সতী
লোকটি হাত দেখিতে জানে, ঠিকুজি-কোষ্ঠী গণনা করিতে জানে, এবং গল্প বলিতে পারে। পেশা কিন্তু বীমার দালালি। বয়স আন্দাজ পঁয়তাল্লিশ; গম্ভীর, মোটা এবং ধড়িবাজ। এই জাতীয় লোককে আমি সর্বদাই এড়াইয়া চলি, কিন্তু কেমন করিয়া জানি না তাহার খপ্পরে পড়িয়া গিয়াছিলাম। দশ হাজার টাকা জীবনবীমা করিয়া ভবিষ্যতের পায়ে বর্তমানকে বন্ধক রাখিয়া চক্ষে সরিষার ফুল দেখিতেছিলাম।
কিন্তু সে যাক্। নিজের দুঃখের কথা এখানে বলিতেছি না। লোকটি তাহার জীবনের একটি অভিজ্ঞতার যে কাহিনী শুনাইয়াছিল তাহাই লিপিবদ্ধ করিতেছি। বীমা-দালালের সত্যবাদিতা সম্বন্ধে কোনও মতামত প্রকাশ করিতে চাহি না। তাঁহারা হয়তো অহরহ সত্য কথাই বলিয়া থাকেন; কিন্তু এই কাহিনীর সত্যাসত্য বিষয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করিতেও আমি অক্ষম। যেমন শুনিয়াছিলাম তেমনি লিখিতেছি।
আমি তখন বোম্বাই প্রবাসী। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আরম্ভের দিকে চাকরি ছাড়িয়া দিয়া বসিয়া আছি। সে কোনও দিন সকালে, কোনও দিন বিকালে আমার বাসায় আসিত। আমার হাত দেখিয়া এমন উজ্জ্বল ভবিষ্যতের চিত্র আঁকিয়াছিল যে মুগ্ধ হইয়া গিয়াছিলাম।
লোকটির গল্প বলিবার ভঙ্গি নাটুকে নয়, বরঞ্চ তাহার বিপরীত। সামান্য সূত্র ধরিয়া সে গল্প আরম্ভ করিত, ধীর মন্থর কণ্ঠে বলিয়া যাইত; সে যে গল্প বলিতেছে তাহা প্রথমে ধরা যাইত না। তারপর কখন অলক্ষিতে গল্প জমিয়া উঠিত, আফিমের নেশার মতো ধীরে ধীরে মনকে গ্রাস করিয়া ফেলিত।
একদিন সন্ধ্যার পর সে আসিয়া জুটিয়াছিল। সেদিন আর কেহ আসে নাই। আমি আরাম-কেদারায় লম্বা হইয়া গড়গড়া টানিতেছিলাম, সে একটা বেতের চেয়ারে বসিয়া দীর্ঘ সিগার ধরাইয়াছিল। বাহিরে রিম্ঝিম্ বৃষ্টি চলিয়াছে। বোম্বাই বৃষ্টি, বজ্ৰহীন বিদ্যুৎহীন উদ্বেগহীন বৃষ্টি। এ বৃষ্টিতে শুধু বহিরঙ্গ নয়, মনও ভিজিয়া ভারি হইয়া ওঠে।
সে সন্তর্পণে অ্যাশ-ট্রেতে সিগারের ছাই ঝাড়িয়া রাখিতে রাখিতে বলিল, ‘আজকাল সীতা সাবিত্রী খুব বেশি দেখা যায় না বটে, কিন্তু সতীসাধ্বী মেয়ে একেবারে নেই এ কথা বলা চলে না।’
কথাটা সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক, কোনও পূর্বসংযোগ নাই। আমি ভ্রূ বাঁকাইয়া প্রশ্ন করিলাম, ‘তাই নাকি! হঠাৎ এ কথা কেন?’
সে সিগার দাঁতে চাপিয়া দু’তিনটা মৃদু টান দিল। বলিল, ‘বৃষ্টি দেখে মনে পড়ে গেল। গত বছর গ্রীষ্মের শেষে আমি গুজরাতে গিয়েছিলাম, একেবারে গুজরাতের অন্দর মহলে। সেখানে একটা ব্যাপার দেখিলাম—’
‘কী— সতীদাহ? ওদিকে এখনও মাঝে মাঝে হয় শুনেছি।’
‘না। সতীদাহ নয়’— একটু কাশিয়া গলাটা পরিষ্কার করিয়া সে বলিতে আরম্ভ করিল:
কাকুভাই দেশাই আমার বন্ধু, এক কোম্পানিতে কাজ করি। গুজরাতের কয়েকটা তসিল নিয়ে তার এলাকা; সেখানেই থাকে, মাঝে মাঝে বোম্বাইয়ের হেড্ অফিসে আসে। গত বছর কাকুভাই হেড্ অফিসে এসেছে, আমাকে বলল, ‘চল না গুজরাত বেড়িয়ে আসবে। আমার অফিসে অনেক কাজ জমে গেছে, তোমাকে পেলে সামলে নিতে পারব।’
কর্তার অনুমতি নিয়ে দু’জনে বেরিয়ে পড়লাম। আমি সুরাট আমেদাবাদে কয়েকবার গেছি বটে, কিন্তু অজ গুজরাতে কখনও ঢুকিনি। দেশটা দেখবার ইচ্ছে ছিল। ভারতবর্ষে যত জাত আছে তার মধ্যে গুজরাতিরাই বোধ হয় সবচেয়ে বড়মানুষ। টাকা রোজগারের এত ধান্দা মাড়বারিরাও জানে না। ভাবলাম, দেখে আসি কোন্ গোলার চাল খেয়ে ওদের এত বিষয়বুদ্ধি!
সারা গুজরাতে বোধ হয় দু’চার শ’ রাজ্য আছে। ক্ষুদে ক্ষুদে রাজ্য, ক্ষুদে রাজা, ক্ষুদে রাজধানী। শহরগুলির জীর্ণ অবস্থা; সরু সরু গলি, বাড়িগুলো গলে খসে পড়েছে। মৌচাকের মধু নিঙড়ে নিয়ে শুকনো ভাঙ্গা মৌচাকটা যেন কে ফেলে দিয়েছে। আসল গুজরাতের এই চেহারা। বেশ বোঝা যায়, গুজরাতিদের ঘরে কিছু নেই, মাড়বারিদের মতো ঘর থেকে বেরিয়ে ওরা মধুসঞ্চয় করে। যে জাতের ঘরে খাবার আছে তারা বাইরে যায় না, বাঙালীর মতো ঘরের মাটি কামড়ে পড়ে থাকে। মধু সঞ্চয় করতে পারে না।
যা হোক্, আমরা তো গিয়ে পৌঁছুলাম। শ্রীহীন শহর, দেখবার কিছু নেই। তার ওপর পচা গরম। আকাশে মেঘ ঘোরাঘুরি করছে, দু’চার দিনের মধ্যে বৃষ্টি নামবে। তার আগে গ্রীষ্মঋতু অন্তিম কামড় দিয়ে যাচ্ছে।
কাকুভাইয়ের বাসাতেই আছি। তার ঘরে বৌ আর দু’টি মেয়ে। মহাত্মাজীর কল্যাণে গুজরাতী মেয়েরা পর্দা থেকে মুক্তি পেয়েছে, কিন্তু তাদের মন এখনও রান্নাঘরের চৌকাঠ পার হতে পারেনি। বড় বেশি সংসারী গুজরাতী মেয়েরা, সংসার নিয়েই আছে। নিজেরা রাঁধে, জল তোলে, কাপড় কাচে, বাজার করে। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপার অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। মাছ-মাংসের পাট নেই; তবে খুব দুধ খায়, কথায় কথায় দুধ খায়। বাড়িতে কেউ এলে তাকে চায়ের বদলে দুধ দেয়। কাকুভাইয়ের বৌ সুশীলা বেন ভারি শান্ত প্রকৃতির মহিলা, আমাকে যথেষ্ট আদর-যত্ন করলেন। তবু মনে হল তিনি যদি একটু কম সংসারী হতেন তাহলে বোধ হয় ভাল হত। কিন্তু কী করবেন উনি; গুজরাতী জাতের ধাতই ঐ। চড়ুইপাখি যেমন বেশি উঁচুতে উড়তে পারে না, ওদের মন তেমনি মাটি থেকে বেশি উঁচুতে ওঠে না।
তাই বলে কি ব্যতিক্রম নেই? আছে বৈ কি! মহাত্মাজীই তো মস্ত একটি ব্যতিক্রম। কিন্তু এরকম ব্যতিক্রম বড় বেশি চোখে পড়ে না। আদর্শ নিয়ে ওদের বেশি মাথাব্যথা নেই; তাই বোধ হয় মাঝে মাঝে ওদের মধ্যে বিরাট আদর্শবাদী মানুষ জন্মগ্রহণ করে জাতটাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন।
তিন-চার দিন কেটে গেল। কাকুভাই আমাকে তার অফিসে নিয়ে যায়, সেখানে তার কাজকর্মে তাকে সাহায্য করি, অফিসের কাজকর্ম এগিয়ে দিই। অনেক লোক আসে অফিসে। বীমা কোম্পানির অফিস আড্ডা দেবার জায়গা; কেউ আড্ডা দিতে আসে, কেউ বীমা সম্বন্ধে খোঁজখবর নিতে আসে; সাব-এজেন্টরা কেস নিয়ে আসে। কাকুভাইয়ের মুখে তারা যখন শোনে আমি হাত দেখতে জানি, সবাই আমাকে ঘিরে ধরে। সকলের মুখে এক প্রশ্ন— কবে আমার টাকা হবে?
একদিন বিকেলবেলা কাকুভাই বলল, ‘চল, তোমাকে বেড়িয়ে নিয়ে আসি। শহরটা তো একবার দেখলেও না।’
বললাম, ‘কি আছে তোমার শহরে?’
সে বলল, ‘কিছুই না। তবু নদীর ধারটা মন্দ নয়। চল, সেইদিকেই যাওয়া যাক।’
দু’জনে বেরুলাম। আকাশে মেঘ বেশ গাঢ় হয়েছে; বাতাস নেই। ঘরে বসে বসে দম বন্ধ হয়ে আসে, তার চেয়ে বাইরে ভাল। বোধ হয় আজ রাত্রেই বর্ষা নামবে।
গলির পর গলি পার হয়ে নদীর দিকে চলেছি। এক সময় কাকুভাই বলল, ‘চল, চম্পকভাইকে একবার দেখে যাই, অনেকদিন খোঁজ পাইনি। কাছেই তার বাড়ি।’
আর একটা গলিতে ঢুকলাম— ‘চম্পকভাই কে?’
কাকুভাই বলল, ‘চম্পকভাই পাটেল, আমার পরিচিত একটি ছোকরা। সাব-এজেন্টের কাজ করত, মাঝে মাঝে দু’একটি কেস আনত। বড় গরিব। কয়েক মাস হল টি. বি. ধরেছে।’
গলিটা সরু হয়ে যেখানে পাশাপাশি দু’জন হাঁটার অযোগ্য হয়ে পড়েছে সেখানে একটা ছোট একতলা বাড়ি। বাড়ির গা থেকে খাবলা খাবলা প্ল্যাস্টার উঠে গেছে, বন্ধ দরজার রঙ মাছের আঁশের মতো ছেড়ে ছেড়ে আসছে। জরাজীর্ণ বাড়িটায় মানুষ আছে বলে মনে হয় না, যেন পোড়ো-বাড়ি। কাকুভাই দরজায় ধাক্কা দিল।
কিছুক্ষণ পরে একটি মেয়ে এসে দরজা খুলে দাঁড়াল। কাকুভাই জিজ্ঞেস করল, ‘চম্পকভাই কেমন আছে, রমাবেন?’
এক নজর দেখে মনে হয় মেয়েটি অপূর্ব সুন্দরী। তারপর বুঝতে পারা যায়, অপূর্ব সুন্দরী নয়, অপূর্ব তার লাবণ্য। মুখে আর সারা গায়ে লাবণ্য ফেটে পড়ছে। বয়স আন্দাজ ছাব্বিশ-সাতাশ; রঙ ফরসা, টানা-টানা চোখ, ঠোঁট দুটি পাকা তেলাকুচোর মতো টুক্টুকে লাল; কিন্তু মুখে রুজ পাউডার নেই। গুজরাতী মেয়েরা সিঁথেয় সিঁদুর পরে না, তাই সধবা কি বিধবা কি কুমারী বোঝা যায় না, তবু বুঝতে কষ্ট হল না যে, রমাবেন চম্পকভাইয়ের বৌ।
কাকুভাইয়ের প্রশ্নের উত্তরে রমাবেন একটু ঘাড় নাড়ল। তার টানা-টানা চোখের মধ্যে কি যেন রয়েছে ঠিক ধরা যায় না; যেন তার মন ইহলোক ছাড়িয়া অনেক দূর চলে গেছে। যেন সে পৃথিবীর মানুষ নয়! এটা তার স্বাভাবিক ভঙ্গি কিনা, প্রথমবার তাকে দেখে বুঝতে পারলাম না।
ঘরের ভিতর থেকে অবসন্ন কাশির আওয়াজ এল।
কাকুভাই বলল, ‘এসেছি যখন, চম্পকভাইকে একবার দেখে যাই।’
রমাবেন একবার আমার মুখের পানে তাকাল, একবার কাকুভাইয়ের পানে তাকাল, তারপর আস্তে আস্তে মাথা নাড়ল। অর্থাৎ— না!
কাকুভাই তৎক্ষণাৎ বলল, ‘আচ্ছা থাক। আমার এই বন্ধুটি বোম্বাই থেকে এসেছেন, তাই ক’দিন খবর নিতে পারিনি। আমি কাল আবার আসব।’
রমাবেনের মুখে একটু হাসি ফুটে উঠল, তারপর চটা-ওঠা দরজা আবার বন্ধ হয়ে গেল।
ফিরে চললাম। যেতে যেতে কাকুভাই বলল, ‘চম্পকভাই বোধ হয় বাঁচবে না। যদি না বাঁচে রমাবেনের কি হবে তাই ভাবছি। ওদের কারুর তিন কুলে কেউ নেই। চম্পকভাইকে বলেছিলাম অন্তত হাজার টাকার একটা পলিসি নাও। তা শুনল না—’
রমাবেনের লাবণ্যভরা মূর্তি আমার চোখের সামনে ভাসতে লাগল। যার স্বামী টি. বি.-তে মরছে তার এত লাবণ্য! কী রকম মেয়ে রমাবেন? মুমূর্ষু স্বামীর সেবা করে না?
আরও কয়েকটা গলিঘুঁজি পেরিয়ে নদীর ধারে গিয়ে পৌঁছুলাম। মেঘলা আকাশ থম্থম্ করছে, মেঘের আড়ালে সূর্যাস্ত হয়েছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না।
নদী খুব চওড়া নয়, বড় জোর পঞ্চাশ-ষাট গজ, তাও জল শুকিয়ে বালি আর পাথরের ঢেলা বেরিয়ে পড়েছে, খাদের মাঝখান দিয়ে জলের একটা সরু নালা বয়ে যাচ্ছে। দু’ধারে উঁচু পাথুরে পাড়, বর্ষা নামলে নিশ্চয় কানায় কানায় জল ভরে ওঠে।
আমরা একটা পাথরের ওপর পা ঝুলিয়ে বসলাম। এখানটা বেশ নিরিবিলি, নদীর ঘাট এখান থেকে বেশ খানিকটা দূরে। আমি সিগার ধরালাম। কাকুভাই সিগারেট বের করল। গুমট ভেঙে পশ্চিম থেকে একটু ঠাণ্ডা হাওয়া দিতে আরম্ভ করেছে। সমস্ত দিনের আকাট গরমের পর ভারি মিষ্টি লাগল।
নদীর এপাশে শহর, ওপারে জনবসতি নেই। ওদিকে পাড়ের ওপর একসারি ছোট ছোট মন্দির রয়েছে, বোধ হয় কুড়ি-পঁচিশটা। সবগুলো এক মাপের, ছ’ফুট কি সাত ফুট উঁচু। জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওগুলো কিসের মন্দির?’
কাকুভাই একবার সেদিকে তাকিয়ে কপালে হাত ঠেকাল, বলল, ‘ওগুলো সতী মন্দির।’
সতী মন্দির! সে কাকে বলে? কেষ্টবিষ্টুর মন্দির, গণপতি মহালক্ষ্মীর মন্দির, জগন্নাথ মা-কালীর মন্দির জানি। কিন্তু সতী মন্দিরের নাম কখনও শুনিনি। বললাম, ‘সে কাকে বলে?’
কাকুভাই তখন গল্প ফেঁদে বসল। বলল, ‘আজকের কথা নয়, প্রায় হাজার বছর ধরে চলে আসছে। যখনি এই শহরে কোনও সতী নারীর মৃত্যু হয়েছে তখনি শহরের লোকেরা তাঁর স্মৃতিরক্ষার জন্যে নদীর ধারে একটি করে মন্দির তৈরি করেছে। সবসুদ্ধ চব্বিশটি মন্দির আছে। শেষ মন্দিরটি তৈরি হয়েছিল ষাট-সত্তর বছর আগে। তারপর আর হয়নি। প্রতি পূর্ণিমায় শহরের মেয়েরা মন্দিরে গিয়ে ফুল জল দিয়ে আসে। কামনা করে, তারাও যেন সতী হতে পারে। মন্দিরগুলি আমাদের শহরের মস্ত গৌরব।’
আমি বললাম, ‘ঠিক বুঝলাম না। তুমি বলছ এক হাজার বছরে মাত্র চব্বিশটি সতী পাওয়া গেছে। আর বাকী সব মেয়েরা কি অসতী ছিল? কে সতী কে অসতী তার বিচার হয় কি করে?’
কাকুভাই একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘গোড়ার দিকে কি হয়েছিল জানি না, কিন্তু গত দেড়শ দু’শ বছরে যা হয়েছে তা বলতে পারি। শহরের বুড়ো বুড়িদের মুখে শুনেছি, এক অলৌকিক ব্যাপার হয়। যেদিন শহরে কোনও সতী নারীর মৃত্যু হয় সেদিন সন্ধ্যার পর ঐ মন্দিরগুলোতে হঠাৎ আলো জ্বলে ওঠে, তারপর প্রদীপ হাতে নিয়ে সতী নারীরা মন্দির থেকে বেরিয়ে আসেন, তাঁরা দল বেঁধে মন্দিরগুলোকে প্রদক্ষিণ করেন, তারপর আবার মন্দিরে অদৃশ্য হয়ে যান; শহরের লোকেরা তাই দেখে বুঝতে পারে; তখন তারা নতুন মন্দির তৈরি করে।’
অলৌকিক ব্যাপারে হঠাৎ বিশ্বাস হয় না; আবার সংস্কারের বিরুদ্ধে তর্ক করাও চলে না, তাতে বন্ধুবিচ্ছেদ হয়। আমি চুপ করে রইলাম।
এতক্ষণে চারিদিক ঘোর ঘোর হয়ে এসেছে, বাতাসে একটা ভিজে ভিজে স্পর্শ, যেন কাছেই কোথাও বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে। পশ্চিম দিক থেকে কুয়াশার মতো একটা আবছায়া পর্দা এগিয়ে আসছে। কাকুভাই উঠে পড়ল, ‘চল, ফেরা যাক।’
নিভে যাওয়া সিগারটা ফেলে দিয়ে আমিও উঠে দাঁড়ালাম। কুয়াশার পর্দা তখন ওপারের মন্দিরগুলোর ওপর এসে পড়েছে, কিন্তু মন্দিরগুলো একেবারে ঢাকা পড়ে যায়নি। হঠাৎ এক অদ্ভুত ব্যাপার হল। মন্দিরগুলোর মধ্যে দপ্ করে আলো জ্বলে উঠল, যেন কেউ সুইচ টিপে সবগুলো মন্দিরের আলো একসঙ্গে জ্বালিয়ে দিলে।
আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম। আমার পাশে দাঁড়িয়ে কাকুভাইও দেখতে পেয়েছিল। সে দু’হাত জোড় করে বলতে লাগল, ‘জয় সতী-মা! জয় সতী-মা!’ তার গলা থর্থর্ করে কাঁপছে।
আমি ফিস্ফিস্ করে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মন্দিরগুলোতে ইলেক্ট্রিক্ লাইট আছে নাকি?’
সে চাপা গলায় বলল, ‘ইলেক্ট্রিক্ কোথায়! জয় সতী-মা! কত পুণ্যে আমি এ দৃশ্য দেখলাম! জয় সতী-মা।’
ওদিকে আলোর সারি নড়তে আরম্ভ করেছে। এত দূর থেকে স্পষ্ট মানুষের মূর্তি দেখতে পেলাম না, তবু মনে হল এক দল মেয়ে প্রদীপ হাতে নিয়ে মন্দির প্রদক্ষিণ শুরু করেছে। আলোর সারি সাপের মতো মন্দির প্রদক্ষিণ করে ফিরে এল। তারপর প্রদীপগুলো ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে নিভে গেল।
গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি মুখে লাগছে; যাকে কুয়াশা মনে করেছিলাম তা আসলে বৃষ্টির সূত্রপাত। কাকুভাই তখনও তদ্গতভাবে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি বললাম, ‘চল, এবার ফেরা যাক!’
কাকুভাই চমকে উঠল। তারপর বলল, ‘কোন্ সতীর দেহান্ত হয়েছে কে জানে। চল, শহরে খবর নিই।’
ফিরে চললাম। শহরের দোকানপাটে আলো জ্বলছে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি বাতিগুলোকে ঘিরে রঙ ফলাচ্ছে। কিছুক্ষণ চলবার পর দেখলাম কোট-প্যান্ট পরা একজন লোক হাতে ব্যাগ নিয়ে হন্হন্ করে আসছে। কাকুভাইকে দেখে থমকে দাঁড়াল; বলল, ‘কে, কাকুভাই?’
কাকুভাই বলল, ‘হ্যাঁ। কি খবর ডাক্তার সামন্ত? কোথায় চলেছ?’
ডাক্তারকে চিনতে পারলাম, আমাদের কোম্পানির স্থানীয় ডাক্তার। সে বলল, ‘শোননি চম্পকলাল মারা গেছে?’
দু’জনেই চমকে উঠলাম। কাকুভাই বলে উঠল, ‘মারা গেছে! এই ঘণ্টাখানেক আগে তার বাড়িতে গিয়েছিলাম, তার বৌ রমাবেন—’
ডাক্তার বলল, ‘রমাবেনও নাকি মারা গেছে।’
‘অ্যাঁ!’
‘হ্যাঁ। কিছু বুঝতে পারছি না। আসবে তো এস৷’ বলে ডাক্তার হন্হন্ করে চলল।
আমরা আচ্ছন্নের মতো তার পিছু পিছু চললাম। যাকে এক ঘণ্টা আগে সহজ সুস্থ মানুষ দেখেছি, যার অপরূপ লাবণ্য চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে, সে মরে গেছে! চম্পকভাইকে দেখিনি, তার হয়তো মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছিল— কিন্তু—
ডাক্তার চলতে চলতে বলল, ‘চম্পকলালকে আমিই দেখছিলাম, সে দু’এক দিনের মধ্যে যাবে জানতাম। কিন্তু রমাবেনের স্বাস্থ্য তো বেশ ভালই ছিল। কে জানে হয়তো স্বামীর মৃত্যুর শক্ সহ্য করতে পারেনি, কিংবা হয়তো বিষ-টিষ কিছু—’
চম্পকভাইয়ের বাড়ির দরজা খোলা, সামনে কয়েকজন লোক জড়ো হয়েছে। আমরা ডাক্তারের পিছনে পিছনে ভিতরে গেলাম।
একটি ঘরে আলো জ্বলছে। বিছানার উপর শুয়ে আছে কঙ্কালসার একটি মৃতদেহ, আর তার পাশে তার একটা হাত দু’হাতে বুকের ওপর চেপে ধরে রমাবেন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। তার মুখে কোনও বিকৃতি নেই, যেন পরম নিশ্চিন্ত মনে স্বামীর পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।
ডাক্তার দু’জনকে পরীক্ষা করল, তারপর মুখ তুলে বলল, ‘দু’জনেই মৃত!’
আমি আর কাকুভাই আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। বাইরে অন্ধকারে তখনও কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টির জোর বেড়েছে; আমরা ভিজতে ভিজতে বাসায় ফিরে চললাম।
হঠাৎ কাকুভাই আমার একটা হাত চেপে ধরে বলে উঠল, ‘ভাই! সতী নারীরা কেন আজ প্রদীপ হাতে নিয়ে বেরিয়েছিলেন এখন বুঝতে পারলে? রমাবেনকে আমি হাজার বার দেখেছি, কিন্তু সে যে এতবড় সতী তা একবারও মনে হয়নি।’
রমাবেন বিষ খেয়েছিল কিনা আমরা জানতে পারিনি। ডাক্তার ডেথ্ সার্টিফিকেট দিয়েছেন, দু’জনের দেহ এক চিতায় দাহ হয়েছিল। সতীত্ব বলতে ঠিক কি বোঝায়, আমার চেয়ে আপনি ভাল জানেন। কায়মনোবাক্যে একটি পুরুষকে যে-মেয়ে ভালবাসে তাকেই আমরা সতী বলি। রমাবেন সম্বন্ধে আমি কিছুই জানি না। মাত্র একবার দু’মিনিটের জন্য তাকে দেখেছিলাম; কিন্তু সে যে মহাসতী ছিল তাতে আমার সন্দেহ নেই! স্বামীর হাত বুকে নিয়ে মহানিদ্রায় ডুবে যাওয়ার সে দৃশ্য যে দেখেছে সেই বুঝেছে রমাবেনের মন কী ধাতুতে তৈরি ছিল।— তাই বলছিলাম আজকালকার দিনেও সতী নারী একেবারে নেই এ কথা বলা চলে না।
২৫ পৌষ ১৩৬৪