ছায়ানট

ছায়ানট

জীবনে কিছু রহস্য থেকে যাওয়া ভালো, বুঝলেন কি না। বলে কলপ দেওয়া গোঁফের আড়াল থেকে কয়েকটি পরিষ্কার দাঁত বার করে সামান্য হাসলেন রাজকুমার শাউ। হাতে ধরা দামি চায়ের কাপটা টি-টেবিলের ওপর রেখে দিয়ে আবার বললেন, সব রহস্য উদঘাটন করা যায় না, করা উচিতও নয়।

কিছুক্ষণ আগে রাতের খাওয়া শেষ হয়েছে। বেশ এলাহি আয়োজন ছিল। খাওয়াদাওয়ার পরে গ্রিন টি। বেশ লাগছে।

আমি আর সৈকত রাজকুমারবাবুর মুখের দিকে তাকালাম। ওঁর কথাটাই বেশ রহস্যময়।

পোড় খাওয়া ব্যবসায়ী রাজকুমার শাউ আমাদের মুখের দিকে একঝলক তাকিয়েই বুঝে গেলেন আমরা ওর কাছ থেকে আরেকটু ডিটেল আশা করছি।

বেশি হেঁয়ালি করে ফেললাম নাকি? তা সৈকত, তোমার বাবা, মানে রজত কিন্তু হেঁয়ালিতে ওস্তাদ ছিল। মুখে মুখে ধাঁধাঁ বানাতে পারত।

কাকাবাবু বাবা এই বয়েসেও সেটা পারে।

তাই! হা হা হা! এটা ওর জন্মগত প্রতিভা। ইস্কুল জীবন থেকেই ব্যাটা এমন।

আমি সুযোগ পেয়ে টোকা দিলাম রাজকুমারবাবুকে। আপনি একটু আগে যে রহস্য নিয়ে কথাটা বললেন ওটা একমাত্র তারাই বলতে পারে, যাদের জীবনে এমন কিছু ঘটেছে। আমার ধারণা…বাকিটকু বলতে গিয়েও থেমে গেলাম।

রাজকুমারবাবু আমার দিকে সামান্য ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রয়েছেন।

থামলেন কেন, বলুন, নির্দ্বিধায় বলুন।

বলতে পারি, তবে আমাকে তুমি সম্বোধন করতে হবে। কারণ সৈকত আমার বন্ধু।

আচ্ছা বেশ বেশ। বলো।

আমার ধারণা আপনার জীবনেও এমন কিছু রহস্যজনক ঘটেছে, যা আপনি ভুলতে পারেননি।

রাজকুমারবাবু আমার কথা শুনে কয়েক মুহূর্ত চুপ থাকলেন, তারপর আবার সেই মুচকি হেসে বললেন, তুমি বুদ্ধিমান।

এবার সৈকত বলল, ঠিক ধরেছেন জেঠু, অর্ণবের বুদ্ধি খুব প্রখর। আসলে লেখক তো।

তাই নাকি! তুমি লেখালেখি করো? ভেরি গুড। কী লেখো?

আমি সংকোচ নিয়েই বললাম, না না তেমন কিছু নয়, ওই টুকটাক শখ আর কি। গল্পটল্প…

খুব ভালো। আমার জীবনে অনেক গল্প রয়েছে জানো, কিন্তু সময় আর প্রতিভার অভাবে লিখে উঠতে পারলাম না। তোমার যখন দুটোই রয়েছে তখন লেখো…লেখো। বললেন রাজকুমারবাবু।

গল্প হচ্ছে রাজকুমারবাবুর ড্রয়িংরুমে। বর্ধমান স্টেশনের খুব কাছেই মেন রাস্তার ওপরে রাজকুমার শাউয়ের বিশাল বাড়ি। বনেদি বড়লোক। এখানে আজ সন্ধেবেলায় আমি আর সৈকত এসেছি একটি বিশেষ দরকারে। দরকারটি হল সৈকতের বিয়ের নেমন্তন্ন করতে আসা। আমার বিয়ে বছর দুয়েক আগেই হয়েছে। এবার সৈকতের হবে। আমি আর ও কলেজ জীবনের মানিকজোড়। আর সৈকতের বাবা বিশ্বনাথ সেন আর এই রাজকুমার শাউ হলেন স্কুল জীবনের বন্ধু। চাকরি পেয়ে কলকাতায় পাকাপাকিভাবে চলে আসার আগে পর্যন্ত সৈকতদের বাড়িও ছিল এই বর্ধমানেই। অনেকদিন হয়ে গেছে সৈকতের বাবা কলকাতায়, কিন্তু রাজকুমারবাবুর সঙ্গে বন্ধুত্বে ছেদ পড়েনি। নিয়মিত যাতায়াত কমে গেলেও ফোনে যোগাযোগটা রয়েই গেছে।

সৈকতের কাছে এই রাজকুমারবাবুর অনেক গল্প শুনেছি আমি। তাই ওর বিয়ে ঠিক হওয়ার পর সৈকতের বাবা যখন বললেন রাজকুমারবাবুর বাড়ি গিয়ে তাঁকে নেমন্তন্ন করতে, তখন সৈকত আমাকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করেছিল, আমার সঙ্গে যাবি নাকি?

আমি এককথায় রাজি হয়ে গেছিলাম। আজ বিকেলে এসে পৌঁছেছি। আজ রাতটা থেকে কাল সকালে রওনা দেওয়ার ইচ্ছে। আসার পথে ট্রেনে সৈকতের কাছে আরও অনেক গল্প শুনেছি রাজকুমারবাবুর। পূর্বপুরুষ জমিদার ছিলেন। রাজকুমার আর শিবকুমার দুই ভাই। সম্পত্তি ভাগাভাগি হয়ে যাওয়ার পর ভাই শিবকুমার আলাদা বাড়িতে থাকে। তবে সদ্ভাব রয়েছে। রাজকুমারের বিভিন্ন ব্যবসা রয়েছে। খুব সৌখিন মানুষ। জমিদারি মেজাজটা এখনও রয়েছে ষাট বছর পার করার পরেও। সেটা নিজের চোখেই দেখেছি। যেমন রূপবান তেমনই ভারী কণ্ঠস্বর। গিলে করা সাদা পাঞ্জাবি আর ধুতি, গলায় সোনার চেন, আঙুলে অনেকগুলো আংটি সবকটাই সোনার। এই বয়েসেও মাথাভরা চুল এবং কলপ করা।

সৈকতের কাছে শুনেছি আপনার ঝুলিতে অনেক অভিজ্ঞতা রয়েছে। তার মধ্যে যদি একটা-দুটো বলেন তাহলে বেশ একটা জমিয়ে গল্প লেখার চেষ্টা করতে পারি।

হা হা হা এই হল জাত লেখকের কথা। ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠলেন রাজকুমারবাবু। তারপর বললেন, একটা ঘটনা তোমাকে বলতে পারি। একদম সত্যি ঘটনা, কিন্তু তাই দিয়ে গল্প লেখা যায় কি না বা আদৌ বিশ্বাসযোগ্য গল্প হবে কি না সেটা তোমাকে বুঝে নিতে হবে।

ঠিক বুঝলাম না।

আসলে আমার সিনেমা হলটিকে নিয়ে এমন কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছিল যা বুদ্ধি, যুক্তি দিয়ে ব্যখ্যা পাইনি আজও। সেই জন্যই বললাম আর কি।

আপনি বলুন, ইনফ্যাক্ট গল্প শোনার লোভেই আমার এখানে আসা। আমি নড়ে চড়ে বসলাম।

হুঁ। শোনো তাহলে। বলে একটা কিংসাইজ গোল্ডফ্লেক ধরিয়ে আয়েশ করে বসে বলতে শুরু করলেন রাজকুমারবাবু।

সৈকত জানে আমাদের এই বাড়ির ঠিক পিছনেই যে শপিং মলটা রয়েছে, ওখানে আগে একটা সিনেমা হল ছিল। আমার ছোটবেলার স্বপ্ন ছিল নিজস্ব একটা সিনেমা হলের। বিশ্বনাথ আমার এই স্বপ্নের কথা জানত। দুই বন্ধুতে কথা ছিল আমি সিনেমা হল বানালে সেই হলের নাম দেবে ও।

তাই যখন পড়াশোনা শেষ করে পৈতৃক ব্যবসায় হাত লাগালাম তখন থেকেই নিজের লাভ্যাংশের টাকা জমাতে শুরু করেছিলাম। বিশ্বনাথ চাকরি পেয়ে কলকাতায় চলে গেল, আমিও ব্যবসায় মেতে গেলাম। বয়েস বাড়লে অনেকের অনেক স্বপ্নই ফিকে হয়ে যায়, কিন্তু আমার হয়নি। আমি পুষে রেখেছিলাম স্বপ্নকে। বাড়ির পিছনের জমিটায় বানালাম হল। বিশ্বনাথ নাম দিল ছায়ানট। এখনও উদবোধনের দিনটা মনে পড়ে। হাজার হাজার লোক এসেছিল দেখার জন্য। টলিগঞ্জের সেই সময়কার নাম করা সব অভিনেতা, পরিচালক, প্রযোজকদেরও এনেছিলাম। এলাহি ব্যপার হয়েছিল সেদিন। বিশ্বনাথও এসেছিল সপরিবার। সৈকত তখন মাতৃক্রোড়ে।

হ্যাঁ উদবোধনের কোনও স্মৃতিই আমার নেই, তবে পরে বাবার সঙ্গে যতবার এই বাড়িতে এসেছি সিনেমা দেখেছি এইটুকু মনে আছে। একবার তো হাউজফুল, মিঠুনের কী একটা সিনেমা চলছিল। আমি বায়না করলাম দেখবই। অথচ বসার সিট নেই। শেষে এই বাড়ি থেকে চেয়ার নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আমার বসার জন্য। বলে হেসে উঠল সৈকত। তবে হ্যাঁ, বলে আমার দিকে তাকিয়ে সৈকত আবার বলল, ছায়ানট একটা দেখার মতো হল করেছিলেন জেঠু। এখনকার যেকোনও মালটিপ্লেক্সকে লজ্জায় ফেলে দেবে। যেমন বিশাল তেমনই ব্যবস্থা। কী বিরাট স্ক্রিন ছিল পুরোটা চোখে আঁটত না।

হ্যাঁ ঠিকই বলেছ সৈকত, ছায়ানটকে আমি আমার স্বপ্নের মতো করেই বানিয়েছিলাম। আমি বরাবরই একটু শৌখিন মানুষ। যা করেছি নিখুঁতভাবে করার চেষ্টা করেছি। ইচ্ছে ছিল এমন একটা সিনেমা হল বানাব যা এই অঞ্চল তো দূরের কথা কলকাতার নামিদামি হলদেরও টেক্কা দেবে। তা সত্যি বলতে কী, দিয়েওছিল। ছায়ানটকে আমি যা দিয়েছিলাম সেও আমার প্রতি কৃপণতা করেনি। কত দূর দূর থেকে দর্শক আসত এই হলে সিনেমা দেখবে বলে। এইটটি টু-তে ছায়ানট করলাম তারপর পুরো দুহাজার এক-দুই পর্যন্ত চলল। অবশ্য চলল বলা ভুল হল, খানিকটা জোর করেই চালানো বলা যেতে পারে। দর্শক কমতে শুরু করেছিল। আসলে বাজারে সিডি ঢুকে যাওয়ার পরই সিনেমার ব্যবসা মার খেতে শুরু করেছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম, ছায়ানটের দিন ঘনিয়ে আসছে। শেষ তিন-চার বছর পুরো শ্মশান পাহারা দেওয়ার মতো করে আমি আর আমার স্টাফরা মিলে আগলে রেখেছিলাম ওকে। কিন্তু দর্শক হল সিনেমার প্রাণ। তারা না আসলে হল মরে যেতে বাধ্য। আর আমিও একটানা লস টেনে যেতে পারছিলাম না। প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা খরচ, অথচ ইনকাম নেই। দু’হাজার তিনে আমার স্বপ্ন বন্ধ হয়ে গেল। বলে থামলেন রাজকুমারবাবু। লম্বা শ্বাস ছাড়লেন।

আমি দেখলাম অমন রাজকীয় চেহারায় অন্ধকার ছাপ পড়েছে। কষ্টের ছাপ।

আপনার বলতে কষ্ট হলে থাক। বললাম আমি।

নাহ এতদিন পর আর কষ্ট কীসের? আর তুমিও ভাবছ এই গল্পে রহস্যটা কই? আছে রহস্য আছে, সেটা বলার জন্যই এতগুলো কথা তোমার জানা দরকার। একটু ধৈর্য ধরে শোনো।

না না, আমি খুব মন দিয়েই শুনছি। আসলে আপনার বলতে খারাপ লাগছে মনে হল, সেই কারণেই…

হুম…খারাপ লাগলেও সেই তীব্রতাটা আর এখন নেই। বলে আর একটা সিগারেট ধরালেন উনি। আবার বলতে শুরু করলেন। মুন্নাভাই এমবিবিএস সিনেমাটার নাম নিশ্চয়ই তোমাদের মনে রয়েছে? সঞ্জয় দত্ত আর আরশাদ কুরেসি। সুপারডুপার হিট হয়েছিল সিনেমাটা।

হ্যাঁ জেঠু, মনে রয়েছে। দারুন মুভি।

হ্যাঁ, ওটাই ছায়ানটের শেষ শো ছিল। ওই শো আমি নিজে বসে দেখেছিলাম। সত্যি বলতে ছবি যখন শেষ হল আমি চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি। একসময় এই ছায়ানটে সিনেমা দেখবে বলে ভোর বেলা থেকে কাউন্টারের সামনে লাইন দিত মানুষ আর সেদিন হলে সব মিলিয়ে দশজনও ছিল না। আসলে লোকে আসাই বন্ধ করে দিয়েছিল। হল বন্ধ করে দিলাম। টানা চার বছর বন্ধ থাকল আমার ছায়ানট। তারপর বিক্রি করে দিলাম একটা কোম্পানিকে। চোখের সামনে আমার ছায়ানট গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেল। উফ, কী যে কষ্ট হয়েছিল তা বলে বোঝাতে পারব না। ছায়ানট যখন ভাঙা হচ্ছিল তখন হাতুড়ির এক একটা ঘা যেন আমার বুকের ওপরে পড়ত। বড় যন্ত্রনার দিন কাটিয়েছি সেই সময়টা। তবে যে কোম্পানিকে জায়গাটা বেচেছিলাম তারা আমার একটা অনুরোধ রেখেছিল, মলটার নাম ছায়ামল দেবে। সেইকথা তারা রেখেছে। অবশ্য শুধু আমার কথা রাখার জন্যই নয়, তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থও ছিল। যেহেতু ছায়ানটের খুব নাম ছিল এই অঞ্চলে, তাই ছায়ামল নাম দিলে পরিচিতি দ্রুত হবে। আর এই জায়গাটা এমনিতেই বুঝতে পারছ খুবই দামি।

আমার সঙ্গে এই প্লটটা কেনার জন্য আরও দুটো কোম্পানি কথা বলেছিল কিন্তু তারা তাদের ব্র্যান্ডের সঙ্গে আমার ছায়ানটের নাম জড়াতে চায়নি, তাই আমিই ক্যানসেল করেছিলাম তাদের। যাই হোক। মল হল, মালটিপ্লেক্সও হল। তিনটে হল। দু’হাজার আটের ফিফথ ডিসেম্বর নতুন মল উদবোধন হওয়ার কথা। কাকতালীয়ভাবে যেদিন আমার ছায়ানট ভাঙার জন্য প্রথম হাতুড়ির ঘা পড়েছিল, সেদিনটাও ছিল ফিফথ ডিসেম্বর। আমি মাল্টিপ্লেক্সের কর্তাদের অনুরোধ করলাম প্রথম দিন একনম্বর হলে প্রথম যে সিনেমার শো হবে তার সব টিকিট আমি কাটব। বাইরে যেন কোনও টিকিট বিক্রি করা না হয়।

এবার আমি সামান্য চমকে উঠলাম। সেকী! সব টিকিট! কেন?

রাজকুমারবাবু মুচকি হাসলেন তারপর বললেন। আসলে এতগুলো বছর পর আবার ওই জমির ওপর সিনেমা হবে, না হোক আমার ছায়ানট, তবু সিনেমা তো! সেইজন্য আমার মাথায় একটা খেয়াল চেপেছিল, আমার ছায়ানটে এমন বহু দর্শক ছিলেন যাঁরা নিয়মিত ছবি দেখতে আসতেন। তাঁদের অনেকের সঙ্গেই আমার বেশ ভাল সম্পর্ক হয়ে গেছিল। সকলেই লোকাল। নিয়মিত রাস্তাঘাটে দেখাসাক্ষাতও হতো। ছায়ানট বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তারাও খুব দুঃখ পেয়েছিলেন কারণ ওরা ছিলেন সিনেমার পোকা। আর বড় স্ক্রিনে ছবি দেখার নেশা যার রয়েছে, তাকে তুমি ছোট স্ক্রিনে কিছুতেই মন ভরাতে পারবে না। আমার ইচ্ছে হয়েছিল এতকাল বাদে যখন আবার ছবি দেখানো হবে তাহলে ওই পুরোনো মানুষগুলোর সঙ্গে আমি নিজে বসে প্রথম সিনেমাটা দেখব। কিছুটা নস্টালজিক ব্যাপার বা খ্যাপামো, যা খুশি বলতে পারো। প্রথম শোতে আমি দুশো টিকিটই কেটে ফেললাম। পরেশ রাওয়ালের কমেডি ফিল্ম ‘ওহ মাই গড’ ছবিটা দেখানো হবে। আমার পুরনো ম্যানেজারের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। তিনি পুরনো দর্শকদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। অনেকে এলেন। বেশিরভাগই এলেন না। যাই হোক, তাও মোটামুটি ওই জনা ষাটেক আমার পরিচিতরা এসেছিলেন আর কি। আর সেদিন সন্ধের শোতে যা ঘটল তা ভাবলে আমার গায়ে এখনও কাঁটা দেয়। বলে থামলেন রাজকুমার বাবু। সামনে কাচের গ্লাসে রাখা জল খেলেন কিছুটা।

এতক্ষণ বাদে গল্পের ক্লাইম্যাক্সে এসে এইভাবে থেমে যাওয়ায় আমি ধৈর্য রাখতে পারলাম না। কী হল?

উঁ…কী হল? তোমরা ভাবতে পারো আমি ভুল দেখেছি…কিন্তু সেদিন হলে যেকজন মানুষ ছিলেন তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ছিলেন আমার ছায়ানটের শেষদিনের শো দেখেছিলেন, তারাও কি তবে ভুল দেখেছিলেন? বলে আবার যেন নিজের মধ্যে হারিয়ে গেলেন রাজকুমারবাবু। বিশ্বাস করবে না তোমরা, সবাই জানি ওহ মাই গড দেখানো হবে। কিন্তু যেইমাত্র সিনেমা শুরু হল সকলে অবাক হয়ে দেখলাম স্ক্রিনে মুন্নাভাই এমমিবিএস-এর টাইটেল দেখাচ্ছে। সেই সেলুলয়েড ফিল্ম! শুধু তাই নয় হলের ভেতরটাও…ভেতরটাও আমার মনে হচ্ছিল অবিকল ছায়ানটের মতো হয়ে গেছে। প্রজেকশনে যারা ছিলেন কয়েক মুহূর্তের জন্য তারাও চমকে গেছিলেন। হলের ভেতর আবার লাইট জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। নতুন করে আবার ছবি শুরু করা হল। তখন আবার ওহ মাই গড চলতে শুরু করল, কিন্তু কিছুক্ষণ পর পরই সেই ছবি থেমে যাচ্ছিল। কী এক অদ্ভুত শক্তি যেন সেই ছবিকে থামিয়ে দিতে চাইছে। সাউন্ড জড়িয়ে যাচ্ছে। সেই শো শেষপর্যন্ত বন্ধ করে দিতে হয়েছিল সেদিন। আমাদের জানানো হল টেকনিকাল ত্রুটি। কিন্তু আমি নিজে এতকাল এই লাইনে রয়েছি তাই জানি, টেকনিকাল ফল্ট থাকলেও এইধরনের গন্ডগোল কখনোই হয় না।

তারপর? সোজা হয়ে বসে জিজ্ঞাসা করল সৈকত।

তারপর? নাহ, তারপর থেকে আর কোনও সমস্যাই হয়নি কোনওদিন। কিন্ত সেদিনের ওই শো…কেন এমন হয়েছিল তার কোনও যুক্তিই আমি খুঁজে পাইনি।

আমি আর সৈকত দুজনেই চুপ। কী বলব বুঝে পাচ্ছি না। রাজকুমারবাবুও চুপ। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, কী বলবে বলো।

বললাম, কী বলব আমি ঠিক বুঝে পাচ্ছি না। মানুষ বা অন্যান্য প্রাণীদের নিয়ে অনেক ভূতুড়ে কাণ্ডের কথা পড়েছি, শুনেওছি। আমি নিজে সেসব বিশ্বাস করি না কিন্তু ভূত থাকলেও প্রাণীর আত্মা থেকেই সৃষ্টি হওয়ার কথা। কিন্তু এ যে ছায়ানট…একটা প্রাণহীন…

এবার আচমকাই যেন গর্জে উঠলেন রাজকুমার। প্রাণহীন! আমার ছায়ানট প্রাণহীন বলছ! রোজ হাজার হাজার মানুষ সেখানে দুবেলা জড়ো হতো। শয়ে শয়ে মানুষের নিঃশ্বাস, কথা, হাসি, কান্না মিশেছিল ছায়ানটের দেওয়ালে, ছাদে, প্রজেক্টরে…সেসবের কোনও মূল্য নেই? প্রাণহীন কী? যা মৃত। কিন্তু আমার ছায়ানট ছিল জ্যান্ত একটা জিনিস বুঝেছ। আমি ওর প্রাণ অনুভব করতাম। কিন্তু…গলা নামালেন রাজকুমার। কিন্তু তারপরেও অনেক যুক্তি থেকে যায়। যেসব যুক্তির উত্তর আমার কাছে নেই। আজও নেই। বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালেন রাজকুমারবাবু। এতক্ষনের ঝলমলে মানুষটাকে কেমন ঝড়ে নুয়ে পড়া বিধ্বস্ত গাছের মতো মনে হচ্ছে। মন খারাপ হয়ে উঠল আমার।

বললাম, কাকাবাবু, জীবনে কিছু রহস্য থেকে যাওয়া ভালো। কী দরকার সব রহস্যের সমাধান করে?

আমার কথা উনি শুনলেন কি না বুঝতে পারলাম না। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে যেতে অস্ফুটে বললেন, তোমরা শুয়ে পড়ো, অনেক রাত হয়ে গেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *