ফেসবুক, প্রেজেন্টেশন ও বিভানের গল্প

ফেসবুক, প্রেজেন্টেশন ও বিভানের গল্প

বিভান মাঝে-মাঝে ভাবে মার্ক জুকেরবার্গ না জন্মালে ওর নিজের জীবনটাও ব্যর্থ হয়ে যেত। এই ভাবনার পিছনে বেশ কিছু শক্তসমর্থ যুক্তি রয়েছে। সাইত্রিশ বছরের বিভান গত পঁচিশ বছর ধরে বিশ্বাস করে আসছে যে সলমন খানের মতো ওরও এমন বিপুল ক্রেজের একমাত্র কারণ হল অবিবাহিত থাকা। ব্যাচেলারদের মার্কেটভ্যালু মার্কেটে বরাবরই হাই। আর সত্যি বলতে বিভানের গায়ের রং একটু চাপা হলেও হাইট, চুলের কেতা, চোখ, মুখ বেশ চোখে পড়ার মতো। এই জন্য কৈশোর থেকেই বিভানের বেশ কিছুটা ঘ্যাম তৈরি হয়েছিল। তারপর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই ঘ্যামও গোকুলের শ্যামের মতো বাড়তে থাকল। কলেজ লাইফ থেকেই প্রেমে পড়া শুরু হয়েছিল বিভানের। কিন্তু যে কারণে ওর বেশিরভাগ প্রেমগুলোই ঝাড় খেয়ে যাচ্ছিল তা হল বিভানের গলা, মানে কণ্ঠস্বর। বিভানের জীবনের একমাত্র কলঙ্কিত নাছোড় অধ্যায় হল ওর ভয়েস। একেবারে বয়স্ক পাতি হাঁসের মতো গলা। ফলে যখনক্ষণ বিভান গম্ভীর, যতক্ষণ ও মুচকি হাসছে ততক্ষণ ও অক্ষয় কুমার কিংবা শাহরুখ খান, কিন্তু কথা বললেই নবদ্বীপ হালদার। মেয়েরা প্রেমের ক্ষেত্রে সবদিক বিচার করেই ডিসিশন নেয়। আর গলা যে প্রেমের ব্যাপারে একটা মেজর ভূমিকা নেয় সে কথা আর নতুন করে বলার নেই। তাই সবকিছু ঠিক থাকলেও, ওই একটা জায়গায় ঝাড় খেয়ে বিভানের লাভস্টোরিগুলো সব রাজকুমার আর মিনাকুমারীর ট্র্যাজিক এন্ডে পরিণত হতো।

বিভান তার স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিল ঐশ্বর্যা রাইকে দিয়ে। তারপর নামতে নামতে বিপাশা, পূজা ভাট। এর পরে ও আর স্বপ্ন দেখেনি। কেরিয়ার ভেবেছিল মুম্বইয়ের অক্ষয়, শাহরুখ, সলমনের মতো হবে। সেই মতো প্রফেশনাল ফটোশুট করিয়ে অনেক জায়গায় পাঠিয়েছিল, মুম্বাইতে সাড়া মেলেনি। ফলে বলিউড ছেড়ে টলিউড। সেই প্রসেনজিত থেকে চিরঞ্জিত সেরে দেব, জিৎ হয়ে বাংলা সিরিয়ালেও ট্রাই করেছিল, অ্যাটলিস্ট যদি ঋষি কৌশিকও হওয়া যায়। কিন্তু সে গুড়েও বালি পড়ল। শেষে এক বাংলা সিরিয়ালের ডাইরেক্টর বলল, দেখো ভাই, এমনিতেই বাংলা সিরিয়ালের যা দশা, অনেক কস্ট কাটিং করে আমাদের চলতে হয়, তোমাকে কাস্টিং-এ নিলে আবার ডাবিং-এর জন্য আলাদা লোক হায়ার করতে হবে…মানে, সমস্যাটা বুঝেছ তো?

এতটা অপমান আর হজম হয়নি বিভানের। সেইদিনই ঠিক করে নিয়েছিল জীবনে আর অ্যাক্টিং মুখো হবে না। কিন্তু তা বলে আয়নার সামনে দাঁড়ানো বন্ধ হল না। কলেজ জীবন থেকেই ব্যায়াম আর জিম করে চেহারাটা বেশ বাঁটুল দি গ্রেট টাইপ করে ফেলেছিল ও, কিন্তু সিনেমা-সিরিয়ালে সে চেহারা দেখাতে না পেরে মনে মনে শুকিয়ে যাচ্ছিল বিভান। বাড়িতে মা বার বার চাপ দিচ্ছিল ওরে একটা চাকরি বাকরি কর এবার, নইলে নাতি-নাতনির মুখ দেখা তো দূরের কথা, ছেলের বউয়ের মুখটাও দেখে যেতে পারব না।

কিন্তু কে কার কথা শোনে? দাঁড়াও না, বিয়ের বয়স কি পেরিয়ে যাচ্ছে?

বিয়ের বয়স পেরোল কি পেরোল না, তা আমার জানার দরকার নেই, কিন্তু এবার চাকরি বাকরি না করলে নিজের রাস্তা দেখ। অনেকদিন খাইয়েছি, এবার নিজেরটা নিজে সামলাও। মুখ খুলেছিল বাবা।

এরপর আর মানুষের চামড়া নিয়ে বসে থাকা যায় না। কী করা যায় তাই নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনার পর বিভান কয়েকটা প্রাইভেট কোম্পানিতে ইন্টারভিউ দিয়ে বুঝল এই চাকরিবাকরি ওর দ্বারা সম্ভব নয়। অন্য কিছু করতে হবে। সুতরাং ব্যবসা। বেশ কয়েক রকমের ব্যবসা করার পর টের পেল ব্যবসাও অতি কঠিন ব্যাপার। হাল ছেড়েই দিচ্ছিল বিভান। তখন পাড়ার এক বন্ধু বলল, আরে বিজনেস হল জলের মতো সোজা।

মানে?

মানে এই সময়ের বাম্পার বিজনেস হল জল। বলে সেই বন্ধু বুঝিয়েছিল মানুষ এখন দু-বেলা এন্তার ফাস্ট আর জাঙ্কফুড খেলেও খাওয়ার জলের কেসে হেব্বি সচেতন হয়েছে। কেনা জল ছাড়া মুখে দিতে চায় না। তুই সিম্পলি জলের বিজনেসে নেমে যা। কলের জলে ক্লোরিন মেশাবি, আর বোতলে ভরে মিনারেল ওয়াটার বলে সাপ্লাই দিবি। ফ্রি ডেলিভারি। দেখবি বিজনেস রমরমিয়ে চলবে। কুড়ি টাকার লিটার। পুরোটাই প্রফিট।

চলবে?

চলবে মানে?

লোকে এখন জলের পিছনে জলের মতো টাকা ঢালে। ট্রাই করে দেখ।

বিভান ট্রাই করল, এবং দেখল কেস সত্যি। জল বিকোতে শুরু করল। পাড়া-বেপাড়ার লোক সোনা মুখ করে ক্লোরিন দেওয়া টাইমকলের জল মিনারেল ওয়াটার ভেবে খেতে থাকল। এই করেই বেশ কয়েকবছর চলল। মা বলল, এবার তুই বিয়ে কর। বাবাও খুব আপত্তি জানাল না। ততদিনে বিভানের বিয়ের বয়স পার হল বলে। বিভান বলল, আমার মেয়ে খোঁজার সময় নেই। তোমরা দেখ, আমি তোমাদের সঙ্গে রয়েছি।

বাবা বলল, সময় নেই না, বল মুরোদ নেই। অপদার্থ। বিয়ে করবে নিজে আর মেয়ে দেখে দিতে হবে আমাদের! নিজে একটা মেয়ে খোঁজার যোগ্যতা নেই তোর।

কথাটা খুব গায়ে লেগেছিল বিভানের। কিন্তু লাগলেও কোনও উপায় নেই। কণ্ঠস্বর ছাড়া বিভানের জীবনের আরও একটি সমস্যা হল, ওর চেহারাটা সুনীল শেঠি টাইপ হলেও মেয়েদের এক কিলোমিটার রেডিয়াসের মধ্যে এলেই ওর ঘনঘন গলা শুকিয়ে যায়, কপালের দুপাশে চিনচিনে ঘাম হয়, বারবার রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে ইচ্ছে করে ইত্যাদি নানাধরনের উপসর্গ। এর ফলে বিভান স্কুল-কলেজ জীবনে কোনও মেয়ে বন্ধুর সঙ্গে ঘনিষ্ট হওয়া তো দূর, ধারেকাছেও ঘেঁষতে পারেনি। বেচারা দূর বহুদূর থেকেই আপন মনে বাঁশি বাজিয়েছে।

বয়স গড়ানোর পরেও স্বভাবটা বদলায়নি। ফলে বিভান এবারেও মেয়ে খুঁজতে পারল না, আর মা-ও বহু খুঁজে পেতে যাও বা দুই-চারটে বেছে বুছে এনেছিল তাদের একজনকেও মনে ধরল না বিভানের। বিপাশা বসু পাওয়া যাবে বলে ললিতা পাওয়ার? এতটা বাড়াবাড়ি ঠিক নয়, তার থেকে কার্তিক থেকে লাইফ কাটানো ঢের ভালো। বিয়েই করব না, যাহ… এমনই একটা সিদ্ধান্ত প্রায় নিয়েই ফেলেছিল বিভান, ঠিক সেই সময় মার্ক জুকেরবার্গ এলেন পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের ত্রাণকর্তা হয়ে। ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খুলল বিভান। বন্ধুর সংখ্যা বাড়ানো নেশা হয়ে দাঁড়াল। শুধু তাই নয় অহরহ নিজের ছবি পোস্ট করল বিভিন্ন পোজে। কোনওটায় তেত্রিশটা লাইক তো কোনওটায় সাতান্ন। মাঝেমাঝে কমেন্টও পড়ে। ওয়াও, হোয়াট এ ফিজিক! খুব সুন্দর পোজ, সিনেমায় ট্রাই নাও। ইত্যাদি কমেন্ট পড়ে বিভানের মনোজগতে বিপ্লব ঘটে গেল। বিভান বুঝল এখানে কথা মানে লেখা, মানে কণ্ঠস্বর শোনানোর প্রয়োজন নেই, সুতরাং মার দিয়া কেল্লা। বিভান এন্তার সুন্দরী মহিলাদের ফ্রেন্ড রিকু পাঠাতে থাকল। কেউ নিল, কেউ নিল না। যারা নিত তাদের সঙ্গে বিভান শুরু করল খেজুর। হাই কেমন আছেন? আপনি কী করেন? লাঞ্চ হল? ডিনারে কী খেলেন? ইত্যাদির পরেই নিজের বায়োডাটা প্লেস করতে শুরু করল বিভান। কেউ বিরক্ত হয়ে বিভানকে ব্লক করল, কেউ স্ক্রিনশট ছড়াল। কিন্তু বিভান ততক্ষণে অপ্রতিরোধ্য। লজ্জা, ঘৃণা, ভয়, তিন থাকতে বিয়ে হওয়ার নয়—সেটা ভালো করেই বুঝে গিয়েছিল।

কত রঙিন প্রজাপতি ফেসবুকের বাগানে, আকাশে, ঝোপে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এর মধ্যে একটাও কি বিভানের হাতে ধরা পড়বে না? দেবে, নিশ্চয়ই ধরা দেবে। বিভান ট্রাই করে চলল। করতে করতে অবশেষে ধরা দিলেন তিনি। শ্বেতা প্রামাণিক। সেলফ এমপ্লয়েড, বারাসাতবাসী এবং সিঙ্গল। রূপ, অপসরা বিশেষ। দুই চোখে লাল-নীল দেখল বিভান। হাই-হ্যালোর দুই দিন পেরোতে না পেরোতেই মেসেজ বক্স উপচে পড়তে থাকল বিভানের। কী করছেন? কেমন আছেন? আমি একটু বেরিয়েছি। উফফ খাওয়া-দাওয়া লাটে উঠল বিভানের। তারপরেই এল সেই অভাবনীয় স্বপ্নমাখা দিন। শ্বেতা প্রামাণিক এক সকালে জিজ্ঞাসা করল, হ্যালো ঘুম হল?

হ্যাঁ, মানে ওই আর কী?

ওই আর কী মানে?

মানে ঠিকঠাক হয়নি।

সেকি কেন?

অনেক স্বপ্ন দেখেছি একজনকে নিয়ে।

ওহ রিয়্যালি! তা কার স্বপ্ন দেখলেন?

বিভান ফেসবুকের চ্যাটে ম্যাস্টারডিগ্রি। এতদিন গুঁতোগাঁতা খেয়ে ভালো করে বুঝে গিয়েছে কখন কী উত্তর দিতে হয়। জুকেরবার্গ সব ব্যবস্থাই রেখেছেন শুধু খুঁজে নিতে হবে। বিভান উত্তরে একটি লাভ সাইন পাঠাল আর সঙ্গে ডট ডট ডট।

ওদিক থেকেও ধুকপুক করতে থাকা লাল হার্টের ছবি এল। বিভানের বুক ধড়াস করে উঠল। লেগেছে…এবার লেগেছে!

কিছুক্ষণ চুপ। বিভান আর উত্তেজনা সামলাতে পারল না, জিজ্ঞাসা করল কিছু বলবেন না?

রিপ্লাই এল। আপনি এখনও সিঙ্গল?

উফফফফ জিও! বিভান লিখল, ইয়েস।

একটা কথা জানতে পারি?

হ্যাঁ শিয়োর। বিভান মনে মনে বলল যা খুশি জানতে চাও। সব, সব, সবই তোমার।

আপনি সত্যিই সিঙ্গল?

হ্যাঁ, আমার ইনফোতেও তাই-ই দেওয়া রয়েছে।

হুঁ দেখেছি। আসলে অনেকেই বাজে কথা লেখে তো…

আমি বাজে কথা একদম বলি না।

সো কিউট! আমার আরেকটা কথা জানার রয়েছে।

হ্যাঁ বলুন।

আপনার এজটা একটু বলবেন প্লিজ?

এই তো…একটু থেমে নিয়ে বিভান লিখল থার্টি এইট ওনলি। ওনলি লেখাটা ঠিক হল কি না কনফিউজড হয়ে গেল বিভান। কিন্তু ততক্ষণে মেসেজ সেন্ট হয়ে গিয়েছে।

ভেরি গুড। আপনাকে একটু পরেই আবার পিং করছি। বলে অফ হয়ে গেল শ্বেতা প্রামাণিক।

বিভান অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে করতে দুপুর পার করে বিকেল শেষ করে ফেলল, কিন্তু পিং আর এল না। ধৈর্য রাখতে না পেরে বিভানই পিং করল, হ্যালো।

ওহ হাই—রিপ্লাই এল।

পিং করলেন না তো? ওয়েট করছিলাম। বিভানের গলায় অনুযোগের সুর। বেশ একটা অধিকার অধিকার বোধ অলরেডি আসতে শুরু করে দিয়েছে।

ওহো ভেরি সরি, কাজের প্রেশারে ভুলেই গিয়েছিলাম। বলুন কী খবর?

এই তো…

আচ্ছা শুনুন, আমরা কি একবার মিট করতে পারি কোথাও?

নিজের চোখকে বিশ্বাস হল না বিভানের। লিখল, শিয়োর। হোয়াই নট?

তাহলে কবে আপনি ফ্রি রয়েছেন বলুন?

আমি… সব সময়ই ফ্রি বলাটা ঠিক হবে না। বিভান লিখল, কাল বিকেলের দিকে ফ্রি রয়েছি।

কোনও ব্যাপার না, কখন আর কোথায় বলুন?

আপনার কোনদিকে সুবিধা বলুন আমি চলে যাব।

শ্বেতা বলল আমারও কোথাও প্রবলেম নেই, তবে বিকেলের দিকটায় মিন্টোপার্কের কাছে থাকব।

খুব ভালো, আমি ওখানেই চলে আসব। কোথায় দেখা করবেন বলুন? উৎসাহে টগবগ করে ফুটতে থাকল বিভান।

যদি আপনার সমস্যা না হয় তাহলে একটা কফিশপ রয়েছে, সেখানেই বসতে পারি।

বিভান ভেবেছিল শ্বেতা নিশ্চয়ই ওকে মিন্টোপার্কের মধ্যেই ডাকবে। কিন্তু কফিশপও ভালো। পার্কে মশা কামড়াতে পারে, বিভানের মশায় অ্যালার্জি।

আপনার জন্য একটা প্রেজেন্টেশন আনব। না করতে পারবেন না কিন্তু।

উফফফ, মনে মনে পুরো গলে জল হয়ে গড়িয়ে গেল বিভান। পথম দিনেই প্রেজেন্টেশন, মানে উপহার!

চ্যাটবক্সে আবেগের চোটে একটা চুমুর ইমোটিকন দিয়েই ফেলল বিভান।

রিপ্লাই এল পালটা চুমুর। কেস পুরো জমে ক্ষীর। তবে এই বয়েসে আর বেশি ঝুলিয়ে লাভ নেই। সেরকম বুঝলে কালই বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে ফেলতে হবে।

আপনার সেল নাম্বারটা…

বিভান নিজের মোবাইল নাম্বার দিল, ওরটা নিল। তারপর পরস্পরকে টা টা দিয়ে বিভান ঘেমে নেয়ে স্নান করে দু-হাত ছড়িয়ে ইয়াহু করে উঠল। কিন্তু শ্বেতা প্রেজেন্টেশন মানে গিফট আনবে বলেছে, তাহলে ওর জন্যও কিছু একটা কেনা দরকার। কী কেনা যায়? বিভানের মাথায় এল না। ফ্লাওয়ার ভাস থেকে ডিনারসেট, চকোলেট থেকে ক্যাশারোল, টোস্টার সবকিছু ভেবে অস্থির হয়ে হঠাৎ মনে হল মেয়েরা একটা জিনিসেই কাত। তা হল সোনা। এখন কত করে ভরি চলছে কে জানে? তবে দিলে ক্ষতি নেই, বাড়ির জিনিস বাড়িতেই ফেরত আসবে। আর বেশি না ভেবে বিভান বেরিয়ে পড়ল বাইক নিয়ে। সাড়ে নয় হাজার টাকা দিয়ে একজোড়া দুল কিনে ফেলে অপেক্ষা করতে থাকল আগামীকাল বিকেলের।

কফি শপটা বেশ। এয়ারকন্ডিশন্ড। বিভানকে মিনিট পনেরো বসে থাকতে হল। তারপরেই কফিশপ আলো করে ঢুকল শ্বেতা। প্রস্ফুটিত মুক্তোর মতো দন্তরাজি নিয়ে নীলচে চোখের তারায় ঝিলিক দিয়ে ফিনফিনে বাদামি কেশরাশি উড়িয়ে শ্বেতা জিজ্ঞাসা করল—হাই, সরি ফর বিইং লেট। বিভান স্পষ্ট দেখতে পেল গোটা পৃথিবীতে যেন পূর্ণিমা রাত, আর সেই চাঁদনী রাতে বেশ কয়েকটি কোকিল গলা সাধছে। নাহ, ফেবুর ফটোশপ সুন্দরী নয়, রিয়্যাল জিনিস।

কালো রঙের শাড়ি আর ব্লাউজে কী যে অসাধারণ লাগছে শ্বেতাকে! গায়ের রং ছবির তুলনায় বেশ চাপা। কিন্তু ফিগার? উফফ কিছু বলার নেই!

শ্বেতা সামনে এসে বসতেই জুঁই, কুন্দ, দোলনচাঁপা ইত্যাদি সব ফুলের গন্ধে চারদিক ভরে গেল।

বিভান কী করবে বুঝে না পেয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াচ্ছিল, শ্বেতা মিষ্টি হেসে বলল, আরে বসুন বসুন।

অসম্ভব টেনশন হচ্ছে বিভানের। কী কপালে আছে কে জানে?

আপনি বসুন—বলল বিভান। নিজের অমন সুমধুর কণ্ঠস্বরে কথা বলার ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু এখন আর উপায় নেই। কিন্তু বিভান খুব অবাক হয়ে দেখল শ্বেতা ওর গলার শব্দে সামান্যতম বিচলিত হল না। এই হয়, ভালোবাসলে মনটাই আসল, বাকি সব তুচ্ছ। শ্বেতা, তুমি যে আমার।

শ্বেতা ওর কাঁধ থেকে একটা লেদারের দামি ব্যাগ খুব সাবধানে টেবিলের পাশে রাখল। তারপর বলল, বলুন কেমন আছেন?

আমি তো খুব ভালো।

থ্যাঙ্কস টু ফেসবুক। দেখুন দু’জনের কেমন পরিচয় হয়ে গেল।

সে আর বলতে! গদগদ হয়ে বলল বিভান।

আমার অনেক বন্ধু হয়েছে ফেসবুকের জন্য।

আমারও। আচ্ছা কী খাবেন বলুন?

কিচ্ছু না, স্রেফ কফি।

যাহ তাই আবার হয়! কিছু একটা খান।

আচ্ছা খুব সামান্য কিছু। লিপস্টিক মাখা দুই মায়াবি ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে মুক্তোর মতো কয়েকটি দাঁত ঝিলিক দিল। কাউন্টারে গেল বিভান। প্রতিটা আইটেমই শালা আগুন দাম! দুই কাপ কফি আর দুটো মাংসের পুর দেওয়া পাঁউরুটি কিনতে প্রায় ছ’শো টাকা বেরিয়ে গেল। কিন্তু ফার্স্ট ইম্প্রেশন ইজ দ্য লাস্ট ইম্প্রেশন। প্রথমেই কিপটেমি দেখালে খারাপ ভাবতে পারে। পেমেন্ট করে আবার যখন টেবিলে ফিরে এল শ্বেতা ততক্ষণে নিজের ব্যাগ থেকে ল্যাপটপ বার করেছে। এই সেরেছে! এখন আবার কী দেখাবে! নিজের ছবি-টবি হয়তো। সে তো পছন্দ হয়েই গিয়েছে।

শ্বেতা হেসে বলল, আপনার জন্য কিন্তু আমি একটা দারুণ প্রেজেন্টেশন নিয়ে এসেছি, না করতে পারবেন না।

শুনে হে হে করে হাসল বিভান। তারপর হিরোয়িক স্টাইলে বলল, আমিও একটা সামান্য জিনিস প্রেজেন্ট করতে চাই আপনাকে। না বলতে পারবেন না।

আমার জন্য। ওহ, সো সুইট! কী জিনিস দেখি দেখি?

বিভান পকেট থেকে ভেলভেটের ছোট বাক্সটা বা করল, তারপর কায়দা করে শ্বেতার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, দেখুন তো পছন্দ হয় কিনা, আমি যদিও এসব কেনার ব্যাপারে একেবারেই আনাড়ি।

শ্বেতা বক্সটা খুলেই সে কী উচ্ছ্বাস! ওয়াও, হাউ সুইট! কী সুন্দর হয়েছে!

পছন্দ হয়েছে আপনার?

দারুণ। কিন্তু এসব কেন করতে গেলেন?

বাহ রে, করব না! আপনি আমাকে প্রেজেন্টেশেন দেবেন আর আমি খালি হাতে আসব তাই কখনো হয়!

হিহিহি করে হেসে উঠল শ্বেতা।

ওয়েটার কফি আর খাবার দিয়ে গেল। বিভান দেখল শ্বেতা কয়েক কামড়ে বার্গারটা শেষ করে কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলল, এবার আপনার প্রেজেন্টেশনটা দেখাই, আপনারও কাজ রয়েছে। আমাকেও তাড়াতাড়ি উঠতে হবে। আপনার পর আরও একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট রয়েছে।

অ্যাপয়েন্টমেন্ট! কীসের! খটকা লাগল বিভানের। চুপ করে থাকল। শ্বেতা চটপট ল্যাপি অন করে, মিনিট কয়েক খুটখাট করল তারপর একগাল হেসে বলল, এই দেখুন আমি নিজে করেছি এটা আপনার জন্য। বলে বিভানের দিকে ল্যাপিটা ঘুরিয়ে যা দেখাল তা দেখে কয়েক সেকেন্ডের জন্য ব্ল্যাকআউট হয়ে গেল বিভান। এটা কী! একটা এক্সেল শিট। তারপর বিভানের নাম, ঠিকানা, বয়স ইত্যাদি লেখা। নীচে খোপ কাটা একেকটা ঘরে অদ্ভুত সব কথা লেখা, প্রিমিয়াম পেইড, ইয়ার, ম্যাচিউরিটি ভ্যালু আরও কী কী যেন…

কী এটা!

বুঝিয়ে দিচ্ছি। আমার আসলে ডাকডাক ইন্সিওর্যান্সের এজেন্সি নেওয়া রয়েছে তো, যখন আপনার সঙ্গে পরিচয় হল আর জনলাম আপনি এখনও ব্যাচেলর তখনই মনে হল বিয়ে তো ঠিকই করবেন। তাই এটাই হল সেভিংস শুরু করার বেস্ট টাইম। আমি এই প্রেজেন্টেশেনটা নিজে হাতে বানিয়েছি স্রেফ আপনার জন্য। দেখুন আপনি যদি এই ইয়ারে থার্টি থাউজেন্ড প্রিমিয়াম পে করেন তাহলে আফটার টুইয়েন্টি ইয়ার…

বিভান হাঁ করে তাকিয়েছিল শ্বেতার দিকে আর শ্বেতা কীসব যেন বলে যাচ্ছিল ম্যাচিউরিটি ভ্যালু, আফটার ডেথ, নমিনি, রিটার্ন আরও কী কী যেন…।

চোখে চল জলে আসছিল বিভানের। শালা ছোটবেলা থেকে প্রেজেন্টেশনের একটাই মানে জানত, উপহার, তার যে আরও মানে রয়েছে…!

শ্বেতা আরও কী কী সব বলে আবার একগাল হেসে বলল, আমি জানি আপনার নিশ্চয়ই এটা ভালো লাগবে। বলুন কবে আপনার বাড়িতে এক্সিকিউটিভ পাঠাব? জাস্ট একটা চেক আর কয়েকটা ডকুমেন্টের ফটোকপি লাগবে।

বিভানের সামনে কফি আর মাংসের পুর দেওয়া পাঁউরুটি পড়ে রয়েছে। একটাও চুমুক দেওয়া হয়নি। সোনার দুলটা ইচ্ছে করছে শ্বেতার ব্যাগের ভেতর থেকে খামচে বার করে নিতে।

ফেসবুক থেকে আমার অনেক ক্লায়েন্ট পেয়ে যাই জানেন, তাদের সঙ্গে খুব ভালো ফ্রেন্ডশিপও হয়ে যায়।

বিভান অতি কষ্টে হাসল।

মোবাইল বেজে উঠল শ্বেতার। হ্যাঁ স্যার…নো নো স্যার, জাস্ট টেন মিনিটস, ইয়েস আয়্যাম রিচিং…প্লিজ স্যার…থ্যাঙ্ক ইউ। ফোন রেখে শ্বেতা বলল বলুন কেমন লাগল?

ভালো…

থ্যাঙ্কস। আমি জানতাম আপনার ভালো লাগবে। আপনার বাড়িতে কি তাহলে কাল এক্সিকিউটিভ পাঠাব?

কাল… তো থাকছি না। আমি দিল্লি চলে যাচ্ছি কাজে।

ওহ, বাট প্লিজ লেট করবেন না। এই অফারটা খুব লিমিটেড কাস্টমারদের জন্য। আপনি অনলাইনেও করে দিতে পারেন। আপনার মেল আইডিটা বলুন আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। পেমেন্টও অনলাইনে হয়ে যাবে।

বিভান একটা মেল আইডি দিল।

শ্বেতা সেটা টুকে নিয়ে ল্যাপি অফ করে বলল, আচ্ছা শুনুন না, আমাকে এবার উঠতে হবে, আরেকটা ভিজিট রয়েছে। ক্লায়েন্ট খুব তাড়া দিচ্ছে, সো আজ উঠলাম। আপনি ফিরলে জানাবেন। আর এফবিতে কথা হবে। আমি আজ রাতেই আপনাকে সব ডিটেল মেল করে দেব। বলে ব্যাগ গুছিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল শ্বেতা। বিভানও যন্ত্রের মতো উঠে দাঁড়াল।

আরে, আপনি এখনও কিছুই খাননি তো। প্লিজ…খেয়ে নিন। সরি আজ আমাকে বেরিয়ে যেতে হচ্ছে। ওহ, থ্যাঙ্কস এগেইন ফর ইয়োর প্রেসাশ গিফট। বাই।

কাচের দরজা খুলে বেরিয়ে গেল শ্বেতা। চেয়ারে থম মেরে বসে রইল বিভান। ঠান্ডা কফি আর বার্গারের সামনে। মেল আইডিটা ভুল দিয়েছে। এটাই বাঁচোয়া। শ্বেতার মোবাইল নাম্বারটা ব্লক করল তারপর ফেসবুক অ্যাকাউন্টটা ডিঅ্যাকটিভেট করার আগে ভাবল জুকেরবার্গকে ফেসবুকের অপকারিতা নিয়ে একটা কড়া চিঠি লেখা দরকার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *