শুদ্ধানন্দ প্রেতসিদ্ধ ও কিকিরা

শুদ্ধানন্দ প্রেতসিদ্ধ ও কিকিরা — কিকিরা সমগ্র ১ — বিমল কর

০১.

তারাপদ এসে দেখল, কিকিরা বসে বসে ফ্লুট বাজাচ্ছেন। দেখে অবাক হয়ে গেল। যাত্রাদলের বাজনদারদের মতন চোখ বুজে মাথা দুলিয়ে-দুলিয়ে ফ্লুট বাজানোর শখ যে কেন চাপল কিকিরার কে জানে। হাসিও পাচ্ছিল তারাপদর। কিকিরার ওই ছাতিতে কী ফ্লুট বাজে। প্যাঁ-পোঁ অদ্ভুত খাপছাড়া সং ছাড়া আর কিছুই আওয়াজ বেরোচ্ছিল না ফ্লুট থেকে। অথচ কিকিরার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল, তিনি যেন মেডেল-পাওয়া ফ্লুটমাস্টার।

তারাপদ হেসে ফেলে ডাকল, “স্যার?”

সাড়া দিলেন না কিকিরা, তারাপদকে দেখলেন মাত্র।

 তারাপদ খুব বিনীতভাবে বার-তিনেক ‘স্যার স্যার’ করল।

কিকিরা মুখের সামনে থেকে বাদ্যযন্ত্রটি সরালেন শেষ পর্যন্ত। বললেন, “এসো।” বলে দম নিতে লাগলেন।

তারাপদ বলল,”স্যার, এটা কী বাজাচ্ছিলেন?”

“ক্ল্যারিনেট। তোমরা বলো, ক্ল্যারিওনেট।”

“ফ্লুট নয়?”।

“গোলাপও চেনো না, গাঁদাও চেনো না। যা তোমার মুখে আসে বলে যাচ্ছ।” বলে বাদ্যটি কোলের ওপর রাখলেন। “ফু-লু-ট। ঘা, ও ভদ্রলোকে বাজায়।”

তারাপদ হাত জোড় করে হাসতে হাসতে বলল, “সত্যিই স্যার, কোনোটাই চিনি না। তা আপনি হঠাৎ প্যাঁ-পোঁ শুরু করলেন কেন? যাত্রাদল খুলবেন নাকি।”

কিকিরা মুখ-চোখের অদ্ভুত এক ভঙ্গি করে বললেন, “আমি কিকিরা দি গ্রেট, আমি খুলব যাত্রার দল। বলছ কী?”

তারাপদ হাসির তোড়েই বলল, “আপনি কিকিরা দি ওয়ান্ডার… : গ্রেট ম্যাজিশিয়ান। কখন কী মতি হয় আপনার কে জানে।”

কিকিরা এবার খানিকটা খুশি-খুশি মুখ করে বললেন, “ব্যাপারটা কী জানো তারাপদ। এই জিনিসটি আমি নটবর কর্মকারের কাছ থেকে কালই কিনেছি। চোর-বাজারের নটবর। বেটা নিজেও পয়লা নম্বর থিফ। আমায় বলল, অ্যালফ্রেড থিয়েটারের শশী শীল এই ক্ল্যারিওনেটটি বাজাতেন। গায়ে নাম লেখা আছে এস এস।”

“শশী শীল কে?”

“তোমাদের নিয়ে জ্বালা। কিস্যু জানো না। শশীবাবু ছিলেন পয়লা নম্বর ক্ল্যারিওনেট হ্যান্ড। মাস্টার লোক। পিয়ানোয় দু’কড়ি, বেহালায় ছোটু বড়াল আর ক্ল্যারিওনেটে শশী শীল–এরা ছিলেন থ্রি মাস্টারস। লোকে বলত, থ্রি মাসকেটিয়ারস। সেকালের থিয়েটারপাড়া কাঁপিয়ে রাখতেন ওঁরা। তিনজনেই মারা যান ভিখিরির মতন। ছেলেপুলেগুলো যে যা পেরেছে বাপ-ঠাকুরদার জিনিস বেচে দিয়েছে।”

তারাপদ বলল, “ও! ব্যাপারটা এতক্ষণে বুঝলাম। শশীর ছেলে কাশী বাপের জিনিস চোরা বাজারে ঝেড়ে দিয়েছিল কবে, সেই জিনিসটি আপনি কিনেছেন। এই তো?”

কিকিরা বললেন, “শশীর ছেলে, কাশী না ঋষি–আমি জানি না বাপু। জিনিসটা নটবরের কাছে এসেছিল, কিনে নিলাম। কত মূল্যবান জিনিস বলো?”

তারাপদ মাথা নাড়ল। কিকিরা যা কিনে এনে জড়ো করেন, সবই যে মহামূল্যবান–এটা স্বীকার করে নেওয়াই ভাল। পাথুরেঘাটার কোন যদু মল্লিক যে কলকেটিতে দম মেরে নিয়ে টপ্পা গাইতেন, সেই বাঁধানো কলকেটিও যে অতি মূল্যবান–কিকিরার কাছে তাও স্বীকার করে নিতে হবে। নয়ত বিপদ।

কিকিরা এবার উঠলেন, “জল খেয়ে আসি বোসো। চায়ের কথা বলে দিই বগলাকে। কী খাবে চায়ের সঙ্গে। বার্মিজ ওমলেট খাও। চট করে হয়ে যাবে।”

তারাপদ মুখ টিপে হাসল, বলল, “যা হোক হলেই হল। আপনার এখানে এত রকম খাবার খেয়েছি যে, চাঁদু বলে কুকিং-এর ব্যাপারেও আপনি অরিজিনাল…।“

“কোথায় সেই স্যান্ডেল উড?”

“পরে বলছি, আপনি জল খেয়ে আসুন।”

 কিকিরা আর দাঁড়ালেন না। ঘর ছেড়ে চলে গেলেন।

কিকিরা চলে যাবার পর তারাপদ অন্যমনস্কভাবে ঘরের চারদিক দেখতে লাগল। মানুষটির সঙ্গে এই ঘরটির অদ্ভুত মিল। বিচিত্র ছাঁটের, আর বেয়াড়া রংচং-অলা এক আলখাল্লা-পরা কিকিরাকে বাড়িতে যেমনটি দেখায় এই ঘরটিও সেইরকম অদ্ভুত দর্শন। এ-ঘরে কী নেই? কিকিরার সিংহাসন-মাক চেয়ার ছাড়াও যত্রতত্র বিচিত্র সব জিনিস ছড়ানো। পুরনো দেওয়ালঘড়ি, চিনে মাটির জার, বড় বড় পুতুল, কালো ভুতুড়ে আলখাল্লা, চোঙাঅলা সেকেলে গ্রামোফোন, ম্যাজিকঅলার আই বল, ফিতে জড়ানো ধনুক, পাদরিসাহেবের টুপি, ম্যাজিক ছাতা আর তলোয়ার, পায়রা-ওড়ানো বাক্স, টিনের চোঙ-কোনটা নয়! তার সঙ্গে এক-দু’মাস অন্তর জমানো ম্যাজিক-মশাল, গাঁজার কলকে, বাহারি মোমদান-এ-সব তো জমেই যাচ্ছে দিনের পর দিন। চন্দন ঠাট্টা করে। বলে, “কিকিরা আপনার এই মিউজিয়ামটির নাম দিন “ছানাবড়া ঘর, সত্যিই এই দৃশ্য দেখলে চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়।”

কিকিরা ফিরে এলেন। আজ তাঁর পরনে হাফ-আলখাল্লা, মানে জামার হাত দুটো কনুই পর্যন্ত লম্বা, কোমরের ঝুল হাটুতক, জামার-রং নীল। মাথায় টুপি। নেই। রুক্ষ বড় বড় চুল ঘাড় পর্যন্ত ছড়ানো। লম্বা নাক, বসা গাল, সরু থুতনি আর বোগা হাড়জিরজিরে কিকিরার চেহারার মধ্যে কিন্তু কী-যেন একটা আকর্ষণ আছে। উনি মজাদার মানুষ এটা বোঝা যায়, আবার নজর করলে ওঁর ভালমানুষি স্বভাবটাও ধরা পড়ে। তারাপদরা অবশ্য জানে, কিকিরার বুদ্ধির ধারেকাছেও তারা পৌঁছতে পারবে না।

কিকিরা নিজের জায়গায় বসতে বসতে বললেন, “স্যান্ডেল উডের খবর কী যেন বললে?”

“চাঁদু হসপিটালে ডিউটি দিচ্ছে।”

“ওর এমনি খবর ভাল?”

“হ্যাঁ। তবে বলছিল, এবার না- ট্রান্সফার করে দেয়। কোনো গাঁ-গ্রামে পাঠিয়ে দেবে।“

“আগে দিক। তোমার খবর কী?”

“এমনিতে ভাল। তবে আপনার কাছে একটা খবর নিয়ে এসেছি।”

“কী খবর?”

তারাপদ পকেট থেকে কিছু-একটা বার করতে করতে বলল, “দেখাচ্ছি। আপনাকে। তার আগে গৌরচন্দ্রিকাটা সেরে নিই।”

“বলো?”

“আমাদের অফিসে জগন্নাথ দত্ত বলে একজন আছে। আমার চেয়ে বয়েসে খানিকটা বড়। আমরা বলি জগুদা। জগুদারা থাকে বিডন পার্কের দিকে। মানে সেকেলে পুরনো কলকাতা পাড়ার এক গলিতে। পৈতৃক বাড়ি। সাত শরিক। জগুদা মানুষটি খুব ভাল। মাটির মানুষ। কিন্তু জগুদার কতক রোগ আছে অদ্ভুত। কাছে গিয়ে আচমকা গায়ে হাত দিলে বা জোরে ডাকলে ভূত দেখার মতন চমকে ওঠে, সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে যায়, কেমন তোতলাতে শুরু করে, কথা বলতে পারে না অনেকক্ষণ। আমরা ঠাট্টা করে জগুদার নাম দিয়েছি নার্ভাস সিস্টেম, মানে ওর নার্ভাস সিস্টেমে গোলমাল আছে।”

কথার মাঝখানে চা নিয়ে এল বগলা।

বগলার সঙ্গে আগেই বাড়িতে পা দিতে-না-দিতেই তারাপদর কথাবার্তা হয়ে গিয়েছে। তারাপদ বলেছিল, “বগলাদা আমার পেটে আগুন জ্বলছে। আমাকে তুমি লুচি আর বেগুনভাজা খাওয়াবে। কিকিরার ওইসব মুলতানি আলুর দম, খানদানি কচুরি, কিসমিসের পকৌড়া আমায় খাওয়াবে না। আমার পেটের নাড়িভুড়ি আমারই বুঝলে তো, কিকিরার নয়। প্লিজ বগলাদা, সেরেফ লুচি আর বেগুনভাজা। কিকিরাকে কিছু বোলো না। উনি যখন জানবেন, তখন জানবেন। জানলেও তো গলা কাটতে পারবেন না।”

তারাপদর কথা মতনই বগলা লুচি-বেগুনভাজা নিয়ে এসেছে। অবশ্য কিকিরা খানিকটা আগেই সেটা ধরতে পেরেছেন। বগলাকে বার্মিজ ওমলেট বানাবার পরামর্শ দিতে গিয়ে দেখেন, সে লুচির ময়দা মেখে নিয়েছে।

বগলার সঙ্গে, তারাপদর চোখাচোখি হল। মুখ টিপে হাসল বগলা। তারাপদ একবার কিকিরার দিকে চোরের মতন তাকিয়ে অপরাধীর ভঙ্গিতে হাসল একটু।

খাওয়া শুরু করার আগেই তারাপদ একটা ইনল্যান্ড লেটার কার্ড এগিয়ে দিল কিকিরাকে।

কিকিরা বললেন, “কী আছে এতে?”

“পড়ে দেখুন।”

“পড়ছি। আগে মুখে শুনি।”

তারাপদ লুচি মুখে দিল। চিবোতে চিবোতে বলল, “ক্লীং রিং হিং…”

ইনল্যান্ড চিঠিটা দেখতে দেখতে কিকিরা বললেন, “মানে?” বলে চোখ তুলে তারাপদর দিকে তাকালেন, “হিং টিং ছট?”

তারাপদ বলল, “আপনি চিঠিটা মন দিয়ে পড়ুন–আমি ততক্ষণে একটু ইট করে নিই, ভেরি হাংগরি, স্যার।”

কিকিরা চিঠি পড়তে লাগলেন।

তারাপদর সত্যিই খিদে পেয়েছিল খুব। খেতে-খেতে কিকিরার চোখ-মুখ দেখছিল। কিকিরা চিঠি পড়তে পড়তে এতই অবাক হচ্ছিলেন যে, তাঁর চোখের পলক পড়ছিল না, মুখ হাঁ হয়ে যাচ্ছিল।

বার-দুই চিঠিটা পড়ে কিকিরা তারাপদর দিকে তাকালেন। “কী ব্যাপার হে! এই শুদ্ধানন্দ প্রেসিদ্ধ কল্পবৃক্ষঃ-টি কে?” কল্পবৃক্ষঃ-এর বিসর্গটি বেশ জোরের সঙ্গে মজার গলায় উচ্চারণ করলেন। তারপর ঠাট্টা করে বললেন, “এ যে তোমার স্যাংসক্রিট ট্রি।”

খানিকটা খাওয়ার পর তারাপদর আর তাড়া ছিল না। জলও খেয়েছে আধগ্লাস মতন। কিকিরার কথায় হেসে ফেলল। তারপর ধীরেসুস্থে খেতে লাগল। বলল, “কে আমি কেমন করে জানব স্যার। উনি নিজেই বলেছেন প্রেতসিদ্ধ এবং কল্পবৃক্ষঃ।”

কিকিরা বললেন, “তা তো দেখছি। উনি আবার বিশুদ্ধ প্রেসিদ্ধ। মানে দাগমারা খাঁটি প্রেত-সিদ্ধপুরুষ। ভেজাল নয়। এরকম মহাত্মা ব্যক্তি তো আগে আমি দেখিনি, তারাপদ।…ক্লীং রিং হিং…বাঃ, এ যেন ভূতের হাতে বেল রিংগিং…ছন্দ আছে হে, বাজছে ভাল…ক্লীং রিং হিং…।”

তারাপদ বলল, “চিঠিটা স্যার আমি জগুদার কাছ থেকে কেড়েকুড়ে নিয়ে এলাম। বললাম, আমাকে দাও, আমি একজনকে জানি, যিনি ভূত-প্রেতের ব্যাপারে মাস্টার। এ টু জেড পর্যন্ত জানেন ভূতপ্রেতদের। ওঁর কাছে ভূতপ্রেতদের ডিরেক্টরি আছে–খুঁজে বার করে নেবেন নামধাম…” বলে তারাপদ হাসতে লাগল, “ঠিক বলিনি স্যার?”

কিকিরা বললেন, “দাঁড়াও, আরও একবার পড়ি চিঠিটা। তুমিও শোনো।”

কিকিরা চিঠি পড়তে শুরু করলেন

“ক্লীং রিং হিং

কাঁঠালতলা গলি
টেগোর ক্যাসেল স্ট্রিট (উঃ)
 কলিকাতা
২৯ অগ্রহায়ণ ১৩৯৫

 মহাশয়,

আমাদের পরমারাধ্য গুরু প্রেতসিদ্ধ কল্পবৃক্ষঃ শুদ্ধানন্দজির আশীর্বাদ জানিবেন। তাঁহার নির্দেশ অনুযায়ী এই পত্র লিখিতেছি।

গত ২০ অগ্রহায়ণ রাত্রিকালে গুরু শ্ৰদ্ধানন্দজি যখন সূক্ষ্ম শরীরে আত্মালোকে বিচরণ করিতেছিলেন তখন আপনার পরমারাধ্যা পরলোকবাসী মাতৃদেবী সুরমা দেবীর সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ ও কথোপকথন হয়। আপনার দুর্দশা বিষয়ে মাতৃদেবী সবিশেষ অবগত আছেন। তাঁহার ব্যাকুলতারও অবধি নাই। আপনি যে আর্থিক ও মানসিক কষ্ট ভোগ করিতেছেন তাহাতে তিনি অতীব কাতর। আপনার ভগ্নির বিবাহ অবশ্যই হইবে, অর্থ ও অলঙ্কারের জন্য আটকাইবে না। আপনার মাতৃদেবী তাঁহার ও উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত অলঙ্কারগুলি গোপনে এমন স্থানে গচ্ছিত রাখিয়াছেন, যাহা আপনারা কেহই জানেন না। আকস্মিক মৃত্যু হেতু তিনিও আপনাকে কিছু জানাইয়া যাইতে পারেন নাই। এক্ষণে জানাইতে চান। প্রত্যক্ষভাবে আপনাকে জানানো সম্ভব নয়, যেহেতু তিনি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম রূপে আত্মালোকে বিচরণ করিতেছেন, আর আপনি মর্ত্যলোকে। যাহাই হউক, প্রেতসিদ্ধ শুদ্ধানন্দজি মারফত নিজ পুত্রকন্যার সুখ শান্তির জন্য তিনি গোপন বিষয়টি জানাইতে ইচ্ছুক। তিনি যে কী পরিমাণ ধনরত্ন রাখিয়াছেন আপনি জানেন না। এ-বিষয়ে আপনি যত শীঘ্র সব শুদ্ধানন্দজির সহিত সাক্ষাৎ ও যোগাযোগ করুন।

আমাদের পরমারাধ্য গুরু শুদ্ধানন্দজি একাদশ তন্ত্রমন্ত্র সাধনায় সিদ্ধ। মাত্র চতুর্দশ বৎসর বয়েসে গৃহত্যাগ করিয়া ইষ্ট গুরু অন্বেষণ করিয়াছেন। পাহাড়-পর্বত, নদী-সমুদ্র, জনপদ-শ্মশান–এই দেশের কোথায় না ভ্রমণ করিয়াছেন, কত মহাসাধন্দ্রে সংস্পর্শেই না আসিয়াছেন। দুঃখীর দুঃখ মোচন, দুর্গতজনের দুর্গতি দূর করাই তাঁহার একমাত্র ব্রত।

আপনি অবিলম্বে শুদ্ধানন্দজির সহিত সাক্ষাৎ করুন। উদ্বেগ দুশ্চিন্তা দূর হইবে। আসিবার পূর্বে পত্র দিবেন।

গুরুজির আশীবাদ লইবেন। ইতি

নিবেদক, কৃষ্ণমূর্তি।

 পুনশ্চ পত্রটি সঙ্গে আনিবেন। পত্ৰ-বিষয়ে গোপনতা অবলম্বন না করিলে আপনর শত্ৰুজন হইতে ক্ষতির আশঙ্কা।“

চিঠি পড়া শেষ হল। কিকিরা যেন হাঁফ ছাড়লেন।

 তারাপদ চা খেতে শুরু করেছিল। লুচি খাওয়ার পর্ব শেষ।

 কিকিরাও চায়ের কাপ টেনে নিলেন। বললেন, “হাতের লেখাটি বেশ। ছাপার হরফ যেন।”

“হ্যাঁ, মুক্তাক্ষর। কিন্তু কিকিরা চিঠি থেকে কী আন্দাজ হচ্ছে আপনার?”

“কী আন্দাজ করতে বলছ?”

“বাঃ, আপনি হলেন কিকিরা দি গ্রেট! ভুজঙ্গ কাপালিকের ভুতুড়ে খেলা আপনি ধরতে পেরেছিলেন, আর এ তো কোন শুদ্ধানন্দ। আপনার কাছে ছেলেমানুষ স্যার।”

কিকিরা চা খেতে-খেতে বললেন, “তোমার অফিসের বন্ধুর নাম যেন কী বললে?”

“জগন্নাথ দত্ত। আমরা জগুদা বলি।”

“মা নেই?”

“না, মা মারা গিয়েছেন বছরখানেকের ওপর। বাবা অনেক আগেই।”

“বোন আছে?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ। একটি মাত্র বোন। জগুদার নিজের কোনো ভাই নেই। বোনই সব।”

“বোনের বিয়ে?”

“কথাবার্তা হয় মাঝে-মাঝে, এগোতে পারে না। বিয়ে দেবার ক্ষমতা জগুদার নেই। যা মাইনে পায় দুই ভাই-বোনের চলে যায় কোনোরকমে। আমারই মতন অবস্থা, কিকিরা। আমি তবু ঝাড়া হাত-পা। একা মানুষ।”

কিকিরা হাত বাড়িয়ে চিঠিটা রেখে দিলেন, দিয়ে চুরুটের খাপ টেনে নিলেন।“কী তুমি বলছিলে তখন? সাত শরিকের বাড়ি…?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ। কলকাতার সেকেলে বনেদি পরিবার একটা বাড়ি আছে তিন-চার পুরুষের। সে বাড়ির চেহারা দেখলে মনে হবে, মাথার ওপর বাড়ি পড়ো-পড়ো।”

কথাটা আর তারাপদকে শেষ করতে দিলেন না। কিকিরা বললেন, “বুঝেছি। ইট বার করা, ভাঙা, অশ্বত্থ গাছের ডালপালা গজিয়েছে ভাঙা, ফাটা দেওয়ালে। গঙ্গাজলের, ফাটাফুটো ট্যাংক, গিরগিটি, টিকটিকির আড়ত…এই তো।”

“ইয়েস স্যার।”

“কজন শরিক?”

“মুখে বলি সাত শরিক। তা জগুদা বলে চার শরিক।”

“শরিকরা তোমার জগুদারই আত্মীয় তো?”

“হ্যাঁ, খুড়তুতোর খুড়তুতো, জেঠতুতোর জেঠতুতে। ভেরি কমপ্লিকেটেড স্যার।“

“জগন্নাথের সঙ্গে সম্পর্ক নিশ্চয় ভাল নয়।”

“কেমন করে হবে। যে যার নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। অভাবী সকলেই। তাদেরও ঘাড়ে বড় বড় সংসার। ওর মধ্যে দু-একজন ধড়িবাজও আছে।”

“বুঝেছি।”

 কিছুক্ষণ চুপচাপ। কিাি একটা চুরুট ধরালেন। আঙুলের মতন সরু, লম্বায় ছোট।

তারাপদ বলল, “ব্যাপারটা পুরো চিটিংবাজি। নয় কি?”

“তা আর বলতে। তবে দেখতে হবে প্রেতসিদ্ধ কল্পবৃক্ষ শুদ্ধানন্দটি কে? কী তার মতলব? কে তাকে বলেছে জগন্নাথের মা মারা যাবার আগে বেশ কিছু গয়নাগাটি ধনরত্ন লুকিয়ে রেখে গিয়েছেন?”

“আমিও তাই বলি। এমন কে আছে যে এই কাজ করবে? কেনই-বা করবে? কিসের স্বার্থ তার? নাকি জগুদার সঙ্গে কেউ তামাশা করছে?”

কিকিরা চোখ বুজে কিছুক্ষণ চুরুট ফুকলেন। তারপর বললেন, “তোমার জগুদা কী বলছে? তামাশা?”

তারাপদ মাথা নাড়ল। বলল, “জগুদা ভীষণ ভাল, নিরীহ। ভিতু। যে যা বলে জগুদা বিশ্বাসও করে নেয়। আমি কথা বলেছি জগুদার সঙ্গে। দেখলাম মায়ের কথাটা সে বিশ্বাস করে নিয়েছে।”

কিকিরা বললেন, “কোন কথাটা? মায়ের সঙ্গে শুদ্ধানন্দর দেখা হওয়া, না গয়নাগাটি লুকিয়ে রাখা?”

“দুটোই। বলে তারাপদ চায়ের কাপ সরিয়ে রাখল। ঢেকুর তুলল বড় করে। বলল, “জগুদা খুবই মাতৃভক্ত। বাবা মারা গিয়েছেন বছর আট-নয় আগে। তখন জগুদার বয়েস কম। মাথার ওপর মা ছাড়া আর কেউ ছিলেন না। বোনও ছোট। কত কষ্ট সহ্য করে মা তাদের মানুষ করেছেন। জগুদা বলে, মা না থাকলে ওরা ভেসে যেত। শক্ত হাতে মা হাল ধরেছিলেন বলে ওরা বেঁচে গিয়েছে।”

কিকিরা অন্যমনস্কভাবে বললেন, “বেশ তা না হয় হল। কিন্তু মা যে যথেষ্ট সোনাদানা লুকিয়ে রেখে গিয়েছেন এ কথা কেমন করে বিশ্বাস করছে তোমার জগুদা?”

তারাপদ বলল, “আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। জগুদা বলল, ব্যাপারটা অসম্ভব নয়। মা ছিলেন হিসেবি, বুদ্ধিমতী, বিচক্ষণ। ভবিষ্যতের কথা সব সময় ভাবতেন। বিশেষ করে বোনের কথা। তা ছাড়া সেকালের বনেদি বাড়ির বউ, জগুদার দাদামশাই-দিদিমাও একসময়ের পয়সাঅলা লোক। নিজের মায়ের কাছ থেকে জগুদার মা নিশ্চয় অনেক কিছু পেয়েছিলেন। জগুদারা ছেলেবেলায় মায়ের গয়নাগাটি দেখেছে।”

 “না হয় দেখল। কিন্তু তারাপদ, জগুদার মা সব সোনাদানা লুকিয়ে রাখবেন কেন?”

তারাপদ বলল, “বাড়ির অন্যদের ভয়ে। জগুদার যেসব জ্ঞাতিরা ও বাড়িতে থাকে তাদের দু-একজন পয়লা নম্বরের শয়তান। চোর, গুণ্ডা, বদমাশ। ওদের ভয়েই মা সোনাদানা লুকোতে পারেন।”

কিকিরাও চা শেষ করে চায়ের কাপ সরিয়ে রাখলেন। নিজের মনেই কিছু ভাবছিলেন। ঘর বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে। শীত এখনও পড়েনি। তবে এই সন্ধের মুখে গা শিরশির ভাব হয়। উঠলেন কিকিরা। বাতি জ্বালিয়ে দিলেন ঘরের।

“তা হলে?” কিকিরা বললেন হঠাৎ।

তারাপদ বলল, “আপনি বলুন?”

“তুমি বলছ, এই প্রেতসিদ্ধ শুদ্ধানন্দ মহারাজকে একবার দেখা দরকার। তাই না?”

“রাইট স্যার।”

“তোমার জগুদা কি মহারাজের কাছে গিয়েছে?”

“না। তার যাবার ইচ্ছে। ভয়ে যেতে পারছে না।”

“চিঠিটা কতদিন হল পেয়েছে ও?”

“দিন পাঁচেক।”

“কাকে কাকে দেখিয়েছে?”

“আমাকে আর ঘোষালদাকে।“

“ঘোষালদা লোকটি কে?”

 “আমাদের সিনিয়ার। জগুদার খুব বন্ধু।”

“চিঠি দেখে কী বলল, ঘোষাল?”

“বলল, বাজে ব্যাপার, ফালতু। জগুদার সঙ্গে কেউ মজা করেছে। ভিতু মানুষ জগুদা, ভয় দেখিয়ে তামাশা করেছে।”

কিকিরা নিজের জায়গায় এসে বসলেন। মাথার চুল ঘাঁটলেন। বললেন, “তা তোমার জগুদাকে নিয়ে এলে না কেন?”

“আনতাম। ভাবলাম আপনাকে না বলে আনা কি ভাল হবে। তা ছাড়া জগুদাকৈ বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আনতে হবে। বললেই যে জগুদা আসবে মনে হয় না। ধরে আনতে হবে।”

কিকিরা বললেন, “তবে তাই নিয়ে এসো। কথা বলে দেখি। ভাল কথা, চন্দনকে কিছু বলেছ?”

“না। সময় পেলাম না। কাল-পরশু বলব।”

“ঠিক আছে।…আপাতত তুমি তোমার জগুদাকে ম্যানেজ করো। করে এখানে নিয়ে এসো। দেখি, কথা বলে দেখি। তারপর কিছু একটা করা যাবে।”

.

০২.

দিন তিনেক আর দেখা নেই তারাপদর।

চারদিনের দিন সন্ধের মুখে তারাপদ হাজির, সঙ্গে চন্দন আর নতুন একটি ছেলে। পরিচয় করিয়ে দেবার আগেই কিকিরা বুঝে নিলেন, ছেলেটি জগন্নাথ।

ঘরে পা দিয়েই তারাপদ বলল, “কিকিরা-স্যার, আপনার স্যান্ডেল উডকে ধরে এনেছি। আর এই আমাদের জগুদা।”

কিকিরা হাসিমুখে বললেন, “এসো। বোসো হে জগন্নাথবাবু, বোসো।” বলে চন্দনের দিকে তাকালেন। “কিসের এমন ডিউটি তোমার স্যান্ডেল উড? আজ মাসখানেক বেপাত্তা হয়ে রয়েছ?”

চন্দন বলল, “বলবেন না, হাসপাতালে গণ্ডগোল, অর্ধেক লোক ছুটিতে। খেটে-খেটে মরছি। তার ওপর শুনছি, জানুয়ারিতে নাকি আমাকে বাইরে ট্রান্সফার করে দেবে। কোথায় দেবে কে জানে! অজ গাঁ-গ্রামে ঠেলে দেবে! আমার মন-মেজাজ বড় খারাপ, কিকিরা!”

কিকিরা বললেন, “জানুয়ারি! তার এখন মাস-দুই দেরি। এখন থেকে মেজাজ খারাপ করছ কেন! এখন সবেই নভেম্বরের গোড়া!”

চন্দন বলল, “আপনার আর কী? ভিলেজ ডাক্তারির ঝক্কি তো জানেন না। হাসপাতালের দরজায় বড়ি ফেলে দিয়ে পালায়। ডেঞ্জারাস?”

তারাপদ রগড় করে বলল, “তোর বডিও একদিন ফেলে দেবে, চাঁদু তুই বরং চাকরি ছেড়ে দে, দিয়ে নফর কুণ্ডু লেনে পি. পি. শুরু কর।

কিকিরা বললেন, “পি. পি-টা কী?”

“প্রাইভেট প্র্যাকটিস” বলে হাসতে লাগল তারাপদ। হাসতে হাসতে বলল, “খুব কম খরচে বসে যেতে পারবি। একটা টেবিল, দু-তিনটে চেয়ার, বেঞ্চি একটা। ব্যস! আর তোর লাগবে নাম-ছাপানো প্যাড। একটা স্টেথো। সেটা তোর আছে। কত কম খরচে ব্যবসা বল!”

কিকিরা, চন্দন, দুজনেই হেসে উঠলেন।

জগন্নাথ হাসল না। সে একে নতুন লোক, তায় কিকিরার চেহারা, পোশাক, এই অদ্ভুত ঘরটি দেখে কেমন যেন হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। তারাপদ তাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে কোথায় ধরে এনেছে? কিকিরাকে দেখলে তো সাকাসের জীব মনে হয়। আর এই ঘরটা যেন চিতপুরের থিয়েটারের সাজ-ভাড়া দেওয়া কোনো দোকান-টোকান।

জগন্নাথ রীতিমত হতাশ হয়ে পড়ছিল। তারাপদ অবশ্য আগেই বলে দিয়েছিল, “জগুদা, তোমাকে যেখানে নিয়ে যাচ্ছি সেখানে গিয়ে ভড়কে যাবে না, আমাদের কিকিরা রহস্যময় পুরুষ, মিস্টিরিয়াস ক্যারেকটার কিকিরা দি গ্রেট, কিকিরা দি ওয়ান্ডার। ওঁর বাইরের স্টাইল দেখে ভেতরের ব্যাপার বুঝবে না। বাইরে উনি সাকাসের ক্লাউন, ভেতরে হুডিনি। ম্যাজিশিয়ান হুডিনি নাম শুনেছ তো? কিকিরা হলেন হুডিনি প্লাস শার্লক হোমস।”

জগন্নাথের মনে হল, তারাপদ বাজে কথা বলেছে। কিকিরার ওপর ভরসা করা মানে পুরোপুরি ডুবে যাওয়া।

তারাপদ জগন্নাথের মুখ দেখে বুঝতে পারছিল জগুদা বেশ হতাশ। কিকিরার দিকে তাকাল সে। বলল, “কিকিরা-স্যার, জগুদার সঙ্গে আপনি কথা বলুন। জগুদা ভাবছে, এ-কোথায় তাকে নিয়ে এলুম! ঘাবড়ে গিয়েছে বেচারি।”

কিকিরা জগন্নাথের দিকে তাকালেন, বললেন, “আগে কথা, না, চা?”

“চা আসছে। বগলাদাকে বলে এসেছি।”

কিকিরা বললেন, “ভাল করেছ। তা জগন্নাথবাবু, আপনি কি প্রেসিদ্ধ কল্পবৃক্ষর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এসেছেন?” মজার ঢঙেই বললেন কিকিরা।

জগন্নাথ থতমত খেয়ে গেল। কিকিরার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকল, কথা বলতে পারল না।

তারাপদ অবাক হয়ে বলল, “কিকিরা, হাউ স্ট্রেঞ্জ! আপনি কেমন করে জানলেন?”

কিকিরা হেসে বললেন, “ভৌতিক উপায়ে। আমি স্পিরিট ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। দু’দিন চেষ্টা করে লাইন পেলাম। কলকাতার টেলিফোনের মতন ওদের লাইনেও গোলমাল, জট পাকিয়ে আছে। আমাদের যেমন বর্ষা ওদের তেমন শীত–বেশি কুয়াশা হলেই লাইন নষ্ট বারবার রং নাম্বার।” বলে কিকিরা হাসতে লাগলেন।

তারাপদরা হেসে ফেলল।

শেষে তারাপদ বলল, “আপনি ঠিকই ধরেছেন। জগুদা শুদ্ধানন্দ প্রেতসিদ্ধর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল।”

“কবে?”

তারাপদ জগন্নাথের দিকে তাকাল। মানে সে জগুদাকেই জবাবটা দিতে বলল।

জগন্নাথ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে নিচু গলায় বলল, “গত পরশু।”

“দেখা হল প্রেতসিদ্ধর সঙ্গে?”

“আমি বাড়িটার মধ্যে ঢুকিনি। ঢুকতে ভয় হল। বাইরে থেকে দেখে এলাম।”

“বাইরে থেকে! কী দেখলে?”

“গলির নাম কাঁঠালতলা নয়। লোকে বলে, কাঁঠালতলা। গলির মুখে বিরাট এক কাঁঠালগাছ। কত কালের গাছ কে জানে! সরু গলি, বাই লেনের মতন। ইট বাঁধানো গলির একদিকে কোনো বড় গুদোম-টুদোম হবে, কিসের জানি না, পাঁচিল তোলা রয়েছে। মাথায় পুরনো টিনের ছাউনি। লঙ্কার ঝাঁঝ নাকে আসছিল। বোধ হয় মশলাপাতি থাকে ওখানে। মশলা-গুদোম। বাঁ দিকে গুদোম, ডান দিকে ভাঙাচোরা কয়েকটা বাড়ি। অনেক পুরনো। ওখানে কারা থাকে জানি না, জনকতক মুটে-মজুর, ঠেলাওয়ালা দেখলাম। গলির শেষে একটা পোড়ো বাগানবাড়ির মতন বাড়ি। সামনের দিকে ঝোঁপঝাড়, আগাছা। ভেতরে এক বাড়ি। কম সে কম শ’ সোওয়া-শো বছরের হবে।”

কিকিরা বললেন, “তুমি বাড়ির কাছে গিয়েছিলে?”

 মাথা নেড়ে জগন্নাথ বলল, “খুব কাছে যাইনি। যেতে ভয় করছিল।”

“ভয় ছিল! কিছু দেখলে ওখানে?”

“আজ্ঞে দেখেছি।”

“কী দেখলে?”

“দু-তিনজনকে দেখলাম, বাড়িটার মধ্যে ঢুকছে।”

“একসঙ্গে?”

“প্রথমে ঢুকল দু’জন। খানিকটা পরে একজন।”

“সাজপোশাক কেমন, বয়েস কত হবে আন্দাজে, বাঙালি না অন্য কিছু?”

জগন্নাথ বলল, “তিনজনেই বাঙালি বলে মনে হল না। অবাঙালিও রয়েছে। বয়েস কম নয়। আমার চেয়ে বড়। একজনের তো মাথার চুলই সাদা-সাদা লাগল। সন্ধে হয়ে গিয়েছিল, জ্যোৎস্নাও ফুটেছিল। তবু আমি ভাল করে দেখতে পাইনি। আমার ভয়ও করছিল। আমি যেখানে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম, সেখানটায় বোধ হয় আগে দরোয়ানের ঘর ছিল। এখন সব ভাঙাচোরা, চারদিকে কুলঝোঁপ!”

কিকিরা বললেন, “কতক্ষণ ছিলে তুমি?”

“বড়জোর আধ ঘণ্টা।”

 “আর কিছু দেখোনি?”।

“আজ্ঞে, আর-একটা জিনিস দেখেছি। একটা লোক বড় প্লাস্টিকের বস্তার মধ্যে কাকে যেন পুরে কাঁধে করে বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল।”

চন্দন আর তারাপদ চোখ চাওয়াচাওয়ি করল। কিকিরাও যেন অবাক হলেন।

তারাপদ কিকিরাকে বলল, “জগুদা আমাকে বলেছে, স্যার। আমার মনে হয়, জগুদা ভুল দেখেছে। আজকাল কত তাড়াতাড়ি অন্ধকার হয়ে যায়, আপনি দেখেছেন! জগুদা বলছে, বাড়িটার কাছাকাছি কোনো আলোও জ্বলছিল না। ব্যাপারটা চোখের ভুল।”

কথার মধ্যে বাধা দিয়ে জগন্নাথ বলল, “চোখের ভুল নয়। আমি দেখেছি। অন্ধকার হয়ে এলেও এখন শুক্লপক্ষ। চাঁদের আলো ছিল। গতকাল পূর্ণিমা গিয়েছে।”

কিকিরা বললেন, “প্লাস্টিকের ব্যাগে লোক ঢোকে কেমন করে?”

জগন্নাথ বলল, “বড় ব্যাগ। মুড়ি-অলারা যেমন প্লাস্টিকের ব্যাগ মাথায় নিয়ে মুড়ি বিক্রি করতে যায়, সেইরকম।“

“ব্যাগের মধ্যে মানুষ ছিল তুমি বুঝলে কেমন করে?”

“দেখলাম।”

“ভুল দেখোনি?”

“কী জানি, আমার চোখে তো মানুষই মনে হল।”

 চন্দন এতক্ষণ চুপচাপ ছিল, এবারে বলল, “একজন মানুষের ওজন কত হতে পারে? রোগাসোগা হলেও মিনিমাম চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ কেজির মতন। সাবালকের কথা বলছি। বাচ্চা-কাচ্চা হলে অন্য কথা। একজন সাবালক, মানুষকে কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যাওয়া সোজা কথা?”

জগন্নাথ বলল, “বাঃ, ঘাড়ে-পিঠে করে আমরা মানুষ বই না! আগের দিনে কলকাতার বাবুরা ঝাঁকামুটের মাথায় চেপে অফিস-কাছারি যেত।”

চন্দন হেসে ফেলে বলল, “সেই মুটে, সেই বাবু এখন আর নেই। জগন্নাথবাবু! অবশ্য হ্যাঁ, ঘাড়ে-পিঠে আমরা মানুষ বই বইকি এখনও। তবে তার প্রসেস আলাদা।”

কিকিরা বললেন, “তুমি কি ঠিকই দেখেছ, জগন্নাথ?”

“আমার তাই মনে হয়।”

কিকিরা কথা ঘুরিয়ে নিলেন। বললেন, “তুমি তারপরই চলে এসেছ।

“হ্যাঁ। আমার এমনিতেই ভয় করছিল। তার ওপর লোকজন ঢুকছে, প্লাস্টিকের ব্যাগে-ভরা মানুষ, এইসব দেখে আমি পালিয়ে এলাম”।

তারাপদ বলল, “কিকিরা-স্যার, জগুদা এমনিতেই ভিতু মানুষ, নার্ভাস, নিরীহ। জগুদা যে কেমন করে ওখানে গিয়েছিল, কোন সাহসে, তাই আমি বুঝতে পারছি না। না।”

জগন্নাথ কোনো জবাব দিল না।

এমন সময় চা নিয়ে এল বগলা। গোল বড় ট্রে করে চা এনেছে। চায়ের সঙ্গে ডালপুরি, আলুর দম; একটা করে ডবল শোনপাপড়ি।

কিকিরা বললেন, “নাও হে তোমরা, হাত লাগাও। এ ডালপুরি হাউস মেড নয়, গণেশের দোকানের। ভালই করে। খাও।”

নিজে কিকিরা কিছু নিলেন না, শুধু চায়ের কাপটি তুলে নিলেন।

চন্দন খাবারের দিকে হাত বাড়াল। বলল, “গরম আছে রে তারাপদ, নিয়ে নে। আপনিও নিন জগন্নাথবাবু।“

ওরা খাওয়া শুরু করল।

কিকিরা জগন্নাথকে লক্ষ করতে লাগলেন। আধময়লা রং জগন্নাথের। মাথায় মাঝারি। সামান্য গোলগাল চেহারা। মাথায় চুল কম। মুখটি দেখলেই বোঝা যায়, ছেলেটি নিরীহ ধরনের, গোল-গোল চোখ, মোটা নাক, ছোট কপাল। কত আর বয়েস হবে। বড়জোর ঊনত্রিশ-ত্রিশ।

কিকিরা জগন্নাথকে বললেন, “এবার একটা কথা বলো তো?”

 তাকিয়ে থাকল জগন্নাথ।

“তুমি যে ওই প্রেতসিদ্ধ কল্পবৃক্ষটির কাছে গিয়েছিলে, কেন গিয়েছিলে?”

জগন্নাথ চুপ। যেন তার মুখে কোনো জবাব জুটছে না। ইতস্তত করতে লাগল। চোখ নিচু করল।

কিকিরা নিজেই বললেন, “তুমি ওই প্রেতসিদ্ধর চিঠির কথা বিশ্বাস করো?”

জগন্নাথ চোখ তুলে তারাপদর দিকে তাকাল, চন্দনকেও দেখল। কী বলবে বুঝতে পারছিল না। বোধ হয় তার সঙ্কোচও হচ্ছিল। শেষে ভাঙা-ভাঙা ভাবে সামান্য আড়ষ্ট হয়ে বলল, “দেখতে গিয়েছিলাম।”

“কেন?”

“মনে হল…”

“তোমার মনে হল, ওই লোকটার কথা যদি সত্যি হয়। তাই না?”

জগন্নাথ আবার চোখ নিচু করল। অল্প সময় চুপ করে থেকে বলল, “আজ্ঞে হ্যাঁ। ..আপনি আমাদের বাড়ির কথা কিছু জানেন না। আমার বাবা একজন জুয়েলার ছিলেন। অবস্থা পড়ে যাবার পর তিনি নিজে আর তেমন ব্যবসাপত্র করতে পারতেন না। কলকাতার কয়েকটা বড়-বড় জুয়েলারের দোকানে আসা-যাওয়া করতেন। তাদের পাথর-টাথর পরখ করে দিতেন। নিজে কোনো অডার পেলে দোকান থেকে কিনিয়ে দিতেন। তাঁর একটা কমিশন থাকত।” কথা বলতে বলতে হঠাৎ চুপ করে গেল জগন্নাথ। যেন বাবার কথা ভাবছিল। খানিকটা উদাস বিষণ্ণ হয়ে থাকল অল্পক্ষণ। পরে আবার বলল, “আমার বাবা অদ্ভুতভাবে মারা যান। একদিন বর্ষার সময় রাত করে বাড়ি ফিরছিলেন। বাড়ির কাছাকাছি যখন, তখন একটা মোটর সাইকেল এসে তাঁকে ধাক্কা মারে। বাবা হুমড়ি খেয়ে পড়ে যান রাস্তায়। তাঁর কোমরের কাছে লেগেছিল। বাবাকে রাস্তায় পড়ে যেতে দেখে দুজন পাড়ার রিকশঅলা হইচই করে ওঠে। মোটর সাইকেলঅলা পালিয়ে যায়। বাবাকে ওরা বাড়ি পৌঁছে দেয়। কিন্তু বাবার কোথায় যে লেগেছিল কে জানে, দিন-তিনেকের মাথায় হাসপাতালে মারা যান। বাবা কম বয়েসেই মারা গেলেন।”

কিকিরা জগন্নাথের বিষণ্ণ মুখের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকলেন, তারপর নরম গলায় বললেন, “কী আর করবে! তোমার ভাগ্য! ওই তারাপদরও তো একই অবস্থা। ওকেও মা বাবা হারাতে হয়েছে কম বয়েসেই।”

তারাপদ বলল, “আমি জগুদাকে বলেছি সব। ও-নিয়ে আর দুঃখ করে লাভ নেই। আমাদের মতন আরও কত ছেলেমেয়ে আছে!”

কিকিরা বললেন, জগন্নাথকে, “তোমার মা কতদিন হল নেই?”

“মা আজ প্রায় দেড় বছর হল নেই। গত বছরের গোড়ার দিকে মা মারা যান।”

“কী হয়েছিল?”

“বুকে ব্যথা। আমি তখন অফিসে। খবর পেয়ে বাড়ি গিয়ে দেখি, মা নেই। মাকে হাসপাতাল নিয়ে যাবারও সুযোগ হয়নি। আগেই মারা গিয়েছেন।”

“হার্ট অ্যাটাক?”

“হ্যাঁ। মায়ের হার্টের রোগ ছিল। তবে হঠাৎ এমন হবে কেউ ভাবেনি।”

চন্দন বলল, “হার্টের রোগের ব্যাপারটা বড় ট্রেচারাস। কখন কী হয়ে যায় কেউ বলতে পারে না। “

কিকিরা চা শেষ করে চুরুটের খাপটা টেনে নিলেন। মাঝে-মাঝে শখ করে চুরুট খান। বড় চুরুট পছন্দ করেন না। সরু-সরু আঙুলের মতন পাঁচ-দশটা চুরুট তাঁর সব সময়েই মজুত থাকে।

চুরুট ধরিয়ে কিকিরা জগন্নাথকে বললেন, “এবার একটু অন্য কথা বলা যাক। আমার প্রথম কথা হল, ওই প্রেসিদ্ধ শুদ্ধানন্দ কল্পবৃক্ষটির কথা তুমি বিশ্বাস করছ কেন?”

জগন্নাথ মুখ তুলে তাকিয়ে থাকল। জবাব দিতে পারছিল না। শেষে বলল, “পুরো বিশ্বাস করিনি।”

“বিশ্বাস না করলে চিঠিটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছ কেন?”

জগন্নাথ মাথা চুলকোতে-চুলকোতে বলল, “ঠিক বিশ্ব নয়, তবে এরকম হয় শুনেছি।”

“কী শুনেছ?”

কী শুনেছে জগন্নাথ বলতে যেন লজ্জা পাচ্ছিল। কিংবা সঠিকভাবে জানে না বলে চট করে বলতে পারছিল না। ইতস্তত করে বলল, “আমার এক পিসেমশাই সাহেব কোম্পানিতে হেড ক্যাশিয়ার ছিলেন। একবার ক্যাশ থেকে হাজার চল্লিশ টাকা তছরুপ হয়। পিসেমশাইয়ের হাতে হাতকড়া পড়ার অবস্থা। পিসেমশাই, তো লজ্জায়, অপমানে, ভয়ে আত্মহত্যাই করতে যাচ্ছিলেন। পিসিমাই তাঁকে বাঁচিয়ে দেন। পিসিমা আগেই মারা গিয়েছিলেন। তাঁর আত্মা এসে পিসেমশাইকে বলে দেয়, টাকাটা কে নিয়েছে, নিয়ে কোথায় রেখেছে?”

তারাপদ আর চন্দন হেসে উঠল। কিকিরা হাসলেন না।

তারাপদদের হাসিতে জগন্নাথ ক্ষুণ্ণ হল। বলল, “বিশ্বাস না করলে আমি আর কী করব। তবে এরকম ঘটনা আমি আরও শুনেছি। আমাদের পাড়ার মথুরজেঠা একবার বিশেষ দরকারে বাড়ির সিন্দুক থেকে দরকারি দলিলপত্র বার করেছিলেন। পরে সেই দলিলপত্র হারিয়ে যায়। ওই দলিল শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল মথুরজেঠারই বইয়ের আলমারির নিচের তাকে, পুরনো পাঁজির আড়ালে। জেঠার বাবার আত্মা এসে বলে গিয়েছিল। নয়ত ওই পুরনো দলিল আর সময়মতন খুঁজে পাওয়া যেত না।”

চন্দন এবার পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করল। তারাপদকে সিগারেট দিল। বলল, “জগন্নাথবাবু, এসব হল গল্প। আপনি এগুলো বিশ্বাস করেন?”

জগন্নাথ বলল, “বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না, তবু মনে হয়, হতেও তো পারে। কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যে কেমন করে বলব! এই তো সেদিন কাগজে পড়ছিলাম, একজন নামকরা বিজ্ঞানী যাচ্ছিলেন বিদেশে, এক সেমিনারে। সকালে তাঁর প্লেন। রাত্রে ঘুমের মধ্যে মাকে স্বপ্ন দেখলেন। মা বারণ করলেন ওই প্লেনে যেতে। ভদ্রলোকের মন খুঁতখুঁত করতে লাগল। তিনি শেষ পর্যন্ত সকালের প্লেনে গেলেন না। দুপুরে দিল্লির প্লেন ধরলেন। সকালের প্লেনটায় অদ্ভুতভাবে অ্যাকসিডেন্ট হল। মারা গেল কত প্যাসেঞ্জার। এ-সব কেন হয় কে জানে! হয়।”

তারাপদ সিগারেট ধরিয়ে বলল, “কাকতালীয় ব্যাপার…!”

 কিকিরা কিছুক্ষণ কথা বলেননি। এবার বললেন, জগন্নাথকে, “হয় কি হয় না সেটা পরের কথা। তার আগে তুমি আমায় বলল তো, বোনের বিয়ে নিয়ে তুমি খুব চিন্তায় আছ, তাই না?”

জগন্নাথ মাথা হেলিয়ে বলল, “হ্যাঁ। মা বেঁচে থাকতে কত খোঁজখবর করতেন। মা তো মারা গেলেন। আমার আর কেউ নেই, এই বোনটি ছাড়া। ওর জন্য আমি সারাদিন ভাবি। ওর বিয়ে হয়ে গেলে আমার দায়িত্ব চুকবে।”

কিকিরা বললেন, “বিয়ের কি সব ঠিকঠাক হয়েছে!”

“আজ্ঞে না। কথাবার্তা এক-একবার হয়। আর এগোয় না। আমরা গরিব মানুষ। বাবা মারা যাবার পর মা আমাদের বড় কষ্ট করে মানুষ করেছিলেন। মা আর নেই। আমি যে কেমন করে ঝুমুর বিয়ে দেব কে জানে?”

কিছুক্ষণ আর কথা বলল না কেউ।

শেষে কিকিরা বললেন, “জগন্নাথ, একটা কথা বলো তো? তোমার একথা কেন মনে হচ্ছে যে, তোমার মা তোমার বোনের বিয়ে-থার জন্য কিংবা তোমাদের আপদ-বিপদের জন্য কম হোক, বেশি হোক–কিছু সোনাদানা, টাকা কোথাও লুকিয়ে রেখে গিয়েছেন।”

জগন্নাথ বোকার মতন তাকিয়ে থাকল। কী বলবে বুঝতে পারছিল না। পরে বলল, “আমার মনে হত না। ওই চিঠিটা পেয়ে আমি প্রথমে বিশ্বাসও করিনি। ভেবেছিলাম, কোনো বাজে লোক আমার সঙ্গে তামাশা করেছে। ওটা উড়ো চিঠি। পরে পাঁচরকম ভাবতে-ভাবতে আমার মনে হল, মা মাঝে-মাঝে বলতেন, ঝুমুর বিয়ের জন্যে ভাবতে হবে না, একটা ব্যবস্থা মা করে রেখেছেন। কী ব্যবস্থা, মা অবশ্য বলতেন না। কথাটা মনে হবার পর আমার কেমন…।” কথাটা আর শেষ করল না জগন্নাথ।

কিকিরা ঘাড় নাড়তে-নাড়তে বললেন, “বুঝেছি। তোমার মনে হচ্ছে হয়ত মা কোথাও কিছু রেখে গেছেন লুকিয়ে।”

“আজ্ঞে হ্যাঁ।”

কিকিরা তাঁর মাথার লম্বা-লম্বা চুল ঘাঁটতে-ঘাঁটতে আচমকা বললেন, “জগন্নাথ, তোমার বাবা না জুয়েলার ছিলেন? দামি পাথর-টাথর পরখ করতে পারতেন?”।

“হ্যাঁ। বাবার খুব নামডাক ছিল। বাবা পাথর যাচাইয়ে এক্সপার্ট ছিলেন। দামটামও ঠিক করতে পারতেন। হীরের ব্যাপারে বাবার চেয়ে বড় আর কেউ ছিল না।”

“হঁ। তোমার বাবা মোটর সাইকেলের ধাক্কায় ভীষণ জখম হন। মারাও যান। এইখানটায় যে গোলমাল লাগছে, জগন্নাথ। উনি জখম হন, না, ওঁকে জখম করা হয়? একটু তো ভাবতে হয় হে। দু-একটা দিন সময় দরকার। না কি হে চন্দন?”

চন্দন কোনো জবাব দিল না।

.

০৩.

জগন্নাথকে বলেননি কিকিরা, আড়ালে তারাপদকে বলে দিয়েছিলেন।

পরের দিন শনিবার। বিকেল-বিকেলই এল তারাপদ। চন্দনকে সঙ্গে নিয়েই এসেছে।

কিকিরা মোটামুটি তৈরি ছিলেন। বললেন, “আমি রেডি। শুধু তোমাদের জন্যে বসে ছিলাম। একটু টি টেকিং করে চলো বেরিয়ে পড়ি। বগলাকে বলি।”

কিকিরাকে যেতে হল না, তারাপদই হাঁক মেরে বলল, “বগলাদা তিন কাপ চা। শুধু চা। একটু তাড়াতাড়ি।”

চন্দন বলল, “আর্টটা নাগাদ ফিরতে হবে, কিকিরা। আমার একটা জরুরি কাজ আছে।”

কিকিরা বললেন, “আগেই ফিরে আসব।”

“আজ আপনি কী দেখতে যাচ্ছেন?”

“শুদ্ধানন্দজির ঘাঁটি। জায়গাটা একবার নিজের চোখে দেখে নেওয়া উচিত।” বলে উঠে গিয়ে একটা কাগজ তুলে আনলেন টেবিল থেকে। ভাঁজ করা কাগজ। কাগজটা খুলে নিতে নিতে বললেন, “কলকাতার ম্যাপ। বছর বিশ-পঁচিশ আগে ছাপা। রাস্তা থেকে একটা কিনে রেখেছিলুম। এত বড় শহর, কয়েকশো পাড়া, হাজার কয়েক গলি, বাই-গলি, মানে বাই লেন, কে তার হিসেব রাখে গো! আর নামের কত বাহার বাবা! গুমঘর লেন, কর্ক লেন, ঝাঁপতলা বাই লেন…, গুলু ওস্তাগর…নামের ফুলঝুরি। তা এই ম্যাপ থেকে দেখছি–চিতপুর দিয়ে এগোলেই বা ব্র্যান্ড রোড ধরেও আমরা যেতে পারি।”

তারাপদ আর চন্দন ম্যাপ দেখায় গা করল না। ইশারায় বোঝাতে চাইল, ম্যাপের দরকার নেই, জায়গাটা খুঁজে নেওয়া যাবে।

কিকিরা ম্যাপটা ভাঁজ করতে করতে বললেন, “জগন্নাথের খবর কী?”

“নতুন কিছু নয়, তারাপদ বলল।

“কিছু বলছিল?”

“না, ওই বলছিল–কিকিরা কী করেন? ম্যাজিক দেখান? …আমি বললাম,

এখন আর স্টেজে ম্যাজিক দেখান না, রিয়েল লাইফে ম্যাজিক দেখিয়ে বেড়ান।” বলে তারাপদ ঘসতে লাগল।

কিকিরাও হাসলেন।

চন্দন জগন্নাথের চিঠির ব্যাপারে কাল থেকেই খুঁতখুঁত করছিল।বলল, “আমার কিন্তু মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা ঠাট্টা-তামাশা। কোনো বন্ধু বান্ধব বা জানাশোনা কেউ জগন্নাথের সঙ্গে মজা করেছে।”

তারাপদ বলল, “তা কেমন করে হবে!” বলে কিকিরার দিকে তাকাল, বলল আবার, “চাঁদু একটা জিনিস বুঝছে না। এটা যদি মজা হত, ঠাট্টা হত–জগুদা কাঁঠালতলার গলিতে গিয়ে ওরকম একটা বাড়ি দেখত না। না হয় বাড়িটাই শুধু দেখত, কলকাতায় পুরনো অলিগলিতে অমন বাড়ি নিশ্চয় অনেক আছে। কিন্তু জগুদা কি প্লাস্টিকের বস্তার মধ্যে একটা মানুষকে পুরে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে তা দেখতে পেত? না কি, ওই যে তিনটে নোক ঢুকছে–তাদের দেখত?…জগুদা মানুষটা ভিতু, গোবেচারা, বোকাসোকা, কিন্তু কিকিরা-স্যার, একটা কথা ঠিক, জগুদা কখনোই মিথ্যে কথা বলবে না এ ব্যাপারে। বলে কী লাভ!”

কিকিরা মাথা নাড়লেন। বললেন, “আমারও সেরকম মনে হয়। জগন্নাথ সাদাসিধে, সরল ছেলে। ওর কথাবার্তা থেকেই সেটা বোঝা যায়। মিথ্যে কথা জগন্নাথ বলেনি। তবে ও যে ঠিক কী দেখেছে, ভুল দেখেছে চোখে, না। সত্যি-সত্যি যা দেখেছে সেটাই বলছে, সে-ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে।”

চন্দন বলল, “কিকিরা, ভয়ের সময় মানুষ অনেক ভুতুড়ে জিনিস দেখে। এটা তার দোষ নয়, আমাদের সকলেরই চোখ মাথা বুদ্ধি ভয়ের সময় স্বাভাবিক। কাজ করতে পারে না। তারাপদকে মর্গের মধ্যে নিয়ে গিয়ে একদিন রেখে দিলেই দেখবেন ওর কী হাল হয়েছে!”

তারাপদ বলল, “চাঁদু, জগুদা ভিতু ঠিকই, কিন্তু সে মিথ্যে কথা বলার লোক নয়।”

চন্দন বলল, “মিথ্যে কথা বলছে জগন্নাথ–তা তো বলিনি। আমি বলছি, চোখে ভুল দেখেছে। একটা সার্বালক মানুষকে ওভাবে মুড়ির ব্যাগে করে ভরে মাথায় চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় না। অসম্ভব।”

কিকিরা বললেন, “স্যান্ডেল উড, তুমি সাবালক মানুষ বলছ কেন?”

চন্দন তাকাল। কিছু বুঝতে পারল না। বলল, “কেন?”

“ধরো ওটা মানুষ নয়, মানুষ-পুতুল। মানে, মানুষের নকল বা ডামি?”

“ডামি?”

“আর ওটা যে ঠিক সাবালকই ছিল, জগন্নাথ এমন কথাও বলেনি।“

চন্দন তাকিয়ে থাকল। কথা বলল না। ডামি? কথাটা যেন সে ভাবছিল অন্যমনস্কভাবে।

কিকিরা বললেন, “কাপড়চোপড়ের দোকানে, বড়-বড় টেলারিং শপে যে ডামি দেখো তার ওজন কত হে? আজকাল তো আবার শুনি প্লাস্টিকের, পেপার পাল্পের ছাঁচ করে মুখ হাত পা তৈরি হচ্ছে। এতে ফিনিশ ভাল হয়। আর ওজন…? হালকা, একেবারেই হালকা…।”

চন্দন আগে কথাটা ভাবেনি, এখন তার মনে হল, সত্যি তো একটা ডামির আর ওজন কত হবে। নিতান্ত ফাঁপা ফাঁকা বস্তু, ওপরের খোলটাই সব। প্লাস্টিকের ব্যাগে করে ও-জিনিস অনায়াসেই বয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। তবে হ্যাঁ, ব্যাগের মধ্যে ধরে এমন ডামি হতে হবে। মুড়ি মাথায় করে যারা ঘুরে বেড়ায়, তাদের প্লাস্টিকের ব্যাগের মাপটা আন্দাজ করলে মনে হয়, সাবালক ছেলেমেয়েকে দাঁড় করানো অবস্থায় তার মধ্যে ঢোকানো মুশকিল। নাবালক বাচ্চাকাচ্চাকে অবশ্য ঢোকানো চলে।

চন্দন এবার একটু লজ্জা পেয়ে বলল, “ডামির কথা আমি ভাবিনি, কিকিরা, সরি। আপনার তো বেশ মাথায় এসেছে।”

তারাপদ হঠাৎ বলল, “স্যার, আমি সেদিন কোথায় যেন একটা ছবি। দেখছিলাম সিনেমার। একটা ডামিকে পাঁচতলার ছাদ থেকে ফেলে দিচ্ছে।”

কিকিরা বললেন, “একসময় মাটি দিয়ে, ছেঁড়া কাপড়চোপড়, তুলো, কাঠের গুঁড়ো পুরে ডামি করা হত। দিনকাল পালটে গিয়েছে। এখন যা ডামি করে আসল-নকল বোঝা যায় না।”

বগলা চা নিয়ে এসেছিল। চা রেখে দিয়ে চলে গেল।

চায়ের কাপ তুলে নিয়ে তারাপদ বলল, “নিন, চা খেয়ে নিন। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়তে হবে।”

কিকিরা বললেন, “সন্ধের মুখে-মুখে পৌঁছতে পারলেই ভাল।”

“কেন?”

“লুকিয়ে-চুরিয়ে দেখতে হবে প্রেতসিদ্ধর আখড়া। কারও চোখে পড়তে চাই না। তবে আজকাল তো পাঁচটা বাজলেই অন্ধকার হয়ে যায়। আমরা ঠিক সময়ে পৌঁছে যাব।”

চন্দন চা খাচ্ছিল; বলল, “স্যার, আজ শনিবার। আজ প্রেতসিদ্ধর আখড়ায় গ্যাদারিং বেশিই হতে পারে। তাই নয়?”

কিকিরা মজার গলায় বললেন, “শনিবার বারবেলার পর টাইমটা ভাল। মনে হয়, মক্কেল ভালই হবে। চলো, দেখা যাক কী হয়!”

চা খাওয়া শেষ করে উঠতে উঠতে সামান্য সময় লাগল। তারপর উঠে পড়ল তিনজনে।

.

ট্যাক্সিতে যেতে-যেতে কিকিরা বললেন, “তারাপদ, জগন্নাথের জ্ঞাতিগুষ্ঠি যারা একই বাড়িতে থাকে ওর সঙ্গে, তাদের তুমি চেনো?”

মাথা নাড়ল তারাপদ। বলল, “চেনা বলতে দু’-একজনকে দেখেছি। জগুদার বাড়িতে আমি বার তিন-চার গিয়েছি। তখনই যা দেখেছি। সকলকে নয়, দু-একজনকে চিনি।”

“জগন্নাথ তার জ্ঞাতিদের সম্পর্কে কিছু বলে না?”

“কারও কারও সম্পর্কে বলে।”

“যেমন?”

তারাপদ রাস্তা দেখছিল। কলকাতার রাস্তায় বাতি জ্বলে উঠেছে। আজ খানিকটা মেঘলা রয়েছে। বৃষ্টি হবার আশা অবশ্য নেই। কিন্তু মেঘলার দরুন, ধুলো আর হালকা কুয়াশা মিলে অন্যদিনের তুলনায় ঝাপসা ভাবটা বেশিই হয়েছে আজ।

তারাপদ বলল, “জগুদা কী বলে জানতে চাইছেন?…জগুদার মুখে দু’জনের। কথা বেশি শুনেছি। একজন তার কাকা, জ্ঞাতিসম্পর্কে। পুরো নাম জানি না, জগুদা বলে, কুমারকাকা। অন্যজন জগুদার দাদা হয় সম্পর্কে, বাচ্চুদা। দু’জনেই নচ্ছার টাইপের। জগুদাকে বিরক্ত করে, খোঁচায়, তামাশা করে তাকে নিয়ে। আসলে ওরা জগুদাকে পছন্দ করে না। জগুদাও ওদের দেখতে পারে। না।”

চন্দন বলল, “তুই একদিন একটা লোকের সঙ্গে কথা বলছিলি কলেজ স্কোয়ারে দাঁড়িয়ে, সেই লোকটা?” বলে চন্দন তারাপদকে ইশারায় যেন বোঝাতে চাইল, ঘাড়ে-গদানে হওয়া একটা লোক কি না!

তারাপদ ভাবল একটু। বলল, “কবে বল তো?”

“আরে সেই যে ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে নাটক দেখতে গেলাম..”

“ও! না, না, সে তো আমাদের বিল সেকশানের জয়ন্তদা। জয়ন্তকুমার। এ অন্য। এর নাম জানি না। জগুদা বলে কুমার কাকা। আমি ভদ্রলোককে দেখেছি। চোখে চিনি। হিন্দি সিনেমার ফাইটারদের মতন দেখতে। সলিড বডি।”

“বয়েস কত?” কিকিরা জিজ্ঞেস করলেন।

 “ক-ত আর! বছর বিয়াল্লিশ-চুয়াল্লিশ। দারুণ বডি।”

“ও! আর তোমার ওই বাচ্চুদা?”

“সেটাকে একেবারে পাড়ার গুণ্ডা বদমাশের মতন দেখতে। চেহারা দেখলে আপনি হাসবেন। ল্যাকপ্যাক করছে। তবে স্যার, তার ড্রেস, চোখে গগলস, গলায় রুপোর চেন, মাথার চুল দেখলে বুঝতে পারবেন পাড়ার ঘাঁটিতে তার প্রেস্টিজ আছে। রেসিং সাইকেল নিয়ে ঘোরে। সাইকেলে নাকি ব্রেক নেই, ঘন্টিও নয়।”

চন্দন হেসে ফেলে বলল, “ব্রেকলেস বাচ্চু। …ব্রেক থাকবে না পায়ে ব্রেক মেরে সাইকেল থামাবে, ঘণ্টি থাকবে না–তোর ঘাড়ে পড়তে পড়তে পড়বে না, বেরিয়ে যাবে শাঁ করে, এ-সব হল কায়দা। যার যত কায়দা সে তত বড় হিরো। জানিস?”

জানে তারাপদ।

কিকিরা বললেন, “ব্রেকলেসবার বয়েস কত?”

“জগুদার চেয়ে এক-আধ বছরের বড়। জগুদা যা বলে।

“এরা দু’জন করে কী?”

তারাপদ বলল, “বাচ্চু কিছুই করে না। পাড়ার কাছে কোথায় একটা লন্ড্রি খুলেছিল একবার। বলত, শালকরের দোকান। কিছু শাল ঝেড়ে দিয়ে দোকান বন্ধ করে দেয়। তারপর কিছুদিন ও-পাড়ার কোনো সিনেমা হাউসের টিকিট ব্ল্যাকে নেমেছিল। পুলিশ ওকে ধোলাই দেবার পর সেটাও ছেড়ে দেয়। এখন কী করে জানি না।”

কিকিরা বললেন, “বাঃ! দুটিই রত্ন। কাকা-ভাইপো। বডিবিল্ডার-কুমার আর ব্রেকলেস বাচ্চু! ভেরি গুড।”

চন্দনের খেয়াল হল। বলল, “এখানে নেমে পড়া ভাল।“

তারাপদ সঙ্গে-সঙ্গে ট্যাক্সি থামাতে বলল।

.

খানিকটা আগেই নেমে পড়েছিল তারাপদরা। হাঁটতে লাগল। রাস্তার লোকজনকে জিজ্ঞেস করছিল মাঝেসাঝে। উত্তর কলকাতার এই জায়গাটার যেমন কেমন মরা-অবস্থা। আদ্যিকালের এলাকা বলেই বোধ হয় তার আর কোনো শোভা নেই। রাস্তা, দোকান, বাড়িঘর সবই খাপছাড়া, ভাঙাচোরা। পুরনো দিনের গন্ধও বুঝি পাওয়া যায়।

অনেকটা এগিয়ে এসে তারাপদ বলল, “কিকিরা-স্যার, আমরা কি গঙ্গার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি?”

কিকিরা মাথা নাড়লেন।

চন্দন বলল, “চিতপুরের এইসব এলাকা এককালে কলকাতার বনেদি পাড়া ছিল, তাই নয় কিকিরা?”

কিকিরা বললেন, “ছিল বই কি!” বলে তারাপদর দিকে মুখ ফেরালেন। বললেন, “তারাপদ, তুমি জগন্নাথের বাবা সম্পর্কে কিছু জানো?”

তারাপদ অবাক হয়ে বলল, “জগুদার বাবা! না, জগুদার বাবা সম্পর্কে কেমন করে জানব! জগুদার বাবা! না, জগুদার মুখে আপনি যা শুনেছেন আমিও তাই শুনেছি। বরং সেদিন আপনার কাছে জগুদা বাবার কথা খানিকটা বলল, আমি অতটাও আগে শুনিনি।”

চন্দন বলল, “যাচ্ছি আমরা প্রেতসিদ্ধকে খুঁজতে, আপনি জগন্নাথের বাবার কথা তুলছেন কেন?”

কিকিরা বললেন, “গাছের শেকড়টা বোধ হয় ওই বাবাতেই ছড়িয়ে আছে। এ যা দেখছ–এগুলো ওপরের ডালপালা।”

“মানে?”

“মানেটা বোঝবার চেষ্টা করো স্যান্ডেল উড! তুমি তো ডাক্তার। একটা লোক এসে তোমায় বলল, তার মাথা ব্যথা করছে, তুমি তখন কী করবে? ব্যথাটা কেন, কী থেকে হচ্ছে জানার চেষ্টা করবে না। এটাও হল সেইরকম। শুদ্ধানন্দ বাবাজি হল পরের ব্যাপার, আগের ব্যাপারটা তো জানতে হবে।”

তারাপদ হঠাৎ বলল, “স্যার, আমরা বোধ হয় এসে গিয়েছি।”

চন্দন দাঁড়িয়ে পড়ল।

ক’দিন আগে পূর্ণিমা গিয়েছে। আজ কোন তিথি কে জানে। এখনো চাঁদ ওঠেনি। কৃষ্ণপক্ষ। অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল।

কিকিরা ভাল করে দেখলেন। বললেন, “এই গলিটাই মনে হচ্ছে।”

চন্দন বলল, “হ্যাঁ, এই গলি। গাছটাও রয়েছে।”

“তবে এসো,” বলে কিকিরা পা বাড়ালেন।

জগন্নাথ যেমন-যেমন বলেছিল, গলির বাঁ দিকে লম্বা একটানা টিনের চালা, গুদোমখানার মতনই দেখতে। ডান দিকে ঠেলাঅলাদের আস্তানা। সরু গলি, ইট বাঁধানো। ভাঙা ঘরবাড়ি, আগাছা আর স্যাঁতসেঁতে জমিজায়গার এক ঘন গন্ধ রয়েছে। এই গলিতে বাতিও জ্বলে না।

একটু লক্ষ করলেই বোঝা যায়, গুদোমখানা বা ঠেলাগাড়ির আস্তানার পেছন দিকের গলি এটা। এই গলি দিয়ে মানুষই কোনোমতে চলতে পারে, আর কিছু করা সম্ভব নয়।

কবেকার এক পুরনো ভাঙা মন্দির, ভেঙে পড়া বাড়ির স্তূপ, গাঁ-গ্রামের মতন শ্যাওড়া আর কুলঝোঁপ, জোনাকি উড়ছিল কয়েকটা।

খানিকটা এগিয়ে কিকিরা বললেন, “ওহে, একসঙ্গে এসো না। পজিশন নিয়ে এগোও।“

চন্দন ঠাট্টা করে বলল, “আমরা কি যুদ্ধে যাচ্ছি, না, ডাকাতি করতে যাচ্ছি যে পজিশন নেব?”

কিকিরা মজার গলায় বললেন, “স্পাইয়িং করতে যাচ্ছি। স্পাইয়িং করার সময় ঘাপটি মেরে যেতে হয়, বুঝলে?”

“বুঝলাম।”

“তোমাদের কাছে টর্চ নেই?”

“না।”

“আমার কাছে আছে। আমি এখন টর্চ জ্বালাব না। নেহাত দরকার না পড়লে জ্বালাবই না। আমি আগে-আগে যাচ্ছি। তোমর পেছন-পেছন এসো। তফাতে থাকবে। কেউ যেন কাউকে চেনো না, এইভাবে আসবে।”

তারাপদ বলল, “ঠিক আছে। আপনি এগিয়ে যান।”

কিকিরা বিশ-পঁচিশ পা এগিয়ে গেলেন। তারাপদ বলল, “চাঁদু, তুই এগো। আমি সবার শেষে।”

সামান্য দাঁড়িয়ে থেকে চন্দনও পা বাড়াল।

 তারাপদ অপেক্ষা করতে লাগল।

 সামান্য পরে তারাপদর মনে হল, পেছনে যেন কার পায়ের শব্দ হচ্ছে। আসছে কেউ। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখবে কি দেখবে না করেও সে ঘাড় ঘোরাল না। গলি দিয়ে লোকজন আসতেই পারে। কৌতূহল দেখানো উচিত নয়।  

তারাপদ খুব আস্তে-আস্তে হাঁটতে লাগল, যেন তার পায়ে চোট রয়েছে, জোরে-জোরে হাঁটতে পারছে না।

শব্দটা ক্রমশই কাছে এসে গেল।

হঠাৎ তারাপদর মনে হল, শ্ৰদ্ধানন্দর কোনো চেলা তাদের ওপর নজর রাখছে না তো? কিন্তু তাই বা কেমন করে হবে। ওরা যে আজ কাঁঠালতলার গলিতে গোয়েন্দাগিরি করতে আসছে এ-কথা অন্য কেউ জানে না। জগুদাও নয়।

তারাপদ ঘাবড়াল না। আগের মতনই হাঁটতে লাগল। সামনে চন্দন রয়েছে, তার আগে কিকিরা। বেমক্কা কিছু ঘটলে তারাপদ চেঁচাবে। তার চিৎকার শুনলে চন্দনরা ছুটে আসবে।

একেবারে ঘাড়ের ওপর কে যেন এসে পড়ল। দাঁড়াল তারাপদ। ঘাড় ঘোরাল।

অন্ধকার এমন নয় যে লোক দেখা যায় না। তারাপদ লোকটাকে দেখল। দেখে অবাক হল। কুচকুচে কালো, নাদুসনুদুস, টাক মাথা বয়স্ক এক ভদ্রলোক। ধুতি-জামা পরা। চোখে চশমা। হন্তদন্তভাবে হাঁটছিল। ঘাড়ে এসে পড়েছে।

তারাপদ ইচ্ছে করেই বলল, “দাদা, একটু সামলে…। ঘাড়ে এসে পড়ছেন যে!”

লোকটি কোনো কথা বলল না। যেন কানেই তুলল না কথাটা। দেখলেও না তারাপদকে। হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে গেল। ওর তাড়া দেখে মনে হল, কোনো দিকে খেয়াল রাখার মতন অবস্থা এখন আর মশাইটির নেই। আশ্চর্য!

হাঁটতে-হাঁটতে তারাপদ লোকটিকে দেখছিল। ও কি প্রেতসিদ্ধর কাছে যাচ্ছে? বোধ হয় সেখানেই যাচ্ছে।

গলিটা একেবারে সোজা নয়, ডাইনে-বাঁয়ে বাঁক আছে। লোকটা কোথায় মিলিয়ে গেল।

চন্দন বা কিকিরাকেও দেখতে পাচ্ছিল না তারাপদ। আড়ালে পড়ে গিয়েছে ওরা। খানিকটা এগোতেই বাঁ দিকের এক ভাঙাচোরা একতলা বাড়ির সদর খুলে গেল আচমকা। শব্দ হল। এরকম একটা দরজা এখানে থাকতে পারে কে জানত! দরজার চেহারা দেখলেই ভয় করে। কালো ঝুল যেন। বোঝাই যায় না ওটা দরজা না অন্য কিছু।

দরজা খুলে ঢ্যাঙামতন একটা লোক বেরিয়ে এল। তার পেছন-পেছন এক নেড়ি কুকুর। কুকুরটা ডেকে উঠেছিল। তারাপদর পায়ের কাছে ছুটে আসতে-না-আসতেই ঢ্যাঙা লোকটা ধমক দিল কুকুরটাকে।

তারাপদকে দেখতে-দেখতে লোকটা বলল, “কোন বাড়ি চাই?” ওর গলার স্বর ভাঙা, খসখসে।

তারাপদ ঘাবড়ে গেল। বলল, “এটা কাঁঠালতলার গলি নয়?”

“হ্যাঁ।”

“এখানে শুদ্ধানন্দ গুরুজি?”

“ও!…সিধে হাঁটতে হবে।”

“কতটা?”

“পাঁচ-সাত মিনিট।” বলে লোকটা উলটো দিকে পা বাড়াতে গিয়ে থেমে গেল। বলল, “ঘন্টা পড়েছে?”

“ঘণ্টা?”

“ঘণ্টা পড়ার পর বাবার ওখানে ঢোকা যায়।”

“ও।”

“প্রথম ঘণ্টাও পড়েনি?”

“শুনিনি।..তবে একজনকে যেতে দেখলাম।”

“আজ শনিবার না? ঘণ্টা পড়ে যাবে।” বলে লোকটা আর দাঁড়াল না। এগিয়ে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে দূর থেকে ঢং করে ঘণ্টা বেজে উঠল।

.

০৪.

বাড়িটা যে কার ছিল, কিসের ছিল–কিছুই বোঝা যায় না। অনেকটা কুঠিবাড়ির মতন দেখতে। চারপাশে গাছপালার জঙ্গল। ভাঙাচোরা পাঁচিল। একসময় হয়ত কোনো সাহেব কোম্পানির ঘাঁটি ছিল, কিংবা কোনো সাহেবসুবো থাকত, ব্যবসা বাণিজ্য দেখাশোনা করত। এখন বাড়িটার কিছু কিছু কোনোরকমে দাঁড়িয়ে আছে, বাকিটা ভেঙে পড়েছে।

তারাপদ ভাঙা ফটকের কাছেই কিকিরাদের পেয়ে গিয়েছিল। কিকিরাই নিচু গলায় ডেকে নিয়েছিলেন তারাপদকে।

ওরা তিনজনে গাছপালার আড়ালে এমন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল যে, এই বাড়িতে কারা আসছে সেটা নজর করা যায়। এখনো চাঁদ ওঠেনি। চাঁদ না উঠলেও অন্ধকার সামান্য ফিকে হয়েছে। আকাশের একপাশে চাঁদ উঠি-উঠি করছে।

কিকিরা ভেবেছিলেন, জায়গাটা একবার দেখেশুনে আজ চলে যাবেন। বেশি উঁকিঝুঁকি মারার চেষ্টা করবেন না। প্রথম দিনে ধরা পড়ার সম্ভাবনা বেশি। কিছুই যে জানেন না। সাবধান হতে পারবেন না। প্রেসিদ্ধর চেলারা কখন কোন দিক থেকে দেখে ফেলবে কে জানে!

কিন্তু প্রেতসিদ্ধর আখড়ায় পৌঁছে দেরি হতে লাগল। ২০১২

এর মধ্যে দুটো ঘণ্টা পড়ে গিয়েছে। পেটা ঘড়িতে ঘণ্টা বাজানোর মতন করে ঢং করে ঘণ্টা বাজাচ্ছিল কেউ।

এখন আর ঘণ্টা বাজছে না।

চন্দন হাত বাড়িয়ে কিকিরাকে ঠেলা দিল। চাপা গলায় বলল, “সাহেব!”

কিকিরা তাকালেন। তারাপদও দেখল।

কোট-প্যান্ট পরা একটা লোক ভাঙা ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে কী যেন দেখছিল। অল্পক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সে সামনের দিকে পা বাড়াল। দাঁড়াল, আবার। বুঝতে পারছিল না কোন দিকে যাবে। কিকিরাদের বড় কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে লোকটি।

লোকটা জোরে-জোরে কাশল। তারপর গলা চড়িয়ে ডাকল, “কে আছে?”

বারকয়েক ডাকাডাকির পর সাহেব যখন বিরক্ত হয়ে পায়চারি করছে, বাড়ির দিক থেকে একজনকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল।

সাহেব কিছু বলার আগেই লোকটা যেন কী বলল। শোনা গেল না।

পকেট হাতড়ে সাহেব এক টর্চ বার করেছিল বোধ হয়। আলো জ্বলল। ছোট টর্চ নিশ্চয়। সঙ্গে-সঙ্গে তার হাত থেকে টর্চ কেড়ে নিল লোকটা, প্রেতসিদ্ধর চেলা। টর্চ নিবিয়ে দিল।

সাহেব এবার খাপ্পা হয়ে উঠেছিল। চেঁচিয়ে বলল, “এটা কী?”

লোকটা বলল, “এখানে আলো নিয়ে আসা বারণ। লিখে দেওয়া হয়েছিল। চিঠি কই?”

সাহেব পকেট থেকে কী-একটা বার করল।

অন্ধকারেই লোকটা চিঠি দেখল, না, চিঠির চেহারা দেখেই বুঝে নিল সব কে জানে! বলল, “জোয়ারদার?”

“বিশ্বনাথ জোয়ারদার। পাতিপুকুর থেকে আসছি।…কী জায়গা তোমাদের! খুঁজে পাওয়া যায় না। এমন জায়গায় মানুষ আসে?”।

“দরকার পড়লেই আসে। …কথা বলবেন না। আসুন।” বলে লোকটা ফিরতে লাগল। ফিরতে-ফিরতে বলল, “দেরি করে এলে ঘরে ঢুকতে দেবার নিয়ম নেই। গুরুজি আসনে বসে পড়েছেন। ঘর বন্ধ। দেখি কী বলেন।“

দু’জনের কথাবার্তা অস্পষ্টভাবেই শোনা যাচ্ছিল। শেষে আর কথা শোনা গেল না, ওরা এগিয়ে তফাতে চলে গেল।

তারাপদ বলল, “বাঙালিসাহেব।”

কিকিরা বললেন, “জোয়ারদার। বাবা বিশ্বনাথ।”

চন্দন বলল, “ক’জন হল কিকিরা?”

“সাহেবকে নিয়ে পাঁচজন। প্রথমে এসেছিল টাক, সেকেন্ড এল দাড়িঅলা বুড়ো, তিন নম্বর এল–রোগাসোগা চশমা চোখে, মাস্টার-মাস্টার চেহারার লোকটা, চার নম্বর হল তোমার সেই পাজামা-পাঞ্জাবি পরা ছোকরা। আর লাস্ট এই জোয়ারদার।”

তারাপদ বলল, “আরও আসবে নাকি?”

“শনিবারের বাজারে পাঁচজন–মন্দ কী! এখানেই তো পঞ্চমুখী হয়ে গেল।”

ধীরে-ধীরে কথা বলছিল ওরা। গলার শব্দ উঠছিলই না। গায়ে-গায়ে তিনজনে দাঁড়িয়ে আকাশে চাঁদ উঠে এল।

চন্দন বলল, “দাঁড়িয়ে থেকে আর লাভ আছে?”

কিকিরা ভাবলেন সামান্য। তারপর বললেন, “না। আজকের মতন এখানেই ইতি। ভেতরে উঁকি মারার চেষ্টা করে লাভ নেই, ধরা পড়ে যাব। ওটা পরে হবে। জায়গাটা তো দেখা হয়ে গেল। আমি সকালের দিকেও খোঁজ নিতে পারব দু’-একদিনের মধ্যেই।”

“তা হলে ফেরা যাক।”

“চলো।”

 সাবধানেই বাড়ির চৌহদ্দির বাইরে এল তিনজনে। জ্যোৎস্না ফুটতে শুরু করেছে। হাওয়া আসছিল গঙ্গার দিক থেকে। কাছেই গঙ্গা। এই সরু গলিটা দিয়ে এগিয়ে গেলে কি গঙ্গা পাওয়া যাবে? কে জানে!

ফিরতি পথে তারাপদ বলল, “কিকিরা-স্যার, কী মনে হচ্ছে আপনার?”

কিকিরা বললেন, “মনে হচ্ছে, কল্পবৃক্ষটির গাছে রাই ফ্রুট ভালই ফলেছে।”

চন্দন জোরে হেসে উঠল।“রাইপ ফ্রুট!”

“গাছে ফল-ফুল ছাড়া আর কী ধরবে হে! এ-গাছ আবার ফুল ধরার গাছ নয়, ফলং বৃক্ষঃ। মানে ফল-ধরা গাছ।” কিকিরা রগুড়ে গলায় বললেন, পাকা লোক, প্রেতসিদ্ধ মহাপুরুষ উনি! পাকা ফল ফলাতে কতক্ষণ!”

তারাপদ বলল, “মহাপুরুষকে একবার যে দেখতে ইচ্ছে করছে, কিকিরা?”

“হবে। তর সও। এত তাড়াতাড়ি কি সব হয়! ধৈর্য ধরতে হবে, মাথা খাটাতে হবে। তবে না!”

হাঁটতে-হাঁটতে গলি দিয়ে বড় রাস্তায় এসে পড়ল তারাপদরা।

সঙ্গে-সঙ্গে লোডশেডিং। কলকাতা বলে শহর। আলো না গেলে কি হয়!

ঝপ করে অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় তিনজনেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। অচেনা জায়গা। কোন দিকে এগোবে যেন ঠাওর করতে পারছিল না। চোখ সইয়ে নিতে সময় লাগল সামান্য। ধীরে-ধীরে জ্যোৎস্নাও ফুটে উঠেছিল। এ-দিকটায় দোকানপত্র বেশি নেই। বসতবাড়িও কম। পর-পর বুঝি গুদোম-ঘর। কাঠগোলাও রয়েছে। লণ্ঠন, কুপি, মোমবাতি জ্বলে উঠতে লাগল একে-একে।

কিকিরা তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে পা বাড়াতে যাচ্ছেন এমন সময় তারাপদ সেই ঢ্যাঙা লোকটিকে আবার দেখল। সঙ্গে তার নেড়ি কুকুরটাও। লোকটি বোধ হয় বাড়ি ফিরছে।

তারাপদর সঙ্গে লোকটির চোখাচুখি হয়ে গেল। চলে যেতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়ল সে। হয়ত তারাপদদের তিনজনকে দেখছিল। তখন তারাপদ ছিল একলা মানুষ; এখন তিনজন হয়ে গেল কেমন করে?

তারাপদ কিছু বলার আগেই লোকটি নিজেই বলল, “দেখা হয়নি?”

মাথা নাড়ব কি নাড়ব না করে তারাপদ এমনভাবে মাথা নাড়ল যে হ্যাঁ-না কোনোটাই ঠিক করে বোঝা যায় না।

“তাড়াতাড়ি হয়ে গেল?” লোকটি বলল। গলার স্বরে যেন খানিকটা উপহাস। ওর হাতে একটা পাতায় মোড়া খাবারের ঠোঙা।

তারাপদ বুদ্ধি করে বলল, “আজ লোক বেশি। চলে এলাম।”

“ও! শনি-মঙ্গল বুঝি!”

“শুদ্ধানন্দজি এখানে কত দিন আছেন, দাদা?”

“কত দিন! ওই তো…গত বছর…তা ধরেন দেড় বছরটাক। “

“তা হলে বেশিদিন নয়।”

“ওই হল।…আয় ল্যাংড়া…।” লোকটি আর দাঁড়াল না, তার লেজুড়টিকে ডেকে নিয়ে গলির মধ্যে চলে গেল। নেড়ি কুকুরটার নাম ল্যাংড়া, না কি সে এক পায়ে ল্যাংড়া তারাপদ বুঝতে পারল না।

কিকিরা বললেন, “কে হে লোকটা?”

“এই গলিতে থাকে। যাবার সময় দেখা হয়েছিল।”

“প্রেতসিদ্ধর এজেন্ট নয় বলেই মনে হল।”

“কী জানি!”

“নাও, চলো।”

চন্দন বলল, “কিকিরা, এতরকম ঝাট না করে এখানকার থানায় একটা খবর দিয়ে দিলেই তো হয়।”

তারাপদ বলল, “থানায় খবর!..চাঁদু, তুই থানা দেখাস না। যা না, গিয়ে খবর দে। কচু হবে।”

কিকিরা বললেন, “থানা-টানা পরে, আগে কল্পবৃক্ষটিকে দেখি। আলাপ-পরিচয় হল না মহারাজের সঙ্গে, আগে থেকেই থানা-পুলিশ কেন! নাও, চলো। হাঁটতে হবে খানিকটা।”

.

চন্দনের জরুরি কাজ ছিল, সে নেমে গিয়েছিল আগেই, কিকিরা আর তারাপদ বাড়ি ফিরলেন সাড়ে আটটার পরই। তারাপদর বোর্ডিংয়ে ফিরতে ফিরতে রাত হবে। কিকিরার বাড়িতেই খাওয়া-দাওয়া সেরে সে নিজের আস্তানায় ফিরবে। মাসের মধ্যে চার-পাঁচটা দিন তার এইভাবেই কাটে।

বাড়ি ফিরে বগলাকে চা করতে বললেন কিকিরা। তারপর আরাম করে বসলেন।

তারাপদও গা ছড়িয়ে বসে পড়ল।

কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর কিকিরা বললেন, “তারাপদ, তোমার অফিসের বন্ধু জগন্নাথের বাড়িতে এমন কেউ নেই যে হাঁড়ির খবর-টবর দিতে পারে?”

মাথা নাড়ল তারাপদ। বলল, “না। হাঁড়ির খবরে আপনি কী করবেন?”

কিকিরা বললেন, “জগন্নাথের বাবা সম্পর্কে খোঁজ-খবর করা দরকার।”

“কেন?”

“আসল রহস্যটা বোধ হয় ওখানে।”

“আপনি তখনও কথাটা বললেন, স্যার। আমি কিন্তু বুঝিনি। জগুদার বাবা কবে মারা গিয়েছেন, এখন তাঁকে টানাটানি কেন? মরা মানুষের সঙ্গে কিসের সম্পর্ক…”

“তুমি কিছু বুঝলে না.” তারাপদকে কথা শেষ করতে না দিয়ে কিকিরা বললেন। “একটু মাথা খাটাও।”

“আপনিই বলুন।”

দু-চার মুহূর্ত কথা বললেন না কিকিরা, তারপর বললেন, “জগন্নাথের বাবা কী ছিলেন? না, জুয়েলার! তাঁর নিজের অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তিনি তাঁর পেশা এবং নেশা কোনোটাই ছেড়ে দেননি। ভদ্রলোক একজন নামকরা স্টোন স্পেশ্যালিস্ট ছিলেন। বড় বড় কয়েকটা দোকানে আসা-যাওয়া করতেন, তাদের পাথর-টাথর পরখ করে দিতেন। ওঁর নিজের হাতে কোনো মক্কেল এলে উনি চেনা দোকান থেকে মালপত্র কিনিয়ে দিতেন। তাতে নিজের একটা কমিশন থাকত। তাই না? রাইট?”

“রাইট!” তারাপদ মাথা হেলাল।

বগলা চা এনেছিল। এগিয়ে দিল। দিয়ে চলে গেল।

চায়ে চুমুক দিয়ে কিকিরা আরামের শব্দ করলেন। পরে বললেন, “এই ভদ্রলোক, জগন্নাথের বাবা, একদিন বর্ষাকালে বৃষ্টির মধ্যে বাড়ি ফিরছিলেন। তখন সন্ধে। এমন সময় এক মোটরবাইকঅলা এসে তাঁকে বাড়ির কাছাকাছি, পাড়ার মধ্যে আচমকা ধাক্কা মারে ভদ্রলোক রাস্তায় পড়ে যান। আশেপাশের রিকশাঅলারা চেঁচামেচি করে উঠতেই মোটরবাইকঅলা পালিয়ে যায়। রাইট?”

মাথা হেলিয়ে সায় দিল তারাপদ। চা খেতে লাগল।

কিকিরা বললেন, “জগন্নাথের বাবাকে ধরাধরি করে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হয়। সেখান থেকে হাসপাতাল। দিন-তিনেক পরে তিনি মারা যান।”

“কোথায় যে চোট লেগেছিল জগুদা জানে না। বলতে পারে না, তারাপদ বলল।

“কোমরের কোনো বেকায়দা জায়গায় লাগতে পারে বা ধরো পড়ে যাবার পর মাথাতেও লাগতে পারে। হেড ইনজিউরি।”

“হতে পারে। অ্যাকসিডেন্ট ইজ অ্যাকসিডেন্ট…”।

কিকিরা তারাপদকে দেখতে-দেখতে বললেন, “আমি যদি বলি ওটা অ্যাকসিডেন্ট নয়!”

“নয়?” তারাপদ অবাক হয়ে বলল।

“ধরো, জগন্নাথের বাবার কেউ পিছু নিয়েছিল। যে-লোকটা পিছু নিয়েছিল সে জেনেশুনে ইচ্ছে করে জগন্নাথের বাবাকে ধাক্কা মেরেছে।”

“জেনেশুনে? আপনি বলছেন কী, কিকিরা?জগুদার বাবাকে কি তবে জখম করার, খুন করার চেষ্টা হয়েছিল?”

“খুন না হোক, অন্তত জোর জখম।“

“কেন?”

“কেন!…কেন তা ভেবে দেখে আমার মনে হয়েছে, জগন্নাথের বাবার কাছে অত্যন্ত মূল্যবান কিছু ছিল। কী থাকতে পারে? সোনাদানা, না, পাথর? সোনাদানা থাকার চেয়েও যেটা সম্ভব সেটা হল পাথর। দু-চার টুকরো দামি হীরে, চুনি, ক্যাটস আই..”

“কী বলছেন আপনি, কিকিরা? হীরে, চুনি নিয়ে একটা লোক বৃষ্টির মধ্যে বাড়ি ফিরবে? তা ছাড়া জগুদার বাবা ওসব পাবেনই বা কেমন করে?”

“কেন? ওঁর পক্ষেই তো পাওয়া সম্ভব।” কিকিরা হাত বাড়িয়ে চুরুটের খাপ টেনে চুরুট বার করতে লাগলেন। বললেন, “কোনো জুয়েলারের দোকান থেকে আনছিলেন। কিংবা কোনো জুয়েলারের দোকানে বেচতে নিয়ে গিয়েছিলেন।”

“বেচতে? জগুদার বাবা! আপনি ভুলে যাচ্ছেন–জগুদার বাবার যা অবস্থা ছিল…”

“জানি হে জানি। অবস্থা ভাল ছিল, না ওঁর। কিন্তু এই কলকাতা শহর বলে নয়, সর্বত্র স্মাগল্ড বা চোরাই সোনা, পাথর বেচাকেনা হয়। ধরো, কোনো চোরাইঅলা জগন্নাথের বাবার মারফত কিছু পাথর বিক্রি করতে চেয়েছিল। বলবে, তা কি সম্ভব? আমি বলব, সম্ভব। সম্ভব ওই জন্যে যে, সব কারবারের মতন এ-সব কারবারেরও একটা সার্কেল আছে। রিং। ওরা। পরস্পরকে চেনে। কারবার করে। বিশ্বাসও করে।”

তারাপদ চুপ। সে যেন ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছিল না। আবার এত কথা শোনার পর সরাসরি অবিশ্বাস করতেও বাধছিল।

চুরুট ধরিয়ে কিকিরা বললেন, “দুটো জিনিস হতে পারে। হয় কোনো চোরাইঅলার কিছু মাল জগন্নাথের বাবার কাছে ছিল; না হয়, কোনো দোকান থেকেই জগন্নাথের বাবা কিছু সোনাদানা, পাথর চুরি করে আনছিলেন। জিনিসগুলো ওঁর ফতুয়ার ভেতরের পকেটে, না হয় কোমরে কষির মধ্যে ছিল। হাতে ছিল না, পকেটেও নয়। মোটরসাইকেলঅলা যদি সহজে সেগুলো পেত, ছেড়ে পালাত না, কেড়েকুড়ে নিয়ে চলে যেত। ও জগন্নাথের বাবাকে ফলো করে এসেছিল জিনিসগুলো হাতাতে, পারেনি। তারপর তাড়া খেয়ে পালিয়ে যায়।”

তারাপদর চোখের পলক পড়ছিল না। কিকিরা কি ঠিক বলছেন? পাথর-টাথরের কথা যদি সত্যি হয়, জগুদার বাবা যে কোনো জুয়েলারের দোকান থেকে দু-দশটা দামি পাথর চুরি করে আনছিলেন, একথা সে বিশ্বাস করে না। ছি ছি। জগুদার বাবা চোর? কিকিরার কি মাথা খারাপ হয়েছে? এক মৃত ভদ্রলোকের নামে তিনি চোর অপবাদ দিচ্ছেন। তারাপদ মনে-মনে অসন্তুষ্ট, বিরক্ত হয়ে উঠেছিল। ক্ষুব্ধ হয়েই বলল, “আপনি জগুদার বাবাকে চোর ভাবছেন?”

কিকিরা বললেন, “না, চোর ভাবিনি। আমি বলছিলাম, হয় এটা না হয় ওটা! যুক্তিতে তাই বলে। অঙ্কের নিয়ম আর কি! তা ছাড়া তুমি কেমন করে বুঝছ, একটা মানুষ, খুব একটা খারাপ অবস্থায় পড়ে হঠাৎ একদিন লোভের বশে এমন কাজ করবে না! করতেও তো পারে। তবু চোর কথাটা বাদ দিচ্ছি। চোরাই মাল তো বটেই..।”

“আপনি কি বলতে চাইছেন, এই চোরাই জিনিসগুলো জগুদার বাবা জগুদার মাকে লুকিয়ে রাখতে বলে মারা যান?”

 “আমার তাই মনে হয়।”

“আপনি ভুল করছেন কিকিরা-স্যার।”

“হতেই পারে ভুল। চাণক্য শ্লোকে নাকি বলেছে, বুদ্ধিমানে আধাআধি ভুল করে, বোকারা পুরোটাই ভুল করে।”

তারাপদ জবাব দিল না কথার।

 কিকিরা চুরুট টানতে টানতে চোখ বুজে থাকলেন সামান্যক্ষণ। তারপর চোখ চেয়ে তারাপদকে দেখলেন। “এতক্ষণ যা শুনলে সেটা হল স্টেজের পেছনের ব্যাপার। যবনিকার অন্তরালে। তোমার-আমার চোখে পড়ছে না। পরের ব্যাপারটা বাপু অন্ দি স্টেজ। শুদ্ধানন্দ প্রেসিদ্ধ।…যাক্ সিনেমার এখানে ইন্টারভ্যাল, পরের ব্যাপারটা কাল-পরশু হবে। তুমি শুধু জগন্নাথদের বাড়ির ব্যাপারটা খোঁজখবর করো। ওর বাবা, ওর জ্ঞাতিগুষ্টি…যা যা পারো জেনে নেবার চেষ্টা কোরো।”

তারাপদ শুনল। মনে হল, কেমন যেন মুষড়ে পড়েছে।

.

০৫.

পরের দিন সাতসকালে কিকিরা একা-একাই বেরিয়ে পড়লেন। কলকাতা শহরের নানান এলাকায় তাঁর চেনাজানা লোজন রয়েছে, কেউ-কেউ বন্ধুর মতন, কেউ বা মুখচেনা, কিন্তু পাতিপুকুরে কেউ আছে বলে তাঁর মনে পড়ল না। না পড়ুক খোঁজ করতে করতে একটা হদিস তো পাওয়া যেতে পারে। সম্ভাবনা রয়েছে।

কিকিরা ঠিক করে নিয়েছিলেন, এ-বেলা অন্তত চার জায়গায় তিনি যাবেন। প্রথম যাবেন বদ্যিনাথ চক্রবর্তীর বাড়ি। মানিকতলায় থাকেন বদ্যিনাথ, জমি কেনাবেচার ব্যবসা ছিল, হয়ত এখনো আছে, বেলগাছিয়ার দিকে কাজ-কারবার করেছেন ভদ্রলোক। দেওঘরে আলাপ হয়েছিল কিকিরার সঙ্গে। ঠাকুর-দেবতায় ভীষণ ভক্তি। মানুষটিও আলাপী। কিকিরার সঙ্গে বার দুই-চার দেখাও হয়েছে পরে। পাতিপুকুরের খোঁজ দিলেও দিতে পারেন। কেননা ওপাশের জমি-জায়গার কারবার করা তাঁর পক্ষে সম্ভব।

মানিকতলার বাড়িতে বদ্যিনাথকে পাওয়া গেল না। উনি শরীর সারাতে ভুবনেশ্বর গিয়েছেন। মানিকতলা থেকে সোজা পল্টনবাবুর কাছে গ্রে স্ট্রিটে। পল্টনবাবু নেই। মধ্যমগ্রামে গিয়েছেন।

কিকিরার লিস্টে তিন নম্বর ছিল সুবল দেব। সুবল থাকে বেলগাছিয়ায়। সরকারি চাকরি করে আর নাটক করে বেড়ায়। হাসি-তামাশার অভিনয় ভালই করে। বকেশ্বর, ফাজিল, তবে কাজের লোক।

সুবলকে পাওয়া গেল। সবে ঘুম থেকে উঠে এক পট চা আর মগের মতন দুটো কাপ নিয়ে বসে-বসে চা খাচ্ছে, সামনে সকালের টাটকা কাগজ! রবিবারের সকাল বলে কথা।

কিকিরাকে দেখে সুবল প্রায় লাফিয়ে উঠল।“আরে দা-দ্দা–আপনি। শুভ প্রাতঃকাল! সকালে উঠে এ কার মুখ দেখছি..”

“দি গ্রেট কিকিরার মুখ দেখছ!”

“বসুন বসুন, আমার কী সৌভাগ্য!”

“তোমার মতন লুডিক্রাম লয়টারিং ল্যাল্যাফায়িং…”

“দাদা, প্লিজ, নো মোর “এল’! আপনি কি আজ “ল’-এর ঝাঁকা মাথায় করে এনেছেন! হরিফায়িং ব্যাপার!”

দু’জনেই হেসে উঠলেন জোরে।

 কিকিরা বসলেন।

 সুবল বলল, “দাদা, আগে চা হোক, তারপর দুটো টোস্ট ডিম…”

 মাথা নাড়লেন কিকিরা। বললেন, “নো টোস্ট! গরম জিলিপি খাব। আনাও। তোমার সেই বুলেটটা, আছে?”

“না। বেটা নবদ্বীপ চলে গেছে। ওর মায়ের কাছে।…আপনি ভাববেন না। ব্যবস্থা আছে। চা দিয়ে শুরু করুন।”

সুবল এক মগ চা ঢেলে দিল। বলল, “দুধ-চিনি মিশিয়ে নিন, আমি আসছি।” সুবল ভেতরে চলে গেল।

কিকিরা দুধ-চিনি মিশিয়ে চায়ে চুমুক দিলেন। বাহুল্য নেই, কিন্তু গোছানো, ফিটফাট ঘর। বইয়ের আলমারি, রেকর্ড-প্লেয়ার, একরাশ রেকর্ড, পেপার পাল্পের মা দুগ, দু-চারটে ফোটো। সুবলের থিয়েটারের ফোটোও টাঙানো রয়েছে।

ফিরে এল সুবল। বসতে বসতে বলল, “বলুন দাদা? এই সকালে আমার মতন বখাটেকে মনে পড়ল?”

কিকিরা বললেন, “বলছি। তার আগে বলি, তুমি সেদিন আসছি বলে পালালে। আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকলাম হাঁ করে, শেষে চলে এলাম।”

সুবল হাতজোড় করে বলল, “ভীষণ অপরাধ হয়ে গিয়েছিল। হল কী জানেন, আমাকে যে ডেকে নিয়ে গেল সে একটা গুণ্ডা-ক্লাসের ছেলে। এক দোকানে ঢুকে গণ্ডগোল শুরু করে দিল। তার ক্যামেরা খারাপ করে দিয়েছে। মারপিট লেগে যাবার উপক্রম। ওদিকটা সামলে যখন এলাম, আপনি চলে গেছেন। আমি দাদা, ভেরি ভেরি সরি।”

কিকিরা হাসলেন। চুমুক দিলেন চায়ে। রাস্তাঘাটে গুণ্ডামি করার বয়েস সুবলের আর নেই। মাথায় তো টাক পড়ে গিয়েছে।

কিকিরা বললেন, “পাতিপুকুর চেনো?”

“পাতিপুকুর চিনব না, বলেন কী! ঘাড়ের পাশে পাতিপুকুর।“

“আসা-যাওয়া আছে?”

“আছে। আমাদের এক কোলিগ থাকে সেখানে। বঙ্কিম। তা ছাড়া হিরো রয়েছে।”

“হিরো?”

 “নাটকের হিরো মধুময়।”

“একটা লোকের ঠিকানা আমার দরকার। পাতিপুকুরে থাকেন ভদ্রলোক। জোয়ারদার। বিশ্বনাথ জোয়ারদার। তাঁর বাড়ির ঠিকানা প্লাস কাজ-কারবারের ঠিকানা।”

“ছোকরা?”

“না, ছোরা নয়। মাঝবয়েসির ক্লাস।”

“কী নাম বললেন?”

“বিশ্বনাথ জোয়ারদার।”

সুবল কী যেন ভাবল। তারপর বলল, “ক’টা বাজল? আট, সোয়া-আট হবে!…দাঁড়ান, হিরোকে পেয়ে যেতে পারি। আজ রবিবার হলেও হিরো ভেরি বিজি। হয়ত কোথাও রিহার্সাল দিতে যাবে। ওকে একটা ফোন করি। হিরোর বাড়িতে ফোন আছে। আমার নেই। পাশের ফ্ল্যাট থেকে ধরতে হবে।…ভেরি আর্জেন্ট, কিকিরা?”

“ইয়েস, ভেরি-ভেরি।”

“তা হলে আপনি বসুন। গরম জিলিপি আসছে, খান। আমি ফোন করে আসি। বিশ্বনাথ জোয়ারদার, মাঝবয়েসি…”

“সাহেব-সাহেব পোশাক…?”

“ও. কে।”

 সুবল চলে গেল।

 কিকিরা চা শেষ করতে লাগলেন। কাল প্রেতসিদ্ধর বাড়ির বাগানে যে জোয়ারদার সাহেবের দেখা পেয়েছিলেন কিকিরারা, সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে দু-চারটে কথা বলতে চান কিকিরা। জগন্নাথ প্রেতসিদ্ধর মুখোমুখি হয়নি, জোয়ারদার হয়েছিলেন। তিনিই বলতে পারেন, ওখানে কী হয়, কল্পবৃক্ষটি কী ধরনের ভেলকিবাজি দেখায়, কোন খেলা দেখায়!

গরম জিলিপির প্লেট এসে গেল সামান্য পরেই। যে-ছেলেটি জিলিপি এনেছিল তাকে দেখতে নেপালি-নেপালি। গাঁট্টাগোট্টা চেহারা, মাথার চুল ছোট। পরনে পাজামা, গায়ে কটকটে লাল গেঞ্জি। সুবলের পছন্দ আছে।

খানিকটা পরে সুবল ফিরল। ফিরেই বলল, “পেয়েছেন জিলিপি? দারুণ।”

“তুমি খাও।…হাত লাগাও।”

“লাগাচ্ছি। আগে জোয়ারদারের খবরটা দিয়ে নিই।” সুবল বসে পড়ল। বলল, “বিশ্বনাথ জোয়ারদার পাতিপুকুরেই থাকেন। পাড়ার পুরনো লোক। পয়সাঅলা। তাঁর একটা দোকান আছে এজরা স্ট্রিটে। ইলেকট্রিক্যাল গুডস বিক্রি হয়। বড় দোকান, চালু দোকান। পুরনো দোকানও। ভদ্রলোকের এমনিতেই মাথায় একটু ছিট ছিল। হালে তাঁর ছোট ভগ্নিপতি অ্যাকসিডেন্টে মারা যাওয়ায় কেমন খেপাটে হয়ে গিয়েছেন। ছোট ভগ্নিপতিটি ওঁর বন্ধু এবং ব্যবসার পার্টনার ছিলেন।”

কিকিরা মন দিয়ে শুনলেন সব। তারপর বললেন, “ভগ্নিপতির নাম?”

“জানি না। ভগ্নিপতির নামে কী হবে।”

“এজরা স্ট্রিটে দোকান?”

“হ্যাঁ।“

“কোনো নাম নিশ্চয় আছে দোকানের?”

“জিজ্ঞেস করিনি। নামকরা পুরনো দোকান। ওখানে কাউকে বললে নিশ্চয় দেখিয়ে দেবে।”

কিকিরা ঘাড় হেলালেন। অর্থাৎ বোঝালেন, হ্যাঁ, তা ঠিকই।

জিলিপি খাওয়া শেষ করে কিকিরা উঠে পড়লেন। বললেন, “চলি হে সুবলস।”

“আসুন। কিন্তু, আপনি মশাই শরৎকালের বৃষ্টির মতন এলেন, আবার চলে যাচ্ছেন, ব্যাপারটা বোধগম্য হল না আমার! জোয়ারদার ভদ্রলোকটি কে? আপনি তার খোঁজ নিতে বেরিয়েছেন সাতসকালে!”

কিকিরা গম্ভীর মুখ করে ডান হাত তুলে তিনটে আঙুল দেখালেন। “ক্লীং রিং হিং।” চোখ নাচিয়ে-নাচিয়ে শব্দগুলো উচ্চারণ করলেন জোরে জোরে।

সুবল অবাক হয়ে বলল, “মানে? ক্রিং ক্রিং!”

“না, সাইকেলের ঘণ্টি নয়, সংস্কৃত মন্ত্র। ক্লীং রিং হিং!”

 সুবল উঠে পড়েছিল। কিকিরাকে এগিয়ে দেবে নিচে পর্যন্ত।

বাইরে এসে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে কিকিরা বললেন, “সুবল, আমি এখন এক বিশুদ্ধ প্রেতসিদ্ধ কল্পবৃক্ষের খোঁজে বেরিয়ে পড়েছি। শুনলাম সেই মহাপুরুষ রাত্রের দিকে আত্মালোকে বিচরণ করেন। তাঁর দেহটি বিছানায় পড়ে থাকে, চৈতন্যটি বায়ুলোকে সাঁতার কাটতে কাটতে আত্মালোকে চলে যায়…”

সুবল হেসে ফেলেছিল। “দারুণ তো! মহাপুরুষটি কে? থাকেন কোথায়?”

“টেগোর ক্যাসেল স্ট্রিট…কাঁঠালতলা গলি। শুদ্ধানন্দ প্রেতসিদ্ধ কল্পবৃক্ষঃ।”

“ভেরি ইন্টারেস্টিং। আমায় নিয়ে যাবেন?”

“দাঁড়াও। মহাপুরুষকে আগে দেখি!”

নিচে রাস্তায় এসে কিকিরা বললেন, “চলি। পরে দেখা হবে।”

.

বাড়ি ফিরলেন না কিকিরা। সোজা তারাপদর বোর্ডিংয়ে।

ছোট একফালি ঘর নিয়ে থাকে তারাপদ। একাই। কোনোরকমে একটা তক্তাপোশ পাতার মতন জায়গা ঘরে, অবশ্য একটি টেবিলও আছে ছোট মতন, আর একটি মাত্র চেয়ার।

কিকিরা এসে দেখেন, তারাপদ দাড়ি কামাবার ব্যবস্থা করছে। সেফটি রেজার, সাবান, ব্রাশ, আয়না নিয়ে তৈরি।

তারাপদ বলল, “কিকিরা-স্যার, আপনি?”

“সাত-তাড়াতাড়ি দাড়ি কামাতে বসেছ?”

“আপনার জন্যেই। ভাবছিলাম একবার জগুদার বাড়ি যাব। আজ রোববার, জগুদা বাড়িতেই থাকবে।”

কিকিরা বিছানাতেই বসলেন। বললেন, “খুব ভাল কথা। যাও, ঘুরে এসো।”

“আপনি কোথায় বেরিয়েছিলেন? সোজা আমার কাছে?

 মাথা নাড়লেন কিকিরা। বললেন, “আমি গিয়েছিলাম বিশ্বনাথ জোয়ারদারের খোঁজ করতে। কালকের সেই জোয়ারদার-সাহেব মনে পড়ছে?”

“হ্যাঁ। তাঁর কাছে কেন?”

“ভেবে দেখলাম, সাহেব প্রেতসিদ্ধর ক্লায়েন্ট। বোধ হয় নতুন ক্লায়েন্ট। কালকের কথাবার্তা থেকে তাই মনে হল। তা সাহেব তো দেখলাম কাল শেষ পর্যন্ত প্রেতসিদ্ধ ভবনে চলে গেল। গিয়ে কী হল, কী দেখল, কী হয় সেখানে তার কিছু খোঁজ-খবর যদি নেওয়া যায়, ভালই হবে। তোমার জগুদা সরাসরি প্রেতসিদ্ধর কোনো খেলাই এখন পর্যন্ত দেখেনি। জোয়ারদার দেখেছেন।”

তারাপদ বলল, “খোঁজ পেলেন জোয়ারদারের?”

“পেয়েছি। আজ রবিবার। কাল সাহেবের দোকানে যাবার ইচ্ছে।” বলে কিকিরা সুবলের কাছে যাওয়া এবং জোয়ারদারের হদিস খুঁজে বার করার বৃত্তান্ত শোনালেন।

তারাপদ চা আনাতে যাচ্ছিল, বারণ করলেন কিকিরা। টেবিল থেকে তারাপদর সিগারেটের প্যাকেট-দেশলাই উঠিয়ে নিয়ে ধীরেসুস্থে একটা সিগারেট ধরালেন। তারপর বললেন, “তারাপদ আমি অনেক ভেবেছি। ভেবে দেখলাম, জগন্নাথের বাবার এবং মায়ের একটা ব্যাপার এখানে জড়িয়ে আছে। তোমায় আগেই বলেছি, জগন্নাথের বাবার অ্যাকসিডেন্ট আমার কাছে সাধারণ বলে মনে হচ্ছে না। তাঁর কাছে নিশ্চয়ই কিছু ছিল।” বলে কিকিরা চুপ করে থাকলেন। ভাবছিলেন কিছু। লম্বা করে সিগারেট টানলেন, বললেন আবার, “জগন্নাথের বাবা এই জিনিসগুলো তাঁর স্ত্রীকে রাখতে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, এমনভাবে লুকিয়ে রাখতে যেন কেউ টের না পায় কোনো দিন। জগন্নাথের মা স্বামীর কথামতনই জিনিসগুলো রেখেছিলেন। হয়ত একদিন জগন্নাথ তার মায়ের মুখ থেকেই জানতে পারত সব, কিন্তু ভদ্রমহিলা হঠাৎ মারা যাওয়ায় সেটা হয়নি।”

তারাপদ বলল, “আমিও আপনার কথা ভেবেছি স্যার। আমার মনে কিন্তু একটা খটকা রয়েছে। …আপনার প্রথম কথা আমি না হয় ধরে নিচ্ছি, জগুদার বাবা কিছু গুপ্তধন রেখে গেছেন। জগুদার মা ছাড়া সে-কথা অন্য কেউ জানত না। কিন্তু একটা কথা বলুন-জগুদা তার মায়ের একমাত্র ছেলে। মা কি ঘুণাক্ষরেও ছেলেকে এই গুপ্তধনের আভাস দেবেন না? বিশেষ করে জগুদারা যখন অত দুঃখকষ্ট করে মানুষ হচ্ছে, সংসার চালাচ্ছে?”

কিকিরা মাথাটা উঁচু করে ছাদের দিকে তুলে কিছু যেন লক্ষ করতে-করতে বললেন, “হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ! কিন্তু ধরো সেই গুপ্তধন যদি এমনই হয়, যা সাধারণ অবস্থায় ছেলের কাছে বলা যায় না। হয়ত বলতে লজ্জা করে। হয়ত বললে ছেলে বিগড়ে যেতে পারে। তার ধারণা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। বা, এমনও হতে পারে তারাপদ, জগন্নাথ সাদামাটা নিরীহ ছেলে। কথাটা তার জানা থাকলে যদি পাঁচকান হয়ে যায়।”

“পাঁচকান?”

“জগন্নাথের বাড়ির শরিকদের কারও কারও কানে যেতে পারে।”

“আপনি কী বলতে চাইছেন?”

“আমি বলতে চাইছি,” বাধা দিয়ে কিকিরা বললেন, “দুটো জিনিস হালে ঘটতে পারে। এক, জগন্নাথদের বাড়ির কেউ-না-কেউ কোনোভাবে এই খবরটা জেনেছে, বা জানত। জগন্নাথের মায়ের জীবিত অবস্থায় সে বা তারা। গুপ্তধন হাতাবার সাহস করতে পারেনি। ভেবেছিল মহিলা অনেক বুদ্ধিমতী এবং শক্ত ধাতের মানুষ, সুবিধে হবে না। এখন অবস্থা পালটে গেছে।”

দাড়ি কামিয়ে গাল মুছতে মুছতে তারাপদ বলল, “বেশ, আপনার একটা অনুমান শুনলাম। দ্বিতীয়টা কী হতে পারে?”

“দ্বিতীয়টা এই হতে পারে–যার জিনিস জগন্নাথের বাবার কাছে ছিল, কিংবা ধরো চুরি গিয়েছিল–সেই লোক এতদিনে হাজির হয়ে পড়েছে। সে চাইছে নিজের জিনিস ফেরত নিতে।”

তারাপদ অবাক হয়ে বলল, “প্রেসিদ্ধ কি সেই লোক?”

কিকিরা বললেন, “প্রেতসিদ্ধ তার এজেন্ট হতে পারে।”

তারাপদ কথা বলতে পারল না।

.

০৬.

জোয়ারদারের দোকান খুঁজে পেতে অসুবিধে হল না। নাম বলতেই দেখিয়ে দিল অন্য-এক দোকানের কর্মচারী।

দোকানটা যে পুরনো বোঝাই যায়। সাবোর্ডের মাথায় লেখা আছে শুভারম্ভের সালটা। হিসেব করলে প্রায় পঞ্চাশে দাঁড়ায় এখন। তা পঞ্চাশ বছরের চেহারায় খানিকটা ভাঙাচোরা ময়লা ছাপ তো পড়বেই।

বড় দোকান বইকি! রাস্তার গা ঘেঁষে দোকান, মালপত্র সাজানো; কাঠের তক্তার “ল’; বোধ হয় ওখানে আরও মালপত্র ঠাসা আছে। কাঠের এক পার্টিশান একদিকে। পার্টিশানের ওপাশে জোয়ারদারের অফিস।

নানান ধরনের পাখা, ল্যাম্প, বাহারি আলোর শেড থেকে ইলেকট্রিক ইস্ত্রি, হিটার, মিটার কী না আছে দোকানে! ইলেকট্রিক তার, সুইচ, প্লাগ, মায় ইনভারটার পর্যন্ত।

দোকানে জনা-তিনেক কর্মচারী, একজন বুড়োসুড়ো ক্যাশবাবু।

 তারাপদ সঙ্গেই ছিল। কিকিরা তারাপদকে ইশারায় বুঝিয়ে দিলেম যেন সে সঙ্গে-সঙ্গে থাকে তাঁর।

দোকানের এক কর্মচারী এগিয়ে এল। অন্যরা খদ্দের সামলাচ্ছে। ভিড় এমন কিছু নেই।

“কী চাই আপনার?” কর্মচারী এগিয়ে এসে বলল।

কিকিরা আগেভাগেই সব ছকে এসেছিলেন। বললেন, “মিস্টার জোয়ারদার কে? আপনাদের মালিক না?”

“হ্যাঁ, কেন?”

“তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চাই। দোতলা একটা বাড়ির ইলেকট্রিকের সবরকম কাজ হবে। ফিটিংস সুন্ধু। আমার এক বন্ধু মিস্টার জোয়ারদারের কথা বললেন। এখানে কোনো ঠগ-জোচ্চুরি নেই, খারাপ মাল বিক্রি হয় না, দামটাও ঠিকঠাক…। তাই না, তারাপদ?”

তারাপদ মাথা নাড়ল।

কর্মচারীটি যেন ধাঁধায় পড়ে গেল। দোতলা একটা বাড়ির ইলেকট্রিকের সমস্ত কাজকর্মের জিনিস যাবে এই দোকান থেকে? সে তো অনেক টাকার কাজ। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে হাজার বারো-চোদ্দ। মালপত্র দামি কিনলে আরও বেশি।

কর্মচারীটি বলল, “দাঁড়ান দেখছি,” বলে পার্টিশানের ওপারে এক ঘরে ঢুকে গেল।

কিকিরা ফিসফিস করে তারাপদকে বললেন, “সাইনবোর্ডে দেখলাম লেখা আছে, কনট্রাকটারস। ঢিল ছুড়লাম। দেখি কী হয়!”

সামান্য পরেই কর্মচারীটি ফিরে এসে বলল, “আসুন।”

পার্টিশানের গা-লাগানো কাঠের এক খুপরি। চেয়ার, টেবিল, ফোন, লোহার আলমারি, ছোট এক লোহার সিন্দুক।

কিকিরাদের খুপরির মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে লোকটি চলে গেল।

টেবিলের ওপাশে জোয়ারদারসাহেব বসে।

কিকিরা নমস্কার করে বলল, “আমার নাম কে, কে, রায়। আপনিই তো। মিস্টার বিশ্বনাথ জোয়ারদার? পাতিপুকুরে থাকেন?”

জোয়ারদার একটু অবাক হলেন। নমস্কার জানিয়ে বললেন, “বসুন।”

লোহার হালকা চেয়ার। দু জনেরই বসার ব্যবস্থা ছিল। কিকিরা তারাপদকে বসতে বলে নিজে বসলেন।

তারাপদ বসল।

 কিকিরা জোয়ারদারকে দেখছিলেন। প্যান্ট-শার্ট পরে বসে আছেন। ভদ্রলোক। গায়ের কোটটা আলমারির পাশে দেওয়ালে গাঁথা হুকে। হ্যাঁঙারসমেত ঝোলানো। ভদ্রলোকের বয়েস পঞ্চাশ কি সামান্য বেশি। লম্বাটে মুখ। গালের হাড় উঁচু। আধ-ফরসা গায়ের রং, মাথার চুল কিছু-কিছু পাকতে শুরু করেছে। চশমাটা টেবিলে নামানো। টেবিলে কাগজপত্র, বিল, চেই পড়ে আছে। জলের গ্লাস, চায়ের কাপ।

কিকিরার মনে হল, জোয়ারদারসাহেব তেমন স্বাস্থ্যবান নন। চোখে-মুখে অসুস্থতার ছাপ ফুটে রয়েছে।

জোয়ারদার বললেন, “বলুন, কী দরকার। আমার কথা কে বলল আপনাদের?”

কিকিরা খুব সহজেই সুবলের নাম বলে দিলেন। পারলে সুবলের বাবার নামই বলে ফেলতেন। নামটা তিনি জানেন না।

“আপনার দোকানের পুরনো কাস্টমার,” কিকিরা হেসে-হেসে বললেন।

জোয়ারদার কিছুই মনে করতে পারলেন না। খদ্দের কত আসে কত. যায়। কে আর মনে রাখে সকলকে। তবে জোয়ারদার ব্যবসাদার মানুষ, কথা বলতে জানেন। হেসে বললেন, “ও!…আচ্ছা! পুরনো খদ্দের আমার অনেক। বাবার আমলে এখানে ক’টা আর দোকান ছিল। এখন তো গিজগিজ করছে।…তা বলুন, আপনার দরকারটা শুনি।“

কিকিরা হাসি-হাসি মুখ করে বললেন, “আপনারা তো ইলেকট্রিকের সমত রকম কাজকর্মের কনট্রাক্ট নেন।”

“কনট্রাক্ট …ইয়ে, মানে…সেভাবে এখন আর নিই না। আগে নিতাম। আজকাল লোকজন পাওয়া বড় মুশকিল। হাতেপায়ে ধরতে হয়। কাজে ফাঁকি মারে। পাটির কাছে কথা শুনতে হয় আমাদের। অনর্থক ফ্যাচাং আর ভাল লাগে না। বয়েসও হচ্ছে।”

“কনট্রাক্ট আর নিচ্ছেন না?”

“একেবারে নিই না-তা বলব না। নিই।”

কিকিরা স্পষ্টই বুঝতে পারলেন জোয়ারদার হিসেব করে কথা বললেন। অর্থাৎ এখন ঝামেলার কাজ নেন না বড় একটা, তবে তেমন কাজ হলে নিতে আপত্তি নেই।

তারাপদ হতাশ হবার ভান করে বলল, “তা হলে আমরা…”

“আপনাদের ব্যাপারটা আগে শুনি।”

কিকিরা বেশ গুছিয়ে দোতলা বাড়ির ইলেকট্রিকের কাজকর্মের কথা বললেন।

জোয়ারদার ততক্ষণে সিগারেট ধরিয়ে নিয়েছেন। কিকিরাদেরও দিয়েছেন। তারাপদ সিগারেট নেয়নি।

শেষে জোয়ারদার বললেন, “বাড়িটা কোথায়?”

 “টেগোর ক্যাসেল স্ট্রিট।”

“টে-গোর ক্যাসেল!” জোয়ারদার কেমন থতমত খেয়ে গেলেন।

কিকিরা কথা বললেন না, জোয়ারদারকে দেখছিলেন।

নিজেকে সামান্য সামলে নিয়ে জোয়ারদার বললেন, “বলেন কী মশাই! ওখানে বাড়ি! ও জায়গাটা তো সেই কী বলে, ধ্বংসস্তূপ হয়ে গেছে। ওখানে বাড়ি। এত জায়গা থাকতে শেষে…”

কিকিরা বললেন, “খুব সস্তায় পেয়ে গিয়েছিলাম। মর্টগেজ প্রপারটি থেকে কোর্টকাছারি…তা সে যাক, বলতে গেলে মহাভারত। সেই বাড়ি ভেঙেচুরে নতুন করে করাতে হল। আপনি দেখলেই বুঝতে পারবেন।”

“কোথায় বাড়িটা? মানে, ঠিক কোন জায়গায়!”

“কাঁঠালতলা বলে লোকে।”

জোয়ারদার যেন চমকে উঠলেন। “কাঁঠালতলার গলি!…বলেন কী! ওই গলিতে ভদ্রলোক বাড়ি করে। আরে ছি-ছি, সে তো একরকম ব্লাইন্ড লেন। ওখানে নতুন বাড়ি কোথায়? আরে মশাই, ওখানে এক বেটা তান্ত্রিক…ডেঞ্জারাস! সে বেটা ওখানে…”

“শুদ্ধানন্দ প্রেতসিদ্ধ কল্পবৃক্ষঃ…! “কিকিরা কল্পবৃক্ষ-এর বিসর্গে জোর দিলেন।

জোয়ারদারের মুখ হাঁ হয়ে থাকল। চোখের পাতা পড়ছিল না। শেষে বললেন, “চেনেন বেটাকে?”।

“না। নাম শুনেছি।”

“নাম শুনেছেন। দেখেননি?”

“না।” কিকিরা মাথা নাড়লেন, “আপনাকে দেখেছি।”

“আমাকে?” জোয়ারদারের যেন ফাঁস লেগে গেল গলায়, “কবে দেখলেন আমাকে?”

“গত পরশু! শনিবার সন্ধের পর।”

জোয়ারদার রীতিমত হতবাক। বিহ্বল। তাকিয়ে থাকলেন বোকার মতন।

কিকিরা হাসি-হাসি মুখে বললেন, “কী! ঠিক বলিনি?”

“আপনি কে মশাই? ডিটেকটিভ? লালবাজারের লোক?”

মাথা নেড়ে হাসতে-হাসতে কিকিরা বললেন, “না।”

“না!” জোয়ারদার ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলেন। ঢোক গিললেন বার দুই। নানারকম ভাবতে লাগলেন। তারপর হঠাৎ বললেন, “তা হলে কি আপনি ওই কালো আলখাল্লার দলে ছিলেন?”

“কালো আলখাল্লা “

“বুঝেছি। ওদের দলে আপনি ছিলেন। ওখান থেকেই আপনি আমার নাম শুনেছেন। জোয়ারদার হঠাৎ কেমন খেপে গিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই কিকিরা বাধা দিলেন।

কিকিরা বললেন, “না, আপনাকে আমি আগেই দেখেছি। প্রেতসিদ্ধর চেলা এসে আপনাকে যখন হাত চেপে ধরল।”

জোয়ারদার যেন অগাধ জলে পড়েছেন! কে এই লোকটা? কাস্টমার না পুলিশের লোক? না চিটিংবাজ!

কিকিরা বললেন, “জোয়ারদারসাহেব, আপনি খুব অবাক হচ্ছেন। অবাক হবারই কথা। আপনাকে আমি আরও অবাক করতে পারি। আচ্ছা দেখুন আপনাকে একটা জিনিস দেখাই।” বলে নিজের পকেটে হাত দিলেন কিকিরা। স্টিলের একটা সুচ বার করলেন। ইঞ্চি-দেড়েক লম্বা। একটু মোটা। সুচের মুখ সামান্য ভোঁতা। সুচটা নিজের ডান চোখে ছোঁয়ালেন, ভুরুর তলায়, চোখের আর নাকের কাছে গর্তে। বললেন, “এই দেখুন, এই সুচটা আমি চোখে ঢুকিয়ে দিচ্ছি সবটা।” বলে কিকিরা চোখের কোলে মুচ ঢোকাতে লাগলেন।

জোয়ারদার ভয় পেয়ে গেলেন। আজব মানুষ তো! চোখে সুচ ঢুকিয়ে যাচ্ছে। মরবে নাকি! মুখ শুকিয়ে যাচ্ছিল জোয়ারদারের। “মশাই, করছেন কী! প্লিজ স্টপ। প্লিজ।…আমার এ-সব সহ্য হয় না।”

কিকিরা বারো আনা সুচ ঢুকিয়ে ফেলেছিলেন। বার করলেন এবার। বার করে চোখ বন্ধ রেখেই পকেট থেকে রুমাল টেনে নিয়ে চোখটা চাপা দিলেন। মুছলেন সামান্য। তারপর রুমালটা নিয়ে টেবিলের ওপর ফেলে দিলেন। তাকালেন এবার। ডান চোখ খুলেই।

হাসি-হাসি মুখ করে কিকিরা প্রথমে রুমালটা দেখালেন। দেখিয়ে টেবিলের ওপরই ফেলে রাখলেন। তারপর ডান চোখটা দেখালেন। বললেন, “কী? রক্তটক্ত দেখলেন?”

“না।”

“সুচটা তো আমি চোখে ঢুকিয়ে ছিলাম।”

“হ্যাঁ।”

“আরও কিছু দেখবেন?”

“না, মশাই। থাক।”

কিকিরা রুমালটা তুলে নিলেন টেবিল থেকে। “আপনি যদি একটা চেক লেখেন এখন, আপনার কালির রং পালটে যাবে!”

“মানে?”

“দেখুন না। পরীক্ষা করুন।”

জোয়ারদার চোখ নামিয়ে চেক বই টানতে যাচ্ছিলেন। বই নেই। কাগজপত্র সরালেন। ড্রয়ার টানলেন। চেক বই? টেবিলের ওপরেই তো ছিল।

কিকিরা এবার হেসে ফেললেন। রুমাল তোলার সময় চেক বইটা তুলে নিয়েছিলেন। জোয়ারদার বোঝেনি।

চেক বই ফেরত দিতে-দিতে কিকিরা বললেন, “জোয়ারদারসাহেব, কিছু মনে করবেন না। এ হল লোককে ধোঁকা দেবার খেলা। চোখে যেটা ঢোকালাম ওর মধ্যে স্প্রিং ছিল। গাড়ির শক অ্যাবজরভার বোঝেন! সেইরকম অন্যটা ক্লিন হাত সাফাই। দুটোই। আমি একজন ওল্ড ম্যাজিশিয়ান, ক্লাসিক্যাল টাইপ। লোকে আমাকে বড় চেনে না। এই ছোকরারা চেনে,” বলে তারাপদকে দেখালেন।

তারাপদ বিনয় করে বলল, “উনি হলেন কিকিরা দি ওয়ান্ডার, কিকিরা দি গ্রেট!”

জোয়ারদার ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। বললেন, “আমার এখানে ম্যাজিক কেন? ম্যাজিক দেখাবার জায়গা এটা? আশ্চর্য লোক মশাই.আপনারা!”

কিকিরা বললেন, “না, ম্যাজিক দেখাবার জায়গা এটা নয়। কিন্তু সাহেবমশাই, আপনি গত পরশু দিন, শনিবার, সন্ধেবেলা কী দেখতে গিয়েছিলেন কাঁঠালতলা গলিতে?”

জোয়ারদার বললেন, “আমি দেখতে যাইনি। আমাকে একজন বলল, ওখানে গেলে ওই শুদ্ধানন্দ আমাকে বাসুর গলা শোনাবে।”

“বাসু কে?”

“আমার বন্ধু।”

“আপনার ভগ্নিপতি এবং পার্টনার।”

“কেমন করে জানলেন?”

“আমি পিশাচসিদ্ধ।” বলে কিকিরা হাসতে লাগলেন।

“আপনি মশাই লোকটি কে?”

“কিকিরা দি ম্যাজিশিয়ান।…এখন বলুন তো, স্যার, সেদিন কি আপনি বন্ধুর গলা শুনেছিলেন?”

“একটা গলা শুনেছিলাম।”

“বন্ধুর?”

“মনে হল না বাসুর! সর্দিতে গলা বসে গেলে, কিংবা ফোনের লাইনে গোলমাল হলে যেরকম গলা শোনা যায়, সেইরকম এক গলা শুনলাম।”

“আচ্ছা! তা আপনি কি গলা শুনতেই গিয়েছিলেন, না, কোনো বিশেষ কথা ছিল?

জোয়ারদার খানিক চুপ করে থেকে বললেন, “ছিল। বিজনেস সিক্রেট। পার্সোনাল ব্যাপার।”

“কথা হল?”

“না।…গলাটা শুনলাম, বুঝলাম না। শুদ্ধানন্দ বলল, বাসুর আত্মা একটা লেভেলের এপারে আসতে পারছে না। কোথাও গোলমাল হচ্ছে। আত্মারা নিজের মরজিতে আসে; আবার আসতে চাইলেও সব-সময় পারে না ভিড়ে আটকে যায়। আসছে হপ্তায় আবার চেষ্টা করা যাবে।”

তারাপদ মুচকি হাসল। কিকিরাও হাসিমুখে বললেন,কত নিল? মানে কত টাকা?”

“একশো এক। বেটা বলল, পরের দিন যদি ঠিকঠাক এসে যায় বাসু, কথা বলে, পাঁচশো এক লাগবে।“

কিকিরা মাথা দুলিয়ে বললেন, “বাঃ!…দুশো, পাঁচশো, হাজার…! বাঃ! ভাল ব্যবসা।…তা জোয়ারদারমশাই, কালো আলখাল্লার ব্যাপারটা একটু বলবেন। শুনতে ইচ্ছে করছে।”

জোয়ারদার বললেন, “সে এক ভুতুড়ে কাণ্ড মশাই। ও আপনি বুঝতে পারবেন না। আমি বললেও ধরতে পারবেন না। চোখে দেখতে হবে আপনাকে। অবশ্য চোখে দেখবেনই বা কী! সব অন্ধকার, কালো; যারা থাকে তাদেরও একটা করে কালো আলখাল্লা পরতে হয়। কাঁধ থেকে পা পর্যন্ত তো বটেই, ঘাড় থেকে মাথা পর্যন্ত ঢাকা থাকে, অনেকটা সেই ইংরেজি সিনেমায় দেখা সেকেলে সাধুসন্ন্যাসীর মতন, যাকে ওই ‘রোব’-টোব বলে। ধরুন না, মেয়েদের ওয়াটার পুফের মাথা ঢাকার যেমন ব্যবস্থা থাকে–সেইরকম মাথা ঢাকা।…মশাই, একে অন্ধকার তায় কালো আলখাল্লা, তার ওপর ঘাড়-মাথা ঢাকা, কেউ কারও মুখও আঁচ করতে পারে না।”

তারাপদ বলল, “আলখাল্লা সঙ্গে নিয়ে যেতে হয়?”

না, না, ঘরে ঢোকার আগে এক জায়গায় বসিয়ে দেবে। দিয়ে বলবে, জামা-জুতো খুলে ওই আলখাল্লা পরে নিতে। ওরাই দেয় আলখাল্লা।”

কিকিরা বললেন, “যে ঘরে আপনারা ঢুকলেন, ঘরটা কেমন? সেখানে কী কী আছে?”

“আমায় জিজ্ঞেস করবেন না। আমি বলতে পারব না। জীবন আমার বেরিয়ে যাচ্ছিল। ..আপনি নিজেই যান না, দেখুন গিয়ে।”

“যাবার খুব ইচ্ছে। যাব কেমন করে?”

 জোয়ারদার যেন কিছু ভাবলেন। বললেন, “সত্যি সত্যি যাবার ইচ্ছে?”

“হ্যাঁ। একশো ভাগ ইচ্ছে।”

“বেশ, আমার সঙ্গে যাবেন।…তবে আপনি কার জন্যে যাবেন? আছে কেউ যাকে ডাকতে চান?”

কিকিরার, একবার তারাপদর দিকে তাকালেন তারপর মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললেন, “আছে। ও আপনি ভাববেন না! আপনার সঙ্গে যেতে পারলেই হল।”

“আমি নিয়ে যাব। যারা ওখানে যায়, তারা আগে থেকে বলে রাখলে সঙ্গে অন্য একজনকে নিয়ে যেতে পারে।”

“মানে, নতুন খদ্দের।”

জোয়ারদার মাথা নাড়লেন। তারপর বললেন, “আমি আপনাকে নিয়ে যাব। কিন্তু আপনার টাকাটা আপনি দেবেন।”

কিকিরা হেসে বললেন, “ঠিক আছে।”

.

০৭.

দিন দুই-তিন তারাপদর আর কোনো সাড়াশব্দ নেই।

রবিবার বিকেলে তারাপদ এল; সঙ্গে চন্দন।

কিকিরা বললেন, “ছিলে কোথায়? তোমাদের দিয়ে কুটোটিও নড়ানো যাবে না। এজেন্সি তুলে দাও।”

তারাপদ আর চন্দন মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। বুঝল না কিছু! তারাপদ বলল, “কিসের এজেন্সি কিকিরা?”

“কুটুস এজেন্সি।”

“সেটা কী?”

“কিকিরা-তারাপদ-চন্দন ডিটেকটিভ এজেন্সি। কে. টি. সি। মিষ্টি করে বলতে পারো ‘কুটুস’।”

তারাপদরা হেসে উঠল।

চন্দন হাসতে হাসতে বলল, “এটা আপনি মন্দ বলেননি, কিকিরা। ভাল আইডিয়া। কলকাতায় আজকাল প্রাইভেট ইনভেস্টিগেশনের অনেকগুলো কোম্পানি হয়েছে। আমরাও একটা লাগিয়ে দিতে রাজি। কুটুস এজেন্সি।”

তারাপদ হেসে বলল, “আপনি হবেন ব্যুরো চিফ। ম্যাজিশিয়ান ডিটেকটিভ। ভাবা যায় না, স্যার। জগতে এমন জিনিস দুটি নেই।”

কিকিরা রাগের ভান করে বললেন, “তোমরা তো আমাকে ওই অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছ! ছিলাম ভাল; বাজাচ্ছিলাম বাঁশি, হয়ে গেল ফাঁসি।”

তিনজনেই হেসে উঠল।

শেষে তারাপদ বলল, “আমি স্যার, আপনার হুকুমের নফর। যেমন যেমন হুকুম করেছিলেন তেমনটি করছি। জগুদার পেছনে লেগে আছি। ওর বাড়িতে যাচ্ছি-আসছি। আমায় আপনি দোষ দিতে পারবেন না।”

চন্দন বলল, “আমাকে চাকরিতেই মেরে দিয়েছে, কিকিরা। তবু তারার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে যাচ্ছি।”

কিকিরা তারাপদকে বললেন, “তোমার জগুদা অন্তর্ধান করে গেল গো!”

“আজ আসবে,” তারাপদ বলল, “সন্ধের আগেই। বলে দিয়েছে “

 কিকিরা তারাপদর দিকে তাকিয়ে বললেন, “খবরটবর জোগাড় করতে পারলে?”

“অল্পস্বল্প।“

“বলো, শুনি।”

কিকিরার এই জাদুঘরে তারাপদ নিজের একটি বসার জায়গা করে নিয়েছে, সেখানেই সে বসে। চন্দনও বরাবর জানলার দিকে এক ছোট সোফাতেই বসে সাধারণত। ঘরে জায়গা কম। ওরই মধ্যে বসার ব্যবস্থা করে রেখেছেন কিকিরা।

ঘরে দু-চারটে মশা উড়ছিল। এবার যেন শীতের আগেই মশার উৎপাত শুরু হয়েছে। এক মশা-মারা ধূপ জ্বলছিল। খুব হালকা একটু গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।

তারাপদ বলল, “জগুদাকে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে যা জানতে পারলাম, তাতে মনে হল, ওর বাবা যে কিছু রেখে গেছেন সেটা ও বিশ্বাস করে। কেননা, মায়ের কথা থেকে মাঝে-মাঝে মনে হয়েছে, বোনের জন্যে অত ভেবে মরার কারণ। নেই। মা এর বেশি কিছু বলতেন না। আর-একটা কথা মা বলতেন, বাবার কোনো পুরনো বন্ধুবান্ধব যদি গায়ে পড়ে মেলামেশা করতে চায় বা সাহায্য করতে চায়, জগুদা যেন কখনোই তা না নেয়। বাবার পুরনো বন্ধুরা বাড়িতে কোনো কাজেকর্মে নেমন্তন্ন করলেও জগুদার মা ছেলেকে বলে দিতেন–কোন বাড়িতে সে যাবে, কোন বাড়িতে যাবে না।”

কিকিরা শুনতে শুনতে মাথা নাড়লেন। “আচ্ছা! মায়ের কথামতনই চলতে হত জগন্নাথকে।”

“হ্যাঁ।”

“ওর বাবা কোন-কোন বড় দোকানে আসা-যাওয়া করতেন, খোঁজ নিয়েছ?”

“নিয়েছি।” বলে তারাপদ পকেট থেকে একটা কাগজ বার করে কিকিরাকে দিল। বলল, “প্রথম দু-তিনটে নাম নজর করবেন। বাকি দু-তিনটে তেমন নয়। তবে ছোটখাটো দু-চারজন জুয়েলারও ছিল যারা জগুদার বাবার কাছে। আসত। তাদের কথা জগুদার মনে নেই বড়।”

কিকিরা কাগজটা নিয়ে দেখলেন। চন্দন বলল, “কিকিরা, তারাপদ ওর জগুদার বাড়ির এক বুড়োকে ক্যাচ করেছে। তার কথা শুনুন।”

কিকিরা তারাপদকে বললেন, “কী কথা?”

তারাপদ বলল, “জগুদার এক জেঠা আছে। বছর-পঁচাত্তর বয়েস। সম্পর্কে জেঠা। ওই বাড়ির নিচের তলায় একটা ঘরে থাকেন। ঘরটা বোধ হয় কোনো সময়ে আস্তাবল ছিল। কী বিশ্রী দেখতে। ঘরের সামনে চৌবাচ্চা, শ্যাওলা-পড়া উঠোন, গোটা-দুই ডালিম গাছের ঝোঁপ, গোবর, খুঁটে–সে একেবারে যাচ্ছেতাই অবস্থা। জেঠা ভদ্রলোক, একাই থাকেন; নিজের ঘরেই তাঁর কেরোসিন স্টোভে রান্না হয়। কতকগুলো ছোট-ছোট হাঁড়ি, কড়াই, মালা। পাশে একটা সরু তাপোশে চিট-বিছানা। জেঠামশাই করেন না কিছুই। সকাল-বিকেল তাঁকে বাড়ির সামনে দেখা যায়। সকালে পাড়ার চায়ের দোকান থেকে চা আনিয়ে টিনের চেয়ার টেনে বসে থাকেন আর বিড়ি ফোঁকেন। সন্ধেবেলায় খান আফিং।”

“বা-বা, বেশ মানুষটি তো। ওঁর চলে কেমন করে?”

“চলে আর কই? কোনোরকমে দুটো জুটে যায়। উনি কয়েকটা দৈব ওষুধ জানেন। পোড়া, অম্লশূল, একজিমা, হাঁপানি–এই সব। এগুলো তৈরি করে দেন। তাতেই যা পান। তা ছাড়া দু’-দশ টাকা পাড়ার লোকও দেয়।”

“কী নাম?”

“মণিবাবু।”

“ওঁর সঙ্গে তুমি আলাপ করেছ?”

“উনি নিজেই একদিন ডেকে আলাপ করলেন। জগুদার কাছে। যাচ্ছি-আসছি দেখে।”

“কী বললেন?”

“বুড়ো মানুষ–সাত কাসুন্দি শোনালেন দত্তবাড়ির।”

“জগন্নাথের বাবা-মা সম্পর্কে কী বললেন?”

“বললেন, আজকাল সংসারে ধর্মও নেই, ধর্মের কলও নেই, বাতাসে আর কিছুই নড়ে না। তবে হ্যাঁ, ওই ওপরে একজন আছেন, তাঁর চোখে সবই পড়ে।

“তুমি জগন্নাথের বাবার কথা জিজ্ঞেস করলে না?”

“করেছি।”

“কী বললেন?”

“বললেন, কুকুরের পেটে কি ঘি সয় গো? যেমন ছিলি, তেমন থাকলে তো খেয়ে-পরে থাকতে পারতিস। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। সংসারটাকে ভাসিয়ে গেল।”

কিকিরার কান ছিল কথায়, বললেন, “লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু!”

“তাই তো বললেন।”

“তুমি আর কিছু জিজ্ঞেস করলে না?”

“অ্যাকসিডেন্টের কথা জিজ্ঞেস করলাম। বললেন, ওপর থেকে প্রথমে অতটা বোঝা যায়নি, পরে দেখা গেল কোমরের কাছে জোর জখম হয়েছিল জগুদার বাবা। ভেতরে ভীষণ লেগেছিল। দু-চার ঘণ্টার পর আর হুঁশও ছিল না।”

কিকিরা কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন এমন সময় জগন্নাথ এসেছে বোঝা গেল। ফ্ল্যাটের সদরে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল বগলার সঙ্গে।

জগন্নাথ ঘরে এল একটু পরেই।

কিকিরা বললেন, “এসো হে জগন্নাথ! আছ কেমন?”

জগন্নাথ বলল, “ভাল নয়।”

“তোমায় বেশ শুকনো-শুকনো দেখাচ্ছে। বসো!”

 বসল জগন্নাথ।

বগলার চা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। চা আর কচুরি এনে দিয়ে গেল।

 চা খেতে-খেতে কিকিরা জগন্নাথকে বললেন, “নতুন কিছু ঘটেছে নাকি?”

“আজ্ঞে, নতুন বলতে কাল বাড়ি ফিরে গিয়ে আবার একটা চিঠি পেলাম।“

“প্রেতসিদ্ধর?”

“হ্যাঁ। কাল শনিবার ছিল। অফিস থেকে বেরিয়ে একবার আমার এক মামার কাছে গিয়েছিলাম। জেলেপাড়ায়। নিজের মামা নয়। মায়ের মাসতুতো দাদা। হাত ভেঙে পড়ে আছেন বুড়ো বয়েসে। মামাকে দেখে বাড়ি ফিরে চিঠিটা পেলাম।”

“বয়ান কী? সেই আগের মতন? এনেছ চিঠিটা?”

 জগন্নাথ পকেট থেকে চিঠি বার করে কিকিরাকে দিল।

তারাপদ ইশারায় কচুরি তুলে চা নিতে বলল জগন্নাথকে। এই চিঠির কথা সে জানে না। জগুদা সন্ধেবেলায় বাড়ি ফিরে গিয়ে চিঠিটা পেয়েছে, কাল ছিল শনিবার, আজ রবি, জগুদার সঙ্গে তার দেখা হয়নি।

কিকিরা চিঠি পড়া শেষ করে বললেন, “চিঠি তো একই। এবার তাড়া বেশি। তোমার মায়ের আত্মার সঙ্গে শুদ্ধানন্দর বড় ঘন ঘন দেখা হয়ে যাচ্ছে। তাই না?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ।”

“তা তুমি চুপ করে বসে আছ কেন? জানিয়ে দাও, তুমি শুদ্ধানন্দর সঙ্গে দেখা করতে যাবে।”

“যাব?”

“অবশ্যই যাবে।”

জগন্নাথ ভয়ে-ভয়ে বলল, “যদি কিছু হয়?”

“কী আর হবে। হবে না কিছু।”

“আমার কিন্তু ভয় করছে।”

“ভয় পাবার ব্যাপার নেই জগন্নাথ! তুমি জানিয়ে দাও, তুমি যাবে। কবে যাবে তাও আমি বলে দিচ্ছি।” বলে কিকিরা কিসের হিসেব করলেন মনে-মনে। শেষে বললেন, “আগামী শনিবার। …না, শনিবার থাক, রবিবার। আগামী রবিবার।”

জগন্নাথ তাকিয়ে থাকল।

কিকিরা হেসে বললেন, “ভয় করার কারণ নেই। আমি থাকব। কিন্তু একথা যেন কেউ না জানতে পারে। তোমার সঙ্গে থাকব আমি। প্রেতসিদ্ধর খাস ঘরে। যেখানে তিনি আত্মাদের আনেন-টানেন। আর বাইরে থাকবে এরা, তারাপদ আর চন্দন। দু-চারজন বাইরের লোক আরও থাকতে পারে। সে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা।”

জগন্নাথ ঘাড় নাড়ল।

কিকিরা বললেন, “তুমি শুধু চিঠিতে লিখে দিও প্রণামী’ সম্বন্ধে আপনি চিন্তা করিবেন না। আমি যথাযোগ্য পুস্পাঞ্জলি দিব। তবে সামান্য নিরিবিলিতে কথাবার্তা বলিতে চাহি।”

.

০৮.

বাড়ি থেকে বেরোবার সময় কিকিরা বললেন, “স্যান্ডেল উড, পাঁজিতে আজ কী লিখেছে জানো? মঙ্গলবার কালরাত্রি–ঘ ৬/২৭ গতে ৮/৫ মধ্যে। যোগিনী-পূর্বে। মাসদগ্ধা। ক্লীং রিং হিং…।”

চন্দন আর তারাপদ হেসে উঠল। কিকিরাও হাসছিলেন। চন্দন বলল, “আপনি কি পঞ্জিকা-পণ্ডিত?”

“কে বলেছে হে! সংসারে সব জিনিস একটু-একটু চেখে রাখতে হয়। চিংড়ি মাছের পায়েস থেকে পঞ্জিকার কালরাত্রি পর্যন্ত। আজ মঙ্গলবার। যাচ্ছি তন্ত্রাচার্য শুদ্ধানন্দ প্রেতসিদ্ধ কল্পবৃক্ষর কাছে। এমন শুভ বা অশুভ দিন-যাই বলো একবার দেখে নিতে হয় বইকি! জয় মা তারা।”

তারাপদ হাসতে-হাসতে বলল, “আপনাকে কিন্তু সুপার্ব দেখাচ্ছে। মেটে ফিরিঙ্গি।”

কিকিরা হেসে ফেললেন। চন্দন বলল, “মেটে ফিরিঙ্গি কাকে বলে, জানেন?”

“না।”

“মেটেবুরুজের ফিরিঙ্গি।”

তিনজনে হাসতে হাসতে নিচে রাস্তায় নেমে এল। সন্ধে হয়নি তখনও তবু এই হেমন্তের মরা বিকেলে অন্ধকার নেমে গিয়েছিল।

কিকিরাকে সত্যিই অদ্ভুত দেখাচ্ছিল। লম্বা লম্বা ডোরাকাটা এক প্যান্ট পরেছেন। ডোরাগুলো কালো। প্যান্টের জমিটা খয়েরি রঙের। এ-প্যান্টের কাটছাঁট কোন দরজির কে জানে! পাগুলো সরু-সরু, কোমরের কাছে ঢোললা। গায়ে চেক শার্ট, শার্টের ওপর এক হাফ হাতা সোয়েটার। গায়ের কোটটা কুচকুচে কালো, তার ঝুল নেমেছে হাঁটু পর্যন্ত। গলায় এক সিল্কের মাফলার। মাথায় ফেলট হ্যাট। চোখে গোল কাঁচের চশমা। ফ্রেমটিও সেই রকম, তারের ফ্রেম কানে জড়ানো সেকেলে ছিরি, চশমার।

রাস্তায় এসে কিকিরা বললেন, “আমার নাম কী জানো?”

“কী?”

“বিভুপদ হংস।”

“হংস?”

“আজ্ঞে, হংস। হাঁস। ডাক্।” কিকিরা হাতের ছড়িটা দোলাতে দোলাতে গম্ভীরভাবে বললেন, “বিপদ হাঁস হল আদ্রা পুরুলিয়ার লোক। বাবা ষষ্ঠীপদ। হাঁস। বিভুপদ কাঠ, সিমেন্ট, মাটি, মশলা, গুড়-এর কারবারি। তার গাঁটে-গাঁটে দশ-পঞ্চাশ-একশোর বাজারি নোট গোঁজা থাকে। ভেরি রিচ, বাট ড্যাম্প ফুল। বিভুপদ তার বাবার সঙ্গে দুটো কথা বলতে চায়। বাবা পাঁচ বছর আগে হেভেনে চলে গেছেন। তাঁর একটা উইল ছিল। সেই উইল যে কেমন করে আগাগোড়া পালটে গেল কে জানে। বিভুপদ তার বাবার কাছে দুটো কথা জানতে চায়। ব্যস। …”

চন্দন একটা ট্যাক্সি দেখতে পেয়ে হাত তুলে চেঁচাল, “ট্যাক্সি।”

ট্যাক্সি দাঁড়াল।

কিকিরারা উঠে পড়লেন। ট্যাক্সিঅলা যেন মজার চোখে দেখলেন কিকিরাকে।

“যাবেন কোথায়?”

কিকিরা বললেন, “নিমতলার দিকে।”

ট্যাক্সিঅলা অদ্ভুতভাবে “ও,” বলল।

ট্যাক্সিতে যেতে-যেতে তারাপদ বলল, “আচ্ছা স্যার, জোয়ারদারকে তো আপনি বিশ্বাস করলেন। ওই সাহেব যদি ফাঁসিয়ে দিয়ে থাকে।”

“দেবে না। ও নিজে বেশ চটে আছে।”

“তবু…”

“কোনো চিন্তা নেই। আমি কিকিরা দি ওয়ান্ডার। আমার এই মেটে ফিরিঙ্গি ড্রেসের তলায় ম্যাজিশিয়ান কিকিরা বিরাজ করছে হে! কল্পতরু আমার কিছু করতে পারবেন না। তবে ষণ্ডাদের দিয়ে মারধোর করলে মরে যেতে পারি। দেহ অতটা সইতে পারবে না।”

চন্দন বলল, “আমরা থাকব কিকিরা, ওয়াচ রাখব। আপনি শুধু একবার ত্রাহি-ত্রাহি চেঁচাবেন।”

তারাপদ হেসে বলল, “আগে বললে ক’টা পটকা কিনে আনতাম কিকিরা। কালীপুজোর রেশ চলছে।”

কিকিরা বললেন, “তারাপদ, ছেলেবেলায় আমাদের পাড়ার ক্লাবে যাত্রা হত। তাতে একবার আমি এক সেনাপতির পার্ট করেছিলাম। কথা কম কাজ বেশি মাকা পার্ট। মানে যখন-তখন আমাকে তরোয়াল বার করতে হত খাপ থেকে আর ঢোকাতে হত। আর বলতে হত, যথা আজ্ঞা মহারাজ।’ তা অন্য সময় তরোয়াল কোনো গণ্ডগোল বল না, খুললাম বন্ধ করলাম। কিন্তু মহারাজের যখন বিপদ, গুপ্তশত্রু এসে লাফিয়ে পড়েছে মহারাজের ঘাড়ে তখন আমার তরোয়াল খাপে আটকে গেল। কিছুতেই খুলল না। ওদিকে মহারাজেরও যাই-যাই অবস্থা। তখন কী করলাম বলো তো?”

“কী?”

“কোমর থেকে খাপসুষ্ঠু তরোয়াল খুলেই লড়তে লাগলাম। সে কী হাসির ধুম। লোকে চেঁচাতে লাগল–ওরে বেটা, খাপ থেকে তরোয়াল বার কর, খাপ নিয়ে কি লড়া যায়?”

তারাপদ আর চন্দন হো-হো করে হাসতে লাগল।

কিকিরাও হাসতে-হাসতে বললেন, “ম্যানেজ আমি করে ফেলব। তোমরা ভেব না।”

.

যথাস্থানে জোয়ারদার অপেক্ষা করছিলেন। কিকিরাকে দেখে চমকে গেলেন। বললেন, “ব্যাপার কী মশাই?”

“কিছু নয়। বিভুপদ হাঁস, আদ্রা-পুরুলিয়ার লোক, নানা ধরনের ব্যবসা। টাকার গাছ। ব্য–এই পর্যন্ত আপনি। বাকিটা আমি। আমার ওপর ছেড়ে দেবেন।”

“তা না হয় দেব। পারবেন?”

“দেখবেন তখন।”

“ওর কতকগুলো ষণ্ডামার্কা চেলা আছে..”

“আমার কাছে পিস্তল আছে।”

“পিস্তল?” জোয়ারদার আঁতকে উঠলেন।

“আসল নয়। নকল। ম্যাজিশিয়ানের পিস্তল। ফায়ার হবে, গুলি বেরোবে না। … চলুন।”

দু’জনে পা বাড়ালেন গলির দিকে। চন্দন আর তারাপদ তফাতে থেকে গেল। তারা সামান্য পরে যাবে।

ব্যবস্থায় কোনো ফাঁক নেই। কিকিরার মনে হল, এ যেন কোনো নিষিদ্ধ এলাকায় ঢোকার মতন।

শুদ্ধানন্দর বাড়ির বাইরে থেকে ভেতর বোঝার উপায় নেই। বাইরেটার যতই ভাঙাচোরা, ঝোঁপঝাড়ভরা চেহারা হোক না কেন, ভেতরটা তেমন নয়। বাড়ি যে বেশ পুরনো, আদ্যিকালের, সেটা বোঝা যায়; বোঝা যায় এককালে সাহেব-সুবোই থাকত, কুঠিবাড়ির ছাদ আর বাংলোবাড়ির খোলামেলা বারান্দা। বারান্দাগুলো বড়, চওড়া। দেওয়ালের থাম মোটা-মোটা। আর্চগুলোও বেশ বড়। তবে সবই ভাঙাচোরা, ফাটাফুটো। ইলেকট্রিকও আছে। মিটমিটে আলো এদিকে-ওদিকে জ্বলছে। গুটি দুয়েক। তাতে আলো তেমন হয় না।

শুদ্ধানন্দর এক চেলা জোয়ারদারকে ডেকে নিয়ে গেল। এই লোকটা সেদিনের সেই ষণ্ডা কি না বোঝা গেল না। হতে পারে, নাও পারে। লোকটাকে দেখলে মনে হয়, গঙ্গার ঘাটে দলাইমলাই করে বেড়ায় পালোয়ান ধরনের চেহারা।

কিকিরার কোনো অসুবিধে হল না। জোয়ারদার যে শুদ্ধানন্দর স্থায়ী মক্কেল একথা জানার পর তার খাতির বোধ হয় বেড়ে গিয়েছে। তা ছাড়া জোয়ারদার আগে থেকেই বলে কয়ে ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন বলে কিকিরাকে ষণ্ডা-লোকটা কিছু বলল না। শুধু চেয়ে-চেয়ে দেখল বিচিত্র পোশাকের কিকিরাকে।

ঘরের গালাগানো প্যাসেজ দিয়ে দু-তিনটে ঘর পেরিয়ে একটা মাঝারি ঘরে নিয়ে গিয়ে জোয়ারদারদের বসাল লোটা। তারপর বলল, “মহারাজকে খবর দিচ্ছি।”

এই ঘরটায় দেখার মতন কিছুই নেই। ন্যাড়া দেওয়াল। একপাশে এক টিমটিমে বাতি। বসার জন্য কাঠের বেঞ্চি। একটিমাত্র চেয়ার। দেওয়ালের রং বোঝা যায় না, এমন ময়লা। ফাটা দাগ। সিমেন্টের মেঝেও ফেটে গিয়েছে। দেওয়ালে অবশ্য টিকটিকি-গিরগিটির অভাব নেই।

জোয়ারদার কী বলতে গিয়ে চুপ করে গেলেন, তারপর ঠোঁটে আঙুল চেপে ইশারায় বোঝালেন, এখানে কথাবার্তা না বলাই ভাল।

খানিকটা পরে অন্য একজন এল। এর চেহারা ঠিক ষণ্ডামার্কা নয়। ছিপছিপে। বড় বড় বাবরি চুল। পরনে গেরুয়া লুঙ্গি, গায়ে আলখাল্লা, একটা সুতির মোটা চাদর রয়েছে গায়ে।

ইশারায় ডাকল জোয়ারদারদের।

পাশের ঘরে এনে লোকটি বলল, “জুতো খুলুন। টুপি পরা চলবে না। পকেটে চামড়ার জিনিস থাকলে রেখে দিন। টর্চ রাখবেন না। এখানে রেখে যান। “

জোয়ারদার জানেন সব। ক’ দফা এলেন। জুতোটুতো খুলতে লাগলেন।

 লোকটা চলে গেল।

জোয়ারদার নিচু গলায় বললেন, “এরপর সার্চ হবে।”

কিকিরা বললেন, “আন্দাজ করেই এসেছি।” বলে বেশ জোরে হেঁচে ফেললেন।

“হাত দিয়ে ঘেঁটেঘুঁটে দেখবে।”

“বুঝতে পারছি।” বলতে না বলতে আবার হাঁচি।

“হল কী আপনার?”

“সিজন চেঞ্জ, ঠাণ্ডা লেগে গিয়েছে।”

সামান্য পরে আবার সেই লোকটি ফিরে এল। এসে বলল, “রেখেছেন সব?”

“আজ্ঞে?”

“আপনি আসুন..” জোয়ারদারকে ডাকল।

এগিয়ে গেলেন জোয়ারদার। তাঁকে সার্চ করা হল।

 কিকিরা আবার হাঁচলেন।

এবার কিকিরার পালা।

“নাম?”

“বিভুপদ হাঁস।”

“পাতি না রাজহাঁস?”

“রাজহাঁস। আমার বাবা ষষ্ঠীপদ হাঁসকে লোকে রাজাবাবু বলত আদ্রা-পুরুলিয়া বাউলডিঙ্গিতে আমাদের ঘরবাড়ি জমিজায়গা। চার-পাঁচ রকম কারবার, “বলতে বলতে কিকিরা আবার হাঁচলেন, বিরাট হাঁচি।

লোকটা দু পা পিছিয়ে গেল। বিরক্ত হয়ে বলল, “কী হয়েছে আপনার?”

“ঋতু পরিবর্তন। নতুন শীত আসছে। সর্দি..”

“সর্দি নিয়ে এসেছেন কেন?”

“রাস্তায় হল।”

 জোয়ারদার বললেন, “আমার বন্ধু। আসার কথা ছিল।”

“নাকে রুমাল চাপা দিন।”

“আজ্ঞে দিয়েছি।”

লোকটা আবার এগিয়ে এসে কিকিরার গা হাতড়াতে না হাতড়াতেই উনি হেঁচে ফেললেন।

“হল কী মশাই আপনার?”

“হাঁচি।”

“হাঁসদের হাঁচি হয় শুনিনি। …যাকগে ওখানে গঙ্গাজল আছে, হাতটাত ধুয়ে নিন আপনারা। শুদ্ধ হয়ে নিন।”

কিকিরা শুদ্ধ হতে-হতে শুনলেন–প্রথম ঘণ্টা বাজছে।

ঘরের একদিকে একটা কাঠের বাক্স মতন ছিল। তালা খুলে তার ভেতর থেকে দুটো কালো জোব্বা বার করল লোকটি। বলল, “নিন পরে নিন। মাথা কান কপালও ঢেকে রাখবেন। খুলবেন না।”

জোয়ারদার কালো জোব্বা গায়ে চাপালেন।

 কিকিরা একবার করে হাঁচছেন, আর কালো আলখাল্লা পরছেন। বুদ্ধি করে রুমালটা তিনি রঙিন এনেছিলেন, মেরুন রঙের। নয়ত ওই চেলা হয়ত রুমালটাও ফেলে দিতে বলত।

কিকিরাকে ভাল করে দেখে নিয়ে গেরুয়াধারী চলে গেল। বলে গেল, “আসছি।”

ও চলে যেতেই জোয়ারদার ফিসফিস করে বলল, “এবার ওই ঘরে যেতে হবে।”

কিকিরা মাথা হেলালেন।

 “একটু হুঁশিয়ার থাকবেন। টাকা এনেছেন?”

“দুশো দুই।”

“দুশো দুই?”

“এখন দুশো; পরের দিন তিনশো। প্লাস একটা মোহর।”

“মোহর!”

“বাবার আমলের। কাজ হলে তবে…”

“মশাই, সাবধান।”

চেলাটি এসে পড়ল। “আসুন। প্রণামী হাতে রাখুন।”

সরু এক গলিপথের মতন প্যাসেজ দিয়ে কিকিরারা একটা ঘরের সামনে এলেন। দরজা বন্ধ।

শুদ্ধানন্দর চেলাটি দরজা খুলল ধীরে-ধীরে। কিকিরা আবার হাঁচলেন। লোকটা বিরক্ত হল। বলল, “যান, ভেতরে গিয়ে বসুন। মাটিতে। …প্রণামীটা?”

দুজনেই টাকা দিলেন।

কিকিরার হাত থেকে দু’শো টাকা পেয়ে লোটা বোধ হয় খুশি হল না। বলল, “আজ স্পেশ্যাল ছিল। মাত্র দুশো টাকা?”

কিকিরা বললেন, “আবার আসব। তিনশো দেব। সঙ্গে একটা মোহর। পুরনো আমলের।”

“যান।”

 ঘরে ঢুকে কিছু আর দেখা যায় না। ঘুটঘুট করছে অন্ধকার। ধুনোর ধোঁয়া। তার সঙ্গে ধূপের গন্ধ। গন্ধটা এতই উগ্র যে, ধুনোর গন্ধকেও ছাড়িয়ে যায়।

চোখ সইয়ে নিতে সময় লাগল। ততক্ষণে ঘরের এক কোণে একটা লাল আলো, টুনি বাবের আলো যেমন হয়, এক ফোঁটা জ্বলে উঠেছে।

.

জোয়ারদার গায়ে ঠেলা মারলেন।

কাছেই একটা তক্তাপোশ। তার ওপর ফরাস পাতা। দেখা না গেলেও অনুমান করে নিতে হয়।

জোয়ারদারের দেখাদেখি কিকিরা ফরাসের ওপর বসলেন। হাঁটু ভেঙে আসন করে। পায়ে লাগে। কিন্তু উপায় কী?

কিকিরার চোখ খানিকটা সয়ে গিয়েছে। অনুমানে মনে হল, এই ঘরটা হলঘরের মতন। বড়ই বলা যায়। কিকিরা যে-জায়গায় বসে আছেন, সেই জায়গাটা কি সামান্য ঢালু? হতে পারে। বেশ খানিকটা তফাতে, অন্তত গজ-তিরিশ দূরে একটা কী যেন রয়েছে। উঁচু মতন। ওখানেও কি কোনো তক্তাপোশ বা মঞ্চ পাতা আছে। হলঘরে কি কোনো স্টেজ বাঁধা আছে?

এমন সময় লাল মিটমিটে বাতিটা নিভে গেল। জ্বলল পর মুহূর্তে। আবার নিভল।

“উনি আসছেন?” জোয়ারদার বলল।

কিকিরা আবার হাঁচলেন, নাক পরিষ্কার করলেন।

এবার এক হালকা বেগুনি বাতি জ্বলে উঠল। বাতিটা এমন জায়গায় জ্বলল যাতে দূরের উঁচু জায়গাটা আবছাভাবে চোখে পড়ে।

কিকিরা ঠিকই অনুমান করেছিলেন। দূরে একটা মঞ্চ পাতা রয়েছে। ছোট। তক্তাপোশের ওপর মোটা কোনো জিনিস, তার ওপর কালো চাদর। দু পাশে দুই ধুনোর পাত্র, একটা থালায় গাঁদা ফুলের মালা। মঞ্চের দুধারে পেছনে দুই ত্রিশূল। একটা ত্রিশূলের ডগায় মরা কাক, অন্যটার মাথায় খুলি।

এমন সময় শব্দ হল ঘণ্টার। কে যেন পুজোর ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে, খুবই ধীরে খড়মের শব্দ করতে করতে পেছন থেকে এগিয়ে এল। মুখে অত সব শব্দ “ক্লীং রিং হিং। ওঁ অপসৰ্পন্তু তে ভূতাঃ যে ভূতাঃ ভুবি সংস্থিতা। যে ভূতাঃ বিকতারম্ভে পশ্য..চ হুং ফট। আং হ্রীং ক্রোং যং রং লং হৌং হঃ…ফট…।”

ইনিই তবে শুদ্ধানন্দ? একাদশ তন্ত্রমন্ত্র-সিদ্ধ শুদ্ধানন্দ প্রেতসিদ্ধ কল্পং বৃক্ষঃ! ফট বাবাজি!

কিকিরা ভাল করে লক্ষ করবার চেষ্টা করতে লাগলেন। বড়ই অস্পষ্ট। তবু শুদ্ধানন্দর চেহারা এবং পোশাকটি আন্দাজ করা যায়। পোশাক একেবারে ঘন রক্তবর্ণ। গায়ের চাদরটিও লাল। গলায় মোটা-মোটা রুদ্রাক্ষ-মালা। মাথার চুল ঘাড় পর্যন্ত, বাবরি ছাঁট। রুক্ষ ঝাঁকড়া চুল। কপালে রক্তচন্দন। দুটি চোখ লাল। তবে চোখের তলা কালো। ভূরু মোটা। টানা টানা। কিকিরার সন্দেহ হল, শুদ্ধানন্দ চোখের ভুরু আর চোখের তলায় কাজল লেপেছেন।

শুদ্ধানন্দ বসলেন। আসনে বসার মতন করে। চোখ বন্ধ। নিজের মনে বিদঘুঁটে মন্ত্র আওড়াচ্ছেন–তে ভূতাঃ যে ভূতাঃ…চ হুং ফট…ক্রোং যং বং লং হে হঃ…ফট।’

কিছুক্ষণ মন্ত্র আওড়ানোর পর শুদ্ধানন্দ হাত উঠিয়ে কী যেন ছুঁড়ে দিলেন। একবার ডাইনে, একবার বাঁয়ে। ধুনোর পাত্র থেকে ধক করে আগুন জ্বলে উঠল। নিভেও গেল।

সেই আগুনের আলোয় কিকিরা শুদ্ধানন্দকে দেখে নিতে পারলেন অল্পের জন্য। চেহারায় না থোক সাজে-পোশাকে চারপাশের সাজেসজ্জায় একটা গা-ছমছমে ভাব হয়।

আগুন নিভে যাবার পর শুদ্ধানন্দ আরও একবার মন্ত্র আওড়ালেন। তারপর কথা শুরু করলেন।

“জোয়ারদারবাবু, তুমি এসেছ?”

“আজ্ঞে!”

“পরশু তিন যামে ভন্তরালিকা স্তরে তোমার আত্মীয় বাসুদেবের সঙ্গে দেখা হল। আহা, বেচারি ব্রীহিবৃক্ষের তলায় অবস্থান করছিল। বলল, কোন্ অপরাধে কে জানে সে নিম্নগামী হতে পারছে না। বাধা পাচ্ছে। আগামী অমাবস্যার পর সে আসতে পারবে।”

“আর কিছু জানাল মহারাজ?”

“বলল, ও যখন আসবে মুখোমুখি তোমায় শুনিয়ে যাবে।”

“বড় বিপদে পড়েছি মহারাজ! ব্যবসার ব্যাপার। বাড়িতেও খানিকটা অসুবিধে হচ্ছে। ভাগনেটা…”

“ধৈর্য ধরো জোয়ারদার। আত্মা দেহধারী জীব নয়। তার আসতে কষ্ট, যেতেও কষ্ট। সে কষ্ট তুমি বুঝবে না।”

“আগামী অমাবস্যা?”

“হ্যাঁ।”

“সে কবে?”

“দেরি নেই।”

জোয়ারদার চুপ করে গেলেন।

সামান্য পরে শুদ্ধানন্দ বললেন, “তোমার সঙ্গীটি এসেছে দেখছি।”

কিকিরা হাতজোড় করে বিনীতস্বরে বলল, “আজ্ঞে হ্যাঁ।”

“কী নাম?”

“বিভুপদ হাঁস। পিতার নাম ষষ্ঠীপদ হাঁস। তিনি পাঁচ বছর আগে স্বর্গে গিয়েছেন। নিবাস বাউলডিঙি, আদ্রা-পুরুলিয়া।”

 “পেশা?”

“মহারাজজি, পেশা আর কী বলব! ব্যবসা! কাঠগোলা, সিমেন্ট, মশলাপাতি, গুড়, এই সব। একটা ছোট কলকারখানা…ইচ্ছে তো ছিল, কিন্তু বড় বিপদে পড়ে গিয়েছি।”

“কী বিপদ?”

“কী বলব মহারাজ! আমার শিবতুল্য বাবা একটা উইল করে গিয়েছিলেন। আমরা তিন ভাই। উইলে আমার ছিল অনেক কিছু। এখন এক অন্য উইল বার করে ভাইরা…কী বলব, মহারাজ!”

“বুঝেছি।…উইল জাল হয়েছে।”

“কেমন করে হল! জগতে কাউকে বিশ্বাস নেই।” বলতে বলতে আবার হাঁচলেন কিকিরা। নাকে-মুখে রুমাল চাপা দিলেন।

“পিতা গিয়েছেন কবে?”

“তা পাঁচ বছর। “

“পাঁচ বছর!…পঞ্চম হল ভৌরিক স্তর, পঞ্চদশ গৌরিব। পাঁচ হলে সেই আত্মা অর্ধ-নিদ্রিত।…তা এই সব আত্মাকে আনানো কঠিন। ওঁদের নিদ্রাকাল তো মানুষের মতন নয়।”

“আজ্ঞে হ্যাঁ…কিন্তু কী করব! আপনি আমায় সাহায্য করুন।”

শুদ্ধানন্দ চুপ করে থাকলেন। তারপর আবার কী যেন ছুঁড়লেন ধুনোর পাত্রে। এবারে আর আগুন জ্বলল না, ধোঁয়া হল সামান্য।

নিজের মনে কয়েকটা অদ্ভুত মন্ত্র আওড়াতে আওড়াতে শুদ্ধানন্দ বললেন, “দেখি…। খোঁজ করতে হবে। সময়সাপেক্ষ।”

কিকিরা বললেন, “আমি আপনার কাছে এসে পড়েছি। আপনি না পারলে কে পারবে মহারাজজি। খরচের জন্যে আপনি ভাববেন না। আমি ব্যবসাদার মানুষ…বিপদ উদ্ধারের জন্যে দু-চার হাজার টাকা খরচ করায় আমার আটকাবে না।”

“বুঝলাম, কিন্তু তুমি বড় অধৈর্য হচ্ছ! এ-সব কাজ..”

“জানি। আপনি ইচ্ছে করলে পারেন মহারাজ।”

“পারি?” শুদ্ধানন্দ একটু চুপ করে থেকে হঠাৎ তালি দিলেন হাতে। ঘন্টি নাড়লেন। সঙ্গে-সঙ্গে সব অন্ধকার। ঘুটঘুটে হয়ে গেল ঘর।

একেবারে স্তব্ধ ভাব। নিঃসাড়।

কিছুক্ষণ পরে শুদ্ধানন্দের গম্ভীর গলা শোনা গেল, “হে ধেনুক, আপনি কি এসেছেন?”

কোনো সাড়াশব্দ নেই।

অপেক্ষা করে শুদ্ধানন্দ বললেন, “হে সর্বগামী ধেনুক, আমি আপনাকে আহ্বান করছি। যদি এসে থাকেন–দেখা দিন।”

কেউ দেখা দিল না।

 শুদ্ধানন্দ আবার ডাকলেন, “ধেনুক! আপনি কি আসবেন না?”

হঠাৎ যেন একটি জোনাকি জ্বলে উঠল শুদ্ধানন্দের পিছনে, ত্রিশূলের দিকে। জোনাকির আলো বারকয়েক নাচল। মনে হল, মরা কাকের মাথার দিকেই জোনাকি নাচল।

“আপনি এসেছেন?”

একটা শব্দ হল। খট খট।

“হে ধেনুক। আমার এখানে একজন হতভাগ্য অতিথি এসেছেন। তিনি “তাঁর পিতার কাছে একটি কথা জানতে চান। পিতা ভৌরিক স্তরে আছেন। পুত্রের নাম বিভুপদ। …আপনি কি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন?”

জোনাকির মতন আলোর কণাটি স্থির হয়ে থাকল।

শুদ্ধানন্দ বললেন, “ঠিক আছে।”

আলোর কণাটি নিভে গেল।

শুদ্ধানন্দ বললেন, “বিভুপদ?”

“মহারাজ?”

“আপনি আসুন অন্য একদিন।”

“রবিবার আসব মহারাজ। সোমবার আমাকে একবার আদ্রা যেতে হবে।”

“রবিবার?”

“আমাকে কৃপা করুন মহারাজ।”

“আসুন।..অর্থাৎ অর্থাদি বিষয়ে…”

“আপনি ভাববেন না।”

.

০৯.

ঘোলাটে মেঘলা-মেঘলা আকাশ দেখে বোঝা যায়নি ঝপ করে অমন বৃষ্টি নামতে পারে। একটা দিন সন্ধে থেকে ঘণ্টা-দুই মোটামুটি বৃষ্টি হয়ে গেল। কলকাতার রাস্তাঘাটে কোথাও-কোথাও যদিবা জল দাঁড়িয়ে থাকে, পরের দিন আবার সব শুকনো।

বিকেলবেলা তারাপদ এল অফিস ফেরত। কিকিরা বাড়ি নেই।

সামান্য পরে এল জগন্নাথ। কথা ছিল আমার। তারাপদর সঙ্গেই আসতে পারত সে, পারেনি অন্য একটা কাজে আটকে গিয়ে।

তারাপদ আর জগন্নাথ বসেবসে গল্পগুজব করছে, চা খাচ্ছে, এমন সময় কিকিরা এলেন। হাতে একটা মোটা প্যাকেট।

“গিয়েছিলেন কোথায়?” তারাপদ বলল।

“আজ একটু শীত শীত লাগছে! ম্যালারু হবে নাকি হে?” প্যাকেটটা রাখতে রাখতে কিকিরা বললেন, “ছেলেবেলায় যদি মাকে বলতাম, মা আমার শীতশীত করছে, সঙ্গে-সঙ্গে মা বলতেন, তোর কম্পজ্বর হবে। আমাদের ওদিকে কম্পজ্বরটা ভালই হত। কত যে কুইনিন মিকশচার খেয়েছি তারাপদ, খেয়ে-খেয়ে লিভারটাই নষ্ট হয়ে গেছে।”

তারাপদ ঠাট্টার গলায় বলল, “আপনাকে দেখলেই সেটা বোঝা যায়। যা বলছিলুম, গিয়েছিলেন কোথায়?”

নিজের জায়গায় বসতে বসতে কিকিরা বললেন, “দরজির কাছে।”

“দরজি?”

“আফজল খলিফা। আমার পেয়ারের দরজি।…তা জগন্নাথবাবু, তুমি কেমন আছ?”

“একরকম।“

“যা যা বলেছিলাম করেছ?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনার কথা মতন পরের দিনই চিঠি লিখে দিয়েছি।”

“জবাব পাওনি?”

“না।”

“পেয়ে যাবে। আজ মাত্র বৃহস্পতিবার। এখনও দু’দিন আছে। শনিবারের মধ্যে জবাব পেয়ে যাবে। রবিবার আমাদের যাত্রা।”

“যদি না পাই?”

“পাবে। আমি আন্দাজ করছি পাবে। তোমার কাছে তো আগের চিঠিও রয়েছে।”

কিকিরার জন্যে চা এল। বোধ হয় তৈরি করাই ছিল আগে থেকে।

চা খেতে-খেতে কিকিরা তারাপদকে বললেন, “এই প্যাকেটটা খোলো হে। তারাপদ।”

তারাপদ উঠে গিয়ে প্যাকেটটা নিল। খুলল। ভেতরের জিনিসগুলো বার করতে করতে বলল, “এ-সব কী?”।

“কালো আলখাল্লা। তিনটে আছে।”

“কী হবে এগুলো দিয়ে?”

“আমরা পরব। ওয়ান ফর মি, ওয়ান ফর ইউ, তিন নম্বরটা স্যান্ডেল উডের জন্যে।…তুমি একটা ট্রাই করো।”

তারাপদ বলল, “প্রেতসিদ্ধর কালো আলখাল্লা!”

“ইয়েস।”

তারাপদ আলখাল্লা গায়ে গলাল। মাথা ঢাকল। বলল, “কিকিরা এ যে ভূতের মতন দেখাচ্ছে।”

“তাই দেখাবে। ভূতের নাচ নাচতে হলে কি ঝলমলে পোশাক পরতে হবে। “

তারাপদ ঘরের মধ্যে ঘুরেফিরে নিজের পোশাক দেখতে দেখতে বলল, “কিন্তু স্যার, প্রেতসিদ্ধ যদি..”

কিকিরা বুড়ো আঙুল দেখালেন। বললেন, “ছাঁটকাট কোথাও কোনো অদলবদল নেই। যেমনটি চুরি করে এনেছিলাম–অবিকল তেমনটি। দেখো না তুমি, অরিজিনালটাও রয়েছে। শেষেরটা।”

তারাপদ বলল, “স্যার, ওদের যদি হিসেব থাকে! ধরুন গুনতি করে রেখে দিয়েছে। একটা শর্ট দেখে যদি…”

“না রে বাবা না, অত হিসেব না ওদের। আর থাকলেও আমার কী! আমি কি চোর? বিভুপদ হাঁস। ষষ্ঠীপদ হাঁসের ছেলে। টাকা-পয়সায় আমার ছাতা পড়ছে।”

তারাপদ বলল, “ ঠিক।”

 কিকিরা জগন্নাথের দিকে তাকালেন। বললেন, “রবিবার তুমি অবশ্যই যাবে। তারাপদ তোমাকে নিয়ে যাবে বাড়ি থেকে। গলির মুখে ছেড়ে দেবে। তারপর তুমি একলা।”

“আমি কী করব?”

“কিছুই করবে না। ওরা যা-যা করতে বলবে করবে। ওরা তোমাকে এইরকম কালো আলখাল্লা পরতে বলবে। পরবে। হাত ধুতে বলবে গঙ্গাজলে। ধোবে। তোমাকে আত্মা-নামানোর ঘরে নিয়ে বসিয়ে রাখবে। বসবে। ভয় পাবে না। ঘাবড়াবে না। বরং প্রেতসিদ্ধর গায়ে লুটিয়ে পড়তে পারো এমন ভাব করবে।”

তারাপদ বলল, “কিন্তু কিকিরা, আপনাকে আর জগুদাকে যদি একসঙ্গে না। ডাকে। আলাদা-আলাদা করে তলব করে?”

“করতে পারে। আবার না-ও করতে পারে। জোয়ারদারসাহেব যা। বললেন, তাতে তো শুনলাম, সব মক্কেলই একসঙ্গে ডাক পায়। স্পেশ্যাল। কেস হলে আলাদা। জেনারেল কেস হলে একই সঙ্গে সিটিং। তাতে জমে ভাল। একই খেলা দুবার খেলতে হয় না। যারা থাকে তারা একেবারে স্পিক্-টি-নট, চক্ষু ছানাবড়া। প্রেতসিদ্ধর নাম ছড়িয়ে যায়।…তবে হ্যাঁ, অনেকে তো ঘরের কথা অন্যকে শোনাতে চায় না। সেগুলো স্পেশ্যাল কেস। ভিজিটও বেশি।”

“জগুদার তো স্পেশ্যাল কেস হবে।”

“মনে হয় তাই।..আমিও স্পেশ্যাল চেয়েছি।…তবে শুদ্ধানন্দর কথা থেকে মনে হল, রবিবার উনি এক মতলব ভেঁজে রেখেছেন। জানি না, জগন্নাথের চিঠি পেয়ে ব্যবস্থা করে রাখছেন কি না। আমি একেবারে নাছোড়বান্দা হয়ে ওই দিনটাই নিলাম।”

জগন্নাথ বলল, “আমায় যদি কিছু করে?”

“কী করবে! ওর ক্ষমতা কী!…আমি তো থাকব।… তারাপদরাও থাকবে কাছাকাছি। তুমি ভয় পাচ্ছ কেন?”

তারাপদ আলখাল্লা খুলে ফেলল। “স্যার!”

“বলো?”

“চাঁদু বলছিল দু-চারটা হাড় ও সাপ্লাই করতে পারে। হাড় দিয়ে পেটালে যা লাগে।”

“একটা খুলি থাকলে ভাল হত। দরকার নেই।”

“আমাদের আরও একটু লোকবল হলে ভাল হত না?”

“যা আছি এতেই হবে।”

 চা খাওয়া শেষ হল।

জগন্নাথ যেন কী বলব বলব করছিল, বলতে পারছিল না। শেষে অনেক কষ্টে বলল, “আমি কি সত্যি আমার মায়ের গলা শুনতে পাব?”

কিকিরা মাথা নাড়লেন। “না’। ওটা অসম্ভব জগন্নাথ!”

“তবে যে লোকে বলে…।”

“লোকে অনেক কথাই বলে।…তবে কী জানো, অনেক সময় আমাদের মনের ভুল হয়, কানের ভুল হয়। কেউ আমাকে ডাকল না, হঠাৎ মনে হল, আমায় কেউ ডাকছে। দরজায় কড়া নড়ল না, অথচ মনে হল, কেউ যেন কড়া নাড়ছে। এগুলো হয় মনের ভুলে।”

“আমাদের বাড়িতে আমরা মাত্র দুটো ঘর পেয়েছিলাম,” জগন্নাথ বলল, “বারান্দার একপাশে আমাদের রান্নাঘর। কলঘর নিচে। মায়ের ঘরেই মা ঠাকুর পুজো করতেন। আমার মা সকাল-সন্ধে পুজোআচা করতেন। একটা ঠাকুর ঘরও ছিল না আমাদের। আমি সব তন্নতন্ন করে দেখেছি। কোথাও কিছু পাইনি। আপনি বিশ্বাস করুন।”

কিকিরা বললেন, “তোমার কথা অবিশ্বাস করব কেন জগন্নাথ! …আমি দু’-চারটে দোকানেও খোঁজ করেছি, তোমার বাবা যেখানে আসা-যাওয়া করতেন। আমায় তো কেউ মন্দ কথা বলেনি। শুধু একজন, তাকে আমার ভাল লাগেনি।”।

“কে?”

“ত্রিদিবেশবাবু! ওরিয়েন্টাল জুয়েলারি।”

জগন্নাথ অবাক হয়ে বলল, “ত্রিদিবেশবাবু! এ নাম আমি কখনও শুনিনি।”

কিকিরা বললেন, “ভালই করেছ। …যাকগে, আর মাত্র দুটো দিন, তারপর বোঝা যাবে কল্পবৃক্ষ তোমাকে কী দেন।”

.

১০.

কিকিরার ডাক পড়ল আগে।

শুদ্ধানন্দর সেই ভুতুড়ে ঘরে যাবার আগে কিকিরা চোখে-চোখে ইশারা করে গেলেন জগন্নাথকে। জগন্নাথ বুঝতে পারল। কিকিরা যেমন যেমন শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছেন সেইভাবেই সব করতে হবে জগন্নাথকে। চেষ্টা সে করবে, কিন্তু কতটা পারবে কে জানে! ভয়ের কিছু নেই। তারাপদ, চন্দনবাবু, জোয়ারদারসাহেব–সকলেই আশেপাশে আছে। ঝামেলা দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে।

সেই একই ঘর। কিকিরার শুধু মনে হল, আগের দিনের সঙ্গে আজ একটিমাত্র তফাত যেন রয়েছে। শুদ্ধানন্দ যেখানে বসেন, তাঁর সেই তন্ত্রমন্ত্রের আসনে–সেই মঞ্চমতন জায়গার ডান পাশে, ঘরের একেবারে কোণ ঘেঁষে একটা কিছু আছে। কাঠের খোপ মতন। কী আছে বোঝা যাচ্ছে না, তবে মনে হয় পাতলা কোনও পরদা ঝোলানো আছে। অন্ধকারে এতটা দূর থেকে কেমন করেই বা আর বেশি ঠাওর করা যায়!

আগের দিনের মতনই একফোঁটা লাল আলো জ্বলছিল একপাশে। জ্বলতে জ্বলতে নিভেও গেল, আবার জ্বলল, আবার নিভল। তারপর সেই পুজোর ঘণ্টা বাজতে লাগল। লাল আলোটা জ্বলল। শেষে শুদ্ধানন্দ দেখা দিলেন। অবিকল আগের মতনই, মন্ত্র আওড়াতে আওড়াতে–তে ভূতাঃ যে ভূতাঃ ভুবি সংস্থিতাঃ থেকে শুরু করে হ্রীং ক্রোং যং রং লং হৌং হঃ সঃ.ক্লীং রিং হিং পর্যন্ত টানা মন্ত্র।

বসলেন শুদ্ধানন্দ নিজের আসনে। দু পাশের ধুনোর পাত্রে কী যেন ছুঁড়ে দিলেন, দপ করে আগুনের শিখা জ্বলে উঠল। নিভে এল সামান্য পরে। লাল বাতিও আর জ্বলছিল না, তার বদলে অনেকটা তফাতে, আড়ালে রাখা ফিকে বেগুনি আলো, যা প্রায় কালো ছায়া ছড়িয়ে রেখেছে, আশেপাশে জ্বলতে লাগল।

শুদ্ধানন্দ আরও খানিকটা পরে কথা বললেন, “বিভুপদ?”

কিকিরা হাত জোড় করে বসে, ভয়-ভক্তি মেশানো গলায় বললেন, “মহারাজ!”

শুদ্ধানন্দ সামান্য অপেক্ষা করে বললেন, “পুরোপুরি হল না, বিভূপদ। তোমায় আগেই বলেছিলাম, তোমার বাবার আত্মা যে স্তরে আছেন, সেখান থেকে তাঁকে দু’-চারদিনের চেষ্টায় টেনে আনা মুশকিল।”

“হল না?” কিকিরা চশমাটা পালটে নিলেন সাবধানে।

 “তুমি দুঃখ কোরো না।…প্রেতসিদ্ধ কখনও ব্যর্থ হয় না। একাদশ তন্ত্রসাধনায় আমার সিদ্ধি, আমি তোমায় একেবারে হতাশ করব না।”

“সিদ্ধমহারাজ আপনিই আমার একমাত্র ভরসা।”

শুদ্ধানন্দ হাসলেন। প্রায় অট্টহাসি। বললেন, “তোমার ভাইরা উইল জাল করেছে। যে জাল করেছে তার বাম দেহাংশে বড় তিল আছে, হাঁটার সময় তার শরীর একপাশে ঝুঁকে যায়, দক্ষিণ নৈঋত দিকে বাস,…তার বাম শয়ন, ক্ষুধা ভয়ঙ্কর।

কিকিরা অদ্ভুত এক শব্দ করে যেন ফুঁপিয়ে উঠলেন। মহারাজ, আমার মেজোভাই, মায়াপদ। …হাঁ মহারাজ তার অনেক তিল আছে গায়ে, সে বেঁকে-বেঁকে হাঁটে। বাঁ দিকে কাত হয়ে শোয়, রাক্ষসের মতন তার খাওয়া-দাওয়া।”

“খুবই শঠ, চতুর…”

“ঠিকই মহারাজ।”

“তার জন্যে তোমায় ভাবতে হবে না। দুষ্কর্মের প্রতিফল তাকে পেতে হবে। কিন্তু বিভুপদ, আসল উইল কোথায় লুকনো আছে সেটা জানতে হলে যে সময় লাগবে। তোমার পিতৃদেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ না-হওয়া পর্যন্ত…”

“আমি রাজি মহারাজ। দু-দশদিন দেরি হোক, আমার ক্ষতি নেই। আমি আমার কাজ সেরে আবার ফিরে আসব কলকাতায়।”

“খুবই ভাল হয়। এর মধ্যে তোমার জন্যে আমি একটি কবচ করে রাখব। সেকবচের কথা কেউ জানে না, হিঙ্গুলহরিতি কবচ।”

“আপনি যা আজ্ঞা করবেন।”

“ব্যয় একটু বেশি হবে বিভুপদ, আঠারোশো থেকে দু হাজারের মতন।”

“আপনি চিন্তা করবেন না।”

“ঠিক আছে। এক পক্ষ সময় লাগবে।”

“ক্ষতি কিসের মহারাজ!…আপনার জন্য আজ আমি একটা মোস্ত্র এনেছিলাম।”

“মোহর!…আচ্ছা! তুমি যেখানে বসে আছ, তার নিচে রেখে দাও।”

“আপনি নেবেন না?”

“নেব।” শুদ্ধানন্দ একটু হাসলেন, “এখন আমি পবিত্ৰাচারে রয়েছি। সাধনাসনে বসে আছি। আমায় কেউ স্পর্শ করতে পারবে না। কাছে আসাও বারণ।”

“আমি কি তবে যাব?…মোহর রেখে যাই।”

“এসো।”

দু মুহূর্ত পরে কিকিরা বললেন, “যদি অপরাধ না নেন তো একটা কথা বলি?”

“বলো।”

“একটি ছেলেকে দেখলাম। অপেক্ষা করছে।”

“হ্যাঁ, ওর আসার কথা।”

“কিন্তু মহারাজ, ছেলেটি বোধ হয় মৃগী রোগী।”

“মৃগী রোগী!”

“আমার কেমন সন্দেহ হল। ওর চোখ-মুখ কেমন যেন দেখাচ্ছিল। ঠোঁটের পাশে ফেনা-ফেনা ভাব।”

“বলো কী বিভুপদ!”

“আজ্ঞে, ও কেন এসেছে আমি জানি না, কিন্তু ওকে যেমন দেখলাম–এখানে এসে বসলে তো মূর্ছা যাবে।”

শুদ্ধানন্দ কেমন চুপ করে গেলেন।

কিকিরা বললেন, “ওকে বরং আপনি ফেরত পাঠিয়ে দিন আজ। এখানে এসে বসে একটা কিছু যদি হয় আপনি কী করবেন?”

চুপ করে থেকে শুদ্ধানন্দ বললেন, “তাই তো বিভুপদ! ফেরত পাঠালে আবার কবে আসবে …ওর আবার জরুরি দরকার।”

“আপনি যদি আজ্ঞা করেন আমি একটা কাজ করতে পারি।”

“কী?”

“আমি যদি ওকে সঙ্গে নিয়ে আসি! ওর পাশে থাকি। তাতে একটু সাহস পাবে। তা ছাড়া মৃগীদের আমি সামলাতে পারি। আমার পরিবারের ওই রোগটি আছে।”

শুদ্ধানন্দ কিছু ভাবলেন। বললেন, “বেশ, নিয়ে এসো।

কিকিরা বললেন, “আজ্ঞে, তাতে কোনো অসুবিধে যদি হয়…”

“না, অসুবিধে কিসের! সাবধানের মার নেই।”

 কিকিরা উঠলেন।

.

জগন্নাথকে সঙ্গে নিয়ে কিকিরা এসে নিজেদের জায়গায় বসার সময় দেখা গেল, শুদ্ধানন্দ মন্ত্র আওড়াচ্ছেন।

মন্ত্র আওড়ানোর পর্বটা দীর্ঘ হল না এই যা রক্ষে।

 ক’ মুহূর্ত পরে শুদ্ধানন্দ বললেন, “কে? জগন্নাথ এসেছে?”

জগন্নাথ ঘরের চেহারা আর ভুতুড়ে অন্ধকার দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। সাড়া দিতে পারল না।

শুদ্ধানন্দর মাথার পেছন দিকে ত্রিশুলের মাথায় গাঁথা মরা কাকের চারপাশে সেই জোনাকির মতন আলো জ্বলল, নিভল। তারপর ওই আলোয় বিন্দুই অন্যদিকের ত্রিশুলের ওপর রাখা মাথার খুলির চোখের কোটরে জ্বলে উঠল বার কয়েক। নিভে গেল।

কিকিরা জগন্নাথের হাত ধরে চাপ দিলেন। অর্থাৎ বোঝাতে চাইলেন-”ভয়। পেয়োনা, কথা বলো।

“জগন্নাথ না? কথা বলছ না কেন?” শুদ্ধানন্দর গলা। গম্ভীর।

“আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি জগন্নাথ।“

“অতুল দত্তর ছেলে?”

“হ্যাঁ।”

“মায়ের নাম সুরমা দত্ত।”

“আজ্ঞে।”

“এতদিন আসোনি কেন?” জগন্নাথ জবাব দিল না।

“তোমার মা যে কতবার আমার ষঃ চেতনায় এসে দেখা করে গেলেন! মায়ের জন্যে তোমার কষ্ট হয় না?”

“খুব হয়।”

“তা হলে আসোনি কেন?”

জগন্নাথ কথা বলল না।

“তোমার মা এই নশ্বর জগৎ ছেড়ে চলে গেছেন। তাঁর কায়া-শরীর আর নেই। কিন্তু উনি তো মা জননী। আমরা মা বলি কাকে? যিনি আমাদের জন্ম দেন তিনিই শুধু মা নন, যিনি মায়া, মমতা, প্রাণ দিয়ে আমাদের লালন করেন, পালন করেন, আমাদের দুঃখে-বিপদে ঘিরে রাখেন, তিনিই মা। মায়ের বড় কেউ নেই জগন্নাথ। সংসারে মা ভিন্ন আর কেউ উপাস্য নন।” শুদ্ধানন্দ একটু থামলেন। তাঁর গলার স্বরটি ভরাট গম্ভীর শোনাচ্ছিল। ক’ মুহূর্ত পরে বললেন, “তুমি তোমার মাকে ভুলে গেছ, তিনি তো ভোলেননি।”

“মাকে আমি ভুলিনি,” জগন্নাথ বলল।

 “তা হলে তুমি আছিলে না কেন?”

“আজ্ঞে, আমার নানান দুশ্চিন্তা, তার ওপর ঠিক বুঝতে পারছিলাম না–মায়ের সঙ্গে আপনার…”

শুদ্ধানন্দ হেসে উঠলেন। জোরে। হাসিটা গা ছমছমে।

“তোমার মাকে যদি এখানে দেখতে পাও, তাঁর গলা শুনতে পাও–কেমন লাগবে জগন্নাথ?”

জগন্নাথের গলা কাঠ, দম বন্ধ হয়ে আসছে। বিহ্বল। ভয়ে কাঁপছিল।

 কিকিরা জগন্নাথের হাঁটুর কাছটায় খোঁচা মারলেন। নিশ্বাসের সুরে বললেন, “বলো, হ্যাঁ দেখতে চাই।”

জগন্নাথ চুপ।

 “দেখতে চাও না? শুদ্ধানন্দ বললেন, “মায়ের সূক্ষ্ম আত্মার রূপটি তুমি দেখতে চাও না? তাঁর গলা আর শুনতে চাও না?”

জগন্নাথ যেন হঠাৎ কেঁদে ফেলল, “চাই।”

“বেশ। আমি তোমায় দেখাব। তবে আত্মা রক্তমাংসের বস্তু নয়, তার স্পষ্ট। অবয়ব নেই। ছায়ার চেয়েও সূক্ষ্ম, অ-স্পর্শ যোগ্য। তুমি শুধু মাকে দেখবে। তাঁর কথাও শুনবে। মানুষ আর আত্মালোকের মধ্যে যে যোজন ব্যবধান, তাতে আত্মার আসা-যাওয়ার বড় কষ্ট হয়। সব সময় তাঁরা আসেন না। তুমি তাঁকে ধ্যান করো–তাঁর কথা একমনে ভাবো।” বলে শুদ্ধানন্দ মন্ত্রপাঠ শুরু করে দিলেন। ফ্রি হোঃ হ, ভূত প্রেত ইমা ক্রোং যং যে,ভূতাঃ ভবি..”

শুদ্ধানন্দর মন্ত্রপাঠের মাঝামাঝি সময় থেকে ঘর ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে এল। যে ফিকে বেগুনি রঙের বাতিটা তফাতে জ্বলছিল সেই বাতি নিভে গেল ধীরে ধীরে। ঘরের ধোঁয়া আরও বুঝি ঘন হল।

কিছুক্ষণ পরে শুদ্ধানন্দ নীরব। ঘরে কোনো শব্দ নেই। অদ্ভুত স্তব্ধতা। হঠাৎ দেখা গেল, সরু, খুব সরু কিছু একটা অন্ধকারের মধ্যে শুদ্ধানন্দের সামনে দিয়ে ছুটে গেল। একবার, দুবার, তিনবার। ঘড়ির কাঁটার মতন সরু লম্বা এই জিনিসটা বার-তিনেক ছুটে যাবার পর শেষে এক জায়গায় গিয়ে স্থির হল। পরে মিলিয়ে গেল। শুদ্ধানন্দর গলা শোনা গেল।

“আপনি কি এসেছেন?”

শব্দ হল খটখট।

“আপনার অনেক কষ্ট। মার্জনা করবেন।…আপনি আপনার ছেলে জগন্নাথকে কিছু বলতে চেয়েছিলেন। সে এসেছে। আপনি কি তাকে দয়া করে দেখা দেবেন একবার?”

প্রথমে কোনো শব্দ নেই। তারপর খটখট শব্দ হল।

শুদ্ধানন্দ বললেন, “জগন্নাথ, তোমার মা এসেছেন। দেখা দেবেন। মাত্র কয়েক মুহূর্তই তুমি তাঁকে দেখবে। দূর থেকে। তাঁর কথা শুনবে। তোমার মাকে ডাকো, তাঁকে প্রণাম জানাও।”

ধীরে-ধীরে কখন–কিকিরার বসার জায়গার একেবারে ডান পাশে ঘড়ির কাঁটার মতন সরু একটু আলো যেখানে গিয়ে থেমে গিয়েছিল সেখানে অতি ক্ষীণ আলো যেন দেখা গেল। ক্রমশ একটি মুখের আদল ভেসে উঠতে লাগল। অতি অস্পষ্ট। সাদাটে। পুরো শরীর নয়, বুক পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল।

কিকিরা সবই লক্ষ করছিলেন। তাঁর অনুমান মোটামুটি ঠিক। শুদ্ধানন্দর বসার উঁচু জায়গাটির হাত ছয়-সাত তফাতে বাক্স ধরনের একটা কী রয়েছে। লম্বাভাবে দাঁড় করানো। হয়ত কাঠের ওয়ার্ডরোব। বোধ হয় পেছন দিকে কিছু নেই, শুধু মাথার দিক, পায়ের দিক, দু’পাশে তক্তা আছে। সামনের দিকে কালো মিহি প্রদা। পরদার পেছনে সাদা এক মুখ। কালের আড়ালে মুখটি সাদা নয় খানিকটা সাদাটে দেখাচ্ছে।

শুদ্ধানন্দ বললেন, “জগন্নাথ, তোমার মা এসেছেন।”

 জগন্নাথ ফুঁপিয়ে উঠল।

“কথা বলো! ওঁকে যেমন দেখছ, এইভাবেই তাঁকে দেখবে। সূক্ষ্ম আত্মার পক্ষে কায়ারূপ ধারণ সম্ভব নয়। কথা বলো?”

জগন্নাথ ফোঁপাতে-ফোঁপাতে বলল, “মা!”

সঙ্গে-সঙ্গে কোনো সাড়া নেই। সামান্য পরে ভাঙা অস্পষ্ট গলায় সাড়া এল।“জগু! কেমন আছ তুমি?”

“মা, আমরা বড় কষ্টে আছি।”

“বোন ভাল আছে?”

“আছে। তোমার জন্যে আমরা…”

“দুঃখ কোরো না, বাবা! মানুষের আয়ু! কে বলতে পারে কার কখন..”

“মা?”

“আমি এখানে বেশিক্ষণ থাকতে পারব না। বড় কষ্ট হচ্ছে। …শোনো, বাড়িতে একটা চাবি আছে। লোহার সেফের চাবি। আর একটা ছেঁড়া কাগজ। এই দুটো নিয়ে তুমি মথুরবাবুর সঙ্গে দেখা করবে। তোমার বাবা যা রেখে গেছেন–বোনের বিয়ে দিতে পারবে রাজকন্যের মতন। তোমারও থাকবে বাবা…”

“কোথায় আছে মা চাবি?”

“ঘরেই আছে।”

মাকে আর দেখতে পেল না জগন্নাথ। আবার সেই ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিছুই চোখে পড়ে না।

শুদ্ধানন্দর গলা শোনা গেল।“তোমার মা চলে গিয়েছেন জগন্নাথ!”

“আর আসবেন না?”

“না।”

“আমি কী করব?”

“চাবি আর ছেঁড়া কাগজটা খুঁজবে। খুঁজে নিয়ে ওঁর কাছে যাবে–যাঁর কথা তোমার মা বললেন?”

“তাঁকে আমি চিনি না।”

“খুঁজে নিও। পেয়ে যাবে। ..এখন যাও, পরে এসো। আমার এই শরীর আর সহ্য করতে পারছে না। ওঁদের ডেকে আনতে আমার বড় কষ্ট হয়। তোমরা যাও।“

কিকিরা ঠেলা দিলেন জগন্নাথকে।

.

১১.

মথুরবাবুকে খুঁজে বের করতে দিন-দুই সময় গেল। উনি থাকেন গিরিবাবু লেনে। বাইরে থেকে বাড়ির চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই ভেতরের ছাঁদ-ছিরি কেমন। ঘরে ঢুকেও বোঝা যায় না, তবে কথাবাতার থেকে, তাঁর। খাস বসার ঘরের দু-তিনটে সেফের বহর দেখে আন্দাজ করা যায়–মানুষটি লেনদেন ভালই করেন।

জগন্নাথ একা আসেনি। সঙ্গে কিকিরা আর তারাপদ। চন্দন বাড়ির ভেতরে ঢোকেনি। বাইরে আছে।

মথুরবাবুর বয়েস বছর পঞ্চান্ন। চেহারার বাঁধুনি আছে। গায়ের রং তামাটে। মাথার চুল ছোট-ছোট। চোখ দুটি ওপরে যত শান্ত মনে হয়, তেমন নয়। নজর করলে বোঝা যায় উনি শুধু চতুর নন, নিষ্ঠুর।

জগন্নাথ নিজের পরিচয় দিল।

মথুরবাবুর খাস বসার ঘরে চেয়ার নেই, ফরাস পাতা। এক ফরাসে তিনি বসেন। অন্যরা বসে আলাদা ফরাসে।

মথুরবাবু সিগারেট খেতে-খেতে বললেন, “ও! তুমি অতুলদার ছেলে! কোথায় ছিলে এতদিন?”

জগন্নাথ বলল, “আপনার কথা আমি জানতাম না।”

“তোমার মা জানতেন।”

“মা নেই।”

“জানি।…তোমার সঙ্গে এঁরা কে?”

জগন্নাথ কিকিরাকে দেখিয়ে বলল, “ইনি আমার উকিল!” বলে তারাপদকে দেখাল। “আমার বন্ধু!”

মথুরবাবু কিকিরাকে দেখলেন। “উকিল কেন?”

“আমি ওঁকে সঙ্গে নিয়ে এসেছি।”

“কেন?”

জগন্নাথ যেন হাসল একটু। কিকিরা যেমনটি শিখিয়ে দিয়েছিল সেইভাবেই কথা বলছিল সে। কিকিরা না থাকলে জগন্নাথ আজ এখানে আসতে পারত না।

“আপনার সঙ্গে লেখাপড়া করতে হবে।”

“কিসের?”

“আমি সেই চাবি আর কাগজ নিয়ে এসেছি।”

মথুরবাবু যেন সজাগ হলেন, নড়েচড়ে বসলেন। “কোথায় পেলে?”

“মায়ের বাঁধানো লক্ষ্মীর পটের পেছন দিকে।“

“সে কী! এতদিন..”

“লক্ষ্মীর বাঁধানো ছবিটার পেছন দিকটা অ্যালুমিনিয়াম শিট দিয়ে ঢাকা ছিল। ছবির পেছনে কাগজ থাকে, বোর্ড থাকে। পোকা ধরার ভয়ে অনেকে টিন দিয়ে মুড়ে নেয়। মায়ের এই লক্ষ্মীর পট আমাদের তিন পুরুষের। মা পটটিকে যত্ন করে রাখতেন। পুজো করতেন রোজ।”

“আচ্ছা, তা হলে তোমার মা লক্ষ্মীর পটের মধ্যে–মানে বাঁধানো ছবির মধ্যে চাবি রেখেছিলেন। অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে ছবির পেছনটা ঢাকা রেখেছিলেন।…তোমার মায়ের বুদ্ধি তো ভীষণ।…যেভাবে রেখেছিলেন চাবিটাবি তাতে কার বাপের সাধ্যি ওর খোঁজ পাবে।”

জগন্নাথ জানে, লক্ষ্মীর পটের পেছনে চাবি আর কাগজের টুকরো খুঁজে পাওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। ভাগ্যিস কিকিরা সেদিন বাড়িতে গিয়ে তন্নতন্ন করে সব দেখেছিলেন–তাই না পাওয়া গেল।

 “এই চাবিটা…”

“আমার এখানে একটা সিন্দুক আছে। সেকেলে সাবেকি আমলের সে। তার তিনটে ভাগ। তিন দরজা। শেষ ডালাটার দুটো আলাদা চাবি। একটা চাবিতে ডালা খোলা যাবে না। ডাবল লক সিস্টেম। একে বলত, পারসন্ কোম্পানির দুশো বারো নম্বর আয়রন সেফ। তোমার বাবা সেখানে কিছু জিনিস জমা রেখে গিয়েছেন। আমি একটা চাবি রেখেছি, অন্যটা তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন। …চাবিটা তুমি এনেছ?”

“হ্যাঁ।“

“কিন্তু একটা কথা কি তুমি জানো? ওর মধ্যে যা আছে তার অর্ধেক তোমার, বাকি আমার?”

“জানি।”

“আরও একটা কথা আছে হে! আমরা দুজনে একটা কাগজে বখরার শর্ত লিখে নিজেদের নাম সই করেছিলাম। সেই কাগজের অর্ধেকটা ছিঁড়ে আমার কাছে রেখেছি। বাকিটা তোমার বাবার কাছে ছিল। সেই কাগজটাও যে চাই।”

কিকিরা এবার কথা বললেন, “কাগজটাও আপনি পাবেন। কিন্তু একটা কথা আপনি বলুন? জগন্নাথের বাবা যেদিন চাবি আর কাগজ নিয়ে ফিরছিলেন সেদিনই কি তিনি মোটর সাইকেলের ধাক্কা খাননি?”

মথুরবাবু নিজের কপাল দেখালেন। “বরাত! একেই বরাত বলে উকিলবাবু! আহা, বেচারি অতুলদা…কী বলব…এমন করে তিনি চলে যাবেন…।”

“তিনি গেছেন? না, তাঁকে আপনি যাওয়াবার চেষ্টা করেছিলেন?”

মথুরবাবু চমকে উঠলেন, “এ কী কথা বলছেন আপনি!”।

“উনি চলে যাবার পর আপনি লোক লাগিয়ে সেই দিনই ওঁর কাছ থেকে চাবি আর কাগজটা হাতিয়ে নেবার চেষ্টা করেছিলেন। আপনি চোর, ডাকাত, খুনি…”।

মথুরবাবু রাগের মাথায় সোজা হয়ে বসলেন। তাঁর চোখ জ্বলছিল যেন। বাঁধানো দাঁত আলগা হয়ে উঠে যাচ্ছিল। “আপনাকে আমি চাবকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে পারি, জানেন।”

“আপনাকে আমি জেলে ভরতে পারি! চোর, জোচ্চোর আপনি?”

“আমি চোর, না, জগন্নাথের বাবা চোর! চোরাই মাল বোঝেন, স্মাগণ্ড, মাল। সেই মালহীরে, চুনি, নীলা আমার জিম্মায় রেখে যে চলে যায় তাকে আপনি ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির বলবেন! লাখ দুই আড়াই টাকার জিনিস। আজ তার বাজার দর…”

জগন্নাথ উঠে দাঁড়াল। “আমার বাবা চুরি করেছিলেন। পাপের ফল তিনি ভোগ করেছেন। আপনি কিন্তু বেঁচে আছেন?” বলতে বলতে জগন্নাথ পকেট থেকে একটা বড় চাবি বার করল। করে দেখাল চাবিটা। বলল, “নিন, আপনার চাবি।” বলে চাবিটা মথুরবাবুর দিকে ছুঁড়ে দিল।

মথুরবাবুর কপালে এসে লাগল চাবিটা।

“এই কাগজটা কিন্তু আপনি পাবেন না। আমি ছিঁড়ে ফেললাম।” জগন্নাথ পুরনো ময়লা ছেঁড়া একটা কাগজ কুচিকুচি করে ছিঁড়ে ফেলল।

মথুরবাবু চাবি কুড়িয়ে নিলেন।

কিকিরাও উঠে দাঁড়ালেন। তারাপদ উঠে পড়ল।

কিকিরা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “চলি মথুরবাবু। নাকি শুদ্ধানন্দ প্রেতসিদ্ধর মালিক মহারাজ!”

মথুরবাবু আঁতকে উঠলেন।

কিকিরা বললেন, “আপনি পাকা লোক। অনেকে মন্দির-চন্দির বসিয়ে ভাল রোজগারের পথ করে নেয়। আপনি বন্ধক তেজারতি চুরি জোচ্চুরির কারবারের সঙ্গে আর-একটি ভাল কারবার ফেঁদেছেন। কিন্তু আপনার চেলাটি–প্রেসিদ্ধ একেবারে নবিশ। কিস্যু জানে না।”

“জা-জা…জানে না?”

“আজ্ঞে না। ওর খেলায় অনেক খুঁত। গন্ধকের গুঁড়ো ছড়িয়ে কি বোকা বানানো যায়! আপনার নাক থাকলে গন্ধ পাবেন। আর ওই মরা কাক, মড়ার খুলির মাথায় আলোর পিটপিট করে জ্বলে ওঠা মশাই, বাচ্চাদের যে জ্ঞানের আলো’ খেলনা পাওয়া যায়–এ তো তাই, ব্যাটারি আর তার নিয়ে বসে খেলা। দেখানো! বলবেন। আত্মা এলে যে আলোর কাঁটা ছোটে–সেটা কী? ঘড়িতে রেডিয়াম দেখেননি? ছি ছি–এগুলো কি খেলা! নবিশ একেবারে!…আরও একটা কথা মথুরামোহনমশাই! জগন্নাথের মা বলে যে জিনিসটিকে প্রেসিদ্ধ হাজির করেছিলেন, তার জন্যে দুটো বেশি পয়সা খরচ করলে পারতেন। কারিগর ভাল নয়; মামুলি ডামিও করতে পারে না। নাইলনের পরদা ফেলে কত আর সামলানো যাবে। টেপ-রেকর্ডটাও খারাপ। জগন্নাথের মায়ের গলা শুনেই বোঝা যাচ্ছিল বাজে টেপ…।”

মথুরবাবু উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। ভয়ে কাঠ। ঘামছিলেন। “চলি, প্রেতসিদ্ধ বাবামশাই। একটা কথা বলে যাই। জোয়ারদারসাহেব পুলিশ নিয়ে আপনাদের আখড়ায় গিয়েছেন। নিচে আমাদের সঙ্গে এসেছেন এক অফিসার, লালবাজার থেকে। তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। আমাদের কোনো ক্ষতি হলে…”

মথুরবাবুর গলা উঠছিল না। “আপনি কে?”

“কিকিরা দি ম্যাজিশিয়ান। ওরফে বিভুপদ হাঁস।”

“আপনি এত জানলেন কেমন করে?”

“সর্দি, রুমাল, ইনফ্রা রেড চশমা। একসময় স্নাইপারস্কোপিক বাইনোকুলার বলা হত যাকে, তারই একটা লেটেস্ট মডেল। আমি ওই মজার চশমাটি পরে নিতাম ঘরে বসে। প্রেতসিদ্ধর চেলারা ভাবত, আমার সর্দি হয়েছে বলে নাকে রুমাল চাপা দিচ্ছি। এ-হল আমাদের রুমালের খেলা! চশমা বদল করে নিতাম ঘরে ঢুকে। অন্ধকারে আপনার প্রেসিদ্ধর বাহাদুরি প্রায় সবই দেখতে পেতাম।..যাক, চলি। চলো হে জগন্নাথ, চলো তারাপদ।“

ওরা উঠে দাঁড়িয়েছিল।

মথুরবাবু হতভম্ব হয়ে বললেন, “এই চাবিটা..?”

জগন্নাথ বলল, “ওটা মামুলি চাবি। নকল। আসলটা গঙ্গার জলে ফেলে দেব।”

মথুরবাবু মাথার চুল ছিঁড়ে পাগলের মতন দাপাতে লাগলেন।

কিকিরা হাসতে-হাসতে বললেন, “একটু মাথা ঠাণ্ডা করে নিন। পুলিশ এলে দুটো কথা তো বলতেই হবে।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *