দেখা হবে
ভূপতির স্ত্রী স্মৃতিকণার মৃত্যুকালে আমি তাহার শয্যাপার্শ্বে ছিলাম। কেবল ডাক্তার বলিয়া নয়, ভূপতি আমার বন্ধু।
স্মৃতিকে কঠিন রোগে ধরিয়াছিল। আমি নিজের হাতে চিকিৎসার ভার রাখি নাই, কলিকাতার সব বড় বড় ডাক্তারই তাহাকে দেখিয়াছিলেন; কিন্তু কিছুতেই বাঁচানো গেল না।
মৃত্যুর রাত্রে শয্যাপার্শ্বে কেবল আমি আর ভূপতি ছিলাম। তেতলার প্রকাণ্ড শয়নকক্ষে দুইটি বড় বড় বৈদ্যুতিক গোলক জ্বলিতেছিল। ঘরের মাঝখানে একটি পালঙ্কের উপর শুইয়া স্মৃতি; ভূপতি আর আমি শয্যার দুই পাশে বসিয়া রোগিণীর মুখের পানে চাহিয়া প্রতীক্ষা করিতেছি।
স্মৃতির গলা পর্যন্ত সিল্কের চাদর দিয়া ঢাকা, মুখখানি শুধু খোলা। মুখ দেখিয়া মনে হয় না, গত তিন মাসে নৃশংস রোগ তাহার চব্বিশ বছরের সবল সুস্থ দেহটাকে কুরিয়া কুরিয়া জীর্ণ করিয়া ফেলিয়াছে। টুলটুলে মুখ, মুদ্রিত চোখ দু’টি যেন সুর্মাআঁকা, চুলগুলি মুখখানিকে ঘিরিয়া মণ্ডল রচনা করিয়াছে। দেখিয়া বোঝা যায় না মৃত্যু আসন্ন।
স্মৃতি আজ রাত্রি দশটার পর আচ্ছন্ন হইয়া পড়িয়াছে। জ্ঞান নাই। আমি মাঝে মাঝে নাড়ি দেখিতেছি, নাড়ি ভাল নয়। এই অবস্থাতেই বোধ হয় শেষরাত্রে কোনও সময় তাহার মৃত্যু হইবে। এখন রাত্রি একটা।
শয্যাপার্শ্বে বসিয়া ভাবিতেছিলাম। দশ বৎসরের চিকিৎসা-ব্যবসায়ে অনেক মৃত্যু দেখিয়াছি, কিন্তু আজ মনে হইতেছে স্মৃতির মৃত্যু যেন অন্য মৃত্যু হইতে পৃথক। তাহার কারণ বোধ হয় এই যে, ভূপতি আমার প্রিয়তম বন্ধু, তাহাকে আমি অন্তরে বাহিরে চিনি। সে বড় ব্যবসায়ী, অনেক টাকার মানুষ; কিন্তু মনের মধ্যে সে একেবারে অসহায়। অপরপক্ষে স্মৃতির মতো এমন পরিপূর্ণরূপে সংসারী মেয়ে আমি আর দেখি নাই। সংসারকে সুমধুর করিয়া তুলিবার মন্ত্র সে জানিত। দুইজনে মিলিয়া সুখের নীড় রচনা করিয়াছিল; ভূপতি স্মৃতির হাতে নিজের জীবন তুলিয়া দিয়া নিশ্চিন্ত হইয়াছিল। তাহাদের পাঁচ বছরের বিবাহিত জীবনকে একটি অখণ্ড কাব্য বলা চলে, একদিনের জন্যও ছন্দপতন হয় নাই। তারপর বজ্রাঘাতের মতো এই রোগ। একটা সন্তানও নাই। স্মৃতির মৃত্যুতে পৃথিবীর আর কোনও ক্ষতি হোক না হোক, ভূপতির জীবনটা ছারখার হইয়া যাইবে।
রাত্রি তিনটার সময় স্মৃতি চক্ষু মেলিল। দৃষ্টিতে জড়তা নাই, অস্পষ্টতা নাই; ভূপতির মুখের পানে কিছুক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া সহজ স্বাভাবিক স্বরে কথা বলিল। তাহার এই স্বর অনেকবার শুনিয়াছি, হলফ লইয়া বলিতে পারি তাহাতে বিকারজনিত প্রলাপের চিহ্নমাত্র ছিল না। সে বলিল, “একশিলা নগরীতে আবার দেখা হবে।”
ভূপতি তাহার মুখের উপর ঝুঁকিয়া পড়িয়া ব্যগ্র-বিস্মিত প্রশ্ন করিল, “কী— কী বললে?”
স্মৃতি আর কথা বলিল না, আরও কিছুক্ষণ ভূপতির মুখের পানে চাহিয়া থাকিয়া ধীরে ধীরে চক্ষু মুদিল। আমি তাহার নাড়িতে হাত দিলাম। নাড়ি কয়েকবার ক্ষীণভাবে স্ফুরিত হইয়া থামিয়া গেল।
স্মৃতি মরিয়া গিয়াছে কিন্তু আমার মনে একটা প্রকাণ্ড প্রশ্ন-চিহ্ন রাখিয়া গিয়াছে। একশিলা নগরীতে আবার দেখা হবে। ইহা মৃত্যুকালের উদ্ভ্রান্ত প্রলাপ নয়; মানুষ যেমন রেলের স্টেশনে ট্রেন ছাড়িবার পূর্বে প্রিয়জনকে বলে— অমুক দিন আবার দেখা হবে, এ সেই ধরনের উক্তি। একশিলা নগরী বলিয়া কি কোনও স্থান আছে? কখনও নাম শুনি নাই। আবার দেখা হবে— একথার অর্থ কি? মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে কেহ যদি বলে, আবার দেখা হবে, তবে তাহার কী অর্থ হয়? পরলোক পুনর্জন্ম আমি মানি না। স্মৃতি আধুনিকা ছিল, কিন্তু হয়তো মনে মনে এইসব কুসংস্কার পোষণ করিত; মৃত্যুকালে মনের বাসনা ভবিষ্যদ্বাণীর আকারে দেখা দিয়াছিল। কিন্তু স্মৃতির কণ্ঠস্বরে হৃদয়াবেগের বাষ্পটুকু ছিল না। তাছাড়া— একশিলা নগরীতে কেন? এই অশ্রুতপূর্ব নামটা স্মৃতি কোথা হইতে পাইল।
স্মৃতির মৃত্যুর পর ভূপতির সঙ্গে কয়েক মাস দেখা হয় নাই। তাহার বাড়িতে গিয়া দেখা পাই নাই। স্মৃতির কথা মন হইতে সরাইয়া রাখিবার জন্যই বোধকরি সে ব্যবসায়ে প্রাণ-মন ঢালিয়া দিয়াছিল। বাড়িতে খুব কমই থাকিত, এখানে ওখানে ঘুরিয়া বেড়াইত। একবার শুনিলাম সে প্লেনে বিলাত গিয়াছে।
মাস দুয়েক পরে হঠাৎ একদিন আমার কাছে আসিয়া উপস্থিত। শুষ্ক রুক্ষ চেহারা, রোগা হইয়া গিয়াছে। আমি বলিলাম, “কোথায় ছিলি এতদিন? মড়ার মতো চেহারা হয়েছে, অসুখ-বিসুখ করেনি তো।”
ভূপতি আমার প্রশ্নের জবাব দিল না; আমার স্ত্রীর সহিত কিছুক্ষণ রঙ্গ-রসিকতা করিল, চা ও জলখাবার ফরমাস দিল। স্ত্রী প্রস্থান করিলে আমার পানে কাতরচক্ষে চাহিয়া বলিল, “ভাই, আর তো পেরে উঠছি না, একটা কিছু উপায় কর্।”
“কি উপায় করব? কিছুতেই ভুলতে পারছিস্নে?”
“না। যতদিন সে বেঁচে ছিল ততদিন নিশ্চিন্ত ছিলাম। তার কথা ভাববার দরকার হত না, সে-ই অষ্টপ্রহর আমার ভাবনা ভাবত। এখন— তার চিন্তা অষ্টপ্রহর আমার ঘাড়ে চেপে আছে।”
“এতে চিন্তার কি আছে? একদিন তো ভুলতেই হবে। মনকে শক্ত কর্, মনের রাশ ছেড়ে দিসনে।”
“সে চেষ্টা কি করিনি? কিছুতেই কিছু হল না। —মরবার সময় কী যে একটা কথা বলে গেল— একশিলা নগরীতে দেখা হবে। তুই কিছু মানে বুঝতে পেরেছিস?”
“না। হয়তো বোঝবার মতো মানে কিছু নেই। তুই ও নিয়ে মাথা ঘামাসনি।”
ভূপতি কিয়ৎকাল নীরব থাকিয়া বলিল, “একশিলা নগরী। অনেককে জিজ্ঞেস করেছি, কেউ বলতে পারেনি; কিন্তু আমার বিশ্বাস কোথাও না কোথাও একশিলা নগরী আছে।”
জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “একশিলা নগরীর নাম স্মৃতি আগে কখনও তোর কাছে করেছিল?”
“কখ্খনো না।”
অতঃপর দুইজনে চুপ করিয়া বসিয়া রহিলাম। স্ত্রী আসিয়া চা ও জলখাবার রাখিয়া গেলেন, ভূপতি নীরবে জলযোগ সম্পন্ন করিল। আমি বলিলাম, “ভূপতি, আয় তোর শরীরটা পরীক্ষা করে দেখি। শরীরে রোগ থাকলে মনও অসুস্থ হয়ে পড়ে।”
সে বলিল, “দূর! শরীর আমার দিব্যি আছে।”
বলিলাম, “তবে আবার বিয়ে কর্। স্মৃতিকে তুই কত ভালবাসিস আমি জানি, তাকে ভুলে যেতে বলছি না; কিন্তু এভাবে জীবনটা নষ্ট করে ফেলার কোনও মানে হয় না। আমার কথা শোন, আবার বিয়ে কর্।”
সে বলিল, “তুই পাগল! নিজেকে সামলাবার চেষ্টা কি আমি করিনি। মদ খেয়ে দেখেছি, লোচ্চামি করবার চেষ্টা করেছি; কিন্তু আমার দ্বারা হল না। তোর কথায় একটা মেয়েকে বিয়ে করে কি তার জীবন নষ্ট করে দেব?”
“তবে কি করবি?”
“তা জানি না।” সে উঠিয়া দাঁড়াইল— “আচ্ছা আজ চলি, আবার দেখা হবে।”
দ্বারের দিকে পা বাড়াইয়া সে থামিয়া গেল, তারপর হাসিয়া উঠিয়া বলিল, “এই দ্যাখ, আমিও বলছি আবার দেখা হবে; কিন্তু আমার বলার একটা মানে হয়। স্মৃতি কেন বলল?”
আমি নিরুত্তর রহিলাম। ভূপতি চলিয়া গেল। তারপর তিন মাস আর তাহার দেখা পাইলাম না।
শীতের মাঝামাঝি ভূপতি অকস্মাৎ আবির্ভূত হইল; বলিল, “চল, বেড়াতে যাবি?”
“বেড়াতে! কোথায়?”
“ভারতবর্ষে বেড়াবার জায়গার অভাব! চল কাশ্মীর যাই।”
“এই শীতে কাশ্মীর!”
“তবে রাজপুতানা কিংবা দক্ষিণে যাওয়া যাক। দক্ষিণটা দেখা হয়নি। যাবি? সব খরচ আমার।”
দোনা-মনা করিয়া রাজী হইলাম। ভূপতির যেরূপ চেহারা হইয়াছে, শীতের সময় দেশে বিদেশে বেড়াইলে শরীর সারিতে পারে। মনটা বোধ হয় আস্তে আস্তে সুস্থ হইয়া আসিতেছে, কারণ স্মৃতির উল্লেখ একবারও করিল না। তবু তাহাকে একলা যাইতে দেওয়া উচিত নয়, একলা থাকিলেই তার মন স্মৃতির কাছে ফিরিয়া যাইবে। এদিকে আমার গৃহিণী কিছুকাল যাবৎ বাপের বাড়ি যাইবার জন্য বায়না ধরিয়াছিলেন। শীতের সময় রোগীর সংখ্যাও বেশি নয়। সুতরাং মাসখানেকের জন্য ভ্রমণে বাহির হইবার বিশেষ বাধা নাই।
সাত-আট দিনের মধ্যে গোছগাছ করিয়া দুইজনে বাহির হইয়া পড়িলাম।
রেলের প্রথম শ্রেণীতে ভ্রমণের মতো এমন আরামের ভ্রমণ আর নাই। ইহার কাছে এরোপ্লেন জেটপ্লেন তুচ্ছ।
দক্ষিণে অনেক প্রসিদ্ধ স্থান দেখিলাম— মহীশূর বাঙ্গালোর উটি। প্রত্যেক স্থানে দুই চারি দিন বাস করিতেছি, আবার চলিতেছি। ভূপতির শরীর দ্রুত সারিয়া উঠিতেছে, মনের উপর হইতেও কালো ছায়াটা সরিয়া যাইতেছে। আশা হইতেছে ভ্রমণের শেষে সুস্থ সহজ মানুষটাকে আবার পাওয়া যাইবে।
বেজওয়াডা হইতে কাজিপেটের লাইনে একটা স্টেশনে গাড়ি থামিয়াছে। ভূপতি হঠাৎ নামিয়া পড়িল— “আয়, এখানে যাত্রা ভঙ্গ করা যাক।”
এখানে যাত্রাভঙ্গের কোনও প্রস্তাব ছিল না; কিন্তু ভূপতি পূর্বেও দুই-একবার এরূপ করিয়াছে, অজ্ঞাত অখ্যাত স্থানে নামিয়া পড়িয়াছে। আপত্তি করিলাম না। আমাদের খেয়ালখুশির ভ্রমণ, যেখানে ইচ্ছা নামিয়া পড়িলেই হইল। নেহাত যদি এস্থানে হোটেল বা ধর্মশালা না থাকে তখন রেলের ওয়েটিং রুম আছে।
প্রস্তরফলকে স্টেশনের নাম দেখিলাম— ওরঙ্গল।
শহরটি ছোট, খুব পরিচ্ছন্ন নয়। তবে পাথুরে দেশের শহর পুরনো হইলেও সহজে নোংরা পঙ্কিল হইয়া উঠিতে পায় না। একটি হোটেল আছে, আমরা তাহাতে গিয়া উঠিলাম। হোটেলের দ্বিতল হইতে শহরের পার্বত্য পরিবেশ দেখা যায়। সমস্ত দাক্ষিণাত্য যে একটি বিপুলকায় অধিত্যকা, দক্ষিণে পদার্পণ করা অবধি তাহা ভুলিবার সুযোগ পাই নাই।
আর একটি কথা ভুলিবার উপায় নাই; বাঙালীর সর্বত্র গতি। বাঙালীর ‘কুনো’ বদনাম আছে, কিন্তু দাক্ষিণাত্যের অতি নগণ্য অজ্ঞাতনামা স্থানে গিয়া দেখিয়াছি, দুই-একটি বাঙালী বিরাজ করিতেছে, অপরিচিত কণ্ঠে বাংলা ভাষা শুনিয়া চমকিয়া উঠিয়াছি। কেহ চাকরি করিতে আসিয়াছে, কেহ ব্যবসায় উপলক্ষে। বাঙালীর অগম্য স্থান নাই।
ওরঙ্গলেও তাহার ব্যত্যয় হইল না। কোট-প্যান্টলুন পরা জিরাফের মতো একটি লোক হোটেলে বাস করিতেছিলেন, জানা গেল তিনি বাঙালী। তিনি একজন প্রত্নবিৎ, খুব মিশুক লোক নন। পরে জানিতে পারিয়াছিলাম তিনি অত্যন্ত সন্দিগ্ধ প্রকৃতির লোক পাছে তাঁহার আবিষ্কৃত প্রত্নবিষয়ক তত্ত্ব কেহ চুরি করিয়া নিজের নামে ছাপিয়া দেয় তাই তিনি সহজে কাহারও সহিত কথা বলেন না, বলিলেও অতি সন্তর্পণে বলেন; কিন্তু সে যাক্।
বৈকালে আমরা পদব্রজে বেড়াইতে বাহির হইলাম। দর্শনীয় বিশেষ কিছু নাই, তবু যখন আসিয়াছি তখন ঘুরিয়া ফিরিয়া দেখা উচিত। অবশেষে একটি মন্দিরের নিকট উপস্থিত হইলাম। মন্দিরটি প্রাচীন বলিয়া মনে হয়, গঠন গতানুগতিক নয়। একটি লোককে প্রশ্ন করিয়া জানিতে পারিলাম মন্দিরের নাম সহস্ৰস্তম্ভ মন্দির। অতগুলা না হইলেও অনেকগুলা স্তম্ভ আছে।
জিজ্ঞাসা করিলাম, “কতদিনের পুরনো মন্দির?”
লোকটি বলিল, “পৃথিবী সৃষ্টি হবার আগে থেকে আছে।”
খুবই পুরাতন বলিতে হইবে। ভূপতির দিকে চাহিয়া দেখি, সে স্থাণুর মতো দাঁড়াইয়া মন্দির দেখিতেছে, চোখে বিস্ময়াহত অপলক দৃষ্টি।
বলিলাম, “কী হল?”
সে অস্ফুটস্বরে বলিল, “এ মন্দির আমি আগে দেখেছি।”
“অ্যাঁ! কোথায় দেখলি?”
‘তা জানি না— কিন্তু দেখেছি।”
“বোধ হয় ফটো দেখেছিস।”
“ফটো—! কি জানি—।”
যখন ফিরিয়া চলিলাম তখনও তাহার চোখ তন্দ্রাচ্ছন্ন হইয়া রহিল।
হোটেলে ফিরিয়া চায়ের ঘরে গেলাম। এখানে চা কেহ খায় না, কফির রেওয়াজ। দেখিলাম অদূরে বাঙালী ভদ্রলোকটি নাক সিঁটকাইয়া কফি পান করিতেছেন। আমরা ব্যথার ব্যথী, সহজেই ভাব হইয়া গেল। ভদ্রলোকের নাম সুরেশ পাকড়াশী। আমরা নিজেদের পরিচয় দিলাম। চা ও কফির আপেক্ষিক মহিমা লইয়া কিছুক্ষণ আলোচনা চলিল। তারপর জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনি কতদিন এখানে এসেছেন?”
পাকড়াশী বলিলেন, “তা প্রায় মাসখানেক হতে চলল।”
“কাজে এসেছেন বুঝি?”
“না— হ্যাঁ— না, কাজ এমন কিছু নয়, বেড়াতে এসেছিলাম। শহরটা প্রাচীন— হিন্দু আমলের— আগে নাম ছিল বর্ণকুল, এখন ওরঙ্গলে দাঁড়িয়েছে। ভাবলাম, দেখি যদি কিছু পাওয়া যায়।”
“ও— আপনি প্রত্নবিৎ। কিছু পেলেন?”
ভদ্রলোক হঠাৎ শামুকের মতো অন্তঃপ্রবিষ্ট হইয়া গেলেন। “কিচ্ছু না” বলিয়া সন্দিগ্ধভাবে তাকাইলেন। তাঁদের বাক্যস্রোতে ভাটা পড়িল; দুই চারবার আমার কথায় হুঁ হাঁ করিয়া এক সময় উঠিয়া গেলেন। তাঁহার বিচিত্র ভাবগতিক তখন বুঝিতে পারি নাই।
পরদিন সকালবেলা ঘুম ভাঙিয়া দেখি ভূপতি শয়নঘরের জানালা খুলিয়া একদৃষ্টে বাহিরের দিকে তাকাইয়া আছে। আমিও উঠিয়া গিয়া তাহার পাশে দাঁড়াইলাম। সে বলিল, “দ্যাখ, উটের কুঁজের মতো ঐ পাহাড়টা— ওটা আমি আগে দেখেছি।”
বলিলাম, “আগে দেখেছিস মানে কি? কতদিন আগে?”
সে বলিল, “তা জানি না; কিন্তু— পাহাড়টা আগে আরও বড় ছিল। চেহারা ঠিক আছে, একটু যেন ছোট হয়ে গেছে।”
বলিলাম, “আগে ফটো দেখেছিলি। ছবিটা অবচেতন মনের মধ্যে ছিল, পাহাড় দেখে বেরিয়ে এসেছে। ও রকম হয়।”
ভূপতি কিছু বলিল না, দূরে উটের মতো পাহাড়টার দিকে স্বপ্নাচ্ছন্ন চোখে চাহিয়া রহিল।
তারপর ওরঙ্গলে তিন-চার দিন কাটিয়া গেল। আমার মনটা উসখুস করিতে লাগিল। এখানে দ্রষ্টব্য কিছু নাই, দীর্ঘকাল বসিয়া থাকার কোনও অর্থ হয় না; কিন্তু ভূপতির কী হইয়াছে জানি না, সে মোহাক্রান্ত ভাবে এখানে ওখানে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, তাহাকে এখান হইতে গা তুলিবার কথা বলিলে শুনিতে পায় না। তাহার মনের মধ্যে রহস্যময় একটা কিছু ঘটিতেছে। আমি সবিশেষ নির্ণয় করিতে না পারিয়া উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিলাম।
ইতিমধ্যে পাকড়াশী মহাশয়ের সঙ্গে আর একটু ঘনিষ্ঠতা হইয়াছে। তিনি যদিও আমাদের এড়াইয়া চলিতেন, তবু মাঝে মাঝে বাংলা ভাষায় কথা বলিবার লোভ সংবরণ করিতে পারিতেন না। আমরাও প্রত্নতত্ত্ব সম্বন্ধে তাঁহার দুর্বলতা বুঝিয়াছিলাম, তাই ও প্রসঙ্গ যথাসাধ্য বাদ দিয়া কথা বলিতাম।
আরও কয়েকদিন নিষ্ক্রিয়ভাবে কাটিয়া যাইবার পর আমি মরীয়া হইয়া উঠিলাম, বলিলাম, “ওরঙ্গলে কি মধু পেলি তুই জানি না, কিন্তু আমি আর থাকছি না। একমাস হয়ে গেছে, আমাকে এবার ফিরতেই হবে।”
সমস্তদিন ঝুলোঝুলির পর রাত্রিকালে তাহাকে রাজী করিলাম, পরদিন বিকালের গাড়িতে দুইজন যাত্রা করিব। সে বলিল, “ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না, কিন্তু তোর যখন এত তাড়া— চল। আমি কিন্তু আবার আসব।”
পরদিন সকালবেলা চাকর ঘরে চা দিয়া গেল, দুইজনে একত্র বসিয়া পান করিলাম। প্রাতরাশ শেষ করিয়া ভূপতি ইজি-চেয়ার জানালার কাছে টানিয়া লইয়া বসিল। আমি বলিলাম, “চল না স্টেশনে খবর নিয়ে আসি, রিজার্ভেশন পাওয়া যাবে কিনা।”
সে বলিল, “তুই যা, আমার যেতে ইচ্ছে করছে না।”
আমি বাহির হইলাম। জীবিতাবস্থায় ভূপতির সঙ্গে এই শেষ দেখা। ঘণ্টাখানেক পরে ফিরিয়া আসিলাম, তখনও সে সেই চেয়ারে বসিয়া আছে, মাথাটা পিছন দিকে হেলান দেওয়া। চোখ দুটো বিস্ফারিত হইয়া খুলিয়া আছে। চোখে এবং মুখে কী অনির্বচনীয় বিস্ময়ানন্দ তাহা বর্ণনা করা যায় না। যেন প্রিয়জনকে বহুদিন পরে দেখার শুভ মুহূর্তে তাহার মৃত্যু হইয়াছে।
আমার মানসিক অবস্থার কথা বলিব না।
ভূপতির অন্ত্যেষ্টি করিলাম। আমি বোধ হয় তাহার সবচেয়ে নিকট আত্মীয়, কারণ আমার হাতের আগুন তাহার দেহটা ছাই করিয়া দিল। কাহাকেও খবর দিতে পারি নাই, ঘনিষ্ঠ আপনার জন তাহার নাই, শুনিয়াছি এক ভাগিনা উত্তরাধিকারী; কিন্তু ভাগিনার ঠিকানা জানি না।
দেশে ফিরিয়া চলিয়াছি। সঙ্গে চলিয়াছেন পাকড়াশী মহাশয়। বিপদের সময় তিনি দূরত্ব রাখেন নাই, বুক দিয়া পড়িয়া সাহায্য করিয়াছেন। তারপর একসঙ্গে ফিরিতেছি।
ভূপতির মৃত্যু সম্বন্ধে একটা গভীর রহস্য মনকে আচ্ছন্ন করিয়া রাখিয়াছে। আমি ডাক্তার, আমি জানি তাহার দেহে এমন কোনও রোগ ছিল না যাহাতে সে হঠাৎ মরিয়া যাইতে পারে। তবে এ কী হইল? স্মৃতির কথা বারবার মনে পড়িতে লাগিল। সে বলিয়াছিল— একশিলা নগরীতে দেখা হবে; কিন্তু—
পাকড়াশী মহাশয় একথা সেকথা বলিয়া আমার মন ভুলাইবার চেষ্টা করিতেছেন। তিনি ভাবিয়াছেন আমি শোকে অভিভূত হইয়া পড়িয়াছি।
হঠাৎ একসময় তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “সুরেশবাবু, আপনি পণ্ডিত মানুষ, একশিলা নগরী কোথায় জানেন?”
তিনি হাসিয়া বলিলেন, “জানি বৈকি। ওরঙ্গলের প্রাচীন নাম একশিলা।”
‘অ্যাঁ— তবে যে সেদিন বলেছিলেন বর্ণকুল!”
“বর্ণকুলও একটা নাম। আর একটা নাম একশিলা। কেন বলুন দেখি?”
কিছুক্ষণ হতবুদ্ধি হইয়া রহিলাম, তারপর স্মৃতির মৃত্যুকালীন কাহিনী বলিলাম। এবার পাকড়াশী মহাশয় বিস্মিত হইলেন, বলিলেন, “তাই নাকি! ভারি আশ্চর্য তো! ইতিহাসে পড়েছি দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডারের জীবনে এই রকম একটা ব্যাপার ঘটেছিল। কালানল নামে এক ভারতীয় সাধু—”
তিনি সোৎসাহে বলিয়া চলিলেন, কিন্তু সব কথা আমার কানে পৌঁছিল না। আমি ভাবিতে লাগিলাম— মৃত্যুকালে কি মানুষ ভূত-ভবিষ্যৎ দেখিতে পায়? স্মৃতি অনাগত ভবিষ্যৎ দেখিতে পাইয়াছিল? ওরঙ্গলে ভূপতির মৃত্যু হইবে তাহা জানিতে পারিয়াছিল? আবার ওরঙ্গলের প্রাচীন নাম একশিলা তাহাও সে জানিয়াছিল? অতীত এবং ভবিষ্যৎ দুই দিকেই তাহার মুমূর্ষু প্রাণ প্রসারিত হইয়াছিল? ভূপতির চোখে ওরঙ্গল চেনা চেনা ঠেকিয়াছিল। তবে কি কোনও সুদূর অতীতে ভূপতি ও স্মৃতি একশিলা নগরীর নাগরিক নাগরিকা ছিল?
বুঝি না— কিছু বুঝি না। অগাধ অন্ধকারের মধ্যে খদ্যোতকণার মতো বুদ্ধি-দীপ জ্বালিয়া কেবল বুঝিবার চেষ্টা করিতেছি।
৭ ফাল্গুন ১৩৬১