নীলকর
সেদিন সন্ধ্যার পর আমরা মাত্র তিনজন সভ্য ক্লাবে উপস্থিত ছিলাম— আমি, বরদা এবং একজন নূতন সভ্য, হিরন্ময়বাবু। ইনি সম্প্রতি সিগারেট ফ্যাক্টরিতে চাকরি লইয়া এখানে আসিয়াছেন। সন্ধ্যা কাটাইবার জন্য ক্লাবের সভ্য হইয়াছেন। বেশ মিশুক ও রসিক লোক।
ফাল্গুন মাস। খোলা জানালা দিয়া বাতাস আসিয়া টেবিলের উপর পাট-করা খবরের কাগজখানাকে চঞ্চল করিয়া তুলিয়াছে, মাথার উপর বিদ্যুৎবাতিটা প্রখরভাবে জ্বলিতেছে। আমরা দুই-চারিটা অনাবশ্যক কথা বলিয়া নীরব হইয়া পড়িয়াছি। বরদা কড়িকাঠের দিকে তন্ময় চক্ষু তুলিয়া বোধকরি নূতন ভৌতিক গল্প উদ্ভাবন করিতেছে। হিরন্ময়বাবু লম্বা একটা হোল্ডারে সিগারেট জুড়িয়া টানিতেছেন এবং থাকিয়া থাকিয়া বরদার দিকে কটাক্ষপাত করিতেছেন। আমি ভাবিতেছি—
হঠাৎ হিরন্ময়বাবু বলিলেন, “বরদাবাবু, আপনি নাকি ভূত দেখেছেন?”
চমকিয়া মুখ তুলিলাম। বরদাকে এই প্রশ্ন করা আর পাগলকে সাঁকো নাড়িতে বারণ করা একই কথা। হিরন্ময়বাবু নূতন লোক, বরদাকে এখনও ভাল করিয়া চেনেন নাই। আমি সন্ত্রস্ত হইয়া উঠিলাম।
বরদা কড়িকাঠ হইতে চক্ষু নামাইয়া তন্ময় দৃষ্টিতে হিরন্ময়বাবুর পানে চাহিল। এবং ঠিক এই সময় বিদ্যুৎবাতি নিবিয়া ঘর অন্ধকার হইয়া গেল। অতর্কিত ঘটনায় হিরন্ময়বাবু হেঁচকি তোলার মতো একটা শব্দ করিলেন।
হিরন্ময়বাবুর প্রশ্নের সঙ্গে আলো নিবিয়া যাওয়ার কোনও অনৈসর্গিক সংযোগ আছে তাহা মনে করিবার কারণ নাই। কিছুদিন হইতে এই ব্যাপার ঘটিতেছিল, হঠাৎ আলো নিবিয়া সমস্ত পাড়াটাই নিরালোক হইয়া যাইতেছিল। বৈদ্যুতিক কর্তারা বলিতেছিলেন লাইনের দোষ হইয়াছে। কিন্তু দোষ ধরিতে পারিতেছিলেন না। আজও তাহাই হইয়াছে, আধ ঘণ্টার মধ্যে আলো জ্বলিবে না।
অন্ধকারে বসিয়া আছি। প্রথম কথা কহিল বরদা, তাহার কণ্ঠস্বরে বেশ একটু পরিতৃপ্তির সুর ধরা পড়িল। যেন তাহার গল্পের পরিবেশ রচনার জন্যই আলো নিবিয়া গিয়াছে। সে বলিল, “ভূত আমি অনেক দেখেছি, হিরন্ময়বাবু! দিশী ভূত, বিলিতি ভূত, ভালমানুষ ভূত, দুর্দান্ত ভূত। মানুষ যেমন হরেক রকমের আছে ভূতও তেমনি। কিন্তু গত পৌষ মাসে যে-ভূতটিকে দেখেছিলাম, তার মতো অশ্লীল ভূত জীবনে দেখিনি।”
বরদার গল্প ফাঁদিবার টেকনিক আমাদের জানা আছে। গোড়াতেই চমকপ্রদ একটা কথা বলিয়া শ্রোতাদের হতবুদ্ধি করিয়া দেয়, তারপর শ্রোতারা সামলাইয়া উঠিবার আগেই গল্প শুরু করে। তখন আর তাহাকে থামাইবার উপায় থাকে না। উপরন্তু আজ হিরন্ময়বাবু অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দিলেন, বলিলেন, “অশ্লীল ভূত কী রকম। কাপড়-চোপড় পরে না?”
বরদা বলিল, “ঠিক ওরকম নয়। ভূতকে অশ্লীল কেন বলছি তা বুঝতে হলে গল্পটা শোনা দরকার। গত পৌষ মাসে আমি মজঃফরপুরে গিয়েছিলাম—”
গল্প আরম্ভ হইয়া গেল। অন্ধকারে হিরন্ময়বাবুর সিগারেটের অগ্নিবিন্দুটি থাকিয়া থাকিয়া স্ফুরিত হইতেছে, দক্ষিণা বাতাস খবরের কাগজ লইয়া ফর্ ফর্ শব্দে খেলা করিতেছে, তাহার মধ্যে বরদার নিরালম্ব কণ্ঠস্বর শুনিতে পাইতেছি:
“মজঃফরপুর জেলায় আমাদের সামান্য জমিজমা আছে। জায়গাটার নাম নীলমহল। আগে সাহেবরা নীলের চাষ করত। তারপর নীলের চাষ যখন উঠে গেল তখন আমার ঠাকুরদা ওটা কিনেছিলেন। এখন সেখানে ধান হয়, আখ হয়, আম-লিচুর বাগানও আছে। দু-চার ঘর প্রজা আছে। আমাদের সাবেক নায়েব শিবসদয় দাস সেখানে থেকে সম্পত্তি দেখা-শোনা করেন। দাদা শীতকালে গিয়ে তদারক করে আসেন।
“এ বছর দাদা লম্বেগো নিয়ে বিছানায় শুলেন। কী করা যায়? ধান কাটার সময়, আখও তৈরি হয়েছে। এ সময় মালিকদের একবার যাওয়া দরকার। শিবসদয়বাবু অবশ্য লোক ভালই, বিপত্নীক নিঃসন্তান মানুষ, চুরি-চামারি করেন না। কিন্তু সম্প্রতি তিনি তাড়ি এবং অন্যান্য ব্যাপারে বেশি আসক্ত হয়ে পড়েছেন, কাজকর্ম ভাল দেখতে পারেন না, প্রজারা লুটেপুটে খায়। সুতরাং আমাকেই যেতে হল।
“ছেলেবেলায় দু’-একবার নীলমহলে গিয়েছি, তারপর আর যাইনি। মজঃফরপুর শহর থেকে চার-পাঁচ মাইল দূরে; সাম্পানী নামে একরকম বলদ-টানা গাড়ি আছে, তাতেই চড়ে যেতে হয়। পৌষের মাঝামাঝি একদিন বিকেলবেলা গিয়ে পৌঁছলাম। ওদিকে তখন প্রচণ্ড শীত পড়েছে।
“আগে খবর দিয়ে যাইনি, আগে খবর দিয়ে গেলে জমিদারির প্রকৃত স্বরূপ দেখা যায় না, কর্মচারীরা ধোঁকার টাটি তৈরি করে রাখে। গিয়ে দেখি কাছারি-বাড়ির সামনে তক্তপোশ পেতে শিবসদয়বাবু রোদ্দুরে বসে বৃহৎতন্ত্রসার পড়ছেন, তাঁর সামনে এক কলসি তাড়ি। রোদ্দুরে তাড়ি গেঁজিয়ে কলসির গা বেয়ে ফেনা গড়িয়ে পড়ছে।
“আমাকে দেখে শিবসদয় বড়ই অপ্রতিভ হয়ে পড়লেন, তারপর এসে পায়ের ধুলো নিলেন। তিনি আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়, কিন্তু আমি মালিক, তার উপর ব্রাহ্মণ। পায়ের ধুলো নিয়ে আমতা আমতা করে বললেন, ‘আগে খবর দিলেন না কেন? খবর পেলে আমি ইস্টিশনে গিয়ে—’
“মনে মনে ভাবলাম, খবর দিলে তাড়ির কলসি দেখতে পেতাম না। ন্যাকা সেজে বললাম, ‘দাদা আসতে পারলেন না, তাঁর কোমরে বাত হয়েছে। হঠাৎ আমার আসা স্থির হল।’ তারপর কলসির দিকে আঙুল দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওটা কী?’
“শিবসদয় এতক্ষণে সামলে নিয়েছেন, বললেন, ‘আজ্ঞে, তালের রস। শীতটা চেপে পড়েছে, এ-সময় তালের রসে শরীর গরম থাকে। একটু হবে নাকি?’
“বললাম, ‘না। অনেকদিন বেহারে আছি কিন্তু তাড়ি এখনও ধরিনি। আমার জন্যে বরং একটু চায়ের ব্যবস্থা করুন।’
“শিবসদয় ‘হলধর’ বলে হাঁক দিলেন। কাছারি-বাড়ির পিছন দিক থেকে হলধর এসে আমাকে দেখে তাড়াতাড়ি আমার পায়ের কাছে মাটিতে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করল। হলধরকে চিনি, মাঝে মাঝে ধান বিক্রির টাকা নিয়ে মুঙ্গেরে আসে। বুড়ো লোক, জাতে কাহার কিংবা ধানুক, চোখ দুটো ভারি ধূর্ত। কাছারিতে চাকরের কাজ করে আর বিনা খাজনায় দু-তিন বিঘে জমি চাষ করে।
“শিবসদয় বললেন, ‘ছোটবাবুর জন্যে চা আর জলখাবার তৈরি কর।’
“হলধর বলল, ‘চা-জলখাবার! আজ্ঞে— তা— আমি কবুতরীকে এখুনি ডেকে আনছি। সে সব জানে।’
“হলধর ব্যস্তসমস্তভাবে বাইরে চলে গেল, বোধ হয় গ্রামে গেল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কবুতরী কে?’
“শিবসদয় একটু থমকে বললেন, ‘কবুতরী— হলধরের নাতনী।’
“শিবসদয় আমাকে কাছারিতে নিয়ে গিয়ে বসালেন। কাছারি পাকা বাড়ি নয়, পাশাপাশি তিনটে মেটে ঘর, সামনে টানা বারান্দা, মাথায় খড়ের চাল। ভিত বেশ উঁচু, কিন্তু অনাদরে অবহেলায় মাটি খসে খসে পড়ছে। চালের অবস্থাও তথৈবচ, কতদিন ছাওয়া হয়নি তার ঠিক নেই। তিনটে ঘরের একটাতে দপ্তর, মাঝের ঘরটা শিবসদয়বাবুর শোবার ঘর, তার পাশে রান্নাঘর। তিনটে ঘরের অবস্থাই সমান; মেঝেয় ধুলো উড়ছে, চালে ফুটো। শিবসদয়ের উপর মনটা বিরক্ত হয়ে উঠল। তাড়ি খেয়ে খেয়ে লোকটা একেবারে অপদার্থ হয়ে পড়েছে। নেহাত পুরনো চাকর, নইলে দূর করে দিতাম।
“শিবসদয় বোধ হয় আমার মনের ভাব বুঝতে পেরেছিলেন, কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, ‘আমার বড় চুক হয়ে গেছে। আপনি আসবেন জানলে সব ফিটফাট করে রাখতাম। নিজের জন্যে কে অত করে! যা হোক, এবার ধান কাটা হলেই চালটা ছাইয়ে ফেলব।’
“মনটা একটু নরম হল। কাছারি থেকে নেমে বললাম, ‘চায়ের দেরি আছে, আমি ততক্ষণ চারদিক ঘুরে দেখি। ছেলেবেলায় দেখেছি, ভাল মনে নেই।’
“শিবসদয় বললেন, ‘চলুন আমি দেখাচ্ছি।’
“দু’জনে বেরুলাম। সত্তর-আশি বিঘে চাষের জমি, তার মাঝখানে বিঘে চারেক উঁচু জায়গা; এদেশে বলে ভিঠ্জমি। এই উঁচু জায়গাটার উপর আমাদের কাছারি। আগে এখানে নীলকর সাহেবদের কুঠি ছিল। মাঝখানে মস্ত একটা পুকুর; এই পুকুরে নীলের ঝাড় পচিয়ে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড লোহার কড়ায় সেদ্ধ করে নীলের ক্বাথ বার করত। এখন পুকুর মজে গেছে, যেটুকু জল আছে তা পদ্ম আর কলমির দামে ভরা। পুকুরের উঁচু পাড়ের একধারে সারি সারি সাহেবদের কুঠি ছিল, এখন ইটের স্তূপ। পুকুরের আর এক পাড়ে কাতার দিয়ে এক সারি বিরাট উনুন; উনুনের গাঁথুনি পাকা, তাদের ওপরে এখনও কয়েকটা লোহার কড়া বসানো রয়েছে। এই সব কড়ায় নীল সেদ্ধ হত, এখন মরচে ধরে ফুটো হয়ে গেছে। তবু আছে, সাহেবরা যেমন রেখে গিয়েছিল তেমনি পড়ে আছে।
“এই চার-বিঘে জোড়া ভগ্নস্তূপের চারদিকে ঝোপঝাড় জন্মেছে। বড় বড় গাছ গজিয়েছে। একটা বিশাল সূচীপর্ণ ঝাউগাছ হাত-পা মেলে পুকুরের ঈশান কোণটাকে আড়াল করে রেখেছে। বাইরের দিকে দৃষ্টি ফেরালে মনে হয়, সবুজ সমুদ্রের মাঝখানে পাথুরে দ্বীপের উপর আমরা দাঁড়িয়ে আছি। ধানের খেত, আখের খেত, আম-লিচুর বাগান; বিকেলবেলায় পড়ন্ত রৌদ্রে তার উপর বাতাসের ঢেউ খেলে যাচ্ছে। আম-লিচুর বাগানের কোলে প্রজাদের গ্রাম, মোট কুড়ি-পঁচিশটা খড়ে ছাওয়া কুঁড়ে ঘর। বড় সুন্দর দেখতে।
“কিন্তু দেখতে যতই সুন্দর হোক, ওখানকার আবহাওয়া ভাল নয়। ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে নিজের অগোচরেই একটা কাঁটা আমার মনে বিঁধতে লাগল। কোথায় যেন একটা বিকৃত পচা অশুচিতা লুকিয়ে আছে, ঢাকা নর্দমার চাপা দুর্গন্ধের মতো। নীলকর সাহেবরা শুধু অত্যাচারী ছিল না, পাপী ছিল। এমন পাপ নেই যা তারা করত না। তাদের পাপের ছাপ যেন এখনও ও-জায়গা থেকে মুছে যায়নি। মনে পড়ল, দাদা বলেছিলেন— নীলমহলের বাতাসে ম্যালেরিয়ার চেয়েও সাংঘাতিক বিষ আছে; ওখানে বেশিদিন থাকলে মানুষ অধঃপাতে যায়, অমানুষ হয়ে যায়।
“ফিরে আসতে আসতে হঠাৎ চোখে পড়ল, ঝাউগাছটার আড়ালে একটা পাকা ঘর। আঙুল দেখিয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘ওটা কী?’
“শিবসদয় বললেন, ‘ওটা কোৎঘর।’
“কোৎঘর! সে কাকে বলে?”
“নীলকরদের আমলের ঘর। প্রজারা বজ্জাতি করলে সাহেবরা তাদের ধরে এনে ঐ কোৎঘরে বন্ধ করে রাখত। খুব মজবুত ঘর গড়েছিল, যেন লখীন্দরের লোহার ঘর।’
“চলুন তো দেখি।’
“গিয়ে দেখি ঝাউগাছের আওতায় ছোট একটি ঘর। খুব উঁচু নয়, বেঁটে নিরেট চৌকশ, জগদ্দল পাথরের মতো মজবুত ঘর। চব্বিশ ইঞ্চি চওড়া দেওয়াল, মোটামোটা গরাদ লাগানো জানালার লোহার কবাট খোলা রয়েছে, দরজার লোহার কবাটও খোলা। দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলাম; ইট কাঠ দরজা জানালা কিছুই নষ্ট হয়নি, ষাট-সত্তর বছর ধরে দিব্যি অটুট রয়েছে!
“মনে হল, কোৎঘর কিনা, তাই অটুট আছে। সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ে, তার জায়গায় অন্য শাসনতন্ত্র আসে, কিন্তু কারাগার ঠিক খাড়া থাকে। মানুষ যখন সমাজ গড়েছিল তখন কারাগারও গড়েছিল— যতদিন একটা আছে ততদিন অন্যটাও থাকবে।
“দোরের কাছে গিয়ে ভিতরে উঁকি মারলাম। মেঝে শান-বাঁধানো, দেওয়ালের চুনকাম এখনও বোঝা যায়। আমি শিবসদয়কে বললাম, ‘ঘরটা তো বেশ ভাল অবস্থাতেই আছে। ব্যবহার করেন না কেন? দরজা জানালা কি জাম হয়ে গেছে?’
“শিবসদয় ‘আজ্ঞে—’ বলে থেমে গেলেন। আমি দরজার কবাট ধরে টানলাম, মরচে ধরা হাঁসকলে ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ হল বটে, কিন্তু বেশ খানিকটা নড়ল। আমি শিবসদয়ের পানে তাকালাম। তিনি উৎকণ্ঠিত ভাবে বললেন, ‘সন্ধে হয়ে এল, চলুন এবার ফেরা যাক।’
“সূর্যাস্ত হয়েছে কি হয়নি, কিন্তু ঝাউগাছতলায় ঘোর ঘোর হয়ে এসেছে। কাছারিবাড়ি এখান থেকে বড় জোর এক শ’ গজ। আমি দরজা ছেড়ে পা বাড়ালাম। ঠিক এই সময় আমার কানের কাছে কে যেন খিসখিস শব্দ করে হেসে উঠল। আমি চমকে ফিরে তাকালাম। কেউ নেই। উপর দিকে চোখ তুলে দেখলাম, ঝাউগাছের ডালগুলো একটা দমকা হাওয়া লেগে নড়ে উঠেছে। তারই শব্দ। কিন্তু ঠিক মনে হল যেন চাপা গলার হাসি।
“পুকুরের পাড় দিয়ে অর্ধেক পথ এসেছি, শিবসদয় একটু কেশে কেশে বললেন, ‘কোৎঘরের জানালা দরজা বন্ধ করা যায়, কিন্তু বন্ধ থাকে না। আপনা-আপনি খুলে যায়।’
“তার মানে?’ আমি থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম।
“শিবসদয় বললেন, ‘সেই জন্যেই ঘরটা ব্যবহার করা যায় না। ওতে সাহেব থাকে।’
“সাহেব থাকে! কোন্ সাহেব?’
“আজ্ঞে, আছে একজন।’ শিবসদয় একবার ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকে তাকালেন, বললেন, ‘এখন চলুন, রাত্রে বলব।’
“একটু বিরক্ত হলাম। লোকটা কি আমাকে ভূতের গল্প শুনিয়ে ভয় দেখাতে চায় নাকি! পীরের কাছে মামদোবাজি!
“যা হোক্, কাছারিতে ফিরে এসে দেখলাম, পূর্ণকুম্ভটি স্থানান্তরিত হয়েছে; তক্তপোশের উপর কম্বল পাতা, তার উপর ফরাস, তার উপর মোটা তাকিয়া। গদিয়ান হয়ে বসলাম। পশ্চিম আকাশে তখনও বেশ আলো রয়েছে, কিন্তু বাতাস ক্রমেই ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। শিবসদয় ঘরে গিয়ে একটা বালাপোশ গায়ে জড়িয়ে চৌকির কোণে এসে বসলেন। বোধ হয় এই ফাঁকে শরীর-গরম করা সঞ্জীবনী-সুধা সেবন করে এলেন।
“এই সময় একটা মেয়ে রান্নাঘর থেকে নেমে এল দু’হাতে বড় কাঁসার থালার উপর চায়ের পেয়ালা আর জলখাবারের রেকাবি নিয়ে। চলনের ভঙ্গিতে বেশ একটু ঠমকে আছে, হিন্দীতে যাকে বলে লচক্। উচক্কা বয়স, নিটোল পুরন্ত গড়ন। গায়ের রঙ ময়লা বটে, মুখখানাও সুন্দর বলা চলে না। পুরু ঠোঁট, চোয়ালের হাড় চওড়া, চোখের দৃষ্টি নরম নয়। কিন্তু সব মিলিয়ে একটা দুরন্ত আকর্ষণ আছে—
“হলধরের নাতনী কবুতরী।’
“আমার সামনে থালা রেখে আমার মুখের পানে চেয়ে হাসল, সাদা দাঁতগুলো ঝক্ঝক্ করে উঠল। সহজ ঘনিষ্ঠ প্রগল্ভতার সুরে বললে, ‘ছোট মালিককে এই প্রথম দেখলাম।’
“আমি উত্তর দিলাম না। শিবসদয়ের দিকে তাকালাম। তিনি অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে আছেন। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি চা খাবেন না?’
“শিবসদয় অস্পষ্ট স্বরে বললেন, ‘আমি খাই না।’
“কবুতরী আমার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, বলল, ‘ছোট মালিক, দেখুন না চায়ে মিষ্টি হয়েছে কি না।’ গলায় এতটুকু সঙ্কোচ নেই।
“চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম, ‘ঠিক আছে।’
“কবুতরী বলল, ‘আর নিমকি? খেয়ে দেখুন না।’
“আমি নিমকিতে কামড় দিয়ে বললাম, ‘ঠিক আছে।’
“কবুতরী তবু দাঁড়িয়ে রইল। আমি তার দিকে একবার তাকালাম, সে আমার পানে অপলক চোখ মেলে চেয়ে আছে। মুখে ঘনিষ্ঠ নির্লজ্জ হাসি।
“শিবসদয় তার দিকে না তাকিয়েই একটু অপ্রসন্ন স্বরে বললেন, ‘কবুতরী, দাঁড়িয়ে থেকো না, তাড়াতাড়ি রান্নার কাজ সেরে নাও। বাবু ক্লান্ত হয়ে এসেছেন, সকাল সকাল খেয়ে শুয়ে পড়বেন।’
“কবুতরী আরও খানিক দাঁড়িয়ে রইল, তারপর অনিচ্ছাভরে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।
“আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার রান্না কি কবুতরীই করে?’
“হ্যাঁ।”
“ওর ঘরে কে কে আছে?”
“একটু চুপ করে থেকে শিবসদয় ম্রিয়মাণ স্বরে বললেন, ‘ও হলধরের কাছেই থাকে। একটা স্বামী ছিল, বছরখানেক আগে ওকে ত্যাগ করে চলে গেছে।’
“শিবসদয়ের দিকে ভাল করে চেয়ে দেখলাম। এতক্ষণ যা চোখে পড়েনি হঠাৎ তাই দেখতে পেলাম। তাঁর শীর্ণ চেহারা, নিষ্প্রভ চোখ, ঝুলে-পড়া আলগা ঠোঁট— তার সাম্প্রতিক জীবনের সম্পূর্ণ ইতিহাস যেন ঐ মুখে লেখা রয়েছে। বুড়ো বয়সে তিনি শুধু তালরসেরই রসিক হননি, অন্য রসেও মজেছেন। পরকীয়া রস। কবুতরী ছোট ঘরের স্বৈরিণী মেয়ে, সে তাঁকে গ্রাস করেছে। কিন্তু কবুতরী শিকারী মেয়ে, বড় শিকার সামনে পেয়ে সে ছোট শিকারের পানে তাকাবে কেন? কবুতরীর ভাবভঙ্গি থেকে শিবসদয় তা বুঝতে পেরেছেন। তাই তাঁর মনে সুখ নেই।
“অথচ যখন বয়স কম ছিল, শিবসদয় তখন সচ্চরিত্র ছিলেন। লেখাপড়া বেশি না জানলেও মনটা ভদ্র ছিল। পাঁচ বছর আগে পর্যন্ত তিনি আমাদের মুঙ্গেরের জমিজমা দেখতেন। কাজকর্মে দক্ষতা ছিল, অবৈধ লাভের লোভ ছিল না। আর আজ নীলমহলে এসে তাঁর এই অবস্থা। এটা কি স্থান-মাহাত্ম্য? ম্যালেরিয়ার চেয়েও সাংঘাতিক বিষ তাঁর রক্ত দূষিত করে দিয়েছে?
“চা-জলখাবার শেষ করে বললাম, ‘চলুন, ভেতরে গিয়ে বসা যাক। বাইরে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।’
“হলধর ঘরে ঘরে লণ্ঠন জ্বেলে দিয়েছে। আমরা দপ্তরের মেঝেয় পাতা গদির ওপর গিয়ে বসলাম। শিবসদয় মচ্ছিভঙ্গ হয়ে আছেন, মাঝে মাঝে চোখ বেঁকিয়ে আমার পানে চাইছেন; বোধ হয় বোঝবার চেষ্টা করছেন কবুতরীর দিকে কতটা আকৃষ্ট হয়েছি।
“জিজ্ঞেস করলাম, ‘রাত্রে শোবার ব্যবস্থা কী রকম? আমার সঙ্গে লেপ বিছানা সব আছে।’
“শিবসদয় বললেন, ‘শোবার ঘরে আপনার বিছানা পেতে দিয়েছি। আমি এই গদির ওপরেই রাত কাটিয়ে দেব।’
“সিগারেট ধরিয়ে তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে বসলাম। বললাম, ‘এবার কোৎঘরের সাহেবের গল্প বলুন।’
“একটু বসুন, আমি রান্নার খবরটা নিয়ে আসি।’ বলে শিবসদয় উঠে গেলেন। মিনিট পাঁচেক পরে আবার ফিরে এসে বসলেন। গন্ধ পেয়ে বুঝলুম, শুধু রান্না পরিদর্শন নয়, শীতের অমোঘ মুষ্টিযোগও বেশ খানিকটা টেনেছেন। তাঁর চোখে মুখে সজীবতা ফিরে এসেছে।
“বললেন, ‘আপনি কি সাহেবের কথা কিছু জানেন না?’
“কিছু না। কেউ কিছু বলেনি।’
“শিবসদয় তখন আরম্ভ করলেন— ‘আমারও শোনা কথা। হলধর আর গাঁয়ের পাঁচজনের মুখে যা শুনেছি তাই বলছি।— আশি-নব্বুই বছর আগেকার ঘটনা। তখন নীলকর সাহেবদের ব্যবসা গুটিয়ে আসছে, জার্মানির কারখানায় নকল নীল তৈরি হয়েছে। সেই সময় এখানে যে-সব সাহেব থাকত তাদের মধ্যে একটা ছোঁড়া ছিল ভয়ঙ্কর পাজি। এখানকার নীলচাষীরা তার নাম দিয়েছিল ‘বিল্লি-সাহেব’। প্রজারা কিছু করলে তাদের ধরে এনে হাসতে হাসতে যে-সব যন্ত্রণা দিত, তা শুনলে এখনও গা শিউরে ওঠে। গ্রীষ্মকালে হাত-পা বেঁধে রোদ্দুরে সারা দিন ফেলে রেখে দিত, শীতের রাত্তিরে পুকুরে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখত। আঙুলের নখের উপর পেরেক ঠুকে দিত। আর, কমবয়েসী মেয়েমানুষ দেখলে তো রক্ষে নেই। অন্য সাহেবরাও দরকার হলে প্রজাদের উপর অত্যাচার করত, ধরে এনে কোৎঘরে বন্ধ করে রাখত; কিন্তু বিল্লি-সাহেবের তুলনায় সে কিছুই নয়। বিল্লি-সাহেব রোজ নতুন নতুন যন্ত্রণা দেবার ফন্দি বার করত। অন্য সাহেবরা তাকে সামলাবার চেষ্টা করত, কিন্তু পেরে উঠত না।
“একবার একটা প্রজা দাদনের টাকা নিয়ে গা-ঢাকা দিয়েছিল, সাহেবরা তার সোমত্ত বৌকে ধরে এনে কোৎঘরে বন্ধ করে রেখেছিল। বৌটার উপর অত্যাচার করার মতলব তাদের ছিল না। প্রজাটাকে জব্দ করাই ছিল উদ্দেশ্য। কিন্তু বিল্লি-সাহেব মনে মনে অন্য ফন্দি এঁটেছিল। দুপুর-রাত্রে অন্য সাহেবরা যখন ঘুমিয়ে পড়েছে তখন সে কোৎঘরের তালা খুলে ঘরে ঢুকল।
“বৌটার কাছে ছোরাছুরি ছিল না। কিন্তু তার দু’হাতে ছিল ভারী ভারী রূপোর বালা, এদেশে যাকে বলে কাঙনা। তাই দিয়ে সে মারল বিল্লি-সাহেবের রগে। সাহেব সেইখানে পড়ে মরে গেল। বৌটা পালাল।
“অন্য সাহেবরা জেগে উঠেছিল; তারা ব্যাপার দেখে ভয় পেয়ে গেল। তখন দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ বেরিয়েছে, লং সাহেব তার তর্জমা করে জেলে গেছে; এ সময় যদি এই ব্যাপার জানাজানি হয়, তাহলে আর রক্ষে থাকবে না। সাহেবরা সেই রাত্রেই কোৎঘরের মেঝে খুঁড়ে বিল্লি-সাহেবকে কবর দিলে। তারপর মেঝে আবার শান বাঁধিয়ে ফেললে। বাইরে রটিয়ে দিলে, বিল্লি-সাহেব দেশে ফিরে গেছে।
“এই ঘটনার দু-তিন বছরের মধ্যেই নীলের ব্যবসা উঠে গেল, সাহেবরা জমিদারি বিক্রি করে দেশে চলে গেল। আপনার ঠাকুরদা নীলমহল কিনলেন।
“কোৎঘরটা সেই থেকে পড়ে আছে। শুনেছি, গোড়ার দিকে ঘরটাকে গুদাম হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু মুশকিল হল এই যে, ওর দরজা-জানালা বন্ধ রাখা যায় না, যতবার বন্ধ করা হয় ততবার খুলে যায়। এমন কি দরজায় তালা লাগালেও ফল হয় না, তালা আপনা-আপনি খুলে যায়। তাই সকলের বিশ্বাস, বিল্লি-সাহেব ওখানে আছে।
“শিবসদয় চুপ করলেন। আমিও খানিকক্ষণ চুপ করে রইলাম। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, ‘বিল্লি-সাহেবের ভূতকে কেউ দেখেছে?’
“আজ্ঞে না, কেউ কিছু চোখে দেখেনি।’
“আপনিও দেখেননি?’
‘না— কিন্তু অনুভব করেছি। একটা দুষ্ট প্রেতাত্মা আছে।’ বলে শিবসদয় চকিতে ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকে তাকালেন।
“আপনি প্রেতাত্মা বিশ্বাস করেন? মানে, ভূত মানেন?’
“আজ্ঞে, সে কী কথা! প্রেতাত্মায় বিশ্বাস করব না! আত্মা যদি থাকে প্রেতাত্মাও আছে।’
“তা বটে।’
“যাঁরা আত্মার অস্তিত্বই বিশ্বাস করেন না তাঁদের কাছে এ যুক্তির কোনো মূল্য নেই। কিন্তু বিশ্বাসের একটা মূল্য আছে।’
“কোৎঘরের ব্যাপারটা হয়তো একেবারে বুজরুকি নয়। ভূতপ্রেত সম্বন্ধে আমার একটু কৌতূহল আছে। ভাবলাম, ব্যাপারটা অনুসন্ধান করে দেখতে হবে। বিল্লি-সাহেব যদি সত্যি থাকে, অজ্ঞ চাষাভুষোর অলীক কুসংস্কার না হয়, তাহলে সেটা জানা দরকার।
“রাত্রি আটটার মধ্যে খাওয়া সেরে নিলাম। শিবসদয়ও আমার সঙ্গে বসলেন। রান্না বেশি নয়; ফুলকা রুটির সঙ্গে বেগুনপোড়া, হিঙ দিয়ে ঘন অড়র ডাল, মাংস, পুদিনার চাটনি আর ক্ষীর। মাংস কোথায় পেল কে জানে, হয়তো আমার জন্যেই পাঁঠা কেটেছিল। কিন্তু কবুতরী মাংসটা রেঁধেছিল বড় ভাল। এ-দিশী রান্না; একটু ঝাল বেশি, তার সঙ্গে আদা পেঁয়াজ রসুন-বাটা আর আস্ত গোলমরিচ। খাওয়া একটু বেশি হয়ে গেল।
“খেয়ে উঠে আঁচাতে আঁচাতেই শীত ধরে গেল। আর বসলাম না, একেবারে শোবার ঘরে গেলাম। শিবসদয়ও সঙ্গে সঙ্গে এলেন।
“একটা তক্তপোশের উপর পুরু বিছানা পাতা হয়েছে, ঘরের কোণে হ্যারিকেন লণ্ঠন জ্বলছে। আমি সঙ্গে একটা ইলেকট্রিক টর্চ এনেছিলাম, সেটা সুটকেস থেকে বার করে বালিশের পাশে রাখলাম। তারপর বিছানায় বসে সিগারেট বার করলাম। ঠাণ্ডায় আঙুলগুলো কালিয়ে গেছে, হাড়ে কাঁপুনি ধরেছে।
“শিবসদয় আমার অবস্থা দেখে একটু কেশে বললেন, ‘এখানকার ঠাণ্ডা আপনার অভ্যেস নেই, লেপে শীত ভাঙবে না। কিন্তু—’
“কিন্তু কী?’
“যদি এক পেয়ালা গরম তালের রস খেয়ে শোন, তাহলে আর শীত করবে না।’
“একটু কড়া সুরেই বললাম, ‘না।’ তারপর সিগারেট ধরিয়ে বললাম, ‘আপনি শুয়ে পড়ুন গিয়ে। কাল সকালে আপনার খাতা-পত্তর দেখব।’
“শিবসদয় আর কিছু বললেন না, আস্তে আস্তে দরজা ভেজিয়ে দিয়ে চলে গেলেন।
“আমিও আলোটা কমিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লাম। লেপ গায়ে দিয়ে শুয়ে শুয়ে সিগারেট টানছি। নানা রকম চিন্তা মনে আসছে…শিবসদয় আমাকে তাড়ি ধরাবার চেষ্টা করছেন… কবুতরী চেষ্টা করছে বড় শিকার ধরবার… যদি বেশি দিন এখানে থাকি আমার মনের অবস্থাটা কী রকম দাঁড়াবে?… বিল্লি-সাহেব— উঃ, নীলকর সাহেবগুলো কী শয়তানই ছিল…
“লেপের মধ্যে শরীর গরম হয়ে আসছে, সিগারেট শেষ করে চোখ বুজে শুয়ে আছি। এত তাড়াতাড়ি ঘুমনো অভ্যেস নেই, তবু একটু তন্দ্রা আসছে—
“হঠাৎ চোখ খুলে গেল। দেখি, কবুতরী বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। কমানো লণ্ঠনের অস্পষ্ট আলোয় তাকে দেখে আমার যেন দম বন্ধ হয়ে এল; কখন নিঃশব্দে ঘরে ঢুকেছে জানতে পারিনি।
“আমি চোখ খুলেছি দেখে কবুতরী আমার মুখের কাছে ঝুঁকে চাপা গলায় বলল, “ছোট মালিক, আপনি জেগে আছেন, আপনার পা টিপে দিই?”
“ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলাম: ‘না, দরকার নেই। তুমি যাও।’
“কবুতরী মোটেই অপ্রস্তুত হল না, সহজভাবে বলল, ‘আচ্ছা। কাল ভোরে আমি আপনার চা তৈরি করে আনব। এখন ঘুমিয়ে পড়ুন।’ সে ছায়ার মতো ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
“আমি কিছুক্ষণ বসে রইলাম। তারপর উঠে দরজা বন্ধ করতে গেলাম। দরজায় হুড়কো থাকবার কথা, কিন্তু হুড়কো নেই। বাইরের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার কোনো উপায় নেই। কী করা যায়? দরজাটা ভাল করে চেপে দিয়ে এসে শুলাম।
“আমি সাধু-সন্ন্যিসি নই, আবার লুচ্চা-লম্পটও নই। নিজেকে ভদ্রলোক বলে মনে করি। পঁয়ত্রিশ বছর বয়স হয়েছে। জীবনে প্রলোভন এসেছে, কিন্তু প্রলোভন যে এমন দুর্নিবার হতে পারে তা কখনও কল্পনা করিনি। মনের মধ্যে যে-সব চিন্তা আসতে লাগল সেগুলোকে ভদ্র চিন্তা বলতে পারি না। এ যেন নর্দমার পাঁক নিয়ে নোংরামির হোলিখেলা। সঙ্গে সঙ্গে কবুতরীর ওপর রাগও হতে লাগল; রাগ হতে লাগল তার চুম্বকের মতো আকর্ষণ করার শক্তির ওপর। ছোটলোকের মেয়ে! নির্লজ্জ নষ্ট মেয়েমানুষ! পুরুষ-হ্যাংলা রক্তচোষা সূর্পনখার জাত।
“কণ্টকশয্যায় এপাশ-ওপাশ করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। ঘুম ভাঙল একেবারে শেষরাত্রে। দেখি লেপের মধ্যে ঠাণ্ডায় জমে গেছি। বাইরে একটা হাড়কাঁপানো হাওয়া উঠেছে; সে হাওয়া কুলকুল করে ঘরে ঢুকছে কোথা দিয়ে? টর্চ জ্বেলে চারদিকে ঘোরালাম। মাথার দিকে একটা ছোট জানালা আছে বটে, কিন্তু সেটা বন্ধ। দরজাও চাপা রয়েছে। মাটির দেয়ালে আলো ফেলে দেখলাম কোথাও ফুটোফাটা আছে কি না। কিন্তু নেই। তারপর টর্চের আলো গিয়ে পড়ল চালের নীচে। সেখানে একটি মস্ত ফুটো। শেষরাত্রের হাওয়া সেই ফুটো দিয়ে ঢুকছে।
“নিরুপায়, চালের ফুটো বন্ধ করা যাবে না। আগাপাস্তলা লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে রইলাম; কিন্তু হাড়ের কাঁপুনি গেল না। মনে হল, এই সময় শিবসদয়বাবুর তালের রস পেলে কাজ হত। হাত-ঘড়িটা দেখলাম, পাঁচটা বাজতে কয়েক মিনিট বাকী আছে। এখনও সকাল হতে দেড় ঘণ্টা। বিছানায় উঠে বসে সিগারেট ধরালাম।
“গোটা তিনেক সিগারেট পর-পর টানলাম, কিছু হল না। লাথির ঢেঁকি চড়ে ওঠে না। ভাবছি এবার কী করব, লণ্ঠনটাকে কোলে নিয়ে বসলে কেমন হয়! এমন সময় দোর ঠেলে কবুতরী ঘরে ঢুকল। তার হাতে চায়ের পেয়ালা ধোঁয়াচ্ছে। বাক্যব্যয় না করে পেয়ালা হাতে নিলাম। এক চুমুক দিতেই জিভটা যেন পুড়ে গেল। কিন্তু শরীরের মধ্যে তৃপ্তি ভরে উঠতে লাগল। রক্ত গরম হওয়ার তৃপ্তি।
“কবুতরী হেসে বলল, সিগারেটের গন্ধ পেয়ে বুঝলাম, ছোট মালিকের ঘুম ভেঙেছে।’
বললাম, ‘তুমি কি বাড়ি যাওনি?’
“সে বলল, ‘না। রান্নাঘরে উনুনের পাশে শুয়ে রাত কাটিয়ে দিয়েছি। নইলে মালিকের চা তৈরি করতাম কী করে?”
“চা শেষ করে পেয়ালা তার হাতে দিলাম, বললাম, ‘আর এক পেয়ালা নিয়ে এস।’
“সে একগাল হেসে ছুটে চলে গেল। আশ্চর্য মেয়ে! কী অসম্ভব খাটতে পারে, শরীরে ক্লান্তি নেই। ভোরবেলা মালিকের চা তৈরি করে দেবার জন্যে সারা রাত উনুনের পাশে শুয়ে থাকতে পারে। অথচ অন্য দিকে আবার—
“দ্বিতীয় পেয়ালা চা এনে আমার হাতে দিয়ে বলল, ‘যাই, রাত্তিরের এঁটো বাসনগুলো এই বেলা মেজে ফেলি। দরকার হলেই আমাকে ডাকবেন কিন্তু—অ্যাঁ?’ ঘাড় বেঁকিয়ে হেসে কবুতরী চলে গেল।
“সেদিন বেলা ন’টার সময় দপ্তরে গিয়ে বসলাম, শিবসদয়কে বললাম, “ওঘরে আর আমি শোব না। আজ থেকে কোৎঘরে আমার শোবার ব্যবস্থা করুন।’
“শিবসদয় ঘাবড়ে গেলেন: ‘কোৎঘরে! কিন্তু—’
“আমি বললাম, ‘কিন্তু কী? বিল্লি-সাহেব? বিল্লি-সাহেবের সঙ্গে আমি বোঝাপড়া করব, আপনার ভাবনা নেই।’
“তারপর প্রায় সারা দিনটাই কাজকর্মে কেটে গেল। হিসেব-নিকেশ, জমা-খরচ, আম-লিচুর বাগান জমা দেওয়ার ব্যবস্থা, ধান কাটা এবং বিক্রির ব্যবস্থা। প্রজারা খবর পেয়েছিল আমি এসেছি, তারা এসে সেলাম করে গেল। কেউ এক টাকা, কেউ আট আনা সেলামি দিলে।
“দুপুরবেলা খেয়েদেয়ে আমার নতুন শোবার ঘর তদারক করতে গেলাম। দুপুরের আলোয় জায়গাটা মোটেই ভূতুড়ে বলে মনে হয় না। দিব্যি ঝরঝরে। হলধর ঘরটা ঝেড়েঝুড়ে পরিষ্কার করে রেখেছে, একটা তক্তপোশ ঢুকিয়েছে। দেখে-শুনে ফিরে এলাম। কোৎঘরে ভূত থাকে থাক, ছাদে ফুটো নেই।
“বিকেলবেলাটাও কাজে-কর্মে কাটল। যত সন্ধ্যে হয়ে আসতে লাগল, শিবসদয় ততই শঙ্কিত হয়ে উঠতে লাগলেন। শেষে রাত্রে খেতে বসে বললেন, ‘দেখুন, আমার ভয় করছে। যদি কিছু ঘটে—’
“বললাম, ‘কিছু ঘটবে না। বরং এ ঘরে শুলেই নিউমোনিয়া ঘটবার সম্ভাবনা আছে।’
“কবুতরী পরিবেশন করছিল, খিল খিল করে হেসে উঠল। ও যখন থেকে শুনেছে আমি কোৎঘরে শোব, তখন থেকে ওর মুখে চোখে বিদ্যুৎ খেলছে। মনে মনে কী বুঝেছে কে জানে! কিন্তু ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয় ভূত-টূত ও বিশ্বাস করে না। হয়তো ভেবেছে—
“শিবসদয় কট্মট্ করে তাকিয়ে বললেন, ‘মালিকের সামনে হাসছিস! তোর সহবৎ নেই?’
“কবুতরী হাসি থামাল বটে, কিন্তু তার চোখে-মুখে চাপা কৌতুক উপচে পড়তে লাগল।
“রাত্রি সাড়ে আটটার সময় কাছারি-বাড়ি থেকে বেরুলাম। কবুতরী দাঁড়িয়ে রইল, শিবসদয় লণ্ঠন নিয়ে আমার আগে আগে চললেন, হলধর আর একটি লণ্ঠন নিয়ে পিছনে চলল। আকাশে এক ফালি চাঁদ আছে। কনকনে ঠাণ্ডা, কিন্তু হাওয়া নেই।
“কোৎঘরে পৌঁছলাম। দরজা জানালা খোলা রয়েছে; ঘরে বোধ হয় ধূপধুনো দিয়েছিল, এখনও একটু গন্ধ লেগে আছে। তক্তপোশের উপর বিছানা পাতা, লেপ বালিশ সব আছে। এক কোণে গেলাস-ঢাকা জলের কুঁজো।
“হলধর ধূর্ত চোখে আমার পানে চেয়ে বলল, ‘সব ঠিক আছে বাবু?’ বুড়োটা সব জানে, সব বোঝে, কিন্তু বেশি কথা কয় না।
‘টর্চ, সিগারেটের টিন, হাত-ঘড়ি বালিশের পাশে রাখলাম, ঘরের চারিদিকে একবার তাকিয়ে বললাম, ‘সব ঠিক আছে। তোমরা এবার যাও! জানালাটা আপাতত খোলা থাক। পরে বন্ধ করব। দরজা ভেজিয়ে দিয়ে যেও।’
“শিবসদয় একটু খুঁতখুঁত করলেন, তারপর লণ্ঠন নিয়ে বাইরে গেলেন। হলধর নিজের হাতের লণ্ঠনটি একটু উস্কে দিয়ে তক্তপোশের শিয়রের কাছে রাখল, ধূর্ত চোখে আমার পানে চেয়ে ঘাড় হেলিয়ে যেন ইশারা করল, তারপর ঘরের বাইরে গিয়ে লোহার দরজা ভেজিয়ে দিলে। মরচে-ধরা হাঁসকলে ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ হল। আমি একা।
“জানালাটা খোলা, তার ভিতর দিয়ে চৌকশ খানিকটা দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। আমি গিয়ে জানালাটা পরীক্ষা করলাম। জানালায় ছিটকিনি আছে, ভিতর থেকে বন্ধ করা যায়। পাল্লা দুটো নেড়ে দেখলাম, সচল আছে, দরকার হলে বন্ধ করা যাবে।
“ফিরে এসে বিছানায় বসলাম। তরিবত করে সিগারেট ধরাতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম, আলোটা আস্তে আস্তে নিবে আসছে। তেল ফুরিয়ে গেল নাকি? কিন্তু তা তো হবার কথা নয়, সমস্ত রাত জ্বলবে বলে হলধর লণ্ঠনে তেল ভরে দিয়েছে। তবে—?
“আলোটা দপ্ দপ্ করল না, কমতে কমতে নীল হয়ে নিবে গেল, যেন কেউ কল ঘুরিয়ে নিবিয়ে দিলে। ঘর অন্ধকার। জানালা দিয়ে কেবল বাইরের ফিকে জ্যোৎস্না দেখা যাচ্ছে। আমি মনটাকে শক্ত করে নিয়ে আবার সিগারেট ধরাতে গেলাম। ক্যাঁচ করে একটা শব্দ হল; চোখ তুলে দেখি, লোহার দরজা আস্তে আস্তে খুলে যাচ্ছে।
“তারপর কানের কাছে শুনতে পেলাম খিসখিস হাসির শব্দ। ধড়মড়িয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। হাসি কিন্তু বন্ধ হল না, কানের কাছে খিসখিস শব্দ চলতে লাগল। এবার আর ঝাউপাতার শব্দ বলে ভুল করবার উপায় নেই। হাসিই বটে। একটা অসভ্য অশ্লীল হাসি।
“হাসি অনেক রকম আছে। প্রাণখোলা হাসি, বিদ্রূপের প্যাঁচানো হাসি, মুরুব্বিয়ানার গ্রাম্ভারী হাসি। কাষ্ঠ হাসি। এ হাসি ও ধরনের নয়। এ হাসির বর্ণনা করা শক্ত, এ হাসি শুনলে মনে হয় এর পিছনে অকথ্য নোংরামি লুকিয়ে আছে, যে হাসছে তার মনের পাঁক শ্রোতার গায়ে লেগে যায়। গা ঘিনঘিন করে।
“আমার গা ঘিনঘিন তো করলই, উপরন্তু শিরদাঁড়া শিরশির করে উঠল। কতটা ভয় কতটা ঘেন্না বলতে পারব না। তবে ভূত আছে, বিল্লি-সাহেব চাষাদের অলীক কল্পনা নয়।
“ভূতের সঙ্গে গা শোঁকাশুঁকি আমার নতুন নয়। জানি, ভয় পেলেই বিপদ। আমি জোর করে নিজেকে শক্ত করে নিলাম। তারপর সিগারেট ধরালাম। নিবে-যাওয়া লণ্ঠনটা নেড়ে দেখলাম, তাতে তেল ভরা রয়েছে।
“লণ্ঠন আবার জ্বালালাম। লোহার দরজা টেনে আবার বন্ধ করলাম; তারপর খোলা জানালাটা বন্ধ করে ছিটকিনি লাগিয়ে দিলাম। দেখি এবার কী হয়!
“ইতিমধ্যে হাসি থেমে গিয়েছিল। আমি বিছানায় এসে বসলাম। লণ্ঠন আর নিবল না। কিছুক্ষণ পরে আর এক রকমের শব্দ কানে আসতে লাগল। এ শব্দও খুব মৃদু; যেন একটা কুকুর নিশ্বাস টেনে টেনে কী শুঁকছে আর ঘরময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। বদ্ধঘরে সিগারেটের ধোঁয়া তাল পাকাচ্ছিল, হঠাৎ মনে হল, প্রেতটা সেই গন্ধ শুঁকছে নাকি? হয়তো যখন বেঁচে ছিল খুব সিগারেট খেত—
“একটা অত্যন্ত দুষ্ট প্রকৃতির অতৃপ্ত ক্ষুধিত প্রেতাত্মা এখানে আছে সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রেতাত্মাদের শরীর ধারণ করবার ক্ষমতা থাকলেও দৈহিক অনিষ্ট করবার ক্ষমতা বেশি নেই। পাশ্চাত্য দেশে poltergeist নামে একরকম বিদেহাত্মার কথা জানা আছে, যারা শূন্য ঘরে বাসনকোসন ভাঙে, টেবিলের উপর থেকে জিনিস ঠেলে মাটিতে ফেলে দেয়, আরও নানা রকম ছোটখাটো উৎপাত করে, কিন্তু এর বেশি কিছু করতে পারে না। বিল্লি-সাহেব বোধ হয় সেই জাতের ভূত।
“সিগারেট শেষ করে ফেলে দিলাম। ঘড়িতে দেখলাম ন’টা বেজে গেছে। এই পরিবেশের মধ্যে ঘুম যদিও সুদূরপরাহত, তবু লেপ গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়লাম।
“খুট্! ঘাড় ফিরিয়ে দেখি, জানালার ছিটকিনি খুলে গেছে। পাল্লা দুটো আস্তে আস্তে খুলছে। সঙ্গে সঙ্গে দরজার কপাটও। উঠে বসলাম। অমনি কানের কাছে খিসখিস হাসি। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।
“টর্চ হাতে নিয়ে ঘরের বাইরে গেলাম। দোরের সামনে পায়চারি করতে লাগলাম। কী করা যায়? জানালা দরজা বন্ধ করে লাভ নেই, যতবার বন্ধ করব ততবার খুলে যাবে। সারা রাত দরজা জানালা খোলা থাকলে নির্ঘাত নিউমোনিয়া কিংবা প্লুরিসি। ফিরে যাব? কিন্তু ফিরে গেলে শিবসদয় মাথা নেড়ে বলবেন, আমি আগেই বলেছিলাম। কবুতরী খিলখিল করে হাসবে। না, তার চেয়ে যেমন করে হোক এই ঘরেই রাত কাটাতে হবে। যাক্ প্রাণ থাক্ মান।
“ঘরে গিয়ে আপাদমস্তক লেপ মুড়ি দিয়ে শুলাম। শুয়ে শুয়ে শুনছি, ঘরের মধ্যে একটা অদৃশ্য প্রাণী ঘুরে বেড়াচ্ছে, তার খস্খস্ পায়ের শব্দ। কখনও কানের কাছে জঘন্য অশ্লীল হাসি। একবার গব্ গব্ শব্দ শুনে মুণ্ডু বার করে দেখি, ঘরের কোণে কুঁজোটা কাত হয়ে পড়েছে, গব্ গব্ শব্দে জল বেরুচ্ছে। আমি আবার লেপ মুড়ি দিলাম।
“ঘণ্টাখানেক কেটে গেল। ভূতের সংসর্গ অনেকটা গা-সওয়া হয়ে এসেছে, এই ভাবে যদি রাতটা কেটে যায় মন্দ হবে না। বোধ হয় একটু তন্দ্রাও এসেছিল, হঠাৎ চমকে উঠলাম।
“ছোট মালিক!”
“মাথা বার করে দেখি, কবুতরী। এতক্ষণ ভূতের কার্যকলাপ দেখে যা হয়নি এবার তাই হল, বুকটা ধড়াস্ করে উঠল। আমি কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠে বললাম: ‘তুমি! তোমার এখানে কী দরকার?’
“লণ্ঠনের আলোয় কবুতরীর দাঁত ঝক্ঝক্ করে উঠল, সে বলল, ‘ছোট মালিককে দেখতে এলাম।’
“আমার গলাটা বুজে এল, বললাম ‘তোমার কি ভূতের ভয় নেই?’
“কবুতরী খিলখিল করে হাসল। এখানে চাপা সুরে কথা বলার দরকার নেই, বলল, ‘মালিক কাছে থাকলে ভূতের ভয় কিসের?’
“এই সময় চোখে পড়ল, কবুতরীর পিছনে ঘরের দরজা আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
“ও কী! ও কী!’ বলে আমি লাফিয়ে বিছানা থেকে নামলাম।
“তারপর— এক বিশ্রী কাণ্ড।
“কবুতরী হঠাৎ চিৎকার করে মাটিতে পড়ে গেল। আমি সম্মোহিত হয়ে দেখছি, সে ওঠবার চেষ্টা করছে, কিন্তু উঠতে পারছে না। প্রাণপণে শুধু চেঁচাচ্ছে। যেন একটা অদৃশ্য মূর্তির সঙ্গে সে ধস্তাধস্তি করছে। তার গায়ের কাপড় আলুথালু হয়ে যাচ্ছে।
“আমি আর থাকতে পারলাম না। এ অবস্থায় কি করা উচিত ছিল জানি না, কিন্তু আমি ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে এলাম। দরজা তখনও পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়নি। পাছে বন্ধ হয়ে যায় এই ভয়েই বোধ হয় পালিয়ে এলাম।
“বাইরে এসে দেখি, একটা লোক ছুটতে ছুটতে এদিকে আসছে। হলধর! কাছেই কোথাও ঘাপটি মেরে ছিল, কবুতরীর চিৎকার শুনতে পেয়েছে। হলধর এখানে কেন, এ প্রশ্ন তখন মনে আসেনি; পরে বুঝেছিলাম, হলধর কবুতরীকে কোৎঘরে পৌঁছে দিতে এসেছিল, তারপর ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য কাছে বসে অপেক্ষা করছিল।
“কী হয়েছে— কী হয়েছে বাবু?’ হলধর হাঁপাতে হাঁপাতে এসে দাঁড়াল। আমি কি বলব, দরজার দিকে শুধু আঙুল দেখিয়ে বললাম, ‘কবুতরী!’
“দরজা তখন বন্ধ হয়ে গেছে। ভেতর থেকে কবুতরীর চিৎকার আর গোঙানির শব্দ আসছে।
“হলধর দরজার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমিও গেলাম। যে দরজা বন্ধ রাখা যেত না, সে দরজা এখন আর খোলা যায় না। দু’জনে ধরে টানতে লাগলাম; অতি কষ্টে একটু একটু করে দরজা খুলল। দেখি লণ্ঠনটা উল্টে গিয়ে দপ্দপ্ করছে। কবুতরী লণ্ঠনের কাছে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছিল। আমরা ঢুকতেই সে যেন ছাড়া পেল। তার চুল এলোমেলো, কাপড় ছিঁড়ে গেছে, পাগলের মতো চেহারা। সে উঠে চিৎকার করতে করতে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল। হলধর তার পিছনে পিছনে ছুটল। আমি কি করব ভাবছি, কানের কাছে সেই অসভ্য বেয়াড়া হাসি শুনতে পেলাম। আমিও ছুটলাম—”
এইসময় ইলেক্ট্রিক বাতি কয়েকবার চিড়িক মারিয়া জ্বলিয়া উঠিল। এতক্ষণ অন্ধকারের পর তীব্র আলোকে বরদার মুখ ফ্যাকাসে দেখাইল। সে আলোর দিকে একবার চোখ তুলিয়া নীরস স্বরে বলিল, “এই গল্প। দু’দিন পরে আমি নীলমহল থেকে চলে এলাম। বেশি দিন থাকতে সাহস হল না। নীলকর সাহেবরা গিয়েও যায়নি; তাদের মনের পাপ প্রেতমূর্তি ধরে এখনও সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কবুতরী সেই যে কোৎঘর থেকে পালিয়েছিল, আর তাকে দেখিনি, সে-রাত্রে সে কী অনুভব করেছিল তা জানা হয়নি। তবে যতটুকু চোখে দেখেছিলাম তা থেকে অনুমান করা শক্ত নয়।” হিরন্ময়বাবুর দিকে চক্ষু ফিরাইয়া বলিল, “অশ্লীল ভূত কেন বলেছিলাম বুঝতে পেরেছেন?”
হিরন্ময়বাবু আমাদের একটি করিয়া সিগারেট দিলেন, নিজে একটি ধরাইলেন। বলিলেন, “খাসা গল্প। শুধু ভূত নয়, রসও আছে। তবে আলো নিবে না গেলে এতটা জমতো কি না বলা যায় না।” বলিয়া হো-হো করিয়া হাসিয়া উঠিলেন।
১৮ আষাঢ় ১৩৬৫