ঘোড়া সাহেবের কুঠি

ঘোড়া সাহেবের কুঠি — কিকিরা সমগ্র ১ — বিমল কর

০১.

তারাপদ অফিস থেকে মেসে ফিরতেই বটুকবাবুর সঙ্গে দেখা। বটুক বললেন, “ওহে, তোমার সেই ম্যাজিশিয়ান কিকিরা এসেছিলেন। আবার আসবেন। বলে গেছেন, তুমি যেন মেসেই থাকো।”

সামান্য অবাক হল তারাপদ। আজ সপ্তাহ দুই হল, কিকিরা কলকাতা-ছাড়া। দু-দুটো রবিবার তারাপদ আর চন্দন অভ্যেসমতন কিকিরার বাড়ি গিয়েছে, গিয়ে ফিরে এসেছে। কিকিরার দেখা পায়নি। কিকিরার বাড়ি গিয়েছে, গিয়ে ফিরে এসেছে। কিকিরার দেখা পায়নি। সর্বজ্ঞ বগলাচন্দ্রও কিছু বলতে পারল না। বরং মনে হল, বগলা খানিকটা চটেই রয়েছে কিকিরার ওপর। সংসারের যা কিছু বগলাই করবে–চণ্ডীপাঠ থেকে জুতো পালিশ, আর বগলাকে বিন্দুমাত্র কিছু না জানিয়ে একটা লোক বেপাত্তা হয়ে বসে থাকবে–এ কেমন কথা! বগলার কি ভাবনাচিন্তা হয় না! যাবার সময় বগলার হাতে কিছু টাকাপত্তর খুঁজে দিয়ে কিকিরা নাকি বলে গেছেন : “বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছি। সাবধানে থাকবি। তারা আর চাঁদু এলে বলবি, দিন সাত-আট পরে ফিরব।”

সেই সাত-আট দিন পনেরো-ষোলো দিনের মাথায় গিয়ে ঠেকল। যাক্, কিকিরা ফিরে এসেছেন, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল।

নিজের ঘরে গিয়ে তারাপদ জামা-প্যান্ট ছাড়ল। ছেড়ে সাবেকি লুঙ্গি জড়াল; তারপর সাবান আর গামছা নিয়ে নিচে নেমে গেল স্নান সারতে। আজ তার মন বেশ হালকা। একটা দিন আর, পরশু থেকে পুজোর ছুটি শুরু। আজই মাইনে পেয়ে গিয়েছে। অফিস-টফিসে কাজ করার সময় ছুটিছাটা পাওয়া যে কত আনন্দের, তারাপদর আগে জানা ছিল না। এখন জানছে। অবশ্য এ-সবই কিকিরার দয়ায়। কিকিরা বেছে-বেছে নিজে তদ্বির করে তারাপদকে এই চাকরিটা জুটিয়ে দিয়েছেন। বেসরকারি চাকরি, কিন্তু ভাল। ছোট অফিস। কোনো গোলমাল নেই। যাও, খাতা খুলে কলম ধরে হিসেবপত্র মেলাও, চা-সিগারেট খাও, ছুটি হলে বাড়ি ফিরে এসো ভালই লাগছে তারাপদর। সে স্বপ্নেও ভাবেনি, মাস গেলে শ’ ছয়েক টাকার মতন তার পকেটে আসবে! চাকরি পাবার প্রথম দিকে ভেবেছিল, টাকা যখন আসছে হাতে, তখন বটুকবাবুর মেস ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবে। কিন্তু যাওয়া হল না। এতকাল থাকতে-থাকতে কেমন মায়া পড়ে গিয়েছে বটুকবাবুর মেসের ওপর, নিজের ওই হতকুৎসিত ঘরের ওপরেও। এক সময় বটুকের টাকার তাগাদায় তারাপদ কেঁচো হয়ে থাকত, এখন বটুককেই কেঁচো করে রেখেছে! না না, বটুকবাবু মানুষ খারাপ নয়, কথাবাতার ধরনটাই যা খরখরে। বটুকবাবু যদি মন্দ হতেন, তারাপদ কি তার দুর্দিনে টিকে থাকতে পারত। এই মেসে! না, তারাপদ নেমকহারামি করতে পারবে না বটুকবাবুর সঙ্গে। বটুকের জয় হোক।

নিচের শ্যাওলা-পড়া কলতলা থেকে স্নান সেরে “বটুকের জয় হোক” গাইতে গাইতে তারাপদ তার ঘরে ফিরে এল। ফিরে এসে মুখ মুছে চুল আঁচড়াচ্ছে, দরজায় পায়ের শব্দ শুনল। মুখ না ফিরিয়েই তারাপদ বলল, “আসুন, কিকিরা মশাই! কোথায় যাওয়া হয়েছিল, স্যার?

কোনো সাড়াশব্দ কানে এল না।

ঘুরে দাঁড়াল তারাপদ। দরজার সামনে বটুকবাবু দাঁড়িয়ে! হাসল তারাপদ। ও, আপনি! টাকা চাইতে এসেছেন?”

“না। বলতে এসেছি, তুমি বড় এঁচোড়ে-পাকা হয়ে গিয়েছ! আমি তোমার ইয়ার? খুব যে গান গাইতে-গাইতে এলে!”

তারাপদ জোরে হেসে উঠল।”আপনার কানে গিয়েছিল? সরি, বটুকদা! ভেরি সরি। তা আপনার টাকাটা এখন নেবেন?”

“আজ বেস্পতিবার। কাল দিও। মাইনে পেয়েছ?”

মাথা হেলাল তারাপদ।

বটুক বললেন, “তোমায় একটা কথা বলব, ভাবছি। দুলালবাবু আজ দু’ তিন মাস ধরে ভুগছেন। কেউ বলছে আলসার, কেউ বলছে লিভার খারাপ হয়েছে। তোমার ওই ডাক্তার-বন্ধুকে বলে হাসপাতালে ঢুকিয়ে দাও না, ভাই; মানুষটার একটা চিকিৎসা হয়!”

তারাপদ দু’মুহূর্ত বটুবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর বলল, “আগে কেন বলেননি? আমি চন্দনকে বলব। নিশ্চয় বলব।”

এমন সময় কিকিরাকে দেখা গেল। বটুকবাবু চলে গেলেন।”

“কী গো অফিসের বাবু? কখন ফেরা হল?” কিকিরা ঘরে ঢুকে বললেন।

“খানিকটা আগে। তা আপনার হঠাৎ-আবির্ভাব কেন কিকিরা-স্যার? কোথায় হাওয়া হয়েছিলেন?”

“অজ্ঞাতবাসে গিয়েছিলাম। মাঝে-মাঝে তোমাদের এই কলকাতায় হাঁপিয়ে উঠি। তখন দু-চার দিন কোথাও পালিয়ে যাই।”

“দু-চার দিন তো নয়, স্যার; আপনি সপ্তাহ-দুই ডুব মেরে ছিলেন। বগলা ফায়ার হয়ে গিয়েছে, তা জানেন?”

“ও একটা আস্ত উজবুক। পইপই করে বলে গেলাম, তুই ভাবিস না, আমি দিন কতকের জন্যে এক বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছি। অনেক দিন যাইনি। কদিন থেকে আসব। তা হতচ্ছাড়া যাকেই পেয়েছে, তার কাছেই প্যানপ্যান করেছে।”

“গিয়েছিলেন কোথায়?”

“বেশি দূরে নয়। আসানসোলের কাছে কালীপাহাড়ি বলে একটা জায়গা আছে। কোলফিল্ডকে কোলফিল্ড, আবার গ্রামও।”

“সেখানে বন্ধু আছে?”

“পুরনো বন্ধু, বাপু। একসঙ্গে খেলাধুলো করেছি। স্কুল ফ্রেন্ড।…তা নাও, সাজগোজ শেষ করো; চলল, একটু ঘুরে আসি।”

তারাপদ অবাক হয়ে বলল, “এই ভিড়ের মধ্যে কোথায় ঘুরবেন! পুজোর ভিড়। রাস্তাঘাটে হাঁটা যায় না। আজ পঞ্চমী, তা জানেন?”

“সব জানি। নাও, পাজামা চড়িয়ে নাও। চলো।”

তারাপদ কিছু বুঝল না। কিকিরা যখন বলছেন, তখন যেতেই হবে। বলল, “একটু চা হবে না, কিকিরা-স্যার?”

“সে বাইরে হবে। তুমি ঝটপট নাও তো।”

তারাপদ গায়ে গেঞ্জি গলাতে লাগল।

 পার্ক তো নয়, নেড়া মাঠ। বর্ষার দৌলতে কোথাও কোথাও সামান্য ঘাস গজিয়ে কোনো রকমে টিকে ছিল। কিকিরা বেছে-বেছে একটা জায়গায় বসলেন। কাছাকাছি কেউ নেই।

তারাপদও বসল। বসে একটা সিগারেট ধরাল।

কিকিরা হাত বাড়ালেন।”দাও তো, একটা ধোঁয়া দাও।”

 তারাপদ প্যাকেট দিল সিগারেটের।

কিকিরা ন’মাসে ছ’মাসে শখ করে সিগারেট খান। গোটা কয়েক কাঠি নষ্ট করে সিগারেট ধরালেন। বললেন, “তোমার অফিস কবে বন্ধ হচ্ছে?”

“কাল অফিস হয়ে।”

“খুলবে কবে?”

“খুলবে দ্বাদশীর দিন। তবে আমার লক্ষ্মীপুজো পর্যন্ত ছুটি। অবাঙালিরা দেওয়ালির ছুটি পাবে চার দিন, আমরা শুধু কালীপুজোর দিন।”

“ভালই হল। আমরা তা হলে কালকেই কালীপাহাড়ি স্টার্ট করতে পারি।” কিকিরা বেশ সহজভাবেই বললেন।

তারাপদ অবাক হয়ে কিকিরার দিকে তাকাল।”কালীপাহাড়ি! সেখানে যাব কেন?”

কিকিরা হাসিমুখে বললেন, “পুজোর এই ভিড় হই-হট্টগোলের মধ্যে কলকাতায় থেকে কী করবে? চারদিকে শুধু মাইক আর ঢাকের বাজনা। আমার সঙ্গে ঘুরে আসবে চলল। তোফা থাকবে, পোলাও-মাংস খাবে, কত সিনসিনারি দেখবে–ধানখেত, পলাশ ঝোপ, কাশফুল, মাঝে-মাঝে বৃষ্টি। শরৎকাল দেখবে হে, রিয়েল শরৎকাল। পদ্য পড়েছ আজি কি তোমার মধুর মুরতি হেরিনু শারদ প্রভাতে…? সেই জিনিস দেখবে।”

তারাপদ সিগারেটের টুকরোটা ছুঁড়ে ফেলে দিল। কেমন সন্দেহ হচ্ছিল তার। কিকিরা শরৎকাল দেখতে কালী পাহাড়ি যাবেন? বর্ধমান লোকালে গিয়েও তো শক্তিগড় থেকে শরৎকাল দেখে আসা যায়।

“কিকিরা স্যার,” তারাপদ বলল, “খুলে বলুন তো ব্যাপারটা?”

“কেন, কেন! খোলাখুলির কী আছে! একেবারে সিপিল ব্যাপার। পুজোর ছুটিতে দিন কয়েক নিরিবিলিতে থেকে আসা।”

“তা ঠিক,” তারাপদ অবিকল কিকিরার মতন করে বলল, “ভেরি সিমপি। তবে কিনা আপনি এই দিন-পনেরো নিরিবিলিতে কাটিয়ে এলেন, আবার সেই একই জায়গায় নিরিবিলিতে কাটাতে যাচ্ছেন তো, তাই বলছিলাম ব্যাপারটা কী?”

“তোমাদের বড় সন্দেহবাতিক?”

“সঙ্গদোষ স্যার! আপনার রহস্য দেখে-দেখে আমরাও সাসপিশাস হয়ে উঠেছি।…তা সত্যি করে বলুন তো, এবারের মিস্ট্রিটা কী? আবার কোনো ভুজঙ্গ কাপালিক?”

“না।”

“রাজবাড়ির ছোরা-গোছের কিছু পেয়েছেন?”

“না হে, না।”

“তবে?”

 কিকিরা বললেন, “এবার দুশো শক্ত কাজ করতে হবে, একই সঙ্গে। ওঝাগিরি করব একদিকে, আর অন্যদিকে একটা খুন।”

“খুন? মার্ডার?” তারাপদ চমকে উঠল। বড় বড় চোখ করে দেখতে লাগল কিকিরাকে।

কিকিরা বেশ সহজভাবেই বললেন, “তুমি ভেবো না, এমন ছিমছাম, নিট অ্যান্ড ক্লিন খুন হবে যে, কারুর সাধ্য হবে না আমাদের ধরে।”

তারাপদ বলল, “আপনি একলাই যান, খুন সেরে ফেলুন। আমি যাচ্ছি না।”

কিকিরা হেসে ফেললেন। তারাপদর কাঁধের কাছে থাপ্পড় মেরে বললেন, “তুমি একটি আস্ত হাঁদা। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার কথা শোনোনি কখনো? বিষ দিয়ে বিষক্রিয়া নষ্ট করা? শোনোনি? এটাও হল সেই রকম। একটাকে

হেভেনে পাঠিয়ে দেব, আর-একটাকে হেল্ থেকে টেনে তুলব।

“হেভেনে কাকে পাঠাবেন? আমাকে?” তারাপদ ঠাট্টা করে বলল।”ঠিক ধরেছ! তোমার মাথার ঘিলু অনেককাল জমাট ছিল। এবার দেখছি গলে যাচ্ছে। শীতকালে নারকেল-তেল যে ভাবে গলে, সেই ভাবে।”

রসিকতা করে তারাপদ বলল, “আজ্ঞে হ্যাঁ, আপনার তাতে।”

কিকিরা জোরেই হাসলেন। হাসি সামলে বললেন, “এবার কাজের কথা বলি। কাল রাত্রের প্যাসেঞ্জারে আমরা যাচ্ছি। তুমি গোছগাছ করে আমার বাড়িতে সন্ধের মধ্যে চলে আসবে। আর চন্দনের সঙ্গে কাল সকালে দেখা করে বলবে, সে কবে যেতে পারবে?”

“চাঁদু পারবে না।”—

 “কেন?”

“অনেক কষ্টে দিন চারেক ছুটি ম্যানেজ করেছ; বাড়ি যাবে মা-বাবার কাছে।”

“বেশ তো, বাড়ি থেকে ফিরে এসে যাবে।”

“ওর হসপিটাল-ডিউটি নেই?”

“তুমি বড় বাগড়া দাও। বেশ, স্যান্ডেল-উডকে বলল, কাল আমার সঙ্গে একবার দেখা করতে। দুপুরের পর আমি থাকব। বুঝলে? সকাল আমাকে পাবে না। দুপুরের পর পাবে।”

“বলব।”

“ব্যস, তা হলে ওঠো। কাল দেখা হবে।”

”আপনি কিন্তু ব্যাপারটা বললেন না?”

“অত অধৈর্য হচ্ছ কেন? কাল ট্রেনে যেতে-যেতে বলব।” কিকিরা উঠলেন।

 তারাপদকেও উঠতে হল।

পা বাড়িয়ে কিকিরা বললেন, “একটা ব্যাপার বেশ মন দিয়ে ভেবো তো! তেতালার সমান উঁচু থেকে একটা লোক যদি লাফিয়ে পড়ে, সে মাটিতে-না পড়ে আর-কোথায় যেতে পারে? হাওয়ায় কি মিলিয়ে যাওয়া যায়।”

তারাপদ কিছুই বুঝল না।

.

০২.

ষষ্ঠীপুজোর দিন হাওড়া স্টেশনে পা দেয়, কার সাধ্য। ভিড়ে-ভিড়াক্কার, থিকথিক করছে মানুষ। রাশি রাশি মালপত্র। পায়ে-পায়ে কুলি। হাজার কয়েক লোক একই সঙ্গে কথা বলছে, চেঁচাচ্ছে, দৌড়ঝাঁপ করছে। দম বন্ধ হয়ে যাবার জোগাড়।

কিকিরা বুদ্ধি করে প্যাসেঞ্জারের টিকিট কিনেছিলেন। রাত্রের দিকে প্রায় শেষ ট্রেন। যারা যাবার তারা মেলে, এক্সপ্রেসে, পূজা স্পেশ্যালে চলে যাবার পর ঝড়তি-পড়তি ভিড়টা পড়ে ছিল মোগলসরাই প্যাসেঞ্জারের জন্যে। মামুলি যাত্রী ছাড়া এ-গাড়িতে কেউ চড়ে না। তবু ভিড় কম হল না।

একেবারে ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট কিনেছিলেন কিকিরা। একটু আরামে যেতে চান আর কী! বললেন, “ক ঘণ্টার নবাবি করে নিচ্ছি, বুঝলে তো, তারাপদ। প্যাসেঞ্জারের ফার্স্ট ক্লাস–তাও কালীপাহাড়ি পর্যন্ত। আমাদের মতন বাবুর এইটুকুই দৌড়।”

চার বার্থের কামরা। কিকিরা আর তারাপদ ছাড়া অন্য দুজনই অবাঙালি। একজন হলেন, বিশাল চেহারার এক পঞ্জাবি ভদ্রলোক, যাবেন বর্ধমান পর্যন্ত। অন্যজন বোধহয় আসানসোলের কোনো ব্যবসাদার, প্রচুর লটবহর নিয়ে উঠেছেন গাড়িতে, মারোয়াড়ি। কিকিরার সঙ্গে মালপত্র তেমন বেশি না হলেও একটা বড়সড় ট্রাংক রয়েছে।

গাড়ি ছাড়ার পর বিশাল চেহারার পঞ্জাবি ভদ্রলোক সটান শুয়ে পড়লেন, সঙ্গে একটা অ্যাটাচি ছাড়া কিছু নেই। মারোয়াড়ি ভদ্রলোক গন্ধমাদন নিচে রেখে, ওপরে বসলেন, পা ঝুলিয়ে। সামান্য আলাপ-পরিচয়ের চেষ্টাও করলেন, কিকিরা তেমন উৎসাহ দেখালেন না।

ঘেমে প্রায় নেয়ে উঠেছিল তারাপদ। হাতমুখে জল দিয়ে এসে রুমাল ঘাড় গলা মুছে জলের বোতল খুলে জল খেল।

কিকিরা বসে ছিলেন নিচের বার্থে।

গাড়ি চলতে শুরু করার পর বাতাস আসছিল। রাত হয়েছে। বাতাস ঠাণ্ডা।

কিছুক্ষণ দুজনেই গায়ে হাওয়া লাগিয়ে শরীরটা জুড়িয়ে নিলেন।

 কিকিরাই কথা বললেন প্রথমে। বললেন, “চন্দন বলেছে, বাড়ি থেকে ফিরে এসে দিন-দুই হাসপাতাল করবে। তারপর ডুব দিতে পারবে।”

তারাপদ বলল, “জানি। ওর ডাক্তারির আপনিই বারোটা বাজাবেন’।”

“কে বলল! চাঁদুবাবুর হাসপাতাল তো আর মাস-দুই পরে শেষ হয়ে যাচ্ছে, তারপর বাবুকে চরে বেড়াতে হবে।”

ঠাট্টা করে তারাপদ বলল, “আপনার সঙ্গে চরবার প্ল্যান করেছে নাকি?”

হাসলেন কিকিরা।

কিছুক্ষণ হাসিঠাট্টার কথা হল। গাড়ির ভেতরে গুমোটভাব ছিল, সেটাও কেটে গিয়েছে বাইরের ঠাণ্ডা বাতাসে। লিলুয়ায় গাড়ি থেমে আবার চলতে শুরু করেছে।

তারাপদ বলল, “কালীপাহাড়িতে তো নিয়ে চললেন কিকিরাস্যার; কিন্তু কেন নিয়ে যাচ্ছেন, সেটা এবার বলুন।”

“বলছি, বলছি” কিকিরা পা তুলে আরাম করে বসলেন।” তোমাদের কোথাও নিয়ে গেলেই রহস্যের গন্ধ পাও, তাই না?”

ঠাট্টার গলায় তারাপদ বলল, “তা পাই। কেন পাব না, বলুন। আপনি কিকিরা দি ওয়ান্ডার! মিস্টিরিয়াস ম্যাজিশিয়ান।”

কিকিরা বললেন, “তা হলে শোনো। একটু গৌরচন্দ্রিকা গেয়ে শুরু করি?”

“করুন।”

সামান্য চুপ করে থেকে কিকিরা শুরু করলেন, “আমার এক বন্ধু আছে ছেলেবেলার। আগেই তো বলেছি, একেবারে অল্প বয়েসের বন্ধু। তার নাম ফকিরচন্দ্র রায়। আমরা বলতাম ফকির। ফকিররা দু-তিন পুরুষ ধরে কালীপাহাড়িতে থাকে। নামে ফকির হলেও ওরা মোটামুটি ধনী লোক। এক সময়ে জমিজমাই ছিল ওদের সব, সে ওর ঠাকুরদার আমলে। বাবার আমলে জমি-জায়গা ছাড়াও কোলিয়ারিতে নানা রকমের কনট্রাকটারি ধরেছিল। তাতে আরও ফেঁপে ফুলে ওঠে। বিস্তর পয়সা এলে যা হয়–শবাবিতে ধরে যায়, ফকিরদেরও তাই হল, নবাবিতে ধরল। পয়সা ওড়াতে লাগল চোখ বুজে। কিন্তু ওই যে বলে, চিরদিন সমান যায় না। ফকিরদেরও হল তাই অবস্থা। অবস্থা পড়তে শুরু করল, রবরবা কমতে লাগল।”

তারাপদ বলল, “কেন?”

কিকিরা বললেন, “ঠাকুরদার আমলে ছিল এক। বাবা কাকার আমলে হল তিন। ফকিরের বাবার আরও দুই ভাই ছিল। ফকিরদের আমলে সেটা আরও ভাগ হয়ে গেল। তার মানে এই নয় যে, সে ফকির হয়ে গিয়েছে, এখনো যা আছে, তাতে তোমার আমার মতন মানুষের বরাতে থাকলে বর্তে যেতুম।”

“মানে এখনো বেশ আছে?”

“ওদের কাছে বেশ নয়, তোমার আমার কাছে যথেষ্ট।”

“গোলমালটা কেথায়?”

“মুখে শুনলে গোলমালটা ভাল বুঝতে পারবে না। চোখে দেখলে আঁচ করতে পারবে খানিকটা। তা হলেও ঘটনাটা ছোট করে শুনে রাখো।” কিকিরা একবার মুখ ফিরিয়ে বাইরেটা দেখে নিলেন। আবার স্টেশন এসে গেল। বললেন, “ফকিরদের বিষয়-সম্পত্তি এখন একরকম ভাগ-বাঁটরা হয়ে গিয়েছে। যে-সব সম্পত্তি কেউ কাউকে ছাড়তে রাজি নয়, তাই নিয়ে কোর্ট কাছারি চলছে। এইরকম এক সম্পত্তি ঘোড়া-সাহেবের কুঠি।”

“ঘোড়া-সাহেবের কুঠি? সেটা আবার কী?”

“একটা বাড়ি। যেমন-তেমন বাড়ি অবশ্য নয়; দুর্গ বলতে পারো। পাথরের তৈরি। এক-একটা পাথর হাতখানেকের বেশি লম্বা। চওড়াও আধ হাত।“

“কী পাথর?”

“এমনি পাথর, সাধারণ। পাথরের বাড়ি দেখোনি?”

 তারাপদ ঘাড় হেলাল। দেখেছে।

 গাড়ি থামল। সামান্য থেমে আবার চলতে শুরু করল।

তারাপদ বলল, “বলুন তারপর। ঘোড়া-সাহেবটা কে?”

 কিকিরা বললেন, “অনেকদিন আগেকার কথা বলছি। তা ধরো বছর পঞ্চাশ তো বটেই। তখন ব্রিটিশ রাজত্ব। এ-দিককার অনেক কোলিয়ারির মালিকানা ছিল সাহেবদের। ম্যানেজার, ইঞ্জিনিয়ার বেশির ভাগই ছিল সাহেব। ওয়েলকাম কোলিয়ারিজ বলে একটা কোম্পানি ছিল সাহেবদের। এদিকে তাদের ছোট-বড় অনেকগুলো কয়লাকুঠি ছিল। ফারকোয়ার সাহেব বলে এক সাহেব ছিল। সে-ই কয়লাকুঠিগুলোর সর্বেসর্বা। এজেন্ট অ্যান্ড জেনারেল ম্যানেজার। ঘোড়া-সাহেবের কুঠি ছিল তাঁর বাংলো আর অফিস দুই-ই।”

“তা ঘোড়া-সাহেব নাম হল কেন?” তারাপদ জিজ্ঞেস করল।

 “সাহেবের ঘোড়া বাকি ছিল। আস্তাবল ছিল বাংলোয়, ঘোড়া রাখতেন, ঘোড়ার তদ্বির করার জন্যে লোজন থাকত। সাহেব নিজে প্রায়ই ঘোড়ায় চড়ে সকাল-বিকেল টহল মারতেন। তাই লোকে নাম দিয়েছিল ঘোড়া-সাহেব।”

তারাপদ মাথা নাড়ল। ব্যাপারটা যেন সহজ হল এতক্ষণে। বলল, “ঘোড়া-সাহেবের বাড়ি আপনি দেখেছেন?”

“দেখেছি বই কি! আমাদের ছেলেবেলায় ওটা দেখার মতন জিনিস ছিল। ধরো, কলকাতায় যেমন মনুমেন্ট। সবাই অন্তত একবার তাকিয়ে দেখে। ঘোড়া-সাহেবের কুঠি দেখা ছিল সেইরকম। ওখানকার মানুষ, গাঁ-গ্রামের লোক, কোলিয়ারির লোকজন, সবাই দেখত। বাইরে থেকেই। বিঘে আট-দশ জমি, মস্ত পাঁচিল, নানা রকম গাছগাছালি, ফুলের বাগান, মধ্যিখানে দোতলা বাংলো ঘোড়া-সাহেবের। পাশেই ছিল নালার মতন এক নদী, নুনিয়া। বর্ষায় জল থাকত, অন্য সময় শুকনো।…তা আমাদের যখন বাচ্চা বয়েস, তখন ঘোড়া-সাহেব বুড়ো হয়ে পড়েছেন। তিনি আর বেশিদিন থাকেননি, নিজের দেশে ফিরে গেলেন। অন্য কে একজন এল, তার নাম মনে নেই।”

“আপনিও কি কালীপাহাড়ির লোক?”

“না না, লোক নই। আমার মামা কাজ করত একটা কোলিয়ারিতে। মাঝে মাঝে মামার বাড়ি গিয়ে থাকতাম। আর ফকিরের সঙ্গে আমার ভাব স্কুলে। আমি শহরের স্কুল-বোর্ডিংয়ে থেকে পড়তাম, ফকির আসত বাড়ি থেকে।”

তারাপদ এবার একটা সিগারেট ধরাল।”তারপর বলুন, কী হল?”

কিকিরা বললেন, “ওয়েলকাম কোম্পানির সুদিন ফুরলো। ঘুষিকের দিকের একটা কোলিয়ারিতে বিরাট এক অ্যাকসিডেন্ট হল। আরও পাঁচরকম গোলমাল। ওয়েলকাম কোম্পানি তাদের কোলিয়ারি বেচে দিতে লাগল। দু-একটা করে। ঘোড়াসাহেবের কুঠি ফাঁকা হয়ে গেল। মারোয়াড়ি, কচ্ছিরা কোলিয়ারি কিনে নিতে লাগল। এক বাঙালি ভদ্রলোকও কিনলেন একটা। তিনিই ওই ঘোড়াসাহেবের কুঠিটা কিনেছিলেন। বাগান-টাগানের বেশির ভাগই তখন নষ্ট। কিন্তু সেই ভদ্রলোক বেশিদিন বাঁচেননি। অ্যাকসিডেন্টে মারা গেলেন। তখন ফকিরদের উঠতি সময়, টাকা আসছে বস্তা বস্তা। ফকিরের বাবা আর কাকা বেশ সস্তায় ওই কুঠি সেই ভদ্রলোকের স্ত্রীর কাছ থেকে কিনে ফেললেন। কেন যে কিনলেন নিজেরাও জানেন না। পয়সা আছে, লোকের কাছে চাল দেখাতে হবে বলেই বোধ হয়। ওই কুঠিতে কেউ কিন্তু থাকতে যায়নি। খানিকটা ভয়ে, খানিকটা দরকার পড়েনি বলে। ঘোড়া-সাহেবের কুঠি ধীরে ধীরে জঙ্গল হয়ে আসতে লাগল। ফকিরের বাবা কাকা একসময়। এক একরকম প্ল্যান করতেন বাড়িটাকে নিয়ে। কাজে কিছুই করতেন না। শেষে ফকিরদের মন্দ দিন এল। মারা গেলেন ফকিরের বাবা। বছর কয় পরে মেজকাকা। ফকিররা সব সেয়ানা হয়ে উঠেছে ততদিনে, জমিজমা ব্যবসাপত্র দেখছে। শরিকের ঝগড়া শুরু হয়ে গেল। সেটা আর থামল না। পরিবার আলাদা হল, ভাঙল, বিষয়সম্পত্তি ভাগাভাগি হতে লাগল, মামলা ঝুলতে থাকল মাথায়।” কিকিরা একটু থামলেন। আবার বললেন, “ফকিরের নিজের ছোট ভাই তার সব বেচেবুচে বিদেশে চলে গেছে। কাকার ছেলেদের মধ্যে ছোটজন পুরীতে থাকে। ব্যবসা করে হোটেলের।”

প্যাসেঞ্জার গাড়িটা আপন খেয়ালে চলছে। থামছে, চলছে, আবার থামছে। লোকও উঠছে নামছে কম নয়।

তারাপদ বার দুই হাত তুলল। বলল, “ঘোড়া-সাহেব কুঠির ইতিহাস তো শুনলাম। কিন্তু গণ্ডগোলটা কী নিয়ে?”

কিকিরা বললেন, “গণ্ডগোল বাড়িটা নিয়ে। ফকিররা বাড়িটা তাদের বলে দাবি করছে, আবার তার খুড়তুতো ভাই বলছে, বাড়ি তাদের।”

“এটা তো মামলা-মকদ্দমা করে ঠিক করতে হবে। বাড়িটা কাদের! তাই না?”

“হ্যাঁ, সেই রকমই। কিন্তু এর মধ্যে একটা কাণ্ড ঘটে গিয়েছে।”

“কী কাণ্ড?”

“ওই বাড়ির দোতলায় একজন খুন হয়েছে।”

“খুন হয়েছে?” তারাপদ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল কিকিরার দিকে। কিকিরা বললেন, “খুন হয়েছে, কিন্তু যে-খুন হয়েছে, তাকে ঘরে কিংবা নিচে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। খুন হবার পর সে বাতাসে মিলিয়ে গিয়েছে।”

তারাপদ বলল, “তা আবার হয় নাকি?”

“হয় না,” মাথা নাড়লেন কিকিরা।”তুমিও জানো হয় না, আমিও জানি হয় না। কিন্তু ফকিরের বড় ছেলে বলছে, সে স্বচক্ষে খুন দেখেছে।”

তারাপদ বিশ্বাস করল না। বলল, “সে কেমন করে বলছে? খুনের সময় সে ছিল সামনে?”

“হ্যাঁ, ছিল।”

“বয়েস কত ছেলেটির?”

“বছর কুড়ি-একুশ। ফকিরদের সব অল্পবয়সে বিয়ে-থা হত। কাজেই, তার বড় ছেলে এখন সাবালক।”

তারাপদর সন্দেহ হল। বলল, “ছেলেটার মাথায় গোলমাল নেই তো?”

“আগে ছিল না। এই ঘটনার পর হয়েছে। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে আছে। ভূতে পেলে যেমন হয়।”

তারাপদ ঠিক ধরতে পারল না।”কেন?”

“ভয়ে।” বলে একটু থেমে কিকিরা বললেন, “ওর মাথায় ঢুকেছে, পুলিস ওকে ধরবে। এটা ওর মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে কেউ।”

“উদ্দেশ্য?”

“উদ্দেশ্য নানা রকম হতে পারে। তবে একটা উদ্দেশ্য, ফকিররা যেন আর ঘোড়া-সাহেবের কুঠির দিকে নজর না দেয়।”

“তার মানে–” তারাপদ বলল, “ফকিরের খুড়তুতো ভাইরা প্যাঁচ মেরে কুঠিটা বাগাবার চেষ্টা করছে?”

“ভাইরা নয়, ভাই। খুড়তুতো এক ভাইকে নিয়েই গোলমাল। ফকির তাই বলে।”

তারাপদ কিছুক্ষণ যেন কিছু ভাবল, তারপর বলল, “একটা ব্যাপার আমি বুঝতে পারছি না। খুনই যদি হবে, তবে তো সেটা পুলিশকে জানানো হয়েছে। আর পুলিশ যদি জানে, তারা তো মুখ বুজে থাকবে না। ফকিরের ছেলেকেই বা ধরবে কেন?”

কিকিরা পকেট থেকে নস্যির ডিবে বার করলেন। বাহারি চৌকোনো ডিবে। তারাপদ আগে কখনো কিকিরাকে নস্যি নিতে দেখেনি। অবাক হল। কিছু অবশ্য বলল না।

নস্যির টিপ নাকের কাছে ধরে আস্তে আস্তে টানলেন কিকিরা। বললেন, “মজাটা তো সেইখানে, তারাপদবাবু! যে খুন হয়েছে তাকে যদি জলে-স্থলে খুঁজে না পাওয়া যায়–তবে পুলিসের কাছে কে প্রমাণ করবে, অমুক লোক খুন হয়েছে। বড় জোর বলতে পারে–আমাদের অমুক লোক বেপাত্তা হয়েছে। ফকিরের খুড়তুতো ভাই পুলিসে যায়নি, যেতে পারছে না–শুধু এই কারণেই। প্রমাণ কী খুনের? কিন্তু থানায় না গিয়ে আড়ালে থেকে ফকিরকে চাপ দিচ্ছে, ভয় দেখাচ্ছে, আর তার ছেলেটাকে তো আধ পাগলা করে তুলেছে। বুঝলে?”

“কিন্তু ফকিরের ছেলে তো খুনি নয়।” তারাপদ বলল।”

“সে বলছে, নয়। কিন্তু অন্যপক্ষ যদি প্রমাণ করতে পারে, ফকিরের ছেলে খুনি-তা হলে!”

তারাপদ কিছু বুঝল, কিছু বুঝল না। বলল, “ভাল বুঝলাম না।”

“মুখে শুনে এর বেশি কিছু বুঝবে না। জায়গায় চলো; থাকো কয়েকদিন। ওদের সবাইকে চোখে দেখো–তখন বুঝতে পারবে।”

কিকিরা জল খাবার জন্যে উঠলেন। ওয়াটার বটল ঝুলছিল একপাশে।

 জল খেয়ে আরামের শব্দ করলেন কিকিরা। “একটু গড়িয়ে নেওয়া যাক, কী বলো?”

তারাপদ বলল, “নিন।”

“একেবারে ভোরের মুখে কালীপাহাড়ি পৌঁছব। তুমিও শুয়ে পড়ো।”

তারাপদর আবার হাই উঠল। সারাটা দিন কম হুড়োহুড়ি যায়নি। একবার চন্দনের কাছে, তারপর অফিস, অফিস থেকে ফিরে কিছু কেনাকাটা, সেখান থেকে কিকিরার বাড়ি। চরকিবাজি চলছে আজ।

হাই-জড়ানো গলায় তারাপদ বলল, “আমি কিন্তু মড়ার ঘুম ঘুমোব। আপনি সময়-মতন ডাকবেন।”

কিকিরা বললেন, “তুমি নাকে তেল দিয়ে ঘুমোও।”

.

০৩.

তখনো ভোর হয়নি, সাদাটে ভাব ফোটেনি আকাশে, গাড়ি এসে কালীপাহাড়ি স্টেশনে পৌঁছল। কিকিরা খানিকটা আগেই তারাপদকে ঘুম থেকে ডেকে দিয়েছিলেন।

স্টেশনে গাড়ি থামতেই দু’জনে মালপত্র সমেত নেমে পড়ল। তারাপদর লাগেজ বলতে একটা সুটকেস আর কাঁধ-ঝোলা। কিকিরার সঙ্গে ছিল কালো রঙের এক ট্রাভেলিং ট্র্যাংক, গোটা-দুই বেয়াড়া সুটকেস। ট্র্যাংকটা যে কেন সঙ্গে নিয়েছেন কিকিরা, তারাপদর মাথায় আসছিল না। কলকাতায় তারাপদ জিজ্ঞেস করেছিল, “এই গন্ধমাদনটা আপনি কেন নিচ্ছেন? ওঠাতে-নামাতে প্রাণ বেরিয়ে যাবে।” কিকিরা খানিকটা রহস্য করে জবাব দিয়েছিলেন, “ওটায় আমার ধনদৌলত থাকে, বাপু। সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছি।” তারাপদ আর কিছু বলেনি।

প্ল্যাটফর্মে নেমে তারাপদ বলল, “এখনো রাত রয়েছে।”

“আরে না, দেখতে-দেখতে ফরসা হয়ে যাবে।”

স্টেশনে লোক কিন্তু খুব একটা কম নামল না। বেশির ভাগই গাঁ-গ্রামের মানুষ। প্ল্যাটফর্মে তখনো বাতি জ্বলছে।

এমন বিদঘুটে সময় যে, কুলিও জুটছিল না। কোনো রকমে দুজনে মালপত্র প্ল্যাটফর্মে নামাতে পেরেছে। এখন সকাল না-হওয়া পর্যন্ত হাঁ করে বসে থাকা।

“আপনার বন্ধুর বাড়ি থেকে তোক আসবে না?” তারাপদ বলল।

“আসবে। এত ভোর-ভোর আসা, একটু দেরি হচ্ছে বোধহয়।”

“আমরা তা হলে কী করব?”

“এখানে বসে থাকি খানিকক্ষণ।”

তারাপদর গা শিরশির করছিল। শরঙ্কাল। ভোর হয়ে আসার আগের মুহূর্ত। এই সময় গা শিরশির করাই স্বাভাবিক। ওভারব্রিজের বাঁ দিকে মন্ত-মস্ত গাছ। ডান দিকে ঘরবাড়ি। আসলে, স্টেশনটা নিচে, দু পাশে বালিয়াড়ির মতন উঁচু জমি।

একটা সিগারেট ধরিয়ে তারাপদ কাছাকাছি পায়চারি করতে লাগল। বেশ লাগছে ঠাণ্ডা বাতাস, একটু হিম-হিম ভাব রয়েছে। আকাশ সাদা হয়ে আসছে বোধ হয়। কিকিরা ঠিকই বলেছিলেন।

আর খানিকটা পরে একেবরে ফরসা হবার মুখে-মুখে ফকিরের বাড়ি থেকে জনা-দুই লোক চলে এল।

দু’জনেই কিকিরার চেনা। লোচন আর নকুল। লোচন ফকিরদের বাড়ির কাজের লোক, বাইরের কাজকর্মগুলো সে করে; আর নকুল গাড়ির ড্রাইভার।

কিকিরার সঙ্গে কথা বলতে বলতে দুজনে ভারী ট্র্যাংকটা তুলে নিল। বললে, গাড়িতে রেখে আবার আসছে।

তারাপদ কৌতূহলের সঙ্গে দু’জনকেই দেখছিল। দু’জনেই গড়নে-পেটনে তাগড়া। নকুল বেঁটে, বয়সেও কম, পঁচিশ হবে। একমাথা চুল, ভোঁতা মুখ। লোচনের বয়েস খানিকটা বেশি, বছর পঁয়ত্রিশ তো হবেই। মাথায় সে মাঝারি।

দু’জনে যেভাবে অক্লেশে ভারী ট্র্যাংকটা নিয়ে ওভারব্রিজে উঠতে লাগল, মনে হল এ-সব তাদের কাছে সাধারণ ব্যাপার।

তারাপদ তারিফ করার গলায় বলল, “গায়ে বেশ ক্ষমতা তো?”

কিকিরা বললেন, “ওরা কি কলকাতার লোক হে, রোদে-জলে তেতেপুড়ে মানুষ। ওই নকুল সের দেড়েক ভাত নাকি একপাতে বসে খেতে পারে। বিশ-পঁচিশখানা রুটি হজম করা ওর কাছে কিছুই নয়।”

হাসল তারাপদ। ”খাইয়ে লোক।”

 “শুধু খাইয়ে নয়, খুন-জখম করতেও ওস্তাদ।”

 ঘাবড়ে গেল তারাপদ। “মানে? ও কি খুন-জখম করে বেড়ায়?”

“খুন করে কি না জানি না, তবে জখম করে। ফকিরের গাড়ি নকুলই চালায়। ফকির বড়-একটা দূরে কোথাও যায় না গাড়ি নিয়ে।”

“কেন?”

“এমনিতে তো শত্রুর অভাই নেই আজকাল। তার ওপর ব্যবসাপত্রের জন্যে দূরে যখন যেতে হয়, কাঁচা টাকা সঙ্গে থাকে। হয় আদায় করে ফিরছে, না হয় সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে। রাত-বিরেত হয়ে যায়। এসব জায়গায় হামেশাই ডাকাতি হয়।”

“নকুল তা হলে ফকিরবাবুর বডিগার্ড?” তারাপদ বলল।

”খানিকটা তাই।”

ফরসার ভাব আরও বেড়ে গেল। এখন কাছাকাছি অনেক কিছুই চোখে পড়ছে স্পষ্টভাবে। তারাপদ স্টেশন, গাছপালা, প্ল্যাটফর্ম দেখছিল।

লোচন আর নকুল ফিরে এল।

 জিনিসপত্র উঠিয়ে চারজনেই এবার এগিয়ে চলল ওভারব্রিজের দিকে।

তারাপদ হাঁটতে হাঁটতে গন্ধ শুকছিল। সকালের গন্ধ। গাছগাছালি থেকে কী সুন্দর গন্ধ উঠছে এই সকালে, বনতুলসীর ঝোপ বাঁ দিকে, তারই সামান্য তফাতে মাঠ। ওভারব্রিজের বাঁ দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে সামনে তাকালে কিছুটা দূরে কয়লার স্তূপ চোখে পড়ে, সেই কয়লার একটা কাঁচা গন্ধও যেন বাতাসে মেশানো রয়েছে।

“এ-দিকে হে,” কিকিরা তারাপদকে ডান দিকে টানলেন।

ওভারব্রিজের ডান দিক দিয়ে নিচে নামলেই স্টেশনের কম্পাউন্ড। একটা জিপগাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। বোঝাই যায় ফকিরবাবুর জিপ। দূর থেকেই বোঝা যাচ্ছিল, বেশ পুরনো কাজ-চালানো গোছের গাড়ি।

স্টেশনের দোকানপত্র এক-এক করে খোলার তোড়জোড় চলছিল। চায়ের স্টলের সামনে উনুনে ধোঁয়া উঠছে, দুটো কুকুর ঘুমিয়ে রয়েছে, একপাশে, বারোয়ারি কলকতলায় নিমের দাঁতন হাতে একটি কুলি দাঁড়িয়ে আছে।

তারাপদ বলল, “এক কাপ চা খেয়ে নিলে হত না?”

“বেশ তো, চলো,” কিকিরা বললেন, “আমারও হাই উঠছে।” বলেই লোচনকে ডাকলেন, “লোচন, চা-সেবা হবে নাকি? তোমরা মালগুলো রেখে এসো।”

স্টলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন কিকিরা। চায়ের কথা বললেন।

চা-অলা সকালের বউনির জন্যে মন দিয়ে চা করতে লাগল।

”কেমন লাগছে, তারাপদ?”

“ভালই লাগছে।”

“খানিকটা ভেতর দিকে চলো, আরও ভাল লাগবে। একসময় বড় সুন্দর জায়গা ছিল–এখন কোলিয়ারি আর কয়লা সব গিলে খাচ্ছে। গাছপালা, মাঠঘাট কতটুকু আর আছে!”

চা তৈরি হল। কিকিরা লোচনদের ডাকলেন।

খানিকটা সঙ্কোচ বোধ করলেও লোচনরা কাছে এল, চায়ের খুরি হাতে নিয়ে আবার জিপগাড়ির দিকে চলে গেল।

তারাপদ আর কিকিরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা খেতে লাগলেন।

 তারাপদ হঠাৎ বলল, “ফকিরবাবুর জিপ দেখে মনে হচ্ছে, ওটারও ঘুম ভাঙেনি।” বলে হাসল।”কেমন ময়লা দেখছেন?”

কিকিরা বললেন, “কোলিয়ারির গাড়ি ওই রকমই হয় হে, এ কি তোমার কলকাতা? কয়লার দেশ। চলো না রাস্তাঘাটের চেহারা দেখবে।”

জিপগাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই তারাপদ হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, “ফকিরাবুর কি ওই একটিই ছেলে?”

“দুটি ছেলে, একটি মেয়ে। বড় বিশু–মানে বিশ্বময়; ছোট, অংশু। মেয়ে সকলের ছোট। পৃর্ণিমা। বড় মিষ্টি দেখতে! ফকিরের ছেলেমেয়েদের সকলকেই দেখতে সুন্দর। ফকির নিজেও দেখতে সুপুরুষ ছিল। গ্রামে যাত্রাপার্টি করেছিল ফকির, রাজাটাজা সাজত।” কিকিরা হাসলেন।

চা খাওয়া শেষ করে তারাপদ আবার একটা সিগারেট ধরাল। একটা কথা সে স্পষ্টই বুঝতে পারছিল কিকিরা ফকিরের বাল্যবন্ধু শুধু নন, ফকিরকে তিনি ভালবাসেন। কিকিরার কথাবার্তা বলার ধরনে সেটা বোঝা যায়।

পয়সা মিটিয়ে দিয়ে কিকিরা বললেন, “চলো, যাওয়া যাক।”

কিকিরা আর তারাপদকে সামনেই বসিয়ে নিল নকুল। পেছনে মালপত্র সমেত লোচন।

স্টেশনের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে গাড়ি ডান দিকে ঘুরল।

 তারাপদর ভালই লাগছিল। কিকিরা মিথ্যে বলেননি। জিপ মিনিট দশেক ধরে চলছে, সকালও হয়ে গিয়েছে, রোদ উঠল এইমাত্র, রাস্তা ভাল নয়, কিন্তু চারপাশে কত রকম দৃশ্য ছড়িয়ে আছে। মস্ত-মস্ত নিমগাছ, বট, ছোট-ছোট কুঁড়ে, সাঁওতাল গোছের মেয়ে-পুরুষ চোখে পড়ছে, মুরগি চরছে কুঁড়ের সামনে, কুকুর, হঠাৎ খানিকটা জায়গায় ধানের খেত, তারপরই নেড়া মাঠ, কোথাও সামান্য জল জমে রয়েছে পুকুরের মতন, শালুক ফুল ফুটছে, আবার দূরে তাকালে কোলিয়ারির পিটও দেখা যাচ্ছে।

দেখছিল তারাপদ। জায়গা বেশ শুকনো, পানা-পুকুর কিংবা বাঁশঝাড় চোখে পড়ে না। বরং পলাশ-ঝোপ আর কুল-ঝোপই বেশি চোখে পড়ে। হ্যাঁ, একপাশে অনেক কাশফুল ফুটে আছে। বাতাসে দুলছে। চোখ জুড়িয়ে যায়।

জিপ আরও খানিকটা এগিয়ে বাঁ দিকে ঘুরল।

কিকিরা বললেন, “আর তিন-চার মিনিট।”

তারাপদর হঠাৎ ঢাকের আওয়াজ কানে এল। কোথায় যেন ঢাক বেজে উঠল। এই বাজনা একেবারেই আলাদা, কলকাতার মতন নয়, কানে বড় মিষ্টি লাগছিল। মনে পড়ল আজ সপ্তমী পুজো। কলকাতায় থাকলে তারাপদ এতক্ষণে বটুকবাবুর মেসে পড়ে-পড়ে ঘুমোত। আর এখানে সে চোখ চেয়ে-চেয়ে সব দেখছে ওই যে কত বড় ধানখেত, সবুজ হয়ে রয়েছে, মাথা দুলছে ধানের শিষের; ওই দেখো কত বিরাট এক পুকুর আর্ট-দশটা আমগাছ ডালপালা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে; ছোট্ট এক টুকরো খেত, সবজি ফলেছে। চোখ যেন জুড়িয়ে গেল তারাপদর। আকাশ রোদে রোদে ভরে উঠছে, পাখি উড়ে যাচ্ছে মাথার উপর দিয়ে সাঁতরে।

কেমন যেন ঘোর এসেছিল তারাপদর, আচমকা জিপগাড়ির হর্নে চমকে উঠল। তারপরই দেখল, দোতলা এক বিরাট বাড়ির সামনে এসে তাদের গাড়ি থামল। ওই বাড়িরই গালাগানো ঠাকুর-দালান থেকে ঢাকের শব্দ আসছে।

কিকিরা নেমে পড়লেন। তারাপদ আগেই নেমেছে।

”ফকিরদের বাড়ি,” কিকিরা বললেন, “আদি বাড়ি।”

বাড়িটা দেখলেই বোঝা যায় একালের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই, পুরনো টঙ, পুরনো ছাঁদ। কলকাতায় চিতপুরের গলির মধ্যে, বউবাজারের এ-গলি ও-গলিতে এই ছাঁওদর বাড়ি দেখেছে তারাপদ। সামনের দিকে কোনো ভাঙচুর নেই, একেবারে সটান, লম্বার দিকটা বেশি, বড়বড় থাম, মোটা পাঁচিল, খড়খড়িকরা দরজা জানালা। রং-চং তেমন কিছু চোখে পড়ছিল না।

লোচন আর নকুল জিনিসপত্র নামাতে লাগল।

তারাপদ জিজ্ঞেস করল, “এবাড়ি কত কালের?”

“সামনের দিকটা অনেককালের। শ খানেক বছরের। পেছনের দিকটা পরে হয়েছে–ফকিরের বাবা কাকারা করেছিলেন। তাও সেটা ধরো বছর পঞ্চাশ-ষাট আগেকার।”

“ঠাকুর-দালান বাইরে কেন?”

“অন্দরমহল আলাদা রাখার জন্যে। গ্রামের লোকজন আসে যায়, দু-চারটে দোকানও বসে, তার ওপর এই যাত্রা–এ-সবের জন্যে বোধহয়। ভেতরেও ফকিরদের গৃহদেবতার ঘর রয়েছে।”

কথা বলতে বলতে তারাপদ কিকিরার সঙ্গে ভেতরে এল। এসে অবাক হয়ে গেল। বাইরে থেকে বোঝাই যায় না যে, ভেতরটা স্কুল বাড়ির মৃতন। মাঝখানে মস্ত চাতাল-অনায়াসেই টেনিস খেলা যায়–এত বড়সড় ফাঁকা জায়গা। আর চারদিক ঘিরে ফকিরের বাড়ি। সবটুকুই প্রায় দোতলা, শুধু একপাশের খানিকটা একতলা। দোতলার বারান্দা আর রেলিং দেখা যাচ্ছিল।

এক-তলার দিকটা আঙুল দিয়ে দেখালেন কিকিরা।”ওই আমাদের আস্তানা। বাইরের লোকজন এলে ওখানে থাকে।”

“কিন্তু আপনি তো বাইরের লোক নন, স্যার।”

“না, ঠিক সেভাবে নই, তবে যেখানের যা আচার। আমি যখনই আসি, ওখানে থাকি।”

“আসেন মাঝে-মাঝে?”

“আসি। ফকির আমার নিতান্ত বন্ধুই নয়, ভাইয়ের মতন।”

তারাপদ আর কিছু বলল না।

 প্রায় গোটা বাড়ি পাক দিয়ে তারাপদ নিজেদের জায়গায় এসে পৌঁছল। ততক্ষণে লোচনেরা ঘর খুলে দিয়েছে। জিনিসপত্রও রাখছে নামিয়ে। ফকিরদের বাড়ির লোকজনের গলা পাওয়া যাচ্ছিল। দু-একজনকে দেখাও গেল।

ঘরে ঢুকে তারাপদ থমকে দাঁড়াল। তাকাল চারপাশ। তারপর বলল, “বাঃ! বেশ ঘর তো।”

পছন্দ হবার মতনই ঘর। বড়সড়। বিরাট-বিরাট জানলা। কাচের শার্সি আর খড়খড়ি দুইই রয়েছে। দরজা-জানলা সবই ভোলা। বাইরে গাছপালা, বাগান। রোদ নেমেছে বাগানে।

কিকিরা বললেন, “এটা আমার ঘর; তোমারটা পাশে। “

তারাপদ অবাক হয়ে বলল, “এত বড়বড় ঘরে মাত্র একজনের থাকার ব্যবস্থা?”

হাসলেন কিকিরা। বললেন, “একেই বলে বনেদিয়ানা। ফকিরলাটের ব্যাপার?” বলে আবার হাসলেন, “আমরা ফকিরের বড়লোকি দেখে ওকে ঠাট্টা করে লাট বলতাম।”

তারাপদ আসবাবপত্র দেখছিল। যা যা প্রয়োজন, সবই গোছানো।

 লোচনরা গেল পাশের ঘর খুলতে।

তারাপদ ঘরের বাইরে দিকের দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে চারপাশ দেখছিল। এ-দিকটায় বাগান। গাছগাছালি কম নয়। এখনো ঢাক বাজছে। শিউলি ফুলের গন্ধও পাচ্ছিল তারাপদ।

হঠাৎ বিশ্রী কানফাটা আওয়াজে চমকে উঠল তারাপদ। সঙ্গে-সঙ্গে সরে গেল একপাশে। গুলি ছোঁড়ার আওয়াজ। ফাঁকায় অনেকটা ছড়িয়ে গিয়েছে শব্দটা। কাক ডাকছে, পাখিরা ভয় পেয়ে ডেকে উঠল। উড়তে লাগল গাছপালার মাথায়।

কিকিরা চেঁচিয়ে বললেন, “দরজার কাছ থেকে সরে এসো।”

তারাপদ সরে গেল। আর কোনো শব্দ হল না।

.

০৪.

হাত-মুখ ধুয়ে কিকিরা আর তারাপদ চা খেতে বসেছে, লোচন এসে বলল, কতাবাবু আসছেন।

তারাপদর মনটাই বিগড়ে গিয়েছিল। সপ্তমী পুজোর সকালটা শুরু হয়েছিল ভাল, চমৎকার লাগছিল তারাপদর, চোখ জুড়িয়ে আসছিল, ঝরঝরে লাগছিল শরীর-মন, হঠাৎ কোত্থেকে একটা বন্দুক ছোঁড়ার আওয়াজে সব নষ্ট হয়ে গেল। কে বন্দুক ছুড়ল, কেনই বা ছুড়ল, তাও বোঝা গেল না।

কিকিরা বললেন, “দেখো তারাপদ, বন্দুক যেই ছুড়ক, আমাদের লক্ষ করে ছোড়েনি। তা যদি ছুড়ত তবে আগেই ছুড়ত। জিপে করে যখন আসছিলাম। বাড়িতে পৌঁছানোর পর কেন আমাদের দিকে নজর দেবে? ওটা অন্য কিছু। ফকির আসুক, জানা যাবে।”

যুক্তিটা তারাপদও স্বীকার করল। মন কিন্তু বিগড়েই থাকল।

“ফকিরবাবুর খুড়তুতো ভাইরা কোথায় থাকেন?” তারাপদ জিজ্ঞেস করল।

“ভাইরা মানে অমূল্যদের বাড়ি। সেবাড়ি এখান থেকে সিকি মাইলটাক হবে। এই যে বাড়ি দেখছ ফকিরদের, এই রকমই দেখতে, তবে বাহার একটু বেশি, আকার কিছু ছোট।”

“আপনি তো ওদের চেনেন?”

“মুখে চিনি একজনকে, ফকিরের খুড়তুতো ভাই অমূল্যকে। অমূল্যর ছেলেমেয়েদের চিনি না।”

“মানুষ কেমন?”

“সুবিধের নয় শুনেছি। বুদ্ধি খুব প্যাঁচালো, বুকের পাটা রয়েছে অমূল্যর, শুনেছি খুনটুন করিয়েছে, বেআইনি কাজকর্ম করে।”

তারাপদ এক কাপ চা শেষ করে আরও এক কাপ ঢালতে লাগল। এখানে সবই বোধ হয় এলাহি কাণ্ড। সাত-আট কাপ চা তৈরি করে একটা কাচের পটে করে দিয়ে গিয়েছে লোচন, বড় একটা কাচের প্লেটে একরাশ মিষ্টি।

চটির শব্দ পাওয়া গেল বাইরে। ফকির রায় ঘরে ঢুকলের। তারাপদ তাকাল।

কোনো সন্দেহ নেই, ফকির রায় সুপুরুষ। মাথায় বেশ লম্বা, ছ’ফুট তো হবেই’। গায়ের রঙ নিশ্চয় টকটকে লালই ছিল কোনো সময়ে, বয়েসে এবং এই কয়লার দেশে সে রঙ জ্বলে এখন তামাটে দেখায়। কাটা কাটা চোখমুখ, নাক লম্বা, গড়ন শক্ত। মাথার চুল কোঁকড়ানো। অবশ্য, চুল বেশি নেই মাথায়। অল্পস্বল্প পেকেছে।

ফকির একেবারে সাদামাটা পোশাকেই এসেছেন। পরনে দামি সাদা লুঙ্গি, গায়ে গেঞ্জি, হাতে সিগারেটের প্যাকেটে আর লাইটার। গলা আর গেঞ্জির ফাঁকে পইতে দেখা যাচ্ছিল।

“এই যে কিঙ্কর, তুমি তা হলে ঠিক সময়মতনই এসে পড়েছ?” ফকির বললেন।

কিকিরা বললেন, “আমি ভাবছিলাম, তোমারই না ভুল হয়ে যায়।..আলাপ করিয়ে দিই। এই হল সেই তারাপদ। এর কথা তোমায় বলেছি। আমার সাকরেদ। আর এক সাকরেদ–চাঁদু-ডাক্তার, সে পুজোর পর আসবে।” বলে কিকিরা তারাপদর দিকে তাকালেন, “তারাপদ, ফকিরের পরিচয় তো তুমি শুনেছ। এখন চোখে দেখো।”

তারাপদ হাত তুলে নমস্কার জানাল।

ফকিরও নমস্কার জানিয়ে কাছে এসে চেয়ার টেনে বসলেন।

কিকিরা বললেন, “নাও, চা খাও। আজ তোমার সকাল-সকাল ঘুম ভাঙল নাকি?”

বাড়তি কাপ ছিল। কিকিরা চা ঢেলে দিলেন।

ফকির বললেন, “ঘুমোলাম কোথায় যে ভাঙবে! সারা রাত জেগে। সকালে চোখ লেগেছিল, তা তুমি আসবে তো, একবার লোচনকে দেখতে বেরুলাম। ফিরে আর ঘুম এল না। নানান চিন্তা।” ফকির চায়ের কাপ তুলে নিলেন।

তারাপদ ফকিরের মুখ দেখছিল। মণির রঙ বেশ কটা, চোখের পাতা মোটা। সারা মুখে ক্লান্তি ও অশান্তির ছাপ। অনিদ্রার জন্যে ফকিরের চোখমুখ শুকনো দেখাচ্ছিল।

কিকিরা বললেন, “খানিকটা আগে বন্দুক ছোঁড়ার শব্দ হল? ব্যাপারটা কী?”

ফকির একটু চুপ করে থেকে বললেন, “বিশু ছুঁড়েছে।”

 কিকিরা যেন চমকে উঠলেন, “সে কী! বিশু? বিশু বন্দুক পেল কোথায়? তার কিছু হয়নি তো?”

“না, কিছু হয়নি।…বন্দুকটা আমার। কদিন ধরে ঘরে রাখছি, কেমন একটা ভয় এসে গিয়েছে কিঙ্কর। কিসের ভয় তোমায় ঠিক বোঝাতে পারব না। আমার শোবার ঘরে হাতের নাগালের মধ্যে রাখি বন্দুকটা।”

“তা না হয় রাখো; কিন্তু বিশুর হাতে গুলিভরা বন্দুক গেল কেমন করে? তা ছাড়া তুমি নিজেই জানো, বন্দুক তো বড় কথা, একটা সামান্য ছুরি ওর হাতে পড়াও সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার।

ফকির অপরাধীর মতন মুখ করলেন।”সবই জানি ভাই। তবু কেমন করে যে হল…।”

“কেমন করে?”

“আমার মনে হয়, আমি যখন নিচে লোচনকে ডেকে দিতে এসেছিলাম। তখন বোধহয় বিশু আমার ঘরে ঢুকছিল।”

“ও ঘুমোয়নি?”

“হয়ত রাত্তিরে ঘুমিয়েছিল। ঘুম ভেঙে গিয়েছিল শেষ রাত্রে।”

“ওকে তো ঘুমোবার ওষুধ খাওয়ানো হয়?”

“খায়। তবে সব সময় যে সমান কাজ করবে ওষুধে–তা তো নয়।”

কিকিরা আর কোনো কথা বললেন না। বোধ হয় ফকিরকে চা খাবার সময় দিলেন।

ফকির চা খেতে-খেতে একটা সিগারেট ধরালেন। অন্যমনস্ক চিন্তিত। তারাপদর দিকে তাকালেন ফকির। ম্লান হাসলেন, “আমি বেশ খানিকটা পারিবারিক গণ্ডগোলের মধ্যে আছি। কিঙ্করের কাছে শুনেছেন?”

মাথা হেলাল তারাপদ।”শুনেছি।…গুলির শব্দে বেশ ঘাবড়েই গিয়েছিলাম।”

ফকির সিগারেটের প্যাকেটটা তারাপদ দিকে ঠেলে দিলেন।”ঘাবড়ে যাবার মতনই ব্যাপার। বন্দুকে টোটা ভরা ছিল। বিশু একটা অঘটন ঘটাতে পারত। ঘটায়নি এই আমার সৌভাগ্য। মা বাঁচিয়েছেন।” ফকির হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বোধ হয় দেবী দুর্গাকেই স্মরণ করলেন।

তারাপদ বেশ খুঁটিয়ে লক্ষ করছিল ফকিরকে। শক্ত মানুষ নিশ্চয়, সংসারের আপদ-বিপদে পোড় খাওয়া, তবু ফকিরকে কেমন ভীত চিন্তিত দেখাচ্ছে।

কিকিরা হঠাৎ বললেন, “বিশু এমনিতে কেমন আছে?”

“সেই রকমই। উনিশ-বিশ। ভালমন্দ বোঝা যায় না। তবে আগের চেয়ে খারাপ নয়।”

“ডাক্তার আসছে?”

“কাল আসেনি। পরশু এসে দেখে গিয়েছে।”

“কে থাকছে ওর কাছাকাছি?”

“ওর মত থাকত। গত পরশু দিন ভবানী এসেছে। ভবানীই থাকে এখন।”

“ভবানী কে?”

“আমার ভাগ্নে। বড়দির ছেলে। বিশুর চেয়ে বছর দুয়েকেরে বড়, দুজনের মেলামেশা বরাবরই।“

কিকিরা চুপ করে গেলেন। কিছু ভাবছিলেন।

তারাপদ অনেকক্ষণ কথাবাতা কিছু বলেনি। তার মনে হল দু-একটা কথা বলা দরকার ফকিরবাবুর সঙ্গে, নয়ত বড় খারাপ দেখাচ্ছে। তারাপদ বলল, “বিশু বন্দুক ছুঁড়তে পারে? না এমনি অন্ধাড়াক্কা ছুঁড়ে ফেলেছে?”

ফকির তাকালেন তারাপদর দিকে, “পারে। আমার ছোট ছেলেও বন্দুক ছুঁড়তে জানে।”

কথাটা এমনভাবে বললেন ফকির যে, তারাপদর মনে হল, এ বাড়ির ছেলেদের ওটা শিখে রাখতেই হয়।

“ও বাড়ির খবর কী?” কিকিরা জিজ্ঞেস করলেন।

“অমূল্যদের কথা বলছ? কাল একবার এসেছিল। ওরাও আজকাল দুগা পুজো করে, বলতে এসেছিল। বিশুকে দেখতে চাইছিল। এড়িয়ে গিয়েছি।

কিকিরা কপাল কুঁচকে চোখ ছোট করে ফকিরকে দেখছিলেন। দেখতে-দেখতে বললেন, “কিছু বলল?”

“না, সরাসরি কিছু বলল না। তবে হাবেভাবে বুঝিয়ে গেল, বিশুকে কোথাও পাঠিয়ে দেওয়াই ভাল।”

“তুমি কিছু বললে না?”

“বলেছি। ঘুরিয়ে বলেছি। বিশুর যদি কেউ ক্ষতি করার চেষ্টা করে আমি তাকে ছেড়ে দেব না। আমার হাতে সে মরবে।” ফকিরের কটা চোখ ঝকঝক করে উঠল প্রতিহিংসায়।

কিকিরা তাড়াতাড়ি কথা ঘুরিয়ে নিলেন।”না, না, এখন মাথা গরম করে কাজ করার সময় নয়, ফকির। মাথা গরম করলে কিচ্ছু হবে না। ঠাণ্ডা মাথায় যা করার করতে হবে। তা ছাড়া তুমি ভাবছ কেন? অমূল্যদের হাতে যদি তেমন কোনো প্রমাণ থাকত, তবে তারা থানা-পুলিশ না করে বসে থাকত নাকি এতদিন?”

“সবই জানি, ভাই। আমার বরাতের দোষ, নয়ত আর কী বলব, বলো? আমি নিজেই বুঝতে পারি না, বিশু কেন, কার পাল্লায় পড়ে ঘোড়াসাহেবের কুঠিতে গেল? কী দরকার ছিল তার ওখানে যাবার?”

কিকিরা বললেন, “ছেলেমানষ, এত কি বুঝতে পেরেছিল!..যাক, সে পরে ভাবা যাবে। এখন অন্য ক’টা কাজের কথা বলি, শোনো।”

“বলো?”

“তোমার কাছে তোমাদের সাত-পুরুষের একটা বংশলতিকা গোছের কি আছে না?”

“আছে একটা। সাতও হতে পারে, দশও হতে পারে।”

“সেটা একবার পাঠিয়ে দিতে পারো না?”

“অনায়াসেই পারি।”

“তা হলে পাঠিয়ে দিও, এ-বেলাতে।…এবার আর একটা কথা বলল, তোমার বাবা কাকারা তিন ভাই ছিলেন তো?”

“হ্যাঁ। তিন ভাই দুই বোন।”

“অমূল্যের বাবা তোমার মেজো কাকা? ছোট কাকা মারা গেছেন। কবে তুমি জানো?”

“জানি বই কি। বছর বারো–হাঁ, মোটামুটি তাই হবে।”

“তুমি বলেছিলে, এখানে মারা যাননি।

“না। ছোটকাকার শেষের দিকে সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসী ভাব হয়েছিল। বাড়ি ছেড়ে চলে যেত। কোথায় ঘুরে বেড়াত কে জানে! কেউ বলত শ্মশানে বসে সাধনা করে, কেউ বলত পঞ্চকোট পাহাড়ের তলায় ধুনি জ্বেলে বসে থাকে। আমরা সঠিক কিছু জানি না।”

“ছোটকাকা মারা গিয়েছেন, এটা কেমন করে জানলে?”

“একদিন এক গেরুয়া-পরা সন্ন্যাসী এসে খবর দিয়েছিল।”

“কী ভাবে মারা গিয়েছিলেন ছোটকাকা?”

“সাপের কামড়ে।”

“মৃতদেহ তোমরা কেউ দেখোনি তো?”

 “না। বরাকর নদীতে মৃতদেহ ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল।”

“সেই কাকার কে কে আছে?”

“কাকিমা বেঁচে আছেন। কাকার ছেলেমেয়ে নেই। কাকিমা এখানে। কেন না। বহুকাল। বাপের বাড়ি কাশীতে সেখানেই থাকেন। আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক একেবারেই নেই। তা তুমি এ-সব জিজ্ঞেস করছ কেন? সবই তো আগে শুনেছ।”

কিকিরা তারাপদর দিকে আঙুল তুলে দেখালেন, “তারাপদ শুনে রাখল।…যাক, তুমি একবার তোমাদের ওই বংশের লিস্টিটা পাঠিয়ে দাও। ভাল করে একবার দেখব। আর শোনো, আজ বিকেলে আমি আর তারাপদ একবার ঘোড়া-সাহেবের কুঠিতে যাব। তারাপদকে দেখিয়ে আনব কুঠিটা। তুমি কিছু ভেব না। আমরা সাবধানে যাব-আসব।”

.

০৫.

ফকির রায়দের বাড়ি থেকে ঘোড়া-সাহেবের কুঠি মাইল দুয়েকের পথ। মাঠঘাট ভেঙে গেলে সামান্য কম। ফকির চেয়েছিলেন, কিকিরাদের সঙ্গে নকুল যাক জিপ নিয়ে; কিকিরা রাজি হননি। জিপের দরকার নেই, মাঠ ভেঙে হাঁটাপথে তাঁরা চলে যাবেন। জিপ সঙ্গে থাকলে পাঁচজনের চোখ পড়বে, হাঁটাপথে বেড়াতে বেরুলে কে আর নজর করবে।

বিকেলে ছোট হয়ে আসছে, আলো থাকতে-থাকতেই কুঠিতে পৌঁছতে চান কিকিরা পড়ন্ত বেলার রোদ নিস্তেজ হয়ে আসার আগেই তিনি বেরিয়ে পড়লেন তারাপদকে নিয়ে।

রোদ সরাসরি মুখে লাগায় সামান্য অস্বস্তি হচ্ছিল তারাপদর। নয়ত এই হাঁটাপথ তার ভালই লাগছিল এখানকার মাঠের চেহারা খানিকটা আলাদা, অনবরত উঠছে আর নামছে, যেন ঢেউ-খেলানো মাঠ, মাটির রঙ কোথাও কোথাও গেরুয়া রঙের হলেও বেশির ভাগটাই কালচে গোছের। পায়ে-পায়ে পলাশ-ঝোপ, আর আকন্দ। কিকিরা চিনিয়ে দিচ্ছিলেন ওটা শিশুগাছ, ওকে বলে অর্জুন।

কিকিরা যে এই অঞ্চলের অনেক কিছুই জানেন, বেশ বোঝা যাচ্ছিল। এমনকী, তিনি ঘোড়া-সাহেবের কুঠি যাবার মেঠো রাস্তাও বেশ চেনেন।

তারাপদ একবার ঠাট্টা করেই বলেছিল, “কিকিরা স্যার, ঠিক রাস্তায় নিয়ে যাবেন তো?”

কিকিরা জবাব দিয়েছিলেন, “চলো দেখবে, সব জায়গায় মাকা করে এসেছি।”

কথাটা ঠিকই। কদিন আগেই কিকিরা ফকিরের বাড়িতে এসে দশ-পনেরো দিন থেকে গিয়েছেন, তখন লোচনকে নিয়ে বার তিনেক এই হাঁটাপথেই ঘোড়া-সাহেবের কুঠিতে গিয়েছেন এসেছেন। অবশ্য কোথায় কী মাকা করে এসেছেন তিনিই জানেন।

মাঠ দিয়ে যেতে-যেতেই সামান্য তফাতে কয়লাখনিও চোখে পড়ছিল। লোহার উঁচু-উঁচু থাম, তার মাথায় বিশাল চাকা ঘুরছে, ডুলি উঠছে নামছে, কয়লার টব গাড়ি ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে কুলি মজুর, এক-এক জায়গায় কয়লার পাহাড় জমে আছে, বাতাসে কেমন কয়লা-কয়লা গন্ধ।

বেশ খানিকটা রাস্তা এগিয়ে এসে গাছপালা ঝোপঝাড় পাওয়া গেল। ছায়াও ঘন। তারাপদ বলল, “স্যার, একটু জল খেয়ে নিই। আপনার বন্ধুর বাড়িতে যেভাবে খেয়েছি, তাতে গলা পর্যন্ত বুজে আছে এখনো।”

তারাপদর কাঁধেই জলের বোতল ঝুলছিল। কিকিরাই নিতে বলেছিলেন। তারাপদ জল খেল।

কিকিরাও জল খেয়ে নিলেন। ঢিলেঢালা পোশাক তাঁর, হাতে একটা সরু ছড়ি, হাতলটা ছাতার হাতলের মতন বাঁকানো। ঘন খয়েরি রঙ ছড়িটার; বোঝাই যায় না ওটা লোহার।

জল খেয়ে তারাপদ একটা সিগারেট ধরাল। আবার হাঁটতে লাগল দুজনেই।

হাঁটতে হাঁটতে কিকিরা বললেন, “তোমায় একটা কথা জিজ্ঞেস করি, তারাপদ। ফকিরদের যে বংশতালিকা দেখলে, তা থেকে কিছু আন্দাজ করতে পারো?”

তারাপদ বলল, “সত্যি কথা বলতে কী কিকিরা, ওই টেবল–কিংবা বলুন চার্ট-এর ছেলে অমুক, তার ছেলে তমুক–এসব আমার মাথায় ঢোকে না। একরাশ নাম দেখলাম এই মাত্র।”

“তা ঠিক। নাম থেকে কী আর বোঝা যায়?” বলে সামান্য চুপ করে থেকে কিকিরা আবার বললেন, “আচ্ছা, ফকিরের ছোটাকাকা সম্পর্কে তোমার কী মনে হয়?”

“ছোটকাকা! মানে সেই সন্ন্যাসী! তিনি তো মারা গিয়েছেন।”

“হ্যাঁ। কিন্তু কেউ চোখে দেখেনি। লোকের মুখের খবর থেকে জেনেছে ফকিররা।”

তারাপদ বেশ অবাক হয়ে কিকিরার মুখের দিকে তাকাল।”আপনার কথা বুঝলাম না। আপনার কি মনে হয়, ছোটকাকা মারা যায়নি?”

“তা আমি বলছি না। হয়ত গিয়েছেন। ..আবার ধরো, না-ও যেতে পারেন?”

“মানে?”

“মানেটা তো এখন বোঝা যাচ্ছে না। …তা ছাড়া আরও একটা ব্যাপারে আমার খটকা লাগছে। ফকিরের ঠাকুরদারা দুই ভাই। বড় হলেন ফকিরের ঠাকুরদা। ছোটজনের একটি ছেলের নাম দেখতে পেলাম ওই লিস্টিতে, কিন্তু তারপর আর কোনো নাম নেই। অর্থাৎ ফকিরের ছোট ঠাকুরদার বংশের একজনকে পাচ্ছি। অন্যরা কোথায়? কেউ কি ছিল না?”

তারাপদ এত জটিল ব্যাপার বুঝল না। বলল, “আপনার সন্দেহ আমি বুঝতে পারছি না।”

কিকিরা হাঁটতে হাঁটতে বললেন, “বিষয়-সম্পত্তি, ধন-দৌলত নিয়ে বড়বড় রাজরাজড়াদের মধ্যে যত না গণ্ডগোল বাধে, এই সব ছোটখাট রাজা-টাইপের লোকের মধ্যে তার চেয়ে ঢের বেশি গোলমাল। উটকো বড়লোকদের মধ্যে আকছাড়। তা ছাড়া এই সব এলাকায় পারিবারিক ঝগড়াঝাটি, খুনোখুনি, মামলা-মকদ্দমা খুব বেশি। আমার মনে হচ্ছে, ফকিরদের ফ্যামিলিতে আরও কিছু রহস্য আছে।”

“সে তো আপনারই জানার কথা। ফকিরবাবু আপনার বন্ধু।”

“বন্ধুরাও সব সময় সব কথা বলে না। যেমন আজ ফকির বলল, তার ছেলে বিশু ছুঁড়েছিল। আমার কিন্তু কথাটা বিশ্বাস হচ্ছে না।”

তারাপদ কোনো কথা বলল না। বরং কিকিরার মাথায় কেমন করে এত। চিন্তা আসে ভেবে অবাক হচ্ছিল।

আর কিছুক্ষণ হেঁটে আসার পর কিকিরা তাঁর ছড়ি তুলে দূরে কিছু দেখালেন। বললেন, “ওই যে দেখো, দেখতে পাচ্ছ? ওটাই ঘোড়া-সাহেবের কুঠি।”

তারাপদ দূরে তাকাল। গাছপালার জঙ্গলের মতন খানিকটা জায়গা, ঘর বাড়ি কিছুই চোখে পড়ে না। তারাপদ বলল, “ওই জঙ্গলটা?”

“আর-একটু এগিয়ে গেলেই দেখতে পাবে।”

বেশি এগিয়ে যেতে হল না, গাছপালার ফাঁক দিয়ে একটা বাড়ির সামান্য অংশ চোখে পড়ল। তারাপদ বলল, “নদী কোথায়? আপনি বলেছিলেন বাড়ির পাশে নদী আছে?”

“নদী নয়; নালা। এখানকার লোক নদীই বলে। নুনিয়া নদী। এখান থেকে দেখতে পাবে না। বাড়ির কাছে গেলে পাবে। নুনিয়া ও-পাশ দিয়েই চলে গিয়েছে।”

“জল নেই?”

“বর্ষাকালে থাকে। ভরেই থাকে। এখন হাঁটুতক থাকতে পারে। চলো, দেখা যাবে।”

“আপনি কদিন আগেই এসেছিলেন, তখন ছিল?”

“অল্প।”

কথা বলতে বলতে কুঠির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল তারাপদরা। সামান্য পরে একেবারে কাছাকাছি এসে গেল।

ঘোড়া-সাহেবের কুঠির কাছাকাছি এসে তারাপদ থমকে দাঁড়াল।

কিকিরার কথা থেকে এতটা বোঝেনি সে। এখন বুঝতে পারছে। বিশাল-বিশাল গাছপালায় ঘেরা একটা পরিত্যক্ত, ভাঙা দুর্গর মতনই দেখতে। মনে হয়, এককালে এখানে বোধ হয় কোনো রাজাটাজা দুর্গ বানিয়ে থাকত। কিকিরা বললেন, “এদিক দিয়ে এসো। পেছন দিক দিয়ে যাব।”

“কেন? সামনে কেউ থাকে?”

“সাবধানের মার নেই। তা ছাড়া সামনে দিয়ে ঢুকতে পারব না। সদর-ফটকটা কাঁটা-তার দিয়ে জড়িয়ে রেখেছে। আসা-যাওয়ার পথ বন্ধ। আগাছার পাঁচিল হয়ে গেছে ওখানটায়।”

তারাপদ কিকিরার কথামতন তাঁর পেছনে-পেছনে এগুতে লাগল। নালার মতন নদীটাও চোখে পড়ল এবার। বাড়ি আর পাথর, মাঝ-মধ্যিখানে গোড়ালি-ডোবা জল। চারদিক ফাঁকা মাঠ আর মাঠ, একেবারে নেড়া মাঠই বলা যায়, গাছপালা নামমাত্র।

এবড়ো-খেবড়ো জমি, কাঁটা-ঝোপ, বনতুলসীর ভেতর দিয়ে এগুতে-এগুতে তারাপদ বুঝল, কিকিরা একটা ঢোকার রাস্তা আগেই বেছে রেখে গিয়েছেন। অবশ্য না বেছে রাখলেও চলত, কেননা কুঠিবাড়ির চারদিকে যে মানুষ-সমান উঁচু পাঁচিল, তার অনেক জায়গাই ভেঙে গিয়েছে, ভেতরের গাছপালার শেকড় পাঁচিল ফাটিয়ে দিয়েছে। তা ছাড়া ওই আম-জাম-জারুলের ডালপালা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে, সামান্য চেষ্টা করলেই পাঁচিলের বাইরে হাত পাওয়া যায়।

রোদের তাত আর নেই, আলোও মরে এসেছে। চারদিক থেকে গাছপালার জংলা গন্ধ ছড়াচ্ছিল, বনতুলসীর গন্ধ বেশ ভারী, অজস্র নয়নতারা ফুটে আছে, কাঁটাঝোপে নানা রঙের ছোট-ছোট ফুল।

অনেকটা হেঁটে এসে কিকিরা বললেন, “এসো। ওই ফাটলটার মধ্যে দিয়ে ঢুকে যাব।”

“পেছনে কোনো ফটক নেই?”

“আছে। গোটা দুয়েক আছে। ছোট ছোট। সেদিকটা এত অপরিষ্কার নয়। তবু ওখান দিয়ে ঢুকব না।”

“কেন বলুন তো? বাড়ির চেহারা দেখে মনে হচ্ছে এখানে কেউ ভুলেও পা দেয় না। এক যদি ভূতটুত থাকে তো আলাদা কথা।” তারাপদ ঠাট্টা করেই বলল শেষের কথাগুলো।

কিকিরা বললেন, “ভূতের কাছে সাহস দেখানো ভাল। কিন্তু অদ্ভুতের কাছে নয়। এখানে যদি অদ্ভুত কিছু দেখো। এসো। সাবধানে আসবে।”

ভাঙা পাঁচিলের গায়ে আতা ঝোপ, কোনোরকমে শরীরটাকে গলানো যায়। কিকিরা রোগা মানুষ, দিব্যি গলে গেলেন। তারাপদ কিকিরার মতন করে সাবধানে ভেতরে মাথা গলিয়ে দিল।

পাঁচিলের এ-পারে গাছ। লতাপাতার জঙ্গল। দু-চার পা এগুতেই বড় বড় গাছের সারি। কতকালের পুরনো। ডালপালায় ছায়া করে রেখেছে নিচেটা। খানিক পরে সূর্য ডুবে গেলে হয়ত অন্ধকার হয়ে যাবে।

কিকিরার পাশে-পাশে আসছিল তারাপদ। গাছপালা পেরিয়ে আসতেই ঘোড়া-সাহেবের কুঠির মুখোমুখি হল। না, তারাপদই কল্পনাই করতে পারেনি এই কুঠি এত বড়, শুরু আর শেষ চোখে যেন ধরাই যায় না। বিশাল বাড়ি। গড়নটা কলকাতার পুরনো সাহেববাড়ির মতন, অন্তত পাশ থেকে সেই রকমই দেখাচ্ছে। পাথরের বাড়ি। রোদে বৃষ্টিতে পড়ে থাকতে থাকতে পাথরের গায়ে। শ্যাওলা ধরে-ধরে কালচে রঙ হয়ে গিয়েছে। বিশাল বিশাল জানলা। জানলার মাথাগুলো বাঁকানো। খড়খড়ি-করা পাল্লা। কোনোটা বন্ধ, কোনোটা ভেঙে জানলার গায়ে ঝুলছে। ভেতরের শার্সিও ভাঙাচোরা। বাড়ির গা-বেয়ে বাঁধানো নালা ছিল চারপাশে জল যাবার জন্যে, আর্বজনায় ভরতি হয়ে সেখানে আগাছা জন্মেছে নানারকমের।

বাড়িটা দোতলা হলেও অনেক অনেক উঁচু দেখাচ্ছিল। সেকালের বাড়ি, তার ওপর সাহেববাড়ি–উঁচু, উঁচু-ছাদ দোতলাই বোধ হয়, সাধারণ বাড়ির চারতলার কাছাকাছি। তারাপদ বলল, “কত উঁচু হবে? ওই ছাদ পর্যন্ত?”

“তা বলতে পারব না। আগেকার দিনে বাংলোবাড়ির ঘরও যত বড় হত, মাথার ছাদও তত উঁচু হত। এতে ঘর ঠাণ্ডা থাকে, বাতাস-চলাচল ভাল হয়। আসলে, এইটেই ছিল তখনকার ধরন। কলকাতার বনেদি পুরনো বাড়িতেও এই রকম ব্যবস্থা।”

“আপনি তেতলা থেকে লাফ মারার কথা বলছিলেন না? তেতলা কোথায়?”

 “এ-বাড়ির দোতলার ছাদ কম করেও সাধারণ বাড়ির তেতলা হবে। তাই নয়? আমি কতটা উঁচু থেকে লাফ মারা হয়েছিল সেটা বোঝাতে চেয়েছিলাম। ধরো, পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ ফুটের কাছাকাছি হবে ছাদটা।”

তারাপদ অত বুঝল না।

কিকিরা ধীরে-ধীরে বাড়ির সামনের দিকে এগুতে লাগলেন। এক সময় বাংলো ঘিরে রাস্তা ছিল। সেই রাস্তা এখন ঘাস আর বুনো লতায় ভরতি, ফাটল ধরেছে, এবড়ো-খেবড়ো হয়ে আছে।

“একটু সাবধানে,” কিকিরা বললেন, “সাপখোপ আছে কিন্তু।“

তারাপদ সঙ্গে-সঙ্গে লাফিয়ে উঠল। সাপের নামে গা শিরশির করে উঠেছিল। বলল, “আপনি কি আমাকে সাপের মুখে ফেলবেন?”

কিকিরা হাসলেন। “কলকাতার ছেলে তোমরা, সাপের নামেই চমকে ওঠো। না, তোমায় সাপের মুখে ফেলব না। আমি নজর রাখছি।”

তারাপদ ভয়ে-ভয়ে বলল, “বিষাক্ত সাপ রয়েছে?”

“থাকলে বিষাক্ত থাকবে,” কিকিরা মজার গলায় বললেন।”কেউটে, গোখরো?”

তারাপদ দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল, “তা হলে আর এগিয়ে দরকার নেই ফিরে চলুন। বিকেল শেষ হয়ে আসছে। এখুনি ঝপ করে অন্ধকার হয়ে যাবে। সাপের মুখে পড়ার চেয়ে ফিরে যাওয়াই ভাল।”

কিকিরা বললেন, “তা ঠিক। অন্ধকারে এ বাড়ির চারপাশে ঘোরাঘুরি করা ভাল না। বিপদ হতে পারে। বাড়িটা তোমাকে চোখের দেখা দেখাবার জন্যে এনেছিলাম। কেমন দেখছ?”

“পুরনো সাহেবি কেল্লার মতন?”

কিকিরা তাঁর ঢিলেঢালা পোশাকের ভেতর থেকে বায়নাকুলার বের করে তারাপদকে দিলেন। বললেন, “এটা চোখে দিয়ে দেখো।”

তারাপদ দূরবীন চোখে লাগিয়ে দেখতে লাগল বাড়িটা। সেকেলে কোনো বিশাল ইমারতের মতনই দেখাচ্ছিল। দেওয়ালের গায়ে গাছ পর্যন্ত গজিয়ে গিয়েছে।

“কত ঘর আছে জানো এই বাড়িটায়?” কিকিরা বললেন, “মোটামুটি কুড়ি পঁচিশটা। বাড়িটা সামনের দিকে ছিল ঘোড়া-সাহেবের অফিস। পেছনে থাকত খানসামা, বাবুর্চি, আয়া। আস্তাবল ছিল আলাদা। ঘোড়া থাকত। সাহেব থাকত ওপরে। বুড়োবুড়ি। মেয়ে থাকত দার্জিলিংয়ে। ছেলে বিলেতে।”

তারাপদ লক্ষ করছিল, বিকেল পড়ে যাবার পর খুব তাড়াতাড়ি ছায়া ঘন হয়ে আসছে। হয়ত আর আধ ঘণ্টার মধ্যে অন্ধকার নেমে যাবে। তার অশান্তি হচ্ছিল। ভয় করছিল। এত গাছপালা জঙ্গলের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে তার সাহস হচ্ছিল না। বাড়িটাও ভীষণ ভুতুড়ে দেখাচ্ছিল। দূরবীন নামিয়ে নিল তারাপদ।

কিকিরা আবার এগুচ্ছেন দেখে তারাপদ বলল, “আবার কোথায় যাচ্ছেন?”

“চলো, সামনেটা একবার দেখে আসবে?”

“না। অন্ধকার হয়ে যাবে।”

“হবে না। এসো। আমার সঙ্গে টর্চ আছে।”

“আপনি স্যার বেশি-বেশি সাহস দেখাচ্ছেন। অন্ধকার হয়ে গেলে ঝোপঝাড় গাছপালা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাব কেমন করে?”

“চলে যেতে পারব। এসো। দাঁড়িয়ে থেকো না।”

অনিচ্ছাসত্ত্বেও তারাপদ পা বাড়াল। তার ভাল লাগছিল না।

খানিকটা এগিয়ে তারাপদ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। কিকিরাও দাঁড়ালেন।

”কিসের শব্দ?” তারাপদ বলল।

”বাড়ির ভেতর থেকে আসছে?” কান পেতে থাকলেন কিকিরা।

 শব্দটা দূরে মেঘ ডাকার মতন লাগছিল অনেকটা। বাড়ল। তারপর থেমে গল হঠাৎ।

তারাপদর গলা শুকিয়ে গিয়েছিল। কিকিরার দিকে তাকিয়ে থাকল বড়বড় চোখ করে।

কিকিরা যেন কিছু ভাবছিলেন। বললেন, “না, ফিরেই চলল।”

“শব্দটা কিসের?”

“বুঝতে পারছি না। মনে হল, কোনো ভারী জিনিস কেউ সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে দিয়েছে। কাঠের সিঁড়ি। শব্দ হচ্ছিল।”

“বাড়িতে কেউ আছে তা হলে?”

“থাকাই সম্ভব। যে আছে, সে হয়ত আমাদের দেখতে পেয়েছে। বোধ হয় ভয় দেখাল।” কিকিরা তারাপদকে টেনে নিয়ে ফিরতে লাগলেন।

.

০৬.

অষ্টমী পুজোর দিন সকাল থেকেই মেঘলা। বেলা বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে মেঘলা আরও ঘন হয়ে এল। বৃষ্টি যেন মেঘের নিচে দাঁড়িয়ে আছে–যে-কোনো সময় ঝাঁপিয়ে পড়বে। এরই মধ্যে ফকির রায়দের ঠাকুর-দালানে পুজো চলছিল। ঢাক বাজছে, ফকিরদের বুড়ো পুরোহিত পুজোয় বসেছেন, অন্দরমহলের লোকজন বাইরে, ঠাকুর-দালানে, গ্রামের অনেকেই এসেছে পুজোতে। কলকাতার বারোয়ারি পুজো নয়, গ্রামের বাড়ির পুজো, তারাপদ একপাশে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ পুজো দেখল। ভালই লাগছিল তার। শহুরে জাঁকজমক নেই, অথচ কিসের যেন এক সাদামাটা সৌন্দর্য রয়েছে।

শেষ পর্যন্ত তারাপদ ঠাকুর-দালান ছেড়ে চলে এল। ঘরে গেল না। কাছাকাছি খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরি করার জন্যে বেরিয়ে পড়ল। বৃষ্টি আসতে পারে। এলেও ক্ষতি নেই। কাছাকাছি থাকবে তারাপদ।

ফকির রায়দের বাড়ির শ’খানেক গজের মধ্যেই গ্রাম। বোধ হয় গ্রামের শুরু, কেননা, যত পুব দিকে যাওয়া যায় ততই ঘরবাড়ি বেশি করে চোখে পড়ে। পাকা বাড়ি, কাঁচা বাড়ি, দুরকম বাড়ি রয়েছে। চোখে দেখলে মনে হয়, নিতান্ত ছোট গ্রাম নয়। তিরিশ-চল্লিশ ঘর লোকের বসবাস তো নিশ্চয়। কোথাও আকন্দগাছের বেড়া, কোথাও কাঁটাগাছের, বাঁশের খুঁটি আর কাঁটাতার দিয়েও কেউ-কেউ বেড়া বেঁধেছে, নানা ধরনের গাছপালা, শিউলী করবী জবা, কোথাও লাউ কিংবা কুমড়োর মাচা। পুজো বলেই বাড়ির সামনে দাওয়া নিকোনো, গ্রামের মুদির দোকানের বেঞ্চিতে বসে আছে কেউ কেউ, ময়রা-দোকানে ফুলুরি ভাজা চলছে, একরাশ ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে।

তারাপদ যেন মজা পাচ্ছিল। ফুলুরি খাবার সাধ হলেও সে এগুল না। সময় বুঝে এক বেলুনঅলাও হাজির হয়েছে। কাঁধে কাগজের খেলনা, কাঁধের ঝুলিতে বেলুন, এক হাতে সাইকেলের পাম্প, মুখে একটা বিচিত্র হুইসল। মাঝে মাঝে হুইসল বাজাচ্ছে।

এগিয়ে আসতেই তারাপদ পুকুর দেখতে পেল। খুব বড় না। পুকুরের চারদিকে কিছু গাছপালা। জনা-দুই লোক পুকুরের পাশে সবজি-খেতে কাজ করছে।

আরও সামান্য এগুতেই পেছন থেকে যেন কে ডাকল। দাঁড়াল তারাপদ। ঘর তাকাল।

বাউল বৈরাগী গোছের কে একজন এগিয়ে আসছে। বোধ হয় গাছপালার আড়ালে ছিল–চোখে পড়েনি।

কাছে এসে লোকটি তারাপদকে দেখল সামান্য, তারপর হাত জোড় করে নমস্কার করল। ”বাবু লতুন বটে। চিনতে লারছি।”

তারাপদ লোকটাকে নজর করতে লাগল। বয়েস হয়েছে। একমাথা বাবরি চুল। জট পড়েছে যেন। মুখে দাড়ি, অর্ধেক সাদা হয়ে গেছে। গায়ে একটা আলখাল্লা ধরনের জামা। হয়ত কোনোকালে কালো জামাটার রঙ গেরুয়া ছিল, এখন মাটির মতন রং ধরেছে। পায়ে ছেঁড়া-ফাটা চটি। লোকটা মাথায় লম্বা। তবে রোগা। মুখের আদলও লম্বা। সাদামাটা নিরীহ মুখেই তাকিয়ে ছিল লোকটা।

তারাপদ বলল, “হ্যাঁ, আমি নতুন।”

“কুথা থেকে আসছেন বটে?”

“কলকাতা।”

“কে আছেন হেথায়? লিজের লোক?”

“ফকিরবাবুর বাড়িতে উঠেছি। তুমি এখানে থাকো?”

“আজ্ঞা না। আমার গাঁ দামড়া। চতুর্দিকেই ঘুরি ফিরি।…বাবু ঘুরতে এসেছেন?”

“হ্যাঁ, বেড়াতে।”

“একা বটে?”

“না,” মাথা নাড়ল তারাপদ।”সঙ্গে লোক আছে বলেই তারাপদ হঠাৎ কেমন সাবধান হয়ে গেল। সন্দেহের চোখে লোকটাকে দেখল।”তোমার নাম কী?”

লোকটা আচমকা কেমন থতমত খেয়ে গেল। মুখে একই রকম হাসি। সামান্য যেন শুকনো দেখাল হাসিটা। তারপর বলল, “আমাদের নির্দিষ্ট ডাক আই, বাবু। যে যেমন ডাকে। কেউ হাঁকে খেপা, কেউ ডাকে বোরেগি। আমার নাম শশিপদ পঙ্খি।”

তারাপদ হাসির মুখ করল।”বাঃ, বেশ নাম।”

আরও দু-একটা মামুলি কথার পর তারাপদ আকাশের দিকে তাকাল। বলল, “বৃষ্টি আসবে। আমি চলি।”

শশিপদ দাঁড়িয়ে থাকল। তারাপদ ফিরতে লাগল। অনেকটা এগিয়ে এসে পেছন ফিরে তাকাল একবার, দেখল, শশিপদ পুকুরের দিকে চলে যাচ্ছে।

তারাপদ খুব সময়ে বাড়ি পৌঁছে গিয়েছিল। বৃষ্টি নেমে গিয়েছে। দু-চার ফোঁটা জল গায়ে মাথায় মেখে তারাপদ কিকিরার ঘরে গিয়ে হাজির।

কিকিরা জানলার কাছে চেয়ার টেনে বসে আছেন। সামান্য তফাতে টেবিলের ওপর একটা বন্দুক পড়ে আছে।

তারাপদ বেশ অবাক হল। বন্দুক কেন ঘরে! কার বন্দুক?

“ঘরে বন্দুক কেন, কিকিরা?” তারাপদ বলল।

কিকিরা খুবই অন্যমনস্ক। কিছু ভাবছেন। আজ সকালেও তারাপদ। কিকিরাকে অন্যমনস্ক দেখেছে।

তাকালেন কিকিরা। ”বেড়ানো হল?”

“হ্যাঁ, তা হয়েছে। কিন্তু বন্দুক সামনে রেখে বসে আছেন কেন?”

“দেখছিলাম। বোসো।”

জলের ছাট এদিকের জানলায় আসছে না। বাইরের কালচে রঙ আরও ঘন হয়ে বৃষ্টি বেশ জোরেই নেমেছে।

তারাপদ একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল। বলল, “ফকিরবাবুর বন্দুক?”

মাথা নাড়লেন কিকিরা। “না। আমার।”

“আপনার বন্দুক? আপনার বন্দুক হল কবে?” তারাপদ বিশ্বাস করতে পারছিল না। আবার একবার বন্দুকটার দিকে তাকাল।

কিকিরা বললেন, “ওটা আমারই বন্দুক। ম্যাজিক বন্দুক বলতে পারো। ম্যাজিক দেখবার সময় দরকার হত। বাইরে থেকে কিছু বুঝবে না। ভেতরে তেমন কিছু নেই।”

তারাপদ নিশ্বাস ফেলল।”সত্যি বন্দুক তা হলে নয়। ওটা আপনি আনলেন কেমন করে? সঙ্গে তো দেখিনি?”

“ট্রাংকে ছিল। খোলা যায় পার্টসগুলো।”

“সত্যি কিকিরা, আপনি মিস্টিরিয়াস” তারাপদ হেসে ফেলল। কালো ট্রাংকটায় কি ম্যাজিকের জিনিস ভরে এনেছেন?”

“কিছু কিছু এনেছি। দাও, একটা ধোঁয়া দাও।”

তারাপদ সিগারেটের প্যাকেট দেশলাই দিল ককিরাকে। দুজনেই সিগারেট ধরাল।

তারাপদ বলল, “এবার আপনাকে আমি সারপ্রাইজ দেব। খানিকটা আগে একজনের সঙ্গে আলাপ হল। নাম শশিপদ পঙ্খি। বলল, বৈরাগী।”

তাকালেন কিকিরা। “এই গ্রামের লোক?”

“না, ঠিক এই গ্রামের নয় বলল।” বলে তারাপদ শশিপদর সঙ্গে দেখা হবার ঘটনাটা পুরো বলল।

কিকিরা কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বললেন, “লোচনকে জিজ্ঞেস করলেই বোঝা যাবে, ওই নামে আশেপাশের গ্রামে কেউ থাকে কি না। তা ছাড়া এই গ্রামে আসা-যাওয়া করলে তোক নিশ্চয় তাকে চিনবে।”

“ডাকব লোচনকে?”

“এখন কি তাকে পাবে? শুনেছিলাম, এই সময়টায় সন্ধিপুজো। ফকির তাই বলছিল।”

জানলার বাইরে আরও তোড়ে বৃষ্টি হচ্ছে। মেঘও ডাকছিল। বাইরের দিকে তাকিয়ে তারাপদ বলল, “ফকিরবাবুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল?”

“হ্যাঁ। খানিকটা আগে উঠে গেল। স্নান করে সন্ধিপুজো দেখতে যাবে।”

ইতস্তত করে তারাপদ আবার বলল, “কালকের কথা বলেছেন?”

“বলেছি।..ফকির বিশ্বাসই করল না, ঘোড়া-সাহেবের কুঠিতে কেউ থাকতে পারে। বলল, পুরনো বাড়ি, অনেক কিছুই ভেঙেচুরে পড়ে। হয়ত কিছু ভেঙে পড়েছিল।”

“কোথাও কিছু নেই, ভেঙে পড়বে?”

“হতে পারে। তা আমি ঠিক করলাম, আগামী কাল সকালের দিকে আমরা আবার ঘোড়া-সাহেবের কুঠিতে যাব।” বলে মুহূর্তের জন্যে থেমে আবার বললেন, “এবার শুধু তুমি আর আমি নয়। সঙ্গে ফকির থাকবে। নকুলকেও সঙ্গে নেব। বিশুকে নিতে পারলে আরও ভাল হত। কিন্তু তাকে নেবার। উপায় নেই।”

“বিশুকে কেন নেবেন?”।

“ঠিক কোথায়, কোন জায়গায় খুনের ব্যাপারটা ঘটছিল সেটা জানা দরকার। কখনো শুনছি পুব দিকের ঘরে, কখনো শুনছি উত্তর দিকের ঘরের বড় জানলার কাছে। সঠিকভাবে বলতে পারছে না।”

“যে জানালার কাছেই হোক, তফাত কোথায়?”

“তফাত,” কিকিরা তারাপদর চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে থেকে একটু যেন হাসির মুখ করলেন, “তফাত অনেক। সে তুমি এখনো বুঝতে পারবে না।”

“আপনি বুঝেছেন?”

“না,” মাথা নাড়লেন কিকিরা, “বুঝিনি; বোঝার চেষ্টা করছি।”

তারাপদ চেয়ার ছেড়ে উঠে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। সিগারেটের টুকরোটা ফেলে দিল। বৃষ্টির, তোড় কমে এসেছে খানিকটা। শরৎকালের বৃষ্টির অনেকটা এই ধরন।

কিকিরা বললেন, “তোমার সঙ্গে খানিক পরামর্শ করা যাক।…কাল থেকে আজ পর্যন্ত যা দেখলে তাতে কিছু আন্দাজ করতে পারো?”

তারাপদ ভাবল সামান্য। মাথা নাড়ল।”না, আমি কিছুই আন্দাজ করতে পারছি না। সমস্ত ব্যাপারটাই আমার কাছে অপরিষ্কার।”

“যেমন?”

“প্রথমত ধরুন, ঘোড়া-সাহেবের কুঠি নিয়ে ফকিরবাবুদের মধ্যে রেষারেষি এত বেশি হবে কেন? অন্য পাঁচটা সম্পত্তি যদি তাঁরা ভাগাভাগি করে নিয়ে থাকতে পারেন, এটাও পারতেন। যদি ভাগাভাগিতে রাজি না-থাকতেন, মামলা-মকদ্দমা করতেন–তারপর কোর্টের বিচারে যা হবার হত। মামলা তো ওঁদের হাতের পাঁচ।”

কিকিরা বললেন, “তুমি ঠিকই বলেছ। ফকিররা পাঁচ-সাতটা মামলা তো লড়ছেই, আর-একটা বেশি হলে কোনো ক্ষতি হত না। কিন্তু তারা লড়ছে না। কেন? এর নিশ্চয় কোনো কারণ রয়েছে। কারণটা কী?”

“সে তো আপনার বন্ধু ফকিরবাবু বলবে।”

“ফকির বলছে না। এড়িয়ে যাচ্ছে। ও যা বলছে তাতে মনে হয়, নেহাতই রেষারেষির ব্যাপার। আমার কিন্তু তা মনে হয় না।”

“আপনার কী মনে হয়?”

“ঘোড়া-সাহেবের কুঠির মধ্যে অন্য কোনো রহস্য আছে। সেটা যে কী রহস্য, তা আমি তোমায় বলতে পারছি না।”

“যদি কোনো রহস্য থাকবে–সেটা কি এতকাল পরে জানা গেল?”

 কিকিরা বললেন, “বোধ হয় তাই। তা বলে ভেবো না আমি বলছি দু’দশ দিনের মধ্যে জানা গিয়েছে। হয়ত আরও আগে গিয়েছে। তবে খুব বেশিদিন আগে নয়।”

তারাপদ কী মনে করে ঠাট্টার গলায় বলল, “কোনো গুপ্তধনের খবর পাওয়া গিয়েছে নাকি?”

কিকিরা বললেন, “হতে পারে।”

তারাপদ চুপ করে থাকল।

সামান্য পরে কিকিরাই আবার বললেন, “দ্বিতীয় ব্যাপারটা হল, ফকিরের ছেলে বিশু কেন ঘোড়া-সাহেবের কুঠিতে গিয়েছিল?”

কেন গিয়েছিল তারাপদ জানে না, কিকিরাও নয়। ফকিরও বলেছেন, তিনি জানেন না। সত্যি বলেছেন না মিথ্যে বলেছেন, তিনিই জানেন।

তারাপদ যা শুনেছে, তা এই রকম ঘোড়া-সাহেবের কুঠির কাছাকাছি নুনিয়ার এক পাশে এক সাধু এসে আড্ডা গেড়েছিল। বিশাল এক বটগাছের তলায় বসে থাকত সাধুবাবা। ধুনিও জ্বালাত না, গাঁজাও খেত না। শুধু একটা ত্রিশূল সাধুবাবার সামনে মাটিতে পোঁতা থাকত। সাধুবাবার সঙ্গী বলতে একটা জংলি কুকুর। সাধুবাবার খবর কিছুদিনের মধ্যে সর্বত্র রটে যাবার পর অনেকেই বাবাকে দেখতে যেত। অসুখ-বিসুখের ওষুধ চাইত, ভাগ্যে কী আছে জানতে চাইত। সাধুবাবা কথাবার্তা বড় বলত না, ওষুধ-বিষুধও দিত না। তবে খেয়ালের মাথায়-দু একজনকে গাছ-গাছড়ার কথা বলে দিয়েছে। বিশুর এক বন্ধু আছে কাছাকাছি এক কোলিয়ারিতে। ম্যানেজারের ছেলে। সে-বেচারির মা অসুখে খুব ভুগছিল। ছেলেটার বাবা সাধুবাবার কাছে গিয়েছিল দৈব কোনো ওষুধ চাইতে। বন্ধুর মুখ থেকে সাধুবাবার কথা শুনে বিশু সাধুর কাছে গিয়েছিল। সাধুবাবা বিশুকে পরের দিন একা দেখা করতে বলে। বিশু জিজ্ঞেস করেছিল, কেন সে দেখা করবে? সাধুবাবা কথার কোনো স্পষ্ট জবাব দেয়নি; শুধু বলেছিল “তোর মঙ্গল হবে।”

পরের দিন যাব কি যাবনা করে বিশু সাধুবাবার কাছে যায়। বাড়িতে কাউকে কিছু বলেনি। বিকেলের পর সাধুবাবা বিশুকে যেতে বলেছিল। বিশু সেই সময়েই যায়। বিকেল শেষ হয়ে আসার পর সাধুবাবা অন্য যে দু-পাঁচজন ছিল তাদের সরিয়ে দিয়ে বিশুকে নিয়ে ঘোডা-সাহেবের কুঠির মধ্যে ঢোকে। সঙ্গে অন্য কেউ ছিল না। শুধু কুকুরটা ছিল। কুঠির মধ্যে বেশ খানিকক্ষণ ঘঘারাঘুরি করে শেষে সাধুবাবা তাকে দোতলার বড় একটা ঘরে নিয়ে যায়। সেই ঘরে বিশু আরও দুজনকে দেখতে পায় একজন চরণমামা, মানে অমূল্যর শালা, অন্য একজন চরণের সঙ্গী, বিশু তাকে চেনে না।

সাধুবাবার সঙ্গে চরণমামার কথা কাটাকাটি বেধে যায়, কুকুরটা চেঁচাতে থাকে, আর হঠাৎ চরণমামার সঙ্গী সাধুবাবার কুকুরটাকে বন্দুকের বাট দিয়ে মারে। প্রচণ্ড জোরে। এত আচমকা ঘটনাটা ঘটে যায় যে, বিশু প্রথমটায় ভয় পেয়ে পালাতে যাচ্ছিল। পালাতে গিয়ে তার সঙ্গে চরণের সঙ্গীর ধাক্কা লাগে। বন্দুক পড়ে যায় সঙ্গীর হাত থেকে। বিশু সেটা কুড়িয়ে নিতে যায়। বন্দুকটা সে তুলেই নিচ্ছিল। চরণমামা তার হাত থেকে বন্দুক কেড়ে নেয়। তখনই সাধুবাবাকে গুলি করা হয়। সাধুবাবা জানলা দিয়ে লাফ মারছে–বিশু দেখেছে। তারপর কী হয়েছে, তার খেয়াল নেই। শুধু সে যে পালাতে পেরেছিল, এইটুকু তার মনে আছে।

যা শুনেছে তারাপদ সেই ঘটনা থেকে স্পষ্ট করে কিছুই ধরা যায় না। তবু একবার ঘটনাটা ভেবে নিল।

তারাপদ বলল, “সাধুবাবা বোধ হয় বিশুকে কোনো গোপন খবর দিতে চাইছিল। দেখাতে চাইছিল কিছু।”

কিকিরা বললেন, “হতে পারে। নাও হতে পারে। সেই খবর শোনার জন্যে বিশু গিয়েছিল? না, এমনিই গিয়েছিল? মনে রেখো, বিশু ছেলেমানুষ। ছেলেমানুষের মনে নেহাতই একটা কৌতূহল থাকতে পারে। কিংবা ধরো, বিশু খানিকটা ভয়ও পেয়েছিল। সাধুবাবার কথা না শুনলে পাছে অমঙ্গল হয়।”

“সেই সাধুবাবাই বা কোথায় গেল?”

“সেটাও একটা রহস্য।…রহস্য অনেক। কে এই সাধুবাবা? কোথায় গেল সে? কেন ওই কুঠিবাড়িতে চরণ গিয়েছিল, তার সঙ্গীই বা কে? বন্দুক কেন ছিল চরণদের সঙ্গে? এতগুলো কেনর কোনো জবাবই পাচ্ছি না, তারাপদ।”

তারাপদ বলল, “আপনার একার পক্ষে কি এতগুলো কেন র জবাব খুঁজে পাওয়া সম্ভব, কিকিরা? আমার মনে হয়, ফকিরবাবুর উচিত ছিল পুলিশের কাছে যাওয়া।”

মাথা নাড়লেন কিকিরা।”তাতে লাভ হত না।”

“কেন?”

সাধুবাবাই যেখানে বেপাত্তা, সেখানে বিশু কেমন করে প্রমাণ করত যে, সাধুবাবা তাকে কুঠিতে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল? তা ছাড়া, চরণ আর চরণের সঙ্গী কুঠিতে ছিল, এটাও সে প্রমাণ করতে পারত না। কেননা, চরণরা অস্বীকার করত।”

“তা হল চরণরাই বা কেমন করে বিশুকে ফাঁসাতে পারে?”

“পারে না। পারছে না বলেই চুপ করে আছে। তবে ওরা একেবারে চুপ করে নেই। বাইরে চুপ। ভেতরে-ভেতরে ফকিরকে অস্থির করে তুলেছে।”

তারাপদ চুপ করে থাকল। তার মাথায় কিছু আসছিল না।

বৃষ্টি থামেনি। তোড় অনেকটা কমে এসেছে। কালচে আলো অল্প পরিষ্কার হয়েছে।

মাথার চুল ঘাঁটতে-ঘাঁটতে কিকিরা বললেন, “কাল আমরা ঘোড়া-সাহেবের কুঠিতে যাব। তন্ন-তন্ন করে সব দেখব। চরণরা মিছেমিছি কুঠিতে যাবে না। তারা কেন যেত? কী তাদের উদ্দেশ্য? আর ওই সাধুবাবাই বা কে?”

তারাপদ বলল, “চরণ নিশ্চয় অমূল্যর কথা-মতন কাজ করত? তাই না?”

“নিশ্চয়। তা ছাড়া চরণ লোক ভাল নয়। পাকা শয়তান বলে আমি শুনেছি।”

তারাপদ আর কোনো কথা বলল না।

.

০৭.

পরের দিন ফকিরের যাওয়া হল না। আগের দিন রাত্রে সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় পা হড়কে পড়ে গোড়ালি মচকে ফেলেছেন। বাঁ পায়ের গোড়ালি গোদের মতন ফুলে গিয়েছে; ব্যথা প্রচণ্ড। বসার ঘরে বসে গুলাব লোশান লাগাচ্ছেন।

ফকির যেতে পারলেন না, কিন্তু তিনি নকুলকে সঙ্গে দিলেন। বললেন, “গাড়ি নিয়ে যাও, নকুলও সঙ্গে থাক।”

জিপের রাস্তা সরাসরি নয়, খানিকটা ঘোরা পথে যেতে হয়। রাস্তাও পাকা নয়, কোথাও মাটি আর নুড়ি-ছড়ানো রাস্তা, কোথাও ঘেঁষ ছড়ানো, কোথাও বা একেবারে মেঠো পথ।

সঙ্গে লোচনও ছিল।

যেতে-যেতে সাধারণ কিছু কথার পর কিকিরা লোচনকে বললেন, “সেই শশিপদর খবর পেলে, লোচন?”

“আজ্ঞা না। দামড়া গাঁয়েও লাই।” লোচন বলল।

“নেই তো গেল কোথায়? ওর বাড়ি দামড়া গাঁয়ে।”

 লোচন বলল, “উ মস্ত খেপা, বাবু! আজ হেথায়, কাল হোথায়, কুথায় যে থাকে খেপা, কেউ বলতে লারে। তবে গাঁয়ের লোকে বলল বটে, খেপা গাঁয়ে ঘোরাফেরা করছিল।”

নকুল গাড়ি চালাতে চালাতে বলল, “শশিপদ বড় একটা ওঝা বটে, বাবু। চিতি সাপেরও বিষ নামায়।”

কিকিরা আগ্রহ দেখিয়ে বললেন, “তাই নাকি! শশী তো গুণী লোক হে। শুনি, কিছু বলো বটে উর কথা।”

তারাপদ মুচকি হাসল। কিকিরার কথা শুনেই।

লোচন শশিপদর বৃত্তান্ত বলতে লাগল, মাঝে-মাঝে নকুলও বলছিল দু চার কথা।

শশিপদ দামড়া গ্রামের লোক। বরাবরই খেপাটে ধরনের। একটা কুঁড়ে ঘর আর একফালি সবজি বাগানের বেশি ওর কিছু ছিল বলে কেউ জানে না। গানটান গাইতে পারত শশী। গ্রামের যাত্রাদলে গানটান গাইত। শশীর মাসি মারা যাবার পর অনেকদিন ও আর নিজের গ্রামে ছিল না। কোথায় চলে গিয়েছিল কে জানে। আবার ফিরে এল। একেবারে বোষ্টম বৈরাগীর বেশ। ফিরে আসার পর জানা গেল, শশী ওঝাগিরি শিখেছে। গাছ-গাছড়ার ওষুধ দিতে পারত, কাউকে সাপে কামড়ালে বিষ নামাত। শশিপদর হাতে সাপে কামড়ানো লোক অনেক বেঁচে গিয়েছে। যারা মারা গিয়েছে, তাদের জন্যে শশী অনেক করেছিল, বাঁচাতে পারেনি। সদর হাসপাতালে পাঠিয়েও তো সাপেকামড়ানো রোগী মরে। মোট কথা, শশিপদ খেপা হলেও তার কতক গুণ রয়েছে।

কিকিরা আর-কিছু জিজ্ঞেস করলেন না, শুধু তারাপদকে বললেন, “এদিকে সাপের উৎপাত বেশ, বুঝলে তারাপদ। মাঝে-মাঝেই সাপের কামড়ে লোক মারা যায়।”

তারাপদ প্রথমটা ধরতে পারেনি, পরে কিকিরার চোখের দিকে তাকিয়ে ধরতে পারল। কিকিরা বোধ হয় ফকিরের ছোটকাকার ব্যাপারটা ইঙ্গিত করলেন। অবশ্য, এই দুইয়ের মধ্যে কোনো সম্পর্ক তারাপদ খুঁজে পেল না। ফকিরের ছোটকাকা সাপের কামড়ে মারা গিয়েছেন, আর শশিপদ সাপের ওঝা। এই দুয়ের সম্পর্ক কী?

তারাপদ কিছু জিজ্ঞেসও করল না।

ঘোড়া-সাহেবের কুঠির পেছন দিকে একটা গাছতলায় জিপ রেখে চারজন কুঠির ভাঙা পাঁচিল টপকে ভেতরে ঢুকল।

তারাপদ চারদিকে তাকিয়ে দেখল একবার। মাথার ওপর সূর্য দেখা যাচ্ছে না, গাছে আড়াল পড়েছে, রোদও তেমন গায়ে লাগে না বড় বড় গাছপালার জন্যে। পাখির ডাক ছাড়াও কোথাও কোনো শব্দ নেই। নির্জন, নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছে কুঠিটা। আলোয় স্পষ্ট।

আগের বার বিকেলের দিকে এসেছিল বলে, কিংবা প্রথম এসেছিল বলেই তারাপদর ভয়-ভয় লেগেছিল। আজ আর লাগছে না। তা ছাড়া তারা চারজন রয়েছে। নকুল আর লোচন কি কিছু কম!

বাইরে ঘোরাঘুরি না করে কিকিরা প্রথমেই বললেন, “লোচন, সোজা ভেতরে ঢুকব। নকুল, তুমি সবার পেছনে থাকবে। তোমার হাতের ওই লোহার রড়ে শব্দ করো না।”

নকুল গাড়িতে একটা হাত তিনেক লম্বা লোহার রড় সব-সময় রেখে দেয়। সেটা হাতে নিয়ে এসেছে। লোচনের হাতে কিছু নেই। তারাপদরও খালি হাত। কিকিরার হাতে সেই সরু ছড়ি। আলখাল্লা ধরনের ঢিলেঢালা জামার পকেটে কী আছে কে জানে।

কুঠিবাড়ির সামনের দিকে ঢাকা বারান্দা। বারান্দাটা চাঁদের কলার মতন বাঁকানো। বিশাল বারান্দা চওড়াও কম নয়। সাত-আট ধাপ সিঁড়ি উঠে বারান্দা। মাঝের দরজাটা যেন পাহাড়। খোলার উপায় নেই। পাশাপাশি ঘর অনেক। দরজাও রয়েছে পর-পর। একটা দরজার জানলা ভাঙা। লোচন কিকিরাকে ডাকল।

সেই দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকল চারজনেই।

ভেতরে পা দিতেই তারাপদ বিশ্রী গন্ধ পেল। কতকালের ধুলোবালি, আবর্জনা জমে-জমে গন্ধ হয়েছে। বদ্ধ বাতাস। দরজার পাল্লা ভাঙা থাকার দরুন আলো আসছিল মোটামুটি। উলটো মুখের জানলাও আধ-খোলা। তারাপদ পকেট থেকে রুমাল বার করে নাক চাপা দিল।

কিকিরা ঘরটা একবার দেখলেন। একেবারে ফাঁকা ঘর ভেতরের পলেস্তরা ভেঙে পড়েছে, একদিকে কিছু কাঠকুটো জড়ো করা, সাপের খোলস, মরা টিকটিকি, ঝুলে আর মাকড়শার জালের কোনো অভাব নেই। সাপ, ছুঁচো সবই থাকা সম্ভব এই ঘরে।

কিকিরা বললেন, “লোচন, প্রথমে নিচের ঘরগুলো দেখে নিই, পরে দোতলায় উঠব।”

বাড়িটার সুবিধে এই, পাশাপাশি ঘরের মধ্যে আসা-যাওয়া করার জন্যে দরজা রয়েছে, দরজার পাল্লাগুলো ভাঙাচোরা, একটা হয়ত আছে, অন্যটা নেই; কোথাও কোথাও একেবারেই নেই। এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যেতে অসুবিধে হয় না। ঘরগুলো বড়বড়, বেশ বড়, মাথার ছাদ ধরতে হলে লম্বা সিঁড়ি চাই, লোহার কড়ি বরগা, জানলাগুলো বেশির ভাগই বন্ধ, রোদে-জলে কাঠের এমন অবস্থা হয়েছে যে, সেই বন্ধ জানলা আর খোলার উপায় নেই। সমস্ত ঘরেই দুর্গন্ধ। আসবাবপত্রের মধ্যে কদাচিৎ কোনো ভাঙাচোরা চেয়ার কিংবা টেবিল চোখে পড়ে।

কিকিরা তারাপদকে বললেন, “নিচের তলাটা ছিল ঘোড়া-সাহেবের অফিসঘর। এজেন্টেস অফিস।“

তারাপদর মনে হল, অফিসঘর বলেই হয়ত পাশাপাশি ঘরে আসা-যাওয়ার ব্যবস্থা। অফিসের অংশটা মোটামুটি দেখে নিয়ে কিকিরা ভেতর-দরজা দিয়ে সরু বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। এটা ভেতর দিকের বারান্দা। প্যাসেজ বলা যায়। প্যসেজের ওদিকে আরও কতকগুলো ঘর। প্যাসেজের গা দিয়ে চওড়া সিঁড়ি উঠে গিয়েছে দোতলায়। কাঠের সিঁড়ি।

তারাপদ বুঝতে পারল, নিচের তলায় দুটো অংশ। সামনের দিকে অফিস ছিল। পেছনের দিকে কী ছিল? কিকিরা বললেন, “চাপরাশি, পিয়ন, বয়বাবুর্চিরা থাকত।”

প্যাসেজে দাঁড়িয়ে কিকিরা বললেন, “লোচন, ও-পাশে বারান্দায় গিয়ে একবার দেখো তো কোনো দরজা খোলা পাও কি না?”

লোচন বারান্দার দিকে চলে গেল।

তারাপদ বলল, “কিকিস্যার, এটা দেখছি একেবারে ভুতের বাড়ি হয়ে গিয়েছে। এখানে ঢুকলে মানুষ এমনিতেই মরে যাবে।” বলতে বলতে তারাপদ হাঁচল। বদ্ধঘর, ধুলো ময়লা আর দুর্গন্ধে তার মাথা ধরে উঠছিল।

কিকিরা বললেন, “তা ঠিক। তবে ভূতের একটু-আধটু চিহ্ন দেখতে পেলে ভাল হত, তাই না? চলো, দোতলায় চলো, সেখানে যদি দেখতে পাই।”

লোচন ফিরে এল। বলল, দরজা দিয়ে ঢাকার কোনো উপায় নেই। সবই বন্ধ। শুধু বন্ধ নয়, এমনভাবে আটকে আছে যে, একটু নড়ানোও যায় না। তবে ভাঙা জানলা দিয়ে ভেতরে ঢোকা যায়।

কিকিরা একটু ভেবে বললেন, “আগে দোতলাটা ঘুরে আসি। পরে ওদিকটা দেখব, লোচন।”

নকুল হাতের রডটা কাঁধে তুলে এদিক-ওদিক ঘুরছিল। কথাবার্তা বলছিল না। কিন্তু তার চোখমুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল সে খুব সতর্ক, বাইরে গাছপালার শব্দ হলেও কান খাড়া করে শুনেছে।

কিকিরা সিঁড়ি উঠতে লাগলেন। পেছনে তারাপদরা। কাঠের সিঁড়ি। শব্দ হচ্ছিল। পুরু হয়ে ধুলো জমে আছে সিঁড়িতে। ধুলো, পাখির পালক, ঘেঁড়া-খোঁড়া কাগজ, আরও নানান আবর্জনা। সিঁড়ির ধাপ কোনো-কোনোটা নড়বড়ে, কোনোটা আধভাঙা। পায়ের দাগ স্পষ্ট করে বোঝার উপায় নেই, কাঠের রঙ কালচে হয়ে গিয়েছে, ধুলো আর কাঠের রঙ প্রায় এক।

বাইরের আলো থাকায় সিঁড়ি দিয়ে উঠতে কোনো অসুবিধে হল না।

দোতলায় আসতেই বাইরের আলোয় চোখ যেন জুড়িয়ে গেল। অজস্র গাছপালার মাথায় গায়ে শরতের রোদ মাখানো। কাল বৃষ্টি হয়ে যাওয়ায় ঘোওয়া-মোছা গাছপালা যেন সকালের উজ্জ্বল রোদে আরও সবুজ হয়ে গিয়েছে। বাতাসও রয়েছে এলোমেলো।

তারাপদ বেশ কয়েকবার হাঁটার পর রুমালে নাক-মুখ মুছে নিয়ে আলোর দিকে তাকাল।

নিচের তলার মতন দোতলাতেও টানা বারান্দা। বারান্দার ধার ঘেঁষে মোটা মোটা থাম। কোনো কোনো থাম খসে যাচ্ছে। মেঝে ধুলোয় ভরতি, গাছের শুকনো পাতা জমে রয়েছে, আরও নানান রকম আবর্জনা।

কিকিরা প্রথমে বাঁদিকেই পা বাড়ালেন। নিচের তুলনায় ঘরের সংখ্যা কম লাগছিল চোখে। নিচের তলায় পর-পর দরজা ছিল। ওপরে পাশাপাশি দরজা কম। বিশাল-বিশাল দরজা-জানলা। দরজা বন্ধ, জানলা কোথাও-কোথাও খোলা, কাচের শার্সি ভাঙা। সামনের ঘরটারই জানলা খোলা ছিল।

জানলা টপকেই ঘরে ঢুকলেন কিকিরা। তারাপদরাও সাবধানে জানলা টপকাল।

রোদ বা আলো কোনোটাই ঘরে ঢোকার উপায় নেই। জানলা দিয়ে যেটুকু আলো আসছিল।

কিকিরা হাতের টর্চ জ্বাললেন।

তারাপদ টর্চের আলোয় ঘরটা অনুমান করার চেষ্টা করল। এত বড় ঘরে টর্চের আলো কিছুই নয়। ঘরের চারটে দেওয়াল যেন চারপ্রান্তে। বিরাট একটা ভাঙা টেবিল পড়ে আছে একদিকে। কোনো বড়সড় ছবির ভাঙা ফ্রেম। একটা পা মচকানো আর্ম চেয়ার।

কিকিরা টর্চের আলোয় মেঝে দেখালেন। তারাপদর মনে হল, দাবার ছকের মতন দেখতে মেঝেটা। পা দিয়ে ধুলো সরাল।”কিসের মেঝে? কাঠের?”

“সিমেন্টের,” কিকিরা বললেন, “লাল আর কালো রঙ দিয়ে চৌকো ডিজাইন করা।”

লোচন বলল, “মাথার উপর শিকলি ঝুলছে বটে, বাবু।”

কিকিরা টর্চের আলো ফেললেন ছাদের দিকে। একসময় বোধহয় ঝাড়বাতি গোছের কিছু ঝোলাতেন ঘোড়াসাহেব। ঝাড় নেই, কিন্তু গোটা দুয়েক শেকল ঝোলানো রয়েছে। কিকিরা বললেন, “সাহেবের বাতি ঝুলত গো! লাও, চলো।”

জানলা টপকেই বাইরে আসতে হল।

পর-পর তিনটে ঘর দেখলেন কিকিরা। কোনটা কিসের ঘর ছিল বোঝা দায়। কোনোটা হয়ত খাবার, কোনোটা বসার কোনোটা বা শোবার।

বাঁদিকের ঘরগুলো দেখা হয়ে যাবার পর ডান দিকে এগুলেন কিকিরা।

ডানদিকের প্রথম ঘরটার জানলার সবই রয়েছে। কাঁচই যা ভাঙা। দরজা খোলা ছিল।

দরজা দিয়েই ভেতরে এলেন কিকিরা। ফাঁকা ঘর। দুপাটি পুরনো দোমড়ানো জুতো মাত্র পড়ে আছে। বুট জুতো।

কিছুই পাওয়া গেল না। কিকিরা যেন হতাশই হলেন।

আবার বারান্দায় এসে পা বাড়াতেই তারাপদ হঠাৎ বলল, “কিকিরা?”

 “কী?”

 “পায়ের দিকে তাকান”, তারাপদ বলল।

মেঝের দিকে তাকালেন কিকিরা। তাকিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। হাত দিয়ে ইশারায় নোচন আর নকুলকে দাঁড়াতে বললেন।

“কিসের দাগ কিকিরা?” তারাপদ জিজ্ঞেস করল।

মাটিতে বসে কিকিরা ভাল করে নজর করলেন। বললেন, “কোনো ভারী জিনিস টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে যেন। ধুলোটুলোর ঘষটানো দাগ।“ বলে সামনের ঘরের দিকে তাকালেন, দাগটা ঘর পর্যন্ত গিয়েছে। ঘরের দরজা বন্ধ। জানলাও। এতক্ষণে একটিমাত্র জানলা চোখে পড়ল, যা অটুট।

কিকিরা উঠে দাঁড়ালেন।”দরজাটা খোলা যায় কি না দেখ তো, নকুল?”

নকুল প্রথমে ধাক্কা মারল, শেষে লোহার রড গলাবার চেষ্টা করল দরজার ফাঁকে, পারল না।

জানলাটা অবশ্য শেষ পর্যন্ত খোলা গেল।

 কিকিরা জানলা টপকে ভেতরে ঢুকলেন।

 টর্চের আলোয় এই ঘর একেবারে অন্যরকম দেখাল। ঘরটার অনেকটা পরিষ্কার। একপাশে লোহার স্প্রিং দেওয়া খাট, ছোবড়ার গদি রয়েছে খাটের ওপর, যদিও পুরনো গদি। কোণের দিকে মাটির কলসি আর কলাইয়ের অগ রাখা। দু চারটে শুকনোশালপাতা পড়ে আছে ঘরের পাশে। লণ্ঠনও চোখে পড়ল। শিসওঠা কাঁচ। মাদুর গুটিয়ে রেখেছে কেউ।

বাইরের দিকের জানলা বন্ধ ছিল। বড় বড় দুই জানলা। হাত আট-দশ অন্তর। কিকিরা নকুলকে জানলা দুটো খুলে দিতে বললেন, “সাবধানে খুলো হে।”

লোচন আর নকুল জানলা দুটো খুলে দিল। খুলে দিয়েই লোচন যেন কী লল। আলো এল জানলা দিয়ে, ঘর স্পষ্ট হল।

তারাপদ ঘরটা দেখতে লাগল। বিশাল ঘর, সেই একই রকমের লাল কালোর চৌকো-ঘর কাটা সিমেন্টের মেঝে। মাথার ওপর এক জোড়া শেকল ঝুলছে। ঘরের এক কোণে একটা বা দাঁড় করানো।

কিকিরা ডানদিকের জানলার কাছে গিয়ে একমনে কখনো জানলা, কখনো বাইরেটা দেখছিলেন। একবার ডানদিকের জানলাটা দেখেন, আবার গিয়ে বাঁদিকেরটা। জানলার কাঠের ওপর হাত বোলান। বেশ কিছুক্ষণ জানলা দেখার পর তারাপদকে ডাকলেন।

কাছে গেল তারাপদ।

ডানদিকের জানলাটা দেখালেন কিকিরা। তারাপদ অবাক হয়ে দেখল, পর-পর প্রায় গায়ে-গায়ে দুটো জানলা। একই মাপ।

কিকি বাইরের দিকটাও দেখালেন। ”দেখো, নিচেও দেখো।”

তারাপদ অবাক হয়ে দেখল, লোহার একটা ঘোরানো সিঁড়ি নিচে নেমে গিয়েছে। সিঁড়িটা বাড়ির বাইরে থেকে দেখার উপায় নেই, কেননা সিঁড়ির বাইরের তিনটে দিকই ইটের গাঁথনি দিয়ে গোল করে ঘেরা। সেই গাঁথনির জায়গায়-জায়গায় ইট খসে যাওয়ায় আলো ঢুকছে সিঁড়িতে। সুড়ঙ্গর মতন দেখায় সিঁড়িটা।

তাারাপদ সরে গিয়ে বাঁদিকের জানলা দেখল। কিছু বুঝতে পারল না।

 কিকিরা বললেন, “বাঁদিকের ওই জানলা আর এই ডান দিকের জানলাটায় তফাত বুঝতে পারছ? আসলে, ডানদিকেরটা ডবল জানলা। দু আড়াই ফুট তফাত দুটো জানলার মধ্যে। মাঝখানে ফাঁক। সেই ফাঁক দিয়ে গলে গেলেই ওই সিঁড়ি। তুমি লক্ষ করে দেখো, সিঁড়িটা ওপরের দিকে একেবারে জানলা পর্যন্ত উঠে আসেনি। খানিকটা নিচুতে শেষ হয়েছে। তার মানে, এই সামনের দিকের জানলাটা টপকে ফাঁকের মধ্যে দিয়ে গলে গেলেই সিঁড়িটা ধরতে পারা যাবে। আমি যতটা জানি, এই রকম ডবল জানলা একসময় য়ুরোপে দেখা। যেত যুদ্ধবাজ রাজ-রাজড়াদের প্রাসাদে। কেন জানো? তখন কথায় কথায় কাটাকাটি রক্তারক্তি চলত। কে যেন শত্রু হবে কখন, কেউ জানত না। কাজেই, ঘরের মধ্যে আচমকা শত্রুর মুখোমুখি হলে বাঁচবার এই একটা পথ খোলা থাকত। ঘোড়া-সাহেব কেন এমন জানলা বানিয়েছিলেন জানি না। শখ করে কিংবা আভিজাত্যের জন্যে হতে পারে। অন্য কারণও থাকতে পারে।”

তারাপদ বলল, “সাধুবাবা তা হলে এই পথ দিয়েই হাওয়া হয়ে গিয়েছিলেন?

কিকিরা মাথা নাড়লেন, “অবশ্যই।”

“তা হলে এই ঘরেই সেই কাণ্ড ঘটেছিল?”

“এই ঘরে।” বলে কিকিরা নিশ্চিন্তভাবে নিজেই জানলার চারদিক পরীক্ষা করতে লাগলেন।

.

০৮.

ঘোড়া-সাহেবের কুঠি থেকে ঘুরে আসার পর তিন-চারটে দিন দেখতে-দেখতে কেটে গেল। এই কদিনে কিকিরা যেন সামান্য কাহিল হয়ে পড়েছেন। আপন খেয়ালে যে তিনি কী করছেন, তারাপদ বুঝতে পারত না। অর্ধেক সময় ঘরে বসে কিছু ভাবছেন, না হয় কাগজ পেন্সিল নিয়ে কুঠিবাড়ির নকশা করছেন, কিংবা ফকিরের সঙ্গে কথা বলছেন। কিকিরা ফাঁকে ফাঁকে কুঠিবাড়ির বাইরে বাইরেও ঘুরে আসছিলেন লোচনকে নিয়ে। তারাপদকে একরকম ছুটিই দিয়েছেন, বলেছেন তামাশা করে, “নাও হে তারাপদবাবু, খেয়ে আর ঘুমিয়ে গায়ে গত্তি লাগিয়ে নাও ক’দিন, তারপর তোমার এলেম দেখা যাবে। আসুক চন্দন।”

তারাপদর বাস্তবিক কিছু করার ছিল না। খাওয়া আর ঘুম ছাড়া করার কীই বা আছে। ফকিরদের বাড়িতে পুরনো বইপত্তর ছিল, কিছু সেকেলে বই। সেই বই পড়ে সময় কাটাত। আর বিকেলের দিকে ঘুরে বেড়াত এদিক-ওদিক। একদিন কিকিরার সঙ্গী হয়ে কুঠিবাড়ির বাইরেও ঘুরে এসেছে আবার।

কিকিরা যে একটা মতলব আঁটছেন, তারাপদ সেটা বিলক্ষণ বুঝতে পারছিল। কিন্তু মতলবটা কী তা ধরতে পারছিল না।

.

এমন সময় চন্দন চলে এল। এয়োদশীর দিন। স্টেশনে জিপ নিয়ে গিয়েছিল নকুল, সঙ্গে তারাপদ।

জিপ গাড়িতে আসতে-আসতে দু-পাঁচটা কথার পর চন্দন বলল, “কতদূর এগুল ব্যাপারটা?”

তারাপদই বলল, “কিকিরাই জানেন।“

“তুই কিছু জানিস না? তা হলে করছিস কী?”

“আমি কিছুই করছি না। খাচ্ছিাচ্ছি, ঘুমোচ্ছি। আর মাঝে-মাঝে কিকিরার হেঁয়ালি শুনছি।”

“তোর দ্বারা কিছু হবে না, তারা। এত অলস হয়ে গিয়েছিস। ক’দিনে চেহারাটাও তো নাড়র মতন গোল করে ফেলেছিস। গালে চর্বি জমে গিয়েছে।”

তারাপদ হাসল। বলল, “টাটকা দুধ ঘি মাছের ব্যাপার, বুঝলি না?”

চন্দন বন্ধুর পিঠে থাপ্পড় মারল। হাসল। তারপর বলল, “ঘোড়া-সাহেবের কুঠিটা কী বস্তু রে?” কলকাতাতেই কিকিরার মুখে চন্দন ব্যাপারটা মোটামুটি শুনেছিল। বাড়িতে একটা চিঠিও পেয়েছিল তারাপদর।

তারাপদ বলল, “বস্তুটা একটা পুরনো ভাঙাচোরা কেল্লা বলতে পারিস। সেকেলে সাহেবসুবোর ব্যাপার, দু’হাতে টাকা উড়িয়ে বাড়ি বানিয়েছিল।”

চন্দন বলল, “সেখানে কিছু পাওয়া গেল?”

“না। তবে একটা ব্যাপার জানা গিয়েছে। আমি নিজেও দেখেছি প্রমাণ, কেউ একজন ওখানে আস্তানা গেড়েছিল হালে। হয়ত এখনও গেড়ে আছে।”

“লোকটা কে?”

“বলতে পারব না।”

নকুল জিপটাকে থামিয়ে নিয়ে রাস্তার নামল। বনেট খুলে কী যেন করে আবার বন্ধ করল। ফিরে এসে গাড়িতে উঠল।

“কী হয়েছিল, নকুল?” তারাপদ জিজ্ঞেস করল।

”হরনের তারটা খুলে গিয়েছিল বাবু। লাগাই দিলাম।”

আবার গাড়ি চলতে শুরু করলে চন্দন বলল, “কিকিরার বন্ধুর ছেলে কেমন আছে?”

“এখন একটু ভাল শুনেছি। আমি ছেলেটিকে সামনাসামনি দেখিনি। তফাত থেকে দেখেছি।”

অবাক হয়ে চন্দন বলল, “সে কী! তুই আজ হপ্তাখানেক হল এখানে রয়েছিস–ছেলেটাকেই দেখিসনি?”

“কেমন করে দেখব। ও নিচে আসে না। ওকে আসতে দেওয়া হয় না। দোতলায় নিজের ঘরেই থাকে, বেশির ভাগ সময়। কিকিরাও দু-একদিন মাত্র ওপরে গিয়ে ওকে দেখে এসেছেন।”

চন্দন আর কিছু বলল না। সামনের দিকে তাকিয়ে থাকল। নকুল গ্রামের পথ ধরল এবার।

.

দুপুর আর বিকেলটা চন্দন আয়েস করে কাটাল। খেল, ঘুম দিল, তারাপদ আর কিকিরার সঙ্গে বকবক করল। এই একটা হপ্তা কেমন করে কেটেছে তার বৃত্তান্ত শোনাল তারাপদ বন্ধুকে। কিকিরা যতটা পারলেন ফকির, অমূল্য, ঘোড়া-সাহেবের কুঠি এ-সবের ইতিহাস শোনালেন চন্দনকে। তারপর বললেন, “আজ রাত্রে আমরা একটা কনফারেন্স করব, স্যান্ডেলউড তুমি, আমি আর তারাপদ। তার আগে তোমায় একটা-দুটো খুচরো কাজ করতে হবে।”

“কী কাজ?”

“ফকিরের ছেলে বিশুকে একবার দেখবে। আমি ফকিরকে বলে রেখেছি। সেই সঙ্গে ফকিরের পায়ের চোটটা।”

“ফকিরবাবুকে তো সকালে দেখলাম। ও দেখার কিছু নেই। গোড়ালি মচকালে সারতে সময় লাগে।”

“তবু একবার দেখো।”

“বেশ, দেখব।” বলেই চন্দনের কিছু মনে হল, বলল, “বিশু নিচে নামবে, না আমাকে ওপরে যেতে হবে?”

“দেখি কী হয়!…তবে সন্ধের পর আমি আর সময় নষ্ট করতে চাই না, আমরা তিনজনে বসব। বুঝলে?”

মাথা নাড়ল চন্দন। যা বলেছেন কিকিরা, তা-ই হবে।

সন্ধের মুখে চা খাওয়ার সময় ফকির নিজেই বিশুকে নিয়ে নিচে এলেন। ভবানীও সঙ্গে ছিল।

ফকির অল্প খোঁড়াচ্ছিলেন। সকালের মতনই।

কিকিরা বললেন, “তুমি যতটা কম সিঁড়ি-ভাঙাভাঙি করলেই পারো, ফকির। আমরাই ওপরে যেতাম।”

ফকির হাসলেন। বললেন, “চেয়ারে পা তুলে বসে থাকা কি আমাদের পোষায়, কিঙ্কর। আগে এসব চোট গায়ে মাখতাম না। এখন ভাই বয়েস হচ্ছে।” বলে চন্দন আর তারাপদর দিকে তাকালেন।”আমার ছেলেকে আনলাম–” বলে বিশুকে দেখালেন। তারপর ভবানীকে দেখিয়ে বললেন, “আমার ভাগ্নে বিশুর খুব বন্ধু।”

কিকিরা বিশুকে কাছে টেনে নিয়ে আদর করে বসালেন। ভবানীকে বসতে বললেন।

তারাপদ বিশুকে মনোযোগ দিয়ে দেখছিল। ফকির সুপুরুষ ঠিকই, কিন্তু বিশু তার বাবার চেয়েও সুন্দর। বিশুর ভাই অংশুকে আগেই দেখেছে তারাপদ, গল্পটল্পও করেছে। ছেলেমানুষ। স্কুলে পড়ে। অংশুও দেখতে ভাল। তবে বিশুর মতন নয়। ওদের বোন পূর্ণিমাকেও দেখেছে তারাপদ। বাচ্চা মেয়ে। খানিকটা দুরন্ত। সেও চমৎকার দেখতে। মাঝে-মাঝে নিচে এসে কিকিরার ওপর হামলা করে যায়, তারাপদকে বেসমের লাড্ড খাইয়েছিল। বেশ মেয়ে। তবু ভাইবোনদের মধ্যে বিশু সেরা। ছিপছিপে চেহারা, গায়ের রঙ খুবই ফরসা, একমাথা কোঁকড়ানো চুল, কাটাকাটা মুখ-চোখ, ঠোঁট দুটো পাতলা। সবই সুন্দর। কিন্তু বিশুর মুখে কেমন যেন একটা ভয়ের ছাপ, চোখ দুটোয় ঘুম-ঘুম ভাব।

ভবানীকেও দেখল তারাপদ। সাধারণ চেহারা। তবে চালাক-চতুর বলেই মনে হয়। চন্দন বিশুকে দেখছিল। ফকিরকে বলল, “এখানে দেখা হবে না। আপনি ওকে নিয়ে পাশের ঘরে চলুন।” বলেই একটু থেমে হঠাৎ বলল, “আচ্ছা, ওকে কি কোনো ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়?”

“হ্যাঁ। ডাক্তারবাবু যা দিয়েছে, তাই খায়।”

“কবার খায়?”

“দু-তিন বার বোধহয়।”

“এতবার?…আশ্চর্য! চলুন–পাশের ঘরে যাই।”

চন্দন উঠল।

ফকির বিশুকে নিয়ে পাশের ঘরে চলে গেলেন।

কিকিরা ভবানীর সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন। তারাপদ একটা সিগারেট ধরাল। ধরিয়ে বিশুর কথা ভাবতে লাগল।

হঠাৎ কিকিরার একটা কথা কানে গেল। কিকিরা ভবানীকে বলছেন “তুমি এখন এখানেই থাকবে কিছুদিন, না ফিরবে?”

ভবানী বলল, “কালীপুজো পর্যন্ত থাকব।”

তারাপদ অন্যমনস্কভাবে ভবানীর দিকে তাকাল। কেন তাকাল সে, বুঝতে পারল না। চোখের দিকে তাকাল। কটা চোখ। জোড়া ভুরু। তারাপদর কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল।

ভবানী উঠে দাঁড়াল।”আমি যাই, মামা। বড়মামুর দেরি হবে।”

“যাবে? এসো!”

 ভবানী চলে গেল।

তারাপদ দরজার দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর উঠে নিঃশব্দে দরজার কাছে গেল। মুখ বাড়িয়ে দেখল বাইরেটা।

ফিরে এসে নিচু গলায় বলল, “কিকিরা, ভবানী বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।”

কিকিরা বললেন, “তুমি বোসো।”

ফকির আর বিশু আরও খানিকটা পরে এ-ঘরে এল। চন্দনও পেছনে-পেছনে।. ফকির অবশ্য আর বসলেন না, বললেন, “কিঙ্কর, আমরা যাই। সকালে দেখা হবে। …ভাল কথা, কাল একবার অমূল্যদের বাড়ি যাব। খুড়িমাকে প্রণাম করে আসা হয়নি বিজয়ার পর। যাব তো, কিন্তু…তুমি কী বলো?”

কিকিরা একটু ভেবে বললেন, “নিশ্চয় যাবে। একশো বার যাবে। আমি বলি কি, তুমিও একদিন অমূল্যকে কোনো ছুতোয় এ-বাড়িতে ডেকে আনো।”

“ওকে ডেকে আনব? কেন?”

“সে না হয় পরে বলব। ভেবে দেখো ডাকতে পারবে কি না? এখন। যাও–ছেলেটাকে আর দাঁড় করিয়ে রেখো না।”

“আচ্ছা, চলি।” ফকির তিনজনের দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসলেন। তারপর ছেলেকে নিয়ে চলে গেলেন।

সামান্য চুপচাপ। চন্দন চেয়ার টেনে নিয়ে বসল।

 কিকিরা বললেন, “বিশুকে কেমন দেখলে, চন্দন?”

চন্দন তারাপদর কাছ থেকে সিগারেট চেয়ে নিয়ে ধরাল, বলল, “আপা। যেমন বলেছিলেন, তেমন তো মনে হল না।”।

কিকিরা আর তারাপদ দুজনেই যেন অবাক হয়ে চন্দনের দিকে তাকালেন।

 চন্দন নিজের থেকেই বলল, “আমার মনে হল, এমনিতে ওর কোনো অসুখ নেই। তবে খানিকটা নাভার্স হয়ে রয়েছে। আর-একটা জিনিস দেখলাম, ওকে ঘুমের ওষুধ একটু বেশিই খাওয়ানো হয়েছে। দেখলেন না, কেমন ঝিমোনো ভাব!”

কী ভেবে কিকিরা বললেন, “শরীর-মনের কোনো ক্ষতি হয়েছে?”

“না। তা আমার মনে হল না।”

“সেরে যাবে?”

“না-সারার কী আছে, কিকিরা? একটা আচমকা শক হয়ত পেয়েছে। কিন্তু সেটা মানুষ নিজের থেকেই ধীরে-ধীরে সামলে নেয়। বিশু, পাগলও হয়নি, উন্মাদও নয়। ভাববার মতন কিছু দেখলাম না। বরং বলতে পারেন, ওকে নিজের থেকে ধাক্কাটা সামলাতে না দিয়ে গাদাগুচ্ছের ওষুধ খাইয়ে আর চারপাশ থেকে বেঁধে রেখে “সিক করে দেওয়া হয়েছে।”

কিকিরা যেন খুশি হলেন। বললেন, “তুমি যা বলছ, তা যেন সত্যি হয়।”

চন্দন ঠাট্টা করে বলল, “আমি ঘোড়ার ডাক্তার নই, কিকিরা স্যার।”

 তারাপদ জোরে হেসে উঠল।

কিকিরাও পালটা ঠাট্টা করে বললেন, “অবোলা জীবের ডাক্তারি করা আরও কঠিন হে স্যান্ডেলউড়। পেটে ব্যথা হলেও সে বলতে পারবে না, মাথা ধরলেও নয়। বুঝলে?”

আরও দু চারটে হাসি-তামাশার কথা হল। তারপর কিকিরা বললেন, “এবার কাজের কথা হোক, কী বলো তারাপদ?”

মাথা নাড়ল তারাপদ।

একটু চুপচাপ বসে থেকে কিকিরা বললেন, “চন্দন, তুমি তো মোটামুটি সবই শুনেছ। ঘোড়া-সাহেবের কুঠিটাই যা তোমার দেখা হয়নি। তা সেটাও কাল-পরশু দেখিয়ে আনব। এখন কাজের কথা শুরু করি।”

চন্দন আর তারাপদ তাকিয়ে থাকল। কিকিরার দিকে।

কিকিরা বললেন, “আমি অনেক ভেবেচিন্তে দেখেছি, ঘোড়া-সাহেবের কুঠি নিয়ে যে ঝাট বেধেছে, সেটা নেহাত ওই বাড়িটা নিয়ে নয়। তোমরা বলবে, কেন–বাড়ি নিয়ে নয় কেন? তার জবাবে আমি তারাপদর কথাটাই বলব, বাড়ি নিয়ে ঝঞ্ঝাট হলে সেটা আইন-আদালত করে ফয়সালা হতে পারত। তা কেন হচ্ছে না? কেন অমূল্য আর ফকির দু’জনেই ওই বাড়ির ওপর ঝুঁকে পড়েছে? ঠিক কি না বলো? তা ছাড়া, ঘোড়া-সাহেবের কুঠি এতকাল পড়ে থাকল–কেউ তা নিয়ে মাথা ঘামাল না, হঠাৎ আজ মাস-দুই ধরে দু-তরফের টনক ওঠার কারণ কী?”

চন্দন বলল, “ফকিরবাবু আপনাকে কী বলছেন?”

“কিছুই তো বলছে না। ওর কথাবার্তা থেকে বরং মনে হয়, বিশুকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে কুঠিতে নিয়ে গিয়ে অমূল্যরা একটা ভয়ঙ্কর কিছু করবার মতলব এঁটেছিল। পারেনি। এখন ফকিরের রোখ চেপে গিয়েছে।”

তারাপদ বলল, “ভয়ঙ্কর কী করত, কিকিরা?”

“লুকিয়ে রাখতে পারত, গুম করত, মেরে ফেলতেও পারত।”

“কেন? নিজের ভাইপোকে কেউ মেরে ফেলে?”

“টাকা-পয়সা-সম্পত্তির লোভে খুন-খারাপি তো হয়েই থাকে।”

চন্দন বলল, “তা ঠিক। কথায় বলে, অর্থই অনর্থের মূল। রাজবাড়ির সেই কেস না, কিকিরা? কিন্তু আমি ভাবছি, বিশু একজন অচেনা সাধুবাবার কথায় বিশ্বাস করে তার পেছন-পেছন কুঠিবাড়িতে গেল কেন?”

কিকিরা হাতের আঙুল মটকাতে-মটকাতে বললেন, “তুমি ঠিকই ভাবছ। নেহাত কৌতূহলের জন্যে যেতে পারে, কিংবা ভয়ে। আমি ভাবছি এ-ছাড়া অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে কি না?”

তারাপদ বলল, “তা কেন ভাবছেন?”

“ভাবছি এই জন্যে যে, বিশু সাধুবাবার কথায় ভুলে না হয় কুঠিবাড়িতে গেল, কিন্তু সেই সময় অমূল্যর শালা চরণ তার লোক নিয়ে সেখানে হাজির থাকবে কেন? কেন চরণরা গিয়েছিল? কে তাদের নিয়ে গিয়েছিল?”

চন্দন কান চুলকোতে-চুলকোতে বলল, “আপনি কি বলতে চান, ওই সাধুবাবাই বিশুকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে গিয়ে অমূল্যর শালার হাতে তুলে দিয়েছিল?”

 মাথা নাড়লেন কিকিরা।”না, অতটা বলতে পারছি না। তা যদি হত, তবে বিশুকে চরণদের হাতে তুলে দিয়ে সাধুবাবু পালাত। কিন্তু তা তো হয়নি। উলখে সাধুবাবার সঙ্গে চরণদের কথা-কাটাকাটি হয়েছে। সাধুবাবাকে গুলি করা হয়েছে।”

“গুলি খেয়ে সাধুবাবা পালিয়েছে, তারাপদ বলল, “ম্যাজিক দেখিয়ে উধাও।”

কিকিরা বললেন, “গুলি খেয়েছে কি না, তা বলতে পারব না; তবে বিশুর মুখে আমি যা শুনেছি, তাতে বুঝতে পারলাম, চরণদের সঙ্গে সাধুবাবার কথা কাটাকাটি আর ঝগড়া থেকে বিশু বুঝতে পারছিল, চরণরা সাধুবাবার কাছে কিছু জানতে চাইছিল; সাধুবাবা বলছিল না।”

“সেই রাগেই কি বন্দুক চালায় চরণরা?”

“তাই তো মনে হয়।”

 সামান্য চুপচাপ থেকে তারাপদ চন্দনকে বলল, “আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না, চাঁদু। সাধুবাবাও একটা মিষ্ট্রি। বিশুকে কেনই বা ডেকে নিয়ে যাবে, আর কেনই বা উধাও হয়ে যাবে। লোকটার কোনো ট্রেসই আর পাওয়া গেল না।”

কিকিরা বললেন, “আমার কাছে এখন দুটো প্রশ্নই আসল।”

“প্রশ্ন দুটো কী?” চন্দন বলল।

“ওই সাধুবাবা লোকটি কে? কেন সে হঠাৎ এসে হাজির হয়েছিল এখানে। মজার ব্যাপার কী জানো, সাধুবাবা এখানে আসার সময় থেকেই ওই কুঠিবাড়ি নিয়ে গণ্ডগোল কেন?”

“আর আপনার দ্বিতীয় প্রশ্ন?”

“দ্বিতীয় প্রশ্ন, কী জন্যে সাধুবাবা বিশুকে নিয়ে কুঠিবাড়িতে গিয়েছিল। কেন বলেছিল বিশুকে যে, কুঠিবাড়িতে গেলে তার ভাল হবে। আর কেনই বা চরণ সাধুবাবার সঙ্গে ঝগড়া চেঁচামেচি করছিল? কী জানতে চাইছিল? কেন তারা সাধুবাবার পিছু ধরেছিল?”

তারাপদ বলল, “আপনি বলতে চাইছেন, সাধুবাবাই সব গণ্ডগোলের মূল?”

“নিশ্চয়।”

চন্দন বলল, “সাধুবাবার হাওয়া হয়ে যাবার ব্যাপারটা..?”।

“ওটা স্রেফ চালাকি! এক ধরনের ম্যাজিক। সেই ঘর, জানলা, সিঁড়ি তোমায় দেখাব। দেখলেই বুঝতে পারবে। আমিও ওখান থেকে ভ্যানিশ হতে পারি। ওটা কিছু নয়। তবে হ্যাঁ, কুঠিবাড়ির একটা ঘরে “ডবল উইনডো’ আছে এটা সাধুবাবা কেমন করে জানল? আর কেনই বা সে ওই ঘরটাই বেছে নিয়েছিল, নিয়ে বিশুকে নিয়ে গিয়েছিল?” বলে একটু থেমে আবার বললেন কিকিরা, “প্রথমে আমার মনে হয়েছিল, ম্যাজিকে যেরকম ভ্যানিশিং ট্রিক দেখানো হয়–এখানেও তাই হয়েছে। জানলাটা দেখার পর বুঝতে পারছি–ওটা একটু অন্যরকম। সাধুবাবা সব জেনেই ঘর বেছেছিল। মানে জানলার ব্যাপারটা সে জানত।”

চন্দন আর তারাপদ পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল।

চন্দন বলল, “তারা বলছিল, ওই ঘরে কেউ একজন এখন থাকে।”

“থাকার চিহ্ন দেখেছি। লোক দেখিনি। হয়ত কেউ একজন ঘরে থাকত, পাহারা দিত। খুব সম্ভব সাধুবাবারই আস্তানায় ছিল ওটা। কিন্তু কেন? ওই ঘরে কী আছে?”

কেউ কোনো কথা বলল না।

অনেকক্ষণ পরে চন্দন বলল, “সাধুবাবাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না?”

কিকিরা বললেন, “চেষ্টা করছি। লোক লাগিয়েছি।” বলে তারাপদর দিকে তাকালেন। বললেন, “তোমায় একটা কথা বলা হয়নি, তারাপদ। লোচন আজ বিকেলে বলছিল, যে শশিপদকে আবার তার গ্রামে দেখা গিয়েছে।”

“শশিপদ কে?” চন্দন জিজ্ঞেস করল।

“সাপের ওঝা, কিকিরা যেন কেমন করে হাসলেন, “ওই ওঝাটিকে ধরতে হবে হে। নকুলকে আমি বলেছি। …নাও, ওঠো রাত হল। আর নয়।”  

.

০৯.

পরের দিন সন্ধের মুখে লোচন এসে কানে-কানে কথা বলার মতন করে কিছু বলল কিকিরাকে। কিকিরা তারাপদদের সঙ্গে কথাবার্তা বলছিলেন। খানিকটা আগে চন্দন আর তারাপদকে নিয়ে ঘোড়া-সাহেবের কুঠি ঘুরে এসেছেন। ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন খানিকটা। লোচনের কথায় ব্যর্থ হয়ে বললেন, “কই, কোথায়? তাকে নিয়ে এসো।”

লোচন মাথা নেড়ে বলল, “ইখানে আসবেক নাই, বাবু। খেপাকে নকুল ধরে রেখেছে।”

কিকিরা বললেন, “বেশ, চলো৷” বলে তারাপদর দিকে তাকালেন, “তোমার শশিপদ। চলো, দেখে আসবে চলো।”

বাড়ির বাইরে ঠাকুর-দালানের পেছন দিকে একটা ঘরে নকুল শশিপদকে ধরে বেঁধে বসিয়ে রেখেছে। ঘরে আলো নেই। চারদিকে গাছপালা, ডোবা; মস্ত একটা তেঁতুল গাছ সামনে।

কিকিরা আসতেই নকুল দরজার কাছ থেকে সরে দাঁড়াল।

”পেলে কোথায়, নকুল?” কিকিরা জিজ্ঞেস করলেন।

 “কাছকেই ছিল। সাহানা ঠাকুরের বাড়ির কাছে খেপা ঘুরঘুর করছিল।” কিকিরা ঘরের মধ্যে তাকালেন। অন্ধকার। ঘুপচি ঘর। বাইরে চাঁদের আলোয় চারদিক ভেসে যাচ্ছে। কাল কোজাগরী পূর্ণিমা।

কিকিরা বললেন, “অন্ধকারে তো ঠাওর করতে পারছি না। বাইরে আনো হে, নকুল। শশি-ওঝাকে দেখি।”

“আজ্ঞা, যদি ছুট দেয়?”

“দেবে না। তুমি আছ না?” বলে কিকিরা শশিপদকে বাইরে ডাকলেন।

শশিপদ বাইরে এল। বাইরে এসে দেখল সবাইকে। তারাপদকেও। তারপর হাত জোড় করে নমস্কার করল।

কিকিরা চাঁদের আলোয় যতটা পারেন খুঁটিয়ে দেখলেন শশিপদকে। তারপর বললেন, “দাওয়ায় দু-দণ্ড বসা যাক, শশিপদ; কী বলো?”

বলার সঙ্গে-সঙ্গে বসে পড়ল শশিপদ। ওর চোখে কেমন যেন ঝিমুনিভাব।

কিকিরাও বসলেন। তারাপদ আর চন্দন দাঁড়িয়ে থাকল। লোচন সামান্য তফাতে। নকুল একপাশে দাঁড়িয়ে।

কিকিরা যেন শশিপদকে খানিকটা ভরসা দেবার জন্যে বলেন, “তোমার কথা অনেক শুনেছি, শশিপদ। আমি তোমায় দেখতে চেয়েছিলাম। দু-একটা কথা জিজ্ঞেস করব বলে।”

শশিপদ কথার জবার দিল না, হাত জোড় করে আবার নমস্কার করল কিকিরাকে। তারাপদ আর চন্দন হাসল।

সন্দেহ হল কিকিরার।”তুমি কি কিছু খেয়েছ?”

“আজ্ঞা। আফিম।”

“তা বেশ করেছ।…আচ্ছা শশিপদ, তুমি নাকি সাপের মস্ত ওঝা?”।

“আমি লিজে কী বুলব?” শশিপদ নিজের কান মলে আবার নমস্কার করল।

“তা অবশ্য ঠিক। নিজের গুণ গাইতে নেই। …তা শশিপদ, তোমায় দু-একটা পুরনো কথা জিজ্ঞেস করব। বলবে?”

শশিপদ ঘাড় তুলে দেখল চারপাশ। তারপর আঙুল তুলে নকুলদের দেখাল। বলল, “উয়াদের কাছে রা কাড়ব না। বড় নিরদয়, যেতে বলুন কেনে উদের।”

কিকিরা নকুল-লোচনদের চলে যেতে বললেন। শশিপদ বায়না ধরল, তারাপদরাও সরে যাক।

অগত্যা ওরা সরে গেল।

কিকিরা বললেন, “এবার বলো?”

“আজ্ঞা করুন।”

“আমি করব? বেশ, তাহলে আমার প্রথম কথা, তুমি আমায় সত্যি করে বলো, ফকিরবাবুর ছোটকাকাকে তুমি চিনতে?”

শশিপদ মুখ তুলে তাকাল। বলল, “বিলক্ষণ চিনতাম।” শশিপদর ঝিমনো গলা যেন হঠাৎ ধাতে এল। অবাক হলেন কিকিরা।

“তিনি কি সাপের কামড়ে মারা গিয়েছেন?”

“না আজ্ঞা,” মাথা নাড়ল শশিপদ।

”তুমি কি তাঁর ওঝাগিরি করেছিলে?”

কপালে দুহাত জোড় করে ঠেকাল শশিপদ।”ভগবান যাঁকে বাঁচান কর্তা, তাঁর আয়ু লয় হয় না। আমি ছোটবাবুর কাছে ছিলাম। বিষধর তাঁকে কামড়াইছিল বটে, কিন্তু তিনি বিষ খেয়ে লিলেন।”

কিকিরা অকারণ তর্ক করলেন না। ফকিরের ছোটকাকার বিষ হজম করার ক্ষমতা থাক বা না থাক, তাতে কিছু আসে-যায় না। আসল কথা, ফকিরের কাকা সাপের কামড়ে মারা যায়নি।

কিকিরা বললেন, “তবে যে এরা জানে, ছোটকাকা মারা গেছেন সাপের কামড়ে?”

শশিপদ এবার সোজা হয়ে বসল। তাকাল কিকিরার দিকে। বলল, “ছোট মুখে বড় কথা হয় কর্তা। যদি শোনেন তো বলি।”

“শুনব বলেই তো তোমায় খুঁজছি, শশিপদ।”

সামান্য চুপ করে থেকে শশিপদ বলল, “ই সংসার বড় পাপের জায়গা। কর্তা। ধন-দৌলত হল গিয়ে সব্বনেশে। ছোটবাবু মারা যান নাই, বাবু। উ সব হল গিয়ে রটনা।”

কিকিরা বললেন, “আমার তাই মনে হয়েছিল শশিপদ। ছোটবাবু যদি সত্যিই মারা যেতেন, তবে কেউ-না-কেউ তাঁকে দেখত। অত বড় ঘরের ছেলে, করুন না কেন ধর্মকর্ম, সন্ন্যাসী হয়ে ঘুরে বেড়ান না যেখানে খুশি, তা বলে তিনি মারা যাবার পর কেউ কোনো খবর দেবে না, দেখবে না মানুষটাকে–এ হয় নাকি?”

শশিপদ বলল, “ভাইদের হাত থেকে বাঁচতে বাবু রটনা করেছিলেন।”

“এত বড় মিথ্যে রটনা কেউ করে? অকারণে?”

“জানি না, কর্তা!”

“বেশ, তোমায় জানতে হবে না। জানলেও তুমি বলবে না। একটা কথা বলল, ছোটবাবু এখনো বেঁচে?”

শশিপদ ঘাড় হেলাল। ”কোথায় আছেন তিনি?”

“জানি না। “

“তুমি আবার মিথ্যে কথা বলছ! …আমি বলছি, ওই যে, সাধুবাবু এই গাঁয়ে এসেছিলেন, তিনিই ছোটবাবু!”

শশিপদ কিকিরাকে দেখল। হাসল যেন, বলল, “যা ভাবেন। আমি জানি না।”

কিকিরা বুঝতে পারলেন, আফিংখোর শশিপদ খুব সহজ মানুষ নয়। বললেন, “তুমি আমায় ভুল বুঝছ, শশিপদ। আমার কোনো স্বার্থ নেই। ফকিরবাবু আমার বন্ধু। আমি বিশুর জন্যে এসেছি। ফকিরবাবু বড় কষ্টে আছেন।”

শশিপদ যেন হাসিখুশি মুখ করল; বলল, “তা জানি বাবু। …একটা কথা বুঝতে লারি। ফকিরবাবু আপনার বন্ধু, কিন্তুক উ মিছা কথা বলে কেন?”

কিকিরা অবাক হবার ভান করে বললেন, “মিছে কথা? কিসের মিছে কথা?”

“আপনি জানেন বটে।”

“না শশিপদ, আমি জানি না।”

একটু ভাবল শশিপদ, বলল, “ফকিরের বেটাকে সে লিজে সাধুবাবার কাছে পাঠাইছিল!”

“নিজে গিয়েছিল, শুনেছি।”

“সব্বৈব মিছা, সব্বৈব মিছা”–শশিপদ জোরে জোরে মাথা নাড়ল, “ফকির লিজে তার বেটাকে পাঠাইছিল। সাধুবাবার কাছে পাঠাইছিল, কত। কেন পাঠাইছিল?”

“কেন?”

“আপনি জেনে লেবেন। ফকির আপনার বন্ধু বটে।”

“তুমি বলবে না?”

“না।”

কিকিরা কিছু যেন ভাবলেন। পরে বললেন, “তুমি অমূল্যের লোক?”

“সে আপনি যা ভাবেন, কতা।”

কিকিরা এবার অধৈর্য, বিরক্ত হলেন। শশিপদ বড় একগুঁয়ে, জেদি। ভয় দেখিয়ে ওকে বাগে আনা যাবে না। লোভ দেখিয়েও নয়।

কিকিরা বললেন, “তা হলে তোমায় একটা কথা বলি, শশিপদ! তোমার সাধুবাবা কোথায় আছেন আমি জানি না। কিন্তু কেন তিনি এখানে এসেছিলেন, আমি জানি। যে-ঘর থেকে তিনি পালিয়ে গিয়েছিলেন, সেই ঘরের সব খবর আমি জেনেছি। একটা কথা তুমি জেনে রেখো, কুঠিবাড়ির মধ্যে যা আছে, আমি কাল-পরশুর মধ্যে তা বার করে আনব। আমার সঙ্গে যে নতুন বাবুটিকে দেখলে, উনি কলকাতার পুলিশের লোক। ওঁকে আনিয়েছি। অমূল্যকে বলো, ওর যদি ক্ষমতা থাকে–আমাদের সঙ্গে কুঠিবাড়িতে দেখা করতে। ফয়সালা সেখানেই হবে। …যাও, তুমি যাও।”

শশিপদ এবার কেমন হতভম্ব হয়ে বসে থাকল খানিক। কিকিরাকে দেখল। তারপর উঠে দাঁড়াল। দুহাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে নমস্কার করল কিকিরাকে। কোনো কথা না বলে চলে গেল।

ঘরে এসে কিকিরা সব বললেন তারাপদদের।

চন্দন বলল, “এই কাঁচা কাজটা করলেন কেন, কিকিরা? একেবারে আলটিমেটাম দিয়ে দিলেন?”

“উপায় ছিল না।”

“কিন্তু কুঠিবাড়িতে কী আছে, আপনি জানেন না।”

“জানি না বলেই তো ধাপ্পা দিলাম।”

“ধাপ্পায় যদি কাজ না হয়?”

“না হলে আর কী করব! …তবে আমি যা যা সন্দেহ করেছিলাম, তার অনেকগুলোই মিলে গেল।”

“যেমন?”

“যেমন ধরো প্রথম হল, ফকির সব কথা বলছে না। দুই হল, ফকিরের ছোটকাকা বেঁচে আছেন। তিন হল, কুঠিবাড়ি নিয়ে সমস্ত গণ্ডগোল বেধেছে। সাধুবাবা এখানে আসার পর, কাজেই ওই কুঠিতে এমন-কিছু আছে, যার কথা সাধুবাবা ছাড়া অন্য কেউ জানে না…।”

কথার মধ্যে তারাপদ বলল, “আপনার কথা থেকে মনে হচ্ছে, ফকির আর অমূল্য দুই তরফই সাধুবাবাকে চোখে-চোখে রেখেছিল।”

“হ্যাঁ।”

“কেন?”

“চিনতে পেরেছিল বলে।”

“কাকা বলে চিনতে পেরেছিল?”

“অবশ্যই।”

“তা হলে বাড়িতে আনল না কেন?”

“জানি না। হয়ত আনতে চায়নি।”

চন্দন বলল, “আপনার বন্ধু ফকিরই আপনাকে ঠকাল, কিকিরা।”

কিকিরা বললেন, “আমি এই ব্যাপারটায় বড় অবাক হয়ে গিয়েছি, চন্দন। ফকির কেন এমন করবে? …যাক গে, কালই এর একটা হেস্তনেস্ত করব, না হয় পরশু।“

.

১০.

পূর্ণিমার পরের দিন কিকিরা দলবল নিয়ে ঘোড়া-সাহেবের কুঠিতে হাজির হলেন। তখন সন্ধে হয়-হয়। কুঠির বাইরে জিপগাড়িতে লোচন আর নকুল। চারদিকে নজর রেখে বসে থাকার কথা, কিন্তু এই বিশাল কুঠিবাড়ির চারদিক তাদের পক্ষে দেখা সম্ভব নয়। যতটা চোখ যায়, দেখছিল। কাল কোজাগরী গিয়েছে, আজও ফুটফুটে জ্যোৎস্না, আকাশ মাঠ ভেসে যাচ্ছে চাঁদের আলোয়।

কিকিরা আজ ফকিরকে সঙ্গে নিয়েছেন। ফকির প্রথমটায় আসতে চাননি, কিকিরা তাকে বুঝিয়ে বলেছেন, “তোমার যাওয়া দরকার। তুমি না গেলে আমার কাজের কাজ কিছুই হবে না। কাজেই, ফকিরও এসেছেন। সামান্য খুঁড়িয়ে হাঁটছিলেন।

নিচের তলায় ঘোরাঘুরির কোনো দরকার ছিল না; সোজা দোতলায় উঠে এসে কিকিরা বারান্দায় দাঁড়ালেন। সন্ধে যত ঘন হয়ে আসছে, জ্যোৎস্না তত উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল। গাছপালার মাথায় জ্যোৎস্না, অর্ধেকটা বারান্দায় চাঁদের আলো এসে পড়েছে। চারদিক নিঝুম। বাতাস দিচ্ছিল। অনেকটা তফাতে রাশি-রাশি জোনাকি উড়ছে।

কিকিরার হাতে বড় টর্চ, আর সেই সরু ছড়ি। ফকিরের হাতেও রড় টর্চ। তারাপদর এক হাতে লণ্ঠন বাড়ি থেকে বয়ে আনতে হয়েছে; কেননা, কুঠিবাড়ির ঘরে যে-লণ্ঠনটা আছে, সেটা জ্বলবে কি না কে জানে। এসব কিকিরার পরামর্শ। তারাপদর অন্য হাতে একটা ঝোলানো ব্যাগ, তার মধ্যে খুচরো কতক জিনিস, চন্দনের কাঁধে বন্দুক। ফকির বন্দুকটা সঙ্গে করে এনেছেন। চন্দন বন্দুক বইছিল।

বারান্দায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর কিকিরা ফকিরকে বললেন, “চলো, ঘরে যাই।”

দোতলায় সেই ঘর যেমন ছিল, সেই রকমই পড়ে আছে। তারাপদ লণ্ঠনটা জ্বালাল। কিকিরা জানলা দুটো খুলে দিলেন।

চারজনে বসে-বসে সিগারেট শেষ করলেন। তারাপদ একবার বারান্দায় গেল, ফিরে এল।

ফকির বললেন, “তুমি কি সত্যিই মনে করো, অমূল্য আসবে?”

 মাথা নাড়লেন কিকিরা। “আসবে। আসা উচিত।”

চন্দন বলল, “যদি না আসে?”

“তা হলে বুঝব, আমার চালাকি খাটল না।”

ফকির আর কিছু বললেন না। চন্দন তারাপদকে নিয়ে আবার বারান্দায় চলে গেল।

সময় যেন আর কাটছিল না। চুপচাপ বসে থাকাও যায় না। কিকিরা ফকিরের সঙ্গে মাঝে-মাঝে কথা বলছিলেন। তারাপদ আর চন্দন ঘরে এল।

তারাপদ বলল, “কোথাও কোনো ট্রেস পাচ্ছি না কিকিরা, অমূল্য বোধহয় এলেন না।”

কিকিরা বললেন, “দেখো, শেষ পর্যন্ত কী হয়।”

আরও খানিকটা সময় কাটল। কিকিরা উঠে ঘরের মধ্যে পায়চারি করলেন। ফকিরকে মাঝে-মাঝে এ-কথা সে-কথা জিজ্ঞেস করছিলেন। আবার একসময় ফিরে এসে লোহার খাটটায় বসলেন।

ফকির ক্লান্ত হয়ে হাই তুললেন। চন্দন হতাশ হয়ে নিশ্বাস ফেলল। বলল কিছু।

কিকিরাও হতাশ হয়ে পড়েছিলেন।

হঠাৎ একেবার আচমকা ঘর কাঁপানো শব্দ হল, আর সঙ্গে-সঙ্গে ছিটকে গেল লণ্ঠনটা, কাঁচ ভাঙল, মাটিতে পড়ে দপদপ করে জ্বলতে জ্বলতে নিবে গেল। ঘরের মধ্যে কেমন ধোঁয়াটে ভাব, কেরোসিম আর গন্ধকের গন্ধ।

কিকিরা আর ফকির প্রায় লাফ মেরে খাটের তলায় বসে পড়েছেন ততক্ষণে, তারাপদ আর চন্দন দেওয়ালের দিকে সরে গেছে।

জানলার দিকে তাকালেন কিকিরা। জানলা দিয়ে এসেছে গুলিটা। ঘর অন্ধকার। টর্চ জ্বালানো উচিত নয়, জ্বালালেই বিপদ। কিকিরা ফকিরের হাতে। চাপ দিলেন, ফিসফিস করে বললেন, “টর্চ জ্বেলো না।”

ঘর থমথম করতে লাগল।

জানলা দিয়ে কেউ ভেতরে আসছিল। বাইরের জ্যোৎস্নার দরুন তাকে অস্পষ্ট, ভুতুড়ে ছায়ার মতন দেখাচ্ছিল।

“কে, অমূল্য?” ফকির অস্ফুট গলায় আচমকা বললেন।

 মূর্তি ততক্ষণে ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে, জানলার কাছে। বলল, “হ্যাঁ।”

“তুমি আমাদের ওপর বন্দুক চালালে?”।

“বন্দুক চালাইনি। পটকা চালিয়েছি। বাতিটা নিবিয়ে দিলাম। টর্চ। জ্বালাবার চেষ্টা করো না। তোমার সেই পুরনো বন্ধু কোথায়?”

ফকির চুপ করে থাকলেন। কিকিরা জবাব দিলেন, “আমি হাজির। রয়েছি।”

“হাজির রয়েছেন, তা জানি। আমিও হাজির। আপনি আমায় আসতে বলেছিলেন?”

“শশিপদ বলেছে?”

“হ্যাঁ।”

“হ্যাঁ, বলেছিলাম।”

“কেন?”

“কথা বলব বলে।”

“কিসের কথা?”

“তোমাকে তুমিই বলছি, রাগ করো না, তুমি ফকিরের ছোট ভাই।”

“বেশ বলুন।”

কিকিরা যে অন্ধকারে সন্তর্পণে কী করছিলেন, ফকিরও জানতে পারছিল না। কিকিরা বললেন, “এই কুঠিবাড়ি নিয়ে তোমাদের দুই ভাইয়ের ঝগড়ার মিটমাট হয় না?”

অমূল্য রাগল না, তবু গলার স্বর অন্যরকম শোনাল। “আপনি আমাদের মধ্যে নাক গলাতে কেন এসেছেন? বাড়ির ব্যাপার বাড়ির মধ্যেই মিটে যাওয়া ভাল।“

“তুমি আমায় ভুল বুঝছ! আমি নাক গলাতে আসিনি। তা ছাড়া আমি এসে খারাপ তো কিছু করিনি। ধরো, এই বাড়ির মধ্যে যে-জিনিসটা রয়েছে সেটার হদিস তো পেয়েছি।”

এবারে অমূল্য উপহাসের গলায় বলল, “আমার চোখে আপনি ধূলো দেবার চেষ্টা করবেন না। কলকাতা থেকে দুটো ছোকরার সঙ্গে করে এনেছেন। তার মধ্যে একটাকে আপনি পুলিসের নোক বলে চালাতে চাইছিলেন। সে ডাক্তার।”

কিকিরা ঘাবড়ালেন না। বললেন, “তোমার সব দিকে নজর আছে। লোকজনও জায়গা-মতন রেখে দিয়েছ, দেখছি। ফকিরের বাড়িও বাদ দাওনি। কিন্তু, এই ব্যাপারটায় ভুল করছ।”

“কোন ব্যাপারে?”

“এই বাড়ির মধ্যে কী আছে, তা আমি জানতে পেরেছি।”

“অসম্ভব। আপনি পারেন না।”

“বেশ, তা হলে তুমি আমার জানার একটা নমুনা দেখো। …যেখান দিয়ে তুমি উঠে এসেছ, সেখানে যাও। ওই জানলাটার কাছে। প্রথম জানলার ডান দিকের কাঠের মাথার দিকে হাত দাও। একটা জায়গায় ছোট্ট গর্ত-মতন দেখবে। একটা আঙুল বড় জোর ঢুকতে পারে। সেখানে আস্তে-আস্তে চাপ দাও…। সোজা চাপ দেবে। যখন বুঝবে লোহার মতন কিছুতে আঙুল ঠেকছে–তখন জোরে চাপ দেবে। যাও, দেখো।”

অমূল্য সামান্য চুপ করে থাকল, ভাবল।”কী হবে চাপ দিলে?”

“যা হবে, দেখতেই পাবে। জানলার ডান দিকের কাঠ সরে ফোকর বেরুবে।”

“আপনি যে সত্যি কথা বলছেন, তার প্রমাণ কী?”

“দেখতেই পাবে। সাধুবাবা ওই জিনিসটি হাতছাড়া করেননি।”

“তা হলে আপনিই বা করছেন কেন?”

“আমি যা বলেছি তুমি মন দিয়ে শোনোনি। আমি বলেছি, হদিস পেয়েছি, বলিনি সেটা আমার হাতে এসেছে।”

“আপনি হদিস পেয়েছেন অথচ হাতাননি? দাদা আপনাকে বৃথাই এনেছে?” অমূল্য বিদ্রূপ করল যেন।

“না, হাতাতে পারিনি। এক জায়গায় আটকে গিয়েছি।”

অমূল্য আর কোনো কথা বলল না, জানলার দিকেই ফিরে গেল।

কিকিরা তাঁর সেই ছড়ির মধ্যে থেকে লিকলিকে গুপ্তিটা আগেই বার করে নিয়েছিলেন। আস্তে আস্তে নিঃশব্দে উঠলেন। ওঠার আগে ফকিরের হাতে। চাপ দিলেন সামান্য।

অমূল্য জানলার কাঠের ফ্রেমে হাত রেখে দাঁড়াল। বন্দুকটা বাঁ হাতে নিয়ে ডান হাতে কাঠের চারদিক হাতড়াতে লাগল।

কিকিরা ছায়ার মতন অমূল্যর পিছনে গিয়ে গুপ্তির ডগাটা একেবারে তার ঘাড়ের কাছে ছোঁয়ালেন।

চমকে উঠে অমূল্য হাত নামাল।

কিকিরা শান্ত গলায় বললেন, “বন্দুক ধরার চেষ্টা আর কোরো না। আমার। গুপ্তি দিশি নয়, বিলিতি, উইনস্টন কোম্পনির, তোমার গলা ফুটো হয়ে যাবে।”

অমূল্য স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।

কিকিরা ফকিরকে টর্চ জ্বালতে বললেন। টর্চ জ্বালালেন ফকির! আলোয় অমূল্যকে দেখা গেল। কেমন যেন স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে।

কিকিরা তারাপদকে বন্দুকটা সরিয়ে নিতে বললেন। তারাপদ এগিয়ে এসে বন্দুক সরিয়ে নিল। একনলা বন্দুক।

ফকির কিকিরার পড়ে-থাকা টর্চটা মাটি থেকে উঠিয়ে নিয়ে সেটাও জ্বেলে ফেললেন।

সামান্য চুপচাপ। কিকিরা অমূল্যকে ঘুরে দাঁড়াতে বললেন।

জোড়া টর্চের আলোয় অমুল্যকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। কালো প্যান্ট, কালো জামা, পায়ে মোটা কেডস। স্বাস্থ্যবান চেহারা।

কিকিরা বললেন, “তুমি যথেষ্ট সাহসী; কিন্তু চালাক নও। আমি ম্যাজিশিয়ান, কথায় ভুলিয়ে দশ আনা কাজ হাসিল করি। যাক গে, তোমার সঙ্গে সরাসরি কয়েকটা কথা বলতে চাই। ফকির এখানে রয়েছে। কথা বলতে রাজি আছ?”

অমূল্য ভাবল কিছু। বলল, “রাজি। কিন্তু একটা কথা, আমি আপনাদের কাউকে গুলি করতে চাইনি। চাইলে করতে পারতাম। আমার গুলি ফসকায় না। তা ছাড়া, আমি কিন্তু একা আসিনি। আপনাদের মতন আমারও লোক আছে নিচে। আমার যদি কোনো ক্ষতি হয়, তা হলে..”

কিকিরা বললেন, “না, তোমার ক্ষতি হবে না। আমি জানি, তুমি আমাদের কারও ওপর গুলি চালাওনি।”

“বেশ, তা হলে বলুন।” কিকিরা গুপ্তিটা নামিয়ে নিলেন। বললেন, “তোমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে এই কুঠিবাড়ি নিয়ে রেষারেষি শুরু হল কেন হঠাৎ?”

অমূল্য কোনো জবাব দিল না।

কিকিরা বললেন, “সাধুবাবা এখানে আসার পর তোমাদের এই রেষারেষি। ওই সাধুবাবা যে তোমাদের ছোটকাকা, তা নিশ্চয় জানতে পেরেছিলে!”

“পেরেছিলাম। কাকা নিজেই লোক মারফত গোপনে খবর দিয়েছিল।”

“তাঁকে তোমরা বাড়িতে নিয়ে যাওনি কেন?”

অমূল্য একবার ফকিরের দিকে তাকাল।”সেটা অসম্ভব ছিল।”

“তোমাদের কাকা তা হলে এখানে এসেছিলেন কেন?”

“দাদাকে জিজ্ঞেস করুন।”

 কিকিরা ফকিরের দিকে তাকলেন।

ফকির সামান্য চুপচাপ থাকার পর বড় করে নিশ্বাস ফেললেন। বললেন, “আমি যা বলতে চাইনি, কিঙ্কর, এবার আর তা না বলে উপায় নেই। আমি যা বলছি, তা সত্যি। …আমাদের ছোটকাকা আমাদের বংশের কুলাঙ্গার। অনেক কাল আগের কথা, আমার বাবা, মেজকাকা–মানে অমূল্যর বাবা–দুজনেই জীবিত। মেজকাকার নতুন বাড়িও তৈরি হয়ে গিয়েছে। আমাদের তখন বয়েস কম, বাড়িতে প্রায়ই ছোটকাকাকে নিয়ে গণ্ডগোল হতে শুনতাম। দিন দিন অশান্তি বেড়েই চলল। শেষে একদিন ছোটকাকা উধাও হয়ে গেল। কিছুদিন পরে ফিরে এল গেরুয়া পরে। আবার একদিন উধাও। তারপর শুনলাম, কাকা আমাদের বংশের সমস্ত সৌভাগ্যের যা মূল সেটা চুরি করে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছে। আমাদের বাড়িতে চার পুরুষের এক মনসামূর্তি ছিল, সোনার মুর্তি, অপরূপ দেখতে, মূর্তির চোখে হীরে। আরও কিছু দামি পাথর ছিল গায়ে। মূর্তির সঙ্গে ছিল একটা সোনার সাপ, তার দু চোখে দুটো লাল চুনি। এই মূর্তি কোনোদিন বাইরে থাকত না, থাকত সিন্দুকের চোরা-খোপের মধ্যে। মনসাপুজোর দিন তার পুজো হত বাড়িতে। ঠাকুরঘরে। আবার সেটা সিন্দুকে তুলে রাখা হত।” ফকির থামলেন, যেন একটু দম নিচ্ছিলেন।

কিকিরা বললেন, “নিশ্চয় খুব মূল্যবান মূর্তি?”

“তা তো হবেই–টাকায় শুধু মূল্যবান নয়, অমন মূর্তি ভূ-ভারতে খুঁজে পাবে কি না সন্দেহ! …আমাদের বংশে ওই মূর্তির অন্য মূল্য। সে তোমরা বুঝবে না। ছোটকাকা ওই মূর্তি নিয়ে পালিয়ে যাবার পর কাকাকে আমরা ত্যাগ করলুম। বাবা আর মেজকাকা শপথ করিয়ে নিলেন, ভবিষ্যতে কোনোদিন ওই কুলাঙ্গার, আর এই বংশের কারও কাছে যেন একদিনের জন্যেও আশ্রয় না পায়। তাকে বিষয় সম্পত্তির এক কানাকড়িও যেন না দেওয়া হয়। আমরা এই প্রতিজ্ঞা ভাঙিনি। কেমন করে ভাঙব?”

কিকিরা বললেন, “বেশ, প্রতিজ্ঞা না হয় না ভাঙলে কিন্তু তোমাদের ছোটকাকা যেন জীবিত, এটা জানতে?”

মাথা নাড়লেন ফকির।”না, আমরা জানতাম, কাকা মারা গিয়েছে। বিশেষ করে সাপের কামড়ে মারা যাবার খবর শুনে আমাদের মনে হয়েছিল, যা হওয়া উচিত তাই হয়েছে। মা মনসাই তাঁর শোধ নিয়েছেন।”

“কিন্তু ওই কাকা এখানে কেন এসেছিলেন? তাঁর উদ্দেশ্য কী ছিল?”

“উদ্দেশ্য কী ছিল, আগে বুঝিনি। যখন খবর পেলাম কাকা এসে ঘোড়া-সাহেবের কুঠির কাছাকাছি রয়েছে, গোপনে দেখা করতে বলেছে–তখন ভেবেছিলাম হয়ত কাকা বুড়ো বয়সে তার কৃতকর্মের জন্যে অনুতাপ জানাতে চায়। তারপর শুনলাম, কাকা আমাদের বংশের সেই মূর্তি আর সাপ নিজের কাছেই গচ্ছিত রেখেছিল, এখন তা ফেরত দিয়ে যেতে চায়।”

“কে তোমায় এ কথা বলেছে?”

“বিশু।”

“তুমি নিজে কেন কাকার সঙ্গে দেখা করতে যাওনি?”

“রাগে, ঘেন্নায়। তা ছাড়া আমি গেলে কাকা কিছু বলত না। বিশুকেই যেতে বলেছিল।”

কিকিরা অমূল্যর দিকে তাকালেন। বললেন, “তুমিও কি নিজে যাওনি, অমূল্য?”

“আমি নিজেই একদিন গিয়েছিলাম। কাকা আমায় ওই একই কথা বলেছিল–দাদা যা বলল।”

“তারপর? সাধুবাবা যেদিন বিশুকে নিয়ে এই কুঠিবাড়িতে এল, সেদিন তুমি নিজে না এসে তোমার শালা চরণকে পাঠালে কেন?”

অমূল্য চুপ। তার মুখ কেমন শক্ত, কালো হয়ে আসছিল। দাঁতে দাঁত চাপল অমূল্য। হঠাৎ দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলল।”আমি বলব না, বলতে পারব না।”

তারাপদ, চন্দন দুজনেই পাথরের মতন দাঁড়িয়ে।

কিকিরা বললেন, “আমি বলছি। জানি না, ঠিক বলছি কি না! …তোমার কাকা তোমায় বলেছিলেন, তিনি বিশুকে ভুলিয়ে কুঠিবাড়ির এই ঘরে নিয়ে আসবেন। তোমার কাজ হবে, বিশুকে গুলি করে মারা। তাকে আগে মারব, তারপর তিনি তোমায় মনসা-মূর্তি দেবেন। তাই না?”

অমূল্য ছটফট করছিল। বলল, “হ্যাঁ। কাকা তাই বলেছিল। কিন্তু আমি অমূল্য রায়। মামলা-মোকদ্দমা, জমিজিরাত নিয়ে লাঠালাঠি ফৌজদারি করতে পারি; নিজের ভাইপোকে গুলি করতে পারি না।”

“নিজের হাতে পারবে না বলে চরণদের পাঠিয়েছিলে?”

অমূল্য রুক্ষভাবে কিকিরার দিকে তাকাল।”হ্যাঁ। …কিন্তু আপনি যা বলছেন, তা নয়। আমি চরণকে বলেছিলাম, ওই শয়তানের কাছ থেকে আগে মূর্তির খবর জেনে নেবে, তারপর তাকে কুকুরের মতন গুলি করে মারবে। বিশুর গায়ে যেন আঁচড় না পড়ে।” কথা শেষ করার আগেই অমূল্য প্রায় কেঁদে ফেলল; জড়ানো গলায় বলল, “আমি ইতর নই, জন্তু নই; বিশুকে চরণরাই যে পরে কুঠির বাইরে এনেছে, সে-খবর আপনি রাখেন?”

“না। তবে আমার সন্দেহ ছিল।”

“দাদা আপনাকে যা বলেছে, আপনি তাই বিশ্বাস করেছেন।”

কিকিরা সামান্য অপেক্ষা করে অমূল্যকে বললেন, “আমি তোমার সমস্ত কথা। বিশ্বাস করছি, অমূল্য। বিশুকে গুলি করার দরকার হলে চরণরা যে-কোনো সময়ে সেটা করতে পারত। সাধুবাবার সঙ্গে বচসা করত না।” বলে অমূল্যের কাঁধে হাত দিলেন, যেন সান্ত্বনা জানালেন।

অমূল্য ক্ষোভের গলায় বলল, “দাদা আপনাকে ভুল বুঝিয়েছে। বিশুর সঙ্গে আমার শত্রুতা নেই।”

ফকির চুপ করে ছিলেন।

কিকিরা ফকিরকে বললেন, “ফকির, তুমি আমার কাছে অনেকগুলো বাজে কথা, মিথ্যে কথা বলেছ। শুধু মিথ্যে বলোনি, নিজের ছেলেটাকে তুমি লোকের চোখের আড়ালে রেখেছ, তাকে অনর্থক একগাদা ঘুমের ওষুধ খাইয়েছ, অ্যাবনরমাল করে রেখেছ! কেন? তোমার কি সবসময় ভয় হত, বিশু স্বাভাবিক থাকলে সব কথা সাফসুফ বলে দেবে?”

ফকির মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলেন। অনেকক্ষণ পরে বললেন, “হ্যাঁ সে-ভয় ছিল। তবে তোমায় আমি আগেই বলেছি, আমাদের বংশের এমন কয়েকটা কথা আছে, যা আমরা বাইরে বলতে চাই না। বলতে পারি না। বলা নিষেধ। ছোটকাকার কথা, মনসার মূর্তির কথা আমি বাইরে প্রকাশ করতে চাইনি। আজ বাধ্য হয়ে বললাম তোমায়।”

“তা অবশ্য বললে, ফকির,” কিকিরা একটু ইতস্তত করে বললেন, “আমার কিন্তু মনে হচ্ছে, তুমি আমার অমূল্য–দুজনেই আলাদা-আলাদা ভাবে তোমাদের কাকার কাছ থেকে মূর্তিটি পেতে চেয়েছিলে। তার জন্যেই এত!”

ফকির চুপ। অমূল্যও কথা বলল না।

কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর কিকিরা বললেন, “ফকির, আমি যেদিন তারাপদকে নিয়ে তোমার বাড়িতে এলাম, দোতলা থেকে কে বন্দুক ছুঁড়েছিল? তুমি বলছ বিশু। কিন্তু আমার বিশ্বাস হয়নি।”

“আমি ছুঁড়েছিলাম,” ফকির বললেন।

”কেন?”

“তোমায় ঠকাতে চেয়েছিলাম। না না, ঠকানোই বা কেন। আমি তোমায় বোঝাতে চেয়েছিলাম, বিশু কেমনকী বলব–পাগল-পাগল ব্যবহার করছে। …আমায় তুমি ক্ষমা করো, ভাই।”

কিকিরা কেমন ম্লান মুখ করে হাসলেন। বললেন, “আমায় তুমি সব কথা যদি খুলে বলতে ফকির, ভাল হত। তুমি অন্যায় করেছ! তা ছাড়া, আমার মনে হয় তুমি আমায় অন্যভাবে একটা কাজে লাগাতে চেয়েছিলে–সেই মনসামূর্তি যদি আমি খুঁজে বার করতে পারি এই কুঠিবাড়ি থেকে, তাই না?”।

মাথা নাড়লেন ফকির।”না কিঙ্কর আমি মোটেই তা চাইনি। তুমি কলকাতা থেকে হঠাৎ আমার কাছে সেবার বেড়াতে এলে! এসে দেখলে আমি ঝঞ্ঝাটে রয়েছি। আমি তোমায় সব কিছু খুলে বলতে পারছিলাম না। বিশু তখনো ধাক্কা সামলাতে পারেনি। আমি যে কী করব ঠিক করতে না পেরে বোকার মতন নিজের পায়ে কুড়ল মেরেছি। তোমায় মিথ্যে কথা বলেছি, ছেলেটাকেও জবুথবু করে রেখেছি। তুমি না এলে ব্যাপারটা এতদূর গড়াত না বোধহয়। তবে সত্যি বলছি, পরে আমার মনে হয়েছিল, তুমি যদি কুঠিবাড়ি থেকে মনসামূর্তি উদ্ধার করতে পারো–ভালই হয়। অবশ্য সে-আশা আমার কমই ছিল।”

“কম ছিল, তবু তোমাদের বিশ্বাস ছিল মূর্তিটা এই বাড়িতেই আছে।”

 “হ্যাঁ,” অমূল্য বলল, “কাকা যদি ও-ভাবে পালিয়ে যায় তবে মূর্তি কোথায় থাকবে?”

কিকিরা বললেন, “সে-মূর্তি উদ্ধার হবে কেমন করে! তোমাদের ছোটকাকা অনেক আগেই বেচেবুচে দিয়েছেন। বাইরে সন্ন্যাসী হলেও ভেতরে কি তিনি তাই ছিলেন? যে মানুষ বাড়ি থেকে লক্ষ টাকার জিনিস চুরি করে, সে-মানুষ সাধু?” অমূল্য বলল, “তাই যদি হবে, তবে কাকা এসেছিল কেন এখানে?”

“কেন এসেছিল বুঝতে পারো না?”

“না।”

“প্রতিশোধ নিতে। যাকে তোমরা বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছ, বংশ থেকে বাদ দিয়েছ, এক কানাকড়ি সম্পত্তিও দাওনি, সে যে তোমাদের ক্ষমা করবে, একথা বিশ্বাস করা মুশকিল। তার হাতে যতকাল টাকা পয়সা ছিল, ফুর্তি ফাতা করে দিন কাটিয়েছে। তারপর হয়ত তার দুর্দিন গিয়েছে। শেষে যখন বুঝল, তোমাদের ভাইয়ে-ভাইয়ে সম্পত্তি নিয়ে ভাগাভাগি গণ্ডগোল রেষারেষি চলছে, তখন সে এল। এল মতলব নিয়ে। তোমাদের মধ্যে আরও রেষারেষি, খুনোখুনি বাধিয়ে এই বংশ প্রায় শেষ করে দিতে। ধরো, অমূল্য–তুমি যদি বিশুকে সত্যিই খুন করতে, ফকির তোমায় ছাড়ত না, সেও তোমায় খুন করত। দু’তরফে বিদ্বেষ, খুনোখুনি, রক্তারক্তি চলত। তারপর কোথায় গিয়ে এই শত্রুতার শেষ হত, ভগবানই জানেন।”

“কাকা এত নীচ?”

“নীচ, উন্মাদ। তার যদি অনুতাপ হত, সে গাছতলায় বসেই তোমাদের দুজনকে ডেকে মনসামূর্তি ফেরত দিত। কেন সে এই ষড়যন্ত্রের মধ্যে যাবে?”

অমূল্য রাগে কাঁপছিল। বলল, “আমি সেদিন চরণকে বলেছিলাম, ওকে কুকুরের মতন গুলি করে মারতে। আর কোনোদিন যদি দেখতে পাই, আমি তাকে নিজের হাতে গুলি করে মারব।”

“আর কোনোদিন তাকে পাবে না। আর কি সে আসে? …নাও চলো, রাত হয়ে যাচ্ছে।”

ঘরের বাইরে এসে কিকিরা অমূল্যকে বলল, “ওই ঘোরানো সিঁড়ি, ওই জানলার কথা তুমি আগে জানতে?”

মাথা নাড়ল অমূল্য।”না, কেমন করে জানব। এখানে কে আসে? যদি জানতাম, তা হলে কি কাক পালাতে পারত! আমরা ভেবেছিলাম, গুলি খেয়ে জানলা দিয়ে লাফ মেরেছে। পরের দিন খোঁজ করতে গিয়ে সিঁড়িটা দেখি। সিঁড়িটা বড় অদ্ভুত, বাগানে গিয়ে শেষ হয়েছে। গাছপালার মধ্যে। কাকা ওখান থেকেই পালিয়েছে।”

কিকিরা বললেন, “শশিপদ বলেছে, তোমাদের কাকা এখনো বেঁচে আছে।”

“শশিপদ কাকার হয়ে খবরাখবর দিত। আমি তাকে পয়সা দিয়ে কাজে লাগিয়েছিলাম। আজ সে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছে। ভয়ে। সহজে আর আসছে না।”

কুঠিবাড়ির নিচে এসে কিকিরা বললেন, “তোমার লোকজন কোথায়? ডাকো।”

অমূল্য একটু হাসল। তারপর শিস দেওয়ার মতন করে শব্দ করল। তীক্ষ্ণ শব্দ। বলল, “চলুন, ওরা আসবে। পেছনেই।”

হাঁটতে হাঁটতে কিঙ্কর বললেন, “একটা কথা তোমাদের দুজনকেই বলি। রক্তে যদি তোমাদের মামলা-মোকদ্দমা থাকে ভাই, সেটা আর কে রুখবে। তবে এই খুনোখুনি-রক্তারক্তিটা ভাইয়ে-ভাইয়ে না থাকাই ভাল। …তা ছাড়া, যা গিয়েছে তা যখন আর ফিরে আসবে না, তখন তোমরা ও নিয়ে আর চিন্তা কোরো না। তোমাদের কাকা যা চুরি করে নিয়ে পালিয়েছেন, সেটা তোমাদের বংশের সৌভাগ্যের লক্ষ্মী হতে পারে কিন্তু তিনি যা দিতে এসেছিলেন, সেটা দুভাগ্য। তোমরা বেঁচে গিয়েছ।”

ফকির চঞ্চল হয়ে পড়েছিলেন, কিকিরার হাত ধরে ফেললেন আবেগে। বললেন, “কিঙ্কর, আমি তোমার কাছে বড় ছোট হয়ে গেলাম। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি যা করেছি, তা দায়ে পড়ে। বোকার মতন কাজ করেছি। আমায় ক্ষমা করো।”

কিকিরা ফকিরের কাঁধে হাত রেখে হেসে বললেন, “আমি সবই বুঝেছি। নাও, চলো। চলো, অমূল্য।”

পেছনে পায়ের শব্দ শোনা গেল। মুখ ফিরিয়ে তাকালেন কিকিরা। তারপর হেসে অমূল্যকে বললেন, “তুমি দেখছি, অনেক সৈন্যসামন্ত এনেছিলে।”

অমূল্য লজ্জা পেয়ে হাসল।

তারাপদ আর চন্দন কিকিরার পেছনে। চাঁদের আলোয় অতগুলো মানুষ ঘোড়া-সাহেবের কুঠির বাগান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল, যেতে-যেতে শুনল দমকা বাতাস এসে গাছপালার পাতায় কেমন এক শব্দ তুলেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *