মৃত্যু বিভীষিকা
(১)
অনেক খুঁজে শেষে অমলবাবুর বাড়িটা পাওয়া গেল। কেউ ঠিক করে ঠিকানাটা বলতেই পারছিল না। জায়গাটা খুব প্রত্যন্ত অঞ্চলে। আছে বলতে কয়েকটা হাতে গোনা বাড়ি আর একটা স্কুল। প্রাগৈতিহাসিক আমলের সাক্ষী বহু পুরানো স্কুলটা৷ প্রবেশদ্বারের প্রায় অর্ধভগ্ন উঁচু স্তম্ভদুটোর মাথার মাঝে, অর্ধচন্দ্রাকৃত চুনসুরকির ফলকে আধভাঙা অক্ষরে লেখা, ‘তেঁতুলগ্রাম উচ্চবিদ্যালয়৷ স্থাপনকাল ১৮৭৮৷’ ব্রিটিশ আমলের স্কুলবাড়িটা আজ পরিত্যক্ত৷ মরচে পড়া একপাল্লা ভাঙা লোহার ফটকের মধ্যে থেকে দেখা যাচ্ছে, সেটার ঘরগুলোর ছাদ ভেঙে পড়ে প্রবাহমান কালের সাথে নিচে জড়ো হয়েছে ইঁটের স্তূপ।
অমলবাবুর বাড়িটা এই স্কুলের গায়ে কয়েক মিটারের ব্যবধানে। এই বাড়িটার অবস্থাও কিছুটা ওই স্কুলটার মতো৷ দেওয়ালের সিমেন্ট খসে পড়ে অধিকাংশ ইঁট বেরিয়ে এসেছে, কোথাও কোথাও ইঁট ছেড়ে পড়ে ফুটো দেখা যাচ্ছে। কোথাও কোথাও আবার নোনা ধরে গেছে। এই বাড়িটাও যে সেকেলে, তা এর অবস্থা দেখেই বোঝা যাচ্ছে৷
বাড়ির দরজার সিংহমুখওয়ালা কড়া নাড়তেই ভিতর থেকে চাপা ক্ষীণ গলায় ‘আসছি!’ বলে আওয়াজ এল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই একজন সিড়িঙ্গে চেহারার লোক এসে দরজা খুলে দিল। লোকটির বেশভূষা আর চেহারার অবস্থা দেখে এই বাড়ির চাকর ঠাউরেছিল। জরা-জীর্ণ চেহারা, গালের চামড়াগুলো যেন করোটির সাথে লেগে গিয়েছে, চোখগুলো দেখে মনে হচ্ছে সেগুলো যেন কোটরে ঢুকে গিয়েছে, রক্তহীন ফ্যাকাসে ঠোঁট৷ দেখে মনে হচ্ছিল যেন মারণরোগাক্রান্ত কোন রুগী৷
লোকটা ইশারা করে আমাকে ভিতরে আসার জন্য বলল৷ ভিতরে ঢুকে যা দেখলাম তাতে আমার চক্ষু চড়কগাছ৷ বাইরে থেকে এই বাড়ি দেখে কেউ ভাবতেই পারবে না যে এর ভিতরটা এত সুন্দর, পরিপাটি করে সাজানো গোছানো এবং রীতিমত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন৷ লোকটা একটি ঘরের দিকে ইশারা করে আমাকে সেই ঘরের ভিতর গিয়ে বসতে বলল৷ আমি যথারীতি সেই ঘরের ভিতর গিয়ে বসলাম আর অবাক দৃষ্টিতে আশেপাশের সাজানো জিনিসপত্রগুলো দেখতে থাকলাম৷ ঘরের অধিকাংশ আসবাবপত্র দেখে বোঝাই যাচ্ছিল সেগুলো বেশ দামী, সেগুলোর বেশিরভাগই ব্রিটিশ সময়ের আর সম্ভবত বাদাম আর সেগুন কাঠের তৈরি৷ দেওয়ালের উপর চমৎকার পোড়ামাটির খোদাই করা কারুকৃতি, বাঁশের মাদুরের উপর এনামেল রঙ দিয়ে আঁকা এক নেপালি মেয়ের ছবি, নিখুঁত কাজ করা রঙিন কাঁচের ঝাড়বাতি, মেঝেতে রাজস্থানি কার্পেট ইত্যদি৷ এককালে আঁকাজোকার অভ্যাস ছিল তাই এসব কারুকৃতিগুলোকে বিশ্লেষণ করে চিনতে অসুবিধা হল না৷ তবে ঘরের উত্তরদিকের জানালাটা বেশ দৃষ্টিনন্দন। মোটা বাদাম কাঠের তৈরি জানালার কালো বার্নিশ করা পাল্লাগুলোর উপর কারুকার্যগুলো বেশ অদ্ভুত ধরণের দেখতে লাগছিল৷ যেন সূঁচ বা ওই জাতীয় সূঁচালো কোন জিনিস দিয়ে ঘষে ঘষে সেগুলো করা হয়েছিল৷
আমি অমলেন্দু নস্কর৷ কলেজ পাশ দিয়ে এক বেসরকারি বিমা কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছিলাম৷ বেশ কয়েকমাস আগেই আমার ক্লায়েন্ট অমলবাবু আমাদের সংস্থা থেকে একটি বিমা করিয়েছিলেন৷ প্রথমদিকে সব ঠিকঠাক ছিল, কিন্তু হঠাৎই কয়েকমাস থেকে অমলবাবু তাঁর বিমার প্রিমিয়াম জমা করছেন না৷ টেলিফোনেও পাচ্ছিলাম না৷ তাই বাধ্য হয়ে খোঁজ-খবর নিতে আমাকেই আসতে হল৷
বাড়িটা ঘুরে দেখতে গিয়েই বেশ কিছুক্ষণ সময় পেরিয়ে গেল৷ আচমকা পেছনে কারো উপস্থিতি অনুভব করলাম৷ অমলবাবুর সৌখিনতার নিদর্শনগুলো দেখতে দেখতে সেগুলোর প্রতি এতটাই হারিয়ে গেছিলাম যে, খেয়ালই করি নাই, সেই সিড়িঙ্গে চাকরটা কখন আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে৷
‘অমলবাবু কখন আসবে?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম৷
চাকরটা আমার দিকে মুহূর্তের জন্য তাকাল৷ তারপর সন্তর্পণে এগিয়ে গেল সেই জানালাটার দিকে, ‘সে অনেকদিন আগের কথা’৷ চাপা রুক্ষ স্বরে বলে উঠল৷
মনে মনে ভাবলাম, লোকটার গলায় কি সুর বলে কিছু নেই? কী বিশ্রী গলা রে বাবা! হঠাৎ চাকরটা, জোরে ধাক্কা দিয়ে ওই বাদামকাঠের জানলাটার পাল্লাদুটো খুলে, বাইরের স্কুলটার দিকে ইশারা করে বলতে লাগল৷
ওই যে দেকচেন ওই ইশকুলটা৷ ওখানেই, হ্যাঁ ওখানেই বহুদিন আগে ওই ইশকুলে প্রীতম নামে একটা ছেলে পড়ত৷ এখানে সে থাকত মেস ভাড়া করে৷ এই বাড়িটাই ছিল তার মেস৷
তখন সে সবে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ দিয়ে উঁচু কেলাসে ভর্তি হয়েছে৷ একদিন সে সন্ধ্যার সময় ইশকুলের পিছনের দিকে হাওয়া খেতে বেরিয়েছিল৷ ওই ইশকুলের পিছনের দিকে ছিল একটা গোরস্থান৷ সেদিন সেখানে অনেক লোকজনকে ভিড় করে থাকতে দেখেছিল৷ কৌতুহলের বশে সেও সেখানে গিয়েছিল৷ দেখেছিল, গলা অবধি সাদা কাপড়ে ঢাকা এক অল্পবয়সী ছেলের লাশ কবর দেওয়া হচ্ছিল৷ বুড়ো মৌলবি জানাজার নামাজ পড়ছিল ওর রুহ্-এর জন্নত বাসের জন্য৷ বয়স আন্দাজ একুশের কাছাকাছি হবে৷ এত অল্প বয়সে মৃত্যু! দেখেই কেমন যেন বুকের ভিতরটা ছ্যাঁত করে উঠেছিল তার৷ কিন্তু এই কাঁচা বয়সে প্রাণ হারাল কী করে? পাশের দু’-একজনকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পেরেছিল, ছেলেটার উপর নাকি ‘খলা’ বা হিন্দুদের ভাষায় যাকে খারাপ পিশাচ বলে, ভর করেছিল৷ কথাটা শুনেই যেন তার সর্বাঙ্গে এক শিহরণ বয়ে গিয়েছিল৷ সে আরো একটা জিনিস লক্ষ করেছিল, লোকগুলোর কেউই ছেলেটার দেহটাকে স্পর্শ করছিল না৷ প্রত্যেকেই একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে, বাঁশ বা ওইরকম কোন জিনিস দিয়ে সেটাকে নাড়াচাড়া করছিল৷ ছেলেটা ভেবেছিল হয়তো এটাই তাদের ধর্মের রীতি। ব্যাপারটা তার কাছে গুরুত্বহীন মনে হওয়ায় সেটার কারণ সম্পর্কে কৌতুহল প্রকাশ করেনি সেই সময়৷
সন্ধ্যা নেমে এসেছিল৷ চারপাশের হ্যারিকেন জ্বলে উঠেছিল৷ লাশের উপর কবরের মাটি ফেলার সময় হ্যারিকেনের আলোয় শেষবারের মত ছেলেটার মুখ দেখেছিল৷ মনে হয়েছিল, কোন দেবসন্তান যেন তার পালঙ্কে নিদ্রাবেশে শুয়ে ছিল৷ অমন সুন্দর চাঁদপারা মুখখানি দেখলে কেউ ভাবতেই পারবে না যে ছেলেটার মৃত্যু কতটা মর্মান্তিক৷ বড় খারাপ লেগেছিল প্রীতমের৷’
(২)
বুড়ো কিছুক্ষণ থামল। তারপর একটু দম নিয়ে ফের বলতে শুরু করল:
সেদিনের পর থেকে কোন এক অজানা বিষন্নতা, কালো মেঘের মত তার মনটাকে গ্রাস করল৷ তারপর থেকে তাঁর চোখের সামনে প্রায়ই সেই ছেলেটার মুখটা ভেসে উঠত৷ এভাবে বেশ কিছুদিন কেটে গেল৷
একদিন বিকেলে প্রীতম সেই কবরের কাছে এসে বসল৷ ছেলেটার মায়া যেন তাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল সেখানে৷ সেখানে বসে থাকতে থাকতে অনেকক্ষণ কেটে গেল৷ পশ্চিম আকাশে সূর্যের আলো ক্রমশ ম্লান হয়ে এল৷ আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝুপ করে চারিদিকে ছেয়ে নেমে আসবে অন্ধকার৷
একসময় সে উঠে দাঁড়াল৷ মেসের দিকে পা বাড়াতে যাবে অমনি হঠাৎ পা হড়কে সে পড়ে গেল কবরের উপর৷ তাড়াতাড়ি সেখান থেকে উঠে পড়ে জামা-কাপড়ের ধুলো ঝাড়তে লাগল৷ ঝাড়তে গিয়ে দেখেছিল তার কনুইটা ছুলে গিয়ে সেখান থেকে রক্ত বেরোচ্ছে৷ নিমেষের মধ্যে যে কী হল? কী করে পা-টা হড়কাল কিছুই সে ঠাউর করতে পারছিল না৷
হঠাৎ তার চোখ গেল তার আশেপাশের দিকে৷ যা দেখল তাতে তার দুই চোখ বিস্ফারিত হয়ে রইল৷ দেখল সে দাঁড়িয়ে রয়েছে কবরটার মধ্যে৷ তার চারপাশে কাটা মাটির দেওয়াল৷ আশ্চর্য! মাটি ভরাট করা কবর, যার সামনে সে এতক্ষণ বসে ছিল সেটার মাটি উধাও হল কী করে? এবার সে বেশ ভয় পেল৷ তাড়াতাড়ি সেখান থেকে উঠে পড়ে পিছন ফিরে পালাতে যাবে, এমন সময় কী মনে হল, মনে সাহস সঞ্চয় করে সূর্যের ম্লান আলোতে কবরটার কাছে গিয়ে পূর্ব ঘটনা নিশ্চিত হওয়ার জন্য দেখার চেষ্টা করল, সত্যিই সেখানে কোনো খাল আছে কিনা৷ আশ্চর্যের বিষয় এবার সেখানে কোনো খাল ছিল না৷ মাটি ভর্তি কবর, যেমনটি সে বিকালে দেখেছিল৷
হঠাৎ প্রীতমের মনে হল তার পায়ে কী যেন একটা চলছে৷ সে চটজলদি পা সরিয়ে, লাফিয়ে কয়েকহাত পিছনে সরে গেলো৷ ততক্ষণে সূর্য অস্ত গিয়েছে৷ চারদিকে কালো মিশমিশে অন্ধকার নেমে এসেছিল৷ সে পকেট থেকে দেশলাই-এর বাক্স বের করে একটা কাঠি জ্বালালো৷ নিচে করে ধরে সেটার আলোতেই সে দেখলো একটা বীভৎস হাত সেই কবর থেকে বেরিয়ে এসেছে৷ সে হাতের অধিকাংশে পোকা ধরে গিয়ে স্থানে স্থানে পচা মাংস দেখা যাচ্ছে, সাদা রস ও কালচে রক্ত গড়াচ্ছে৷
এই হাড় হিম করা দৃশ্য দেখামাত্র সে প্রাণপনে সেই অন্ধকারের মধ্যেই ছুটতে লাগল৷ ছুটতে ছুটতে রাস্তায় যে কতবার হোঁচট খেয়েছে তার কোনো ঠিক নেই৷ কোনভাবে সে মেসে পৌঁছিয়ে, নিজের ঘরে এল৷ তার হৃদস্পন্দন এখন প্রায় মিনিটে একশো ছুঁই ছুঁই, শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি প্রচণ্ড বেড়ে গিয়েছে৷ এরকম অভিজ্ঞতা তার জীবনে এর আগে কখনও ঘটেনি৷ বন্ধুরা তার এই অবস্থার কারণ জিজ্ঞেস করাতে, অন্য অজুহাত দেখিয়ে গোরস্থানের ঘটনাটা চেপে গিয়েছিল পাছে তারা অবিশ্বাস করবে, ঠাট্টা করবে৷
সেসব দেখার পর থেকে ওর শরীরটা খুব খারাপ করছিল, রাতেও কিছু খেতে পারেনি৷ তাই সেদিন সে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছিল৷ ওর ঘরটায় ওর সাথে থাকত আরও দু’জন৷ প্রত্যেকেই ওই স্কুলের ছাত্র৷
রাত তখন গভীর, আন্দাজ দুটো নাগাদ, ঘুমের ঘোরে হঠাৎই মনে হল, তার বুকের উপরটা কেমন যেন ভারী ভারী লাগছে৷ চোখ খুলতেই, ঘরের ডিম লাইটের আলোয় সে দেখলো একটা বিশাল সাপ তাঁর বুকের উপর পাকিয়ে বসে আছে৷ সেটা তার দেহের উপর ভর করে প্রায় দু’ হাত বড় ফনা তুলেছে৷ সাপটার রক্তলোলুপ চোখে, হিংস্রতার ছাপ স্পষ্ট৷
সে যেন তার বাকশক্তি হারিয়েছে, চিৎকার করে যে বন্ধুদের ডাকবে সে ক্ষমতা নেই৷ কিছুক্ষণ পর সে দেখল সাপটা ধীরে ধীরে তার বুক থেকে নেমে, এঁকেবেঁকে ঘরের কোণের দিকের অন্ধকারটায় অদৃশ্য হয়ে গেল৷ পরমুহূর্তেই সে যেন তাঁর বাকশক্তি ফিরে পেল৷ এক লাফে খাট থেকে নেমে রুমের লাইট জ্বালিয়ে, চিৎকার করে ডাকতে লাগল সবাইকে৷ তাঁর চিৎকারে আশেপাশের ঘরের ছেলেরাও ছুটে এসেছিল৷
প্রীতমের কথা শুনে, সকলে ঘরের আনাচে-কানাচে তন্নতন্ন করে খুঁজল৷ কিন্তু না, কোত্থাও কিছু নেই৷ বন্ধুরা তাকে বলল যে সে কোনো খারাপ স্বপ্ন দেখেছে হয়তো৷ কিন্তু প্রীতম বুঝতে পেরেছিল যে এটা কোনো খারাপ স্বপ্ন ছিল না৷ সে রাতে তার ঘুম এল না, পাছে সেটা আবার চলে আসে, তাই সারারাত সে সতর্ক প্রহরীর মত সজাগ থাকল৷
এরপর সপ্তাহখানেক কেটে গেল৷ সব ঠিকই ছিল, কিন্তু হঠাৎ একদিন আবার এক ঘটনা ঘটে গেল৷ সেদিন রাত্রে ভ্যাপসানি গরম থাকায় প্রীতমের ঘুম আসছিল না, তাই বাতাস আসার জন্য উত্তরের জানালাটা খুলতে গিয়ে সে দেখল — একটা রক্তবর্ণের আগুনের স্ফুলিঙ্গ বাইরের থেকে ধীরে ধীরে শূন্যে ভাসতে ভাসতে তারই দিকে আসছে৷ সে তাড়াতাড়ি জানালাটা বন্ধ করতে গেল৷ কিন্তু কী আশ্চর্য, শত গায়ের বল প্রয়োগ করেও সে সেটার পাল্লা দুটোকে টেনে আনতে পারল না৷ জানালাটা বন্ধ করার মত ন্যূনতম শক্তি, যেন তখন সে হারিয়েছে৷ তার সমগ্র শরীরকে কোন এক অদৃশ্য শক্তি আঁকড়ে ধরে আছে৷ হাত, পা, ওষ্ঠ সমেত তার সর্বাঙ্গ পাথরের মত আড়ষ্ট ও ভারী হয়ে আসতে লাগল৷ ক্রমশ তার বাকশক্তিটুকুও লোপ পেল৷
সেই স্ফুলিঙ্গ ভাসতে ভাসতে সেটা একসময় প্রীতমের একদম কাছে চলে এল৷ পরমুহূর্তেই সেটা তার দেহের মধ্য দিয়ে গলে ঘরে ঢুকে পড়ল৷ তার সাথে কী ঘটে চলছিল তার আগাগোড়া কিছুই সে বুঝতে পারল না৷ অপলক দৃষ্টিতে সে চেয়ে রইল সেই স্ফুলিঙ্গটার দিকে৷ সে বুঝতে পারল এবার হয়ত কিছু একটা ভয়ানক ঘটতে চলেছে৷ তার মন তাকে কোন অজানা বিপদের আশঙ্কার ইঙ্গিত দিচ্ছিল৷
অদ্ভুত এক আওয়াজে তাঁর ঘোর কাটল৷ এর পরই তার চোখ গেল, ঘরের পশ্চিমদিকের চৌকিটার দিকে৷ যেখানে তারই দু’জন বন্ধু শুয়ে থাকে৷ সে দেখল তারা দুজন নিজেদের পেট চিরে ফেলেছে, আর সেখান থেকে খুবলে খুবলে মাংস খাচ্ছে৷ টাটকা গাঢ় রক্ত গড়িয়ে পরছে তাদের চিবুক বেয়ে৷ চেরা জায়গাটা থেকে নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে ঝুলে পড়েছে চৌকি থেকে, আর সেখন থেকে বেরোনো রক্তে ভিজে গিয়েছে বিছানার চাদর৷
হিংস্র কোন প্রানী বহুদিন ক্ষুধার্ত থাকার পর, হঠাৎ শিকার পেলে যেমন করে খায়৷ এ দৃশ্য যেন তার থেকেও ভয়াবহ৷ রক্তাক্ত তাদের চোখ, আর্ত তাদের গোঙানি, অভিশপ্ত তাদের অট্টহাসি৷
তাদের মধ্যে একজন পেটের অংশটা থেকে টান মেরে এক টুকরো মাংস ছিঁড়ে, সেটা প্রীতমের দিকে বাড়িয়ে বলল — ‘খাবি?’
চোখের সামনে এরকম বিভীষিকাময় দৃশ্য দেখে সে লুটিয়ে পড়ে যায়৷
পরদিন, অনেক বেলা অবধি প্রীতমের ঘরটা বন্ধ থাকায় আশেপাশের ঘরের ছেলেরা দরজায় ধাক্কা মেরে ডাকাডাকি শুরু করল৷ অনেক ডাকাডাকির পরেও যখন ঘরের দরজা কেউ খুলল না, তখন তারা মেস মালিককে ডেকে এনে দরজা ভাঙা শুরু করল৷
দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকেই দেখতে পেয়েছিল রক্তে রাঙা খাটের উপর দু’জনের ছিন্নভিন্ন শরীর৷ একজনের শরীরের অর্ধেকাংশ চৌকি থেকে প্রায় ঝুলে পড়েছিল৷ তাদের পেটগুলো চেরা, সেখান থেকে বেড়িয়ে এসে বিছানার চারিদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নাড়িভুঁড়ির উপর বড় বড় ডাঁশ মাছি ভনভন করে চক্রাকারে উড়ে চলেছে৷ বিস্ফারিত তাদের চোখ ফেটে দু’গাল বেয়ে বেরিয়ে আসা চাপ চাপ রক্ত জমাট বেঁধে গিয়েছে৷ দু’জনের রক্তাক্ত চোখ দু’টো স্পষ্ট ব্যক্ত করছিল, এ যেন এক নারকীয় যন্ত্রনাদায়ক মৃত্যু৷ ঘরের চারিদিকে রক্তের দাগ, ঘর জুড়ে বিশ্রীরকমের দুর্গন্ধ৷
উত্তরদিকের জানালাটার পাশে অচেতন অবস্থায় পড়েছিল প্রীতমের শরীর৷
পুলিশ ডাকা হল৷ মৃতদেহদুটিকে তারা নিয়ে গেল৷ প্রীতমের অবচেতন দেহটাকে তুলে ধরার সময় দেখেছিল তার মাথার পিছন থেকে কিছুটা রক্ত মাটিতে পড়ে জমাট বেঁধে গিয়েছিল৷ মাথা ঢাকা ছিল তাই প্রথমে কারও চোখে পড়ে নি৷ পরে পুলিশের ডাক্তার নাড়ি টিপে জানাল সেও মারা গিয়েছে এবং প্রীতমের দেহটাকেও তারা নিয়ে গেল৷
(৩)
পরে ময়নাতদন্তের রিপোর্টে পুলিশ ছেলেদুটোর মৃত্যুর কারণ জানিয়েছিল, মানসিক বিকৃতির কারণে তারা নিজেদের পেট নিজেরাই চিরে একপ্রকার আত্মহত্যা করে এবং প্রীতমের মৃত্যুর কারণ জানিয়েছিল, মাথার পিছনটা কোন শক্ত কিছুতে ঠোকা খেয়েছিল৷
আমি জানি, সেসব নারকীয় দৃশ্য দেখে, অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবার সময় তার মাথাটা সজোরে ঠোকা খেয়েছিল জানালার তাকে৷ লোকে বলে পিশাচে মারা মরার ছোঁয়া লাগলে নাকি তাকেও পিশাচে মারে৷’
এতগুলো কথা বলার পরে একটা তির্যক হাসি হাসল চাকরটা৷
তুমি কী করে জানলে? তুমি সেখানে ছিলে বুঝি?’ আমি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম তার দিকে৷
আমার প্রশ্নের কোনোরকম উত্তর না দিয়ে সে আবার বলতে শুরু করল:
সেই ঘটনার পর প্রীতমের ঘরটাকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল৷ সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই মেসের অন্যান্য ভাড়াটিয়ারাও মেস ছেড়ে চলে যেতে থাকল৷ তারা বলত তারা নাকি রাত্রে কার গোঙানির আওয়াজ পেত, ঘরে কাদের সব ছায়াদের আসতে যেতে দেখা যেত৷ ক্রমে এটা ভুতুড়ে মেস বলে পরিচিত হল এবং একসময় এটা বন্ধ হয়ে গেল৷ বছর খানেক আগে এই মেস অমলবাবু কেনেন৷ আর তারপর তিনি দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা প্রীতমের সেই ঘরটা খোলেন৷ তার বেশ কিছুদিন পরই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন…
এই বলে চাকরটা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ফের বলল:
জানেন মশাই আপনি এখন, এই যে ঘরটায় বসে আছেন এখানেই প্রীতম আর সেই ছেলেদুটোর লাশ পাওয়া গিয়েছিল৷ ওই যে উত্তরের জানালাটা, আমি ওটার পাল্লাটায় সব ঘটনাগুলোর ছবি খোদাই করে এঁকেছি, এখনও এঁকে চলেছি৷’ বলেই সে আপনমনে হাসতে হাসতে উন্মাদের মত জানালার পাল্লাগুলোতে হাত বোলাতে লাগল৷
কথাগুলো বলার ভাব-ভঙ্গিটা কেমন যেন ভালো ঠেকল না আমার৷ এক অজানা ভয়ে আমার সারা শরীরে একটা শিহরণ বয়ে গেল৷ কিছুটা ভয় মেশানো বিরক্তভাবেই জিজ্ঞেস করলাম, ‘তা অমলবাবু এখন কোথায় আছেন, ডাক্তার দেখাতে গেছেন নাকি? আর তুমি বললে না তো তুমি এত কিছু জানলে কী করে?’
ওই যে বললাম, তিনি অসুস্থ ছিলেন৷ দিন চারেক অসুস্থ থাকার পর ব্যস, উনিও মারা গেলেন৷ আর আমি এত কিছু জানলাম কীভাবে?’ কথাটা অসম্পূর্ণ রেখেই সে প্রচণ্ড জোরে, উন্মাদের মত হাসতে লাগল৷ তার সেই হাসিতে এক বিভীষিকাময় রহস্যের আভাস পেলাম৷
একসময় হঠাৎ সেই হাসি থামিয়ে বজ্রগম্ভীর গলায় বলল, ‘আমিই সেই প্রীতম!’