সব স্বপ্ন মিথ্যা হয় না
(১)
এই এক দোষ হুলোদার, জন্মদিনের পার্টিটা কীভাবে ফাঁকি দেওয়া যায় কেবল সেই ধান্দা৷ বিগত দু’বছরের মত এই বছরও বিশ্বকর্মা পুজোর সাথে পার্টিটাকে জুড়ে দিলো৷
বাসস্ট্যান্ডে ওদের নিজস্ব গ্যারেজ আছে৷ বাবা বিশ্বকর্মার কৃপায় আয় মন্দ হয় না, তাই প্রতি বছর আজকের দিনে ওদের বাড়িতে ঘটা করে পুজোর আয়োজন করা হয়৷ অনেক লোকজন খাওয়ানো হয়৷ আর সে কিনা এর সাথেই জন্মদিনের পার্টিটা জুড়ে দিলো৷ সে যাই হোক কি আর করা যাবে? অগত্যা যথা দিনে, যথা স্থানে উপস্থিত হলাম৷
প্রীতম, তোফা, পম বান্ধব-চক্রের অনেকেই এসেছে৷ সবাই যে যার নিজের ফোন নিয়ে ব্যস্ত৷ এই একটা জিনিস আমার চক্ষুশূল৷ আজকালকার ছেলেমেয়েরা মানুষের সাথে মেশে কম, মোবাইল নামক বস্তুটিকে সময় দেয় বেশি৷ টেকনলজির একটা ডার্কসাইট, আমি এটাকে বলি “It’s a devil’s gift to mankind”৷ যদিও এটিকে সম্পূর্ণ ভাবে দোষারোপ করা যায় না৷ কারণ আসক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করাই হল প্রকৃত চ্যালেঞ্জ৷ এ বিষয়ে একালের ছেলে হয়েও এই সাধারণ ভাবনাটা যে শুধু ভাবতেই পারিনা বরং মেনেও চলতে পারি৷ তারজন্য যে আমি নিজের উপর কিঞ্চিত গর্ববোধ করি এটা অস্বীকার করব না৷ জলজ্যান্ত একটা মানুষ যে ঘরে উপস্থিত আছে সেদিকে কারও কোনো হুঁশ নেই৷ খেঁকিয়ে বললাম, ‘রাখতো ফোনগুলো! সব সময় শুধু ফোন আর ফোন৷ আজকে পুজোর দিন সবাই একজায়গায় আছি, কোথায় গল্প করবো সবাই মিলে তা না….’
প্রীতম বলল, ‘আয়, আয়৷ বোস, গেম খেলবি?’
‘না৷ হুলোদা কোথায়?’
‘পাপাইকে সঙ্গে নিয়ে মিষ্টি আনতে গিয়েছে৷’ পেছন থেকে পম বলল।
পাপাই, হুলোদার কোন এক মামাতো ভাই৷ পাপাই -এর নামটা শুনে হঠাৎ মনে পড়লো, হুলোদার মুখেই শোনা, পাপাই -এর কোন এক মেসো নাকি পোজেস্ট, মানে ভূতে পেয়েছিল৷ ভূতে ভয় পেলেও গল্পের আঁচ যেখানে পাওয়া যায়, আমি সেখান থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারি না৷ নিজের জীবনে অভিজ্ঞতা ছাড়াও আত্মীয় সজ্জনদের থেকে শোনা অনেক ঘটনার কথা জানে সে৷ এককথায় তার ভূতের গল্পের ঝুলি খালি করা প্রায় অসম্ভব৷ তাই তো আমি মাঝে মধ্যে বলি হুলোদাকে, ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে না পড়ে অলৌকিক বিদ্যা বা প্যারাসাইকোলজি অকাল্টিজিম নিয়ে পড়লে এতোদিনে ভালো জায়গায় স্ট্যান্ড করে যেতো৷
পাপাই কে এলেই চেপে ধরতে হবে, ঘটনাটা শুনব৷ তার আগে এই গেঁতোর দলটাকে একটু পটিয়ে রাখতে হবে৷ নইলে গেমের কথা তুলে সব পন্ডুল করে দেবে৷ তখন ওরাও এসে যোগ দেবে এই আড্ডাতে৷ আমি প্রীতম কে বললাম, ‘হ্যাঁ রে প্রীতম, পাপাই -এর কোন এক মেসোকে ভূতে পেয়েছিলো না? একদিন কথায় কথায় বলছিলো হুলোদা মনে আছে?’
‘হ্যাঁ বলেছিলো তো একদিন, কিন্তু ঘটনাটা কি ঘটেছিলো আর ওর মেসোরই বা কি হল শেষমেশ সেসব কিছু বলে নাই৷’
আমি বললাম, ‘ঠিক! আর সেই ঘটনা বলতে পারবে খোদ পাপাই৷ হুলোদাই বলেছিলো যে ও জানে৷ তাই আমি বলছিলাম এই ফোনগুলো রেখে, পাপাই এলে ওর কাছ থেকে পুরো ঘটনাটা শোনা যাক৷ সবাই আছি বেশ একটা ভুতুড়ে পরিবেশ তৈরি হবে৷’
পাশ থেকে পম ফোড়ন কাটল, বললো, ‘তোর খালি ভূত আর ভূত৷ তবে এটা হলে মন্দ হবে না৷ অনেকক্ষণ ধরে গেম খেলছি, বোরিং লাগছে৷ পাপাই আসুক তাহলে, আসর জমানো যাবে৷’
‘ব্যস্ তাহলে তাই হোক, আসুক পাপাই৷ প্রীতম, হুলোদাকে একটা ফোন করে জিজ্ঞাসা কর তো, কতদূর ওরা?’ কথাটা শেষ হতে না হতেই বাইরে বাইকের আওয়াজ পেলাম৷
পম বলল, ‘এল বোধহয়, দেখ?’
গিয়ে দেখি ইয়াব্বড় শালপাতা মোড়া ডেকচি ধরে নিয়ে এসেছে পাপাই৷ দেখছি হুলোদা পাপাই-এর উপর চিৎকার করছে৷ কাছে গিয়ে জানলাম, গাড়ির ঝাঁকুনিতে কিছুটা রস হুলোদার জ্যাকেটে পড়েছে৷ পাপাই-এরও প্যান্টে পড়েছে অবশ্য, তাই এই বকাঝকা৷ রাগ হবে নাই বা কেনো, মেলাতে কত সাধ করে একশো পঁচিশ টাকায় কেনা অরিজিনাল ব্রান্ডের মরা সাহেবের জ্যাকেট বলে কথা৷ যদিও দারদামটা না করে দিলে পেতো না৷ ওর চিৎকারে বিরতি টানতে আমি ডেকচি নামাতে উদ্যত হলাম৷ ওরা দুজনে এসে আমাদের আড্ডায় যোগ দিলে প্রীতম নিজে থেকেই মেসোর কথাটা তুললো৷ আমি খুব উৎসাহের সাথে সায় দিলাম ওকে৷ পাপাই বলল, ‘মেসোর বাড়ি যে খুব একটা যাওয়া আসা করি এমনটা নয়৷ যা ঘটেছে তা কিন্তু আমি নিজের চোখে দেখি নাই, পুরোটাই মায়ের কাছে শোনা৷’
আমি বললাম, ‘আহাঃ! মাসিমা যেটা বলেছে সেটাই বল না, শুনি ব্যাপারটা, ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে!’
‘বেশ তাহলে বলছি শোন৷’ এই বলে পাপাই বলা শুরু করল-
(২)
ভারতীয় নৌবাহিনীতে চাকরি করতো মেসো৷ ভলেন্টিয়ার রিটায়ারমেন্ট নিয়ে কিন্নাহার গ্রামে চলে আসে সপরিবারে৷ পরিবারের সদস্য বলতে দুই ছেলে আর স্ত্রী৷ অবসর জীবন শান্তিতে কাটাবে তাই বেশ নিরিবিলি এই গ্রামে পুরোনো একটা দোতলা বাড়ি কেনে৷ সেটার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ করে ছিলো একটি পুকুর আর এই সেই পুকুর পারে, বাড়িটার কিছুটা গা ঘেঁষে ছিলো একটি অতিকায় তেঁতুল গাছ৷ গাছটার বড়ো বড়ো ডালপালা, ঘন করে ঘরটার দক্ষিণ অংশকে ঢেকে ফেলত৷
ওর কথায় বাধা দিয়ে আমি বললাম, ‘ঢেকে রাখত মানে?’
-ঢেকে রাখত এরজন্যই বললাম, সেটার ডালপালা, পাতাগুলো নাকি এতই নিবিড় ছিলো যে দক্ষিণের জানালা দিয়ে সূর্যের আলো তাদের সেই দুর্গম নিভৃতলোক পার করে ঘরে ঢুকতে পারত না৷
-ও! বুঝলাম, তারপর?
-এমনি তে সব ঠিকঠাকই চলছিলো কিন্তু বিপত্তিটা শুরু হল মাস দু’য়েক পর থেকে৷ ওই যে তেঁতুল গাছটার কথা বললাম ওই গাছটার নাকি তেঁতুল ছিলো খুব মিষ্টি, মানে টক মিষ্টি যেটাকে বলে৷ বাড়িটার দক্ষিণের ঘরে থাকত মেসো আর মাসি, আর ভিতরের ঘরে থাকত তার দুই ছেলে৷ হাট বাজার, ইত্যাদি টুকিটাকি সাংসারিক কাজকর্ম সেরে মেসো বই নিয়ে বসত৷ আসলে মেসোর বই পড়ার খুব নেশা ছিলো৷ আর এই নেশার মাঝে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো…
আবারও ওর কথায় বিঘ্ন সৃষ্টি করে, বিদ্রোহী ভাব নিয়ে আমি বলে উঠলাম, ‘হ্যাঁ, শখের মাঝে কিছু যদি বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় তাহলে সেটাকে বরদাস্ত করা যায় না! এই যেমন ধর ছবি আঁকা আমার শখ, কিন্তু এর মাঝে যদি কিছু বাধা হয়ে দাঁড়ায় তাহলে কি সেটাকে আমি মেনে নিতে পারব?’
আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু তার আগেই তোফা আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘থাম তো তুই, গল্পটার রিদম টা ভেঙে দিচ্ছে বার বার!’
ওদিকে সবাই পাপাইকে আবার শুরু করতে বলল৷
‘হ্যাঁ৷ তো কোনখানটা বলছিলাম যেনো?’
‘বই পড়ায় বাধা৷’ গল্পের সূত্রটা ধরে দিলো প্রীতম৷
‘হ্যাঁ৷ আর এই শখের মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়ালো তেঁতুল গাছটা৷ এক বিন্দুও দিনের আলো ঘরে প্রবেশ করতে পারত না এই গাছটার জন্য৷ এমনিতেই বই পড়াতে একপ্রকার বাধা৷ তার উপর ঘরে আলো ঢুকতে না পারায় সেটা গুমোট, অন্ধকার, স্যাঁতস্যাঁতে এক অস্বস্তিকর পরিবেশে পরিণত হয়েছিল৷ গাছটার মিষ্টি তেঁতুলের জন্য কখনও গাছটাকে কাটার কথা ভাবে নি, এমনি ডাল, পাতা ছেঁটে দিয়েছে অনেকবার৷ কিন্তু তাতেও কোনো ফল হয় নি৷ যখনই কাটা হত, তার কিছুদিনে পরেই আবার সেগুলো চড়চড় করে বেড়ে উঠত৷ অগত্যা এই আপদটাকে গোড়া থেকে উপড়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিতেই হল৷ আর এখান থেকেই শুরু হল বিপত্তি৷ সেদিন রাত্রে মেসো এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলো৷ তার এতো বছরের জীবনে সে এরকম স্বপ্ন এর আগে কখনও দেখেনি৷
কৌতুহল নিয়ে প্রশ্ন করে বসলাম, ‘সরি, সরি আবার ব্যাঘরা দেওয়ার জন্য৷ লেট মি ক্লিয়ার ওয়ান থিং, তুই স্বপ্নের কথা জানলি কি করে?’
পাপাই বলল, ‘ওখানেই তো সাসপেন্স, ওটা শেষে ডিসক্লোসড করব৷’
-ওকে কন্টিনিউ!’
-স্বপ্নটা ছিলো এরকম: ভোরের প্রথম আলো চোখে পড়ার সাথে সাথে মেসোর ঘুম ভাঙে৷ হঠাৎই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ৷ এতো ভোরে কে এল দেখতে মেসো দরজা খুলতে যায়৷ দরজা খুলেই দেখে এক আজব দৃশ্য৷ সেই তেঁতুল গাছটা! দরজার সামনে রাতারাতিই যেন উদ্ভব হয়েছে বিশাল এই মহীরুহ৷ আরো দেখলো, গাছের সব পাতাগুলো যেন দুলে চলেছিল৷ ঝড়ের সময় গাছের পাতারা যেমন অস্থির হয়ে যায়, ঠিক সেইরকম৷ কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় আকাশ পরিষ্কার, বাতাসের বেগ স্বাভাবিক৷ এবার সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘন পাতার মধ্যে ফুটে উঠছে উজ্জ্বল একটা সাদা বস্তু৷ ভালো করে খেয়াল করে দেখল সেই সাদা বস্তুটা একটা কাপড়ের টুকরো৷ ধীরে ধীরে সেই কাপড়ের টুকরোটার আকার বড়ো হতে লাগলো৷ কেও গাছ বেয়ে নামলে যেমন লাগে ঠিক তেমন৷ কি আশ্চর্য! সেই ধব ধবে উজ্জ্বল সাদা কাপড়ের টুকরোটা একটা আকার নিতে শুরু করল, মানুষের মতো আকার! গ্রাম বাংলায় সদ্য বিবাহিত বধূরা, সন্ধ্যায় তুলসী-মঞ্চে প্রদীপ জ্বালতে যাওয়ার সময়, চিবুক পর্যন্ত লম্বা ঘোমটা টানা তাদের যেমন সাজ লক্ষ করা যায়, এই কাপড় ঠিক যেন সেরকম এক আকৃতি ধারন করল৷ সেটার আকৃতি অনেকটা মহিলার মতন, চিবুক পর্যন্ত লম্বা ঘোমটা টানা, নিটোল, সুঠাম দেহের বাইরের আকারে আন্দাজ করাই যেত ঘোমটার ওপারে নিশ্চয় কোন সুশ্রী, সুন্দর এক নারী আছে৷ বা হতেও পারত স্বর্গের কোন অপ্সরা৷ ঘোমটা ঢাকা নারী মূর্তি মেসোর কাছে ধীর পায়ে এগিয়ে এল৷ পরিমার্জিত, মাপা চলন৷
এতক্ষণে মেসো, মহিলাটার পা -এর দিকে তাকাল৷ কি সুন্দর সেই চরণ যুগল৷ ঠিক যেমন সিদ্ধহস্ত মূর্তিকার পোড়ামাটির অলঙ্কার তৈরিতে মাটিটিকে সযত্নে মাখে, যেটিতে কোন কাঁকর, বালির চিহ্ন পাওয়া যায় না, সেই পা জোড়া ঠিক যেন সেরকম৷ এবার সেই নারীমূর্তি বলে উঠলো, ‘গাছটি কাটবেন না৷’ হুমকি দেওয়ার মত, রুক্ষ স্বরে বলল সেটা৷ গলার স্বরটা সেটার অবয়বের একেবারে পরিপন্থী৷ একটি মেয়ে আর একটি ছেলে একসাথে মিলিত কন্ঠে কথা বললে যেমন শোনায় ঠিক সেরকম৷
প্রত্যুত্তরে মেসো কারণ জানতে চাইলে মহিলা চুপ করে থাকে৷ এবার কিছুটা কঠোরভাবে, জোর দিয়ে আবার কারণ জানতে চাইল মেসো৷
যদি গাছ কাটিস তাহলে তার ফল ভালো হবে না বলে দিলাম৷ সবাইকে ভুগতে হবে!’ বীভৎস গলায়, গগনবিদারী চিৎকার করে বলে উঠল সে৷ এবার মেসো ভয় পেল৷ কিছু একটা আন্দাজ করেছিল, এরকম কন্ঠস্বর কোন স্বাভাবিক মানুষের হতে পারে না৷ হঠাৎ ঘরের ভিতর থেকে একটা আওয়াজ শোনা গেছিল৷ কাঠের ভারি কোন জিনিস মেঝেতে প্রচণ্ড জোরে, বারবার আছড়ে মারলে যেরকম আওয়াজ হয় ঠিক সেইরকম৷ পিছনে তাকিয়ে মেসো দেখে, যে খাটে মাসি শুয়ে ছিল সেই খাট একবার করে শূন্যে ভাসছিল, আবার পরক্ষণেই প্রচণ্ড জোরে মেঝেতে আছড়ে পড়ছিল৷ শয্যারত মাসির শরীরও শূন্যে ভেসে থাকতে থাকতে, প্রচণ্ড জোরে খাটে আছড়ে পড়ছিল৷ তার হাত, পা গুলো সব বেঁকে গিয়েছিল৷ একটা চাপা আর্ত গোঙানি শোনা যাচ্ছিল৷ হ্যাঁ, মানুষের সহ্য সীমার মাত্রা ছাড়িয়ে ব্যথা হলে যেমন ঠিক করে সেটা প্রকাশের ক্ষমতা থাকে না৷ তেমনই মাসির গলা দিয়ে সেই ব্যথার আবেগটাও বেরোতে পারছিল না ঠিক ভাবে৷ এরপর হঠাৎই সব থেমে গেছিল৷ সব শান্ত, যেন কোনকিছু ঘটেই নাই৷ খাট তার যথাস্থানে, সেই খাটে শয্যারত মাসিও শান্তিতে ঘুমাচ্ছিল৷ মেসো বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখেছিল সেই ঘোমটা টানা নারীমূর্তি ধীরে ধীরে পিছিয়ে যাচ্ছিল৷ সেটার দু’হাতের আঙুল ধরে তার সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছিল মেসোর দুই ছেলে৷ ভীতসন্ত্রস্ত স্বরে মেসো বলেছিল, ‘কোথায় নিয়ে যাচ্ছো আমার ছেলেদের, কোথায় নিয়ে যাচ্ছো? এই তোরা ওর সাথে কোথায় যাচ্ছিস? ফিরে আয় এদিকে, ফিরে আয়!’
তারা যেন মেসোর কোন কথাই শুনতে পাচ্ছিল না৷ শুধুই সম্মোহিতের মত তার সাথে চলেছিল৷ হঠাৎ মেসোর চোখ পড়লো সেই নারীমূর্তির পায়ে৷ সেই পা, যেটা কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত একটা সুন্দরের রূপ ফুটিয়ে তুলেছিল মেসোর হৃদয়ে, যাকে সে কিছুক্ষণ আগেই দেখেছিল অপূর্ব সুন্দর, এখন সেটাই দেখাচ্ছে কুচকুচে কালো, লোমে ঢাকা বীভৎস এক জোড়া পা৷ মেসো প্রণপনে ছুটে গিয়ে তার হাত থেকে নিজের ছেলেদের ফিরিয়ে আনতে উদ্যত হয়েছিল; কিন্তু মেসো যত এগোচ্ছে সেই নারীমূর্তি মেসোর গতির সাথে তাল মিলিয়ে হাত দশেক দূরত্ব বজায় রেখে পিছিয়ে যাচ্ছিল৷ মেসো ছুটছে, সেও পিছোচ্ছে৷ কিছুতেই মেসো তার কাছাকাছি যেতে পারছিল না৷ হঠাৎই কোথা থেকে একটা চোখ ধাঁধানো তীব্র আলোর ঝলকানিতে চারিদিক উজ্জ্বল হয়ে গেলো৷ ধীরে ধীরে সেই আলোতে মিলিয়ে গেল সেই নারীমূর্তি, সঙ্গে মেসোর দুই ছেলেকে নিয়ে৷ মেসো চিৎকার করে ডাকছিল তার ছেলে দুটোকে৷ ক্রমশ সেই চিৎকারের আওয়াজটাও ধীরে ধীরে শূন্যে মিলিয়ে গেছিল৷
হুড়মুড়িয়ে উঠে বসলো মেসো৷ তার সারা গা ঘামে ভিজে ঝুপসি হয়ে গিয়েছিল ততক্ষণে৷ ‘কি বিদঘুটে দুঃস্বপ্ন!’ বলে, জানলার দিকে তাকিয়েছিল৷ তেঁতুল গাছের পাতাগুলো, সকালের স্নিগ্ধ বাতাসের তালে তালে মাথা নাড়ছিল৷ জানালার উপর তারা তাদের সর্বস্ব বিস্তার করেছিল৷
চরমভাবে জমে ক্ষীর হয়ে যাওয়া আমাদের ভৌতিক আড্ডার গাড়ি যখন ভালোরকম স্পীড নিয়েছে, ঠিক তখনই মাঝপথে হাম্পস্ এর মত কাকিমা আর্বিভূত হয়ে আমাদের গল্পের গাড়িতে ব্রেক লাগিয়ে বললো, ‘বলি ঘড়িতে চোখটা দিয়ে দেখ সব৷ দুটো বাজতে চললো৷ তাড়াতাড়ি খেতে আয় সব এবার৷
তাই তো, সবাই গল্পে এতো মত্ত হয়ে গিয়েছিল যে কেউ খেয়ালই করে নাই কখন পেটে ইঁদুরে ডন বৈঠক মারা শুরু করেছিল৷ আপাতত গল্পের আসর স্থগিত রেখে চটপট হাত ধুয়ে একবারে পাত পেড়ে, আসন জাঁকিয়ে বসলাম৷ হাসি, ঠাট্টা আর মেনুতে সরু নাফিস চালের গরম ভাত, খাঁসির মাংস, চাটনি, পাঁপড়, মিষ্টি, ওফ! জাস্ট অপূর্ব একটা ভোজ হল৷ যাই হোক খাওয়া-দাওয়ার পালা সেরে চটজলদি সব আবার একসাথে হলাম৷ পাপাই জিজ্ঞেস করল, ‘হ্যাঁ, তো কোথায় যেন ছিলাম?’
এবার গল্পের সূত্রধর হয়ে তোফা বলল, ‘মেসো স্বপ্ন দেখলো, অতদূর৷’
-স্বপ্নটাকে আর পাঁচটা দুঃস্বপ্নের মত ভেবে মেসো সেটাকে সেরকম গুরুত্ব দিলো না, নিজের মধ্যে চেপে রেখেই একসময় ভুলে গেলো৷ যাই হোক, দিন দুই-তিনেক পর গাছটাকে কাটার জন্য কাঠুরের একটা দল ডাকা হল৷ আর এই গাছ কাটা থেকেই নাকি শুরু হয়েছিলো মূল ঘটনার সূত্রপাত৷ যাই হোক এবার মূল ঘটনায় আসা যাক৷ গাছটার বর্ণনা আগেই দিয়েছি৷ যেরকম দীর্ঘকায়, সেরকম মোটা আর ঘন পাতার আচ্ছাদনে মোড়া৷ একজন কাঠুরে গাছে উঠেছিল ডালপালা গুলো ছেঁটে ফেলার জন্য৷ কিছুক্ষণ পরেই ঘন ডালপালার মধ্যে থেকে সেই কাঠুরের চিৎকার শোনা গেছিল আর তার ঠিক পরেই সে গাছ থেকে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারিয়েছিল৷ সকলে তড়িঘড়ি ঘরের ভিতরে নিয়ে গিয়ে, চোখে মুখে জল দিয়ে কোনরকমে জ্ঞান ফিরিয়েছিল তার৷ কোমরে আর পায়ে ব্যথা পেয়েছিলো, কিন্তু ভাঙে নি৷ তার দলের এক সদস্য যখন তাকে জিজ্ঞেস করল, সে গাছ থেকে কিভাবে পড়ে গেলো তখন তার চোখে-মুখে বিভীষিকার ছাপ লক্ষ করা গেছিল৷ সে বলেছিল, ‘বাবু ও গাচ একদম পয়া লয়৷ তেনাদের বাস আছে ওগাচে৷ আমি লিজের চোখে দেখেচি৷ ডাল ছাঁটতে ছাঁটতে হঠাৎ মনে হয়, পেচনে কে যেন আছে৷ আমি তাকিয়ে দেখি একজন সাদা কাপড় পড়ে বসে আছে৷ পোতমে ভাবি কোন বাচ্চাছিলে হয়ত তেঁতুল লিতে ঘাপটি মেরে বসে ছিল আগেভাগেই, আমরা চলে আসাতে পালানোর সুযোগ পাই লাই৷ অন্ধকারে ঠিক মুখ দেখা যাচ্চিল না৷ আমি ওর মুখ দেখবার লেগে যেই কাছে যায়, অল্প আলোতে দেখি কালো পোড়া মুখ, এই চোখা চোখা দাঁত আর চোখগুলো দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে৷ আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়েছিলো যেন এখুনি আমার টুঁটি ছিঁড়ে লেবে, সেই দেখে আমি ভয়ে তাড়াতাড়ি লামতে গিয়ে পা হড়কে পড়ে যায়৷ কোমরে খুব বেদনা হচ্ছে৷ আ আ আ…’
দলের দু’তিনজনে তাকে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যায়৷
কাঠুরের কথাগুলো শুনে মেসোর, তার সেই স্বপ্নটার কথা মনে পড়ছিলো৷ স্বপ্নেও তো ঠিক এরকম একজন সাদা কাপড় পড়া মেয়েকে দেখেছিলো৷ যদি সত্যিই এই গাছ অশুভ হয়ে থাকে তাহলে এটাকে যে ভাবেই হোক কাটতে হবে৷ সেদিনের মত আর গাছ কাটা সম্ভব হয়নি৷ পরদিন মেসো কাঠুরের দলকে বলে, ডালপালা ছাঁটার দরকার নেই, গোড়া থেকে একবারে কেটে দাও৷ যেমন কথা তেমন কাজ৷ মোটা কড়াত দিয়ে গাছটাকে একেবারে গোড়া থেকে কাটা হল৷ বেশ বেগ পেতে হয়েছিলো সেটাকে কাটতে, হবে নাই বা কেন, যা মোটা গুড়ি৷ তারপর থেকে সকালের ঝলমলে আলোই হোক কিংবা বিকালের পড়ন্ত রোদ, জানালা বেয়ে ঘরের মেঝেতে তারা আলোর খেলা দেখাতে থাকল৷ ঘরটার গুমোট ভাব কেটে গেল৷ মেসো ভাবলো এবার একটা আপদ বিদেয় হল৷ কিন্তু এটাই যে আসন্ন বিপদের সূত্রপাত সে ধারণা থেকে মেসো তখনও বহুদূরে৷
এরপর বেশ কিছুদিন পেরিয়ে যায়৷ একদিন মাঝরাত্রে, খুব হালকা একটা কিসের শব্দে মেসোর ঘুমটা পাতলা হতে থাকে, ঘুমটা ভাঙে, যখন শব্দটা একটানা তার কানে আসতে থাকে৷ বিছানাতে শুয়েই মেসো কান খাঁড়া করে সেটা ভালো করে শোনার চেষ্টা করে৷ বেশ কিছুক্ষণ শোনার পর বুঝতে পারে শব্দটা জলের৷ ঘাটে কাপড় কাচার সময় যেমন ঝপ্ ঝপ্ আওয়াজ হয় এটা ঠিক সেরকম৷ মেসো আন্দাজ করল আওয়াজটার উৎসস্থল তাদেরই দক্ষিণ-পশ্চিমের পুকুর৷ গ্রামের দিকে মাঝরাত্রে পুকুরের মাছ চুরির ঘটনা প্রায়ই হয়ে থাকে৷ বিশেষ করে মেসোদের পুকুরটা ছিল চোখে লাগার মত৷ এক-দেড় হাত লম্বা তিন-চার সের ওজনের রুই থাকলে কার না লোভ হয়? সেই মাছ কেউ চুরি করছে, এই ভেবে মেসো তাড়াতাড়ি দেখতে যায়৷ সঙ্গে নেয় একটা মোটা বেতের লাঠি আর সেলের টর্চ লাইট৷ সেদিন ছিলো কৃষ্ণপক্ষ, কিন্তু আকাশের অবস্থা ভালো না থাকায়, জ্যোৎস্না ম্লান হয়ে ছিলো৷ জল-ঝাপটানোর শব্দ তখন বেশ স্পষ্ট৷ মেসো তখন নিশ্চিত যে, নির্ঘাত কেউ মাছ চুরি করার জন্য পুকুরে নেমেছে৷ পেশীবহুল হাতে সিদ্ধহস্ত সৈনিকের চালে লাঠিটা জাঁকিয়ে ধরে, সেই আওয়াজ লক্ষ করে টর্চের সুইচ টিপলো৷ কিন্তু টর্চ জ্জ্বলল না৷ বেশ অশ্চর্য হল মেসো, কারন পুরানো সেল গুলো সেদিনই পালটে নতুন সেল লাগিয়েছিলো৷ মেঘে ঢাকা চাঁদের সেই স্তিমিত জ্যোৎস্নায় পুকুরের দিকে ভালোভাবে দেখার চেষ্টা করল৷ পা টিপে টিপে এগোলো, যাতে পায়ের আওয়াজে চোর সতর্ক না হয়ে যায়৷ কিছুক্ষণ জলের দিকে চেয়ে লক্ষ করল পুকুরে কি যেন একটা এপার থেকে ওপারে সাঁতরে চলেছে৷ মাছ নয়, অত বড় মাছ হয় না, জলে সেটার অবয়ব মানুষের মতন ঠেকছিল৷ চোর যদি চুরিই করতে আসে তাহলে এভাবে সাঁতার কাটবে কেন? ব্যাপারটার কোন ব্যখ্যা খুঁজে পেল না৷ এবার মেসো বজ্রগম্ভীর জোর গলায় বলে উঠল, ‘কে ওখানে? মাছ চুরির মতলব? শিগগিরি উঠে আয় জল থেকে ভালোয়-ভালোয়, নইলে এক্ষুনি এই লাঠি দিয়ে তোর মাথা চৌচির করে দেব৷’
বলা মাত্রই মেসো লক্ষ করল জলের কল্-কল্ শব্দটা ক্রমশই তার থেকে দূরে সরে সরে যাচ্ছিল৷ আলোর অভাবে ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না৷ এদিকে আবার টর্চটাও বিগড়েছিল৷ হয়ত চোরটা ওই পারে সাঁতরে পালাচ্ছে৷ ওই আবছা আলোতেই যেটুকু বুঝতে পারলো, তার ধারণাটাই ঠিক৷ ওদিকের পারে উঠে, বাঁশের বেড়া গলে, চোরটা ধীরে ধীরে পগার-পার দেবার চেষ্টা করছে৷
‘পালানো হচ্ছে? থাম বলছি,থাম!’ এই বলে যেই তার পিছু নিতে যাবে, ওমনি পিছন থেকে ‘বাবা’ বলে কে ডেকে উঠলো৷ পিছনে তাকিয়ে দেখে তার বড় ছেলে, কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিল৷ চেঁচামেচির আওয়াজ শুনেই হয়ত এসেছিল৷ মেসোর কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সে দৌড়ে বাড়ির পিছন দিকের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল৷ তার ছেলের এরকম আচরণ দেখে খুব অবাক হল মেসো৷ চোরটা ততক্ষণে উধাও হয়েছিল৷ আর পিছু নেওয়াটা বোকামি হবে৷ তার উপর আবার টর্চটাও জ্বলছিল না, বরং ছেলেটা কেন ওরকম করে ছুটে পালালো সেটা দেখাটা দরকার৷ এই ভেবে মেসো ঘরে যায়৷ ঘরে ঢুকতে গিয়েই দেখে সদর দরজায় মাসি দাঁড়িয়ে৷ সে জানায় মেসোর গলা পেয়ে ঘুম ভেঙে গিয়েছেলো, কি হয়েছে দেখতে যাচ্ছিল। মেসো সংক্ষেপে সব বৃত্তান্ত দেয়৷ শেষে বড়ছেলে জেগে আছে কিনা এবং বাইরে বেরিয়েছিলো কিনা জানতে চাইলে মাসি বলে, ‘কই না তো, সে তো নিজের ঘরে ঘুমাচ্ছে৷ আসার সময় এইমাত্র দেখে এলাম৷’
মেসো অবাক হয়ে বলে, ‘কিন্তু আমি যে…৷ চলো তো একবার দেখে আসি৷’
‘মেসো গিয়ে দেখে দুই ভাই অকাতরে ঘুমোচ্ছে৷ সেদিন মেসোর সারারাত ঠিক করে ঘুম হল না৷ আজে-বাজে চিন্তা মাথায় আসতে লাগল, প্রথমে ওরকম এক আজব চোর, তারপর তার ছেলের ওরকম আচরণ৷ ব্যাপারগুলো খুব ভবাচ্ছিলো মেসোকে৷
‘পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল, মাসির ডাকাডাকিতে৷ বাইরে লোকজনের শোরগোল শোনা যাচ্ছিল৷ তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে দুজনে বাইরে যায়, কি হয়েছে দেখার জন্য৷ পুকুরের দিকে লোকজনের ভিড়৷ মেসো সেই ভিড় ঠেলে এগিয়ে এসে দেখে, ঘাটের কাছে পড়ে আছে একটা লাশ৷ বছর চোদ্দোর কিশোর৷ হাত, পা-গুলোকে পিছমোড়া করে এমনভাবে মোচড়ানো হয়েছে যে কুনুই-এর হাড় চামড়া ফেটে বেরিয়ে পড়েছিল, আর হাঁটু শরীরের উল্টো দিকে ঘুরে নিতম্ব ছুঁয়ে গেছিল৷ ঘাড়টাকে মটকে পিঠের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ অসহ্য মৃত্যু যন্ত্রনায় চোখগুলো ঠিকরে বেরিয়ে এসেছিল তার৷
কি ভয়ানক সেই দৃশ্য! কিন্তু তার থেকেও মর্মবিদারী যেটা, সেটা হল, লাশটা ছিলো মেসোর বড় ছেলের৷
সেই ঘটনার পর মাসিতো প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলো৷ কারওসাথে কথা বলতো না, খাওয়াদাওয়া করতো না, কেবল সারাদিন গুম হয়ে বসে থাকত৷ বাড়িতে শোকের ছায়া।এদিকে মাসির এই অবস্থায় তাকে সামলানো দায়৷ দাদার অকালমৃত্যুতে তাদের ছোটছেলেটাও মুষড়ে পড়েছিল৷ আবার শ্রাদ্ধ-শান্তি, থানা-পুলিশের ব্যাপার৷ মেসো নিজেকে সামলেছিলো খুব কষ্টে৷ কিন্তু সেদিনও নিয়তি আড়ালে মুচকি হেসেছিলো৷ ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাস যে এখনো বাকি ছিলো!
একটা শোকের ছায়া কাটতে না কাটতেই, মাস ঘোরার আগেই মেসোর পরিবারে নেমে এল আরেক শোকের ছায়া৷ একদিন সকালে প্রচণ্ড দুর্গন্ধে সকলের ঘুম ভেঙে গেল৷ একটা পচা বিশ্রী, তীব্র গন্ধে ঘরে শ্বাস নেওয়া দায় হয়ে পড়েছিল৷ ঘরের কোনো আসবাবের নিচে কোন ইঁদুর অথবা ছুঁচো হয়ত অনেকদিন থেকে মরে পরে আছে, সেটাই পচে গন্ধ ছড়াচ্ছে৷ তাই মেসো প্রত্যেকটা ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখলো কিন্তু দুর্গন্ধের উৎস পাওয়া গেলো না৷ ছাদে জলের ট্যাঙ্কের মধ্যেও দেখলো, কিন্তু না৷ কোন কিছু পাওয়া গেলো না৷ খুঁজতে খুঁজতে কি মনে হল মেসোর, একবার নিচে ঝুঁকে দেখলো৷ পশ্চিমের ড্রেনে কি যেন একটা পড়ে আছে৷ নোংরা কালো জলে সেটা এতো মাখামাখি হয়েছিল যে, দোতলা ছাদ থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না৷ ওটা থেকেই গন্ধটা আসছিল৷
নিচে যায় মেসো, সেটাকে দেখার জন্য৷ দেখামাত্রই মেসো কান্নায় ভেঙে পড়ে৷ তার কান্নার শব্দে ঘরের অন্যান্যরাও ছুটে আসে৷ সকলের চোখের সামনে তখন এক হৃদয়বিদারী দৃশ্য৷ পচে দুর্গন্ধ ছড়ানো জিনিসটা, তার আট বছরের ছোটছেলের ক্ষতবিক্ষত লাশ৷ ঠিক একই ভাবে, তার বড় ছেলের মতন, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিকৃত হয়ে ড্রেনের নোংরা কালো জলে উপুড় হয়ে পড়ে আছে৷ তার নরম-কচি শরীরের বিকৃত অংশ থেকে ফেটে বেরিয়ে ঝুলে পড়া হাড়-মাসগুলো ড্রেনের নোংরায় পুরো মাখামাখি হয়ে আছে৷ ময়লা জলের কিসব পোকা পচে যাওয়া শরীরটার উপর কিলবিল করে দলেদলে চড়ে বেড়াচ্ছে৷ পুলিশ এলে সকলের বয়ান নেওয়া হল৷ বডি পোস্টমর্টামের জন্য পাঠানো হল৷ পুলিশের রিপোর্ট অনুযায়ী একটা জিনিস খুব রহস্যজনক ছিলো৷ দুজনকেই ঠিক একইভাবে মারা হয়েছিল৷ মানে যে তাদের মেরেছিল, সে একটা নির্দিষ্ট কিলিং প্যার্টান ফলো করেছিল৷ কেবল একটি জিনিস আলাদা ছিল, তার ছোট ছেলের লাশ পচে গিয়েছিলো৷ আর ঠিক এখানেই রহস্যের জট বেঁধেছে৷ তাদের ছেলে যে বহুদিন থেকে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলো তা নয়, ঘটনার আগের দিন রাত্রেই মেসো তাকে ঘুম পাড়িয়ে আসে৷ কোন লাশ ষোলো থেকে কুড়ি ঘন্টার মধ্যে পচে যাওয়া অসম্ভব৷ আর তাছাড়া ঘরে ঢুকে খুন করে লাশ বাইরে এনে ফেলে দেওয়া বা বাইরে ডেকে এনে মেরে ফেলা এরকম কোন প্রমাণ বা চিহ্ন পুলিশ পায় নি৷
দুই ছেলেকে হারিয়ে শোকস্তব্দ মাসির শরীর পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিল৷ মেসো নিজেই এতো ভেঙে পড়েছিল যে মাসিকে সান্ত্বনা দেওয়ার অবস্থায় ছিল না৷ আত্মীয়, প্রতিবেশী সকলে এসেছি৷ আমার মা’ও গিয়েছিলো৷ দিন কাটতে থাকে এই শোকের ছায়ার মধ্যে৷
এভাবে বেশ কিছুদিন পর, ছেলেদের শেষকৃত্যের কাজ যখন শেষের দিকে তখন এক সন্ধ্যায়, গায়ে প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে মাসি শুয়েছিলো৷ ঘর ভর্তি লোকজন৷ হঠাৎ চিৎকার করে পাগলের মত বলতে উঠল, ‘দেখো, দেখো, ও আসছে, ওর হাত বেরিয়ে আসছে আমার পেট চিরে, দেখো! ব্যথা…খুব ব্যথা…’ কখনও উন্মাদের মত হা হা করে হাসি, কখনও বা ব্যথায় কাতর৷ মাসির এই আচরণ অবোধ বিস্ময়ে, হতভম্বের মত সবাই দেখতে থাকল৷ কি আসছে? কোথায় আসছে? পেটে তো কিছু হয় নি৷ মেসো নির্বিকার তখনও৷
পাশ থেকে একজন বলল, ‘পরপর দুটো ছেলের মৃত্যু শোকে ট্রমাটিক হয়ে গিয়েছে, তাই ভুলভাল বকছে৷’
ডাক্তার ডাকা হল৷ ততক্ষণে মাসি জ্বরের ঘোরে আচ্ছন্ন হয়েছিল৷ ডাক্তার দেখে জানালো মাসি কোমায় চলে গিয়েছিল, বাহাত্তর ঘন্টা আগে কিছু বলা সম্ভব ছিল না৷
পরপর এতোগুলো আঘাতে মেসো মানসিক ভাবে খুব ভেঙে পড়েছিল৷ তাই হয়ত এত কিছুর পরেও মেসো বিন্দুমাত্র বিচলিত হয় নি৷ নির্বিকার, নিথর এক দেহের শুধু যেন অস্তিত্বই ছিল মাত্র৷ তার জীবনীশক্তিটা কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলো৷ প্রতিবেশী, আত্মীয়সজ্জনদের কেউ কেউ, সারা-সারা রাত জেগে মাসির সেবা করল৷ কিন্তু সেসকল চেষ্টা বৃথা হল৷ পরদিন সকালে মাসিও মারা গেলো৷
এইসবের পর মেসো মানসিক ভারসাম্য সম্পূর্ণ ভাবে হারিয়ে ফেলে পাগল হয়ে যায়৷ মাসির শেষকৃত্য প্রতিবেশীরাই করে৷ সেই ঘটনার পর হঠাৎই একদিন মেসোও কোথাও উধাও হয়ে যায়৷ কিন্নাহারের লোকেদের ধারণা মেসো আর বেঁচে নেই৷
‘কেন? কেন? লোকেদের এরকম ধারণার কারন?’ আমি লাফিয়ে উঠে জিজ্ঞেস করলাম৷
শোনা যায় নাকি, ওই তেঁতুলগাছে অপদেবতার বাস ছিলো৷ গাছটা কেটে ফেলার জন্যই তার ক্ষোভের মুখে পড়ে শেষ হয়ে গেল জলজ্যান্ত গোটা একটা পরিবার৷ সে বারবার, নানা ভাবে ইঙ্গিত দিয়েছিলো, বারণ করেছিলো৷ কিন্তু মেসো শোনে নি৷ আর তারই শেষ পরিণতি এই৷ সব স্বপ্ন মিথ্যা হয় না! সুতরাং মেসোও যে ওর কোপ থেকে নিস্তার পায়নি সেটা বাকিদের অবস্থা দেখে আন্দাজ করায় যায়৷ আর তুই বলছিলি না যে আমি কিভাবে জানলাম মেসোর স্বপ্নের কথা? তাহলে শোন, মেসো নিরুদ্দেশ হবার বেশ কিছুদিন আগে মা’কে মেসো এসব কথা বলেছিল৷ সেই মায়ের মুখ থেকেই শোনা৷
বাড়িটা এখন পরিত্যক্ত৷ নিতান্তই উপায় না থাকলে সচরাচর কেও ওই বাড়ির রাস্তা মারাতে চায় না৷ লোকে বলে নাকি এখনো রাত্রে ওই বাড়ির পাশ দিয়ে কেউ পেরোলে, সেই তেঁতুল গাছের কাটা গদিটার পাশে আলো-আঁধারির মধ্যে মাঝে-মধ্যে কাকে যেন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়৷
হঠাৎ ঢং ঢং আওয়াজে আমাদের সকলের পিলে চমকে উঠলো! ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি, ছয়টা বাজছে৷ বাইরে তখন জমাট বাঁধা অন্ধকার৷