রাজবাড়ির ছোরা

রাজবাড়ির ছোরা — কিকিরা সমগ্র ১ — বিমল কর

০১.

কলকাতায় তখনো শীত ফুরোয়নি। মাঘের শেষটেষ। পাড়ায়-পাড়ায় সরস্বতী পুজোর তোড়জোড় চলছে। আর মাত্র দিন দুই বাকি। এমন সময় আকাশ ঘুটঘুটে হয়ে আচমকা এক ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল! এমন বৃষ্টি যেন শ্রাবণ-ভাদ্রতেই দেখা যায়। এক রাত্রের ঝড়বৃষ্টিতেই কলকাতার চেহারা হল ভেজা কাকের মতন। সরস্বতী পুজোর তোড়জোড় জলে ভেসে যায় আর কি! ছেলের দল আকাশের এই কাণ্ড দেখে মহাখাপ্পা। কাণ্ড দেখেছ, বৃষ্টি আসার আর সময় হল না! বুড়োরা অবশ্য খনার বচন আউড়ে বলতে লাগল যদি বর্ষে মাঘের শেষ, ধন্যি রাজার পুণ্যি দেশ।

পুজোর ঠিক আগের দিন দুপুর থেকে আকাশ খানিকটা নরম হল। মেঘ আর তত ঘন থাকল না, হালকা হল, ফেটে গিয়ে টুকরো টুকরো হয়ে বাতাসে উড়ে যেতে লাগল। ঝিরঝির এক-আধ পশলা বৃষ্টি আর হাওয়া থাকল। মনে হল, কাল সকালে হয়ত রোদ উঠবে।

বিকেলের দিকে টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যে চন্দনরা এল কিকিরার বাড়ি। কিকিরার সঙ্গে চন্দনদের এখন বেশ ভাব। বয়েসে কিকিরা অনেকটাই বড়, নয়ত তিনি হয়ত গলায় গলায় বন্ধু হয়ে যেতেন তারাপদ আর চন্দনের। ঠিক সেরকম বন্ধু তো কিকিরা হতে পারেন না, তবু সৰ্কটা বন্ধুর মতনই হয়ে গিয়েছিল। কিকিরা তারাপদদের স্নেহ করতেন, ভালবাসতেন। আর তারাপদরাও কিকিরাকে যথেষ্ট মান্য করত, পছন্দ করত; রবিবার দিনটা তারা কিকিরার জন্যে তুলে রেখেছিল। বিকেল হলেই দুই বন্ধু কিকিরার বাড়ি এসে হাজির হত, গল্পগুজব, হাসি-তামাশা করে, খেয়েদেয়ে রাত্রে যে যার মতন ফিরে যেত।

দিনটা ছিল রবিবার। চন্দন আর তারাপদ কিকিরার বাড়ি এসে দেখে এক ভদ্রলোক বেশ দামি ছাতা আর কালচে রঙের নাইলনের বর্ষাতি গায়ে চাপিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। ভদ্রলোকের চোখমুখ দেখলেই মনে হয়, মানুষটি বেশ বনেদি। পুরোপুরি বাঙালি চেহারাও যেন নয়, চোখের মণি কটা, ভুরুর রঙও লালচে, লম্বা নাক, থুতনির তলায় ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি।

ভদ্রলোক যাবার সময় চন্দনদের একবার ভাল করে দেখে নিলেন।

উনি চলে গেলে দরজা বন্ধ করে কিকিরা তারাপদদের দিকে তাকালেন। হেসে বললেন, “এসো, এসো–আমি ভাবছিলাম আজ বুঝি তোমরা আর আসবে না।”

চন্দন বলল, “আসব না কেন, আজ আপনি আমাদের আফগান খিচুড়ি খাওয়াবেন বলেছিলেন।”

কিকিরা বললেন, “আফগানি খিচুড়ি, মুলতানি আলুর দম।..বৃষ্টি দেখে আমার মনে হচ্ছিল–তোমরা বোধ হয় আফগানি ভুলে গেছ।”

চন্দন বলল, “খাওয়ার কথা আমি ভুলি না।”

কিকিরা বললেন, “ভেরি গুড। যাও ঘরে গিয়ে বসো, আমি বগলাকে চায়ের জল চাপাতে বলি।”

পায়ের জুতো জলে-কাদায় কদাকার হয়ে গেছে। ছাতা রেখে, জুতো খুলে তারাপদ বাথরুম থেকে পা-হাত ধুয়ে এল। চন্দনও। এই বাড়িতে কোথাও তাদের কোনো সঙ্কোচ নেই। যেন সবই নিজের।

ঘরে এসে বসল দুজনে। বাতি জ্বলছে। যে-রকম মেঘলা দিন, বাতি বিকেল থেকেই জ্বালিয়ে রাখতে হয়। চন্দন কোণের দিকে চেয়ারে বসল। এই চেয়ারটা তার খুব পছন্দ। সেকেলে আর্মচেয়ার। বেতের বুনুনির ওপর কিকিরা পাতলা গদি বিছিয়ে রেখেছেন। হাত পা ছড়িয়ে, গা ডুবিয়ে দিব্যি শোয়া যায়। চন্দন বেশ আরাম করে বসে তারাপদকে ডেকে সিগারেট দিল, নিজেও ধরাল। কিকিরাকে যখন চিনত না চন্দনরা, এন্তার সিগারেট খেয়েছে। চেনাজানা হয়ে যাবার পর ওঁর সামনে সিগারেট খেতে লজ্জাই করত কিন্তু কিকিরা ঢালাও হুকুম দিয়ে দিয়েছেন, বলেছেন–”নো লজ্জা-শরম, খাও। তোমরা তো সাবালক ছেলে।”

চন্দন আরাম করে সিগারেট টানতে টানতে ঘরের চারপাশে তাকাতে লাগল। কিকিরার মতন এই ঘরটাও বড় বিচিত্র। পাড়াটাও কিছু কম বিচিত্র নাকি। ওয়েলিংটন থেকে খানিকটা এগিয়ে এক গলির মধ্যে বাড়ি। পার্ক সাকাসের ট্রামে উঠলেই সুবিধে। কিংবা পঁচিশ নম্বর বালিগঞ্জের ট্রামে উঠতে হয়। নানা জাতের মানুষ থাকে এপাশে। লোকে যাকে বলে অ্যাংলো পাড়া, সেই ধরনের। তবে শুধু অ্যাংলোই থাকে না, চীনে বেহারী বোম্বাইঅলাও থাকে। কিকিরার বাড়ির নিচের তলায় মুসলমান করিগররা দরজিগিরি করে, কেউ কেউ টুপি বানায়। পুরনো আমলের বাড়ি। বোধ হয় সাহেব-সুবোতেই তৈরি করেছিল। কাঠের সিঁড়ি মস্ত উঁচু ছাদ, কড়িবরগার দিকে তাকালে ভয়। হয়। কিকিরার এই দোতলার ঘরটি বেশ বড়। ঘরের গা লাগিয়ে প্যাসেজ। তারই একদিকে রান্নাবান্নার ব্যবস্থা। কাজ চলার মতন বাথরুম। এক চিলতে পার্টিশানকরা ঘরে থাকে বগলা, কিকিরার সব্যসাচী কাজের লোক।

চন্দনরা যতবার কিকিরার ঘরে এসেছে, প্রায় বারেতে দেখেছে একটা-না-একটা নতুন জিনিস আমদানি করেছেন কিকিরা। এমনিতেই ঘরটা মিউজিয়ামের মতন, হরেক রকম পুরনো জিনিসে বোঝাই, খাট আলমারি দেরাজ বলে নয়, বড় বড় কাঠের বাক্স, যাত্রাদলের রাজার তরোয়াল, ফিতে-জড়ানো ধনুক, পুরনো মোমদান, পাদরি টুপি, কালো আলখাল্লা, চোঙঅলা সেকেলে গ্রামোফোন, কাঠের পুতুল, রবারের এটা সেটা, অ্যালুমিনিয়ামের এক যন্ত্র, ধুলোয় ভরা বই–আরও কত কী। কাচের মস্ত বড় একটা বল-ও রয়েছে, ওটা নাকি জাদুকরের চোখ।

চন্দন বলল, “তারা, কিকিরা নতুন কী আমদানি করেছেন বল তো?”

তারাপদ একটা বাঁধানো বইয়ের মতন কিছু নাড়াচাড়া করছিল, বলল “কী জানি! চাঁদু, এই জিনিসটা কী রে?”

চন্দন তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল। বই বলেই মনে হল তার। চামড়ায় বাঁধানো। তারাপদ মামুলি বই চিনতে পারছে না। মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি। চন্দন বলল, “কেন, বই।”

মাথা নেড়ে তারাপদ বলল, “বই নয়।”

“মানে?”

“বইয়ের মতনই অবিকল দেখতে। বই নয়। বাক্স।”

“বাক্স? কই দেখি।”

তারাপদ এগিয়ে এসে জিনিসটা দিল। হাতে নিয়ে দেখতে লাগল চন্দন। সামান্য ভারী। একেবারে বাঁধানো বইয়ের মতন দেখতে। আগেকার দিনে মরক্কো-চামড়ায় যেরকম বই বাঁধানো হত, বিশেষ করে বিদেশি দামি বইটই, সেই রকম। বই হলে পাতা থাকত। এর চারদিকই বন্ধ। ঘন কালো রঙের চামড়া দিয়ে মোড়া। আঙুল দিয়ে টোকা মেরে বোঝার উপায় নেই, কার্ডবোর্ড না পাতলা টিনের ওপর বোর্ড দিয়ে আগাগোড়া বাক্সটা তৈরি করা হয়েছে। কোথাও কোনো চাবির গর্তও চোখে পড়ল না।

চন্দন বাক্সটা নাড়াচাড়া করছে, এমন সময় কিকিরা ঘরে এলেন।

বাক্সটা হাতে তুলে নিয়ে দেখাল চন্দন।”এটা কি আপনার লেটেস্ট আমদানি?”

কিকিরার নিজের একটি বসার জায়গা আছে। নিচু সোফার মতন দেখতে অনেকটা, তার চারধারে চৌকো, গোল, লম্বা নানা ধরনের কুশন। রঙগুলোও বিচিত্র; লাল, কালো, সোনালি ধরনের। মাথার দিকে একটা বাতি। গোল শেড, শেডের গায়ে নকশা।

কিকিরা বসলেন। হেসে বললেন, “ঘণ্টাখানেক আগে হাতে পেয়েছি।”

“মনে হয়, চোরাবাজার, না হয় চিতপুর, কিংবা কোথাও পুরনো জিনিসের নীলাম থেকে কিনে এনেছেন।”

কিকিরা মাথা নাড়তে লাগলেন। তাঁর পোশাক বলতে একটা ঢলঢলে পাজামা, পায়ে চটি, গায়ে আলখাল্লা। আলখাল্লার বাহার দেখার মতন, যেন কম করেও দশ বারো রকমের কাপড়ের ছাঁট সেলাই করে কিকিরার এই বিচিত্র আলখাল্লা তৈরি হয়েছে।

তারাপদ নিজের চেয়ারে ফিরে গিয়ে বসেছে ততক্ষণে।

কিকিরা যেন খানিকটা মজা করার জন্যে প্রথমে কিছু বললেন না–শুধুই মাথা নাড়তে লাগলেন। শেষে মজার গলায় বললেন, “নো থিফমার্কেট, নো চিতপুর। সিটিং সিটিং রিসিভিং।”

চন্দন হেসে ফেলল। বলল, “ইংলিশ রাখুন। এটা কী জিনিস? বাক্স?”

কিকিরা চন্দনের দিকে হাত বাড়ালেন। বললেন, “স্যান্ডাল উড, ওই পদার্থটি নিয়ে আমার কাছে এসো। ম্যাজিক দেখাব।” চন্দনকে মাঝে মাঝে কিকিরা ঠাট্টা করে স্যান্ডাল উড বলে ডাকেন।

উঠে গেল চন্দন। কিকিরা তারাপদকে ডাকলেন, “ওই টিপয়টা নিয়ে এসো তো।”

কিকিরার সামনে টিপয় এনে রাখল তারাপদ। মাথার দিকের বাতি জ্বালিয়ে দিলেন কিকিরা। বাক্সটা হাতে নিয়ে একবার ভাল করে দেখে নিলেন। তারপর বললেন, “তোমরা চৌকোনা টিফিন বাক্স কিংবা পানের কৌটা দেখোনি? এটাও সেই রকম। তবে এর কায়দাকানুন খানিকটা আলাদা, একে জুয়েলবক্স বলতে পারো।” কিকিরা কথা বলতে বলতে বাক্সর সরু দিকের একটা উঁচুমতন জায়গা বুড়ো আঙুল টিপতে লাগলেন।

তারাপদরা দেখতে লাগল। যদি এটা কোনো বাঁধানো বই হত তা হলে বলা যেত-বইয়ের যেটা পুটের দিক–যেখানে পাতাগুলো সেলাই করা হয়–সেই দিকে শিরতোলা বা দাঁড়া-ওঠানো একটা জায়গায় কিকিরা চাপ দিচ্ছিলেন। বার কয়েক চাপ দেবার পর তলার দিকে পুটবরাবর পাতলা কিছু বেরিয়ে এল সামান্য। কিকিরা তার আলখাল্লার পকেট থেকে হাতঘড়ির চাবির মতন একটা চাবি বার করলেন। বললেন, “এই দেখো চাবি।”

হাতে একটা ম্যাগনিফায়িং গ্লাস থাকলে হয়ত আলপিনের মাথার সাইজের ফুটোটা দেখা যেত। আশ্চর্য, বাক্সর ডালা খুলে গেল। যেন স্প্রিং দেওয়া ছিল কোথাও ওপরের ডালা লাফিয়ে উঠল একটু।

চন্দন আর তারাপদ অবাক।

কিকিরা যেন আড়চোখে চন্দনদের মুখের ভাবটা দেখে নিলেন। হাসলেন মিটমিটে চোখে। তারপর ওপরের ডালাটা পুরোপুরি তুলে ধরলেন।

ঘাড় মুখ সরিয়ে নিয়েছিলেন কিকিরা। চন্দন আর তারাপদ প্রথমটায় যেন কিছুই বুঝতে পারল না। কী ওটা? মেয়েদের গয়নার মতন মনে হচ্ছে। চকচক করছে। কত রকমের পাথর! দুজনেই ঝুঁকে পড়ল। বাক্স থেকে বিঘতখানেক তফাতে মাথা রেখে হাঁ করে দেখতে লাগল। ভেলকি না ভোজবাজি? চোখের পলক আর পড়ে না।

ধীরে ধীরে জিনিসটা পরিষ্কার হয়ে আসছিল চোখে, মাথায় ভাসা-ভাসা একটা ধারণা জাগছিল। না, মেয়েদের গয়নাগাটি নয়। অন্য কিছু। কিন্তু কী?

তারাপদ বলল, “কী এটা?” কিকিরা বললেন, “একে বলে কিডনি ড্যাগার।”

“ড্যাগার? মানে ছোরা?”

“হ্যাঁ।”

“কিন্তু ছোরা কোথায়? ওটা তো গয়নার মতন দেখতে।”

 কিকিরা হাত বাড়িয়ে বাক্সটা তুলে নিলেন। বললেন, “যেটা গয়নার মত দেখছ, সেটা হল ছোরার বাঁট। দেখেছ একবার ভাল করে বাঁটটা? কত রকমের পাথর আছে জানো? দামি সবরকম পাথর রয়েছে। বাজারে এর দাম কত হবে আন্দাজ করতে পারো?”

চন্দন মুখ তুলেছিল। তারাপদও হাঁ করে কিকিরাকে দেখছে।

 কিকিরাও মুগ্ধ চোখে সেই পাথর বসানো, কারুকর্ম করা বাঁটটা দেখছিলেন। নীলচে ভেলভেটের ওপর রাখা হয়েছে বাঁটটা। গয়নার মতনই কী উজ্জল, সুন্দর দেখাচ্ছে।

কিকিরা বললেন, “বাঁটটা দেখছ, ছুরিটা দেখতে পাচ্ছ না তো! ওটাই তোত সমস্যা।”

“সমস্যা?” চন্দন বলল।

“ব্যাপারটা তাই। বাঁটটা আছে, ছুরির দিকটা নেই!…ওটা জোগাড় করতে হবে।”

কিকিরার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই তারাপদরা বুঝতে পারল না। কিসের ছুরি, বাঁটটাই বা কোথা থেকে এল? কিকিরা কত টাকা খরচ করে এটা কিনলেন? অত টাকাই বা পেলেন কেমন করে? বড়লোক মানুষ তো কিকিরা নন।

একেবারে পাগলামি কাণ্ড কিকিরার। পুরনো জিনিস কেনার কী যে খেয়াল ওঁর-তারাপদরা বুঝতে পারে না।

চন্দন বলল, “আপনি এটা কিনলেন?”

“কিনব? এর দাম কত জানো? এখনকার বাজারে হাজার ত্রিশ-চল্লিশ তো হবেই–বেশিও হতে পারে।”

“তবে পেলেন কোথায়?”

কিকিরা এবার রহস্যময় মুখ করে বললেন, “পেয়েছি, তোমরা আসার সময় যে ভদ্রলোককে বেরিয়ে যেতে দেখলে, উনি আমায় এটা দিয়ে গেছেন।”

তারাপদ আর চন্দন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। ভদ্রলোককে মনে পড়ল। তেমন করে খুঁটিয়ে তো লক্ষ করেনি, তবু চেহারার একটা ছাপ যেন থেকে গেছে মনে।

তারাপদ জিজ্ঞেস করল, “কে ওই ভদ্রলোক?”

কিকিরা তখনোও খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখছিলেন ছোরার বাঁটটা, যেন তারিফ করছিলেন। কোনো জবাব দিলেন না।

চন্দন বলল, “কিকিরা স্যার, আপনি দিন দিন বড় মিস্টিরিয়াস হয়ে যাচ্ছেন।”

কিকিরা চোখ না-তুলেই রহস্যময় গলায় বললেন, “আমার চেয়েও এই ছোরার ইতিহাস আরও মিস্টিরিয়াস।”

চন্দন হেসে-হেসেই বলল, “আপনার চারদিকেই মিস্ত্রি, স্যার; একেবারে মিস্টিরিয়াস ইউনিভার্স হয়ে বসে আছেন।”

তারাপদ হেসে ফেলল। কিকিরাও মুখ তুলে হাসলেন।

এমন সময় চা এল। চা আর গরম গরম ডালপুরী।

কিকিরা শুধুই চা নিলেন। তারাপদ আর চন্দন যে যার নিজের জায়গায় ফিরে গিয়ে খাবার আর চা নিয়ে বসল। চন্দনদের জন্যে প্রতি রবিবারেই কিকিরাকে কিছু না-কিছু মুখরোচক খাদ্যের ব্যবস্থা রাখতে হয়। রান্নাবান্নাতেও হাত আছে কিকিরার।

ডালপুরী খেতে খেতে চন্দন বলল, “তা ইতিহাসটা বলুন?”

 তারাপদরও ধৈর্য থাকছিল না। বলল, “ভদ্রলোক আপনার চেনা?”

কিকিরা বাক্সটা বন্ধ করে রেখেছিলেন আলগা করে। চা খেতে-খেতে বললেন, “ভদ্রলোক আমার চেনা নন, মানে তেমন একটা পরিচিত নন। গত পরশু দিন আগে এক জায়গায় আলাপ হয়েছিল।”

“কী নাম?” তারাপর আবার জিজ্ঞেস করল।

“দীপনারায়ণ। দীপনারায়ণ সিং।”

“কোথায় থাকেন?”

“এখন কয়েক দিনের জন্যে রয়েছেন পার্কসার্কাসে।”

 চন্দন বলল, “ভদ্রলোকের চেহারায় একটা আভিজাত্য আছে।”

কিকিরা বললেন, “রাজ-রাজড়ার বংশধর, চেহারায় খানিকটা রাজ-ছাপ থাকবেই তো।”

তারাপদ বলল, “আপনার এই ক্রমশ আর ভাল লাগছে না কিকিরা, স্পষ্ট করে বলুন ব্যাপারটা।”

কিকিরা আরাম করে কয়েক চুমুক চা খেলেন। তারপর বললেন, “আগে কোনটা শুনবে, বংশের ইতিহাস, না ছোরার ইতিহাস? দুটোই দরকারি, একটাকে বাদ দিলে আরেকটা বোঝা যাবে না। আগে বংশের ইতিহাসটা বলি, ছোট করে।” কিকিরা একটু থামলেন, তাঁর জোব্বা থেকে সরুমতন একটা চুরুট বের করে ধরালেন। ধোঁয়া উড়িয়ে বললেন, “দীপনারায়ণের চার পুরুষের ইতিহাস শুনে তোমাদের লাভ হবে না। আমার আবার ওই বাবার বাবা তার বাবা–ওসব মনে থাকে না। সোজা কথাটা হল, আগেকার দিনে যারা ধন-সম্পত্তি গড়ে তুলতে পারত তারা এক-একজন রাজাগজা হয়ে উঠত সমাজে। দীপনারায়ণের কোনো পূর্বপুরুষ মুসলমান রাজার আমলে এক সেনাপতির সৈন্যসামন্তর সঙ্গে বিহার বাংলা-ওড়িশার দিকে হাজির হন। সৈন্যসামন্তরা যুদ্ধটুদ্ধ সেরে যখন ফিরে যায় তখন আর তাঁকে নিয়ে যায়নি। কেন নিয়ে যায়নি–তা জানা যায় না। হয় কোনো দোষ করেছিলেন তিনি, না হয় কোনো রোগটোগ হয়েছিল বড় রকমের। সেই পূর্বপুরুষই ওদিকে একদিন দীপনারায়ণদের বংশ স্থাপন করেন। তারপর দু পুরুষ ধরে মস্ত জমিদারি গড়ে তুলে, জঙ্গলের মালিকানা কিনে নিয়ে অনেক ঐশ্বর্য সঞ্চয় করেছিলেন। ব্রিটিশ রাজত্বে ছোট বড় রাজার তো অভাব ছিল না বাপু, দীপনারায়ণের বাপ-ঠাকুরদাও সেই রকম ছোটখাট রাজা হয়ে বসেছিলেন। দীপনারায়ণের বাবার আমলে সাহেব কোম্পানিরা কতকগুলো জায়গা ইজারা নেয়। মাটির তলায় ছিল সম্পদ-মিনারেলস। দীপনারায়ণের বাবা আদিত্যনারায়ণ ইজারার টাকাতেই ফুলেফেঁপে ঢোল হয়ে যান। ভদ্রলোক মারা যান শিকার করতে গিয়ে বন্দুকের গুলিতে।…এই ছোরাটা হল তাঁর–আদিত্যনারায়ণের। এ-দেশি ছোরা এরকম হয় না, এ-ছোরা বিদেশি। হয় তিনি বিদেশ থেকে তৈরি করে আনিয়েছিলেন–না হয় এদেশের কোনো বিদেশি কারিগর তাঁকে ছোরাটা তৈরি করে দিয়েছিল। আগেকার দিনে য়ুরোপ-টুরোপ-এ যখন তরোয়াল নিয়ে যুদ্ধ হত, তখন এই রকম সব ছোরাছুরি কোমরে গোঁজার রেওয়াজ ছিল। আদিত্যনারায়ণ অবশ্য কোমরে গুঁজতেন না। রাজবাড়িতে নিজের ঘরে রেখে দিয়েছিলেন। রাজবংশের ওটা পবিত্র সম্পদ।”

তারাপদ আর চন্দন মন দিয়ে কথা শুনছিল কিকিরার। চন্দন তার ডালপুরী শেষ করে ফেলল। তারাপদ ধীরে-সুস্থে খাচ্ছে।

কিকিরা বললেন, “এই ছোরাটাকে দীপনারায়ণেরা বিগ্রহের মতন মনে করেন, মান্য করেন। তাঁদের বিশ্বাস এই ছোরার দৈবশক্তি রয়েছে। কিংবা দৈবগুণ বলতে পারো। আমরা সোজা কথায় যাকে বলি মন্ত্রঃপূত, এই ছোরাও তাই। দীপনারায়ণ বলেছেন, কখনো কোনো কারণে যদি কেউ প্রতিহিংসার বশে, কিংবা অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কাউকে এই ছোরা দিয়ে আহত করেন, খুন করেন–তা হলে এই ছোরার মুখ থেকে রক্তের দাগ কোনোদিনই, হাজার চেষ্টাতেও উঠবে না। আর প্রতিদিন, একটু একটু করে, ছোরাটা ভোঁতা হয়ে যাবে, ছোট হয়ে যাবে।”

তারাপদ বলল, “সে কী!”

 চন্দন অবিশ্বাসের গলায় বলল, “গাঁজাখুরির আর জায়গা হল না। দীপনারায়ণ আপনাকে ব্লাফ ঝেড়েছে।”

কিকিরা চন্দনকে দেখতে-দেখতে বললেন, “সেটা পরে ভেবে দেখা যাবে। আগে দীপনারায়ণ যা বলছেন সেটা শোনা যাক।”

“কী বলছেন তিনি?” চন্দন তুচ্ছতাচ্ছিল্যের গলায় বলল।

 কিকিরা বললেন, “দীপনারায়ণ বলছেন, গত এক মাসের মধ্যে তাঁদের পরিবারে এক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেছে। দীপনারায়ণের ছোট ভাই জয়নারায়ণ খুন হয়েছেন।”

তারাপদ আঁতকে উঠে বলল, “খুন?”

কিকিরা বললেন, “এই ঘটনা ঘটে যাবার পর–খুবই আশ্চর্যের কথা–এই ছোরার বাক্স থেকে কেউ ছোরার ফলাটা খুলে নিয়েছে, শুধু বাঁটটা পড়ে আছে।”

চন্দন বলল, “তার মানে আপনি বলতে চান, দীপনারায়ণের ছোট ভাই জয়নারায়ণকে কেউ খুন করেছে এই ছোরা দিয়ে? খুন করে ফলাটা খুলে নিয়েছে?”

মাথা নেড়ে কিকিরা বললেন, “দীপনারায়ণ তাই মনে করেন। তাঁর ধারণা, যে জয়নারায়ণকে খুন করেছে সে এই ছোরা রহস্যটা জানে। জানে যে, ছোরার ফলা থেকে রক্তের দাগ মুছবে না–হাজারবার জলে ধুলেও নয়। তা ছাড়া ছোরার ফলাটা ক্রমশই ক্ষয়ে আসবে। কাজে-কাজেই পুরো ফলাটাই সরিয়ে ফেলেছে।”

“কিন্তু আপনি কি বলতে চান–এই ছোরার বাঁট থেকে ফলাটা খুলে ফেলা যায়?”

“যায়,” মাথা নেড়ে কিকিরা বললেন, “তোমরা ভাল করে ছোরাটা দেখলে বুঝতে পারতে বাঁটের নিচের দিকে সরু ফাঁক আছে। ওই ফাঁকের মধ্যে দিয়ে ফলা গলিয়ে–দু দিকের স্প্রিং টিপলে ফলাটা আটকে যায়।”

চন্দন এবার একটু চুপ করে থাকল। চা খেতে লাগল।

তারাপদ জিজ্ঞেস করল, “কিডনি নাম হল কেন?”

কিকিরা বললেন, “ছোরার ওপর দিকের গড়নটা মানুষের কিডনির মতন। দু দিকে দুটো বরবটির দানা বা বিচির মত জিনিস রয়েছে, অবশ্য বড় বড় দানা, প্রায় ইঞ্চিটাক। এটা দু রকম কাজ করে। স্পিংয়ের কাজ করে, আবার ছোরা ধরার সময় ধরতে সুবিধেও হয়।

চন্দন রসিকতা করে বলল, “বোধ হয় মানুষের কিডনি ফাঁসাবারও সুবিধে হয়–কী বলেন কিকিরা? নামটাও তাই কিডনি ড্যাগার।”

কিকিরা কোনোরকম উচ্চবাচ্য করলেন না।

সামান্য চুপচাপ থেকে তারাপদ বলল, “ব্যাপারটা কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। আর একটু পরিষ্কার হয়ে নিই। রাজবাড়ির পুরনো ইতিহাস এখন থাক। আসল ব্যাপারটা কবে ঘটেছে, কিকিরা?”

“মাসখানেক আগে।”

“রাজবাড়িতে?”

“হ্যাঁ। রাজবাড়ির লাইব্রেরি-ঘরে।”

তারাপদ জিজ্ঞেস করল, “কেন?”

“তা কেমন করে বলব! কেন খুন হয়েছে আর কে খুন করেছে সেটাই তো জানার জন্যে এত–!”

চন্দন পাকা গোয়েন্দার মতন ভুরু কুঁচকে বলল, “রাজবাড়িতে কে কে থাকে?”

“রাজপরিবারের লোকরা। দীপনারায়ণের এক অন্ধ কাকাও আছেন-ললিতনারায়ণ। আদিত্যনারায়ণের বৈমাত্র ভাই।”

“জন্মান্ধ?”

“না, মান্সঙ্কয়েক হল অন্ধ হয়েছেন। খালি চোখে সূর্যগ্রহণ দেখতে গিয়ে।”

“বোগাস। ওরকম শোনা যায়, আসলে অন্য কোনো রোগ ছিল চোখের।”

“কাকার কেমন বয়েস?”

“ললিতনারায়ণের বয়স ষাটের কাছাকাছি। জয়নারায়ণের বছর বত্রিশ।”

“দীপনারায়ণ নিশ্চয় বছর-পঁয়তাল্লিশ হবেন?”

“আর একটু কম। বছর চল্লিশ। দীপনারায়ণের পর ছিলেন তাঁর বোন। তিনি এখন শ্বশুরবাড়ি মধ্যপ্রদেশে থাকেন।”

তারাপদ চা খাওয়া শেষ করে মুখ মুছল। বলল, “ছোরাটা থাকত কোথায়?”

“রাজবাড়িতে, দীপনারায়ণের ঘরে, সিন্দুকের মধ্যে।”

“কবে দীপনারায়ণ জানতে পারলেন ছোরার ফলা চুরি হয়েছে?”

কিকিরার চুরুট নিবে গিয়েছিল। চুরুটটা আঙুলে রেখেই কিকিরা বললেন, তা জয়নারায়ণ খুন হবার আট-দশ দিন পরে।”

“কেন? অত দিন পরে জানলেন কেন?”

কিকিরা বললেন, “জয়নারায়ণ যে ভাবে খুন হয়েছিলেন, তাঁকে যে ভাবে লাইব্রেরি ঘরে পাওয়া গিয়েছিল তাতে মনে হয়েছিল, ওটা দুর্ঘটনা। পরে একদিন আচমকা ছোরার বাক্সটা খুলতেই তাঁর চোখে পড়ে, ছোরার বাঁট আছে, ফলাটা নেই। তখন থেকেই তাঁর সন্দেহ।”

চন্দন বলল, “পুলিশকে জানিয়েছেন দীপনারায়ণ?”

“না। পুলিশ দুর্ঘটনার কথা জানে। অন্য কিছু জানে না। দুর্ঘটনায় জয়নারায়ণ মারা গেছেন এই কথাটাই ছড়িয়ে গেছে। তা ছাড়া ওই জঙ্গল-অঞ্চলে কোথায় পাচ্ছ তুমি থানা পুলিশ কলকাতার মতন। ওসব জায়গায় ডেথ সার্টিফিকেটও নেই, পোস্টমর্টেমও নেই। তার ওপর রাজবাড়ির ব্যাপার।”

তারাপদ বলল, “দীপনারায়ণের কথা আপনি বিশ্বাস করেছেন?”

 কিকিরা বললেন, “বিশ্বাস-অবিশ্বাস আমি কোনোটাই করিনি। আমার কথা হল, কোনো দলেই ঝুঁকবে না। একেবারে মাঝামাঝি থাকবে। যখন দেখবে বিশ্বাসের দিক টানছে তখন বিশ্বাসের দিকে টলবে, যদি অবিশ্বাসের দিক টানে তবে অবিশ্বাসের দিকে ঝুঁকবে। আমার হল চুম্বকের কাঁটা–যেদিকে টানবে সেদিকে ঝুঁকব।”

চন্দন বলল, “আপনি যাই বলুন আমি বিশ্বাস করি না, কোনো ছোরার ফলার ওসব গুণ থাকতে পারে! এ একেবারে গাঁজাখুরি। ব্লাফ।”

কিকিরা চুরুটটা আবার ধরিয়ে নিলেন। আস্তে-আস্তে টানলেন। তারপর বললেন, “স্যান্ডাল উড়, আমাদের এই জগতে কত কী অদ্ভুত-অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে তার সব কি আমরা জানি। জানলে তো ভগবান হয়ে যেতুম।”

“আপনি তা হলে বিশ্বাস করছেন যে এমন ছোরাও আছে যার গায়ে রক্তের দাগ পড়লে মোছে না? আপনি বিশ্বাস করছেন, ইস্পাতেও ক্ষয় ধরে?”

মাথা নেড়ে নেড়ে কিকিরা বললেন, “আমি বিশ্বাস করছি না। কিন্তু যারা বিশ্বাস করে তারা কেন করে, সত্যিই তার কোনো কারণ আছে কিনা সেটা আমি খুঁজে দেখতে চাই।”

চন্দন চুপ করে থেকে বলল, “বেশ, দেখুন।…আপনি তা হলে গোয়েন্দাগিরিতে নামলেন?”

“মাথা খারাপ নাকি তোমার। আমি হলাম ম্যাজিশিয়ান। কিকিরা দি ম্যাজিশিয়ান। গোয়েন্দারা কত কী করে, রিভলবার ছেড়ে, নদীতে ঝাঁপ দেয়, মোটর চালায়; আমি তো রোগা-পটকা মানুষ, পিস্তল রিভলবার জীবনে হাতে ধরিনি।..তা ওসব কথা থাক। কথা হচ্ছে আগামী পরশু কি তরশু আমি তারাপদকে নিয়ে একবার দীপনারায়ণের রাজবাড়িতে যাচ্ছি! তুমি কবে যাচ্ছ?”

চন্দন অবাক হয়ে বলল, “আপনি যাচ্ছেন তারাপদকে নিয়ে?” কিকিরা বললেন, “দিন দশ-পনেরো রাজবাড়ির ভাত খেয়ে আসব। মন্দ কী।”

.

০২.

তারাপদর আর ঘুম আসছিল না। বটুকবাবুর মেসের কোথাও আর ছিটেফোঁটা বাতি জ্বলছে না বৃষ্টির দরুন ঠাণ্ডাও পড়েছে, খুব, এ-সময় লেপ মুড়ি দিয়ে তোফা ঘুম মারবে কোথায়, তা নয়, মাথার মধ্যে যত রকম এলোমেলো ভাবনা। আগের বার, যখন তারাপদর কপালে ভুজঙ্গ কাপালিক জুটেছিল, তখন দশ-পনেরোটা দিন মাথা খারাপ হয়ে যাবার অবস্থা হয়েছিল তার। তারাপদ নিজেই সেই ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল, তার ভাগ্য নিয়ে অদ্ভুত এক খেলা চলছিল, মাথা খারাপ না হয়ে উপায় ছিল না তার। কিন্তু এবারে তারাপদ নিজে কোথাও জড়িয়ে নেই। তবু এত ভাবনা কিসের?

কিকিরা মানুষটি সত্যিই অদ্ভুত। এই ক’মাসের মেলামেশায় তারাপদরা বুঝতে পেরেছে, কিকিরা মুখে যত হাসি-ঠাট্টা তামাশা করুন না কেন, তাঁর একটা বিচিত্র জীবন আছে। স্পষ্ট করে, খুলে কিকিরা এখন পর্যন্ত কোনোদিন সে জীবনের কথা বলেননি। বলেছেন, সে-সব গল্প পরে একদিন শুনো, বললে মহাভারত হবে, তবে বাপু এটা ঠিক–আমি ম্যাজিকের লাইনের লোক। তোমরা ভাবো, ম্যাজিক জানলেই লোকে ম্যাজিশিয়ান হয়ে খেলা দেখিয়ে বেড়ায়। তা কিন্তু নয়, কপালে না-থাকলে শেষ পর্যন্ত কেউ দাঁড়াতে পারে না। আমার কপালটা মন্দ। এখন আমি একটা বই লেখার চেষ্টা করছি ম্যাজিকের ওপর, সেই পুরনো আমল থেকে এ পর্যন্ত কেমন করে ম্যাজিকের ইতিহাস চলে আসছে বুঝলে?

তারাপদরা অতশত বোঝে না। কিকিরাকে বোঝে। মানুষটি চমৎকার, খুব রসিক, তারাপদদের স্নেহ করেন আপনজনের মতন। সত্যি বলতে কী, এতকাল চন্দন ছাড়া তারাপদর নিজের বলতে কেউ ছিল না, এখন কিকিরাকেও তারাপদর নিজের বলে মনে হয়।

কিকিরা যখন বলেছেন, তখন তারাপদকে সিংভূমের কোন এক জঙ্গলে যেতেই হবে তাঁর সঙ্গে। তবে দীপনারায়ণের ব্যাপারটা সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না।

রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার সময় তারাপদরা আবার কথাটা তুলেছিল। চন্দন কিকিরাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “আপনি যাঁকে চেনেন না জানেন না, তাঁর কথা বিশ্বাসই বা করছেন কেন, আর এইসব খুনখারাপির মধ্যে নাকই বা গলাচ্ছেন কেন?”

কিকিরা তখন যা বললেন, সেটা আরও অদ্ভুত।

এই কলকাতাতেই কিকিরার এক বন্ধু আছেন, যিনি নাকি আশ্চর্য এবং অলৌকিক এক গুণের অধিকারী। কিকিরার চেয়ে বয়েসে সামান্য বড়, নাম রামপ্রসাদ। সন্ন্যাসীধরনের মানুষ, কোনো মঠের সন্ন্যাসী নন, সাত্ত্বিক ধরনের লোক, চিতপুরের দিকে গানবাজনার যন্ত্র সারাবার একটা দোকান আছে তাঁর। একা থাকেন। এই মানুষটির এক অলৌকিকশক্তি আছে। অদেখা কোনো কোনো ঘটনা তিনি দেখতে পান। তাঁকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বা জানতে চাইলে তিনি চোখ বন্ধ করে চুপচাপ বসে থাকেন কিছুক্ষণ, তারপর ওই অবস্থায় যদি কিছু দেখতে পান সেটা বলে যান। যখন আর পান না, থেমে যান। সব সময় সব প্রশ্নের জবাবও দেন না। বলেন, তিনি কিছু দেখতে পাচ্ছেন না। তাঁর এই অলৌকিক শক্তির কথা সকলে জানে না, কেউ-কেউ জানে। মুখে-মুখে তাঁর কথা খানিকটা ছড়িয়ে গেলেও মানুষটি অন্য ধাতের বলে তাঁকে নিয়ে হইচই করার সুযোগ হয়নি। নিজেও তিনি কারও সঙ্গে গলাগলি করছে চান না। একলা থাকতে ভালবাসেন। তবু গণ্যমান্য জনাকয়েক আছেন, যাঁরা রামপ্রসাদবাবুর অনুরাগী। কিকিরা রামপ্রসাদবাবুকে যথেষ্ট মান্য করেন।

রামপ্রসাদবাবুর বাড়িতেই কিকিরা দীপনারায়ণকে দেখেছিলেন। আলাপ সেখানেই। রামপ্রসাদবাবুই কিকিরাকে বলেছিলেন, “কিঙ্কর, তুমি এর ব্যাপারটা একটু দেখো তো, আমি ভাল কিছু দেখতে পাচ্ছি না।”

“চন্দন জিজ্ঞেস করেছিল, “রামপ্রসাদবাবু চোখ বন্ধ করে কী দেখতে পান?”

“ভূত আর ভবিষ্যৎ–দুইই কিছু কিছু দেখতে পান।” বলেছিলেন কিকিরা।

চন্দন ঠাট্টা করে বলেছিল, “দৈবজ্ঞ!”

কিকিরা বলেছিলেন, “যদি দৈবজ্ঞ বলতে চাও বলো, তবে ব্যাপারটা ঠাট্টার নয় চন্দন। তোমায় আগে বলেছি, আবার বলছি, এই জগৎটা অনেক বড়, বড়ই অদ্ভুত, আমরা তার কণার কণাও জানি না। তুমি রামপ্রসাদবাবুকে দৈবজ্ঞ বলে ঠাট্টা করছ, কিন্তু তুমি জানো না, বিদেশে–যেমন হল্যাণ্ডে সবচেয়ে পুরনো যে বিশ্ববিদ্যালয়, সেখানে সাইকলজির ডিপার্টমেন্টে বিশ বাইশজন এই ধরনের মানুষকে রেখে নিত্যিদিন গবেষণা চালানো হচ্ছে। এই বিশ বাইশজনকে আনা হয়েছে সারা য়ুরোপ খুঁজে–যাঁদের মধ্যে কমবেশি এমন কোনো অলৌকিক ক্ষমতা দেখা গিয়েছে যা সাধারণ মানুষের দেখা যায় না। ডাক্তার আর সাইকলজিস্টরা মিলে কত এক্সপেরিমেন্ট না করছে এদের ওপর। জানার চেষ্টা করছে–কোন্ ক্ষমতা এদের আছে, যাতে এরা যা চোখে দেখেনি তার কথাও কিছু না-কিছু বলতে পারে।”

কিকিরা যত যাই বলুন, চন্দন বিশ্বাস করেনি কোনো মানুষ অলৌকিক কোনো ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়।

তারাপদ চন্দনের মতন সবকিছু অবিশ্বাস করতে পারে না। বিশেষ করে কিকিরা যখন বলছেন। ব্যাপারটা যদি গাঁজাখুরি হত–কিকিরা নিজেই মানতেন না। ভুজঙ্গের আত্মা নামানো তিনি মানেননি। তারাপদ ঠিক বুঝতে পারছে না, কিন্তু তারও মনে হচ্ছে, কিছু থাকলেও থাকতে পারে। সাধারণ মানুষ সাধারণই, তারা কী পারে না-পারে, তা নিয়ে অসাধারণের বিচার হতে পারে না। রাজার ছেলে রাজাই হয়, এটা সাধারণ কথা, কিন্তু রাজার ছেলে সমস্ত কিছু ত্যাগ করে গৌতম বুদ্ধও তো হয়।

এই সব দশরকম ভাবতে-ভাবতে শেষ পর্যন্ত তারাপদ কখন ঘুমিয়ে পড়ল।

পরের দিন বিকেলে সে একাই কিকিরার বাড়ি গিয়ে হাজির। আজ সারাদিন আর বৃষ্টি নেই। তবে মাঝে মাঝে রোদ উঠলেও আকাশটা মেঘলা-মেঘলা। কলকাতা শহরে সব পুজোতেই হইচই আছে সরস্বতী পুজোর বেলায় কম হবে কেন! তারাপদর আজ টিউশানি নেই, কালও নয়। ছুটি। দু-চার দিন ছুটি নিতে হবে আরও। তারাপদর একটা চাকরির জন্যে কিকিরাও উঠে পড়ে লেগেছেন। বলেছেন, “দাঁড়াও, তোমায় আমি চাকরিতে না বসিয়ে মরব না।”

কিকিরা বাড়িতেই ছিলেন। বললেন, “এসো এসো। তোমার কথাই ভাবছিলাম।”

তারাপদ বলল, “কেন?”

কিকিরা বললেন, কালকেই আমাদের যেতে হবে, বুঝলে! টিকিট-ফিকিট দিয়ে গেছে।”

“কালকেই? কখন ট্রেন?”

“রাত্তিরে।”

তারাপদ বসল। কিকিরাকে দেখতে লাগল।

কিকিরা সুটকেসের মতন একটা বাক্সে নানা রকম জিনিস গুছিয়ে নিচ্ছিলেন। পাশে একটা ঝোলা।

তারাপদ বলল, “আপনার সেই দীপনারায়ণ আজ আবার এসেছিলেন?”

না। সকালে আমি গিয়েছিলাম।” কিকিরা বললেন।”একটা জায়গায় যাব, তার আগে কিছু ব্যবস্থা করা দরকার তো! তার ওপর তুমি সঙ্গে যাচ্ছ, চন্দনও যাবে দু-চার দিন পরে–দীপনারায়ণকে বলে আসা দরকার।”

সামান্য চুপ করে থেকে তারাপদ বলল, “উনি নিজে যাবেন না?”

“আজই ফিরে যাবেন!”

কী মনে করে তারাপদ হেসে বলল, “আমরা তা হলে কাল থেকে রাজ-অতিথি?”

কিকিরা মাথা দুলিয়ে-দুলিয়ে বললেন, “কাল এ-বাড়ি ছাড়ার পর থেকে।”

“থাকব কোথায়?”

“রাজবাড়ির গেস্ট হাউসে।”

তারাপদ মনে মনে রাজবাড়ির একটা ছবি কল্পনা করবার চেষ্টা করল। দেখল, হিন্দি সিনেমার রাজবাড়ি ছাড়া তার মাথায় আর কিছু আসছে না। গঙ্গাধরবাবু লেনে বটুকবাবুর মেসের বাসিন্দে বেচারি, রাজবাড়ির কল্পনা তার মাথায় আসবে কেন? নিজের মনেই হেসে ফেলল তারাপদ।

কিকিরা নিজেই বললেন, “আমরা রাজবাড়িতে নিজেদের পরিচয় দিয়ে থাকব না, বুঝলে!”

তারাপদ বুঝতে পারল না। নিজেদের পরিচয় ছাড়া আর কী পরিচয় আছে তাদের। অবাক হয়ে কিকিরার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল।

সুটকেস গুছোতে-গুছোতে কিকিরা বললেন, “দীপনারায়ণ চান না যে, রাজবাড়ির লোক বুঝতে পারে আমরা তাঁর হয়ে গোয়েন্দাগিরি করতে যাচ্ছি। আমরা যাব পুরনো বই কেনাবেচার ব্যবসাদার হিসেবে। পুরনো বই, পুরনো ছবি।”

বুঝতে না-পেরে তারাপদ বলল, “সেটা কী?”

“সেটা ভয়ংকর কিছু নয়। এই কলকাতা শহরে আগে এক ধরনের ভাল ব্যবসা ছিল। প্রেস্টিজঅলা ব্যবসা। একশো সওয়াশো দেড়শো বছর আগেকার সব ছবি-সাহেবদের আঁকা–বিলেতে ছাপা হত নানা জায়গায় বিক্রি হত, এ-দেশেও। ছবিগুলো সব এদেশের মানুষকে নিয়ে, এখানকার নদী পাহাড় বন জঙ্গল নিয়ে। ছবিগুলো মোটা দামে বিকোত, রাজারাজড়ারা, ধনী লোকেরা কিনত, বাড়িতে লাইব্রেরি বৈঠকখানা সাজাত। ছবি ছিল, বইও ছিল। সে সব বই আর পাওয়া যায় না, ছাপা হয় না। কোনো ধনী লোক মারা গেল, কিংবা রাজা স্বর্গে গেল, দেখাশোনার লোক নেই, তখন সে সব বই বিক্রি হয়ে যেত। কখনো কখনো নীলামে আজকাল সেব্যবসা নেই। দু-একজন অবশ্য খোঁজে থাকে। তারা কোনোরকমে কেনা-বেচা করে পেট চালায়–এই আর কী।”

তারাপদ বলল, “আমি তো ওসব কিছু জানি না।”

 কিকিরা বললেন, “জানবার দরকার নেই। আমিই কি ছাই জানি। যাদের বাড়িতে যাব, তারাও জানে না। বাপ-ঠাকুরদা ঘর সাজিয়েছিল, তারাও সাজিয়ে রেখেছে। নয়ত হাজার টাকা দামের ছবি একশো টাকায় ছাড়ে, না পাঁচশো টাকার বই পঞ্চাশ টাকায় ছেড়ে দেয়? তুমি শুধু আমার সঙ্গে থাকবে; যা করতে বলব, করে যাবে। বুঝলে?”

তারাপদ মাথা নাড়ল। বলল, “নামটামও পালটাতে হবে নাকি?”

“না, মোটেই নয়। ফাদার-মাদারের ডোনেট করা নাম পালটাবে কেন?”

কিকিরা এতক্ষণ পরে একটা রসিকতা করলেন। তারাপদ হেসে ফেলল। বলল, “কিকিরা, আমরা তা হলে সত্যি সত্যি গোয়েন্দাগিরি করতে যাচ্ছি? শার্লক হোমস আর ওয়াটসন?”

কিকিরা বললেন, “বলতে পারো। কিন্তু ওয়াটসনসাহেব, সেখানকার জঙ্গলে তোমার এই ফতুয়া চলবে না। একটা লম্বা গরম কোটটোট–পুরনো হলেই ভাল–জোগাড় করতে পারো না? নয়ত শীতে মরবে।”

তারাপদ বলল, “বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে চেয়ে নেব।”

কিকিরা সুটকেস বন্ধ করলেন। বাইরে গেলেন। সামান্য পরে ফিরে এলেন।

তারাপদ যেন কিছু ভাবছিল বলল, “কাল আমি রাত্তিরে শুয়ে-শুয়ে ভাবছিলাম। আচ্ছা, একটা কথা বলুন তো? রামপ্রসাদবাবুর জন্যেই কি আপনি দীপনারায়ণের এই ব্যাপারটা হাতে নিলেন?”

নিজের চেয়ারে বসে কিকিরা একটা সরু চুরুট ধরাচ্ছিলেন। চুরুট ধরানো হয়ে গেলে বললেন, “খানিকটা তাই।”

“খানিকটা তাই মানে?”

 ফুঁ দেবার মতন করে ধোঁয়া ছেড়ে কিকিরা বললেন, “রামপ্রসাদবাবুর কোনো ভৌতিক ক্ষমতা আছে, মস্তর-ফন্তর জানা আছে তা আমি বিশ্বাস করি না, তারাপদ। তবে আমি পড়েছি এবং দেখেছি এক-একজন মানুষ থাকে যারা সচরাচর না-দেখা জিনিস দেখতে পায়, কিংবা ধরো বুঝতে পারে। রামপ্রসাদবাবু যেটা পারেন সেটা হল, দেখা। যেমন ধরো, একটা ছেলে স্কুলে গেল-বিকেলেও বাড়ি ফিরে এল না, সন্ধেতেও নয়। বাড়ির লোক দুশ্চিন্তায় ভাবনায় ছটফট করছে, ভাবছে কোথাও কোনো দুর্ঘটনা ঘটল কি না! থানা-পুলিশ হাসপাতাল করে বেড়াচ্ছে। এখন তুমি রামপ্রসাদবাবুকে গিয়ে ধরলে। তিনি যদি রাজি হন, তবে চোখ বন্ধ করে বসে থাকবেন কিছুক্ষণ। তারপর হয়ত চোখ বন্ধ করেই বলবেন–আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না। তার মানে–সেই ছেলেটি সম্পর্কে তিনি কিছুই বলতে পারছেন না। আবার এমনও হতে পারে, তিনি বললেন : ছেলেটিকে তিনি আর-একটি কালো প্যান্ট-পরা ছেলের সঙ্গে সাইকেল চেপে রাস্তায় ঘুরতে দেখছেন, কোনো পার্কের কাছে গিয়ে দুজনে বসল, তারপর দুই বন্ধু মিলে আবার সাইকেল চালিয়ে চলে গেল। হঠাৎ কোনো বাস এসে পড়ল রাস্তায়। সাইকেলটাকে ধাক্কা মারল…তারপর–তারপর আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না।”

তারাপদ শিউরে উঠে বলল, “মানে ছেলেটি বাস চাপা পড়েছে?”

“চাপাই পড়ুক আর ধাক্কা খেয়ে ছিটকেই পড়ক–সেটা অন্য কথা। মরল, না হাসপাতালে গেল, সেটাও আলাদা কথা। ওই যেটুকু তিনি দেখলেন, মাত্র সেইটুকুই বলতে পারলেন।”

অবাক হয়ে তারাপদ কিকিরার দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ, তারপর বলল, “উনি যা বলেন তা কি সত্যি হয়?”

“হতে দেখেছি। শুনেছি।”

“এটা কেমন করে হয়?”

“তা বলতে পারব না। জানি না। কেমন করে হয় তা জানার জন্যেই তো কত লোক, পণ্ডিত-টণ্ডিত, দিনের পর দিন মাথা ঘামাচ্ছে। ওই যে তোমাদের প্যারা-সাইকোলজি বলে কথাটা আছে, এ-সব বোধ হয় তার মধ্যে পড়ে।”

 তারাপদর অবাক ভাবটা তখনো ছিল, তবু খুঁতখুঁত গলায় বলল, “কেমন করে এটা হয় তার একটা যুক্তি দেবার চেষ্টাও তো থাকবে।”

সরু চুরুটটা ঠোঁটে চুঁইয়ে আবার নামিয়ে নিলেন কিকিরা। বললেন, “বুঝতে পারলে, ধরতে পারলে তবে না যুক্তি। এখন মোটামুটি একটা ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয় সিক্সথ সেন্স।”

“সিক্সথ সেন্স?”

“মানুষের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের কথা আমরা জানি। এটা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়, কিংবা বোধ। কেউ কেউ বলছেন, মানুষ যখন পশুর পর্যায়ে ছিল, আদিম ছিল, তখন তার মধ্যে একটা বোধ ছিল যার ফলে সে অজানা আপদ-বিপদ-ক্ষতি বুঝতে পারত। এখনো বহু পশুর মধ্যে সেটা দেখা যায়। মানুষ বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যত সভ্য হয়েছে ততই তার আদিমকালের অনেক কিছু হারিয়ে গেছে। কিন্তু কখনো কখনো দেখা যায় যে, সেই হাজার-হাজার বছর আগেকার মানুষের কোনো দোষ বা গুণ কোটিতে এক আধজনের মধ্যে অস্পষ্টভাবে থেকে গেছে। একে তুমি প্রকৃতির রহস্য বলতে পারো। এ ছাড়া আর কী বলা যায় বলো।”

তারাপদ বরাবরই খানিকটা নরম মনের ছেলে। সহজে কিছু উড়িয়ে দিতে পারে না। বিশ্বাস করুক না করুক অলৌকিক ব্যাপারে বেশ আগ্রহ বোধ করে। কিকিরার কথা তার ভাল লাগল।

কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর তারাপদ বলল, “রামপ্রসাদবাবু কি আপনাকে বলেছেন, দীপনারায়ণের সন্দেহ সত্যি?”

“তিনি সত্যি মিথ্যে কিছু বলেননি। চোখ বন্ধ করে অনেকক্ষণ বসে থেকেও তিনি কিছু দেখতে পাননি রাজবাড়ির। কাজেই এমনও হতে পারে দীপনারায়ণের সন্দেহ মিথ্যে। বা এমনও হতে পারে সত্যি। রামপ্রসাদবাবুর কাছ থেকে আমরা কোনো রকম সাহায্য এখানে পাচ্ছি না, তারাপদ। কিন্তু আমি ওঁকে শ্রদ্ধাভক্তি করি। উনি যখন দীপনারায়ণের ব্যাপারটা দেখতে বেললেন, আমি না বলতে পারিনি।”

তারাপদ যেন কিছু মনে করে হেসে বলল, “তা হলে ধাঁধার পেছনে ছুটছি?”

“তা বলতে পারো।”

“ওহো, একটা কথা কাল আপনাকে জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছি। রাত্রে আমার মনে পড়ল। দীপনারায়ণদের যে ছোরার বাঁটটা আপনি রেখেছেন, সেটার হাজার-হাজার টাকা দাম বললেন। অত দামি জিনিস আপনি নিজের কাছে রাখলেন কেন? দীপনারায়ণই বা কোন বিশ্বাসে আপনার কাছে রেখে। গেল?”

কিকিরা এবার মজার মুখ করে তারাপদকে দেখতে-দেখতে হেসে বললেন, “ওয়াটসনসাহেব, এবার তোমার বুদ্ধি খুলেছে। সত্যি ব্যাপারটা কী, জানো? ছোরার যে বাঁটটা তোমরা দেখেছ, ওটা নফল, ইমিটেশান। আসলটা রাজবাড়িতে রয়েছে। সিন্দুকের মধ্যেই।”

তারাপদ হাঁ করে তাকিয়ে থাকল।

খানিক পরে আবার বললেন, “না, তোমার সঙ্গে মজা করলাম। ওটা আসলই। ও জিনিসের কি নকল হয়। উনি আমায় বিশ্বাস না করলে রাজবাড়িতে নিয়ে যাবেন কেন! যাকগে, যাঁর জিনিস তাঁকে ফেরত দিয়ে এসেছি।”

.

০৩.

তারাপদ চিরটাকাল কলকাতায় কাটিয়েছে। একেবারে ছেলেবেলায় অবোধ বয়সে মা বাবার সঙ্গে কবে এক-আধবার দেশের বাড়িতে গেছে, কবে কলেজ-টলেজে পড়ার সময় বন্ধুদের সঙ্গে দলে ভিড়ে ব্যান্ডেল চার্চ কিংবা বিষ্ণুপুর বেড়াতে গেছে, সেসব কথা বাদ দিলে তার ঘোরা-ফেরার কোনো বালাই কোনকালে ছিল না। ভুজঙ্গভূষণকে দেখতে গিয়েছিল শংকরপুর, আর এবার এল কিকিরার সঙ্গে দীপনারায়ণের রাজত্বে। অবশ্য এখন রাজত্ব বলতে কিছুই নেই, রাজার দল প্রজা হয়ে গিয়েছে। রাজত্ব না থাক, পুরনো সম্পদ-সমৃদ্ধি তো খানিকটা থাকবেই। আর লোকের মুখে রাজা নামটা অত সহজে কি যায়।

রাত্রে হাওড়া ছেড়েছিল যে গাড়িটা, পরের দিন বেলা দশটা নাগাদ তারাপদদের এক স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। তারাপদর কাছে সবই বিস্ময়! কলকাতায় বাস, ট্রাম, কপোরেশানের ময়লা ফেলা গাড়ি, ঠেলা, রিকশা ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না। কলকাতা থেকে দশ পা বাইরে গেলেই হয় কলকারখানা, না হয় এঁদো পুকুর, বাঁশঝোঁপ, কচুরিপানা। এদিকে যে-মুহূর্তে এসে পড়ল তারাপদ, ভোরবেলায় ঘুম ভেঙে জানলা দিয়ে দেখল–সব পালটে গেছে। মাঠের পর মাঠ, কোথাও নিচু, কোথাও বা উঁচু, হিমে কুয়াশায় সাদা চারপাশ, ঝোঁপঝাড়, বন, পাহাড়ি বা পাথুরে ঢল নেমেছে, বালিয়াড়ি। এ একেবারে আলাদা দৃশ্য। এমনি করেই সূর্য উঠে গেল, বেলা বাড়তে লাগল। বেশ বোঝা যাচ্ছিল, মাটির রঙ পালটে গিয়েছে। বনজঙ্গলের দৃশ্যগুলোও ঘনঘন চোখে পড়ছিল। পাহাড়ের মাথা এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত চলেছে তো চলেইছে, ঢেউয়ের মতন উঁচুনিচু হয়ে।

তারাপদা যেখানে নামল, তাকে বড় ছোট কোনো স্টেশনই বলা যায় না। তবু রেলগাড়ি যেখানে থামে, কাঁকর-বিছানো স্টেশন পাওয়া যায় দেখতে, তাকে স্টেশন না বলে উপায় কী?

স্টেশনের গায়ের ওপরই যেন জঙ্গল হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। তারাপদ গাছটাছ চেনে না, তবু তার মনে হল, নিশ্চয় শাল-সেগুন হবে।

স্টেশনের বাইরে জিপ ছিল। দীপনারায়ণ পাঠিয়েছেন।

 কিকিরাকে কিছু বলতে হল না, তাঁদের দেখামাত্র জিপগাড়ির লোক এগিয়ে এল। কলকাতার লোক বুঝতে এদের বোধ হয় অসুবিধে হয় না। অন্য যারা পাঁচ-দশজন নেমেছিল–সবই স্থানীয়।

মালপত্র জিপে তুলে নিল যে, তার নাম বলল, দশরথ। বাঙালি। তার বাংলা উচ্চারণে মানভূম-সিংভূমের টান, তারাপদ যা জানে না, কিকিরাই বলে দিলেন।

জিপগাড়ির ড্রাইভারের নাম জোসেফ। মাথায় খাটো, বেঢপ প্যান্ট পরনে, গায়ে কালো সোয়েটার, গলায় মাফলার। মাথায় একটা নেপালি টুপি।

কিকিরা আর তারাপদ গাড়ির পেছনে, সামনে জোসেফ আর দশরথ। গাড়ি চলতে শুরু করল।

কিকিরা আলাপী লোক, দশরথ আর জোসেফের সঙ্গে গল্প শুরু করলেন। কে কতদিন আছে রাজবাড়িতে, কার কোথায় বাড়ি, জায়গাটা কেমন, এখানকার জঙ্গলে কোন্ কোন্ পশু দেখা যায়–এইরকম সব গল্প। দশরথরা দু পুরুষ রাজবাড়িতে কাজ করে কাটাচ্ছে, তার বাড়ি ঝাড়গ্রামে, দশরথের কাজ হল বাইরের লোকের তদারকি করা; যখন বাইরের লোকজন থাকে না, তখন তার প্রায় কোনো কাজই থাকে না সারাদিন; রাজবাড়ির বাগানের তদারকি করে দিন কাটে।

জোসেফ লোকটা ক্রিশ্চান। আগে কাজ করত চাঁইবাসায়। বছর দুয়েক হল রাজবাড়িতে এসে ঢুকেছে। আগে ট্রাক চালাত, পিঠের শিরদাঁড়ায় এক বেয়াড়া রোগ হল, ট্রাক চালানো ছেড়ে দিল জোসেফ। তার কোনো দেশ বাড়ি নেই, আত্মীয়স্বজন নেই।

তারাপদ কিকিরাদের কথাও শুনছিল, আবার চারপাশের বনজঙ্গল গাছপালা দেখছিল। মাইল চল্লিশ যেতে হবে জিপে। রাস্তা সরু, পিচ করা। এক-একটা জায়গায় যেন ঘন জঙ্গলের গা ছুঁয়ে চলে গেছে রাস্তাটা, কখনো কখনো পাহাড়তলি দিয়ে, মাঝে মাঝে ছোট-ছোট লোকালয় ভেসে উঠছে, পাঁচ সাতটা কুঁড়ে, আদিবাসী লোকজন চোখে পড়ছে, সামান্য কিছু খেত-খামার।

দেখতে-দেখতে জিপগাড়িটা কখন একেবারে ঘন জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ল। বিশাল বিশাল গাছ, বড় বড় ফাটল, পাথর, ঝোঁপ, সূর্যের আলোও ভাল করে ঢুকতে পারছে না যেন।

তারাপদ কিকিরাকে বলল, “ভীষণ জঙ্গল। ডিপ ফরেস্ট।”

কিকিরা বললেন, “সরকারি জঙ্গল সব, বুঝল। এখন যত জঙ্গল সব রিজার্ভ ফরেস্ট হয়ে গিয়েছে।” বলে তিনি দশরথকে জিজ্ঞেস করলেন, “এই জঙ্গলের নাম কী দশরথ!”

“আজ্ঞে, আমরা বেরার জঙ্গল ডাকি,” দশরথ বলল, “বিশাল জঙ্গল উত্তরে।”

বেরার জঙ্গলের মধ্যে অবশ্য জিপ ঢুকল না। জঙ্গলের পাশ দিয়ে আরও পূবের দিকে এগিয়ে চলল।।

যেতে যেতে এক জায়গায় গাড়ি হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল। জোসেফ ইশারা করে তার ডান দিকটা দেখাল। জোসেল বলল, “সাপ।”

গাড়ি থেকে মুখ বাড়িয়ে কিকিরা আর তারাপদ দেখলেন একটা বিশাল সাপ রাস্তার মধ্যে পড়ে আছে। একেবারে স্থির। যেন মরে পড়ে রয়েছে।

এত বড় সাপ তারাপদ জীবনে দেখেনি। সাপটা দেখতে-দেখতে হঠাৎ তার গা কেমন গুলিয়ে উঠল।

শীতকালে সাপ বড় একটা বেরোয় না বলে শুনেছিলেন কিকিরা, কিন্তু এ যে মস্ত সাপ।

জোসেফ জিপ নিয়ে দাঁড়িয়েই থাকল। সাপটা রাস্তা ছেড়ে সরে না গেলে সে গাড়ি নিয়ে এগুতে পারবে না।

দশরথ গাড়ি থেকে নেমে পাথর কুড়িয়ে সাপের দিকে ছুঁড়তে লাগল, যাতে সাপটা রাস্তা ছেড়ে চলে যায়। তারাপদর এতই গা ঘিনঘিন করছিল যে, বমি চেপে সে বসে থাকল কোনোরকমে।

কিকিরা আস্তে গলায় বললেন, “সর্পযাত্ৰা ভাল না মন্দ, তারাপদ?”

তারাপদ কিছু বলল না।

.

রাজবাড়িতে পৌঁছতে পৌঁছতে দুপুরই হয়ে গেল প্রায়।

তারাপদ কল্পনাই করেনি এই পাহাড় জঙ্গলের মধ্যে এমন একটা রাজবাড়ি থাকতে পারে। চোখের সামনে যেন ভোজবাজির মতন এক বিশাল ইমারত ভেসে উঠল। বিরাট পাঁচিল দিয়ে ঘেরা রাজবাড়ির কম্পাউন্ড। বিশাল ফটক। মূল রাজবাড়িটা সামনে, দোতলা বিশাল বাড়ি, সেকেলে দোতলা, মানে আজকালকার বাড়ির প্রায় চারতলার কাছাকাছি উঁচু। কলকাতার অনেক পুরনো বনেদি বাড়ির এই রকম ধাঁচ দেখেছে তারাপদ, একটানা বারান্দা, আর ঘর। মাথার দিকে আর্চ করা। মোটা মোটা গোল থাম। মূল রাজবাড়ির মুখেও লোহার ফটক।

রাজবাড়ির মুখোমুখি, খানিকটা তফাতে গেস্ট হাউস। একতলা বাড়ি। উঁচু পাঁচিল দিয়ে কম করেও বিঘে দশ পনেরো জমি ঘেরা। ফুলের বাগান, পাখিঘর, একদিকে ছোট মতন এক বাঁধানো পুকুর। মন্দিরের মতনও কিছু একটা দেখা যাচ্ছে পশ্চিমে।

দশরথ জিনিসপত্র নামাতে লাগল। জোসেফ গেল জল খেতে। এ

তারাপদ চারদিকে তাকাতে-তাকাতে বলল, “এই জঙ্গলের মধ্যে এমন বাড়ি, ভাবাই যায় না।”

কিকিরা বললেন, “একসময়ে করেছিল, এখন আর ধরে রাখতে পারছে না। দেখছ না, চারিদিকে কেমন পড়তি চেহারা। রাজবাড়ির গায়ে ছোপ ধরে গেছে, শ্যাওলা জমেছে, বাগানে ফুলের চেয়ে আগাছাই বেশি। ওদিকে তাকিয়ে দেখো, রাজবাড়ির মাঠে কিছু চাষবাস হচ্ছে। দীপনারায়ণ বলেছিলেন, লাখ পাঁচেক টাকা ধার ঝুলছে মাথার ওপর। দেখছি, সত্যিই তাই।”

কিকিরা খেয়াল করেননি, তারাপদও নয়, হঠাৎ পেছন থেকে কার যেন গলা শোনা গেল। মুখ ফিরিয়ে তাকালেন কিকিরা। তাকিয়ে অবাক হলেন। যাত্রাদলের শকুনির মতন চেহারা, রোগা লিকলিকে শরীর, মাথার চুল সাদা, পাটের মতন রঙ, তাও আবার বাবরি করা, গর্তে ঢোকা চোখ, ধূর্ত দৃষ্টি, পরনে ধুতি, গায়ে ফতুয়া আর চাদর। খুব বিনয়ের সঙ্গে নমস্কার করে সেই শকুনির মতন লোকটা বলল, “আমার নাম শশধর সিংহ। রাজবাড়ির কর্মচারী। আসুন আপনারা, বিশ্রাম স্নান সেরে খাওয়া-দাওয়া করুন। আপনাদেরই অপেক্ষা করছিলাম। আসুন।”

রাজবাড়ির অতিথিশালা; ব্যবস্থা সবই রয়েছে–খাট, বিছানা, আয়না, ড্রয়ার, যা যা প্রয়োজন। এক সময় ঘরের শোভা ছিল, ঝকমকে ভাব ছিল বোঝ যায়–এখন সেই শোভার অনেকটা নষ্ট হয়ে গেছে। তবু যা আছে–তেমন পেলেই তারাপদর মতন মানুষরা বর্তে যায়।

পাশাপাশি দুটো ঘর ব্যবস্থা করা ছিল কিকিরাদের। স্নান-টানের ঘর সামনেই, শোবার ঘরের গায়ে-গায়ে। খাবার ব্যবস্থা খাবার ঘরে।

শশধর ছিল না। কিকিরা এক সময়ে তারাপদকে বললেন, “কেমন লাগছে শশককে?”

“শশক? কে শশক?”

“ওই শশধরকে?”

তারাপদ বলল, “সুবিধের লাগছে না।”

“ওর বাঁ হাতে ছ’টা আঙুল লক্ষ করেছ?”

“না।” তারাপদ অবাক হয়ে বলল।

“লক্ষ করো। যতটা পারবে লক্ষ করবে।…বাঁ হাতের আঙুল ছ’টা; কানের লতিতে ফুটো, বোধ হয় এক সময় মাকড়ি পরত।”

“পুরুষমানুষ মাকড়ি পরবে কেন?”

“অনেক জায়গায় পুরুষমানুষও মাকড়ি পরে। এদের বোধ হয় রাজবংশের ব্যাপার–পারিবারিকভাবে পরতে হত আগে, এখন ছেড়ে দিয়েছে “

“শশধর কি রাজবংশের লোক?”

“পদবী সিংহ বলল, সিং সিংহ হতে পারে। রাজবংশের সরাসরি কেউ নয় হয়ত-তবে সম্পর্ক থাকা স্বাভাবিক। যাক গে, নাও; আর দেরি করো না। স্নানটান করে নাও। খিদে পেয়ে গেছে বড়।”

স্নান খাওয়া-দাওয়া সেরে কিকিরা আর তারাপদ যে-যার ঘরে শুয়ে পড়লেন। তখন শীতের দুপুর ফুরিয়ে আসছে।

অবেলায় খাওয়া-দাওয়ার পর বিছানায় গড়ানো মানেই ঘুম। তার ওপর কাল ট্রেনে রাত কেটেছে। কিকিরা যখন তারাপদকে ডাকলেন তখন শীতের বিকেল বলে কিছু নেই, ঝাপসা অন্ধকার নেমে এসেছে।

মুখে চোখে জল দিয়ে চা খেল তারাপদ কিকিরার সঙ্গে। তারপর অতিথিশালার বাইরে এসে পায়চারি করতে লাগল। সন্ধের আগেই শীতের বহরটা বোঝা যাচ্ছিল, রাত্রে যে কতটা ঠাণ্ডা পড়বে তারাপদ কল্পনা করতে পারল না।

এমন সময় শশধর আবার হাজির। পোশাক-আশাক খানিকটা অন্যরকম। লম্বা কোতার ওপর জ্যাকেট, তার ওপর চাদর। পায়ে ক্যানভাস জুতো।

শশধর সদালাপী মানুষের মতন হাসল, বিনয় করে জিজ্ঞেস করল, কোথাও কোনো অসুবিধে হচ্ছে কি না! তারপরে বলল, “দু বার এসে ফিরে গিয়েছি, আপনারা ঘুমোচ্ছিলেন। রাজাসাহেব বলেছেন, আপনারা জেগে উঠলে তাঁকে খবর দিতে।”

কিকিরা চুরুট টানতে-টানতে বললেন, “খবর দিন।”

“উনি নিচেই আছেন, দেখা করতে চাইলে চলুন।”

“অপেক্ষা করছেন?”

“না, অপেক্ষা করছেন না; শরীর ঠিক রাখার জন্য এ-সময় তিনি ভেতরের লনে একটু টেনিস খেলেন।”

“বাঃ বাঃ! কার সঙ্গে খেলেন?”

“ছেলের সঙ্গে।”

“আচ্ছা–আচ্ছা। তা চলুন দেখা করে আসি। এখন রাজাসাহেব নিশ্চয় বিশ্রাম করছেন?”

“আসুন।”

শশধরের সঙ্গে কয়েক পা মাত্র এগিয়েই কিকিরা বললেন, “ওহে, একটু দাঁড়ান শশধর, আমি আসছি।” বলেই কিকিরা অতিথিশালার দিকে চলে গেলেন।

শশধর কিকিরার দিকে তাকিয়ে থাকল কয়েক মুহূর্ত। তারপর তারাপদর দিকে তাকিয়ে বলল, “ওঁর নামটা যেন কী বলেছিলেন তখন–?”

“কিঙ্করকিশোর রায়।”

“আপনার?”

 নাম বলল তারাপদ।

শশধর বললেন, “বইপত্রের ব্যবসা করেন আপনারা?”

“ওল্ড বুকস্ অ্যান্ড পিকচার্স।” তারাপদ মেজাজের সঙ্গে বলল।

“দোকানটা কোথায় মশাই?”

তারাপদ ঘাবড়ে গেল। এরকম একটা আচমকা প্রশ্ন সে আশাই করেনি। কিন্তু যার দোকান রয়েছে সে দোকানের ঠিকানা বলতে পারবে না–এ কেমন কথা? তারাপদ ধরা পড়ে যেতে যেতে কোনোরকমে সামলে নিয়ে কিকিরার বাড়ির ঠিকানা বলল। নিজের ঠিকানাটাই বলত–শেষ সময়ে বুদ্ধি খেলে গেল মাথায়–গঙ্গাচরণ মিত্তির লেন বললেই কেলেঙ্কারি হত; দোকানের ঠিকানায় লেন-টেন’ মানে গলিখুঁজি থাকলেই ইজ্জত চলে যেত।

“জায়গাটা কোথায়?” শশধর জিজ্ঞেস করল ছোট ছোট চোখ করে।”

“পার্কসার্কাস।”

“আপনার দোকান? না ওই ভদ্রলোকের?”

“ওঁর। আমি কাজ করি।”

শশধর পকেট থেকে রুমাল বের করে নাক ঝাড়ল। চতুর চোখে চেয়ে থাকতে থাকতে বলল, “আপনার মনিব লোকটি ভালই, কর্মচারীকে আদর-যত্ন করে দেখছি।”

তারাপদ বুঝতে পারল গোলমেলে ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে। শশধর ধূর্ত, তাকে ধাপ্পা দিয়ে পার পাওয়া সহজ নয়। কথা ঘোরাবার জন্যে সে বলল, “জায়গাটা বেশ ভাল। এদিকে কতদিন শীত থাকে?”

“থাকবে। আরও মাসখানেক।”

কিকিরা আসছিলেন। তারাপদ কিকিরাকে দেখতে পেয়ে যেন বেঁচে গেল।

কাছে এসে কিকিরা বললেন, “সিংহীমশাই, অপনাদের গেস্টরুমের দরজাগুলো কোন্ কাঠের?”।

শশধর ঠিক বুঝতে পারল না। “আজ্ঞে?”

“শাল না সেগুন কোন্ কাঠের বলুন তো?”

“শাল কাঠের। আপনি দরজা দেখতে গিয়েছিলেন?”

“দরজা দেখতে কি কেউ যায়, মশাই? গিয়েছিলুম চশমা আনতে। আমি আবার রাতকানা–নাইট ব্লাইন্ড। সন্ধে হলে কি আমি অন্ধ হয়ে গেলুম একরকম।” বলে কিকিরা হাতে রাখা চশমার খাপ দেখালেন।

শশধর বলল, “এখন অন্ধকার হয়ে গেছে। দেখছেন কেমন করে?”

“কই আর দেখছি! ঝাপসা ঝাপসা দেখছি। আপনাকে ভাসা ভাসা দেখতে পাচ্ছি। এইবার চশমাটা পরব।”

কিকিরা খাপ খুলে একটা নিকেল ফ্রেমের চশমা বের করে পরতে লাগলেন। তারাপদ কোনোদিন কিকিব্রাকে চশমা পরতে দেখেনি। বুঝতে পারল না কোন মতলবে কিকিরা ঘরে গিয়েছিলেন, কেনই বা চশমা নিয়ে ফিরলেন।

তিনজনেই হাঁটতে লাগল আবার। হঠাৎ কোথা থেকে যেন কুকুরের ডাক শোনা গেল। সাধারণ ডাক নয়, গর্জনের মতন। রাজবাড়ির দিক থেকে প্রথমে একটা পরে যেন একদল কুকুরের ভয়ংকর ডাক শোনা যেতে লাগল। তারাপদ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।

শশধর বিনীতভাবেই বলল, “ইন্দরবাবুর কুকুর। ভয় নেই।”

.

০৪.

কিকিরাদের দীপনারায়ণের কাছে পৌঁছে দিয়ে শশধর চলে গেল।

রাজবাড়ির নিচের তলায় একসারি ঘরের মধ্যে তারাপদরা যে-ঘরটায় এসে বসল সেটা ঠিক বসার ঘর নয়, বসা এবং অফিস করা–দুই যেন চলতে পারে। বেশ বড় মাপের ঘর, মস্ত মস্ত দরজা জানলা মেঝেতে কার্পেট পাতা, আসবাবপত্র সাবেকি এবং ভারী ধরনের। রাজবাড়িতে ইলেকট্রিক নেই, ডিজ ল্যাম্প, পেট্রমাক্স, হ্যাঁজাক-এইসব জ্বলে।

দীপনারায়ণ বসতে বললেন কিকিরাদের।

 কিকিরা ঘরের চারদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন, তারপর বসলেন। তারাপদ বোকার মতন দাঁড়িয়েছিল, কিকিরাকে বসতে দেখে বসে পড়ল।

 দীপনারায়ণ বললেন, “গাড়িতে আপনাদের কোনো কষ্ট হয়নি তো?”

মাথা নাড়লেন কিকিরা। “না, আরামেই এসেছি। জিপ গাড়িতে খানিকটা সময় লাগল।”

“অনেকটা দূর। জঙ্গলের রাস্তা।”

তারাপদ নজর করে দীপনারায়ণকে দেখছিল। কলকাতায় সেদিন কয়েক মুহূর্তের জন্যে যাকে দেখেছিল–সেই মানুষই সামনে বসে আছেন–তবু আজ অন্যরকম লাগছে। দীপনারায়ণ সুপুরুষ, গায়ের রঙ উজ্জ্বল, চোখমুখ পরিষ্কার, সুশ্রী, মাথার চুল পাতলা, শরীর স্বাস্থ্য দেখলে মনে হয় চল্লিশের বেশি বয়েস। অথচ কিকিরা বলেছেন, দীপনারায়ণের বয়েস পঞ্চাশ। দেখতে ভাল লাগে মানুষটিকে। ভদ্র, নিরহঙ্কার ব্যবহার।

দীপনারায়ণ কিকিরার সঙ্গে আরও দু-একটা কী যেন সাধারণ কথা বললেন, তারাপদ খেয়াল করে শুনল না।

কলকাতায় ঠাকুর বিসর্জন কিংবা মারোয়াড়ি বিয়ে-টিয়েতে তাসা পার্টি সঙ্গে যেমন গ্যাস বাতি নিয়ে আলোর মিছিলদাররা চলে তাদের হাতে থাকে বাহারি বাতি–সেই রকম একটা বাতি ঘরের একপাশে জ্বলছিল। আজকাল এরকম বাতি কলকাতাতেও কম দেখা যায়, আগে যেত। কার্বাইডের আলো, কিন্তু অন্য ধাঁচের; চারদিক থেকে চারটে সরু সরু নল বেরিয়ে চারদিক ঘিরে রেখেছে, মুখ খোলা কাচের শেড, আলোর শিখা যেন কাচে না লাগে। মাত্র দুটি নলের মুখে শিখা জ্বলছিল, অন্য দুটো নেবানো। শিখাও কমানো রয়েছে। ঘরে কার্বাইডের সামান্য গন্ধ।

দীপনারায়ণ বললেন, “এবার কাজের কথা হোক, কিংকরবাবু?”

“বলুন।”

“আমি আপনাদের কথা বলে রেখেছি। তিনজনের কথাই। দুজনে এসেছেন।”

“আর একজন পরশু নাগাদ আসবে।”

“আমারও তাই বলা আছে।…আমি বলেছি, আপনারা এই রাজবাড়ির লাইব্রেরির ছবি আর বইয়ের ভ্যালুয়েশান করতে আসছেন। যদি দর-দস্তুরে পোষায় আপনারা কিছু কিনতে পারেন। নয়ত কলকাতায় ফিরে গিয়ে আপনারা পার্টি জোগাড় করবেন, বিক্রি বাটা হয়ে গেলে কমিশন পাবেন। ভ্যালুয়েশান করার জন্যে ভ্যালুয়ার হিসেবে আপনারা রাজবাড়িতে অতিথি হিসেবে থাকবেন, আর কাজ শেষ হয়ে গেলে দু হাজার টাকা পারিশ্রমিক পাবেন।…বোধ হয় ঠিক বলেছি, কী বলেন?”

কিকিরা বললেন, “ঠিকই বলেছেন।”

তারাপদ হঠাৎ বলল, “শশধরবাবু আমায় কতগুলো কথা জিজ্ঞেস করছিলেন।”

দীপনারায়ণ তারাপদর দিকে তাকালেন, কিকিরাও।

একটু আগে যে-সব কথা হয়েছে শশধরের সঙ্গে, তারাপদ তা বলল।

কিকিরা বললেন, “যা বলেছ ঠিকই বলেছ। আবার কিছু জিজ্ঞেস করলে বলো, হিসেব তৈরি করা চিঠি লেখা এইসব কাজগুলো তুমিই করো, আমি ও-সব করতে পারি না।”

ঘাড় নাড়ল তারাপদ।

কিকিরা দীপনারায়ণকে বললেন, “আমায় ক’টা কথা বলতে হবে দীপনারায়ণবাবু।”

“বলুন।”

“তার আগে আরও একটা কথা আছে। কেউ যদি আপনাকে জিজ্ঞেস করে রাজবাড়ির ছবি বই–এ-সব কেন আপনি বেচে দিতে চাইছেন তার জবাব কী হবে?”

দীপনারায়ণ তাঁর সিগারেটের কেস থেকে একটা সিগারেট তুলে নিয়ে কেসটা কিকিরার দিকে বাড়িয়ে দিলেন।

কিকিরা সিগারেট নিলেন না।

দীপনারায়ণ সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে বললেন, “কেউ জিজ্ঞেস করবে না। বিক্রি করার অধিকার আমার আছে। তবু যদি জিজ্ঞেস করে, তার জবাব আমার তৈরি আছে।”

“সেটা জানতে পারি?”

“পারেন। পুরনো ছবি কিংবা বই আমি বুঝি না। আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই। জয়নারায়ণ কিছু কিছু বুঝত। তার ভালও লাগত। জয়নারায়ণ ছাড়া লাইব্রেরি ঘরে এবাড়ির কেউ পা দিত না। সে যখন নেই, লাইব্রেরি সাজিয়ে রাখা অকারণ।” দীপনারায়ণ একটু থেমে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন–দরজার দিকে পরদা নড়ে উঠল। তিনি চুপ করে গেলেন।

মাঝবয়সী একটা লোক এসে কফি দিয়ে গেল।

লোকটা চলে যেতে দীপনারায়ণ বললেন, “জয় নেই এটা একটা কারণ। আর অন্য কারণ হল, আমাদের অবস্থা। আপনাকে আমি আগেই কলকাতায় বলেছি–আমাদের অবস্থা পড়ে গেছে, জমি-জায়গা হাতছাড়া হয়েছে আগেই, জঙ্গল-টঙ্গল এখন সরকারি সম্পত্তি, আমাদের একটা ক্লে মাইন ছিল–সেটা নানা ঝামেলায় বেচে দিতে হয়েছে লাখ পাঁচেক টাকা ধার। মামলা মোকদ্দমায় বছরে হাজার দশ পনেরো টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে এখনো।“

তারাপদ বেশ অবাক হচ্ছিল। রাজরজাড়া মানুষ–তারও টাকা-টাকা চিন্তা। তা হলে আর তারাপদ কোন দোষ করল। দীপনারায়ণ মানুষটিকে ভালই লাগছিল তারাপদর, কেমন খোলামেলাভাবে সব কথা বলে যাচ্ছেন।

কফি নিতে বললেন দীপনারায়ণ।

 কিকিরা কাপে চিনি মেটাতে মেশাতে বললেন, “এবার আমায় অন্য কয়েকটা কথা বলুন।”

দীপনারায়ণ জবাব দেবার জন্যে তাকিয়ে থাকলেন।

“রাজবাড়িতে কে কে থাকেন? মানে আপনাদের পরিবারের?”

“আমাদের এই বাড়ির তিনটে মহল। কাকার, আমার আর জয়নারায়ণের।”

“মহলগুলো কেমন একটু বলবেন?”

“কাকা থাকেন পুবের মহলে, জয় থাকত মাঝ-মহলে, আর আমি পশ্চিম মহলে…।”

“নিচের মহলে কারা থাকে?”

দীপনারায়ণ কালো কফিতে চিনি মিশিয়ে কাপটা তুলে দিলেন।”নিচের মহলের এই সামনের দিকটা আমাদের অফিস কাছারি, বাইরের লোকজন এলে বসাটসা, লাইব্রেরির জন্যে রাখা আছে। বাবার আমল থেকেই। ভেতর দিকে আমরা সকলেই ওপর আর নিচের মহল যে যার অংশ মতন ব্যবহার করি। শুধু নিচের একটা দিক রাজবাড়িতে যারা কাজ করে তাদের থাকার জন্যে।”

কফি খেতে খেতে কিকিরা বললেন, “আপনার কাকা কি একা থাকেন?”

“না। কাকিমা জীবিত রয়েছেন। কাকার প্রথমা স্ত্রীর ছেলে আমার খুড়তুতো ভাই এখানে থাকে না। সে আসামে থাকে। ডাক্তার। দ্বিতীয় স্ত্রীর একটি মেয়ে। সে বোবাহাবা। সে এখানেই থাকে। তার বিয়ে হয়নি। কাকিমার এক ছোট ভাই, সেও থাকে কাকার কাছে।”

“ছোট ভাইয়ের নাম?”

“ইন্দর।”

“কী করে?”

“কিছু করে না। ভাল শিকারি। খায় দায় ঘুমোয় আর কুকুর পোষে।”

“কুকুর পোষে?”

“কুকুরের শখ ওর। পাঁচ-সাতটা কুকুর এনে রেখেছে। একেবারে জংলি। চেহারা দেখলে ভয় করে। বুনো কুকুর, অ্যালসেশিয়ান কিংবা টেরিয়ারের চেয়ে কম নয়।”

তারাপদ ভয়ে ভয়ে বলল, “খানিকটা আগে আমরা কুকুরের ডাক শুনেছি।”

“ইন্দরের একটা কুকুর-ঘর আছে। কুকুরদের মাঝে মাঝে হান্টার কষায়। বলে ট্রেনিং দিচ্ছে।”

কিকিরা কুকুরের কথা কানেই তুললেন না যেন, বললেন, “আপনার পরিবারের কে কে আছেন দীপনারায়ণবাবু?”

দীপনারায়ণ সামান্য চুপ করে থেকে বললেন, “আমার মা শয্যাশায়ী, পঙ্গু। স্ত্রী মারা গেছেন। বড় ছেলে দেরাদুন মিলিটারি কলেজে। ছোট ছেলে সিবাস্টিন কলেজে পড়ে, মাদ্রাজের কাছে। এখন সে ছুটিতে। এখানেই রয়েছে।”

“জয়নারায়ণবাবুর কে কে আছেন?” কিকিরা জিজ্ঞেস করল।

“জয়ের স্ত্রী রয়েছেন। একটি ছোট মেয়ে, বছর চার বয়েস। এখন এঁরা নেই, ভুবনেশ্বর গিয়েছেন।”

কফির পেয়ালা নামিয়ে রেখে কিকিরা যেন কিছুক্ষণ কিছু ভাবলেন। তারপর বললেন, “শশধর কি আপনাদের দূর সম্পর্কের কোন আত্মীয়?”

“না”, মাথা নাড়লেন দীপনারায়ণ, “এ বাড়িতে পঁচিশ ত্রিশ বছর রয়েছে। বাবার আমলের কর্মচারী। অনুগত।”

“এই লোকটাকে আপনার সন্দেহ হয় না?”

দীপনারায়ণ তাকালেন কিকিরার দিকে। সামান্য পরে বললেন, “এত দুঃসাহস ওর হবে? শুনেছি, বাবা ওকে প্রাণে বাঁচিয়েছিলেন।”

“কেন?”

“আমি জানি না।”

“ইন্দর লোকটাকে আপনি সন্দেহ করেন?”

“করি। ও একটা জন্তু। অথচ জয় ওকে পছন্দ করত। বন্ধুই ছিল জয়ের।”

কিকিরা আবার চুপ করে থাকলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, “দীপনারায়ণবাবু, আপনি কি সত্যি-সত্যিই বিশ্বাস করেন, আপনাদের রাজবাড়িতে যে ছোরাটা ছিল তার কোনো জাদু আছে?”

দীপনারায়ণ বললেন, “করি। হয়ত এটা আমাদের সংস্কার। বিশ্বাস। কোনো প্রমাণ তো দেখাতে পারব না কিংকরবাবু!”

কিকিরা আর কিছু বললেন না।

.

০৫.

তিন চারটে দিন দেখতে দেখতে কেটে গেল। চন্দনও এসে পড়েছে। তারাপদরা যেভাবে এসেছিল সেই ভাবেই। জিপ গিয়েছিল চন্দনকে আনতে, সঙ্গে ছিল তারাপদ। দশরথ আর জোসেফের সামনে দুই বন্ধু কেউই মুখ খোলেনি, অন্য পাঁচ রকম গল্প করেছিল, কখনো কখনো সাঁটে কথা বলছিল।

চন্দন বুঝতে পারল, কিকিরা কোনো দিকেই এগুতে পারেননি.; লাইব্রেরি ঘরে বসে বসে দিন কাটাচ্ছেন আর চুরুট যুঁকছেন, কাগজ-পেনসিল নিয়ে অকারণে লিস্টি করছেন। চন্দন মনে মনে একটু যেন খুশিই হল, কিকিরা এবার জব্দ হয়েছেন। বললে শোনেন না, কোথাকার কোন্ দীপনারায়ণ গিয়ে এক গাঁজা ছাড়ল, আর এক অন্তর্যামী রামপ্রসাদ কী বলল-কিকিরা অমনি নাচতে নাচতে ছুটে এলেন এবয়সে এ-সব পাগলামি করলে কি চলে!

এ-সব দিকে চন্দনও আগে আসেনি। বেড়াতে আসার পক্ষে জায়গাটা নিঃসন্দেহে ভাল। তবে কখনো কখনো ঘন জঙ্গল দেখে তার মনে হচ্ছিল, সিনেমার ছবিতে আফ্রিকার জঙ্গল বলেও এটা চালিয়ে দেওয়া যায়।

.

গেস্ট হাউসে পৌঁছে কিকিরার সঙ্গে দেখা হল। বললেন, “এসো এসো স্যান্ডাল উড, তোমার জন্যেই হাঁ করে বসে আছি।”

চন্দনহেসে বললে, “শুনলাম তাই তারার কাছে, বসে আছেন, উঠে দাঁড়াতে পারছেন না।”

“এখনো পারিনি।”

“পারবেন বলে মনে হয়?”

“দেখা যাক। তুমি আমার জিনিস এনেছ?”

“এনেছি।” বলে চন্দন চোখের ইশারায় তারাপদকে দেখাল, বলল, “তারা জানে?”

“না।”

 চন্দন বলল, “সে কী? তারা জানে না?” তারাপদর দিকে তাকাল চন্দন। “কিকিরা আমায় খানিকটা কুকুর-বিষ আনতে বলেছিলেন–জানিস। সিক্রেট মেসেজ। খামের ওপর ছোট্ট করে লিখেছেন–ব্রিং ডগ পয়জন তার ওপর স্ট্যাম্প মেরে দিয়েছেন। কার বাবার সাধ্যি ধরে। স্ট্যাম্প না তুললে দেখা যাবে না।”

তারাপদর মনে পড়ল, হাওড়া স্টেশন ছাড়ার আগে কিকিরা চন্দনকে এই ম্যাজিকটা বলে দিচ্ছিলেন। বলেছিলেন, চিঠি মতন কাজ করা, কোনো স্পেশ্যাল মেসেজ থাকলে ওই কায়দায় জানাব।

তারাপদ কিকিরার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল, বুঝতে পারল না কুকুর-বিষ কী কাজে লাগবে। কুকুর মারবেন নাকি কিকিরা? কিকিরাও কিছু বললেন না।

স্নান খাওয়া-দাওয়া সেরে চন্দন এসে তারাপদর ঘরে শুয়ে পড়ল। চন্দনের জন্যে একটা বাড়তি খাট তারাপদর ঘরে ঢোকানো হয়েছে। আলাদা ঘর অবশ্য ছিল কিন্তু চাকরবাকরকে বলে কয়ে একই ঘরে দু জনের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে।

সিগারেট ধরিয়ে বিছানায় শুয়ে চন্দন বলল, “বল, এবার তোদের গোয়েন্দাগিরি শুনি।”

তারাপদ রাজবাড়ির একটা বর্ণনা ও বিবরণ দিল। কারা থাকে, কে কী করে, কার কার ওপর আলাদা করে নজর রাখার চেষ্টা করছেন কিকিরা, সে-সব বৃত্তান্তও বলল। শেষে তারাপদ হতাশ গলায় বলল,”আমাদের কী কাজ হয়েছে জানিস এখন?”

 “কী?”

“সকাল বেলায় চা-টা খেয়ে এক দিস্তে কাগজ, এক বান্ডিল পুরনো ক্যাটালগ, গোটা তিনেক ছোট বড় ম্যাগনিফায়িং গ্লাস, কার্বন পেপার, পেনসিল নিয়ে লাইব্রেরিতে ঢোকা। বেলা বারোটা পর্যন্ত ওই ঘরে বসে থাকতে হয়। স্নান খাওয়া-দাওয়ার জন্যে ঘণ্টা দেড়েক ছুটি। আবার যাই, সারাটা দুপুর কাটিয়ে ফিরি।”

“করিস কী?”

“ঘোড়ার ডিম। বইয়ের নাম লিখি সাদা কাগজে। মাঝে মাঝে পাতা ওলটাই। বই ঘাঁটি।”

“কিকিরা কী করেন?”

“বায়নাকুলার চোখে দিয়ে এ-জানালা সে-জানালা করে বেড়ান মাঝে মাঝে। আর মন্ত-মস্ত ছবিগুলো দেখেন কখনো-সখনো চুরুট ফোঁকেন। খেয়াল হলে বই দেখেন।”

“তার মানে–তোরা বসে বসে ভেরাণ্ডা ভাজছিস?”

“পুরোপুরি!..তবে একটা কথা সত্যি চাঁদু, টাকা থাকলে বড়লোকদের শখ যে কেমন হয়–তুই রাজবাড়ির লাইব্রেরি দেখলে বুঝতে পারবি। এক-একটা ছবি আছে–দেখলে মনে হবে দেওয়ালসাইজের, এত বড়। বইয়ের কথাই বা কী বলব! গাদা গাদা বই নানা ধরনের, অর্ধেক বইয়ের পাতাও কেউ ছোঁয়নি। শুধু শখ করে মানুষ এত টাকা খরচ করে তুই না দেখলে বিশ্বাস করবি না।”

চন্দনের ঘুম আসছিল। জড়ানো চোখে আলস্যের গলায় বলল, “দুর–তোরা ফালতু এসেছিস। একটা অ্যাডভেঞ্চার গোছের কিছু হলেও বুঝতাম।”

তারাপদ একটু চুপ করে থেকে বলল, “আমাদের ওপর এরা চোখ রেখেছে।”

“কাবা?”

“শশধররা। প্রথম দিন আমরা যখন দীপনারায়ণের সঙ্গে দেখা করতে যাই–আমাদের ঘরে কেউ ঢুকেছিল। কিকিরার মনে সন্দেহ হয়, আমরা যখন থাকব না–কেউ ঘরে ঢুকতে পারে। তিনি দরজা বন্ধ করার পর কতকগুলো দেশলাইকাঠি চৌকাঠে সাজিয়ে রেখেছিলেন। দরজা খুলে ঢুকতে গেলেই পা লাগার কথা। দীপনারায়ণের কাছ থেকে ফিরে এসে আমরা দেখলাম, কাঠিগুলো ছড়িয়ে রয়েছে।” তারাপদর মনে পড়ল, কিকিরা চশমা আনার ছুতো করে সেদিন কেমন ভাবে কাঠি সাজিয়ে এসেছিলেন।

চন্দন ঘুম-ঘুম চোখে বলল, “আর কিছু নয়?”

তারাপদ বলল, “সন্ধের পর এখানে থাকা যায় না। ঘুটঘুট করছে অন্ধকার। শীতও সেই রকম। যত রাত বাড়ে, হাত পা একেবারে জমে যায়। তার ওপর এখানে কত কী যে হয়, চাঁদ! এ একটা ভুতুড়ে জায়গা। পাঁচ সাতটা কুকুর রাত্তিরে মাঠের মধ্যে ছুটে বেড়ায়, একবার ডাকতে শুরু করল তো সে কী ডাক ভাই, বুক কেঁপে যায়। ইন্দর বলে একটা লোক আছে রাজবাড়িতে, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, গাল-ভরা দাড়ি, ছুরির মতন চোখ; সে আবার মাঝে মাঝে ঘোড়া ছুটিয়ে ঘুরে বেড়ায়, সঙ্গে কুকুর। মোটরবাইক চালায় ঝড়ের মতন। একদিন তো আমার ঘাড়ে এসে পড়েছিল প্রায়।”

চন্দন কিছুই শুনছিল না। ঘুমিয়ে পড়েছিল।

.

দুপুরে কিকিরা লাইব্রেরিতে যাননি, তারাপদও নয়। বিকেলে চন্দনকে নিয়ে বেড়াতে বেরোলেন কিকিরা, সঙ্গে তারাপদ। রাজবাড়ির চৌহদ্দিটাই ঘুরে দেখাচ্ছিলেন কিকিরা। সেটা কম নয়। উঁচু পাঁচিল দিয়ে চারপাশ ঘেরা। একটা মাত্র বড় ফটক। চারদিকে মস্ত মাঠ, বড় বড় গাছ সারি করে সাজানো, একপাশে ফুলবাগান, চৌকোনা বাঁধানো পুকুরটা পশ্চিমদিকে, তারই কাছাকাছি মন্দির। এ-সব হল মূল রাজবাড়ির বাইরে, মুখোমুখি। রাজবাড়িতে ঢোকার মুখে আবার এক মস্ত লোহার ফটক। অবশ্য রাজবাড়ির বাইরের দিকের ঘর, বারান্দা সবই দেখা যায়। বাইরের দিকটায় বাইরের মহল, রাজবাড়ির কাউকে বড় একটা দেখাও যায় না।

বেড়াতে বেড়াতে চন্দন নানারকম প্রশ্ন করছিল। কিকিরা জবাব দিচ্ছিলেন। তারাপদও কথা বলছিল। চন্দন বুঝতে পারছিল, এক সময়ে রাজবাড়ির শখ-শৌখিনতা কম ছিল না, অর্থব্যয়ও হত অজস্র। এখন পড়তি অবস্থা। যা আছে পড়ে রয়েছে; কারও কোনোদিকে চোখ নেই, অর্থও নেই। যদি অর্থ এবং শখ-শৌখিনতা থাকত, তবে জাল দিয়ে ঘেরা, গোল, অত বড় পাখি-ঘরটায় মাত্র একটা ময়ুর পঁচিশ-ত্রিশটা পাখি থাকত না, আরও অজস্র পাখি থাকতে পারত। অমন সুন্দর পুকুরের কী অবস্থা! পাথর দিয়ে বাঁধানো পুকুরের চারপাশের পথের কী বিশ্রী হাল হয়েছে। বাঁধানো পুকুর, কিন্তু তার জলের ওপর শ্যাওলা আর শালুক-পাতা, জল চোখেই পড়ে না প্রায়। মন্দিরটা অবশ্য কোনোরকমে চকচকে করে রাখা হয়েছে। সকালে পুরোহিত এসে পুজোটুজো করেন, সন্ধেবেলায় আরতি হয়, অন্য সময় মন্দিরের দরজা বন্ধ থাকে।

চন্দনরা যখন পুকুরের কাছে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আচমকা শশধরকে দেখা গেল। গোলমতন একটা লতাপাতা-ঘেরা জায়গার পাশ দিয়ে বেরিয়ে এল।

নজরে পড়েছিল কিকিরার। দাঁড়িয়ে পড়লেন।

 শশধর এগিয়ে এল।

শশধর কাছে এলে কিকিরা বললেন, “এদিকে কোথায় সিংহীমশাই?”

শশধর বলল, “ওদিকে গিয়েছিলাম। যন্ত্রপাতি খারাপ হয়ে গেলে মেরামতের যা হাল হয়–” বলে শশধর অনেকটা দূরে রাখা একটা ছোট ট্রাকটর দেখাল।

চন্দনের সঙ্গে শশধরের আলাপ করিয়ে দিলেন কিকিরা।”তারাপদর বন্ধু। ওর সঙ্গে আপনার আলাপ হয়নি।”

শশধর বলল, “দুপুরে আমি ছিলাম না। উনি আসছেন শুনেছিলাম।”

“ছেলেটি বড় কাজের সিংহীমশাই। বয়স কম, কিন্তু চোখ বড় পাকা। পুরনো জিনিস ঠাওর করা মুশকিল, আসল নকল বোঝা যায় না। চন্দন এসব ব্যাপারে পাকা লোক। ঠিক জিনিসটি ধরতে পারে। কলকাতার মিউজিয়ামে চাকরি করে করে চোখ পাকিয়ে ফেলেছে।”

শশধর ধূর্তের মতন বলল, “আপনার দলের লোক?”

কিকিরা ঘাড় নেড়ে হাসি মুখে বললেন, “ধরেছেন ঠিক।…আমার যখনই কোনো ব্যাপারে সন্দেহ হয়, ওকে ডেকে পাঠাই, সে ছবিই বলুন বা দু-একশো বছরের পুরনো কিছু জিনিস হলেই। আপনাদের রাজবাড়িতে কত যে জিনিস আছে সিংহীমশাই যার মূল্য আপনারাও বোঝেন না। চন্দনের আবার এসব ব্যাপারে বড় শখ। চোখে দেখলেও ওর শান্তি। বড় গুণী ছেলে ভাল কথা, আপনি কি কোনো দৈবচক্ষুর কথা শুনেছেন?”

“দৈবচক্ষু?”

“আছে। এই রাজবাড়িতেই আছে।” কিকিরা বললেন।

শশধর আর দাঁড়াল না। বলল, “উনি আছেন; পরে আলাপ করব। আমি যাই।”

শশধর চলে গেল। কিকিরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলেন কিছুক্ষণ। তারপর চন্দনদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, “এই শশধরটাকে আমি প্রায়ই এই পুকুরের দিকটায় ঘোরাফেরা করতে দেখি! কী ব্যাপার বলো তো?”

চন্দন বলল, “সে তো আপনিই বলবেন!”

মাথা নেড়ে কিকিরা বললেন, “না, লোকটা মিছেমিছি এদিকে ঘুরে বেড়াবার পাত্র নয়। কিছু রহস্য আছে।” বলে কিকিরা চুপ করে গিয়ে কিছু যেন ভাবতে লাগলেন, চারদিক দেখতে লাগলেন তাকিয়ে-তাকিয়ে।

চন্দন বলল, “কিকিরা স্যার, আমার মনে হচ্ছে আপনিই বেশি রহস্যময়।”

“কেন?”

“আপনি এখানে বসে বসে যে কী করছেন আমি বুঝতে পারছি না। তারা বলছিল, আপনি রোজ সকালে এক দফা, আর দুপুরে এক দফা তারাকে সঙ্গে করে লাইব্রেরিতে গিয়ে বসে থাকেন। মাত্র দু বার দীপনারায়ণের সঙ্গে। আপমার দেখা হয়েছে এ পর্যন্ত।”

কিকিরা একবার তারাপদকে দেখে নিয়ে চন্দনকে বললেন, “লাইব্রেরিতে আমি বসে থাকি না চন্দন, বসে বসে দেখি-সব দেখি, অবজার্ভ করি। আমার একটা বায়নাকুলার আছে, তারাপদ তোমায় বলেনি?”

“বলেছে?”

“লাইব্রেরির পজিশনটা খুব ভাল। বড় বড় জানলা, স্কাই লাইট। দূরবীন চোখে লাগিয়ে বসে থাকলে ভেতর আর বাইরের অনেক কিছু দেখা যায়। শশধরটাকে আমি এদিকে ঘোরাফেরা করতে যে দেখেছি, সে তত ওই দূরবীন চোখে দিয়েই।”

“বেশ করেছেন দেখেছেন। কিন্তু শশধরকে দেখেই দিন কাটাচ্ছেন?”

“না”, মাথা নাড়লেন কিকিরা, “ব্রেন শেক্‌ করছি?”

 চন্দন হাঁ হয়ে গেল। “সেটা কী?”

“মগজ নাড়াচ্ছি”, গম্ভীর মুখে কিকিরা বললেন।

চন্দন প্রথমটায় থমকে গেল, তার পর হো হো করে হেসে উঠল। তারাপদও।

হাসি থামিয়ে চন্দন বলল, “কিছু তলানি পেলেন, স্যার?”

“গট অ্যান্ড নো গাই।”

“তার মানে?”

“পাচ্ছি আবার পাচ্ছিও না। চলো, ঘরে ফিরি, তারপর বলব।”

তিনজন গেস্ট হাউসের দিকে ফিরতে লাগলেন। শীতের বিকেল বলে আর কিছু নেই, অন্ধকার হয়ে আসছিল। আকাশে দু একটা তারা ফুটতে শুরু করেছে। বাতাসও দিচ্ছিল ঠাণ্ডা।

গেস্ট হাউসের কাছাকাছি পৌঁছতে শব্দটা কানে গেল। রাজবাড়ির দিক থেকে একটা গাড়ি বেরিয়ে আসছে। মোটর বাইক। আলো পড়ল। ভটভট শব্দটা কানে গর্জনের মতন শোনাল। যেন ঝড়ের বেগে গাড়িটা রাস্তা ধরে সোজা বড় ফটকের দিকে চলে গেল।

হাত বিশেক দূর থেকে কিকিরা মানুষটিকে দেখতে পেলেন।

ইন্দরের পরনে প্যান্ট, গায়ে সেই চামড়ার কোট, গলা পর্যন্ত বন্ধ। মাথায় একটা টুপিকালো রঙেরই।

যাবার সময় ইন্দর একবার তাকাল। দেখল কিকিরাদের।

 বড় ফটকের কাছে একটু দাঁড়াতে হল ইন্দরকে, বোধ হয় ফটক খোলার জন্য। তারপর বেরিয়ে গেল। তার মোটর বাইকের শব্দ বাতাসে ভেসে থাকল কিছুক্ষণ; শেষে মিলিয়ে গেল।

কিকিরা বললেন, “আজ হল কী? এক সময়ে দুই অবতার?”

 চন্দন কিছু বুঝল না তারাপদও কথা বলল না।

হাঁটতে হাঁটতে কিকিরা বললেন, “ওই যে মানুষটিকে দেখলে চন্দন, ওর নাম ইন্দর। ও শুধু ভটভটি চালাতে পারে যে তা নয়, ওর অনেক গুণ। ঘোড়ায় চড়তে পারে, শিকার করতে পারে, কুকুর পোষে–আবার সার্কাসের রিং মাস্টারদের মতন খেলাও দেখাতে পারে। তবে বাঘ-সিংহর নয়, কুকুরের। ও হল দীপনারায়ণের কাকা ললিতনারায়ণের শ্বশুরবাড়ির লোক। এখানেই থাকে। বছর দশেক ধরে আছে। জয়নারায়ণের চেয়ে বয়েসে ছোট হলেও জয়নারায়ণের খুব ঘনিষ্ঠ ছিল। লোকটাকে দিনের বেলায় দেখলে তুমি বুঝতে পারবে।”

.

০৬.

কিকিরার ঘরে বাতি জ্বালা হয়ে গিয়েছিল। কেরোসিনের টেবিলবাতি, দেখতে কিন্তু সুন্দর, সাদা ঘষা কাচের শেড় পরানো, সরু মতন, চিমনিটা শেডের মাথা ছাড়িয়ে গেছে। গেস্ট হাউসে ঠাকুর চাকর থাকে সব সময়। সন্ধেবেলায় চা দিয়ে গিয়েছে চাকরে।

ঘরের দরজাটা খোলাই রেখেছিলেন কিকিরা, তারাপদকে দরজার কাছাকাছি বসিয়ে রেখেছিলেন পাছে কেউ এসে আড়ি পাতে। মাঝে-মাঝে তারাপদকে দরজার বাইরে গিয়ে দেখে আসতে হচ্ছিল আশেপাশে কেউ ঘোরাঘুরি করছে কিনা!

কিকিরা তাঁর সরু চুরুট ধরিয়ে নিয়ে বললেন, “সমস্ত ব্যাপারটা এবার একবার ভাল করে ভেবে দেখা যাক, কী বলো?”

চা খেতে খেতে মাথা হেলাল চন্দন।

 কিকিরা বললেন, আস্তে গলায়, “সোজা কথাটা হচ্ছে এই মাসখানেক আগে জয়নারায়ণ রাজবাড়িতেই মারা গেছেন। প্রথমে মনে করা হয়েছিল, সেটা দুর্ঘটনা; দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন জয়নারায়ণ। বাইরের লোক এই কথাটাই জানে। কিন্তু জয়নারায়ণের দাদা দীপনারায়ণের পরে সন্দেহ হয়েছে, তাঁর ছোট ভাইয়ের মৃত্যুর কারণ দুর্ঘটনা নয়, কেউ তাকে খুন করেছে। তাই না?”

চন্দন আরাম করে চায়ে চুমুক দিল। দিয়ে সিগারেটের প্যাকেট বার করল।

 কিকিরা বললেন, “প্রশ্নটা হল, জয়নারায়ণকে কেউ খুন করেছে, নাকি তিনি দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন? যে মারা গিয়েছে তাকে আমরা চোখে দেখিনি। মানুষ দুর্ঘটনায় মারা গেলে তার পোস্ট মর্টেম হয়, ডাক্তারেরা অনেক কিছু বলতে পারে। এখানে কোনোটাই হয়নি। কাজেই কিছু জানার বা সন্দেহ করার প্রমাণ আমাদের নেই। তবু মানুষের মন মানতে চায় না; তার সন্দেহ বলল, ধোঁকা বলল, থেকে যায়। দীপনারায়ণের মনে একটা ঘোরতর সন্দেহ জন্মেছে, জয়নারায়ণকে কেউ খুন করেছিল।”

তারাপদ চন্দনের দেওয়া সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে একবার উঠল; দরজা দিয়ে মুখ বাড়াল। কাউকে দেখতে পেল না। ফিরে এসে বসল।

কিকিরা চা খাচ্ছিলেন ধীরে ধীরে। বললেন, “দীপনারায়ণের সঙ্গে কথা বলে আমি দেখেছি, এরকম সন্দেহ হবার প্রথম কারণ রাজবাড়ির ওই ছোরা, যার নাকি একটা আশ্চর্য গুণ আছে। কী গুণ তা তোমরা শুনেছ। ওই ছোরা কাউকে অন্যায় কারণে খুন করলে ছোরা থেকে রক্তের দাগ কিছুতেই যায় না, তা ছাড়া দিন দিন ছোরাটা ভোঁতা আর ছোট হয়ে আসে।”

চন্দন সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে বলল, “গাঁজা।”

“গাঁজা না গুলি–সেটা পরে ভাবলেও চলবে”, কিকিরা বললেন, “আপাতত ধরে নাও দীপনারায়ণ যা বলছেন সেটাই সত্যি। যদি তাই হয় তবে জয়নারায়ণকে খুন করল কে? কেনই বা করল?”

তারাপদ মাথা নাড়ল। তাকাল দরজার দিকে। চন্দন চুপ করে থাকল।

কিকিরা বললেন, “আমি একটা জিনিস ভেবে দেখেছি। রাজবাড়ির ওই ছোরার জাদু যাই থাক না কেন–তার বাঁটটার বাজার-দর আছে। দামি পাথর দিয়ে কারুকার্য করে বাঁটটা যেভাবে বাঁধানো–তাতে ওটা যেন কোনো মানুষকে রাতারাতি বেশ কিছু পাইয়ে দিতে পারে। যদি কেউ অর্থের লোভে খুন করে, থাকত–তবে বাঁটটা রেখে যেত না। তাই না?”

চন্দন কিকিরার দিকে তাকিয়ে থাকল। যেন বলল, ঠিক কথা।

চুরুটটা আবার ধরিয়ে নিলেন কিকিরা।”অর্থের লোভে কেউ জয়নারায়ণকে খুন করেনি। কিংবা যদি করেও থাকে–শেষ পর্যন্ত বাঁটটা নিয়ে পালাবার পথ পায়নি। যে অর্থের লোভে ছোরা চুরি করবে, খুন করবে–সে বাঁটটা ফেলে রাখবে এ বিশ্বাস করা যায় না।”

চন্দন বলল, “ছোরাটা না দীপনারায়ণের ঘরে সিন্দুকে থাকত?”

“হ্যাঁ।”

“দীপনারায়ণের শোবার ঘরে ঢুকে কেউ একজন সিন্দুক খুলে ছোরাটা চুরি করবে, সেই ছোরা দিয়ে খুন করবে, আবার সিন্দুকে রেখে আসবে বাঁটটা–এটা বেশ বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না কিকিরা?”

মাথা হেলিয়ে কিকিরা বললেন, “হচ্ছে বইকি! খুবই বাড়াবাড়ি হচ্ছে।”

“এরকম বোকা লোক কে থাকতে পারে! রাজবাড়ির ছোরা-রহস্যের কথা জেনেও, ধরা পড়ার জন্যে সেই ছোরা বার করে আনবে, আবার খুন করে রেখে আসবে?”

“আমিও তো তাই ভাবছি। জয়নারায়ণ কেমন করে মারা গিয়েছিলেন। জানো?”

“অ্যাকসিডেন্টে। মাথার ওপর ভারী জিনিস পড়ে।”

“হ্যাঁ। লাইব্রেরি-ঘরে জয়নারায়ণ মারা যান। তাঁর মাথার ওপর একটা বড় সেলফ বইপত্রসমেত ভেঙে পড়ে, সেই সঙ্গে বড় একটা ছবি, কাঁচে গলা হাত কেটে গিয়েছিল। মাথায় চোট লেগেছিল, তা ছাড়া রক্তপাত হয়েছিল প্রচুর। গলার নলি কেটে গিয়েছিল, হাত কেটেছিল, মুখের নানা জায়গায় কাঁচ ঢুকে গিয়েছিল।”

তারাপদ উঠল। বাইরে চলে গেল।

 চন্দন বলল, “ঘটনাটা ঘটেছিল কখন?”

“রাত্রের দিকে। আটটা নাগাদ।”

“কোনো ডাক্তার আসেনি?”

“এখানে কোনো ডাক্তার নেই। মাইল কুড়ি দূরে ডাক্তার আছে। রাজবাড়ি থেকে গাড়ি গিয়ে যখন ডাক্তার নিয়ে এল–ততক্ষণে জয়নারায়ণ মারা গেছেন।”

“কাছেপিঠে কোনো হাসপাতাল নেই?”

“না। এ-জঙ্গলে তুমি হাসপাতালে কোথায় পাবে!”

তারাপদ ফিরে এসে আবার বসল।

কিকিরা বললেন, “কাল তোমাকে লাইব্রেরিতে নিয়ে যাব। দেখবে লাইব্রেরির চেহারাটা কেমন। মেঝে থেকে পনেরো আঠারো ফুট উঁচুতে ছাদ। চারদিকে বিরাট বিরাট র‍্যাক। বই পড়তে হলে সিঁড়ি লাগে। সিঁড়ি রয়েছে কাঠের। র‍্যাকে ঠাসা বই। বিশাল বিশাল চেহারা। ওজনও কম নয়। জয়নারায়ণ সিঁড়ি দিয়ে উঠে সেলফ থেকে বই টানছিলেন এমন সময় হুড়মুড় করে এক তাক বই তাঁর ঘাড়ে মুখে পড়ে, সিঁড়িসমেত উলটে মাটিতে পড়ে যান। ব্ল্যাকটাও ভেঙে যায়।”

“জয়নারায়ণ কি পণ্ডিত লোক ছিলেন?” জিজ্ঞেস করল চন্দন।

কিকিরা বললেন, “দীপনারায়ণ বলেন, লাইব্রেরি-ঘরে প্রায়ই গিয়ে বসে থাকতেন।”

“পড়াশোনা করতেন?”

“হয়ত করতেন, আমি জানি না।” কিকিরা একটু থেমে হঠাৎ বললেন, “তুমি একটা জিনিস মোটেই লক্ষ করছ না। বই পড়তে গিয়ে একসঙ্গে অনেকগুলো বই হঠাৎ পড়ে যাওয়া সম্ভব। র‍্যাক ভেঙে যাওয়াও অসম্ভব নয়। কিন্তু অত বড় একটা বাঁধানো ছবি, যার ওজন অন্তত পনেরো কুড়ি সের হবে, কেমন করে দেওয়াল থেকে ভেঙে পড়ল তা বলতে পারো? দীপনারায়ণকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বললেন, তাঁদের ধারণা হয়েছিল, জয়নারায়ণ যখন সিঁড়ি সমেত উলটে পড়ছিলেন–তখন হয়ত হাত বাড়িয়ে ছবিটা ধরবার চেষ্টা করেছিলেন।”

“ছবিটা কি নাগালের মধ্যে ছিল?”

“দুটো পাশাপাশি র‍্যাকের ফাঁকে ছবিটা টাঙানো ছিল। ফ্রেম দিয়ে বাঁধানো ছবি।”

“অত বড় ছবি কেমন করে টাঙানো ছিল?”

“তার দিয়ে।”

“তার ছিঁড়ে গেল?”

“পুরনো তার ছিঁড়তে পারে। মরচে ধরে ক্ষয় হতে পারে। কিংবা কোনো জায়গায় পলকা ছিল।”

“আমি বিশ্বাস করি না। তবু দুর্ঘটনা দুর্ঘটনাই। ঘরের টাঙানো পাখাও তো মাথায় পড়ে। ছাদ খসে মানুষ মারা যায়।”

চন্দন কিছু বলল না।

কিকিরা বললেন, “বিপদের সময় মানুষের মাথার ঠিক থাকে না। ছবিটা কেমন করে পড়ল, কেমন করে তার কাঁচে জয়নারায়ণের গলা মুখ হাত কেটে রক্তে সব ভেসে গেল তা কেউই খেয়ালও করল না। জয়নারায়ণ মারা যাবার পর দীপনারায়ণ যখন একদিন নিতান্তই আচমকা নিজের সিন্দুকের মধ্যে ছোরাটাকে দেখলেন তখন তাঁর টনক নড়ল। তখনই তাঁর সন্দেহ হল, ভাইয়ের মৃত্যু দুর্ঘটনা নয়। ছবির ব্যাপারটাও তাঁর খেয়াল হল।”

তারাপদ বলল, “আপনি বলতে চাইছেন, জয়নারায়ণকে আগে খুন করা হয়েছে; তারপর বাকি যা কিছু সাজানো হয়েছে।”

“আমি এখনই কিছু বলতে চাইছি না। যা বলার পরশু রাত্রে বলব, শুধু রাজবাড়ির ছোরা নয়, ওই ছবিও নয়, জয়নারায়ণ যখন দুর্ঘটনায় পড়েছিলেন তখন ইরচাঁদের ওই ডালকুত্তার মতন কুকুরগুলো কেন তাদের ঘর থেকে বেরিয়ে চারপাশে ছোটাছুটি করছিল এবং ডাকছিল–সেটাও রহস্য। কুকুরের ডাকের জন্যে আশপাশের কেউ অনেকক্ষণ কিছু শুনতে পায়নি।”

চন্দন কিছু বলার আগেই কিকিরা আবার বললেন, “কাল আমার অনেক কাজ তোমাদের নিয়ে। চন্দন, কতটুকু ড পয়জেন এনেছ?”

চন্দন হাত দিয়ে মাপ দেখাল।

পরের দিন সকাল থেকেই দেখা গেল কিকিরা খুব ব্যস্ত। সকালে চা খেয়ে তারাপদদের নিয়ে লাইব্রেরিতে চলে গেলেন, ফিরলেন দুপুরে। তারাপদ আর চন্দনকে দেখলেই বোঝা যায় যত রাজ্যের ধুলো ঘেঁটেছে, মুখে চোখে মাথায় ধুলোর ছোপ।

দুপুরে স্নান-খাওয়ার পর চন্দন আর তারাপদ দিব্যি ঘুমিয়ে পড়ল; কিকিরা সামান্য বিশ্রাম সেরে তাঁর ঝোলাঝুলি নিয়ে বসলেন। দরজা বন্ধ থাকল। কী যে করলেন তিনি সারা দুপুর, কেউ জানল না।

বিকেলে চন্দনদের নিয়ে প্রথমে গেলেন দীপনারায়ণের সঙ্গে দেখা করতে। তারপর দীপনারায়ণের সঙ্গে রাজবাড়ির ভেতর মহল ঘুরে বেড়ালেন, দেখলেন সব। মায় দীপনারায়ণের ঘরের সিন্দুক পর্যন্ত।

ফিরে এসে আবার দীপনারায়ণের নিচের অফিস-ঘরে বসলেন সকলে।

কিকিরা বললেন, “দীপনারায়ণবাবু, এবার খোলাখুলি ক’টা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই।”

“বলুন।”

“এই রাজবাড়িতে আপনার অনুগত বিশ্বাসী লোক ক’জন আছে?”

 দীপনারায়ণ কেমন যেন অবাক হলেন। বললেন, “কেন?”

“দরকার আছে। আপনি যাদের বিন্দুমাত্র সন্দেহ করতে পারেন, এমন লোকদের বাদ দিয়ে বলছি।“

সামান্য ভেবে দীপনারায়ণ বললেন, “চার-পাঁচজন আছে।”

“আপনার বাড়িতে বন্দুক রাইফেল, রিভলবার নিশ্চয় আছে?”

 মাথা নেড়ে সায় দিলেন দীপনারায়ণ।

“কার কার আছে?”

“আমার আর জয়নারায়ণের। কাকারও বন্দুক ছিল।”

“কে কে বন্দুক-টন্দুক চালাতে পারে আপনারা তিনজন বাদে?”

আমার ছেলেরা পারে। ইন্দরও পারে।”

“অন্য কোনো মারাত্মক অস্ত্র আছে?”

“পুরনো কিছু অস্ত্র ছিল, কৃপাণবল্লম গোছের, সেসব কোথায় পড়ে আছে, কেউ ব্যবহার করে না।”

কিকিরা একটু চুপ করে থেকে বললেন, “রাজবাড়িতে কাঠের মিস্ত্রি আছে কেউ?”

“কাঠের মিস্ত্রি? কেন?”

“কেউ নেই?”

“আছে।”

“তাদের মধ্যে একজনকে কাল আমার একটু দরকার। সকালের দিকে। আর আপনার বসার ঘরে উঁচু গোল হালকা একটা টেবিল দেখেছি। ওটাও দরকার।”

দীপনারায়ণ অবাক হয়ে বললেন, “কাঠের মিস্ত্রি, টেবিল–এ-সব নিয়ে কী .. করবেন আপনি?”

কিকিরা মজার মুখ করে বললেন, “ম্যাজিক দেখাব।”

“ম্যাজিক?”

“আপনি তো জানেন, আমি ম্যাজিশিয়ান, কিকিরা দি ওয়ান্ডার…!” কিকিরা হাসতে লাগলেন।

দীপনারায়ণ বিরক্ত বোধ করলেও মুখে কিছু বললেন না। সংযতভাবে বললেন, “কিংকরবাবু, এখন আমার মনের অবস্থা ম্যাজিক দেখার মতন নয়।”

কিকিরা বললেন, “জানি দীপনারায়ণবাবু, কিন্তু কাল সন্ধের পর ওই লাইব্রেরি-ঘরে আমি একটা ম্যাজিক দেখাব। আপনাকে সেখানে থাকতে হবে; শুধু আপনি হাজির থাকলেই চলবে না, ইন্দর, শশধর, আপনার কাকা ললিতনারায়ণকেও থাকতে হবে।”

দীপনারায়ণ কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। বললেন, “কাকা অন্ধ। তিনি কেমন করে ম্যাজিক দেখবেন?”

“তাঁকে দেখতে হবে না। তিনি হাজির থাকলেই চলবে।” বলে কিকিরা উঠে দাঁড়ালেন, চোখের ইশারায় চন্দনদের উঠতে বললেন।

দীপনারায়ণ বোবা বোকা হয়ে বসে থাকলেন।

কিকিরা হেসে হেসেই বললেন, “দীপনারায়ণবাবু, আপনি আপনাদের রাজবাড়ির ছোরার অদ্ভুত-অদ্ভুত গুণের কথা বিশ্বাস করেন। আমার একটা ম্যাজিক আছে যার নাম দিয়েছিলাম–’মিস্ট্রিরিয়াস আইজ’–এই খেলাটার মধ্যে একটা অলৌকিক গুণ আছে। কাল সেটা দেখাব। ওই খেলা ছাড়া জয়নারায়ণের খুনিকে ধরবার আর কোনো উপায় আমার জানা নেই। আপনার দায়িত্ব হল, যাদের কথা বলেছি তাদের প্রত্যেককে ঠিক সময়ে ঠিক মতন লাইব্রেরিতে হাজির করা। আপনার হুকুম সবাই মানতে বাধ্য। আর আমরা যখন লাইব্রেরিতে বসব কাল রাত্রে, তখন আপনার বিশ্বাসী লোক দিয়ে। লাইব্রেরি-ঘরের চারপাশে পাহারা বসাবেন। খেলার কথা কাউকে বলবেন না।”

দীপনারায়ণ কিকিরার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। বলার কথা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। শেষে বললেন, “আপনি এসেছেন পুরনো বইয়ের ভ্যালুয়ার হিসেবে। লোকে সেটাই জানে। আপনি তাদের ম্যাজিক দেখাবেন?”

কিকিরা বললেন, “আপনি ম্যাজিক দেখানোর কথা বলবেন না কাউকে। অন্য কিছু বলবেন। হুকুম করবেন। ও দায়িত্বটা আপনার।…আর একটা কথা, কাল আপনি যখন লাইব্রেরিতে আসবেন, ছোরার বাক্সটা সঙ্গে রাখবেন। লুকিয়ে।…পারলে একটা পিস্তল গোছের কিছু রেখে দেবেন।”

.

০৭.

লাইব্রেরি-ঘরে সবাই হাজির ছিল : দীপনারায়ণবাবু, ললিতনারায়ণ, ইন্দর, শশধর–সকলেই। তারাপদও ছিল। চন্দন ছিল না, সবে ঘরে এসে ঢুকল। কিকিরার সঙ্গে চোখে চোখে ইশারা হল চন্দনের।

সন্ধে উতরে গিয়েছে। রাত বেশি নয়, তবু লাইব্রেরি-ঘরের উঁচু ছাদ, রাশি রাশি বই, ছবি, নানা ধরনের পুরনো জিনিস, বন্ধ জানলা এবং অনুজ্জ্বল বাতির জন্যে মনে হচ্ছিল রাত যেন অনেকটা হয়ে গিয়েছে।

কালো রঙের পায়া-অলা গোল টেবিল ঘিরে সকলে বসে ছিলেন। টেবিলটা প্রায় বুকের কাছাকাছি ঠেকছিল। টেবিলের ওপর পাতলা কালো ভেলভেটের কাপড় বিছানো। শশধর তার মনিবদের সামনে বসতে চাইছিল না, দীপনারায়ণ হুকুম করে তাকে বসিয়েছেন।

চন্দন ফিরে আসার পর কিকিরা ঘরের চারপাশে একবার ভাল করে তাকিয়ে নিলেন। আজ তাঁর একটু অন্যরকম সাজ। গায়ের আলখাল্লার রঙটা কালো, পরনের প্যান্টও বোধহয় কালচে, দেখা যাচ্ছিল না। চোখে চশমা। কাঁচটা রঙিন। তাঁর চোখ দেখা যাচ্ছিল না।

কিকিরা তারাপদকে বললেন, দরজাটা বন্ধ আছে কিনা দেখে আসতে।

তারাপদ দরজা দেখে ফিরে আসার পর কিকিরা তাকে বাতিটা আরও কম। করে দিতে বললেন।

টেবিল থেকে সামান্য তফাতে উঁচু টুলের ওপর একটা বাতি ছিল। তারাপদ মিটিমিটে সেই আলো আরও কমিয়ে দিল। অত বড় লাইব্রেরি-ঘর এমনিতেই প্রায় অন্ধকার হয়েছিল, বাতি কমাবার পর আরও অন্ধকার হয়ে গেল।

 টেবিলের চারধারে গোল হয়ে বসে আছেন : কিকিরা, কিকিরার ডান পাশে দীপনারায়ণ, বাঁ পাশে ললিতনারায়ণ, দীপনারায়ণের একপাশে ইন্দর, ইন্দরের পর বসেছে শশধর। তারাপদ আর চন্দন কিকিরার মাথার দিকে দাঁড়িয়ে।

সকলকে একবার দেখে নিয়ে কিকিরা প্রায় কোনো ভূমিকা না করেই বললেন, “দীপনারায়ণবাবু, আপনি আমাদের একটা কাজের ভার দিয়ে এই রাজবাড়িতে এনেছিলেন। আমরা এই ক’দিন সাধ্যমত খেটে আপনার কাজ শেষ করে এনেছি। সামান্য একটু কাজ বাকি আছে। কাজটা সামান্য, কিন্তু সবচেয়ে জরুরি। আপনাদের সকলকে আজ শুধু সেই জন্যেই এখানে ডেকেছি। হয়ত কেউ-না-কেউ আপনারা আমায় সাহায্য করতে পারেন।”

দীপনারায়ণ তাকিয়ে থাকলেন, ললিতনারায়ণ অন্ধ হয়ে যাবার পর চোখে গগলস্ পরেন, তাঁর চোখের পাতা খোলা থাকে, দেখতে পান না। ললিতনারায়ণ সামান্য মাথা ঘোরালেন। ইন্দর কেমন অবজ্ঞার চোখে তাকিয়ে থাকল; শশধর ধূর্ত দৃষ্টিতে।

দীপনারায়ণ বললেন, “কী ধরনের সাহায্য আপনি চাইছেন?”

কিকিরা বললেন, “বলছি। তার আগে বলি, এই লাইব্রেরি-ঘরের কোনো খোঁজই বোধ হয় আপনারা কেউ কোনোদিন রাখতেন না। রাজবাড়ির কেউ এ-ঘরে ঢুকতেন বলেও মনে হয় না।”

দীপনারায়ণ বললেন, “আমরা এক আধ দিন এসেছি; তবে “জয়নারায়ণ প্রায়ই আসত।”

“কেন?”

“ওর বই ঘাঁটা, ছবি ঘাঁটা বাতিক ছিল। পুরনো কিছু জিনিস আছে–ওর পছন্দ ছিল।”

কিকিরা যেন দীপনারায়ণের কথাটা লুফে দিলেন। বললেন, “একটা জিনিস দেখাচ্ছি। এটা কী জিনিস কেউ বলতে পারেন?” বলে কিকিরা পকেট থেকে বড় মার্বেল, সাইজের কাচের একটা জিনিস বের করে টেবিলের ওপর রাখলেন।”এই জিনিসটা ওঁর কাজ করার টেবিলের ড্রয়ারে ছিল। এই ঘরে।”

দীপনারায়ণরা ঝুঁকে পড়ে দেখতে লাগলেন। আশ্চর্য রকম দেখতে। ঠিক যেন একটা চোখের মণি। অথচ বড়। মণির বেশির ভাগটা কুচকুচে কালো, মধ্যেরটুকু জ্বলজ্বল করছে। কেমন এক লালচে আভা দিচ্ছে। অবাক হয়ে দীপনারায়ণ মণিটা দেখতে লাগলেন। ইন্দর এবং শশধরও দেখছিল। ললিতনারায়ণ পিঠ সোজা করে বসে।

“কী দেখছ তোমরা?” ললিতনারায়ণ জিজ্ঞেস করলেন।

দীপনারায়ণ বললেন, “চোখের মণির মতন দেখতে। মানুষের নয়। মানুষের চোখের তারা এত বড় হয় না, বিন্দুটাও লালচে হতে দেখিনি।”

কিকিরা বললেন, “মানুষের চোখের তারা ওটা নয়, দীপনারায়ণবাবু।” বলে পকেটে হাত দিয়ে ছোট-মতন একটা বই বার করলেন, পাতাগুলো ছেঁড়া, উইয়ে খাওয়া। বইটা টেবিলের ওপর রাখলেন না। শুধু দেখালেন। বললেন, “এই যে চটিবইটা দেখছেন–এটা ওই মণির পাশে ছিল। বইটা কোন ভাষায় লেখা বোঝা মুশকিল। নেপালি হতে পারে। আমি জানি না। তবে এর পেছন দিকে পেনসিলে ইংরেজিতে সামান্য ক’টা কথা লেখা আছে। তাই থেকে আমরা ধারণা হল, আপনাদের কোনো পূর্বপুরুষ বইটা পেয়েছিলেন। বই আর মণি। এই বইয়ে ওই মণির কথা লেখা আছে। লেখা আছে যে, মণিটা হিমালয় পাহাড়ের জঙ্গলে পাওয়া হায়না ধরনের কোনো জন্তুর। এই জন্তুদের চোখের অলৌকিক এক গুণ আছে।”

দীপনারায়ণ অবাক হয়ে বললেন, “অলৌকিক গুণ! মণিটার অলৌকিক গুণ কেমন করে থাকবে? এটা তো জ্যান্ত কোনো পশুর নয়?”

কিকিরা বললেন, “আপনি একটু ভুল বললেন। মণিটা জ্যান্ত পশুরই ছিল–এখন সেটা আলাদা করে তুলে রাখা হয়েছে।”

ললিতনারায়ণ বললেন, “আমি কখনো শুনিনি, রাজবাড়িতে এমন একটা জিনিস আছে!”

কিকিরা হঠাৎ বললেন, “রাজবাড়িতে অলৌকিক কিছু কি নেই রাজাসাহেব?”

দীপনারায়ণ তাড়াতাড়ি বললেন, “থাকতে পারে। কিন্তু মণিটার অলৌকিকত্ব কী?”

কিকিরা বললেন, “এর অলৌকিকত্বর কথা ছোট করে লেখা আছে পেনসিলে। কোনো মানুষ, যে নরহত্যা করেছে, পাপ কাজ করেছে, এমন কি প্রবঞ্চনা করেছে–সে যদি এই মণির ওপরে হাত রাখে মণিটা তার হাতের ছায়াও সহ্য করবে না–ছিটকে বেরিয়ে যাবে।”

দীপনারায়ণ কেমন একটা শব্দ করে উঠলেন। শশধর কিকিরার দিকে তাকাল। ইন্দর কেমন বোকার মতন তাকিয়ে হেসে উঠল। ললিতনারায়ণ মাথা নাড়তে লাগলেন।

“অসম্ভব”, ললিতনারায়ণ বললেন, “অসম্ভব। আমাদের বাড়িতে এরকম ভুতুড়ে কোনো জিনিস ছিল না। আমি শুনিনি।”

কিকিরা বিনীত গলায় বললেন, “আপনি শোনেননি, জানেন না–এটাই আমার জানার কথা, রাজাসাহেব। আপনি চোখে দেখতে পান না। মণিটা দেখতেও পাচ্ছেন না। তবু আপনাকে এখানে আনার উদ্দেশ্যই ছিল–যদি সব কথা শুনে কিছু সাহায্য করতে পারেন।”

ইন্দর হাসতে হাসতে বলল, “ভূতুড়ে গল্প শোনার জন্যে আমরা এখানে আসিনি। …শুনে ভালই লাগল। আমি চলি।”

কিকিরা বাধা দিয়ে বললেন, “যাবার আগে চোখে একবার দেখে যাবেন না?”

“কী দেখব?”

“মণিটা সত্যি সত্যি নড়ে কিনা?”

“পাগলের মতন কথা বলবেন না।”

“একটু পরীক্ষা করে দেখলে ক্ষতি কী!..এই লাইব্রেরি-ঘরে জয়নারায়ণ মারা গিয়েছিলেন। তিনি দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন, না কেউ তাঁকে খুন করেছিল–এটা একবার দেখা যেত।”

ঘরের মধ্যে সবাই যেন কেমন চমকে গেল। একেবারে চুপচাপ। শশধর আর ইন্দর কিকিরার দিকে অপলকে তাকিয়ে। চমকটা কেটে গেলে দু জনেই যেন জ্বলন্ত চোখে কিকিরাকে দেখতে লাগল।

ইন্দর বলল, “খুন? কে বলল?”

 কিকিরা বললেন, “বলার লোক আছে।”

খেপে উঠে ইন্দর বলল, “খবরদার, আবার যদি ও কথা শুনি, জিব টেনে ছিঁড়ে ফেলব। রাজবাড়ির বদনাম করতে এসেছেন আপনি!”

কিকিরা বললেন, “না। আমি রাজা দীপনারায়ণের কথায় এসেছি।”

ইন্দর অধৈর্য হয়ে চেঁচিয়ে উঠল।”ননসেন্স। আপনার সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি।” বলে সে দীপনারায়ণের দিকে তাকাল। “আপনি কোথা থেকে একটা ইডিয়েট, পাগলকে ধরে এনেছেন? ওকে তাড়িয়ে দিন। কথা বলতে জানে না।”

দীপনারায়ণ গম্ভীর গলায় বললেন, “বসো। চেঁচামেচি করো না। উনি যা। বলছেন সেটা আমিও বিশ্বাস করি না কিন্তু যা বলছেন সেটা পরীক্ষা করে দেখতে ক্ষতি কিসের? মণিটা যদি বাজেই হয়বাজেই থাকবে। নিশ্চয় নড়বে না।”

শশধর বলল, “রাজাসাহেব, আপনি ওঁর কথা বিশ্বাস করছেন?”

দীপনারায়ণ কোনো জবাব না দিয়ে কিকিরাকে বললেন, “কেমন করে হাত রাখব আপনি বলুন?”

কিকিরা নিজের ডান হাত মণিটার ওপর বিঘতখানেক উঁচুতে তুলে রাখলেন। মণিটা স্থির হয়ে থাকল। নড়ল না।

দীপনারায়ণ বললেন, “আমি রাখছি।”

দীপনারায়ণ মণির ওপর হাত রাখলেন উঁচু করে, নড়ল না।

নিশ্বাস ফেলে দীপনারায়ণ বললেন, “ইন্দর, তুমি রাখো।”

ইন্দর যেন ঘামতে শুরু করেছিল। তার মুখ কঠিন। শক্ত চোখে কিকিরার দিকে তাকাল। বলল, “বেশ, আমি হাত রাখছি যদি দেখা যায় মণিটা নড়ল না, ওই লোকটাকে আমি দেখে নেব।”

ইন্দর যেন রাগের বশে টেবিলে হাত দিয়ে মণিটা তুলে নিতে যাচ্ছিল। কিকিরা হাত ধরে ফেললেন। বললেন, “না না, ছোঁবেন না। ওপরে হাত রাখুন, আমরা যেভাবে রেখেছি।”

ইন্দরের হাত কাঁপছিল। ডান হাতটা সে তুলে রাখল।

খুবই আশ্চর্যের কথা মণিটা এবার নড়তে লাগল ধীরে ধীরে। ইন্দর অবাক। তার চোখের পাতা পড়ছে না। মুখে আতঙ্ক। হাতটা সে সরিয়ে নিল অন্য পাশে, চোখের মণিটাও গড়াতে গড়াতে তার হাতের দিকে চলে গেল। আবার হাত সরাল ইন্দর, মণিটাও গড়িয়ে গেল।

আচমকা খেপে উঠে ইন্দর চেঁচিয়ে উঠল। প্রায় লাফ মেরে গলা টিপে ধরতে যাচ্ছিল কিকিরার। চন্দনও পেছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

দীপনারায়ণ হাতের ঠেলা দিয়ে ইন্দরকে বসিয়ে দিলেন। বললেন, “গোলমাল করো না। বসো!” বলে পকেট থেকে রিভলবার বার করে সামনে রাখলেন। হাতের কাছে।

ইন্দর রিভলবারের দিকে তাকাল। তার মুখ রাগে ক্ষোভে ভয়ে উত্তেজনায় কেমন যেন দেখাচ্ছিল। ইন্দর থামল না, চেঁচিয়ে বলল, “আপনি আমাকে খুনি বলতে চান? কোথাকার একটা উন্মাদ…”

দীপনারায়ণ ধমক দিয়ে বললেন, “চুপ করো।”

কিকিরা শশধরের দিকে তাকালেন।

শশধর ভয় পেয়ে গিয়েছিল। তার ধূর্ত চোখে আতঙ্ক।

কোনো উপায় নেই, শশধর যেন সাপের ফণার দিকে হাত বাড়াচ্ছে এমনভাবে হাত বাড়াল। তার হাত কাঁপছিল থরথর করে।

মণিটা এবারও নড়তে লাগল, গড়িয়ে গেল; শশধর যেদিকে হাত সরায়, সেদিকে গড়িয়ে যায় মণিটা। ভয়ের শব্দ করে হাত সরিয়ে নিল শশধর। চোখ যেন ভয়ে ঠেলে বেরিয়ে আসছে, দীপনারায়ণের দিকে তাকিয়ে বলল, “রাজাসাহেব, আমি নিদোষ; আপনি বিশ্বাস করুন।

দীপনারায়ণ কোনো কথা বললেন না, রিভলবারের ওপর হাত রাখলেন।

কিকিরা তাঁর বাঁ-পাশে বসা ললিতনারায়ণের দিকে তাকালেন। বললেন, “ললিতনারায়ণবাবু, আপনি কি একবার হাত রাখলেন?”

ললিতনারায়ণ বিন্দুমাত্র উত্তেজনা দেখালেন না। বললেন, “রাখব।”

“আপনার সামনেই টেবিল-হাতটা সামনের দিকে একটু বাড়িয়ে দিন।”

ললিতনারায়ণ বাঁ হাতটা বাড়িয়ে দিলেন।

মণিটার ঠিক ওপরেই হাত রাখলেন না ললিতনারায়ণ, অথচ সামান্য সময় মণিটা স্থির থেকে পরে তাঁর হাতের দিকেই গড়িয়ে আসতে লাগল। দীপনারায়ণ দেখছিলেন। কিকিরা ললিতনারায়ণকে হাত সরাতে বললেন। ললিতনারায়ণ হাত সরালেন-মণিটাও সরে এল। টেবিলের চারদিকে হাত ঘঘারাতে লাগলেন ললিতনারায়ণ-মণিটাও গড়াতে লাগল।

হঠাৎ বাঁ হাত উঠিয়ে নিয়ে ললিতনারায়ণ ডান হাত দিয়ে কিকিরার বাঁ হাত চেপে ধরলেন। তারপর হেসে উঠে বললেন, “এসব জোচ্চুরি কতদিন ধরে চলছে? হাত হঠাও।”

কিকিরা বিন্দুমাত্র অপ্রস্তুত হলেন না। বাঁ হাতটা সকলের সামনে মেলে ধরলেন। বললেন, “দীপনারায়ণবাবু, আপনার কাকা জোচ্চুরিটা ঠিকই ধরেছেন। আমার এই হাতে একটা শক্তিশালী চুম্বক ছিল। আর ওই কাচের মার্বেলটার তলায় লোহা দেওয়া আছে। এই ভেলভেটের তলায় যা আছে–সেটাও পাতলা কাঠ। কোনো সন্দেহ নেই এটা ম্যাজিকের খেলা। ধাপ্পা। কিন্তু রাজাসাহেব, আপনার অন্ধ কাকা কেমন করে আমার হাত নাড়া বুঝলেন সেটা একটু ভেবে দেখুন। আপনারা কেউ একবারও সন্দেহ করেননি–আমার বাঁ হাত নিচে ছিল-টেবিলের তলায়। এবং বাঁ হাতে চুম্বক ছিল। আপনার অন্ধ কাকা কেমন করে সেটা লক্ষ করলেন? আমি একবারও তাঁর পা ছুঁইনি। তাঁর যদি দৃষ্টিশক্তি না থাকত তিনি কিছুতেই এই অন্ধকারে আমার হাত নাড়া দেখতে পেতেন না। উনি আগাগোড়াই এটা লক্ষ করেছিলেন; এবং আমার জোচ্চুরি ধরবেন বলে ডান হাত না বাড়িয়ে বাঁ হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। উনি কি বাঁ হাতে কাজ করতে অভ্যস্ত? তা নয়। আগেই আমি সেটা লক্ষ্য করে নিয়েছি। ললিতনারায়ণ অন্ধ নন। অন্ধ সেজে রয়েছেন।”

“কে বলল আমি অন্ধ নয়?” ললিতনারায়ণ বেপরোয়াভাবে বললেন।

কিকিরা বললেন, “আপনি যে অন্ধ নন সেটা আজ স্পষ্ট হল। আরও যদি শুনতে চান–তা হলে বলব, আমি দূরবীন তাগ করে আগেই একদিন দেখেছি, আপনি আপনার মহলে ছাদে দাঁড়িয়ে কোনো চিঠি বা কাগজ পড়ছিলেন। তখনই আমার সন্দেহ হয়েছিল। আজ তা প্রমাণিত হল। আপনি যথেষ্ট চালাক। সন্দেহ এড়াবার জন্যে আগে থেকেই অন্ধ সেজেছেন।”

কিকিরা চেয়ার সরিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।

.

ঘরের মধ্যে এক অদ্ভুত অবস্থা। দীপনারায়ণ চমকে উঠেছিলেন। তারাপদ আর চন্দন কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে। ইন্দর যেন কোনো ভূত দেখেছে সামনে। শশধর কাঁপছিল।

দীপনারায়ণ রিভলভারটা তুলে নিলেন।

কেউ কোনো কথা বলছিল না।

ললিতনারায়ণ চোখের গগলস খুলে ফেললেন। বয়স হলেও তাঁর চেহারা। এখনও মজবুত। চোখ দুটি তীব্র দেখাল। বললে, “জয়কে কেউ খুন করেনি। সে অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে।”

কিকিরা বললেন, “খুনের প্রমাণ আছে।”

“কী প্রমাণ?”

“দীপনারায়ণবাবু, ছোরার বাক্সটা একবার দেবেন?”

দীপনারায়ণ চেয়ারের তলায় ছোরার বাক্স রেখেছিলেন। সতর্ক চোখ রেখে বাঁ হাতে বাক্সটা তুলে দিলেন। চাবিও!

কিকিরা বাক্সটা নিলেন। চাবি খুলে ছোরার বাঁটটা বার করলেন। বললেন, “এর ফলাটা কে খুলে নিয়েছে ললিতনারায়ণবাবু?”

“ছোরার বাঁটটা আপনি চুরি করেও আবার সিন্দুকে রেখে এলেন কেন?”

ললিতনারায়ণ চুপ। দু হাতে মুখ ঢাকলেন। অনেকক্ষণ পরে বললেন, “ছোরাটা আমার ঘরে যে কদিন ছিল–আমি ঘুমোতে পারতাম না সারা রাত। ভয় করত। দুঃস্বপ্ন দেখতাম। জয় আমার পাশে-পাশে যেন ঘুরে বেড়াত। তা ছাড়া ইন্দর আমায় শাসাচ্ছিল। বলছিল, ছোরাটা তাকে দিয়ে দিতে। বিক্রি করে সে আমায় অর্ধেক টাকা দেবে। আমি ওকে বিশ্বাস করতাম না। ছোরার বাঁটটা পেলে ও পালাবে। কোনো উপায় না দেখে, মাথা ঠিক রাখতে–পেরে-বাক্সটা আবার দীপনারায়ণের সিন্দুকে রেখে আসি চুরি করে। আমার পাপ আমি স্বীকার করে নিচ্ছি।”

ললিতনারায়ণের দু চোখের তলা দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন মানুষটা।

2 Comments
Collapse Comments
Dr.Padmapani Chakraborty January 14, 2021 at 8:46 pm

khub bhalo laglo.

Dr.Padmapani Chakraborty January 14, 2021 at 8:51 pm

Bimal karer boi porlam . aro boi porte chai . kichhu banan bhul aachhe . tobe asubidha nei. Dhanyabad .

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *