নানাজির দুঃসাহসিক অভিযান

নানাজির দুঃসাহসিক অভিযান

জেরিনার কদিন হল জ্বর হয়েছে। ইচ্ছামতো খাওয়া-দাওয়া বেড়ানো সব বন্ধ। কাজেই, মেজাজটিও তার হয়েছে ভয়ানক তিরিক্ষি। এর উপর নানাজিও আসেননি কাল থেকে! ফলে, জেরিনার কাছে ঘেঁষে কার সাধ্যি! যে যাচ্ছে, সেই ধমক খাচ্ছে। সারা বাড়িতে মাকেই একটু যা ভয় করে জেরিনা। সেই মা-ও আজ যখন বার্লির বাটি হাতে তার বিছানার কাছে গেলেন, তাঁকেও হাতের ধাক্কা দিতে ভয় পেল না জেরিনা। ফলে, বাটি মেঝেতে পড়ে চুরমার। বেগতিক দেখে জেরিনার ফুপু চললেন নানাজিকে খবর বার্লির দিতে। এই সংকটে একমাত্র নানাজি ছাড়া আর কেউ-ই হালে পানি পাবে না। তাছাড়া, তাঁর নিজের বদনাম খণ্ডানোর জন্যেও নানাজিকে দরকার ছিল। বার্লির বাটি ভাঙার পর মা ঘরের বাইরে এসে বলেছিলেন—’বাপ্ আর ফুপুর আদরেই মেয়েটা এমন বেয়াড়া বদরাগী হয়েছে।’ অথচ আসল দোষী যে তাঁরই নিজের বাপটি—তার বুড়ো বাপের আদরেই যে জেরিনা এমন হয়ে উঠেছে, সেটা মা কিছুতেই স্বীকার করবেন না। তাই, ফুপু মনে-মনে চটে নানাজিকে আনতে চললেন। তাঁর সামনে আজ বিচার দেবেন—জেরিনাকে কে এমন আদর দিয়ে বেয়াড়া করেছে!

ফুপুকে আর যেতে হল না, তার আগেই শোরগোল করতে করতে নানাজি এসে ঢুকলেন; কিন্তু ঢুকেই জেরিনার মা আর ফুপুর থমথমে মুখ দেখে থমকে গেলেন, বললেন—’এই যে, কী ব্যাপার? সবার মুখে যে আষাঢ়ের মেঘ দেখছি।’

ফুপু ফেটে পড়লেন—’দেখবেন না? আপনারই কীর্তি তো! নাতনীকে আদর দিয়ে মাথায় তুলেছেন আপনি, আর দোষ হচ্ছে আমাদের! যান, নাতনীকে এখন সামলান গিয়ে।’— বলেই তিনি হন্হন্ করে রান্নাঘরের দিকে হাঁটা দিলেন।

নানাজি মেয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন—’কী ব্যাপার মা, খুলে বলো তো?’

জেরিনার মা জেরিনার রাগ আর বার্লির বাটি ভাঙার কথা বললেন— ‘আপনি কাল থেকে না আসাতেই ওর রাগটা বেড়েছে। সকাল থেকে কিছুই খাওয়ানো যায়নি।’

নানাজি বললেন, ‘ও, এই ব্যাপার! তা তুমি যাও, দুধ-বার্লি আবার গরম করে নিয়ে এসো। আমি ওর রাগ ভাঙাচ্ছি। তবে দেখো, পনের মিনিট পরে ঢুকো, বুঝলে? এর আগে যেন বার্লির বাটি দেখিয়ো না।’- বলে নানাজি জেরিনার ঘরের দিকে পা বাড়ালেন।

জেরিনা নানাজিকে দেখেই পাশ ফিরে দেয়ালের দিকে মুখ করলো। নানাজী সে-দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে একটা চেয়ারে ধপাস্ করে বসে পড়ে বলে উঠলেন—’ওরে বাপরে বাপ! একেবারে গেছি। হাড়গোড় একটাও আর নেই শরীরে!’

জেরিনার শরীরটা নড়ে উঠল, কিন্তু এ-পাশে ফেরবার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। নানাজি ফোঁস্ করে মস্ত এক নিশ্বাস ছেড়ে বললেন—’এই বুড়ো বয়সে এত ধকল কি সয়? আকাশ থেকে পাতাল পর্যন্ত কী চর্কি-ঘুরোটাই না ঘুরতে হল! প্রাণে যে বেঁচে আছি, এই তো যথেষ্ট।’

এবার আর জেরিনা স্থির থাকে কী করে? তবুও রাগটাতো এত তাড়াতাড়ি শেষ করে দিলে ভালো দেখায় না, তাই মুখটা গোমড়া রেখেই বেশ ভারিক্কি চালে এ-পাশ ফিরে বলল—’যত সব মিছে কথা। আকাশে পাতালে আবার মানুষ যেতে পারে!’

: পারে না? মিছে তুই ক্লাস ফাইভে পড়িস্! গ্যাগারিন, টিটভ, ভ্যালেন্টিনা—এরা তাহলে কী করে আকাশটা পেরিয়ে তারও ওপারে ঘুরে এল? আর আমি কি শুধু ঘুরেই এলুম? কী দুর্ভোগটা যে এর মধ্যে হয়ে গেল, তা যদি শুনিস্, তোর মতো জ্বরো রুগী তো দূরের কথা, বেতো রুগী পর্যন্ত উঠে দাঁড়াবে।

জেরিনার রাগ-বিরক্তি একটু-একটু করে পেঁজাতুলোর মতো উড়ে-উড়ে যাচ্ছে, তবুও মান বজায় রাখার একটা শেষ চেষ্টা করে বলল, ‘এইতো পরশু সন্ধ্যাতে এখান থেকে গেলে। এর মধ্যে কী এত কাণ্ড হতে পারে!’— বলতে বলতে নানাজি না-আসার দরুন যে রাগটা পালিয়ে যাচ্ছিল, সেটা আবার ফিরে এল—’আমি এ-দিকে জ্বরে পড়ে মরতে বসেছি, আর উনি আকাশপাতালে মজা লুটে বেড়াচ্ছিলেন!

: মজাই বটে! শত্রুর হাতে গ্রেফ্‌তার হয়ে নাকালের একশেষ হওয়াটা মজাই বটে! তুই ভারি স্বার্থপর আপু, প্রাণটা নিয়ে যে বেঁচে ফিরতে পেরেছি, শুনে কোথায় শুকুর-গোজারি করবি, তা না—

রাগ, অভিমান আর থাকতেই পারল না। জেরিনা হতভম্ব হয়ে বলে উঠল, ‘গ্রেফ্‌তার! বল কী? শিগগির বল নানা, কী ব্যাপার?’

: তাহলে শোন্— বলে নানাজি চেয়ার থেকে উঠে জেরিনার বিছানায় জাঁকিয়ে বসে শুরু করলেন—’পরশু দিন তো’ তোর এখান থেকে উঠলাম। তারপর তোর মায়ের পাল্লায় পড়ে একপেট ভুরি-ভোজন করে আইঢাই করতে করতে বাড়ি ফিরলাম। শুয়ে আর ঘুম আসে না। বুড়ো মানুষ তো, বেশি খাওয়া কি সয়? শেষে বিছানা থেকে উঠে নদীর ধারে গেলাম পায়চারি করতে। ভাবলাম, এতে যদি পেটের ফাঁপাটা কমে! তখন রাত অনেক হয়েছে, আশপাশে লোকজন একটিও নেই। হঠাৎ দেখি কী, সারি সারি কাদের যেন নৌকো ঘাটের দিকে আসছে। নৌকাগুলোর গড়ন কেমন যেন কিম্ভূত-কিমাকার, মোটেই আমাদের দেশের নৌকার মতো নয়। আমার সন্দেহ হল, নিশ্চয়ই এগুলো শত্রুর নৌকো, চুপিচুপি এসেছে কোনো খারাপ মতলবে! এই-না ভেবে ঘাটের ওপর গিয়ে দাঁড়ালাম, দেখি কী ওদের মতলব! নৌকোগুলো ঘাটে এসে লাগল, তা থেকে পিপিল্‌ করে লোক বের হয়ে এসে আমাকে ঘিরে দাঁড়াল। লোকগুলোর পোশাক-আশাক কেমন যেন অদ্ভুত, চালচলনও বেখাপ্পা, আর কী যে ঘটোরবটোর করে বলছে, কিছুই বুঝিনে।

আমি খুব রাগ দেখিয়ে হাত ছুড়ে ছুড়ে চেঁচিয়ে বললাম, ‘তোমরা কারা, কী মতলবে এসেছ এখানে?’ অমনি তারা একসঙ্গে হৈ হৈ করে চেঁচাতে লাগল। আমি আরও রেগে চোখ পাকিয়ে, পা দিয়ে ঘাটের শানে জোরে লাথি মেরে, হাত ছুড়ে বললাম, ‘খবরদার, এক্ষুনি ভাগো এখান থেকে, নইলে ভালো হবে না–’

যেই-না বলা এ-কথা, অমনি ওরা সব আমার উপর খেপে উঠল। নিজেদের মধ্যে কীসব বলাবলি করে হঠাৎ আচমকা পিছমোড়া দিয়ে বেঁধে ফেলল আমাকে। কোথা দিয়ে কী ঘটছে, বুঝবার আগেই আমাকে কয়েকজনে মিলে চ্যাংদোলা করে নৌকায় নিয়ে ফেলল। তারপর নৌকো খুলে কোনদিকে কোথায় যে রওনা দিল, হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে থেকে তা টেরও পেলাম না। শেষে সম্পূর্ণ এক অজানা দেশে নিয়ে গিয়ে ওদের বাদশার সামনে আমাকে হাজির করল। এ কয়দিনে এটুকু বুঝেছি, এরা দুর্দান্ত বুনো তাতার— এদের ভাষা আমাদের জানা কোনো ভাষা নয়। এদের দেশটা যে পৃথিবীর ঠিক কোন্ জায়গায়, তাও বোঝা গেল না। যাই হোক্, ওদের বাদশা ওদের মতোই কিম্ভূত-কিমাকার পোশাক-পরা। তিনি আমাকে দেখে খুশি হলেন কি ব্যাজার হলেন, টের পেলাম না। কী যে বললেন, তিনিই জানেন। তবে, প্রাণে যে মরতে হবে না, এটুকুই শুধু বুঝলাম। কারণ, তক্ষুনি আমাকে নিয়ে যাওয়া হল বাদশার চাক্খানায়। সেখানে দেখি, দুশো মৌমাছি চাকের খোপে-খোপে বসে আছে।

বাদশার এক পেয়াদা আমাকে নানা কসরত করে বুঝিয়ে দিল, এই দুশো মৌমাছির খবরদারি আমাকে করতে হবে। দু-দিন ধরে লোকটা আমার সঙ্গে সঙ্গে থেকে সব শিখিয়ে-পড়িয়ে দিল। বুঝলাম, বাদশার মৌমাছির রাখালি করেই আমাকে বাকি জীবনটা কাটাতে হবে। রোজ সকালবেলা একথালা পান্তাভাত খেয়ে মৌমাছিগুলোকে মাঠে নিয়ে যেতাম। সারাদিন চরিয়ে সন্ধ্যাবেলা আবার তাদেরকে চাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসতাম। সকালসন্ধ্যা দুবেলা মধুও দুইতে হত। ওই দুশো মৌমাছির মধু দোয়ানো কি চাট্টিখানি কথা! প্রথম ক’দিন তো হাতের ব্যথায় জ্বরই এসে গিয়েছিল।

যাই হোক, এমনি করেই দিন কাটছিল। একদিন সন্ধ্যাবেলা মৌমাছিগুলো গুনতে গিয়ে দেখি, একটি মৌমাছি নেই। সর্বনাশ, বাদশা তাহলে আর আস্ত রাখবে না! ভেবেছিলাম, গরম গরম ভাত খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ব। সে-সব মাথায় উঠল—তক্ষুনি ছুটলুম মৌমাছি খুঁজতে। না পেলে তো নির্ঘাত গর্দান যাবে। খুঁজতে খুঁজতে দেখি, দুটো বুনো শুয়োর মৌমাছিটার মধু খাবার লোভে তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। মৌমাছিটা ছুটোছুটি করে একেবারে হয়রান হয়ে পড়েছে। এই নেতিয়ে পড়ে আর কী! আমার হাতে কোনো অস্ত্র ছিল না। কেবল বাদশার মালী আর গোলামদের কাছে যে-রকম ছোট কুড় ল থাকে, তেমনি একটা রুপোর ছোট কুড়ুল ছিল। শুয়োর দুটোকে ভয় দেখাবার জন্যে আমি কুড়ুলটা তাদের দিকে ছুড়ে মারলাম; কিন্তু কপাল মন্দ, হাতের একটা ওপর-মুখো ঝাঁকুনির ফলে কুড়ুলটা ওপর দিকে উঠে গেল। আমি হাঁ করে দেখতে লাগলাম, কুড়ুলটা উঠতে উঠতে এক্কেবারে চাঁদে গিয়ে ঠেকল।

বিষম মুশকিলে পড়লাম, কী করে এখন নামাই কুড়ুলটাকে? ওটাই যে আমাদের ব্যাজ— এই তোদের যেমন গার্লগাইড ব্যাজ। হঠাৎ আমার মনে পড়ল, তুর্কি সিমের গাছ খুব তাড়াতাড়ি গজায় আর বেজায় লম্বা হয়। তক্ষুনি একটা তুর্কি সিমের গাছ লাগিয়ে দিলাম। গাছটা গজিয়েই বাড়তে লাগল, বাড়তে বাড়তে শেষে কাস্তের মতো চাঁদটার একটা কোণায় গিয়ে আটকে গেল। আমি তখন তরতর করে গাছটা বেয়ে চাঁদে উঠে গেলাম। সেখানে সবকিছুই রুপোর মতো ঝক্‌ঝক্ করছে, এর মধ্যে রুপোর কুড়ুলটা খুঁজে পেতে একটু ঝামেলাই হলো। যাই হোক, অনেকক্ষণ ধরে খোঁজাখুজির পর কুড়ুলটা পেলাম।

এবার নামবার পালা; কিন্তু নামতে গিয়ে দেখি, কড়ারোদে সিমগাছটা শুকিয়ে গেছে। হায় হায়, এখন নামি কী করে? মাথায় হাত দিয়ে বসে-বসে ভাবলাম অনেকক্ষণ। তারপর এ-দিক ও-দিক ঘুরেফিরে খড়কুটো যোগাড় করে একটা লম্বা দড়ি তৈরি করলাম। এই দড়ি বেয়েই নিচে নামব। বিসমিল্লাহ্ বলে দড়ির একটা দিক চাঁদের কোণায় বেঁধে ঝুলিয়ে দিলাম; কিন্তু নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি কী, দড়িটা পৃথিবী পর্যন্ত পৌছয় নি—শূন্যে ঝুলে রয়েছে! যাই হোক্, আল্লাহই তরাবেন’ বলে ঝুলে পড়লাম। দড়িটার শেষ মাথায় এসে মাথাটা বোঁ করে ঘুরে গেল। দু-চোখে অন্ধকার দেখলাম; কিন্তু তাই বলে হাল ছেড়ে দিলাম না। বাঁ-হাতে দড়ির শেষ মাথাটা চেপে ধরে ডানহাতে কুড়ুলটা দিয়ে দড়ির ওপরের অংশটা কেটে ফেললাম। সেই কাটা দড়িটা বাঁ-হাতে ধরা দড়ির নিচের মাথার সঙ্গে শক্ত গিঁট দিয়ে দিলাম। দড়িটা আরো খানিকটা লম্বা হল। তাই ধরে ধরে আরো অনেকটা নিচে নেমে এলাম।

তারপর আবার আগের মতো দড়ির ওপরের অংশ কেটে নিচের মাথায় বেঁধে দড়ি লম্বা করে আরো খানিকটা নামলাম। তারপর দড়ি কাটি আর গিঁট দিই আর নামি—নামতে নামতে পৃথিবীর কাছে এসে পড়লাম; কিন্তু বারবার কাটা আর গিঁট দেওয়াতে দড়ির জোর যে কমে যাচ্ছিল, তা বুঝতে পারিনি। পৃথিবী থেকে আর মাত্র চারমাইল ওপরে যখন, তখন দড়িটা গেল পটাস্ করে ছিঁড়ে। আর আমি এমন জোরে ধপাস্ করে মাটির ওপর এসে পড়লাম যে, সেই চোটে মাটি বসে দশহাত গর্ত হয়ে গেল।

প্রথমটা পড়ার চোটে মাথা ঝিম মেরে রইল কতক্ষণ, তারপর গর্ত থেকে বেরোবার চেষ্টা করতে লাগলাম। পড়ার চোটে কুড়ুলটাও যেন কোন্‌দিকে ছিকে গেছে, তার আর পাত্তাই পাওয়া গেল না। শেষমেষ আঙুল আর নখ দিয়ে মাটি কেটে ধাপ করে গর্তের ওপর এসে উঠলাম। চারদিকে চেয়ে দেখি, এ তো তাতার বাদশার দেশ নয়! এটা আরেক অচেনা জায়গা।

চারদিকে উঁচুনিচু পাহাড়, সামনে সরু রাস্তা, আর বেজায় ঠাণ্ডা। পাহাড়ের চূড়োয়-চূড়োয় বরফ জমে আছে দেখতে পেলাম। তাতার বাদশা আর তার দুশো মৌমাছির হাত থেকে রেহাই পেয়ে খুশি হয়ে উঠলাম; কিন্তু খুশিটা বেশিক্ষণ থাকল না। এই দুরন্ত শীতে বাঁচব কী করে? গায়ে যে একটা গরম জামাও নেই! এমন সময় দেখি, সরু রাস্তাটা দিয়ে একটা ঘোড়ার গাড়ি যাচ্ছে। দৌড়ে গেলাম গাড়িটার কাছে। শুধু একটা কোচোয়ান ছাড়া কেউ নেই গাড়িটাতে। আমাকে সঙ্গী পেয়ে কোচোয়ানটা খুশিই হল। বলল, ‘সামনেই একটা সরাই আছে। সেখানে গিয়ে গরম-গরম খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ব।’ তার পাশে একটা সানাই দেখে বললাম, ‘তুমি সানাই বাজাতে পার?’ সে ঘাড় বেঁকিয়ে বলল, ‘হুঁঃ! পারিনে আবার! এই দ্যাখো, কেমন সুন্দর সুর এটার।’— বলে ঘোড়ার লাগামটা আমার হাতে দিয়ে সে সানাইয়ে ফুঁ দিল; কিন্তু সানাইটার ভেতর থেকে একটুও আওয়াজ বেরুল না। আমি একটু মুচকি হেসে ভাবলাম—যত চাল! বাজাতে জানে না, তার আবার দেমাক্ কত!

আমার হাসি দেখে কোচোয়ান রেগে উঠল। প্রাণপণে গাল ফুলিয়ে সানাইতে ফুঁ দিল; কিন্তু সানাই যে চুপ, সেই চুপ। কোচোয়ানের মুখ লাল হয়ে উঠল, সে বাইরের দিকে তাকিয়ে গুম হয়ে রইল। আমিও কোনো কথা বললাম না।

সরাইখানায় পৌঁছেই ছুট লাগালাম রান্নাঘরের দিকে। কোচোয়ান তার সানাইটা চুলোর পাশের দেয়ালে একটা পেরেকে ঝুলিয়ে রাখল। আমরা আগুনের সামনে হাত-পা সেঁকতে বসলাম। খানিক পরেই বলা নেই, কওয়া নেই, হঠাৎ… টেরেং টেরেং, টেং টেং, ক্যাঁ ক্যাঁ কোঁ কোঁ— নানারকম সুর শোনা যেতে লাগল।

আমরা দুজনে চমকে উঠে চারদিকে চেয়ে দেখি, সানাইটা আপনা-আপনি বাজছে। এতক্ষণে বুঝলাম কোচোয়ান কেন অত গাল ফুলিয়ে চেষ্টা করলেও সানাই বাজেনি। সুরগুলো সব সানাইয়ের ভেতরে ঠাণ্ডায় জমে গিয়েছিল। এখন আগুনের তাপ পেয়ে সেগুলো গলে বের হচ্ছে। কোচোয়ানের মুখ গর্বে ভরে উঠল, ভাবখানা এই—–দ্যাখো আমি বাজাতে পারি কি-না। সত্যিই, সানাইয়ে মুখ না-দিয়েই সে আমাদের অনেকক্ষণ ধরে অনেক সুর শোনাল।

জেরিনা এতক্ষণ অবাক হয়ে হা করে শুনছিল আর মাঝেমাঝে খিখিক্ করে হেসে কুটিপাটি হচ্ছিল। এবার সে থাকতে না-পেরে বলে উঠল—’যতসব গাঁজাখুরি গল্প। কালকে একটা দিনের মধ্যে তুমি এত জায়গা গেলে কী করে? তারপর আবার ফিরলেই বা কী করে?

নানাজি হেসে ফেলে বললেন—’ঐ দ্যাখো, খালি অবিশ্বাস! ফিরলাম কী করে, তাই তো বলছি এবার।’

সরাইখানায় তো খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লাম। কী শীত রে বাবা সে রাতে! বুড়ো হাড়গুলো ঠঠুকিয়ে কাঁপে আর আল্লাহর কাছে কঁকিয়ে বলি, ‘আল্লাহ, বিনা দোষে এ শাস্তি কেন আমার? জেরিনার মা বেশি খাইয়ে পেট ফাঁপালো আমার। সেজন্যই-না রাত বারোটায় নদীর ধারে গেলাম আর অজানা শত্রুর হাতে গ্রেফ্‌তার হলাম। শাস্তি যদি পেতে হয় জেরিনার মা-ই পাক্। আল্লাহ্, আমাকে আমার বাড়ি পৌঁছে দাও। আমার নাতনীটা আমাকে না-দেখে কেঁদে-কেঁদে সার হচ্ছে! তাই-না আল্লাহ্ আমাকে আবার ফিরিয়ে দিয়ে গেলেন। ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখি, নদীর ঘাটের শানের ওপর শুয়ে আছি।’

জেরিনা উঠে বসে বলল, ‘দুহ্, হাওয়া খেতে গিয়ে নদীর ঘাটে ঘুমিয়ে পড়ে যতসব আজগুবি স্বপ্ন দেখেছ! মা, আমার খিদে পেয়েছে, তোমার হাতে কী ওটা, দাও না!’

মা বহুক্ষণ থেকে বার্লির বাটি হাতে করে নানাজির পেছনে দাঁড়িয়েছিলেন। এবার তিনি বাটিটা জেরিনার দিকে এগিয়ে দিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *