পূর্বাভাস

পূর্বাভাস

(১)

আগের থেকে এখন অনেকটাই ভালো আছে রিম্পা৷ ওষুধের ডোজটাও কমিয়ে দিয়েছেন ডাক্তার সেন৷ কিছুদিন আগে পর্যন্ত এই গুমোট, অন্ধকার ঘরটাই ছিল ওর জগৎ সংসার৷ এখন মাঝে মধ্যেই বাইরে যায়৷ একা থাকার বাতিকটা অনেকটা কেটেছে৷

জাপানি ইন্টারপ্রিটারের চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি৷ কাজেই হাতে সময়ের কোন অভাব নেই৷ কদিন হল বিকেলে ওকে নিয়ে গার্ডেনের দিকে যাই, একটু হাওয়া খেতে৷ আজও এসেছি৷ চারপাশে পাঁচটা পাঁচ রকম মানুষজন দেখলে মন ভাল থাকবে৷ ভুলে থাকবে সেইসব৷

ওর আজকের দিনটার কথা মনে নেই বোধ হয়৷ আমি মনে পড়াই নি, পড়াতেও চাই নি৷ মনে থাকলে পাগলামি শুরু করে দিত হয়ত৷ ভয় করে, পাছে মনে পড়ে, তাই সকাল থেকে ওকে বিভিন্নভাবে ভুলিয়ে রেখেছি৷

টং টং করে ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে একটা আইসক্রিমওয়ালা পেরিয়ে যাচ্ছিল৷ ডেকে দাঁড় করিয়ে দুটো আইসক্রিম কিনলাম৷ খেতে খেতে গার্ডেনের এক প্রান্তের নিরিবিলি, ফাঁকা একটা বেঞ্চিতে এসে বসলাম৷ সামনের শান্ত দিঘির জলে চারপাশের গাছপালাগুলোর প্রতিবিম্ব গড়ে উঠেছে৷ অদূরেই দেখা যাচ্ছে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল৷ এই ঊষালগ্নের ম্লায়মান আভাতেও সেটা ধবধবে সাদা মুক্তোর মতো দেখাচ্ছে৷

রিম্পা আমার কাঁধে মাথা রাখল৷ ভিক্টোরিয়ার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললো, ‘দেখো আর কিছুক্ষণ পরেই সূর্য ডুবে যাবে৷’ ছোট্ট একটা ”হু!” এ জবাব দিলাম আমি৷

আমরা যে দিনই এখানে আসি সেই দিন সূর্যাস্ত দেখে তবেই বাড়ি যাই৷ আর কিছুক্ষণ পরেই সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়বে৷ গোধূলির লালচে-কমলা আভায় এই সাদা ভিক্টোরিয়াও তখন রাঙা হয়ে উঠবে৷ অপূর্ব দেখায় তখন৷ প্রকৃতির সাথে তাল মিলিয়ে এও তার রূপ পরিবর্তন করবে৷ ঠিক যেমন মানুষ বেঁচে থাকতে এক রূপ আর মারা যাওয়ার পর আরেক৷ তবে এই তাল মেলানোর ব্যাপারে সবক্ষেত্রে কিন্তু সূত্রটা প্রযোজ্য নয়৷ কিছু জিনিস অতিপ্রাকৃতিকও হয়৷ যেমনটা হয়েছিল আমাদের সাথে, আজ থেকে বছর দু’য়েক আগে, আজকের দিনে৷ মনে পড়লে যত না ভয়ে শিউরে উঠি, তার থেকে কষ্ট হয় বেশি৷ বুকের ভেতর চিনচিনে এক ব্যথা চাগিয়ে ওঠে৷

(২)

বোলপুরের মুলুক গ্রামে আমাদের কিছু পৈতৃক জমি ও একটা পুকুর ছিল৷ কর্মসুবাদে জাপানে বহুবছর থাকার পর ট্রান্সফার নিয়ে দেশে ফিরলাম৷ চাকরির প্রথম কয়েক বছরের মধ্যেই কলকাতায় একটা বাড়ি কিনেছিলাম৷ কিন্তু এত বছর শহুরে পরিবেশে থাকার পর ভাবলাম বাকি জীবনটা নিরিবিলিতে কাটাবো৷ তাই ঠিক করলাম মুলুকের জমিতে একটা বাড়ি করবো৷ রিম্পা বারণ করেছিল, বলেছিল ওই ধ্যারধ্যারে গোবিন্দপুরে এই বয়সে নতুন করে আবার সংসার পাততে পারবে না৷ তাছাড়া আরও একটা অখন্ডপ্রায় যুক্তি দিয়েছিল৷ বলেছিল মেয়ে বড় হয়েছে, বিএসসি কমপ্লিট হলে এই কলকাতায় চাকরির কত সুযোগ৷ ওখানে থাকলে সে সব পাওয়া যাবে না৷ তার থেকে বরং ওই জায়গা আর পুকুর বিক্রি করে দিলে দু’পয়সা আসবে৷ তখন আমি ওসব কথায় কর্ণপাত করিনি৷ কিছুটা একগুঁয়েমি আর জেদের বশেই বলা যেতে পারে৷ এত বছর নিজের দেশ, নিজের জন্মভূমি ছেড়ে বিদেশ-বিভুঁই এ পড়েছিলাম৷ হয়তো এসব কারণেই আমার মধ্যে এত জেদের সঞ্চার ঘটেছিল৷ যাইহোক, রিম্পাকে এসবের মধ্যে না জড়িয়ে ভালো এক ঠিকাদার দেখে বাড়ি করার দায়িত্ব দিলাম৷ পুকুরটার বিশেষ কোনো প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি না করায় ওটাকে বুজিয়ে দিয়ে ওই জায়গায় গ্যারেজ করতে বলেছিলাম৷ আমার এই সিদ্ধান্তের জন্য অবশ্য রিম্পা আমার ওপর বেশ চটে ছিল৷ মাঝখানে বেশকিছুদিন ঠিক করে কথাও বলেনি প্রায় বললেই চলে৷ মেয়ে এ ব্যাপারে একেবারে নিরপেক্ষ ছিল৷ এভাবে দেখতে দেখতে প্রায় এক বছর পর বাড়ি তৈরি শেষ হল৷ সপ্তাহ খানেক পর গৃহপ্রবেশের অনুষ্ঠান শেষে, অফিস থেকে টানা দু’মাসের লিভ নিলাম৷ লোটা-কম্বল সমেত সিফট্ হয়ে গেলাম নতুন ঘরে৷ তারিখটা মনে আছে ১৫ ই মে ২০০৬৷

দোতলা বাড়ি৷ উপর-নিচ সিক্স-বাই-সিক্স আটখানা রুম৷ দুটো বড় ড্রইংরুম, সামনে চওড়া উঠান৷ পুকুরের জায়গায় বিদেশি আদবের কনভার্টাইবেল দরজাওয়ালা গ্যারেজটা তৈরি করা হয়েছিল৷ বাড়ির চারিদিকে লাগানো হয়েছিল সুবর্ণলতা, এস্টার, মর্নিং গ্লোরি, চাইনিজ লিলির মত বিভিন্ন দেশি-বিদেশি ফুলের গাছ৷ মোটের উপর পুরো বাড়িটা আমার মনের মত তৈরি হয়েছিল৷

পাড়া-প্রতিবেশী বলতে বিশেষ কেউ ছিল না৷ যারা ছিল তাদের প্রায় প্রত্যেকের সাথেই গৃহপ্রবেশের অনুষ্ঠানে পরিচয় হয়েছিল৷ বাড়ির সামনে বিস্তর প্রান্তর জুড়ে ছিল একটা ফাঁকা মাঠ৷ আর সেই মাঠের শেষ প্রান্ত থেকে শুরু হয়েছিল সারি সারি আমগাছের ঘন বনানি৷ শুনেছিলাম ওটা নাকি কোন এক সরকারি প্রজেক্টের জায়গা, ‘তপোবন’ নাম৷ বাড়ির সামনে দিয়ে চলে গেছিল লালমাটির কাঁচা রাস্তা৷ কিছুটা গিয়েই সেটা মিলেছিল বাজারের পাকা রাস্তার সাথে৷ বহু বছর আগে দু’একবার এখানে এসেছিলাম৷ তখন দোকানপাট বলতে দু’চারটে ঘুমটি ছাড়া আর বিশেষ কিছুই ছিল না৷ এখন সেখানে রীতিমত বাজার বসে গিয়েছিল৷ সেই সব দেখে রিম্পার ‘ধ্যারধ্যারে গোবিন্দপুর’ কথাটা মনে করে খুব হাসি পেয়েছিল৷

নতুন বাড়িতে সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই দু’জনার মধ্যে ছোটখাট ব্যাপারে দাম্পত্য কলহ হতে লাগল৷ এর অবশ্য কারণও ছিল৷ এত বড় বাড়ির সব কাজকর্ম ওকে একাহাতে সামলাতে হতো, ফলে ওর মেজাজ সবসময় তেতে থাকতো৷ ওর এই ভার লাঘব করার জন্য কাজের মাসি ঠিক করেছিলাম৷ কিন্তু দু’দিন পরই সে কিছু না জানিয়েই আসা বন্ধ করে দিল৷ এভাবে এক সপ্তাহে আরও চারজন কাজের মাসিকে ঠিক করা হল৷ প্রত্যেকেই দু’একদিন কাজ করে পরদিন থেকে আর আসে নাই৷ দু’বেলা খাবার, মোটা মাইনে, অনেক কিছুর লোভ দেখিয়েও একটাকেও টেকাতে পারলাম না৷ কলকাতায় কাজের মাসির অভাব হয় না৷ সেই খোঁটা আমাকে উঠতে বসতে শুনতে হচ্ছিল রিম্পার কাছে৷ খুব ফ্যাসাদে পড়েছিলাম৷ কি করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না৷

একদিন সকালে বারান্দায় বসে দাঁড়ি কামাচ্ছিলাম৷ এমন সময় রাস্তার দিকে চোখ পড়তেই খেয়াল করলাম একটা ভিখারি গোছের বুড়ি আমাদের বাড়িটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে৷ দুটো টাকা হাতে নিয়ে ওকে দিতে গেলাম৷ লক্ষ করলাম ওর দৃষ্টি গ্যারেজটার দিকে৷ তার চোখ কিছু যেন একটা খুঁজছিল৷

‘ও বুড়িমা! কি দেখছ?’

আমাকে দেখেই কেমন যেন একটু চমকে উঠল৷ বয়স্ক, কাঁপা গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘এখানে একটা পুকুর ছিল না? কই গেলো সেটা?’

‘ওটাকে বুজিয়ে ওটার ওপর বাড়ি হাঁকিয়েছি গো!’ বেশ গর্বের সুরেই বললাম কথাটা৷

শুনেই বৃদ্ধা একেবারে আঁতকে উঠল৷ কৌতুহল মাখা আফসোসের সুরে বিড়বিড় করে বললো, ‘বাড়ি হাঁকিয়েছিস! পুকুর মেরেছিস?’

তার পরমুহূর্তেই বড় বড় করে চোখগুলো পাকিয়ে, দাঁত খিঁচিয়ে, হাতের বাঁকা লাঠিটা উঁচিয়ে তেড়ে এল আমার দিকে৷ ভাঙ্গা-নখওয়ালা হাতে লাঠিটা আমার সম্মুখে তুলে ধরল৷ অদ্ভুত বিকৃত ভঙ্গিমায় দূরছাই করার মতো করে বললো, ‘পালা, পালা! বাঁচতে চাইলে পালা! সর্বনাশ করেছিস, সর্বনাশ!’

আমার কিছু বলার আগেই বুড়ি ওই কথাগুলোই আপনমনে বিড়বিড় করতে করতে চলে গেল৷ ভেবেছিলাম কোন পাগল হয়তো৷ তখনও বুঝতে পারিনি, কি সঙ্গিন বিপদ আসতে চলেছিল৷

(৩)

গত দু’দিন ধরে একই স্বপ্ন দেখছিলাম৷ একটা কাঁসার কলসি, মুখে লাল সালু জড়ানো৷ একটা পানা পুকুরে সেটা ভেসে বেড়াচ্ছে৷ আমি একটু ধার্মিক গোছের কাজেই শুভ-অশুভ এসব ব্যাপারে বিশ্বাসী৷ এটা কি নিতান্তই কাকতালীয়, নাকি এর পিছনে কোন সংকেত লুকিয়ে ছিল? তার উপর সেদিনের সেই বুড়িটার কথাগুলো৷ সব মিলিয়ে খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছিল৷ কেন জানিনা মনটা কু-ডাকছিল৷

এখানে আসার আগে কলকাতার বাড়িটা দেখাশোনা, পরিচর্যার জন্য স্ত্রী-পুত্রহীন, মধ্যবয়স্ক একটা পরিচারক ঠিক করে এসেছিলাম৷ সেদিন রাত্রে স্বপ্নে দেখলাম আমি সেই পুকুরে ডুবে যাচ্ছি৷ তবে এবার সেটা পানাপুকুর নয়৷ রক্তের পুকুর৷ সাঁতারে পাড়ে ওঠবার চেষ্টা করছি, কিন্তু কিছুতেই ভেসে থাকতে পারছি না৷ রক্তে হাবুডুবু খাচ্ছি, গিলে ফেলছি সেই রক্ত৷

ঘুমটা ভেঙে গেল, বিছানার উপর উঠে বসলাম৷ সারা শরীর ঘেমে নেয়ে একাকার৷ প্রথমে ওই কলসি, তারপর আবার এই বীভৎস স্বপ্ন৷ এসবের মানে কিছুই বোধগম্য হচ্ছিল না আমার৷ বিছানা ছেড়ে উঠলাম চোখে মুখে একটু জল নেওয়ার জন্য৷ বাথরুমের সামনে এসে দেখলাম, দরজাটা একটু ফাঁক হয়ে ছিল৷ সেই ফাঁক থেকে আলো বেরিয়ে আসছিল৷ আগেই বলেছি আমি একটু ধার্মিক গোছের৷ বাস্তু-শাস্ত্র অনুসারে বাথরুমের দরজা ব্যবহারের পর বন্ধ রাখা গৃহস্থ বাড়ির পক্ষে কল্যাণকর৷ কাজেই আমাদের ঘরের প্রত্যেকেই এসব মেনে চলে৷ ভাবলাম মিমি হয়তো দরজা লাগাতে বা লাইটটা নেভাতে ভুলে গিয়েছে৷

দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে যাবো এমন সময় দরজার ফাঁকে চোখ পড়তেই আঁতকে উঠলাম৷ মনে হল ভিতরে দুটো ঝুলন্ত পা দেখলাম৷ কেউ গলায় দড়ি দিলে যেমন দেখায় ঠিক সেরকম৷ ভয়ার্ত কাঁপা কাঁপা হাতে দরজাটায় ধাক্কা দিতেই ভিতরের যে দৃশ্য চোখে পড়ল তাতে আমার শরীরের রক্ত হিম হয়ে গেল৷

শূন্যে ভাসছিল একটা গলাকাটা, বিবস্ত্র পুরুষের লাশ৷ কোন এক অদৃশ্য দড়ির সাহায্যে সেটা সিলিং -এর সাথে ঝুলছিল৷ তার পা গুলো কালো হয়ে গিয়েছিল, রক্ত জমে গেলে যেমন কালশিটে পড়ে তেমন৷ আমার মাথা বনবন করছিল, হাত পা অসাড় হয়ে আসছিল৷ কোনরকমে শক্তি সঞ্চয় করে রিম্পাকে ডাকতে যাব এমন সময় আমার চোখ গেল ঘরের পূর্ব দিকের দেওয়ালে৷ নীল নাইট-ল্যাম্পটার পাশের হোল্ডারে বসানো একটা কাটা মাথা৷ সে মুখ আমার চেনা৷ এ ছিল আমাদের কলকাতার, বাড়ির পরিচারক ননীগোপাল৷ কেউ নিখুঁতভাবে শরীর থেকে গলাটা কেটে লাইট হোল্ডারটায় বসিয়ে দিয়েছিল৷ আচমকা, ননীর চোখ দুটো খুলে গেল৷ লাল নাইট-ল্যাম্পের মতো তার বিস্ফারিত রক্তাভ চোখ জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠল৷ আমার সারা শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেল৷ সব স্নায়ুগুলো যেন যূথবদ্ধভাবে ধর্মঘট ঘোষণা করল৷

এমন সময় গোড়ালির কাছে তরল জাতীয় কিছু একটার স্পর্শ অনুভব করলাম৷ নিচে তাকাতেই দেখলাম মেঝে রক্তে ভেসে যাচ্ছে৷ সেই রক্ত আসছিল বাথরুম থেকে৷ লাশটার গলার কাটা জায়গা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল৷ সিলিঙ, দেওয়াল, মেঝে সব সেই রক্তে লাল হয়ে গেছিল৷ এই দৃশ্য আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না৷ ছুটে পালাতে গিয়ে রক্তে পিছলে পড়লাম৷ সারা শরীর সেই রক্তে মাখামাখি৷ পরনের সাদা গেঞ্জিটা ভিজে, টকটকে লাল হয়ে জ্যাবজ্যাব করছিল৷ এক বিকট আর্তনাদ করে পড়ি কি মরি করে ছুটে গেলাম আমাদের শোবার ঘরের দিকে৷ ঘরে ঢোকার মুখেই রিম্পার সাথে ধাক্কা লাগল৷ আমার চিৎকারেই সে ছুটে আসছিল৷ আমার মুখ দিয়ে ঠিক করে কথা বেরোচ্ছিল না৷ বাথরুমের দিকে আঙুল দেখিয়ে অসংলগ্নভাবে বলেছিলাম, ‘র….রক্ত! লা….লাশ!’

‘লাশ, রক্ত, কোথায়?’

বিস্ময়ে সে ছুটে গেছিল বাথরুমের দিকে৷ ততক্ষনে মিমিও নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল৷

‘কি হয়েছে বাবা? তোমার চিৎকার শুনলাম বলে মনে হল৷’

ওর কোন প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো পরিস্থিতিতে তখন আমি ছিলাম না৷ বাথরুমের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সাহস আমার ছিল না৷ রিম্পাকে সভয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘দেখলে?’

‘তুমি দেখো এসে, কোথায় রক্ত? কোথায় লাশ? যত্তসব! ঘুমের চোখে কি দেখতে কি দেখেছে৷ মাঝখান থেকে দিল আমার ঘুমটার বারোটা বাজিয়ে৷’

বাথরুমের ভিতরে ঢুকে দেখলাম সাদা মার্বেল পাথর বসানো ঝাঁ চকচকে দেওয়াল৷ কোথায় সেই লাশ? মেঝেতেও রক্তের ছিটেফোঁটা দাগ পর্যন্ত নেই৷ ওপাশের দেওয়ালের নাইট-ল্যাম্পের পাশে খারাপ হয়ে পড়ে থাকা বাল্ব হোল্ডারটাও খালি৷ মনে মনেই ভাবলাম তাহলে কি সত্যিই ভুল কিছু দেখলাম?

সেদিন রাত্রে আর ঘুম আসে নি৷ সারারাত ধরে এই সবকিছুর একটা যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলাম৷ বড় রকমের একটা বিপদের পূর্বাভাস পাচ্ছিলাম৷ মনে বড় দুশ্চিন্তা তৈরি হল ননীর জন্য৷ ঠিক করলাম পরদিন ভোরবেলার ট্রেনে একবার কলকাতার বাড়িতে যাব।

সারারাত ঠিক করে ঘুম হয়নি৷ ট্রেনে একটু চোখ লেগে গেছিল বটে, তাতে অবশ্য ঘুমের আবেশটা একটু হলেও কেটেছিল৷

বেলা এগারোটা নাগাদ পৌঁছোলাম কলকাতার বাড়িতে৷ মান্ধাতার আমলের ডোরবেলটায় চাপ দিতেই ভেতর থেকে কর্কশ যান্ত্রিক আওয়াজ কানে এল৷ ননীগোপালের জন্য বড় দুশ্চিন্তা হচ্ছিল৷ ভেতর থেকে কোনো সাড়া শব্দ না পাওয়ায় দুশ্চিন্তা আরো বেশি করে ভর করছিল৷ বেশ জোর গলায় বললাম, ‘ননী! এই ননী, দরজা খোল৷’

বলার সাথে সাথেই দরজা খুলে গেল৷ ওপাশে খালি গায়ে, কাঁধে গামছা নিয়ে, একগাল হাসি মুখে দাঁড়িয়েছিল ননীগোপাল৷ বড্ড নিরীহ লোকটা৷ এই ক’মাসে স্বভাব চরিত্রের কোনো পরিবর্তন হয়নি৷ যেমনটি দেখে গিয়েছিলাম ঠিক তেমনটিই ছিল৷

আমি ওর আপাদমস্তক একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললাম, ‘কিরে সব ঠিকঠাক আছে তো? শরীর খারাপ হয়েছিল নাকি? দরজা খুলতে দেরি করলি যে বড়?’

ফিক করে হেসে লাজুক ভঙ্গিতে বললো, ‘আজ্ঞে, বাবুর কৃপায় সব ঠিক-ঠাকই আছে৷ দোতলায় ছিলাম তো তাই আসতে দেরি হল৷’

সে আমার হাত থেকে ব্যাগটা নিল৷ ভিতরে যেতে গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল৷ পিছন ফিরে হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, ‘বাবু এই অসময়ে এলেন যে? ভাবলেন ননী মারা গেছে কিনা?’

ওর এই কথাটা তীক্ষ্ণ ফলার মত ছ্যাঁত করে আমার বুকে বিধল৷

একরকম ধমকের সুরে বললাম, ‘কি যা তা বলছিস! ওসব ফালতু কথা কেন ভাবতে যাব? অফিসের কিছু দরকারি ফাইল সঙ্গে করে নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছিলাম সেগুলোই নিতে এসেছিলাম৷’

উত্তরে সে ছিল নির্বাক৷ অবাকবিস্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শুনে গেল কেবল৷ তারপর সে মাথা নিচু করে দু’হাতে ব্যাগটাকে ধরে দাঁড়িয়ে থাকল৷

সিঁড়ি দিয়ে উপরে ওঠার সময় একটা বিশ্রী পচা দুর্গন্ধ নাকে এল৷ রুমালটা তাড়াতাড়ি বের করে নাকে চাপা দিয়েছিলাম৷ ননীকে জিজ্ঞাসা করলাম গন্ধটা কিসের? উত্তর সে বলেছিল, সে তো কোনো গন্ধ পাচ্ছিল না৷ গন্ধটা আসছিল উপরের দোতলা ঘরগুলো থেকে৷ আমি গন্ধ অনুসরণ করে একটা ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালাম৷ পিছন পিছন ননীও এল৷ যে ঘরটা থেকে গন্ধটা আসছিল সেট ননীরই থাকার ঘর৷ ঘরবাড়ির পরিচর্যা বেশ ভালো কিন্তু এভাবে কেউ নিজের ঘরটাকেই অপরিচ্ছন্ন রাখে?

‘কিরে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করিস না নাকি? ইঁদুর, ছুঁচো মরেছে মনে হয়৷’

প্রত্যুত্তরে কোনো জবাব দেয় নি সে, আগের মতই নীরবে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল৷

আমি দরজা ঠেলে ঢুকতে যাচ্ছিলাম, এমন সময় ভিতরের দৃশ্য দেখে বজ্রাহতের মত থমকে গেলাম৷ একটা হিম শীতল স্রোত আমার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল৷ সে মুহূর্তে আমার সব জ্ঞান বুদ্ধি যেন লোপ পেয়েছিল, মাথাটা বন-বন করে ঘুরছিল৷ নিজের হৃৎপিন্ডের শব্দটা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম৷ মনে হচ্ছিল বুকের ভেতর কামারশালার অনবরত হাতুড়িপেটা চলছে৷ প্রতিটা শিরায় শিরায় আতঙ্ক অনুভব করছিলাম৷

ঘরের দু’পাশের খোলা জানালা দিয়ে আলো ভেতরে প্রবেশ করছিল৷ আর তাতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল, সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলে পড়েছ ছোট্ট হাত দু’য়েক লম্বা দড়ি৷ সেটার অন্য প্রান্তে ঝুলছিল ননীগোপালের দেহ৷ লাশটার অনেকাংশেই পোকা ধরে গেছিল৷ চুঁয়ে টপ টপ করে বিন্দু বিন্দু রস মাটিতে পড়ছিল৷ তার উপর ভন-ভন করছিল অজস্র মাছি৷ দেখে মনে হচ্ছিল মড়াটা ছয়-সাত দিনের বেশি পুরনো৷

দেখেই গা টা কেমন গুলিয়ে উঠল৷ কি ঘটছিল, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না৷ কিছুক্ষণ আগে মানুষটার সাথে দিব্যি কথা বললাম, আমার সাথে উপর এল, সে এই ভাবে….৷

‘এ…এ…এ কিরে ননী! এসব কি?’

কথাটা ওকে বলতে গিয়ে দেখলাম, যেখানে ননী এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল সেখানটা শূন্য৷ কেউ ছিল না সেখানে৷

কোনরকমে রেলিং ধরে ধরে নিচে নেমে এলাম৷ মনে মনে ভাবলাম, তাহলে কি আমি হ্যালুসিনেট করলাম? কিন্তু আমার ভাবনা যে ভুল তা পরক্ষণেই প্রমাণ পেলাম চেয়ারে রাখা আমার ব্যাগটা দেখে৷ যেটা ননী আমার হাত থেকে নিয়ে এসে রেখেছিল৷ আমার তখন বারবার, সেদিন রাত্রের ঘটনা আর সেই বুড়ির কথাগুলো মনে পড়ছিল৷ সেগুলো যেন এক অশনির সংকেত দিচ্ছিল৷

শরীর প্রচন্ড খারাপ করছিল৷ কোনরকমে বাইরে বেরিয়ে এসেছিলাম৷ এক প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে লোকাল থানায় খবর দিয়েছিলাম৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ এসে বডি নিয়ে গেছিল৷

পুলিশি জেরার জন্য কলকাতায় আমাকে আরো দিন দুয়েকের মত থাকতে হয়েছিল৷ তবে আমি আর ওই বাড়িতে থাকি নি৷ কাছেই একটা হোটেল ভাড়া করেছিলাম৷ দু’দিন পর পোস্টমর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী ননীর মৃত্যুর কারণ সুইসাইড জেনে খুব অবাক হয়েছিলাম৷ ননীর কাছে এমন কোন কারণই ছিল না যে যার জন্য তাকে আত্মহত্যা করতে হত৷

(৪)

ওর শেষকৃত্য আমরাই করেছিলাম৷ রিম্পা বলেছিল বাড়িতে একটা গৃহশান্তির পুজো করানোর জন্য৷ আমার এক বন্ধু পেশায় পুরোহিত ছিল৷ ওকে খবর দিয়েছিলাম৷ দু’দিন পর নৃসিংহ আমাদের বাড়ি এল৷ গৃহ সীমানায় পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠেছিল, ‘তোদের বাড়ির বাস্তু একদম ভাল না৷ ভাল রকমের খারাপ শক্তি টের পাচ্ছি৷’

এরপর সে হোম-যজ্ঞ করে৷ কালো কাপড়ে গোটা সর্ষে ভরে পুঁটুলি করল৷ সেগুলোকে বাড়ির চার কোণে, চারটে পেরেক দিয়ে পুঁতে দিল৷ আমাদের বারবার সতর্ক করে দিল যে কোনো অবস্থাতেই যেন ওইগুলো নিজেদের স্থানচ্যুত না হয়, অন্যথায় পরিবারে ঘোর বিপদ নেমে আসবে৷

এরপর দেখতে দেখতে প্রায় একমাস কেটে গেল৷ আর কোন সমস্যা হয়নি৷ একদিন মুষলধারায় বৃষ্টি হল সারাদিন ধরে৷ অসময়ের এই বৃষ্টিই ছিল সর্বনাশের আহ্বায়ক। তখনও বুঝিনি যে কি ঘোর বিপদ চুপিসারে অতর্কিতেই হানা দিয়েছে আমাদের পরিবারে৷

প্রত্যহ সকালবেলায় বাগানে পায়চারি করার সময় আমি নিয়মিত একবার ওই পেরেকগুলোকে দেখতাম৷ ভয় হত পাছে কোনভাবে ওইগুলো স্থানচ্যুত হলে নৃসিংহের কথামতো ঘোর বিপদ নেমে আসবে পরিবারে৷

সেইদিনও সকালে বাগানে পায়চারি করছিলাম৷ হঠাৎ চোখ পড়ল গ্যারেজের দিকের ঘরের কোণটায়৷ গতরাত্রের বৃষ্টিতে চারপাশের নরম মাটি গলে যাওয়াতে পেরেক, পুঁটলি সমেত উঠে এসেছিল৷ যে ভয়টা পেয়েছিলাম সেটাই হল! ছুটে গেলাম বাকি গুলোকে দেখার জন্য৷ সবকটারই এক অবস্থা৷ আমার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল নৃসিংহের কথাগুলো মনে করে৷ বৈশাখের কালো মেঘের মত একরাশ ভয় আমাকে ঘিরে ধরল৷ আমি জানতাম, এসব জিনিস যদি কোনভাবে একবার নষ্ট হয়ে যায় তাহলে যে আর কাজ করে না৷ তবুও আসন্ন বিপদ থেকে বাঁচার বৃথা আশায়, সেগুলোকে পুনরায় তাদের যথাস্থানে পুঁতে দিলাম৷

নিঃসৃংহের ল্যান্ড লাইনে ফোন করলাম সময় নষ্ট না করে৷ ওপাশ থেকে এক অল্পবয়সী মেয়েছেলের কান্না ভাঙ্গা গলা ভেসে এল, ‘হ্যালো, কে বলছেন?’

প্রথমে আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলাম৷ পরে নিজেকে সামলে নিয়ে পরিচয় দিয়ে বললাম, ‘নৃসিংহকে ফোনটা একটু দেওয়া যাবে? খুব আর্জেন্ট দরকার ছিল৷’

ওপাশ থেকে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে সে বললো, ‘আজ ভোরে বাবার স্ট্রোক হয়! বাবা এখন ICU-তে ভর্তি৷ খুব সিরিয়াস কন্ডিশন৷’

কথাটা শুনেই আমার হাত-পা যেন অসাড় হয়ে এল৷ মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হল৷ পাশে রাখা চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসলাম৷ ওপাশ থেকে তখনও নৃসিংহের মেয়ের কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছিল৷ সেও আমার মেয়ের বয়সী৷ অনেক ছোটতে তাকে একবার দেখেছিলাম৷ দু’মিনিট নিস্তব্ধ থাকার পর, ওকে কিছুটা সান্তনা দিয়ে রিসিভারটা রেখে দিলাম৷ নৃসিংহের জন্য যত না খারাপ লাগছিল তার থেকে বেশি ভয় করছিল আমার৷ বুঝতে পারছিলাম ওর স্ট্রোকটা নিতান্তই আকস্মিক ঘটনা নয়৷ যে খারাপ শক্তিগুলোকে ও বেঁধেছিল তারাই এবার মুক্তি পেয়ে এর প্রতিশোধ নিয়েছিল৷ কারণ গতরাত্রের বৃষ্টি, মন্ত্রপুত পেরেকগুলোর স্থানচ্যুতি আর তারপরেই ওর স্ট্রোক৷ ঘটনাগুলোর মধ্যে একটা ভালমত যোগসূত্র ছিল৷

দু’হাতে মাথাটা চেপে ধরে বসলাম৷ মনে বারবার একটাই ডাক উঠছিল এবার হয়তো আমার পালা৷ আসন্ন বড় রকম বিপদের আভাস দিচ্ছিল আমার অতীন্দ্রিয়৷ তখন রিম্পার কথাগুলো মনে বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল৷ নিজের উপর খুব রাগ হচ্ছিল৷ কেন শুনলাম না ওর কথা? বারবার বারণ করেছিল, এখানে না আসতে৷ নিজের জেদটাকে এতটা গুরুত্ব না দিলে হয়তো আজ আর এই দিন দেখতে হত না৷

রিম্পাকে ডেকে সব জানালাম৷ শুনে ও প্রচন্ড ভয় পেল৷ দু’জনেই এই ব্যাপারে বিস্তর আলোচনা করলাম৷ এসবের কিছু একটা বিহিত হওয়া দরকার৷ কিন্তু শেষমেশ এই সমস্যা সমাধানের কোন রকম আশার আলো দেখতে পেলাম না৷ এদিকে মেয়ে বড় হচ্ছিল৷ এই বয়সে এইসব অপদেবতাদের সাথে লড়তে গিয়ে পরিবারটাকে বিপদে ফেলাটা বোকামি৷ তাই ঠিক করলাম পরদিন এ বাড়ি ছেড়ে দেব৷

প্রস্তাবটায় দুজনেরই সহমত ছিল৷ কিন্তু সমস্যায় পড়লাম মেয়েকে নিয়ে৷ একদিনের মাথায় বাড়ি ছাড়াটা সম্ভব ছিল না, কারণ দু’দিন পরেই মিমির স্টাডি ট্যুর ছিল শিলিগুড়িতে৷ ফাইনাল ইয়ার, দু’সপ্তাহের স্টাডি ট্যুর, না গেলেই নয়৷ পরীক্ষায় নম্বরের ব্যাপার ছিল৷

(৫)

দু’দিন পর যথাদিনে মেয়েকে স্টেশনে ছাড়তে গেলাম৷ কলেজের দু’তিনজন প্রফেসর সহ আরো অনেক মেয়েরাও ছিল সেখানে৷ এখান থেকে প্রথমে এন.জে.পি, তারপর সেখান থেকে শিলিগুড়ি৷

মিমি যাবার ঠিক একদিন পর, সন্ধ্যাবেলায় ইজিচেয়ারে অলসভাবে বসে, মগ্ন হয়ে আমি বই পড়ছিলাম৷ এমন সময় টেলিফোনটা বেজে উঠল৷ রিসিভারটা তুলে, ‘হ্যালো’ বলতেই ওপাশ থেকে একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক বললেন, ‘গুড ইভিনিং৷ অ্যাম আই স্পিকিং উইথ মিস্টার সুকল্যান মুখার্জ্জী?’

‘ইয়েস, ইটস্ মি, সুকল্যান মুখার্জ্জী! হুজ্ স্পিকিং?’

‘স্যার আমি মিমির কলেজের প্রফেসার সেন বলছিলাম৷ আপনাকে একটা কথা জানানোর জন্যই ফোন করেছি৷’

কথাগুলো বলার সময় ওনাকে খুব বিচলিত মনে হচ্ছিল৷ ওনার গলার স্বরে চিন্তাজনিত দ্বিধাবোধটা খুব স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল৷ যা ঘটেছিল তা নিয়ে এমনিতেই চিন্তিত ছিলাম, তার উপর আবার ভদ্রলোকের ফোন পেয়ে আমি বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলাম, ‘ইজ দেয়ার অল ওকে মিস্টার সেন? মিমি ঠিক আছে তো?’ জিজ্ঞাসা করলাম৷

‘হ্যাঁ এখন ঠিকই আছে, ওর ব্যাপারে বলবো বলেই আপনাকে ফোনটা করা৷’

‘এখন ঠিক আছে মানে? কি হয়েছে ওর?’ দুশ্চিন্তায় প্রায় চিৎকার করার মতন করে বললাম৷ আমার খুব ভয় করছিল৷ অশুভ শক্তিগুলো কি তাহলে এবার মিমির কোন বড় রকম ক্ষতি করে দিলো? খারাপ সব চিন্তা মনে ভিড় করে আসছিল৷

‘দেখুন আপনি উত্তেজিত হবেন না৷ মিমির তেমন কিছু হয়নি, ও ভালো আছে৷ কাল আমরা হাতিঘিসা ক্যাম্পে পৌঁছোয় দুপুর নাগাদ৷ তারপর হঠাৎই মিমিকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না৷ সকল স্টুডেন্ট, টিচার মিলে অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও ওর কোন হদিস পাওয়া যাচ্ছিল না৷ শেষে লোকাল পুলিশে খবর দিলে ওরা এসে খোঁজাখুঁজি শুরু করে৷ কাল সারারাত খোঁজার পর আজ সকালের দিকে, পাশের এক চা বাগানে অচেতন অবস্থায় ওকে পড়ে থাকতে পাওয়া যায়৷ কাছেই আর্মি বেস-ক্যাম্প ছিল৷ আমরা ওকে ওদের ওখানে নিয়ে যায় চিকিৎসার জন্য৷ আর্মি ডাক্তারেরা ওর চিকিৎসা করেছে৷ ঘন্টা দুয়েক আগেই ওর জ্ঞান ফিরেছে৷ আপনাকে আগে জানায়নি দুশ্চিন্তা করবেন বলে৷ ডাক্তার বলেছেন কোন কারনে শারীরিক দুর্বলতার জন্য মাথা ঘুরে গিয়েছিল৷ হয়ত সে কারনেই টাল সামলাতে পারে নি৷ বেকায়দায় পড়ে যাওয়াতে মাথার পেছনে চোট পেয়ে জ্ঞান হারিয়েছিল৷ ভয়ের কিছু নেই, কোনো বড় কিছু ক্ষতি হয়নি৷ ও আমার পাশেই আছে, আমি ফোনটা দিচ্ছি, নিন কথা বলুন৷’

এসব শুনে মানসিক বিপর্যয়ে চুপ করে থাকলাম কিছুক্ষণ৷ উপস্থিত বোধ, বুদ্ধি সব যেন লোপ পেল৷ ওপাশ থেকে মেয়ের গলা পেতেই আমার প্রচন্ড উত্তেজনা বাঁধ ভাঙল৷

‘হ্যালো, মা কি হয়েছে তোর? এখন ঠিক আছিস তো? আমি আসছি তোকে নিতে৷ তোকে আর ওখানে থাকতে হবে না৷’

কথাটা হয়তো প্রফেসর সেন শুনতে পেলেন৷ তিনি বললেন, ‘কাল সকালেই আমাদের একজন স্টাফের সাথে ওকে বাড়ি পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করছি৷ নম্বর নিয়ে চিন্তা করবেন না৷ এখন যেটা জরুরী সেটা হল, আগে ওর সুস্থ হয়ে ওঠা টা৷’

শুনতে পেলাম ওনার বিপক্ষে মিমি বলছিল সে এখন সুস্থ তাই সে ট্যুর শেষে সবার সাথে ফিরবে৷ প্রফেসর সেন, আমি, সবাই ওকে অনেক বোঝালাম বাড়ি ফিরে আসার জন্য৷ কিন্তু আমাদের কোন জোরাজুরিই খাটেনি সেদিন৷ শত বোঝানো সত্ত্বেও মেয়ের অটল সিদ্ধান্তের কাছে নত হতেই হল শেষপর্যন্ত৷

একটা জিনিস আমি লক্ষ করলাম৷ ওর কথা বলার ধরণ আর গলার স্বরটা একটু অন্যরকম লাগছিল৷ এমনিতে সে খুবই নম্র, শান্ত, স্বল্পভাষী৷ কিন্তু তখন ওর কথায় উত্তেজনা আর বিরক্তি মেশা ভাব বেশ স্পষ্ট প্রকাশ পাচ্ছিল৷ শরীরের ক্লান্তির জন্য এসব হচ্ছিল ভেবে, বিশেষ আমল দিইনি ব্যাপারটায়৷

পুরো ব্যাপারটা রিম্পার কাছে চেপে গেলাম পাছে অযথা দুশ্চিন্তা করবে৷ এইভাবে সপ্তাহ কেটে গেল৷ প্রফেসর সেন প্রায়ই ফোন করে মিমির খোঁজখবর দিতেন৷ আমিও মাঝেমধ্যে ফোন করে খোঁজ-খবর নিতাম বটে, কিন্তু এই কদিনে একবারও মেয়ের সাথে কথা হয়নি৷ ওর সাথে কথা বলতে চাইলেই ব্যস্ততার অজুহাতে আমাকে এড়িয়ে যেত৷ কিন্তু রিম্পার সাথে ওর কথা হত৷ আমার বেলাতেই কেবল এরকম করত কেন জানি না৷

একদিন সকালে প্রফেসর সেন ফোন করে জানালেন, পরদিন ওরা সবাই ফিরবে৷ এন.জে.পি থেকে রাত্রের ট্রেনে রওনা দেবে৷ পরদিন দুপুরের মধ্যে যে যার নিজের বাড়ি পৌঁছে যাবে৷

(৬)

বিকেল থেকেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হল৷ সন্ধ্যা হতেই সেটা মুষলধারার রূপ নিল৷ বৃষ্টি আমার বরাবরই খুব ভালো লাগত৷ কিন্তু এখন এই বৃষ্টি দেখলেই আতঙ্ক হয়৷ মনে পড়ে যায় সেদিন রাত্রের সেই বৃষ্টির কথা৷ যে বৃষ্টির জন্য জেরবার হয়ে গেছিল আমাদের পরিবার৷

রিম্পা রান্নাঘরে ব্যস্ত ছিল৷ টিভিতে একটা পুরনো বাংলা সিনেমা চলছিল, আনমনে সেটা দেখছিলাম৷ আমি মনে মনে তখন, কিভাবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে বাড়ি ছাড়ব, সেই অঙ্ক কষছিলাম৷ ঠিক করেই নিয়েছিলাম, মিমি ফিরে এলেই এই বাড়ি ছেড়ে কলকাতায় ফিরে যাব৷ এই বাড়িতে থাকলে সর্বদা আতঙ্কে থাকতে হবে৷ সপ্তাহ দু’য়েক তো ভালোভাবে নির্বিঘ্নে পার হয়ে গেছিল৷ হয়ত আমাদের নিয়তিই আমাদের রক্ষা করছিল৷ কিন্তু এভাবে বেশিদিন নিয়তির উপর ভরসা করে থাকা চলে না৷

এসব ভাবছিলাম ঠিক তখনই কানে এল ডোরবেলের শব্দ৷ এই বৃষ্টি-বাদলের মধ্যে এত রাত্রে আবার কে এল? কোন প্রতিবেশীর আবার বিপদ-আপদ হল নাকি? সোফা ছেড়ে উঠে গেলাম দরজার দিকে৷ রান্নাঘর থেকে রিম্পাও বেরিয়ে এল৷ দরজা খুলতেই দেখলাম অপ্রত্যাশিত আগন্তুক আর কেউ নয়, আমাদের মেয়ে মিমি৷ কিন্তু ওর তো পরদিন আসার কথা৷ স্টেশনে ওকে আমার নিতে যাওয়ার কথা ছিল৷ ওর এই অপ্রত্যাশিত আগমনে আমি একটু অবাক হলাম, ‘তোর তো আজ আসার কথা না? আর এই রাত্রে বৃষ্টি মাথায় করে এলিই বা কিসে?’

মাঝখান থেকে রিম্পা বলে উঠল, ‘আরে, আগে ওকে ভিতরে আসতে দাও! এতদূর থেকে এসেছে৷ সেসব পরে না হয় শোনা যাবে৷’

আমি বাইরের ল্যাম্পপোস্টের দিকে একবার উঁকি মেরে দেখলাম কোন রিক্সা দাঁড়িয়ে আছে কিনা৷ কিন্তু না, সেসব কিছুই চোখে পড়ল না৷

‘হ্যাঁরে! বাইরে এত জোরে বৃষ্টি পড়ছে৷ কিন্তু তোর জামাকাপড় তো একদম শুকনো দেখছি৷’

রিম্পার কথায় আমার চোখ গেল মিমির পোশাকের দিকে৷ বাইরে যে হারে বৃষ্টি পড়ছিল ছাতা কেন, বর্ষাতি পড়ে এলেও যে কেউ ভিজে যায়৷ কিন্তু ওর জামা-কাপড়ে, এমনকি ব্যাগটাতেও একবিন্দু বৃষ্টির ছিঁটেফোঁটা ছিল না৷ তাছাড়াও ওর কাছে কোন ছাতা বা বর্ষাতিও দেখতে পেলাম না৷ বেশ অশ্চর্য লাগল আমার৷ সবমিলে এক কৌতুহল নাড়া দিল আমার মনে৷

‘আমাদের আজ রাত্রে ট্রেনে চাপার কথা ছিল৷ কিন্তু সেটা বাতিল থাকায় সবাই সকালের ট্রেনটাই ধরেছিলাম৷’ উত্তরে মিমি বললো৷

রিম্পা রাত্রের খাবারের ব্যবস্থা করছিল৷ আমি বসে টিভি দেখছিলাম৷ একটা সাবানের হিন্দি বিজ্ঞাপন চলছিল৷ চ্যানেলটা পাল্টাতে যাচ্ছি, অমনি বিজ্ঞাপনের একটা চরিত্র আমার দিকে ইশারা তুলে বললো, ‘কিয়া আপকে পাস লাশ হে?’

প্রথমে ভাবলাম, সেটা হয়ত বিজ্ঞাপনেরই অংশ৷ কিন্তু খুব তাড়াতাড়িই সে ভুল ভাঙল৷ ওই চরিত্রটার চারপাশ থেকে আরো তিন, চারটে চরিত্র বেরিয়ে একই কথা ‘কিয়া আপকে পাস লাশ হে…’ বারবার বলতে লাগল৷ বিভিন্ন প্রকারভেদের ভারী, পাতলা গলায় সমস্বরে বলা কথাগুলোর পুনরাবৃত্তি খুব ভয়ানক শোনাচ্ছিল৷ বুঝতে বাকি রইল না যে এ শুধুই সংলাপ নয়৷ চ্যানেলটা পাল্টে দিলাম৷ কিন্তু প্রত্যেক চ্যানেলেই সেই একই বিজ্ঞাপন৷ ক্রমে তাদের স্বরের পরিবর্তন হতে লাগল৷ শুনে মনে হচ্ছিল কথাগুলো যেন একদল অশুভ শক্তি বলছে৷ আমি ছুটে গিয়ে টিভির মেইন প্লাগটা খুলে দিলাম৷ বন্ধ হয়ে গেছিল সেই সব সংলাপ৷

সোফায় বসে পুরো শরীর এলিয়ে দিলাম৷ প্রচন্ড ভয়ে, সংশয়ে আমার জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়ছিল৷ শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে গেছিল৷ হাত-পা কাঁপছিল৷ মনে-মনে হনুমান চল্লিশা জপ করলাম৷ এক অজানা আসন্ন বিপদের পূর্বাভাস আমার মনকে বারবার নাড়া দিচ্ছিল৷ দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলাম এই প্রেতপুরীতে আর না৷ মেয়ের আসার অপেক্ষায় ছিলাম, এসে গিয়েছে যখন তখন কালই এ বাড়ি ছাড়ব৷

রাত্রের খাওয়া-দাওয়া শেষে ঘুমাচ্ছিলাম৷ মাঝরাত্রে ঘুমের মধ্যেই, হাতের ওপর একটা বরফের মতো ঠান্ডা শীতল স্পর্শ অনুভব হল৷ কেউ আমার হাতটা ধরে নাড়া দিচ্ছিল৷ আমি হুড়মুড়িয়ে উঠে বসলাম৷ ঘরের নাইট-ল্যাম্পের ম্লান আলোয় বুঝতে পারলাম, সামনে মিমি দাঁড়িয়ে৷

‘কি হল রে? এত রাত্রে ডাকলি যে৷ শরীর খারাপ করছে নাকি? আর তোর হাতটাই বা এতো ঠান্ডা কেন? কই দেখি একবার…’ বলে হাত বাড়িয়ে ওর হাতটা ছুঁয়ে দেখতে গেলাম৷

সে হন্তদন্ত ভাবে দু’পা পিছিয়ে গেল৷ বললো, ‘জল খাব৷ ঘরে জল নেই৷ ফ্রিজ টা খুলছে না, খুলে দাও৷’

আশ্চর্য! রিম্পা কখনোই ফ্রিজ লক করে রাখে না৷ সুতরাং সেটা বন্ধ থাকার কোন প্রশ্নই ওঠে না৷ বিছানা ছেড়ে, গেলাম ফ্রিজের কাছে৷ সেটার হাতল ধরে টানতেই দেখলাম সত্যি সত্যিই সেটা লক ছিল৷ সম্ভবত রিম্পা ভুলবশত লক করে দিয়েছিল৷ ফ্রিজের মাথার উপরেই চাবি রাখা থাকত৷ চাবি লাগিয়ে আবার হাতল ধরে টান দিলাম, কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার ফ্রিজের দরজা খুলল না৷ ভাবলাম কোনো কারণে হয়তো জ্যাম হয়ে গিয়েছে সেটা৷ সজোরে একটা হ্যাঁচকা টান মারতেই শেষমেশ দরজা খুলে গেল, আর তারপরেই ভেতর থেকে গড়িয়ে পড়ল কতগুলো নরমুণ্ড৷ ভয়ে তাড়াতাড়ি পিছোতে গিয়ে হড়কে পড়ে গেলাম৷ দেখলাম ফ্রিজের তাকগুলোতে থাকে থাকে সাজানো নরমুণ্ড৷ প্রচন্ড আতঙ্কে কালা জ্বরের রুগীর মত থর থর করে কাঁপতে লাগলাম৷ চিৎকার করতে গিয়েও পারলাম না৷ এমনকি গলা থেকে একটা টুঁ শব্দ পর্যন্ত বেরোল না৷ যেন আমার বাকশক্তি লোপ পেয়েছিল৷ দু’তিনটে নরমুণ্ড আমার পায়ের কাছেই পড়েছিল৷ হঠাৎ সেগুলোর চোখগুলো খুলে গেল৷ প্রজ্বলিত অঙ্গারের মত রক্তাভ চোখগুলোর দৃষ্টি৷ সহসা নরমুণ্ডগুলো খিলখিল করে হেসে উঠল৷ ফ্রিজের তাক থেকে দু’একটা নরমুণ্ড পড়ে গড়িয়ে এসে আমার পায়ে ধাক্কা খেয়ে থেমে গেল৷ সারা ঘর জুড়ে তাদের সেই অমানবিক অট্টহাস প্রতিধ্বনিত হতে লাগল৷

মিমি যে আমার পিছনেই দাঁড়িয়ে ছিল সেটা খেয়াল হতেই পিছনে তাকিয়ে দেখলাম৷ চেহারায়, আকৃতিতে হুবহু একই রকম ওর মতো দেখতে একজন মেয়ে আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে৷ এক্ষেত্রে মেয়ে বলাটা কতটা প্রযোজ্য হবে তা আমার জানা নেই কারণ তার লকলকে, দীর্ঘ জিভ বেরিয়ে এসে লোটাচ্ছিল মাটিতে৷ ক্রুদ্ধ গোঙানির গোঁ গোঁ শব্দ আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভয়ের সঞ্চার করল৷ এক আড়ষ্ট ভাব আমার সমস্ত শরীরে ছেয়ে গেল৷ হাত, পা অসাড় হয়ে এল৷ দৃষ্টি ঘোলাটে হতে থাকল৷ এসব দেখে আমি ভালোভাবে বুঝতে পারলাম, যে আমার সন্দেহটাই ঠিক ছিল৷ এ আমার মেয়ে নয়৷ ওরই মতন দেখতে অপার্থিব এক বহুরূপী৷ তারপর আমার আর কিছু মনে নেই৷

চোখেমুখে ঠান্ডা জলের মতো কিছু একটার স্পর্শ অনুভব করতেই আমার জ্ঞান ফিরল৷ চোখ খুলতেই দেখতে পেলাম রিম্পাকে৷ ওর দু’চোখে জল৷ আমার জ্ঞান ফিরেছে দেখেই জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল৷

ভাঙা গলায় বললাম, ‘কেঁদো না! আমি ঠিক আছি৷’

গতরাত্রের ঘটনার কথা মনে পড়তেই ধড়মড় করে উঠে বসলাম৷ ‘মিমি কোথায়?’ জিজ্ঞেস করলাম৷ কথাটার কোন উত্তর না দিয়েই আবার হাঁপুসনয়নে কাঁদতে শুরু করল৷

‘সাত সকালে তোমাকে এই অবস্থায় দেখে কি করব কিছু বুঝতে পারছিলাম না৷ শেষমেশ ওকে ডাকতে যাই৷ কিন্তু গিয়ে দেখি ও ঘরে নেই৷’

রিম্পার কথাগুলো শুনেই আমার বুকটা ধড়াস করে উঠল৷ পাছে সে ভয় পায়, তাই গতরাত্রের কোন কথাই ওকে জানালাম না৷

আমরা দুজনেই আর সময় নষ্ট না করে মিমিকে খুঁজতে লাগলাম৷ সব ঘর, বাগান তন্নতন্ন করে খুঁজলাম৷ ওকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছিল না৷ যত সময় পেরোচ্ছিল চিন্তা ততই বাড়ছিল৷ নতুন জায়গা, এখনো ঠিকঠাকভাবে সব চেনা-জানা হয়নি৷ তার ওপর পরিবারে একের পর এক দুর্ঘটনা৷ আমাদের মেয়ে ঘরকুনো৷ আমাদের না বলে কোথাও যাওয়া তার স্বভাবে ছিল না৷

মনে তখন খালি একটাই প্রশ্ন উঠছিল বারবার৷ আমি কাকে খুঁজে চলেছি? কেইবা নিখোঁজ হয়েছে? আমার মেয়ে, নাকি ঠিক ওরই মত দেখতে ওই বহুরূপী? হতেও তো পারে, মেয়ে হয়তো এখনও ট্যুর থেকে ফেরেইনি৷

আরেকটা ভাবনা হঠাৎ আমার মাথায় আসতেই আমি ভয়ে শিউরে উঠলাম৷ নিজের অজ্ঞাতসারেই মুখ দিয়ে একটা অস্ফুট শব্দ বেরোল, ‘পোজেসড্?’ কাল যে বাড়ি এসেছিল সে হয়ত মিমিই ছিল৷ বরং ওই অশুভ শক্তিই হয়ত ওর শরীরে ভর করেছে৷ এটা যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে সে খুবই বিপদে আছে৷ আমি কাল বিলম্ব না করে লোকাল থানায় গেলাম পুলিশের সাহায্য নিতে৷

(৭)

গত কয়েকদিন ধরে আমরা ঠিক করে ঘুমোতে পারলাম না৷ রিম্পাতো খাওয়া-দাওয়া প্রায় সবই ছেড়ে দিয়েছিল৷ শুধু কান্নাকাটি করে চলেছিল দু’বেলা৷ থানায় মিসিং ডাইরি করা পাঁচ দিন হয়ে গিয়েছিল৷ মেয়েটার তখনও কোনো খোঁজ দিতে পারেনি পুলিশ, সন্ধান চলছিল৷ মিস্টার সেনকে জেরা করা হল৷ তিনি জানালেন রাত্রের ট্রেনটা বাতিল থাকায় ওরা সকালের ট্রেন ধরে৷ বোলপুরে যখন ট্রেন থামে তখন অনের রাত হয়ে গেছিল, বৃষ্টিও পড়ছিল৷ মিমিকে বাড়ি ছেড়ে দেবার কথা বললে সে জানিয়েছিল নিজেই চলে যাবে৷ স্টেশন থেকে একটা রিক্সা ভাড়া করেছিল৷ পুলিশি জেরায় সেই রিক্সাওয়ালা জানায়, সে রাত্রে প্রায় অর্ধের রাস্তা আসার পর কোন কারনে পিছন ফিরে সে দেখে রিক্সা ফাঁকা৷ ব্যাপারটা পুলিশের কাছেও ধোঁয়াশার মত হয়েছিল৷

খবর পেয়ে পরদিনই বাঁকুড়া থেকে ছুটে এল আমার ভাই আর ভাইয়ের বউ৷ সুপর্ণা, সমানে রিম্পাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করল৷ কিন্তু তাতে চিঁড়ে ভিজল না৷ ওর অবস্থা সেই যা কার তাই ছিল৷

বেলার দিকে স্নান করতে গিয়ে সাওয়ারের জল ছাড়তেই নাকে এল একটা পচা দুর্গন্ধ৷ কিছুটা জল হাতে নিয়ে শুঁকে দেখলাম, সেটা থেকেই গন্ধটা বেরোচ্ছিল৷ ট্যাঙ্কের ফাঁক দিয়ে, গিরিগিটি টিকটিকি প্রায়শই পড়ে থাকে৷ ভাবলাম সেরকমই কিছু একটা হয়ত ট্যাঙ্কের জলে মরে পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে৷ ভাইকে সঙ্গে করে নিয়ে ছাদে গেলাম দেখতে৷ ট্যাঙ্কের ঢাকনা খুলতেই চোখে পড়ল কালো জল৷ অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না৷ টর্চটা জ্বাললাম৷ ট্যাঙ্কের ফুটোর মধ্যে মাথা গলিয়ে দেখতে গিয়ে সহসা চোখে পড়ল এক বীভৎস দৃশ্য৷ ভয়ে, তাড়াতাড়ি মাথাটা বের করে বেরিয়ে আসতে গিয়ে প্রায় পড়েই যাচ্ছিলাম, ভাই ধরে নিল৷ ফুটোটার কিনারায় মাথাটা জোরে ঠোক্কর খেয়ে ফুলে উঠল৷

ট্যাঙ্কের ভেতর একটা লাশ ছিল৷ ঠিক করে মুখটা দেখতে পাইনি৷ পর্যায়ক্রমিক দুর্ঘটনার বিধ্বস্ত আমার মন এসব আর সহ্য করতে পারছিল না৷ ভয়ে আমার হাত পা কাঁপছিল৷ ভাই ধরে ধরে নিচে নামিয়ে আনল৷ আমার গলা শুকিয়ে এসেছিল৷ সুপর্ণা আমার এরকম অবস্থা দেখে খুব অবাক হয়ে কি একটা জিজ্ঞাসা করল৷ আমি এতটাই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম যে, আমার মুখ দিয়ে কোন কথাই বেরোল না৷ ভাই ফোন করে লোকাল থানায় জানান দিল৷

কিছুক্ষণ পর বাইরে পুলিশের গাড়ির আওয়াজ পেলাম৷ রিম্পা গাড়ির আওয়াজ শুনেই ছুটে গেল৷ একরকম ঝাঁপিয়ে পড়ল অফিসারের উপর৷ চরম প্রফুল্লতায় ভরা আশা নিয়ে, আনন্দে আত্মহারা পাগলের মত আচরণ করতে লাগল, ‘পেয়েছেন, পেয়েছেন আমার মেয়েকে? কই আমার মেয়ে? গাড়ির ভেতরে বুঝি?’ গাড়ির কাঁচে উঁকি মেরে দেখতে যাচ্ছিল, আমি টেনে সরিয়ে আনলাম৷ সুপর্ণা কে বললাম ওকে ঘরের ভেতর নিয়ে যাওয়ার জন্য৷ উন্মাদের মত বিড়বিড় করে কিসব বলতে বলতে সে ভেতরে চলে গেল৷

ভাই আর আমি পুলিশ নিয়ে উপরে গেলাম৷ ট্যাঙ্কিটা দেখিয়ে সব বিস্তারিতভাবে জানালাম৷ আমাদের পিছন পিছন সুপর্ণাও এল৷ পুলিশ সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে প্রায় মিনিট পনেরো-কুড়ি পর যখন লাশটাকে বের করল তখন ভয়ে, দুঃখে, কান্নায় এক সংমিশ্রিত বেদনায় ভেঙে পড়লাম৷ কয়েক মুহূর্ত উদ্দেশ্যহীন ভাবে শূন্য আকাশে চেয়ে থাকলাম৷ লাশটা ছিলো মিমির৷ তার হাত-পা, আঙ্গুল, সর্বাঙ্গ কুষ্ঠ আর ধনুষ্টংকার রোগীর মত বিকৃত হয়ে গেছিল৷ কিছুক্ষণ পর মেয়েটার দেহটাকে নিয়ে পুলিশ চলে গেল পোস্টমর্টেমের জন্য৷

না চাইতেও রিম্পাকে জানাতে হল৷ শোনা মাত্রই সে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ল৷ চেতনা ফিরল অনেকক্ষন পর৷ ডাক্তার জানিয়ে দিয়েছিল বড়রকমের একটা শক পাওয়ার কারণে সে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে৷ একটু দেখেশুনে না রাখলে মানসিক ভারসাম্য হারানোর সম্ভাবনা আছে৷

মিমির নিখোঁজ হওয়ার পর সে এমনিতেই ভেঙ্গে পড়েছিল৷ তার উপর মৃত্যুর খবর৷ আমি মেয়ে হারা বাবা৷ নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছিল৷ কখনো নিজেকে, কখনো বা অদৃষ্টকে দোষ দিচ্ছিলাম৷ একটি মাত্র মেয়ে ছিল, তাকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখেছিলাম৷ চোখের নিমেষেই সব যেন তাসের ঘরের মতো ধুলিসাৎ হয়ে গেল৷ এখন কেবল নৈরাশ্য নীরবতার জীবনে কালো মেঘের ঘনঘটা৷ মেয়েকে হারানোর পর মনে হচ্ছিল, আমি যেন আমার সর্বস্ব হারিয়েছি৷ একটাই কথা বারবার আমাকে ভেতর থেকে ঠিকরে ঠিকরে খাচ্ছিল৷ কেন এখানে বাড়ি করলাম? এখানে না এলে এসব কিছুই ঘটত না৷ বিপদের আভাস অনেক আগেই পেয়েছিলাম৷ সেটা যে এইরূপে, এভাবে আসবে, আর তার ফল যে এত মর্মান্তিক হবে তা কখনো ভাবতে পারিনি৷ যতদিন বাঁচবো ততদিন নিজের বিবেকের কাছেই নিজেকে জবাবদিহি করে যেতে হবে৷ এই সবকিছুর পেছনে কোথাও না কোথাও আমিই দায়ী৷

পরদিন সন্ধ্যায় যখন ভাই পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা নিয়ে এল তখন এক আশ্চর্যকর তথ্য সামনে এল৷ ঠিক সাত দিন আগে মিমি তার ট্যুর থেকে ফিরেছিল৷ ফেরার পরের দিনই সে নিখোঁজ হয়৷ আর ঠিক পাঁচ দিন পর ওর মৃতদেহ উদ্ধার হয়৷ অর্থাৎ হিসাব অনুযায়ী নিখোঁজ হওয়ার দিন থেকে পরদিনের মধ্যে ও মারা গেছিল৷ কিন্তু পুলিশের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট অন্য কথা বলছিল৷ রিপোর্ট অনুযায়ী মিমির মৃত্যু হয়েছিল প্রায় কুড়ি দিন আগে এবং তার মৃত্যুকে একেবারে স্বাভাবিক মৃত্যু বলা হয়েছিল৷

যতই রিপোর্টে স্বাভাবিক মৃত্যুর কথা লেখা থাকুক না কেন, আমি ভাল করে জানতাম এ কোন স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল না৷ ভাই আরও একটা অবাক করার মত কথা বললো৷ ডোমেদের সাথে কথা বলে সে নাকি জেনেছিল, লাশটা যখন তাদের কাছে নিয়ে আসা হল তখন সেটা একদম টাটকা মড়ার মত লাগছিল৷ কিন্তু কাটা ছেঁড়ার পর দেখা গেল একেবারে অন্য দৃশ্য৷ ভিতরের অংশ পচে এমন দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল যে গা পাক দিয়ে উঠেছিল৷ বোঝা যাচ্ছিল সেটা অনেকদিন পুরনো মড়া৷ ওদের ভাষায় যেটা বাসি লাশ৷ এছাড়াও মৃত্যুর সাথে শরীরের পচনক্রিয়ার সময়ের একটা সুনির্দিষ্ট সম্পর্ক থাকে৷ বিশেষ করে সেটা ত্বরান্বিত হয় অনেকদিন ধরে জলে থাকলে৷ মিমির ক্ষেত্রে কিন্তু তা হয়নি৷ তার শরীরের বাহ্যিক অবস্থার সাথে ভিতরের অবস্থা খাপ খাচ্ছিল না৷ তারা নাকি এরকম ঘটনা তাদের জীবনে এর আগে কখনো দেখেনি৷

কথাগুলো শুনে কয়েকটা ধাঁধাঁ এবার আমার কাছে স্পষ্ট হল: সেই বৃষ্টির রাত্রে ওর অনাকাঙ্ক্ষিত আগমন, গায়ে বৃষ্টির জলের চিহ্ন পর্যন্ত না থাকা, আবার মধ্য রাত্রে ফ্রিজ খুলতে গিয়ে ঐরকম ভয়ানক সব ঘটনা৷ এসব একটাই ব্যাখ্যা দিচ্ছিল৷ সেদিন রাত্রে যে এসেছিল সেটা কি ছিল আমি জানি না, কিন্তু আমার মিমি ছিল না এটা নিশ্চিত৷ প্রফেসর সেন যেদিন ফোন করে ওর নিখোঁজ হবার কথা জানিয়েছিল, সেদিনই ওই অশুভ শক্তি ওকে পেয়েছিল৷

কান্নায় আমার দু’চোখ ভরে এল৷ ঠিক করলাম সেই দিন রাত্রে যেটুকু হোক গোছগাছ সেরে রাখব৷ পরদিন সকালেই এ বাড়ি ছাড়ব৷ রিম্পাকে নিয়ে আপাতত বাঁকুড়া যাব ভাইয়ের বাড়িতে৷ কলকাতার বাড়িতে ননীর লাশ পাওয়া গেছিল৷ ও বাড়িতেও অশুভ শক্তি থাকাটা অস্বাভাবিক নয়৷ কাজেই এমতাবস্থায় ওখানে যাওয়ার ঝুঁকি নিতে পারব না৷

সেদিন সন্ধ্যায় ভাইকে পাঠালাম একটা ভাড়া গাড়ি ঠিক করার জন্য৷ রিম্পাকে ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছিল৷ পাশের ঘরে অঘোরে ঘুমাচ্ছিল৷ আমাদের দু’জনের মতো জামাকাপড় স্যুটকেসে

প্যাক করে রেখে, ড্রইংরুমে চুপচাপ বসেছিলাম৷ সুপর্ণা রাত্রের খাবার তৈরি করছিল৷ আলোতে থাকতে ভাল লাগছিল না৷ যখন মনে অন্ধকার নেমে আসে তখন এই যান্ত্রিক আলো সেই অন্ধকারকে দূর করতে পারেনা৷ চোখ, মুখ দু’হাতে ঢেকে বিপর্যস্ত মনে বসে ছিলাম৷ সহসা একটা চেনা কন্ঠস্বর আমার কানে এল৷

‘বাবা!’

খুব মিষ্টি সুরে একটা মেয়ে ডাকল৷ ঠিক এমন আহ্লাদী সুরেই ডাকতো মিমি৷ বুকটা ধড়াস্ করে উঠল৷ ডাকটা এসেছিল পূব দিকের জানলার বাইরে থেকে৷

জানলার অস্বচ্ছ কাঁচে, আলো-আঁধারিতে ফুটে উঠেছিল একটা অবয়ব৷ মনে হল কেউ একজন দাঁড়িয়ে ওখানে৷ এমনসময় ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে জানলাটা খুলে গেল৷ মাকড়সার চালে, সহসা ঘরে ঢুকে এল বছর উনিশ-কুড়ির একটা মেয়ে৷ রান্নাঘরের আলোর কিছুটা ছটা তার শরীরের উপর এসে পড়ছিল৷ সেই আলোতে যা দেখলাম তাতে আমার শরীরের সব রক্ত এক লহমায় শুকিয়ে গেল৷ সম্পূর্ণ বিবস্ত্র, গায়ে একটা সুতো পর্যন্ত নেই, এলোকেশী এক মেয়ে আমার অনতিদূরে দাঁড়িয়ে৷ বুক থেকে পেট পর্যন্ত একটা সরু কাটার সুস্পষ্ট দাগ আনুভূমিকভাবে নেমে গিয়েছিল৷ দুই হাতের বিকৃত আঙ্গুলগুলো দিয়ে মুখের উপরের এল চুলেগুলো সরাতেই, আমি ভয়ে দু’হাতে নিজের বুক চেপে ধরলাম৷ হৃদযন্ত্রের গতি দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল৷ মনে হচ্ছিল তক্ষুনি হার্টফেল করব৷ আমার সামনে দাঁড়িয়েছিল মিমি৷ কিছুক্ষণ আগেই যার মৃতদেহের কাটা-ছেঁড়া হয়েছিল, সে দাঁড়িয়ে আমার সামনে৷ ক্ষিপ্র গতিতে ছুটে গেল ঘরের দক্ষিণ-পশ্চিমের অন্ধকার কোণে৷ হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসে সুর করে কাঁদতে লাগল৷ পরক্ষনেই রাগে গোঁঙাতে গোঁঙাতে পাগলের মত মাথার চুলগুলো ছিঁড়তে থাকল৷ আমাকে লক্ষ্য করে ছুঁড়তে লাগল মুঠো মুঠো ছেঁড়া চুল৷ নিজেকে মনে হচ্ছিল যেন কোন এক বিভীষিকাময় পরলৌকিক নাটকের দর্শক৷ খেলনা পুতুলের মত আমি সেসব দেখে যাচ্ছিলাম৷ এমনসময় একটা চুলের গোছা আমার কোলে এসে পড়ল৷ সেটাতে কি সব পোকা গিজ গিজ করছে দেখেই পেটের নাড়ি সমেত পাক দিয়ে উঠল৷ সেটাকে যে ঝেড়ে ফেলব, সে ন্যূনতম শক্তিটুকু আমার শরীরে ছিলনা৷

হঠাৎ ওঘর থেকে রেকর্ড প্লেয়ারটা বেজে উঠল৷ কিশোর কুমারের একটা গান শুনতে পাচ্ছিলাম৷ ওঘরের দিকে চোখ যেতে না যেতেই পাল্লা ঝাপটানোর শব্দ আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল পূবের জানলার দিকে৷ পাল্লা দুটো হালকা দুলছিল৷ ঘরের অন্ধকার কোণটা ফাঁকা৷ কেউ ছিলনা সেখানে৷

আমি শরীরের সব বল যেন আবার ফিরে পাচ্ছিলাম৷ এমন সময় ওঘর থেকে সুপর্ণার চিৎকার শোনা গেল৷ ছুটে গিয়ে দেখি সে দরজার চৌকাঠে সিঁটিয়ে প্রস্তরবৎ দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ চোখে মুখে বিভীষিকার ছাপ৷ কিছু বলার অপেক্ষার আগেই দেখলাম, গানের তালে তালে পাগলের মত নেচে চলেছে রিম্পা৷ সেদিনের আগে পর্যন্ত কোনদিনও ওকে ওরকমভাবে নাচতে দেখিনি৷ সেই নাচে অস্বাভাবিকতা স্পষ্ট লক্ষ করা যাচ্ছিল৷ হাত-পা বেঁকিয়ে, কখনো বা মাটিতে শুয়ে পড়ে উন্মাদ ভঙ্গিমায় নাচছিল সে৷ মাটিতে শুয়ে কনুই, পায়ের পাতায় ভর দিয়ে পেট, বুক সমেত শূন্যে তুলে দিচ্ছিল৷ আবার কখনো আমাদের দিকে চেয়ে খিলখিল করে হাসছিল৷ আবার কখনো বা ত্রিভঙ্গ মূর্তির মত নাটকীয় ভঙ্গিমায় সারা শরীর বেঁকিয়ে দিচ্ছিল৷

বুঝতে পারলাম যে ও তখন নিজের মধ্যে নেই৷ মেয়েটার মত ওর শরীরেও আস্তানা গেড়েছে ওই অশুভ সব শক্তি৷

জানি না কি ভেবে করেছিলাম৷ ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম৷ শুরু করলাম মহা মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র পাঠ৷ জল থেকে মাছ তুলে নিলে সেটা যেমন ছটফট করে, ঠিক সেরকমই ছটফট করতে লাগল রিম্পা৷ মন্ত্রটা যেন ওর জন্য কাটা ঘায়ের উপর নুনের মতো কাজ করছিল৷ প্রাণপনে সে আমার কবল থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছিল৷ তখন তাকে মেয়ে মানুষ বলে মনে হচ্ছিল না৷ তার একার গায়েই যেন তিন তিনটে লেঠেলের শক্তি৷ মেয়েকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিল ওই শয়তানি শক্তি৷ মনে মনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলাম যে, আমার স্ত্রীকে কিছুতেই ওদের কেড়ে নিতে দেবনা৷

একসময় সে চিৎকার করতে লাগল৷ সেই চিৎকারে একাধিক নারী, পুরুষের সম্মিলিত আর্তনাদ৷ খামচে আমার হাতের, কাঁধের চামড়া তুলে নিল৷ সেসব ক্ষত থেকে বেরোনো রক্তে রক্তাক্ত হয়ে গেল আমার সারা শরীর৷ কিন্তু কোনমতেই আমি আমার বাঁধন আলগা করি নি৷ কিছুক্ষণ এভাবে ধ্বস্তাধ্বস্তির পর একসময় বুঝতে পারলাম ওর শরীরের জোর কমে আসছে৷ একসময় ওর অচেতন শিথিল শরীর ভগ্ন স্তূপের মত লুটিয়ে পড়ল৷ দরজার পাশ থেকে ভয় কাঁদতে কাঁদতে সুপর্ণা বেরিয়ে এল৷ ওকে রিম্পার কাছে থাকতে বলে আমি ডাক্তারকে ফোন করতে গেলাম৷

কিছুক্ষণ পর ওর জ্ঞান ফিরল৷ ডাক্তার কিছু ঔষধপত্র লিখে দিলেন আর ভালো করে যত্ন নিতে বললেন৷ ইতিমধ্যেই ভাই ফিরে এল৷ ডাক্তার চলে যাওয়ার পর ভাইকে সব কিছু জানালাম৷ সে গাড়ি ঠিক করে এসেছিল৷ ভোর পাঁচটায় গাড়ি পৌঁছে যাবে৷ কিন্তু তার আগে জানতে হত রিম্পার সাথে কি হয়েছিল৷

ও ক্লান্ত শরীরে শুয়েছিল৷ আমার হাত ওর মাথা স্পর্শ করতেই চোখ মেলে তাকাল আমার দিকে, আর তারপরই হাঁপুস নয়নে কেঁদে উঠল৷ আমি ওকে আশ্বস্ত করলাম৷ ওর সাথে কি কি ঘটেছিল সেগুলো সব বলতে বললাম৷

‘আমি আমার ঘরে শুয়ে ছিলাম৷ কেন জানি না, হঠাৎ আমার চোখ পড়ল পশ্চিমের জানলার উপর৷ দেখলাম, কালো একটা ছায়া জানলার ফাঁক গলে ঘরে ঢুকে পড়ছে৷ কালো জল জানলা বেয়ে এলে যেমন দেখায় ঠিক তেমন৷ আমি উঠে দেখতে যাব ঠিক তখনই যেন কোন অদৃশ্য হাত আমাকে শক্তকরে বিছানার সাথে সিঁটিয়ে রাখল৷ এরপর সেই ছায়া একটা বামনের রূপ নিল৷ সারা ঘরময় ছুটে বেড়াতে লাগল৷ আমি এতটাই ভয় পেয়ে গেছিলাম যে চিৎকার করবার মত অবস্থায় ছিলাম না৷ হঠাৎই বামনটা আমার বুকের উপর উঠে এল৷ আমি তার মুখটা দেখেছিলাম৷ কি ভয়ঙ্কর, কি বীভৎস! চোখের জায়গাটা, চোখের পাতা দিয়ে জোড়া৷ যেন কেউ সেগুলোকে সেলাই করে দিয়েছিল৷ সারা দেহ লালচে বাদামি লোমে ঢাকা৷ গায়ে বোঁটকা গন্ধ৷ আরেকবার শরীরের অবশিষ্ট সব শক্তি এক করে ডাকতে গেলাম তোমাকে৷ তখনই আপনা থেকেই বেজে উঠল রেকর্ড প্লেয়ারটা৷ তারপর সে তার দু’হাতে আমার গলা চেপে ধরল৷ আমার আরো কাছে ঝুঁকে পড়ে তার কপালটা আমার কপালে ঠেকাল৷ ধীরে ধীরে সবকিছু কেমন ঝাপসা হয়ে এল৷ তারপর আমার আর কিছু মনে নেই৷’

সেদিন রাত্রে আমরা কেউই দু’চোখের পাতা এক করতে পারিনি৷ সারারাত আতঙ্কে কেটেছিল৷ রিম্পাকে আর একা ছাড়িনি৷ তিনজনে ওর ঘরে বসেই সারারাত কাটিয়ে দিলাম৷ একসময় জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম কালো রাত পরিষ্কার করে সূর্যোদয় হচ্ছে৷ ঘড়িতে পাঁচটা বাজতে আর বেশি দেরি ছিল না৷

একসময় বাইরে গাড়ির হর্ন শুনতে পেলাম৷ গাড়ি চলে এসেছিল৷ আমরা আর এক মুহূর্তও দেরি করি নি৷ ব্যাগপত্তর সব গাড়িতে তুলতে লাগলাম৷

এমন সময় অদূরেই দেখলাম নৃসিংহকে৷ কাঁচা রাস্তা ধরে হেঁটে আসছিল এদিকেই৷ ওর অপ্রত্যাশিত আগমন আমাকে বেশ আশ্চর্যচকিত করল৷ ওর তো স্ট্রোক হয়েছিল৷ এরই মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠল?

সে আমার সামনে এসে দাঁড়াল৷ চারপাশ একবার দেখে নিয়ে বললো, ‘বাড়ি ছেড়ে দিচ্ছিস বুঝি? তা বেশ ভালোই করছিস৷’

জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোকে সেদিন ফোন করেছিলাম৷ তোর মেয়ের কাছেই শুনলাম তোর অসুস্থতার খবর৷ তা এখন ঠিক আছিস বুঝি? তা এই কাকভোরে, এপথে কি মনে করে?’

প্রত্যুত্তরে সে কিছুই বললো না৷

‘তোর মেয়ের খবরটা শুনলাম৷ আমি খুব মর্মাহত হয়েছি শুনে৷ কিন্তু এটা যে হওয়ারই ছিল৷’

বিষাদ মাখা কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি বলছিস তুই! হবার ছিল মানে?’

‘আমি আমার সাধনা দ্বারা জেনেছি৷ যে পুকুরটাকে ভরাট করে গ্যারেজ বানিয়েছিস, ওই পুকুরটায় ছত্রিশটা দুষ্ট প্রেতাত্মার বাস ছিল৷ বহু আগে এক কাপালিকের বাস ছিল এই তপোবনে৷ সে স্বার্থসিদ্ধির জন্য কালো জাদু আর তন্ত্র-বিদ্যার দ্বারা প্রেতাত্মা বশীভূত করে ওই পুকুরে বেঁধে রাখত৷ এভাবে একে একে ছত্রিশটা দুষ্ট প্রেতাত্মাকে সেখানে বন্দী করে রেখেছিল৷ শেষে একদিন এদের হাতেই মরতে হল কাপালিককে৷ তারপর থেকে এদের এখানেই বাস৷ তুই এদের পুকুর বুজিয়ে এদের চটিয়ে দিয়েছিস৷ এরপর এখানে থাকলে এরা তোর পুরো পরিবারকে শেষ করে দিত৷ কাউকে বাঁচতে দিত না৷’

সেই বুড়িটার কথাগুলো আমার কানে বাজছিল৷ ওর কথা প্রথমে শুনলে হয়তো এইদিন দেখতে হতো না৷

আমি আর এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করলাম না৷ তখনকার মত নৃসিংহের কাছে বিদায় নিয়ে সেই মারণ বাড়ি ত্যাগ করলাম৷

(৮)

ভাইয়ের বাড়িতে ওঠার ক’দিন পর মিমির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করেছিলাম৷ তার বেশ কিছুদিন পর কলকাতায় একটা বাড়ি ভাড়া নিলাম৷ সেই থেকে এখানেই আছি৷

সেই ঘটনার পর রিম্পা মানসিক আর শারীরিকভাবে প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়ে৷ আজকের দিনেই মিমি মারা গেছিল৷ যদিও ওর সঠিক মৃত্যুদিনটা জানা নেই৷ তবে ট্যাঙ্কিতে ওর লাশ উদ্ধারের দিনটাকেই মৃত্যুর দিন হিসেবে মেনে নিয়েছি৷ আজকের দিনটা এলেই রিম্পা পাগলের মত আচরণ করতে থাকে৷ সামলানো দায় হয়ে পড়ে৷ আজও কিন্তু সেই দিন, সেই অভিশপ্ত তারিখ৷ তবে আজ সে একেবারে শান্ত৷ কোনরকম উন্মাদের মত আচরণ সে করে নি৷ কি জানি হয়ত ওষুধের জেরে বা হয়ত মনে নেই ওর৷ যাই হোক না কেন ওর শরীরের অবস্থার উন্নতি হচ্ছে দেখে আমি কিছুটা নিশ্চিন্ত৷

সূর্য অস্ত গিয়েছে অনেকক্ষণ৷ হ্যালোজেন লাইটের আলোয় ভিক্টোরিয়াকে চমৎকার দেখাচ্ছে৷ ক্রমশ মাঠের ভিড় কমতে লাগল৷ এই স্থাপত্যটার সাথে নিজের একটা মিল খুঁজে পেলাম কোথাও৷ দিনের আলোতে এর আত্মগৌরব স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রকাশ পায়৷ ঠিক তেমনই সেটা টিকিয়ে রাখতে রাত্রে প্রয়োজন পড়ে কৃত্রিম আলোর৷ তাতে কি সেই স্বতঃস্ফূর্ত আসল রূপ প্রকাশ পায়? না! ঠিক তেমনই আমার আনন্দ, ইচ্ছাগুলো আগে ছিল নির্ভেজাল৷ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তা আসত৷ এখন জোর করে আনাতে হয়, প্রকাশ পাওয়াতে হয়৷ সবটাই যে রিম্পার মুখের দিকে চেয়ে তা বলবো না৷ কিছুটা বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিয়েও৷ এ বাস্তব বড়ই কঠিন৷

যখন বাড়ি ফিরলাম তখন ঘড়িতে সন্ধ্যা সাতটা৷ মুলুকের বাড়িটা এখন পরিত্যক্ত৷ বিক্রি করার অনেক চেষ্টা করেছি, ডিল ফাইনাল হয়েও শেষ মুহূর্তে ক্যান্সেল হয়ে গিয়েছে৷ এখন আর চেষ্টা করি না৷

ওখান থেকে ফেরার পর নৃসিংহের সাথে আর যোগাযোগ হয়নি৷ ফোন করে একবার খবরা-খবর নেওয়াটা উচিত মনে হল৷ ওর ল্যান্ডলাইন নাম্বারটা আমার কাছে ছিল৷ ডায়েল করলাম৷ কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর ওপাশ থেকে নারী কন্ঠ ভেসে এল, ‘হ্যালো! কে বলছেন?’

বুঝতে পারলাম নৃসিংহের মেয়ে ফোনটা ধরেছে৷

‘হ্যাঁ মা, আমি নৃসিংহের বন্ধু বলছিলাম৷ ওকে দাও তো ফোনটা একটু৷’

‘কাকু আপনি হয়তো জানেন না, আজ থেকে দু’বছর আগে বাবার স্ট্রোক হয়েছিল…’

কথাটা শেষ করার আগেই বলে উঠলাম, ‘হ্যাঁ জানিতো৷ শুনেছিলাম তোমার কাছেই৷ সেবার ফেরার সময় দেখা হয়েছিল৷ তা এখন কেমন আছে?’

দু’মিনিট নিস্তব্ধতার পর ওপাশ থেকে আবেগপূর্ণ গলায় সে বললো, ‘কাকু আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে৷ হাসপাতালে ভর্তির পরদিনই বাবা হাসপাতালেই মারা যায়৷’

আমার হাত থেকে রিসিভারটা সশব্দে পড়ে গেল৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *