পিছু পিছু চলে
সত্যবান গজাধর সিন্ধে বললেন, ‘আপনি কখনো ভূত দেখেছেন?’
চুপ করে রইলাম। যারা ভূত দেখেছে তারা অন্যকে ভূত দেখাতে পারে না, সুতরাং নাস্তিকদের কাছে হাস্যাস্পদ হয়। আজকাল নাস্তিকদের যুগ চলেছে, অতএব সাবধানে থাকা ভাল।
সত্যবান সিন্ধে পুণায় আমার প্রতিবেশী, আমার সমবয়সী। এককালে সুপুরুষ ছিলেন, এখন জীর্ণ শীর্ণ চেহারা। আমার সঙ্গে বেশি ঘনিষ্ঠতা ছিল না, কিন্তু এক পাড়ায় থাকতে গেলে হাসি কথা শিষ্টতার বিনিময় করতে হয়। তিনি কোন এক বীমা কোম্পানিতে চাকরি করতেন, বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত।
গত পৌষমাসে হপ্তাখানেক দারুণ শীত পড়েছিল। একদিন সন্ধ্যের পর আমি দোর-জানলা বন্ধ করে একখানা বই নিয়ে বসেছি, এমন সময় দোরের ঘণ্টি বেজে উঠল। দোর খুলে দেখি, সত্যবান সিন্ধে। তাঁর মাথায় পাগড়ির মতো স্কার্ফ জড়ানো, গায়ে আলোয়ান, তবু ভদ্রলোক শীতে কাঁপছেন। একটু আশ্চর্য হলাম, কিন্তু আপ্যায়ন করে এনে বসালাম, ‘আসুন, এবার বেজায় শীত পড়েছে।’
তিনি দন্তবাদ্য থামিয়ে এদিক-ওদিক চাইলেন, তারপর প্রশ্ন করে বসলেন, ‘আপনি কখনো ভূত দেখেছেন?’
আমাকে নিরুত্তর দেখে তিনি বললেন, ‘আমি বড় বিপদে পড়েছি। আপনি ভূতের গল্প-টল্প লেখেন শুনেছি, তাই ভাবলাম—’
চাকরকে কফি তৈরি করবার হুকুম দিয়ে বললাম, ‘কি ব্যাপার বলুন দেখি, আপনি ভূত দেখেছেন নাকি?’
তিনি অনেকক্ষণ চোখ বড় করে বসে রইলেন, তারপর বললেন, ‘ভূত কিনা ঠিক বুঝতে পারছি না। আপনি কি ভূত দেখেননি?’
বললাম, ‘চোখে দেখেনি, কিন্তু অন্য ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করেছি।’
‘সে কি রকম?’
‘গন্ধ পেয়েছি, শব্দ শুনেছি, এমন কি স্পর্শ পর্যন্ত পেয়েছি।’
সত্যবান সিন্ধে গুম হয়ে গেলেন। তাঁর চোখে অজানিতের আতঙ্ক দুঃস্বপ্নের মতো জেগে রইল।
চাকর কফি দিয়ে গেল। জিভ-পোড়ানো গরম কফি সত্যবান সিন্ধে এক চুমুকে খেয়ে ফেললেন, তারপর আলোয়ানটা গাঢ়ভাবে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে বললেন, ‘তবে আপনাকে আমার গল্পটা বলি, আপনি হয়তো বিশ্বাস করবেন।’
একটু দম নিয়ে তিনি বলতে আরম্ভ করলেন, ‘গত মে মাসে একদিন সন্ধ্যের সময় আমি টিলক রোডের একটা রসবন্তী দোকানে বসে আখের রস খাচ্ছিলাম। আপনি তো জানেন গরম কালে এখানে খোলা জায়গায় বাখারির বেড়া দিয়ে ঘিরে আখ মাড়াইয়ের যন্তর বসায়। আমি একটা বেঞ্চিতে বসে রস খাচ্ছি, এমন সময় নজর পড়ল, বেড়ার ফটকের কাছে দাঁড়িয়ে একটা লোক একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
‘বুড়ো লোক, দীন-দরিদ্র বেশ। মাথায় ঝাঁকড়া চুল, মুখে ছাবকা ছাবকা দাড়ি-গোঁফ, চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। প্রথমটা চিনতে পারিনি, তারপর—’
তিনি আবার চুপ করলেন। মুখ দেখে মনে হল তার মনের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব চলছে। বললাম, ‘তাহলে চেনা লোক?’
সিন্ধে কুণ্ঠিত ভাবে বললেন, ‘হ্যাঁ। ত্রিশ বছর আগে যখন নাগপুরে ছিলাম তখন অনন্তা বিষ্ণু মারাঠেকে চিনতাম। স্কুলে মাস্টারি করত।’
বললাম, ‘তাহলে অনন্তা বিষ্ণু মারাঠে আপনার বন্ধু!’
তিনি চমকে উঠে বললেন, ‘না, না, বন্ধু নয়। তবে নাগপুরে এক পাড়ায় থাকতাম, যাওয়া আসা ছিল—’ তারপর যে কথাটা চাপবার চেষ্টা করছিলেন তা বেরিয়ে এল, ‘অনন্তার বৌ সুমন্তা ছিল অপরূপ সুন্দরী, আমি— আমি তাকে নিয়ে— সে আমার সঙ্গে ইলোপ করেছিল।’
যৌবনকালে সত্যবান সিন্ধে দেখছি গুণবান ব্যক্তি ছিলেন। এখন বিষ হারিয়ে ঢোঁড়া হয়েছেন। কিন্তু আমাকে এসব কথা বলছেন কেন? আমি বিদেশী, তাই?
বললাম, ‘তারপর বলুন।’
সত্যবান বললেন, ‘সুমন্তাকে নিয়ে নাগপুর থেকে নাসিকে পালিয়ে এসেছিলাম, সেখান থেকে বোম্বে। সুমন্তা কিন্তু বেশিদিন আমার কাছে রইল না, আর একজনের সঙ্গে আমাকে ছেড়ে গেল। আর তাকে দেখিনি।
‘তারপর আমি কাজের সূত্রে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি; আমেদনগর, শোলাপুর, ঔরঙ্গাবাদ; শেষে কাজে অবসর নিয়ে পুণায় এসে বসেছি।’
প্রশ্ন করলাম, ‘এই ত্রিশ বছরের মধ্যে অনন্তা মারাঠের সঙ্গে আর দেখা হয়নি?’
তিনি বললেন, ‘না, এই প্রথম। তাকে যখন চিনতে পারলাম, তখন ভয় হল। অনন্তা মারাঠে স্কুলের মাস্টার ছিল বটে, কিন্তু ভারি একরোখা লোক ছিল।
‘রসবন্তীতে বসে রস খেতে খেতে আড়চোখে তার দিকে তাকাতে লাগলাম। সে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আস্তে আস্তে চলে গেল।
‘আর এক গেলাস রস খেলাম। বাইরে বেশ ঘোর ঘোর হয়ে এল, তখন বাইরে এসে এদিক-ওদিক তাকালাম। রাস্তায় তখন মোটর, অটো-রিক্সা, মানুষের ভিড়; অনন্তা মারাঠেকে দেখতে পেলাম না।
‘তবু বাড়ির দিকে আসতে আসতে মাঝে মাঝে পিছু ফিরে চাইছি। কিছু দূর এসে দেখলাম অনন্তা মারাঠে আমার পিছু নিয়েছে; খুব কাছে আসেনি, লোকের ভিড়ের সঙ্গে মিশে আমাকে অনুসরণ করছে। অনন্তার মতলব বুঝলাম; সে আমার বাড়ির ঠিকানা জানতে চায়। বাড়িতে এসে হাঙ্গামা বাধাবে। বাড়িতে আমার বৌ আছে, ছেলেমেয়ে আছে—
‘রাস্তা দিয়ে একটা খালি অটো-রিক্সা যাচ্ছিল, টপ্ করে তাতে উঠে পড়লাম। চলে গেলাম একেবারে শম্ভাজি পার্ক। সেখানে একটা বেঞ্চিতে অন্ধকারে বসে রইলাম। তারপর ঘণ্টাখানেক পরে বাড়ি ফিরে এলাম। অনন্তাকে আর দেখতে পেলাম না।
‘অনন্তা মারাঠে বোধ হয় কোনো কাজে নাগপুর থেকে পুণায় এসেছিল, তারপর হঠাৎ রসবন্তীতে আমাকে দেখতে পায়। ত্রিশ বছরে আমার চেহারা অনেক বদলে গেছে, তবু সে আমাকে চিনতে পেরেছিল। লোকটা ভয়ঙ্কর রাগী আর প্রতিহিংসাপরায়ণ।’
বললাম, ‘বৌ নিয়ে পালালে রাগ হবারই কথা।’
সিন্ধে বললেন, ‘দেখুন, আমার দোষ ছিল সন্দেহ নেই, কিন্তু দোষ আমার একার নয়। অনন্তার বৌটা ছিল— যাকে জ্যোতিষ শাস্ত্রে বলে— প্রবিকীর্ণকামা বিকীর্ণমন্মথা পুংশ্চলী।’
‘আপনি জ্যোতিষ শাস্ত্র জানেন নাকি?’
‘জানি। আপনার কোষ্ঠী আছে? একদিন দেখব। যা হোক, তারপর তিন দিন আর বাড়ি থেকে বেরুলাম না, ভাবলাম দু-তিন দিনের মধ্যেই অনন্তা কাজ সেরে নাগপুরে ফিরে যাবে।
‘প্রথম যেদিন বেরুলাম সেদিন অনন্তাকে দেখতে পেলাম না। তার পরদিন লছমী রোডে গিয়েছি কিছু কেনাকাটার জন্যে, দেখি অনন্তা আমার পিছু নিয়েছে। তার হাতে একটা মোটা লাঠি। ভয় পেয়ে গেলাম, কি করি! একটা সাত নম্বর বাস রাস্তার ধারে এসে দাঁড়িয়েছিল, টুক্ করে তাতে উঠে পড়লাম। ভাগ্যক্রমে অনন্তা ওঠবার আগেই বাস ছেড়ে দিল।
‘সাত নম্বর বাস পুণা স্টেশনে যায়, আমি স্টেশনে নেমে শিবাজিনগরের টিকিট কিনে একটা লোকাল ট্রেনে উঠে বসলাম; পাঁচ মিনিট পরে শিবাজিনগর স্টেশনে নেমে অটো-রিক্সা চড়ে বাড়ি ফিরে এলাম। অনন্তা আমাকে ধরতে পারল না।
‘এরপর সাত দিন বাড়ি থেকে বেরুলাম না। কিন্তু বুড়ো বয়সে প্রত্যহ একটু ঘোরাফেরা দরকার, নইলে শরীর খারাপ হয়ে যায়। আমি ভোর চারটের সময় বেড়াতে বেরুতে আরম্ভ করলাম। সূর্যোদয়ের আগেই ফিরে আসি। অনন্তার দেখা নেই।
‘কিন্তু শুধু প্রাতঃভ্রমণ করলেই তো চলে না; আমি গেরস্ত মানুষ, বাজার-হাটও করতে হয়। সাতদিন পরে বিকেলবেলা গুটি গুটি বেরুলাম। অনন্তার দেখা পেলাম না। ভাবলাম, যাক্, অনন্তা নাগপুরে ফিরে গেছে।
‘তারপর গ্রীষ্ম গিয়ে বর্ষা এল—’
আমি বাধা দিয়ে বললাম, ‘একটা কথা বলুন। এটা ভূতের গল্প বলছেন, না মানুষের গল্প?’
সত্যবান বললেন, ‘তা আমি নিজেই জানি না। শেষ পর্যন্ত শুনে আপনি বলুন।’
তিনি আবার আরম্ভ করলেন, ‘বর্ষাও শেষ হয়ে এল। আমি বেশ নিশ্চিন্ত হয়েছি। পুণার বৃষ্টি বোম্বের মতো নয়, ঝিরঝিরে বৃষ্টি; কদাচিৎ তোড়ে পাউস্ নামে। একদিন আমি ছাতা নিয়ে মণ্ডাই গেছি শাক-সবজি কিনতে, হঠাৎ তোড়ে বৃষ্টি নামল। ছাতায় সে-বৃষ্টি সামলায় না, আমি বাড়ি ফেরার পথে আটকা পড়ে গেলাম। একটা দোকানের ওল্তলায় কয়েকজন লোক দাঁড়িয়েছিল, আমিও গিয়ে দাঁড়ালাম।
‘তারপর— সেই আকাশ-ভাঙা বৃষ্টির মাঝখানে অনন্তার সঙ্গে মুখোমুখি দেখা। অনন্তাও সেখানে দাঁড়িয়েছিল। অবশ্য ভয়ের বিশেষ কারণ ছিল না, এতগুলো লোকের মাঝখানে অনন্তা নিশ্চয় আমাকে খুন করত না। কিন্তু তার চোখের চাউনি দেখে আমি ভয়ে দিশাহারা হয়ে গেলাম। সে আমার দিকে তাকিয়ে গলার মধ্যে গোঁ গোঁ শব্দ করছে।
‘রাস্তার দিকে চেয়ে দেখলাম, বৃষ্টি ভেদ করে দুটো ট্রাক রাস্তার দু’দিক থেকে দৈত্যের মতো ছুটে আসছে। এই সুযোগ! ট্রাক দুটো এসে পড়বার আগেই আমি যদি রাস্তা পার হয়ে যেতে পারি, তাহলে অনন্তা অন্তত কিছুক্ষণের জন্যে আমার পিছু নিতে পারবে না। সেই ফাঁকে আমি পালাব।
‘রাস্তার ওপর দিয়ে জলের স্রোত বয়ে যাচ্ছে, তবু নেমে পড়লাম; ট্রাক দুটো এসে পড়েছে, আমি চট্ করে রাস্তা পার হয়ে গেলাম। তারপরই শুনতে পেলাম, ট্রাকের ব্রেক কষার কড়্ কড়্ শব্দ। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি, মাঝখানে রক্তারক্তি কাণ্ড।
‘দুটো ট্রাকই দাঁড়িয়ে পড়েছে, আর তাদের মাঝখানে অনন্তার রক্তাক্ত দেহটা পড়ে আছে। তার একটা হাত ট্রাকের চাকার নীচে বিচ্ছিন্ন হয়ে ছিটকে পড়েছে, চারদিকে রক্ত-মাখা জলের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। অনন্তা নিশ্চয় আমাকে অনুসরণ করেছিল, তারপর দুটো ট্রাক দু’দিক থেকে এসে তাকে থেঁতলে দিয়েছে। ডান হাতটা বোধ হয় চাকার নীচে পড়েছিল, কনুই থেকে কেটে আলাদা হয়ে গেছে।
‘চারদিক থেকে লোকজন হৈ-হৈ করে ছুটে এল। আমি আর সেখানে দাঁড়ালাম না।
‘এ-রকম একটা বীভৎস দৃশ্য চোখে দেখলে মানুষের প্রাণে আঘাত লাগে। আমার কিন্তু দুঃখ হল না। মনে হল, অনন্তা মরেছে আমার হাড় জুড়িয়েছে, আমি মুক্তি পেয়েছি।
‘মাসখানেক ভারি আনন্দে কেটে গেল। বর্ষা গিয়ে শীত এল। আমি শীতকালে পাহাড়ের মাথায় পার্বতী মন্দিরে উঠি। আগে রোজ উঠতাম, আজকাল হপ্তায় একদিন উঠি। তার বেশি পেরে উঠি না। রোজ দেড়শো সিঁড়ি ভেঙে ওপরে ওঠার আর শক্তি নেই।
একদিন সন্ধ্যের সময় পার্বতী মন্দিরের পাহাড়ে উঠেছি। এই শিখরটা পেশোয়াদের আমলে দুর্গ ছিল, এখনো তার চৌদ্দ হাত চওড়া প্রাকার ভাঙা অবস্থায় পড়ে আছে। আমি গিয়ে পশ্চিম দিকের প্রাকারের কিনারায় পা ঝুলিয়ে বসলাম। ঠিক পায়ের তলায় পার্বতী পাহাড়ের গা প্রায় খাড়া নীচে নেমে গেছে। সূর্যাস্তের পর আকাশে রঙের খেলা আরম্ভ হয়েছে। আমি সেই দিকে তাকিয়ে বসে রইলাম।
‘হঠাৎ মনে হল, আমার পাশে কে বসে আছে। ঘাড় ফিরিয়ে দেখি— অনন্তা! তার একটা হাত কনুই থেকে কাটা, সে আমার দু’হাত দূরে বসে কট্মট্ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
‘ভয়ে আমার দিগ্বিদিক জ্ঞান রইল না। তারপর কি করে যে পার্বতী পাহাড় থেকে নেমে এসেছিলাম, তা আমি নিজেই জানি না। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে পিছু ফিরে দেখবার সাহস হয়নি, কিন্তু মনে হয়েছে অনন্তা পিছনে তেড়ে আসছে, এখনি ঘাড়ে লাফিয়ে পড়বে। পার্বতী পাহাড় থেকে নেমে আমি এক ছুটে নিজের বাড়িতে ঢুকে পড়লাম।
‘সে আজ দশ-বারো দিন আগের কথা।
‘তারপর থেকে সন্ধ্যের পর যখনি বাড়ি থেকে বেরিয়েছি, হাতকাটা অনন্তা আমার পিছু নিয়েছে; বেশি কাছে আসে না, আট-দশ হাত দূর থেকে আমার অনুসরণ করে। কিন্তু দিনের বেলা তাকে দেখতে পাই না।
‘তাই সন্ধ্যের পর আর বাড়ির বাইরে থাকি না।
‘আজ এক বন্ধুর বাড়িতে সত্যনারায়ণ পূজা ছিল। সন্ধ্যের আগেই সেখানে গিয়েছিলাম; ভেবেছিলাম তাড়াতাড়ি ফিরে আসব, কিন্তু পাল্লায় পড়ে দেরি হয়ে গেল। সেখান থেকে বেরিয়ে বেশ জোরে জোরে পা চালিয়ে দিলাম।
‘আপনার এদিকটা রাত্রিবেলা বেশ নির্জন, কিন্তু এদিক দিয়ে এলে শিগ্গির হয়। তাই এই পথেই এলাম। বেশি দূরে আসতে হল না, দেখি অনন্তা নিঃশব্দে আমার পিছু নিয়েছে। অন্ধকারে অস্পষ্ট ছায়ার মতো মূর্তি। প্রথমটা দূরে দূরে, তারপর ক্রমশ কাছে আসছে।
‘উঠি-পড়ি করে ছুটে চলেছি। বুকের রক্ত শুকিয়ে গিয়েছে; যদি হোঁচট খেয়ে পড়ি আর উঠতে হবে না, হার্টফেল করে মরে যাব। পা দুটো অবশ হয়ে আসছে।
‘আপনার বাড়ির সামনে যখন এলাম, তখন অনন্তা প্রায় আমার ঘাড়ের কাছে এসে পড়েছে। দেখলাম, আপনার সদরে আলো জ্বলছে। আর দ্বিধা করলাম না, এখানেই ঢুকে পড়লাম। নিজের বাড়ি পর্যন্ত যাবার সাহস হল না।
সত্যবান সিন্ধে চুপ করলেন। আমিও খানিক চুপ করে রইলাম; শেষে বললাম, ‘দেখুন, যে অনন্তা ট্রাক চাপা পড়েছিল সে জ্যান্ত মানুষ, কারণ প্রেত গাড়ি চাপা পড়েছে এমন কখনো শোনা যায়নি।’
সত্যবান বললেন, ‘কিন্তু তার পরে?’
‘তার পরে বলা শক্ত। প্রেতও হতে পারে, মানুষও হতে পারে। ভেবে দেখুন, অনন্তার হাত কাটা গিয়েছিল বটে, কিন্তু তার প্রাণটা হয়তো শেষ পর্যন্ত বেঁচে গিয়েছিল।’
‘কিন্তু আমি যে খবরের কাগজে মৃত্যু-সংবাদ পড়েছি। যেদিন দুর্ঘটনা হয়, তার পরদিন ‘সকালে’ বেরিয়েছিল। লিখেছিল, অনন্তা ঘটনাস্থল থেকে হাসপাতাল পৌঁছুবার আগেই মরে গিয়েছিল।’
‘তাই নাকি! তাহলে—’
‘তাছাড়া, বিবেচনা করুন, আমি সেদিন পার্বতী পাহাড়ে ভাঙা পাঁচিলের কিনারায় বসেছিলাম, অনন্তা যদি মানুষ হত তাহলে সে পিছন দিক থেকে আমাকে ঠেলে খাদে ফেলে দিত, আমি মরে যেতাম। ও যে আমার পিছনে লেগেছে, ওর উদ্দেশ্য আমার মৃত্যু ঘটান। জ্যান্ত অবস্থায় আমাকে মারতে পারেনি, এখন ভূত হয়ে মারবে!— আপনি বলুন, এখন উপায় কী! কেমন করে অনন্তার হাত থেকে উদ্ধার পাব।’
ভূতের হাত থেকে উদ্ধার পাবার উপায় জানা নেই। চাল-পড়া সর্ষে-পড়া আজকাল আর চলে না। অনেক ভেবে বললাম, ‘এ-দেশে পিণ্ডদানের কোনো ব্যবস্থা আছে?’
সত্যবান একটু নিরাশভাবে বললেন, ‘আছে। পেন্ঢারপুরে পিণ্ডি দেওয়া যায়, আরো দু’একটা জায়গা আছে। কিন্তু অত দূরে যাওয়া কি সম্ভব? অনন্তা আমার পিছু নেবে।’
‘তা বটে।’
দু’জনে মুখোমুখি বসে উপায় চিন্তা করতে লাগলাম, বাঘের হাত ছাড়ানো যায়, জঙ্গলে না গেলেই হল; কুমিরকে এড়িয়ে চলা যায়, নদীতে না নামলেই হল। কিন্তু অশরীরীর হাত থেকে নিস্তার নেই। এই সব ভাবছি বটে, কিন্তু মনের সংশয় যাচ্ছে না। সত্যি ভূত বটে তো? ভয় পেলে মানুষ ঝোপে ঝোপে বাঘ দেখে—
হঠাৎ বৈদ্যুতিক আলোটা মিট্মিট্ করে চোখ টিপল। এই রে, এবার বুঝি আলো নিভবে! পুণায় এমন প্রায়ই হয়, হঠাৎ অকারণে আলো নিভে যায়, তারপর কখনো পাঁচ মিনিট কখনো দু’-ঘণ্টা অন্ধকারে বসে থাকো।
আলো কিন্তু নিভল না, দু’চার বার মিট্মিট্ করে স্থির হল। কিছুক্ষণ পরে সদর দরজার ঘণ্টি ক্ষীণভাবে একবার বেজে উঠেই থেমে গেল।
এত রাত্রে আবার কে এল! উঠে গিয়ে সদর দরজা খুললাম। সদর দরজার মাথায় আলো আছে; দেখলাম, একজন লোক দোরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ধোপার পাটে আছড়ালে যেমন দেখতে হয় সেই রকম চেহারা। তার ডান হাতটা কনুই থেকে কাটা।
লোকটা ঝাঁকড়া ভুরুর তলা থেকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার হৃদ্যন্ত্রটা ধড়ফড় করে উঠল।
তারপর আলো নিভে গেল। আমি হাঁপিয়ে উঠে বললাম, ‘কে?’ কিন্তু সাড়া পেলাম না।
দু’মিনিট পরে আবার আলো জ্বলে উঠল। দেখলাম, কেউ নেই— লোকটা চলে গেছে।
সে-রাত্রে সত্যবান সিন্ধেকে টর্চ হাতে নিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এসেছিলাম।
এই কাহিনী লেখা শেষ করবার পর আজ খবর পেলাম, সত্যবান সিন্ধে পেন্ঢারপুর যাচ্ছিলেন, পথে হার্টফেল করে মারা গেছেন।
১৯ জুন ১৯৬৫