সোনামুখীর সৎসাহস
শীতের সকাল। কাঠবাদামের গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে সকালের মিঠে রোদ এসে ছড়িয়ে পড়েছে মোটা ডালের ওপর। মোটা গুঁড়িটার একপাশ দিয়ে ওপর দিকে উঠে গেছে ডালটা—গুঁড়ি আর ডালটার মধ্যের জায়গাটা বেশ চ্যাটালো—অনায়াসে শোয়া-বসা যায়। সেইখানটায় চারখানা পা ছড়িয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে আরামে রোদ পোহাচ্ছে সোনামুখী কাঠবেরালি। বেলা অনেকটা হয়েছে, এ-পাতা সে-পাতার ফাঁক থেকে কাঠবাদাম খুঁজে পেড়ে সকালের নাস্তা খাওয়ার কাজটা সোনামুখী অনেক আগেই সেরেছে। এখন গাছের গুঁড়ি বেয়ে নিচে যাবে, মাঠ থেকে ঘাস ছিঁড়ে আনবে, ছোট ছোট ঝোপের পাতা দাঁত দিয়ে কুটকুট করে কেটে কেটে আনবে। তারপর আরো অনেক উঁচু ডালে গিয়ে সুবিধেমতো একটা জায়গা বেছে সেখানে বাসা বানাবে। তার আগে রোদে একটু গড়াগড়ি করে নিচ্ছে। উঠিউঠি করতে করতে অনেকটা সময় চলে যাচ্ছে। শীতের আড় যেন কিছুতেই ভাঙছে না। যতই রোদটা গায়ে লাগছে, ততই আরামে আলসেমো ধরছে। ভাবছে, কাজের জন্যে তো সারাটা দিনই আছে, আর একটু’খন রোদ পুইয়ে নিই।
সোনামুখীর নামটাই যা বাহারে, চেহারায় জৌলুস বেশি নেই। বাদামি রঙের লোমের ওপর কালো আর রুপোলি ডোরাকাটা, কপাল আর দু-চোখের চারপাশে একটু সোনালি ছিটেফোঁটা—তাইতেই তার নাম সোনামুখী। লেজটাও তেমন মোটা-লোম- ভরা নয়, কেমন যেন খ্যাংরাকাঠির মতো সরু, সিড়িংগে।
সোনামুখী বাসা বানাবে, তাই ভারি ফূর্তি তার মনে। গুনগুন করে গান করতে করতে সাঁৎ করে মোটা গুঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল সে। ছোট ছোট ঝকঝকে দাঁত দিয়ে কুটকুট করে কাটল অনেকগুলো ঘাস। তারপর ছোট্ট সুন্দর আঁটি বেঁধে মুখে করে চেপে ধরে আবার হু-স্ করে ওপরে উঠে এল সে। অনেক ওপরে একটা মোটা ডালের গোড়া পছন্দ করল। ডালটার গোড়া ঘেঁসে আরো দুটো ডাল বেরিয়ে বেশ একটা চ্যাটালো কোণার মতো হয়েছে—সেইখানটা সোনামুখী ওর বাড়ির জন্য পছন্দ করল। ঘাসগুলো সেইখানটায় রেখে আবার নিচে নেমে গেল। মাঠ থেকে শুকনো লম্বা খড়, ঘাস বিচালি সব খুঁটে খুঁটে যোগাড় করে আর মুখে করে ওপরে নিয়ে আসে।
সোনামুখীর বাড়ি একটু-একটু করে এগিয়ে যচ্ছে। মনে তার ফুর্তি, গলায় গুনগুন্ গান, বারবার নিচে যাচ্ছে, ওপরে উঠছে।
অনেকবার ওপর-নিচ করে সোনামুখী একটু হয়রান হয়েছে। পেটে খিদেটাও একটু জানান দিয়েছে। বেলা তো আর কম হয়নি, রোদ ঠিক মাথার ওপর। সোনামুখী ভাবল একটু জিরিয়ে নিই, তারপর দুটো বাদাম পেটে দিয়ে আবার কাজে লেগে যাব যেই একটু ডালে গা দিয়ে গড়িয়েছে কি অমনি নিচে থেকে ভেসে এল তীব্র এক চি ৎকার। কী ব্যাপার! লাফ দিয়ে উঠল সোনামুখী। জিরোনো আর হল না। নিশ্চয়ই কেউ বিপদে পড়েছে। যেই-না ভাবা, অমনি তরতর করে নিচে নামতে শুরু করল। অর্ধেক পথ নেমে দেখে, একটু অল্পবয়সী কাঠবেরালি-বউ তার ছোট কচি বাচ্চাকে মুখে করে নিয়ে গুঁড়ি বেয়ে খানিকটা উঠে থরথর করে কাঁপছে, তার নিচে গাছের গোড়ায় দাঁড়িয়ে লেজ আছড়াচ্ছে মস্ত বড় একটা বেজি।
বেজিটাকে সোনামুখী চেনে, বেজিপাড়ার সর্দার ওটা। ওর নাম ডঙ্গু বেজি। ভারি বদ ওটা, ছোট ছোট কাঠবেরালির ছা পেলে আর কথা নেই, সঙ্গে সঙ্গে কচমচিয়ে চিবিয়ে খাবে। এই কাঠবেরালির বাচ্চাটাকেও ও খাবার জন্যেই তাড়া করছিল; কিন্তু বাচ্চাটার কপাল ভালো, ওর মা ভীষণ এক চিৎকার দিয়ে লাফ মেরে গাছের গুঁড়িতে উঠে পড়েছে। বেজিটার নাগালের বাইরে উঠে গেছে বটে, কিন্তু ভয়ের চোটে কিছুতেই স্থির হয়ে সামলে উঠতে পারছে না। দারুণ ভয়ে পা-গুলো যেন অসাড় হয়ে গেছে, গাছের গুঁড়ির গায়ে ওর থাবার চাপটা আস্তে আস্তে আল্গা হয়ে আসছে আর বাচ্চাটাকে মুখে করেই মা-টা একটু একটু করে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। আর নিচেই বেজিটা দাঁড়িয়ে আছে ওপর দিকে মুখ তুলে, হা করে।
কাঠবেরালিটা আর একটা প্রাণ-ফাটানো চিৎকার দিয়ে উঠল। সোনামুখী দেখল আর কয়েক সেকেন্ড মাত্র, তারপরই কাঠবেরালিটা ওর বাচ্চাসুদ্ধই বেজিটার হা-করা মুখের মধ্যে গিয়ে পড়বে। আর বেজিটাও সেই খুশিতে ঘন-ঘন জিভ বের করছে আর লেজ আছড়াচ্ছে।
‘খাওয়াচ্ছি তোমাকে।’— বলে সোনামুখী গর্জে উঠল। ভীষণ এক চিৎকার ছেড়ে সে সেই ডাল থেকে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল ডঙ্গু বেজির ঘাড়ের ওপর। আর এই সুযোগে কাঠবেরালি মা-টা সামলে উঠে বাচ্চাটাকে ভালো করে চেপে ধরে আবার তরতর করে উপরে উঠে গেল। এবার সে উঁচু এক মগডালে গিয়ে বসল, যাতে আর কোনো মতেই বেজিটার খপ্পরে গিয়ে না পড়ে।
এ-দিকে সোনামুখী বেচারির কী হল? ভয়ানক শক্তিশালী ডঙ্গু বেজি। তার মুখের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কি রেহাই পায় সোনামুখীর মতো ছোট্ট, নাজুক কাঠবেরালি? যেই-না ঝাঁপ দেয়া, অমনি ডঙ্গু তার ধারালো দাঁত দিয়ে চেপে ধরল সোনামুখীর নরম লোমে-ভরা ঘাড়টা। তারপর রাগের চোটে তাকে আচ্ছা করে ঝাঁকাতে লাগল। আর মুখ দিয়ে গালাগালির খই ফুটাতে লাগল, ‘পাজি, শয়তান বদমাশ, তোর এত সাহস্! আমার মুখের গ্রাস সরিয়ে দিস্? তুই ভেবেছিস্ কী? ডঙ্গু বেজিকে চিনতে তোর এখনো বাকি আছে। এবার মজাটা টের পাওয়াব তোকে। যেমন আমার মুখের গ্রাস নষ্ট করেছিস্, তোকেই তেমনি খাব আজ।’—এই বলে সোনামুখীকে পটকাতে পটকাতে ডঙ্গু বেজি তার বাসার দিকে হাঁটা দিল। যেতে-যেতে গজগজ্ করতে লাগল, ‘তোকে খাব কী— তোর যা ইটের মতো শরীর, তোকে খেয়ে আমার সুখ হবে না,। অমন নরম কচি বাচ্চাটা তুই আমার মুখ থেকে ফসকে দিলি। তার বদলে তোর এ শক্ত হাড্ডিসার শরীরটা চিবিয়ে থাকতে হবে। দাঁড়া তোকে এমন কষ্ট দিয়ে তিলে-তিলে মারব—বুঝবি আমাকে ঘাঁটানোর ফল।’
সোনামুখী শোনে আর তার মাথাটা ঘুরতে থাকে। একে বেজিটা তাকে দাঁতে কামড়ে ধরে আছড়াতে আছড়াতে নিয়ে যাচ্ছে, তার ওপর এইসব কথা। ডঙ্গু যখন জঙ্গলের ভেতরে তার গর্তের কাছে পৌঁছল, ততক্ষণে পটকানোর ব্যথায় আর মৃত্যুভয়ে সোনামুখী আধমরা হয়ে গেছে; কিন্তু তা সত্ত্বেও তার মনে একটুও আফসোস্ নেই। একটা বাচ্চা আর তার মাকে বাঁচাতে গিয়ে তার এই মরণদশা—তার একটা জীবন গেলে যাক্, তবু মা আর বাচ্চাটা যে বেঁচেছে এইটাই তার সান্ত্বনা।
ডঙ্গু বেজি তার গর্তে ঢুকে সোনামুখীকে মাটিতে নামিয়ে রাখল, তারপর দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘তোকে এক্ষুনি খাব না, না-খাইয়ে তোকে উপোস রেখে আগে কষ্ট দেব, তারপর খাব। থাক তুই আজ কয়েদ হয়ে।’— এই বলে গর্তের বাইরে এসে একটা বড় পাথর ঠেলে গর্তের মুখ বন্ধ করে দিয়ে চলে গেল।
সোনামুখী ভয়ে দিশাহারা হয়ে চারদিকে ছুটোছুটি শুরু করে দিল। প্রথমটা সে ভেবেই পেল না, কী করে এই কয়েদখানা থেকে বের হবে। বারবার করে সেই বড় পাথরখানার ওপর ঝাঁপিয়ে লাফিয়ে পড়তে লাগল, কিন্তু বৃথাই। পাথরখানা একচুলও সরাতে পারল না।
তখন ভয়ে, দুঃখে অবশ হয়ে গর্তের এককোণে এলিয়ে রইল আর মনে মনে আল্লাকে ডাকতে লাগল।
এ-দিকে হয়েছে কী, ডঙ্গু বেজির বউ সকালবেলা উঠে বাপের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিল। ডঙ্গুকে বলে গিয়েছিল, সে-দিন সে বাড়ি ফিরবে না। ডঙ্গু বেজিও সোনামুখীকে গর্তে আটকিয়ে রেখে নিশ্চিন্ত-মনে আবার বাইরে চলে যেতে পেরেছিল। ও-দিকে বেজি-বউ বাপের বাড়ি গিয়ে দেখে, সে-দিন তাদের অবস্থা খারাপ। বাপ-মা কেউই একটাও শিকার ধরতে পারেনি। কাজেই, নিজেরাও উপোস, মেয়েকেও কিছু খাওয়াতে পরেনি। মেয়ে আর কী করবে? বাপ-মার ওপর রাগ করে নিরাশ-মনে খালি পেটে নিজের বাড়িতে ফিরে এল। পথে নিজেও শিকার ধরবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু কপাল মন্দ। একটাও শিকার জুটল না। খিদেয়, পরিশ্রমে হয়রান, পেরেশান হয়ে সে গর্তের মুখের পাথরটা সরিয়ে ভেতরে ঢুকল। আর সঙ্গে সঙ্গে কী যেন একটা তীরের বেগে তার গায়ের ওপর দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল। বেজি-বউ চমকে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে একটা কাঠবেরালি ছুটে পালিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে বেজি-বউ হায় হায় করে উঠল, ‘কার মুখ দেখে উঠেছিলাম আজ। বাপের বাড়ি গেলাম, সেখানে খেতে পেলাম না, নিজেও কিছু ধরতে পারলাম না আবার সর্দার শিকার ধরে রেখেছিল, সেটাও আমার দোষে পালাল। এখন সর্দার এসে বলবে কী? যা রাগী মানুষ সে।’
যা হবার তা হল। সর্দার বেজি তিনপ্রহর বেলায় বাড়ি ফিরে দেখে, শিকার হাতছাড়া। সঙ্গে সঙ্গে ভীষণ রেগে গেল সে। বউকে যা-তা বলে গালাগালি করল, তারপর রাগ করে খালি পেটে ঘরের কোণে শুয়ে রইল। সে-দিন দুজনের কারো খাওয়া জুটল না।
এ-দিকে সোনামুখী বেজির ঘর থেকে বেরিয়েই আর কোনোদিকে চাওয়াচাওয়ি নেই—পড়ি-মরি করে তীরের বেগে ছুটে এক্কেবারে সেই উঁচুগাছটায় নিজের বাসায় এসে থামল। এসে দেখে, সেই কাঠবেরালির মা-টা তার বাচ্চাটাকে নিয়ে তার বাসায় বসে রয়েছে, আর তার সবচেয়ে ভালো বাদামগুলো খেয়েছে। তা দেখে সোনামুখী একটুও রাগ করল না।
প্রথমে এসেই খানিকক্ষণ বসে বসে দম নিল, তারপর একটু সুস্থির হয়ে আস্তে আস্তে কাঠবেরালিটাকে যা-যা ঘটেছিল, সব বলল।
কাঠবেরালি-মা সোনামুখীর বীরত্বের অনেক প্রশংসা করল। এমন সাহসী কাঠবেরালি সে আর দেখেনি। নিজের জীবন বিপন্ন করে অন্যকে বাঁচায়—এ কী কম কথা!
সে-দিনটা সোনামুখীর বাসাতেই ওরা মা-বাচ্চাতে মিলে থাকল। পরদিন সোনামুখী ওদের দুজনকে সঙ্গে নিয়ে ওদের বাসায় রেখে এল। বাসাটা বেশিদূরে নয়, দুটো গাছের পরের গাছটায় ওদের বাসা। বাসায় কাঠবেরালি-বউয়ের স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি আর একটা দেওর আছে। সোনামুখীর সাথে ওদের সবারই আলাপ হল। বিশেষ করে কাঠবেরালি-বউয়ের শাশুড়ি সোনামুখীকে খুব আদর করলেন। এমন পরোপকারী সাহসী কাঠবেরালি তিনি তাঁর জীবনে দেখেননি। সোনামুখীর জন্যেই তাঁর ছেলের বউ আর নাতির প্রাণ বেঁচেছে।
এরপর থেকে সোনামুখীর সঙ্গে ওদের সবার খুব ভাব হয়ে গেল। কাঠবেরালি-বউ প্রায়ই সোনামুখীকে ডেকে-ডেকে কত খাবার তৈরি করে খাওয়াত। শেষে একদিন শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে পরামর্শ করে ওর দেওরের সাথে সোনামুখীর বিয়ে দিয়ে দিল। সোনামুখীর নতুন তৈরী বাড়িতে ওরা দুজন সুখে সংসার করতে লাগল।