নাগের বাজার স্টপেজ ও একটি সেলফি
হাওড়া স্টেশনের লোকাল বাস টার্মিনাসে ধীরেসুস্থে পৌঁছে বাসে উঠল সোমরাজ। মন তীব্র বিষণ্ণ আজ। কপালে বাসটাও জুটল তেমনই। সেই আদ্যিকালের লম্বা সিট। এখন এমন সিট আর প্রায় নেই। দুদিকে পাশাপাশি দুজন বসার সিট হয়। কিন্তু কোনও কোনওটায় এখনও সেই পুরোনো ব্যবস্থা রয়ে গিয়েছে। প্যাসেঞ্জাররা সারসার পাশাপাশি ঠেসাঠেসি করে বসে। কোন স্টপেজ এল বার বার ঘাড় পিছনে ঘুরিয়ে দেখতে হয়।
আজ রবিবার, বাস প্রায় ফাঁকা। ড্রাইভার, কন্ডাক্টর কেউই নেই। প্যাসেঞ্জারও প্রায় নেই বাসে। দু-চারজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে রয়েছে। সোমরাজ সিনিয়র সিটিজেনের দুটো সিট ছেড়ে তারপরে বসল। উল্টোদিকের লেডিজ সিটগুলোও ফাঁকা। পাবলিক টয়লেটটার সামনেই বাসটা দাঁড়িয়ে রয়েছে বলে ভয়ঙ্কর দুর্গন্ধ আসছে।
সোমরাজ বাইরে তাকাল। এখন বসন্তকালের শেষ দুপুর। স্টপেজে যখন ও নামবে ততক্ষণে নিশ্চয়ই বিকেল নেমে যাবে। আজ থেকে দু-বছর আগে এমনই এক বসন্তের বিকেলেই মেখলার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, আর আজ…
ভাবনাটাকে জোর করে থামিয়ে আবার মুখ ঘুরিয়ে নিল সোমরাজ। যতক্ষণ না বাস ছাড়ে ততক্ষণ কীভাবে নিজেকে ভুলিয়ে রাখা যায় সেটা ভাবল। ইদানীং এমন হয়েছে এক মুহূর্তও একা চুপ করে বসে থাকতে ইচ্ছে করে না। চুপ করে থাকলেই কান্না পায়। ছেলে হয়ে কাঁদতে লজ্জা লাগে, প্রাণপণে সেই কান্না চাপতে চেষ্টা করে। চোখের বাইরে সেই জল গড়িয়ে না নামলেও ভেতরটা ভিজে যায়। পকেট থেকে মোবাইল বার করে ঘাঁটাঘাটি শুরু করল সোমরাজ। একবার ভাবল ফেসবুকটা খুলি, তারপরেই মনে হল ধুর ফেবু খুললেই ঝাঁকে ঝাঁকে দাঁত বার করা ছবির ভিড়, মানুষ খাচ্ছে, কাঁদছে, রাগছে, হাঁচছে সবকিছুর ফিলিং সমেত ছবি আর ছবি। বড় একঘেয়ে। কিন্তু এই ফেসবুকেই একটা সময়ে মেখলার সঙ্গে পরিচয়, রাতের পর রাত জেগে কত কথা, পরদিনে ঘুমঘুম চোখে সারাদিন কলেজ করা।
আচ্ছা ওগুলো কি গতজন্মের স্মৃতি? ইদানীং তেমনই যেন মনে হয়। ফেসবুক অ্যাকাউন্টটা কাল থেকে ডিলিট করে দেবে ভেবেছে সোমরাজ। আর দরকার নেই। আজই তো সব শেষ। হোয়াটসঅ্যাপটা রাখার দরকার কারণ বন্ধুদের গ্রুপে ক্লাসনোটস, সাজেশন, রেফারেন্স বইয়ের ডিটেল ইত্যাদি শেয়ার হয়।
মোবাইলে টেম্পলরান গেমটা ওপেন করল সোমরাজ। মিনিট পাঁচেক খেলার পরেই অধৈর্য হয়ে মুখ তুলল। বাসটা মোটামুটি ভরেছে। ড্রাইভার আর কন্ডাকটর এখন বাসের সামনে এসে মাটির ভাঁড়ে চা খাচ্ছে। তার মানে ছাড়বে। এমনিতেই এই প্রাইভেট বাসগুলো নড়তে চায় না। আজ আবার রবিবার তায় দুপুর। নড়তে চড়তে বহু সময় নেবে। সেই আন্দাজমতোই বাড়ি থেকে বেরিয়েছে ও।
বেলুড় মঠের কাছে বাড়ি ওর। লালবাবা কলেজে পড়ে। কেমিস্ট্রি অনার্স, ফাইনাল ইয়ার। স্টুডেন্ট হিসেবে মোটামুটি হলেও, দেখতে শুনতে ভালো আর ফুটবলে হিরো। সাবডিভিশনে খেলে। কলকাতার মাঠে নিয়মিত প্র্যাকটিসে যায়। সকলেই বলে খেলাটা চালিয়ে গেলে সোমরাজের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। সোমরাজ নিজেও খেলা অন্ত প্রাণ। ফুটবল, বন্ধুবান্ধব, আর পড়াশোনা নিয়ে চলছিল দিব্বি, বিপদ বাঁধিয়ে দিল এক বন্ধু। দাঁড়া তোর একটা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট করে দিই, বলে সঙ্গে সঙ্গে ওর একটা ছবি তুলে অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়ে বলেছিল, যা এবার পরে পাসওয়ার্ডটা বদলে নিস। দেখবি আজিব দুনিয়া। তবে সাবধানে, ফুটবলের মাঠের মতো এখানে ছুটতে যাস না। চাপে পড়ে যাবি।
সোমরাজের কোনও আগ্রহ ছিল না। খুলেও দেখেনি বেশ কিছুদিন, তারপর একদিন অলস দুপুরে কী খেয়াল হতে নিজের প্রোফাইলটায় লগ ইন করেছিল। বেশ কয়েকটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট। সবই প্রায় চেনাশোনা বন্ধু, কয়েকজন পুরোনো বন্ধুও ছিল। হাই, হ্যালো, ওয়েলকাম টু ফেসবুক ইত্যাদি মেসেজ।
প্রায় ঘণ্টাখানেক খুটখাট করার পর বেশ ইন্টারেস্ট লেগে গিয়েছিল। তার পরদিন থেকে নিয়মিত একটা সময় করে কিছুক্ষণ কাটাত ফেবুতে। ওই ভারচুয়াল দুনিয়াতেই একদিন মেখলার সঙ্গে পরিচয়। রিকোয়েস্টটা অবশ্য মেখলাই পাঠিয়েছিল। দমদমে থাকে। মেট্রো স্টেশনের কাছেই বাড়ি। পলিটিকাল সায়েন্সে অনার্স, উত্তর কলকাতার প্রিয়নাথ কলেজে। বেশ কয়েকদিন হাই-হ্যালো, থেকে কী করছ? একদিন মিট করবে? গড়াতে গড়াতে সত্যি সত্যিই বিকেলে গড়ের মাঠ, সিটি সেন্টার, সেন্ট্রাল পার্ক, ফুচকা, এগরোল, প্রিন্সেপ ঘাটের আইসক্রিম স্কুপ।
পৃথিবীতে সম্পর্কগুলো ঠিকঠাক জল-হাওয়া পেলে ঠিক যেভাবে বেড়ে ওঠে সোমরাজ আর মেখলার সম্পর্কটাও ওই একই নিয়ম মেনে পার করে ফেলেছিল বেশ কতগুলো দিন। কবে যে একে অপরের প্রতি চূড়ান্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়ল, কেন যে সারাদিনে একটিবার দেখা না হলে দুজনেরই দম বন্ধ হয়ে আসত তা ওরা নিজেরাও জানত না। ভালোবাসার পাশাপাশি ঝগড়া, মনখারাপ, অভিমানও চলত তাল মিলিয়ে। ফুটবলের সাঙ্ঘাতিক ভক্ত মেখলা। নিজের প্রোফাইলে মেসির ফটোর ছড়াছড়ি। এই নিয়েও মজা হতো খুব। দুজনে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের ম্যাচও দেখতে গিয়েছে। দিব্বি চলছিল এইভাবেই হেসে খেলে। আচমকাই বজ্রপাত এক বিকেলে।
ড্রাইভার উঠে পড়ল নিজের সিটে। বাস স্টার্ট দিল। ছাড়বার ঠিক আগের মুহূর্তে একজন মহিলা উঠলেন। ছোটখাটো ভারিক্কি চেহারা, মাথার কোঁকড়া চুল প্রায় সবই সাদা। খুব ফর্সা। কন্ডাক্টর ওর হাত ধরে প্রায় টেনেই বাসে তুলল। মহিলা মিষ্টি হেসে কন্ডাক্টরকে ধন্যবাদ দিয়ে বললেন, হাঁটুতে বাত বুঝলে ভাই। বাসে উঠতে খুব কষ্ট হয়। আগে কত ছোটাছুটি করেছি, এখন আর পারি না।
কন্ডাক্টর অত কথা শুনলও না। সে ব্যস্ত প্যাসেঞ্জার তুলতে।
মহিলা যে বেশি বকবক করেন তা প্রথমেই বুঝিয়ে দিলেন। কিন্তু সবথেকে হাস্যকর, উনি পরেছেন ঘন সবুজ রঙের একটা সালোয়ার। এই বয়সে যে এমন সাজ স্রেফ হাস্যকর লাগছে সেটা বোঝার মতো বোধ ওনার নির্ঘাত নেই। এই ধরনের এক-একজন মহিলা থাকেন যারা নিজেদের বয়সকে প্রায় খামচে ধরে রাখার চেষ্টা করেন। আরে বাবা বয়স বাড়া একটা স্বাভাবিক ধর্ম। তাকে বাড়তে না দিতে চাইলেও বাড়বে। এইভাবে আটকাতে গেলে কমিক ক্যারেকটারের মতো লাগে। সোমরাজ মহিলার মুখের দিকে ভালো করে তাকায়নি। আলগোছে একঝলক তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিয়েছিল।
বাস চলতে শুরু করে দিয়েছে। স্ট্যান্ডিং প্যাসেঞ্জার নেই। রাস্তাও ফাঁকা। হাওড়া ব্রিজ পেরিয়ে এমজি রোডে উঠল বাস। কোনও জ্যাম নেই। তরতরিয়ে চলল। ওই মহিলা পাশের একজনের সঙ্গে ক্রমাগত বকে চলেছেন।
ও ভাই টিকিটটা নেবে, আমি নাগের বাজারে নামব।
বসুন না, নেব। দেরি আছে। কন্ডাক্টর এখনই টিকিট নিতে নারাজ। আজ প্যাসেঞ্জারের চাপ নেই। ধীরেসুস্থে কাজ শুরু করতে চায়।
যদি স্টপেজ এসে যায় আমি যদি ভুলে নেমে যাই, নাও না বাবা।
আচ্ছা দিন, নেহাত অনিচ্ছায় বুড়ির মুঠো থেকে টাকা নিল কন্ডাক্টর।
যাক বাবা নিশ্চিন্ত করলে। স্টপেজ এলে আমাকে একটু নামিয়ে দিও বাবা।
হুঁ।
আসলে বহু বছর পরে যাচ্ছি তো। কিছুই মনে নেই।
হঠাৎ সোমরাজের মনে হল মহিলা তার পাশের সহযাত্রিনীর সঙ্গে কথা বলছেন কিন্তু বার বার যেন ওর দিকেই তাকাচ্ছেন। তাই কি? ধুস, তা কেন হবে? তবু অস্বস্তিটা কাটানোর জন্যই একবার মহিলার মুখের দিকে তাকাল সোমরাজ। আর ভয়ংকর চমকে উঠল।
আজ থেকে ঠিক মাস দুয়েক আগের কথা। একদিন বিকেলে মেখলা এল সোমরাজের কাছে। দেখেই মনে হয়েছিল খুব উদ্বেগে রয়েছে। কী হয়েছে প্রশ্নটা বার কয়েক করার পরই আচমকা কেঁদে ফেলেছিল মেখলা। ওর বাবা ট্রান্সফার হয়ে যাচ্ছে। এবং সেটা দেশের কোথাও নয়, সেই সুদূর নেদারল্যান্ডের আমস্টারডামে।
মেখলার বাবা যে একজন আইটি প্রফেশনাল এবং বেশ উঁচু পদে চাকরি করেন, সেটা সোমরাজ জানত। মাস গেলে কয়েকলাখ টাকা মাইনে, গাড়ি, দু-তিনটে ফ্ল্যাটওলা বাবার একমাত্র মেয়ে মেখলার সঙ্গে মিশলে কিন্তু কোনওভাবেই বোঝার উপায় নেই যে, ও এমন বড়লোক বাড়ির মেয়ে। একেবারে সাধারণভাবে থাকে। মেখলার বাবা কাজের কারণে মাঝে মাঝেই বিদেশে যান, অনেক সময় মাস খানেক থাকতেও হয় সেখানে, কিন্তু সেবারের ব্যাপারটা ছিল অন্যরকম। মেখলা বলেছিল, টুর নয় বাবা ট্রান্সফার হয়ে যাচ্ছে, উইদ ফ্যামিলি যেতে হবে।
মানে! তোমরাও চলে যাবে! কতদিন?
মেখলা মাথা নিচু করে বসেছিল কিছুক্ষণ, তারপর ফিসফিস করে বলে উঠেছিল, বাবা বলেছে মিনিমাম ফাইভ ইয়ারস!
কী! শিউরে উঠেছিল সোমরাজ। পাঁ-চ বছর! কী বলছ তুমি মেখলা!
মেখলা চুপ ছিল। মাথা নীচু করে বসেছিল আর ওর দু’চোখ দিয়ে টপটপ করে জলের ফোঁটা পড়ছিল।
তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে মেখলা? অতি কষ্টে শব্দকয়েকটা উচ্চারণ করতে পেরেছিল সোমরাজ। ভুলে যাবে আমাকে?
ভুলে যাব! কেন?
আমি জানি যাবে। আউট অফ সাইট আউট অফ মাইন্ড।
এসব কী বলছ তুমি! এতই কি সোজা? জীবনের সবকিছু কি একই সূত্র মেনে চলে সোম?
কিন্তু এতদিন আমি তোমাকে না দেখে থাকতে পারব না মেখলা। প্লিজ যেও না। মেখলার হাতদুটো কাতরভাবে চেপে ধরেছিল সোমরাজ। মেখলার হাতের তালুদুটোও ওর চোখের মতোই ভেজা ছিল।
মেখলা কী উত্তর দেবে বুঝতে পারেনি। শুধু বলেছিল, ঠিক ফিরে আসব, দেখো তুমি। প্লিজ আমার জন্য অপেক্ষা কোরো একটু।
সোমরাজ মেখলার চোখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছিল ওর বিশ্বাস। কিন্তু নিজে বিশ্বাস করতে পারেনি। পাঁচ বছর বলে যে মানুষ যায় সে যে আজীবন ওখানে থেকে যাবে না, তার কি কোনও গ্যারান্টি রয়েছে? কিন্তু মেখলাকে ছাড়া একটা দিনও থাকা যে নিজের আত্মাকেই ছেড়ে থাকা!
ওই দিনের পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই দেখা হয়েছে দুজনের, কথা হয়েছে কম আরও কম, শুধু দুজনে দুজনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে একে অপরের শরীরের উত্তাপ নিজের শরীরে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে, অন্যের স্পর্শকে নিজে অনুভব করার চেষ্টা করেছে। কীভাবে ঝড়ের মতো যেন কেটে গেল একটা মাস। কাল মেখলারা চলে যাবে। সবকিছু ছেড়ে চলে যাবে কতদূর কতকালের জন্য…
সামনের মহিলার মুখটা দেখে চমকে উঠল সোমরাজ। কী আশ্চর্য! এ যে অসম্ভব! হতে পারে এমন? নাকি ওরই চোখের ভুল? তাই-ই হবে।
এই একমাস ধরে দিন রাত চোখের সামনে শুধু একটা মুখই ভেসেছে, তা হল মেখলার মুখ। কলেজ, খেলার মাঠ, বন্ধুবান্ধব কিছুই আর ভালো লাগে না। আজ মেখলার সঙ্গে শেষবার দেখা হওয়া। নাগেরবাজারে একটা কফিশপ রয়েছে। বহু পুরোনো কফিশপ। মেখলার সঙ্গে ফেসবুকে প্রায় মাসখানেক চ্যাট করার পর যেদিন প্রথম মিট করার কথা হয়েছিল, মেখলা নাগেরবাজারে সেই কফিশপটায় ডেকেছিল। ভেতরটা অনেক পুরোনো ডেকরেশন। ঢুকলে মনে হয় যেন একশো বছর আগের কোনও এক সময়ে ঢুকে পড়া গিয়েছে। দারুণ পরিবেশটা। প্রথম দিনের সেই বিকেলে প্রায় ঘণ্টাদুয়েক কথা বলেছিল দুজনে। কলেজস্ট্রিটের কফি হাউজের মতো এখানেও কেউ এসে তাড়া দেয় না, এক কাপ কফি নিয়ে দিব্বি অনেকটা সময় কাটিয়ে দেওয়া যায়।
ওই প্রথমবারের দেখা হওয়ার ঘোর কিংবা সেই ইউনিক ক্লাসিকাল অ্যাটমসফিয়ারটার জন্যই কি না কে জানে, দুজনের রিলেশনটা ম্যাচিওর করে যাওয়ার পরেও ওখানে তারপর বেশ অনেকবার মিট করেছে দুজনে। আর আজ দুজনের শেষবার দেখা হবে, সেটাও ওই কফিশপেই। দুজনেই ঠিক করেছে ওই ভেন্যু।
কিন্তু এই মহিলার মুখ দেখে সত্যিই চমকে উঠল সোমরাজ। আজ থেকে ঠিক চল্লিশ কিংবা পয়তাল্লিশ বছর পরে মেখলাকে যেমন দেখতে হবে তা যেন হুবহু এই বয়স্কা মহিলার মুখ। নিজের মনকে শাসন করল সোমরাজ। ধুস কীসব হাবিজাবি ভাবছে ও! মাথাটা পুরো গিয়েছে। কিন্তু সত্যিই তাই…আবার তাকাল, হ্যাঁ অবিকল তাই! ঠিক ওরকমই গোল মুখ, চওড়া ফর্সা কপাল, কোঁকড়া চুল, পাতলা ঠোঁট, দীর্ঘ চোখদুটো, এমনকী কানদুটোর আকৃতিও মেখলার সঙ্গে মেলে! এ কী করে হয়! যেন চল্লিশ-পয়তাল্লিশ বছর পরের মেখলা এসে ওর উল্টোদিকে বসেছে। হাঁ করে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ।
মহিলা ওর পাশের সহযাত্রীনির সঙ্গে অনবরত কথা বলে চলেছেন, আর মাঝেমাঝেই ফোনে কাকে যেন বলে চলেছেন—হ্যাঁ এই তো বাসে রয়েছি, ও ভাই, এটা কতদূর এলো গো? ওহ আচ্ছা…এখন এখানে এসেছি। ওনার সবেতেই খুশি। এই বয়সে এমন খুকি টাইপ সেজেও খুশি। কিন্তু এমন সাজের আড়ালে স্পষ্ট মেখলাকে দেখা যাচ্ছে।
হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সোমরাজ দেখল মহিলাও সোমরাজের দিকে মাঝেমাঝেই তাকাচ্ছেন, আর মিটিমিটি হাসছেন।
অদ্ভূত লাগল সোমরাজের। অবশ্য এই ধরনের মানুষরা, যারা সকলের সঙ্গে কথা বলতে ভালোবাসেন, তারা অচেনা মানুষ দেখলেও হাসেন, যদি আলাপটা জমিয়ে ফেলা যায় তাহলেই কথা শুরু করে দেন আর কি।
কিন্তু সোমরাজ সেই সুযোগ দিল না। শুধু নিজের মোবাইলটা কায়দা করে সামনে তুলে ধরে বেশ কয়েকটা ফটো তুলে নিল ওই মহিলার। মেখলাকে দেখাতে হবে। তুমি যখন ফিরবে কিংবা হয়তো আর আমার কাছে ফিরবেই না, হয়তো একদিন আমরা দু’জনেই পরস্পরের কাছে অপরিচিত হয়ে যাব আর কোনও যোগাযোগ থাকবে না, তবু এই ছবিটা রেখে দেব আমার কাছে, আমারও যখন ষাট কিংবা সত্তর বছর বয়স হবে ভাবব তোমাকে তখন এমন দেখতে হয়েছে।
কথাগুলো মনে হতেই আবার বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল সোমরাজের। যদি দুজনেই আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতো, যদি বয়সটা দুজনেরই আরও কিছুটা বেশি হত তাহলে কিছুতেই মেখলাকে ছেড়ে দিত না সোমরাজ। মেখলাও নিশ্চয়ই যেত না ওকে ছেড়ে।
আবার তাকাল সেই মহিলার দিকে। ওনার হাতের মোবাইলটাও স্মার্টফোন। সোজা করে তুলে কীসব খুটখাট করে চলেছেন। সম্ভবত চোখে কম দেখার কারণে মুখের সামনে ফোনটা তুলে নিয়ে কিছু দেখছেন। সোমরাজের সঙ্গে চোখাচুখি হতেই সেই মিষ্টি করে মিটিমিটি হাসছেন। এবার ভদ্রতার কারণে সোমরাজও অল্প হাসল। জোর করেই হাসল। আজকাল হাসি আর পায় না। তারপর জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। কাল মেখলারা চলে যাবে। পৃথিবীর অপরপ্রান্তে। মেখলা বলেছে—এই ইন্টারনেটের যুগে দূরত্বটা কোনও ফ্যাক্টরই না, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ভিডিও কল সবই তো রয়েছে যোগাযোগের জন্য।
আর তোমার হাতের স্পর্শটা? সেটা কি ইন্টারনেট দিতে পারবে মেখলা?
নাগের বাজার… নাগের বাজার নামবেন। কন্ডাকটরের ডাকে হারিয়ে যাওয়া মন আচমকাই ফিরে এল সোমরাজের। এবার নামতে হবে। আর কতক্ষণ? খুব বেশি হলে দুইঘণ্টা…তারপরেই আর দেখা হবে না মেখলার সঙ্গে। হয়তো অনন্ত প্রতীক্ষা, হয়তো এইজন্মেই আর নয়। বাস থেকে নামার সময় দু-চোখ ঝাপসা হয়ে গেল সোমরাজের। ইসস এত কান্না পাচ্ছে কেন?
চোখদুটো ভালো করে ঘষে নিয়ে মন শক্ত করে রাস্তাটা ক্রস করতে যাবে, হঠাৎই পিছন থেকে ও ছেলে…ওই ছেলে শোনো ডাক এল।
পিছন ফিরে দেখল সেই মহিলাও নেমেছেন বাস থেকে। থপথপ করে হাঁটছেন। হাঁটতে যে বেশ অসুবিধা হচ্ছে, সেটাও বোঝা যায়। চলে যাবে ভেবেও পারল না সোমরাজ। দাঁড়াল।
মহিলা এগিয়ে এসে বলল, আমাকে রাস্তাটা একটু পার করে দাও না। ওই যে ওই মুখটায় পৌঁছে দিলেই হবে। বলে সোমরাজের ডানহাতের কনুইটা ধরল। কী অদ্ভুত স্পর্শ। আর কী আশ্চর্য, রাস্তায় পাশাপাশি হাঁটতে থাকলে মেখলা অনেকসময়েই সোমরাজের ঠিক ওই কনুইটার ওখানেই ধরে। যেন চল্লিশ বছর পর ওই এসে আবার হাত ধরেছে। গা সিরসির করে উঠল সোমরাজের। এ কীসব ঘটছে! চওড়া রাস্তাটা পার করার পর সোমরাজ বলল, আপনি কোথায় যাবেন?
আমি কোথাও যাব না। আমাকে এইখানে দাঁড়াতে বলা হয়েছে। এখানেই দাঁড়াই কেমন?
আচ্ছা।
আর শোনো মোবাইলে আমার অত ছবি তুলছিলে কেন শুনি? তোমার ঠাকুমা কি আমার মতো দেখতে নাকি? নাকি আমাকে একেবারে ক্লাউনের মতো লাগছে বলে এখন ছবি তুলে নিলে তারপর বন্ধুদের দেখিয়ে নিজেরা খুব হাসাহাসি করবে, তাই না?
এমন প্রশ্নে খুব ঘাবড়ে গেল সোমরাজ। স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি মহিলা যে ওর ফটো তোলা দেখতে পেয়েছেন। কী বলবে ভেবে পেল না। না বলে অচেনা কারও ফটো তোলা অন্যায়, সেটাও ওর জানা।
কোনটা ঠিক বলো? আচ্ছা আমাকে খুব খারাপ লাগছে, তাই না? আমিও ওকে বললাম, এই বয়সে কি আর এমন সাজা মানায় বলো? কিন্তু উপায় কী এমনই দেখতে চেয়েছে সে?
ওহ আচ্ছা। সে মানে কে সেটা আর জিজ্ঞাসা করল না সোমরাজ।
কিন্তু বুড়িও নাছোড়। ও আচ্ছা মানে? জানতে চাইবে না সে কে?
কে?
আমার প্রেমিক। বলে ফিক করে হাসলেন তিনি। খুব ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিল, আমি অবশ্য একেবারেই ছাপোষা। চন্দননগর থেকে আসতাম প্রেসিডেন্সিতে পড়তে। ওখানেই পড়ত কল্লোল। এক ডাকে সকলে চিনত। মেয়েদের লাইন পড়ে থাকত ওর পিছনে। সবার দেখাদেখি আমিও ক্যাবলার মতো লাইন দিয়েছিলাম, জানতাম হবে না, কিন্তু এমনই কপাল সকলকে ছেড়ে সেই ছেলে শেষে কি না আমার মতো সাদামাটা বেগুন মেয়েকেই বাছল। ঠিক সাত মাস ছিল আমাদের রোজ দেখা হওয়া, তারপর…বলে একটু থামলেন মহিলা। কাঁধের ঝোলা থেকে জলের বোতল বার করে দুঢোক জল খেলেন তারপর ঠোঁটের লিপ্সটিক বাঁচিয়ে সাবধানে মুখ মুছে আবার বললেন, ‘তারপর কী একটা স্কলারশিপ পেয়ে সোজা চলে গেল লন্ডন কীসব পড়তে। আমাকে বলে গেল শিগগিরিই ফিরবে। কিন্তু সারাক্ষণ মাথায় পড়াশোনার ভূত, লন্ডনের পড়া শেষ করে সেখান থেকে আমেরিকা, জার্মানি, আরও কী কী সব করতে করতে পয়তাল্লিশটা বছর সারা পৃথিবী ঘুরে কাটিয়ে দিল। কিন্তু আমিও চন্দননগরের মেয়ে হুঁ…হুঁ অপেক্ষা কি শুধু ও একাই করতে পারে? আমিও পারি দেখিয়ে দিয়েছি। পয়তাল্লিশ বছর অপেক্ষা আর এমন কী বলো? ইস্কুলের দিদিমনি হয়ে পয়ত্রিশ বছর কাটিয়ে ফেললাম দিব্বি অপেক্ষায়। শেষে এই তো গতকাল ফিরেছে। আর কোথাও যাবে না। এবার নিজের দেশেই থাকবে বাকি জীবনটা, বলেছে আমাকে।
আমাকে এখানেই দাঁড়াতে বলল, কোথায় কোন অফিসে গিয়েছে কাজে, এখানে গাড়ি নিয়ে আসবে। তারপর আজ দু’জন কোথায় যাব জানো? কলেজস্ট্রিট, কফি হাউজে। ওখানেই আমাদের শেষদিন দেখা হয়েছিল কি না। আমি বলেছিলাম ওখানেই তাহলে সরাসরি চলে যাই না বাপু, আমার অনেক কাছে পড়বে। কিন্তু না, তিনি শুনবেন না, দুজনকে নাকি একইসঙ্গে ঢুকতে হবে। শুধু তাই নয়, যেদিন নাকি আমাদের শেষবার দেখা হয়েছিল আমি সেদিন সবুজ সালোয়ার আর লিপস্টিক লাগিয়েছিলাম। বাবুর এতকাল পরে সেটাও মনে রয়েছে আর তার আবদার আজ আমাকে সেই সাজে আসতে হবে। আচ্ছা তুমিই বলো, আমাকে এই বয়সে এমন মানায়…বলে একটু থেমে যেন নিজের মনেই বললেন, তা না মানাক, যে যা খুশি ভাবুক, ছেলেটা একইরকম ছেলেমানুষ রয়ে গেল।
ছেলেটা! হয়তো তার এখন সত্তর বছর বয়স কিংবা আরও বেশি। সোমরাজ কিছু বলতে পারছিল না। মোবাইলে ছবিগুলো তুলেছিল আজ মেখলাকে দেখাবে বলে, এই দেখো যদি আজ থেকে তোমার সঙ্গে আমার চল্লিশ বছর পরে দেখা হয় তাহলেও যেন একবারে দেখে চিনতে পারি তাই তোমার ভবিষ্যতের ফটো তুলে রাখলাম। আর তো দেখা হবে না আমাদের।
কিন্তু এখন কেমন যেন হিসেব গুলিয়ে যাচ্ছে সোমরাজের।
তুমি জানো ও যখন কলেজ থেকে বিদেশে চলে গেল কেমন সুন্দর দেখতে ছিল ওকে? দাঁড়াও দেখাই তোমায়। বলে নিজের মোবাইল বার করে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিলেন। সোমরাজ আবার অবাক হল। অতকাল আগে তো মোবাইল ছিল না, তারমানে নিশ্চয়ই ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট ফটো থেকে মোবাইলে ছবি তুলে রেখেছেন উনি…
এই যে, দেখো তো, চেনা লাগে?
ভীষন চমকে উঠল সোমরাজ। এ কী! এ যে ওরই ছবি। একটু আগে চলে যাওয়া বাসটার সিটে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে ও।
আপনি…!
হ্যাঁ, অবিকল তোমার মতোই ওইসময় দেখতে ছিল কল্লোলকে। আমি তো বাসে উঠে তোমাকে দেখতে পেয়েই চমকে উঠেছি। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল তোমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে কল্লোলকে দেখাই, কিন্তু সে উপায় তো নেই, তারপর যখন দেখলাম তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে আমার ছবি তুলছ তখন আমার মাথাতেও এল, আরে, আমিও তো তুলে নিতে পারি, ওকে বেশ দেখানো যাবে, খুব মজা লাগবে। কী ভাবছ তুমি? ফেরে গো ফেরে। কিছু মানুষ ঠিক ফেরে, অপেক্ষা করতে হয়।
সোমরাজের কানে কিছু ঢুকছিল না। গোটা পৃথিবীটা যেন এক আশ্চর্য নরম আলোতে ভরে গিয়েছে। সবকিছু যেন স্বপ্নের মতো।
চলো আমরা দু’জনেও এবার একটা সেলফি তুলে রাখি। আমাদের আবার যেদিন দেখা হবে…নাও নাও, এদিকে তাকাও। সেলফি মোডে করা ক্যামেরার দিকে তাকাল সোমরাজ। হ্যাঁ ঠিক তাই। ওর পাশে সেই মহিলা নয়…মেখলা…মেখলা…।
একটু হাসো না প্লিজ…
চিক করে ক্যামেরায় শব্দ হল। ছবিটা কোথায় সেভ হল তা ওরা দুজন ছাড়া আর কেউ জানল না।