত মাছ যারা খায় না তাদের প্রতি নিজের ঘৃণাকে সমপরিমাণে ফিরিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর হয়ে উঠল। যেন একটা দায় টের পেল সে। একটা আমিত্বের রসদ টের পেল যা পরমেশের প্রতি বিরুদ্ধ, বিতৃষ্ণ। সে বলল নিজেকে— ‘যারা মাছ খায় আর যারা মাছ খায় না, তারা ভয়ংকর রকম আলাদা, তারা অসম্মানজনকরূপে পৃথক।’ যখন মাছের প্রতি তার ভাবালুতা ক্রমশ বেড়ে উঠছে তখন সে পরমেশের সঙ্গে ভয়ে ভয়ে তর্ক করত, ‘পরমেশ’, বলত সে, ‘তুমি মাছ খেতে পছন্দ কর না বলে, তোমার মাছের গন্ধ অসহ্য লাগে বলে আমি কেন মাছ খাওয়া থেকে বঞ্চিত হব? তোমার আচরণটা আমার ওপর চাপিয়ে দেবে কেন তুমি? আমি তো তুমি নই, আমি তো আলাদা একজন মানুষ, আমি তো আলাদা একজনই থাকব! এটা কি তোমার ভুল হচ্ছে না, পরম?’ পরমেশ রেগে যেত। চূড়ান্ত সমর্পণের কথা বলত তাকে। বলত, ‘আমি ভুল হলেও এ ক্ষেত্রে তোমার কাছ থেকে কোয়েশ্চেনলেস সাবমিশন আশা করব আমি। মনে রেখো, এই সম্পর্ককে সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ অবস্থায় রাখতে হলে এ ছাড়া আর কোনও পথ নেই। না হলে, তুমি জানো, খারাপ যা কিছুই হতে পারে, তখন তুমি আমাকে দায়ী কোরো না।’
মনীশ, সাহানার প্রাক্তন প্রেমিক, ঠিক এই সময়ই ফিরে এল সাহানার কাছে। যেহেতু ঘৃণা জিনিসটা চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ে এবং ঘৃণার কারণগুলো আবছা হয়ে যেতে থাকে, অথচ ঘৃণিতই হয়ে ওঠে প্রধান, সেহেতু পরমেশকে ঘৃণা করে গোপন এক সম্পর্ক প্রায় অপ্রয়োজনেই তৈরি করল সাহানা মনীশের সঙ্গে।
একদিন বন্ধুদের দেওয়া ঘরোয়া পার্টিতে পরমেশ মাছ, মাংস খাওয়ার তীব্র বিরোধিতা করল। বলল, ‘এই মাছ মাংস খেতে ভাল লাগার চরম অবস্থাটাই তো ক্যানিবালিজম! মানুষের মাংসই তো সবচেয়ে সুস্বাদু!’ সেদিন বন্ধুর বাড়ির টয়লেটে বসে হু হু করে কাঁদল সাহানা বহুক্ষণ। তারপর রাগে দাঁতে দাঁত পিষল— ‘ঘৃণা? এত ঘৃণা?’ বাড়ি ফেরার পথে গাড়িতে পরমেশের মুখটা সবুজ গলা গলা একটা পদার্থ দিয়েই তৈরি বলে মনে হল তার। পরের দিন সে মাছও রাঁধল, মনীশের কোলে বসে সেই মাছ খেলও।
তারপর সেই প্রথম বার পরম ঘৃণায় ভর দিয়ে মনীশকে দেহদান করল। কিন্তু সে বুঝতে পারছিল এই ঘৃণা সবটাই তার একার ওপর কার্যকর হচ্ছে। ঘৃণার কিছুই যেহেতু পরমেশ টের পাচ্ছিল না, দুঃস্বপ্নের এই ঘৃণার সম্পর্কে কোনও ধারণা যেহেতু পরমেশের ছিল না, সেহেতু এই ঘৃণা যে বহন করছিল সে অন্য কেউ নয়, একা সাহানা। বেচারি সাহানা! সে-ই ঘৃণা করল, আবার সে-ই ঘৃণার প্রকোপে ভুগতে লাগল। ঠিক যেমন ঠকানো ব্যাপারটা, যে ঠকে সে যতক্ষণ অবহিত না থাকে নিজের ঠকা সম্পর্কে ততক্ষণ ঠকার ভার তাকে কিছুই বহন করতে হয় না, যে ঠকায় সবটাই সে-ই বহন করে। আবার যে ঠকে সে যে মুহূর্তে সকল ঠকে যাওয়ার তথ্য জেনে যায় অমনি সে আর ঠকে না। অথচ তখনও যে ঠকিয়েছে সে ঠকানোর সমস্ত ভার পূর্ববৎ বহন করেই চলতে বাধ্য হয়! অর্থাৎ মানুষ ঠকায়, কিন্তু মানুষ কখনও ঠকে না— বিষয়টা একতরফাই ঘটে। ঠিক তেমনই সাহানা পরমেশকে ঠকাল, কিন্তু পরমেশ ঠকল না। সাহানা ঘৃণা করল, কিন্তু পরমেশ ঘৃণিত বোধ করল না। সাহানা নিজের ঘৃণায় নিজেই অষ্টপ্রহর জবজবে হয়ে রইল। অথচ পরমেশ দিনে-রাতে যখনই সাহানার ঘনিষ্ঠ হতে চাইল সাহানার মুখে কখনও স্ট্রবেরির গন্ধ, কখনও গুলাবজামের গন্ধ, কখনও মিন্টের গন্ধ পেয়ে শরীর সম্পূর্ণ শিথিল করে দিয়ে নিবিড় চুম্বনে প্রবিষ্ট হতে পারল এবং বলতে পারল, ‘সানা, তুমি কি আমাকে এখন আর ভালবাস না? নইলে তোমার মুখের ভেতরটা এত ঠান্ডা কেন?’
অন্য দিকে সাহানা কিনে আনা মাছ প্রায় দিনই রাঁধতে গিয়ে টের পেতে লাগল—পচা! ভীষণ পচা! মনীশের সঙ্গে মিলিত হতে গিয়ে টের পেল মনীশকে সে চায় না, পরমেশের সঙ্গে সঙ্গমকালে ভুগল অপরাধবোধ ও অশান্তিতে, ভয়ে— বাকি সময়টাকে সে পূরণ করল ঘৃণা দিয়ে। অব্যক্ত, অনুচ্চারিত ঘৃণা যা ক্রমশই নিষিদ্ধ আনন্দের সীমা অতিক্রম করে বাসি মাছের মতোই পচে উঠছিল। অথচ সাহানা যার থেকে কোনও কাঁটা আঁশ পর্যন্ত বেছে তুলে ছুড়ে ফেলতে পারছিল না। পরমেশ আর সে যে কুৎসিত রকমের আলাদা এই সত্য বিস্মৃত হতে পারছিল না! ৭/৭-এর দিন পরমেশ লন্ডনে ছিল। দুপুরে পুবালি ফোন করে বিস্ফোরণের কথা প্রকাণ্ড উদ্বেগের সঙ্গে জানানোর আগে অবধি সাহানা কিছুই জানত না, কারণ সে টিভি খোলেনি।
সে পাগলের মতো পরমেশকে মোবাইলে ধরতে চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু একটা রেকর্ডেড ভয়েস তাকে বার বার শোনাল যে ‘দা সাবস্ক্রাইবার ইজ আউট অব রিচ অ্যাট দিস মোমেন্ট…।’
তার বন্ধুরা একে একে জড়ো হতে লাগল। মনীশ, পুবালি, তুষার, বসুন্ধরা। যে যেভাবে পারল চেষ্টা করতে লাগল পরমেশের একটা খবর পাওয়ার। কিন্তু সন্ধে গড়িয়ে রাত হয়ে এল, না পরমেশের কোনও খবর পাওয়া গেল, না পরমেশের দিক থেকে এল কোনও খবর!
সমস্ত বন্ধুরা মিলেও কিছুতেই সামলাতে পারছিল না সাহানাকে। সে উন্মাদের মতো আচরণ করছিল। ঠিক কী যে বলছিল সাহানা তা বুঝতে পারলেও তার অর্থ বোধগম্য হচ্ছিল না কারও।
সাহানা বলছিল, ‘পরমেশকে মেরে ফেলল আমার ঘৃণা, আমার প্রাণপণ ঘৃণা!’ ক্রন্দনরত সে আরও বলছিল, ‘আচ্ছা, এতখানি ঘৃণার কি কোনও প্রয়োজন ছিল?’
দিন কাটল ঝড়ের বেগে। পরমেশ ফিরল না। সাত-আট দিনের মাথায় সাহানা, পরমেশের দিদি-জামাইবাবুর সঙ্গে লন্ডনের ফ্লাইটে চড়ে বসল। এবং ফিরে এল খালি হাতে।
কোথাও পরমেশের কোনও সন্ধান পাওয়া গেল না। কোনও চিহ্ন নেই পরমেশের। এমনকী পরমেশ মৃত কি না, তা-ও বলা যাচ্ছে না!
মাস দুয়েক পরে মনীশ একদিন এল সাহানার কাছে। সাহানা মনীশকে পেয়ে জড়িয়ে ধরল তার হাত। বলল, ‘মনীশ আমি ধর্মান্তরিত হচ্ছি, আমি মুসলমান হয়ে যাচ্ছি।’
মনীশ এত বেশি অবাক হল যে কিছু বলতেই পারল না। ভেবেই পেল না পরমেশের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার শোকের সঙ্গে এর কী যোগ আছে, বা আদৌ আছে কি না! সাহানা বলে চলল, ‘মনীশ, পরমেশ চূড়ান্ত সমর্পণের কথা বলত। বলত, যতক্ষণ না তুমি আমি হতে পারছ ততক্ষণ কিছুতেই এই সহাবস্থান চলতে পারে না। আমি তখন রাগে-বিস্ময়ে বলতাম, পরম, সেটা তো আমিও তোমাকে বলতে পারি।’
ও মাথা নাড়ত। বলত, ‘আলটিমেট সাবমিশন মানে, প্রশ্নাতীত সমর্পণ। যেখানে কোনও প্রশ্ন ওঠারও জায়গা থাকে না! প্রশ্নমাত্র থাকে না!’ ‘মনীশ, এখন যখন পরমেশ আর ফিরবে কি না আমি জানি না, তখন পরমেশের ফেরার অপেক্ষায় আমি সেই চূড়ান্ত সাবমিশনের একটাই পথ বের করেছি। একটা মাত্র খোলা পথ। দু’দিন বাদেই এক প্রবীণ মুসলমান ধর্মগুরু আমাকে মুসলমান বলে চিহ্নিত করে দেবেন। আমার নাম হবে শামিম।’
মনীশ সম্ভবত এবার কিছুটা বুঝতে পেরে সাহানার চুলগুলো সরিয়ে দিল মুখ থেকে। বলল, ‘সাহানা, আর কি কোনও পথ নেই?’
‘না, নেই। নেই মনীশ! কোনও শর্টকাট নেই। কোনও বার্গেন করার জায়গা নেই। এর কমে ‘আমি’, ‘তুমি’ হতে পারব না। সব প্রচেষ্টা বৃথা যাবে। কমপ্লিট সাবমিশন মানে তো এই-ই, মনীশ। পরমেশ ফিরে এলে বুঝবে যে দেরি করে হলেও এত দিন পরে আমি ওকে অন্তর দিয়ে গ্রহণ করতে পেরেছি।’
পাঠক, এ গল্প নিয়ে আপনি কোনও প্রশ্ন তুলবেন না। আপনি কোনও প্রশ্ন তোলার আগেই আমি মনে করিয়ে দিতে চাই যে, এটা একটা প্রশ্নাতীত সমর্পণের গল্প।
আনন্দবাজার পত্রিকা, রবিবাসরীয় ২ অক্টোবর ২০০৫