পটির কেরামতি

পটির কেরামতি

ছাগল-পাড়ার ছোট মোড়ল ভুটি ছাগল মারা যাবার পর তার বিধবা বউ পটি সাতটি অপোগণ্ড ছানাকে অনেক কষ্টে মানুষ করছিল। অন্য অবস্থাপন্ন ছাগলদের বাড়িতে কাজকর্ম করে কোনোমতে খাওয়া-পরা চালাচ্ছিল। তবে, পটির একটা গুণ ছিল—কারো ফোঁড়াটোড়া পাকলে ক্ষুর দিয়ে বেশ সুন্দর করে কেটে সুচসূতো দিয়ে সেলাই করে দিতে পারত। আবার কাটবার আগে একরকম ইনজেকশান দিয়ে নিত, তাতে একটুও ব্যথা লাগত না। তাছাড়া, জ্বর-জারি, সর্দি-কাশির ছোটখাটো ওষুধ দেওয়া, হাত-পা ভাঙলে চুন-হলুদের প্ল্যাস্টার দিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দেওয়া, এ-সব কাজ সে ভালোই করত।

তার বাপ এক ডাক্তারের কম্পাউন্ডার ছিল কি-না, তাই ছোটবেলা থেকে দেখে-দেখেই এ-সব তার রপ্ত হয়ে গিয়েছিল। এ-জন্য ছাগল-পাড়ার সব বাড়িতেই হর-হামেশা তার ডাক লেগেই থাকত, আর রোজগার যা হত, সাতটি বাচ্চা নিয়ে কোনোমতে খাওয়া-পরা চলে যেত।

সে বছর ছাগল-পাড়ায় এক দৈত্যের মতো বিরাট নেকড়েবাঘের বড় উৎপাত শুরু হল। সন্ধে লাগলেই ছাগলদের বাড়িগুলোর আনাচে-কানাচে ঘোরাঘুরি করবে আর বাচ্চা-ছাগল পেলেই ধরে ঘাড় মটকাবে। কত যে ছাগলছানা নেকড়েটার পেটে গেল তার হিসেব নেই। ছাগলদের ঘরে-ঘরে হৈচৈ, কান্নাকাটি পড়ে গেল, সামাল সামাল রব উঠল।

পটি ছাগলীও বড্ড ভয়ে ভয়ে থাকে, এই বুঝি নেকড়েবাঘটা তার বাচ্চাদেরই ঘাড় মটকায়। তার সাতটি ছানা তার কজের টুকরো, চোখের মণি! বাড়িতে কোনো পুরুষ ছাগলও নেই, সেই একা—তাও তো কাজকর্মে প্রায়ই তাকে বাইরে যেতে হয়। বাচ্চাগুলো তখন থাকে একা। কী জানি কখন কী হয়, এই ভয়েই পটি অস্থির। সন্ধের পর পারতপক্ষে বাড়ি থেকে বেরোয় না, দরজা-জানালা সব বন্ধ করে থাকে।

এমনি সময় একদিন রাত দশটায় ছাগল-পাড়ার বড় মোড়লের বাড়ি থেকে পেয়াদা এল জরুরি তলব নিয়ে—মোড়লের ছোট ছানাটার পায়ের গোড়ালিতে একটি ফোঁড়া পেকেছে, যন্ত্রণায় অস্থির; এক্ষুনি কাটতে যেতে হবে।

পটির মাথায় তো আসমান ভেঙে পড়ল, এই রাত দশটায় বাচ্চাদের একলা ফেলে সে যাবে কী করে? পেয়াদাকে বলল, ‘কাল সকালে গেলে হয় না? নেকড়েবাঘের উ ৎপাত, বাচ্চাদের একলা ফেলে যাই কী করে?

পেয়াদা হুমকি দিয়ে বলল, ‘না, এক্ষুনি যেতে হবে। মোড়ল হুজুরের ছানাটা পাকা ফোঁড়ার টাটানিতে ভ্যা ভ্যা করছে। তুমি কি চাও সারারাত কেউ ঘুমোবে না?

পটি কী আর করে? মোড়লের তলব! ক্ষুর, সুচ, সূতো, ইন্‌জেশান—সব সরঞ্জাম গুছিয়ে ছানাদের ডেকে বলল, ‘বাছারা, আমি চললাম, খুব হুঁশিয়ার হয়ে থেকো। নেকড়েবাঘটা বড় শয়তান। একবার যদি কোনোমতে ঘরে ঢুকতে পারে তো তোমাদের সবাইকে হাড়-মাংসশুদ্ধ চিবিয়ে খাবে। শুনেছি, শয়তানটা আবার ছদ্মবেশ ধরে ছাগল ভোলাবার চেষ্টা করে; কিন্তু তোমরা ওর হেঁড়ে গলা শুনে আর ওর কালো পা দেখলেই বুঝে ফেলো যে ও নেকড়ে।’

সাতটি ছাগলছানা একসঙ্গে বলে উঠল, ‘মা, তুমি কিচ্ছু ভেব না। আমরা খুব সাবধানে থাকব।

পটি বাচ্চাদের চুমো খেয়ে পেয়াদার সঙ্গে চলে গেল। বাচ্চারা দরজায় খিল এঁটে বিছানায় শুয়ে পড়ল।

খানিক পরেই দরজায় ঘা পড়ল। আর খুব হেঁড়ে গলায় কে যেন বলল, ‘ওঠো, ওঠো আমার সোনামণি বাছারা। এই যে তোমাদের মা এসেছে, মোড়ল তোমাদের জন্য কত খাবার দিয়েছে দেখ।’ কিন্তু ছানারা হেঁড়ে গলা শুনেই বুঝল, এ তাদের মা নয়। তারা বলল, ‘না, দরজা খুলব না। তুমি আমাদের মা নও! মার গলার স্বর খুব মিষ্টি। তোমার হেঁড়ে গলা শুনে বুঝতে পেরেছি তুমি নেকড়ে।’

নেকড়েটা এ-কথা শুনে একটা ময়রার দোকানে গেল। সেখানে একসের চিনি কিনে খেতেই তার গলার স্বর মিষ্টি হয়ে গেল। তখন সে আবার এসে পটির বাড়ির দরজায় ঘা দিয়ে মিষ্টি গলায় ডাকল, ‘ওঠো, ওঠো বাছারা। এই যে তোমাদের মা এসেছে, দ্যাখো কী-সব জিনিস দিয়েছে মোড়ল।’

কিন্তু এবারও ছাগলছানারা জানালা দিয়ে নেকড়ের কালো পা দেখে বলে উঠল, তুমি আমাদের মা নও। মার পা তোমার পা-র মতো কালো নয়। তুমি নেকড়ে। আমরা দরজা খুলব না।’

এবার নেকড়েটা একটা রুটিওয়ালার কাছে গিয়ে বলল, ‘আমার পা-র চামড়া ছিলে গেছে। খানিকটা ময়দার খামির আমার পায়ে লাগিয়ে দাও।’ তারপর নেকড়ে এক ময়দার কলের মালিকের কাছে গিয়ে খানিকটা ময়দা কিনে সমস্ত পা-র উপর ছড়িয়ে দিল। এতে তার পাগুলো শাদা হয়ে গেল।

এবার যখন শয়তান নেকড়েটা ছাগলছানাগুলোকে দরজা খুলতে বলল, তখন ছানারা তার মিষ্টি গলার স্বর শুনে আর শাদা পা দেখে ভাবলো, তাদের মা-ই বুঝি ফিরে এসেছে। তখন তারা উঠে দরজা খুলে দিল। তারপর অবাক!

হায়! দরজা দিয়ে যে ঘরে ঢুকল, সে তো তাদের মা নয়, সেটা সেই শয়তান নেকড়ে!

ছাগলছানারা ভয়ের চোটে এ-দিক ও-দিক ছুটোছুটি করে লুকোবার চেষ্টা করল। বড়টা টেবিলের নিচে লুকাল, মেজোটা বিছানায় গিয়ে উঠল, সেজোটি চুলোর ভেতরে ঢুকল, তার পরেরটা ভাঁড়ার ঘরে, তার পরেরটা মিটসেফে, আরেকটা পানির বাতির মধ্যে আর সবচেয়ে ছোট ছানাটা আলমারির পেছনে গিয়ে সেঁধোল; কিন্তু ধূর্ত নেকড়েটা ছ’টা বাচ্চাকেই একে-একে খুঁজে বের করে টপাটপ গিলে ফেলল। কেবল আলমারির পেছনে লুকানো ছোট ছানাটাকে বের করতে পারল না।

ছ’টা ছানা খেয়ে তার পেট ভরে চোখে ঘুম এসে গেল। তারপর সে সেখান থেকে বেরিয়ে পেছনের এক ঝোপঝাড়ওয়ালা মাঠে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

এ-দিকে মোড়লের বাড়ির কাজ সেরে পটি হন্হন্ করে বাড়ি এসে দেখে—ভয়ানক দৃশ্য! বাড়ির দরজা খোলা, ঘরের ভেতরে সব জিনিসপত্র তছনছ্— টেবিল-চেয়ার ওলটানো, বালিশ-তোশক-চাদর ছিঁড়ে ফাল্লাফাল্লা, বাসন-পেয়ালা-গেলাস ভেঙে চুরমার। পটি ব্যাকুল হয়ে এক-এক করে বাচ্চাদের নাম ধরে ডাকতে লাগল, কারো সাড়া পেল না। ছোট ছানাটার নাম ধরে ডাকতেই সে চিঁচিঁ করে বলল, ‘এই যে মা, আমি আলমারির পেছনে।’ তার মা যখন তাকে টেনে আলমারির পেছন থেকে বের করল, তখন সে কাঁদতে কাঁদতে মাকে সব ঘটনা খুলে বলল।

পটি ছাগলীর তখন সে কী কান্না! ছানাদের দুঃখে তার বুক যেন ফেটে যেতে লাগল। শেষে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এ-দিক ও-দিক ঘুরে বেড়াতে লাগল। ছোট ছানাটা মা-র পেছুপেছু দৌড়োতে লাগল। বাড়ির পেছনের মাঠে এসে তারা দেখল রাক্ষুসে নেকড়েটা নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। তার নাক ডাকানির চোটে আশপাশের ঝোপঝাড়গুলো পর্যন্ত কাঁপছে।

পটি আর তার বাচ্চা, শয়তানটার চারপাশে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। পাহাড়ের মতো বিরাট পেটটা নিয়ে সে পড়ে আছে। পটি দেখতে পেল, নেকড়েটার পেটের ভেতর কী যেন সব নড়ে-চড়ে বেড়াচ্ছে। সে চমকে উঠল— ‘হায় আল্লাহ্, একি সম্ভব যে আমার বাচ্চাগুলো ওর পেটের মধ্যে এখনও বেঁচে আছে?’

আশায় বুক বেঁধে পটি দৌড়ে বাড়ি থেকে তার অপারেশনের যন্ত্রপাতিগুলো নিয়ে এল। খুব সাবধানে নেকড়েটার বিরাট পেটটার একপাশে প্রথমে একটা ইন্‌জেশান দিয়ে জায়গাটা অসাড় করে নিল। তারপর আস্তে আস্তে ধারালো ক্ষুর দিয়ে খানিকটা চামড়া চিরে ফেলল। যেই-না চেরা হয়েছে আর অমনি একটা ছাগলছানার মাথা ওর পেটের ভেতর থেকে উঁকি দিল।

পটি চেরা-জায়গাটা একটু বড় করে কাটতে ছ’টি ছাগলছানাই একে-একে টুপটুপ করে নেকড়েটার পেট থেকে বেরিয়ে পড়ল। নেকড়েটা লোভে পড়ে তাড়াতাড়িতে ছাগলগুলোকে চিবিয়ে খাবার অবসর পায়নি, গোটা-গোটাই গিলে ফেলেছিল। তাই, ছানাগুলোও গোটা-গোটাই বেরিয়ে এল। পটির তখন আনন্দ দেখে কে! বাচ্চাদেরকে আদর করে, চুমো খেয়ে তারপর বলল, ‘বাছারা, তাড়াতাড়ি কিছু ইট-পাটকেল কুড়িয়ে নিয়ে এস। শয়তানটার পেটে ও-গুলো ভরে সেলাই করে দিই।’

ছানাগুলো ইট-পাটকেল-পাথর কুড়িয়ে নিয়ে এল। পটি সেগুলো দিয়ে নেকড়েটার পেট ঠেসে বোঝাই করে কাটা জায়গাটা সেলাই করে দিল। তারপর সাতটি ছানাকে নিয়ে বাড়িতে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।

এ-দিকে নেকড়েটার যখন ঘোর ভাঙল, তখন তার বেজায় পিপাসা পেয়েছে। একটা ঝরনার কাছে গিয়ে পানি খাবে, এই মতলবে সে উঠে দাঁড়াল; কিন্তু দাঁড়ানো মাত্রই তার পেটের ভেতরের পাথরগুলো খটমট শব্দ তুলে নড়ে উঠল।

নেকড়েটা ভড়কে গিয়ে ভাবল, ‘এ-কী ব্যাপার! দেখলাম নরম তুলতুলে ছাগলছানা, এখন পেটের মধ্যে ইট-পাথরের শব্দ হচ্ছে!’ তা ছাড়া, পাথরগুলোর চাপ ঐ সেলাই-করা কাটা জায়গায় পড়তেই চিনচিন করে ব্যথা করতে লাগল। নেকড়েটা ঝরনার ধারে পৌঁছাল, তখন ব্যথায় আর অজানা ভয়ে সে পাগলের মতো হয়ে উঠেছে। ঝুঁকে পড়ে যেই পানি খেতে গিয়েছে, আর অমনি পা পিছলে ঝরনার মধ্যে পড়ে গেল। উঠবার চেষ্টা করল, কিন্তু পেটের ভেতরকার ইট-পাথরের ভারে সে উঠতে পারল না। পানির মধ্যে পড়ে ডুবে মারা গেল।

পটি আর তার ছানারা যখন জানতে পারল যে, নেকড়েটা মারা গেছে, তখন তারা খুশিতে লাফিয়ে চেঁচিয়ে পাড়া মাত করে সবাইকে সু-খবরটা জানিয়ে দিল। ছাগল-পাড়ার সবাই যখন শুনল যে, পটির কেরামতিতেই নেকড়েটা মরেছে, তখন তারা পটি আর তার ছানাদেরকে অনেক জিনিসপত্র উপহার দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *