পৈশাচিক হাসি

পৈশাচিক হাসি

(১)

প্রতিদিনের মতো আজকেও সকালে মাঠে গেছিলাম৷ এটা আমার একপ্রকার ডেলি রুটিন, ভোর সকালে ঘুম থেকে উঠে মাঠে গিয়ে কিছুক্ষণ শরীর চর্চা করা৷ কিন্তু আজ মাঠে সকলের মাঝে বুবাইদাকে দেখতে পেলাম না৷ প্রীতমকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম বুবাইদার জেঠিমা মারা যাওয়ায় তাকে গত রাত্রেই কলকাতা যেতে হয়েছে৷

খোঁজখবর নিতে বিকেলে ওকে ফোন করেছিলাম৷ সে জানাল, জেঠিমার শ্রাদ্ধ-শান্তি মিটিয়ে দিন কয়েক পরে ফিরবে৷

এরপর বেশ কিছুদিন পেরিয়ে গেল৷ অত:পর একদিন বিকেলে মাঠে খেলার শেষে দেখি বুবাইদা কাঁচা রাস্তা ধরে এদিকেই আসছে৷ নেড়া মাথা, মুখে একগাল হাসি নিয়ে আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল আমি কেমন আছি৷ আমি যথাযথ উত্তর দিয়ে, কাজকর্ম সব মিটে গিয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করতে বুবাইদা জানায় যে, ক্রিয়া কর্ম সব মিটে গিয়েছে৷

কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমাকে আর প্রীতমকে ডেকে, মাঠে উপস্থিত অন্য সবার কাছ থেকে একটু দূরে আলাদা করে নিয়ে গিয়ে বলল, ‘খুব দরকারি কথা আছে৷ সন্ধ্যায় তোরা দু’জন যেন আমার বাড়িতে অবশ্যই চলে আসবি৷’

আমি কৌতুহল বশত জিজ্ঞেস করলাম,’কী এমন দরকারি কথা যা এখন বলা যাবে না?’

ঘাড় নেড়ে সে বলল, সন্ধ্যায় সে সব বলবে৷ কিছুক্ষণ পর কালো ঘন অন্ধকার চারিদিক গ্রাস করে নিয়ে সন্ধ্যা নামালো৷ মাঠের ছেলেরা সবাই আড্ডা ভেঙে যে যার বাড়ি চলে গেলো৷ আমিও বাড়ির পথে পা বাড়ালাম৷

সাড়ে সাতটা নাগাদ, কথামত আমি আর প্রীতম, বুবাইদার বাড়িতে উপস্থিত হলাম৷ ঠিক হল বাইপাশের ভাঙা পাইপে বসে মুড়ি খেতে খেতে কথাটা সে আমাদের বলবে৷ যথারীতি মুড়ির সরঞ্জাম, চপ, ঘুগনি ইত্যাদি নিয়ে আসার পর্ব সেরে খেতে খেতে সে বলা শুরু করল-

জেঠিমা মারা যাওয়ার খবর শুনে সেদিন রাত্রেই কলকাতা রওনা দিলাম৷ সেখানে গিয়ে দাদার কাছে জানতে পারি জেঠিমা সন্ধ্যা নাগাদ হার্টঅ্যাটাকে মারা গিয়েছে৷ বেশ কিছুদিন থেকে শারীরিক অসুস্থতার কারনে হসপিটালে ভর্তি ছিলো৷ বয়স হয়েছিল আটান্নর কাছাকাছি৷ রেগুলার মর্নিং ওয়াক, হেলদি ডায়েটের মধ্যে থেকেও এই বয়সে একমাত্র ছেলে, পুত্রবধূ আর সাত বছরের নাতিকে ছেড়ে চলে যাবে, এটা কেউ ভাবতেই পারেনি৷ জেঠিমার মৃত্যুটা যে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলো না দাদা, দেখেই বোঝা যচ্ছিল৷

একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল বুবাইদা৷ জেঠিমার এই হঠাৎ চলে যাওয়াতে সেও বেশ কষ্ট পেয়েছে৷ তার কথাবার্তা আর চেহারায় সে ছাপ স্পষ্ট লক্ষ করা যায়৷ এই তো কয়েক মাস আগেই, মানুষটা দিব্যি সুস্থ শরীরে সপরিবারে পুরী ঘুরে এল৷ বুবাইদা নিজে গিয়ে ট্রেনে চাপিয়ে এসেছিল, আমিও ছিলাম সঙ্গে৷ সেখান থেকে আসার পরেই তো অসুস্থ হল৷ হাসপাতালে ভর্তি ছিলো, সুস্থ হয়ে উঠেছিলো ধীরে ধীরে৷

বুবাইদার দাদা পুলিশের মেজোকর্তা৷ জীবিকার কারণে পরিবারকে সেভাবে সময় দিয়ে উঠতে পারে না৷ তবে দাদার স্ত্রী অর্থাৎ জেঠিমার একমাত্র পুত্রবধূ কিন্তু তাঁর শাশুড়ির প্রতি অতি যত্নশীল৷ বুবাইদার মুখেই শুনেছিলাম, হাসপাতালে ভর্তির দিন থেকে সবরকম পরিচর্যা, সময়মত ঔষধ খাওয়ানো সবই করত নিয়ম মাফিক৷

প্রীতম আর বুবাইদার মুড়ি শেষ, আমারটা একটু বাকি৷ ঠোঁঙায় হাত মুছতে মুছতে বুবাইদা বলল, ‘দাদা ঘোর নাস্তিক৷ ঠাকুর দেবতার নাম শুনলেই যে চোখ কপালে তোলে, সে তার মায়ের সুস্থতা কামনার জন্য দক্ষিণেশ্বর ঘাটে পুজো দিয়ে এসেছিলো৷ ভাবতে পারিস? কেবল জেঠি ঠাকুর-দেবতা বিশ্বাস করে বলে, সেই বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতেই এসব করা৷ কিন্তু এতকিছুর পরেও যে শেষ রক্ষা আর হল না৷ নিয়তির লিখন কি আর খন্ডানো যায়? যার যখন যাওয়ার সময় তাকে তখন ঠিকই যেতেই হবে৷ অনেক ছোটতেই বাবাকে হারিয়েছিল দাদা৷ অভিভাবক বলতে কেবল জেঠিই ছিলো, এখন সেই ছাদটাও মাথার উপর আর রইলো না৷’

পুনরায় একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে কিছুক্ষণ থামল৷ তারপর আবার বলা শুরু করল।

ঘন্টা খানেকের মধ্যেই দাদার কিছু কলিগ ও সিনিয়র অফিসার উপস্থিত হল, সকলেই দাদাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল৷ বৌদি এককোণে রণোকে কোলে নিয়ে চুপচাপ বসে ছিলো আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলো৷ সেদিন ওই সাত বছরের বাচ্চাটাও বুঝতে পেরেছিলো, যে তার দিদা আর নেই, আর কখনও ফিরে আসবে না৷ বললে বিশ্বাস করবি না, সেদিন রণোর স্বভাবের যেন আমূল পরিবর্তন ঘটেছিলো৷ সারাক্ষণ লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে, সারা ঘর মাথায় করা ছেলেটা কেমন চুপ করে তার মায়ের কোলে বসে ছিলো৷ তারপর তো বডি নিয়ে যাওয়া হল শ্মশানে৷ ইলেকট্রিক চুল্লিতে শেষ হয়ে গেলো মা ছেলের শেষ নাড়ির টান টুকু!

আমি কিছুটা সান্ত্বনা দেওয়ার মত করে বললাম, ‘সেই, কি আর করা যাবে বলো!’

সে বলল, ‘এই পর্যন্ত তো সব ঠিক ঠাক ছিলো, কিন্তু পিন্ডদানের পর থেকে শুরু হল বিপদ৷’

এতক্ষণ চুপ করে শুনছিলো প্রীতম৷ এবার ও চরম কৌতুহলের সাথে একেবারে লাফিয়ে উঠে জিজ্ঞেস করল, ‘কিরকম বিপদ?’

আমি বুবাইদার মুখের দিকে একবার তাকালাম৷ স্পষ্ট বোঝা গেলো ভয়ের এক রেখা ফুটে উঠেছে ওর মুখে৷

পকেট থেকে সিগারেটটা বের করে বাঁদিকের ঠোঁটে রেখে অগ্নিসংযোগ করল৷ কিছুটা যে ভয়টাকে কাটানোর উদ্দেশ্যেই সেটা, আঁচ করলাম৷ আমি স্মোক করি না, তাই ধোঁয়াটাও সহ্য করতে পারি না৷ একটু দূরত্ব তৈরি করে আমি বললাম, ‘বলো এবার৷ কিরকম বিপদ শুরু হল?’

অ্যাপ্রুভাল না পাওয়া ধোঁয়াটাকে মুক্ত করে, চোখদুটো বিজ্ঞ ব্যক্তির মত ছোট করে বললো, ‘জেঠিমা দোষ পেয়েছিলো! ওসব কত পোয়া টোয়া নাকি হয়, বামুন ঠাকুরেরা বলছিলো তাই৷’

রনে ভঙ্গ দিয়ে প্রীতম বললো, ‘রাবিশ! ওসব দোষ টোষ বলে কিছু হয় না৷ যত্তসব আষাঢ়ে গল্প৷’

আমিও আগে এটাই ভাবতাম, কিন্তু এই কদিনে যা দেখেছি, শুনলে তোর ও এই ধারনা পালটে যাবে৷ পিন্ডদান করার পরদিন সন্ধ্যায় সকলে মিলে বসে জেঠিকে নিয়ে আলোচনা করছি, ঠিক সেই সময় আমার সাথে ঘটে গেলো অস্বাভাবিক কিছু৷ সকলে মিলে গল্প করছি, জেঠিকে নিয়ে কথা হচ্ছে, আমি ঠিক আমার জায়গায় বসে আছি৷ এমন সময় কোথা থেকে একটা পোড়া পোড়া গন্ধ পেলাম, চামড়া পোড়ার গন্ধ৷ পরক্ষণেই দেখি জেঠি আমার পিছন দিক দিয়ে ঘুরে সামনে এসে বসলো৷ জেঠির মুখটা পুরো পোড়া, কি বীভৎস সেই রূপ৷ কি আশ্চর্য! সকলে নিজেদের মত করে গল্প করেই চলেছে৷ তাকে, আমি ছাড়া আর কেউ যেন দেখতেই পাচ্ছে না৷ রণোকে ডেকে নিজের কোলে বসিয়ে বলছে, তাকে সে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে! এসব শোনা মাত্রই আমি নেড়ে-চেড়ে বসি৷ এই সব ধকল সামলাতে সামলাতে দুদিন ঠিক করে ঘুমোতে পারি নি, বুঝলাম আমার চোখ লেগে গেছিলো৷ বাপরে কি ভয়ানক স্বপ্ন! আদপেও স্বপ্ন দেখছিলাম তো? চারদিকে একবার তাকিয়ে দেখে নিলাম, চোখ টা ভালো করে কচলে নিশ্চিত হলাম৷ যেখানে যারা যেমন ছিলো সব সেরকমই আছে৷ কিছুক্ষণের জন্য মনে হয়েছিল সব যেন বাস্তবে ঘটছে৷

বললাম, ‘বাপরে, সাংঘাতিক ব্যাপার তো!’ প্রীতমও আমার কথায় সায় দিলো৷

‘এ পর্যন্ত তো ঠিক ছিলো, কিন্তু এর পরের ঘটনা গুলো…৷’ এই বলে একটু থেমে, বিভীষিকায় ভরা চোখে আমাদের দিকে তাকাল৷ তারপরের যে ঘটনাগুলো বললো সেগুলো এরকম…

(২)

জেঠির শ্রাদ্ধ শান্তির কাজকর্ম শেষ হবার পর দাদা বেশ কিছুদিনের ছুটি নিয়ে, বৌদি আর রণোকে নিয়ে দেবপুরের গ্রামের বাড়িতে চলে আসে৷ গ্রামের বাড়িটা ফাঁকাই পড়ে থাকত বেশির ভাগ সময়৷ জেঠি বেঁচে থাকতে মাঝে মধ্যে আসত, দাদা ছুটি পেলে আসত কখনো কখনো৷ দেবপুরটাকে গ্রাম ঠিক বলা চলে না, কারণ ওই গ্রামের পরিবেশে ছিলো কিছুটা শহুরে ছোঁয়া৷ পাশের গ্রামের একজন মাঝ বয়সের মহিলা কে ঠিক করে রাখা ছিলো ঘরদোর পরিষ্কার, ফাইফরমাস খাটা ইত্যাদি ঘরোয়া কাজকর্মের জন্য৷ দাদাদের আসার খবর পেয়ে সে এসে সব কাজকর্ম সেরে বাড়ি চলে যায়৷

একরাত্রে যথারীতি রাত্রের খাওয়া শেষ করে সকলে শুতে চলে যায়৷ রণো এমনিতে খুব চঞ্চল হলেও খাওয়া-দাওয়া, ঠিক সময়ে শুয়ে পড়া, পড়াশুনো এসব বিষয়ে খুব ডিসিপ্লিন্ড৷ নতুন জায়গা, সেইজন্য সেদিন বৌদির ঠিক করে ঘুম হচ্ছিলো না৷ একসময় পাশ ফিরতেই হঠাৎ খেয়াল করল যে রণো তার পাশে নেই, দাদাকে নাড়া দিয়ে তাড়াতাড়ি ডাকলো বৌদি৷ বিছানা থেকে নামতে গিয়ে বৌদির পায়ে নরম মতো কিছু একটা ঠেকে, ভয়ে পা’টা তাড়াতাড়ি সরিয়ে নেয়৷ ফোনের ফ্ল্যাসের আলোয় দেখে সেটা খাটের তলা থেকে বেরিয়ে আসা দুটো পা৷ একটু ভালোকরে দেখতেই বোঝা গেল সেটা রণো৷ উপুড় হয়ে মেঝেতে পড়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে৷ তার মাথা থেকে কোমর পর্যন্ত খাটের তলায় বাকি পায়ের অংশটা কেবল বেরিয়ে আছে৷ দাদা রণোকে কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দেয়৷ রণো এর আগে কিন্তু কখনো এরকম করে নি৷ হয়ত ঘুমের ঘোরে পড়ে গিয়েছিল৷ তাহলেও পড়ে গেলে সে টের পাবে না, ওরকম ভাবে পড়ে থাকবে?

পরদিন দাদা রণোকে গতরাত্রের কথা জিজ্ঞেস করলে রণো বলে, সে তার দিদার কোলে ঘুমাচ্ছিল৷ দিদা নাকি তাকে কোলে তুলে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছিল৷ রণোর কথা শুনে দাদা, বৌদি দুজনেই অবাক৷ তারা ভাবল, এটা হয়ত তার কোন রকমের দুষ্টুমি৷ কিন্তু তাদের সে ধারণা খুব তাড়াতাড়ি পাল্টে গেল দুপুরে খাওয়ার সময়৷ যা ঘটলো সেটাকে কিন্তু আর কোয়েন্সিডেন্স বলা যায় না৷ পুকুরের টাটকা রুই মাছের ঝোল হয়েছিলো, রণো নিজে খেতে পারে না এখনো, বৌদি খাইয়ে দেয়; সেদিন রণো নিজে হাতে করে খাবে বলে জেদ করায় বৌদি সম্মতি দেয়৷ যে ছেলে আধখানা মাছ খেতে হিমসিম খায় সেই রণো গোটা দু’পিস মাছ খাওয়ার পর, পড়ে থাকা মাছের উচ্ছিষ্ট গুলোও কুড়িয়ে খেতে লাগে৷ দাদার ধমকেও সে কান পাতে না৷ শেষে বৌদি পিঠে দু চাপড় মেরে টেনে টেবিল থেকে তুলে দেয়৷

রণোর হাব-ভাব বৌদির কাছে ভালো ঠেকল না৷ দাদাকে বললো ওকে কোনো ভালো ডাক্তার দেখাতে৷ এসব রণোর চঞ্চল মস্তিষ্ক প্রসূত দুষ্টুমি বলে দাদা, বৌদির কথাটা উড়িয়ে দেয়৷ পরদিন দাদা হাটে যায় আর বৌদি এদিকে রণোকে কাজের মাসি লক্ষ্মীর কাছে রেখে রান্নায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে৷ রণোর দস্যিপনা কোন বাঁধ মানে না৷ একবার কি করছে ছেলেটা, দেখে আসা দরকার, এই ভেবে বৌদি যেই রান্নাঘর থেকে বেরোতে যাবে, দেখে লক্ষ্মী সামনে দাঁড়িয়ে৷

‘ছোট বাবু আসে লাই আপনার কাচে?’

লক্ষ্মীর প্রশ্নে বৌদি থ৷ পাশেই পুকুর, রণো যা বাউন্ডুলে ছেলে, বৌদির ভয় হয়, ছুটে ড্রয়িং রুমে আসে৷ ঠিক যেমন টি ভেবেছিলো! রণো সেখানে ছিলো না৷

লক্ষ্মী জানায়, ‘ছোট বাবু বলল যে আপনার কাচে যাচ্চে!’

বৌদি কোনো কথায় কান না দিয়ে, ছুটে সোজা পুকুর ঘাটে আসে৷ কিন্তু সেখানেও রণো ছিলো না৷ হন্নি হয়ে খুঁজতে খুঁজতে শেষে রণো কে পাওয়া গেলো৷ কিন্তু তারপর তারা যেটা দেখলো তাতে বৌদি আর লক্ষ্মী দুজনেই নিজেদের চোখকে বিশ্বাস করে উঠতে পারছিলো না৷ রণোর কান্ড দেখে বৌদি যেনো দিশেহারা৷ রান্নাঘরের জানলার নিচে যে বাঁধানো ড্রেনটা আছে, সেটার ঠিক পাশে জানলা থেকে ফেলা আবর্জনা স্তূপাকৃত হয়ে ছিল৷ গতকাল রাত্রের খাবারের শেষ পাতের উচ্ছিষ্ট গুলো বৌদি রাত্রে ওর একপাশে ফেলে রেখেছিলো৷ সকালে কুকুরে ওগুলো যাতে খেতে পারে৷ অবোধবিস্ময়ে সে দেখে, রণো সেই ড্রেনের একধারে বসে মাছের কাঁটা, আঁশ ইত্যাদি বেছে বেছে খাচ্ছে৷ বৌদি ক্ষিপ্র বেগে ছুটে যায় রণোর কাছে, পিঠে সজোরে দু’ঘা মেরে চিৎকার করে বলে, ‘পাগল হয়ে গেছিস নাকি তুই!’ শেষে ক্রন্ধনরত ছেলেকে কোলে তুলে ভিতরে নিয়ে চলে যায়৷

‘লক্ষ্মী, দেখ তো তোর দাদবাবু এল কিনা?’

‘না দিদি, দাদাবাবু এখোনো ফেরে লাই তো৷’

বৌদি দাদাকে ফোন করে তাড়াতাড়ি আসতে বলে৷ দাদা ফিরে এলে বৌদি কাঁদতে কাঁদতে দাদাকে সব ঘটনা খুলে বলে৷ সব শুনে দাদা বলে- ‘তুমিও দেখছি রণোর মতো ছেলেমানুষি করছো৷ তুমি তোমার ছেলেকে চেনো না? সারাদিনই তো কত দস্যিপনা করে বেরায়, এটাও তার এক দুষ্টুমি কান্ড৷ আমি তো ছোটবেলায় মাটি, গুঁড়ো মাজন খেয়ে কত মার খেতাম মায়ের কাছে৷ কৃষ্ণও তো ছোটবেলায় মাটি খেত৷ তোমার ছেলে তাহলে কলির কৃষ্ণ৷’

এবারেও দাদা ব্যাপারটাকে বিশেষ গুরুত্ব দিল না৷ রণোর দস্যিপনা বলে দাদা বৌদি কে যতোই সান্ত্বনা দিক, বৌদি কিন্তু কোন ভাবেই ব্যাপারটাকে অতোটা সহজে নিতে পারছিলো না৷ কোথাও না কোথাও একটা খটকা লাগছিল তার৷ মায়ের মন বলে কথা৷

এর পরদিন ঘটলো আরেক ঘটনা৷ পশ্চিমাকাশে সূর্যের যে টুকু লালের আভা ছিলো সেটাও ধীরে ধীরে রক্তবর্ণ হতে হতে ঘন কালো হয়ে এল৷ জ্যোতির অবসান ঘটিয়ে মালসা ভরা অন্ধকার উপুড় করে দিল কেউ৷ নিশুতি রাত্রের নিস্তব্ধ এই গ্রাম্য পরিবেশ যেন দিতে চাই কোনো এক অশনি ইঙ্গিত৷ চারিধারে শোনা যায় কেবল আশপাশের কয়েকটা হাঁস, গরু, ছাগলের আওয়াজ, মনুষ্য জীবন গ্রামের এই অন্ধকারে কোথায় বিলুপ্ত হয়ে যায়৷ আধুনিক কলকাতা শহরে থাকলেও বাঙালির সংস্কৃতি বজায় রাখার চেষ্টা কিন্তু বৌদি সর্বদা করে চলে৷ উদাহরণ, তুলসি মঞ্চে জল ঢালার সময় মাথায় লম্বা ঘোমটা টানা৷ এখানেও তার কোন অন্যথা হয়নি৷ বৌদি যখন সন্ধ্যারতি দিতে ব্যস্ত তখন হঠাৎই দাদা বৌদির কাছে এসে রণোর খোঁজ করে৷

বলে, ‘রণো আসে নি তোমার কাছে?’

বৌদি বলে, ‘কই না তো৷ ওতো তোমার কাছে ছিলো, তোমার সাথেই খেলা করছিলো৷’

‘হ্যাঁ তা তো ছিলো৷ আমি তো বাথরুমে যাচ্ছিলাম, ও তো বলল তোমার কাছে যাচ্ছে…’

‘ঘর গুলো একবার দেখো তো, কোথাও লুকিয়ে আছে কিনা?’

দাদা-বৌদি তন্ন তন্ন করে সব ঘর খুঁজেও কোথাও রণোকে পেলো না৷ এই ভর সন্ধ্যাবেলায় কোথায় গেলো ছেলেটা! গ্রামের দিকে ছেলেধরার প্রকোপ বেশ আছে, সুযোগ পেলেই ছেলে তুলে পাচার করে দেয় বাইরে৷ এসব ভাবনা মাথায় এলে দুজনে রীতিমত দুশ্চিন্তায় পরে৷ এদিকে রণোকে না পেয়ে বৌদি কান্নাকাটি করতে লাগে৷

জোরালো পুলিশি সার্চলাইট নিয়ে দাদা-বৌদি দুজন মিলে রণোকে খুঁজতে বেরোয়৷ প্রতিবেশীদের দু একজন তাদের হাঁক-ডাকে বেরিয়ে আসে৷ তারাও একসাথে রণোকে খুঁজতে লেগে পরে৷ কোথাও নেই রণো৷ বাড়ির চারপাশ, পুকুরের ধার, সব তন্নতন্ন করে খোঁজা হয়েছে৷ কোথাও পাওয়া যায় নি তাকে৷

হঠাৎ খুব মৃদু একটা ‘খচ্ খচ্’ শব্দ দাদা শুনতে পায়৷ শব্দটাকে লক্ষ করে দাদা এগিয়ে যেতে থাকে৷ বেশি দূরে না, কাছেই একজনার বাড়ির পিছন থেকে আসছিলো সেটা৷ লোকগুলোও দাদার পিছু পিছু গেলো৷ বাড়িটার পিছনে একটা অন্ধকার গোয়াল ঘর, ঘুটঘুট্টি অন্ধকার, একটা বাজে, আঁশটে গন্ধে জায়গাটা ভরে গেছে, এ গোয়ালের গন্ধ নয়৷ টর্চের আলো ফেলতেই গরুটা ডেকে উঠলো৷ আলোর ছটাটা একটু সরাতেই দেখলো, মাটিতে গড়িয়ে যাচ্ছে রক্ত৷ টাটকা, কাঁচা, গরম রক্ত! ছাগলটার ধরে যে টুকু প্রাণ আছে সেটুকু দিয়ে সে প্রাণপন নিস্তার পেতে চাইছে৷ জীবনের শেষ সবটুকু শক্তি দিয়ে পা গুলো ছড়িয়ে, ‘ম্যা ম্যা’ করে আর্ত ডাকে কোনরকমে এই পৈশাচিক মৃত্যুর কবল থেকে নিস্তার পাবার শেষ চেষ্টাটুকু করছে৷ আলোর ছটায় রণোর ভোজনে যেন একটু ব্যাঘাত ঘটলো, রণোর মুখ রক্তে ভরে গিয়েছে; গালে, চোয়ালে চারিদিকে রক্ত আর রক্ত৷ ছাগলটাকে বগলদাবা করে ডান হাত দিয়ে টুঁটিটাকে চেপে ধরে আছে আর দাঁতে করে ছিঁড়ে এনেছে সেটার পিঠের কাছের এক খাবল মাংস৷ লোকজন দেখে সে খাওয়া থামিয়ে উপস্থিত সকলের দিকে একবার তাকাল৷

তারপরেই ছাগলটাকে মেঝেতে আছড়ে ফেলে, তার তীক্ষ্ণ নখ সেটার বুকে গেঁথে দিল৷ মরণ যন্ত্রনায় আর্তনাদ করে উঠল ছাগলটা৷ আর ঠিক তখনই রণো সজোরে ফালা ফালা করে দিল সেটার বুক৷ অনেকটা রক্ত ছলকে চারিদিকে ছিটিয়ে পড়ল৷ রণোর মুখে একটা পৈশাচিক হাসির রেখা ফুটে উঠলো৷ সবাই দেখল, তার তীক্ষ্ণ দাঁত গুলো৷ ‘খ্যাঁক’ করে একটা বিদঘুটে আওয়াজ করে বুঝিয়ে দিলো আলোটা তাঁর ভোজনে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে৷ আরও একটা জিনিস সকলে খেয়াল করল, রণোর চোখের সাদা অংশটা নেই পুরো চোখটাই কুচকুচে কালো দেখাচ্ছিল৷ দেখে তো বৌদির অজ্ঞান হবার মত অবস্থা৷ পাশের কোন এক লোক বলে উঠলো, ‘ওকে তেনাতে পেয়েচে !’

দাদা রণোর এই অবস্থা দেখে ভয় পেলেও দিশেহারা হয়ে পড়ে নি৷ পাশে থেকে এক প্রবীন দাদার কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, ‘এই শয়তানকে কেবল বৈকুন্ঠ ওঝাই নামাতে পারবে, গাঁয়ের শেষে থাকে ও৷’

দু’তিন জন লোক যায় ওঝাকে খবর দিতে, এদিকে কয়েকজন বউ বৌদিকে চাতালে বসিয়ে সান্ত্বনা দেয়৷ এতক্ষনে যাদের গোয়ালে এসব কান্ড ঘটছিল তারাও চলে এসেছিল, আর ভয়ে কুঁকড়ে এক কোনে সিঁটিয়েছিল৷

সময় যত পেরোয়, উত্তেজনা তত বাড়তে থাকে৷ ততক্ষণে রণো ছাগলটাকে অর্ধেক খেয়ে ফেলেছে৷ ক্রমশ ভিড় বাড়তে থাকল, খবর পেয়ে আশপাশের গ্রাম থেকে লোকজন আসতে থাকে৷ উপস্থিত সকলেই সচক্ষে দেখছে এই নারকীয় যাত্রাপালা৷ অধীর আগ্রহে দাদা অপেক্ষা করে কখন ওঝা এসে তার ছেলেকে এই পিশাচের হাত থেকে মুক্ত করবে৷ এ কিরকম নিয়তির খেলা? ওই সাত বছরের শিশুটার ভাগ্যে কেন এরকম নিয়তির পরিহাস?

‘মড় মড়’ করে হাড় ভাঙার মত আওয়াজ হল৷ সকলের দৃষ্টি তখন রণোর দিকে৷ ছাগলটার চোয়ালটা ক্ষুরের মত ধারালো নখ দিয়ে চিড়ে মাথা থেকে আলাদা করে দিল৷ লক্ লক্ করে ঘিলুটা খেয়ে, রক্ত লাগা আঙুলগুলো পরম তৃপ্তিভরে চেটে চলেছে৷ সে কি নিষ্ঠুর তৃপ্তি! এই তৃপ্তিরস যেন শয়তানের উচ্ছিষ্ট৷

এতক্ষন ধরে এসব দেখে দাদা পুরো পাথরের মত হয়ে গেছিল৷ মনে মনে ভাবছিল এটা কি তার সাত বছরের ছেলে, রণো?

পিছন থেকে একটা ভারি, গম্ভীর গলায় কেউ বলে উঠল, ‘কই দেখি! কোন শালা শরীল লিয়েচে, কই সে?’

আতঙ্কে ভরা নিস্তব্ধতা ভেঙে আবির্ভূত হল আপাদমস্তক কালো আলখাল্লা পড়া এক প্রৌঢ়৷ হাতে আঁকশির মত কি একটা, ইয়াব্বড় বুক পর্যন্ত ঝুলে পড়া দাড়ি, দু’হাতের কড়ায় মোটা বালা, মাথায় চিট ধরা চুলের পাকানো জটা, রক্তবর্ণ দুই চোখ, মুখ থেকে বেরোচ্ছে দেশি মদের ঝাঁঝালো দুর্গন্ধ৷

উপস্থিত সকলের মধ্যে থেকেই কেউ একজন বলল, ‘বৈকুণ্ঠ বাবা চলে এসেচে! এবার তেনারা পালাবার পথ পবে না৷’

গোয়ালের এক কোনে পড়ে থাকা একটা গরুর দড়ির দিকে আঙুল দখিয়ে বৈকুণ্ঠ বাবা বলল, ‘ওই দড়িটা দিয়ে বাঁধ ওকে তাড়াতাড়ি!’

দাদা ও আরো দু’জন গোয়ালে পড়ে থাকা দড়িটা দিয়ে রণোকে ভালোভাবে বেশ শক্ত করে বেঁধে ফেললো৷

বৈকুন্ঠ ওঝা বলল, ‘তোরা ওকে তুলে লিয়ে আয় আমার পিচু পিচু, ভালো করে চেপে ধরবি!’

রণো হেসে চলেছে৷ সেই হাসি, হাড় হিম করা হাসি, নির্মমতায় পরিপূর্ণ সেই হাসি৷ বৈকুণ্ঠ ওঝার পিছু পিছু রণোকে নিয়ে গিয়ে গাঁয়ের তিন মাথা রাস্তার মোড়ের মাঝখানে ওকে বসানো হল৷

তিন কোণে তিনটি গজালের মত কিছু একটা পুঁতে, বৈকুণ্ঠ ওঝা চিৎকার করে করে কিসব মন্ত্রপাঠ করতে লাগলো৷ চারিদিকে শুধু লঙ্কাপোড়া আর সর্ষে পোড়ার চোখ জ্বালানো ধোঁয়া, আর বিচ্ছিরি গন্ধ৷ বৈকুন্ঠ ওঝা একটা নারকেল ঝাঁটা সজোরে মাটিতে মারতে মারতে বলছে, ‘ছাড় ওর শরীর, ভাগ শালা!’

কিছুক্ষণ পরেই রণোর ব্যবহারে পরিবর্তন দেখা দিলো৷ কিসব ভুল বকতে লাগল সে, ‘মা দেখো কত সুন্দর ঘোড়া ছুটে যাচ্ছে, ঐ দেখো হাতি!’

কিন্তু অন্য সকলে যা দেখল তা ছিল, কালো ধোয়ার মত ঘন মেঘ রণোর শরীর থেকে বেরিয়ে শূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে৷ রণোর দৃষ্টি স্বাভাবিক হয়ে আসছে৷ তীক্ষ্ণ দাঁত, হাতের নখ গুলো, হিংস্র স্বভাব সব যেন কোথায় মিলিয়ে যাচ্ছে৷ ‘জ্যাত্তারা, মা মাগো! যাঃ খুলে দে ওর দড়ি! ও এখন বিপদমুক্ত৷ শয়তান কে তেড়ে দিয়েছি ওর শরীর থেকে৷ আর বেশি দেরি হলে ওকে আর বাঁচানো যেত না৷ কচি বয়স, কচি শরীর৷ তোদের কি কেউ খুব কাছের মারা গেচে অল্পদিন আগে?’

দাদা জানায় যে কিছুদিন আগেই তার মা গত হয়েছেন৷ বৈকুন্ঠ ওঝা জানায়, জেঠি দোষ পেয়েছিল৷ রণো যেহেতু খুব কাছের ছিল তাই ওর মায়া কাটাতে পারে নি৷ ওকে সঙ্গে করে নিতে এসেছিল৷ ওর শরীরে চেপেছিল৷ দাদা নিজের চোখে না দেখলে হয়ত এসব কিছু বিশ্বাসই করতো না৷

যাওয়ার আগে বৈকুন্ঠ ওঝা বলে গেল, ‘উনি মায়া কাটাতে পারচেন না৷ গয়াতে পিন্ডি দিয়ে আসতে হবে৷ আমি মায়ের একটা মাদুলি করে দিচ্ছি ছেলেটাকে পড়িয়ে দিস৷ আর খেয়াল রাখিস পিন্ডিদান না করা পর্যন্ত এটা ওর শরীর থেকে আলাদা না হয় যেন৷ মঙ্গলময়ী মা তোদের মঙ্গল করুন৷ জ্যাত্তারা!’

ওনার পাওনা-গণ্ডা মিটিয়ে, গ্রামের লোকেদের ধন্যবাদ জানিয়ে দাদা, রণো আর বৌদিকে নিয়ে পরদিনই সেই গ্রাম ছাড়ল৷ রণোর দু’তিন দিনের মত জ্বর ছাড়ে নি ওই ঘটনার পর৷ তবে এখন সে সুস্থ৷ কিন্তু বৌদি এখন রণোকে কোথাও একা ছাড়ে না, সবসময় চোখে চোখে রাখে৷

(৩)

পুরো ঘটনাটা শোনার পর, কখন যে পৈতেটা বের করে মুঠো করে ধরেছি খেয়ালই নেই৷ ওরা দেখে ফেলার আগেই সেটা তাড়াতাড়ি জামার ভিতর ভরে নিলাম৷ শেষে একটাই কথা বললাম বুবাইদা কে, ‘আমাকে বাড়ি ছেড়ে দিয়ে আয়৷ রাস্তাটা বড্ড অন্ধকার একা একা যেতে পারব না৷’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *