সেই অদৃশ্য লোকটি

সেই অদৃশ্য লোকটি — কিকিরা সমগ্র ১ — বিমল কর

০১.

বর্ষার পালা শেষ হয়ে আশ্বিন পড়েছিল। বৃষ্টি তবু বিদায় নেয়নি। মাঝে-মাঝেই এক-আধ পশলা জোর বৃষ্টি হচ্ছিল।

তারাপদ পর-পর দু দিন আটকে পড়ল বৃষ্টিতে। একেবারে বিকেলের শেষে এমন ঝমাঝম বৃষ্টি নেমে গেল দু দিনই যে, সে আর কিকিরার কাছে আসতেই পারল না।

আজ কোথাও কোনো বিঘ্ন ঘটেনি। অফিস থেকে সোজা কিকিরার বাড়ি এসে হাজির তারাপদ।

এসে যা দেখল তাতে চমৎকৃত হল।

 কিকিরা যথারীতি তাঁর বসার ঘরেই ছিলেন। এই ঘরটিকে তারাপদরা বলে জাদুঘর। এখানে না আছে কী। দেওয়াল জুড়ে নানান জিনিস, মাটিতেও পা রাখার জায়গা নেই।

নিজের সেই সিংহাসন-মাকা চেয়ারে কিকিরা বসে ছিলেন। সামনে এক মোড়া। মোড়ার ওপর তুলোর গদি। গদির ওপর কিকিরার বাঁ পা। পায়ের সঙ্গে দড়ির ফাঁস। অবশ্য কিকিরার বাঁ পায়ের পাতা থেকে গোড়ালির অনেকটা ওপর পর্যন্ত মোটা করে ক্রেপ ব্যান্ডেজ জড়ানো। দড়ির ফাঁসটা গোড়ালির ওপর দিকে বাঁধা। আলগা করে। সেই দড়ি এক বিচিত্র কায়দায় মাথার ওপর। ঝোলানো চাকার মধ্যে গলিয়ে দেওয়া হয়েছে। গলিয়ে দড়ির অন্য প্রান্তটা ঝুলিয়ে একেবারে কিকিরার বাঁ হাতের সামনে। মানে, কিকিরা যখন দড়ি টানছেন, তাঁর বাঁ পা উঠে যাচ্ছে, যখন দড়ি আলগা করছেন, পা এসে মোড়ার ওপর পড়ছে।

কিকিরার ডান হাতে তাঁর পছন্দের চুরুট। দেখতে আঙুলের মতন সরু-সরু। চুরুটের ধোঁয়ার গন্ধটা কিন্তু বিশ্রী।

তারাপদ যেন কতই বিমোহিত বাহবা দিয়ে বলল, “দারুণ স্যার। এ-জিনিস আপনিই পারেন।”

কিকিরা সাদামাটা গলায় বললেন, “পুলিসিস্টেম।” 

“পাঙ্খা কুলি সিস্টেম?”

“পাঙ্খা কুলি দেখেছ?”

“চোখে দেখিনি, ছবিতে দেখেছি। ইলেকট্রিসিটির যুগে পাঙ্খ-কুলি আর কোথায় দেখতে পাব!”

“জ্ঞানের রাজা! ইলেকট্রিসিটির যুগ! এ-দেশে এখনো কেরাসিন তেলের যুগ চলছে। যাও না একবার ভেতর দিকের গাঁ-গ্রামে।”

“ভুল হয়েছে স্যার।” তারাপদ যেন চট করে অপরাধ স্বীকার করে নিল।

“বাঁশবেড়ের হিরুবাবুর নাম শুনেছ? মস্ত বড় শিকারি। এক সময় হাতি ধরে বেড়াতেন। বিরাট ওস্তাদ। হিরুবাবুর কথা হল, ইলেকট্রিক মানেই সর্বনাশ। ওতে চোখ খারাপ হয়, মাথা নষ্ট হয়।”

“তাই নাকি?”

“হিরুবাবু বলেন, রেড়ির তেলের যুগটাই ছিল বেস্ট। রেড়ির যুগ গিয়েছে, রবীন্দ্রনাথ, রামকৃষ্ণ ঠাকুরের মতন মানুষও গিয়েছেন।

তারাপদ হাসতে-হাসতে প্রায় মাটিতেই বসে পড়ে আর কী!

কিকিরা হাসলেন না। গম্ভীর মুখে বার দুই পায়ের দড়ি টানাটানির খেলা খেলে নিলেন।

হাসি থামলে তারাপদ বলল, “স্যার, আপনার লেগ কেমন?”

“পুল করতে পারছি। চাঁদু ডাক্তার কী বলে হে?”

“তিন হপ্তা নড়াচড়া চলবে না। মানে বাইরে বেরোতে পারবেন না।”

“তি-ন হপ্তা! আজ তো মাত্র দশ দিন হল তারাপদ, আরও দশ বারো দিন! আমি পারব না।”

“পারব না বললে চলবে কেন, স্যার! কে আপনাকে খানা-খন্দে পাগলাতে বলেছিল! গোড়ালির হাড় ভাঙেনি–এই যথেষ্ট। পা মচকানোর ব্যথা সারতে। সময় লাগে!”

“চাঁদু জ্বরজ্বালা, আমাশার ডাক্তার, হাড়গোড়ের সে কী বোঝে?”

তারাপদ রগড় করে বলল, “বলব চাঁদুকে। বলব, তুই বোগাস! কিস্যু জানিস না।”

কিকিরা একটু হেসে কথা পালটে বললেন, “বোসো। চা-টা খাও।” বলে চুরুটটা আবার ধরিয়ে নিলেন। ধোঁয়া আসছিল না। জোরে-জোরে টান মেরে ধোঁয়া বার করলেন।

তারাপদ বসে পড়েছে ততক্ষণে। মুখ মুছে নিচ্ছিল রুমালে।

কিকিরা নিজেই বললেন, “চাঁদুকে কাল-পরশু একবার পাঠিয়ে দিয়ে। আমি তিরিশ হাজার টাকা লোকসান দিতে পারব না।”

খেয়াল করে কথাটা শোনেনি তারাপদ, তবে কানে গিয়েছিল। টাকার অঙ্কটা মাথায় থাকেনি। সে কিকিরার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল।  

“থারটি থাউজেন্ড ইজ এনাফ।” কিকিরা আবার বললেন।

 তারাপদ বোকার মতন বলল, “তিরিশ হাজার!”

“এখন তিরিশ, পরে হাজার পঞ্চাশও হতে পারে।”

তারপদ এবার যেন ধাতে এল। রসিকতা করে বলল, “আপনার লেগ-প্রাইস…? মানে ইনসিওরেন্সের কোনো কমপেনসেশান…”

“দুঃ।” কিকিরা অদ্ভুতভাবে ‘দুঃ’ বললেন।

“লটারি পাচ্ছেন?”

“নো।”

“তা হলে ব্যাপারটা কী? তিরিশ হাজারের সঙ্গে আপনার পা মচকানোর সম্পর্কটা কোথায়?”

কিকিরা বললেন, “কাগজ-টাগজ পড়া হয় মশাইয়ের?”

“হয়। তবে পড়া না বলে চোখ বুলনো বলতে পারেন। কাগজে পাঠ্য বলতে তো মন্ত্রী-সংবাদ…!”

“বুঝেছি। তা একবার ওখানে যাও। ওই যে দেওয়ালে ঝোলানো বাস্কেট দেখছ, ওর মধ্যে তিনটে কাগজ আছে। নিয়ে এসো।”

তারাপদ উঠল।

কিকিরার এই ঘরে না আছে কী? চোরবাজারের দোকানও এমন বিচিত্র নয়। চন্দন কি সাধে বলে, ওল্ড কিউরিয়োসিটি শপ! সেকেলে গ্রামাফোন, পাদরিটুপি, দেওয়াল ঘড়ি, পায়রা-ওড়ানো বাক্স, ম্যাজিক পিস্তল, কালো আলখাল্লা, পুতুল, ভাঙা বেহালা, তরোয়াল, কাঁচের মস্ত বড় বল, আরও কত কী!

দেওয়ালে এক মাদুর কাঠির সরু টুকরি আটকানো ছিল। তারাপদ কাগজ নিয়ে ফিরে এল।

কিকিরা বললেন, “লাল পেনসিলে দাগ দেওয়া আছে। দেখো।”

তারাপদ খবরের কাগজগুলো দেখল। তিন দিনের কাগজ। তারিখ আলাদা। দু-তিন দিন বাদ-বাদ তারিখ। কাগজ একই। লাল পেনসিলের দাগ-দেওয়া জায়গাটা বার করে নিল সে।

“এটা কী স্যার?”

“পড়ো।”

“মনে-মনে, না, জোরে-জোরে?”

“জোরে-জোরে।”

তারাপদ পড়তে লাগল “আমি লোচন দত্ত, পুরা নাম ত্রিলোচন দত্ত, সাতাশের এক, যদু বড়াল লেন, কলকাতা বারোর নিবাসী, এই মর্মে জানাইতেছি যে–জনৈক প্রতারক আমার ছোট ভাই মোহন দত্ত সাজিয়া নানা জনের সঙ্গে প্রতারণা করিতেছে বলিয়া সংবাদ পাইতেছি। আমার ভাই মোহন দত্ত উনিশশো পঁচাশি সালে একুশে অগস্ট মারা গিয়াছে। আমার অন্য কোনো ভাই নাই। আমাদের উক্ত নম্বরের বসতবাটী এবং দত্ত অ্যান্ড সন্স-এর একমাত্র উত্তরাধিকারী আমি ও আমার দুই নাবালক পুত্র–বিশ্বনাথ ও যোগনাথ। মোহন দত্ত আর জীবিত নাই। ওই নামে কেহ যদি কোথাও আমাদের তরফ হইতে ব্যক্তিগত, ব্যবসায়গত ও সম্পত্তিগত কোনো কাজকারবার করেন, আমরা তাহার জন্য দায়ী থাকিব না। উপরন্তু কেহ যদি প্রতারক মোহন দত্ত নামের মানুষটির বিস্তারিত খবরাখবর দেন ও তাহাকে ধরাইয়া দেন–আমাদের। পক্ষ হইতে তাঁহাকে নগদ ত্রিশ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হইবে প্রতিশ্রুতি দিতেছি। যোগাযোগের ঠিকানা : সাতাশের এক, যদু বড়াল লেন, কলকাতা বারো। সময় সকাল আটটা হইতে বেলা দশটা।”

তারাপদ পড়া শেষ করেও যেন ভাল বুঝল না। মনে-মনে আবার পড়ে নিচ্ছিল।

শেষে তারাপদ বলল, “বাবা! বিরাট নোটিস। লিগ্যাল নোটিস স্যার।” কিকিরা বললেন, “লিগ্যাল নোটিস নয় বলেই মনে হচ্ছে। বয়ানটা উকিলের মতন। ব্যক্তিগত বিজ্ঞপ্তি ওটা।”

“সব দিনেই কি একই বয়ান? মানে তিন দিনের কাগজে?”

“হ্যাঁ।”

“শুধু বাংলা কাগজেই?”

“ইংরিজি আমি দেখিনি। মনে হয়, অন্য বাংলা কাগজ আর ইংরিজি কাগজেও আছে। কোন কাগজ কার চোখে পড়বে-বলা তো যায় না।”

তারাপদ বলল, “তবে এই আপনার ত্রিশ হাজার?”

“ইয়েস স্যার।”

“আপনি স্বপ্ন দেখছেন কিকিরা। টাকা অত সস্তা নয়।”

 কিকিরা বললেন, “নো সার, আমি ড্রিমিং করছি না। ড্রিলিং করছি। মানে রহস্যটা বোঝার জন্য জমি খুঁজছি। তুমি ঠিক বলেছ, অত সস্তা নয়। নয় বলেই তো ব্যাপারটা কঠিন। তুমি কি ভাবছ, লোচন দত্ত টাকার হরিলুঠ দেওয়ার জন্যে কেঁদে মরছে?”

“আমি কিছুই ভাবছি না। শুধু দেখছি, লোচন দত্ত এক আহাম্মক আর আপনিও পাগল!”

এমন সময় বগলা এল। চা আর হিঙের কচুরি, কুমড়ো-আলুর ছক্কা এসেছে।

অফিস থেকে ফিরছে তারাপদ। খিদে পেয়েছিল জোর। কচুরির ডিশটা তাড়াতাড়ি টেনে নিল। চলে গেল বগলা।

কিকিরা বললেন, “ব্যাপারটা তোমার মাথায় ঢোকেনি।

 “একেবারেই নয়।”

“একটা মরা লোক চার-পাঁচ বছর পরে ফিরে আসে কেমন করে?”

“আসে না। মরা লোকের ভূত আসতে পারে।”

“তা ছাড়া–এই লেখাটা পড়ে বোঝা যাচ্ছে, কোনো জাল মোহন দত্ত নানান বান্ধা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ধান্ধা বৈষয়িক হতে পারে, অন্য কিছুও হতে পারে।”

তারাপদ মাথা নাড়ল। মোহন দত্ত সম্পর্কে তার খুব যে একটা আগ্রহ রয়েছে-মনে হল না।

চা খেতে-খেতে কিকিরা বললেন, “একটা জিনিস নজর করেছ?”

“কী?”

“লোচন দত্ত এমনভাবে লিখেছে যেন সে এই মোহন দত্তকে–মানে প্রতারক জালিয়াত মোহনকে চোখে দেখেনি এখন পর্যন্ত, শুধু তার কথা শুনেছে।”

তারাপদ কচুরি খেতে-খেতে জড়ানো জিভে বলল, “হতেই পারে। এর মধ্যে অস্বাভাবিক কী আছে কিকিরা! আমার নাম করেই অন্য একটা লোক যদি মানুষ ঠকিয়ে বেড়ায়–বেড়াতেই পারে–তাকে আমি চোখে না দেখতেও পারি। অন্য কেউ এসে আমায় বলতে পারে কথাটা…।”

কিকিরা বললেন, “তোমার কথা হচ্ছে না, হচ্ছে লোচন দত্ত আর মোহন দত্তের কথা। তুমি ভুলে যেয়ো না, মরা মানুষ আবার জ্যান্ত হয়ে ফিরে এসে লোক ঠকিয়ে বেড়াবে–এটা খুব ইজি কাজ নয়। কথা হল, কাদের ঠকাচ্ছে? যাদের ঠকাচ্ছে তারা যদি লোচনদের জানাশোনা লোক হয়-তবে সেই বোকা, বুন্ধুগুলো কি জানে না যে, মোহন অনেক আগেই মারা গিয়েছে?”

তারাপদ বলল, “হয়ত লোচনের অপরিচিতদের ঠকাচ্ছে!”

“যুক্তি হিসাবে সেটাই হতে পারে। কিন্তু কথা হল, কেন ঠকাবে? যে-লোক অন্যকে ঠকাচ্ছে–তার উদ্দেশ্য কী? যে ঠকছে তারই বা কী দায় পড়েছে ঠকার! ধরো, রামবাবু বলে একটা লোককে জাল মোহন ঠকাবার চেষ্টা করছে। কেন করছে? আর রামবাবু কি এতই বোকা যে, ঠকাবার আগে একবার লোচনদের খোঁজ-খবর করবে না? বাড়ি, সম্পত্তি, দোকান-সংক্রান্ত যদি কিছু হয়–তবে এইসব জিনিস এমনই যে, লোকে এই ধরনের জিনিসের সঙ্গে কোনো কারবার করতে হলে ভাল করে খোঁজ-খবর নেয়। খোঁজ নিলেই মোহন ধরা পড়ে যাবে।”

“তাই তো যাচ্ছে।”

“যাচ্ছে কি না আমি জানি না। তবে আমার মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা অত সহজ নয়। তিরিশ হাজার টাকা পুরস্কার কেউ এমনি-এমনি দেয় না। জাল লোক ধরতে নয়। তার জন্যে থানা-পুলিশ আছে। লোচন থানায় ডায়েরি করিয়েছে? কেন সে কাগজে সরাসরি লিগ্যাল নোটিস না দিয়ে এইরকম একটা ব্যক্তিগত বিজ্ঞপ্তি ছাপল!”

চা খাওয়া শুরু করেছিল তারাপদ। বলল, “আপনিই বলুন, কেন?” কিকিরা বললেন, “আমি ভেবে দেখেছি, দুটো কারণে হতে পারে। প্রথম কারণ, বড়াল লেনের লোচনবাবুটি মোহনচাঁদকে ধরতে চাইছে। নিজেই সে জানিয়েছে, জালিয়াত মোহনকে ধরে দিতে হবে। দ্বিতীয় কারণ, মোহন লোকটাকে সে ভয় পাচ্ছে। “

“জাল মানুষকে ভয়?”

“যদি জাল না হয়।”

তারাপদ অবাক হয়ে বলল, “কী বলছেন আপনি! লোচন, সাল-সময় দিয়ে তার ভাইয়ের মরার খবর জানাচ্ছে, তবু বলছেন এ জাল মোহন নয়।”

কিকিরা চা খেতে-খেতে স্বাভাবিক গলায় বললেন, “তুমি জাল প্রতাপচাঁদ, ভাওয়াল মামলা–এ-সব শুনেছ? নিশ্চয় শোনোনি! শুনলে এত অবাক হতে না। দীনরাম মামলার কথাও শোনোনি। বম্বের মামলা। দীনরামকে পাক্কা আট বছর মামলা লড়তে হয়েছিল, সে আসল দীনরাম প্রমাণ করতে।”

“স্যার, ভাওয়াল মামলার কথা আমি শুনেছি। সে তো সাঙ্ঘাতিক ষড়যন্ত্র ছিল।”

কিকিরা বললেন, “লোচনও যে সাঙ্ঘাতিক ষড়যন্ত্র করেনি তুমি কেমন করে বুঝলে?”

তারাপদ চা খেতে শুরু করেছিল, বলল, “লোচনের কাছে নিশ্চয় ডেথ সার্টিফিকেটের প্রমাণ আছে…।”

“প্রমাণ থাকতে পারে, নাও পারে। আর ডেথ সার্টিফিকেট? টাকায় কী না হয়। তা ছাড়া, ছোটখাটো কোনো জায়গায় অজ গাঁ-গ্রামে মারা গেলে ডেথ। সার্টিফিকেট বড় একটা থাকে না। থানায় জানিয়ে দিলেই হয়। তা ছাড়া, কোথায় কখন কী অবস্থায় মোহন মারা গিয়েছে না জানলে কোনো কিছুই বলা যায় না। ধরো, ট্রেন অ্যাকসিডেন্টে দশ-বিশটা লোক মারা গেল। তার মধ্যে অনেকের যা হাল হল–মাংসের খানিকটা তাল–মাথা নেই, হাত নেই, পা নেই–কোনোরকমেই ট্রেস করা গেল না তারা কারা। তাদেরই পুড়িয়ে ফেলা হল। শনাক্তকরণই তো হল না। কী করে তুমি তাদের যথার্থ সার্টিফিকেট পাবে! কে দেবে! থানাতেই বা কী লেখা থাকবে?”

তারপদ এসব কিছু জানে না, চুপ করে থাকল।

কিকিরা বললেন, “মোহনের মতন ঘটনা এ-দেশে কখনো-সখনো ঘটে। আমরা তার খবর পাই না। মানে, আমি বলছি মারা গেছে বলে সবাই যাকে জানে, সেই মরা-লোক আবার ফিরে এসেছে।”

তারাপদ এবার খানিকটা কৌতূহল বোধ করল। বলল, “আপনি বলতে চাইছেন, মোহন মারা যায়নি?”

“না, না, এত তাড়াতাড়ি তা কেমন করে বলা যাবে?”

“তা হলে বলা যাক, মোহন মারা না যেতেও পারে!”

“হতে পারে।”

“এখন তবে কী করতে চান?”

“মোহন অনুসন্ধান। লোচন দত্তর সঙ্গে আমাদের দেখা করতে হবে। ওই যে লিখেছে, যোগাযোগ–সেই যোগাযোগটা করতে হবে আগে। দেখতে হবে লোচন কার কার কাছ থেকে জেনেছে যে, এক জাল মোহন তাদের সঙ্গে দেখা করেছে। দেখা করলেও কোন উদ্দেশ্য নিয়ে? লোচন নিজে মোহনকে কোথাও আচমকা দেখেছে কি না? বা মোহনই কোনোভাবে লোচনকে নিজেই জানিয়েছে কি না যে, সে হাজির হয়েছে। লোচন এর মধ্যে থানা-পুলিশ করেছে, কি করেনি!” চায়ের কাপ নামিয়ে রাখলেন কিকিরা। হাতের পাশেই এক গোল টেবিল। পুরনো টেলিফোন থেকে টুকটাক অনেক কিছুই পড়ে আছে টেবিলে।

তারাপদ পেট ভরে কচুরি খেয়েছিল। চা খেতে-খেতে ঢেকুর তুলল। বলল, “আপনি এখন লোচনের সঙ্গে দেখা করতে চান?”

“ইয়েস স্যার।”

 “কেমন করে?”

“লেম ম্যান, লিম্পিং লিম্পিং করে…।”

তারপর হেসে ফেলল, “খোঁড়া মানুষ খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে?”

“উপায় কী?”

“চাঁদ শুনলে রাগ করবে স্যার।”

“চাঁদু ক্যান ওয়েট, তিরিশ হাজার যদি ওয়েট না করে? কে জানছে এরই মধ্যে কত লোক লোচনের কাছে গিয়ে হাজির হয়েছে! টাকার লোভ বড় লোভ।”

“লোচন কোনো প্রাইভেট ডিটেকটিভও তো লাগাতে পারে। কলকাতায় এখন ডিটেকটিভ এজেন্সির অফিস হয়েছে।”

“আমরাও তো এজেন্সি খুলেছি : কে-টি-সি–কিকিরা, তারাপদ, চন্দন। হেড অফিস আমার বাড়ি।”

তারাপদ হাসতে-হাসতে বলল, “স্যার, আমি কেটিসির নাম দিয়েছি কুটুস। দয়া করে একটা প্যাড ছাপিয়ে নিন এবার, আর শ’ খানেক ভিজিটিং কার্ড।” বলে তারাপদ চায়ের কাপ নামিয়ে রাখল। সিগারেটের প্যাকেট হাতড়াতে লাগল পকেটে।

কিকিরা বললেন, “হবে। শনৈঃ শনৈঃ। ধৈর্য ধরতি বালকঃ।…এবার কাজের কথা বলি।”

“বলুন”, তারাপদ সিগারেট ধরিয়ে নিল।

“আমি এর মধ্যে বাড়িতে বসে বসে দু একটা গোড়ার কাজ সেরে রেখেছি।”

“বাঃ। ফাস্ট কেলাস।”

“গলিটার খোঁজ নিতে বগলাকে পাঠিয়ে দিলাম। আমার কাছে কলকাতা কপোরেশনের স্ট্রিট ডাইরেক্টরি আছে।“

“গলিটা কোথায়?”

“বউবাজার থানার মধ্যে।”

“কেমন গলি?”

“পুরনো শহরের পুরনো গলি। লোচনদের বাড়িও পুরনো। তবে বেশ বড়। বনেদি বাড়ি ছিল বোধ হয়। এখন সামনের দিকে ভেঙেচুরে গিয়েছে।”

“লোচনকে দেখা গেল?”

“না। বগলা শুধু গলিটার খোঁজ নিয়ে বাড়ি দেখে চলে এসেছে।”

“আর কী সংবাদ সংগ্রহ করেছেন, স্যার?”

“লোচনের ছেলে দুটি যমজ। তার মধ্যে একটিকে–কেউ বা কারা একবার চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল। একবেলা আটকে রেখে আবার ফেরতও দিয়ে গিয়েছে। ঘটনাটা মাস-দুই আগেকার।”

তারাপদ অবাক হয়ে বলল, “সে কী! ছেলে চুরি?”

“লোচনের বাড়িতে এখন মস্ত এক পালোয়ানকে আনা হয়েছে। সে বাড়ি পাহারা দিচ্ছে। ওদের বাড়ির কুকুরটাও বাইরে ছাড়া থাকে। মানে, লোচন হালফিল খুব সাবধান হয়ে গিয়েছে।…তা কাল-পরশু নাগাদ চলো একবার, নিজের চোখে দেখে আসি।”

তারাপদ মাথা নাড়ল। সে রাজি।

.

০২.

তারাপদকে সঙ্গে করে কিকিরা রবিবার বেলা ন’টা নাগাদ যদু বড়াল লেনে হাজির।

শরৎকালের আকাশ। ঝকঝকে রোদ মাঝে-মাঝে সামান্য চাপা পড়ছে, ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল মাঝে-মাঝে। তুলোর আঁশের মতন বৃষ্টি এই এল, এই গেল। আবার রোদ।

গলিটা পুরনো তো বটেই–কিন্তু সরু নয়, মোটামুটি চওড়া। গাড়ি ঘোড়া আসা-যাওয়া করতে কোনো অসুবিধে হয় না। বাড়িগুলোও দোতলা-তেতলা। কোনো-কোনোটা জীর্ণ চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আবার কোনোটা বেশ পাকাঁপোক্ত। ওরই মধ্যে একটা বাড়ি নতুন করে সারিয়ে রংচঙ করা হচ্ছিল।

গলির মধ্যে রোদও ছিল, ছায়াও ছিল। রাস্তা সামান্য ভিজে ভিজে। দু-চারটে মামুলি দোকান। লন্ড্রি, চায়ের, মুদিখানার, তেলেভাজার দোকানও রয়েছে একটা।

কিকিরা ঠিকানা মতন বাড়িটার সামনে এসে রিকশা ছেড়ে দিলেন। বগলা যা বলেছিল, মোটামুটি ঠিক। উঁচু পাঁচিল-ঘেরা বাড়ি। অবশ্য পাঁচিলের দশ আনাই ভেঙে পড়েছে। ইট একেবারে শ্যাওলাধরা। বাড়ি ঢোকার মুখে এক ভাঙা ফটক। ফটকটা বন্ধ হয় না। ভোলাই থাকে ফটকের একপাশে থামের ওপর কোনোকালে আলোর ব্যবস্থা ছিল, এখন নিতান্তই একটা লোহার বাঁকানো পাইপ খাড়া হয়ে আছে।

ফটক দিয়ে ঢুকতেই খানিকটা মাঠ। একেবারে জংলা চেহারা। নিম আর কুলগাছ। একপাশে ফুলগাছের ঝোঁপ। শিউলিগাছ, করবী। মাঠে জলকাদা, ঘাস। ডান দিকে দারোয়ানের ঘর ছিল আগে। এখন ভাঙা ঝুপড়ি।

গজ চল্লিশ হয়ত হবে না, মাঠটুকু পেরিয়েই দোতলা বাড়ি। বাড়ি সেকেলে। চেহারাতেই সেটা বোঝা যায়। কাঠের খড়খড়ি, লোহার নকশাদারি রেলিং, বড়বড় থাম, কাঁচের শার্সি। বাড়ির নানান জায়গায় ভাঙা-চোরা। বাইরে থেকে বেশ বিবর্ণ দেখায়। মাঠের একপাশে একটা ভাঙা টালির শেড। জায়গাটা নোংরা হয়ে রয়েছে।

তারাপদকে নিয়ে খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে বিশ-ত্রিশ পা এগোতে-না-এগোতেই কার গলা শোনা গেল।

 “এ বাবু?”

কিকিরা দাঁড়িয়ে পড়লেন। তাকালেন।

বাড়ির চওড়া থামের আড়াল থেকে একটা লোক এগিয়ে আসছিল। কুস্তিগিরের মতন চেহারা। পরনে মালকোঁচা-মারা ধুতি, খাটো বহরের। গায়ে হাক্কাটা গেঞ্জি। গেঞ্জিটা রং করা। মাথা প্রায় ন্যাড়া।

কাছে এলে বোঝা গেল, নোকটা পালোয়ানই বটে। বুকের ছাতি, পায়ের গোছ, হাতের পেশী দেখার মতনই। সেইসঙ্গে তার পইতেটাও। গলা থেকে পেট পর্যন্ত লম্বা। লোকটার কপালে চন্দন, কানের লতিতে চন্দন।

কাছে এসে লোকটা বলল, “কাঁহা যাইয়ে গা?”

কিকিরা বললেন, “বাবুসে ভেট করনা হ্যায়।”

“কোন বাবু?”

“বড়া বাবু! লোচনবাবু!” বুদ্ধি করেই বললেন কিকিরা।

 “কেয়া নাম আপনোগা?”

কিকিরা বললেন, “কিকিরা!”

“কেয়া?”

“কি-কিরা!”

“কিক্কিরিয়া!” বলে লোকটা কেমন সন্দেহের চোখে দেখল কিকিরাদের। তারপর বলল, “ঠাহের যাইয়ে।”

কিকিরাদের দাঁড়াতে বলে লোকটা বাড়ির দিকে চলে গেল।

কিকিরা রঙ্গ করে বললেন, “কোন বাবু?” বলেই কৌতূহল হল। “এবাড়িতে আর ক’জন বাবু থাকে হে?”

এতক্ষণ পরে কুকুরের ডাক শোনা গেল। মনে হল, কুকুর এখন কাছাকাছি কোথাও নেই। হয়ত বাড়ির পেছন দিকে, বা দোতলায়।

কিকিরার সাজপোশাক যথারীতি খানিকটা বিচিত্র। আলখাল্লা ধরনের জামা, সরু প্যান্ট। মানুষটি যেমন রোগা তেমনই লম্বা। এই পোশাকে তাঁকে আরও লম্বা দেখায়। মাথায় একরাশ চুল, বড়বড়, প্রায় কাঁধ ছুঁয়েছে। কিকিরার হাতে বেতের লাঠি ছিল। পায়ে ক্রেপ ব্যান্ডেজ। পায়ে চটি।

তারাপদ বলল, “কিকিরা, এই বাড়ি দেখে তো মনে হচ্ছে–ভেরি ওল্ড। কুইন ভিক্টোরিয়া আমলের নাকি?”

কিকিরা বললেন, “হতে পারে। অন্তত জর্জ দ্য ফিফথের আমলের তো হবেই।” বলে চারপাশ দেখিয়ে বললেন, “বাড়িটার সামনে কত জায়গা দেখেছ! পুরনো দিনের বাড়ি না হলে কলকাতা শহরে এত জায়গা ফেলে কেউ বাড়ি করে। এখন এই জমিরই কী দাম! লোচন দত্তরা ধনী লোক ছিল হে। ধনী আর বনেদি। আমার মনে হচ্ছে, একসময় এবাড়িতে নিজেদের ঘোড়া আর গাড়িও থাকত! ওই শেডটা বোধ হয় ঘোড়ার আস্তাবল ছিল এক সময়। “

“কী করে বুঝলেন?”

“এরকম আমি দেখেছি। তা ছাড়া একটা ভাঙা চাকা পড়ে আছে একপাশে।”

আরও দু-চারটে কথা শেষ না হতে-না-হতেই পালোয়ান ফিরে এল।

 “আইয়ে।”

 কিকিরা পা বাড়ালেন। সামনে পালোয়ানজি।

হাঁটতে হাঁটতে কিকিরা হঠাৎ বললেন, “এ পালহানজি! দেশ গাঁও কাঁহা। তুমহারা?”

“ছাপরা জিলা!… লাটোয়া গাঁও।”

“আচ্ছা! কলকাত্তামে নয়া মালুম!”

কিকিরা দু-চার কথা আরও জেনে নিলেন। পালোয়ানের নাম, হরিপ্রসাদ। আগে সেজানবাজারে থাকত। লখিয়াবাবুর বাড়িতে দারোয়ান ছিল।

সিঁড়ি কয়েক ধাপ। তারপর ঢাকা বারান্দা। বারান্দার গায়ে-গায়ে তিন-চারটে ঘর।

পালোয়ান হরিপ্রসাদ কিকিরাদের নিয়ে গিয়ে একটা ঘরে বসাল।

 কিকিরারা কাঠের চেয়ারে বসলেন।

ঘরটা বড়। জানলা-দরজাও বেশ বড় বড়। কড়ি কাঠ থেকে লোহার রড ঝুলছে। রডের সঙ্গে পাখা লাগানো। গুটি দুই বাতি ঝুলছিল উঁচু থেকে। ঘরে আসবাবপত্র বলতে এক জোড়া কাঠের আলমারি। রাজ্যের জঞ্জাল জমিয়ে রাখলে যেমন হয়–আলমারির মধ্যেটা সেইরকম দেখাচ্ছিল। পাল্লার কাঁচ অর্ধেক ভাঙা। গোটা কয়েক কাঠের চেয়ার, আর তক্তপোশের ওপর পাতা ময়লা ফরাস ছাড়া অন্য কিছু বড় একটা দেখা যায় না। একটা ক্যারাম বোর্ড একপাশে রাখা। টিনের একটা কৌটোও রয়েছে বোর্ডের পাশে। দেওয়ালে এক মস্ত বড় ছবি। বোধ হয় দত্ত বাড়ির কোনো প্রাচীন কতার। দেওয়ালে এক কাগজ সাঁটা রয়েছে। সাদা কাগজের ওপর রং দিয়ে লেখা ক্যারাম প্রতিযোগিতা। গোটা দুয়েক ঘেঁড়া-ফাটা ক্যালেন্ডার। ঘরের চেহারা থেকে বেশ বোঝা যায়–এটা ঝড়তি-পড়তি ঘর। মামুলি লোকজনদেরই বসানো হয়।

লোচন দত্ত ঘরে এল। প্রথম নজরেই আন্দাজ হয় বয়েস বেশি নয় লোচনের।

কিকিরা উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার জানালেন।

লোচন দত্তর পরনে দামি চেককাটা লুঙ্গি। গায়ে ফতুয়া। এক হাতে সিগারেটের প্যাকেট, দেশলাই, অন্য হাতে চাবির গোছা। মনে হল, চাবির গোছা ছাড়া তিনি কোথাও নড়েন না।

লোচনের চেহারা দেখে কিকিরার ধারণা হল ওর বয়েস বছর পঁয়তাল্লিশ। স্বাস্থ্য মজবুত। গায়ের রং তামাটে। মুখটা চৌকোনো ধাঁচের, শক্ত। দুটো চোখ যেন ঠেলে বেরিয়ে আসছে। বড় বড় চোখ। খানিকটা রুক্ষ। চতুর বলেও মনে হচ্ছিল। মাথার চুল কোঁকড়ানো, মাঝখানে সিঁথি। গোঁফ রয়েছে। গলায় সোনার সরু হার।

ঘরে ঢুকে লোচন দত্ত একবার পাখার দিকে তাকাল। “আহা, পাখাটা খুলে দিয়ে যায়নি। যত্ত সব গাধা আহাম্মক।” বলতে বলতে নিজেই পাখার সুইচে হাত দিল।

পাখা চলতে শুরু করল।

লোচন এবার একটা চেয়ারে বসতে বসতে বলল, “আপনারা?”

কিকিরা বললেন, “আপনার কাছে এসেছি।”

“কী ব্যাপারে?”

“খবরের কাগজে আপনি একটা নোটিস দিয়েছিলেন।”

“হ্যাঁ-হ্যাঁ। অনেক টাকা খরচ হয়ে গেল।”

 “অন্য কেউ এসেছিল আপনার সঙ্গে দেখা করতে?”

“দুজন। দু’দিনে দু’জন। দুজনের কাউকেই আমার পছন্দ হয়নি। একজন বোধ হয়–একসময় হোটেলে কাজ করত। সিকিউরিটির কাজ।”

“আমরা আপনার সঙ্গে ওই নোটিসের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি।”

লোচন চাবির গোছাটা কোলের ওপর রাখল। দেখল কিকিরাকে। মনে হল না, খুশি হয়েছে।

“মিশাইয়ের নাম?”

“কিরকিশোর রায়।” বলে কিকিরা তারাপদকে দেখালেন, পরিচয় করিয়ে দিলেন। তারপর সরল গলায় বললেন, “লোকে আমাকে কিকিরা বলেই জানে।”

“কী? কিকিরা?” লোচন অবাক।

“কিঙ্কর-এর কি, কিশোর-এর কি, আর রায়-এর রা।” কিকিরা মজা-মজা মুখ করে হাসলেন।“আজকাল সবাই ঘোটর ভক্ত। ফ্যান্টাসটিক-কে বলে “ফ্যান্টা’, ওয়ান্ডারফুল-কে “ওয়ান্ডা। নামের বেলাতেও তাই। ডিপি, বিবি, কেজি। বড় নাম বারবার বলতে কষ্ট হয়।”

“আচ্ছা-আচ্ছা! তা মশাইয়ের কী করা হয়? কিকিরা অমায়িক মুখ করে হাসলেন। “আমার পেশা বলে কিছু নেই। একসময় ম্যাজিক দেখাতাম। লোকে বলত, “কিকিরা দ্য ওয়ান্ডার’। এখন আর ওসব বিদ্যে জাহির করি না। একটা বই লিখছি প্রাচীন ভারতের ইন্দ্রজাল বিদ্যা। …সেকালে নানা শাস্ত্রে কাব্যে…”

কিকিরাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে লোচন বিরক্ত হয়ে বলল, “না না, প্রাচীন ইন্দ্রজাল- টিন্দ্রজাল আমি ছাপব না।” বলে বেশ কঠিনভাবে কিকিরার দিকে তাকাল। “আপনি বললেন, কাগজ দেখে এসেছেন। এখন বলছেন ইন্দ্রজাল…! আশ্চর্য ব্যাপার মশাই। আমি ইন্দ্রজাল দেখার জন্যে গাঁটের পয়সা খরচ করে কাগজে নোটিস ছাপিনি।”

কিকিরা হাসি-হাসি মুখেই বললেন, “আজ্ঞে না। আমি বই ছাপাবার জন্যে আপনার কাছে আসিনি! আমি জানি, আপনি ছাপাখানার ব্যবসা করেন।”

“হ্যাঁ। আমাদের সত্তর বছরের ব্যবসা। দত্ত অ্যান্ড সন্স।”

“বিখ্যাত ছাপাখানা। ফেমাস! ধর্মতলায় আপনাদের বিরাট প্রেস। আপনারা বিশাল বিশাল কাজ করতেন। সরকারি, বেসরকারি। একবার সি আর দাশের স্পিচ ছেপেছিলেন, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির অভিভাষণ…”

লোচন কেমন অবাক হয়ে গেল। হ্যাঁ করে কিকিরাকে দেখছিল। ও

তারাপদ মনে-মনে হাসছিল। কিকিরা অতি চতুর। আসার আগে লোচন দত্তর কাজ কারবারের খোঁজ করে নিয়েছেন তবে। অবশ্য যত না খোঁজ করছেন তার চেয়ে বেশি গুল-গাপ্পা ঝাড়ছেন লোচন দত্তর কাছে। সি আর দাশ, শ্যামাপ্রসাদ-বোধ হয় বাজে কথা।

লোচন বলল, “সি আর দাশের কথা আপনি জানলেন কেমন করে?”

“আপনি জানেন না?” কিকিরা যেন কতই অবাক।

 “আমার বাবা জানতে পারতেন। আমি কেমন করে জানব। ..তবে হ্যাঁ আমাদের প্রেসের অফিসঘরে কয়েকটা সার্টিফিকেট টাঙানো আছে। বড় বড় কাজকারবার যখন করেছি, সার্টিফিকেট পেয়েছি। দু-একটা ফোটোও আছে। নেতাজি একবার আমাদের প্রেসে এসেছিলেন। ইয়ে–কী নাম যে, অ্যাক্টর-ওই যে, আহা কী যেন নামটা..”

“শিশিরকুমার!”

“না না, শিশির ভাদুড়ী নন, মিত্তির, মিত্তির।”

“নরেশ মিত্তির।”

“তাঁরও ফোটো আছে। জ্যাঠামশাইয়ের বন্ধু ছিলেন।”

কিকিরা আড়চোখে তারাপদকে দেখলেন।

লোচন বলল, ছাপাখানার কথা থাক। ছাপাখানার জন্যে আমি কাউকে ডাকিনি।”

“জানি স্যার। আপনি মোহনবাবু সম্পর্কে খোঁজ-খবর চান।”

“হ্যাঁ।”

“আমি আদতে ম্যাজিশিয়ান হলেও মাঝেসাঝে এই ধরনের খোঁজখবর রাখার কাজও করি।”

“গোয়েন্দা?”

“না স্যার। আসল গোয়েন্দা নই।”

“তবে?”

“পাতি গোয়েন্দা।” কিকিরা হাসলেন মজার মুখ করে। “আপনি আমায় ওয়ার্থলেস মনে করবেন না। আমি কাপালিক ধরেছি, রাজবাড়ির কাজও করেছি। সত্যি বলতে কি, আপনি আমায় একটু লোভ দেখিয়ে টেনে এনেছেন।”

“লোভ?” লোচন সিগারেটের প্যাকেটটা খুলতে-খুলতে বলল।

 “তিরিশ হাজার টাকার লোভ!”

“ও!”

“মোহন দত্তকে, মানে জাল মোহন দত্তকে আমি খুঁজে বের করতে চাই।”

লোচন সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে যেন বিদ্রূপ করে হাসল। “আপনি জাল মোহনকে খুঁজে বের করবেন! বলেন কী মশাই! আপনি তো বললেন পাতি গোয়েন্দা। আমি ভাবছি একটা আসল গোয়েন্দা ভাড়া করব।”

কিকিরা হাসিমুখেই জবাব দিলেন, “তা করতে পারেন। শাঁটুলদাকেই করুন।”

“শাঁটুল! কে শাঁটুল?”

“শার্লকদাকে আমি শাঁটুলদা বলি!”

লোচন তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাত-মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “না না, ওসব শটুল-মাটুল আমার চাই না।”

কিকিরা হঠাৎ হাত বাড়ালেন। “স্যার, একবার আপনার দেশলাইটা দেবেন?”

“দেশলাই!”

“মানে, আমি একটা বিড়ি ধরাব।”

“বিড়ি!”

“চুরুট!”

 লোচন যেন বিরক্ত হয়েই দেশলাইটা ছুঁড়ে দিল।

কিকিরা ততক্ষণে কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়েছেন। চুরুট বের করছেন। দেশলাইটা এসে তাঁর পায়ের কাছে পড়ল। তারাপদ কুড়িয়ে নিল দেশলাই।

কিকিরা কোটের পকেট থেকে হাত বের করলেন। দেশলাই দিল তারাপদ। চুরুট ধরিয়ে কিকিরা বললেন, “কাগজে যা ছেপেছেন তাতে তো বলেছিলেন–যে-কোনো লোকই আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। বিশেষ করে কাউকে তো আসতে বলেননি। তা হলে এই খোঁড়া পা নিয়ে আসতাম না। কাজটা ঠিক করেননি, দত্তবাবু! কথায় কাজে মিল থাকা দরকার! …তা ঠিক আছে। চলি। এই নিন আপনার দেশলাই!” বলে কিকিরা উঠে দাঁড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দু’পা এগিয়ে ছুঁড়ে দিলেন দেশলাই।

লোচন দেশলাইয়ের বাক্সটা লোফার জন্যে হাত বাড়াল। কোথায় দেশলাই! পায়ের কাছে ঠং করে কী যেন একটা পড়ল।

নিচু হয়ে একটু খোঁজাখুঁজি করে লোচন জিনিসটা তুলে নিল। তুলে নিয়েই। অবাক। চকচক করছে। সোনা নাকি? “কী এটা?”

“সোনার মেডেল…!”

“মে-ডে-ল?”

“আরও দেখবেন! এই দেখুন আমার ডান হাত। ফাঁকা। দেখছেন? ভাল করেই দেখুন স্যার! …নিন, আরও একটা মেডেল।” এবারের জিনিসটা লোচনের কোলে গিয়ে পড়ল। “আরও চাই? আচ্ছা–এই নিন আরও একটা। এটা স্বয়ং গভর্নর সাহেব দিয়েছিলেন। ছ’আনা সোনা আছে–গিনি গোল্ড!”

লোচন রীতিমতন ঘাবড়ে গিয়েছিল। বলল, “থাক থাক…।”

“না স্যার, কিকিরা হল জেনুইন। ফাঁকিবাজি পাবেন না। আরও কিছু শো করব? দেখবেন? দিন না আপনার চাবির গোছাটা। হাওয়া করে দেব।”

লোচন তার চাবির গোছা মুঠোর মধ্যে পুরে ফেলল। “না না, চাবির গোছ থাক। আপনি…”

“আমি কিকিরা দ্য গ্রেট। ম্যাগনিফিসিয়ান্ট ম্যাজিশিয়ান। ডাক ডিটেকটিভ–মানে পাতি গোয়েন্দা।”

লোচন বেশ বিমূঢ়।

কিকিরা বললেন, “দিন দত্তমশাই, মেডেলগুলো ফেরত দিন। …তারাপদ, ওগুলো নিয়ে নাও।”

তারাপদ এগিয়ে গিয়ে মেডেলগুলো নিয়ে নিল।

“তা হলে চলি সার!”

লোচন থতমত খেয়ে গিয়েছিল। বলল, “আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। আপনারা কি সত্যিই জাল মোহনকে ধরে দেওয়ার জন্যে এসেছেন?”

“ভদ্রলোকের এক কথা। কাগজ দেখে এসেছি। কাজ করতে পারলে তিরিশ হাজার টাকা, নয়ত তিরিশ পয়সাও নয়।”

লোচন যেন কী ভাবল। “পারবেন?”

“চেষ্টা করব।”

“বসুন।”

 কিকিরা বসলেন, ইশারায় বসতে বললেন তারাপদকে।

লোচন খানিকক্ষণ যেন কিছু ভাবল। তারপর বলল, “মোহন আমার ছোট ভাই। সহোদর ভাই নয়। জ্যাঠামশাই ওকে পোষ্য নিয়েছিলেন। মানে জ্যাঠার ছেলেমেয়ে ছিল না। আমরা জন্মের বছর দশ পরে পরে এক বন্ধুর ছেলেকে পোষ্য নেন। বন্ধু মারা যান। …তা মোহন আমার ভাই-ই। আমরা দুটি ভাই ছিলাম। মোহন আজ পাঁচ বছর হল মারা গিয়েছে। নাইনটিন এইট্টি ফাইভে। “

“অগস্ট মাসে?”

“হ্যাঁ।”

“কোথায়?”

“সে সব কথা পরে। এখন যা বলছি শুনুন। …আজ মাস দেড়-দুই হল একটা লোক আমার ছোট ভাই মোহন সেজে নানা জায়গায় ঝঞ্ঝাট করে বেড়াচ্ছে।”

“আপনি তাকে চোখে দেখেছেন? মানে, যে-লোকটি ঝঞ্ঝাট করে বেড়াচ্ছে, তাকে দেখেছেন?”

“না, আমি দেখিনি।”

“তা হলে?”

 লোচন অন্যমনস্কভাবে আরও একটা সিগারেট ধরাল। বলল, “আমি খবর পাচ্ছি।”

“কোত্থেকে খবর পাচ্ছেন?”

“এর-ওর কাছ থেকে।”

“যেমন? নাম বলুন? ঠিকানা?”

ধোঁয়া গিলে লোচন বলল, “মাস দেড়েক আগে একদিন আমার এক আত্মীয়, সম্পর্কে মাসতুতো দাদা, রাত্তিরে ফোন করে প্রথম খবরটা দিল।”

লোচনের কথা শেষ হয়নি, আচমকা এক ছোকরা ঘরে ঢুকল। ঘন মেরুন। রঙের গেঞ্জি গায়ে–স্পোর্টস গেঞ্জি, পরনে সাদা প্যান্ট। চোখে বাহারি গগলস। হাতে একটা লম্বা মতন বাক্স। বাজনার। বলল, “জামাইবাবু, দিদি আপনাকে ডাকছে। ফোন এসেছে। তাড়াতাড়ি যান।” বলে ডোকরা। কিকিরাদের দেখল কৌতূহলের সঙ্গে, তারপর চলে গেল।

লোচন নিজেই বলল, “আমার ছোট শ্যালক, জ্যোতি। ভাল গিটার বাজায়। কোথাও চলল। বাজাতে বোধ হয়। ..আপনারা বসুন। আমি আসছি।”

লোচন চলে গেল।

.

০৩.

লোচন দত্ত ঘর ছেড়ে চলে যাওয়ার পর তারাপদ সামান্য অপেক্ষা করল, তারপর দুহাত জোড় করে নিচু গলায় বলল, “স্যার, আপনি সত্যিই গ্রেট, আমাকেও হাঁ করে দিয়েছেন। এত কথা জানলেন কেমন করে?”

কিকিরা মুচকি-মুচকি হাসছিলেন। বললেন, “তোমরা অল্পেতেই হাঁ হও। হাঁ হওয়ার কিছু নেই। বগলাকে পাঠিয়েছিলাম বড়াল গলি আর লোচনের খবর নিতে। বগলা যা খবর দিল আগেই বলেছি। একটা কথা বোধ হয় বলতে ভুলে গিয়েছি। ও শুনেছিল, বাবুদের ছাপাখানা আছে ধর্মতলায়। তা আমার কাছে গোটা দুয়েক পুরনো টেলিফোন-পাঁজি আছে, যাকে তোমরা বলো ডাইরেক্টরি। দুটোই বছর কয়েকের পুরনো। খুব ইউসফুল জিনিস হে তারাবাবু, তুমি ওটা ঘাঁটাঘাঁটি করলে অনেক কিছু পেয়ে যাবে। সেই জন্যেই রেখেছি।”

“আপনি পেলেন?”

“পেলাম। দেখলাম লেখা আছে দত্ত অ্যান্ড সন্স। প্রিন্টার্স অ্যান্ড পাবলিশার্স। ধর্মতলা স্ট্রিট…। ছাপাখানার ফোন নম্বর। পরের লাইনে লেখা ডিরেক্টর এল, দত্ত। রেসিডেন্স ফোন নম্বর… এত এত। ব্যস–সহজ জিনিসটা বেরিয়ে গেল। লোচন দত্ত ছাপাখানার ডিরেক্টর। তার বাড়ির ফোন নম্বর সো অ্যান্ড সো।”

“সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু আপনি দত্তদের ছাপাখানা সম্পর্কে যেসব গল্প ঝাড়ছিলেন..”

“সেরেফ গল্পই। লোচন দত্ত নিজেই বলল, তাদের ছাপাখানা সত্তর বছরের। মানে বেশ পুরনো। মামুলি ছাপাখানা সত্তর বছর টিকে থাকে না তারাপদ। তা ছাড়া চোখ বুজে ডাউন দ্য মেমারি লেন করলাম। ধর্মতলা স্ট্রিট আমার খুব চেনা রাস্তা। মনে হল, এরকম একটা নামের সাইনবোর্ড যেন দেখেছি। মৌলালির কাছাকাছি হবে।”

তারাপদ ঠাট্টা করে বলল, “সি আর দাশকেও দেখেছেন নাকি?”

 কিকিরা হাসলে লাগলেন। “ছবি দেখেছি। দেশবন্ধু মারা যান–উনিশশো পঁচিশ-টচিশ হবে। তখন আমি কোথায়, লোচনই বা কোথায়? আর কোথায় বা তাদের প্রেস।”

তারাপদ যেন মজাটা উপভোগ করছিল। কিকিরা লোককে বোকা বানাতে ওস্তাদ। ম্যাজিশিয়ান বলে কথা!

“আপনি কি খেলা দেখাবার জন্যে ওইসব মেডেল পকেটে পুরে এনেছিলেন?”

“রাইট! ম্যাজিশিয়ানদের পকেট কখনও ফাঁকা থাকে না। হুডিনি সাহেব বলতেন, আমাদের ফাঁকা পকেটে ঘুরতে নেই, জাদুকরের জাত যায়। অন্তত একটা রুমাল বা তাসের প্যাকেটও রেখ।”

“পকেটে আর কী কী আছে?”

“তেমন কিছু না। রুমাল আর আই-পিন।”

“আপনি ভাগ্যবান। ম্যাজিকটা কাজে লেগে গেল।”

“লেগে যেত। সাধারণ মানুষের কাছে দুটো জিনিস লেগে যাওয়ার নাইনটি পার্সেন্ট চান্স। হাত দেখা আর ম্যাজিক।” বলে কিকিরা হাসতে লাগলেন। “আমার কাছে আরও একটা তুরুপের তাস ছিল। দরকার হল না।”

পায়ের শব্দ শোনা গেল।

পালোয়ান হরিপ্রসাদ এসে হাজির। বলল, “আইয়ে…!”

তারাপদ অবাক হল। আইয়ে মানে? লোচন কি তাদের পালোয়ান দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছে? বলল, “কাঁহা?”

“দপ্তরমে। দুসরা কামরা।”

 কিকিরা উঠে দাঁড়ালেন। “চলো, অফিস ঘরে ডাক পড়েছে।”

 তারাপদও উঠে পড়ল।

.

ঢাকা বারান্দায় খানিকটা এগোলেই দোতলার সিঁড়ি। সিঁড়ির পাশ দিয়ে দশ পা হাঁটলেই অফিস ঘর।

কিকিরাদের অফিস ঘরে পৌঁছে দিয়ে পালোয়ানজি চলে গেল।

অফিস ঘরে লোচন দত্ত বসে ছিল। বলল, “আসুন। এই ঘরে বসেই আমি কাজের কথাবার্তা বলি। এটা আমার বসার ঘর অফিস ঘর দুইই। বসুন। আপনারা। আগের ঘরটায় এখন আমার ছেলেরা পাড়ার বন্ধুদের নিয়ে ক্যারাম খেলতে বসবে। ওদের নাকি ক্যারাম কম্পিটিশন চলছে। ছেলেপুলের কাণ্ড। বসুন আপনারা। চা খান।”

ছেলের কথা উঠলেও কিকিরা লোচনের ছেলে চুরি যাওয়ার কথা তুললেন না।

এই ঘরটা মাঝারি। মোটামুটি সাজানো-গোছানো। সোফা-সেটি চেয়ার। একপাশে লোচন দত্তর কাজকর্মের সেক্রেটারিয়েট টেবিল, গদিআঁটা চেয়ার। দেওয়াল-আলমারিতে নানান জিনিস। ফোনও রয়েছে ঘরে। দেওয়ালে গান্ধীজি আর রামকৃষ্ণের ছবি। চমৎকার একটা ক্যালেন্ডার।

কিকিরারা সোফায় বসলেন। টিপয়ের ওপর দু কাপ চা আর প্লেটে কিছু বিস্কুট।

“নিন, চা খান।”

লোচন দত্তর ব্যবহারও খানিকটা পালটে গিয়েছিল। আগের মতন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছিল না কিকিরাদের। খাতির করে চা খাওয়াচ্ছে।

কিকিরা চায়ের কাপ তুলে নিলেন। “কাজের কথা আগে সেরে নিই দত্তমশাই?”

“হ্যাঁ, সেরে নিন। আমার আবার তাড়া আছে। রবিবার হলেও একবার বেরোতে হবে।”

“আপনি বলছিলেন, আপনার এক আত্মীয় প্রথমে মোহনের খবরটা দেয়।”

“হ্যাঁ। আমার এক ডিসট্যান্ট রিলেশান। মাসতুতো ভাই হয় সম্পর্কে।”

“মাস দেড়েক আগের ঘটনা বলছিলেন…”

“ওইরকমই। রাতের দিকে ফোন করে বলল ব্যাপারটা।”

“আত্মীয়ের নাম-ঠিকানা? প্লিজ, স্যার এক টুকরো কাগজ যদি দেন।”

টেবিলের ওপর কাগজ ছিল। কিকিরার ইশারায় তারাপদ উঠে গিয়ে কাগজ নিল। ডট পেন তার পকেটেই ছিল।

ফিরে এসে বসল তারাপদ।

লোচন বলল, “নাম অনিল। অনিলচন্দ্র দেব। ঠিকানা দিনেন্দ্র স্ট্রিট। বাড়ির নম্বর একশো বত্রিশ বাই ওয়ান বোধ হয়।”

“নম্বরটা ঠিক মনে পড়ছে না?”

“ওইরকমই। শ্যামবাজারের দিকে। “

“কী করেন ভদ্রলোক?”

“মেশিনারির ডিলার। অফিস মিশন রো-তে।”

“কী বললেন উনি?”

লোচন সিগারেট ধরিয়ে নিল। বলল, “অনিলদা বলল, একটা লোক দু’দিন ধরে বাড়িতে তাকে ফোন করে বলছে যে, সে মোহন।”

“মাত্র ওইটুকু?”

 “না। বলছে যে, সে মরেনি। বেঁচে আছে। তার মরার খবর মিথ্যে।”

 “একথা কেন বলছে?”

“আমি জানি না। তবে সে বলতে চাইছে, আমি মিথ্যে করে তার মরার বির রটিয়েছি। সে বেঁচে আছে।”

কিকিরা তাপাপদর দিকে তাকালেন। তারাপদ অনিলচন্ত্রের নাম-ঠিকানা কে নিয়েছিল আগেই। চা খাচ্ছিল। কিকিরা বললেন, “আর কিছু?”

“না।”

একটু থেমে কিকিরা এবার বললেন, “অনিলবাবুর সঙ্গে আপনি দেখা করেননি?”

“করেছিলাম। আলাদা কিছু জানতে পারিনি।”

“অনিলবাবুর কী মনে হয়েছে?”

“অনিলদা বলল, পাঁচ-ছ বছর পরে তো গলার স্বর মনে থাকার কথা নয়। তবে লোকটা আমাদের বাড়ি সম্পর্কে যা-যা খবর দিল দু-পাঁচটা, তা ঠিকই। “

কিকিরা চা শেষ করলেন। সামান্য চুপ করে থেকে বললেন, “এর পর? মানে অন্য আর কাদের সঙ্গে মোহন যোগাযোগ করেছে?”

নোচন বললেন, “আমাদের এক মামা আছেন.। মায়ের খুড়তুতো ভাই। বয়েস হয়েছে। ডাক্তারি করতেন। মানে চাকরি করতেন করপোরেশনে। রিটায়ার্ড। তাঁকেও লোকটা ফোন করেছিল।”

“মামার নাম? ঠিকানা?”

“পি সি সেন। প্রফুল্ল সেন। ঠিকানা শোভাবাজার।” লোচন ঠিকানা দিল।

“মামাকেও সেই একই কথা”, লোচন বলল, “সে বেঁচে আছে। আমি নাকি মিথ্যে করে তার মরার খবর রটনা করেছি।”

“আপনার মামা তাকে আসতে বললেন না বাড়িতে?”

“মামা বলেছিলেন। ও আসবে না।”

“কেন?”

“বলল, আসার বিপদ আছে।”

“আপনার মামার কী মনে হল লোকটার কথা শুনে?”

লোচন একটা পেনসিল তুলে নিয়ে ঘাড়ের কাছটায় চুলতে নিতে-নিতে বলল, “মামার ধারণা হল, লোকটা চিট, তবে আমাদের বাড়ির খবরাখবর রাখে।”

কিকিরা বললেন, “এর পর? মানে আর কার কার সঙ্গে সে যোগাযোগ করেছে?”

লোচন খানিকটা বিরক্ত হয়ে বলল, “আরও তিন-চারজনের সঙ্গে। তার মধ্যে রয়েছে আমার বন্ধু ভবানী; আমার শ্বশুরবাড়ির তরফের বলতে বড় শ্যালক; আমাদের প্রেসের পুরনো ম্যানেজার তুলসীবাবু, এই পাড়ার মিহিরকাকা।”

“পুরো নাম-ঠিকানাগুলো বলবেন দয়া করে?”

লোচন তার বন্ধু ভবানীর কথা বলল। ভবানী সরকারি চাকরি করে, থাকে ক্রিক রো-তে। শ্বশুরবাড়ির বড় শ্যালকের নাম সতীশ চন্দ্র। সে থাকে বাগবাজারে। আলাদাই থাকে সতীশদা।

কথার মাঝখানে ফোন এল।

লোচন ফোন তুলল, সাড়া দিল, তারপর বলল, “ধরো, ওপরে তোমার মেজদিকে দিচ্ছি।” বলে নিচের ফোনের লাইন ওপরে জুড়ে দিল। দিয়ে নিচের ফোন নামিয়ে রাখল।

তারাপদ নাম-ঠিকানা টুকে নিচ্ছিল।

 “আপনাদের প্রেসের ম্যানেজার?” কিকিরা বলল।

“তুলসীবাবু। তুলসী সিংহ। আমারা “তুলসীকাকা বলতাম। কাকা বছর চার-পাঁচ হল বাড়িতেই বসে আছেন। বয়েস হয়েছে। তা পঁয়ষট্টির বেশিই হবে। উনি শেষের দিকে বার কয়েক বড় বড় অসুখে পড়েন। শেষে হার্টের গোলমাল। তার ওপর চোখে আর দেখতে পাচ্ছিলেন না। ছানি কাটানো হল একটা। কাজ হল না। কাকা রিটায়ার করলেন।”

“কোথায় থাকেন?”

“পটুয়াটোলা লেনে। …কাকা বাড়িতে একাই থাকেন। বিধবা এক ভাইঝি দেখাশোনা করে। কাকা বিয়ে-থা করেননি। নিজের বলতে কেউ নেই। মানুষটি খুব ভাল। ধার্মিক। একমাত্র কাকার কাছেই লোকটা একদিন হাজির হয়েছিল।”

“সামনাসামনি?”

“হ্যাঁ। বৃষ্টির মধ্যে সন্ধের পর।”

“তুলসীবাবু তাকে দেখেছেন?”

“সামান্য দেখেছেন। যে-মানুষের চোখ নেই বললেই চলে–তার দেখা আর না-দেখা সমান।”

“তবু তিনি কী বললেন?”

“মোহনের মতনই লেগেছে তাঁর।”

“ও!… তা সেই লোকটা সরাসরি দেখা বলতে এই যা তুলসীবাবুর সঙ্গেই করেছেন? অন্যদের বেলায়…”

“ফোন। চিঠি।”

“চিঠি?”

“চিঠিও লিখেছে দু-একজনকে। সেই চিঠি আমি দেখেছি। হাতের লেখা খানিকটা মিলে যায়।”

কিকিরা অবাক হলেন। তারাপদর দিকে তাকালেন।

 তারাপদ বলল, “দু-চার বছর পরেও কারও হাতের লেখা দেখলে তার পুরনো হাতের লেখার সঙ্গে মেলাতে গেলে মুশকিল হয়ে পড়ে। অবশ্য খুব চেনা হাতের লেখা হলে অন্য কথা।”

“হাতের লেখা নকল করাও কঠিন নয়। সই জাল, হাতের লেখা জাল-এ তো আকছার হয়। “ লোচন বলল।

কিকিরা কথা পালটে নিলেন। “আর-একজনের কথা বলছিলেন আপনি, পাড়ার লোক।”

“মিহিরকাকা। উনি এই পাড়াতেই থাকেন। একটা ছোট পার্ক আছে ওদিকে। বাচ্চাদের পার্ক। পার্কের গায়েই ওঁর বাড়ি। মিহিরকাকা উকিল মানুষ। বাবার বন্ধু ছিলেন। ওকালতি মন্দ করতেন না, তবে ওঁর শখ হল নাটক করার। এখানে একটা পুরনো ক্লাব আছে নাটকের, ইভনিং ক্লাব। মিহিরকাকা আজ বছর দশ-পনেরো ক্লাব নিয়ে মেতে আছেন। পয়সাওলা বাড়ির ছেলে। চিন্তা-ভাবনা নেই। তবু মিহিরকাকা একসময় যাও বা কোর্টে আসা-যাওয়া করতেন, বছর কয়েক তাও করেন না।”

“কেন?”

“ওঁর ডান হাত অ্যামপুট করতে হয়েছে। গাড়ির সঙ্গে অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল।”

“ইস!”

“ওকালতি প্রায় ছেড়ে দিলেও ক্লাব ছাড়েননি। ক্লাবই এখন ধ্যান-জ্ঞান।”

“জাল মোহন কি ওঁর কাছে গিয়েছিল?”

“না। ফোনে কথা বলেছে।”

“কী বলেছে?”

“সে বেঁচে আছে। এখন কলকাতায় রয়েছে।”

“লোকটার উদ্দেশ্য কী?”

“জানি না। সে-ই জানে। তবে আমার মনে হচ্ছে, লোকটা ভয় দেখিয়ে আমাকে ব্ল্যাকমেল করতে চায়।”

কিকিরা ভেবেছিলেন লোচন ছেলে-চুরির কথা তুলবে। তুলল না। সামান্য অবাকই হলেন তিনি। খানিকক্ষণ কিছু ভাবলেন। তারপর বললেন, “মোহন কোথায় কীভাবে মারা যায়?”।

লোচন যেন সামান্য ইতস্তত করল। বার কয়েক দেখল কিকিরাকে। হতাশ, করুণ মুখ করল কেমন। আবার সিগারেট ধরাল। বলল, “ঘটনার কথা ভাবতে গেলে আমার কী যে হয়ে যায় মশাই, সারা গা ভয়ে শিউরে ওঠে। মনে হয়, কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছি।” লোচন চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ। আবার বলল, “আমাদের দুই ভাইয়েরই বেড়াবার শখ ছিল। ছুটিছাটায় তো বটেই–এমনিতেও হুট করে বেরিয়ে পড়তাম কাঁধে একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে। সেবার আমরা চারজন একটা জায়গায় বেড়াতে যাই। জায়গাটা আপনারা চিনবেন না। বালিয়া জেলার ছোট্ট এক জায়গায়। জঙ্গল আর ছোট-ছোট পাহাড়। গাছপালা, পাখি তো কতই! তার সঙ্গে ছিল এক ঝরনা, ছোট ঝরনা, ঝরনার শেষে একটা লেক। ওখানকার ভাষায় বলে ‘তাল’। বোধ হয় ‘তালাও’ শব্দ থেকে। বর্ষার শেষ সময় গিয়েছিলাম আমরা। অগস্ট মাসে। …যা বলছিলাম, ‘সারাও তাল’ বলে যে লেকটা আছে–তার কাছাকাছি এক মামুলি সরকারি ডাকবাংলোয় আমরা উঠেছিলাম। দিন পাঁচ-সাত থাকার কথা।”

“আপনারা চারজন কে-কে ছিলেন?”

“আমি, মোহন, আমার মেজো শ্যালক, আর মোহনের এক বন্ধু।”

“তারপর?”

“একদিন আমরা ঝরনা দেখতে পাহাড়ের ওপরে গেলাম। পাহাড় যে খুব উঁচু তা নয়। তবে বড় রাফ। খাড়াই পাহাড়। পাথরে ভরতি। ওপরে গাছপালার ঝোঁপ। বেশিরভাগ গাছই ঝোঁপ ধরনের।”

“আপনারা চারজনেই গিয়েছিলেন?”

“হ্যাঁ। চারজনেই। …পাহাড়ের মাথার কাছে এক জায়গায় যেখান থেকে ঝরনার জল নামছে, সেখানে পা রাখাই কষ্টের। পাথর, ঝোঁপ, শ্যাওলা, জংলা। গাছ। …আমি মোহনকে বারণ করেছিলাম আর না-এগোতে। আমার কথা শুনল না। সে এগিয়ে গেল। আমার মেজো শ্যালক আর মোহনের বন্ধু খানিকটা পেছনেই ছিল। মোহন এগিয়ে যাচ্ছে দেখে বাধ্য হয়ে আমিও গেলাম। হঠাৎ একেবারে ঝরনার মুখের কাছে গিয়ে মোহনের পা পিছলে গেল।” লোচন যেন শিউরে উঠে চোখ বন্ধ করল, দৃশ্যটা সে দেখতে পাচ্ছে এখনো।

কিকিরা আর তারাপদ কোনো কথা বললেন না।

নিজেকে সামলে নিয়ে শেষে লোচন বলল, “ঝরনার জলের সঙ্গে পড়তে-পড়তে সে কোথায় যে আটকে গেল পাথরে, ঝোঁপঝাড়ে–তা আর আমরা দেখতে পেলাম না।”

“আপনারা কী করলেন?”

“নিচে নেমে লোকজন জুটিয়ে আনলাম। মোহনকে খুঁজে পাওয়া গেল না। পুরো একটা দিন কেটে গেল। দেড় দিনের মাথায় তাকে উদ্ধার করা গেল। পাথর আর জলের মধ্যে ঘন শ্যাওলার তলায় আটকে রয়েছে। পড়ার সময় তার যা জখম হয়েছিল–তা তো হয়েই ছিল, তার ওপর জলের স্রোতে এখানে-ওখানে ধাক্কা খেতে-খেতে মোহনের চোখমুখ মাথা বলতে কিছুই প্রায় ছিল না। রক্তমাংসের একটা তাল। জলের মধ্যে পড়ে ছিল বলে পোকামাকড় তার গা ঘেঁকে ধরেছে। সারা শরীর ভাঙাচোরা, মাংস খাবলে নিয়েছে যেন কোনও জন্তুজানোয়ারে। সে দৃশ্য বীভৎস!”

“মোহনকে চেনা যাচ্ছিল?”

“কষ্ট হচ্ছিল। তবে আমি চিনতে পেরেছিলাম।”

“আপনার শ্যালক আর মোহনের বন্ধু?”

“তারাও চিনেছিল।”

“মোহনকে আপনারা ওখানেই দাহ করেন?”

“হ্যাঁ। কাছেই। এক ডাক্তার পাওয়া গিয়েছিল মাইল তিনেক তফাতে। পুলিশ-থানাতেও খবর দেওয়া হয়।”

“কাগজপত্র আছে?”

“না। ডাক্তারের সার্টিফিকেট থানায় জমা নিয়ে নেয়। তার একটা কপি পরে আমি আনিয়েছি।”

“আপনার মেজো শ্যালক এখন কোথায়?”

“ডুয়ার্সে? চা বাগানে। সেখানে চাকরি করে।”

“মোহনের বন্ধু?”

“সে চলে গিয়েছিল দিল্লিতে। সেখানে চাকরি করত। তারপর কোথায় আছে আমি জানি না।”

“আপনি কি এদের কোনো খবর দিয়েছেন?”

“মেজো শ্যালককে চিঠি লিখেছি। মোহনের বন্ধুর ঠিকানা আমি জানি না। …কলকাতায় তাদের কেউ নেই।”

কিকিরা খানিকক্ষণ কোনো কথা বললেন না। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “মোহনের কোনো ফোটো হাতের কাছে আছে?”

“না, হাতের কাছে নেই। তবে ওই দেওয়ালে-ওই ছবিটা দেখতে পারেন। আমরা দুই ভাই-ই রয়েছি ফোটোতে।”

কিকিরা এগিয়ে দেওয়ালের কাছে গেলেন। ফোটোটা দেখলেন কিছুক্ষণ।

“আজ আমরা যাই। পরে আপনার কাছে আবার আসছি।” বলে কিকিরা ইশারায় তারাপদকে উঠতে বললেন।

.

০৪.

চন্দন ঘরে আসতেই কিকিরা বললেন, “কী ব্যাপার হে, নাটকের মাঝখানে তোমার আবিভাব। বলি এটা কি দাশরথি পার্টির যাত্রা।” বলে রঙ্গ করে চোখ এলে তাকিয়ে থাকলেন চন্দনের দিকে। কে যে দাশরথি তিনি বললেন না।

চন্দন মাথা মুছতে লাগল। ইলশেগুঁড়ির মতন বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। দু-দশ ফোঁটা জল গায়ে-মাথায় লেগেছে তার। মাথা মুছতে মুছতে চন্দন বলল, “ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে বেড়াচ্ছেন আপনারা, আমার তো সে আহ্লাদ করার সময় নেই। ডিউটি ডিউটি ডিউটি। লাইফ হেল করে ছেড়ে দিল। ওপরঅলা গিয়েছেন দিল্লি, সেমিনার করতে, যত ঝঞ্জাট আমার। আসছে জন্মে যেন আর ডাক্তার না হই।”

“কী হতে চাও?” কিকিরা মজা করে বললেন, “কম্পাউন্ডার?”

“আজ্ঞে না, বরং ম্যাজিশিয়ান হব। ভড়কি মেরে বাজিমাত। কত হাততালি। কাগজে ছবি।”

“তাই হবে। এখন বোসো। চা-টা খাও।”

 কিকিরার ঘরে তিনি আর তারাপদ। সন্ধে হয়েছে সবে। আজকের দিনটায় মোটামুটি আরাম লাগছিল। গরম নেই, ঘাম নেই, বাদলাও না থাকার মতন। শরকাল যেন পুরোপুরি দেখা দিচ্ছে।

“আপনার পা কেমন?”

“ও-কে।”

“আপনি বাইরে বেরোতে শুরু করেছেন শুনলাম?”

“এই মাঝে-মাঝে!”

“চালাকি করবেন না কিকিরা। আমি সব জানি। রবিবারে আপনি সফর করতে বেরিয়েছিলেন। গতকালও টহল মেরে এসেছেন।”

কিকিরা অমায়িক হাসি হেসে বললেন, “যাচ্চলে, আমার তো খেয়ালই থাকে না। বুড়ো হয়ে ভীমরতি হয়েছে আমার। …তা স্যান্ডেলউড, ইয়ে মানে–তিরিশ হাজার টাকার ব্যাপারটা তোমায় বলেনি তারাপদ?” কিকিরা বললেন বটে বোকা সেজে, কিন্তু তিনি জানেন, তারাপদর কাছ থেকে সব খবরই পেয়েছে চন্দন।

তারাপদ চন্দনের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসল।

 চন্দন বলল, “যা ইচ্ছে আপনি করুন, স্যার। কিন্তু আপনার পায়ের দায়িত্ব আমি নিচ্ছি না। পরে যখন ব্যথায় কাতরাবেন, আমি নেই।”

কিকিরা হেসে-হেসে জবাব দিলেন, “পাগল নাকি! আমি তোমার অ্যাডভাইস ছাড়া কিছু করি নাকি? তবে কী জানো, তিরিশ হাজারের লোভটা সামলাতে পারিনি বলে দু’দিন বাড়ির বাইরে বেরিয়েছি। খুব সাবধানে। ওয়াকিং করিনি বললেই হয়, সঙ্গে ছড়ি রেখেছি। প্রথমদিন তারাপদ ছিল। …তুমি সব শুনেছ তো?”

“লোচন দত্ত শুনেছি। “

“কাল একবার উত্তরে গিয়েছিলাম। বাগবাজার আর দিনেন্দ্র স্ট্রিট।”

চন্দন বসল। বসে হাত বাড়িয়ে তারাপদর সামনে রাখা প্লেট থেকে একটা শিঙাড়া তুলে নিল।

কিকিরা নিজেই বললেন, “দিনেন্দ্র স্ট্রিটে থাকেন লোচনের মাসতুতো দাদা। অনিলচন্দ্র দেব, অনিলদা। মাসতুতো হলেও ঠিক নিজের মাসির নয়। মায়ের খুড়তুতো দিদির ছেলে। বয়েস হয়েছে। পঞ্চাশ-টঞ্চাশ হবে। অনিলচন্দ্র সেরে একবার সতীশবাবুর কাছে গেলাম। সতীশবাবু নোচনের বড় শ্যালক। থাকেন বাগবাজারে। আলাদাভাবেই থাকেন, মানে লোচনের নিজের শ্যালক হলেও, নিজেদের পৈতৃক বাড়িতে থাকেন না। ভাড়া বাড়িতে থাকেন।”

চন্দন বলল, “দেখুন কিকিরা, আমি তারার মুখের গোড়ার কথা সব শুনেছি। সব ব্যাপারে আপনি নাক গলাতে যান কেন?”

মজা করে কিকিরা বললেন, “নাক এখনো গলাইনি; শুধু গন্ধটা শুকছি। …তা ছাড়া তিরিশ হাজার ফেলনা নয় আজকের দিনে। আমি গরিব মানুষ। যদি থার্টি থাউজেন্ড পেয়ে যাই…।

“কচু পাবেন। ওসব ধাপ্পাবাজি আমি অনেক দেখেছি।”

“তুমি আগে থেকেই সব মাটি করে দিচ্ছ! কথাগুলো যদি না শোনো, ব্যাপারটার মধ্যে কী আছে বুঝবে কেমন করে?”

চন্দন আর কথা বলল না।

কিকিরা সামান্য সময় চুপ করে থেকে বললেন, “ব্যাপারটা যা ভাবছ তা নয়। এর মধ্যে সামথিং হ্যাজ…!”

বগলা চা নিয়ে এসেছিল চন্দনের জন্য। তারাপদদের চা তখনও শেষ হয়নি।

চা নিতে নিতে কিকিরার দিকে তাকাল চন্দন। বলল, “সামথিং তো সব ব্যাপারেই থাকে। তা বলে আপনি খোঁড়া পায়ে নেচে বেড়াবেন!”

কিকিরা কথাটা শুনলেন, পাত্তা দিলেন না।

চন্দন নিজের ঝোঁকেই বলল, “আমার মাঝে-মাঝে মনে হয়, আপনার উচিত ছিল ক্রিমিন্যাল প্র্যাকটিসে নেমে পড়া। বিস্তর পয়সা কামাতেন। আজকাল ও-লাইনে অনেক কদর।”

কিকিরা বললেন, “নেক্সট লাইফ, মানে পরের জন্মে চেষ্টা করব। এখন আমার কথাটা শোনো।”

চন্দন আর কিছু বলল না। কিকিরা বললেন, “বলছিলাম অনিলবাবুর কথা। বাড়িতে গিয়েই ধরলাম তাঁকে। বললাম, আমি লোচনবাবুর হয়ে কাজ করছি। ভদ্রলোক আমাকে পাত্তাই দিতে চান না। পরে ফোন করলেন লোচনকে। জেনুইন পার্টি আমি। শেষে কথা বললেন।”

“কী বললেন?” তারাপদ বলল।

“বললেন টেলিফোন কল বার-দুই হয়েছে। টেলিফোনে গলা শুনে তিনি আন্দাজ করতে পারেননি ওটা মোহনের গলা কি না! এত বছর পর কারও গলার স্বর মনে রাখা অসম্ভব। তার ওপর লাইনে শব্দ হচ্ছিল। পাবলিক বুথ থেকে ফোন করছিল বোধ হয় কেউ। “

“অনিলবাবুর মোট কথাটা কী?

“বললেন, মোহন কি না তা তিনি জানেন না, তবে লোকটা লোচনদের ঘরবাড়ি পরিবার ছাপাখানা সম্পর্কে যা-যা বলল, দু-দশটা কথা, তা ঠিকই। মানে অনিলবাবু যতটা জানেন।”

চন্দন তাচ্ছিল্যের গলায় বলল, “এটা কোনো কথা হল কিকিরা? ইনফরমেশান জোগাড় করা কঠিন নাকি?”

কিকিরা বললেন, “কোনো কোনো জিনিস খুঁজে বের করা কঠিন। মানে, আমি বলছি–কোনো লোক বা বাড়ির সম্পর্কে আমরা যখন খোঁজখবর করি, ওপর-ওপরই করি। হয়ত খানিকটা খুঁটিয়েও করলাম কিন্তু সেটা কতটা হতে পারে। তোমার মা-বাবা-ভাই-বোন ঘরবাড়ি সম্পর্কে তুমি যা জানো, যতটা জানো, দেখেছ ছেলেবেলা থেকে–আমি বা তারাপদ ততটা কি জানতে পারি? পারি না।”

চন্দন বলল, “জাল মোহন কি সব কথা বলতে পেরেছে?”

“সব কথা নয়। সে-অবস্থাও ছিল না। মোহন দত্ত-পরিবার সম্পর্কে, নিজের বাবা আর কাকা, মানে লোচনের বাবা সম্বন্ধে দু-চার কথা যা বলেছে, তা ঠিক।”

“একটু শুনি?”

“যেমন ধরো সে বলেছে, তার বছর দশ বয়েসে তাকে দত্তক নেন রামকৃষ্ণ দত্ত, মানে লোচনের জ্যাঠামশাই। লোচনের বয়েস তখন দশ-এগারো। মোহন নামটা রামকৃষ্ণরই দেওয়া। আগে তার নাম ছিল গোপাল। নিজের বাবার সম্পর্কে এইটুকু তার ভাসা-ভাসা মনে আছে যে, ভদ্রলোক বড় গরিব ছিলেন, সামান্য একটা কাজ করতেন। স্ত্রী মারা গিয়েছিলেন। …তা রামকৃষ্ণর বন্ধু ছিলেন ভদ্রলোক। গোপালের নিজের বাবার টিবি রোগ হয়। বাড়াবাড়ি। উনি মারাও যান। মারা যাওয়ার আগে রামকৃষ্ণকে বলেন, গোপালকে দত্তক নিয়ে নিতে। রামকৃষ্ণর ছেলেপুলে ছিল না। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী গোপালকে দত্তক নিয়ে নেন। পোষ্যও বলতে পারো।”

তারপদ বলল, “অনিলবাবু এ-সব জানেন?”

“জানেন। শুনেছেন।”

“আর কী বলল মোহন?”

“লোচনের বাবার অসুখের কথা। দু-দুবার এমন অসুখ হয়েছিল যে, মারা যেতে বসেছিলেন। নোচনের মা দক্ষিণেশ্বরে পুজো দিতে গিয়ে গঙ্গার ঘাটে পা হড়কে হাত-পা ভেঙেছিলেন–সে কথাও বলেছে।”

চন্দন আর তারাপদ সিগারেট ধরাল। কিকিরাও একটা চেয়ে নিলেন।

“অনিলবাবুর কী ধারণা, এই লোকটা আসল মোহন?”

 মাথা নাড়তে নাড়তে কিকিরা বললেন, “না। তাঁর ধারণা লোকটা জাল।”

“আসল বলে তিনি মানতে চাইছেন না কেন?”

“যে জন্যে তোমারাও মানতে চাইছ না। মরা মানুষ কেমন করে ফিরে আসবে? মোহন যে মারা গেছে তার প্রমাণ রয়েছে হাতেনাতে। লোচন ছাড়াও বাকি দুজন তাকে মারতে দেখেছে, লোচনের মেজো শ্যালক আর মোহনের বন্ধু।”

তারাপদ বলল, “অনিলবাবু শেষ পর্যন্ত কী বলতে চাইলেন?”

“তিনি অবাক হয়েছেন ঠিকই, তবে এই ফোন করা মোহনকে ভদ্রলোক জালিয়াত জোচ্চোর ছাড়া আর কিছু ভাবতে রাজি না।”

 চন্দন কোনো কথা বলল না। তারাপদও চুপচাপ।

 কিকিরা নিজের থেকেই বললেন, “অনিলবাবু সেরে গেলাম সতীশবাবুর কাছে। উনি থাকেন বাগবাজারে। পৈতৃক বাড়িতে থাকেন না। বাগবাজারে একটা বাড়ির দোতলা ভাড়া নিয়ে থাকেন।”

“পৈতৃক বাড়ি কী দোষ করল?”

“সেটা কি আমি জিজ্ঞেস করতে পারি? নিজেদের ফ্যামিলির ব্যাপার। ..সতীশবাবু মানুষটি কিন্তু সজ্জন। ভাল। বছর পঞ্চান্ন বয়েস হয়েছে। একটা ওষুধ কোম্পানিতে কেমিস্ট। পরিবার বলতে স্ত্রী আর ছেলে। ছেলে কলেজে পড়ায়। বিয়ে-থা এখনো হয়নি।”

“সতীশবাবু কী বললেন?”

“বললেন অনেক কথাই। মোহনের গলার স্বর তিনি ধরতে পারেননি ঠিকই তবে দু-পাঁচটা কথা প্রমাণ হিসাবে যা বললেন, তা ঠিকই। সতীশবাবু বেশ আশ্চর্যই হলেন। উনি বললেন, দেখুন, ও-বাড়ির সব খোঁজখবর আমি রাখি না, কুটুমবাড়ির নাড়ির খবর, হাঁড়ির খবর রেখে আমার কী লাভ! তবে হ্যাঁ, আমাদের জামাইয়ের বাবা যেদিন মারা গেলেন সেদিন কলকাতা যে জলে ডুবে ছিল, তা আমার মনে আছে। ওদের ছাপাখানায় আগুন লেগে অনেক ক্ষতি হয়েছিল সেটাও আমি জানি। …এইরকম কয়েকটা কথা মোহন যা বলেছে–সতীশবাবু স্বীকার করে নিলেন সত্যি বলেই।”

“সতীশবাবুর ধারণা, এ-মোহন তবে আসল?”

“না, সে কথা তিনি কেমন করে বলবেন।”

“তবে?”

“তবে এটা তিনি স্পষ্টই বললেন, মোহন ছেলেটিকে তাঁর খুবই ভাল লাগত। হাসিখুশি ছেলে, আচার-ব্যবহার সুন্দর। চট করে নজর কেড়ে নিত। মোহন কিন্তু স্বভাবে খুব ভিতু ছিল। সাবধানী ছিল। বেপরোয়া ধরনের ছেলে সে একেবারেই ছিল না। চলন্ত ট্রামে বাসে সে লাফিয়ে উঠত কি না সন্দেহ। ময়দানে বড় খেলা থাকলে গণ্ডগোলের ভয়ে সে মাঠে যেত না। রেডিয়ো শুনত, টিভি দেখত। এই ছেলে যে কেমন করে ঝরনা-নামা দেখতে পাহাড়ের মাথায় উঠবে, উঠে অমন বিপজ্জনক জায়গায় যাবে–সতীশবাবুর তা মাথায় ঢোকেনি। বললেন, একেই বলে নিয়তির টান মশাই, নিয়তি তাকে টান ছিল…।”

চন্দন হঠাৎ বলল, “ওর কি ভারটিগো রোগ ছিল? তা থাকলে মাথা ঘুরে যেতে পারে।”

কিকিরা বললেন, “সে-খবর নিইনি।”

তারাপদ বলল, “সতীশবাবুর কথা থেকে কি আপনার মনে হল, ওঁর মনে কোনো সন্দেহ আছে?”

“সন্দেহের কথা কেমন করে বলবেন! তবে আমার মনে হল, ব্যাপারটা এমনই যে, সতীশবাবু মনে-মনে মেনে নিতে পারেননি।”

“লোচন সম্পর্কে বললেন কিছু?”

“না। নিজের ভগিনীপতি সম্পর্কে চুপচাপ দেখলাম। বেশি কিছু বললেন। হয়ত এড়িয়ে গেলেন।”

চন্দন বলল, “আপনার কী মনে হচ্ছে?”

“ভাবছি। এখনো অনেকের সঙ্গে দেখা করা বাকি। দেখি কোথাকার জল। কোথায় গড়ায়। মুশকিল কী জানো চাঁদু, যে দু’জন বড় সাক্ষী ছিল, তাদের একজন এখন চা বাগানে, অন্যজন বেপাত্তা। ঘটনা যে সময় ঘটেছে তখন ওরা ওখানে ছিল। ওরাই বলতে পারে।”

বাধা দিয়ে তারাপদ বলল, “স্যার, অন্য দু’জন কাছে ছিল কিন্তু পাশে বা গায়ের কাছে ছিল না। আমার যতদূর মনে হচ্ছে লোচন সেই রকমই। বলেছিল।”

চন্দন বলল, “সতীশবাবুর কী ধারণা, এই লোকটা মোহন হলেও হতে পারে?”

“না। তা নয়; তবে তিনি ধোঁকা খেয়েছেন। …মরা মানুষ ফিরে আসে না–এটা সবাই বোঝে। কথা হল, মোহন সত্যিই মারা গিয়েছে কি না?”

“সতীশবাবুরও সন্দেহ রয়েছে?”

“বাইরে প্রকাশ করলেন না, ভেতরে মনে হল, কোনো একটা সন্দেহ আছে।”

চন্দন আর তারাপদ পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল।

কিকিরা তাঁর মচকানো পায়ের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়ালেন। দেখলেন নিজে। দেখালেন চন্দনকে, “হাঁটতে পারি। ব্যথা কম। বেশি হাঁটাচলা করলে ব্যথা বাড়ে।”

“আপনি তা হলে বেশি হাঁটাচলা করছেন?”

হাসলেন কিকিরা, ছেলেমানুষ যেমন করে মিথ্যে গল্প সাজায়, অবিকল সেইভাবে বললেন, “না, কোথায়? রিকশায়-রিকশায় ঘুরি। আজকাল আবার অটো বেরিয়েছে।” বলে অন্য কথায় চলে গেলেন। “কাল আমি তুলসীবাবুর কাছে যাব। পটুয়াটোলা লেন। উনি ম্যানেজার ছিলেন দত্ত কোম্পানির ছাপাখানার। তুলসীবাবুই একমাত্র লোক যিনি জাল মোহনকে সামনাসামনি দেখেছেন। দেখি তিনি কী বলেন?”

“আরও তো আছে।”

“হ্যাঁ, ভবানী আর সেই উকিল মিহিরবাবু, থিয়েটার পাগলা।”

“সবই কি একদিনে সারবেন?”

“তা বোধ হয় হবে না। দেখি! একটা কথা আমায় বড় ভাবাচ্ছে হে! তোমরা নিশ্চয় লক্ষ করেছ, যে দু’জন লোক লোচনদের সঙ্গে ছিল তখন-মানে ঘটনার সময়, তাদের কেউ আর কলকাতায় নেই। একজন চলে গিয়েছে চা বাগানে, অন্যজন কোথায় কেউ জানে না। তার চেয়েও যা আশ্চর্যের ব্যাপার, লোচনের মেজো শ্যালক আগে কলকাতাতেই থাকত। ঘটনার পর সে চা বাগানে চলে গিয়েছে চাকরি নিয়ে। সতীশবাবুই আমাকে বললেন। মোহনের বন্ধু সম্পর্কে অবশ্য তিনি কিছু জানেন না। আমি ভাবছি, এই দুটো লোককে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, না, তারা নিজেরাই সরে গেছে। লাখ টাকার প্রশ্ন হে! জবাবটা কে দেবে?”

.

০৫.

পরের দিন কিকিরা এলেন তুলসীবাবুর বাড়ি। সঙ্গে তারাপদ। বিকেল শেষ করেই এসেছেন।

পটুয়াটোলা গলির যে বাড়িতে তুলসীবাবু থাকেন–তার চেহারা দেখলে মনে হয়, বাড়িটা এই বুঝি ভেঙে পড়বে। ওই বাড়িতেই তিন-চার ঘর ভাড়াটে। তুলসীবাবু থাকেন দোতলার একপাশে।

তুলসীবাবু যে-ঘরে থাকেন সেই ঘরেই কিকিরাদের বসতে হল। একটা খাট, টেবিল, চেয়ার আর বেতের মোড়া। কাঠের এক আলমারি একপাশে। ঘর ছোট, জানলা মাঝারি। দরজা-জানলার পাল্লায় রং বলে কিছু নেই আর। দেওয়ালে চুনের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় না।

তুলসীবাবু কলঘরে গিয়েছিলেন, ফিরে এলেন।

মানুষটির যত না বয়েস হয়েছে তার চেয়েও বুড়োটে দেখায়। রোগা চেহারা, মাথার চুল সাদা, চোখে গোল-গোল চশমা। পরনে ধুতি আর গায়ে ফতুয়া।

পাখা চলছিল, আলোও জ্বালা ছিল।

কিকিরারা উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার জানালেন।

তুলসীবাবু ভাল দেখতে পান না। ছানিকাটানো চোখটা প্রায় অন্ধ। ঠাওর করে দেখতে-দেখতে বললেন, “কে আপনারা?”

কিকিরা নিজেদের পরিচয় দিলেন। বললেন, লোচনবাবুর মুখ থেকে ওঁর কথা শুনে তাঁরা আসছেন।

তুলসীবাবু সরল মানুষ, ঘোর-পাঁচ বড় বোঝেন না। বললেন, “বড়দা পাঠিয়েছে?”

কিকিরা বললেন, “না, তিনি পাঠাননি। তাঁর মুখে আপনার কথা শুনে আসছি।”

“ও! তা আমি কী করতে পারি?”

“আপনি খবরের কাগজ দেখেন?”

“দেখি। পড়তে কষ্ট হয়। আতস কাঁচ চোখে লাগিয়ে পড়ি খানিকটা।”

কিকিরা কাগজের নাম বললেন। পকেটে ছিল একটা পুরনো কাগজ। বললেন, “লোচনবাবু কাগজে একটা নোটিস ছেপেছেন। জানেন আপনি? না, পড়ব! কাগজ সঙ্গে করে এনেছি।”

তুলসীবাবু মাথা নাড়লেন। “আমি দেখেছি। প্রাণকেষ্টও আমাকে বলেছে। “

“প্রাণকেষ্ট কে?”

“ছাপাখানায় কাজ করে। পিয়ন। সে কাছাকাছি থাকে। প্রায়ই আসে আমার কাছে। সে বলছিল।”

“তা হলে তো আপনি সবই জানেন।”

“ওটা জানি।”

“লোচনবাবু বলছিলেন, মোহন নাম নিয়ে একজন আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল।

মাথা নাড়লেন তুলসীবাবু, “এসেছিল। আমি তো একটা চিঠি লিখে প্রাণকেষ্টর হাত দিয়ে বড়দাকে পাঠিয়ে দিয়েছি।”

“যে এসেছিল সে কি মোহন?”

তুলসীবাবু খাটের ওপর বসেছেন ততক্ষণে। ভদ্রলোকে অভ্যেস হল হাঁটু মুড়ে আসন করে বসা। সেইভাবেই বসেছেন। হাতে গামছা। ছোট। বোধ হয় ভিজে। পায়ের চেটো মোছাও তাঁর অভ্যাস। পা মুছতে মুছতে বললেন, “চোখে ভাল দেখি না। ঘরের বাতিটাও জোরালো নয়। যে-ছেলেটি এসেছিল তাকে দেখে ছোড়দা বলেই মনে হচ্ছিল। বুঝতে অসুবিধেই হয়। গালে দাড়ি রেখেছে। চোখে চশমা। ক’ বছর পরে আচমকা দেখা। ছোঁড়া নেই জানি, হঠাৎ তাকে দেখবই বা কেমন করে? ভূত বলে চমকে উঠতে হয়। যথার্থ কথা বলতে কী–আমি এমনই হকচকিয়ে গিগেছিলাম যে, ভাল করে কিছু বুঝিনি।”

তারাপদ কিকিরার মুখের দিকে তাকাল। তারপর চোখ ফিরিয়ে তুলসীবাবুর দিকে। “আপনার ভাইঝিও তো দেখেছেন।” তারাপদ বলল।

“মায়া! হ্যাঁ, মায়াও দেখেছে।”

“উনি কী বললেন?”

“ও বলল, মোহন।”

“উনি চিনলেন?”

 তুলসীবাবু বললেন, “এসেছিল আমার কাছে, আসা-যাওয়ার পথে মায়ার সঙ্গে দেখা। দেখেছে ঠিকই। তবে ভুল না ঠিক–আমি তো বলতে পারব না।”

তারাপদ ঘরের বাতিটা দেখছিল, সত্যিই বড় টিমটিমে, ষাট পাওয়ারের বা হবে বড়জোর। তার ওপর পুরনো। হলুদহলুদ দেখায়। বাইরের একফালি বারান্দায় যা আলো তা আরও কম। তুলসীবাবুর ভাইঝি ঠিক দেখেছে কি না কে জানে!

কিকিরা তুলসীবাবুকে দেখছিলেন। বললেন, “আপনার কি মনে হল, এখানে যে-লোকটি এসেছিল–সে মোহন হলেও হতে পারে?”

তুলসীবাবু যেন কিছু ভাবছিলেন; বললেন, “দেখুন, মরা মানুষ আর তো ফিরে আসে না। ছোড়দা ফিরে আসবে কে ভাবতে পারে! তবু ওরই মধ্যে যে-সময়টুকু ও ছিল–আমার মনে হচ্ছিল ছোড়দা হলেও হতে পারে।”

“কেন মনে হচ্ছিল?”

“কথা শুনে। আমাকে ওরা “কাকা বলে ডাকে। ছোড়দা বরাবর কাকাবাবু। বলত, বড়দা “কাকা’ বা “তুলসীকাকা বলে। দেখলাম ও আমাকে কাকাবাবুই বলছে। গলার স্বর আমি ঠিক বুঝিনি। ছেলেটি বড় কাশছিল। তার ওপর বৃষ্টিতে ভিজে গলা বসে গিয়েছে।”

কিকিরা বললেন, “মাত্র এই, না আর কিছু আছে?”

“আছে।” তুলসীবাবু মাথা হেলিয়ে বললেন, “ছোড়দা থাকতে প্রেসে যারা কাজকর্ম করত তাদের সকলের নাম বলল ছেলেটি। কে কোথায় কাজ করত তাও বলল। ওদের কথা জিজ্ঞেস করল। “

“তারা সবাই এখনো আছে প্রেসে?”

না। একজন নিজেই চলে গিয়ে একটা ছোট ছাপাখানা খুলেছে। আর-একজন মারা গেছে।”

“অন্য কথা কী বলল!”

“রং-এর কাজের জন্যে একটা সেকেণ্ডহ্যান্ড মেশিন কেনা হয়েছিল। ছোড়দা মারা যাওয়ার আগে সেটা চালু করা যাচ্ছিল না। সেই মেশিনের কথা জিজ্ঞেস করল। “

“সবই ছাপাখানার কথা?”

“বাড়ির কথাও বলছিল।”

“কী কথা?”

“ছোড়দার শখ ছিল পাখি পোর। বাড়িতে মস্ত খাঁচা ছিল দুটো। পাখি রাখত। তা ছাড়া, ওর ঘর–যে-ঘরে ও থাকত–তার কথাও বলল।”

তারাপদ হঠাৎ বলল, “ও কি এ-ঘরে বসেনি?”

“না। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল।”

“আপনি বসতে বলেননি?”

“না বোধ হয়। আমি তখন নিজের হুঁশে ছিলাম না। কী দেখছি, কী শুনছি ভাল করে বুঝতেই পারছিলাম না। বিশ্বাসও হচ্ছিল না।”

তুলসীবাবু যে রীতিমতন বিভ্রমে পড়েছিলেন, তাঁর কথা থেকে বোঝাই যাচ্ছিল।

কিকিরা বললেন, “মোহনের এমন কোনো চিহ্ন ছিল শরীরে, ধরুন মুখে, কপালে, গলায় বা অন্য কোথাও, যা চোখে দেখা যায়? আপনি কি সেরকম কিছু দেখেছিলেন?”

তুলসীবাবু মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, “তখন এসব কথা মনে হয়নি। তবে মনে হচ্ছে, কপালের ডান পাশে বড় আঁচিলটা চোখে পড়েছিল। সঠিক করে কিছু বলতে পারব না মশাই।”

গামছাটা খাটের মাথায় রেখে দিলেন তুলসীবাবু। চোখের চশমার কাঁচ মুছলেন। ছানিকাটা চোখটার জন্য চশমার যে কাঁচ রয়েছে–সেটা যেমন মোটা তেমনই ঘোলাটে রঙের। চশমা চোখে দিলেন উনি।

কিকিরা বললেন, “আপনি দত্তদের প্রেসে কতদিন কাজ করেছেন?”

আঙুল দিয়ে মাথার সাদা চুল গুছিয়ে নিতে-নিতে তুলসীবাবু বললেন, “আটত্রিশ বছর’।”

“আটত্রিশ…।”

“যখন ঢুকছিলাম তখন ছেলে-ছোকরা ছিলাম। যখন চলে এলাম তখন বুড়ো। আমি ছাপাখানায় ঢুকেছিলাম বিল-কেরানি হয়ে। হিসাবপত্র লিখতাম খাতায়, বিল তৈরি করতাম, আদায় দেখতাম। ওইভাবেই ধীরে-ধীরে ছাপখানায় কাজকর্মের অনেক কিছু শিখলাম। বড়বাবু বেঁচে থাকতেই আমি ছোট ম্যানেজার। তখন বড় ম্যানেজার ছিলেন শচীনবাবু।”

“বড়বাবু মানে রামকৃষ্ণ দত্ত?”

“হ্যাঁ। বড় ভাই রামকৃষ্ণ, ছোট ভাই শ্যামকৃষ্ণ।”

“রামকৃষ্ণ কেমন মানুষ ছিলেন?”

“খুব ভাল মানুষ। সদাশিব। শ্যামকৃষ্ণ ছিলেন কাজের মানুষ। তাঁর কথামতনই প্রেস চলত। কাজ বুঝতেন। বড়বাবুর ছিল নানা জায়গায় জানাশোনা। তাঁর খাতির ছিল। সেই খাতিরে আমরা বড় বড় কাজ ধরতাম। মোদ্দা কথাটা কি জানেন বাবু, ছাপাখানা শুরু করেন বড়বাবুর বাবা তখন যা ছিল, ছেলেদের হাতে পড়ে তার দশগুণ বেড়ে যায়।”

কিকিরা বললেন, “রামকৃষ্ণ যে মোহনকে পোষ্য নিয়েছিলেন এ-কথা নিশ্চয়ই জানেন?”

“সে আর জানব না!”

“ভাইয়ে-ভাইয়ে সদ্ভাব ছিল?”

“ভালই ছিল। …তবে কী জানেন, নদীর ওপর দেখে তল বোঝা যায় না।”

“লোচনবাবু আর মোহনবাবুর মধ্যে…?”

কিকিরা তাকিয়ে থাকলেন তুলসীবাবুর মুখের দিকে। লক্ষ করছিলেন।

তুলসীবাবু বললেন, “এঁদের মধ্যেও ভাব ছিল। অন্তত বাইরের কথা বলতে পারি। ভেতরের কথা কেমন করে বলব? …দুজনে দু ধাতের। বড়দা ব্যবসা বুঝতেন, ছোড়দা ছিল খামখেয়ালি।”

কিকিরা বুঝতে পারলেন, তুলসীবাবু ভেতরের কথা গোপন করতে চাইছেন। এসময় ওঁকে ঘাঁটিয়ে লাভ নেই।

কিকিরা বললেন, “মোহনকে আপনি পছন্দ করতেন না?”

“সে কি! মালিক বলে কথা। ছোটবাবু খানিকটা ছেলেমানুষ ছিলেন। তবে ভালমানুষ।”

কিকিরা আবার কথা ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তা আপনি কী মনে করেন? মোহন নামে যে-লোকটি এসেছিল সে জাল জোচ্চোর? কোনো মতলব নিয়ে এসেছিল?”

তুলসীবাবু সঙ্গে-সঙ্গে কথার জবাব দিলেন না, পরে মাথা নেড়ে-নেড়ে বললেন, “মরা মানুষ কেমন করে ফিরে আসে?”

“তা হলে এই লোকটা জাল?”

তুলসীবাবু কিছুই বললেন না।

কিকিরাই আবার বললেন, “আপনার কি মনে হয় কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে লোকটা এসেছিল? কিছু বলল সে?”

“না। সে আমায় একটা কথাই বারবার বলেছে। সে মোহন।”

 কিকিরা কথা ঘোরালেন। বললেন, “আচ্ছা তুলসীবাবু, একটা কথা। মোহনের বয়েস হয়েছিল। সে যদি বছর পাঁচেক আগে মারা গিয়ে থাকে, তার বয়েস তখন তিরিশ ছাড়িয়ে গিয়েছে। দত্ত-পরিবারে এতদিন পর্যন্ত কোনো ছেলে কি আইবুড়ো থাকে? মোহনের বিয়ে হয়নি কেন?”

তুলসীবাবু বললেন, “কথাবার্তা হচ্ছিল। বড়দার ঠিক পছন্দ মতন মেয়ে জুটছিল না।”

কিকিরা এবার একটু হাসলেন। ইশারা করলেন তারাপদকে। উঠতে বললেন। নিজেও উঠে পড়েছিলেন। বললেন, “দত্তদের ছাপাখানার আয় কেমন?”

তুলসীবাবু বলব কি বলব-না করে বললেন, “কাজ ভালই হয়। হালে বছর কয়েক খানিকটা মন্দা যাচ্ছে। আজকাল সব পালটে যাচ্ছে মশাই। ছাপাখানাও ভাল-ভাল হচ্ছে। তা যাই হোক, পুরনোর খানিকটা কদর তো থাকেই। আমার মনে হয়, বছরে লাখখানেক টাকার বেশি বই কম আয় ছিল না। ছাপাখানা থেকে।”

“আয় তবে মন্দ কী!..আচ্ছা, ছাপাখানার ওপর-ওপর ভ্যালুয়েশন কত হবে?”

তুলসীবাবু মাথা নাড়লেন। “আমি বলতে পারব না।”

“মোহনের অবর্তমানে সমস্ত সম্পত্তির মালিক তো লোচনবাবুরা?”

মাথা নোয়ালেন তুলসীবাবু। “হ্যাঁ।”

“মোহন না থাকলে ষোলোআনা লাভটা তবে লোচনবাবুর?”

 তুলসীবাবু কিছু বললেন না।

কিকিরাও আর দাঁড়ালেন না ঘরে। তারাপদকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন।

.

০৬.

কয়েকটা দিন কিকিরা যে কোথায়-কোথায় ঘুরে বেড়ালেন তিনিই জানেন। সকাল-বিকেল দু’বেলাতেই তাঁর টহল চলছিল।

সেদিন তারাপদ আর চন্দন এল বিকেলের দিকে, এসে দেখল, কিকিরা নিজের মনে পেশেন্স খেলছেন। আসলে অভ্যাসবশে খেলছেন, মনে-মনে কিন্তু ভাবছেন কিছু। এটা তাঁর অভ্যাস। ওদের দেখে তাস গুটিয়ে নিলেন কিকিরা।

চন্দন বলল, “কী ব্যাপার, আপনি ঘরে বসে আছেন? রাউন্ডে যাননি? মানে রোদে?”

ঠাট্টা করেই কথাটা বলেছিল চন্দন। তারাপদর মুখে সে শুনেছে, কিকিরা যেন জাল মোহন ধরার জন্য খেপে গিয়েছেন। হরদম ঘুরে বেড়াচ্ছেন বাইরে। তারাপদ দুদিন এসে, দেখা পায়নি তাঁর, অপেক্ষা করে করে ফিরে গিয়েছে।

কিকিরা বললেন, “না, আজ বেরোইনি; ঘাড়ে রদ্দা খেয়েছি। ব্যথা।”

 চন্দন বলল, “মানে? লোচন দত্তর পালোয়ান আপনাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে।”

“না না,” কিকিরা বললেন, “লোচন কেন হবে, এক বেটা ভূত। ট্রাম থেকে নেমেছি, কোত্থেকে একটা ভূত ছুটতে ছুটতে এসে ঘাড়ে পড়ল। তারপর হতভাগা লাফ মেরে চলন্ত ট্রামে উঠে পড়ে চলে গেল।”

“সে কী? আপনি তো ট্রামের চাকার তলায় চলে যেতেন স্যার?”

“নাইন্টি পার্সেন্ট চান্স ছিল। কিন্তু লেগ ব্রেক দিলাম…।”

“লেগ ব্রেক”, চন্দন অবাক-অবাক মুখ করে বলল, “ওটা তো ক্রিকেটের ব্যাপার। আপনি কি ক্রিকেটও খেলেছেন? বোলার ছিলেন?”

মাথা নাড়তে কষ্ট হল কিকিরার, তবু সামান্য মাথা নেড়ে বললেন, “নো সান্ডাল উড, নো। সাহেবদের ওই রাবিশ খেলা আমি কখনো খেলিনি। ওর চেয়ে আমাদের গুপো ডাংগুলি অনেক ভাল। …আমি আমার পায়ের কথা বলছিলাম। লেগটায় ব্রেক মেরে নিজেকে সামলে নিলাম। হাতে লাঠিও ছিল। “

চন্দন হাসতে-হাসতে বলল, “মাঝে-মাঝে আপনার লেগের ব্রেক ফেল করে যায়, এই যা দুঃখ! খানাখন্দে গিয়ে পড়েন।”

কিকিরা বললেন, “ভগবানের রাজ্যে সবই মাঝে-মাঝে ফেল করে হে। লেগও করে হার্টও করে।”

তারাপদ জোরে হেসে উঠল। চন্দনও হেসে ফেলল।

হাসি-তামাশা শেষ হলে তারাপদ বলল, “স্যার, আপনার কথামতন আমি লোচনবাবুর বন্ধু ভবানীর খোঁজ লাগিয়েছিলাম। ক্রিক রোয়ে আমাদের অফিসের বিশ্বাসদা থাকেন। সিনিয়ার লোক। উনি বললেন, ভবানী একটা জুয়াড়ি। চারদিকে দেনা করে বেড়ায়। ওর কথার কোনো দাম নেই। লোচনকেও চেনেন বিশ্বাসদা। দুই বন্ধুতে খুব ভাব। ভবানী বোধ হয় টাকা ধার নেয় লোচনের কাছ থেকে।”

কিকিরা বললেন, “লোচনের পার্টি বলছ! তা হতে পারে।”

“মোহন নামের ভেজাল লোকটা ভবানীকে কেন ধরল বলুন তো?”

“বোধ হয় বন্ধুকে দিয়ে বলালে লোচন আরও তটস্থ হবে–এই জন্যে। আর কী হতে পারে।”

চন্দন বলল, “আপনি কোথায়-কোথায় ঘুরছিলেন? পেলেন কিছু?”

কিকিরা যে এর মধ্যে লোচনের কাছে বার দুই গিয়েছেন–ওরা জানত। দত্তদের প্রেসেও কিকিরা উঁকিঝুঁকি মেরেছেন। মোহনের ফোটোও পেয়েছেন লোচনের কাছ থেকে। এই খবরগুলো তারাপদর জানা ছিল। তারাপদর মুখ। থেকে চন্দনও শুনেছে।

কিকিরা বললেন, “দুটো কাজ করেছি। একটাও অবশ্য পুরোপুরি সারা হয়নি, তবু হয়েছে খানিকটা।”

“যেমন?”

“উকিল এবং নাটক-পাগলা মিহিরবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। কথাও হয়েছে অল্পস্বল্প। আগামীকাল আমায় যেতে বলেছেন বাড়িতে। …কাল ওঁর ক্লাবের ছুটি। কোনো কাজ নেই।”

“দ্বিতীয়টা কী?”

“মোহনের সেই বন্ধুর খবর জোগাড় করেছি।”

তারাপদ বলল, “খবর পেয়েছেন?”

“হ্যাঁ। ওর নাম অমলেন্দু। অমলেন্দু গুপ্ত। ডাকনাম–সিতু। লোচন পুরো নামটা বলতে পারেনি। বা চায়নি। বারবার বলেছে, মোহনের ওই বন্ধুটি নতুন। সে ভাল করে চেনে না। সেবারই প্রথম তাদের সঙ্গে গিয়েছিল।”

“আপনি খবর জোগাড় করলেন কেমন করে?”

“ঘুরে-ঘুরে। মোহনের অন্য বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করে। অমলেন্দুর বাড়ির ঠিকানা ছিল দমদম চিড়িয়ামোড়। সেখানে সে একাই একটা ঘর ভাড়া করে থাকত। তার মা ছিল বর্ধমানের মানকরে। অমলেন্দু পেশায় ছিল ফোটোগ্রাফার। চাকরিবাকরি করত না। একটা দোকানে মাঝে-মাঝে বসত, আর নিজের ভোলা ছবি বিক্রি করত কাগজে, ম্যাগাজিনে। একা মানুষ, চলে যেত।”

চন্দন বলল, “তা সে দিল্লি চলে গেল কেন?”

“চাকরি পেয়েছিল। একটা ম্যাগাজিনে। ইংরিজি ম্যাগাজিন।”

“এখনো দিল্লিতে?”

কিকিরা মাথা নাড়লেন সাবধানে। “না, দিল্লিতে নেই।”

“কোথায় সে?”

“দিল্লির ঠিকানা যে বন্ধু জানত, সে বলল–মাস কয়েক আগেও অমলেন্দু দিল্লিতে ছিল। চিঠি পেয়েছে তার। তারপর চিঠিপত্র আর পায়নি। খবর নিয়ে জেনেছে দিল্লিতে সে নেই।”

বগলা চা নিয়ে এল।

তারাপদদের চায়ের কাপ এগিয়ে দিল। বলল, পরে খাবার আনছে।

কিকিরা বললেন, “মোহনের খুবই বন্ধু ছিল অমলেন্দু। সকলেই বলল। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, লোচন দত্ত এই ছোকরার কথা অনেক কিছু চেপে গেল কেন? অমলেন্দুর কথা সে ভালো করেই জানত। জানে। অথচ এমন ভাব করল লোচন, যেন সে ভাল করে চেনেই না অমলেন্দুকে।”

চন্দন বলল, “অমলেন্দু যে দিল্লি চলে গেল–এটা কি সত্যি-সত্যি চাকরি পেয়ে? না, সে সরে গেল?”

“মানে? কী বলতে চাইছ?”

“বলছি, লোচন কি তাকে সরাবার ব্যবস্থা করল? ..যদি করে থাকে, কেন করল?”

কিকিরা বললেন, “সেটাই তো কথা হে! মোহন মারা যাওয়ার পর একজন গেল চা বাগানে, আর-একজন দিল্লিতে। এই দুজনেই বড় সাক্ষী। লোচন না হয় নিজের শ্যালকটিকে সরাল, অমলেন্দুকে সরাল কেমন করে?”।

তারাপদ বলল, “স্যার, লোচন এ-সব করবে কেন? করতে পারে, যদি সে দোষী হয়!”

“তা তো ঠিকই।”

“আপনি তবে বলছেন লোচন দোষী?”

কিকিরা বললেন, “মুখে বললে তো হবে না, প্রমাণ চাই। আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি, লোচনের মেজো শ্যালক কাজকর্ম তেমন কিছু করত না। লোচন তাকে নিজেদের বাড়ির কাজকর্মে খাটাত। তা শ্যালককে না হয় সে সরিয়ে দিল চা বাগানে। দিতেই পারে। শ্যালক তো তার ভগিনীপতির স্বার্থ দেখবে। কিন্তু অমলেন্দু? এটা আমি বুঝতে পারছি না। সে নিজেই চলে গেল কাজ পেয়ে? না, লোচন তাকে টাকাপয়সা দিয়ে বশ করল?”

চন্দন বলল, “তা আপনার পুরো হিসাবটাই হল, আপনি লোচনকে কালপ্রিট ভাবছেন?”

“হ্যাঁ।”

“যদি সে দোষী না হয়?”

“বলতে পারছি না। লোচনকে আমি সন্দেহ করছি। সে অনেক মিথ্যে কথা বলেছে। বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যানটা লোচনই করেছিল।”

“কে বলল?”

“লোচন নিজেই বলেছে। প্রথমে সে অন্য কথা বলছিল। কথায়-কথায় স্বীকার করে ফেলল, বেড়াতে যাওয়ার কথাটা তার মাথাতেই এসেছিল।”

“জায়গাটাও কি সে বেছে নিয়েছিল?”

“না বোধ হয়। তবে, যেখানেই যাক, তার একটা মতলব থাকতে পারে। সে শুধু সুযোগ খুঁজছিল। কোনোরকমে একটা সুযোগ পেলে সেটা কাজে লাগাবার চেষ্টা করবে।”

“আপনি স্যার, লোচনকে বড় বেশি সন্দেহ করছেন।”

কিকিরা মাথা হেলালেন। বললেন, “করছি, কারণ–মোহন মারা গেলে একমাত্র লোচনেরই লাভ। পুরো বিষয়-সম্পত্তি, ছাপাখানার মালিকানা তার। স্বার্থ তার। সন্দেহ তাকে ছাড়া অন্য কাকে করব?”।

চন্দন বলল, “কিন্তু যদি এমন হয়–এটা সত্যিই দুর্ঘটনা, মোহন অসাবধানে ছিল, পা হড়কে পড়ে গিয়েছে! নিত্যদিন কত অ্যাকসিডেন্ট হচ্ছে, আমরা তার কিছু খোঁজ তো রাখি। সাধারণ ব্যাপার, তবু অ্যাকসিডেন্ট হয়ে গেল।” বলে চন্দন একটু থামল, চা খেল দু চুমুক, তারপর হঠাৎ বলল, “এই যে আপনি ট্রামের চাকার তলায় চলে যাচ্ছিলেন, বরাতজোরে বেঁচে গেলেন, যদি বরাত একটু মন্দ হত–কী অবস্থা দাঁড়াত, স্যার?”

কিকিরা একটু হাসলেন। পকেটে হাত ডুবিয়ে বললেন, “আমার বাড়িতে কে বা কেউ একটা ফ্লাইং লেটার ফেলে গিয়েছে।”

“ফ্লাইং লেটার…!” তারাপদ যেন আকাশ থেকে পড়ল।

“উড়ো চিঠি।” বলতে বলতে পকেট থেকে একটা খাম বের করে এগিয়ে দিলেন তারাপদর দিকে।

তারাপদ হাত বাড়িয়ে খামটা নিল। সাদা খাম। মুখ ছেঁড়া। খামের ওপর কোনো নাম লেখা নেই। খামের মধ্যে একটুকরো কাগজ। তারাপদ কাগজটা বের করল। পড়ল।

“জোরে-জোরে পড়ো।”

তারপদ পড়ল “দাদু, আর নয়। নিজের চরকায় তেল দিন। বাড়াবাড়ি করলে বিপদে পড়বেন। পড়া শেষ করে সে অবাক হয়ে বলল, “এ কী! এ-চিঠি কেমন করে এল? কে দিয়ে গেল?” বলতে বলতে চিঠিটা চন্দনের দিকে এগিয়ে দিল।

কিকিরা বললেন, “আমার ফ্ল্যাটের সদর দরজার ফাঁক দিয়ে গলিয়ে দিয়ে গিয়েছে।”

“কে, কবে?”

“কে, তা জানি না। চিঠিটা গতকাল পাওয়া গেছে।”

চন্দন রলল, “এ তো মনে হচ্ছে পাড়ার মস্তান টাইপের ছেলের কাজ। দাদু–আপনাকে দাদু বলেছে।”

কিকিরা মাথার সাদা চুল ঘাঁটতে-ঘাঁটতে বললেন, “আদর করে বলেছে হে! একমাথা সাদা চুল। তা বলুক। কথাটা হল, আমি কার চরকায় তেল দিচ্ছি–এ-কথা সে জানে কেমন করে? লোচন ছাড়া অন্য যারা জানে তাদের মধ্যে রয়েছেন, অনিলবাবু, সতীশবাবু, প্রফুল্ল-ডাক্তার, তুলসীবাবু। ভবানীকে দেখিনি। আর মিহিরবাবুর সঙ্গে আমার এখনো সাক্ষাৎ-পরিচয় হয়নি।”

তারাপদ বলল, “আপনার ঠিকানা এরা সবাই জানে?”

“লোচন জানে। আর কাউকে তো ঠিকানা বলিনি।”

“এ কি তবে লোচনের কাজ? সে কোনো ভাড়াটে লোক লাগিয়েছে!” তারাপদ ধাঁধায় পড়ে গেল। তাকাল চন্দনের দিকে। বলল, “ব্যাপারটা বড় অদ্ভুত তো! লোচন নিজেই খবরের কাগজে নোটিস ছাপছে, জাল মোহনকে ধরে দিলে তিরিশ হাজার টাকা পুরস্কার দেবে বলছে, আবার সেই লোকই। কিকিরাকে ওয়ার্নিং দিচ্ছে। ব্যাপারটা কী! আমি তো কিছুই বুঝছি না।”

চন্দনও বুঝতে পারছিল না। বলল, “যে-লোকটা ট্রাম লাইনের কাছে আপনাকে ধাক্কা মেরেছিল–সে কি এইসবের মধ্যে আছে, কিকিরা?

কিকিরা বললেন, “বলতে পারছি না। লোকটাকে আমি দেখেছি। বাঙালি। তবে উটকো ধরনের। চেহারা দেখে গুণ্ডা বদমাশ মনে হয় না। আহাম্মক মনে হয়।”

“ও বাঙালি, আপনি কেমন করে বুঝলেন?”

“ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছিল। আমি সামলে নেওয়ার পর ও নিজেও সামলে নিল নিজেকে। তারপর “সরি’ বলে ছুটে গিয়ে ট্রামে উঠে পড়ল। “

“সরি কি বাংলা শব্দ, স্যার?”

“আজকাল সবাই সরি বলে। বাজারের মাছঅলারাও। ওর “ছরি’ বলা শুনে বাঙালি মনে হল।”

তারাপদ বলল, “ছেড়ে দিন বাঙালি-অবাঙালি! আদত কথাটা কী তাই বলুন? কী মনে হয় আপনার? এই উড়ো চিঠির মানে কী? লোচন কি আপনাকে নিয়ে খেলা করছে?”

কিকিরা কিছু বললেন না।

চন্দন বলল, “স্যার, আমার পরামর্শ হল–আপনি আর একলা-একলা খোঁড়া পা নিয়ে ঘোরাফেরা করবেন না। সঙ্গে আমাদের রাখবেন। তারাকে সঙ্গে না নিয়ে কোথাও যাবেন না। নেভার।”

কিকিরা বললেন, “কাল একবার মিহিরবাবুর কাছে যাব। তারাপদকে সঙ্গে নিয়েই।”

.

০৭.

মিহিরবাবু মানুষটিকে দেখলে খোলামেলাই মনে হয়। চেহারাটি ভালই, কিন্তু মাথায় সামান্য খাটো, একটু নধর গোছের। মাথার চুল পাকেনি। সামান্য টাক পড়তে শুরু হয়েছে। গোলগাল মুখ। চোখে চশমা। পান-জদা-সিগারেট–কোনোটাই বাদ যায় না। কথা বলেন অনর্গল। তবে তারই মধ্যে যা নজর করার করে নিতে পারেন। বাইরে বোঝা যায় না; ভেতরে তিনি কিন্তু বুদ্ধিমান এবং চতুর। গায়ে পাতলা একটা চাদর মতন থাকে। কাটা হাতটাকে ঢেকে রাখেন।

কিকিরা আর তারাপদকে তিনি খানিকটা বাজিয়ে নিলেন প্রথমে। কিকিরাও কম যান না। কথা বলার ভঙ্গিতে তিনি মিহিরবাবুকে হাসিয়ে ছাড়লেন। দু-একটা খুচরো ম্যাজিক দেখিয়ে দিলেন সামনে বসে। লাইটার উড়িয়ে দিলেন টেবিল থেকে, আবার যথাস্থানে রেখে দিলেন। মিহিরবাবুর লাইটারের শখ রয়েছে। দু-দুটো লাইটার সামনেই পড়ে ছিল। সিগারেটের প্যাকেটও।

মিহিরবাবু যে-ঘরে বসে ছিলেন, সেটি তাঁর নিজস্ব বৈঠকখানা। সাজানো-গোছানো। দেওয়ালে ‘ইভনিং ক্লাবে’র নাটকের ফোটো, একপাশে দুটো কাপ। শিশির ভাদুড়ীর বড় ছবি একটা। বইয়ের আলমারিতে ঠাসা বই আর বাঁধানো মাসিক পত্রিকা। আইনের বই একটাও নেই।

চা খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। মিহিরবাবু পান বিলি করলেন কিকিরাদের। নিজেও পান-জদা মুখে পুরে এবার কাজের কথা পাড়লেন। বললেন, “তা মশাই, আপনি তো ম্যাজিক-মাস্টার। হঠাৎ এই গোয়েন্দাগিরিতে নামলেন কেন?”

কিকিরা অমায়িক হাসি হেসে বললেন, “ইচ্ছে করে নামিনি, স্যার। এই যে আমার লেজুড়টিকে দেখছেন, এর পাল্লায় পড়ে হেভেন থেকে ফল করতে হয়েছে।”

“ফল?”

“আজ্ঞে, ফ্রম ম্যাজিক টু গোয়েন্দা। জাদুবিদ্যা থেকে পাতি গোয়েন্দাগিরিতে পড়ে যেতে হল।”

মিহিরবাবু হেসে উঠলেন। “আচ্ছা। ফল ফ্রম ম্যাজিক। ..তা আমাদের ক্লাবের যে শো হচ্ছে–পুজোর পর। কালীপুজোতে। তাতে একটু খেলা দেখান না। ক্লাসিকাল ম্যাজিক। ধরুন ঘন্টাখানেক। বেশ জমে যাবে।”

কিকিরা বিনয়ের সঙ্গে বললেন, “আমি আর খেলা দেখাই না। বাঁ হাতটা কমজোরি হয়ে গেছে। সুইফটনেস নেই। অন্য কাউকে ব্যবস্থা করে দেব, আপনি ভাববেন না।“

নিজেদের ক্লাবের খানিকটা গুণগান গেয়ে মিহিরবাবু বললেন, “আসবেন একদিন ক্লাবে। সোমবার বাদে। কাছেই আমাদের ইভনিং ক্লাব, ওয়েলিংটন স্কোয়ারের গায়েই।”

মিহিরবাবু এবার আসল কথা পাড়লেন। বললেন, “কাজের কথা শুরু করা যাক কিঙ্করবাবু। বলুন, আমি কী করতে পারি?”

কিকিরা হেসে বললেন, “স্যার, আমায় বাবুটাবু বলবেন না। স্রেফ কিকিরা।”

“অতি উত্তম। তাই হবে।”

“আপনার কাছে আমি কেন এসেছি, আগেই আপনাকে জানিয়েছি। লোচনবাবুর নোটিস, তিরিশ হাজার টাকা পুরস্কার–সবই বলেছি…।”

“হ্যাঁ, কাগজে আমি দেখেছি।”

“নোটিসের বয়ানটা কি আপনি করে দিয়েছিলেন?”

“না। মনে হয় অন্য কাউকে দিয়ে করিয়েছে, নিজেও করতে পারে।”

“লোচনবাবু আপনার কাছে এর মধ্যে ক’বার এসেছেন?”

মিহিরবাবু পান চিবোতে-চিবোতে বললেন, “নিজে একবারও নয়ন আমিই ওকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম, তখনই এসেছিল; তারপর আর নয়।

“মোহনের কথা বলতে ডেকে পাঠিয়েছিলে?”

“হ্যাঁ। চিঠি দেখালাম।”

তারাপদ চুপ করে বসে কথা শুনছিল। হঠাৎ বলল, “মোহনবাবু কেমন লোক?”

মিহিরবাবু পিঠ সামান্য সোজা করে বসলেন। বললেন, “খাসা ছেলে। চমৎকার। অতি চমৎকার। ভদ্র, বিনয়ী, হাসিখুশি। আমার ইভনিং ক্লাবের একজন ইম্পট্যান্ট মেম্বার। আমার এক চেলা। আমাদের রিলেশানটা ছিল বড় ভাই ছোট ভাইয়ের মতন; যদিও সম্পর্কে খুড়ো-ভাইপো। ও আমাদের অনেক কাজ করত। থিয়েটারের আগে স্টেজ ভাড়া, সেট সেটিংয়ের ব্যবস্থা, সুভেনির ছাপা–অনেক কাজ রে ভাই। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডী পাঠ।”

“নিজে কি অভিনয় করত?”

“না। একবার মাত্র করেছে,” বলে দেওয়ালের দিকে আঙুল দেখালেন। বললেন, “আমরা জুবিলি ইয়ারে একটা ড্রামা করেছিলাম। ডিটেকশান স্টোরি। গোয়েন্দা গল্পের নাটক। ইংরিজি নাটক থেকে গল্পটা নিয়েছিলাম। আমিই লিখেছিলাম নাটকটা। নাম ছিল “বিষের ধোঁয়া’। শরদিন্দু বাঁড়জ্যের একটা নভেল আছে ওই নামে। সেটা নয়। নামেই যা মিল। নাথিং এলস।…ইয়ে, কী বলছিলাম–সেই নাটকে মোহনকে দিয়ে জোর করে একটা পার্ট করিয়ে দিলাম। সামান্য পার্ট। যাও না ভাই, দেওয়ালে টাঙানো ছবিটা দেখো। গ্রুপ ফোটো।”

তারাপদ উঠে গেল ফোটো দেখতে। কিকিরার কাছে সে মোহনের ফোটো দেখেছে। সামান্য কৌতূহল হচ্ছিল অভিনেতা মোহনকে দেখতে।

কিকিরা কথা বলছিলেন মিহিরবাবুর সঙ্গে। বললেন, “ঘটনাটা সম্পর্কে আপনার কী মনে হয়?”

মিহিরবাবু চুপ করে থাকলেন প্রথমে একটা সিগারেট ধরিয়ে নিলেন। সামনের দিকে ঝুঁকে পড়লেন খানিকটা। পরে বললেন, “দেখুন কিকিরামশাই, দত্ত-ফ্যামিলি আমাদের প্রতিবেশী। তিন-চারপুরুষ ধরে একই পাড়ায় আছি। খানিকটা তো ওদের কথা জানি। একসময় দত্তরা বেশ ধনী ছিল। পরে অবস্থা খানিকটা পড়ে যায়। রামকৃষ্ণদা আর শ্যামকৃষ্ণদা ছাপাখানার ব্যবসাটাকে বাড়িয়ে আবার দাঁড়াবার চেষ্টা করেছিল। একেবারে যে আনসাকসেসফুল, হয়েছিল তাও নয়। পরে যে কী হয়েছিল আমি বলতে পারব না, তবে রামদা শ্যামদা মারা যাওয়ার পর থেকেই ব্যবসা পড়ে যাচ্ছিল। শুনেছি, লোচন বিস্তর দেনা করেছে। ছাপাখানার মেশিনপত্রও সে বেচে দিয়েছে দু-একটা। …ওদের ভেতরকার ব্যাপারে আমি মাথা গলাতে যাইনি। আমার এক পুরনো মক্কেলের কাছে জানতে পারলাম, লোচন বেনামে জমি কিনেছে বেহালায়, সেখানে নাকি একটা সিনেমা হাউসও করতে গিয়ে ফেঁসে গেছে।”

“লোচনবাবুর কি অনেক দেনা?”

“বলতে পারব না। খানিকটা দেনা তো আছেই।”

“সম্পত্তির ভাগীদার কি দুই ভাই?”

“হ্যাঁ। সমান-সমান।”

“মোহন তো পোষ্যপুত্র?”

“তা হোক। রামকৃষ্ণদা তাঁর স্বােপার্জিত সমস্ত কিছু মোহনকে দিয়ে গিয়েছেন।”

“আপনি জানেন?”

“জানি। …আরও জানি, লোচন তাদের পৈতৃক বাড়ির সামনের জমিটুকু বেচে দেওয়ার জন্যে হালাল লাগিয়েছে।”

“কবে থেকে?”

“হালে।”

 কিকিরা বললেন, “মোহনের মৃত্যু সম্পর্কে আপনার কী মনে হয়?”

মিহিরবাবু মাথা নাড়লেন। যেন বলতে চাইলেন, তিনি আর কী বলবেন?

 “মোহন মারা গিয়েছে?” কিকিরা বললেন।

“তাই শুনেছি।”

“আপনি কি নিশ্চিত?”

“অফিসিয়ালি মৃত বলতে পারেন।”

“তবে এই লোকটা কে? এই যে ফোন করছে, চিঠি লিখছে, তুলসীবাবুর সঙ্গে দেখা করছে, এ কে?”

মিহিরবাবু কিছু বললেন না।

তারাপদ ডাকল, “একবার এদিকে আসবেন, স্যার?”

কিকিরা উঠে গেলেন।

তারাপদ বলল, “বিষের ধোঁয়া’ নাটকের গ্রুপ ফোটো। মোহনকে চিনতে পারেন? আমি তো পারলাম না।”

কিকিরা দেখলেন। নাটক শেষ হওয়ার পর পাত্রপাত্রীরা যে-যেমন সাজ পরেছিল, মেক-আপ নিয়েছিল–সেই পোশাক আর বেশবাস নিয়েই ফোটোটা তোলা। কিকিরা খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখলেন। চিনতে পারছিলেন না। শেষ পর্যন্ত এক দাড়িওয়ালা বুড়োটে গোছের লোক দেখে তাঁর সন্দেহ হল। কাঁধে কাপড়ের মস্ত ঝোলা নিয়ে যারা পাড়ায় পাড়ায় পুরনো খবরের কাগজ কিনে বেড়ায়–অবিকল সেই বেশ। মাথায় গামছা বাঁধা। অর্ধেকটা কপাল ঢাকা পড়েছে গামছায়।

কিকিরা বললেন, “এই কাগজঅলা।” বলে মিহিরবাবুর দিকে তাকালেন ঘুরে গিয়ে। “এই কাগজঅলা মোহন? বেশ মেক-আপ নিয়েছে তো?

মিহিরবাবু হাসছিলেন। মাথা নাড়লেন। বললেন, “না।আপনি ভুল করলেন। ম্যাজিক চলল না মশাই। ওই ফোটোর মধ্যে একজনকে দেখুন-ক্লাউন সেজে দাঁড়িয়ে আছে। ও-ই মোহন। …ওকে দিয়ে সার্কাসের ক্লাউনের ছোট্ট পার্ট করিয়েছিলাম।”

কিকিরা আবার ছবি দেখলেন, বাঃ বললেন। “চেনা যায় না। ঠকে গেলাম।” বলে নিজের জায়গায় ফিরে এলেন। বসলেন। বললেন, “এই জাল মোহনের আবিভাব কেন স্যার বলতে পারেন?”

মিহিরবাবু হেসে বললেন, “গোয়েন্দা আপনি। আমি কী বলব?”

কিকিরা একদৃষ্টে মিহিরবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন, বোধ হয় লক্ষ করছিলেন কিছু। শেষে বললেন, “আমারও ধারণা মোহন মারা গিয়েছে। কিন্তু সে বোধ হয় পা পিছলে পড়ে যায়নি, তাকে পাহাড়ের বিশ্রী জায়গা থেকে ঝরনার মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছে। জলের স্রোতের সঙ্গে মোহন নিচে গড়িয়ে গিয়েছে।”

মিহিরবাবু কোনো কথা বললেন না। শুনলেন। তাঁর চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হল।

কিকিরা নিজেই বললেন, “এ কাজ লোচন ছাড়া অন্য কেউ করতে পারে না।

“কেন?”

“মোহন যখন পড়ে যায় তখন তার পাশে লোচন ছাড়া কেউ ছিল না। অন্য দু’জন–লোচনের মেজো শ্যালক আর মোহনের বন্ধু খানিকটা পেছনে ছিল। ঝোঁপঝাড় পাথরের আড়ালও থাকতে পারে। তারা কিছু দেখতে পায়নি।”

কিকিরার কথা শেষ হওয়ার আগেই মিহিরবাবু বললেন, “আপনার অনুমান ঠিক হতে পারে। তবে আইন অনুমানকে প্রমাণ হিসাবে গ্রাহ্য করে না। প্রমাণ কী যে, লোচন তার ছোট ভাইকে ঝরনার মধ্যে ঠেলে ফেলে দিয়েছে।”

কিকিরা স্বীকার করে নিলেন, প্রমাণ কিন্তু নেই।

মিহিরবাবু বললেন, “প্রমাণ ছাড়া কাউকে খুনি হিসাবে ধরা যায় না। প্রমাণটাই আসল। লোচন যে খুনি একথা আপনি প্রমাণ করবেন কেমন করে?” বলে একটু থেমে আবার বললেন, “নিজের সব কাজ লোচন পরিপাটি করে গুছিয়ে নিয়েছে। দেহাতি ডাক্তারের সার্টিফিকেট, আইডেনটিফিকেশন, থানা–সবই সে গুছিয়ে সেরে রেখেছে। এখন আপনি কেমন করে লোচনকে খুনি বলে সাবাস্ত করবেন?”

কিকিরা মাথার চুল ঘাঁটতে-ঘাঁটতে বললেন, “পারছি কোথায়? পারছি না স্যার। এই জিনিসটাও আমার খুব অবাক লাগছে। চার-পাঁচ বছর পরে হঠাৎ জাল মোহনের আবিভাবই কেন ঘটল। কে ঘটাল? লোচন এত ভয়ই বা পেয়ে গেল কেন যে, ত্রিশ হাজার টাকা ঘর থেকে বের করে দিতে রাজি হল?”

মিহিরবাবু বললেন, “লোচন ভেবেচিন্তে কাজ করে, বোকা নয়।”

“সেটা বোঝা যাচ্ছে। আসলে লোচন চাইছে এই জাল মোহনের রহস্যটা উদ্ধার করতে।

“মানে সে বুঝতে পেরেছে, এমন কেউ তার সঙ্গে শত্রুতা করছে, যে আসল ঘটনাটা জানে। এই লোকটাকে সে ধরতে চায়।”

“আসল ঘটনা জানতে পারে মাত্র দু’জন। লোচনের মেজো শ্যালক, আর মোহনের বন্ধু। তাদের কাউকেই তো পাওয়া যাচ্ছে না। এর মধ্যে লোচনের মেজো শ্যালক ভগ্নীপতির দলে বলে মনে হয়। আর মোহনের বন্ধুর তো কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না।”

“আপনি খোঁজ করেছেন?”

“অনেক। নামটা জানতে পেরেছি। তার দেশ গ্রামের কথাও জানতে পেরেছি। সে দিল্লিতে ছিল তাও ঠিক। তারপর আর কিছু পারিনি।”

মিহিরবাবুর সামনে জলের গ্লাস ছিল। গ্লাসের ঢাকা সরিয়ে জল খেলেন। বললেন পরে, “কী নাম তার?”

“অমলেন্দু..”

“তার কোনো ফোটো দেখেছেন?”

“না।”

“দেখতে চান?…ওই গ্রুপ ফোটোটার কাছেই যান, আবার বিষের ধোঁয়া। মাঝখানে একজনকে দেখবেন, শিকারির পোশাক পরা, হাতে বন্দুক। ভাল চেহারা। ওই হল অমল–অমলেন্দু। মোহনের বন্ধু।”

কিকিরা অবাক হয়ে বললেন, “মোহনের বন্ধুও নাটক করত?”

“করত কী মশাই! ভাল করত। গুড অ্যাক্টর। গলা ভাল, ভয়েস পালটাতে পারত অদ্ভুতভাবে। ওকে যে-কোনো মেক-আপে মানিয়ে যেত।:যান, গিয়ে দেখে আসুন ছবিটা।”

কিকিরা উঠলেন। তারাপদ তখনও ফিরে এসে বসেনি। ছবি দেখছে, ঘর দেখছিল।

দু’জনেই যখন দেওয়ালে টাঙানো বিষের ধোঁয়ার গ্রুপ ফোটো দেখছে, মিহিরবাবু আচমকা বললেন, “আপনারা ওই ফোটোর মানুষটাকে দেখে নিন। তারপর আসল মানুষটাকে যদি একদিন দেখতে পান, অবাক হবেন না।”

 কিকিরা আর তারাপদ ঘাড় ঘোরাল। দেখল, মিহিরবাবু চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালেন। মুখের সেই হাসি নেই, সহজ ভাবটাও দেখা যাচ্ছে না। কেমন যেন গম্ভীর, শক্ত মুখ।

.

০৮.

বাড়ি ফিরে চন্দনকে পাওয়া গেল। সে অপেক্ষা করছিল।

সামান্য রাত হয়েছে।

কিকিরা বললেন, “বোসো, একেবারে খেয়েদেয়ে বাড়ি ফিরো।”

 পোশাক পালটে হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসলেন কিকিরারা। চন্দন বলল, “কী সার? কতটা এগুলো?” চন্দনের বলার মধ্যে একটু ঠাট্টার ভাব ছিল।

কিকিরা প্রথমে জবাব দিলেন না। পরে বললেন, “অমলেন্দু!”

“কে অমলেন্দু? মোহনের বন্ধু?”

“হ্যাঁ। মোহনের বন্ধু।” বলে তারাপদর দিকে তাকালেন কিকিরা।

“তারাপদ, তুমি এতদিনে এমন একজনকে দেখলে–যিনি অনেক কিছুর খোঁজ রাখেন। মিহিরবাবুর কথা বলছি। পাকা লোক। উনি কিন্তু জানেন এই অমলেন্দু ছোকরা কোথায় আছে। ..তারাপদ, মিহিরবাবুর মতলবটা কী?”

তারাপদ মাথা নাড়ল। “বুঝতে পারছি না।”

 চুপচাপ। কথা বলল না কেউ কিছুক্ষণ। শেষে চন্দন বলল, “অমলেন্দু তা হলে এখন কলকাতায়?”

কিকিরা বললেন, “তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অমলেন্দু “শুধু কলকাতায় নেই, এই ঘটনাগুলো সেই ঘটাচ্ছে।”

“আপনি ফোনের কথা বলছেন?”

“হ্যাঁ, সে ফোন করছে। তুলসীবাবুর কাছে সে-ই গিয়েছিল। মিহিরবাবুর কথা থেকে বোঝা গেল, ও শুধু ভাল অভিনেতা নয়, ভাল মেক-আপ নিতে, গলার স্বর পালটাতেও পারে।”

তারাপদ হঠাৎ বলল, “আর-একটা জিনিস লক্ষ করেছেন? জাল মোহন ফোন করেছে চার জায়গায়, নিজে গিয়ে হাজির হয়েছে এক জায়গায়, আর চিঠি লিখেছে মাত্র এক জায়গায়–ওই মিহিরবাবুর কাছে। কেন? ফোনে গলা শোনা যায় চোখে দেখা যায় না। জাল মোহন এমনই একজনের কাছে সশরীরে দেখা দিয়েছিল, যে প্রায় অন্ধ। ছানিকাটানো চোখ। তাও দেখা দিয়েছিল সন্ধেবেলায়, টিমটিমে আলোর মধ্যে। আর চিঠি লিখেছে ওই মিহিরবাবুর কাছে। শুধুমাত্র তাঁকেই চিঠি লিখতে গেল কেন?”

 চন্দন খেতে-খেতে বলল, “তোরা চিঠি দেখতে চাসনি?”

“না। দেখতে চেয়ে লাভই বা কী হত? আমরা তো হ্যান্ড রাইটিং এক্সপার্ট নই। তা ছাড়া মোহনের আগের হাতের খেলাও চিনি না। সেই লেখা পাব কোথায়? তার চেয়ে লোচনের কথাই স্বীকার করে নেওয়া ভাল। লোচন বলেছে, দেখতে তো একইরকম। মিহিরবাবু ওকে চিঠি দেখিয়েছেন।”

চন্দন যেন ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করল। মিহিরবাবুর কাছে এই জাল মোহনের হাতের লেখা দেখে লোচন স্বীকার করে নিয়েছে লেখাটা মোহনের বলেই মনে হচ্ছে। আশ্চর্য কাণ্ড! এখানে তারাপদরা আর কী করতে পারে নতুন করে?

কিকিরা বললেন, “চাঁদু, এখন আমার মনে সন্দেহ হচ্ছে মিহিরবাবু এর মধ্যে আছেন। তিনি কোনো প্যাঁচ খেলছেন।”

“কেমন?”

“কেমন!..তুমি পুতুলনাচ দেখেছ! একটা লোক পরদার আড়াল থেকে লুকিয়ে পুতুল খেলা দেখায়? দেখেছ নিশ্চয়। মিহিরবাবু বোধ হয় সেই লোক। তিনিই নাচাচ্ছেন জাল মোহনকে।”

“মিহিরবাবুর স্বার্থ?”

 মাথা নাড়লেন কিকিরা। “বুঝতে পারছি না। লোচন আর মোহনের মধ্যে মিহিরবাবু কেন? তাঁর কিসের স্বার্থ? তিনি তো তৃতীয় ব্যক্তি।”

তারাপদ বলল, “মোহনকে উনি খুবই ভালবাসতেন।”

চন্দন বলল, “মিহিরবাবু মানুষটি কেমন? মানে আসল চেহারাটি কেমন?”

“খারাপ বলে তো মনে হল না,” কিকিরা বললেন খেতে-খেতে, “গুড ম্যান। নাটক-পাগল। কথাবার্তায় মাই ডিয়ার। মানুষটিকে ভালই লাগে। তা ছাড়া বড় ফ্যামিলির ছেলে। নিজেরাও বেশ সচ্ছল। পড়াশোনা করা মানুষ। ওঁর নিজের কোনো স্বার্থ থাকার কথা নয়।”

“তবে?”

“সেটাই বুঝতে পারছি না।”

 তারাপদ হঠাৎ বলল, “মোহনের হয়ে উনি লড়ছেন না তো?”

“মানে?”

“আমি বলছিলাম, মোহনের পক্ষ নিয়ে উনি লড়ছেন না তো?

চন্দন বলল, “উকিলরা বরাবরই তাদের মক্কেলের পক্ষ নিয়ে লড়ে। কিন্তু এখানে মক্কেল কই? সে তো মারা গিয়েছে। মরা মানুষের পক্ষ নিয়ে লড়া। তাতে লাভ। মোহনের হয়ে যদি কেউ মিহিরবাবুকে লড়াতে চায় অন্য কথা। তেমন কেউ নেই। মোহনের স্ত্রী নয়, নিজের কেউ নয়..”।

কিকিরা হঠাৎ বাধা দিয়ে বলে উঠলেন, “তারাপদ, তুমি একটা জিনিস লক্ষ করেছ। মিহিরবাবু বারবার বলছিলেন, যদি ধরে নেওয়া যায় লোচনই খুনি–তবে তা প্রমাণ করা যাবে কেমন করে?…ওঁর কথা থেকে মনে হচ্ছিল, লোচনকে উনি পুরোপুরি সন্দেহ করলেও এমন কোনো প্রমাণ দেখতে পাচ্ছেন না-যা দিয়ে বলা যায়, লোচন খুনি।” খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল কিকিরার। উঠে পড়লেন। বাইরে গেলেন হাত-মুখ ধুতে।

তারাপদ বলল, “চাঁদু, কেসটা কেমন জট পাকিয়ে যাচ্ছে। মিহিরবাবু জটটাকে আরও পাকিয়ে দিলেন।”

চন্দন বলল, “ওই অমলেন্দুকে ট্রেস করতে পারিস না? খোঁজ লাগা।”

“আমি পারব না। কোথায় খোঁজ করব?”

“চেষ্টা কর।”

তারাপদ কিছু বলল না। একাজ তার পক্ষে অসম্ভব। কোথায় খোঁজ করবে অমলেন্দুর?

কিকিরা হাত মুছতে মুছতে ফিরে এলেন। বললেন, “মিহিরবাবুই এখন এক নম্বর হল তারাপদ। ভদ্রলোকের ওপর নজর রাখা দরকার। উনিই যে কলকাঠি নাড়ছেন, তাতে আমার সন্দেহ নেই। তবে কী উদ্দেশ্য, তা বুঝতে পারছি না।” বলেই কিকিরা কী ভেবে বললেন, “ইভনিং ক্লাবটা কোথায় যেন? ওই পাড়াতেই না!”

তারাপদ বলল, “হ্যাঁ। ওয়েলিংটন স্কোয়ারের কাছেই। “

“ওদের বোধ হয় রোজই রিহার্সাল হয়। সোমবার বাদে। আজ সোমবার ছিল। মিহিরবাবুর ছুটি। কাল থেকে দু-তিনদিন ইভনিং ক্লাবের ওপর নজরদারি লাগাও তো!”

“তাতে লাভ কী হবে?”

“কিছুই নয়। যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখো তাই বুঝলে কিনা! কে বলতে পারে, অমলেন্দুবাবুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল…”

“আপনি কি পাগল? অমলেন্দু যাবে ইভনিং ক্লাবে?”

“যেতেও তো পারে। ধরো রাত্তিবেলায় দাড়ি, চশমা লাগিয়ে গা ঢাকা দিয়ে মিহিরবাবুর সঙ্গে দেখা করতে গেল?”

“সে তো বাড়িতেও যেতে পারে।”

“তা পারে। তবে আমার সামনে মনে হয়, বাড়ির চেয়ে ইভনিং ক্লাব সেফ।”

“কী বলছেন স্যার? অত লোকের মধ্যে…”

“না, অত লোক নয়। রিহার্সাল ভাঙার পর–সবাই যখন চলে যায়, মিহিরবাবু বাড়ি ফেরেন, তখন যদি দেখা হয়?”

চন্দন বলল, “আপনি বাঁকাপথে নাক দেখাচ্ছেন। অমলেন্দুর সঙ্গে মিহিরবাবু ওভাবে যোগাযোগ করেন বলে আমারও মনে হচ্ছে না। ঠিক আছে, কাল একবার আমি আর তারা ইভনিং ক্লাবের দিকে ঘোরাফেরা করে আসব। আপনি বরং মিহিরবাবুকে আরও একটু জােন।”

ঘাড় হেলালেন কিকিরা। “জপাব। তবে দু-একটা দিন পরে। ওঁর একটা জিনিস আমি নিয়ে এসেছি, ফেরত দিতে যাব।”

“কী জিনিস?”

“ওঁর টেবিলের ওপর থেকে লাইটারটা নিয়ে চলে এসেছি। জাপানি লাইটার। ভেরি স্মল অ্যান্ড বিউটিফুল!” বলে কিকিরা হাসলেন।

 চন্দন বলল, “নিয়ে এসেছেন মানে হাত সাফাই করেছেন?”

“ম্যাজিশিয়ানস হ্যাণ্ড!”

“আপনাকে চোর বলবে স্যার।”

“বলবে না। আমি আসল ফেরত দেব, তার সঙ্গে সুদ। মানে আরও একটা লাইটার, ভাল লাইটার হে, বেলজিয়ান, লাইটার জ্বললেই তার গায়ের রং খেলা করবে। নিভিয়ে দিলেই আবার যে কে সেই। কে, পি, সাহার দোকানে পাওয়া যায়। প্রায় দু’শো টাকা দাম। মিহিরবাবুকে প্রেজেন্ট করব। বলব স্যার, এ গিফট ফ্রম কিকিরা দ্য গ্রেট ম্যাজিশিয়ান।” বলে কিকিরা হাসতে লাগলেন। তাঁর হাসির গুঢ় অর্থটা বোঝা গেল না।

.

০৯.

ইভনিং ক্লাবের ওপর দিন দুই নজর রাখার চেষ্টা করল তারাপদরা। পার্কের গায়েই বাড়ি। পুরনো আমলের। ভাঙা ফটক, বিশ-ত্রিশ হাত মাঠ, দু-চারটে মামুলি ফুলগাছ, সিঁড়ি–তারই এপাশে-ওপাশে নানান কারবার। কোথাও ফ্রিজ মেরামতি হয়, কোথাও বাঁধাইখানা, একপাশে এক ছোট ছাপাখানা, মায় সাইনবোর্ড লেখার দোকানও। ছাপোষা ভাড়াটেও আছে। ওই বাড়ির ভেতরে কোথায় কী আছে বোঝা অসম্ভব। বাড়িও বড়। দোতলা। দোতলার একপাশে হলঘরের মতন ঘরে ইভনিং ক্লাবের আসর। অন্যপাশে এক সিনেমা কোম্পানির অফিস। পেছন দিকে হয়ত ভাড়াটে, গুদাম সবই আছে।

তারাপদ দোতলায় যায়নি, নিচে ছিল। চন্দন গিয়ে দেখে এল ওপরটা। এসে বলল, “এ বাড়িতে কাউকে খুঁজে বের করা কঠিন। হরদম লোক আসছে-যাচ্ছে।”

কথাটা মিথ্যে নয়। তবে সন্ধের পর লোকের আসা-যাওয়া কম। কাজ কারবারের জায়গাগুলো তখন বন্ধ হয়ে যায়। প্রেসটা খোলা থাকে রাত সাতটা-আটটা পর্যন্ত।

বাড়ির সামনে ঘোরাঘুরি না করে বাড়িটার মুখোমুখি পার্কে বসেই প্রথম দিন নজর রাখল তারাপদরা। কোনো লাভ হল না। বোঝাই যায় না, কারা ইভনিং ক্লাবে রিহার্সাল দিতে আসছে। তবে দোতলা থেকে ক্লাব ঘরের হল্লা মাঝে-মাঝে পার্ক পর্যন্ত ভেসে আসছিল।

প্রথম দিন মিহিরবাবু বেরোলেন পৌনে ন’টা নাগাদ। সঙ্গে আরও তিন-চারজন লোক। মিহিরবাবুর শাগরেদ। ক্লাবের লোক। খানিকটা গল্পগুজব সেরে মিহিরবাবু রিকশায় উঠলেন। দ্বিতীয় দিনে মিহিরবাবুর বেরোতে-বেরোতে নটা।

চন্দন বিরক্ত হয়ে উঠেছিল। বলল, “দুর, এ হয় নাকি? রোজ এ ভাবে পার্কে এসে বসে থাকা যায়?”।

তারাপদ গা এলিয়ে বসে সিগারেট খাচ্ছিল। ঠাট্টা করে বলল, “পার্কে লোকে হাওয়া খেতেই আসে। কত লোক বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত বসে আছে দেখছিস না! আমরা তো লেটে আসি।”

চন্দন বলল, “পার্কে বসে হাওয়া খায় বুড়োরা, আর নিষ্কর্মারা। আমি নিষ্কর্মা নই। “

তারাপদ বলল, “কী করবি বল। কিকিরার খেয়াল। আর-একটা দিন দেখে নিই; তারপর আর নয়।”

তৃতীয় দিনে অদ্ভুত এক কাণ্ড ঘটল।

মিহিরবাবু যথারীতি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন। সঙ্গে দু’জন। রাস্তায় দাঁড়িয়ে গল্প করছেন। ঘড়িতে তখন ন’টা বাজতে চলেছে। হঠাৎ একটা মোটরবাইক এসে থামল। থামামাত্র বিকট এক শব্দ। তারপর চোখের পলকে মোটর বাইক হাওয়া। খানিকটা ধোঁয়া। কেমন এক গন্ধ।

চন্দন আর তারাপদ ছুটল।

মিহিরবাবু তাঁর দুই সঙ্গী নিয়ে দাঁড়িয়ে। খানিকটা সরে গিয়েছেন।

তারাপদ দেখল, মিহিরবাবু আর তাঁর সঙ্গীরা অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ধর্মতলা স্ট্রিটের দিকে তাকিয়ে আছেন। মোটরবাইকটা ওদিকেই পালিয়েছে।

মিহিরবাবু চোখ ফেরাতেই তারাপদকে দেখতে পেলেন।

 তারাপদ বলল, “ব্যাপার কী? আপনার কোথাও লাগেনি তো?”

মিহিরবাবু তারাপদকে দেখলেন। চিনতে পারলেন। অবাকও হলেন, “তুমি এখানে?”

তারাপদ বলল, “আমরা এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম। আমার বন্ধু চন্দন। ডাক্তার।”

“ও!” বলে মিহিরবাবু তাঁর সঙ্গীদের দিকে তাকালেন, “তাপস, কাল তুমি কোঠারিবাবুকে বলে দেবে, তাদের ঝগড়া তারা হয় ঘরে বসে, না হয় মাঠে গিয়ে মিটিয়ে আসুক। এভাবে বোমা ছোঁড়াছুঁড়ি করে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল করলে ভাল হবে না। এটা পাঁচজনের রুজি-রোজগারের জায়গা। যখন-তখন দুমদাম এখানে চলবে না। আমি কিন্তু থানায় খবর দিয়ে দুটোকেই ধরিয়ে দেব।”

তারাপদ কিছুই বুঝল না।

মিহিরবাবুর এক সঙ্গী রিকশা ডাকতে কয়েক পা এগিয়ে গেল। অন্য সঙ্গী বলল, “মিহিরদা, কাল আমি আসতে পারব না। বাগনান যেতে হবে। মাকে নিয়ে। ছোট মামার অসুখ।”

“ঠিক আছে। কাল তোমার জায়গায় প্রক্সি চালিয়ে দেব। কী হয়েছে মামার?”

“হার্ট প্রবলেম?”

“কত বয়েস?”

“সিক্সটি ফাইভ।”।

“ঠিক আছে, তুমি দু-একদিন না আসতে পারো। তুমি না হয় এখন যাও।”

“সুকুমার আসুক।”

“রিকশা ওই তো একটা আসছে। ডাকো সুকুমারকে।” উলটো দিক থেকে একটা রিকশা আসছিল।

সুকুমারকে ডাকতে হল না, অন্য একটা রিকশা নিয়েই সে আসছিল।

মিহিরবাবু সামান্য অপেক্ষা করলেন।

সুকুমার সামনে এসে দাঁড়াতেই তিনি বললেন, “তোমরা তবে যাও। আমি এদের সঙ্গে একটু কথা বলে নিই।”

সুকুমার চলে গেল।

রিকশা থাকল দাঁড়িয়ে, চেনা রিকশা বোধ হয়। অন্য রিকশাটা হাত সাত-দশ দূরে।

মিহিরবাবু তারাপদর দিকে তাকালেন। “তুমি এদিকে?”

“আমার বন্ধুর সঙ্গে যাচ্ছিলাম। ও ডাক্তার। আমরা তালতলা থেকে ফিরছি। …ব্যাপারটা কী হল বলুন তো?”

“ও কিছু নয়। মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল খেলা। এই বাড়িটায় কোঠারির একটা ছেলে থাকে–জলসা করে বেড়ায়। আর ওই মোটরবাইকের ছেলেটা হল মলঙ্গা লেনের। ওটা বাপের পয়সায় খায় আর ষাঁড় হয়ে ঘুরে বেড়ায়। দুজনের মধ্যে কোনো ঝগড়া আছে পুরনো। মাঝে-সাঝে পটকা ফাটিয়ে একে অন্যকে শাসিয়ে যায়।”

“পটকা?”

“ওই বোমা-পটকা!”

“তা বলে আপনাদের গায়ের সামনে বোমা ফাটিয়ে যাবে?”

“ফটকের কাছেই ফাটাতে গিয়েছিল। আমাদের বোধ হয় নজর করতে পারেনি।”

“আমরা ভাবলাম…”

“তা ভাবতেই পারে। যা দিনকাল! তবে কী জানো ভাই, আমার গায়ে হাত ভোলার মতন মানুষ এ-পাড়াতে নেই। বউবাজার পাড়ার পুরনো লোক হে, মাস্টার। দু-একজন ইয়ে আমাদেরও আছে।” বলে হাসতে লাগলেন।

চন্দন কৌতূহলের সঙ্গে মানুষটিকে দেখছিল। পান চিবোতে-চিবোতে দিব্যি খোশগল্প করে যাচ্ছেন ভদ্রলোক।

“তোমার সেই ম্যাজিশিয়ানের খবর কী?”

তারাপদ সতর্ক হয়ে বলল, “এমনিতে ভালই। তবে পা নিয়ে..”

“পা! পায়েও খেলা আছে নাকি হে। হাতের খেলাটা তো ভালই তোমার গুরুদেবের।” মিহিরবাবু ঠোঁট চেপে হাসলেন, “ওঁকে বললো, আমার লাইটারটা ফেরত দিয়ে যেতে।”

তারাপদ অপ্রস্তুত। সামলে নিয়ে চালাকি করে বলল, “উনি নিজেই বলছিলেন সেদিন একটা ইয়ে হয়ে গেছে…”

“ম্যাজিক?”

“না, মানে… ঠিক যে-কোনো পারপাস ছিল তা নয়! ভুলো মনে..”

“বুঝেছি। …তা ওঁকে আসতে বলো।”

“উনি আসবেন। বলেছেন আসলের সঙ্গে সুদ নিয়ে আসবেন।”

“সুদ?”

তারাপদ হাসল। বলল, “কিকিরা বড় ভালমানুষ। সত্যিই উনি বড় ম্যাজিশিয়ান ছিলেন।”

“হুঁ! তা যে কাজ হাতে নিয়েছেন সেটা তো ম্যাজিশিয়ানের কর্ম নয়, ভাই। যার সঙ্গে রণে নামতে চাইছেন, সেই লোকটাও কম নয়।”

চন্দন কিছু বলল না। তারাপদর হাত টিপল আড়ালে।

তারাপদ বলল, “কিকিরা এখন অমলেন্দুর ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন।”

“তাই নাকি?”

“স্যার?”

“বলো।

“কিছু যদি মনে করেন একটা কথা বলব?”

“বলে ফেলো।”

“অমলেন্দু আপনার কাছে আসে?”

মিহিরবাবু সামান্য সময় তাকিয়ে থাকলেন তারাপদর দিকে। পরে বললেন, “আমি তো সেদিনই বলে দিয়েছি, সময়মতন তাকে তোমরা দেখলেও দেখতে পারো।”

রিকশাঅলা ঘন্টি বাজাল।

মিহিরবাবু তাকালেন একবার। তারাপদকে বললেন, “চলি ভায়া। ম্যাজিশিয়ানকে তাড়াতাড়ি আসতে বলল।”

চলে গেলেন মিহিরবাবু।

চন্দন কয়েক মুহূর্ত রিকশাটার দিকে তাকিয়ে থেকে মুখ ফেরাল.। তারাপদকে বলল, “চল, আমরা ওই রিকশাটা ধরি। আমি মেসের কাছে নেমে যাব। তুই চলে যাস হোটেল পর্যন্ত।”

অন্য রিকশাটা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল, মিহিরবাবু চলে যাওয়ার পর সে তার রিকশার হাতল তুলে নিচ্ছিল।

তারাপদ আর চন্দন দু-পাঁচ পা এগিয়ে গিয়ে রিকশাঅলাকে বলল, “এই, রোখ যাও। যানা হ্যায়…।”

রিকশাঅলা রিকশা থামাল না। “দুসরা গাড়ি দেখিয়ে।”

“কাহে?”

মাথা নাড়ল রিকশাঅলা। সে যাবে না।

তারাপদ বলল, “তুমি বাপ এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন চুপচাপ; এখন বলছ যাবে না। তোমার মরজি।”

“হামকো পেট দুখাতা হ্যায়। নেহি জায়গা।”

তারাপদ চন্দনকে বলল, “কারবার দেখছিস! এতক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল–আর আমরা যাব বলতেই বেটা পেটব্যথার অজুহাত খাড়া করল! ব্যাটা মহা বদমাশ তো।” বলে তারাপদ রিকশার কাছ থেকে সরে আসছিল।

চন্দন হাত ধরল তারাপদর। “দাঁড়া! ওর পেট ব্যথা আমি দেখাচ্ছি।” বলে সোজা দু পা এগিয়ে রিকশার হাতল ধরে ফেলল। এই, রিকশা উতারো। পেট দুখাতা হ্যায়? ঠিক হ্যায় থামা মে চল…। হাম থানাকা বাবু। আ যাও…”

রিকশাঅলা ভয় পেয়ে গেল। বোধ হয় ক’ মুহূর্ত মাত্র হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর অদ্ভুত কাণ্ড করল। রিকশার হাতল ফেলে দিয়ে দে দৌড়। ক্রিক রোয়ের গলি দিয়ে ছুট।

চন্দনরাও কম হতভম্ব হল না। এরকম হবে তারা ভাবতেই পারেনি। রিকশাঅলা পালাল।

তারাপদ বলল, “কী হল রে?”

 চন্দন বলল, “আশ্চর্য! ব্যাটা পালাল কেন? ও কে রে?”

তারাপদর কেমন খটকা লাগল চন্দনের কথায়। “লোকটা অমলেন্দু নয় তো?”

“রাবিশ। অমলেন্দু রিকশাঅলা হবে কেন? এব্যাটা রিয়েল-রিয়েল রিকশাঅলা। কিন্তু ব্যাপারটা কী হল? মিহিরবাবুর ফেরার পথে কেউ নজর রাখছে নাকি?

.

১০.

নিজের বৈঠকখানাতেই ছিলেন মিহিরবাবু; সাদরে অভ্যর্থনা করলেন কিকিরাদের। কিকিরা আর তারাপদর সঙ্গে চন্দনও এসেছে আজ।

মিহিরবাবু বললেন, “আসুন ম্যাজিকবাবু! আসুন। বসুন।” বলে রহস্যময় চোখ করে চন্দনকে ইশারা করলেন। “এটি কি আপনার দু নম্বর অ্যাসিস্ট্যান্ট?”

কিকিরা যেন কতই লজ্জা পেয়েছেন এমন মুখ করে বললেন, “আজ্ঞে, ঠিক তা নয়, আমার এজেন্সির পার্টনার?”

“পার্টনার! কী এজেন্সি আপনার?”

“কুটুস!”

“কুটুস! তার মানে?”

“স্যার, হওয়া উচিত ছিল কিকিরা-তারাপদ-চন্দন, ছোট করে কে. টি. সি.। তারাপদ একটু পালটে নিয়ে নাম দিয়েছে “কুটুস’।”

মিহিরবাবু হো-হো করে হেসে উঠলেন। হাসি আর থামতে চায় না। শেষে বললেন, “রিয়েলি, আপনি ফানি লোক মশাই। বসুন বসুন। তোমরা বসো। সিট ডাউন। তা ম্যাজিকমশাই, থিয়েটারে আমরা আজকাল ডিরেক্টর, মিউজিক, আলোকসম্পাত রাখি। আপনার এ দুটি বোধ হয় তাই, সঙ্গীত আর আলো, তাই না?”

কিকিরা হাতজোড় করে বললেন, “থিয়েটারের খোঁজ আমি রাখি না স্যার। সেই বড়বাবু, মানে শিশিরবাবুর আমলে রাখতাম।”

মিহিরবাবু মজার মুখ করে দেখলেন কিকিরাকে, চোখের ভঙ্গি থেকে মনে হল, তিনি যেন ঠাট্টা করে বলছেন, তাই নাকি?

কিকিরা এবার পকেট থেকে দুটো লাইটার বের করে মিহিরবাবুর সামনে টেবিলে রাখলেন। বললেন, “স্যার, আমায় আপনি মাফ করবেন। ম্যাজিশিয়ানদের হাত বড় চঞ্চল। লোভ সামলাতে পারে না। নো থিফিং সার, জাস্ট মজাফ্যায়িং…।”

“থিফিং? মানে?”

“মানে, ইয়ে, বলছি চুরি করিনি স্যার, মজাফ্যায়িং-মানে ইয়ে মজা করেছিলাম।”

মিহিরবাবু আবার হেসে উঠলেন জোরে। বিষম খান আর কি! কাশি সামলে বললেন কোনোরকমে, “মশাই, আপনি আমায় নাকের জলে চোখের জলে করে ফেলবেন! ইংরেজরা এদেশে থাকলে আপনাকে শূলে চড়াত।”

“থাকল কোথায়! তাড়িয়ে ছাড়লাম…।”

“বেশ করলেন। তা একটু চা হোক।” বলে টেবিলের সঙ্গে লাগানো ঘন্টি-বোম বাজালেন। মানে, খবর গেল ভেতরে। “দুটো লাইটার কেন? নিয়েছিলেন একটা, দিচ্ছেন দুটো।”

“একটা স্যার আমার প্রণামী! উপহার। বেলজিয়ান লাইটার। যখন জ্বলে তখন লাইটারটার বডিও কালারফুল হয়ে যায়। বেশ দেখতে দেখুন না!”

মিহিরবাবু নতুন লাইটারটা জ্বেলে দেখলেন। দেখতে ভাল–তবে সামান্য বড়। ছোট সিগারেটের প্যাকেটের সাইজ। খুশি হলেন। “দাম কত?”।

“দামের জন্যে কী স্যার!…এটা হল টেবল লাইটার, মানে টেবিলে রাখার। সাইজটা একটু বড় দেখছেন না!”

“না না, তবু…”

“প্লিজ! এটা আমার গুরুদক্ষিণা।”

“গুরুদক্ষিণা?” মিহিরবাবু অবাক।

চন্দন আর তারাপদ মুখ টিপে হাসছিল।

বাড়ির ভেতর থেকে কাজের লোক এল। দাঁড়াল এসে। মিহিরবাবু চায়ের কথা বললেন। তারপর বললেন, “জলুকে বলে দিস, কেউ এলে যেন বলে দেয়, আজ দেখা হবে না, আমি ব্যস্ত রয়েছি। কাল সকালে আসতে।”

লোকটি চলে গেল।

মিহিরবাবু ডিবে থেকে পান তুলে নিতে-নিতে বললেন, “কিকিরাবাবু আপনি মজাদার লোক, ভেরি ইন্টারেস্টিং ম্যান, আবার গোয়েন্দা। ম্যাজিশিয়ান-গোয়েন্দা। তা এ-সবই না হয় মানলুম। কিন্তু মশাই, আপনার গুরুদক্ষিণার ব্যাপারটা তো বুঝলাম না?”

কিকিরা অমায়িক মুখ করে হাসলেন। “বোঝার কী আছে?”

“নেই?”

“না স্যার। যেটুকু আছে পরে বুঝিয়ে দেব।”

“আপনি মশাই আমার পেছনে দুই চেলাকে লাগিয়েছেন?” বলে তারাপদদের দেখালেন।

সঙ্গে-সঙ্গে জিভ বের করে নিজের কান মললেন কিকিরা। “ছিঃ ছিঃ, আপনি বলছেন কী! আপনার পেছনে লোক লাগাব! না না, আপনি ভুল বুঝছেন। আমাদের একটু দেখার ইচ্ছে হয়েছিল–অমলেন্দু আপনার সঙ্গে ওই ক্লাবের আশেপাশে দেখা করে কি না! কৌতূহল মাত্র।…তা এক রিকশাঅলা..” বলতে বলতে কিকিরা তারাপদদের দিকে তাকালেন। বললেন, “রিকশাঅলার কথাটা বলো তো?”

তারাপদ বলল সব।

মিহিরবাবু শুনলেন। চুপ করে থাকলেন কিছুক্ষণ। কপাল কুঁচকে দুশ্চিন্তার ভান করলেন। পরে বললেন, “ব্যাপারটা নতুন মনে হচ্ছে! তা পাড়ার মধ্যে আমাকে কাবু করার সাহস কার হবে? লোচনেরও হবে না।”

“ধরুন, ও যদি আপনার ওপর নজর রাখার জন্যে…”

মিহিরবাবু এবার সকৌতুক মুখে বললেন, “না, আপনারা ভুল করছেন। রিকশাঅলা আমারই লোক। কদিন ধরে ওকে রাখছি। একটু নজর রাখে।”

কিকিরা থ হয়ে গেলেন। “আপনার লোক?”

“হুঁ”

“আমাকে স্যার কে যেন শাসিয়েছে উড়ো চিঠি দিয়ে। বলেছে, দাদু, তুমি নিজের চরকায় তেল দাও।”

তারাপদ বলল, “একটা উটকো লোক এসে কিকিরাদের ট্রামের ওপর ঠেলে ফেলে দিতে গিয়েছিল।”

মিহিরবাবু কিছু বললেন না। জর্দা মুখে দিলেন।

 কিকিরা বললেন, “লোচনের সঙ্গে আমি গত পরশু দেখা করেছিলাম।”

পান-জর্দা মুখে মিহিরবাবু শঙ্কিত গলায় বললেন, “অমলেন্দুর কথা বলেছেন নাকি?”

“পাগল নাকি! তা আমি বলি?”

“তবে কী বললেন?”

“বললাম, জাল মোহনকে প্রায় ধরে ফেলেছি। আর দু-চারটে দিন।”

“বিশ্বাস করল?”

“বুঝতে পারলাম না। তবে জাল মোহনকে দেখতে ওর খুব আগ্রহ।”

“দেখিয়ে দিন।”

কিকিরা একটু হাসলেন। বললেন, “লোচনকে নিয়ে একটু খেলা খেলতে চাই। এখন আপনার দয়া।”

“দয়া?” সন্দেহের চোখে কিকিরাকে দেখলেন মিহিরবাবু, “আপনার মতলবটা কী মশাই? খোলসা করে বলুন তো?”

কিকিরা হাত বাড়িয়ে মিহিরবাবুর সিগারেটের প্যাকেটটা টেনে নিলেন। যেন কিছুই নয়, ধীরেসুস্থে একটা সিগারেট ধরালেন। বললেন, “স্যার, আমার মতলব ভেরি সিম্পল। আমি লোচনকে আপনার এখানে হাজির করাতে চাই।”

এরকম একটা মামুলি কথা শুনতে হবে, মিহিরবাবু ভাবেননি। খানিকটা অবাক হয়ে বললেন, “এর মধ্যে দয়া করার কী আছে, মশাই? লোচন থাকে কাছেই। ক’-পা দূরে; পাড়ার ছেলে, তাকে হাজির করাতে চান, করাবেন।”

“সেইসঙ্গে আপনাকে যে একটা কাজ করতে হবে।”

“কী কাজ?”

“মোহনকে এখানে হাজির করাতে হবে।”

“মোন?” মিহিরবাবু অবাক। “মোহনকে আমি কোথায় পাব?”

 কিকিরা সিগারেটে টান মেরে ধোঁয়া গিললেন। কাশলেন অল্প। তারাপদ আর চন্দনকে এক পলক নজর করে নিলেন। আবার মিহিরবাবুর দিকে তাকালেন। বললেন, “আপনি ছাড়া একাজ কে করবে! আপনিই পারেন

“ধ্যুত মশাই, আমি কি ভগবান? না, আপনার মতন ম্যাজিশিয়ান যে, মরা মানুষ আবার জ্যান্ত করতে পারি?”

“আপনি স্যার আসল। মানে আপনি যন্ত্রী, আমরা যন্ত্র।“

 “তার মানে?”

“তার মানে, এই রহস্যের চাবিকাঠিটি আপনার হাতে। আপনি যতক্ষণ না তালাটা খুলে দিচ্ছেন, কিস্যু করার নেই।”

মিহিরবাবু চুপ। তাকিয়ে থাকলেন কিকিরার দিকে। শেষে বললেন, “মোহনকে আমি কোথায় পাব! সে আর নেই।” বলার সঙ্গে সঙ্গে মিহিরবাবুর চোখ-মুখ কঠিন হয়ে উঠল। কেমন যেন হতাশ, ক্রুদ্ধ!

কিকিরা বললেন, “জাল মোহনের কথা বলছি। আমি জানি আসল মোহন আর নেই।”

মিহিরবাবু কথা বললেন না। তাঁর মুখ আরও থমথমে হয়ে উঠল। দুটি চোখ যেন কঠিন হল। অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন।

কিকিরা অপেক্ষা করতে লাগলেন।

শেষে মিহিরবাবু বললেন, “আপনি কি সব বুঝতে পেরেছেন?”

 মাথা হেলিয়ে কিকিরা বললেন, “খানিকটা। আমি বুঝতে পেরেছি এই জাল মোহনকে আপনি এনেছেন? ঠিক কি না?”

মিহিরাবাবু তাকিয়ে থাকলেন অন্যদিকে। তবে মাথা নাড়লেন। হ্যাঁ, তিনিই এনেছেন।

কিকিরা বললেন, “লোচনকে আপনি সব দিক থেকে কোণঠাসা করে ফেলতে চান, তাই না?”

“হ্যাঁ।”

“কেন?”

মিহিরবাবু এবার যেন আচমকা জ্বলে উঠলেন। বললেন, “সে খুনি। মাডারার। শয়তান।”

“আপনি কি শুধু খুনি লোকটাকে ধরার জন্যে এত চেষ্টা করছেন?”

মিহিরবাবুর আর যেন ধৈর্য থাকল না। বললেন, “শুধু খুনি বলে…? না, তার চেয়েও বেশি। আপনি কেমন করে জানবেন মোহনের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী ছিল! আপনি জানেন না। আমি ওকে নিজের ছোট ভাইয়ের। চেয়েও বেশি ভালবাসতাম। বলতে পারেন, ছেলের মতনই। ও এত ভাল, সরল, শান্ত ছিল। সবাই ওকে ভালবাসত। তা ছাড়া রামদা, মানে মোহনের বাবা আমায় বিশ্বাস করতেন, স্নেহ করতেন। তিনি আমায় বারবার বলেছেন, “মিহির, সংসার বড় খারাপ জায়গা, আমার ছেলেটাকে তুমি দেখো।” আমি তখন অত কিছু ভাবিনি, বলেছিলাম, আপনি ভাবছেন কেন, নিশ্চয় দেখব।’

মিহিরবাবু থেমে গেলেন। কে যেন আসছিল।

বাড়ির লোক ঘরে এল। চা রেখে গেল টেবিলের ওপর। চায়ের সঙ্গে কিছু প্যাসট্রি।

মিহিরবাবু বললেন, “নিন, চা খান…যা বলছিলাম ৷ সংসার বড় অদ্ভুত জায়গা। এখানে কী না হয়। আমি তো কিছুকাল ওকালতি করেছি। ক্রিমিনালও না ঘেঁটেছি এমন নয়। লোচন একটা পাক্কা ক্রিমিনাল। মোহনকে সে মেরেছে। হি হ্যাজ কিলড হিম।”

“আমারও তাই সন্দেহ।”

“সন্দেহ নয়, সত্যি। …আপনি বলবেন, প্রমাণ কী? প্রমাণ নেই। লোচন অত্যন্ত চালাক, ওর মগজ ক্রিমিনালের। ভাইকে খুন করার পর ও এমনভাবে জিনিসগুলো ওর তরফে সাজিয়ে নিয়েছে যে, আইনমাফিক ওকে ধরবার উপায় রাখেনি। আইন প্রমাণ চায়–অনুমান সন্দেহ এ-সব স্বীকার করে না। লোচন এক দেহাতি ডাক্তারের ডেথ সার্টিফিকেট জোগাড় করেছে। থানা আর ডাক্তারকে টাকাও খাইয়েছে নিশ্চয়। আইডেনটিফিকেশন করিয়ে নিয়েছে ওর মেজো শ্যালক আর অমলেন্দুকে দিয়ে। সব পথ ও মেরে রেখেছে।”

“তা হলে?”

“তা হলেও সব চাপা দেওয়া যায় না। আইন আইন, মানুষ মানুষ। অমলেন্দুর মুখে সব শুনে আমি বুঝতে পারি, লোচন কেমনভাবে সাজিয়ে-গুছিয়ে একাজ করেছে।”

“অমলেন্দু কী বলেছে?”

“বলেছে, ঝরনা দেখতে যাওয়ার প্ল্যানটা লোচনের। অবশ্য তাতে কিছু প্রমাণ হয় না। কিন্তু পাহাড়ের যে-জায়গায় মোহনকে সে নিয়ে গিয়েছিল, সেখানে মোহন যেতে চায়নি। মোহন বরাবরই ভিতু ধরনের। সাবধানী। লোচন তাকে ভুলিয়েভালিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।”

“অমলেন্দুরা কাছে ছিল না?”

“না। যাওয়ার সময় পাহাড়ের মাথায় লোচনের মেজো শ্যালক চালাকি করে এক জায়গায় বসে পড়ল। বলল, পায়ের শিরায় টান ধরে গিয়েছে, একটু ম্যাসাজ করে নিয়ে উঠে দাঁড়াবে। সে অমলেন্দুকে ছুতো করে কিছুক্ষণ আটকে রাখল। ততক্ষণে লোচন আর মোহন অন্তত ত্রিশ-চল্লিশ গজ এগিয়ে গিয়েছে। তা ছাড়া পাহাড়ি জায়গা, ওরা খানিকটা আড়ালে পড়ে গিয়েছিল। লোচন যখন মোহনকে ঠেলে দেয় ঝরনার স্রোতে, তখন আশেপাশে কেউ ছিল না।”

চন্দন বলল, “একেবারে প্ল্যানড ব্যাপার।”

“একেবারে ছক কেটে খুন করা। …আমার মনে হয় না, মোহনের বডি যখন দেড়দিন পরে পাওয়া গেল–ওকে পোস্টমর্টেম করলেও প্রমাণ করা যেত এটা অ্যাকসিডেন্ট নয়, অন্য কিছু?” বলে চন্দনের দিকে তাকালেন মিহিরবাবু।

চন্দন বলল, “আমারও মনে হয় না, পোস্টমর্টেম রিপোর্ট থেকে বলা যেত কেউ মোহনকে জলে ঠেলে ফেলে দিয়েছে। ঝরনার স্রোত, জল, পাহাড়, পাথর, খানাখন্দ–শরীরের কোন “জখম কেমন করে হয়েছে তা বলা যেমন মুশকিল ছিল, তেমন বলা যেত না, ওটা অ্যাকসিডেন্ট নয়, কিলিং। আমারও তাই মনে হয়। তা ছাড়া ডেডবডিও পাওয়া গেছে প্রায় দেড়দিনের মাথায়। …তা পোস্টমর্টেম যখন হয়নি, হওয়া সম্ভব ছিল না ওখানে, তখন আর ও নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কী লাভ!”

মিহিরবাবু বললেন, “আমি এসব কথা অমলেন্দুর মুখে শুনেছি।”

“ও কি আপনাকে আগেই এসব কথা বলেছিল?”

“ফিরে এসেই বলেছিল। মোহনকে সে খুবই ভালবাসত। তবে–গোড়ায় তার সন্দেহ ততটা হয়নি। আমার হয়েছিল। আমি যখন বারবার তাকে খুঁচিয়ে নানা কথা জিজ্ঞেস করতে লাগলাম, তখনই তার সন্দেহ হতে লাগল।”

কিকিরা বললেন, “ও দিল্লি চলে গেল কেন? ঘটনাটার পরই যেন পালাল।”

“একটা কাজ পেয়ে গেল। তা ছাড়া আমিও ওকে চলে যেতে বললুম। বলা কি যায়, কোনো কারণে যদি লোচনের সন্দেহ হয় ওর ওপর, তাতে বিপদ হতে পারে।”

তারাপদ কথা বলল এবার। বলল, “তখন থেকেই কি আপনি…”

তারাপদকে কথা শেষ করতে না দিয়েই মিহিরবাবু বললেন, “অমলেন্দু দিল্লি যাওয়ার আগে আমি তাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিলুম, একদিন না একদিন–এই খুনের শোধ আমরা নেব। লোচনকে ফাঁসিকাঠে ঝোলাব।”

কিকিরা বললেন, “আজ পাঁচ বছর ধরে আপনারা সে-চেষ্টা করেছেন?”

“হ্যাঁ, পাঁচ বছর ধরে। ধীরে ধীরে। …লোচনকে ভুলে যেতে দিয়েছি তখনকার ঘটনা। ভুলে যেতে দিয়েছি তার ওপর কোনো সন্দেহ রয়েছে। কারও। সে ভাবতেই পারেনি তার কোনও চরম শত্রু আছে, যে তাকে খুনের মামলায় আসামি করতে পারে। সে এই ক’ বছর নাকে তেল দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছে, সম্পত্তি ভোগ করেছে। নিজের খেয়ালে যা পেরেছে বেচেছে, দেনা বাড়িয়েছে, এমনকী অন্য জায়গায় চলে যাওয়ার তোড়জোড় করছে নতুন বাড়ি করে। আর আমি তলায়-তলায় নিজের কাজ করে গিয়েছি।”

চা শেষ হল কিকিরাদের। একটা পান নিলেন তিনি।

মিহিরবাবু অন্যমনস্কভাবে সিগারেট নিলেন। লাইটার জ্বালিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন কিকিরা।

সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে মিহিরবাবু বললেন, “আমি তাড়াহুড়ো করে কিছু করিনি। ধৈর্য ধরে ধীরে-ধীরে করতে হয়েছে যা করার। একদিকে লোচন যেমন নিশ্চিন্ত হয়ে দিন কাটিয়েছে, ভেবেছে সে নিরাপদ, তার কোনো ভয়। নেই, অন্যদিকে তার গলায় ফাঁস বাঁধার সবরকম চেষ্টা আমি গুছিয়ে নিয়েছি।”

কিকিরা বললেন, “ আপনি জাল মোহনকে আসল মোন করতে চেয়েছেন বুদ্ধি করে।”

“হ্যাঁ। জালকে আসল করা যায় না। কিন্তু ধোঁকা দেওয়া যায়।”

তারাপদ বলল, “অনিলবাবু, সতীশবাবু, তুলসীবাবু-মানে এদের সকলকে আপনিই বেছে নিয়েছিলেন?”

মিহিরবাবু মাথা নাড়লেন। “ভেবে-ভেবে এদেরই বেছে নিয়েছিলাম। এরা কেউ লোচনের আত্মীয়, কেউ বন্ধু, কেউ পুরনো কর্মচারী। লোচন যখন এদের কাছ থেকে একে একে মোহনের কথা শুনবে, ধাঁধায় পড়ে যাবে। পাপের মন যার, সে কি আর নিশ্চিন্ত হয়ে থাকতে পারে। লোচনের এখন মনের অবস্থা বুঝতেই পারছ। তার ঘুম বন্ধ হয়ে গেছে।”

কিকিরা বললেন, “আপনাকে অনেক খবর জোগাড় করতে হয়েছে।”

“অনেক। লোচনরা আমাদের প্রতিবেশী। তাদের বাইরের খবর কম-বেশি আমি জানি। তা ছাড়া রামদার কাছে শুনেছি নানা কথা। …তবু বাড়ির ভেতরের খবর? সে সব তো আমার অত জানা নেই। এক-এক করে কুড়িয়ে বাড়িয়ে এখান-ওখান থেকে সেগুলো জোগাড় করতে হয়েছে কাঠখড় পুড়িয়ে। ওই খবরগুলো যদি না জানা থাকে, নকল মোহনকে আসল মোহন বলে ধোঁকা দিয়ে চালানোর চেষ্টা করা যেত না।”

“ছাপাখানার খবরও নিয়েছেন দেখছি?”

“নিয়েছি। না নিলে কেমন করে লোচন আর তুলসীবাবু ধোঁকা খাবে।”

“তুলসীবাবুর কাছে আপনি অমলেন্দুকে মোহন সাজিয়ে পাঠিয়েছিলেন।”

“হ্যাঁ। কারণ তুলসীবাবু নোচনের বিশ্বস্ত কর্মচারী। কর্মচারী বিশ্বস্ত হলেও, ভদ্রলোক এখন চোখে ভাল দেখেন না। এই সুযোগটা নিয়েছি। তা ছাড়া আপনাকে আগেই বলেছি, অমলেন্দু মেক-আপটা ভাল নিতে পারে; গলার স্বর পালটাবারও ক্ষমতা রয়েছে ওর। …শুনতে চান তো শুনিয়ে দিতে পারি।”

তারাপদ বলল, “শুনি একটু।”

 মিহিরবাবু তাঁর সেক্রেটারিয়েট টেবিলের তালা-লাগানো ড্রয়ার খুলে একটা ছোট টেপ রেকর্ডার মেশিন আর টেপ বের করলেন। দেখেই বোঝা গেল, বিদেশি মেশিন।

“এখন যার গলা শুনবেন এটা আসলে অমলেন্দুর, কিন্তু নকল মোহনের।” বলে মিহিরবাবু মেশিন চালিয়ে দিলেন। ব্যাটারি তাজাই ছিল। টেপ বাজতে লাগল। তারাপদরা ঝুঁকে পড়ে শুনতে লাগল নকল মোহনের গলা।

কিছুক্ষণ পরে মিহিরবাবু বললেন, “এই গলার সঙ্গে আসল মোহনের গলার স্বর আপনারা চট করে ঠাওর করতে পারবেন না। শোনাচ্ছি সেই আসল গলা।”

মেশিন থেকে ক্যাসেটটা খুলে নিয়ে অন্য একটা ক্যাসেট ঢুকিয়ে দিলেন মিহিরবাবু। বললেন, “এই গলাটা আসল মোহনের। তবে এখানে যা শুনবেন–সেটা আমাদের নাটক থেকে। মাঝে-মাঝে শখ করে আমরা নাটকের কিছু কিছু অংশ টেপ করে রাখি। শুনুন এবার।”

মেশিন চালিয়ে দিলেন মিহিরবাবু।

দু জনের গলার স্বরের পার্থক্য ধরা সত্যিই মুশকিলের। হয়ত বারবার শুনলে.ধরা যেতে পারে। নয়ত ধরা যাবে না।

কিকি বললেন, “বুঝেছি। আর দরকার নেই।”

মেশিন বন্ধ করলেন মিহিরবাবু। বললেন, “অমলেন্দু প্র্যাকটিস করে গলাটা ধরেছে বেশ।”

কিকিরা হঠাৎ বললেন, “হাতের লেখা? সেটাও কী..”।

মিহিরবাবু একটু হাসলেন। বললেন, “মোহন আমাদের নাটকের সময় রিহার্সাল দেওয়ার কপি তৈরি করত। পার্ট মুখস্থ করার কপি লিখত। তার হাতের লেখা আমার কাছে অনেক আছে। অমলেন্দুকে দিয়ে দিনের পর দিন তা নকল করিয়েছি।”

“এখানে?”

“না, দিল্লিতে থাকতেই এ-সব করেছে অমলেন্দু। একাজ দু-একদিনে হয় না। সময় লাগে।“

কিকিরা চুপ করে থাকলেন। মিহিরবাবুর ধৈর্য ও অধ্যবসায়কে প্রশংসা করতে হয়। বুদ্ধিকেও।

শেষমেশ কিকিরা বললেন, “আপনি এত কষ্ট করলেন যে-জন্যে তার চৌদ্দ আনাই কাজে লেগেছে। লোচনকে চারপাশ থেকে আপনি চেপে ধরেছেন। সে ভয় পেয়েছে। ভীষণ অশান্তির মধ্যে রয়েছে।”

“আমি তাই চেয়েছিলাম। চারদিক থেকে প্রেশার দিয়ে ওর মনের ডিফেন্সট্রা আগে ভেঙে দিতে.”

“বাকি দু আনা কাজই আসল। তাই না, স্যার?…ওটা আমায় করতে দিন।”

“কী কাজ?”

“লোচনকে আমি আপনার কাছে নিয়ে আসতে চাই। …ওকে এখানে আনার পর বাকি কাজটাও আপনি করবেন।”

“সে আসবে?”

“মনে হয় আসবে। জাল মোহনকে ধরার জন্যে সে উন্মাদ। লোচন বুঝতে পেরেছে, এই জাল মোহনকে ধরতে না-পারা পর্যন্ত তার শাস্তি হবে না। যদি নকল মোহন এইভাবেই থেকে যায়, সে তাকে জ্বালাবে। দিনের পর দিন।”

মিহিরবাবু কী যেন ভাবলেন। বললেন, “লোচনকে আপনি আনবেন কেমন করে?”

কিকিরা রহস্যময় হাসি হাসলেন। “আনব। সে-দায়িত্ব আমার।”

“আপনি বলবেন, জাল মোহন আমার কাছে আসা-যাওয়া করে, এই তো?”

“ধরেছেন ঠিক। বলব, জাল মোহন আপনার কাছে হালে বার কয়েক এসেছে। সে চাইছে আপনার পরামর্শ নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা কিছু একটা লাগিয়ে দিতে। তাকে ভয় দেখাব। বলব, মামলা যদি একবার লেগে যায়–এ সেই দীনরাম মামলার মতন হয়ে যাবে। কত বছর চলবে কেউ জানে না।“ বলে কিকিরা হাত বাড়িয়ে ডিবে থেকে একটা পান নিলেন। বললেন, “লোচনের কাগজে নোটিস ছাপার উদ্দেশ্য কী ছিল? কী চেয়েছিল সে? চেয়েছিল জাল মোহনের খোঁজ। কে সে, কোথায় আছে, কী তার মতলব, দেখে নিতে। তা স্যার, এখন যদি লোচন সেই জাল মোহনকে সরাসরি হাতে পায়, ছাড়বে কেন?”

মিহিরবাবু মাথা হেলালেন। “বেশ, আনুন। কিন্তু..”

“কিন্তুর কিছু নেই। আপনি তৈরি থাকুন। একেবারে পাকাপাকিভাবে।” বলে কিকি নতুন লাইটারটা দেখিয়ে ইঙ্গিতে কিছু বুঝিয়ে দিলেন।

মিহিরবাবু ভাবলেন কিছুক্ষণ। “কবে আনবেন লোচনকে?”

“আপনি বলুন?”

“আসছে বুধবার আনুন। আমি ক্লাবে যাব না।”

“সন্ধেবেলাতেই আসব।”

“আসুন। ..আমি তৈরি থাকব।”

.

১১.

আসার কথা ছিল সন্ধে সাতটা নাগাদ, ঘড়িতে সোয়া সাতটা বেজে যাওয়ার পরও লোচন আসছে না দেখে মিহিরবাবু চঞ্চল হয়ে উঠছিলেন। ব্যবস্থা তিনি সবই করে রেখেছেন, এখন শুধু নোচনের অপেক্ষা।

সাড়ে সাতটা নাগাদ কিকিরা এলেন। সঙ্গে লোচন। তারাপদও ছিল।

ঘরে ঢুকেই লোচন উত্তেজিত গলায় বলল, “এ-সমস্ত কী হচ্ছে মিহিরকাকা? শেষ পর্যন্ত আপনি…!”

মিহিরবাবু স্বাভাবিক গলায় বললেন, “বোসো। আমি আবার কী করলাম হে?”

লোচন উত্তেজিত। ক্রুদ্ধ। বলল, “এঁরা বলছেন, আপনি একটা চোর-জোচ্চোরকে বাড়িতে আসা-যাওয়া করতে দিচ্ছেন?”

মিহিরবাবু হাসিমুখে বললেন, “আমি উকিল মানুষ, আমার কাছে সাধুও যা, চোরও তাই। মক্কেলের জাত-বিচার থাকে না।”

“আপনি ওকালতি ছেড়ে দিয়েছেন?”

“তা দিয়েছি। তবে মাঝে-মাঝে পুরনো মক্কেলদের অ্যাডভাইস দিতে হয় বইকি! কমলা ছাড়লেও কমলি কি আর ছাড়ে! বাসো বোসো। দাঁড়িয়ে আছ কেন?”

লোচন বসল না। রাগের গলায় বলল, “এঁরা বলছেন, আপনার এখানে সেই জোচ্চোরটা লুকিয়ে লুকিয়ে আসে?”

মিহিরবাবু শান্তভাবেই বললেন, “আগে বোসো। তুমি তো এসেই রাগারাগি শুরু করলে! বোসো আগে, তারপর তোমার কথা শুনি।”

লোচন বসল।

কিকিরারা আগেই বসে পড়েছিলেন। বসে পড়ে অন্যমনস্কভাবে টেবিল থেকে সেই নতুন লাইটারটা তুলে নিয়ে জ্বালালেন। নিভিয়ে দিলেন আবার।

মিহিরবাবু বললেন, “এবার বলো, কী বলছিলে?”

লোচন বলল, “আমি সেই জোচ্চোর লোকটার কথা বলছি। “

“মোহনের কথা?”

“কে মোহন? জাল-জালিয়াত একটা লোককে আপনি মোহন বলছেন?”

“জাল-জালিয়াত…!” মিহিরবাবু বললেন। বলে মাথা নাড়ালেন, “তুমি বলছ জাল-জালিয়াত। সে বলছে, ও মোটেই জাল নয়।”

“ও বলছে! ও কে?…আপনি মোহনকে চেনেন না? তাকে ছেলেবেলা থেকে দেখেননি? মোহন না আপনার আদরের ছেলে ছিল?”

মাথা হেলিয়ে মিহিরবাবু বললেন, “মোহনকে আমি সব দিক দিয়েই ভাল করে চিনি বলেই বলছি, ও মোহন। “

লোচন একেবারে হতভম্ব। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল মিহিরবাবুর দিকে। কী বলবে যেন বুঝে উঠতে পারছিল না। ক্রমেই তার মাথায় যেন রক্ত চড়তে লাগল। চেঁচিয়ে বলল, “আপনি বলছেন মোহন। আশ্চর্য! আপনি একটা জালিয়াতকে মোহন বলছেন?”

“তুমি কি ভাবছ, আমার মাথা খারাপ হয়েছে?”

 রাগে যেন ফেটে পড়ল লোচন। “আপনি, আপনি একটা জালিয়াতকে কেমন করে মোহন ভাবছেন আমি জানি না।”

“প্রমাণ না পেলে ভাবতাম না।”

“প্রমাণ? কী বলছেন? সত্যিই আপনার মাথার গোলমাল হয়েছে। আপনি কি সেই চিঠির হাতের লেখার কথা বলছেন? ওটা কোনো প্রমাণ?”।

মিহিরবাবু বললেন, “লেখা না,হয় নকল হল, কিন্তু মোহনের বন্ধুবান্ধব।” হলে তিনি বইয়ের আলমারির দিকে হাত তুলে কী যেন দেখালেন। বললেন, “ওই যে ওখানে যে-ছেলেটি বসে আছে সে মোহনের ছেলেবেলার বন্ধু।”

লোচন ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল। আলমারির পাশ ঘেঁষে আড়ালে চন্দন বসে ছিল। তাকে দেখল লোচন। অচেনা মানুষ।

মিহিরবাবু বললেন, “ওকে জিজ্ঞেস করো?”

জিজ্ঞেস করতে হল না। চন্দনকে শেখানো ছিল। সে নিজেই বলল, “মোহনদা আমার স্কুলের বন্ধু। আমরা সেন্ট পলস স্কুলে একসঙ্গে পড়তাম। তখন আমি পিসির কাছে গড়পারে থাকতাম। আমার চেয়ে এক বছরের সিনিয়র ছিল মোহনদা। সিনিয়ার হলেও বন্ধু ছিল। কলেজে আমরা ছাড়াছাড়ি হয়ে যাই। মোহনদা সেন্ট পলসেই ছিল, আমি স্কটিশে…। তারপর আমি ডাক্তারিতে..”

লোচন অদ্ভুত চোখে চন্দনকে দেখছিল।

 চন্দন বলল, “আমি এখন ডাক্তার। মোহনদা..”

“কোথায় বাড়ি আপনার?” লোচন বলল হঠাৎ।

 “বাড়ি বহরমপুর। এখানে থাকি কোয়ার্টারে, মেডিকেল মেস…”

“আপনি মোহনকে দেখেছেন?”

“দেখব মানে? কী বলছেন আপনি! আগে প্রায়ই দেখাশোনা হত, তারপর আর হয়নি। শুনেছিলাম মোহনদা মারা গেছে। সেটাই জানতাম। হঠাৎ মাসখানেক আগে দেখা। ট্রামে। আমি অবাক।”

লোচন চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ার মতন করে দাঁড়িয়ে পড়ল। “বাজে কথা। মিথ্যে কথা। মোহন নয়। মোহন হতেই পারে না।”

“মানে! মোহনদা নয়!…আলবাত মোহনদা। আমরা ট্রাম থেকে নেমে চায়ের দোকানে বসে চা খেলাম। কত পুরনো গল্প হল!”

অবিশ্বাসের মুখ করে লোচন বলল, “কখনোই নয়। এ-সবই সাজানো।” বলে মিহিরবাবুর দিকে তাকাল। “আপনি ওকে মিথ্যে সাক্ষী সাজিয়েছেন।”

“আমি! কেন?”

“ওই জালিয়াত আপনাকে ব্রাইব করেছে। ছি ছি, মিহিরকাকা… ছি!”

মিহিরবাবু শান্তভাবেই বললেন, “নোচন, আমাদের পরিবারের কাউকে টাকা দিয়ে এ-পর্যন্ত কেউ কেনেনি। তুমি খুব খারাপ কথা বললে। অন্য সময় হলে তোমাকে আমি এখানে দাঁড়াতে দিতাম না। …যাকগে, সাক্ষীও শুধু একা নয়, আরও আছে।”

চন্দন সঙ্গে-সঙ্গে বললে, “আছে বইকী! মোহনদাকে নিয়ে আজ কদিন আমি অন্তত চার-পাঁচ জায়গায় গিয়েছি। আদিত্য, হরিহর, বিজন… সকলেই আমাদের বন্ধু। ওরা সবাই শুনেছিল মোহনদা মারা গিয়েছে। আজ জানতে পারছে, খবরটা ভুল। “

লোচন মিহিরবাবুর দিকে তাকাল। রাগে গা জ্বলছে, চোখ লাল। গলার স্বর রুক্ষ। বলল, “আমি বুঝতে পেরেছি, আপনি একটা জাল লোকের হয়ে মামলসা সাজাচ্ছেন।”

“হ্যাঁ, সাজাচ্ছি। তবে জাল লোকের নয়, আসল লোকের হয়ে। …হয়ত এ-নিয়ে আমি মাথা ঘামাতাম না। চিঠিটাও জাল বলে ভেবে নিতাম। কিন্তু মোহন জাল নয়। জাল হলে ও বারবার আমার কাছে আসত না। মাঝে-মাঝে এখন সে এখানে আসছে। ওর পুরনো জানাশোনা লোকেদেরও আনছে সঙ্গে করে। আমি এখন কনভিনড় যে, জাল নয়, এই মোহনই আসল।”

“অসম্ভব। হতেই পারে না।”

“তুমি যতই অসম্ভব বলল, আমি মনে করছি, মোহন মারা যায়নি। সে বেঁচে আছে। আর এখন সে কলকাতায়।”

লোচন পাগলের মতন চেঁচিয়ে উঠল। “কোথায় সে! ডেকে আনুন তাকে। আমার সামনে এসে দাঁড়াক। দেখি সে কেমন মোহন?”

কিকিরা এমন মুখ করে বসে থাকলেন যেন তিনি নীরব দর্শক। অবশ্য চোখে-চোখে যেন কিছু বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন মিহিরবাবুকে।

মিহিরবাবু বললেন, “লোচন, তুমি যদি মোহনকে দেখতে চাও দেখাতে পারি। কিন্তু আমি বলি দেখাটা আদালতে হওয়াই ভাল।”

লোচন কাঁপছিল। বলল, “মিহিরকাকা, আমাকে আপনারা ব্ল্যাকমেইল করতে চান? লোচন দত্ত অত সহজে ভয় পায় না।”

“তোমায় কেন ব্ল্যাকমেইল করব হে?”

“করেছেন। আপনি না করুন আপনার মক্কেল করেছে। জাল মোহন। আমার ছেলেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। নেয়নি?”

এবার কিকিরা কথা বললেন। মাথা নেড়ে বললেন, “ওটা আপনারই চলি দত্তবাবু! একবেলার জন্যে ছেলেকে ভবানীপুর পাঠিয়েছিলেন, আপনার এক ভায়রার বাড়ি। নিজেই ছেলেকে সরিয়ে দিয়ে দেখাতে চাইছিলেন জাল মোহন আপনাকে ব্ল্যাক মেইল করতে চায়।”

লোচন থতমত খেয়ে গেল। “আমি? আমি আমার ছেলেকে সরিয়ে রেখেছিলাম? কে বলল?”

“আপনার পালোয়ান দরোয়ান। একশো টাকা খসিয়ে খবরটা পেয়েছি। তারপর ভবানীপুরেও খোঁজ করেছি। …আপনি মশাই, ডালে-ডালে যান, গোয়িং ব্রাঞ্চেস, আর আমি যাই পাতায়-পাতায়, গোয়িং লিফ। আপনি দত্তমশাই আমার পেছনে গুণ্ডাও লাগিয়েছেন। উড়ো চিঠি পাঠিয়েছেন ভয় দেখিয়ে।”

লোচন থরথর করে কাঁপছিল। খেপে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠল। “ভাঁড়ামি করবেন না। আমার ছেলেকে আমি সরাইনি।”

“কেন মিথ্যে কথা বলছেন দত্তবাবু! ধোপে টিকবে না।”

“তাই নাকি!” লোচন যেন ব্যঙ্গ করে হাসল। আপনাদের মোহন ধোপে টিকবে?”

“টিকবে না?”

“না, না, না। নেভার। এ-জন্মে নয়। হাজার চেষ্টা করলেও নয়।”

“নয় কেন? এত সাক্ষীসাবুদ, তবু নয়?”

“বলছি নয়। মোহন নেই। সে ফিরে আসতে পারে না।”

কিকিরা বললেন, “মোহন ফিরে এসেছে। আপনি কি তাকে দেখতে চান?”

লোচন থতমত খেয়ে গেল। কী বলছে ওই ম্যাজিকঅলা! লোকটার গালে থাপ্পড় মারার জন্যে হাত উঠে যাচ্ছিল লোচনের। বিশ্রীভাবে চেঁচিয়ে উঠে সে বলল, “হ্যাঁ, চাই। দেখান তাকে।”

কিকিরা মিহিরবাবুর দিকে তাকাল।

মিহিরবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন ধীরে ধীরে। বললেন, “দেখাচ্ছি। সে এখানেই আছে। আনছি তাকে।” বলে উনি ডান দিকে এগোলেন। পরদা ফেলা ছিল। পরদা সরিয়ে পাশের ঘরে চলে গেলেন।

লোচন একেবারে খেপে গিয়েছিল। নিজের মনে চেঁচাতে লাগল, গালমন্দ শুরু করল কিকিরা আর মিহিরবাবুকে।

কিকিরা বললেন, “অনর্থক চেঁচাচ্ছেন কেন? দু দণ্ড অপেক্ষা করতে পারছেন না? মোহনকে আগে দেখুন!”

“শাট আপ! মোহনকে দেখুন? আপনারা আমায় মোহন দেখাবেন? যত্তসব ধাপ্পাবাজ চোর-জোচ্চোরের দল! আপনাদের আমি কোর্টে নিয়ে যাব।”

“যাবেন। তার আগে মোহনকে দেখুন।”

“আমায় মোহন দেখাবেন! বেশ, দেখান। তবে জেনে রাখবেন-সূর্য পশ্চিম দিকে ওঠে না। মোহনও আর ফিরে আসবে না। আমার চোখের সামনে সে মারা গেছে।”

“মারা গেছে! …আপনিই তাকে আর কত মারবেন দত্তবাবু! এতকাল তো মেরেই এসেছেন। এবার জ্যান্ত হতে দিন।”

লোচন যেন বোধবুদ্ধি হারিয়ে ফেলল হঠাৎ। উত্তেজনার মাথায় চেঁচিয়ে উঠল, “না, সে জ্যান্ত হবে না। আমি তাকে মেরেছি। আমি। আমি নিজে। মরা মানুষ বেঁচে ফিরে আসে না।”

কিকিরা যেন হাসলেন। “আপনি স্বীকার করলেন আপনি মোহনকে মেরেছেন।”

“করলাম। মুখে করলাম। তাতে আমার কী হবে! আপনারা আমার কী করবেন মশাই! পুলিশে নিয়ে যাবেন? বলব, বাজে কথা, আমি কিছু বলিনি। কোর্ট-কাছারি করবেন? বলব, বানানো কথা সব…।”

লোচনের কথা শেষ হল না, মিহিরবাবু ঘরে এলেন। সঙ্গে অমলেন্দু।

 অমলেন্দুকে দেখে লোচন যেন বুঝতেই পারল না, কাকে দেখছে? চেনা, না, অচেনা কাউকে। স্তম্ভিত। মুখে আর কথা নেই।

মিহিরবাবু লোচনকে বললেন, “একে চেনো না? অমলেন্দু। মোহনের বন্ধু। তোমাদের সঙ্গে সেদিন ছিল।”

লোচনের মুখ কালো হয়ে উঠেছিল। গলা কাঠ। বলল, “ও এখানে কেন? কোত্থেকে এসেছে?”

কিকিরা ততক্ষণে হাত বাড়িয়ে টেবিল থেকে সেই বেলজিয়ান টেবিল লাইটার তুলে নিয়েছেন। তুলে নিয়ে মিহিরবাবুকে বললেন, “এই নিন স্যার। এটা রেখে দিন যত্ন করে। টেপ হয়ে গেছে সব কথাবার্তা। দত্তমশাই স্বীকার করছেন–নিজের ভাইকে তিনি মেরেছেন।” বলে কিকিরা লাইটার-টেপ রেকর্ডারটা চালিয়ে দিলেন।

লোচন চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল। সে বুঝতে পারছিল না কী করবে। পালাবে, না, কিকিরার হাত থেকে জিনিসটা কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেবে।

মিহিরবাবু বললেন, “লোচন, ওই টেপে তোমার স্বীকারোক্তি ধরা থাকল। আর দু নম্বর প্রমাণ, সাক্ষী থাকল এই অমলেন্দু। তুমি মোহনকে ধাক্কা দিয়ে ঝরনার স্রোতে ফেলে দিয়েছিলে। এবার তুমি কেমন করে বাঁচো তা আমরা দেখব। তুমি বাঁচতে পারবে না। ভাইকে তুমি মেরেছ। তুমি ভেবেছিলে তুমিই একমাত্র চালাক লোক, তোমায় কেউ ধরতে পারবে না। তুমি ধরা পড়েছ। পাঁচ বছরের চেষ্টা আজ আমার সফল হয়েছে।”

লোচন পালাবার চেষ্টা করল। পারল না। অমলেন্দু যেন লাফ মেরে গিয়ে তাকে ধরে ফেলল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *