বিজন বনের পুষুমণি

বিজন বনের পুষুমণি

বিজন বনের মধ্যে মস্ত উঁচু একটা পাহাড়। সেই পাহাড়ের মধ্যে এক্কেবারে চূড়ার কাছাকাছি একটা গুহা, সেই গুহার মধ্যে থাকে রঙ পুষুমণি— ওর বাবা, মা আর ছোট বোনটির সাথে।

রঙ পুষি দেখতে ভা-রি সুন্দরী। হালকা গোলাপি আভা দেওয়া শাদা রঙ ওর – কেবল মাথাটা, কান দুটো, লেজটা আর পায়ের থাবা চারটে কুচকুচে কালো। কী চকচকে রেশমের মতো মোলায়েম, নরম ওর গায়ের লোম। লেজটা কেমন বেঁকে ওপর দিকে উঠে গেছে, ফুলো-ফুলো কালো লোমে যেন ঝালর দেওয়া। চোখ দুটো চমৎকার কটা। কালো থাবাগুলো দেখলে মনে হয় পুষুমণি যেন পায়ে কালো জুতো পরে রয়েছে। গোলাপি ঠোঁটের দু-পাশে তারের মতো সরু, শক্ত, গোঁফের গোছাগুলো আবার চিকচিকে কালো। তাতে রঙর মুখের বাহার খুলেছে আরো বেশি।

রূপের জন্য রঙর মনে অহংকারের আর সীমা নেই। ওরই বা দোষ কী! ছোটবেলা থেকে সবাই ওর রূপের প্রশংসা করে করে মাথাটি বিগড়ে দিয়েছে। এইজন্যই বোধকরি ও একটু জেদি, বেয়াড়া আর বে-পরোয়াও রটে। কোনো কিছুকেই রঙর ভয় নেই। থাকবে কী করে, যেখানেই যায়, সবাই আদর করে মাথায় রাখতে চায় যে!

রঙুর মা রঙুর বেয়াড়াপনার জন্যে প্রায়ই ওকে বকে। আর সাবধান করে দেয়, ‘খবরদার বনের রাস্তায় বেশিদূর যাবি নে। এখন ছোট আছিস্, পথ ভুলে কোথায় যেতে কোথায় চলে যাবি, শেষে মানুষের পাল্লায় গিয়ে পড়বি। মানুষের হাতে পড়লে আর বাঁচবি নে। কষ্টের একশেষ হবে।’

মার কথা শুনে রঙুর ভয়ও হয়, আবার কৌতূহলও হয়— মানুষ কেমন তা দেখবার জন্য; কিন্তু বনের পথে বেশিদূর যেতে পায় না ও, বাবা-মা সবসময় চোখে-চোখে রাখে। বেশিদূর যেতে না পেরে ক্রমেই হাঁপসিয়ে ওঠে আর মানুষের হাতে কষ্টের কথাটা ভুলে শেষে মানুষ দেখার কৌতূহলটা ওর বেশি হয়ে ওঠে।

শীতের এক সুন্দর সকালে রঙ ঘুম ভেঙে আড়মোড়া দিয়ে উঠে বসল। চেয়ে দেখল, সারারাত শিকার ধরে ক্লান্ত হয়ে বাবা-মা অসাড় হয়ে ঘুমুচ্ছেন।

গুহার মধ্যে অনেক শিকার। রঙ ইচ্ছেমতো খেয়ে পেট ভরিয়ে ভাবল, ‘বাবা-মা ঘুমোচ্ছে। এই ফাঁকে একটু দূর গিয়ে মানুষ দেখে আসি। বাবা-মা টের পাবার আগেই আবার ফিরে আসব।

গুহা থেকে বেরিয়ে পাহাড়ের গায়ের আঁকাবাঁকা সরুপথটি বেয়ে রঙ নিচের জঙ্গলে নেমে এসে দাঁড়াল। তারপর মনের খুশিতে এ-দিক ও-দিক ঘুরে বেড়াতে লাগল। হঠাৎ নজরে পড়ল ছোট্ট একটা ঝোপের ওপর বসে নীলরঙের একটা পাখি। আর যায় কোথা। একলাফ দিয়ে রঙ ঝাঁপিয়ে পড়ল নীলপাখিটার ওপর। নীলপাখি ফুরুৎ করে উড়ে আরেকটা ঝোপে বসল। রঙ আবার দৌড়ল ওর দিকে। নীলপাখিও আবার উড়ে নড়ে বসল। এমনি শিকার-শিকার খেলা চলল অনেকক্ষণ। তারপর হঠাৎ নীলপাখিটার মনে পড়ল ওর দুপুরের খাবার জন্যে এখন কেঁচো ধরতে যেতে হবে। অমনি ফুরুৎ করে উড়ে ও কোন্‌দিকে যেন চলে গেল।

রঙ ভাবল আর একটু এগিয়ে যাই, তাহলে হয়তো মানুষের দেখা পেয়ে যাব। এই ভেবে, সে সামনের রাস্তাটা দিয়ে এগিয়ে চলতে লাগল। যতই চলে, ততই যেন চারপাশে জঙ্গল আরো ঘন মনে হয়। চলতে চলতে ওর খিদে পেয়ে গেল— ‘দুর ছাই, মানুষ খুঁজতে খুঁজতে খিদেয় পেট চোঁচো করে উঠল, মানুষের দেখা নেই। আর মানুষ দেখে কাজ নেই। এখন বাড়ি ফিরি। নইলে মা বকাবকি করবে আবার।’

আর বাড়ি ফিরতে গিয়েই রঙ টের পেল ও রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে। সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে ওর বুক হিম হয়ে গেল। এখন কী করবে ও, কেমন করে বাড়ি ফিরবে? উহ্, কেন যে মার কথার অবাধ্য হয়েছিল! দিশেহারা হয়ে রঙ এ-রাস্তা ও-রাস্তা খানিক দৌড়াদৌড়ি করে ফিরল। তারপর হঠাৎ একটা ফাঁকা জায়গায় এসে পড়ল। চারদিকে অনেকখানি জায়গা জুড়ে গাছপালা একদম নেই, এ-দিক ও-দিক অনেকগুলো কুঁড়েঘর রয়েছে— আর ঘরের ভেতরে, বাইরে একধরনের কিম্ভূত জীব ঘোরাফেরা করছে। রঙ এতদিন ওর মার কাছে যা শুনেছে, তাতে বুঝল এরাই মানুষ। ও অবাক হয়ে চেয়ে-চেয়ে ওদের দেখতে লাগল। মানুষগুলোর গায়ের রঙ শ্যামলা, পরনে রঙচঙে ডোরাকাটা কাপড়। মানুষগুলো সবাই কাজে ভারি ব্যস্ত। মেয়েরা কেউ হাঁড়ি-বাসন মাজছে, কেউ কুটনো কুটছে; পুরুষরা কেউ মাছধরা জাল, কেউ ঝুড়ি, কেউ-বা তাঁতে কাপড় বুনছে। ছোট ছোট বাচ্চারা খেলে বেড়াচ্ছে। দুটো ছোট ছোট ছেলে পাথরের নুড়ি দিয়ে খেলছিল। ওদের একজন হঠাৎ মুখ তুলেই পুষিকে দেখতে পেল। আর অমনি খুশিতে চিৎকার দিয়ে উঠল ও। লাফ দিয়ে একটা ছেঁড়া জালের টুকরো নিয়ে দৌড়ে এসে ছেলেটা রঙুর গায়ের উপর ছুড়ে দিল জালটা।

ভয়ানক ভয় পেয়ে রঙ হাত-পা ছুড়ে জালটা খামচে কামড়ে বের হবার চেষ্টা করল; কিন্তু বের তো হতেই পারল না, বরং জালে আরো জড়িয়ে গেল। ছেলেটা জালসুদ্ধ চেপে ধরে ওর বাপের কাছে নিয়ে গেল। ওর বাবা তো এমন সুন্দর বেড়ালের বাচ্চা দেখে ভারি খুশি। বলল, ‘এ তো বহুত আচ্ছা বেড়াল দেখছি। এখন একটা ঝুড়ি চাপা দিয়ে রেখে দে। সন্ধ্যায় শহরে হাটে গিয়ে যে-লোকটা কুকুর-বেড়াল-পাখি বেচে, তার কাছে এটা বেচে দেব।’

বেচারা রঙ সারাদিন ঝুড়ি-চাপা হয়ে পড়ে রইল। না একদানা কাবার, না একফোঁটা পানি কেউ ওকে দিল। পানির পিয়াসে ওর গোলাপি জিভটা শুকিয়ে বেরিয়ে পড়ল। ওর বুকটা ধড়াস ধড়াস করতে লাগল, চোখ ঘোলাটে হয়ে গেল। ও কেঁদে কেঁদে ভাবতে লাগল, ‘মার কথা তো সত্যিই। এবার বুঝি মারা পড়তে হয় মানুষের হাতে! কেন যে মার কথা শুনিনি।’

ছেলেটার বাবা জেলে। সারাদিন মাছ ধরে সন্ধের সময় মাছের ঝুড়ি মাথায় নিয়ে তাতে রঙর ঝুড়িটা ঝুলিয়ে জেলে চলল শহরে। সারাদিনের খিদে-তেষ্টার ওপর মাছের গন্ধ এসে নাকে লাগছে, কষ্টে রঙুর ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠতে ইচ্ছে করছে। কী নিষ্ঠুর এই লোকটা। এতগুলো মাছ নিয়ে যাচ্ছে, একটুকরোও যদি দিত ওকে, খেয়ে ওর প্রাণটা বাঁচত।

শহরের বাজারে যে-লোকটা কুকুর-বেড়াল-পাখি বেচে, সে ঝুড়ি থেকে রঙকে নিয়ে তুলে ধরল। রঙ ওকে আঁচড়ে কামড়ে দেবার চেষ্টা করল; কিন্তু দোকানি এমনভাবে ওর ঘাড়ের কাছের লোমগুলো চেপে ধরছে, রঙ হাজার হাত-পা ছুড়েও কিছু করতে পারছে না।

এমন সুন্দর বেড়াল-বাচ্চা দেখে দোকানি খুশিই হল, কিন্তু মুখে ব্যাজার ভাব দেখিয়ে বলল, ‘এই হাড়-জিরজিরে আধমরা বেড়াল-বাচ্চা নিয়ে কী লাভ হবে আমার? মরেই যাবে হয়তো। তা এনেছ যখন, রেখে যাও— আটআনার বেশি দিতে পারব না, তা বলে দিচ্ছি বাপু।’

জেলে আর কী করে, আটআনা পয়সা নিয়েই রঙকে রেখে গেল। ভেবেছিল এমন সুন্দর বাচ্চা বেচে অনেক পয়সা পাবে—তা আর হল না।

রঙর নতুন মালিক ওকে একটা খাঁচায় বন্ধ করে রেখে একবাটি ছাগলের দুধ রেখে দিল ওর সামনে।

রঙ রাগে-দুঃখে, অপমানে প্রথমটা দুধের দিকে চেয়েও দেখল না; কিন্তু মাঝরাতের দিকে খিদে-তেষ্টায় অস্থির হয়ে শেষে একচুমুক দুধ খেলো। তারপর আস্তে আস্তে সবটা দুধই চুকচুক করে খেয়ে ফেলল।

খেয়ে একটু সুস্থ হল ও। তারপর বাবা-মা, ছোট বোনটির কথা ভেবে মিউমিউ করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল রঙ।

পরদিন সকালে একজন মহিলা দোকানে এসে পশু-পাখিগুলো দেখতে লাগলেন। এমন সময় রঙ ওর বাবা-মার কথা ভেবে মিউমিউ করে কেঁদে উঠল। অমনি মহিলাটির নজর পড়ল রঙুর ওপর। উনি বলে উঠলেন, ‘ওমা, কী সুন্দর বেড়াল বাচ্চাটা! এটাই আমি কিনব মানুর জন্মদিনে উপহার দেবার জন্য।’

সুতরাং মানুর আম্মা রঙকে কিনে নিয়ে বাড়ি চললেন।

বাড়ি পৌঁছে উনি একটা ছোট খালি ঘরে ঢুকে রঙর ঝুড়িটা নামিয়ে রেখে চাকরকে বললেন, ‘প্রথমে একবাটি দুধ আনো। তারপর খানিকটা মাছ নিয়ে এসো।’ ছোকরাটা মাছ আর দুধ এনে দিলে মানুর আম্মা ঘরের দরজা বন্ধ করে রঙর ঝুড়ির ঢাকনা খুলে দিলেন।

রঙ তো ভয়ের চোটে প্রথমে নড়েই না। মানুর আম্মা ঝুড়ির সামনে দুধের বাটি রেখে চু-প করে বসে আছেন। রঙ খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে আর পারল না। আস্তে আস্তে গুঁড়ি মেরে বেরিয়ে তারপর দুধের বাটির ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল।

মানুর আম্মা একটুও না-নড়ে চুপ করে বসে থেকেই মিষ্টি-মিষ্টি করে কথা বলতে লাগলেন, ‘খাও পুষুমণি, লক্ষ্মী পুষুমণি। পুষুমণি কী সুন্দর, পুষুমণিকে কত আদর করব।’ — এই সব। পুষুমণি আস্তে আস্তে ভরসা পেয়ে আরেকটু এগিয়ে এসে মাছের বাটিতে মুখ দিল।

রোজই মানুর আম্মা রঙকে নিজের হাতে খাওয়ান আর মিষ্টি-মিষ্টি কথা বলেন। এমনি করে রঙুর ভয় ভেঙে গেল আস্তে আস্তে। ও এখন মানুর আম্মার কোলে ওঠে, শাড়ির আঁচল ধরে লুটোপুটি খায়। খুশিতে গর্গর্ করে। পুষি যখন বেশ পোষ মেনে ‘গেল, তখন মানুর আম্মা মানুকে ওর জন্মদিনের উপহার হিসেবে দিলেন রঙকে। মানু তো রঙকে পেয়ে খুব খুশি। রঙর প্রথম-প্রথম ভয় হল মানুকে দেখে; কিন্তু যখন ও দেখল মানুও খুব ভালো, তখন মানুর সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেল রঙর। মানুর পেছুপেছু ফেরে এখন রঙ। মানুর ঘাড়ে উঠে বসে থাকে। মানু স্কুলে গেলে রঙ সারাদিন মিউমিউঁ করে ঘুরে বেড়ায়, মানু এলেই লাফ দিয়ে ওর কোলে ওঠে।

রঙর এখন আর কোনো কষ্ট নেই। পেট ভরে খেতে পাচ্ছে। মানু, মানুর আম্মার কাছে অঢেল আদর পাচ্ছে। তবু মাঝে মাঝে ওর বাবা-মার কথা, ছোট বোনটির কথা মনে পড়ে, তখন একটু কষ্ট হয়। আবার খানিক পরে ভাবে, মা বোধহয় জানতেন না সব মানুষই খারাপ নয়। দুনিয়াতে ভালো মানুষও আছে। মার কথা না শুনে বেরিয়ে পড়ে প্রথমে মানুষের হাতে অনেক কষ্ট পেয়েছে বটে; কিন্তু সাহস করে ও বেরিয়েছিল বলেই না আজ এই বিচিত্র বিরাট দুনিয়াটা ও দেখতে পেল– এখানকার এত আনন্দ আর সুখের খোঁজ ও পেল।

এত আরাম আর যত্নের বদলে রঙও চেষ্টা করে মানুষের উপকার করতে। ঘরে একটি ইঁদুর কি পোকামাকড় থাকতে দেয় না রঙ। দেখলেই মেরে ফেলে। মানুর আম্মা আচার রোদে দিলে রঙ বসে বসে কাক তাড়ায়। দরজার কাছে অচেনা লোক, কি ভিখারি এলে রঙ লেজ উঁচিয়ে ফ্যাসফ্যাস করে মহা হৈচৈ বাঁধিয়ে দেয়।

কিছুদিন পর রঙর বাচ্চা হল কয়েকটা।

কী সুন্দর মোটাসোটা বাচ্চাগুলো। প্রথমে সবগুলোই শাদা হয়েছিল, মাসখানেক পর দেখা গেল মাথায়, লেজে, কানে কালো কালো ছোপ ধরছে। কিছুদিনের মধ্যেই ওরা মায়ের মতো হয়ে গেল। শরীরটা শাদাটে গোলাপি; মাথা, কান, লেজ আর থাবা কালো। মানুর আম্মা তিনটে বাচ্চা বন্ধু-বান্ধবদের দিয়ে দিলেন, দুটো বাচ্চা রঙর সঙ্গে রইল। যাঁদেরকে বাচ্চা দিলেন, তাঁরাও মাঝে মাঝে বাচ্চাগুলোকে সঙ্গে নিয়ে এ বাড়িতে বেড়াতে আসেন। তখন রঙ ওর সবগুলো বাচ্চা নিয়ে বেশ গরবের সাথে ঘরের মেঝেয় বসে থাকে, আর মানুরা সবাই ওদের ঘিরে বসে গল্প করে। তখন ভারি একটা আনন্দের হুল্লোড় পড়ে যায়।

এমনিভাবে বিজন বনের পুষুমণি মানুষের ঘরে ঠাঁই নিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *