সুপারম্যানের পিতা – ১ উপন্যাস ৯ গল্প – বিনোদ ঘোষাল
প্রথম প্রকাশ আগস্ট ২০১৯
বন্ধু, গবেষক
কৌশিক মজুমদার-কে
কৈফিয়ত
বছর কয়েক আগে একটি সংবাদপত্রে সেই স্বপনকুমারকে নিয়ে ফিচার লিখলেন আমার এক সাংবাদিক বন্ধু। সেই ফিচার পড়ে আমি থ! সেই ছোটবেলার শ্রীস্বপনকুমার, যাঁর আসল নাম সমরেন্দ্রনাথ পাণ্ডে, প্রথম বয়সে ডাক্তার, মধ্যবয়সে বাংলায় পাল্প ফিকশনের সম্রাট এবং শেষ বয়সে তিনিই আবার জ্যোতিষী শ্রীভৃগু। আমার মন এই মানুষটাকে আরও জানতে চাইল। তার জীবন, তার কাজের ব্যাপারে জানার জন্য আমাকে নানাভাবে সাহায্য করল বেশ কয়েকজন বন্ধু। আমি সমরেন্দ্রনাথ পাণ্ডের জীবন শুনে অবাক হয়ে গেলাম। কী অদ্ভুত, বিচিত্র! ওঁর জীবনটাই তো প্রায় গোটা পাল্প ফিকশন!
সুপারম্যানের পিতা উপন্যাসটি কিন্তু কোনওভাবেই সমরেন্দ্রনাথ পাণ্ডের জীবনকাহিনি বলা যাবে না। কিছু কিছু মিল পাওয়া যেতে পারে। এই কাহিনি লিখতে যে সকল বন্ধুদের অকৃপণ সহায়তা পেয়েছি তাদের মধ্যে কৌশিক মজুমদার, প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত, অভি চক্রবর্তী, শান্তনু ঘোষের নাম অবশ্যই বলতে হয়।
উপন্যাসটির সঙ্গে এই বইতে রইল আরও কয়েকটা অগ্রন্থিত ছোট গল্প। সবমিলিয়ে এই আয়োজন পাঠকদের ভালো লাগলে সেটাই আমার প্রাপ্তি।
বিনোদ ঘোষাল
উপন্যাস
সুপারম্যানের পিতা
দরজা ফাঁক হতেই নাকের মধ্যে যে গন্ধটা ঝাপট দিল সেটা বহু পুরোনো ড্যাম্প খাওয়া ঘরের। চামচিকের গন্ধ মেশানো একটা পোড়ো বাড়ির দরজা খুলল যেন ক্যাঁ-চ শব্দ করে। যেমন দরজা তার তেমন শব্দ। দরজাখানাও যেন দীর্ঘকালের ঘুম ভেঙে নেহাত অনিচ্ছায় দু-ফাঁক হ’ল।
ঘরের ভেতর থেকে যিনি দরজা খুললেন তাঁকে দেখা যাচ্ছে না, কারণ প্রথমত ওইটুকু ফাঁক করা দরজা, দ্বিতীয়ত ঘরের ভেতর অন্ধকার। বাইরে থেকে বোঝা অসম্ভব ভেতরে দরজার সামনে কে এসে দাঁড়িয়েছেন।
কী চাই? ভাঙা গলায় একটা পুরুষকণ্ঠ ভেসে এল ভেতর থেকে।
আজ্ঞে, আমি মানে…তপনবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম। একটু ঘাবড়ে গিয়েই বলল সায়ন্তন।
ওই নামে এখানে কেউ নেই, এই বাক্যের সঙ্গে দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল।
না না, প্লিজ শুনুন, শ্রীতপনকুমার…ইয়ে মানে, অমরেন্দ্রনাথ পান্ডে…
দরজাটা বন্ধ হতে গিয়েও থামল। আবার প্রশ্ন ভেসে এল। কী দরকার বলুন?
সায়ন্তন এবার কিছুটা সাহস পেল। দরকার মানে…আসলে একটু কথা ছিল ওনার সঙ্গে। দয়া করে দশটা মিনিট যদি উনি যদি একটু সময় দেন।
জুন মাসের ভ্যাপসা দুপুর। আজ সকাল থেকে প্রবল গুমোট দিয়েছে। বৃষ্টির নামগন্ধ নেই। সেই যোধপুর পার্ক থেকে ঠেঙিয়ে উত্তর কলকাতার ঝামাপুকুর লেনের তস্য একটি গলিতে একটি অতি পুরোনো তিনতলা বাড়ির একতলার পিছন দিকের একটি দরজার সামনে এখন সায়ন্তন দাঁড়িয়ে কুলকুল করে ঘামছে। গলিটা ঘিঞ্জি এবং বেশ কয়েকটি বিহারি পরিবারের পায়রার খুপড়ি টাইপের ঘর। দু-চারটে ন্যাড়ামাথা বাচ্চা গলিতে খেলছে, হামা টানছে। দু-তিনজন বিভিন্ন বয়েসের মহিলা তাদের খুপড়ির সামনে বসে আয়েস করে চুল আঁচড়াচ্ছে। টেবিল ফ্যানের ঘোঁও শব্দ, ভোজপুরি গান, বাচ্চার কান্না—সব মিলিয়ে জমজমাট।
কী কথা বলতে চাইছেন তার সঙ্গে? এ্যাঁ, কী কথা? আবার ভাঙা গলায় প্রশ্ন। সঙ্গে বেমক্কা কাশি। কাশির দাপট সামলাতে না পেরে প্রশ্নকর্তা দরজার সামনে থেকে একটু সরে গেলেন। প্রায় মিনিট খানেক ধরে চলল কাশিপর্ব। ততক্ষণে দরজাটা নিজেই ঠেলে সরিয়ে দিয়েছে সায়ন্তন। ঘরের ভেতরে দেখল মোটামুটি একটা কোলকুঁজো লোক বেঁকেচুরে গিয়ে বেমক্কা কাশছে। এমন কাশি যেন প্রাণটা এই বুঝি বেরিয়ে যাবে।
টিবি ফিবি নয় তো? কিংবা কোনও ছোঁয়াচে রোগ। চলে যাব? কথাগুলো ভাবল সায়ন্তন। তারপর দরজা ঠেলে কিছুটা ভেতরে এসে বলল, আপনি একটু জল খান। বসুন…
লোকটা উত্তর না দিয়ে আপন মনে কাশতে থাকলেন।
জল কোথায় রয়েছে বলুন? আমি দিচ্ছি।
উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা নেই। লোকটা প্রায় মাটিতে বসে পড়েছেন। কাশির দমক একটু কমেছে। দীর্ঘ শ্বাস টানছেন। সেই শ্বাসে ঘরঘর শব্দ। সায়ন্তন বুঝল, এর ডেফিনিট অ্যাজমা রয়েছে। অবশ্য এ যা ঘর, এখানে একবেলা থাকলে যে কারও শ্বাসকষ্ট ধরে যাবে।
কাতলা মাছকে আচমকা জল থেকে ডাঙায় আছড়ে ফেললে যেমন অবস্থা হয় মাছটার, ঠিক তেমনই অবস্থা লোকটার। গোটা পৃথিবীতে অক্সিজেন খুঁজছে। পাচ্ছে না।
সায়ন্তন চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। লোকটা যতক্ষণ না একটু ধাতস্থ হচ্ছে ততক্ষণ ঘর ছেড়ে যেতে মানবিকতায় লাগছে। যদি কোনও দরকারে লাগে।
প্রায় মিনিট পাঁচেক ঠায় দাঁড়িয়ে থাকার পর মেঝেতে থেবড়ে বসে থাকা তিনি দুই হাতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।
ঘরের একটা জানলা খোলা। সেই জানলার ঠিক একফুট দূরেই অন্য বাড়ির দেওয়াল। ফলে আলো বিশেষ ঢুকছে না। ঘরে ঝাপসা আলো। সেই আলো আঁধারিতে চোখ সয়ে নিয়ে সায়ন্তন দেখল টাকমাথা একটা লোক…ঢ্যাঙা। গায়ের চামড়া কিছুটা ফর্সা বলেই মালুম হচ্ছে তবে চামড়ার চাদরটা স্রেফ হাড়ের ওপর বিছানো। মাঝে মাংস বলেও যে একটা ফ্যাক্টর থাকে সেটা এর বডিতে নেই। পুরোটাই শুধু খাঁচা। পরনে একটা ময়লা লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি। গেঞ্জিটা প্রাচীনত্বের কারণে বগলের কাট আর গলার কাট ঝুলে পেট-কোমর পর্যন্ত চলে এসেছে। বেশ কয়েকটি ছিদ্রও রয়েছে গেঞ্জিতে।
ঘরের মধ্যে জিনিসপত্র বলতে একটি সিঙ্গল চৌকি, সেটা ঘরের একমাত্র জানলাটি যে দেওয়ালে সেখানে সেট করা। চৌকিতে বসে জানলা দিয়ে আসা আলোতে দিনের বেলা কিছু লেখা পড়ার কাজ করা গেলেও যেতে পারে। নচেৎ বিকেল নামলে এই ঘর ইলেক্ট্রিক বাতি ছাড়া অন্ধকার। চৌকির ওপর এক কাঁড়ি পুরনো কাগজ, ম্যাগাজিন, একটা মুড়ির কৌটো, বাটি, গেলাস। চৌকির এক কোণে মশারির দুটো খুট দেওয়ালের হুকে ঝোলানো। মশারিটা দলা পাকিয়ে চৌকির এক কোণে পড়ে রয়েছে। মশারির ঘাড়ে আবার নোংরা একটা বালিশ। অন্য দেওয়ালে একটি অতি পুরাতন কাঠের আলমারি।
মেঝেতে এক কোণে রাখা স্টোভ, কয়েকটা থালা-বাসন, বেশ কিছু কৌটো ইত্যাদি। ব্যস, সংসার কমপ্লিট। আর চৌকির একধারে ছোট লম্বা একটা টেবিলে টেবিল ফ্যান রয়েছে। ফ্যানটা বিশ্রী শব্দ করতে করতে ঘুরছে। বোঝাই যাচ্ছে হাওয়া খাওয়ানোর ক্ষমতা ওর অনেককাল আগেই গিয়েছে। এখন শুধু প্রাণের দায়ে ঘোরে।
ঘরে ইনি ব্যতীত যে আর কেউ থাকে না সেটা স্পষ্ট।
কী চাই আপনার? চৌকিতে এসে বসলেন ভদ্রলোক। কাশি কমেছে। এখন প্রাণপণে হাঁফাচ্ছেন।
বলছি। আপনাকে কি একটু জল দেব? জিজ্ঞাসা করল সায়ন্তন।
লোকটা কিছু না বলে শুধু হাত বাড়ালেন। পাটকাঠির মতো একটা সরু লম্বা হাত। কব্জির হাড় উঁচু, কেঠো আঙুলগুলোর ডগায় লম্বা লম্বা ময়লা নখ। দেখলে গা ঘিনঘিন করে। তিনি যেখানে বসেছিলেন তার ঠিক অন্যপ্রান্তে টেবিলফ্যানটা ঘুরছে। ওই ফ্যানের পাশেই প্লাস্টিকের জলের বোতল রাখা ছিল। ওটা বাড়িয়ে দিল সায়ন্তন। বোতলের ছিপি খুলে দু-তিন ঢোঁক জল কোতকোত করে খেলেন তিনি। তারপর আআহ করে একটা শব্দ তুলে বোতলটা চৌকিতে নিজের পাশে রাখলেন।
সায়ন্তন বুঝল একটু ধাতস্থ হয়েছেন তিনি।
আবার প্রশ্ন, কী চাই আপনার?
আজ্ঞে শ্রীতপনকুমার…
নেই নেই…বহুদিন আগে তপনকুমার মরে গেছে। মরে পুড়ে ছাই হয়ে মাটি হয়ে গিয়েছে। বাপের দেওয়া অমরেন্দ্র নামটা নিয়ে এখনও আমি পৃথিবীতে পড়ে রয়েছি আরও কিছুদিন খাবি খাব বলে। বলুন কী বলবেন?
ওহ আপনিই…আন্দাজ মিলে যাওয়ায় কিছুটা নিশ্চিন্ত এবং একইসঙ্গে চিন্তিত হল সায়ন্তন। নিশ্চিন্তি ওর আন্দাজ মিলেছে বলে আর চিন্তিত এই লোককে দিয়ে কি আদৌ ওর আসল কাজ হাসিল হবে? যে উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে আসা তা কতদূর সফল হবে জানা নেই, কিন্তু ট্রাই শেষ পর্যন্ত করতেই হবে। লোকটা যে হাঁপানি ইত্যাদি নিয়ে হেবি খিট খেয়ে রয়েছে সেটা স্পষ্ট। খুব সাবধানে হ্যান্ডেল করতে হবে।
হ্যাঁ, আমি আসলে অমরেন্দ্রবাবুর সঙ্গেই দেখা করতে এসেছি। আমি কি আপনাকে একবার প্রণাম করতে পারি?
প্রণাম আমাকে? কেন? একইরকম খেঁকিয়ে উঠে জিজ্ঞাসা করলেন অমরেন্দ্র।
বলছি, আগে প্রণামটা সেরে নিই।
পা ছুঁয়ে প্রণাম করার সময় সায়ন্তন দেখল লোকটার জরাজীর্ণ পা দুটোর আঙুলগুলোতেও কালো কালো লম্বা নখ, ফাটা গোড়ালিতে ময়লা জমে রয়েছে।
প্রণাম পেয়ে কোনও ভাবান্তর হল না অমরেন্দ্রর। আবার তিনি প্রশ্ন করলেন, কী চাই আমার কাছে?
হ্যাঁ বলছি, আমি কি একটু বসতে পারি?
ইশারায় চৌকিতে সায়ন্তনকে বসতে বললেন তিনি।
সায়ন্তন বসল। ও একটু সময় নিচ্ছিল যাতে বুড়োর মেজাজ ঠান্ডা হয়। নিজের সাইডব্যাগ থেকে জলের বোতল বার করে বেশ কয়েকঢোঁক জল খেয়ে বলল, আজ খুব গুমোট গরম। বৃষ্টিটাও হল না।
কোনও হুঁ হাঁ পর্যন্ত করলেন না অমরেন্দ্র। উনি যেন অপেক্ষা করছেন সায়ন্তনের আগমনের হেতু জানার জন্য বা বিরক্ত হচ্ছেন তার ঘরে সায়ন্তনের আগমনে। ঘর দেখে বোঝাই যায় এই ঘরে দীর্ঘকাল কেউ আসে না।
কী দেখছ, এ্যাঁ কী দেখছ? কী চাই? ঘরঘরে গলায় আবার সেই একই প্রশ্ন।
তোবড়ানো ভাঙা গালে বিজিবিজি দাড়ি, কপালে সারসার ভাঁজ, কণ্ঠা, গলার নলি উঁচুওলা বিরক্ত লোকটাকে দেখে মায়া লাগল সায়ন্তনের। আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।
আমি কারও সঙ্গে কথা বলি না। আপনি যেতে পারেন।
প্লিজ স্যর, অনেক দূর থেকে অনেক আশা নিয়ে আমি আপনার কাছে এসেছি। আমার কথাটুকু একটু শুনুন তারপর না হয় তাড়িয়ে দেবেন। প্লিজ…বলতে বলতে হাতজোড় করল সায়ন্তন। এত দিনের পরিশ্রম, আশা মুহূর্তে মাঠে মারা পড়ছে দেখে ও মরিয়া হয়ে উঠল।
ভুরু কুঁচকে সায়ন্তনকে দেখলেন অমরেন্দ্র। বার দুয়েক কাশলেন, তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, আমার ঠিকানা আপনাকে কে দিয়েছে?
বলছি স্যর, তার আগে আমাকে তুমি করেই বলুন, আপনি করে বললে আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছে। আপনার মতো এমন একজন রাইটারকে…
থামো থামো, ওঠো এখান থেকে, যাও বেরোও। বেরোও ঘর থেকে এখুনি! আচমকা প্রায় মারমুখি হয়ে গেলেন অমরেন্দ্র। আরও কিছু বলতে গেলেন, পারলেন না কাশির দমকে। আবার মিনিট খানেক কাশিপর্ব চলল। লোকটার কাশিতে কি ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদি রয়েছে? থাকতেই পারে? কিন্তু নাকে রুমাল দেওয়ার উপায় নেই। যা আছে কপালে।
স্যর, আপনি প্লিজ রাগ করবেন না, আমি কিন্তু আমার মনের বিশ্বাসটাই বললাম আপনাকে।
চৌকির এক কোণে ঘাড় ঝুঁকিয়ে বসে হাঁফাচ্ছিলেন অমরেন্দ্র। ছেলেটার প্রতি ভীষণ রাগ হচ্ছে। ইচ্ছে করছে গলাধাক্কা দিয়ে বার করে দিতে। এই জগতে প্রতিটি প্রাণী, প্রতিটি বস্তুর প্রতি অশেষ ঘৃণা অমরেন্দ্রর। অনন্ত ঘৃণা নিয়ে তিরাশি বছরের এক বৃদ্ধ পৃথিবীর একটা ঘুপচি ঘরে বসে মৃত্যুর জন্য অনন্তকাল ধরে অপেক্ষা করছে।
কেন খুঁজছ আমাকে? কী চাও?
আবার একই প্রশ্ন। এবার সরাসরি প্রসঙ্গে চলে গেল সায়ন্তন। হ্যাঁ স্যর, বলছি। একটু ডিটেলে বলছি দয়া করে শুনুন। তারপর যদি আমাকে পছন্দ না হয়, বলবেন, আমি বেরিয়ে যাব।
অমরেন্দ্র সায়ন্তনের কথার উত্তর না দিয়ে শুধু তাকিয়ে রইলেন ওর দিকে।
আমার বয়স তখন ছয় কি সাত হবে। বাড়িতে তখন অনেকরকমের পত্র-পত্রিকা, বই আসত। আমার জন্যও যেমন আসত, তেমন আমার দাদু, বাবা, মা, এবং ঠাকুমার জন্যও আসত। রান্নাবান্না, খেলা, সাহিত্য, সব রকমের ম্যাগাজিন। এবং বিশেষ সংখ্যাগুলোকে পুরনো হলেও বিক্রি করে দেওয়া হত না। গুছিয়ে রেখে দেওয়া হতো স্টোররুমে। আমাদের পুরোনো বাড়ি। জায়গা অঢেল। ফলে শুধু বইপত্র এবং পুরোনো পত্র-পত্রিকা রাখার জন্য একটা ঘর ছিল…মানে এখনও তাই রয়েছে। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দেখতাম আমাদের বাড়িতে পরিবারের কেউ অবসর সময়ে বই পড়ছে। তো এই দৃশ্য দেখতে দেখতে আমিও খুব ছোটবেলা থেকেই গল্পের বইয়ের পোকা হয়ে পড়ি। আমার বয়েসে যেসব বই, ম্যাগাজিন পড়া উচিত বা পড়তে ভালো লাগবে সেগুলো নির্দিষ্ট সময় অন্তর আমার হাতে ঠিক পৌঁছে যেত। আমিও গোগ্রাসে পড়তাম। পড়তে পড়তে বড় হলাম। স্কুল থেকে কলেজ তারপর ইউনিভার্সিটি…
কী চাও আমার কাছে? আবার সেই একই প্রশ্ন ছুঁড়লেন অমরেন্দ্র।
সেটাই বলছি স্যর। বাংলা সাবজেক্ট আমার। আমি মাস্টার্স করেছি বাংলা সাহিত্য নিয়ে। এই বছরখানেক আগের কথা। আমাদের যে গোডাউনঘরটায় প্রচুর পুরোনো বইপত্র ম্যাগাজিন ডাঁই করে রাখা রয়েছে যুগের পর যুগ ধরে, মা বলল কিছু বই বিক্রি করে দিতে, কারণ পোকা ধরছে। আমি একটা রবিবার নাকে কাপড় বেঁধে ঢুকলাম সেই ঘরে, যে বই, ম্যাগাজিনগুলো বয়সের কারণে অতি জীর্ণ এবং যেগুলো আর কোনওকালেই দরকার নেই সেগুলো আলাদা করছিলাম কেজি দরে বিক্রি করে দেব বলে। বুঝতেই পারছেন স্যর, শত শত ম্যাগাজিন থেকে ঘেঁটে দরকারি আর অদরকারিগুলোকে আলাদা করা বিশাল চাপের কাজ। তো যাই হোক কাজটা করছিলাম। করতে করতে গাদার অনেক ভেতরে মোটা কাপড় দিয়ে বাঁধা একটা গাঁটরি পাই। হাত দিয়ে বুঝতে পারি ভেতরে ঠাসা বই। পুঁটুলি করে বই কেন রাখা সেটা আমার নেহাত কৌতূহল হয়, তাই গাঁটরিটা ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার আগে একবার খুলে দেখার মনস্থির করি। স্টোররুমটায় যে লাইটটা রয়েছে সেটা টিউব নয়, স্রেফ একটা হলদে বালব। বালবের গায়েও ঝুলকালি। আসলে ওই ঘরেও যে টিউব লাগানো যেতে পারে সেটা নিয়ে কেউ কখনও ভাবেনি তাই যুগের পর যুগ ওই সিলিং থেকে তার ঝোলানো হোল্ডারে একটা ময়লা ডুম, ব্যস এই ব্যবস্থাই চলছিল। ওই আলোতেই আমি গাঁটরি খুলে দেখলাম অজস্র ছোটছোট বই। প্রায় পঞ্চাশ-ষাটটা তো বটেই। থরে থরে সাজিয়ে কাপড়ে ঢেকে গিঁট দিয়ে রাখা ছিল। পাতলা পাতলা পেপারব্যাক বই, রংচঙে মলাট। কিন্তু ওই আলোতে বইয়ের কনটেন্ট আমি ভালো করে দেখতে পাচ্ছিলাম না। তবে বইগুলোর মাপ এবং কয়েকটা মলাট প্রায় একই স্টাইলের। আমার বেশ আগ্রহ হল। আমি গাঁটরিতে বইগুলো আবার ভরে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে আবার সেগুলোকে মেঝেতে ছড়িয়ে দিলাম। দেখলাম অসংখ্য ছোটছোট পেপারব্যাক বই। হলদে হয়ে যাওয়া পৃষ্ঠা। বইগুলোর অদ্ভুত সব নাম, বাজপাখির অট্টহাসি, ড্রাগনের পরিহাস, রক্তলোলুপ ড্রাগন, বাজপাখির প্রতিশোধ, ব্ল্যাকপ্যান্থারের হাসি। এমন বইয়ের সঙ্গে যে কভারের ছবিগুলো সেগুলোও প্রায় ওইরকমই। হাতে আঁকা ছবি, সবই অ্যাকশনধর্মী। কেউ বন্দুক থেকে গুলি ছুড়ছে, কেউ ঘুষি, চাকু মারছে, কেউ পাহাড় থেকে পড়ে যাচ্ছে। শুধু কভার নয়, বইগুলোর ভেতরে যেসব ইলাসট্রেসন ছিল সেগুলোও প্রায় ওইরকমই, শুধু কভারগুলো ছিল কালার আর ভেতরের ছবিগুলো ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট। আর প্রতিটি বইয়ের কভারে নিচের দিকে লেখা ছিল শ্রীতপনকুমার। বলে থামল সায়ন্তন।
তারপর আবার বলল, আমার সাবজেক্ট বাংলা, ফলে শ্রীতপনকুমার নামটা আমি জীবনে শুনিনি তা নয়, কিন্তু ওই নামটুকুই কয়েকবার গল্পগুজবে কানে এসেছে, ব্যস, কোনওদিন তপনকুমারের বই চোখে পড়েনি, কেউ পড়ার বা পড়ানোর আগ্রহও দেখায়নি। শুধু ক্লাসে কখনও সখনো প্রফেসরদের বলতে শুনেছি, অমুকের লেখা তপনকুমারের মতো, সেটা ব্যঙ্গ করেই বলতেন ওরা।
অমরেন্দ্র তখন সায়ন্তনের দিকে তাকিয়ে নেই। অন্যদিকে তাকিয়ে অস্থিরভাবে পা নাচাচ্ছেন।
সায়ন্তন আবার বলা শুরু করল, সেই তপনকুমারের বই আমার প্রথম দেখা, শুধু তাই নয় সেটাও আবার আমার বাড়িতেই! বইগুলো সবই ওই আটচল্লিশ থেকে চৌষট্টি পৃষ্ঠার মধ্যে। আর দামও চার-আনা থেকে একটাকা। ভেতরের পৃষ্ঠাগুলো হলুদ, ভাঁজ করলে বিস্কুটের মতো ভেঙেও যেতে পারে। আমি কয়েকটা বইয়ের পাতা উলটে অল্প একটু পড়ার চেষ্টা করলাম। অ্যাকশন থ্রিলার মনে হল। পরে পড়ব ভেবে আমি গেলাম বাবার কাছে। বাবাকে সটান প্রশ্ন করলাম, এই বইগুলো কী? এমনভাবে এতদিন ধরে পুঁটুলি বেঁধে রেখে দেওয়া কেন?
বাবা আমার হাতে ধরা কয়েকটা বই দেখে বলল, কই দেখি? তারপরেই হো হো করে হেসে উঠল বলল, আরে, কোথায় পেলি এগুলো? এ যে শ্রীতপনকুমার সিরিজ! দেখি দেখি…।
বাবা আমার হাত থেকে বইগুলো নিয়ে পাতা উল্টেপাল্টে দেখে আমাকে ফেরত দিয়ে বলল, কোথায় ছিল এগুলো? সেই কবেকার বই!
আমি আবার বাবাকে জিজ্ঞাসা করলাম, বইগুলো এইভাবে গাঁটরি করে কেন রাখা ছিল। তাই শুনে বাবা আবার একচোট হাসল। আর বলল লম্বা একটা ইতিহাস।
সায়ন্তন দেখল অমরেন্দ্র পা নাচানো বন্ধ করেছেন। তিনি স্থির হয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়েই শুনছেন সায়ন্তনের কথা। সায়ন্তন থামতে উনি মুখ ফেরালেন। বললেন, ইতিহাস আবার কী? কোনও ইতিহাস নেই। ইতিহাস গড়েন নামী দামি লোকেরা। তপনকুমারের কোনও ইতিহাস নেই। কোনও ভূগোলও নেই। কিস্যু নেই।
না স্যর, আমার বাবা কিন্তু সত্যিই একটা বড় ইতিহাস সেদিন সারা দুপুর ধরে বলেছিলেন আমাকে। আর সেদিন বাবার কাছে শুনেই আমি অনেক কিছু ঠিক করে নিয়েছিলাম।
কী ঠিক করে নিয়েছিলে?
বলব স্যর। সবই বলব। বলব বলেই এসেছি। শুধু আমাকে একটু সময় দিন। বলেই বুক পকেটে রাখা মোবাইলে রেকর্ডিং-এর বোতামটা অন করে দিল সায়ন্তন।
সময় দেওয়ার কথা শুনে হ্যাঁ বা না কিছুই বললেন না অমরেন্দ্র। শুধু খুকখুক করে একটু কাশলেন।
সায়ন্তন যা বোঝার বুঝে নিল। আবার বলতে শুরু করল, আমি খুব অবাক হলাম জানেন, বাবা আমার ঘরে গিয়ে মাটিতে বসে বইগুলো ঘাঁটতে শুরু করল। একটা করে বই তোলে, পাতা ওল্টায় আর পুরোনো দিনের কথা বলতে থাকে। বাবার কলেজ লাইফের বই এগুলো। কলেজের সামনেই নাকি বিক্রি হত। ঝাঁকায় করে মুটে বই নিয়ে আসত আর পলকের মধ্যে সব বই শেষ। ছেলে বুড়ো সকলে ঝাঁপিয়ে পড়ে কিনে নিত বইগুলো। এনে দাদুর নজরে যাতে না পড়ে সেই জন্য বইগুলো লুকিয়ে রাখত বাবা। কারণ বাড়িতে ওইসব চটুল বই অ্যালাউড ছিল না। আমার ঠাকুর্দা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম, মধুসূদন পড়া মানুষ। এলিয়েট, বায়রনও আওড়াতেন। বাড়িতে নিজস্ব লাইব্রেরি, সেখানে দেশ বিদেশের বইয়ের সারি। অন্তত হাজার কয়েক বই ছিল। প্রতি মাসে বিদেশ থেকেও ম্যাগাজিন আসত, বই আসত। নিজের ছেলেকেও ওই ক্লাসিকাল লিটারেচারেই শিক্ষিত করার চেষ্টায় ছিলেন। কিন্তু তাও শেষ রক্ষা হল না। ছেলে, মানে আমার বাবা কলেজে পড়ার আগে থেকেই দস্যু রোহণে চোখ তৈরি করে নিয়েছিলেন। অবশ্য দস্যু রোহণ আমিও কোনওদিন পড়িনি। ওই গল্পও বাবার কাছে, আর স্কুল কলেজের স্যরেদের কাছে শোনা।
দস্যু রোহণ…হুঁ। খুব নিচুস্বরে শব্দটা বলে সামান্য যেন হাসলেন অমরেন্দ্র।
হ্যাঁ স্যর, দস্যু রোহণ। তো যাক যেটা বলছিলাম, একদিন নিজের ঘরে তপনকুমারের একটি বই এমনই বুঁদ হয়ে বাবা পড়ছিল যে ঘরে দাদু ঢুকেছে বাবার হুঁশই নেই।
কী পড়ছিস এটা, বলে দাদু যখন হুংকার দিয়েছে তখন আর বই লুকোনোর উপায় ছিল না। ফলে যা হওয়ার তাই হল, যতগুলো বই ছিল প্রায় সবকটাই দাদুর হাতে তুলে দিতে হল বাবাকে। কলেজে পড়লে হবে কী, দাদুর দোর্দণ্ডপ্রতাপের কাছে বাবা তখনও কেঁচো।
বাবার মন খারাপ সব বইগুলো খুইয়ে, আর জীবনে ফেরত পাবার চান্স তো নেই-ই উলটে আরও কী কী ঘটে তার জন্য অপেক্ষা করতে থাকল। আর এর পরেই শুরু হল আসল মজা। বাবা সাধারণত দাদুর ঘরে খুব একটা যেত না, একদিন রাতে খাওয়া দাওয়ার পর কী একটা দরকারে দাদুর ঘরে ঢুকেও বাবা নিঃশব্দে বেরিয়ে এসে নিজের ঘরে ঢুকে একা একাই তুমুল হেসেছিল, কেন জানেন?
কেন? মুখ গম্ভীর করে এই প্রথমবার নিজে একটি প্রশ্ন করলেন অমরেন্দ্র।
কারণ দাদু তখন চেয়ারে বসে টেবিলে ঝুঁকে একটি বই পড়ছিলেন। আর সেই বইটা ছিল বাবার থেকে ছিনিয়ে নেওয়া শ্রীতপনকুমার সিরিজের একটি বই। বলে হাসল সায়ন্তন।
হুঁ, বলে শুধু অল্প মাথা নাড়লেন অমরেন্দ্র।
সায়ন্তন আশা করেছিল লোকটা আরেকটু বেশি রিয়্যাক্ট করবে, কিন্তু করল না। কেমন যেন পাথুরে টাইপ হয়ে গিয়েছে। স্টোনম্যান।
সায়ন্তন বলল, তারপর যেটা হল আরও মজার। পরদিন সকালে দাদু এসে বাবাকে বলল, তোর কাছে আরও ওইসব বই থাকলে এখনই দে, নইলে পরে যদি খুঁজে পাই বাড়ি থেকে দূর করে দেব। বাবার কাছে আর কিছুই ছিল না। বাবার নামে বাড়িতে সার্চ ওয়ারেন্ট বেরোল। ঘর তন্নতন্ন করে খোঁজা হল কিছুই পাওয়া গেল না। ঘর তল্লাসি করাতে বাবা বেজায় অপমানিত বোধ করে দাদুর সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিল, আর তার ঠিক দুদিন পরেই দাদু সরাসরি এসে বাবাকে বলল, তোকে ওই বইগুলো পড়ার পারমিশন দিতে পারি শুধু একটা শর্তে।
কী শর্ত?
তোর পড়া হয়ে যাওয়ার পর বইগুলো নিজের কাছে রাখতে পারবি না, আমার কাছে জমা করে দিতে হবে।
তাই শুনে হাসি আর চাপতে পারছিল না বাবা। কিন্তু প্রাণপণে হাসি চেপে বলেছিল, কিন্তু বাবা আমি যে তোমার বারণ শুনে ওই বই পড়া ছেড়ে দিয়েছি।
তাই শুনে দাদু বলল, নাহ আমি একটু উল্টেপাল্টে দেখেছি একেবারে জঘন্য নয়। পড়তে পারিস। তবে নিজের কাছে রাখতে পারবি না।
বাবা রাজি হয়ে গেল। তারপর শুরু হল বাপ-ব্যাটার দুজনেরই তপনকুমার পড়া।
বাবার কাছে শুনেছি, দাদুর নাকি এক একটা বই এক বেলাতেই শেষ হয়ে যেত। তারপরেই বাবার কাছে এসে খুঁজত।
এতটা শুনে মুচকি হাসলেন অমরেন্দ্র। তারপর বললেন এমন বেঁকে বসে রয়েছ কেন? চৌকিতে পা তুলে বসো। আমার চৌকি কোনও নামী সাহিত্যিকের পালঙ্ক নয় যে, পা ঠেকলে অনন্ত নরকবাস হবে।
শুনে হাসল সায়ন্তন। বলল, স্যর শ্রীতপনকুমারের মতো সাহিত্যিক হতে গেলে কয়েকজন্ম তপস্যা করতে হয়।
তোমার ব্যাপার কী হে ছোকরা? এই ভর দুপুরে কি তুমি আমার সঙ্গে মস্করা করতে এসেছ! হঠাৎই খেঁকিয়ে উঠলেন অমরেন্দ্র।
স্যরি স্যর, আপনি প্লিজ রাগ করবেন না। রাগলেই আপনার কাশি বেড়ে যাবে।
বাড়ুক কত বাড়বে গত কুড়ি বছর ধরে কাশিবাস করছি, এই আমার কাশিধাম। আশি বছর বয়েস পার হয়ে গেল। আর কতদিন?
এইভাবে বলবেন না স্যর। তবে ছোট মুখে একটা বড় কথা বলছি, প্লিজ কিছু মনে করবেন না, আপনি যে এই ঘরটায় রয়েছেন দেখে মনে হচ্ছে ড্যাম্প ধরা, আর আলো বাতাসও তেমন ঢোকে না, সর্দিকাশি বা শ্বাসের সমস্যা থাকলে শুনেছি এই রকম ঘরে…
তুমি কি ডাক্তার?
না, মানে…
তাহলে ডাক্তারি ফলিও না। ডাক্তারিটাও আমি কিছু কম বুঝি না। বুঝেছ ছোকরা, এই বস্তির গুমটিতে থাকি বলে ভেবো না যে অমরেন্দ্র পান্ডে ডাক্তারি ভুলে গিয়েছে, অ্যাঁহ!
না না স্যর…মানে আপনি…
মানে আমি ঠিক এখনও ততটাই আপডেট যতটা একজন প্র্যাকটিস করা ডাক্তার থাকেন কিংবা থাকেন না। বুঝেছ?
ডাক্তার মানে…
ব্যাঁকা হাসলেন অমরেন্দ্র। তারপর আচমকাই হাত তালি দিয়ে ঠিক জমিদারের স্টাইলে হাঁক পেরে উঠলেন, কে আছিস?
প্রশ্নটা করা মাত্র ঘর জুড়ে ঠিক কী হল বুঝতে পারল না সায়ন্তন, প্রবল বেগে ঘরের ভেতর ঝড় শুরু হল। ভয়ংকর ঝড়। এসব কী হচ্ছে কিছু বুঝতে পারল না সায়ন্তন। ভয় লাগতে শুরু করল খুব। ঘরের সবকিছু যেন ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। ছত্রভঙ্গ হয়ে যাচ্ছে। চোখে যেন ধাঁধা লেগে গেল। উফফফ…ভয়ে হাত পা গুটিয়ে যাচ্ছে। এ কেমন ঝড়! কিছুই দেখা যাচ্ছে না তার প্রাবল্যে। ঘরের ভেতরেই এমন হলে বাইরে তাহলে কী অবস্থা? ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল ও। চেতনায় কেমন যেন ঘোর লেগে যাচ্ছে। অনেক দূর থেকে কেউ একটা কথা বলছে। নাম ধরে ডাকছে সায়ন্তনকে।
চোখ মেলল সায়ন্তন। ঝড় থেমেছে। ঘরের ভেতর একই রকম। কিন্তু সামনে এ কে! কে দাঁড়িয়ে! গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল সায়ন্তনের। মুহূর্তের মধ্যে শরীরের সব রোম খাড়া হয়ে উঠল। ওর খুব সামনে যে একটি অবয়ব দাঁড়িয়ে রয়েছে তার চেহারা সেই কমিক্সের চরিত্রের মতো! অবিকল কমিক্সের ব্যাটম্যানের মতো গায়ে কালো চাপা পোশাক। কালো মুখোশ। পিঠে ওই ব্যাটম্যানের মতোই কালো ওড়না বাঁধা। লেগিংসের মতো কালো চাপা প্যান্টের ওপর একটা জাঙিয়া পরা। জাঙিয়ায় আবার বেল্ট লাগানো। বেল্টের দুদিকে লটপট করে ঝুলছে দুটো রিভলভারের খাপ। সবকিছু নিখুঁত শুধু ব্যাটম্যানের চেহারাটা ওই অমরেন্দ্রবাবুর মতোই প্যাঁকাটি। চাপা পোশাক পরে থাকায় সুপার হিরোর বদলে কেমন অনাহারক্লিষ্ট সোমালিয়াবাসীর মতো দেখাচ্ছিল।
সায়ন্তন চৌকিতে পা তুলে ফেলেছিল, কেঁপে কেঁপে উঠছিল ভয়ে। অমরেন্দ্র অন্যপ্রান্তে বসে ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি ঝুলিয়ে তাকিয়ে ছিলেন সায়ন্তনের দিকে।
কে…কে? অতি কষ্টে গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোল সায়ন্তনের।
উত্তরটা অমরেন্দ্রই দিলেন, সে কী, চিনতে পারলে না দেখে? ভালো করে দেখো।
সায়ন্তন দেখবে কী? বুকের ভেতর ধড়াস ধড়াস করছে। এতক্ষণের চেনা পরিবেশটা একটা হাততালিতে এমন বদলে গেলে যে কোনও সুস্থ মানুষেরই ভয় লাগা স্বাভাবিক। অমন প্রবল ঝড় তারপরেই এমন অদ্ভুত পোশাক পরা একটা প্রাণী। মানে চেহারাটা মানুষের মতোই কিন্তু আদৌ ম্যান না সুপারম্যান ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
রোগা ব্যাটম্যানটা আরও এগিয়ে এল সায়ন্তনের দিকে। ওর পিঠে বাঁধা কালো ওড়নাটা মেঝেতে লোটাচ্ছে। মুখোশের ওপর দিয়েই গাল চুলকাল ব্যাটম্যান। তারপর কিছুটা ঘরঘরে গলায় বলে উঠল, আমি স্যর বাজপাখি। ওনার বড়ছেলে। বলে গলা খাঁকড়াল সে। গলাতে কফ-এর উপস্থিতি জানান দিল।
মুখোশটা ব্যাটম্যানের মতো হওয়ায় নাকের দুপাশ থেকে খোলা। মুখ পুরো ঢাকা নয়। নাক, ঠোঁট, চিবুক সবই দেখা যাচ্ছে। সায়ন্তন খেয়াল করল কথা বলতে বলতে বাজপাখি যখন হাসল ওর কালচে ঠোঁটের ভেতরে থাকা তরমুজের বিচির মতো দাঁতগুলো দেখা গেল। নির্ঘাত গুটখা খায়। বাজপাখি…নামটা যেন…সেই বাজপাখি!
মনে পড়েছে? সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করলেন অমরেন্দ্র।
পড়েছে। হ্যাঁ, মনে পড়েছে। বাজপাখি…কিন্তু সে তো?
এবার খিক খিক করে হেসে উঠল মুখোশপরা বাজপাখি। নাক টেনে সর্দির শব্দ তুলে আবার খড়খড়ে গলায় বলল, সে তো অনেক কাল আগের গল্প ভাইটি। আমার বাবারও বয়েস হয়েছে, আমারও হয়েছে। আমাদের সকলেরই হয়ছে।
আপনি মানে…
অত ইয়ে ইয়ে করার কী রয়েছে? ওকে ডাকলাম কারণ তোমাকে চা দিতে বলব। খাবে তো?
হ্যাঁ। কিছু ভাবার আগেই মুখ থেকে খসে পড়ল শব্দটা।
তবে বিস্কুট নেই। শুধু চা। চলবে?
সায়ন্তনের মুখ থেকে সহজে কথা সরছিল না। খোদ কলকাতা শহরে দিনে দুপুরে এসব কী ঘটছে তা ওর মাথায় ঢুকছিল না কিছুতেই।
কী হল? জল বসাবে কি তোমার?
অ্যাঁহ…হ্যাঁ…খাব। চা খাব।
সায়ন্তনের কথা শুনে খ্যাক করে হাসল বাজপাখি। তারপর পিঠে বাঁধা ময়লা কালো ওড়নাটাকে এক ঝটকা দিয়ে ওইটুকু ঘরেই শোঁও করে দুই কদম উড়ে গিয়ে বসল ঘরের কোণে রাখা স্টোভের সামনে। তারপর স্টোভটা জ্বালতেই ঘরময় ছড়িয়ে পড়ল কেরোসিনের গন্ধ। এনামেলের বাটিতে জল ঢালল মাটির কুঁজো থেকে। এখনও কলকাতায় কুঁজো পাওয়া যায়!
স্টোভে জল বসিয়ে বাজপাখি আবার পিছন ফিরে জিজ্ঞাসা করল, স্যর, আপনি চায়ে চিনি খান?
খাই। একটু ধাতস্থ হতে শুরু করেছে সায়ন্তন। নিজেকে প্রাণপণে বোঝানোর চেষ্টা করছে এই পৃথিবীতে বহুকিছু ঘটে যা যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা হয় না। ফলে সবকিছুতে ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টা করেও লাভ নেই। তার থেকে বরং যা ঘটছে ঘটুক।
আপনাকে দেব নাকি এক কাপ?
বাজপাখি অমরেন্দ্রবাবুকে প্রশ্নটা করার সঙ্গে সঙ্গে আবার তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন তিনি। জুতোপেটা করব হারামজাদা। এই শেষ দুপুরে আমি কবে চা খেয়েছি? আমার জিনিসপত্র দে।
ফিক করে হেসে ঘরের মধ্যে একটা ডিগবাজি খেয়ে চৌকির তলায় ঢুকে গেল বাজপাখি, তারপর আবার ঠিক ওই স্টাইলেই বেরিয়ে এল। একটা কাচের বোতল আর কাচের গ্লাস। বোতলে জল ভরা।
ঢেলে দেব? জিজ্ঞাসা করল বাজপাখি।
শুয়োরের বাচ্চা! তো আমি কি নিজে ঢেলে খাব? আবার খেঁকিয়ে উঠলেন অমরেন্দ্র।
একটা মানুষ জীবনে এত ক্ষুব্ধ কেন? কীসের এত রাগ জগতের প্রতি। আর এই বাজপাখিও কেনই বা অমরেন্দ্রর এত গালাগাল মুখ বুজে হজম করে নিচ্ছে।
সায়ন্তন ভেবেছিল, বোতলে সত্যিই জল রয়েছে। সাদা জল। কিন্তু বাজপাখি সেই বোতল খুলে যে কায়দায় কাচের গেলাসে সেই তরল মেপে ঢালল, তাতে সায়ন্তনের আর বুঝতে বাকি রইল না যে জলের মতো দেখতে বস্তুটি আসলে বিশুদ্ধ বাংলা। প্রখ্যাত সাহিত্যিক শ্রীতপনকুমার বাংলা মাল খায়—এই দৃশ্য সায়ন্তনকে আবার একটু আঘাত দিল।
দিশি মাল অত সাহেবি কেতায় মেপেমুপে দিচ্ছিস কেন রে হারামজাদা? মন খুলে ঢাল।
আজ্ঞে না, পারলাম না। ডাক্তার কী বলেছেন আপনাকে? একেবারে মেপে, আমাকে মেরে ফেললেও এর বেশি দেব না।
ধ্যার হারামদাজা, আমাকে ডাক্তার দেখাচ্ছে! আমি ডাক্তার অমরেন্দ্রনাথ পান্ডে…
স্যর, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?
কী? গেলাসটা হাতে নিয়ে চুমুক দিয়ে সায়ন্তনকে পালটা প্রশ্ন করলেন অমরেন্দ্র।
আপনি সত্যি ডাক্তার ছিলেন?
সায়ন্তনের প্রশ্নে খিক খিক করে হেসে উঠল মেঝেতে উবু হয়ে বসে চা বানাতে বসা বাজপাখি।
অমরেন্দ্র আরও একটা চুমুক দিলেন গেলাসে। তারপর একটা রইস হাসি হেসে সায়ন্তনকে বললেন, তাকাও ওই দেওয়ালে।
সায়ন্তন ওর উল্টোদিকের নোনাধরা দেওয়ালটার দিকে তাকিয়ে দেখল কেউ যেন দেওয়ালটা স্ক্রিন বানিয়ে অদৃশ্য প্রোজেক্টরে কোনও পুরনো তথ্যচিত্র চালিয়েছে। ছয়-সাত দশকের বাংলা ছবিগুলো টিভিতে দেখতে বসলে এমন মুড়ি ভাজার মতো ক্রমাগত করকর শব্দ ওঠে আর তার মধ্যে ছোপছোপ দাগ এবং সাদা কালোর সাদাটা হলদেটে এবং ঝাপসাটাইপ হয়, ঠিক তেমনই। এই ঘরে এটা কে চালাল? কোথা থেকে আলো আসছে? কী এটা? পরপর প্রশ্নগুলো মাথায় আসতে অমরেন্দ্র বললেন, শ্রীতপনকুমারকে জানতে এসেছ তাই না? তাহলে অত কেন, কী করে এসব প্রশ্ন বাদ, দেখো চুপ করে।
সায়ন্তন যুক্তি, বিচারবোধ উড়িয়ে দিয়ে চোখ রাখল ওই অতি প্রাচীন দেওয়ালের ছায়াছবিতে।
গভীর রাত। কলকাতার আর এস কর হাসপাতালের ছাত্রাবাসের একটি ঘর। সার সার অনেকগুলি বেড পাতা, প্রতিটি বেডেই একজন করে তরুণ শায়িত, সকলেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ঘরে একটিমাত্র বাতি টিমটিম করে জ্বলছে। তার আবছা আলোতে ঘরের সবকিছুই কেমন বিষণ্ণ এবং রহস্যময় মনে হচ্ছে। ঘরটিকে দেখে মনে হচ্ছে যেন লাশকাটা ঘর। এক একটি বেডে যেন এক একটি লাশ শোয়ানো রয়েছে কাটা ছেঁড়া করার জন্য। এমনই নিঃশব্দ, এমনই করুণ।
এই গোটা হলঘরটিতে একটি মাত্র ছেলে জেগে রয়েছে। সে চুপ করে বসে রয়েছে তার বেডে। ঘুম আসছে না, কিছুতেই ঘুম আসছে না তার। আজ রাতে তার ঘুম আসবে না। ছেলেটির সামনে রাখা রয়েছে একটি খাম খোলা চিঠি। চিঠিটা আজ সকালে এসেছে তার কাছে। সকাল থেকে অনেকবার পড়েছে চিঠিটা। আর যতবার পড়েছে প্রতিবারই যন্ত্রণায় কাতর হয়ে উঠেছে ডাক্তারির দ্বিতীয় বর্ষে পাঠরত এই সদ্য তরুণ। তাহলে কি এতদিনের স্বপ্ন, এত লড়াই এত সহজে চুরমার হয়ে যাবে! এক পৃষ্ঠার চিঠিটায় যতবার চোখ রাখছে ছেলেটি ততবারই চোখ ভিজে উঠছে, ঝাপসা হয়ে উঠেছে পৃথিবীর চারদিক। অস্থির লাগছে, বুকের ভেতর চাপ চাপ ব্যথা। শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে।
চিঠির প্রতিটি লাইন মুখস্থ হয়ে গিয়েছে ছেলেটির—
স্নেহের অমর,
আশা করি কুশলে আছ। আমরা এখানে জগদীশ্বরের আশীর্বাদে কালাতিপাত করছি। তবে সেই দিনযাপন সুখের নয়। সংসারের আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে তোমাকে নতুন করে কিছুই বলার নেই। তুমি আমাদের বংশের একমাত্র পুত্র সন্তান, তোমার স্বপ্নপুরণ করা আমার ঐকান্তিক ইচ্ছা ছিল, কিন্তু অতিশয় দুঃখের সঙ্গে তোমাকে জানাচ্ছি, শারীরিক অসুস্থতার কারনে দীর্ঘদিন হ’ল কোর্টে যেতে পারি না, চেম্বারেও বসা অসম্ভব হয়ে গিয়েছে। ফলতঃ মক্কেল আসা বন্ধ এবং উপার্জন গত কয়েকমাস যাবত প্রায় শূন্যই বলা যায়। ডাক্তার, কবিরাজ কেউই এই রোগ নিরাময়ের আশ্বাস দেননি। ফলে আমার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। কতদিন আর এই পৃথিবীর আলো দেখব আমি নিজেও জানি না। সঞ্চিত অর্থ দ্বারা আমার চিকিৎসা এবং সংসারের এবং তোমার ডাক্তারি পড়ার যাবতীয় খরচ সামলাতে গিয়ে এখন বুঝতে পারছি আর সম্ভব নয়। এই মুহূর্তে যদি খরচকে না সামলাই তাহলে অদূর ভবিষ্যতে পুরো পরিবারকে অনাহারে থাকতে হবে। তাই অতিশয় দুঃখের সঙ্গে তোমাকে জানাই, এই মাস থেকে তোমার ডাক্তারি পড়ার যে খরচ তার ভার আমি নিতে অপারগ। এই পত্রের সঙ্গে যে অর্থটুকু পাঠালাম এটাই শেষ। পিতা হিসেবে এ আমার ব্যর্থতা আমি জানি, আমাকে পারলে ক্ষমা কোরো। এই পত্র পাওয়া মাত্র তুমি হয় গৃহে ফিরে এসো অথবা যদি নিজ উপার্জনে নিজের পড়াশোনার খরচ চালাতে পারো তাহলে ভালো হয়। কলকাতা শহরে অর্থ উপার্জনের হাজার পথ রয়েছে। যদি নিজ যোগ্যতায় দুই একটি পথ খুঁজে নিতে পারো তবে তোমার ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন সফল হবে। আমার আশীর্বাদ সর্বদাই তোমার প্রতি রয়েছে। তোমার মায়ের শরীর একপ্রকার।
সুস্থ থেকো। তোমার পত্রের আশায় রইলাম।
বাবা
চিঠির প্রতিটি লাইন এতবার পড়েছে তরুণটি যে প্রতিটি শব্দ মুখস্থ হয়ে গিয়েছে। দুপুরে চিঠিটি হাতে আসার পর থেকে মাথায় যেন বাজ পড়েছে ছেলেটির। আর কিছু ভালো লাগছে না, কিচ্ছু না। এক পৃষ্ঠার চিঠিটা খামে ভরতে গিয়ে আবার খামের ঠিকানায় চোখ পড়ল ছেলেটির। নীল কালিতে লেখা। শ্রী অমরেন্দ্রনাথ পান্ডে (দ্বিতীয় বর্ষ)। ছাত্রাবাস, আর এস কর হাসপাতাল। শ্যামবাজার, কলিকাতা ৭০০০০৪।
চিঠিটা খামে ভরে বিছানার তলায় রেখে উঠে দাঁড়াল উনিশ বছরের তরুণ অমরেন্দ্র। তারপর পায়ে চটি গলিয়ে বেরিয়ে এল ঘরের বাইরে। মনের ভেতরে উথাল পাথাল। ঘর লাগোয়া লম্বা করিডর দিয়ে পায়চারি করতে থাকল। মস্ত, নিঝুম করিডরটায় মাত্র দুটো বাতি জ্বলছে। আলোর জোর খুবই কম। শুধু অমরেন্দ্রর নিজের পায়ের শব্দ।
অসহ্য… অসহ্য লাগছে সবকিছু। এই হাসপাতাল, এই ছাত্রাবাসের প্রতিটি দেওয়াল, ছাদ গত রাত পর্যন্তও কত প্রিয় ছিল, কত আপন ছিল। পাখির বাসার মতো এই হাসপাতালের প্রতিটি অলিন্দের কোণে, ঘুলঘুলিতে তার স্বপ্ন বাসা বেঁধে রয়েছে। সেগুলো সব টান মেরে ছিঁড়ে ছত্রাকার করে দিয়েছে কেউ।
নাহ, আর পারা যাচ্ছে না। আর কিছুতেই পারা যাচ্ছে না। করিডরের শেষপ্রান্তে সিঁড়ি। নেমে এল অমরেন্দ্র। ছাত্রাবাসটির সামনে বেশ কিছুটা ফাঁকা জায়গা। তারপর হাসপাতালের মূলভবন। ওদিকে আলো জ্বলছে। এখন রাত প্রায় একটা। হাসপাতালের চত্বরে ইতস্তত মানুষজন, কেউ বসে ঝিমোচ্ছে, কেউ চাদর পেতে গভীর ঘুমে। কয়েকজন জটলা পাকিয়ে নিচু গলায় গল্প করছে। এদের সকলেই প্রায় রুগির আত্মীয়স্বজন।
হাসপাতালের মূল ফটক সারাক্ষণই খোলা। ধীর পায়ে বাইরে বেরিয়ে এল অমরেন্দ্র।
খুব মনে পড়ছে বছর দেড়েক আগের সেই দিনটা, যেদিন দেশের বাড়ি থেকে জিনিসপত্র নিয়ে বাবার সঙ্গে এই বিশাল বাড়িটায় পা রেখেছিল অমরেন্দ্র। দুই চোখে কত স্বপ্ন ছিল সেদিন। কত ছোটবেলা থেকে ডাক্তারি পড়ার স্বপ্ন।
কণৌজের ব্রাহ্মণ এই পান্ডে পরিবারের আদি বাড়ি ছিল রাজশাহী। ঠাকুর্দা রণেন্দ্রনাথ ছিলেন সেই সময়ের নামকরা ব্যারিস্টার। দোর্দণ্ড প্রতাপ ছিল তাঁর। রণেন্দ্রপ্রতাপ কোনও কেস হাতে নিলে প্রতিপক্ষের গলা শুকিয়ে যেত। কারণ রণেন্দ্র ছিলেন প্রায় অপরাজেয়। বিশাল সম্পত্তি করেছিলেন তিনি। প্রতিদিন দুই বেলা অন্তত পঞ্চাশটি পাত পড়ত পান্ডে বাড়ির দালানে। ঠাকুর্দার বয়েস হয়ে যাওয়ার পর রাজশাহীর সকল স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়ে চলে এলেন বিজয়নগরে। বিজয়নগর ভারি সুন্দর এক জায়গা। কলকাতা শহর থেকে রেলপথে ঘণ্টা পাঁচেকের পথ। চারদিকে সবুজ প্রকৃতি। ওখানেই বাড়ি করলেন তিনি। একমাত্র ছেলে তপেন্দ্রনাথকে গড়ে তুলতে লাগলেন নিজের মনের মতো করে।
অমরেন্দ্রর বাবা, তপেন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর পিতৃদেবের প্রতি নিবেদিত প্রাণ। রণেন্দ্রনাথকে এক জ্যোতিষী বলেছিলেন, তোর বংশে আইনি পেশাতেই উন্নতি রয়েছে। অন্য কোনও পেশায় গেলে ছারখার হয়ে যাবি। জ্যোতিষীর কথা মেনে রণেন্দ্র নিজে যেমন আইনের পেশায় স্বনামধন্য হয়েছিলেন নিজের পুত্রকেও আদেশ করেছিলেন তাঁর পথে চলতে। তপেন্দ্র তাঁর পিতার পথই অনুসরণ করেছিলেন। অমরেন্দ্রর যখন মাত্র দুই বছর বয়েস তখন রণেন্দ্রনাথ পরলোকে গেলেন। ফলে ঠাকুর্দার কোনও স্মৃতিই অমরেন্দ্রর নেই। শুধু বাবার চেম্বার এবং বৈঠকখানার ঘরে ঠাকুর্দার যে দুটি মস্ত বাঁধানো ছবি ছিল আর বাবার মুখ থেকে শোনা গল্প, এর থেকেই ঠাকুর্দার সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল অমরেন্দ্রর।
বাবাও ব্যারিস্টার হয়েছিলেন। তবে ঠাকুর্দার মতো সংযমী জীবনযাত্রা তার কোনও কালেই ছিল না। সবকিছুতেই বড্ড বেহিসাবি। নিজের উপার্জন তো দুই হাতে ওড়াতেনই উপরন্তু ঠাকুর্দার সঞ্চয়ও দেদার খরচ করতেন। বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে আমোদ আহ্লাদ, কেউ চাইলেই তাকে টাকা ধার দিয়ে ভুলে যাওয়া, দান খয়রাত। আর সঙ্গে মদ্যপান। এই নেশাটি বাবাকে অল্প বয়েসেই শারিরীক এবং আর্থিক, দুই দিক থেকেই অসমর্থ করে দিয়েছিল। অমরেন্দ্র ইস্কুল বয়েস থেকেই দেখত বাড়িতে নিত্যদিন ডাক্তার বদ্যি লেগেই রয়েছে। অতিরিক্ত মদ্যপান এবং বেহিসাবি জীবনের কারণে বাবা খুব দ্রুত নিজের কর্মস্থলেও অনিয়মিত হয়ে পড়ছিল। সংসারের খরচের একটা বড় অংশ চলে যেত বাবার চিকিৎসায়, এবং তার থেকেও বড় সমস্যা ছিল বিজয়নগরে চিকিৎসকের অভাব। ছোট মফস্বলে ডাক্তার পাওয়া যায় না। বাবার পেটে যখন তখন যন্ত্রনা উঠত, ডাক্তার ডাকতে ছুটতে হতো অমরেন্দ্রকে। কোনওদিন পাওয়া যেত কোনওদিন যেত না। চিকিৎসার অভাবে অনেকেই মারা যেতেন ওই অঞ্চলের।
ফলে তপেন্দ্রনাথ যেদিন তার পুত্রের মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, বাবা অমর, আমি তো আমার বাবার মতো অমন নামী ব্যারিস্টার হতে পারলাম না, আমি ব্ল্যাকশিপ, তুমি তোমার ঠাকুর্দার সম্মান রেখো। এমন ব্যারিস্টার হয়ো যাতে দূর-দুরান্তের মানুষ এক ডাকে তোমাকে চিনতে পারে। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে সেদিন অমরেন্দ্র বলেছিল আমি ব্যারিস্টার হতে চাই না বাবা।
সে কী কথা! কী করবে তাহলে?
আমি ডাক্তার হতে চাই। ব্যারিস্টার হওয়ার থেকে একজন ডাক্তার হওয়া আরও বেশি দরকার বাবা।
ছেলের যন্ত্রণা বুঝেছিলেন তপেন্দ্র। তার মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন, তোমাকে আমি জোর করব না, তুমি জীবনে যা হতে চাও, তাই হয়ো। জানি না জ্যোতিষীর কথা যদি সত্যি হয় তবে হয়তো অন্য পেশায় যাওয়া তোমার জীবনের পক্ষে ক্ষতিকারক হবে, কিন্তু তার জন্য আমি তোমার স্বপ্নকে নষ্ট করতে চাই না। ভবিষ্যতে কী হবে জানি না, কিন্তু তোমার ইচ্ছেয় আমি বাধা দেব না। যা হতে চাইছ, সেই পথেই এগোও।
অমরেন্দ্র বেশ বুঝতে পেরেছিল, বাবা নিজের অনিচ্ছাকে চেপে রেখে অমরেন্দ্রকে উৎসাহ দিচ্ছেন। সত্যি বলতে, তপেন্দ্র জানতেন তার পুত্রটি স্বভাবে শান্ত হলেও বড় জেদি, কিছু একটা মনস্থির করলে সেটা করেই ছাড়বে। ছোট থেকেই বইয়ে মুখ গুঁজে থাকতে ভালোবাসে অমরেন্দ্র। ক্লাসে পড়াশোনায় বরাবরই ভালো, শুধু তাই নয়, গল্পের বইতেও সমান নেশা। বিশেষ করে অ্যাডভেঞ্চার, রহস্য রোমাঞ্চ কাহিনির পোকা। খেলাধুলোয় তেমন আগ্রহ নেই। ক্লাসের পড়া শেষ করেই রহস্য রোমাঞ্চের সব বইয়ে ডুব। দুটো লাইব্রেরির মেম্বার। মোটা মোটা বই কয়েকদিনের মধ্যেই শেষ। তপেন্দ্র ভাবেন ছেলেটা একটু অন্যরকম।
স্কুল পাশ করার পর আর বিজয়নগরে থাকেনি অমরেন্দ্র। সোজা কলকাতায় পড়তে চলে আসে। মেসে থেকে অনেক কষ্ট করে নিজেকে ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করে তোলা একটা কঠিন লড়াই ছিল। তারপর ডাক্তারি পরীক্ষায় সসম্মানে পাশ করার খবরটা যেদিন পেয়েছিল, আনন্দে ঘুম আসেনি অমরেন্দ্রর। একদিন ডাক্তার হয়ে নিজের ভিটেতে ফিরে এসে বিনা পয়সায় গরিব মানুষদের চিকিৎসা করার একটা স্বপ্ন এবার সফল হবে। হবেই।
সেই জেদেই তল্পিতল্পা নিয়ে আর এস কর হাসপাতালের মূল ফটকে পা রেখেছিল সে। সেদিন অসুস্থ শরীর নিয়েও বাবা এসেছিল ছেলের আনন্দে সামিল হতে, ভরসা দিতে। তাঁর নিজের মনেও আশা ছিল ছেলেকে ডাক্তারি পড়ানোর যে খরচ, তা হয়তো শেষ পর্যন্ত তিনি সামলে উঠতে পারবেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। শেষের দিকে ধার-কর্জ করাও শুরু হয়ে গেল। বাড়িতে পাওয়ানাদারদের নিত্য আনাগোনা।
লিভার নষ্ট হয়ে গিয়েছিল তপেন্দ্রর। বাঁচার আশাও কমে আসছিল দিনে দিনে। সেটা নিজেও টের পাচ্ছিলেন, কিন্তু বড় আশা ছিল ছেলেটাকে ডাক্তার হতে দেখে যাবেন। হল না। এমনকী তাঁর মৃত্যুর আগেই ছেলের পড়া থামানোর চিঠি লিখতে হল তাঁকে। এ যে একজন পিতার কাছে কতটা যন্ত্রণার! শুধু শত যন্ত্রণার মধ্যে একটাই আশার ক্ষীণ আলো ছিল তার পুত্রের মেধা। কলকাতা শহরে দুটো টিউশন করেও নিজের খরচটা অন্তত তুলতে পারে…সেই আশাতেই চিঠিতে ওই কথা উল্লেখ করেছেন তিনি।
পুরোনো স্মৃতিগুলো হাতড়াতে হাতড়াতে কখন যে হাসপাতালের মূল ফটক ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে খেয়াল নেই অমরেন্দ্রর। ঘন অন্ধকার। আকাশে চাঁদ বা তারা কিছুই নেই। রাস্তার দু-একটি গ্যাসবাতি শুধু নিজেকেই আলোকিত করছে, বাকিটা অন্ধকার। রাস্তার দুধারে ঢ্যাঙা বাড়িগুলো অন্ধকারাচ্ছন্ন, নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে। মাঝে মাঝে কুকুর ডাকছে। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সামনের একটা গলিতে ঢুকে পড়ল অমরেন্দ্র। মনের ভেতর উথাল পাথাল। তাহলে কি সত্যিই নিজের স্বপ্ন এইভাবে শেষ হয়ে যাবে? ডাক্তার হওয়া আর হবে না?
বাবা লিখেছে কলকাতা শহরে হাজারটা রোজগারের পথ রয়েছে, কিন্তু কী সেগুলো? কিছুই জানা নেই। বছর কয়েক হয়ে গেল কলকাতার জীবন, কিন্তু শুধু নিজের পড়াশোনার জগৎ ছাড়া বাইরের কলকাতা যে আর কিছুই দেখা হয়নি। কী হবে কাল থেকে? কলেজের ফিজ এক মাস বাকি রাখা যায়, কিন্তু খাওয়া দাওয়া ইত্যাদির খরচ? বাবা যা টাকা পাঠাত তা সামান্যই, তবু তার থেকে প্রতি মাসে কিছু টাকা বাঁচিয়ে খুব অল্প হলেও একটা মোটামুটি সঞ্চয় হয়েছে। তাতে অবশ্য…
আচমকাই কুকুরের চিৎকারটা বেড়ে গেল। রাতের নৈঃশব্দকে খান খান করে দিয়ে সমবেত ঘাউ ঘাউ চিৎকার। বেশ ভয় পেয়ে গেল অমরেন্দ্র। কুকুরের চিৎকার শুনে মনে হচ্ছে এদিকেই দ্রুত এগিয়ে আসছে। প্রতিটি বাড়ির সদর দরজা বন্ধ, কোথাও নিজেকে আড়াল করার উপায় নেই। কী হবে এবার?
বেখেয়ালে হাঁটতে হাঁটতে কোন গলিতে ঢুকে পড়েছে নিজেই বুঝতে পারছে না। পায়ের শব্দ। সহসাই দেখতে পেল, কেউ একজন প্রাণপণে ছুটে আসছে ওর দিকেই। বুক কেঁপে উঠল অমরেন্দ্রর। পাদুটো যেন মাটিতে আটকে গিয়েছে।
গলিটা যথেষ্ট সরু, ও যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেখান দিয়ে আরও একটা সরু গলি ডানদিকে চলে গিয়েছে। লোকটা প্রায় মরিয়া হয়ে ছুটে আসছে, হাতে একটা ব্যাগ, নিমেষে অমরেন্দ্রর কাছে এসে গিয়ে ওকে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে ধপ ধপ শব্দ করতে করতে ছুটে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। সেই বিহ্বলতা কাটতে না কাটতেই আবার একটি ছায়ামূর্তি প্রায় হাওয়ার গতিতে এসে হাজির হল অমরেন্দ্রর সামনে। সেই মূর্তির আগাগোড়া কালো পোশাকে ঢাকা। মুখটাও কাপড়ে ঢাকা। এক হাতে ছোরা। অন্যহাত দিয়ে অমরেন্দ্রর কলার খামচে ধরল। থরথর করে কাঁপতে থাকল অমরেন্দ্র। লোকটা চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করল, কোন দিকে গেল?
গলা দিয়ে শব্দ বেরোলো না অমরেন্দ্রর। শুধু ইশারা করে দেখাল আগের লোকটা কোনদিকে গিয়েছে। লোকটা ইশারা দেখা মাত্র অমরেন্দ্রকে এক ধাক্কায় ফেলে দিয়ে সেইদিকে ছুটে বেরিয়ে গেল।
মাটিতে ছিটকে পড়ে গিয়ে বেশ কয়েক মিনিট ওইভাবেই রইল অমরেন্দ্র। শরীরে যেন এতটুকু জোর নেই, হাত-পা সব অবশ হয়ে গিয়েছে। বুকের ভেতরে শুধু অসহ্য ধুপধাপ শব্দ। ঝিমিয়ে বেশকিছুক্ষণ পড়ে থাকার পর দুইহাতে রাস্তায় ভর দিয়ে উঠল। তারপর কিছুটা পথ পা ঘষটে চলার পর মনে কিছুটা জোর পেল। বাকি রাস্তাটুকু ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে নিজের বেডে গিয়ে পৌঁছল।
ভেতরে ভেতরে ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেই চকচকে ফলার ছোরাটা, কালো পোশাক পরা মুখ ঢাকা লোকটা, আর তার আগে প্রাণের দায়ে প্রাণপণে ছুটে পালাতে থাকা লোকটা। ছোরাধারী কি এতক্ষণে খুঁজে পেয়ে গিয়েছে তার শিকারকে? রাস্তায় রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে লোকটা। বাজপাখি যেভাবে উড়ে গিয়ে ছোঁ মেরে তার শিকার ধরে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে তেমনই করেছে কি সেই আততায়ী? কী উদ্দেশ্য? ধন সম্পত্তি লুঠ, নাকি কোনও গোপন তথ্য জানার অপরাধ? এমনই শয়ে শয়ে প্রশ্ন মাথার ভেতর ভিড় করে আসতে থাকল অমরেন্দ্রর মনে।
কথাগুলো মনের ভেতর ঘুরপাক খেতে খেতে আচমকাই বিদ্যুৎঝলকের মতো একটা ভাবনা এল। খাতা আর কলম টেনে নিয়ে অমরেন্দ্র প্রায় ঘোরের মধ্যেই লিখে ফেলল একটি লাইন—অমাবস্যার প্রগ্রাঢ় অন্ধকার প্রকাণ্ড এক দৈত্যের ন্যায় চারিদিক গ্রাস করেছে। শহরের প্রতিটি রাস্তা, গলি, জনহীন, প্রতিটি গৃহ অন্ধকারাচ্ছন্ন। কোথাও আলোর লেশমত্র নেই। যেন এক মৃতনগরী চিরঘুমে শায়িত। সহসাই সেই নৈঃশব্দকে খান খান করে দিয়ে শোনা গেল দ্রুত পদধ্বনি। একজন পালাচ্ছে। প্রাণভয়ে পালাচ্ছে ওই গহিন অন্ধকার অলিগলি দিয়ে। লোকটি দুহাতে আঁকড়ে রয়েছে একটি কালো রঙের চামড়ার ব্যাগ। এই ব্যাগ সে প্রাণ থাকতে হাতছাড়া করবে না। কারণ ওই ব্যাগের মধ্যে রয়েছে দেশের সরকারের বেশ কিছু অতিগোপনীয় দলিল যা শয়তানদের হাতে পড়লে দেশের সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে। লোকটির পিছনেই তাড়া করেছে কালো পোশাক পরা আরেকজন ব্যক্তি। বিশাল লম্বা ঢ্যাঙা পা ফেলে সেই লোকটি দৌড়চ্ছে আগের জনকে ধরবে বলে।
স্যর, এই নিন, চা খান।
সায়ন্তন চায়ের কাপের দিকে তাকানো মাত্র দেওয়ালে এতক্ষণ ধরে চলতে থাকা ছায়াছবিটি ঝপ করে বন্ধ হয়ে গেল।
বাজপাখি হাতে কাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। একগাল হাসি। মুখোশের ফাঁক দিয়ে সেই বিচ্ছিরি কালচে দাঁতগুলো দেখা যাচ্ছে।
সায়ন্তন হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপটা নিল। সস্তার মোটা কাপ। হাতলের ফুটোয় আঙুল ঢোকে না, পুরো হাতলটা চেপে ধরে চা খেতে হয়। দুধ ছাড়া চা, সিটিসি গুঁড়ো চা জলে ফুটিয়ে স্রেফ দিয়ে দিয়েছে। চুমুক দিয়েই সায়ন্তন বুঝল, গরম কালমেঘ খেতে হবে।
আরেকটু চিনি দেব স্যর?
না থাক। বলে অমরেন্দ্রর দিকে তাকাল সায়ন্তন। স্যর, এই ছায়াছবিটা আপনার বায়োপিক?
খিক খিক করে হেসে উঠলেন অমরেন্দ্র। বায়োপিক! হাসালে তুমি মোরে বালক…আমি কি শরৎ চাটুজ্জে নাকি ডয়েল সায়েব, অ্যাঁ? আমরা হলাম বটতলা, সস্তা, ঘৃণ্য…বলে নাকে ঘরঘর করে সর্দির শব্দ তুললেন অমরেন্দ্র, যেন এখনই মেঝেতে থুতু ফেলবেন। ফেললেন না, সর্দিটা গিলে নিলেন, গা ঘুলিয়ে উঠল সায়ন্তনের। চায়ে চুমুক দিতে গিয়েও থমকে গেল।
কিন্তু ওই রাত্তিরটা ইয়েস ওই রাত্তিরটাই আমার জীবনটাকে ঘুরিয়ে দিয়েছিল। ভগ্যিস সেদিন সেই রাতে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। বুঝলে, এক রাতের মধ্যে লিখে ফেলেছিলাম অন্ধকারের হাতছানি। অল্পবয়স থেকেই ছিলাম দেশি-বিদেশি রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজের পোকা। দস্যু রোহন যেমন পড়তাম তেমনই দারোগাসাহেবের দফতরও পড়েছি, আবার বিলিতি ব্ল্যাক মাস্ক, ডাইম ডিটেকটিভ-এর মতো বইগুলোও আমি ঠিক জোগাড় করে পড়ে ফেলেছি। কলকাতা শহরে পড়তে এসে পার্কস্ট্রিটের পুরোনো বইয়ের দোকানে খুঁজে বেড়াতাম পুরোনো বিলিতি ডিটেকটিভ ম্যাগাজিনের কপি, ভাগ্য ভালো থাকলে দু-একটা ঠিক জুটেও যেত। মাথার ভেতর ভনভন করত একটা ভাবনা—ডাক্তার হব সমাজ কল্যাণের জন্য আর লেখক হব নিজের শখে। গোয়েন্দা কাহিনির লেখক। কিন্তু আমার কাহিনির দস্যুরা হবে ভয়ঙ্কর, আইনের ফাঁদে সে ধরা পড়বে না। আর আমার ডিটেকটিভও হবে একেবারে ড্যালির সৃষ্ট গোয়েন্দা রেস উইলিয়মসের মতো—একেবারে হার্ডবয়েলড ডিটেকটিভ যাকে বলে। ড্যালিকে আমি নিজের গুরু মানতাম।
মানে, আপনি বাঙালি হয়েও রসধর দত্তর দস্যু রোহণের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন না বলছেন?
তিনি আমার মাথায় থাকুন। বলে ব্যাঁকা হাসলেন অমরেন্দ্র। তারপর বললেন, আসলে রসধরবাবুর দস্যু রোহণ কে? বলো কে? পালটা প্রশ্ন করলেন অমরেন্দ্র।
আমি যেটুকু জানি ইংল্যান্ডের নটিংহামের শেরহুড বনের দস্যু রবিনহুডের ছাঁচ থেকেই রসধরবাবু তাঁর দস্যু রোহণ তৈরি করেছিলেন।
রবিনহুড? সামান্য ভুরু কুঁচকালেন অমরেন্দ্র।
আজ্ঞে হ্যাঁ, মানে হাওয়ার্ড পাইল যে চরিত্রটি রচনা করে অমর হয়ে গিয়েছেন। সুযোগ পেয়ে একটু জ্ঞান ফলানোর চেষ্টা করল সায়ন্তন।
চোখ ছোট করে সায়ন্তনের দিকে তাকালেন, তারপর বললেন, হাওয়ার্ড পাইল রবিনহুডকে নিয়ে লিখে নিজে বিখ্যাত হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু রবিনহুড ওর সৃষ্টি নয়। ওঁর লেখার অনেক আগে থেকেই ইংল্যান্ডে লোকমুখে রবিনহুডের নাম ঘুরত। বিপুল জনপ্রিয়তার জন্য একপ্রকার কিংবদন্তি হয়ে গিয়েছিল রবিনহুড, তার নানা গল্প মানুষের মুখে মুখে ঘুরত, কোন গল্প সত্যি আর কোনটা মিথ্যে কেউ জানে না। আর ঠিক সেই কারণেই লন্ডনের এ্যন ক্রাফটস বুক থেকে যে দ্য অ্যাডভেঞ্চার অফ রবিনহুড নামে বই প্রকাশিত হয়েছিল সেখানে কোনও লেখকের নাম নেই, কারণ রবিনহুড কোনও একজন লেখকের সৃষ্টিই নয়। আন্ডারস্ট্যান্ড?
সায়ন্তন পুরো ভেবলে গেল। এত ইনফরমেশন ওর জানা ছিল না।
কী ভাবছ হে ছোকরা? সবার মতো তুমিও নিশ্চয়ই ভাবছ, ওই শালা দুই আনার শ্রীতপনকুমার, যে কিনা নিজের পিতৃদত্ত নামটাও ব্যবহার করল না কোনওদিন, সে আবার কী জানবে? তিরিশ-চল্লিশ বছর ধরে শুধু হাবিজাবি গুলগাপ্পা গপ্পো ফেঁদে গেল, কোনও মাথামুণ্ডু নেই, তাই না? ঠিকই ভেবেছ। সবাই ভেবেছিল, আজও ভাবে। তোমাদের কোনও দোষ নেই।
সায়ন্তন বুঝল এবার ওর আগমনের কারণটা খোলসা করে বলে ফেলার সময় হয়েছে।
চায়ে শেষ চুমুকটা দিয়ে সায়ন্তন বলতে গেল, আসলে স্যর আমি এসেছিলাম…
ওয়েট মিস্টার সায়ন্তন মিত্র, ওয়েট, আপনি কেন এসেছেন সেটা আমরা বলব। আপনি শুধু মিলিয়ে নেবেন।
বেশ ভারি একটা কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠে পিছনে ফিরল সায়ন্তন। দেখল দুই যুবক। সামনের জনের মাথায় বহু ব্যবহারে জীর্ণ হ্যাট, চোখে সস্তার সানগ্লাস, কনুই পর্যন্ত গোটানো সাদা শার্ট আর চেক ট্রাউজার দুটোই বেশ পুরোনো, কোঁচকানো এবং ময়লা, চামড়ার চওড়া বেল্টটার মুখও কোঁকড়ানো, শার্ট ট্রাউজারে ইন করে পরা। পায়ে অনেকদিন পালিশ না করা শু। লোকটার দুই কোমরে দুটো পিস্তল গোঁজা আর হাতে একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস, গ্লাসটাও ঘষা। লোকটির মাঝারি হাইট এবং চেহারা ছিপছিপে। লম্বাটে মুখে গালভরা বিজিবিজি দাড়ি। কেমন যেন রুগ্নটাইপ দেখতে। ওর পিছনে যে লোকটি দাঁড়িয়ে তার পোশাকও প্রায় এক তবে সানগ্লাস, হ্যাট, কোমরে রিভলভার, হাতে আতশকাচ নেই এবং মুখখানি গোলাকার।
আপনি…
ওয়েল মিস্টার সায়ন্তন মিত্র আমি হলাম রূপক, গোয়েন্দা রূপক চ্যাটার্জি, বলে বেশ কেতা নিয়ে ডানহাতটা সায়ন্তনের দিকে বাড়িয়ে দিল রূপক।
সায়ন্তন হ্যান্ডশেকের জন্য নিজের হাত বাড়িয়ে খেয়াল করল ও তেমন অবাক হচ্ছে না। আসলে এই দশফুটের ঘরটা যে জগতের নিয়মের বাইরে, সেটা ও নিজেকে বুঝিয়ে ফেলেছে। সায়ন্তন হ্যান্ডশেক করে বলল, নাইস টু মিট ইউ মিস্টার চ্যাটার্জি, আর উনি নিশ্চয়ই আপনার বন্ধু কাম অ্যাসিসট্যান্ট মাখনলাল।
হ্যাঁ নমস্কার, ঠিকই চিনেছেন, বলে পাশের লোকটি হাতজোড় করে নমস্কার জানাল।
তোরা দুই হারামজাদা এখন কী করতে এসেছিস, চা শেষ। এখন আর কিছু পাবি না।
না না, আমরা স্যর একটু তদন্ত করতে এসেছিলাম।
হারামজাদা, জুতো দিয়ে মারব, নিজের বাপকে শালা স্যর বলা!
সরি স্য…বাবা মানে…
রূপক চ্যাটার্জির কথা শেষ না হতেই মেঝেতে উটকো হয়ে বসে থাকা বাজপাখি রূপকের দিকে আঙুল তুলে খ্যাক খ্যাক করে হাসতে শুরু করল। বিশ্রী ব্যঙ্গের হাসি।
রূপকের সেটা সহ্য হল না। সঙ্গে সঙ্গে কোমর থেকে দুটো রিভলভারই বার করে বাজপাখির দিকে টার্গেট করে বলল, সাবধান বাজপাখি, আমি তোমাকে লাস্ট ওয়ারনিং দিচ্ছি। আর একবার যদি এইভাবে হাসো…আমার দুই রিভলভারের প্রতিটা গুলি তোমার শরীরকে ছিন্নভিন্ন করে দেবে।
ওই কথা শুনে হঠাৎ ঘর কাঁপিয়ে খলখল করে হেসে উঠল বাজপাখি। তিড়িং করে উঠে দাঁড়িয়ে পিঠে বাঁধা কালো ওড়নাটা হাত দিয়ে নাড়িয়ে ভয়েজ টোন বদলে খসখসে গলায় বলে উঠল, পৃথিবীতে এমন কোনও জেলখানা তৈরি হয়নি মিস্টার রূপক চ্যাটার্জি, যা বাজপাখিকে আটকাতে পারে। এমন কোনও গুলি তৈরি হয়নি যা বাজপাখির শরীরকে বিদ্ধ করতে পারে। বলেই সহসা এক লাফ দিয়ে প্রায় বাদুড়ের মতোই উড়ে ঘরের ওই শিক লাগানো জানলা দিয়ে গলে বাইরে বেরিয়ে গেল। রূপক জানলার দিকে হাতে পিস্তল নিয়ে ছুটে গেল, উঁকি দিয়ে দেখতে থাকল বাইরেটা।
অমরেন্দ্র বললেন, পারলি না তো হারামজাদা, আজও পারলি না, কোনওদিনই বাজপাখিকে ধরতে পারবি না তুই। ওকে ধরা তোর সাধ্য নয়।
সে আপনি যেমন চেয়েছেন তাইই হয়েছে। আমার কী দোষ বলুন? বলে রিভলভার দুটো কোমরে গুঁজে নিল গোয়েন্দা রূপক চ্যাটার্জি।
সায়ন্তন মিটিমিটি হাসছিল, ওর মনে হচ্ছিল পাড়ার কোনও যাত্রাপালার মহড়া চলছে ক্লাবঘরে, কিংবা টিভিতে সুপারহিরোর কার্টুন।
হাসি পাচ্ছে না? খুব হাসি পাচ্ছে? কিন্তু এই রূপক চ্যাটার্জি আর বাজপাখির কাহিনি পড়ার জন্য তিরিশ বছর ধরে লাখে লাখে বাঙালি হাঁ করে বসে থাকত, বুঝেছ। তোমাদের শরৎ চাটুজ্জের বইয়ের বিক্রিকেও ছাপিয়ে গিয়েছিল, আমার এই রূপক আর বাজপাখির গল্প। হ্যাঁ, তোমাদের এলিট ক্লাস আমাকে সাহিত্যিকের মর্যাদা দেয়নি, আজও দেয় না। সেই জন্য বাঙালি সাহিত্যিকদের কোনও বিবলিওগ্রাফিতে আমার নাম নেই। আমিও স্রেফ তোমাদের ওই এলিট ক্লাসকে পোকামাকড়ের মতো টোকা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছি চিরকাল। তোমাদের এলিট ক্লাস আমাকে ডাক্তারি পড়ার টাকা জোগাতে পারেনি, মুখে দুইবেলা ভাত জোটাতে পারেনি, এই এই আমার ছেলেগুলো আমার জন্য চাল ডাল জুটিয়েছে, বুঝেছ। আমি বটতলার লেখক, চটি বইয়ের লেখক, তাই শহরের বাবু লেখকরা আমার সঙ্গে এক পংক্তিতে বসতে ঘেন্না পেতেন। তাদের নামের সঙ্গে যেন আমার নাম উচ্চারিত না হয়, তার জন্য সদাসচেষ্ট ছিলেন। একরাশ ঘৃণা নিয়ে মুখ বিকৃত করে কথাগুলো বললেন অমরেন্দ্র।
কিন্তু স্যর একটা সত্যি কথা বলবেন, আপনি নিজেও তো চিরকাল নিজের আসল নামটা আড়াল করতেই চেয়েছেন। বলুন, চাননি? আমার তো মনে হয় এই নিজেকে আড়াল করে রাখার স্বভাবটা একটা কমপ্লেক্স। কথাটা বলেই ফেলল সায়ন্তন।
মুখ সামলে কথা বলবে, কার নামে কী সব বলছ তুমি জানো? গর্জে উঠল রূপক চ্যাটার্জি। আমার তো মনে হচ্ছে তুমি বাজপাখির চর। সত্যি করে বলো তো কেন এসেছ তুমি, কী উদ্দেশ্য?
মুখের সামনে থেকে সরুন, বলছি।
সরে দাঁড়াল রূপক চ্যাটার্জি।
সায়ন্তন অমরেন্দ্রর দিকে তাকিয়ে বলল, স্যর আপনাকে এবার আমার এখানে আসার উদ্দেশ্যটা বলি। আমি আমাদের পুরোনো বইয়ের গোডাউনে ঢুকে যে শ্রীতপনকুমার সিরিজের একগাদা বই পেয়েছিলাম এবং বাবার কাছে তার কলেজ জীবনের গল্প শুনেছিলাম, শুনে আমারও আগ্রহ হল বইগুলো পড়তে। একটা একটা করে পড়তে শুরু করলাম। মিথ্যে কথা বলব না স্যর, লেখাগুলো আমার খুব উন্নতমানের লাগেনি। হয়তো যেসময়ে আপনি ওগুলো লিখেছিলেন তখন যে সোসিও ইকনমিক পরিস্থিতি ছিল সেখানে ম্যাচ করে গিয়েছিল, বাট পরবর্তী জেনারেশন এই ধরনের লেখাকে যে অ্যাকসেপ্ট করবে না সেটা শিয়োর, কারণ টাইমটা বদলে গিয়েছিল। কিন্তু সবথেকে আশ্চর্য ঘটনা হল, ওই পাতলা সস্তা কাগজের বইগুলোর কাহিনিগুলো প্রায় একইরকমের হওয়া সত্ত্বেও আমি কিন্তু মাঝপথে ছাড়তে পারছিলাম না। প্রত্যেকটা বইকে এতকাল পরেও গোগ্রাসে গিলেছি। কী দুর্দান্ত গতি লেখাগুলোর মধ্যে। ক্যারেকটারগুলোর মতো পাঠককেও ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়তে হয়, থামার উপায় নেই। এটা একজন লেখকের মস্ত ক্ষমতা।
বাড়ির বইগুলো সব শেষ হয়ে গেল, কিন্তু আমি থামতে পারছি না, আরও আপনার লেখা পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে। খুঁজতে শুরু করলাম, কিন্তু কোথায় কী? কিচ্ছু নেই। সাহিত্যের বাজার থেকে আপনি জাস্ট ভ্যানিশ! বইয়ের দোকানে দোকানে, লাইব্রেরিতে, কোথায় না ঢুঁ মেরেছি আপনার বইয়ের জন্য। বই তো দূরের কথা অনেকে আপনার নামটাও জানে না, কেউ আবার হয়ত নামটা জানেন, কোনও একসময়ে আপনার বই পড়েওছেন, কিন্তু সেসব বইয়ের কোনও হদিশ নেই। কোনও অমনিবাস, সমগ্র, বাছাই, সংকলন কিছু না, যেন জোর করে মুছে দেওয়ার চেষ্টা একজনের কাজকে। যত ব্যর্থ হচ্ছিলাম ততই আমার জেদ বেড়ে যাচ্ছিল। এর মধ্যে কলেজ পাশ করেছি, ইউনিভার্সিটিতে তুলনামূলক সাহিত্য নিয়ে ভর্তি হয়েছি, পড়াশোনা চলছে।
একদিন ইন্টারনেটে সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের একটা সাইটে বিজ্ঞাপন দেখলাম জুনিয়র ফেলোশিপের। ক্রাইটেরিয়া খুলে দেখলাম, তারপর আমিও অ্যাপ্লাই করে দিলাম। কী সাবজেক্ট নিলাম জানেন? শ্রীতপনকুমার—বাংলা সাহিত্যের এক বিস্মৃত লেখক। সিনপসিস পড়ে ইন্টারভিউতে ডাকা হল আমাকে। গেলাম। তিনজন মিলে ইন্টারভিউ নিলেন আমাকে, খুব কড়া ইন্টারভিউ। কেন আমি এতকাল পরে শ্রীতপনকুমারের মতো একজন বটতলার হারিয়ে যাওয়া লেখককে নিয়ে গবেষণা করতে চাইছি, তা যুক্তি দিয়ে বোঝাতে প্রায় চল্লিশ মিনিট লড়াই করতে হল। তাঁরা সন্তুষ্ট হলেন কি না বুঝলাম না। ভেবেছিলাম ফেলোশিপটা হবে না, কিন্তু প্রায় মাস ছয়েক পর এই দিন পনেরো আগে বাড়িতে চিঠি এসে উপস্থিত, আমি সিলেক্টেড হয়েছি। খুব আনন্দ পেলাম। তারপরেই বিপদ, আপনার জীবন এবং আপনার লেখা সম্পর্কে কিছুই সংগ্রহ করতে পারি না। বইগুলো থেকে পাবলিশার্সদের ঠিকানা নিয়ে বইপাড়ায় খোঁজ নিতে গিয়ে দেখি, লেখকের মতো অনেক পাবলিশিং হাউজও উধাও। আর যে দু-একটি এখনও রয়েছে তারা লেখকের সম্পর্কেও কিছু জানেন না, পুরোনো বইগুলোর কপিও কিছুই নেই। একজন তো বলেই দিলেন ওসব বই কি আর ক্লাসিক, যে সংরক্ষণ করব? ওগুলো বেরতো, ফুলুরি আলুর চপের মতো গরম গরম বিক্রি হয়ে যেত ব্যস। বাসি ফুলুরি কেউ খায়, বলুন? তাই কোনও পুরনো বই রাখাও হয়নি।
বাড়ি কোথায়, কোথায় থাকতেন অনেক খোঁজাখুঁজি করতে শুরু করলাম। কিন্তু কেউ আপনার সম্পর্কে কিছুই জানে না, মানে কিছুই না, আপনি যেন কোনওদিন এই পৃথিবীতে আসেননি, অথচ একটা সময় এত বই লিখেছেন। দ্বারে দ্বারে ঘুরছি, কেউ কোনও সন্ধানই দিতে পারলেন না। শেষে একটা বুদ্ধি এল। আপনার বইগুলোর যে পাবলিশার্সরা এখনও রয়েছেন সেখানে গিয়ে পুরোনো কর্মচারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম। শেষে মিলল। লাহা বুক হাউজ, যেখান থেকে একসময় আপনার অজস্র বই বেরিয়েছে, সেখানকার নতুন কর্মচারীদের থেকে খোঁজ পেলাম—কেষ্টবাবু নামের এক পুরোনো কর্মচারী আপনাকে চিনতেন। বরানগরে বাড়ি সেই কেষ্টবাবুর। ঠিকানা জোগাড় করে চলে গেলাম গত কাল। দেখা হল, আপনার কথা মনে রেখেছেন তিনি। জানালেন আজ থেকে প্রায় পনেরো বছর আগে আপনি যেখানে থাকতেন তার ঠিকানা, তারপর আর যোগাযোগ হয়নি আপনার সঙ্গে। এই হল সেই ঠিকানা, যেখানে পনেরো বছর পরেও আপনাকে পেয়ে গেলাম।
কেষ্ট…হ্যাঁ কেষ্টকে মনে আছে। শুধু এইটুকুই নীচু স্বরে বলে উঠলেন অমরেন্দ্র।
এলিট, পেটি বুর্জোয়ারা আপনাকে ভুলে গেলেও প্রলেতারিয়েত শ্রেনি আপনাকে আজও মনে রেখেছে। আর মনে রেখেছি আমরা। এতগুলো বছর ধরে বুকে আগলে রেখেছি আপনাকে, নিজের পিতার মতো। কথাগুলো বলতে বলতে আবার জানলা দিয়ে সুরুত করে গলে এল বাজপাখি। এবারে একা নয়, সঙ্গে আরও একজন রয়েছে, তারও বিকটদর্শণ রূপ, ছয় ফুটের ওপর হাইট। লম্বা মুখ, ছুঁচলো চিবুক, টিয়াপাখির ঠোঁটের মতো বাঁকা নাক, চোখদুটো নেকড়ের মতো ধকধক করে জ্বলছে, হাতে উদ্যত পিস্তল আর পরনে কালো একটা মাথা ঢাকা আলখাল্লা।
সায়ন্তন বুঝতে পারল ঘরে আরেক খলনায়কের প্রবেশ ঘটল—ড্রাগন। দুজনেই ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়াল।
অমরেন্দ্র গভীর শ্বাস ছেড়ে বললেন, জন্ম দিলেই বাপ হওয়া যায় না, আর মায়ের পেট থেকে বেরোলেই সে মায়ের সন্তান হওয়া যায় না রে। আমার প্রকৃত সন্তান হলি তোরা—তুই, ড্রাগন, কালরুদ্র, ব্ল্যাকপ্যান্থার, কালনাগিনী…
এন্ড আমি ডিটেকটিভ রূপক চ্যাটার্জি এন্ড হিজ অ্যাসিস্ট্যান্ট কাম ফ্রেন্ড মাখনলাল। বলে উঠল রূপক।
হ্যাঁ বাবা তোরাই আমার আসল ছেলে-মেয়ে। বছরের পর বছর তোরা মিলেই আমার মুখে দুইবেলা অন্ন তুলে দিয়েছিস। বলে অমরেন্দ্র ওদের দিকে তাকালেন। তারপর মুখ নিচু করে কয়েকমুহূর্ত বসে রইলেন চুপচাপ। ঘরের ভেতর নৈশব্দ। এতগুলো লোক রয়েছে বোঝাই যাচ্ছে না।
এরা, এরা আমার ছেলে-মেয়ে বুঝলে ভাই, গত পঞ্চাশ বছর ধরে ওরা আমার সঙ্গে রয়েছে, একটা মুহূর্তের জন্যও আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ভাবেনি। সেই কতকাল আগে ওদের জন্ম দিয়েছি, তারপর পৃথিবীতে কতকিছু ঘটে গেল। সবাই ছেড়ে চলে গেল আমাকে, যাওয়ার সময় আস্তকুঁড়ে আবর্জনার মতো আমার কাজ আর আমাকে ফেলে দিয়ে গেল, কিন্তু আমার এ ছেলে-মেয়েগুলো…আজও আমার সঙ্গে রয়ে গিয়েছে, আমার সঙ্গে কথা বলে, আমার সঙ্গে ঘুমোয়, আমার অসুখ হলে ওষুধ খাইয়ে দেয়, রান্না, চা করা, সব সব কিছু ওরা। এখনও যে বেঁচে রয়েছি সেটাও স্রেফ ওদের জন্য। আবেগে হড়বড় করে কথাগুলো বলতে বলতে ঠোঁটের ফাঁক থেকে ঘন আঠার মতো লালা বেরিয়ে এসে কোলের ওপর পড়ল অমরেন্দ্রর। সেদিকে হুঁশ নেই। ওরাই আমার সব। আর কেউ কোনওদিন পাশে ছিলও না, দরকারও নেই।
কিন্তু স্যর দরকার রয়েছে। আমি আজ এসেছি আপনার ইন্টারভিউ নেব বলে। আমার মনে হয়—আপনাকে নিয়ে একটা অন্তত ডকুমেন্টেশন থাকা দরকার।
কী হবে? কী হবে এসব করে? চলে যাও তুমি।
আচ্ছা স্যর, আমি মেনে নিচ্ছি কিছুই হবে না, অন্তত আমার আপনাকে জানার অধিকারটুকু দিন। এই অনুরোধটুকু করছি আপনাকে। প্লিজ স্যর…অনেক দৌড়েছি আপনাকে পাবার জন্য। আর কারও কাছে না হোক আপনার এই সন্তানদের মতো আমার কাছেও আপনি একজন হিরো।
সায়ন্তনের কথাগুলোর মধ্যে যে সত্যিকারের আবেগ রয়েছে সেটা অমরেন্দ্রর নজর এড়াল না। বরং ছেলেটি যে সত্যিই অনেক আকুতি নিয়ে এসেছে, তা ওর কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু দীর্ঘদিনের বঞ্চনার অভিমান জমতে জমতে বুকের ভেতরটা এতটাই পাথরের মতো শক্ত হয়ে গিয়েছে যে, কোমল কোনও আবেগই আর হৃদয়কে স্পর্শ করে না। তবু আজ বহু যুগ পরে এই সদ্য যুবকটির মুখ, তার আর্তি, কাজ করার ইচ্ছে দেখে নিজের স্মৃতিঘরের বন্ধ দরজায় কে যেন কড়া নাড়ছে। গুম গুম শব্দ করছে। দরজা খুলে দিতে ইচ্ছে করল অমরেন্দ্রর।
বেশ নীচু অথচ ধীর গলায় কথা বলতে শুরু করলেন অমরেন্দ্র। পাল্প ফিকশন রাইটার…হ্যাঁ আমি একজন পাল্প ফিকশন রাইটার। বাংলার শেষ পাল্প ফিকশন রাইটার আমি। এই নামেই দেগে দেওয়া হল আমাকে। কিন্তু তাদের ধরে যদি জিজ্ঞাসা করো পাল্প ফিকশন কী? আর্ধেক লোক এর মানেই জানে না, পাল্প শব্দটা কী, কোথা থেকে পাল্প ফিকশন জন্ম নিল, এই দীর্ঘ ইতিহাসটা জানে না তারা।
আমাকে বলুন প্লিজ, আমি জানতে চাই।
সায়ন্তনের অনুরোধে দীর্ঘযুগ পর অমরেন্দ্র ডুব দিলেন নিজের ইতিহাসে, এক অজানা ইতিহাসে।
অক্সফোর্ড ডিকশনারি খুলে দেখো, লেখা রয়েছে ‘সফট মাস অফ উড ফাইবার ইউজড ফর মেকিং পেপার।’ আসলে ইংরেজিতে পাল্প শব্দটির এসেছে পাল্পউড থেকে। অর্থাৎ কি না পাল্প শব্দটির সঙ্গে সাহিত্যের কোনও সরাসরি যোগাযোগ নেই। অথচ এই পাল্প ফিকশনই এক সময় হয়ে উঠেছিল বিপুল জনপ্রিয় একটি সাহিত্য ধারা। কীভাবে সৃষ্টি হল পাল্প ফিকশন? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে তোমাকে চলে যেতে হবে বেশ কিছুটা সময় পিছনে। নাইনটিন্থ সেঞ্চুরির একেবারে শেষ এবং টুয়েন্টিয়েথের গোড়ার দিকে আমেরিকায় ম্যাগাজিনের আকারে কিছু ডাইম নভেল প্রকাশিত হত। ডাইম বোঝো তো? খুব চটুল কাহিনি, সস্তার কাগজে ছাপা নভেলগুলোকে ডাইম নভেল বলা হতো, তো সেগুলো তখন বিপুল পরিমানে জনপ্রিয় হয়েছিল। লেখকরা খুব দ্রুত কিছু রোমাঞ্চে ঠাসা আজগুবি ধরনের কাহিনি লিখতেন। আর সেই কাহিনিগুলি রংচঙে অ্যাকশনধর্মী কভারে বই করে ছাপানো হতো। এইসব বইয়ের পাঠক হতো এই এক্কেবারে সাধারণ মানুষ, যারা সাহিত্য-ফাহিত্য ইত্যাদি বিশেষ বোঝে না। সারাদিনের খাটাখাটনির পর এন্টারটেনমেন্টের অন্যতম আইটেম ছিল এই ডাইম নভেলস। পাতার পর পাতা শুধু অ্যাডভেঞ্চার, আর কাউবয়দের অ্যাকশন। লোকে এক নিঃশ্বাসে পড়ত আবার ভুলেও যেত। মনে রাখার প্রয়োজনও পড়ত না। তখন আমেরিকার সময়টাও জটিল। অলি গলিতে তখন গজিয়ে উঠেছে ভাওডেভিল, চিপ পপুলারিটিতে মজে রয়েছে দেশের মানুষ, উদ্বাস্তু বাসা বেঁধেছে দেশের আনাচে কানাচে। তাদের সামনে না রয়েছে কোনও নিশ্চিন্ত জীবন, না রয়েছে সুস্থ সংস্কৃতি। তাদেরই ওই দমবন্ধ জীবনে ঠান্ডা হাওয়া জুগিয়েছিল এই অ্যাডভেঞ্চারধর্মী ডাইম নভেলগুলি।
থামলেন অমরেন্দ্র। কপালে আলতো টোকা মেরে কিছু মনে করার চেষ্টা করলেন। তারপর আবার বললেন, একজ্যাক্ট সালটা আর মনে নেই, তবে যদ্দুর সম্ভব ওই আঠেরোশো ষাট-পয়ষট্টি সাল নাগাদ আমেরিকায় আরউইন পি. বিডল প্রকাশনা থেকে প্রথম প্রকাশ করলেন ডাইম নভেল সিরিজের প্রথম বই। বইটার নাম ছিল মালাস্কা; দ্য ইন্ডিয়ান ওয়াইফ অফ দ্য হোয়াইট হান্টার। লেখকের নাম, অ্যান এস. স্টিফেনস। এতটাই পপুলার হয়েছিল যে কয়েক মাসের মধ্যে ষাট-সত্তরহাজার কপি হুড়হুড় করে বিক্রি হয়েছিল। আর ঠিক এরপর থেকেই ৬.৫ X ৪.২৫ মাপ এবং ১০০ পৃষ্ঠার এই টাইপের সিরিজ রেগুলার প্রকাশ পেতে থাকল। এতটুকু বলে সামান্য থামলেন অমরেন্দ্র। ঘরের প্রতিটি লোক তাঁর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছে, সায়ন্তন এবার বুঝতে শুরু করেছে এই মানুষটার নলেজের লেভেল। চেহারাটা এমন হয়ে গেলেও, লোকটার স্মৃতিশক্তি এবং নলেজ এখনও চমকে দেওয়ার মতো।
অমরেন্দ্র বলতে থাকলেন, আমেরিকায় গৃহযুদ্ধের সময়ে দেশে সাধারণ মানুষ যখন নানাভাবে বিপর্যস্ত তখন এই ধরনের এন্টারটেইনিং স্টোরিগুলো খেটে খাওয়া মানুষদের কিছুটা আনন্দ দিত। বিশেষ করে ওই সময়ের ইয়ং জেনারেশনের কাছে এই বইগুলো ছিল টাইম পাস করার সঙ্গী। দামে সস্তা মানেও সস্তা এই বইগুলিই ছিল আসলে পাল্প ফিকশনের বাপ। বুঝতে পারলে?
হুঁ, সংক্ষেপে উত্তর দিয়ে চায়ে চুমুক দিল সায়ন্তন।
সালগুলো এতবছর চর্চার অভাবে আমার আর মনে নেই, তবে ১৯০০ থেকে ১৯৫০, এই পঞ্চাশ বছর কি আর কয়েকছর বেশি ছিল পাল্প ফিকশনের বা বলা ভালো পাল্প ম্যাগাজিনগুলোর আয়ু। শুরুতেই তোমাকে বললাম না পাল্প শব্দটা এসেছিল পাল্পউড থেকে। সস্তার হলদেটে খসখসে কাগজে ছাপা হত বইগুলো—সেই জন্য নাম দেওয়া হয়েছিল পাল্প। ঠিক তার অপোজিটে ভালো কোয়ালিটির কাগজে প্রিন্ট করা ম্যাগাজিনগুলোকে বলা হত গ্লস বা স্লিপস।
কীরকম সাইজ হতো পাল্প ম্যাগাজিনগুলোর? জিজ্ঞাসা করল সায়ন্তন।
খুব বেশি না, এই ধরো লম্বায় সাত ইঞ্চি, চওড়ায় দশ ইঞ্চি, এইরকমই হতো আর কি, সব উনিশ বিশ। আমার কাছে একসময় অনেক ছিল। কী টানটান সব লেখা! একেবারে রগরগে মশলায় খাস্তা ভাজা। ইংল্যান্ডের পেনিড্রেডফুল বা ডাইমনভেলের সুপুত্তুর ছিল এইসব এক-একটা ম্যাগাজিন। পড়তে বসলে মনে হবে যেন টকঝাল আচার খেতে বসেছ। বেশিরভাগ লেখকই ছিল অনামী, কিন্তু তার মানে এই নয় যে শুধুমাত্র অনামী লেখকরাই এইসব গপ্পো লিখতেন, বরং ওই সময়ের অনেক বিখ্যাত লেখকও কলম ধরেছিলেন ওইসব প্রকাশনাগুলির জন্য। তবে শর্ত ওই একটাই—যত বিখ্যাতই হোন না কেন, এইসব ম্যাগাজিনে লিখতে গেলে তাকে ওই ম্যাগাজিনের মতোই মশলাদার, টকঝাল লেখা লিখতে হত। সাহিত্যের গুনমান এখানে বিচার্য ছিল না। পরে ফ্যান্টম, ডক স্যাভেজ বা শ্যাডোর মতো যেসব সুপারহিরোরা বাজার মাত করেছে, তাদের বাপ-ঠাকুর্দা ছিল এইসব পাল্প ম্যগাজিনের নায়করা। বলে হাসলেন অমরেন্দ্র। কী ভাবছ? তোমাকে যে কথাগুলো আমি ইশকুল মাস্টারের মতো বলে যাচ্ছি, এগুলো জানতে পারলাম কী করে? এগুলো সত্যি না মিথ্যে সন্দেহ হচ্ছে তো? হচ্ছে, হচ্ছে, হওয়ারই কথা।
না না, হচ্ছে না। বিশ্বাস করুন, আমি বরং সত্যিই ভেবে অবাক হয়ে যাচ্ছি এত ইনফরমেশন আপনি পেলেন কোথা থেকে। আর পেলেও এগুলো মনে রেখে দিয়েছেন!
সায়ন্তনের কথায় আবার মৃদু হাসলেন অমরেন্দ্র। এই জগৎটাই তো ছিল আমার ধ্যানজ্ঞান, বছরের পর বছর ধরে শুধু এইসব নিয়েই চর্চা করে গেছি, বলতে পারো সাধনা করে গেছি, আর স্মৃতিশক্তি? হ্যাঁ, সেটা আমার অল্পবয়স থেকেই প্রখর। আজ এতবছর পার করে ঘাটে যাওয়ার বয়েসেও স্মৃতিতে মর্চে পড়েনি। পড়লে যদিও ভালোই হতো। মনে রাখার থেকে ভুলে যাওয়া ঢের ভালো। বুঝলে হে ছোকরা।
সায়ন্তন বুঝল অমরেন্দ্র আবার সেন্টিমেন্টাল হয়ে উঠছেন। তার আগেই থামাতে হবে। এই বলার মুড একবার বিগড়ে গেলে আবার ফেরানো মুশকিল। তাই সায়ন্তন পুরো প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু আপনি এই লিটারেচরে ঢুকলেন কীভাবে?
সায়ন্তনের কথায় উৎসাহিত হয়ে অমরেন্দ্র বললেন, সেটাও একটা কাহিনি বটে। সেই রাতের কথা তো তোমাকে বলেছিলাম, যে সারা রাত ধরে বসে লিখে ফেলেছিলাম একটা কাহিনি। তারপর কী হল দেওয়ালে দেখো, বলে সেই দেওয়ালটার দিকে আঙুল তুললেন অমরেন্দ্র।
সায়ন্তন দেখল আবার সেই দেওয়ালে সাদা কালো সিনেমা শুরু হয়েছে।
ঘুম ভেঙে গেল অমরেন্দ্রর। চোখের মধ্যে সকালের রোদ্দুর এসে পড়েছে। হাসপাতালের ছাত্রাবাসে ওর বেডটা জানলার ধারে। দরজার মতোই বিশাল জানলা। এমনিতে রোজ ভোরবেলাতেই ঘুম ভেঙে যায় ওর। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে, তারপর ফ্রেশ হয়ে পড়াশোনা শুরু করে দেয়। বেলা গড়ালে তারপর ক্লাস, একেবারে সন্ধের পর আবার মেসে ফেরা, নাইট শিফট থাকলে হাসপাতালেই রাত কাটানো। গতরাতে ঘুম হয়নি বলে চোখ মেলতে আজ কষ্ট হচ্ছে। জোর করে চোখ মেলল, আর চোখ মেলতেই পরপর মনে পড়ে গেল গতকাল দুপুর থেকে শেষ রাত পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সব ঘটনা। উঠে বসল ও। ঘরে প্রায় সকল ছাত্রই উঠে পড়েছে, যদের মর্নিং শিফট রয়েছে তারা চলে গিয়েছে, যাদের বেলায় ক্লাস রয়েছে তাদের কেউ চা-বিস্কুট খাচ্ছে কেউ বা খবরের কাগজ অথবা টেক্সট বুক পড়ছে। কেউ আবার অন্যের সঙ্গে গল্পে ব্যস্ত।
অমরেন্দ্র চিরকালই একাকীত্ব ভালোবাসে, বেশি হইচই, বন্ধুবান্ধব এইসব ওর ভালোলাগে না। দশ কথার উত্তর একটা উত্তরে দেয়। নিজের জগতে থাকতেই ভালোবাসে। সেই কারণে অমরেন্দ্রর বন্ধু হয় না কেউ। বিজয়নগরে থাকতেও যেমন বন্ধু ছিল না, এখানেও নির্বান্ধব। এমনটাই ভালোলাগে।
বালিশের নীচে গোঁজা খাতাটা বার করল। গতরাতে লেখা কাহিনিটা দেখে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। ফিজ এই মাসে দিতে না পারলেও হস্টেলে থাকার জন্য অন্তত কুড়ি দিন হাতে রয়েছে। তার মধ্যে কিছু একটা করতেই হবে। কিন্তু বিজয়নগরে ফিরে কিছুতেই যাব না। যদি কিছু না করতে পারি এই কলকাতার ফুটপাতে মরে পড়ে থাকব, কিন্তু ওখানে কিছুতেই নয়। বাবার প্রতি অনিবার্য অভিমানে অন্তর ডুকরে ওঠে অমরেন্দ্রর। বাবা যদি বেহিসাবির মতো টাকাপয়সা না ওড়াত তাহলে ওকে আজ এই দিনের মুখোমুখি হতে হত না। এতদিন ধরে গড়ে তোলা স্বপ্ন এমন নিমেশে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ত না।
লেখার খাতাখানা দুই হাতে আঁকড়ে বেশ কিছুক্ষণ কী যেন সব ভাবল অমরেন্দ্র। তারপর ব্যাগ হাতড়ে দেখল, হাতে কত টাকা রয়েছে। মনে মনে একটা হিসাব করে ফেলে উঠে পড়ল। আজ ক্লাসে না গিয়ে কিছু কাজ সেরে ফেলতে হবে।
বটতলা আর পার্কস্ট্রিট এলাকায় অমরেন্দ্রর চেনা কয়কজন পুরনো বই বিক্রেতা রয়েছে, যাদের কাছ থেকে নিয়মিত দেশি-বিদেশি বই ম্যাগাজিন কেনে অমরেন্দ্র। পড়া হয়ে গেলে সেই বইয়ের প্রয়োজন না থাকলে আবার আরও কমদামে ওই বইকে বিক্রিও করে দেয়। কলেজ স্টুডেন্ট বলে ওকে কিছুটা ক্ষমা ঘেন্না করেই অল্পদামে দিয়ে দেয় বিক্রেতারা। পার্কস্ট্রিটে রতন মালাকার তেমনই একজন বিক্রেতা। খুব ছোট তার দোকান, বেশিরভাগই পুরনো বিলিতি বই-ম্যাগাজিন ইত্যাদি বিক্রি করে। ওর বেশ কিছু বাঁধাধরা খরিদ্দার রয়েছে। বেশিরভাগই অ্যাংলো, তবে তার মধ্যে অমরেন্দ্রও একজন।
রতন তার পরিচিত খরিদ্দারদের রুচি জানে। সেইমতো তাদের বইয়ের সন্ধান দেয়। আজ অমরেন্দ্র রতনের সামনে এসে দাঁড়ানোমাত্র রতন বলে উঠল, এই যে ডিটেকটিভ কোথায় থাকো? চারদিন হয়ে গেল তোমার জন্য একটা স্পেশাল বই এনে রেখেছি। একদম রেয়ার জিনিস।
কই দেখি। হাত বাড়াল অমরেন্দ্র।
দাঁড়াও দিচ্ছি। বলে তার বইয়ে ঠাসা র্যাক থেকে টানাটানি করে একটা ইয়া মোটা বই বার করে অমরেন্দ্রর হাতে দিল রতন।
সাধারণ বইয়ের প্রায় দ্বিগুণ লম্বা ও চওড়া বোর্ড বাঁধাই বই। মলাটে এক মুখোশধারী বন্দুক হাতে দৌড়চ্ছে, বন্দুকের নল থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। তার পাশেই একটা লোক ছুরিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে পড়ে রয়েছে আর মলাটের নিচে এক স্বল্পবসনা লাস্যময়ী নারীর আবক্ষ মুখ। পুরো জমজমাট কভার। বইয়ের কভারে লেখা সিলেক্টেড ওয়ার্কস অন পাল্প লিটারেচার।
বইয়ের মলাটটা খুলল অমরেন্দ্র। আর্গোসি, অ্যাডভেঞ্চার, ব্লু বুক, অ্যামেজিং স্টোরিজ, ব্ল্যাক মাস্ক, ডাইম ডিটেকটিভ, ফ্লাইং এস, হরর স্টোরিজ, লাভ স্টোরি ম্যাগাজিন, প্ল্যানেট স্টোরিজ, থ্রিলিং ওন্ডার স্টোরিজ এবং আরও বেশ কিছু পাল্প ম্যাগাজিনের সচিত্র কাহিনির সংকলন এই বইটা। এরমধ্যে বেশ কয়েকটা ম্যাগাজিনের নাম খুব ভালো করেই জানে অমরেন্দ্র। বইটা যেন সাক্ষাত একটি আশীর্বাদ। উফ!
বইটা পাতা উলটে পালটে দেখে অমরেন্দ্র বুঝতে পারল, এটা বই নয়, আলাদিনের প্রদীপ। মনের ভেতরে অনেক কল্পনা, ভাবনা উথালপাথাল করতে থাকল।
রতন জিজ্ঞাসা করল, কী, কেমন?
দারুউউণ!
নিয়ে যাও, তোমার জন্যই রেখে দিয়েছি। তবে এটা খুব কষ্টে কালেক্ট করেছি ভাই। দরদাম করবে না। পুরো আটটাকা দাম নেব।
আ-ট! চমকে উঠল অমরেন্দ্র।
আটে চমকে গেলে। এই বইটার অরজিনাল দাম কত হতে পারে তোমার আন্দাজ আছে?
অমরেন্দ্র স্বভাববশে কিছুই দরদাম করতে পারল না। শুধু বেশ কিছুক্ষণ পাতা উলটে বিরসবদনে বইটা রতনদার হাতে দিয়ে দিয়ে বলল, না গো, রেখে দাও।
নেবে না! অবাক হল রতন। এই বই ছেড়ে দেবে।
অমরেন্দ্রর মুখ থেকে বেরিয়ে আসছিল টাকার অভাবে ডাক্তারি পড়াই ছেড়ে দিচ্ছি এ তো একটা বই, বলতে পারল না। ম্লান হেসে বলল, পেরে উঠব না গো। অত টাকা নেই।
চলে যাচ্ছিল অমরেন্দ্র।
এই শোনো শোনো, পিছন ডাকল রতন। আবার ফিরল অমরেন্দ্র।
কত দিতে পারবে? একটা দাম বলো।
ছেড়ে দাও রতনদা। আমার টাকা পয়সার অবস্থা ভালো নয় গো।
রতন ভুরু কুঁচকে তাকাল শান্ত লাজুক ছেলেটির মুখে। এই ছেলে তো এমন কথা বলে না কখনও।
কত পারবে বলো?
আমি খুব বেশি হলে তিনটাকা আট আনা দিতে পারব।
পাঁচটাকাও পারবে না?
না গো। বললাম যে তুমি কাউকে দিয়ে দাও। বলে আবার রওনা হচ্ছিল অমরেন্দ্র।
এদিকে শোনো ভাই। একটা প্ল্যান বলছি, শুনতে পারো। দেখো এই বই সাড়ে তিনটাকায় ছাড়লে আমার তুমুল লস হয়ে যাবে। কিন্তু তুমি আমার পুরনো খদ্দের, একটা হেল্প আমি তোমার জন্য করতে পারি। এক সপ্তাহের জন্য বইটা তোমাকে ভাড়া দিতে পারি। রাজি?
খুব রাজি। আমার এক সপ্তাহের মধ্যেই হয়ে যাবে। কত টাকা দেব বলো?
রতন হাসল। তারপর বলল, টাকা লাগবে না, নিয়ে যাও। কিন্তু মনে করে এক সপ্তাহ পরেই দিয়ে যেও কিন্তু।
অমরেন্দ্র আনন্দের চোটে কিছুই বলতে পারল না। শুধু বইটাকে বুকে আঁকড়ে ধরে হাঁটা দিল মেসের দিকে। উত্তেজনায় বুক ঢিবঢিব করছে।
নিজের বিছানায় বসে মোটা বইটার প্রতিটা পৃষ্ঠা গোগ্রাসে গিলতে শুরু করল অমরেন্দ্র। নাওয়া খাওয়া সব ভুলে পড়তে থাকল। জানতে থাকল, বুঝতে থাকল। ছোটবেলা থেকেই খুব শার্প ব্রেন, যে কোনো বিষয় অ্যানালিসিস করার ক্ষমতা অসাধারণ। আর্গোসি ম্যাগাজিনের স্টোরিগুলো পড়তে পড়তে তার সঙ্গে বিশেষজ্ঞদের আলোচনাগুলিও পড়তে থাকল অমরেন্দ্র, বুঝতে চেষ্টা করছিল পাল্পের জনপ্রিয়তার কারণ এবং ওই সময়টাকে। পাশে খাতা কলম নিয়ে নোট নিচ্ছিল।
আর্টিকেলে লেখা রয়েছে, ১৮৯৬ সালে ফ্রাঙ্ক মুনসের আর্গোসি ম্যাগাজিনটি ছিল প্রথম প্রকাশিত পাল্প। প্রায় এক লক্ষ পয়ত্রিশ হাজার শব্দ, একশো বিরানব্বই পৃষ্ঠা প্রতি ইস্যু, ট্রিম না করা খসখসে সস্তার কাগজে ছাপা হতো আর্গোসি। গোটা পত্রিকাটিতে কোনও ইলাস্ট্রেশন এমনকী কভারেও কোনোরকম অলংকরণ ব্যবহার করা হত না। সস্তার লেখক, সস্তার কাগজ, ছাপাই, এবং দামেও সস্তা এই ম্যাগাজিন দেশের শ্রমিকদের মধ্যে এত দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে, মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে এই পত্রিকার সার্কুলেশন কয়েক হাজার থেকে পঞ্চাশ হাজারের অধিক হয়ে গিয়েছিল।
আর্গোসির এমন চুড়ান্ত সাফল্য দেখে ১৯০৩ সালে স্ট্রিট এন্ড স্মিথ নামের একটি ডাইম নভেলের প্রকাশক পপুলার ম্যাগাজিন নামে একটি ম্যাগাজিন প্রকাশ করা শুরু করল এবং নিজেদের তারা ঘোষণা করেছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যাগাজিন নামে। পাল্প প্রকাশনার জগতে এই পপুলার ম্যাগাজিন প্রথম রঙিন ফ্রন্ট এবং ব্যাক কভার করা শুরু করেছিল। এবং ওই সময়ের বহু নাম করা সাহিত্যিক যেমন এডগার রাই বরো, রবার্ট ই. হাওয়ার্ড, আব্রাহাম মেরিট ইত্যাদিরাও জঁর ফিকশনে ঝুঁকেছিলেন। বেশ কিছুকাল পর পপুলার ম্যাগাজিন জনসাধারণের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পর ম্যাগাজিনের দাম বাড়িয়ে করা হয়েছিল ১৫ সেন্ট। অবশ্য ম্যাগাজিনের পৃষ্ঠা সংখ্যাও বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।
১৯২০-৩০ এই দশ বছরের মধ্যে পাল্প ফিকশনের প্রকাশনাগুলির জনপ্রিয়তা এতই উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছিল যে প্রায় প্রতিটি ম্যাগাজিনের ইস্যু এক লক্ষেরও অধিক বিক্রি হত।
এক লক্ষ! সংখ্যাটা মনে মনে বিড়বিড় করল অমরেন্দ্র। তারপর খাতায় পরপর চারটে শব্দ লিখল—বিশ্বযুদ্ধ, ক্লান্ত মানুষ, পাল্প, একলক্ষ কপি।
আবার মুখ ডোবাল বইয়ের পাতায়। ১৯৩৪ সালে ফ্র্যাঙ্ক গ্রুবের নামক একজন লেখক বলছেন যে ওই সময়টায় প্রায় দেড়শোটি পাল্প ম্যাগাজিন নিয়মিত প্রকাশ পেত, যাদের মধ্যে সবথেকে জনপ্রিয় পাল্প ম্যাগাজিনগুলি ছিল আর্গোসি, অ্যাডভেঞ্চার, ব্লু বুক এবং শর্ট স্টোরিজ। এই চারটি সবথেকে জনপ্রিয় ম্যাগাজিনকে একসঙ্গে দ্য বিগ ফোর নামে ডাকা হত।
বিগ ফোর, শব্দটা আবার খাতায় লিখে আর্গোসি ম্যাগাজিনের গল্পে ডুবে গেল অমরেন্দ্র। এক অন্য জগতের ইতিহাসে মিশে যেতে থাকল।
টানা তিনদিন আমি ওই বইটায় মুখ গুঁজে পড়েছিলাম। শুধু নাওয়া খাওয়ার জন্য যেটুকু সময় না দিলে নয়, বাকি সময়টা পুরো চুষে খেয়ে ফেলেছিলাম বইটাকে। স্মৃতিশক্তি তো আমার অল্পবয়েস থেকেই প্রবল। বাপ-ঠাকুর্দার কল্যাণে ইংরেজিটা মন্দ জানতাম না। ঝড়ের বেগে পড়ে ফেলেছিলাম প্রায় গোটা বইটা। শুধু পড়া নয়, প্রায় প্রতিটা শব্দকে মগজে ভরে নিয়েছিলাম।
অমরেন্দ্র সায়ন্তনের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে যথারীতি দেওয়ালের সিনেমা বন্ধ হয়ে গেল। বাইরে গুড়গুড় করে শব্দ হচ্ছে। বৃষ্টি হবে মনে হয়। হওয়ারই কথা। যা গুমোট গরম ছেড়েছে! ঘরে যে টেবিলফ্যানটা চলছে সেটায় হাওয়ার থেকে শব্দ বেশি। মেঝেতে বসে রয়েছে ড্রাগন, বাজপাখি, রূপক চ্যাটার্জি, মাখনলাল। সকলেই হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছে তাদের পিতার দিকে। চোখে মুখে কী অপরূপ মুগ্ধতা!
রূপু ঘরের লাইটটা জ্বালিয়ে দে তো। অন্ধকার লাগছে। রূপক চ্যাটার্জিকে নির্দেশ দিলেন অমরেন্দ্র। রূপক উঠতে গেল, সায়ন্তন বলল, আমার কিন্তু অসুবিধা হচ্ছে না। এখনও তো সন্ধে নামেনি। আরেকটু পরেই না হয়।
থাক তাহলে। আমিও খুব প্রয়োজন ছাড়া লাইট-ফ্যান জ্বালাই না, যতটা খরচ কমিয়ে রাখা যায়। তারপর আবার হুকুম করলেন আরেকবার চা বানা কেউ।
বাজপাখি ড্রাগনকে বলল, তুই বানা এবারে। আগেরবার আমি বানিয়েছি।
ড্রাগন বসা অবস্থাতেই পাছা ঘষটে স্টোভের সামনে গিয়ে সসপ্যানে জল ঢালল।
অমরেন্দ্র বললেন, ওই বইটা…ইয়েস, ওই বইটা আমার জীবনটাকে পুরো ঘুরিয়ে দিল। ঈশ্বর অর্থ না দিলেও মগজে ঘিলু বস্তুটা কম দেননি, ফলে খুব দ্রুত বুঝতে পেরে গিয়েছিলাম আর্গোসি, ব্ল্যাক মাস্ক, ব্লু বুকের মতো ম্যাগাজিনগুলোর জনপ্রিয়তার কারণ কী? আর সবথেকে বড় কথা হল যে সময়ে আমার হাতে ওই বইটা এসে পৌঁছেছে তখন আমার দেশেও ঠিক সেই পরিস্থিতি চলছিল।
কী পরিস্থিতি? ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল সায়ন্তন। পকেটে মোবাইলের রেকর্ডার অন করা সেটা ভেবে ও আরেকবার নিশ্চিন্ত হল। এত কষ্ট করে এখানে পৌঁছনো ওর বিফলে যায়নি। এই মানুষ এখনও মাথার ভেতরে যা রেখে দিয়েছেন তা ভাঙিয়ে কয়েকটা থিসিস পেপার হয়ে যাবে।
সেটা বলার আগে তোমাকে জিজ্ঞাসা করি, আমেরিকার পাল্প লিটারেচার কি তুমি কিছু পড়েছ?
আজ্ঞে কিচ্ছু না। আমি শুধু আপনার কিছু লেখা এবং কিছু দস্যু রোহণ পড়েছি। আর এই বিদেশের থ্রিলার বলতে ড্যান ব্রাউন…
ঠিকাছে ঠিকাছে। বুঝেছি। পাল্পের জগৎ পুরো আলাদা ভাই। বলতে পারো এ এক প্যারালাল ওয়ার্ল্ড। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বেশ কিছুদিন পর আমেরিকায় এই পাল্প ম্যাগাজিনগুলো পপুলার হওয়ার কারণ ছিল ওই সময়ে আমেরিকার আর্থসামাজিক অবস্থা। যদি তুমি ইতিহাসটা খেয়াল করো তাহলে দেখবে—আমেরিকায় তিনের দশকে মহামন্দার সময়ে এই পাল্প কাহিনি তার জনপ্রিয়তার টপে উঠেছে। ঠিক সেই সময় যখন আমেরিকার মহামন্দা, বেকারত্ব, নেতাদের কারচুপি আর প্রত্যহের দুর্দশায় সাধারণ মানুষ অস্থির, দিকভ্রান্ত। তাই তাদের দরকার হয়েছিল এমন কিছু সুপারহিরোর মতো চরিত্র যারা কিনা তাদের হয়ে লড়াই করবে সামাজিক যাবতীয় অন্যায় বা বলা ভালো সাধারণ মানুষের হয়ে সমাজের উঁচু তলার মানুষদের বিপক্ষে। আর ঠিক সেই জন্যই পাল্প ফিকশনগুলোর যারা ডিটেকটিভ, তাদের চরিত্রগুলো টিপিক্যাল ডিটেকটিভদের মতো নয়। সমস্ত পাল্প ম্যাগাজিনগুলো ঘেঁটে দেখো, বুঝতে পারবে তাদের অসম্ভব জনপ্রিয়তার প্রধান কারণ কী ছিল? গল্পের প্রধান চরিত্র হচ্ছে একেবারে হার্ডবয়েল্ড ডিটেক্টিভ। নাম তার যাই হোক না কেন, চরিত্রগতভাবে সে নিঃসঙ্গ, একলা, ঠিক যেমন একলা হয়ে পড়েছিল ওই সময়ের সাধারণ মানুষ। আর তার লড়াই ভয়ংকর সব চোরাচালানকারী, খুনি, অপরাধী, শয়তান রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে। গোয়েন্দারা আসছে এবং বীরবিক্রমে লড়াই করে প্রতিটিতেই অমিত শক্তিধর ভিলেনদের বুদ্ধি ও শক্তির জোরে হারিয়ে দিচ্ছে। তোমরা যাদের ওই মেনস্ট্রিম লিটারেচার বলো সেখানে ডিটেকটিভরা যেমন ভাবে বেশি, কাজ করে কম, এখানে ঠিক উলটো। এরা অনেক বেশি মারকুটে। বন্দুক চালানো থেকে ঘোড়ায় চড়ায় সিদ্ধহস্ত, দেওয়ালে পাইপ বেয়ে উঠতে পারে, লোহার রড দিয়ে প্রতিপক্ষের মাথা ফাটাতে পারে, আবার শত আঘাত খেলেও কাহিনির শেষে ঠিক বেঁচে থাকে। নো প্যানপ্যানানি, নো বুদ্ধির মারপ্যাঁচ। শুধু ঢিসুম আর গুড়ুম।
স্যর চা। ড্রাগন ঝুঁকে পড়ে প্রথম কাপটা বাড়িয়ে দিল অমরেন্দ্রর দিকে। আরেকটা কাপ ওর দিকে আসছে দেখেই বুক ঢিপঢিপ করে উঠল সায়ন্তনের। আবার সেই গরম চিরতার জল…ওহ মাই গড!
নিন চা খান।
নাহ, আমি খাব না।
কেন খাবে না? সস্তার চা বাবুর মুখে রোচে না বুঝি? অমরেন্দ্র খোঁচা দিলেন।
আরে এই না না, তা নয়। সঙ্গে সঙ্গে সায়ন্তন চায়ের একটা কাপ হাতে নিয়ে নিল। এ যা তিরিক্ষে মেজাজের লোক, অনেক কষ্টে মুডে আনা গিয়েছে আর চটিয়ে লাভ নেই। গরম চায়ে চুমুক দিল। একইরকম স্বাদ।
আলো আঁধারি ঘরে সকলের চোখমুখ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। কেমন একটা অলৌকিক পরিবেশ। অলৌকিক…শব্দটা মনে পড়তে হাসি পেল সায়ন্তনের। এই ঘরে দুপুরে ঢোকার পর থেকে যা যা ঘটে চলেছে তা কোনটা লৌকিক? বরং বলা ভালো শ্রীতপনকুমার সিরিজের কাহিনির মতোই মজাদার, রোমহর্ষক, অবিশ্বাস্য, কিন্তু অনস্বীকার্য।
বাকিরা আবার যে যার মতো মেঝেতে বসে পড়েছে। অমরেন্দ্র বললেন, তোমাকে ড্যালির কথা বলেছিলাম না শুরুতে, যাকে আমি আজও আমার গুরু মানি, এই যে পাল্পের হার্ডবয়েল্ড ডিটেকটিভ সেটা কিন্তু প্রথম তৈরি করেছিলেন ক্যারল জন ড্যালি। সেই উনিশশো তেইশে থ্রি গান ট্রি কাহিনিতে এসেছিল প্রথম হার্ডবয়েল্ড ডিটেকটিভ টেরি ম্যাক। তার ঠিক পরেই ড্যালি তৈরি করলেন গোয়েন্দা রেস উইলিয়ামসকে। সিরিজ গোয়েন্দাদের মধ্যে প্রথম হার্ডবয়েল্ড গোয়েন্দা ছিল এই রেস। লেখক হিসেবে ড্যালি কিন্তু তেমন দক্ষ ছিলেন না কিন্তু পাল্প লিটারেচারের গ্রামার ড্যালির হাতেই তৈরি হয়। এর অনেক পরে ব্ল্যাক মাস, ডিটেকটিভ ফিকশন উইকলি, ডাইম ডিটেকটিভ ইত্যাদি নানা নামের পাল্প ম্যাগাজিন ভরে ওঠে ভশাসল হ্যামেটের কন্টিনেন্টাল অপ, ফ্রাঙ্ক গ্রুবারের ইয়ার কোয়েড, রামন ডেকুলার জো গ্যার, নোবার্ট ডেভিসের মাক্স লাতিন, জর্জ হারমোন কক্সের ফ্ল্যাশ কেসি, কিংবা রবার্ট ডের কেনিস্মিথের নানা গল্পে। কেমন মনে রয়েছে বলো? এ্যাঁ? খুব তৃপ্তির সঙ্গে সায়ন্তনকে প্রশ্ন করলেন অমরেন্দ্র।
ওই তোবড়ানো খোদলানো মুখটাও ঝাপসা আলোতে কেমন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে দেখে ভালো লাগল সায়ন্তনের। মানুষটা দীর্ঘকাল পর যেন আজ নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু কী অবিশ্বাস্য স্মৃতিশক্তি রে বাবা! গড়গড় করে কেমন বিদেশি লেখক, তাদের ম্যাগাজিন সালতামামি বলে চলেছে, যেন অদৃশ্য ল্যাপটপ থেকে দেখে বলছে।
আমি বইটা পড়ছিলাম, জানছিলাম আর বুঝতে পারছিলাম পাল্প গোয়েন্দাদের সঙ্গে অন্য গোয়েন্দাদের বেসিক ডিফারেন্সটা কী? পাল্প গোয়েন্দারা হল আদর্শবাদী এবং নির্মম। তারা অপরাধের সঙ্গে সঙ্গে অপরাধীকেও ঘৃণা করত। পাল্পের জগত এক বিচিত্র সাদা-কালো জগৎ। এখানে ধূসরের কোনও স্থান নেই। পাল্পের ঝকঝকে মলাটের মাঝে লুকিয়ে থাকা হলদে, খসখসে পাতায় পাতায় শুধুমাত্র ধর্মের জয় আর অধর্মের পরাজয় রচিত হত।
শুধু তাই নয় আমি আরও একটা জিনিস বুঝে নিয়েছিলাম—পাল্পে শুধু গোয়েন্দাই প্রধান নয়, তার সমানে সমানে হতে হবে ভিলেনকেও। তবেই জমবে। এবং দুজনের চরিত্রই হবে লার্জার দ্যান লাইফ। গোয়েন্দাকে মহান করতে গেলে ভিলেনকেও হতে হবে এতটাই ক্রুর, নীচ, বিবেকহীন ও শক্তিশালী যে একমাত্র অমিতক্ষমতাশালী নায়কই পারবে তার মোকাবিলা করতে। গোয়েন্দার পথ কণ্টকসঙ্কুল। প্রতি মুহূর্তে পাঠক ভাববে, এবার বুঝি তার শেষরক্ষা হল না। কিন্তু সব বিপদকে হেলায় তুচ্ছ করে শেষ পর্যন্ত জয় নায়কেরই হয়। এরপর পাল্প গোয়েন্দা কাহিনিতে তিরিশের দশকের শুরু থেকে এক ধরনের ভিলেনের আবির্ভাব হল। এরা চোর, আইনভঙ্গকারী—কিন্তু রবিনহুডের মতো। এরা মানুষ খুন করে না। এরা শুধু ধনী মানুষদের লুণ্ঠন করে, যারা নানা কুটিল উপায়ে সে ধন সংগ্রহ করেছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রতিদিন রুটির জন্য লম্বা লাইনে দাঁড়ানো, না খেতে পাওয়া, বেকার মার্কিন মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তরা এদের গোয়েন্দার থেকেও বেশি আপন করে নেয়। এদের সিরিজে মজাটা হত অন্য জায়গায়। ভিলেন কখনও ধরা পড়ত না, বা পড়লেও শেষ মুহূর্তে পালিয়ে যেত, আর বই থেকে বইতে গোয়েন্দা পালটাত। কিছু ক্ষেত্রে তো এইসব ভিলেনদের গোয়েন্দার ভূমিকাও পালন করতে হত। ধরা যাক কোনও খুন হয়েছে যা সেই ভিলেন করেইনি, কিন্তু পুলিশ তাকেই সন্দেহ করছে। সেই ক্ষেত্রে ভিলেন নিজেই নেমে পড়ে আসল অপরাধীকে ধরতে।
মানে আপনি পুরো অ্যানালিসিস করে ফেলেছিলেন?
একদম। শুধু তাই নয়, আমার আগে যে রসধরবাবু দস্যু রোহণকে তৈরি করেছিলেন সেই রবিনহুডের আদলে, দস্যু রোহণও কিন্তু খেয়াল করে দেখো ভিলেন হয়েও নায়ক। তাকে সাধারন মানুষ মনে করেন তাদের মসিহা, কিন্তু আমি যখন ওই বই পড়ছি ততদিনে দস্যু রোহণের মার্কেট ডাউন, বাজারে অন্যান্য লেখকরা ওই টাইপের খাপছাড়া কিছু লিখছেন বটে কিন্তু কেউ সাহস করে এগিয়ে আসছেন না এই ধরণের লেখায় পুরোপুরি প্রবেশ করতে। হয় তারা সাহস পাচ্ছিলেন না, অথবা ওই এলিট মনোভাব তাদের এই সাহিত্য রচনায় বাধা দিচ্ছিল পাছে সাহিত্য জগৎ থেকে তাদের লাথ মেরে দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়। বলে খ্যাল খ্যাল করে হেসে উঠলেন অমরেন্দ্র। কিন্তু আমি পুরো মনস্থির করে ফেললাম, ময়দানে নামলে এটা খেলতেই নামব। পেটে ভাত দরকার ছিল ভাই, আর নিজের ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নও পূরণ করার ছিল। দস্যু রোহণের বিক্রি শরৎ চাটুজ্জেকে ছুঁয়ে ফেলেছিল। আমিও মনেপ্রাণে তৈরি হলাম, আমাকেও ওই জায়গায় পৌঁছতে হবে।
এক্সকিউজ মি বাবা, আমার একটি প্রশ্ন রয়েছে। ম্যাগনিফাইং গ্লাস ধরা হাতটা ওপরে তুলে বলল রূপক।
তোর তো চিরকালই সবেতে সন্দেহ। কী প্রশ্ন বল। বেশ সস্নেহেই বললেন অমরেন্দ্র।
আপনার কথা থেকে এটা স্পষ্ট যে, আমাদের নিয়ে গল্প লেখার জন্য আপনি পুরোপুরি বিদেশি পাল্প থেকেই উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন, দেশীয় আই মিন রসধরবাবুর দস্যু রোহণের দ্বারা কোনওভাবেই প্রভাবিত হননি? ইজ ইট ট্রু স্যর?
অমরেন্দ্র চোখ ছোট-ছোট করে নিজের প্রিয় সন্তানকে বললেন, কাছে আয় একবার।
রূপক গ্যাঁট মেরে বসে রইল।
আয় না, ভয় নেই। পোষা বিড়ালটিকে যেভাবে গৃহকর্তা ডাকে ঠিক, তেমনভাবেই নিজের সৃষ্ট চরিত্রকে ডাকলেন অমরেন্দ্র।
রূপক মেঝেতে হামাগুড়ি দিয়ে অমরেন্দ্রর কাছে এল। তারপর চৌকিতে বসা অমরেন্দ্রর দিকে নিজের মুখটা উঁচু করে তাকাল। অমরেন্দ্র রূপকের ফেল্ট টুপির ওপরেই রুগ্ন, শিরা ওঠা নিজের হাতটা বেস কয়েকবার বুলিয়ে দিয়ে বললেন, সোনা আমার, তোকে এইজন্যই আমার এত ভালো লাগে, যেমনটি তৈরি করেছিলাম তেমনই রয়েছিস। নিজের বাপকেও প্রশ্ন করতে ছাড়িস না। গুড। যা বোস গিয়ে।
রূপক আবার সেই স্টাইলেই গিয়ে নিজের জায়গায় বসে পড়ল।
অমরেন্দ্র বললেন, রূপক খুব ভালো প্রশ্ন করেছে, আমি রসধর দত্তর দ্বারা কি কোনওভাবেই প্রভাবিত হইনি? উত্তর হল—হ্যাঁ হয়েছি। আলবাত হয়েছি। আমি আমার চরিত্রকে কেমন তৈরি করব, আমার গল্পগুলো কেমন হবে সেটা আমি বিলিতি পাল্প ম্যাগাজিনগুলো থেকে নিলেও রসধরবাবুর দস্যু রোহণকে আমি অস্বীকার করতে পারি না। তাঁর লেখাগুলি আমি নিজেও গোগ্রাসে গিলেছি, তার বইগুলোর যে বিপুল জনপ্রিয়তা…
শ্রীতপনকুমার আছ নাকি? ও অমর…আছ? ঘরের বাইরে থেকে কে যেন ডাকছে। কোনও বৃদ্ধের গলা। সায়ন্তন বেশ অবাক এবং হতাশ হল। এখন আবার কে এল! ইন্টারভিউটা কি তাহলে মাঠে মারা যাবে!
অমরেন্দ্র বলে উঠলেন, অয়, ওই যে এসে গিয়েছেন। যা রে, দরজাটা খুলে দিয়ে আয়।
ব্যস এবার হয়ে গেল। দুই বুড়োতে মিলে শুরু করবে। নীচু গলায় বলে উঠল ড্রাগন।
অ্যায় হারামজাদা, কী বলছিস রে। এমন থাবড়া দেব, বাপের নাম ভুলে যাবি।
বাপ তো আপনিই, খিক খিক করে হেসে উঠল মাখনলাল।
অমরেন্দ্র কিছু উত্তর দেওয়ার সুযোগ পেলেন না। ঘরের ভেতর ঢুকলেন এক তস্য বৃদ্ধ। এর চেহারা গোলগাল, সাদা ধুতি, পাঞ্জাবি। হাতে একটি ছড়ি, মাথার সব চুল পাকা, ব্যাকব্রাশ করা। চোখে মোটা কাচের গোল চশমা। সব মিলিয়ে চেহারায় অমরেন্দ্রর মতো দারিদ্রের ছাপ নেই। দিব্বি মধ্যবিত্ত শ্রেনির বৃদ্ধ বলেই মালুম হচ্ছে।
কী অমর, আছ কেমন? প্রশ্নটা করতে করতে ঘরে ঢুকে সোজা চৌকির দিকে এগিয়ে এলেন তিনি। মেঝেতে তাকিয়ে বললেন, বাহ বেশ আন্ডাবাচ্চা নিয়ে বসেছ তো জমিয়ে। তা বাবারা রয়েছ কেমন?
এই তো আপনার আশীর্বাদে চলে যাচ্ছে জেঠু। বলল বাজপাখি।
বেশ বেশ। তা তোমাদের মধ্যে দিদিমনিকে দেখছি না তো? তিনি কই?
কালনাগিনী? তার কোনও আসার ঠিক রয়েছে নাকি? হয়তো কোনও শেঠের নেকলেস চুরির ধান্দা করছে।
অ্যাই বাজে কথা বলবি না। আমি অনেকক্ষণ এসেছি। একটু শুয়েছিলাম। চৌকির তলা থেকে মহিলা কণ্ঠে প্রতিবাদ এল। তারপর চৌকির তলা থেকে কাত হয়ে গড়িয়ে যে বেরিয়ে এল তাকে দেখে হাঁ হয়ে গেল সায়ন্তন। বিশাল লম্বা আর তেমনই চওড়া এক তরুণী, চোখে মুখে কঠোরতা, পরনে সামী লাল সালোয়ার আর পায়জামা। উদ্ধত বুকে জড়ানো পাথর আর জরির কাজ করা ওড়না, কানে দুল, নাকে নাকছাবি।
ভালো আছেন জেঠু? প্রশ্ন করল সেই তরুণী।
হ্যাঁ তা চলে যাচ্ছে টুক টুক করে।
আর রোহণ?
সেও রয়েছে দিব্বি। আমাকে সেই তো গিয়ে খবর দিল, বলল বাবা, অমরেন্দ্রবাবুর ঘরে আপনাকে নিয়ে কীসব আলোচনা চলছে। তা আমাকে নিয়ে আলোচনা তো কতযুগ আগেই বন্ধ, তাই যখন শুনলাম ভাবলাম যাই একবার নিজে কানেই শুনে আসি।
এই তাহলে সেই কালনাগিনী? শ্রীতপনকুমারের আরেক চরিত্র। দস্যুরানি কালনাগিনী। হ্যাঁ ওকে নিয়েও দুটো কাহিনি পড়েছে, মনে পড়ল সায়ন্তনের। এ খাটের তলায় শুয়েছিল এতক্ষণ! আশ্চর্য! কখনই বা এল! কোথা দিয়েই বা এল? যাই হোক, এই ঘরে যুক্তি খুঁজে লাভ নেই। দস্যু রোহণের খোঁজ নিচ্ছে কালনাগিনী, তাহলে বুড়োটা নিশ্চয়ই রসধর দত্ত।
তা এই ছেলেটি কে অমর? একে তো চিনলাম না। সায়ন্তনের মুখের সামনে নিজের মুখ প্রায় ঠেকিয়ে এনে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি।
সায়ন্তন নিজে কিছু বলার আগেই অমরেন্দ্র বলে উঠলেন, ছেলেটি এসেছে আমার ইন্টারভিউ নিতে। ওর নাকি আমার বই ভালো লাগে। হা হা হা খুক খুক…
বলো কী, তোমার বই! এমন পাঠক আর রয়েছে নাকি?
হুঁ দাদা, সেই তো দেখছি। ওই ওকে আমার গল্প শোনাচ্ছিলাম কীভাবে লেখালেখির জগতে এলাম সেই প্রসঙ্গেই আপনার কথা বলছিলাম আর কী।
অঃ, তা দেখি একটু বসি, তুমি ভাই পা ঝুলিয়ে না বসে একটু দেওয়ালের দিকে সেঁটে গিয়ে বসো, তাহলে তিনজনের চৌকিতে জায়গা হয়ে যাবে।
সায়ন্তন রসধরবাবুর কথা শুনে পা তুলে নিল চৌকিতে তারপর দেওয়ালের দিকে সেঁধিয়ে গেল।
ব্যস ব্যস এই তো জায়গা হয়ে গিয়েছে। আয়েশ করে রসধরবাবু বসলেন। পাঞ্জাবির পকেট থেকে সিগারেটের টিন আর মাচিস বার করে বাড়িয়ে দিলেন অমরেন্দ্রর দিকে।
অমরেন্দ্র একটা সিগারেট তুললেন। তারপর মাচিসটা নিয়ে সিগারেট ধরিয়ে ফেরত দিলেন রসধরকে। রসধরও ধরালেন একটা। বেশ লম্বা সিগারেট। প্রথম ধোঁয়াটা ছেড়ে আআহ করে তৃপ্তির শব্দ ছাড়লেন অমরেন্দ্র। অনেক দিন পরে এ সিগারেটে টান দিলেন সেটা বোঝাই যাচ্ছে। টানের ঠিক পরেই খুক খুক করে কাশি।
কাশিটা তো ভালোই বঁধিয়েছ দেখছি।
হ্যাঁ দাদা, বহুদিন ধরেই কাশিবাসী হয়েছি।
তাহলে একটু ডাক্তার-বদ্যি…
ধুর, কী হবে ওসব করে?
অবিশ্যি তুমি নিজেই তো ডাক্তার। তোমাকে আর কী জ্ঞান দেব। যাক গে যাক, কী যেন বলছিলেন অমর? প্রসঙ্গ বদলালেন রসধর। ওহ আমার কথাই তো হচ্ছিল বোধহয়।
হ্যাঁ আপনি না শুরু করলে আমার হয়তো তপনকুমার হয়ে ওঠা হত না।
সায়ন্তন খেয়াল করল কথাগুলো বেশ বিনয়ের সঙ্গেই বললেন অমরেন্দ্র। কিন্তু সাক্ষাতকারের গোড়ার দিকে উনি এই রসধরবাবুর দস্যু রোহণের ব্যাপারে একটু যেন উপেক্ষাই দেখিয়েছিলেন…
আসলে কী জানো অমর, লোকে বলে বটে বাংলায় সিরিজ সাহিত্য আমিই প্রথম লিখেছি। কথাটা মিথ্য না হলেও আমি কিন্তু প্রিয়ব্রত মুখুজ্জে আর সাতকড়ি দে-র অবদান অস্বীকার করতে পারি না।
মানে প্রিয়ব্রত মুখোপাধ্যায়, দারোগা সাহেবের দপ্তর?
হুঁ পড়েছ তুমি? সায়ন্তনকে জিজ্ঞসা করলেন রসধর।
আজ্ঞে হ্যাঁ পড়েছি। তবে আপনাদের মতো দু’জন প্রবাদপ্রতীম মানুষের কাছে মুখ খোলা নেহাত বাতুলতা হলেও সাহস নিয়ে বলছি, সত্যি বলতে ওই লেখাগুলো তো ঠিক ফিকশন নয়, কেস হিস্ট্রি। বরং গোয়েন্দা কাহিনি যদি বলেন তাহলে আমি বলব বাংলা রহস্য রোমাঞ্চ গোয়েন্দা কাহিনিকে প্রথম সাহিত্যে নিয়ে এসেছিলেন সাতকড়ি দে। তাঁর লালবসনা সুন্দরী, মায়াবীনি, কে হত্যাকারী আমি পড়েছি। রোমাঞ্চ পত্রিকার বেশ কিছু কপিও…
তুমি থামো তো ছোকরা, গর্জে উঠলেন অমরেন্দ্র। কী জানো তুমি? এই এই যে মানুষটা তোমার পাশে বসে রয়েছেন, ইনি কি তোমার ওই সাতকড়ি দে-র থেকে কোনও অংশে কম, অ্যাঁ? কিন্তু বাংলার সব নামিদামি সাহিত্য সমালোচকগণ ওই সাতকড়ির মাথাতেই প্রথম গোয়েন্দা কাহিনির লেখকের শিরোপা চাপালেন। আর ওরই সমসাময়িক এই মানুষটিকে তেমন কোনও গুরুত্বই দেওয়া হল না। বাঙালি চরিতাভিধানে যেখানে ওই সাতকড়িকে এত লম্বা লম্বা লাইন সেখানে রসধরদার জন্য সব মিলিয়ে তিনটে লাইন স্রেফ তিনটে। রসধর দত্ত, জন্মসালটাও দেওয়া নেই। হরিদিত্য—হুগলি। রচিত গ্রন্থ ‘জল ও আগুন’, ‘স্বর্গাদপী’, ‘আগুন ও মেয়েরা’, ‘শ্রীকান্তের উত্তরপর্ব’, ‘শেষ প্রশ্ন’ ইত্যাদি। ‘রোহণ সিরিজ’ আখ্যায় তিনি ‘রোহণ’ নামে এক দুঃসাহসী, উদার দস্যুর রোমাঞ্চকর ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে শতাধিক উপন্যাস লিখে বহু অর্থ ও কিছু পরিচিতি লাভ করেন। ব্যস গল্প শেষ। অথচ সাতকড়ির বেলায় লম্বা লম্বা লাইন। পক্ষে যুক্তি কী? না, সাতকড়িবাবুর লেখায় লজিক রয়েছে। কিন্তু রসধরবাবুর লেখায়…
কোথায় হইতে কী হইয়া গেল বোঝা গেল না, মাঝনদীতে রোহণ ভাসিয়া উঠিল। বলে নিজেই হো হো করে হেসে উঠলেন রসধর।
আপনি হাসছেন দাদা! বিস্ময় প্রকাশ করলেন অমরেন্দ্র।
হাসব না তো কী? চিরকাল ধরে এই কোটেশনই আমার নামের আগে ও পরে ব্যবহার করা হয়ে চলেছে। আমার লেখায় লজিক নেই, গাঁজাখুঁরি ইত্যাদি ইত্যাদি। আসলে কী জানো অমর, এই সমালোচকরা লজিক অফ অ্যাবসার্ডিটিকে ধরতে পারেনি। মাস আসলে এন্টারটেনমেন্টে রিলিফ খোঁজে, সাধারণ মানুষ রিয়্যালিটির লজিকের মধ্যে কোনও আরাম পায় না। তাকে তৃপ্তি দিতে হলে এই বাস্তব যুক্তির ঘেরাটোপ থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে এমন এক রূপকথার দেশে, যেখানে সে হবে নায়ক আর সে হবে সকল অসম্ভবের রাজা। তবে না…
তবে না দস্যু রোহণের বই মুঠোমুঠো বিক্রি হবে, হতচ্ছেদ্দা করলেও, চরিতাভিধানে তিনলাইনে কাজ সারলেও পাঠকের মন থেকে মোছা যায়নি। তা দাদা, আপনার কতগুলো কাহিনি হবে মোটামুটি? দেড়-দুশো তো হবে, তাই না?
সায়ন্তন বলে উঠল, আমি জানি, একশো ষাটখানা।
না, আমার শরীরে যতগুলো হাড়, ঠিক ততগুলো। ২০৬টা, অবশ্য যদি বলো এতগুলো বই লিখে হাজার হাজার টাকা রোজগার করেছি, সেই টাকা গেল কই? সেই প্রশ্ন আমি তোমাকেও করব অমর।
এবারে হেসে উঠলেন দু’জনেই।
অমরেন্দ্র বললেন, হ্যাঁ প্রকাশকমহাশয়রা এত টাকা ভরে দিয়েছেন আমাদের যে রাখার জায়গা না পেয়ে জলে ভাসিয়ে দিয়ে এখন এই গুমটি ঘরে কেশে মরছি।
হাহাহা, তা ভালো বলেছ।
নিন জেঠু, চা খান। এক কাপ চা রসধরবাবুর দিকে বাড়িয়ে দিল বাজপাখি।
ওহ, তুমি আবার এরমধ্যে চা বানিয়ে ফেললে! বাড়ি থেকে খেয়েই বেরিয়েছি অবশ্য। যাক, দাও অধিকন্তু না দোষায়। কাপে হাত দিয়ে দুই চুমুক পর পর দিয়ে স্বগতোক্তির মতো বললেন রসধর।
ঘরে কয়েক মিনিটের নৈঃশব্দ। অস্বস্তি হতে লাগল সায়ন্তনের। বাইরে গুড়গুড় শব্দ হচ্ছে। যে কোনও মুহূর্তে প্রবল বৃষ্টি হতে পারে। ঘর পুরো অন্ধকার হয়ে গিয়েছে বলে একটু আগে কেউ একজন ঘরের লাইটটা জ্বালিয়ে দিয়েছে। অতি ঘোলাটে একটা বালব। ধুলো, ঝুল পড়ে তার আলো বিকিরণের ক্ষমতা তলানিতে এসে ঠেকেছে। আলো আঁধারি ঘরে মানুষগুলোকে ছায়ার মতো লাগছে। অবশ্য এরা সত্যি আসলে কারা, তা জানে না সায়ন্তন। হবে কিছু একটা। তবে স্বপ্ন যে দেখছে না সেটা সত্যি।
সাধারণ মানুষ আমার কাছে কী চেয়েছিল জানো? মুক্তি…প্রত্যহের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি। দারিদ্র, বেকারত্ব, এইসব থেকে মুক্তি। আমার বিশ্বাস তপনের কাছেও মানুষ ঠিক ওই একই জিনিস চেয়েছিল। শুধু আমি যখন লিখতে শুরু করেছিলাম তখন ভারতবর্ষে ব্রিটিশরাজ চলছে। মানুষ প্রায় দুশো বছরের দাসত্ব করতে করতে ক্লান্ত, আর তপন যখন লিখতে এল তখন দেশ সবেমাত্র স্বাধীন হয়েছে কিন্তু সদ্য স্বাধীন দেশ দিশেহারা—মহামারী, দাঙ্গা, বেকারত্ব, কালোবাজারিতে চারদিকে হাহাকার করছে, জনগণ ভাবছে এ কোন স্বাধীনতা পেলাম আমরা! ওই সময় তপন কঠিন কঠিন মাথা চুলকানো সাহিত্য না করে সিরিজ সাহিত্য করার জন্য কলম ধরেছিল। এর জন্য হিম্মত চাই বুঝলে, হিম্মত। কীভাবে কী হয়ে গেল রোহণ মাঝনদীতে ভেসে উঠল এমন লাইন লেখার জন্য আত্মবিশ্বাস আর কলজের জোর চাই, নইলে ওই লাইনের পরেও কেন আমার বই হাজারে হাজারে বিক্রি হতো? ফালতু ট্র্যাশ বলে পাঠক মুখ তো ফেরাতে পারেনি বাওয়া। এমনকী তপনের রূপকও যখন…।
আমি কিন্তু দুই হাতে উদ্যত পিস্তল আর অন্য হাতে টর্চ ধরে সত্যিই পাঁচতলা বাড়ির পাইপ বেয়ে নিচে নেমেছি জেঠু, কোনও রিডার আঙুল তুলে আমাকে প্রশ্ন করেনি—কী করে পারলে? আরে আমরা হলাম রূপক চ্যাটার্জি, দস্যু রোহণ, বাজপাখি, ড্রাগনের দল—আমরা যা করব, তা পাবলিককে বিশ্বাস করতে হবে, কারণ আমরা পারি না এমন কোনও কাজ নেই। আমরা যেমন সাহেবের বিরুদ্ধে লড়েছি, তেমনই পৃথিবীর সকল চক্রান্তের বিরুদ্ধে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আজীবন লড়েছি। মেঝেতে চাপড় মেরে বলল রূপক।
তবে আমার সঙ্গে রসধরদার একটা বেসিক ডিফারেন্স ছিল, প্রথমত উনি লিখেছিলেন প্রাকস্বাধীনতাকালে। আর আমি লিখতে শুরু করেছিলাম তখন দেশ সবে স্বাধীনতা পেয়েছে। রসধরদার লেখাগুলোতে দস্যু রোহণ যতই ধনীদের থেকে ধন-সম্পত্তি ছিনিয়ে নিয়ে গরীবদের মধ্যে বিলিয়ে মহান হোক না কেন, কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের আনুগত্য কিন্তু ছাড়তে পারেনি সে, কী দাদা, ঠিক বললাম তো? আর সেইজন্যই ব্রিটিশ আমলেও রোহণের আসল শত্রু কোনও সাহেব পুলিশ না হয়ে এক বাঙালি ডিটেকটিভ। আবার তেমনই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যে দেশগুলো ইংরেজের শত্রু, তারা রোহণেরও শত্রু। ‘রোহণের জার্মানি অভিযান’, ‘গেস্টাপো—যুদ্ধে রোহণ’, ‘জার্মান ষড়যন্ত্রে রোহণ’ এইসব গল্প কিন্তু তারই প্রমাণ। তাই না রসধরদা? ঠিক একইভাবে রোহণ নিজের রাজানুগত্য প্রমাণের জন্য ব্রহ্মদেশ, জাপান অভিযানেও গিয়েছিলেন, ঠিক কি না বলুন?
রসধর কিছু বললেন না, শুধু মিটি মিটি হেসে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন।
রূপক ফোড়ন কাটল, শুধু জার্মান বা জাপান নয়, মিত্রবাহিনীর অংশ হওয়া সত্ত্বেও রুশদের পছন্দ ছিল না দস্যু রোহণের, বিশেষত বলশেভিকদের। আপনি বোধহয় কমিউনিস্টদের পছন্দ করতেন না, তাই না জেঠু? তাই আপনার রোহণ সর্বহারাদের বন্ধু হয়েও বলশেভিকদের শত্রু। আপনার অনেক কাহিনিতে ষড়যন্ত্রকারীরা ছিল রুশ বলশেভিক ‘ডাকাত’! ঠিক যেভাবে ইয়ান ফ্লেমিং-এর জেমস বন্ড দীর্ঘকাল ধরে রাশিয়ার বিরুদ্ধে একা গোপনে লড়াই করে গিয়েছে। তিনিও ছিলেন ওই ব্রিটিশের অনুগত!
রূপক থামল। আবার ঘরময় নৈঃশব্দ।
খুক খুক করে কাশলেন রসধর। চায়ের কাপটা চৌকির ওপর রেখে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর আচমকাই হো হো করে হেসে উঠে বললেন, অমর তোমার ছেলেরা কিন্তু এখনও বেশ তৎপর। নিজে দুই হাতে পিস্তল ধরে অন্য হাতে টর্চ ধরে কীভাবে পাইপ বেয়ে নামে সেটা না জানলেও আমার রোহণের রাজভক্তির অ্যানালিসিসটা কিন্তু জব্বর করেছে। সাব্বাশ বাচ্চা। চলি অমর, আবার আসব আরেকদিন। চলি ভাই। বলে সায়ন্তনের দিকে তাকালেন রসধর।
বৃষ্টি নামবে দাদা, একটু অপেক্ষা করে যেতে পারতেন।
ধুর আমার আবার বৃষ্টিতে ভয়! চিন্তা কোরো না, বাইরে রোহণ রয়েছে।
আচ্ছা, আবার আসবেন তাহলে।
হ্যাঁ। ড্রাগন উঠে দরজা খুলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে ঘরের ভেতর ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রবল হাওয়া। ঝড় শুরু হয়েছে। বাইরে দরজার সামনে বিশাল লম্বা এক পুরুষ দাঁড়িয়ে। হাতে মস্ত একটা ছাতা। সায়ন্তন আন্দাজ করল কে হতে পারে। রসধর বেরিয়ে গেলেন। দরজা বন্ধ করে দিয়ে আবার নিজের জায়গায় বসে পড়ল ড্রাগন।
অমরেন্দ্র রূপককে বললেন, চিরটা কাল গেঁড়েপাকা রয়ে গেলি।
শুনে রূপক ফিকফিক করে হাসল।
মাখন বলে উঠল, ওর কী দোষ বলুন, যেমন ওকে তৈরি করেছেন ও তেমনই হয়েছে।
তাই বলে রসধরদার মুখের ওপর এমন সত্যিকথাগুলো কি বলা ঠিক হল, উনি যে ব্রিটিশের ভক্ত ছিলেন তা তো সকলেই জানে।
হুঁ সেটা যে সকলে জানে তা ওঁর জানা একটু দরকার ছিল।
বড্ড বেশি বকিস। দিলি তো লোকটাকে চটিয়ে। যতই ইংরেজের অনুগত হোন না কেন, ওঁর লেখার ক্যারিশমাকে কিন্তু অস্বীকার করতে পারব না কেউ। বাংলার পাঠককে কয়েক দশক ধরে দস্যু রোহণে ডুবিয়ে রেখে দিয়েছিলেন উনি।
সায়ন্তন খেয়াল করল, কথাগুলো বলার সময় অমরেন্দ্রর কণ্ঠ থেকে যে আবেগ প্রকাশ পাচ্ছিল তা অকৃত্রিম।
কিন্তু একটা কথা বলব স্যর?
কথা? কী কথা? বাংলা চরিতাভিধান আমি দেখেছি, সেখানে রসধরবাবুর সম্পর্কে মাত্র তিনলাইন হলেও লেখা রয়েছে কিন্তু…
কিন্তু শ্রীতপনকুমার দ্য গ্রেট যে কি না প্রায় তিরিশ বছর ধরে বাংলার সাহিত্য জগতে দাপিয়ে বেড়িয়েছিল তার সম্পর্কে একটা লাইনও লেখা নেই, তাই তো? সেটাই বলবে তো? গলা চড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন অমরেন্দ্র।
হুঁ।
শালা বাঙালি জাতিটারই কোনও চরিত্র নেই সে আবার চরিতাভিধান কী তৈরি করবে হে? চিরকাল অন্যের পা চেটে খুদকুঁড়ো জোটানো জাতি তার কাছ থেকে আমি কিস্যু আশা করি না। এই যে শোনো, তোমরা যেসব সাহিত্যিকদের নাম উচ্চারণ করলে দুহাত জড়ো করে মাথায় ঠেকাও, আমিও তেমন সাহিত্য রচনা করতে পারতাম। ইয়েস পারতাম আমি, সেই ক্যাপাসিটি আমার ছিল। বাট…বাট অ্যাট দ্যাট টাইম আই ওয়াজ হেল্পলেস। আমার টাকার প্রয়োজন ছিল। খুব দ্রুত টাকার দরকার হয়েছিল। এবং আমি মানিকবাবু হতে চাইনি, অনাহারে থেকে পদ্মানদীর মাঝি লেখার ক্ষমতা ঈশ্বর আমাকে দেননি ভাই। তাই ওই পথ আমি নিইনি। অন্যপথ নিয়েছিলাম। সেটা মহৎ সাহিত্যের পথ নয়, কিন্তু চুড়ান্ত ঝুঁকিটা আমি নিয়েছিলাম সেই রাত্রে। বলে বাজপাখির দিকে তাকালেন অমরেন্দ্র। বাজপাখি সেই তাকানো দেখেই আন্দাজ করে সায়ন্তনকে ওই দেওয়ালে চোখ রাখতে ইশারা করল। সায়ন্তন দেখল আবার সাদা কালো সিনেমা শুরু হয়ে গিয়েছে।
ছাত্রাবাসে নিজের বেডে বসে তরুণ অমরেন্দ্র। সময়জ্ঞান নেই। কখন দিন থেকে বিকেল বিকেল থেকে সন্ধে গড়িয়ে গিয়েছে। ঘরে বাতির আলোতে রতনদার দোকান থেকে আনা বইটার প্রতিটি পৃষ্ঠার নির্যাসকে প্রায় দুই চোখ দিয়ে চুষে নিংড়ে নিচ্ছে। হ্যাঁ আলোর দিশা পাওয়া যাচ্ছে, পাওয়া যাচ্ছে। শতশত ভাবনা ছুটোছুটি করছে তার মস্তিস্কে। ঠিক যেমনভাবে ড্যালি সৃষ্টি করেছিল তার গোয়েন্দা রেস উইলিয়মকে, ঠিক যেভাবে রেস জন্ম নিয়েছিল তার সঙ্গে মেশাতে হবে ভারতীয়ত্ব। সৃষ্টি করতে হবে এমন একজনকে যে বাঙালি হয়েও পুরোপুরি বাঙালি চরিত্রের নয়। ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু স্বাধীনতার আনন্দ কোথায়? নেহেরুজি যে স্টেট সিকিউরিটির কথা বার বার উল্লেখ করতেন জনগণ সেই সিকিউরিটি কোথায় পাচ্ছে? দেশভাগের যন্ত্রণা, লাখে লাখে উদ্বাস্তু, অনাহার, বেকারত্ব, অলি-গলিতে নানাবিধ অপরাধ, অত্যাচারে জর্জরিত মানুষ।
মানুষ মুক্তির পথ খুঁজছে। মনেপ্রাণে চাইছে এমন একজন সুপারম্যানকে যে কি না তাদের হয়ে সব সমস্যাকে মিটিয়ে দিতে পারে। অপরাধী যতই ভয়ংকর হোক না কেন, যেখানেই থাকুক না কেন, তাকে খুঁজে বার করে শায়েস্তা করবে। দেশীয় আইন, প্রশাসন যেখানে মানুষকে নিরাপত্তা দিতে প্রতিদিন ব্যর্থ হচ্ছে, সেখানে আসুক এমন একজন নেতা যে হবে সকল মুশকিলের সমাধান।
গোয়েন্দা শব্দটা খাতায় দুবার লিখল অমরেন্দ্র। তারপর শব্দদুটোয় কলম দিয়ে গোল পাকাতে লাগল। একজন গোয়েন্দা দরকার। যে কিনা সরকারি কর্মচারী নয়, আমজনতার সে প্রতীক, আম জনতার লড়াইয়ের রূপক হয়ে উঠবে সেই গোয়েন্দা…রূপক, ইয়েস রূপক হবে আমার গোয়েন্দার নাম। শক্ত মুঠো করে একবার হাতটা ঝাঁকাল অমরেন্দ্র। তারপর খাতায় লিখল রূপক। কয়েক সেকেন্ড পরে নামের পাশে লিখল চ্যাটার্জি। কেউ জানল না ওই রাত্রে এমন এক দুর্ধর্ষ গোয়েন্দার নামকরণ হল যে আর কিছুদিন পরেই গোটা বাংলাদেশ কাঁপাবে।
রঙ্গলাল সরণিতে দ্বিজেন্দ্র লাইব্রেরি। বাংলা বই প্রকাশনা জগতে যথেষ্ট স্বনামধন্য। প্রকাশক কৃষ্ণলাল গুপ্ত অবাঙালি হলেও দীর্ঘকাল কলকাতায় থাকার কারনে বাংলা জ্ঞান তার কোনও বাঙালির থেকে কম নয়। শুধু বাংলা বা হিন্দি নয়, ইংরেজি সাহিত্যও কৃষ্ণলালবাবু নিয়মিত পড়েন। পার্কস্ট্রিট অঞ্চলে সাহেব পাড়ায় বেশ কিছু বিলিতি বই, ম্যাগাজিনের দোকান রয়েছে। সেখানে গিয়ে নিয়মিত অ্যাডভেঞ্চার, থ্রিলার বই পত্রিকা ইত্যাদি নিয়ে আসেন, পড়েন। অন্তরঙ্গমহলে মাঝেমাঝে আক্ষেপ করে বলেন বাঙালি এমন কাউকে যদি পাওয়া যেত যার সাহিত্যিক হওয়ার লোভ নেই কিন্তু ভালো ট্রান্সলেট করতে পারে আর লিটারেচারের নলেজ রয়েছে তাহলে এই ম্যগাজিনগুলোয় যেসব ডিটেকটিভ স্টোরিগুলো ছাপা হয় তা বাংলায় অনুবাদ করে ছাপলেও মুড়িমুড়কির মতো বিক্রি হতে পারে, কিন্তু তেমন লোক কোথায়? হয় তাদের ইংরেজি ভাষার, লিটারেচারের নলেজ নেই অথবা তারা সব রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র হতে চান।
দুপুরের দিকে চূড়ান্ত ব্যস্ততা থাকে কাজের। নিজের ঘরে বসে কাজ করছিলেন কৃষ্ণবাবু। কর্মচারী এসে খবর দিল—এক ছোকরা এসে সকাল থেকে বসে রয়েছে আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়।
কী দরকার? বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন কৃষ্ণলাল।
কী দরকার বলবে আপনাকেই।
ভাগাও।
আজ্ঞে সেই চেষ্টাও করেছি। নাছোড়বান্দা।
বলো ব্যস্ত রয়েছি।
তাও বলেছি। উত্তর দিয়েছে তাহলে বসছি, উনি যখন বেরোবেন তখন দেখা করে যাব।
শুনে হেসে ফেললেন কৃষ্ণলাল। আচ্ছা, পাঠাও।
কিছুক্ষণ পর ঘরে ঢুকল এক তরুণ। লম্বা, ফর্সা, রোগা, মাথাভরা কোঁকড়া চুল। ঘন ভুরু।
কী চান? গম্ভীর গলায় সরাসরি প্রশ্ন করলেন কৃষ্ণলাল।
আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।
কৃষ্ণলাল আরও গম্ভীর গলায় বললেন, কেন বলুন?
একখানি উপন্যাস লিখেছি, আপনার কাছে জমা দিতে চাই।
অহ। তো তার জন্য আমার সঙ্গে দেখা করার কী আছে? বাইরে রায়বাবু বসে রয়েছেন ওঁর কাছে জমা দিয়ে যান।
আজ্ঞে, আমি চাই উপন্যাসটি আপনি নিজে পড়ুন।
কেন?
এখানে আসার আগে আমি এই পাণ্ডুলিপিটি নিয়ে আরও কয়েকজন প্রকাশকের দ্বারস্থ হয়েছি, তারা সকলেই উপন্যাসের নাম এবং বিষয় দেখে, কেউ বা একটু চোখ বুলিয়েই ফেরত দিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন চলবে না। আপনি চতুর্থ। আমি চাই আপনি একবার পড়ে দেখুন, আমার বিশ্বাস এই উপন্যাস ছাপলে বাংলা সাহিত্যে এক নতুন দিক তৈরি হবে। আপনার লস হবে না কথা দিতে পারি।
ছোকরার আত্মপ্রত্যয় দেখে মোটা গোঁফের আড়ালে হাসলেন কৃষ্ণলাল। এত বছরে কম অভিজ্ঞতা হয়নি তাঁর। কত লেখক এল গেল। কত সাহিত্যিক নিজেকে শরৎ চাটুজ্জে প্রমাণ করতে গিয়ে কালের গহ্বরে হারিয়ে গেল, তার ইয়ত্তা নেই। ছেলেটির আত্মবিশ্বাস ভরপুর। অনেকেরই প্রথম লেখার পর এমন আত্মবিশ্বাস দেখা দেয়। তারপর…
প্রচুর কাজের চাপ রয়েছে, তাই আর কথা বাড়ালেন না কৃষ্ণলাল। বললেন রেখে যান।
ছেলেটি তার ঝোলা থেকে একটা খাতা বার করে টেবিলে রাখল।
কবে খোঁজ নেব স্যর?
কাল আসবেন।
আচ্ছা। পড়ে দেখুন। আমি আপনাকে হতাশ করব না। আবারও একই প্রত্যয়ী কণ্ঠ। কৃষ্ণলাল ছেলেটির সামনেই কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। তার ইঙ্গিত—কথা শেষ, এবার তুমি এসো।
আচ্ছা নমস্কার। আমি কাল এই সময়ে আসব তাহলে।
বিকেলের পর তেমন কোনও কাজ থাকে না। তখন কৃষ্ণলাল ঘণ্টাখানেক সময় কাটান গল্পগুজব করে অথবা বিলিতি ম্যাগাজিন পড়ে। আজও তাই করতে যাচ্ছিলেন। চোখ পড়ল টেবিলের পাশে রাখা সেই খাতাটিতে। পড়ে দেখার কোনও মানে হয় না। উঠতি ছোকরা কীসব ছাইভস্ম ব্যর্থ প্রেমের উপন্যাস লিখে নিয়ে এসেছে। সেই কারণেই কাল আসতে বলেছেন তাকে। এলেই যাতে পাণ্ডুলিপি ফেরত দিয়ে দেওয়া হয়। রায়বাবুকে খাতাটা দেবেন বলে হাতে নিলেন। কাল ছোঁড়া এলে যাতে আবার না দেখা করতে হয় সেই কারণেই রায়বাবুর কাছে দিয়ে রাখার প্ল্যান।
পুরনো খাতাটার বেশ কয়েকটি পৃষ্ঠায় মানুষের অ্যানাটমির ছবি। হিউম্যান বডি পার্টসের ডিটেল নোটস। সবটাই ইংরেজিতে লেখা। ছেলেটি কি ডাক্তারি পড়ছে নাকি? বেশ কৌতূহল হল কৃষ্ণলালের।
খাতাটার মাঝখান থেকে শুরু হয়েছে একটা কাহিনি, রক্তচোষার অভিশাপ। নাম পড়ে মুচকি হাসলেন তিনি। ছেলেটা কলেজে টলেজে পড়ে নিশ্চয়ই। হাতের লেখাটি বেশ পরিষ্কার, তবে খুব দ্রুত লেখা। আর কাটাকুটি প্রায় নেই বললেই চলে। রায়বাবুকে খাতাটা ফেরত দেওয়ার আগে এমনিই নিছক কৌতূহলে তিনি খানিকটা পড়তে শুরু করলেন।
পড়া যখন শেষ হল তখন ঘণ্টা দেড়েক পেরিয়ে গিয়েছে। কখন যে হুশ করে দেড় ঘণ্টা পেরিয়ে গিয়েছে খেয়ালই নেই। কাহিনিটা পড়ে পুরো থমকে গিয়েছেন কৃষ্ণলাল। এ কোন জুয়েল তার দ্বারে নিজে পায়ে হেঁটে এসেছিল দুপুরে। হায় হায় একটু হলেই কী ভয়ংকর ভুল তিনি করে ফেলছিলেন! এই ছেলের হাতে তো পুরো ম্যাজিক রয়েছে। প্রথম লাইন থেকে শেষ পর্যন্ত একেবারে টানটান থ্রিল। সাব্বাশ বেটা!
দস্যু রোহণের পর এমন ধারার রুদ্ধশ্বাস কাহিনি আর পড়েছেন কিনা মনে করতে পারলেন না কৃষ্ণলাল। পোড়খাওয়া ব্যবসায়ী তিনি। ছেলেটি যদি সত্যিই এমন লিখে থাকে, আর লিখে যেতে পারে তাহলে বাংলা প্রকাশনায় আবার একটা নতুন জগৎ খুলে যেতে পারে, ঠিক যেভাবে রসধর দত্ত করেছেন। এখনও অনেকে সেই চেষ্টা করছেন বটে তবে তা বিক্ষিপ্ত, এবং এই ঘরানার লেখার জন্য যে এলিমেন্ট দরকার তা তাদের নেই। কৃষ্ণলাল স্পষ্ট বুঝতে পারছিলেন, এই ছোকরাকে যদি একটু ট্রেইন করিয়ে নেওয়া যায়, এ হল বাজি জেতার ঘোড়া।
রায়বাবু…রায়বাবু…হাঁক পাড়লেন কৃষ্ণলাল। কারও কোনও সাড়া নেই। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন সন্ধে সাতটা বেজে গেছে। এখন কারোরই থাকার কথা নয়। আবারও অবাক এবং মুগ্ধ হলেন কৃষ্ণলাল, ছেলেটির হাতে এমন দম যে সময়জ্ঞান পর্যন্ত হারিয়ে দিয়েছে! সাব্বাশ বাচ্চে। খাতার যে পৃষ্ঠায় কাহিনিটা শেষ হয়েছে সেখানে ছেলেটির নাম সই করা, অমরেন্দ্রনাথ পান্ডে। কাল ছেলেটি আসা পর্যন্ত তর সইছে না। কাল যদি আসে তবে তাকে বাঁধতেই হবে।
রায়বাবুকে বলা ছিল অমরেন্দ্র এলেই যেন সোজা কৃষ্ণলালের ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
বেলা দুটো নাগাদ অমরেন্দ্র যখন পৌঁছল তাকে দেখামাত্র রায়বাবু হাউমাউ করে চিল্লে উঠলেন—এই যে ভাই, কোথায় থাকো এ্যাঁ? এত দেরি করে এলে হবে? দাদা সকাল থেকে অন্তত দশবার খোঁজ নিয়েছেন তোমার। যাও যাও, ভেতরে যাও শিগগির।
অমরেন্দ্র কৃষ্ণলালের ঘরে ঢোকামাত্র কৃষ্ণলাল উচ্ছ্বসিত। এই তো এসেছ। এসো এসো, আমি সেই সকাল থেকে তোমার জন্য পথ চেয়ে রয়েছি। বোসো বোসো।
কৃষ্ণবাবুর সামনে দুজন লোক বসেছিলেন। তাদের হাতজোড় করে তিনি বললেন, বেশ তাহলে এই পর্যন্ত কথা রইল আজ। আমি ব্যাপারটা দেখছি কী করা যায়।
লোকদুজন ইঙ্গিত বুঝে উঠে দাঁড়ালেন তারপর বিদায় নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরোনো মাত্র কৃষ্ণলাল অমরেন্দ্রকে বললেন বসে পড়ো চেয়ারে। কী খাবে বলো? বলে আর অপেক্ষা করলেন না, হাঁক পেড়ে পাঁচু নামের এক কর্মচারীকে ডেকে লেমোনেড আর সন্দেশ আনাতে বলে দিলেন। তারপর অমরেন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি থাকো কোথায়?
কোথায় থাকে, কী করে, বাড়ির বর্তমান অবস্থা, এখন কী করবে ইত্যাদি সবকিছু খুঁটিয়ে জানলেন কৃষ্ণলাল। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, এই কাহিনি তুমি নিজে লিখেছ? সত্যি কথা বলবে। মিথ্যা বললেও আমার কাছে ধরা পড়ে যাবে।
আজ্ঞে আমার নিজেরই লেখা।
তোমার গল্পের ডিটেকটিভ রূপক চ্যাটার্জি, তারপর ওই বাজপাখি এসব তোমার নিজের কল্পনা?
হ্যাঁ।
কীভাবে এমন প্লট পেলে একটু বলো তো শুনি। কৃষ্ণলাল আসলে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে চাইছিলেন ছেলেটির ক্ষমতা সম্পর্কে। অমরেন্দ্রও আন্দাজ করতে পারছিল তার সামনে বসে থাকা লোকটা ওর কাহিনি পড়েছেন এবং ভালোও লেগেছে, সেই কারণেই এত প্রশ্ন, টেবিলের সামনে রাখা সন্দেশের প্লেট এবং লেমোনেডের বোতল।
অমরেন্দ্র লেমোনেডের বোতলে চুমুক দিয়ে সেই রাতের ঘটনা থেকে রতনদার দোকান থেকে বই আনা এবং তারপর নিজের লিখে ফেলা সবটাই ডিটেলে বলল। ইচ্ছে করেই কোনওকিছু বাদ দিল না।
তিপ্পান্ন বছর বয়েসি প্রকাশনা জগতের অভিজ্ঞ কৃষ্ণলাল ভুরু কুঁচকে পুরো গল্পটা শুনলেন। তারপর পানের বাটা থেকে একখিলি পান মুখে পুরে বললেন, হুম। মানে ড্যালি পড়ে তোমার এই ভাবনা এসেছিল বলছ? কী তাই তো?
হ্যাঁ, অনেকটাই।
আচ্ছা তোমাকে এবার একটা প্রশ্ন করি। তুমি কি প্রিয়বাবুর দারোগাসাহেবের দপ্তর পড়েছ?
দারোগাসাহেবের দপ্তর?
হুঁ, পড়েছ?
না পড়িনি। তবে নামটা জানি। স্পষ্ট উত্তর দিল অমরেন্দ্র।
হুম। গোয়েন্দা কাহিনি যখন লিখেছ তখন তোমার জেনে রাখা দরকার বাংলা সাহিত্যে রহস্য রোমাঞ্চ গোয়েন্দা কাহিনির শুরু হয়েছিল প্রিয়লাল মুখোপাধ্যায়ের লেখা দারোগাসাহেবের দপ্তর দিয়ে। এ আজকের কথা নয়। ধরো আজ থেকে প্রায় ষাট বছর আগের কথা বলছি যখন দারোগাসাহেবের দপ্তর নামের মাসিক পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা প্রকাশ পায়। কী পরিমাণে পত্রিকাটি জনপ্রিয় হয়েছিল ভাবতে পারবে না। আসলে উনি ছিলেন পেশায় একজন পুলিশ কর্মচারী। কলকাতা ডিটেকটিভ পুলিশে টানা ২২ বছর চাকরির সুবাদে বহু অভিজ্ঞতার সাক্ষী হয়েছিলেন। কর্মজীবন থেকে অবসর নেওয়ার পর বন্ধুদের সঙ্গে গল্পগুজব করার সময়েই প্রিয়লালের মুখ থেকে উঠে আসত তার কর্মজীবনের নানা রোমহর্ষক অভিজ্ঞতার গল্প। সেই থেকেই বন্ধুদের অনুরোধ, গল্পগুলো শুধু মুখে মুখে না করে লিখে ফেললে তো আরও পাঁচটা মানুষ পড়তে পারে। সেই অনুরোধ রক্ষার্থেই লেখা শুরু, এবং লেখাগুলো তুমি পড়লে বুঝতে পারবে ফিকশন নয়, একেবারেই প্রবন্ধের আকারে লেখা। কিন্তু একটা সময়ে বাংলার প্রায় প্রতি ঘরে ওই দারোগাসাহেবের দপ্তরের দু-চারটে কপি ঠিক মিলে যেত।
প্রিয়নাথবাবুর পরে সাতকড়ি দে…
আজ্ঞে হ্যাঁ, সাতকড়ি দে-র লেখা উপন্যাস আমি পড়েছি। গোয়েন্দা হাজির সিরিজে।
হুঁ, ওটা দারোগাসাহেবের দপ্তর আর গোয়েন্দাকাহিনি নামের আরেকটা ম্যাগাজিনকে খিচুড়ি বানিয়ে আরেকটা সিরিজ বেরিয়েছিল। ওটাও খুব ভালোই চলেছে। সাতকড়িবাবুই কিন্তু বলতে গেলে বাংলায় ডিটেকটিভ ফিকশন প্রথম লেখেন।
অমরেন্দ্র বুঝতে পারছিল কৃষ্ণলালবাবু গোয়েন্দা গল্পের শুধু পোকা নন, ইতিহাসটাও বেশ ভালোই জানেন।
তুমি ভাবছ এইসব গল্প আমি কেন করছি তোমার সঙ্গে। করছি কারণ তোমার গল্পটা কাল আমি একটানে পড়ে শেষ করেছি। তুমি যে ইংরেজিটা ভালো জানো সেটা বুঝেছি, তোমার লেখার স্টাইলেও সেই ইংরেজি পাল্পের একটা ফ্লেবার রয়েছে, এটা খুব ভালো। এবার তোমার সঙ্গে আমি কিছু দরকারি কথা বলতে চাই।
হ্যাঁ বলুন।
লেমোনেডটা শেষ করে ফেলো ঝপ করে, তারপর বলছি।
কয়েক চুমুকে বোতলটা খালি করে ফেলল অমরেন্দ্র। তারপর কৃষ্ণলালকে জিজ্ঞাসা করল, আপনার পছন্দ হয়েছে আমার লেখা?
শুনে হাসলেন কৃষ্ণলাল। বললেন, বাঙালিবাবু, আমি আসলে ব্যবসাদার মানুষ। ফ্রি তে কাউকে একগ্লাস জলও খাওয়াই না। সেখানে তোমাকে বসিয়ে সন্দেশ লেমোনেড তো আর এমনি খাওয়াচ্ছি না ভাই। কাজের কথাটা হল তোমার লেখা তুখোড়। অনেক দূর তুমি যেতে পারো। দেখো, রসধরবাবুর পরে আর এই মুহূর্তে বাংলায় তেমন কেউ নেই যে পাল্প ফিকশনকে শক্তহাতে লিখতে পারে। সকলেই ছুটেছেন ক্লাসিক লিখতে অথবা প্রেমের কিংবা সামাজিক উপন্যাস লিখতে। অথবা গোয়েন্দা, রোমাঞ্চ কাহিনি লিখলেও তা নিয়মিত লিখছেন না। অথচ এর বাজার এখনও বিপুল। কেউ যদি রসধরবাবুর রেখে যাওয়া বাজারটাকে ধরে, আমি শিয়োর, আবার জমে যাবে। এবং তোমার লেখায় সেই দম রয়েছে। শোনো তোমার পরিস্থিতি আমি শুনলাম। কলকাতায় থাকতে গেলে তোমাকে রোজগার করতে হবে। আর ডাক্তারি তুমি পাশ করতে পারছ না এখন, ফলে তুমি রুগিও দেখতে পারবে না, সুতরাং উপার্জন করার মতো তোমার কাছে একটা পথ হচ্ছে এই গোয়েন্দা কাহিনি লেখা।
অমরেন্দ্র এতটাই মনোযোগ দিয়ে শুনছিল কৃষ্ণলালের কথা যে, নড়াচড়া করতেও ভুলে গিয়েছিল।
আমি তোমাকে সবরকম হেল্প করতে পারি। তুমি ইংরাজি ভালো জানো। আমি তোমাকে অনেক বিলিতি ডিটেকটিভ ম্যাগাজিন দেব সেখান থেকে তুমি লেখার থিম পাবে, তোমার গোয়েন্দা এবং ভিলেনদের আরও স্ট্রং তৈরি করতে পারবে। শুধু কয়েকটা শর্ত তোমাকে মেনে চলতে হবে। প্রথমত, তুমি যা লিখবে সব আমার প্রকাশনা থেকে বই করতে হবে। এর জন্য তোমাকে যা যা সাপোর্ট দেওয়ার সবকিছু আমি দেব। দুই, মার্কেটে যেমন ডিমান্ড তৈরি হবে সেইমতো তোমাকে সাপ্লাই দিতে হবে। আর কাহিনিগুলো হবে এই তুমি যেমন লিখেছ ঠিক তেমনই। গোয়েন্দা আর ভিলেনকে একই রাখতে পারো। প্রয়োজনে গোয়েন্দাকে একজন সহকারী দিতে পারো। বুঝলে?
হ্যাঁ।
আর তুমি তো বললে এই মাসটা পেরিয়ে গেলে হাসপাতালের মেসবাড়িতে তোমার আর থাকার জায়গা লাগবে না। তাহলে একটা মাথা গোঁজার জায়গা তো চাই নাকি?
হুঁ।
এক কাজ করো আজ গিয়ে নিজের জিনিসপত্র সব গুছিয়ে ফেল। আমার দপ্তরের পিছনে একটা ছেলেদের মেসবাড়ি রয়েছে। আমারই বাড়ি ওটা। ওখানে একটা বিছানা তোমার জন্য ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। থাকা খাওয়া আপাতত ফ্রি, যতদিন না তোমার বইয়ের বিক্রি শুরু হয়, ততদিন বিনামূল্যে থাকো খাও। তারপর টাকা পেতে সুরু করলে পে এন্ড স্টে, বুঝলে?
হুঁ।
তাহলে এখন ফিরে যাও। কাল একেবারে বাক্স-বিছানা বেঁধে বেলার দিকে চলে এসো এখানে।
আচ্ছা স্যর।
স্যর নয়, কৃষ্ণবাবু বলে ডাকবে আমাকে। বেস্ট অফ লাক।
আসছি তাহলে?
হ্যাঁ এসো। আচ্ছা দাঁড়াও। বলে ড্রয়ার টেনে কিছু টাকা বার করে বাড়িয়ে দিলেন অমরেন্দ্রর দিকে।
না না, লাগবে না।
না লাগলেও রাখো। পরে আমি অ্যাডজাস্ট করে নেব। ধরে নাও এটা তোমার বই বিক্রির রয়্যালটি।
বাইরে বেরিয়ে এসে অমরেন্দ্র টাকাটা গুনে দেখল। পুরো দ-শ টাকা!
দেওয়ালের সিনেমা আচমকাই বন্ধ হয়ে গেল। সায়ন্তনের দিকে তাকালেন অমরেন্দ্র। কী বুঝলে? ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি সায়ন্তনকে।
হুঁ…
কী বুঝলে?
সায়ন্তন অমরেন্দ্রর দিকে তাকিয়ে দেখল তিনি বাংলা মদের বোতল খুলে বসেছেন। গেলাসে ঢালছেন আর চুমুক দিচ্ছেন। ঘর ভরে গিয়েছে মোদো গন্ধে।
চলে?
না। আপনি খান।
না চললেই ভালো। বিষ যত শরীরে কম ঢোকাবে তত বেশিদিন বাঁচবে। বুঝেছ?
হুঁ। সায়ন্তন প্রমাদ গুনল। সর্বনাশ এ যদি এখন মাল খেয়ে তাল হয়ে হাবিজাবি বকতে শুরু করে তাহলেই বিপদ! সব ঘেঁটে যাবে।
কী ভাবছ তুমি, অ্যাঁ? এ ভাবাভাবির কী রয়েছে? জানো না, বেশি ভাবলে শরীর খারাপ হয়। বলে নিজেই হা হা হা করে হাসলেন। মেঝেতে বসা তার ছেলে-মেয়েরাও হা হা হো হো করে হেসে উঠল।
যেদিন ওই হাসপাতালের মেসবাড়িটা ছেড়ে দিয়ে চলে এলাম সেদিন থেকেই ভাবাভাবি বন্ধ করে দিয়েছিলাম জীবন থেকে। দুটো জিনিস আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সেটা হল কলকাতা শহরে আমাকে থাকতে গেলে টাকা রোজগার করতে হবে এবং টাকা আমাকে দিতে পারে আমার লেখা। যে লেখা লিখলে ওই কৃষ্ণলালের মতো ব্যবসায়ী প্রকাশক টাকা দেবে, সেই লেখা লিখতে হবে।
পরের দিনই তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে এলাম আমার সাধের হাসতাপালের সেই বেডটাকে ছেড়ে।
কষ্ট হয়নি?
হুঁ হয়নি আবার? খুব হয়েছিল। ওই দামড়া বয়েসেও কেঁদে ফেলেছিলাম।
তারপর কী করলেন?
তারপর? গেলাসে চুমুক দিলেন অমরেন্দ্র। গ্লাস নামিয়ে আআআহ শব্দ করে বললেন, চলে এলাম। শুরু হয়ে গেল এক অন্যজীবন। মেসের বিছানায় বসে আমি শুধু সারাদিন লিখছি আর লিখছি। কৃষ্ণলালবাবু আমাকে তার স্টক দিয়ে চলেছেন। বলতে দ্বিধা নেই আমি প্রচুর লেখা তখন লিখেছি জাস্ট ইংরেজি থেকে বাংলায় ট্রান্সলেট করে। দিন রাত এক করে ঘাড় গুঁজে লিখে চললাম। প্রথম দুটো বই বিক্রি হল না। আমার মন ভেঙে গেল। কৃষ্ণবাবু মার্কেট থেকে বইদুটো তুলে নিয়ে আমাকে বললেন, চিন্তা কোরো না। তোমার লেখায় কোনও খামতি নেই। ভুল আমার হয়েছে। প্রোডাকশনে ভুল। উনি আবার নতুন করে সাজালেন। বিজ্ঞাপন বানালেন।
এই যে বিজ্ঞাপনটা। দেখুন, দেখুন হাতে নিয়ে। সায়ন্তন ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল ড্রাগন একটা অতি পুরনো ম্যাগাজিন ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে। মলাট দেখেই বোঝা যাচ্ছে শ্রীতপনকুমারের লেখা।
বইয়ের পিছনের কভারটা দেখুন। দেখুন দেখুন। রীতিমতো ধমকেই উঠল ড্রাগন।
ম্যাগাজিনটার পিছনের কভারে দেখল বেশ বড় অক্ষরে লেখা—
এ বছরের সবচেয়ে সেরা
ডিটেকটিভ সিরিজ
অনবদ্য রচনা নৈপুন্যে বিষয়ের ভিন্নতা আর টান টান রোমাঞ্চে ভরপুর
ডিটেকটিভ সাহিত্যের জাদুকর
শ্রীতপনকুমারের লেখা
বাজপাখি সিরিজ
আজই পড়ুন দাম—৪০ পয়সা
অবিকল যাত্রা পালার বিজ্ঞাপন যেন। ম্যাগাজিনটার পাতা ওল্টাতে ভয় লাগল সায়ন্তনের। পৃষ্ঠাগুলো পুরো তেজপাতা হয়ে গিয়েছে। একটু বেশি ভাঁজ পড়লেই ভেঙে গুঁড়ো হয়ে যাবে।
আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞাসা করব আপনাকে?
করে ফেলো।
আপনি নিজের নামটা ছেড়ে হঠাৎ শ্রীতপনকুমার নাম কেন নিতে গেলেন?
প্রশ্নটা শুনে একটু যেন নড়ে চড়ে বসলেন অমরেন্দ্র। গেলাসে আরেকটু বাংলা ঢেলে চুমুক দিয়ে বললেন, নিয়ে নিলাম। ইচ্ছে হল নিয়ে নিলাম। কী বুঝলে?
বুঝলাম আপনি হয়তো আমাকে সত্যিটা বলতে চাইছেন না।
মানে?
একজন শিল্পী বা সাহিত্যিক শুধু অর্থ নয়, সে প্রতিষ্ঠাও চায়, নাম চায়, কিন্তু আপনি কখনোই নিজের নামটা ব্যবহার করেননি। কেন, এর কারণ আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে।
কারণ…কারণ আবার কী? আমার মনে হয়েছে লেখকের নামে একটা চমক থাকলে বই বিকোবে বেশি, তাই অমন নাম নেওয়া।
তাই কি? তাহলে আপনি…
থামো থামো… আজকালকার ছেলে-ছোকরাদের সমস্যা কী জানো, তোমরা অল্পবয়েসেই বেশি পেকে যাও। দুনিয়ার সবকিছু বুঝে ফেলো। অস্থিরভাবে বলে উঠলেন অমরেন্দ্র।
সায়ন্তন দেখল অমরেন্দ্র ঘন ঘন শ্বাস ফেলছেন। মানে ভেতরে চঞ্চল হয়ে উঠেছেন তিনি। গোপনীয়তায় আঘাত পড়লে অসংযত মানুষ যেমন করতে থাকে তেমনি করছেন অমরেন্দ্র। কিন্তু ওকে চঞ্চল হতে দিলে চলবে না। একে বাংলার ধুনকি চলছে,তার ওপর যদি আবার মেজাজ বিগড়ে যায় হয়তো মাঝপথেই থামিয়ে দেবেন সব। তার থেকে যা বলছেন তাই বলুক।
আচ্ছা আমার ভুল হয়েছে। ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি আপনার কাছে।
এক্সকিউজ মি মিস্টার সায়ন্তন, ক্ষমাটা কি আপনি মন থেকে চাইলেন? সায়ন্তনের দিকে আঙুল তুলে প্রশ্ন করল রূপক।
সঙ্গে সঙ্গে পেল্লায় চিৎকার করে উঠলেন অমরেন্দ্র। আরে অ্যায় হারামজাদা…তোকে সব ব্যাপারে ফোড়ন কাটতে কে বলেছে রে শালা…এই বেশি লাই দিয়ে তোকে মাথায় তোলাটাই আমার ভুল হয়েছে।
রূপককে সকলের সামনে এমন অপদস্ত করায় হা হা করে হেসে উঠল বাজপাখি, ড্রাগন আর কালনাগিনী।
চোওপ, চোওপ শুয়োরের পাল, যা বেরো বেরো এক্ষুনি আমার চোখের সামনে থেকে।
অমরেন্দ্রর এমন রুদ্রমুর্তি দেখে ভয় লেগে গেল সায়ন্তনের। নাম লুকনোর কথাটা কি খুব সেন্সেটিভ ইস্যু? ইসস, বলে তো খুব ভুল হল! মনে মনে আফশোস করতে করতে সায়ন্তন দেখল পিতার প্রবল ক্রোধানলে ভীত হয়ে সব সুপারম্যান এবং ওম্যান দুরদার করে পালাল। কেউ জানলা দিয়ে গলে বেরিয়ে গেল, কেউ লুকালো চৌকির নীচে। মুহূর্তে ঘরে মাত্র দুজন লোক।
এ্যাহ আমার বই, আমার ইচ্ছে আমি আমার কী নাম রাখব। সেটা কি তুমি ঠিক করে দেবে? কেন, আমি যখন জন্মেছিলাম তখন কি এই নাম নিয়েই পৃথিবীতে এসেছিলাম নাকি আমার নামকরণের সময় আমার অনুমতি নেওয়া হয়েছিল যে অমরেন্দ্রনাথ পাণ্ডে, এই নাম আমার পছন্দ কি না। না নাহ, কেউ জিজ্ঞাসা করেনি। একখানা নাম জগদ্দলের মতো ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আই হেট মাই নেম। অ্যান্ড হোয়াটস ইন আ নেম? নাথিং…
আবার বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ।
তোমাকে কি আমি বকাঝকা করলাম? জিজ্ঞাসা করলেন অমরেন্দ্র।
না না, আমাকে কিছু বলেননি আপনি। মৃদু হেসে উত্তর দিল সায়ন্তন।
হ্যাঁ, কী যেন বলছিলাম?
ওই যে বইয়ের বিজ্ঞাপন।
ওহ হ্যাঁ। একটু থমকে মনে করে অমরেন্দ্র আবার বললেন, কৃষ্ণবাবু সব বই তুলে নিয়ে আবার নতুন করে ভাবলেন। বিষ্ণুদেবনাথ নামে আমারই বয়েসি একজন আর্টিস্টকে ডাকলেন প্রচ্ছদ করার জন্য। তাকেও বুঝিয়ে দিলেন কেমন ধরনের প্রচ্ছদ উনি চাইছেন। একেবারে বিদেশি পাল্প ম্যাগাজিনগুলোর প্রচ্ছদ যেমন হয়, তেমন। আর বইয়ের মাপ করে ফেললেন একেবারে ছোট। আটচল্লিশ পৃষ্ঠা আর আঠেরো বাই বারো সেন্টিমিটার। কয়েকদিনের মধ্যে ওই বিষ্ণুবাবুু ছবি করে নিয়ে এলেন, জব্বর ছবি। আবার বই বেরোল। পুরোনো বই-ই মার্কেটে ওই মাপে যখন বেরোল বিশ্বাস করবে না, গপ গপ করে গিলতে শুরু করল আমজনতা। পুরো ম্যাজিক হয়ে গেল। পুরো কনফিডেন্স পেয়ে গেলাম। মাত্র চল্লিশ পয়সা দাম। পেপারব্যাক। ইচ্ছেমতো ক্যারি করা যায়। অনায়াসে পাঞ্জাবি কিংবা প্যান্টের পকেটেও ভরে ফেলা যায়। কৃষ্ণবাবু আমাকে বললেন, কী বলেছিলাম অ্যাঁ, মিলল তো আমার কথা? এবার শুধু লিখে যাও। আর হ্যাঁ, এই বাজপাখিকে নিয়েই পরপর সিরিজ লেখো। এমন লেখো যাতে তোমার রূপক চ্যাটার্জি কিছুতেই তাকে ধরতে না পারে।
এই একটু ডিস্টার্ব করছি। এই যে আপনি সিরিজ বললেন। আপনার এই লেখাগুলোরও তো দস্যু রোহণের মতো সিরিজই বেরোত, তাই না?
হ্যাঁ।
তার মানে রোহণের পর আপনিই আবার…
উঁহু, একেবারেই তা নয়, আমি যখন বাজপাখি সিরিজ লিখতে শুরু করলাম তখন বাজারে মেনস্ট্রিম লিটারেচারের পাশাপাশি রমরমিয়ে চলছে এই সিরিজ সাহিত্য। শুধু পুরুষরা নয়, মহিলা লেখকরাও এগিয়ে এসেছিলেন লিখতে। প্রভাতীদেবীর নাম শুনেছ কি না জানি না, উনি কৃষ্ণা এবং কাবেরী, এই দুই নামে দুটি ফিমেল ক্যারেকটার তৈরি করেছিলেন। দুটো ক্যারেকটারই লড়াকু। বাঙালি মেয়েদের মতো শাড়ি-ঘোমটা পরা গৃহবধু নয়, একেবারে ছেলেদের মতো তারা দস্যুদের সঙ্গে লড়াই করতে জানে।
ভেবে দেখো, ভারত তখনও স্বাধীন হয়নি। ওই সময়ে দাঁড়িয়ে ভারতীয় নারীশক্তিকে জাগিয়ে তোলার কী অভিনব প্রয়াস তিনি নিয়েছিলেন। বঙ্কিম চাটুজ্জের আনন্দমঠের শান্তি যদি আইডিয়াল হয় তাহলে কৃষ্ণা হল রিয়াল। দেশের মেয়েরা যাতে নিজেদের সুরক্ষার ভার নিজেরাই নিতে পারে, দেশের শত্রুকে কড়া হাতে বিনাশ করতে পারে, তারই উদাহরণ হয়ে উঠেছিল এই কৃষ্ণা, কাবেরী।
ওরেব্বাস, তাই!
হুঁ, তবে শুধু তাই নয়, ওই টাইমটায় আরেকটি নামী প্রকাশনা থেকে কাঞ্চনকন্যা, কুহেলিকা সিরিজও বেরোত। এবং ওই কাঞ্চনকন্যা সিরিজে তো তোমার শুদ্ধদেব বসু, রমেন্দ্রকুমার রায়, অচিন্ত্যকুমার দাশগুপ্ত থেকে শুরু করে প্রমোদকুমার সান্যাল, প্রেমেন্দ্র দত্ত, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়…তারপর নির্মল বসু, কে না লিখেছেন।
এরাও লিখেছেন!
ইয়েস, তোমাদের এলিট সোসাইটির এলিট লেখককুলও দিব্বি লিখেছেন বাবা। এ-রা-ও লিখেছেন, আর এঁদের মতো নামীদামি সাহিত্যিকরা তাঁদের মহান সাহিত্য রচনার পাশাপাশি এইসব জাতখোয়ানো রচনাও লিখছিলেন বলে চ্যালেঞ্জটা আমার পক্ষে খুব কঠিনই হয়েছিল। বাট আই টুক দ্যাট চ্যালেঞ্জ। আমার এ ছাড়া আর কোনও উপায়ও ছিল না সেটাও ঠিক।
এবং কয়েক মাসের মধ্যে শ্রীতপনকুমার বিকেম আ ব্র্যান্ড। ইয়েস, আই বিকেম এ ব্র্যান্ড। ছেলে বুড়ো নাতিপুতি তখন পাগলের মতো শুধু শ্রীতপনকুমারের বাজপাখি সিরিজ খুঁজছে আর পড়ছে। হাজারে হাজারে কপি ফুচকার মতো, গরম কচুরির মতো শেষ হয়ে যাচ্ছে। অনেকগুলো বাজপাখি সিরিজ লিখলাম। কলকাতার নন এলিট, নন ইন্টেলেকচুয়ালরা তখন দিনের আলোতে বাসে, ট্রামে, ট্রেনে, মাঠে, আপিসে মাত্র চল্লিশ পয়সায় আটচল্লিশ পৃষ্ঠার বইতে বুঁদ হয়ে শুধু বাজপাখি আর রূপক চ্যাটার্জির লড়াই পড়ছে। আর আমারও হাতে এসে পড়ছে মুঠোমুঠো টাকা। পঁচিশটা সিরিজ লেখার পর কৃষ্ণবাবু বললেন, এবার সিরিজ বদলাও। গোয়েন্দাকে একই রেখে ভিলেনকে বদলে ফেলো। আরও ভয়ংকর ভিলেন আনো। আমি সৃষ্টি করলাম ড্রাগনকে।
সঙ্গে সঙ্গে চৌকির নিচ থেকে খলখল করে হাড় হিম করা অট্টহাসির শব্দ এল। শিউরে উঠল সায়ন্তন। আবারও রণহুংকার দিয়ে উঠলেন অমরেন্দ্র। চোওওওপ, কথার মাঝে ডিসটার্ব করলে এবার সবকটাকে জুতোপেটা করে তাড়াব বলে দিচ্ছি।
আজ্ঞে মাপ করবেন, কিন্তু আজ আপনি নিজে মুখেই স্বীকার করলেন যে বাজপাখির থেকে আমার ক্ষমতা বেশি। সেই আনন্দটাই রাখতে পারিনি। বলে আবারও খলখল করে হেসে উঠল ড্রাগন।
এই পৃথিবীতে এমন কেউ নেই যে বাজপাখিকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। খাটের তলা থেকেই গর্জন শোনা গেল বাজপাখির।
এই আবার দুটোতে লাগবে…আর পারি না এই শয়তানদুটোকে নিয়ে। অবাধ্য ছেলেদের নিয়ে যেমন আপশোস করেন পিতা, তেমনই হতাশা ঝরে পড়ল অমরেন্দ্রর গলা দিয়ে।
ঠিক সেই মুহূর্তে জানলা দিয়ে প্রায় সাপের মতোই গলে ভেতরে নামল গোয়েন্দা রূপক চ্যাটার্জি। মাথায় ফেল্ট হ্যাট। ওভারকোট, দুই হাতে পিস্তল। অমরেন্দ্রর দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি কোনও চিন্তা করবেন না। আজ দুটোকেই একসঙ্গে শায়েস্তা করব আমি, বলেই চৌকির নিচে দুটো বন্দুক থেকেই ফট ফট করে গুলি চালাল।
চমকে উঠল সায়ন্তন। দুটোই মরে গেল নাকি! একটু ঝুঁকে নীচু হয়ে দেখল চৌকির নীচে একটা ম্যানহোলের মতো ঢাকনা সরিয়ে বাজপাখি আর ড্রাগন খুব দ্রুত ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। ঢাকনাটা আবার বন্ধ করে দেওয়ার আগে ড্রাগন চিৎকার করে বলে উঠল, রূপক চ্যাটার্জ তুমি যত বড়ই ডিটেকটিভ হও না কেন, ড্রাগন আর বাজপাখিকে ধরার ক্ষমতা তোমার আজও হয়নি। চলি বন্ধু আবার আমাদের দেখা হবে।
রূপক আরও দুটো গুলি করল কিন্তু ততক্ষণে দুজনেই মাটির তলায় উধাও।
রূপক তার দুটো পিস্তলের ধোঁয়া ওঠা নলে ফুঁ দিয়ে আবার কোমরে গুঁজে নিয়ে বলল, আমি ছাড়ব না। পাতাল থেকে হলেও খুঁজে বার করব ওদের। আমি রূপক চ্যাটার্জি। বলে চৌকির তলায় ঢুকে ওই ম্যানহোলের ঢাকনার মতো ওটা সরিয়ে সরসর করে নেমে গেল নীচে।
ওটা কী? জিজ্ঞাসা করল সায়ন্তন।
ওটা সুড়ঙ্গের মুখ। খুব ক্যাজুয়ালি উত্তর দিলেন অমরেন্দ্র।
আপনার ঘরে সুড়ঙ্গ!
কেন, হতে পারে না? বারণ রয়েছে নাকি?
না মানে…এই সুড়ঙ্গ কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে?
যেখানে খুশি। বার্মাতেও হতে পারে, নেপালে কিংবা বাংলাদেশেও হতে পারে…বলে সায়ন্তনের অসহায় মুখটার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে অমরেন্দ্র বললেন, মাই ফ্রেন্ড, এভরিথিং ইজ পসিবল ইন দ্য ওয়ার্ল্ড অফ পাল্প ফিকশন। বুয়েচ?
হুঁ…
পাল্প হল মানুষের স্বপ্ন, সাধারণ মানুষের ইচ্ছে। মানুষের স্বপ্ন তার জীবনের থেকেও বড়, সো পাল্প ইজ লার্জার দ্যান লাইফ, আমি সেটাই লিখেছি। তাই আমার বাজপাখি, আমার ড্রাগন বাস্তবের ভিলেনের থেকেও ক্রুর, চতুর, তাদের কিছুতেই ধরা যায় না। সারা দুনিয়ায় তার জাল বেছানো। সাধারণ মানুষ থেকে দেশের সরকার, সকলের কাছেই তারা মুর্তিমান যম। আর রূপক, তার চেহারা বেশভূষা একেবারে তোমার আমার মতো সাধারণ, ভিড়ের মধ্যে তাকে আলাদা করে চিনতে পারবে না, অন্যান্য ডিটেকটিভরা যেখানে কথা বলে বেশি সেখানে রূপকের কথা কম অ্যাকশন বেশি। কারণ দেশের মানুষ আর কথা চাইছিল না। রাষ্ট্রর কাছ থেকে কথা শুনতে শুনতে হাঁফিয়ে পড়েছিল পাবলিক। তারা খুঁজছিল এমন একজনকে যে কথা নয় কাজ করে দেখাবে। আমার রূপক সেটাই করেছিল। তাই দুহাতে পিস্তল চালাতে চালাতে তিনতলা থেকে পাইপ বেয়ে নামা যায় কি না। কলকাতার সুড়ঙ্গ বার্মাতে গিয়ে শেষ হতে পারে কি না, এসব ছেঁদো লজিক আমার রিডাররা কোনওদিন খোঁজেননি। ইনফ্যাক্ট খুঁজতে চাননি। তাদের দরকার ছিল কনফ্রন্টেশন, মুক্তি। আর আমি সেই মুক্তি দিয়েছিলাম তাদের।
সায়ন্তন দেখছিল এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলতে বলতে হাঁফাচ্ছিলেন অমরেন্দ্র। খক খক করে কাশতে শুরু করলেন।
জল খাবেন?
জল…ও জিনিস শালা মানুষে খায়! বাংলা চালু হওয়ার পর থেকে আমি কখনও জল খাইনি। আমার জল হল এটাই, বুঝলে? বলে বাংলা মদের বোতলটা তুলে ধরে দেখালেন অমরেন্দ্র। অবশ্য এই জল আমার সবকিছু খেয়েছে। সবকিছু…কিন্তু আমি একে ছাড়তে পারিনি। তখন কাঁচা বয়েস, হাতে টাকা আসতেই আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না, সব নেশা একে একে জুটতে থাকল। কেউ তো ছিল না বারণ করার মতো। আমি একা…পুরো একা। বাংলা মদের ঠেক থেকে রেসের মাঠও বাকি রইল না। হাতে টাকা তো থাকলই না উপরন্তু ধার-দেনা হতে শুরু করল। বুঝলাম আরও রোজগার বাড়াতে হবে, নইলে পাওনাদারের জ্বালায় মরে যাব। কৃষ্ণবাবুকে বললাম আমাকে আরও টাকা দিতে হবে নইলে লিখব না, ততদিনে আমার শ্রীতপনকুমার নামটাই বাজারে যথেষ্ট। কৃষ্ণবাবু আমাকে তুলেছেন বাজারে নামিয়েছেন, কিন্তু তবু তাঁকে কথাগুলো বলতে বাধ্য হয়েছিলাম আমি, তার একটা কারণ যেমন স্বেচ্ছাচারী জীবন অন্য কারণ ছিল আমি দিব্বি বুঝতে পারছিলাম আমার বইয়ের বাজারে যে পরিমানে কাটতি হচ্ছিল সেই তুলনায় আমার প্রাপ্য আমি পাচ্ছিলাম না। প্রকাশক আমাকে ঠকাচ্ছিলেন। একদিন কথা কাটাকাটি হয়ে গেল। কৃষ্ণবাবুকে মুখের ওপর বলে দিলাম আপনার প্রকাশনায় আমি আর লিখব না। কৃষ্ণবাবু বললেন, না লিখলে অন্য প্রকাশনায় আমি একমাসের বেশি টিকতে পারব না। আমি শেষ হয়ে যাব। চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে চলে এলাম। তখন আমার জন্য দেবকী সাহিত্য কুঠী অপেক্ষা করে বসে রয়েছে। নাম শুনেছ তো?
হ্যাঁ, খুব ভালো মতোই। বলল সায়ন্তন।
হ্যাঁ, ওখানে যোগাযোগ করলাম। তারপর ওখানে শুরু করলাম কালচক্র সিরিজ। বাজপাখি নয়, সেখানে এল হায়না আর প্যান্থার নামে দুই দস্যু। এমন কোনও অপরাধ নেই যা তারা করতে পারে না। দিন আর রাত সবই তাদের কাছে সমান। ভারতে ধনরত্ন চুরি করে নেপালে লুকিয়ে রেখে বার্মায় পালাচ্ছে এক বেলার মধ্যে। শালা তাই গপগপ করে বিশ্বাস করেছে আমার রিডার। কোনও শালা আঙুল তুলে কোশ্চেন করেনি কীভাবে গেল? বটতলা বলো, বটতলা পপুলার বলো, পপুলার যা খুশি বলো, কিন্তু তপনকুমার ইজ আ ব্র্যান্ড। শিষ্ট সাহিত্যের ঘরানাকে, মানুষের কলোনিয়াল আইডেন্টিটিকে, রেনেসাঁর শিক্ষা সংস্কৃতিকে আমি ভেঙে তছনছ করে দিয়েছি শালা। কোনও মাই কা লাল আমার একটা বালও ব্যাঁকাতে পারেনি।
ধেনো মদের ঘোরে কথাগুলো বলতে বলতে মুখে থুতু উঠে আসছিল অমরেন্দ্রর। যারা সাতজন্মেও বই পড়ত না—সেই ঠেলাওলা, রিকশাওলা, ফেরিওলাও যেমন মুখ গুঁজে বছরের পর বছর শ্রীতপনকুমার পড়েছে, তেমনই যারা এলিট সোসাইটি, বটতলা সাহিত্যের নাম শুনলে যাদের নাইতে হয়, তারাও ওই রাতের অন্ধকারে হাড়কাটা গলিতে ধাওয়া করার মতো লুকিয়ে কিনে নিয়ে যেত আমার কালরুদ্র সিরিজ। তারপর বাথরুমে কিংবা বেডরুমে মুখ থুবড়ে পড়ত, শশাল্লাহ! হ্যা হ্যা হ্যা…
আপনি বোধহয় কলকাতা ছেড়ে রামনগর না ওইদিকে কোথায় বাড়ি করেছিলেন শুনেছিলাম…
হ্যাঁ…হ্যাঁ করেছিলাম তো। বিয়ে করলাম রমাকে, তারপর কলকাতা ছেড়ে বেশ খানিকটা দূরে বাড়ি করলাম রামনগরে।
আপনার কাজের জায়গা কলকাতা আর ওই অতদূরে বাড়ি করলেন কেন?
সায়ন্তনের প্রশ্ন শুনে ম্লান হাসলেন অমরেন্দ্র। রমা…রমা…দুইবার নামটা উচ্চারণ করে একটা বিড়ি ধরালেন। কটূগন্ধে ভরে গেল ঘর।
আমার লাইফটা বুঝলে সায়ন্তন বেসিক্যালি খুব ওলটপালট। মানে আমার কাহিনির চরিত্রগুলোর মতোই বাঁধাধরা গতে বাঁধা জীবন আমিও কখনও পাইনি বুঝলে। লার্জার দ্যান লাইফ গল্প লিখতে লিখতে আমার নিজের জীবনটাও কবে যেন…বলতে বলতে চুপ করে গেলেন অমরেন্দ্র। মনে পড়ছে…মনে পড়ে যাচ্ছে বহু বছর আগের এক রাতের কথা…ভাবতে ভাবতে তিনি তাকালেন তার নোনাধরা দেওয়ালটার দিকে। আর সঙ্গে সঙ্গে সেই দেওয়ালে শুরু হয়ে গেল প্রাচীন আর এক চলচ্চিত্র।
অনেক রাত। উত্তর কলকাতার এক কুখ্যাত পতিতাপল্লি। ওই পল্লিরই মুখে একটি বাড়ির রকে চুপ করে বসে রয়েছে অমরেন্দ্র। ঠোঁটে সিগারেট জ্বলছে। কোলের ওপর ছোট একটি খাতা, ডানহাতে ডটপেন।
এই পল্লিতে মাঝেমাঝেই চলে আসে অমরেন্দ্র। লেখার অনেক রসদ এই পল্লি থেকেই পাওয়া যায়। বেশ কয়েকজন দালাল আর মাসির সঙ্গে বেশ সখ্য বানিয়ে নিয়েছে ও। শুধু তাই নয়, প্রকাশকের সাহায্য নিয়ে লোকাল পুলিশের সঙ্গেও দিব্বি একটা যোগাযোগ করে নিয়েছে। পৃথিবীর যেসব জায়গায় পতিতাপল্লি রয়েছে সেইসব অঞ্চলে ক্রাইমের পরিমাণও বেশি। তাই এখানে মাঝেমাঝেই সন্ধের পর চলে আসে। ঘণ্টা কয়েক চুপ করে বসে দেখতে থাকে এখানকার কার্যকলাপ। কত রকমের মানুষ যে আসে, যায়। নিজের চোখেই এখানে চুরি, ছিনতাই, খুন, বন্দুক, চাকু, সব দেখেছে অমরেন্দ্র। দেখতে দেখতে এখন অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। মুটে থেকে শেঠ, ডাকাত-গুন্ডা থেকে মন্ডাওলা সব শ্রেনির মানুষ এখানে সন্ধের পর মধুর লোভে ভিড় জমায়। বেল-জুঁইয়ের মালার গন্ধের সঙ্গে ঘুগনির, তেলেভাজার খুশবু মেশে হাওয়াতে। লেখার রসদ এখানে মুঠো-মুঠো।
পুলিশ টহল চলে মাঝেমাঝেই। পুলিশের সিপাই থেকে বড় কর্তা সকলেই স্বপনকুমার বলতে অজ্ঞান। অমরেন্দ্রকে তারা একটি পুলিশি হুইসল দিয়েছেন। সঙ্গে এটাও বলে দিয়েছেন, আপনি নিশ্চিন্তে যখন খুশি এখানে এসে লেখার মেটিরিয়াল নেবেন, হুইসলটা সঙ্গে রাখবেন, কোনও সমস্যায় পড়লে তিনবার বাজাবেন। কাছাকাছি আমাদের পাহারাদাররা কেউ না কেউ থাকবেই, গিয়ে হেল্প করে দিয়ে আসবে। এই আশ্বাস বড় আশ্বাস। বাঁশিটা শার্টের বুকপকেটেই রেখে দেয় অমরেন্দ্র। তবে এযাবত দরকার পড়েনি।
আজ সন্ধেবেলায় চলে এসেছে ও। পতিতাপল্লির অনেক বেশ্যাই অমরেন্দ্রকে চেনে, অনেকে ডাকে কলমবাবু। প্রথমদিকে খরিদ্দার বানানোর চেষ্টাও করেছিল, পরে তারা বুঝেছে এই ছেলে সেই ব্যাপারে একেবারেই নিরামিষ। তবে নারীসঙ্গে আগ্রহী না হলেও অল্প বয়েসে মদ, জুয়া, রেস সবই ধরে নিয়েছে ভালো মতো। আসলে জগতের যেসব জায়গাগুলোতে অন্ধকার, অপরাধপ্রবণতা, সেইসব জায়গা অমরেন্দ্রকে নিশির মতো টানে। তা বাংলা মদ কিংবা জুয়ার ঠেকই হোক, অথবা পতিতাপল্লি।
অমরেন্দ্র যে বাড়ির রকের কোণায় বসে থাকে সেটা খানিক ঘুপচি অন্ধকার মতো, পতিতাপল্লিতে প্রবেশের মুখে এই বাড়িটা। দীর্ঘকাল ধরে বাড়িটি পরিত্যক্ত।
অমরেন্দ্র সিগারেটে টান দিচ্ছিল আর মাঝে-মাঝে পকেট থেকে দিশি মদের একটা ছোট বোতল বার করে চুমুক দিছিল। সামনে শালপাতায় রাখা কাঁচা ছোলা আর পেঁয়াজের চাট।
বসন্তকালের রাত আটটা। মাঝেমাঝে ফুরফুরে মিষ্টি হাওয়া এসে ঢুকছে গলিতে। বেশ আরাম লাগছে। আচমকাই একটি মোটরগাড়ি এসে থামল গলির মুখে। তিনজন ষন্ডামার্কা লোক বেরিয়ে এল গাড়ি থেকে। চেহারা দেখেই বোঝা যায় কোন জগতের লোক এরা। মস মস করে তিনজনেই হেঁটে গেল গলি দিয়ে। ঠিক মিনিট দশেকের মধ্যেই অমরেন্দ্র দেখতে পেল একটি মেয়েকে তিনজনে মিলে টানতে টানতে নিয়ে আসছে। মেয়েটা নিজেকে ছাড়ানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে, কিন্তু ওদের সঙ্গে শারিরীক শক্তিতে পারা অসম্ভব।
এই দৃশ্যও অমরেন্দ্রর কাছে নতুন কিছু নয়। এই পল্লিতে নিয়মিত পাচার হওয়া মেয়ে আসে, তারপর এখান থেকে অন্যত্র সাপ্লাই হয়। আবার মেয়েদের ভাড়া করেও অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয় ফুর্তির জন্য। সব মেয়েই যে সুস্থ হয়ে ফেরে তারও ঠিক নেই। পরের দিন বা কয়েকদিন পর তার গলার নলিকাটা লাস গলির মুখে পড়ে থাকতে বা একেবারেই নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে। তবে এসবই এখানে স্বাভাবিক ঘটনা। খুব বেশি কেউ মাথা ঘামায় না।
মেয়েটা প্রাণপণে চিৎকার করছে, নিজেকের ছাড়ানোর জন্য আছাড়িপিছাড়ি করছে। ওকে প্রায় পাঁজাকোলা করেই গাড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছে সেই ষন্ডা তিনটে। অমরেন্দ্রর পাশ দিয়ে ওরা যাচ্ছিল যখন এক ঝলক মেয়েটাকে দেখতে পেল ও। মেয়েটাও ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল অমরেন্দ্রর দিকে। বড় করুণ সে তাকানো। নীরবে যেন বলতে চাইল, আমাকে বাঁচাও।
ওই করুণ, ভীত চোখদুটোর মুখোমুখি হয়ে বাংলার ধুনকিতে আচমকা কী যে হল, নিজেকে যেন নিজেরই রচিত রূপক চ্যাটার্জি মনে হল। উঠে দাঁড়াল অমরেন্দ্র। হন হন করে হেঁটে গেল ওদের দিকে। লোকগুলো ততক্ষণে মেয়েটাকে গাড়ির প্রায় সামনে নিয়ে চলে গিয়েছে, এবার ভেতরে ঢোকাবে। তার আগেই গড়ির দরজা গার্ড করে দাঁড়াল অমরেন্দ্র।
গুন্ডাগুলো খুব সামান্য থমকাল, তারপর মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বলল, চল, সর এখান থেকে।
মেয়েটাকে ছেড়ে দাও। কথাটা বলার সময় অমরেন্দ্র স্পষ্ট বুঝতে পারছিল ওর কণ্ঠ দিয়ে আসলে রূপক চ্যাটার্জি কথা বলছে। অকুতোভয় প্রাইভেট ডিটেকটিভ যে পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে যে কোনও সময় পৌঁছে যেতে পারে। বিশ্বের সবথেকে বড় ত্রাস—বাজপাখি, ড্রাগনও যার নাম শুনলে ভয় পায়, সেই রূপক চ্যাটার্জি।
কী হল কী, সর সামনে থেকে। গায়ে ধাক্কা দিল একটা গুন্ডা।
সেই ধাক্কায় টলে গেল অমরেন্দ্র। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল। মেয়েটাকে এখনই ছেড়ে দাও। নইলে ফল ভালো হবে না।
তাই নাকি? অমরেন্দ্রর রোগা চেহারাটার দিকে তাকিয়ে খ্যাল খ্যাল করে হেসে উঠল একজন। এই তুই কে রে? মরতে চাস নাকি?
আমি কে সেটা এখনই বুঝবে। বলে আচমকাই এক ঘুসি চালাল অমরেন্দ্র। ঘুসি আদৌ কারও গায়ে লাগল না, কিন্তু পালটা এক ঘুসি খেয়ে রাস্তায় ছিটকে পড়ল। লোকগুলো অমরেন্দ্রর জন্য সময় নষ্ট করতে রাজি নয়। গাড়ির দরজা খুলল। হঠাৎই বিদ্যুৎচমকের মতো বুদ্ধি খেলে গেল মাথায়। বুকপকেটে রাখা পুলিশি হুইসেলটা বার করে প্রাণপণে ফুঁ দিতে শুরু করল অমরেন্দ্র।
থমকে গেল লোকগুলো। একজন বলে উঠল, এই শালা পুলিশ রে!
গাড়ি ততক্ষণে স্টার্ট নিয়ে নিয়েছে। মেয়েটাকে যে দুজন চেপে ধরেছিল তারাও হতভম্ব হয়ে ছেড়ে দিয়েছে। গাড়ির ড্রাইভার তাড়া দিল। জলদি আও। ভাগনা হ্যায়।
বাকি দুজনও দ্রুত গাড়িতে উঠে পড়ল। একজন জিজ্ঞাসা করল মেয়েটাকে?
ছেড়ে দে, রাস্তায় ঝামেলা করবে।
ততক্ষণে অমরেন্দ্রর হুইসেল শুনে অন্যপ্রান্ত থেকে পুলিশের পাহারাদারের হুইসেলে উত্তর এসে গিয়েছে। মানে পুলিশ এসে পড়বে। মেয়েটিকে ছেড়ে বাকি লোকটাও গাড়িতে উঠে পড়ল। ওঠার আগে অবশ্য অমরেন্দ্রর পেটে টেনে এক লাথি কষাল শিকার ফস্কে যাওয়ার প্রবল আক্রোশে।
আঁ-ক করে শব্দ করে উঠল অমরেন্দ্র। গাড়িটা চলে গেল।
ততক্ষণে রুস্তম চলে এসেছে অমরেন্দ্রর কাছে। রুস্তম এই বেশ্যাপট্টিরই একজন দালাল। অমরেন্দ্রর সঙ্গে বেশ খাতির। রুস্তমের মারফত এই পল্লির অনেক গোপন খবর অমরেন্দ্রর কাছে পৌঁছয় যা লেখার কাজে লাগে।
ভাই ইয়ে কেয়া কিয়া তুমনে? প্রায় আর্তনাদ করে উঠল রুস্তম। পাতা হ্যায় উয়ো কৌন থা? শাকিল ওস্তাদ…জানতে হো না শাকিল কো?
হুঁশ ফিরল অমরেন্দ্রর। হ্যাঁ মনে পড়েছে, কলকাতার অন্যতম ত্রাস এই শাকিল ওস্তাদ। এমন কোনও অপরাধ নেই যা সে করে না। বিশাল গ্যাং।
হতভম্বের মতো রুস্তমের দিকে তাকিয়ে রইল অমরেন্দ্র। কী করবে কিছু বুঝতে পারছে না। মেয়েটিও বলির পাঁঠার মতো থরথর করে কাঁপছে।
তুরন্ত অভি ইঁহা সে নিকল যাও ভাই। কলকাত্তা সে ভাগো, নেহি তো কাল সুবাহ তক জিন্দা নেহি রহোগে। ইয়ে লড়কি ভি খতম হো জায়গি।
একটা খালি ট্যাক্সি যাচ্ছিল, হাত বাড়িয়ে সেটাকে থামাল রুস্তম। তারপর নিচু গলায় বলল, চলিয়ে, তুরন্ত ভাগিয়ে।
দরজা খুলে ট্যাক্সিতে উঠতে গিয়েও অমরেন্দ্র থমকে দাঁড়াল, রুস্তমকে জিজ্ঞাসা করল, ওর কী হবে?
কেয়া হোগা…বলে এক সেকেন্ড ভেবে নিয়ে রুস্তম বলল, উসকো সাথ লেকর যাইয়ে, রাস্তেমে কঁহি ছোড় দে না। বলেই মেয়েটিকে এক ধমক দিয়ে বলল, আরে খড়ি খড়ি কেয়া তমাশা দেখ রহি হ্যায়, চল অন্দর ঘুস।
রুস্তমের ধমকে ট্যক্সিতে ঢুকে বসল মেয়েটি। রুস্তম ট্যাক্সির ভেতর গলা ঢুকিয়ে অমরেন্দ্রর কানে ফিসফিস করে বলল, গাড়িতে কোনও আলোচনা করবেন না, ট্যাক্সিওলাদের সঙ্গেও শাকিলভাইয়ের যোগাযোগ রয়েছে। আর যদি এখন বাড়িতে যান তাহলে বাড়ির সামনে ট্যাক্সি দাঁড় করাবেন না। একটু দূরে ছাড়বেন, আর মেয়েছেলেটাকে রাস্তায় কোথাও ছেড়ে দেবেন, নইলে নিজেই মরবেন। এইসব চক্করে পড়বেন না। যান
হড়হড় করে কথাগুলো বলে সেখান থেকে সরে গেল রুস্তম। ট্যাক্সিওলা জিজ্ঞাসা করল কাঁহা যায়েঙ্গে?
চলিয়ে শিয়ালদা স্টেশন।
ট্যাক্সিটা রাতের অন্ধকারে রওনা হয়ে গেল।
খুক খুক করে আপনমনে হেসে উঠলেন অমরেন্দ্র। আর সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেল সাদাকালো ঝাপসা সিনেমাটা। সে রাত্রে কী যে ভর করেছিল আমার মাথায় আমি নিজেও জানি না…ওই হারামজাদা রূপকটা, আমার জীবনটাকে দুম করে বদলে দিল। কী থেকে যে কী হইয়া গেল বোঝা গেল না, আমার হাতে রমা আসিয়া গেল হা হা হা!
রসধর দত্তর সেই বিখ্যাত লাইনটা বলে আপনমনে হাসতে থাকলেন অমরেন্দ্র।
সায়ন্তনের কৌতূহল তখন তুঙ্গে। জিজ্ঞাসা করল, কী করলেন তারপর?
কী করলাম? শিয়ালদা স্টেশনে যখন ট্যাক্সিটা আমাদের নামাল আমি মেয়েটাকে জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি ট্রেন চেপে কোথাও পালাও।
মেয়েটা বলল, কোথায় যাব। আমি বললাম, তোমার বাড়ি। সে বলল তার বাড়ি বরিশালের শিকারপুর। সেখান থেকে পাচার করে আনা হয়েছে। কীভাবে বাড়ি ফিরবে জানে না। বললাম ট্রেনে তুলে দিচ্ছি। কিছু টাকাও হাতে দিয়ে দিচ্ছি। বনগাঁ যাওয়ার ট্রেনে চেপে পড়ো।
মেয়েটি রাজি হল না, বলল বাড়িতে তার আর ঢোকার উপায় নেই। গ্রামেই ঢুকতে পারবে না। হয় মেরে ফেলবে কিংবা তাড়িয়ে দেবে।
আমি কী করব বুঝতে পারছি না, একবার ভাবলাম মেয়েটাকে এখানে ফেলে রেখে পালাই। এসব ঝঞ্ঝাট কে নেবে? ওর হাতে সামান্য কটা টাকা ধরিয়ে দিয়ে বললাম, তুমি এখানে একটু দাঁড়াও, আমি আসছি। মেয়েটা আমার হাত ধরে ভয়ে বলে উঠল, কোথায় যাবেন?
এই একটু মানে খাবার কিনতে…
আমিও যাই।
না, তুমি দাঁড়াও। গলিটা ভালো নয়। বলে হাত ছাড়িয়ে স্টেশনের পাশের গলিতে সুট করে ঢুকে পড়লাম।
ওই গলি দিয়ে আরও কিছুটা গেলেই আমার ঘর, তখন ওইখানে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকি। বেশ কিছুটা চলেও গেলাম নিজের ঘরের দিকে। রাতের খাবারটাও কিনে ফেললাম। ঘরে পৌঁছে দরজার তালা খুলতে যাব, মনে হল মেয়েটা কি এখনও অপেক্ষা করে রয়েছে? আমি ফিরব এই আশা করে কি সারা রাত দাঁড়িয়ে থাকবে ওখানে? বিশ্বাস করো ভাই সায়ন্তন, আমার এই হৃদয় চিরকালই পাথুরে। প্রেম ভালোবাসা ওসব আমার সাতজন্মে আসেনি। কিন্তু সেদিন ঘরে ঢুকতে গিয়েও পারিনি, বেরিয়ে এসেছিলাম। আবার স্টেশনে গিয়ে দেখি মেয়েটা ঠিক ওখানে, ওইভাবেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। কী করব বুঝতে না পেরে নিয়ে এলাম আমার ঘরে। রুটি তরকারি খেয়ে আমি শুলাম আমার চৌকিতে আর মেয়েটাকে মেঝেতে একটা চাটাই পেতে দিলাম। সারা রাত চিন্তায় ঘুম হল না আমার।
ভোর রাতে উঠে পড়ে নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে ফেলে রমাকে, মানে মেয়েটিকে নিয়ে রওনা দিলাম স্টেশনে। একেবারে ফার্স্ট ট্রেনে চেপে বসলাম। কোথায় যাব জানি না, কী করব, কোথায় থাকব কিছুই জানি না। শুধু রমার অসহায় চোখদুটো আমাকে কষ্ট দিচ্ছিল।
আপনি তার মানে প্রেমে পড়েছিলেন, লাভ অ্যাট ফার্স সাইট।
প্রেম-ফ্রেম আমার কোনওকালেই আসেনি ভাই। অন্য সবকিছুর নেশা থাকলেও মেয়েছেলের নেশা কোনওকালেই ছিল না। বিয়ে-থা যে করব সেটাও ভাবিনি, উটকো ঝামেলা মনে হতো। স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, তাই…কিন্তু ট্রেনটা ভোর রাতে শিয়ালদা স্টেশন যখন ছেড়ে দিল, কম্পার্টমেন্টে মাত্র জনাকয়েক প্যাসেঞ্জার, আর আমার প্রত্যককে দেখেই মনে হচ্ছিল শাকিল ওস্তাদের লোক। ট্রেন চলছিল। চলতে চলতে একটা সময়ে যখন মনে হল শহরের বিপদ থেকে অনেকটা নিরাপদ দূরত্বে চলে এসেছি, রমা আর আমার তল্পিতল্পা নিয়ে নেমে পড়লাম একটা স্টেশনে। স্টেশনের নাম রামনগর। ততক্ষণে আমি রমার জীবনের গল্পটা শুনে নিয়েছি আর বাকি সিদ্ধান্তটাও নিয়ে ফেলেছি। তারপর কত কিছু…কত কিছু…গলা নামিয়ে কথাটা বললেন অমরেন্দ্র। যেন নিজেকেই বললেন।
সায়ন্তন বুঝল স্মৃতির গভীরে ডুব দিয়েছেন অমরেন্দ্র। কণ্ঠস্বর খাদে নামতে নামতে ফিসফিস, তারপর পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে গেল। ঘর চুপচাপ। মাথা ঝুঁকে গেল অমরেন্দ্রর।
আচমকাই মুখ তুলে ফোঁস করে উঠলেন আবার, জানো, আমি কিন্তু বিয়ের আগে বা পরেও কখনও একবারের জন্যও প্রশ্ন করিনি রমাকে যে তোমাকে কি কোনও পুরুষ কখনও ছুঁয়েছে, তুমি কখনও কিছু করেছ? কাউকে ভালোবেসেছ? তোমার বাড়ির লোকজন কেমন…নাহ কিচ্ছু না। আমি শুধু রমার ওই করুণ চোখদুটোর মায়ায় পড়ে গেছিলাম। ওই অসহায়, ওই বাঁচতে চাওয়া, আশ্রয় চাওয়া চোখদুটি…আমাকে বাধ্য করেছিল…কিন্তু আমার কপালে যে সংসার, আটপৌরে জীবন এসব নেই। একটা বাড়ি ভাড়াও পেয়ে গিয়েছিলাম দিব্বি। তখন তো আর এখনকার মতো বাড়ি ভাড়া পেতে হলে দুনিয়ার প্রমাণপত্র দেখাতে হতো না। ভাড়াটা দিতে পারলেই মালিক খুশি।
দিব্বি চলছিল জানো সংসারটা। ওই রামনগর থেকে কলকাতায় যাতায়াত করতাম। ততদিনে দুটো পেট, বাড়ি ভাড়া, সংসারের খরচ ইত্যাদি তুলতে আমার প্রায় নাভিশ্বাস। আমার বই বিক্রি হতো প্রচুর, সেটা আমিও জানতাম কিন্তু টাকা তো বেশি পেতাম না, আর যাও বা পেতাম তার বেশ অনেকটাই খরচ করে ফেলতাম মদে, জুয়ায় আর ধার শোধ করতে। মেয়েরা জানো তো সংসার করলে খুব গুছিয়ে করতে চায়। আমারই দোষ ছিল। হ্যাঁ, আমারই। আমি মদ ছাড়তে পারছিলাম না, জুয়াও না। ফলে সংসারে টাকা জোটাতে পারছিলাম না। তবু আরও রোজগারের চেষ্টা করতাম। বহুদিন এমনও গেছে শিয়ালদা স্টেশনে বসে সারা রাত লিখে পরের দিন প্রকাশককে লেখা জমা দিয়ে টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরেছি। কিন্তু এভাবে আর হচ্ছিল না। আমার শরীর ভেঙে যাচ্ছিল অতিরিক্ত পরিশ্রমে। মেজাজও ঠিক রাখতে পারছিলাম না। ফলে বছর ঘুরতেই শুরু হল অশান্তি। বাড়তে বাড়তে অশান্তি তুঙ্গে।
একদিন…একদিন রমা বলল আমার সঙ্গে আর থাকা সম্ভব নয়, সে চলে যেতে চায়। বিশ্বাস করো আমি চাইনি ও চলে যাক, কিন্তু চলেই গেল মেয়েটা। একদিন আমাকে কিছু না জানিয়েই চলে গেল। ঘরটা পুরো ফাঁকা হয়ে গেল আমার। দেড় বছরের সংসার খেলা শেষ। বলে হাসতে গেলেন অমরেন্দ্র। পারলেন না, মুখটা বিকৃত হয়ে উঠল।
আমি কিন্তু আপনাকে বলেছিলাম স্বর্গ হোক বা পাতাল, আপনি আদেশ করলে আমি ঠিক খুঁজে বার করে নিয়ে আসতাম। জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকে এসে বলল বাজপাখি।
ড্রাগনও ঘরে এল ওই একইভাবে। আপনি রাজি হলেন না, একবার শুধু বলে দেখতেন।
চৌকির তলার সেই ম্যানহোলের ঢাকনা সরিয়ে শেষে বেরিয়ে এল রূপক চ্যাটার্জি। তুমি ভুল করছ ড্রাগন, তুমি ভুল বলছ বাজপাখি, আমি সেদিনও বলেছিলাম আজও বলছি, আমাদের পিতা ঈশ্বর, তিনি সৃষ্টিকর্তা, তাঁকে আজীবন একাই থাকতে হয়, এটাই নিয়ম। রমাদেবীকে আমিও চাইলে খুঁজে বার করে নিয়ে আসতে পারতাম, কারণ আমি জানতাম তিনি কোথায় রয়েছেন।
তুমি জানতে!
ইয়েস। ডিটেকটিভ রূপক চ্যাটার্জি পৃথিবীর যেকোনও কর্নার থেকে অপরাধীকে খুঁজে বার করতে পারে তা সে বাজপাখি হোক কিংবা রমাদেবী। কথাটা বলেই সায়ন্তনের দিকে তাকাল রূপক। আপনি ভাবছেন রমাদেবীকে কেন অপরাধী বলছি? বলেই নিজের মুখটা সায়ন্তনের কানের সামনে এনে ফিসফিস করে বলল, আসলে উনি জানেন না যে তার প্রিয় স্ত্রী ওই রামনগরেরই এক পুরুষের সঙ্গে ফস্টিনস্টি করে তার সঙ্গে ভেগেছিলেন, উনি যখন আমাদের নিয়ে লেখার জন্য রাতের পর রাত শিয়ালদা স্টেশনে বসে কাটিয়েছেন, হাতে ভাত-রুটি খাবার পয়সাটাও এক-এক সময় থাকত না বলে বাজার থেকে সস্তায় টম্যাটো কিনে তাই খেয়ে লিখে গিয়েছেন আমাদের নিয়ে কাহিনি, তখন রামনগরের ওই ভাড়া বাড়ির বিছানায় রমাদেবী একলা শুতেন না।
শুয়োরের বাচ্চা, দূর হয়ে যা আমার সামনে থেকে। বলে মদের গেলাসটা ছুড়ে মারলেন অমরেন্দ্র।
রূপক সরে গেল। স্টিলের গেলাসটা দেওয়ালে লেগে ঠং শব্দ করে মেঝেতে ছিটকে পড়ে গড়াতে থাকল। বাজপাখি ওটাকে তুলে নিজের কালো ওড়না দিয়ে যত্ন করে মুছে আবার রাখল তার পিতৃদেবের সামনে।
সায়ন্তন বুঝতে চেষ্টা করছিল ওর সামনে বসে থাকা অসহায় একা মানুষটিকে, যে তার ছেলে মেয়েদের নিয়ে বাঁচে…হয়তো…হয়তো…
রমা আমাকে বলত অপদার্থ। কিন্তু আমার লেখা পড়তে ভালোবাসত। যতদিন ছিল একটা লেখাও বাদ দেয়নি। শুধু ওই কলকাতার এলিটদের মতো মনে করত আমি আসলে থার্ড গ্রেডেড লেখক। কারণ আমার নাম কেউ জানত না যে। কিন্তু ওই হিপোক্রিট এলিট সোসাইটি, যারা আমাকে সামাজিকভাবে বয়কট করলেও আড়ালে আমার বইয়ে মুখ গুঁজে রাখত, যেভাবে হ্যাংলা বেটাছেলেরা মেয়েদের বুকে মুখ গুঁজতে চায়, ঠিক তেমনই ছিল রমা। আমাকে মাঝেমাঝে বলত, তুমি কেমন লেখক কেউ তোমার নাম জানে না…তুমি নামী সাহিত্যিকদের মতো লেখো না কেন? হা হা হা নামী…নাম আমি কোনওদিন চাইনি, বুঝলে হে সায়ন্তন। নামকে আমি ঘৃণা করি।
সায়ন্তন দেখল অমরেন্দ্র আবার সেই নামের দিকে ঘুরছেন, আবার সুযোগটা নিল ও। বলল, আমার মনে সত্যিই একটা প্রশ্ন বারবার এসেছে যে একমাত্র রূপক চ্যাটার্জি ছাড়া আপনি আপনার সকল চরিত্রে ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন, ড্রাগন, কালনাগিনী, বাজপাখি এমনকী আপনার নিজের নামটা অমরেন্দ্রনাথ পান্ডে কখনও ব্যবহার করেননি। কেন?
করিনি…মানে মনে হয়েছিল না করলেও হয়। আর ছদ্মনাম তো শুধু আমি একা নয়, রবিঠাকুর, বঙ্কিম চাটুজ্জে থেকে শরৎবাবু সকলেই করেছেন। আমি একা নই।
হ্যাঁ, কিন্তু তারা স্বনামেই লিখেছেন বেশি। আর আপনি চিরকাল শুধু আড়ালেই থাকলেন নামেও, রূপেও। শুধু শ্রীতপনকুমার নয়, পরে যেসব বইগুলো লিখেছিলেন সেগুলোতেও।
হ্যাঁ, আমি আড়াল চেয়েছি। কারণ আমি আড়ালে থাকতে ভালোবাসতাম। চেয়েছিলাম ডাক্তার হতে, ডক্টর অমরেন্দ্রনাথ পান্ডে নামের রাইটিং প্যাডে প্রেসক্রিপশন লেখার স্বপ্ন ছিল আমার। স্বপ্ন ছিল নামী সাহিত্যিক হওয়ার। জীবন আমাকে সেই সুযোগ দেয়নি। না ডাক্তার হতে পারলাম, না পারলাম সাহিত্যিক হতে। বাট আই হ্যাড কোয়ালিটি। এবং সেটা আমি প্রমাণ করেছি। বিখ্যাত লেখক সুবিমল মিত্রের নামে এই আমি বই লিখেছি—মুদ্রা দিয়ে কিনলাম। সেই বইও মার্কেটে হু হু করে বিক্রি হয়েছে। কেউ শালা আঙুল তুলে বলতে পারেনি, এটা সোনা দিয়ে কিনলাম বইয়ের লেখকের লেখা নয়। বিধায়ক চট্টোপাধ্যায়ের নামে নাটকের বই লিখেছি, কেউ বোঝেনি। ডাঃ এ এন পান্ডের নামে যে সেক্স গাইডের বইগুলো, মেডিকেল বইগুলো লিখেছি, সেগুলো তখনও যেমন বিক্রি হয়েছে, আজও হয়। আমি জানি আজও আমার লেখা বিক্রি হয়। কিন্তু নিজেকে আড়ালেই রেখেছি, কারণ জীবন চেয়েছিল আমি অন্ধকারেই থাকি। প্রথমদিকে সত্যিই মনে মনে ছটফট করতাম, তারপর একটা সময়ের পর আলো আর চোখে সইত না, ইচ্ছে করত না আলোর সামনে দাঁড়াতে।
শুধু ডাক্তারি বই নয় আপনার চাষবাস, পশুপালন, হাঁস-মুরগির পোলট্রি খোলার পদ্ধতি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং এর বইগুলোতেও সেই একই এ এন পান্ডে। আপনার পুরো নাম আমি কোথাও পাইনি। কেন? অমরেন্দ্রনাথ পান্ডে কি এতটাই আড়ালের যোগ্য? নিজেকে এতটাই ব্রাত্য করে রাখার ইচ্ছে কেন আপনার?
শুনে হাসলেন অমরেন্দ্র। অনেক খোঁজই নিয়ে এসেছ দেখছি। তা তোমার কী মনে হয়, কেন আমি নিজের নাম কোথাও ব্যবহার করিনি?
বলব? যদি ভরসা দেন তাহলে বলতে পারি।
বলো শুনি।
আপনি আসলে নিজের ওপর শোধ তুলতে চেয়েছেন চিরকাল। আত্মবিস্মৃতি চেয়েছেন। বলুন, ঠিক কি না?
আত্মবিস্মৃতি! হা হা হা করে হেসে উঠলেন অমরেন্দ্র। যে মানুষটার কোনও অস্তিত্বই নেই তার আবার বিস্মৃতি কীসের হে ছোকরা? অমরেন্দ্রনাথ পান্ডে আসলে একটা মিথ। একটা ব্র্যান্ড, একটা সময়ের চাহিদামাত্র। যার বাস্তবে কোনও অস্তিত্বই নেই।
বেশ, তাই যদি হয় তাহলে আচার্য ভৃগু নিশ্চয়ই রয়েছে।
সায়ন্তনের কথায় থমকে গেলেন অমরেন্দ্র। চুপ করে রইলেন।
ভুল বললাম কী? বলে সায়ন্তন রূপকের দিকে তাকিয়ে বলল, রূপক স্যর, আপনাদের ওই স্পেশাল প্রোজেক্টরটা কি একবার চালাবেন? একটু ডিটেলে দেখতাম।
রূপক একবার তাকাল তার পিতৃদেবের দিকে তারপর ডানহাতের তর্জনিটা সামান্য দেওয়ালের দিকে উঁচু করে ধরতেই শুরু হয়ে গেল ছায়াছবি। তবে পিকচার কোয়ালিটি আগের থেকে কিছুটা স্পষ্ট।
শ্রীরাধা প্রকাশনার প্রকাশক রাধেশ্যামবাবুর ঘরে দুপুর একটা থেকে বসে রয়েছেন অমরেন্দ্র। কারণ একটাই, কিছু টাকা প্রয়োজন। ততদিনে তার দুশোর ওপর বই, প্রতিটি বইয়ের বিক্রি হাজারে হাজারে কিংবা লাখে লাখে। বিশেষ করে ‘কলেজ স্টুডেন্টদের জন্য’ এই লোগো দেওয়া ওয়ার্ল্ড ক্রাইম সিরিজের প্রায় একশোটি বই তো বাঙালির ঘরে ঘরে। এক একটি বই প্রকাশিত হয়ে দোকান পর্যন্তও পৌঁছতে পারেনি। তার আগেই সব বিক্রি।
কিন্তু এতগুলো বছর পর বছর দুয়েক হল বিক্রির জোয়ারে কেমন যেন ভাঁটা টের পাচ্ছেন অমরেন্দ্র। যে প্রকাশকরা কয়েকবছর আগেও টাকা দেওয়ার ব্যপারে ঠকালেও খাতিরদারিতে কোনও কার্পণ্য করতেন না, তারাই ইদানীং যেন একটু উলটো সুর গাইছেন। আর আগের মতো মানুষের চুড়ান্ত আগ্রহ যেন আর নেই শ্রীতপনকুমারে। অমরেন্দ্র টের পান সময়টা বদলাচ্ছে। প্রায় তিরিশ বছর ধরে যে সাম্রাজ্য তিনি একা চালিয়েছেন, যে প্রাসাদ তিনি গড়ে তুলেছিলেন তার বিভিন্ন জায়গা থেকে যেন চুন-সুরকি খসে পড়ছে। রুচি বদলাচ্ছে জনগণের। আর বেশিদিন নেই। মাঝে কিছুদিনের জন্য বম্বেও গিয়েছিলেন, যদি ছবির স্ক্রিপ্ট, কাহিনি ইত্যাদি লিখে রোজগার করা যায়, কিন্তু ভাগ্যে শিকে ছেঁড়েনি। ফিরে আসতে হয়েছে খালি হাতে।
তবু টাকা নেই…টাকা চাই হাতে। যদি প্রকাশক দয়া করে কিছু হাতে দেয় তাহলেই আগামীকাল কিছু পেটে জুটবে নইলে আজই শেষ খাওয়া। ঘরে ঢোকার উপায় নেই, পাওনাদারের হুমকি আর সহ্য হয় না। তাই কখনও রেলস্টেশনের ওয়েটিংরুমে বসে রাত কাটে, আর দিনের বেলায় বটতলা অঞ্চলের অলিগলিতে। আজ সকাল থেকে তার সব প্রকাশকের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন কিছু প্রাপ্য টাকা পাবার আশায়। কেউ দেয়নি। কেউ বলেছেন আজ অসুবিধা, কেউ বলেছেন সামনের সপ্তাহে আসুন, কেউ আবার বাজার খুব খারাপের দোহাই দিয়েছেন। শুধু রাধেশ্যামবাবু বললেন, বসুন, দেখছি কিছু ব্যবস্থা করা যায় কি না।
প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে টাকাপয়সার হিসেব নিয়ে আলোচনা চলছে রাধেশ্যামবাবুর। লোকটার সাজপোশাক অদ্ভুত। কপালে লম্বা সিঁদুরের টিপ। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। গেরুয়া পাঞ্জাবি। দুই হাতের আঙুলে বেশ কয়েকটা পাথর বসানো আঙটি।
অধৈর্য হয়ে উঠেছেন অমরেন্দ্র। এক এক সময় মনে হয় তিনি আসলে লেখক নন, একজন ভিখিরি। প্রকাশকের যদি দয়া হয় তবেই ভিক্ষাবাবদ কিছু পাবেন। আলোচনা চলছে তো চলছেই যেন অনন্তকাল ধরে চলবে।
একটা সময়ের পর আর তিনি ধৈর্য রাখতে পারলেন না। উঠে এসে বললেন, দাদা আমাকে এবার ছেড়ে দিন, বিশেষ দরকার।
রাধেশ্যামবাবু বেশ বিরক্ত হয়েই বললেন, আরে দাঁড়ান মশাই, লেখককে আগে ছাড়ি তারপর আপনাকে ছাড়ব। বসুন চুপ করে।
লেখককে মানে? আমিও তো লেখক। বলে উঠলেন অমরেন্দ্র।
শুনে রাধেশ্যাম আর সেই লোকটি দু’জনেই হেসে উঠলেন।
আপনি বসুন তো চুপ করে, আমি ডাকছি।
পেটে ক্ষিদে চোঁ চোঁ করছে। তার ওপরে ঘরে ফেরার জো নেই, পাওনাদার পাহারা দিয়ে বসে। সকাল থেকে টাকার জন্য প্রকাশকের দ্বারে দ্বারে ঘুরে মেজাজ তিরিক্ষি হয়েই ছিল। আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না, বেশ কড়া গলাতেই বলে উঠলেন, চুপ করেই তো বসেছিলাম। আমি আমার প্রাপ্য টাকা নিতেই এসেছি রাধেবাবু। ভিক্ষে নিতে নয়।
থামুন মশাই। আপনার বই বেচে ক’টা টাকাই বা ঘরে ঢোকে। যা এককালে করেছেন তা হয়ে গেছে। এখন আর আপনার বইয়ের কাটতি নেই। টাকা দরকার, বসুন, দেখছি। বলে আবার ওই লোকটির সঙ্গে কথায় ব্যস্ত হয়ে পড়ছিলেন তিনি, অমরেন্দ্রকে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাধেবাবু বললেন, অমরবাবু, ইনি জ্যোতিষী। জ্যোতিষের বই লেখেন। অনেক কঠিন ব্যাপার। বুঝেছেন। এ আপনার ড্রাগন সিরিজের ছেলেমানুষি নয়।
রাধেবাবুর কথাগুলো গরম শিকের মতো গেঁথে গেল যেন অমরেন্দ্রর গোটা শরীরে। যে সিরিজের লেখা, বছরের পর বছর এইসব প্রকাশকদের হাজার হাজার টাকা লাভের মুখ দেখিয়েছে আজ সেগুলো ছেলেমানুষি হয়ে গেল। সব মিথ্যে হয়ে গেল। বাজপাখি কিংবা কালনাগিনী অথবা বিশ্ব অপরাধচক্রের কাহিনি লেখা কি এতই সস্তা? জ্যোতিষের বই লেখার থেকেও সোজা!
অপমানে মাথা নীচু করে বেড়িয়ে যাচ্ছিলেন অমরেন্দ্র।
কী হল মশাই টাকা নেবেন বললেন যে।
উত্তর দিলেন না অমরেন্দ্র। রাস্তায় নেমে এলেন। অপমানের মুখোমুখি তিনি আজ জীবনে প্রথম হলেন না। দারিদ্র আর অসম্মান এই দুটিকে পাঞ্জাবির দুই পকেটে নিয়েই ঘুরেছেন এতকাল, কিন্তু তাঁর মনে আজ অন্য একটা ধাক্কা এল।
ঈশ্বর অমরেন্দ্রকে অর্থ, যশ, সৌভাগ্য, সংসার কিছুই দেননি, শুধু দিয়েছেন ভয়ংকর একটি গুণ, তা হল জেদ। অদম্য এক জেদ আর অফুরন্ত পরিশ্রমের ক্ষমতা। পথের ধারে বসে দুই-একদিনের মধ্যে লিখে ফেলতে পারেন সহজে ট্রানজিস্টার বানানোর পদ্ধতি কিংবা হারমোনিয়াম সারানোর টিউটোরিয়াল বই। একইসঙ্গে রূপক চ্যাটার্জি তখন সমুদ্রের তলায় সুড়ঙ্গে ঢুকে বাজপাখির সঙ্গে টক্কর নিচ্ছে, একইসঙ্গে তখন লিখেছেন গৃহপালিত পশুর প্রাথমিক চিকিৎসাপদ্ধতি।
টাকার অভাবে একদিন ডাক্তারি পড়া ছেড়ে দিতে হয়েছিল বলে লিখতে এসেছিলেন অর্থ রোজগারের জন্য, কিন্ত স্বপ্নকে নষ্ট হতে দেননি। দীর্ঘ পনেরো বছর পর হাতে কিছু টাকা যখন জমেছে তখন লেখালেখির চুড়ান্ত ব্যস্ততার মধ্যেও আবার পড়েছেন ডাক্তারি। স্বপ্নের এমবিবিএস ডিগ্রিও হাসিল করেছেন। গ্রামের বাড়িতে আর চিকিৎসা করতে যাওয়ার সুযোগ না হলেও, শিয়ালদা বাজারের যে গলিতে একটি গুমটি ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতেন, সেই ঘরেরই দরজায় সাইনবোর্ড লাগিয়েছেন—ডাঃ অমরেন্দ্রনাথ পান্ডে, এমবিবিএস। নীচে লেখা—দাতব্য চিকিৎসালয়। মুটে মজুর থেকে ভ্যানরিকশাওলা কিংবা মধ্যবিত্ত পরিবার সকলেই নিশ্চিন্তে এসেছে, সেই অবারিত দ্বারে। চুড়ান্ত অভাবেও জীবনে একটি টাকাও কখনও কোনও রুগির কাছ থেকে হাত পেতে নেননি অমরেন্দ্র। গরিবমানুষের কাছে পান্ডে ডাক্তার ভগবানের আরেক নাম। জীবনে অন্তত একটি স্বপ্ন পূরণ হয়েছে, এই আনন্দের গায়ে পরম যত্নে হাত বুলিয়েছেন একাকী।
আজ রাস্তায় নেমে কড়া রোদের নিচে দাঁড়িয়ে অমরেন্দ্র তার প্রৌঢ় বয়েসে আবার একটি চ্যালেঞ্জ নিয়ে ফেললেন।
বুঝলে সায়ন্তন, একজন ডাক্তার যেভাবে এক্সপেরিমেন্ট করে আমিও আমার জীবনটাকে নিয়ে শুধু এক্সপেরিমেন্ট করে গেছি। আমি কী পারি, কতটা পারি, জীবনকে শুধু এই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছি বারবার। ওই দুপুরবেলায় ক্ষিদেপেটে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমি প্রতিজ্ঞা করে ফেললাম, আমিও জ্যোতিষের বই লিখে বেস্টসেলার হয়ে দেখিয়ে দেব। অমরেন্দ্রনাথ পান্ডে পৃথিবীর সব বিষয় নিয়ে বই লিখতে পারে, তার সেই ক্ষমতা রয়েছে। তার ইতিহাসে নাম তোলারও কোনও মোহ নেই, কিন্তু চ্যালেঞ্জ জেতার তীব্র জেদ রয়েছে। আর সেই জেদের বশেই শুরু করে দিলাম জ্যোতিষচর্চা। তখন আমার মাথাজোড়া টাক, চেহারা ভেঙে গিয়েছে। শোভাবাজারের এক জ্যোতিষার্ণবের কাছে শিষ্যত্ব গ্রহণ করলাম, আমি অমরেন্দ্রনাথ পাণ্ডে এমবিবিএস, বাজপাখি, রূপক চ্যাটার্জির রচয়িতা বুড়ো বয়েসে শিখতে শুরু করলাম ঠিকুজি কুষ্টি বিচার। হস্তরেখা বিচার। হা হা হা…
সায়ন্তন হাঁ করে তাকিয়ে শুনছিল অমরেন্দ্রর কথা। নিজের কানকেও বিশ্বাস হচ্ছিল না। এমনও হয়!
ছয় মাসের মধ্যে শিখে ফেললাম জ্যোতিষ। ঘরে ভর্তি করে ফেলেছি জ্যোতিষবিদ্যার নানা বই। ততদিনে আমি আবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি কী করব। শুরু করলাম জ্যোতিষচর্চার বই লেখা। দিন সাতেক লাগল পাণ্ডুলিপিটা তৈরি করতে। লেখকের নাম লিখতে গিয়ে থমকে গেলাম। এবার কী নাম? শ্রীতপনকুমার সিরিজ সাহিত্যের জন্য, ডাঃ এ এন পান্ডে ডাক্তারি বইয়ের জন্য, জ্যোতিষের জন্য…বেশিক্ষণ ভাবতে হয়নি, লেখকের নামের জায়গায় লিখলাম আচার্য ভৃগু।
জানো সায়ন্তন, বইটার পাণ্ডুলিপি শেষ হয়েছিল ভোর রাতে। প্রথম যখন ওই নামটা লিখলাম মনে হল আমার শরীর থেকে পুরোনো শুকনো একটা বাকল যেন খসে পড়ল। পরদিন সকালে পাণ্ডুলিপিটা নিয়ে গেলাম ওই রাধেশ্যামবাবুর কাছেই। টেবিলে রেখে দিয়ে বললাম, পড়ে দেখুন, যদি আপনার ওই জ্যোতিষীর লেখার থেকে খারাপ হয় আমাকে ফেরত দেওয়ার দরকার নেই। আস্তাকুঁড়ে ফেলে দেবেন, বলে সটান বেরিয়ে এসেছিলাম। ঠিক তিনদিনের মাথায় আমাকে ডাক পাঠিয়েছিলেন রাধেবাবু। সেই পুরনো খাতির, আরে মশাই, আপনি তো দেখছি যাতে হাত দেন তাইই সোনা, করেছেন কী! চমৎকার লেখা।
আমি জানতাম, পুরো কনফিডেন্ট ছিলাম এই কথাগুলোই শুনব।
শুরু হয়ে গেল আচার্য ভৃগুর জয়যাত্রা…কম বই লিখেছি ওই নামে? আজও বিক্রি হয় আমি দেখেছি…বইগুলো আজও রয়ে গেছে জানো…এখনও আছে, পাওয়া যায়…বলতে বলতে থেমে গেলেন অমরেন্দ্র।
একটা কথা জিজ্ঞাসা করব আপনাকে?
করো।
জীবনে এতবার নাম বদলেছেন আপনি, আইডেন্টিটি ক্রাইসিস হতো না আপনার? নাকি…
আইডেন্টিটি ক্রাইসিস কার হয় জানো সায়ন্তন? যার আমিত্ববোধ রয়েছে। আমি কখনও নিজেকে খোঁজার চেষ্টা করিনি। নিজেকে খোঁড়ার চেষ্টা করেছি। কতটা গভীর খুঁড়লে আমি নিজেকে আড়াল করে রাখতে পারব, সেই কবর খুঁড়ে গেছি শুধু। আমি যখন যা লিখেছি তাই বেস্ট সেলার, আর বেস্ট সেলার কাকে বলে জানো সায়ন্তন? বলে আবার দেওয়ালের দিকে তাকালেন অমরেন্দ্র।
দেওয়ালে আবার অদৃশ্য প্রোজেক্টরের আলো পড়ল কিন্তু কোনও ছবি এল না, শুধু নষ্ট টিভির স্ক্রিনের মতো ঝিরিঝিরি। ওই ঝিরঝির করতে থাকা অর্থহীন আলোর দিকে তাকিয়ে হো হো করে হাসতে শুরু করলেন অমরেন্দ্র। পাগলের মতো হাসতে থাকলেন, সেই হাসিতে যোগ দিতে একে একে এখান ওখান থেকে এসে জড়ো হতে থাকল রূপক চ্যাটার্জি, মাখনলাল, বাজপাখি, ড্রাগন, কালনাগিনীরা। হাসতে থাকল ওরাও। ভয়ঙ্কর শব্দ সেই অদ্ভূত ব্যঙ্গের হাসিতে। যেন গোটা পৃথিবীর প্রতি চুড়ান্ত বিদ্রুপ করে হাসছে সকলে।
সায়ন্তনের মনে হতে লাগল হাসির শব্দে এই ছোট অন্ধকার ঘরটার ছাদ ভেঙে যাবে। গুড়োগুড়ো হয়ে পড়বে সবকিছু। ওই তো ছাদের থেকে পলেস্তারা খসে পড়ছে। ঘরের জানলার একটা পাল্লা খসে পড়ল। দরজাটা কোথায়…দরজাটা বেরোনোর দরজাটা?
বিছানা ছেড়ে উঠে দরজা খোঁজার চেষ্টা করতে থাকল সায়ন্তন। কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। বীভৎস খলখল শব্দের সেই হাসিতে নিজের অস্তিত্বকে খুঁজে পাচ্ছিল না সায়ন্তন। আর কিছুক্ষণ থাকলেই ও পাগল হয়ে যাবে…আহ আআআহ…
সহসাই থেমে গেল অমরেন্দ্রর অমন উন্মাদের মতো হাসি। আবার কাশতে শুরু করেছেন উনি। চৌকিতে বসেই কাশতে কাশতে কুঁকড়ে যাচ্ছেন, এমনভাবে বেঁকে যাচ্ছেন যেন এই মুহূর্তে প্রাণ শরীর ছেড়ে চলে যাবে।
ঘরের দরজাটা খুঁজে পেল সায়ন্তন। ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসার মুহূর্তে পিছন ফিরে দেখল, অমরেন্দ্রকে ঘিরে তার সন্তানরা কী পরম আদরে শুশ্রষা করছে!
সন্ধে নেমে গেছে অনেকক্ষণ। বৃষ্টি হওয়ার কারণে হাওয়াতে ভিজে ভিজে ভাব। সরু গলিটায় জল জমে গিয়েছে। আলো-অন্ধকার গলি পেরিয়ে মেন রাস্তার দিকে হেঁটে আসছিল সায়ন্তন। মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করছে। আজ দুপুরটা আসলে ঠিক কী ছিল সেটা ওর বোধের বাইরে। এমন কি সত্যিই ঘটেছে? নাকি পুরোটাই ইল্যুশন, ভ্রম…মাথা ভার লাগছে। আজ সারা দুপুর ধরে চলতে থাকা অপ্রাকৃত ঘটনাগুলোর প্রতিটি মুহূর্ত ওর মনে রয়েছে। কিন্তু কেউ কি বিশ্বাস করবে এসব কথা?
গলির মুখে পৌঁছে মনে পড়ল রেকর্ডিং, ইয়েস মোবাইল রেকর্ডিং… মনে পড়তেই বুকপকেট থেকে মোবাইলটা বার করে চোখের সামনে তুলে ধরতেই থমকে দাঁড়িয়ে গেল। রেকর্ডিং মোডে নেই তো! তাহলে কি মাঝপথে অফ হয়ে গিয়েছিল! ভয়েজ রেকর্ডিং-এর ফাইলগুলোতে বার বার সার্চ করল সায়ন্তন। নাহ, কিচ্ছু নেই। কিচ্ছু না।
যতটা অবাক আর হতাশ হওয়ার কথা ছিল সায়ন্তনের ততটা হল না। বরং নিজের মনেই সামান্য ক্লান্ত হাসল। এমনটাই তো হওয়ার কথা ছিল। পৃথিবীর সবকিছু কি রেকর্ডিং করা যায়?
পিছন ফিরে তাকাল আলো-অন্ধকারে মেশা সরু রহস্যময় গলিটার দিকে। ওই গলির শেষপ্রান্তে ডানদিকের অতি পুরোনো বাড়ির একতলায় গুমটি ঘর যেখানে হয়তো এখন আদৌ আর কেউ থাকে না, দীর্ঘকাল অন্ধকার, পরিত্যক্ত। ভাঙা দরজাটিতে একটি নিয়মরক্ষার জংধরা তালা ঝুলছে, কিন্তু কেউ যদি উঁকি দেয় সেই বন্ধ দরজার ফাটলের মধ্যে দিয়ে হয়তো এখনও দেখা যাবে ওই ঘরের ভেতর একটি কঙ্কালসার বৃদ্ধ শুকনো তক্তপোষে বসে ঘাড় গুঁজে লিখে চলেছেন—একহাতে পিস্তল আর অন্য হাতে টর্চ ধরে পাঁচতলা বাড়ির পাইপ বেয়ে তড়িৎগতিতে নেমে এল গোয়েন্দা রূপক চ্যাটার্জী। চারিদিকে অমাবস্যার ঘোর অন্ধকার…
বৃদ্ধ লিখে চলেছেন আর তার পাশে দাঁড়িয়ে ছেঁড়া একটা হাতপাখা নিয়ে পরম শ্রদ্ধায় হাওয়া করে চলেছে ব্যাটম্যানের মতো মুখোশ পরা বাজপাখি। স্টোভে চা বানাচ্ছে ড্রাগন আর রূপক মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রয়েছে তার পিতার দিকে।
(এই কাহিনি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। বাস্তবের কোনও চরিত্র এবং ঘটনার সঙ্গে মিল নেহাতই কাকতালীয় এবং অনিচ্ছাকৃত)
তথ্যঋণ ও কৃতজ্ঞতা
১ স্বপনকুমার সমগ্র গোয়েন্দা সিরিজ- (সম্পা- নিমাই গড়াই)—লালমাটি প্রকাশন
২ সিরিজ সাহিত্য বহুত্বময় বরাভয়ের সামাজিক রাজনীতি—অদ্রীশ বিশ্বাস, শারদীয় অনুষ্টুপ(২০১২)
৩ পাল্প কালচার, সিরিজ সাহিত্য ও স্বপনকুমার—কৌশিক মজুমদার।
৪ সাহিত্যের গোয়েন্দা—প্রসেনজিত দাশগুপ্ত—পরশপাথর প্রকাশন
৫ গোয়েন্দা আর গোয়েন্দা—রঞ্জিত চট্টোপাধ্যায় ও সিদ্ধার্থ ঘোষাল সম্পাদিত—আনন্দ
৬ রহস্য রোমাঞ্চ গোয়েন্দা পত্রিকার সেরা ১০০ গল্প—সম্পাদনা —অনীশ দেব—পত্রভারতী
৭ রাতবিরেতের রক্তপিশাচ—অভি চক্রবর্তী—বুকফার্ম
৮ দারোগার দপ্তর—রায়বাহাদুর শ্রীপ্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়—পুনশ্চ
৯ ক্রাইমকাহিনীর কালক্রান্তি—সুকুমার সেন—আনন্দ
১০ মোহনভোগ-(আজকাল পত্রিকা,০৯/০৬/২০১৫)—শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়
১১ দীপক রতন এবং স্বপনকুমার—(আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৮/০৩/২০১৫) শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়
১২ True Crime Detective Magazine 1924—1967, Taschen
১৩ From standard magazines to pulps and big slicks / A note on the history of US general and fiction magazines by R. D Mullen—science fiction studies—Vol. 22, Part-1, March 1995.
১৪ শান্তনু ঘোষ।